What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গৌরীপুর জংশন - উপন্যাস (2 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
329
Messages
6,256
Credits
48,364
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গৌরীপুর জংশন
[FA]pen[/FA] লেখক: হুমায়ুন আহমেদ​

০১.
মনে হচ্ছে কানের কাছে কেউ শিস দিচ্ছে।

শিসের শব্দে জয়নালের ঘুম ভেঙে গেল।

সে মনে-মনে বলল, বিষয় কি? কোন হালার পুতে… মনে-মনে বলা কথাও সে শেষ করল না। মনের কথা দীর্ঘ হলে ঘুম চটে যেতে পারে। ইদানীং তার কী যেন হয়েছে, একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না।

জয়নাল তার হাত পা আরো গুটিয়ে নিল। তবু শীত যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে শুয়ে আছে বড় একটা বরফের চ্যাঙের উপর। অথচ সে শুয়ে আছে কাপড়ের একটা বস্তার উপর। কম্বলটাও দুভাজ করে গায়ের উপর দেয়া। মাথা কম্বলে ঢাকা কাজেই যে উষ্ণ নিঃশ্বাস সে ফেলছে, সেই উষ্ণ নিঃশ্বাসও কম্বলের ভিতরই আটকা পড়ে থাকার কথা। তবু এত শীত লাগছে কেন? শীতের চেয়েও বিরক্তিকর হচ্ছে কানের কাছে শিসের শব্দ। বিষয়টা কি? কম্বল থেকে মাথা বের করে একবার কি দেখবে? কাজটা কি ঠিক হবে? কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করার অর্থই হচ্ছে এক ঝলক বরফ শীতল হাওয়া কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়া। এ ছাড়াও বিপদ আছে, মাথা বের করলেই এমন কিছু হয়তো সে দেখবে যাতে মনটা হবে খারাপ। বজলু নামের আট-ন বছরের ছেলে কদিন ধরেই ইস্টিশনে ঘুরঘুর করছে। শীতের কোনো কাপড়, এমন কি একটা সুতির চাদর পর্যন্ত নেই। সন্ধ্যার পর থেকে ঐ ছেলে শীতের কাপড় আছে এমন সব মানুষের সঙ্গে ঘুরঘুর করে। দেখে অবশ্যই মায়া লাগে। কিন্তু মায়াতে তো আর সংসার চলে না। মায়ার উপর সংসার চললে তো কাজই হত। এই যে সে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে, এই কম্বলও যে-কেউ ফস করে টান দিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এখনও যে নেয় নি এটাই আল্লাহ্‌র অসীম দয়া।।

আবার শিস দেয়ার শব্দ হচ্ছে। বিষয়টা কি? নিতান্ত অনিচ্ছায় জয়নাৰ্ল কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করল। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। স্টেশনের আলো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। মালঘরে রাখা প্রতিটি কাপড়ের কস্তার ওপর একজন দুজন করে শুয়ে আছে। এই কস্তাগুলো থাকায় রক্ষা হয়েছে। মেঝেতে ঘুমুতে হলে সৰ্বনাশ হয়ে যেত।।

জয়নাল চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগল। যা ভেবেছিল তাই—বজলু পায়ের কাছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার গায়ে চটের একটা বস্তা। শীতের সময় চটের বস্তাটা খারাপ না। ভেতরে ঢুকে মুখ বন্ধ করে দিলে বেশ ওম হয়। অল্প বয়স্কদের এর চে ভালো শীতবস্ত্ৰ আর কিছুই হয় না। বড় মানুষের জন্যে অসুবিধা। বস্তার ভেতরে পুরো শরীর ঢেকে না।

শিসের রহস্য এখন বের হল। ঐ হারামজাদা বজলু শিসের মতো শব্দ করছে। কোনো অসুখ বিসুখ না-কি? জয়নাল কড়া গলায় ডাকল, এ্যাই-এ্যাই। প্রচণ্ড শীতে ঘুম কখনো গাঢ় হয় না। বজলু সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তার ভেতর থেকে মাথা বের করে বলল, জ্বি।

লাথি দিয়া ভোতা কইরা ফেলবাম। হারামজাদা শব্দ করস ক্যান?

বজলু কিছুই বুঝতে পারছে না। চোখ বড়-বড় করে তাকাচ্ছে।

শব্দ হয় ক্যান?

কি শব্দ?

সত্যি-সত্যি কি একটা লাথি বসাবে? বসানোনা উচিত। এই তারামজাদা সারাক্ষণ তার পেছনে-পেছনে ঘুরঘুর করে। এইভাবে ঘুরঘুর করলে এক সময় মায়া পড়ে যায়। গরিব মানুষের জন্যে মায়া খুব খারাপ জিনিস। জয়নাল খেকিয়ে উঠল, এই হারামজাদা নাম।

জ্বি।

কথায়-কথায় ভদ্রলোকের মত বলে জ্বি। টান দিয়া কান ছিইড়া ফেলমু। ছোড লোকের বাচ্চা। তুই নাম।

বিস্মিত বজলু উঠে বসল।

নাম। তুই নাম কইলাম।

বজলু চটের ভেতর থেকে বের হয়ে এল। জয়নাল দেখল সে সত্যি-সত্যি নেমে যাচ্ছে। তার মন খানিকটা খারাপ হল। এতটা কঠিন না হলেও হত। তবে এর একটা ভালো দিক আছে। এই ব্যাটা এর পর আর তার পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করবে না। সে যখন ফেরদৌসের দোকানে পোটা ভাজি খাবে তখন একটু দূরে বসে চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে থাকবে না। হারামজাদা একেবারে কুকুরের স্বভাব পেয়েছে। জয়নাল কম্বলে পুরো মুখ ঢেকে ফেলল। বজলু এখন কোথায় যাবে, কোথায় ঘুমুবে—এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। যেখানে ইচ্ছা যাক। শিসের শব্দ কানে না এলেই হল। জয়নালের মন একটু অবশ্যি খচখচ করছে। সে মনের খচখচানিকে তেমন গুরুত্ব দিল না। ভেঙে যাওয়া ঘুম জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে লাগল। পৌষমাস শেষ হতে চলল, এখনো এত শীত কেন কে জানে। মনে হয় দুনিয়া উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। কেয়ামত যখন নজদিক তখন এই রকম উলট-পালট হয়। কেয়ামত যখন খুব কাছাকাছি চলে আসবে তখন হয়তো চৈত্র মাসেও শীতে হুহু করে কাঁপতে হবে।
 
জয়নালের ঘুম আসছে না। বজলুকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়াটা ঠিক হয় নি। মনের খচখচানি যাচ্ছে না। শোবার মতো কোনো জায়গা পেল কি-না কে জানো ছোটখাট মানুষ বেশি জায়গার তো দরকার নেই। দুহাত জায়গা হলেই হয়। এই দুহাত জায়গাই বা কে কাকে দেয়। এই দুনিয়া খুবই কঠিন। দুই সুতা জায়গাও কেউ কাউকে ছাড়ে না। মায়া মহত বলেও কিছু নেই। অবশ্যি মায়া মহত না থাকার কারণ আছে। কেয়ামত এসে যাচ্ছে, কেয়ামত যত নজদিক হয় মায়া মহব্ৰত ততই দূরে চলে যায়। আল্লাহ পাক মায়া মহত উঠিয়ে নেন। দোষের ভাগি হয় মানুষ। অথচ বেচারা মানুষের কোনো দোষই নেই।

বজলুর আপন চাচা, যে বজলুকে গৌরীপুর ইস্টিশনে ছেড়ে চলে গেল, তার জন্যে ঐ চাচাকে দোষী মনে করার কোনো কারণ নেই। সেই বেচারার নিশ্চয়ই সংসার চলছিল না। কী করবে? ভাতিজাকে স্টেশনে ফেলে চলে গেছে। তাও তত লোকটার বুদ্ধি আছে, ইস্টিশনে ফেলে গেছে।

ইস্টিশন হচ্ছে পাবলিকের জায়গা। গভর্মেন্টের জায়গা। এই জায়গার ওপর সবার দাবি আছে। তাছাড়া ইস্টিশনে কেউ না খেয়ে থাকে না। কিছু কিছু জুটেই যায়। আর একটু বড় হলে মাল বাওয়া শুরু করতে পারবে। একটা স্যুটকে নামালে দুটাকা। ওভারব্রিজ পার হলে পাঁচ টাকা। তেমন ভদ্রলোক হলে বাড়তি বকশিশ। অবশ্যি ভদ্রলোকও এখন তেমন নেই। সামান্য একটা দুটা টাকার জন্যে যেভাবে কথা চালাচালি করে এক-এক সময় জয়নালের ইচ্ছা করে একটা চড় বসাতে। একদিন একটা চড় বসিয়ে দেখলে হয়। চড় খেলে কী করবে? কিছুক্ষণ নিশ্চয়ই কথা বলতে পারবে না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকবে। তারপর? তারপর কী করবে? দেখতে ইচ্ছা করে। ভদ্রলোকরা বিপদে পড়লে মজাদার কাকারখানা করে।

তার যখন বোঝ টানার ক্ষমতা ছিল তখন মজা দেখার জন্যেই ভদ্রলোকদের মাঝেমধ্যে বিপদে ফেলে দিত। একবার এক ভদ্রলোকের বিছানা বালিস ট্রাংক সে ওভারব্রিজ পার করে দিল। দুই মণের মতো বোঝ। ভদ্রলোকের হাতে একটা হ্যান্ড ব্যাগ, এটাও তিনি নিতে পারছেন না। বললেন, এই কুলি, এই ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নে। পারবি না?

কী কথার ঢং কুলি বলেই তুই-তুই করে বলতে হবে? আর এই পলকা ব্যাগ, এইটাও হাতে নেয়া যাবে না! জয়নাল উদাস ভঙ্গিতে বলল, দেন।

পারবি তো? দেখিস ফেলে দিস না। ট্রাংকে কাচের জিনিস আছে। সামালকে যাবি।

আপনে নিজেও সামালকে সিঁড়ি দিয়া উঠবেন। বিষ্টি হইছে। সিঁড়ি পিছল। আরে ব্যাটা তুই দেখি রসিক আছিস।

দেখা গেল ভদ্রলোক নিজেও বেশ রসিক। মালামাল পার করবার পর গম্ভীর গলায় বললেন, নে তিন টাকা দিলাম। মালের জন্যে দুই টাকা। এক টাকা বকশিশ।

জয়নালের মাথায় চট করে রক্ত উঠে গেল। এই ছোটলোক বলে কী? সে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, টাকা দেওনের দরকার নাই। আপনের জন্য ফিরি।

কী বললি? টাকা দিতে হইব না?

মজা করবার জন্যেই জয়নাল উদাস গলায় বলল, টেকা পয়সা দিয়ে কী হইব কন। টেকা পয়সা হইল হাতের ময়লা।

ভদ্রলোক রেগে আগুন হয়ে বললেন, তিন টাকা তোর কাছে কম মনে হচ্ছে? সেইটা তুই বল।

ছিঃ ছিঃ কম মনে হইব ক্যান। তিন টেকা অনেক টেকা। তিন টেকায় দুই সের লবণ হয়। দুই সের লবণে একটা মাইনষের এক বছর যায়। কম কি দেখলেন? আচ্ছা তাইলে যাই।

বলেই জয়নাল আর দাঁড়াল না, বেশ গম্ভীর চালে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। প্রথম কিছুক্ষণ ভদ্রলোক কথা বললেন না। তারপর ব্যাকুল হয়ে ডাকতে শুরু করলেন, এই শুনে যাও। এই ছেলে এই, শুনে যাও।

জয়নালের আনন্দের সীমা রইল না। তুই থেকে তুমিতে উঠেছে। এটা মন্দকী। যে শুরুতে তাকে তুই-তুই করছিল, সেই লোক তুমি-তুমি করছে এরচে বড় বিজয় তার মতোলোক আর কি আশা করতে পারে? জয়নাল ফিরেও কাল না। ঐ লোক ছটফট করছে। মালপত্র ফেলে ছুটে আসতে পারছে না, আবার সামান্য একটা কুলি তাকে অপমান করে চলে যাবে এটাও বরদাস্ত করতে পারছে না। ভদ্রলোকের অনেক যন্ত্রণা!



একসময় এই সব মজা জয়নাল করেছে। এখন পারে না। এখন তার দশা কোমরভাঙা কুকুরের মতো। সত্যি-সত্যি তার কোমর ভাঙা। তিন-মণী কস্তা আচমকা পিঠে পড়ে গিয়ে শরীর অচল হয়েছে। একটা পা শুকিয়ে দড়ি-দড়ি হয়ে যাচ্ছে। পা মাটিতে ফেলা যায় না। ব্যথায় সর্বাঙ্গ কাঁপে। আল্লাহর কী অদ্ভুত বিচার-চালের বস্তা পড়ল পিঠে, পা হয়ে গেল অচল। একের অপরাধে অনন্য শাস্তি পাচ্ছে। পা বেচারা তো কেনো দোষ করে নি।
 
সকাল বিকাল দুবেলা পায়ে পেট্রোল মালিশ করলে কাজ হত। পেট্রোল হচ্ছে বাতের মহৌষধ। আর তার পা যা হয়েছে, তাকে এক ধরনের বাতই বলা চলে। কারণ অমাবস্যা পূর্ণিমায় ব্যথা হয়। বাত হচ্ছে একমাত্ৰ অসুখ যার যোগাযোগ আকাশের চাঁদের সাথে।

পেট্রোল জোগাড় করাই মুশকিল। বোতলে করে তিন আঙুল পেট্রোল একবার মোটর স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এলো, তার দাম পড়ল পাঁচ টাকা। কী সর্বনাশের কথা। পেট্রোলের বদলে কেরোসিন তেল মালিশ করলেও হয়। তবে কেরোসিন তেলে সে রকম ধক নেই বলে মালিশের সঙ্গে-সঙ্গে এক চামচ করে খেতে হয়। খাওয়ার সময় নাড়ি-ভুড়ি উন্টে আসে আর মুখ থেকে কেরোসিনের গন্ধ কিছুতেই যেতে চায় না।

অনেকদিন পায়ে পেট্রোল বা কেরোসিন কিছুই দেয়া হয় না বলে পায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। সারাক্ষণ যন্ত্ৰণা করে। তবে গত দুদিন কোনো যন্ত্রণা করছেন। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। মাদারগঞ্জের পীর সাহেবের লাল সুতা পায়ে বেঁধেছে বলে এটা হয়েছে কি-না কে জানে। পীর ফকিররা ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু করতে পারেন। তাদের জ্বিন-সাধনা থাকে।

জয়নাল মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মাথাটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। ঘুমানো দরকার। ঘুম আসছে না। ছেলেটাকে তাড়িয়ে দেয়া ঠিক হয় নি। মনের খচখচানির জন্যেই ঘুম আসছে না। মাদারগঞ্জের পীর সাহেবের কাছ থেকে ঘুমের জন্যে একটা লাল সুতা আনা দরকার। ঘুম ভাঙলে এখন আর ঘুম আসে না। বড় যন্ত্ৰণা হয়েছে।

জয়নাল পাশ ফিরে শুলো আর ঠিক তখন আগের মতো শিসের শব্দ। জয়নাল কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করল। বজলু ফিরে এসেছে। আগের মতো পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছে। মনে হয় কোথাও জায়গা পায় নি।

এই বজলু? এই?

শিসের শব্দ থেমে গেল। বজলু বস্তার ভেতর থেকে মাথা বের করল।

এই রকম শব্দ হয় ক্যান?

বজলু মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু বলছে না। ছেমরা ভয় পেল নাকি?

শীত লাগে?

হুঁ। আয় কম্বলের নিচে আয়।

বজলু এক মুহূর্ত দেরি করল না। জয়নাল দরাজ গলায় বলল, এর পর থাইকা আমার সাথে ঘুমাইস, অসুবিধা নাই।

আইচ্ছা।

দেশ কই?

চাইলতাপুর।

বাবা জীবিত?

না।

মা?

মা আছে।

আবার বিয়া হইছে?

হুঁ।

সৎ বাপ তোরে নেয় না?

না।

চাচার সাথে ছিলি?

হুঁ।

এখন চাচাও নেয় না?

বজলু জবাব দিল না। কম্বলের উষ্ণতায় তার চোখ ভেঙে ঘুম নেমেছে। শিসের শব্দও এখন আসছে না। এই রকম অদ্ভূত একটি শব্দ হয়তোে সে শীতের কারণেই করতো। আহা বেচারা! জয়নাল ছেলেটিকে হাত বাড়িয়ে আরো কাছে টেনে নিল। ঘুমুক। আরাম করে ঘুমুক।
 
ট্রেনের শব্দ আসছে। এটা কোন ট্রেন? জারিয়া-ঝানজাইলের ট্রেন না-কি? আজ মনে হয় সময় মতে এসে পড়েছে। না-কি মালগাড়ি? মালগাড়ির চলাচল এখন আর আগের মত নেই। বিষয়টা কি মালবাবুকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয়। জিজ্ঞেস করতে সাহসে কুলায় না। মালবাবুর মেজাজ খুব খারাপ। মেজাজ খারাপ, মুখও খারাপ। যা মুখে আসে বলে ফেলে। ভদ্রলোকের ছেলে এই ধরনের গালাগাল কার কাছে শিখল কে জানে। তবে মেজাজ ভালো থাকলে এই লোক অন্য মানুষ। খোঁজ-খবর করে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। এই যে গরম কম্বল জয়নাল গায়ে দিয়ে আছে এই কম্বলও পাওয়া গেছে মালবাবুর কারণে। একদিন কথা নেই বার্তা নেই একটা কম্বল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, যা এটা নিয়ে ভাগ। হারামজাদা বান্দির পুলা তোরে যেন চোখের সামনে না দেখি।

জয়নাল মনের গভীর আনন্দ চাপা দিয়ে সহজভাবে বলার চেষ্টা করল, আমি আবার কী করলাম?

শুয়োরের বাচ্চা আবার মুখের উপরে কথা বলে। চোরের ঘরের চোর। গোলামের ঘরের গোলাম।

চোর বলায় জয়নাল কিছু মনে করে নি। চোর বার হক মালবাবুর আছে। ঐ তো কিছুদিন আগের ঘটনা—দশটা টাকা দিয়ে মালবাবু বললেন, জয়নাল যা তো পাঁচ কাপ চা নিয়ে আয়। কাপ ভালো করে ধুয়ে দিতে বলবি গরম পানি দিয়ে। জয়নাল টাকা নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। তবে চায়ের দোকানের দিকে গেল না। তার সারাদিন খাওয়া হয় নি। সে মজিদের ভাতের দোকানে চলে গেল। ইরিচালের মোটা-মোটা ভাত আর মলা মাছের ঝাল তরকারী। দশ টাকায় এত ভালো খাবার সে অনেকদিন খায় নি। মলা মাছের এ রকম স্বাদের তরকারী সে এই জীবনে চাখে নি। ভাত খেতেখেতে সে ভাবছিল মজিদ ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। যে এমন তরকারী রাঁধতে পারে তাকে সালাম করা যায়।

মালবাবুর সামনে পরের সাত দিনে সে একবারও পড়ল না। দূরে-দূরে সরে রইল। লোকটার স্মৃতি শক্তি খুবই খারাপ। সাত দিন পর তার কিছুই মনে থাকবে না। এইটাই একমাত্র ভরসা। হলও তাই, সাত দিন পর যখন মালবাবুর সঙ্গে প্রথম দেখা হল তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কিরে তোর খোঁজ-খবর নাই। কোথায় ছিলি?

জয়নাল বলল, শইল জুইত ছিল না। আপনে আছেন কেন? কাহিল-কাহিল। লাগতেছে।

চুপ কর হারামজাদা। আমারে কাহিল দেখায়। তোর মত অত বড় মিথুক আমি জন্মে দেখি নাই। শুয়োরের বাচ্চা সমানে মিথ্যা বলে। লাথি খাইতে মন চায়?

জয়নাল হাসে। তার বড় ভালো লাগে। পরিষ্কার বোঝা যায় মালবাবুর মনটা আজ ভাল। নিশ্চয়ই অনেক মালামাল বুকিং হয়েছে। যখন প্রচুর মালামাল বুকিং হয় তখন তার মেজাজটা ভালো থাকে। ওজনের হের-ফের করে মালবাবু পয়সা পান। কাঁচা পয়সা। কাঁচা পয়সার ধর্ম হচ্ছে মানুষের মন ভালো করা। সব সময় দেখা গেছে যার হাতে কাঁচা পয়সা তার মনটা ভালো।

তোর পায়ের অবস্থা কিরে জয়নাল?

ভালো না।

চিকিৎসা করাচ্ছিস?

বিনা পয়সায় তো চিকিচ্ছা হয় না। তিন আঙুল পেট্রোলের দাম ধরেন গিয়া পাঁচ টেকা।

পেট্রোল দিয়ে কী চিকিৎসা?

পেট্রোল হইল আপনের বাতের এক নম্বর চিকিচ্ছা।

হারামজাদা বলে কী? তুই কি মোটর গাড়ি নাকি যে তোর পেট্রোল লাগবে?

এই সব চিকিৎসা কোন শুয়োরের বাচ্চা তোদর শেখায়…

মালবাবু সমানে মুখ খারাপ করেন। জয়নালের বড় ভালো লাগে। যাদের মুখ খারাপ তাদের মনটা থাকে ভালো। যা কিছু খারাপ মুখ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জমে থাকছে না। ভদ্রলোকরা খারাপ কিছুই মুখ দিয়ে বলেন না। সব জমা হয়ে থাকে। তাদের জামাকাপড় পরিষ্কার, কথাবার্তা পরিষ্কার, চাল-চলন পরিষ্কার আর মনটা অপরিষ্কার। এমনই অপরিষ্কার যে সোড়া দিয়ে জ্বাল দিলেও পরিষ্কার হবার উপায় নেই।

এই জন্যেই কোনো ভদ্রলোক বিপদে পড়লে জয়নালের বড় ভালো লাগে। ভদ্রলোক বিপদে পড়ে চোখ বড়-বড় করে যখন এদিক-ওদিক চায়, ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলে তখন বড়ই মজা লাগে। তবে ভদ্রলোকরা সহজে বিপদে পড়ে না। বিপদে পড়ে তার মতো মানুষ। ভদ্রলোক বিপদে পড়লে বিপদ কেটে বের হয়ে যেতে পারে। তারা পারে না। তারচেয়েওঁ যেটা ভয়াবহ, ভদ্রলোকরা তাদের বিপদ অন্যদের ওপর ফেলে দিতে পারে।
 
তিন বৎসর আগের ঘটনাটা ধরা যাক। বৈশাখ মাস। সকাল দশটায় ইয়াদ আলি তার এক নতুন সাগরেদ নিয়ে উপস্থিত। ইয়াদ আলিকে দেখেই স্টেশনে সাজ-সাজ পড়ে গেল। ইয়াদ আলি যখন এসেছে তখন কাণ্ড একটা ঘটবে। ইয়াদ হচ্ছে সারা ময়মনসিংহের এক নম্বর ঠগ। যে কোনোলোককে সে ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। থানার ও সি-কেও সে খোলা বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে। ওসি টেরও পাবে না যে, সে বিক্রি হয়ে গেছে। ইয়াদ আলি অতি ভদ্ৰ। অতি বিনয়ী। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সুন্দর চেহারা। লোকজন বলে ইয়াদ আলি উচ্চশিক্ষিত বি, এ পাস। বিচিত্ৰ না। হতেও পারে।

ইয়াদ আলি যখন এসেছে তখন একটা অঘটন ঘটবেই। সবাই মনে-মনে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। জয়নাল জোঁকের মতো ইয়াদ আলির পেছনে লেগে রইল। আজ সে কী করে তা দেখা দরকার।

ইয়াদ আলি ভৈরব লাইনের গাড়িতে উঠে বসল। সেকেন্ড ক্লাস কামরা। যাত্রী বোঝই। নতুন বিয়ে হওয়া বর-কনে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। কামরা ওরাই রিজার্ভ করে নিয়েছে। শুধু এই কামরাই না পাশের একটা কামরাও রিজার্ভ। ইয়াদ আলি গাড়িতে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে দু তিনজন হা-হা করে উঠল— রিজার্ভ রিজার্ভ।।

ইয়াদ আলি মধুর হেসে বলল, এটা যে রিজার্ভ সেটা জানি ভাই। জেনে শুনে উঠলাম।

নামুন নামুন।

নেমে যাব। গাড়ি চলার আগে নেমে যাব। শুধু একটা কথা বলার জন্যে উঠেছি।

কোনো কথা না নিচে যান।

এত অস্থির হলে তো ভাই চলে না। কী বলতে চাই এটা শুনেন। মসজিদ বানাবার জন্যে আমি চান্দা চাইতে আসি নাই। আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চাইতে আসি নাই। আপনারা আমাকে কি সাহায্য করবেন? আপনাদের নিজেদেরই সাহায্য দরকার। আমি একজন বয়স্ক মানুষ, আমার শরীরটাও ভালো না। সামান্য দুটা কথা বলতে এসেছি, না শুনেই আপনারা চেঁচাচ্ছে–নামুন নামুন। এটা কী ধরনের কথা? এটা কি ভদ্রলোকের কথা? আপনারা সব সময় মনে করেন ট্রেনে কেউ দুটা কথা বলতে চায় মানে ভিক্ষা চায়। ভাই, আমাকে কি ভিক্ষুক বলে মনে হয়? এই কি আমাদের শিক্ষা? এই কি…

ইয়াদ আলির মুখ দিয়ে কথার তুবড়ি বেরুতে লাগল। বরযাত্রী হতচকিত। কেউকেউ খানিকটা লজ্জিত। একজন বলল, কিছু মনে করবেন না। যা বলতে চান বলুন।

না, আমি কিছুই বলতে চাই না। বলার ইচ্ছা ছিল। আপনাদের দেখে ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল। ভাবছিলাম মনের ব্যথার কথাটা বলি…

এই পর্যায়ে ইয়াদ আলি থর-থর করে কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছে সে রাগ সামলাতে পারছে না। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। ইয়াদ আলি কথা বন্ধ করে এক হাতে বুক চেপে বলল, শরীরটা যেন কেমন লাগছে। এক গ্রাস পানি, এক গ্রাস পানি। বলতে-বলতে মাথা চক্কর দেয়ার ভঙ্গি করে সে লম্বালম্বি ভাবে কয়েকজনের গায়ে পড়ে গেল। দারুণ হৈ চৈ। সবাই চেঁচাচ্ছে-পানি পানি। হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার কেউ আছে, ডাক্তার?

এই ভিড় এবং হট্টগোলের মাঝে ইয়াদ আলির সাগরেদ কনের দুটি সুটকেস নামিয়ে ফেলল। নামাল সবার চোখের সামনে কেউ তা দেখলও না। জয়নাল শুধু বলল,

ব্যাটা সাবাস।

ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে ইয়াদ উঠে বসল। বলল, শরীরটা একটু ভালো লাগছে। সবাই ধরাধরি করে তাঁকে নামিয়ে দিল।

ঘটনার এক দিন পরই দারুণ হৈ চৈ। পুলিশ এসে জয়নালের মতো যে কজনকে পেল সবাইকে ধরে নিয়ে গেল। জানা গেল ইয়াদ আলির দল একত্রিশ ভরি সোনার অলংকার নিয়ে সরে পড়েছে। কনের কানে সামান্য দুল ছাড়া অন্য কোনো অলংকার ছিল না। সব স্যুটকেসে ভরা ছিল।

বরের আপন মামা পুলিশের আইজি। তিনি প্রচণ্ড চাপ দিলেন। সেই চাপে গৌরীপুর ইস্টিশনে জয়নালের মত সবাই গ্রেফতার হয়ে গেল। মজা মন্দ না। দোষ কে করে আর শাস্তি হয় কার!

পুলিশের কাজকর্মও চমৎকার। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে খানিকক্ষণ পিটিয়ে নেবে। আরে বাবা কিছু প্রশ্ন কর। প্রশ্নের উত্তরে কী বলে মন দিয়ে শোন। সেটা পছন্দ না হলে তারপরে পেটাও। তা না প্রথমেই মার। রুলের গুঁ। রুলের যে এমন ভয়াবহ জয়নালের ধারণাতেও ছিল না। গুঠ বসানো মাত্র বাবারে মারে বলে চিৎকার করা। ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাও ভালো, পুলিশের কারণে বাপ মার কথা মনে পড়ল। পুলিশের গুনা খেলে মনে পড়ত না। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতেই হয় পুলিশ একটা সৎকাজ করেছে। পিতামাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এতে পুলিশের কিছু সোয়াব হয়েছে বলেও তার ধারণা।
 
মার খেলেও জয়নাল পুলিশের উপর খুবই খুশি কারণ পুলিশ কুলি সর্দার মোবারককেও ধরেছে। শুধু যে ধরেছে তাই না বেধড়ক পিটিয়েছে। রুলের গুঁতা খেয়ে হারামজাদা রক্তবমি করেছে। এত বড় একটা জোয়ান, পুলিশের কাছে কেঁচোর মতো হয়ে গেছে—এটা দেখতেও ভালো লাগে। মোবারক শুধু যে কুলি সর্দার তাই নাগৌরীপুর ইস্টিশনের ক্ষমতাবান মানুষদের একজন। স্টেশন মাস্টারকেও তাকে সমীহ করে চলতে হয়। যদি মোবারকের সঙ্গে কখনো দেখা হয়, স্টেশন মাস্টার নরম গলায় বলেন, কি মোবারক আলো?

পনেরোটার মতো মালগাড়ির পুরানো ওয়াগন বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে। এই সব ওয়াগনে দিব্যি সংসার ধর্ম চলছে। একেকটা ওয়াগন একেকটা বাড়ি। এই সবই মোবারকের দখলে। সে প্রতিটি পরিবার থেকে মাসে এক শ টাকা ভাড়া কাটে। ভাড়ার অংশবিশেষ স্টেশনের বড় অফিসাররা পায়, সিংহভাগ যায় যোবারকের পকেটে। একটা ওয়াগনে কয়েকজন দেহপসারিণী থাকে। মোরক তাদের তত্ত্বাবধায়ক। তার নিজের দুই বিয়ে। অতি সম্প্রতি আরেকটি বিয়ে করেছে। এক বিহারী বালিকা নাম রেশমী। ঐ বালিকার রূপ না-কি আগুনের মতো।

জয়নালের মত লোকজন যাদের স্টেশন ছাড়া ঘুমানোর জায়গা নেই, যারা নম্বরী কুলি নয় বা তেমন কোন কাজকর্মও যাদের নেই তারা মোরককে যমের মতো ভয় পায়। মোরকের ছায়া দেখলে তাদের আত্মা শুকিয়ে যায়।

সেই মোবারককেও পুলিশে ধরল এবং পুলিশের গুঁতা খেয়ে সে রক্তবমি করল এই আনন্দের কাছে নিজের মার খাওয়ার ব্যথা কিছুই না।

দারোগা সাহেব যখন জয়নালকে বললেন, তুই কী জানিস বল? জয়নাল বলল, হুজুর মা-বাবা (কথার কথা হিসেবে বলা। খাকি পোশাক পরা সবাইকে ঘন-ঘন হুজুর মা-বাবা বলতে হয়) আমি কিছুই জানি না। লুলা মানুষ, এই দেখেন ঠ্যাঙ-এর অবস্থা। আমার লড়নের শক্তি নাই।

নিঃশ্বাস নেবার জন্যে থামতেই দারোগা সাহেব রুল দিয়ে কোঁক করে পেটে আরেকটা গুঁতা দিয়ে বললেন, একজনের কাজ না, এটা হল গ্যাং-এর কাজ। কারা আছে এই গ্যাং-এ বল। (আবার রুলের গুণ)।

হুজুর মা-বাপ। হুজুরের সঙ্গে মিথ্যা বলব না, কে বা কাহারা এইটা করছে কিছু জানি না তবে আমার মনে সন্দেহ মোরক কিছু-কিছু জানে।

জয়নাল মোরকের নামটা লাগিয়ে দিল। মোবারককে এরা ছিলে ফেললে তার মনটা শান্ত হয়। চামড়া ছিলে লবণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে সে নিজের পয়সায় লবণ কিনে দিত। দারোগা সাহেব বললেন, মোবারককে তোর সন্দেহ? কেন শুনি? ইচ্ছা করে আরেকজনের নাম লাগাচ্ছিস। বজ্জাতের বজ্জাত।

হুজুর মা-বাবা, নাম লাগানির কিছু নাই, ইস্টিশন কনট্রোল করে মোবারক। ইস্টিশনে কী হয় না হয় সবই তার জাননের কথা।

বাবা তুই দেখি ইংরেজিও জানিস ইস্টিশন কনট্রোল। কে কাকে কনট্রোল করে এখন দেখবি। কোনো বজ্জাতের পাছায় চামড়া থাকবে না। একমাস পাছা রোদে দিয়ে শুকাতে হবে।
 
০২.
তিন দিনের দিন সবাই খালাস পেয়ে গেল। শুধু মোরক আটকা রইল। সে ছাড়া পেল সপ্তম দিনে। তবে যে মোবারক ছাড়া পেল সেই মোবারককে কেউ চেনে না। শুকিয়ে চটিজুতা হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নিশ্চয়ই বেকায়দা জায়গায় পুলিশের রুলের গুঁতা লেগেছে। কিছু খেলেই বমি করে ফেলে। সেই বমির সঙ্গে রক্ত উঠে আসে।

মালবাবু তাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, আহা কী অবস্থা করেছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করা নয়ত মারা পড়বি।

সিগন্যাল বাবু বললেন, এরা এত সহজে মরে না। দুএক দিন যাক দেখবেন ঠিক আগের অবস্থা।

সিগন্যাল বাবুর কথা ঠিক হল না। সাত দিনেও মোবারকের অবস্থা উনিশ-বিশ হল না। আরও যেন কাহিল হল।

নূতন কুলি সর্দার হল হাশেম। মোরকের ঘনিষ্ঠ সাগরেদ। এই হাশেমের দলই মোবারককে খুন করল।

ইঞ্জিন শান্টিং করছিল। নির্জন জায়গা, লোকজন নেই। হঠাৎ সেই ইঞ্জিনের সামনে মোবারককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হল।

হাশেম দৌড়ে এসে স্টেশন মাস্টারকে খবর দিল, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, বিরাট একসিডেন্ট হইছে। মোরক কাটা পড়ছে। শান্টিং ইঞ্জিনের নিচে পড়ছে। দক্ষিণের সিগন্যাল পয়েন্টের দশ পনেরো হাত পিছনে।

বলিস কী?

নিজের চউক্ষ্যে দেখা মাস্টার সাব।

মোবারক তো নড়তেই পারে না সে এতদূর গেল কীভাবে?

মউতে টানছে কী করবেন কন। মউতে টানলে না গিয়া উপায় নাই। বড়ই দুঃখের সংবাদ।

হাশেম চোখে গামছা দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল। কান্নার ফাঁকে যা বলল, তার অর্থ হচ্ছে মোরক ভাই একটা মানুষের মতো মানুষ ছিল। তার মৃত্যুতে দুনিয়ার যা ক্ষতি হল তা পূরণ হবার নয়।

তবে হাশেম সেই ক্ষতি দ্রুত পূরণ করার চেষ্টা করল। মোরকের তৃতীয় বউ রেশমা নামের বালিকাটিকে বিয়ে করল। রেল ওয়াগনগুলোর কর্তৃত্ব নিয়ে নিল। কেউ বাধা দিল না। হাশেম মোরকের মতো মূর্খ ছিল না। সে একের পর এক ক্ষমতা দখল করল খুব সাবধানে। সেই সঙ্গে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধিও করল। মোরক নম্বরী কুলির সংখ্যা বৃদ্ধিতে কখনো রাজি ছিল না। হাশেম সেই কাজটিই করল। কুলির সংখ্যা বাড়ুক। যত সংখ্যা বাড়বে ততই ভালো। সংখ্যা বাড়া মানে শক্তি বৃদ্ধি। একদিন জয়নালের কাছেও এল, জয়নাল ভাই নম্বরী কুলির দরখাস্ত করেন। সবে করতেছে।

জয়নাল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কি-যে কন। আমার কি এই ক্ষমতা আছে? একটা বালিশ হাতে নিলে মনে হয় গারো পাহাড় হাতে নিলাম। দেহেন পাওডার অবস্থা। আমার মিত্যু সন্নিকট।

আইজ পাও খারাপ কাইল ভালো হইব। অসুবিধা কি? দরখাস্ত দেন। ফরমের দাম দুই টেকা।

গুণ্ডা-পাণ্ডাদের সঙ্গে বিবাদ করে লাভ নেই। দরখাস্ত করে দিয়ে জয়নাল হল একচল্লিশ নম্বর কুলি। লাল শার্ট বানাতে হবে নিজের খরচায়। শার্টের বুক পকেটে নম্বর লেখা থাকবে। আরো নিয়ম-কানুন আছে। সেই সব নিয়ম-কানুন কাগজেকলমে লেখা।

১। যাত্রীগণের সহিত সদা-সর্বদা ভদ্র ব্যবহার করিতে হইবে।

২। মাল পরিবহনে মণ প্রতি দুই টাকা হিসাব মানিয়া চলিতে হইবে। মালের ওজন প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন উঠিলে রেলওয়ে কর্মচারীদের সাহায্য নেওয়া যাইবে।

৩। অবৈধ মালামাল পারাপার করা যাইবে না। কোনো মালের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়া মাত্র রেলওয়ে পুলিশকে অবহিত করিতে হইবে। টাকার অভাবে জয়নাল আল জামাটা বানাতে পারে নি। লাল জামা থাকুক বা না থাকুক সে একজন নম্বরী কুলি এটা কম কথা না।
 
গৌরীপুর রেল স্টেশনে ভোর হয়েছে।

চারদিকে ঘন কুয়াশা।

টু ডাউন মোহনগঞ্জ-ময়মনসিংহ প্যাসেঞ্জার স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রিতে ট্রেন ঠাসা। হৈ চৈ কলরবের সীমা নেই। বজলু এখনো ঘুমুচ্ছে। জয়নাল বজলুকে রেখে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, ট্রেন দেখলেই কাছে যেতে ইচ্ছা করে। আজ পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে না। ব্যাপারটা কি? সেরে যাচ্ছে? মাদারীগঞ্জের পীর সাহেব মনে হচ্ছে সহজ পাত্র না।

এই বুড়ো এই?

তাকেই কি ডাকছে? তার বয়স চল্লিশও হয় নি এখনি তাকে বুড়ো ডাকছে? মাথার চুলগুলোর জন্যে এরকম হয়েছে। কোমরে ব্যথা পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সব চুল পেকে গেল। আল্লাহর কি লীলা। সে ব্যথা পেল কোমরে। তার ফলে এক দিকে মাথার চুল পেকে গেল অন্য দিকে পা হল অচল। কোমরের কিছুই হল না। আল্লাহতায়ালার এটা কেমন বিচার?

এই বুড়ো এই।

জয়নাল এগিয়ে গেল। জানালার পাশে কচি-কচি মুখের একটা মেয়ে বসে আছে। তার কোলে একটি শিশু। শিশুটি তারস্বরে চেচাচ্ছে। মেয়েটির পাশে তার স্বামী। সেই বেচারার কোলেও একটি শিশু। সেই শিশুটিও কাঁদছে। মনে হচ্ছে যমজ। যমজ বাচ্চারাই এক সঙ্গে কাঁদে হাসে। জয়নাল বলল, কী বিষয় আম্মা?

একটু পানি এনে দিতে পারবে? খাবার পানি।

টিউবওয়েলের পানি আছে। ভালো পানি। এক চুমুকে শইল ঠাণ্ডা।

আর গরম পানি দিতে পারবে?

আল্লাহ ভরসা। চায়ের দোকানে একটা টেকা দিলেই গরম পানি দিব।

এই নাও। এই ফ্লাটাতে গরম পানি। আর এইটাতে রেগুলার পানি, মানে ঠাণ্ডা পানি।

গরম পানির জইন্যে দুইটা টেকা দেন আহ্ম।

মেয়েটি টাকা খুঁজছে। তার বিশাল কাল ব্যাগে সম্ভবত এক টাকার কোনো নোট নেই। মেয়েটির স্বামী বিরক্ত গলায় বলল, তুমি পানি আনার জন্যে এসব পাত্ৰ দিচ্ছ কেন?

এ ছাড়া আর কী দেব? আর কী আছে?

মেয়েটির স্বামী ইংরেজিতে কি-সব বলল, যার মানে খুব সম্ভব—এই লোক পাত্রগুলো নিয়ে পালিয়ে যাবে।

জয়নাল ইংরেজি বোঝ না কিন্তু মানুষের ভাবভঙ্গি বুঝতে পারে। সে মেয়েটির স্বামীর দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, মানুষকে এত অবিশ্বাস করা ঠিক না।

লোকটি মনে হচ্ছে এই কথায় লজ্জা পেল। পাক, মাঝে-মাঝে লজ্জা পাওয়া ভালো। ভদ্রলোক লজ্জা পেলে দেখতে ভালো লাগে। চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। কথা ঠিক মতো বলতে পারে না। তোতলাতে থাকে।

মেয়েটা তার কালো ব্যাগে টাকা খুঁজে পেয়েছে। সে স্বামীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দামী একটা ফ্লাস্ক এবং পানি রাখার চমৎকার একটি পাত্র বাড়িয়ে বলল, ধুয়ে নিও কেমন?

আচ্ছা, আম্মা।

তাড়াতাড়ি আসবে। আমি পাঁচ টাকা বকশিশ দেব। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে।

জয়নাল তার খোঁড়া পা নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত এগুতে লাগল। ঠাণ্ডা এবং গরম পানি নিয়ে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। সে লাইন টপকে বাজারে চলে গেল। জিনিস দুটির জন্যে আশাতীত দাম পাওয়া গেল। দুশ কুড়ি টাকা। চাপাচাপি করলে আড়াই শ পাওয়া যেত। যাক যা পাওয়া গেছে তাই বা মন্দ কী? দুশ কুড়ি টাকা খেলা কথা না। হাত এখন একেবারে খালি।।

বাচ্চা দুটোর জন্যে খারাপ লাগছে। আহা অবোধ শিশু। পেটের ক্রিধেয় কাঁদছে। তবে ওরা কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। তাছাড়া শিশু হচ্ছে ফেরেশতা। আল্লাহতালা নিজেই এদের উপর লক্ষ রাখেন। ক্ষিধের চোটে এরী কিছুক্ষণ কাঁদবে—এরও ভালো দিক আছে। চিৎকার করে কাঁদলে ফুসফুস পরিষ্কার থাকে। ক্ষয় কাশ, হাঁপানি এইসব কখনো হয় না। সব মন্দ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে।
 
ঘন্টাখানেক পর জয়নাল স্টেশনে ফিরল। ট্রেন চলে গেছে। স্টেশন ফাঁকা।

বজলু কম্বল ভাঁজ করে বগলে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ঠোঙ্গায় করে জয়নাল। পরটা ভাজি নিয়ে এসেছে। বজলুকে ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিয়ে দরাজ গলায় বলল, আরাম কইরা খা বজলু আগ্রহ করে খাচ্ছে। বার-বার তাকাচ্ছে জয়নালের দিকে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় সে অভিভূত। জয়নাল বলল, কেউ কি আমারে খুজছে? বজলু না সূচক মাথা নাড়ল।

জয়নাল রেলওয়ে হিন্দু টি স্টলের সামনে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দু টি স্টল চালায় পরিমল। তার ব্যবহার খুবই খারাপ, তবে চা বানায় ভালো। অন্য জায়গায় আধাকাপ চা দিয়ে এক টাকা রেখে দেয়, পরিমল তা করে না।

জয়নাল বলল, পরিমলদা এক কাপ চা দেহি, গরম হয় যেন।

পরিমল মুখ বিকৃত করে বলল, কাছে আয়। হা কর, মুখের মধ্যে চা বানায়ে দেই। গরম চা।

জয়নাল পরিমলের কথা শুনেও না শোনার ভান করল। সকাল বেলায় ঝগড়া করে লাভ নেই। পকেটে এতগুলো টাকা নিয়ে ঝগড়া করতেও মন চায় না। মানুষের যাবতীয় ক্ষুদ্র ও তুচ্ছতা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখতে ইচ্ছা করে।

পরিমলদা আমার এই পুলাডারে এককাপ মালাই চা দেও। সর যেন থাকে।

পরিমল চোখের কোণে বজলুকে এক ঝলক দেখল। শুকনো গলায় বলল, আগে টেকা দেপাঁচ টেকা।

পাঁচ টেকা? কি কও তুমি?

মালাইচা দুই টাকা কাপ। আর তোর কাছে আগের পাওনা দুই টেকা।

জয়নাল নিতান্ত অবহেলায় এক শ টাকার একটা নোট বের করল। যেন এরকম বড় নোট সে প্রতিদিন বের করে। এটা কিছুই না। সে উদাস গলায় বলল, ভাংতি না থাকলে নোট রাইখ্যা দেও। যখন ভাংতি হয় দিবা।

টেহা পাইচস কই?

এইটা দিয়া তো তোমার দরকার নাই পরিমলদা। তুমি হইলা দোকানদার মানুষ। কাস্টমার তোমারে হুকুম দিব সেই হুকুমে তুমি জিনিস দিবা, পয়সা নিবা। তুমি হইলা হুকুমের গোলাম।

কথাটা বলে জয়নাল খুব তৃপ্তি পেল। উচিত কথা বলা হয়েছে। শালা মালাউনের এখন আর মুখে কথা নাই।।

পরিমলের দোকানের চা আজ অন্য দিনের চেয়ে ভালো লাগল। চায়ের মধ্যে তেজপাতা দেয়ায় কেমন পায়েস-পায়েস গন্ধ। জয়নাল দরাজ গলায় বলল, দেখি পরিমলদা আরেক কাপ। চিনি বেশি কইরা দিবা।

পরিমল আরেক কাপ চা বাড়িয়ে দিল। বজলু আগের কাপই এখনো শেষ করতে পারে নি। ফুঁ দিয়ে-দিয়ে খাচ্ছে। একেকটা চুমুক দিচ্ছে আর জয়নালের দিকে তাকাচ্ছে। জয়নাল মনে-মনে ভাবল, এই ছেলেটার একেবারে কুকুর স্বভাব। কুকুরকে খেতে দিলে সে মালিকের দিকে একটু পর-পর তাকায় আর লেজ নাড়ে। এই হারামজাদাও তাই করছে। লেজ নেই বলে লেজটা নাড়তে পারছে না।

জয়নালের হঠাৎ মনে হল আল্লাহতালা সব জন্তকে লেজ দিয়ে পাঠাল মানুষকে কেন দিল না? কুকুর, বিড়াল, বাঘ, সিংহ সবারই লেজ আছে। মানুষের থাকলে তো কোনো ক্ষতি হত না। আসলেই চিন্তার বিষয়। কাউকে জিজ্ঞেস করে জিনিসটা জানা দরকার। জয়নালের মনে মাঝেমাঝে উচ্চ শ্রেণীর কিছু চিন্তা ভাবনা আসে, তখন কেন জানি বড় ভালো লাগে। নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা বলে মনে হয়। বেশিরভাগ মানুষই তো এক পদেরখাও আর ঘুমাও। এর বাইরে কোনো চিন্তা নেই। আল্লাহতালা মানুষকে চিন্তা করার যে ক্ষেমতা দিয়েছে সেই ক্ষেমতা কয়জন আর কাজে লাগায়?

যাই পরিমল দা। চা ভালো বানাইছ। একটা টেকা বেশি রাখ। বকশিশ। তোমারে বকশিশ করলাম। হিহিহি।

হারামজাদা বকশিশ দেখায়। লাথি খাবি।

জয়নাল দাঁত বের করে হাসল। জায়গা মত অপমান করা হয়েছে। অনেকদিন মনে রাখবে।

ভাংতি টাকা সবই ফেরত দিয়েছে। মালাউন জাতের এই এক গুণ, টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব সাবধান। মুসলমান হলে বলত, টাকা থাকুক আমার কাছে। এখন ভাংতি নাই। ভাংতি হলে নিবি। তারপর আজ দিব কাল দিব করে খালি ঘুরাত।

বজলু পেছনে পেছনে আসছে। আসুক। অসুবিধা কী। ভাঁজ করা কম্বল বগলে ধরে আছে। জয়নালের জন্যে সুবিধাই হল—ঝাড়া হাত পা। সাথে আছে চৌকিদার।

ক্ষিদা লাগছে নাকি রে, ঐ বজলু?

হুঁ।

হুঁ কিরে ব্যাটা? পরটা ভাজি তো খাইলি একটু আগে। এখন খাইলি মালাই চা। এক মালাই চা খাইয়া এক দিন থাকা যায়। ক্ষিদা সহ্য করার অভ্যাস কর। পরে কমে লাগব। এইসব অভ্যাস ছোড বেলায় করা লাগে। বুঝছস?

হুঁ।

পান বিড়ির দোকান থেকে জয়নাল এক প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনল। সিগারেট ধরাল না। আস্ত একটা প্যাকেট তার পকেটে এই আনন্দটা সে ভোগ করতে চায়। সে হাঁটছে স্টেশনের শেষ মাথার দিকে। ঐ দিকে সিগন্যাল ঘর। সিগন্যালম্যান পাগলা রমজানের সঙ্গে তার মোটামুটি খাতির আছে। রমজানকে সে ডাকে রমজান ভাই এবং বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা করে। কারণ ঐ লোকটা আর দশটা লোকের মতো না। চিন্তা ভাবনা করে। কিছু কিছু চিন্তা বড়ই জটিল চিন্তা। যা জয়নালের মাথাতেও ঢােকে না। আবার কিছু কিছু চিন্তা পানির মতো। বুঝতে অসুবিধা হয় না।
 
গত বর্ষায় এরকম একটা চিন্তা শুনে সে বড় অভিভূত হয়েছে। সেদিন ঘোর বর্ষা। রমজান ভাই চাবির গোছা নিয়ে লাইন বদলাতে যাচ্ছে। কাজটা দেখতে সহজ হলেও আসলে সহজ না। একটা ভারী লোহার দণ্ড একদিক থেকে অন্য দিকে নিতে হয়। তখন ঘটাং করে লাইন বদল হয়। ট্রেন এলে আগের লাইনে না গিয়ে তখন যাবে অন্য লাইনে।

রমজান বলল, ও জয়নাল, আমার সাথে আয় ছাতা ধরবি। হাঁটতে পারিস তো?

পারি। চলেন যাই।

যেতে-যেতে রমজান বলল, একজন কেউ সাথে থাকলে সুবিধা। পয়েন্টার তুলতে কষ্ট হয়। বয়স হইছে রিটায়ারের টাইম।

জয়নাল বলল, যখন দরকার হইব খবর দিয়েন। আমি আছি।

ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ছপ-ছপ করে দুজন যাচ্ছে। তখন রমজান একটা ভাবনার কথা বলল।

ও জয়নাল, একটা কথা বলি শোন।

বলেন রমজান ভাই।

আমার বেতন হইল চাইর শ ত্রিশ এর সাথে মেডিকেল দশ–চাইর শ চল্লিশ। আমি মানুষটা ছোড পদের কিনা ক দেখি। চাইর শ চল্লিশ টেকায় কি হয়? একটা ঘোড়ারও খাওন হয় না। ঠিক কি-না?

ঠিক।

এই আমার হাতে কী ক্ষমতা চিন্তা করছ? একবার যদি লাইন উল্টা পাল্টা কইরা দেই তাইলে যে একসিডেন হইব সেই একসিডেনে মানুষ মরব কম হইলেও এক হাজার।

কি সব্বনাশ।

এক হাজার মানুষের জান হাতের মুঠোয় নিয়া কাম করি। বুক ধড়ফড় করে। বুঝলি জয়নাল?

আমারো বুক ধড়ফড় করতাছে রমজান ভাই।

তোরে গোপনে একটা কথা কইমন দিয়া শোন, এক দিন দিমু একসিডেন,। বাজাইয়া।

কী কইলেন?

আমি এক কথা একবার কই, দশবার কই না।

একসিডেন বাজাইবেন?

হুঁ।

কোনদিন?

যে কোনোদিন হইতে পারে। আইজও হইতে পারে।

কি সৰ্বনাশের কথা!

হুঁ হুঁ সব্বনাশ বলে সব্বনাশ। এর নাম সাড়ে সব্বনাশ। কথা কিন্তু গোপন রাখবি। কাক-পক্ষীও যেন না জানে।

কাক-পক্ষী না জানার মত গোপন সংবাদ এটা না। স্টেশনে সবাই জানে। পাগলা রমজান নাম তো শুধু-শুধু হয় নি। এইসব কথাবার্তার জন্যই হয়েছে। তবে লোকটার মাথায় চিন্তা খুব ভালো খেলে। এই জন্যই তাকে খুব ভালো লাগে। লেজ বিষয়ক যে চিন্তাটা জয়নালের মাথায় এসেছে এর সহজ ব্যাখ্যা একমাত্র রমজান ভাই-ই দিতে পারেন।

রমজানকে পাওয়া গেল ঘুমটি ঘরে। জয়নালকে দেখেই বলল, কিরে জয়নাল আছস কেমন?

ভালা।

সাথে এই পুলা কে?

ইস্টিশনের পুলা, আছে আমার সাথে। সিগারেট খাইবেন রমজান ভাই?

নিজের পয়সার ছাড়া অন্যের জিনিস খাই না।

জয়নাল এটা জানে। তবু ভদ্রতা করল। তার সঙ্গে স্টার সিগারেটের প্যাকেটটা আছে। রমজান ভাই রাজি থাকলে পুরো প্যাকেটটা দিয়ে দিত। বড় ভালো লোক। ভালো লোকের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করে।

রমজান ভাই।

কি?

একটা চিন্তা আসছে মাথার মধ্যে। চিন্তাটা হইল লেজ নিয়া। সব জন্তুর লেজ আছে। এই যে ধরেন একটা টিকটিকি এরও লেজ আছে। মানুষও তো ধরতে গেলে একটা জন্তু, এর লেজ নাই। এর কারণটা কি?

রমজানকে এই তথ্য মনে হল খুব নাড়া দিয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মাঝে-মাঝে মাথা নাড়ছে।

জয়নাল?

জ্বি।

ভাবনার খোরাক আছে এর মইদ্যে। দেখি চিন্তা কইরা কিছু পাই কিনা।

আজ তা হইলে যাই রমজান ভাই?

রমজান হ্যাঁ না কিছুই বলল না। আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। জয়নাল তাকে ভালো চিন্তার খোরাক দিয়ে গেছে। সব জাতির লেজ আছে মানব জাতির লেজ নাই-বিষয়টা কি?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top