অনিশা মাকে ঠাট্টা করে বলেছে। বাবা একটা পাগল ছিল, তাই ওইরকম পাগলাম করতো।
আজ তাহলে অনিশার এরকম মনে হচ্ছে কেন।
তাহলে কি বাবার মতো পাগলামি ওর মধ্যেও চেপে বসছে ?
কই ওর নিজেকে পাগল বলে মন হচ্ছে না।
জ্ঞানতঃ সব কিছু বুঝতে পারছে। ভাবতে পারছে।
না আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। খাতাটা পড় ফেলতে হবে।
জানলার থেকে সরে এলো।
ল্যাপটপটা টেবিলে রাখল ছোট টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নিল। নিজের ভেতরটা কেমন কেমন যেন লাগছে। একটা নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ করতে চলেছে। মায়ের গোপন কথা।
দূর ছাই যত্তোসব বাজে বাজে চিন্তা।
অনিশা ফোল্ডারটা ওপেন করে ইমেজ ফাইলটা খুলে ফেললো।
বুবুন আমি আর পারছি না।
গত সাত মাস ধরে তোর কথা খালি ভেবেছি। তোকে একটা আনন্দের সংবাদ জানাই। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমার চোখ দিয়ে এখন আর একটুতে জল পরে না।
তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কে আছে বল।
কাকে আমি আমার মনের কথা বলব। সেই তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুই মরে গেছিস। তুই বিশ্বাস কর। আমি এখনো সিঁদুর পরি।
একথা আমি লিখতে পারছি না। চোখে জল ভরে আসছে। তুই আমাকে অথৈ জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলি। এতো বড়ো সাম্রাজ্য, আমি সামলাই কি করে।
তোর সঙ্গে কতো কথা বলার ছিল, তুই কিছুই শুনলি না।
সেদিন তুই চলে আসার পর দাদুর বাড়িতে কতো হৈ হুল্লোড় করলাম। রাতে সব এক সঙ্গে খেতে বসলাম। সব খানেতেই তুই। বরুণদা একে একে সমস্ত ঘটনা বললো।
তখন জানতে পারলাম। তুই পনেরদিন ধরে কোথায় ছিলি, কি করছিলি। তবে বরুণদার কথা শুনে মনে হলো, বরুণদাও সব জানে না। বরুণদা বরুণদার পার্ট টুকু জানে।
দাদুর সঙ্গে দাদা কতোক্ষণ কথা বললো। সব মান অভিমানের পালা শেষ হলো। দাদা কথা দিলো এখানে আসবে। দাদাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললো এখনো এসে পৌঁছয় নি। ভাবলাম কোথাও কাজ সেরে ফিরছিস। তোর মতি গতি বোঝা মুস্কিল।
রাতে তোকে অনেক বার ফোন করলাম, দেখলাম তোর ফোন স্যুইচ অফ। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
দিদিভাই আমি সানা একসঙ্গে শুলাম।
পিকুও আমাদের সঙ্গে শুলো। সারারাত পিকু আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। সে এক আলাদা অনুভূতি, তোকে কি করে বোঝাই।
মনে মনে ভাবলাম আমিও মা হতে চলেছি। আমার সন্তানও আমাকে এই ভাবে জড়িয়ে ধরে সারারাত শুয়ে থাকবে তুই যেমন রাত জেগে পাহাড়া দিস তেমনি পাহাড়া দিবি।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।
সকালে ছোটমার ডাকে ঘুম ভাঙলো।
ছোটমার মুখটা কেমন গম্ভীর, চোখের পাতা ভেঁজা ভাঁজা। মনটা কেমন কু গাইল। ধর ফর করে উঠে বসলাম। ভাবলাম দাদুর হয়তো কিছু হয়েছে। তারপর শুনলাম তোর এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথাটা কেমন চক্কর কাটল তারপর আর জানি না।
তিন দিন পর জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি ডাক্তারদাদা আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বসে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। চোখ দুটো ছলছলে। তখন আমার মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি। ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
বুঝলাম আমি নার্সিংহোমে শুয়ে আছি। ডাক্তারদাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আস্তে করে বললো, একটু ঘুমবার চেষ্টা কর।
আমি ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কতো যন্ত্রপাতি। আমার সারাটা শরীর কেমন যন্ত্রণা করে উঠলো। ডাক্তরাদাদার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। ডাক্তারদাদা চোখ মুছিয়ে দিল। যেন মনে হলো বাবা আমার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। আবার তোর কথা মনে পরে গেলো।
ডাক্তারদাদাকে অস্ফুটট স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, বুবুন।
বললো ভাল আছে।
ওকে ডাকো।
বললো ও একটা নার্সিংহোমে ভর্তি আছে।
মনে মনে আশ্বস্ত হলাম তুই বেঁচে আছিস। মনে একটা জোর পেলাম।
ডাক্তারদাকে বললাম আমি ভাল হয়ে গেছি। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
ডাক্তারদাদা বললো, আর একটু সুস্থ হয়ে ওঠ, তারপর নিয়ে যাব।
ডাক্তারদাদা আমাকে ইঞ্জেকসন দিল, তারপর আর জানি না।
প্রায় দিনকুড়ি বাদে বাড়িতে এলাম। এর মধ্যে কতো লোক আমাকে দেখতে এসেছে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তোর বন্ধুরা ছাড়াও আরও কতো লোক। তাদের সকলকে চিনিও না। তোর কথা জিজ্ঞাসা করলে বলে ভাল আছে।
বাড়িতে যেদিন এলাম। ঘরে লোকে লোকারণ্য। আমি তখন সুস্থ।
আমাকে অনিমেষদা, বৌদি, প্রবীরদা, অনুপদা, বিধানদা, রূপায়ণদা বড়মার ঘরে নিয়ে গেল। নানা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে খালি বলতে লাগল মিত্রা তোকে এবার শক্ত হতে হবে। তুই মা হতে চলেছিস। তোর এখন অনেক কাজ। আমরা তোর পাশে আছি। তোর কোন চিন্তা নেই। তখনই বুঝে গেলাম, আমার কপালে কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে।
তারপর সব জানলাম। গুম হয়ে গেলাম।
জানিষ বুবুন আজ আমার সাধ। তুই জানিষ সাধ কাকে বলে। তুই তো একটা গাধা। তোকে বলেই বা লাভ কি।
জ্যেঠিমনি কাল রাতে এসেছে। তিনজনে মিলে সব গোছ গাছ করছে। বৌদি একবার এসে ফিরে গেছিল আজ সকাল থেকে এসে হাজির। সুরো আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বৌদি তোমার পেটটা এতো বড়ো কেন।
সঙ্গে সঙ্গে বড়মা বলে উঠলো বলতে নেই।
আমার সে কি হাসি।
পূর্ণিমার রাতে পীরবাবার থান থেকে ফিরে এসে তুই আমাকে যে জীবনটা দান করেছিলি। তাকে তিলে তিলে আমার শরীরের রস রক্ত জলে বড়ো করে তুলছি। আমার শরীরে তোর বীজ বাসা বেঁধেছে। কি ভালো লাগছে তোকে বোঝাতে পারব না।
আজ তোর সন্তানের বয়স সাত মাস হয়ে গেল।
আমি এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি।
জেনেছি এ্যাক্সিডেন্টে তুই মারা গেছিস। কিন্তু আমি মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই এই ভাবে মরে যেতে পারিস না।
ইসলামভাই এই কয় মাসে আমার সঙ্গে মাত্র সাতবার দেখা করেছে কিনা সন্দেহ। ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বলেছে ইসলামভাই বাইরে গেছে। কাজ আছে। রতন আবিদ কারুর দেখা পাই না। দামিনী মাসি এলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। বুঝতে পারছি তোর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ওরা কেউ মেনে নিতে পারছে না।
আজকে সবাই এসেছে। সবাই হৈ হুল্লোড় করছে কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কেউ প্রকাশ করতে চাইছে না। কনিষ্করা এলো অনেক দেরিতে। আমার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি ফাজলাম করলো। নীরু দিদিভাই-এর পেছনে একটু লাগল। যে পিকু আঙ্কেল আঙ্কেল করে পাগল সে কেমন চুপচাপ।
বিকেলের দিকে কনিষ্ককে একটু একা পেলাম।
আমি জানতাম আর কেউ কিছু করুক না করুক তোর জন্য ও অনেক দূর এগবে। ওর কাছে তোর সঠিক খবর পাওয়া যাবে। মনে হলো এই দিনটার অপেক্ষায় আমি বসে ছিলাম।
ওকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম, সঙ্গে নীরু বটা। মিলি টিনা আসতে চেয়েছিল বারন করলাম।
কনিষ্ক হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। ঘরে ঢুকেই বললো,
ম্যাডাম তুমি কিন্তু অনির কথা জিজ্ঞাসা করতে পারবে না।
আমি খুব ধীর স্থির ভাবে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমি শুনতে চাই কনিষ্ক।
না। আমি বলতে পারব না।
তুমি বলো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমার কিছু হবে না।
কনিষ্ক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
নীরু বললো, না তোকে বলতে হবে না।
আমরা যদি ওই দৃশ্য সহ্য করতে না পারি। ম্যাডাম সহ্য করবে কি করে।
আমি নীরুকে বললাম, আমি সহ্য করতে পারব। বুবুন আমাকে এই কদিনে সেই সহ্য শক্তি দিয়েছে। তোমরা নির্ভয়ে বলো।
বটা বললো, দেখ কনিষ্ক ম্যাডামের এটা জানা উচিত, তাহলে ম্যাডামও নিজের মতো করে চলতে ফিরতে পারবে।
কনিষ্ক বলতে শুরু করলো।
রাত তখন দেড়টা স্যারের ফোন পেলাম। স্যারের গলায় উৎকণ্ঠা।
তুই কোথায় আছিস।
আমার আজ নাইট স্যার।
একবার আসতে পারবি।
এতো রাতে!
অনির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
মাথাট কেমন ঘুরে গেল।
আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।
ফোনটা রেখেই, সঙ্গে সঙ্গে নীরুকে বটাকে ফোনে ধরলাম। বললাম তোরা চলে আয় অনির বাড়িতে। আমি আর একজনকে দায়িত্ব দিয়ে চলে এলাম।
এই বাড়িতে এসে দেখলাম কে নেই। সবাই চলে এসেছে। অনিমেষদার মুখটা পাংশু। দাদাকে স্যার প্যাথিডিন ইঞ্জেকসন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে। স্যারের মুখ থেকে সব শুনলাম।
তাপসকে কারা যেন বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তাপসের ইঞ্জুরি সেরকম নয়। হাতে এবং মাথায় লেগেছে।
ওকে পুলিস জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আমি বললাম অনির খবর কি।
স্যার বললো, অনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারমানে।
সেটাই তো ভাবছি।
এদিকে তাপস যা বলেছে তা হলো। চোখে আলো পরতে ও গাড়িটাকে স্লো করে দেয়। তারপর অপজিট সাইড দিয়ে আসা গাড়িটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে। তারপর ও কয়েক মিনিটের মতো অচৈতন্য হয়ে যায়।
জ্ঞান আসতে দেখে। অনিকে কারা যেন একটা টাটা স্যুমোতে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়ির নম্বরটাও ও বলেছে। কিন্তু সেই গাড়িটা কলকাতার নয় ইউপির।
তখন তোমাকে নিয়ে যমে মানুষে টানা টানি চলছে। আমাদের কনসেন্ট তখন অনি নয় তুমি। তোমাকে কোন প্রকারে বসিরহাট থেকে নার্সিংহোমে ঢুকিয়ে স্যারেদের হাতে সঁপে দিয়ে অনির খোঁজ করতে শুরু করলাম।
ইসলামভাই-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। অনিমেষদা তার প্রশাসনিক ক্ষমতা কতটা উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন তখন দেখেছিলাম। বিশ্বাস করবে না ম্যাডাম একটা মাছি গলতে পারবে না। বেঙ্গলের চারদিক শিল করে দেওয়া হলো।
ইসলামভাই দুদিনের মাথায় খবর জোগাড় করলো সাগির, অবতার, নেপলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ওদের ফোনও স্যুইচ অফ।
ইদানিং সাগির অবতার নেপলাকে নিয়ে অনি বেশি ঘুরতো। তাহলে কি ওরাই অনির কোন খতি করলো। ইসলামভাই তখন পাগলের মতো চারদিকে খোঁজ লাগাচ্ছে। কোথাও কোন ট্রেস করতে পারছে না।
এমনকি আবিদ রতন দামিনী মাসি যার যেদিকে যতটা এক্সট্রিম ক্ষমতা আছে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে অনিমেষদা পার্টি অফিসে ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বললো এখুনি চল একবার কল্যানী যাব।
কেন!
ওখানকার থানা ইনফর্ম করেছে। একটা বডি পাওয়া গেছে। প্যান্টের পকেট থেকে যে মানি পার্টস পাওয়া গেছে তা থেকে অনির প্রেস কার্ড মিলেছে।
বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো।
অনিমেষদা মাথা ধরে বসে আছেন।
বিধানদার মুখ থেকে কোন কথা সরছে না।
রাজনাথকে হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে, কোথাও রাজনাথের কোন হদিস নেই।
প্রবীরদার অবস্থা পাগলের মতো।
সবাই স্নান খাওয়া সব ভুলে গেছি।
থানা থেকে বডি তুলে আনা হয়েছে। ভয় বলে কি জিনিষ জানতাম না। জীবনে প্রথম সেদিন ভয় পেলাম।
বডিটা দেখে, নীরু বটা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। কি বলবো তোমায় ম্যাডাম, মাথা কোন কাজ করছে না। আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না খবরটা। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠলো। মুখ চেনা যাচ্ছে না। থেতলে গেছে।
সেই ডোরাকাট লালা হলুদ গেঞ্জি জিনসের প্যান্ট পরা।
অনিমেষদা বললেন, কিরে চিন্তে পারছিস।
আমি বললাম পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে অনি। অনিমেষদা তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন রাজনাথই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ইনভলভ অবতার, সাগির, নেপলাও।
পোস্টমর্টেম হলো। সব কিছু মিলে গেল অনির সঙ্গে। পোস্টমর্টেম টেবিলে আমি ছিলাম। আমার মনের অবস্থা তখন তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
চোখে জল এসেছিল কিনা বলতে পারব না। যার সঙ্গে বসে কথা বলেছি হাসি ঠাট্টা করেছি। এক বিছানায় শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। তার মৃত শরীররে আমি ছুঁড়ি চালাচ্ছি।
স্যারকে খালি বললাম, স্যার আমি একটু ডিএনএ টেস্ট করবো। স্যার আমার মুখের দিকে তাকালো।
তোর শেষ অস্ত্র।
হ্যাঁ স্যার, ওর সমস্ত রেকর্ড আমার কাছে প্রিজার্ভ করা আছে।
আর একটা জিনিষ একটু আমাকে বলুন এই বডির হার্টটা কোন দিকে।
কেন বলতো।
একটু দরকার আছে।
বামদিকে।
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।
তখনই আমার স্থির বিশ্বাস হলো, এই বডিটা অনির নয়। অনি মরে নি।
কাউকে এই মুহূর্তে এই কথা বলা যাবে না।
এমনকি এতদিন নীরুরাও জানত না। আজ বলে ফেললাম।
কনিষ্ক ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমার হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বিশ্বাস করো ম্যাডাম ওটা অনির বডি নয়। ও মরে নি। ও বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানি না। তবে ও বেঁচে আছে।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন কথাটা শোনার পর আমার এতো আনন্দ হচ্ছিল, তোকে বলে বোঝাতে পারব না।
নীরুকে বললাম একটু চা আনো, আর কেউ যেন এই সময় আমাদের বিরক্ত না করে।
সত্যি তোর বন্ধু। তুই ভাগ্যকরে কিছু বন্ধু পেয়েছিলি বটে। কতটা তোকে ভালবাসলে এইরকম স্যাকরিফাইস করতে পারে সেদিন জানলাম।
বটা সেদিন একটাও কথা বলে নি। চুপচাপ শুনে গেছে।
কনিষ্ক কান্না থামার পর বললো।
জানো ম্যাডাম আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে বিরল প্রজাতির মানুষ অনি।
সুমন্তর জন্য ও যেদিন রক্ত দেওয়ার মনস্থির করলো। তারপর ওর থরো টেস্ট করলাম।
আমি নিজে হাতে সেদিন ওর সব কিছু টেস্ট করেছিলাম।
সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম। সবার হার্ট বাঁদিকে থাকে ওরটা আছে ডানদিকে। ওর শরীরের টোটাল সিস্টেমটা তাই আলাদা। বইতে পরেছি চোখের দেখা কোনদিন দেখি নি। এক্সরে থেকে শুরু করে সব করলাম। এমনকি ডিএনএ-টেস্ট পর্যন্ত করালাম।
তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। দেখলাম দুটো জিনিষ ওর সঙ্গে মেলে নি। এক ওই বডিটার সঙ্গে ওর হার্টের পজিসন, আর ডিএনএ।
রিপোর্ট গুলো পাওয়ার পর আমি তখন মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি ও মরে নি।
এদিকে সেদিন বডি হ্যান্ড ওভার করা হয়েগেছে। অনিমেষদা কাঁদতে কাঁদতে বডি নিলেন। কেউ গেল না। বড়মা শোনার পর ফিট হয়ে যাচ্ছে। তুমি হাসপাতালে। সে কি অবস্থা। চোখে দেখা যায় না।
একমাত্র তোমাদের কাগজ ছোট করে রিপোর্ট করলো আর সব কাগজ বড়ো বড়ো করে রিপোর্ট করলো। কাগজ পড়ে বাড়িতে সকলে হাজির সে এক হুলুস্থূলুস কান্ড।
ওই রকম জাঁদরেল ইসলামভাই সে পর্যন্ত ভেঙে পরেছে।
রতন আবিদের কথা ছেড়ে দাও। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
অনিমেষদা ওখান থেকেই ফোন করলেন যে ভাবেই হোক মার্ডারার কে ধরে দিতে হবে।
সেই কটা দিন কি ভাবে যে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। কার কথা বলবো।
দাদা খালি বললো অনির শ্রাদ্ধ করা যাবে না।
এই সময় আমার আর একটা সন্দেহ হয়েছিল। যে চিকনা অনির বিয়ের দিন আমার মুখে অনির কথা শুনে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল, সেই চিকনা সেদিন কাঁদল বটে, কিন্তু সেই কান্নার মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না।
দাদা আর অনির কাকা বললো শ্রাদ্ধ করা যাবে না। তাহলে মিত্রার মনের ওপর আরও চাপ বাড়তে পারে এতে হিতে বিপরীত। যেমন চলছে তেমন চলতে দাও।
আমি কবে আরও শিয়োর হলাম ম্যাডাম জানো….।
ঠিক মাস খানেকের মাথায় হঠাৎ আবিদ হাসপাতালে এসে হাজির।
আমি দেখে অবাক, কিরে এখানে।
তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে এলাম।
চা খেতে খেতে চাপা স্বরে বললো। রাজনাথ স্যুইসাইড করেছে একেবারে ডঃ ব্যানার্জীর মতো।
আমি আবিদের কথা শুনে ঝট করে দাঁড়িয়ে পরলাম।
কি বলছিস তুই!
ঠিক বলছি। বসো।
তুই কি করে জানলি।
আমি মজঃফরপুরে লোক পাঠিয়েছিলাম। আমার কাছে খবর ছিল অনিদার ঘটনার পর রাজনাথ পালিয়েছে। তারপর পাত্তা নিতে শুরু করলাম। জানলাম ও মজঃফরপুর থেকে পঞ্চাশ কিলো মিটার দূরে একটা গ্রামের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছে। লোক পাঠালাম।
আজ সকালে খবর এসেছে। মজঃফরপুর স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে লাইনের ওপর ওর বডি পাওয়া গেছে।
আবিদ আমাকে ম্যাসেজটা দেখাল। অবিশ্বাস করি কি করে।
এরপর তুমি বিশ্বাস করো অনিদা মরে গেছে। আলবাৎ অনিদা মরে নি।
আমি আবিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ওর চোখে মুখের কাঠিন্য দেখে আমার বুকটাই ধক ধক করে উঠলো।
তাহলে সাগির, অবতার, নেপলা ?
অনিদার সঙ্গেই আছে।
তুই গেজ করছিস।
আবিদ কোনদিন গেজ করেনা। আমি ভালোপাহাড়ে লোক পাঠিয়েছিলাম, ওখানে শ্যাম শিবু নেই। দারু সমস্ত কিছু কন্ট্রোল করছে। তুমি কতদিন ওখানে যাও নি ?
মাস খানেকের ওপর।
তোমাকে কথা দিলাম কনিষ্কদা, ইসলামভাই অনিদাকে খুঁজে বার করতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত অনিদার মকসদ পূর্ণ না হয়।
অনিদার মকসদ পূর্ণ হলেই অনিদা নিজে ফিরে আসবে। এসব যা দেখছ শুনছ সব গট আপ।
তুই কি আমাকে বাজাতে এসেছিস।
না।
তাহলে।
আমি শেষের কয়েকদিন অনিদার সঙ্গে ঘুরেছি। আমি জানি, ইসলামভাই-এর থেকেও অনিদার হাতটা অনেক বেশি লম্বা। ইসলামভাই-এর মতো দশটা মথা এক করলে অনিদার মাথা হবে।
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না কনিষ্কদা। আমরা যে এখানে বসে আছি। এই খবরটাও হয়তো অনিদার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
কি পাগলের মতো বকছিস। এখানে সবাইকে আমি চিনি।
এটাই অনিদার প্লাস পয়েন্ট, তুমি যাকে সন্দেহ করবে না, সেইই অনিদার ঘুঁটি।
তুই আমার মাথাটা খারাপ করে দিবি।
আজ তাহলে অনিশার এরকম মনে হচ্ছে কেন।
তাহলে কি বাবার মতো পাগলামি ওর মধ্যেও চেপে বসছে ?
কই ওর নিজেকে পাগল বলে মন হচ্ছে না।
জ্ঞানতঃ সব কিছু বুঝতে পারছে। ভাবতে পারছে।
না আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। খাতাটা পড় ফেলতে হবে।
জানলার থেকে সরে এলো।
ল্যাপটপটা টেবিলে রাখল ছোট টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নিল। নিজের ভেতরটা কেমন কেমন যেন লাগছে। একটা নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ করতে চলেছে। মায়ের গোপন কথা।
দূর ছাই যত্তোসব বাজে বাজে চিন্তা।
অনিশা ফোল্ডারটা ওপেন করে ইমেজ ফাইলটা খুলে ফেললো।
বুবুন আমি আর পারছি না।
গত সাত মাস ধরে তোর কথা খালি ভেবেছি। তোকে একটা আনন্দের সংবাদ জানাই। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমার চোখ দিয়ে এখন আর একটুতে জল পরে না।
তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কে আছে বল।
কাকে আমি আমার মনের কথা বলব। সেই তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুই মরে গেছিস। তুই বিশ্বাস কর। আমি এখনো সিঁদুর পরি।
একথা আমি লিখতে পারছি না। চোখে জল ভরে আসছে। তুই আমাকে অথৈ জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলি। এতো বড়ো সাম্রাজ্য, আমি সামলাই কি করে।
তোর সঙ্গে কতো কথা বলার ছিল, তুই কিছুই শুনলি না।
সেদিন তুই চলে আসার পর দাদুর বাড়িতে কতো হৈ হুল্লোড় করলাম। রাতে সব এক সঙ্গে খেতে বসলাম। সব খানেতেই তুই। বরুণদা একে একে সমস্ত ঘটনা বললো।
তখন জানতে পারলাম। তুই পনেরদিন ধরে কোথায় ছিলি, কি করছিলি। তবে বরুণদার কথা শুনে মনে হলো, বরুণদাও সব জানে না। বরুণদা বরুণদার পার্ট টুকু জানে।
দাদুর সঙ্গে দাদা কতোক্ষণ কথা বললো। সব মান অভিমানের পালা শেষ হলো। দাদা কথা দিলো এখানে আসবে। দাদাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললো এখনো এসে পৌঁছয় নি। ভাবলাম কোথাও কাজ সেরে ফিরছিস। তোর মতি গতি বোঝা মুস্কিল।
রাতে তোকে অনেক বার ফোন করলাম, দেখলাম তোর ফোন স্যুইচ অফ। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
দিদিভাই আমি সানা একসঙ্গে শুলাম।
পিকুও আমাদের সঙ্গে শুলো। সারারাত পিকু আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। সে এক আলাদা অনুভূতি, তোকে কি করে বোঝাই।
মনে মনে ভাবলাম আমিও মা হতে চলেছি। আমার সন্তানও আমাকে এই ভাবে জড়িয়ে ধরে সারারাত শুয়ে থাকবে তুই যেমন রাত জেগে পাহাড়া দিস তেমনি পাহাড়া দিবি।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।
সকালে ছোটমার ডাকে ঘুম ভাঙলো।
ছোটমার মুখটা কেমন গম্ভীর, চোখের পাতা ভেঁজা ভাঁজা। মনটা কেমন কু গাইল। ধর ফর করে উঠে বসলাম। ভাবলাম দাদুর হয়তো কিছু হয়েছে। তারপর শুনলাম তোর এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথাটা কেমন চক্কর কাটল তারপর আর জানি না।
তিন দিন পর জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি ডাক্তারদাদা আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বসে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। চোখ দুটো ছলছলে। তখন আমার মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি। ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
বুঝলাম আমি নার্সিংহোমে শুয়ে আছি। ডাক্তারদাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আস্তে করে বললো, একটু ঘুমবার চেষ্টা কর।
আমি ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কতো যন্ত্রপাতি। আমার সারাটা শরীর কেমন যন্ত্রণা করে উঠলো। ডাক্তরাদাদার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। ডাক্তারদাদা চোখ মুছিয়ে দিল। যেন মনে হলো বাবা আমার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। আবার তোর কথা মনে পরে গেলো।
ডাক্তারদাদাকে অস্ফুটট স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, বুবুন।
বললো ভাল আছে।
ওকে ডাকো।
বললো ও একটা নার্সিংহোমে ভর্তি আছে।
মনে মনে আশ্বস্ত হলাম তুই বেঁচে আছিস। মনে একটা জোর পেলাম।
ডাক্তারদাকে বললাম আমি ভাল হয়ে গেছি। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
ডাক্তারদাদা বললো, আর একটু সুস্থ হয়ে ওঠ, তারপর নিয়ে যাব।
ডাক্তারদাদা আমাকে ইঞ্জেকসন দিল, তারপর আর জানি না।
প্রায় দিনকুড়ি বাদে বাড়িতে এলাম। এর মধ্যে কতো লোক আমাকে দেখতে এসেছে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তোর বন্ধুরা ছাড়াও আরও কতো লোক। তাদের সকলকে চিনিও না। তোর কথা জিজ্ঞাসা করলে বলে ভাল আছে।
বাড়িতে যেদিন এলাম। ঘরে লোকে লোকারণ্য। আমি তখন সুস্থ।
আমাকে অনিমেষদা, বৌদি, প্রবীরদা, অনুপদা, বিধানদা, রূপায়ণদা বড়মার ঘরে নিয়ে গেল। নানা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে খালি বলতে লাগল মিত্রা তোকে এবার শক্ত হতে হবে। তুই মা হতে চলেছিস। তোর এখন অনেক কাজ। আমরা তোর পাশে আছি। তোর কোন চিন্তা নেই। তখনই বুঝে গেলাম, আমার কপালে কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে।
তারপর সব জানলাম। গুম হয়ে গেলাম।
জানিষ বুবুন আজ আমার সাধ। তুই জানিষ সাধ কাকে বলে। তুই তো একটা গাধা। তোকে বলেই বা লাভ কি।
জ্যেঠিমনি কাল রাতে এসেছে। তিনজনে মিলে সব গোছ গাছ করছে। বৌদি একবার এসে ফিরে গেছিল আজ সকাল থেকে এসে হাজির। সুরো আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বৌদি তোমার পেটটা এতো বড়ো কেন।
সঙ্গে সঙ্গে বড়মা বলে উঠলো বলতে নেই।
আমার সে কি হাসি।
পূর্ণিমার রাতে পীরবাবার থান থেকে ফিরে এসে তুই আমাকে যে জীবনটা দান করেছিলি। তাকে তিলে তিলে আমার শরীরের রস রক্ত জলে বড়ো করে তুলছি। আমার শরীরে তোর বীজ বাসা বেঁধেছে। কি ভালো লাগছে তোকে বোঝাতে পারব না।
আজ তোর সন্তানের বয়স সাত মাস হয়ে গেল।
আমি এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি।
জেনেছি এ্যাক্সিডেন্টে তুই মারা গেছিস। কিন্তু আমি মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই এই ভাবে মরে যেতে পারিস না।
ইসলামভাই এই কয় মাসে আমার সঙ্গে মাত্র সাতবার দেখা করেছে কিনা সন্দেহ। ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বলেছে ইসলামভাই বাইরে গেছে। কাজ আছে। রতন আবিদ কারুর দেখা পাই না। দামিনী মাসি এলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। বুঝতে পারছি তোর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ওরা কেউ মেনে নিতে পারছে না।
আজকে সবাই এসেছে। সবাই হৈ হুল্লোড় করছে কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কেউ প্রকাশ করতে চাইছে না। কনিষ্করা এলো অনেক দেরিতে। আমার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি ফাজলাম করলো। নীরু দিদিভাই-এর পেছনে একটু লাগল। যে পিকু আঙ্কেল আঙ্কেল করে পাগল সে কেমন চুপচাপ।
বিকেলের দিকে কনিষ্ককে একটু একা পেলাম।
আমি জানতাম আর কেউ কিছু করুক না করুক তোর জন্য ও অনেক দূর এগবে। ওর কাছে তোর সঠিক খবর পাওয়া যাবে। মনে হলো এই দিনটার অপেক্ষায় আমি বসে ছিলাম।
ওকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম, সঙ্গে নীরু বটা। মিলি টিনা আসতে চেয়েছিল বারন করলাম।
কনিষ্ক হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। ঘরে ঢুকেই বললো,
ম্যাডাম তুমি কিন্তু অনির কথা জিজ্ঞাসা করতে পারবে না।
আমি খুব ধীর স্থির ভাবে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমি শুনতে চাই কনিষ্ক।
না। আমি বলতে পারব না।
তুমি বলো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমার কিছু হবে না।
কনিষ্ক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
নীরু বললো, না তোকে বলতে হবে না।
আমরা যদি ওই দৃশ্য সহ্য করতে না পারি। ম্যাডাম সহ্য করবে কি করে।
আমি নীরুকে বললাম, আমি সহ্য করতে পারব। বুবুন আমাকে এই কদিনে সেই সহ্য শক্তি দিয়েছে। তোমরা নির্ভয়ে বলো।
বটা বললো, দেখ কনিষ্ক ম্যাডামের এটা জানা উচিত, তাহলে ম্যাডামও নিজের মতো করে চলতে ফিরতে পারবে।
কনিষ্ক বলতে শুরু করলো।
রাত তখন দেড়টা স্যারের ফোন পেলাম। স্যারের গলায় উৎকণ্ঠা।
তুই কোথায় আছিস।
আমার আজ নাইট স্যার।
একবার আসতে পারবি।
এতো রাতে!
অনির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
মাথাট কেমন ঘুরে গেল।
আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।
ফোনটা রেখেই, সঙ্গে সঙ্গে নীরুকে বটাকে ফোনে ধরলাম। বললাম তোরা চলে আয় অনির বাড়িতে। আমি আর একজনকে দায়িত্ব দিয়ে চলে এলাম।
এই বাড়িতে এসে দেখলাম কে নেই। সবাই চলে এসেছে। অনিমেষদার মুখটা পাংশু। দাদাকে স্যার প্যাথিডিন ইঞ্জেকসন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে। স্যারের মুখ থেকে সব শুনলাম।
তাপসকে কারা যেন বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তাপসের ইঞ্জুরি সেরকম নয়। হাতে এবং মাথায় লেগেছে।
ওকে পুলিস জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আমি বললাম অনির খবর কি।
স্যার বললো, অনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারমানে।
সেটাই তো ভাবছি।
এদিকে তাপস যা বলেছে তা হলো। চোখে আলো পরতে ও গাড়িটাকে স্লো করে দেয়। তারপর অপজিট সাইড দিয়ে আসা গাড়িটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে। তারপর ও কয়েক মিনিটের মতো অচৈতন্য হয়ে যায়।
জ্ঞান আসতে দেখে। অনিকে কারা যেন একটা টাটা স্যুমোতে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়ির নম্বরটাও ও বলেছে। কিন্তু সেই গাড়িটা কলকাতার নয় ইউপির।
তখন তোমাকে নিয়ে যমে মানুষে টানা টানি চলছে। আমাদের কনসেন্ট তখন অনি নয় তুমি। তোমাকে কোন প্রকারে বসিরহাট থেকে নার্সিংহোমে ঢুকিয়ে স্যারেদের হাতে সঁপে দিয়ে অনির খোঁজ করতে শুরু করলাম।
ইসলামভাই-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। অনিমেষদা তার প্রশাসনিক ক্ষমতা কতটা উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন তখন দেখেছিলাম। বিশ্বাস করবে না ম্যাডাম একটা মাছি গলতে পারবে না। বেঙ্গলের চারদিক শিল করে দেওয়া হলো।
ইসলামভাই দুদিনের মাথায় খবর জোগাড় করলো সাগির, অবতার, নেপলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ওদের ফোনও স্যুইচ অফ।
ইদানিং সাগির অবতার নেপলাকে নিয়ে অনি বেশি ঘুরতো। তাহলে কি ওরাই অনির কোন খতি করলো। ইসলামভাই তখন পাগলের মতো চারদিকে খোঁজ লাগাচ্ছে। কোথাও কোন ট্রেস করতে পারছে না।
এমনকি আবিদ রতন দামিনী মাসি যার যেদিকে যতটা এক্সট্রিম ক্ষমতা আছে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে অনিমেষদা পার্টি অফিসে ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বললো এখুনি চল একবার কল্যানী যাব।
কেন!
ওখানকার থানা ইনফর্ম করেছে। একটা বডি পাওয়া গেছে। প্যান্টের পকেট থেকে যে মানি পার্টস পাওয়া গেছে তা থেকে অনির প্রেস কার্ড মিলেছে।
বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো।
অনিমেষদা মাথা ধরে বসে আছেন।
বিধানদার মুখ থেকে কোন কথা সরছে না।
রাজনাথকে হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে, কোথাও রাজনাথের কোন হদিস নেই।
প্রবীরদার অবস্থা পাগলের মতো।
সবাই স্নান খাওয়া সব ভুলে গেছি।
থানা থেকে বডি তুলে আনা হয়েছে। ভয় বলে কি জিনিষ জানতাম না। জীবনে প্রথম সেদিন ভয় পেলাম।
বডিটা দেখে, নীরু বটা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। কি বলবো তোমায় ম্যাডাম, মাথা কোন কাজ করছে না। আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না খবরটা। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠলো। মুখ চেনা যাচ্ছে না। থেতলে গেছে।
সেই ডোরাকাট লালা হলুদ গেঞ্জি জিনসের প্যান্ট পরা।
অনিমেষদা বললেন, কিরে চিন্তে পারছিস।
আমি বললাম পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে অনি। অনিমেষদা তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন রাজনাথই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ইনভলভ অবতার, সাগির, নেপলাও।
পোস্টমর্টেম হলো। সব কিছু মিলে গেল অনির সঙ্গে। পোস্টমর্টেম টেবিলে আমি ছিলাম। আমার মনের অবস্থা তখন তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
চোখে জল এসেছিল কিনা বলতে পারব না। যার সঙ্গে বসে কথা বলেছি হাসি ঠাট্টা করেছি। এক বিছানায় শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। তার মৃত শরীররে আমি ছুঁড়ি চালাচ্ছি।
স্যারকে খালি বললাম, স্যার আমি একটু ডিএনএ টেস্ট করবো। স্যার আমার মুখের দিকে তাকালো।
তোর শেষ অস্ত্র।
হ্যাঁ স্যার, ওর সমস্ত রেকর্ড আমার কাছে প্রিজার্ভ করা আছে।
আর একটা জিনিষ একটু আমাকে বলুন এই বডির হার্টটা কোন দিকে।
কেন বলতো।
একটু দরকার আছে।
বামদিকে।
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।
তখনই আমার স্থির বিশ্বাস হলো, এই বডিটা অনির নয়। অনি মরে নি।
কাউকে এই মুহূর্তে এই কথা বলা যাবে না।
এমনকি এতদিন নীরুরাও জানত না। আজ বলে ফেললাম।
কনিষ্ক ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমার হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বিশ্বাস করো ম্যাডাম ওটা অনির বডি নয়। ও মরে নি। ও বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানি না। তবে ও বেঁচে আছে।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন কথাটা শোনার পর আমার এতো আনন্দ হচ্ছিল, তোকে বলে বোঝাতে পারব না।
নীরুকে বললাম একটু চা আনো, আর কেউ যেন এই সময় আমাদের বিরক্ত না করে।
সত্যি তোর বন্ধু। তুই ভাগ্যকরে কিছু বন্ধু পেয়েছিলি বটে। কতটা তোকে ভালবাসলে এইরকম স্যাকরিফাইস করতে পারে সেদিন জানলাম।
বটা সেদিন একটাও কথা বলে নি। চুপচাপ শুনে গেছে।
কনিষ্ক কান্না থামার পর বললো।
জানো ম্যাডাম আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে বিরল প্রজাতির মানুষ অনি।
সুমন্তর জন্য ও যেদিন রক্ত দেওয়ার মনস্থির করলো। তারপর ওর থরো টেস্ট করলাম।
আমি নিজে হাতে সেদিন ওর সব কিছু টেস্ট করেছিলাম।
সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম। সবার হার্ট বাঁদিকে থাকে ওরটা আছে ডানদিকে। ওর শরীরের টোটাল সিস্টেমটা তাই আলাদা। বইতে পরেছি চোখের দেখা কোনদিন দেখি নি। এক্সরে থেকে শুরু করে সব করলাম। এমনকি ডিএনএ-টেস্ট পর্যন্ত করালাম।
তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। দেখলাম দুটো জিনিষ ওর সঙ্গে মেলে নি। এক ওই বডিটার সঙ্গে ওর হার্টের পজিসন, আর ডিএনএ।
রিপোর্ট গুলো পাওয়ার পর আমি তখন মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি ও মরে নি।
এদিকে সেদিন বডি হ্যান্ড ওভার করা হয়েগেছে। অনিমেষদা কাঁদতে কাঁদতে বডি নিলেন। কেউ গেল না। বড়মা শোনার পর ফিট হয়ে যাচ্ছে। তুমি হাসপাতালে। সে কি অবস্থা। চোখে দেখা যায় না।
একমাত্র তোমাদের কাগজ ছোট করে রিপোর্ট করলো আর সব কাগজ বড়ো বড়ো করে রিপোর্ট করলো। কাগজ পড়ে বাড়িতে সকলে হাজির সে এক হুলুস্থূলুস কান্ড।
ওই রকম জাঁদরেল ইসলামভাই সে পর্যন্ত ভেঙে পরেছে।
রতন আবিদের কথা ছেড়ে দাও। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
অনিমেষদা ওখান থেকেই ফোন করলেন যে ভাবেই হোক মার্ডারার কে ধরে দিতে হবে।
সেই কটা দিন কি ভাবে যে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। কার কথা বলবো।
দাদা খালি বললো অনির শ্রাদ্ধ করা যাবে না।
এই সময় আমার আর একটা সন্দেহ হয়েছিল। যে চিকনা অনির বিয়ের দিন আমার মুখে অনির কথা শুনে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল, সেই চিকনা সেদিন কাঁদল বটে, কিন্তু সেই কান্নার মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না।
দাদা আর অনির কাকা বললো শ্রাদ্ধ করা যাবে না। তাহলে মিত্রার মনের ওপর আরও চাপ বাড়তে পারে এতে হিতে বিপরীত। যেমন চলছে তেমন চলতে দাও।
আমি কবে আরও শিয়োর হলাম ম্যাডাম জানো….।
ঠিক মাস খানেকের মাথায় হঠাৎ আবিদ হাসপাতালে এসে হাজির।
আমি দেখে অবাক, কিরে এখানে।
তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে এলাম।
চা খেতে খেতে চাপা স্বরে বললো। রাজনাথ স্যুইসাইড করেছে একেবারে ডঃ ব্যানার্জীর মতো।
আমি আবিদের কথা শুনে ঝট করে দাঁড়িয়ে পরলাম।
কি বলছিস তুই!
ঠিক বলছি। বসো।
তুই কি করে জানলি।
আমি মজঃফরপুরে লোক পাঠিয়েছিলাম। আমার কাছে খবর ছিল অনিদার ঘটনার পর রাজনাথ পালিয়েছে। তারপর পাত্তা নিতে শুরু করলাম। জানলাম ও মজঃফরপুর থেকে পঞ্চাশ কিলো মিটার দূরে একটা গ্রামের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছে। লোক পাঠালাম।
আজ সকালে খবর এসেছে। মজঃফরপুর স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে লাইনের ওপর ওর বডি পাওয়া গেছে।
আবিদ আমাকে ম্যাসেজটা দেখাল। অবিশ্বাস করি কি করে।
এরপর তুমি বিশ্বাস করো অনিদা মরে গেছে। আলবাৎ অনিদা মরে নি।
আমি আবিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ওর চোখে মুখের কাঠিন্য দেখে আমার বুকটাই ধক ধক করে উঠলো।
তাহলে সাগির, অবতার, নেপলা ?
অনিদার সঙ্গেই আছে।
তুই গেজ করছিস।
আবিদ কোনদিন গেজ করেনা। আমি ভালোপাহাড়ে লোক পাঠিয়েছিলাম, ওখানে শ্যাম শিবু নেই। দারু সমস্ত কিছু কন্ট্রোল করছে। তুমি কতদিন ওখানে যাও নি ?
মাস খানেকের ওপর।
তোমাকে কথা দিলাম কনিষ্কদা, ইসলামভাই অনিদাকে খুঁজে বার করতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত অনিদার মকসদ পূর্ণ না হয়।
অনিদার মকসদ পূর্ণ হলেই অনিদা নিজে ফিরে আসবে। এসব যা দেখছ শুনছ সব গট আপ।
তুই কি আমাকে বাজাতে এসেছিস।
না।
তাহলে।
আমি শেষের কয়েকদিন অনিদার সঙ্গে ঘুরেছি। আমি জানি, ইসলামভাই-এর থেকেও অনিদার হাতটা অনেক বেশি লম্বা। ইসলামভাই-এর মতো দশটা মথা এক করলে অনিদার মাথা হবে।
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না কনিষ্কদা। আমরা যে এখানে বসে আছি। এই খবরটাও হয়তো অনিদার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
কি পাগলের মতো বকছিস। এখানে সবাইকে আমি চিনি।
এটাই অনিদার প্লাস পয়েন্ট, তুমি যাকে সন্দেহ করবে না, সেইই অনিদার ঘুঁটি।
তুই আমার মাথাটা খারাপ করে দিবি।