What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

দেখি নাই ফিরে (উপন্যাস) (2 Viewers)

অনিশা মাকে ঠাট্টা করে বলেছে। বাবা একটা পাগল ছিল, তাই ওইরকম পাগলাম করতো।
আজ তাহলে অনিশার এরকম মনে হচ্ছে কেন।
তাহলে কি বাবার মতো পাগলামি ওর মধ্যেও চেপে বসছে ?
কই ওর নিজেকে পাগল বলে মন হচ্ছে না।
জ্ঞানতঃ সব কিছু বুঝতে পারছে। ভাবতে পারছে।
না আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। খাতাটা পড় ফেলতে হবে।
জানলার থেকে সরে এলো।
ল্যাপটপটা টেবিলে রাখল ছোট টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নিল। নিজের ভেতরটা কেমন কেমন যেন লাগছে। একটা নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ করতে চলেছে। মায়ের গোপন কথা।
দূর ছাই যত্তোসব বাজে বাজে চিন্তা।
অনিশা ফোল্ডারটা ওপেন করে ইমেজ ফাইলটা খুলে ফেললো।
বুবুন আমি আর পারছি না।
গত সাত মাস ধরে তোর কথা খালি ভেবেছি। তোকে একটা আনন্দের সংবাদ জানাই। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমার চোখ দিয়ে এখন আর একটুতে জল পরে না।
তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কে আছে বল।
কাকে আমি আমার মনের কথা বলব। সেই তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তুই মরে গেছিস। তুই বিশ্বাস কর। আমি এখনো সিঁদুর পরি।
একথা আমি লিখতে পারছি না। চোখে জল ভরে আসছে। তুই আমাকে অথৈ জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলি। এতো বড়ো সাম্রাজ্য, আমি সামলাই কি করে।
তোর সঙ্গে কতো কথা বলার ছিল, তুই কিছুই শুনলি না।
সেদিন তুই চলে আসার পর দাদুর বাড়িতে কতো হৈ হুল্লোড় করলাম। রাতে সব এক সঙ্গে খেতে বসলাম। সব খানেতেই তুই। বরুণদা একে একে সমস্ত ঘটনা বললো।
তখন জানতে পারলাম। তুই পনেরদিন ধরে কোথায় ছিলি, কি করছিলি। তবে বরুণদার কথা শুনে মনে হলো, বরুণদাও সব জানে না। বরুণদা বরুণদার পার্ট টুকু জানে।
দাদুর সঙ্গে দাদা কতোক্ষণ কথা বললো। সব মান অভিমানের পালা শেষ হলো। দাদা কথা দিলো এখানে আসবে। দাদাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললো এখনো এসে পৌঁছয় নি। ভাবলাম কোথাও কাজ সেরে ফিরছিস। তোর মতি গতি বোঝা মুস্কিল।
রাতে তোকে অনেক বার ফোন করলাম, দেখলাম তোর ফোন স্যুইচ অফ। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
দিদিভাই আমি সানা একসঙ্গে শুলাম।
পিকুও আমাদের সঙ্গে শুলো। সারারাত পিকু আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। সে এক আলাদা অনুভূতি, তোকে কি করে বোঝাই।
মনে মনে ভাবলাম আমিও মা হতে চলেছি। আমার সন্তানও আমাকে এই ভাবে জড়িয়ে ধরে সারারাত শুয়ে থাকবে তুই যেমন রাত জেগে পাহাড়া দিস তেমনি পাহাড়া দিবি।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।
সকালে ছোটমার ডাকে ঘুম ভাঙলো।
ছোটমার মুখটা কেমন গম্ভীর, চোখের পাতা ভেঁজা ভাঁজা। মনটা কেমন কু গাইল। ধর ফর করে উঠে বসলাম। ভাবলাম দাদুর হয়তো কিছু হয়েছে। তারপর শুনলাম তোর এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথাটা কেমন চক্কর কাটল তারপর আর জানি না।
তিন দিন পর জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি ডাক্তারদাদা আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বসে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। চোখ দুটো ছলছলে। তখন আমার মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি। ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
বুঝলাম আমি নার্সিংহোমে শুয়ে আছি। ডাক্তারদাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আস্তে করে বললো, একটু ঘুমবার চেষ্টা কর।
আমি ঘরের চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কতো যন্ত্রপাতি। আমার সারাটা শরীর কেমন যন্ত্রণা করে উঠলো। ডাক্তরাদাদার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। ডাক্তারদাদা চোখ মুছিয়ে দিল। যেন মনে হলো বাবা আমার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। আবার তোর কথা মনে পরে গেলো।
ডাক্তারদাদাকে অস্ফুটট স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, বুবুন।
বললো ভাল আছে।
ওকে ডাকো।
বললো ও একটা নার্সিংহোমে ভর্তি আছে।
মনে মনে আশ্বস্ত হলাম তুই বেঁচে আছিস। মনে একটা জোর পেলাম।
ডাক্তারদাকে বললাম আমি ভাল হয়ে গেছি। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
ডাক্তারদাদা বললো, আর একটু সুস্থ হয়ে ওঠ, তারপর নিয়ে যাব।
ডাক্তারদাদা আমাকে ইঞ্জেকসন দিল, তারপর আর জানি না।
প্রায় দিনকুড়ি বাদে বাড়িতে এলাম। এর মধ্যে কতো লোক আমাকে দেখতে এসেছে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তোর বন্ধুরা ছাড়াও আরও কতো লোক। তাদের সকলকে চিনিও না। তোর কথা জিজ্ঞাসা করলে বলে ভাল আছে।
বাড়িতে যেদিন এলাম। ঘরে লোকে লোকারণ্য। আমি তখন সুস্থ।
আমাকে অনিমেষদা, বৌদি, প্রবীরদা, অনুপদা, বিধানদা, রূপায়ণদা বড়মার ঘরে নিয়ে গেল। নানা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে খালি বলতে লাগল মিত্রা তোকে এবার শক্ত হতে হবে। তুই মা হতে চলেছিস। তোর এখন অনেক কাজ। আমরা তোর পাশে আছি। তোর কোন চিন্তা নেই। তখনই বুঝে গেলাম, আমার কপালে কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে।
তারপর সব জানলাম। গুম হয়ে গেলাম।
জানিষ বুবুন আজ আমার সাধ। তুই জানিষ সাধ কাকে বলে। তুই তো একটা গাধা। তোকে বলেই বা লাভ কি।
জ্যেঠিমনি কাল রাতে এসেছে। তিনজনে মিলে সব গোছ গাছ করছে। বৌদি একবার এসে ফিরে গেছিল আজ সকাল থেকে এসে হাজির। সুরো আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বৌদি তোমার পেটটা এতো বড়ো কেন।
সঙ্গে সঙ্গে বড়মা বলে উঠলো বলতে নেই।
আমার সে কি হাসি।
পূর্ণিমার রাতে পীরবাবার থান থেকে ফিরে এসে তুই আমাকে যে জীবনটা দান করেছিলি। তাকে তিলে তিলে আমার শরীরের রস রক্ত জলে বড়ো করে তুলছি। আমার শরীরে তোর বীজ বাসা বেঁধেছে। কি ভালো লাগছে তোকে বোঝাতে পারব না।
আজ তোর সন্তানের বয়স সাত মাস হয়ে গেল।
আমি এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি।
জেনেছি এ্যাক্সিডেন্টে তুই মারা গেছিস। কিন্তু আমি মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই এই ভাবে মরে যেতে পারিস না।
ইসলামভাই এই কয় মাসে আমার সঙ্গে মাত্র সাতবার দেখা করেছে কিনা সন্দেহ। ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বলেছে ইসলামভাই বাইরে গেছে। কাজ আছে। রতন আবিদ কারুর দেখা পাই না। দামিনী মাসি এলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। বুঝতে পারছি তোর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ওরা কেউ মেনে নিতে পারছে না।
আজকে সবাই এসেছে। সবাই হৈ হুল্লোড় করছে কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কেউ প্রকাশ করতে চাইছে না। কনিষ্করা এলো অনেক দেরিতে। আমার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি ফাজলাম করলো। নীরু দিদিভাই-এর পেছনে একটু লাগল। যে পিকু আঙ্কেল আঙ্কেল করে পাগল সে কেমন চুপচাপ।
বিকেলের দিকে কনিষ্ককে একটু একা পেলাম।
আমি জানতাম আর কেউ কিছু করুক না করুক তোর জন্য ও অনেক দূর এগবে। ওর কাছে তোর সঠিক খবর পাওয়া যাবে। মনে হলো এই দিনটার অপেক্ষায় আমি বসে ছিলাম।
ওকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম, সঙ্গে নীরু বটা। মিলি টিনা আসতে চেয়েছিল বারন করলাম।
কনিষ্ক হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। ঘরে ঢুকেই বললো,
ম্যাডাম তুমি কিন্তু অনির কথা জিজ্ঞাসা করতে পারবে না।
আমি খুব ধীর স্থির ভাবে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমি শুনতে চাই কনিষ্ক।
না। আমি বলতে পারব না।
তুমি বলো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমার কিছু হবে না।
কনিষ্ক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
নীরু বললো, না তোকে বলতে হবে না।
আমরা যদি ওই দৃশ্য সহ্য করতে না পারি। ম্যাডাম সহ্য করবে কি করে।
আমি নীরুকে বললাম, আমি সহ্য করতে পারব। বুবুন আমাকে এই কদিনে সেই সহ্য শক্তি দিয়েছে। তোমরা নির্ভয়ে বলো।
বটা বললো, দেখ কনিষ্ক ম্যাডামের এটা জানা উচিত, তাহলে ম্যাডামও নিজের মতো করে চলতে ফিরতে পারবে।
কনিষ্ক বলতে শুরু করলো।
রাত তখন দেড়টা স্যারের ফোন পেলাম। স্যারের গলায় উৎকণ্ঠা।
তুই কোথায় আছিস।
আমার আজ নাইট স্যার।
একবার আসতে পারবি।
এতো রাতে!
অনির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
মাথাট কেমন ঘুরে গেল।
আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।
ফোনটা রেখেই, সঙ্গে সঙ্গে নীরুকে বটাকে ফোনে ধরলাম। বললাম তোরা চলে আয় অনির বাড়িতে। আমি আর একজনকে দায়িত্ব দিয়ে চলে এলাম।
এই বাড়িতে এসে দেখলাম কে নেই। সবাই চলে এসেছে। অনিমেষদার মুখটা পাংশু। দাদাকে স্যার প্যাথিডিন ইঞ্জেকসন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে। স্যারের মুখ থেকে সব শুনলাম।
তাপসকে কারা যেন বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তাপসের ইঞ্জুরি সেরকম নয়। হাতে এবং মাথায় লেগেছে।
ওকে পুলিস জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আমি বললাম অনির খবর কি।
স্যার বললো, অনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারমানে।
সেটাই তো ভাবছি।
এদিকে তাপস যা বলেছে তা হলো। চোখে আলো পরতে ও গাড়িটাকে স্লো করে দেয়। তারপর অপজিট সাইড দিয়ে আসা গাড়িটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে। তারপর ও কয়েক মিনিটের মতো অচৈতন্য হয়ে যায়।
জ্ঞান আসতে দেখে। অনিকে কারা যেন একটা টাটা স্যুমোতে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়ির নম্বরটাও ও বলেছে। কিন্তু সেই গাড়িটা কলকাতার নয় ইউপির।
তখন তোমাকে নিয়ে যমে মানুষে টানা টানি চলছে। আমাদের কনসেন্ট তখন অনি নয় তুমি। তোমাকে কোন প্রকারে বসিরহাট থেকে নার্সিংহোমে ঢুকিয়ে স্যারেদের হাতে সঁপে দিয়ে অনির খোঁজ করতে শুরু করলাম।
ইসলামভাই-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। অনিমেষদা তার প্রশাসনিক ক্ষমতা কতটা উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন তখন দেখেছিলাম। বিশ্বাস করবে না ম্যাডাম একটা মাছি গলতে পারবে না। বেঙ্গলের চারদিক শিল করে দেওয়া হলো।
ইসলামভাই দুদিনের মাথায় খবর জোগাড় করলো সাগির, অবতার, নেপলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ওদের ফোনও স্যুইচ অফ।
ইদানিং সাগির অবতার নেপলাকে নিয়ে অনি বেশি ঘুরতো। তাহলে কি ওরাই অনির কোন খতি করলো। ইসলামভাই তখন পাগলের মতো চারদিকে খোঁজ লাগাচ্ছে। কোথাও কোন ট্রেস করতে পারছে না।
এমনকি আবিদ রতন দামিনী মাসি যার যেদিকে যতটা এক্সট্রিম ক্ষমতা আছে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে অনিমেষদা পার্টি অফিসে ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বললো এখুনি চল একবার কল্যানী যাব।
কেন!
ওখানকার থানা ইনফর্ম করেছে। একটা বডি পাওয়া গেছে। প্যান্টের পকেট থেকে যে মানি পার্টস পাওয়া গেছে তা থেকে অনির প্রেস কার্ড মিলেছে।
বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো।
অনিমেষদা মাথা ধরে বসে আছেন।
বিধানদার মুখ থেকে কোন কথা সরছে না।
রাজনাথকে হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে, কোথাও রাজনাথের কোন হদিস নেই।
প্রবীরদার অবস্থা পাগলের মতো।
সবাই স্নান খাওয়া সব ভুলে গেছি।
থানা থেকে বডি তুলে আনা হয়েছে। ভয় বলে কি জিনিষ জানতাম না। জীবনে প্রথম সেদিন ভয় পেলাম।
বডিটা দেখে, নীরু বটা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। কি বলবো তোমায় ম্যাডাম, মাথা কোন কাজ করছে না। আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না খবরটা। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠলো। মুখ চেনা যাচ্ছে না। থেতলে গেছে।
সেই ডোরাকাট লালা হলুদ গেঞ্জি জিনসের প্যান্ট পরা।
অনিমেষদা বললেন, কিরে চিন্তে পারছিস।
আমি বললাম পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে অনি। অনিমেষদা তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন রাজনাথই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ইনভলভ অবতার, সাগির, নেপলাও।
পোস্টমর্টেম হলো। সব কিছু মিলে গেল অনির সঙ্গে। পোস্টমর্টেম টেবিলে আমি ছিলাম। আমার মনের অবস্থা তখন তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
চোখে জল এসেছিল কিনা বলতে পারব না। যার সঙ্গে বসে কথা বলেছি হাসি ঠাট্টা করেছি। এক বিছানায় শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। তার মৃত শরীররে আমি ছুঁড়ি চালাচ্ছি।
স্যারকে খালি বললাম, স্যার আমি একটু ডিএনএ টেস্ট করবো। স্যার আমার মুখের দিকে তাকালো।
তোর শেষ অস্ত্র।
হ্যাঁ স্যার, ওর সমস্ত রেকর্ড আমার কাছে প্রিজার্ভ করা আছে।
আর একটা জিনিষ একটু আমাকে বলুন এই বডির হার্টটা কোন দিকে।
কেন বলতো।
একটু দরকার আছে।
বামদিকে।
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।
তখনই আমার স্থির বিশ্বাস হলো, এই বডিটা অনির নয়। অনি মরে নি।
কাউকে এই মুহূর্তে এই কথা বলা যাবে না।
এমনকি এতদিন নীরুরাও জানত না। আজ বলে ফেললাম।
কনিষ্ক ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমার হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বিশ্বাস করো ম্যাডাম ওটা অনির বডি নয়। ও মরে নি। ও বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানি না। তবে ও বেঁচে আছে।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন কথাটা শোনার পর আমার এতো আনন্দ হচ্ছিল, তোকে বলে বোঝাতে পারব না।
নীরুকে বললাম একটু চা আনো, আর কেউ যেন এই সময় আমাদের বিরক্ত না করে।
সত্যি তোর বন্ধু। তুই ভাগ্যকরে কিছু বন্ধু পেয়েছিলি বটে। কতটা তোকে ভালবাসলে এইরকম স্যাকরিফাইস করতে পারে সেদিন জানলাম।
বটা সেদিন একটাও কথা বলে নি। চুপচাপ শুনে গেছে।
কনিষ্ক কান্না থামার পর বললো।
জানো ম্যাডাম আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রে বিরল প্রজাতির মানুষ অনি।
সুমন্তর জন্য ও যেদিন রক্ত দেওয়ার মনস্থির করলো। তারপর ওর থরো টেস্ট করলাম।
আমি নিজে হাতে সেদিন ওর সব কিছু টেস্ট করেছিলাম।
সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম। সবার হার্ট বাঁদিকে থাকে ওরটা আছে ডানদিকে। ওর শরীরের টোটাল সিস্টেমটা তাই আলাদা। বইতে পরেছি চোখের দেখা কোনদিন দেখি নি। এক্সরে থেকে শুরু করে সব করলাম। এমনকি ডিএনএ-টেস্ট পর্যন্ত করালাম।
তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। দেখলাম দুটো জিনিষ ওর সঙ্গে মেলে নি। এক ওই বডিটার সঙ্গে ওর হার্টের পজিসন, আর ডিএনএ।
রিপোর্ট গুলো পাওয়ার পর আমি তখন মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি ও মরে নি।
এদিকে সেদিন বডি হ্যান্ড ওভার করা হয়েগেছে। অনিমেষদা কাঁদতে কাঁদতে বডি নিলেন। কেউ গেল না। বড়মা শোনার পর ফিট হয়ে যাচ্ছে। তুমি হাসপাতালে। সে কি অবস্থা। চোখে দেখা যায় না।
একমাত্র তোমাদের কাগজ ছোট করে রিপোর্ট করলো আর সব কাগজ বড়ো বড়ো করে রিপোর্ট করলো। কাগজ পড়ে বাড়িতে সকলে হাজির সে এক হুলুস্থূলুস কান্ড।
ওই রকম জাঁদরেল ইসলামভাই সে পর্যন্ত ভেঙে পরেছে।
রতন আবিদের কথা ছেড়ে দাও। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
অনিমেষদা ওখান থেকেই ফোন করলেন যে ভাবেই হোক মার্ডারার কে ধরে দিতে হবে।
সেই কটা দিন কি ভাবে যে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। কার কথা বলবো।
দাদা খালি বললো অনির শ্রাদ্ধ করা যাবে না।
এই সময় আমার আর একটা সন্দেহ হয়েছিল। যে চিকনা অনির বিয়ের দিন আমার মুখে অনির কথা শুনে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল, সেই চিকনা সেদিন কাঁদল বটে, কিন্তু সেই কান্নার মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না।
দাদা আর অনির কাকা বললো শ্রাদ্ধ করা যাবে না। তাহলে মিত্রার মনের ওপর আরও চাপ বাড়তে পারে এতে হিতে বিপরীত। যেমন চলছে তেমন চলতে দাও।
আমি কবে আরও শিয়োর হলাম ম্যাডাম জানো….।
ঠিক মাস খানেকের মাথায় হঠাৎ আবিদ হাসপাতালে এসে হাজির।
আমি দেখে অবাক, কিরে এখানে।
তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে এলাম।
চা খেতে খেতে চাপা স্বরে বললো। রাজনাথ স্যুইসাইড করেছে একেবারে ডঃ ব্যানার্জীর মতো।
আমি আবিদের কথা শুনে ঝট করে দাঁড়িয়ে পরলাম।
কি বলছিস তুই!
ঠিক বলছি। বসো।
তুই কি করে জানলি।
আমি মজঃফরপুরে লোক পাঠিয়েছিলাম। আমার কাছে খবর ছিল অনিদার ঘটনার পর রাজনাথ পালিয়েছে। তারপর পাত্তা নিতে শুরু করলাম। জানলাম ও মজঃফরপুর থেকে পঞ্চাশ কিলো মিটার দূরে একটা গ্রামের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছে। লোক পাঠালাম।
আজ সকালে খবর এসেছে। মজঃফরপুর স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে লাইনের ওপর ওর বডি পাওয়া গেছে।
আবিদ আমাকে ম্যাসেজটা দেখাল। অবিশ্বাস করি কি করে।
এরপর তুমি বিশ্বাস করো অনিদা মরে গেছে। আলবাৎ অনিদা মরে নি।
আমি আবিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ওর চোখে মুখের কাঠিন্য দেখে আমার বুকটাই ধক ধক করে উঠলো।
তাহলে সাগির, অবতার, নেপলা ?
অনিদার সঙ্গেই আছে।
তুই গেজ করছিস।
আবিদ কোনদিন গেজ করেনা। আমি ভালোপাহাড়ে লোক পাঠিয়েছিলাম, ওখানে শ্যাম শিবু নেই। দারু সমস্ত কিছু কন্ট্রোল করছে। তুমি কতদিন ওখানে যাও নি ?
মাস খানেকের ওপর।
তোমাকে কথা দিলাম কনিষ্কদা, ইসলামভাই অনিদাকে খুঁজে বার করতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত অনিদার মকসদ পূর্ণ না হয়।
অনিদার মকসদ পূর্ণ হলেই অনিদা নিজে ফিরে আসবে। এসব যা দেখছ শুনছ সব গট আপ।
তুই কি আমাকে বাজাতে এসেছিস।
না।
তাহলে।
আমি শেষের কয়েকদিন অনিদার সঙ্গে ঘুরেছি। আমি জানি, ইসলামভাই-এর থেকেও অনিদার হাতটা অনেক বেশি লম্বা। ইসলামভাই-এর মতো দশটা মথা এক করলে অনিদার মাথা হবে।
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না কনিষ্কদা। আমরা যে এখানে বসে আছি। এই খবরটাও হয়তো অনিদার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
কি পাগলের মতো বকছিস। এখানে সবাইকে আমি চিনি।
এটাই অনিদার প্লাস পয়েন্ট, তুমি যাকে সন্দেহ করবে না, সেইই অনিদার ঘুঁটি।

তুই আমার মাথাটা খারাপ করে দিবি।
 
আমি ঠিক বলছি কনিষ্কদা। অনিদা আমাদের সকলকে বুকে করে আগলে রাখছে। রাজনাথ দিদির কতবড়ো খতি করেছে তুমি জান না। ইসলামভাই কিছু জানে, সব কথা জানে না। তাহলে ইসলামভাই নিজেই রাজনাথকে সরিয়ে দিত।
খালি অনিমেষদার জন্য রাজনাথ এতদিন বেঁচে যাচ্ছিল।
শেষের পনেরদিন দাদা যা ছক করেছিল তার একটা আমি একটু আভাস ইঙ্গিতে জানতে পেরেছিলাম। তাতে বুঝেছিলাম অনিদা খুব তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে হাওয়া হয়ে যাবে।
তুমি কি ভাবছো আমি বসেছিলাম। না। আমার স্বল্প ক্ষমতায় পাত্তা লাগিয়েছিলাম।
ধরা পরে গেছি। বকুনি খেয়েছি। তারপর আমাকে ফোন করে বললো, যা দিয়িত্ব দিলাম অন্ধের মতো পালন কর। তোর ভাবনা আমি ভাবব।
তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে আগে বলিসনি কেন।
সেদিন অনিদার চেহারা তুমি দেখ নি। আমি রতনদা, নেপলা দেখেছিলাম। কথার যদি অবাধ্য হতাম, সেদিনই ছট্টুর মতো হাওলা করে ছেড়ে দিত। আজও অনিদার কথার অবাধ্য হই নি। যে দায়িত্ব দিয়ে গেছে পালন করে যাচ্ছি।
আমারও তো বলার একটা লোক দরকার, কাকে বলি বলো।
কেন ইসলামভাই।
অনিদা ইসলামভাইকে আর এই জগতে রাখতে চায় না। আমাদেরও। বলেছে অপেক্ষা কর।
অনিদা চলে যাবার পর তোমাকে দাদার আসনে বসিয়েছি।
তাই জানাতে এসেছি। এটা অনিদা করিয়েছে। অনিদা এখনও বেঁচে আছে কনিষ্কদা।
আমি আবিদের কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম।
মাথা কোন কাজ করছে না। এ কি শুনিয়ে গেল আবিদ। যদি সত্যি হয় কার কাছে ক্লারিফাই করবো। নিজের কাছে নিজে ?
অনেকক্ষণ বসে থেকে ওয়ার্ডে ফিরে এলাম।
রাতে অনিমেষদার সঙ্গে কথা বললাম। বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। গেলাম। বৌদি প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেছিল। তারপর অনিমেষদা এলেন। সব বললাম।
আমার কথা শোনার পর অনিমেষদা হাসলেন। খবরের সত্যতা স্বীকার করে নিলেন। সেদিন আমি অনিমেষদাকে আমার সংগ্রহের দুটো ক্লু দিলাম। অনিমেষদার চোখ ছানাবড়া।
কি বলছিস তুই!
আমি ঠিক বলছি দাদা।
বৌদি শুনে লাফাতে আরম্ভ করলো।
অনিমেষদা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি অনি মরে নি।
তোর কথা শুনে এখন তাই মনে হচ্ছে। আমার আর একটা প্রশ্ন মনে জাগছে বুঝলি কনিষ্ক।
কি বলুন দাদা।
কয়েকদিন আগে শুনলাম মুখার্জী ট্রান্সফার নিয়ে দুবাইতে গেছে। একবারে দেশ ছেড়ে বিদেশে।
আমার মাথায় ঢুকছে না দাদা।
ঠিক আছে তুই যা, ভেবে দেখি। মিত্রা কিছু জানতে পেরেছে ?
বলতে পারব না। তবে মনে হচ্ছে আবিদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।
না।
কেন বলছেন দাদা।
আবিদ রতনকে আমি ওয়াচে রেখেছি।
শ্যাম, শিবুর ব্যাপারটা।
ওটা প্রবীরকে দায়িত্ব দিতে হবে।
কনিষ্করা চলে গেল বুঝলি বুবুন। মনটা আশ্বস্ত হলো। আজ থেকে আবার নতুন করে বাঁচার ইনস্পিরেসন পেলাম।
আজ আমি নার্সিংহোমে ভর্তি হলাম। নিজের নার্সিংহোম, নিজের পরিচিত সব। অতএব অসুবিধে হওয়ার কিছু নেই। বড়মা, ছোটমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি সঙ্গে এলো। বুঝতে পারছি সবাই আড়ালে চোখের জল মুছছে।
আমি একটুও মন খারাপ করলাম না। আমি জানি, ওরা জানে না। বৌদি যেহেতু জানে তাই ওদেরকে সান্তনা দিচ্ছে।
সবাই ফোনে খবর নিচ্ছে।
সব কিছু চেক আপ হলো।
বিকেলের দিকে সবাই বসে গল্প করছি। নীরু এসে ঢুকলো। ও এখন আমার দেখভাল করে। তবে টাইট লুজের ব্যাপারটা ওকে দেখাই নি। যা কিছু ওপর ওপর। আমাকে প্রশ্ন করে আমি তার উত্তর দিই। মাঝে মাঝে ইয়ার্কি ফাজলামও মারে।
ম্যাডাম মনে রাখবে আমি কিন্তু অনির সাবস্টিটিউট।
তাহলে বুবুনকে ব্যাপারটা জানাতে হয়।
তোমার যা অবস্থা আমারও তাই অবস্থা।
তারপর একটা জোড়া কলা বার করে বলে খাও তো।
বড়মা হেঁই হেঁই করে উঠলো।
বদমাশ এই সময় জোড়া কলা খাওয়াতে হয়।
খাবে না মানে, আলবাৎ খাবে।
জানিস জোড়া কলা খেলে কি হয়।
দেখো বিদ্যেটা অনি শিখিয়েছে। ভুলি কি করে বলো।
তখন সবাই চুপ করে গেল।
কেন খাওয়াতে চাইছিস বল।
এতদিন বলিনি। আজ বলছি। ম্যাডাম দুজনকে ক্যারি করছে। টুইন বেবি।
জানিস বড়মা উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। থামাতেই পারি না। তারপর বললো, অনি আর কোনদিন দেখতে পাবে না।
আমি চুপ করে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর কনিষ্ক গজ গজ করতে করতে ঢুকলো।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো। তুমি কাউকে নিচে থাকার পার্মিসন দিয়েছো।
না।
আরে আজ সাত আট দিন হয়ে গেল। একটা বানজারা ফ্যামিলি নার্সিংহোমের তলায় রয়েছে।
তোর কি। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
দেখগে যা নিচে। কি নোংরা করে রেখেছে।
ওরা ফুটপাথে আছে। তোর জায়গা।
ওটা নার্সিংহোমের ফুটপাথ। বেশ করেছে আছে, থাকবেও।
তারমানে!
তোকে ওরকম ডেকরেসন করতে কে বলেছে। এটা কলকাতা। ওরা সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার পেতেছে। থাকার জায়গা দিতে হবে তো।
আচ্ছা আচ্ছা। এবার থামো। বুঝেছি।
কি বুঝেছো।
আমাকে সিকুরিটির ছেলেটা এসে বলেছিল। ম্যাডাম ওরা এসে রয়েছে। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা রয়েছে। ওরা বেশিদিন থাকে না। ম্যানেজার সাহেব চলে যেতে বলছেন, ওরা বলেছে কয়েকদিন পর চলে যাবে। আপনি যদি একটু বলে দেন।
তাই আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলেছি।
পরের দিন আমার সিজার করার দিন ধার্য হলো। বড়মা জ্যোতিষদাদার কাছ থেকে ডেট টাইম সব নিয়ে এসেছে। কিন্তু মাঝ রাতের দিকে আমার হঠাৎ শরীরটা খারাপ হলো। কনিষ্করা থাকতোই সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদাদা চলে এলো। যাকে দিয়ে আমার সিজার করানর ঠিক ঠাক ছিল, তাকে পাওয়া গেল না। তখন ডাক্তারদাদার এক বান্ধবী অঞ্জলি সাহাকে দিয়ে সিজার করান হলো। বাড়ির কেউ জানতেও পারল না।
আমাকে সেনস্লেস করে দিয়েছিল। মনে হয় অবস্থাও কিছুটা বেগতিক ছিল। তোর বন্ধুরা সব সামলে দিয়েছে। মাঝে একবার একটু একটু মনে পরছে। আমার মাথার শিয়রে একটা লাইট জ্বলছে।
ডাক্তারদাদা আমার গালে আস্তে আস্তে থাপ্পর মেরে বলছে মামনি দেখ দেখ দাদুভাইকে দেখ।
দিদিভাইকে দেখ। দুজনেই কেমন জুল জুল করে তোর দিকে তাকিয়ে। একবার মনে হয় চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম।
ভোরের দিকে আমার পুরো সেন্স এলো।
সেই ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে হাঁ করে বসে আছে।
হেসে ফেললো।
আমিও হাসলাম।
হাসিস না। তিনজনে মিলে যা চরকি নাচন নাচালি না।
ওরা কেমন আছে।

এদিকে তো টনটনে জ্ঞান আছে। এখন কেমন লাগছে।
ঠিক আছি।
আমাকে হাতমুখ ধুইয়ে ডাক্তারদাদা হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট দিল।
তুমি আগে ওদের নিয়ে এসো।
নিয়ে আসছি। ওদের একটু সাজুগুজু করতে দে। সবে পৃথিবীর আলো দেখলো।
নীরু ফিক ফিক করে হাসছে।
বুঝলি একেবারে গা জালান হাসি।
ওরা সবাই চা খেল। দুজন সিস্টার দুটো বেবি কটে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এলো। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোর মুখটা মনে পরে গেল।
ভীষণ খারাপ লাগছিল। আমাদের দুজনের ভালবাসার প্রথম ফল।
দুজনের গায়ে হাত রাখলাম। এক একটা গোটা টাওয়েলে দুজনকে আলাদা আলাদা করে পৌঁটলা বানিয়ে দিয়েছে।
নীরু তুই সব চেক করে নিয়েছিস।
হ্যাঁ।
এবার দুধ খাওয়াবে।
ম্যাডাম যদি পারে খাওয়াক।
ওরা বেরিয়ে গেল।
ডাক্তারদাদা সিস্টারদের বলে গেল, ওদের একটু দুধ খাওয়াও। বেচারারা পৃথিবীর আলো দেখার পর কিছু খায় নি।
ডাক্তারদাদাও চলে গেল।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন, প্রথম মাতৃত্ব কাকে বলে অনুভব করলাম। বার বার তোর কথা মনে পরে যাচ্ছে। একটা শূন্যতা। তুই পাশে থাকলে কি ভালো লাগতো।
তুই বলেছিলি এক জন্মে সব কিছু পরিপূর্ণ হয় না। পরের জন্মের জন্য কিছু রাখ। এইটুকু পরের জন্মের জন্য রাখলাম।
প্রথমে ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরলাম। মনে মনে বিশ্বাস করলাম। তোর নেক্সট জেনারেসন। তারপর মেয়েকে। ওরে তোকে কি বলবো, যেই কোলে নিয়েছি, টিঁ টিঁ করে সে কি কান্না।
কিছুতেই থামাতে পারি না। সিস্টাররা হেল্প করলো।
দুজনকে দুধ খাওয়ালাম। সারাটা শরীরে একটা বিদ্যুতের শিহরণ। এক আলাদা অনুভূতি। আমার স্বপ্ন স্বার্থক। তোর দেওয়া জীবন তোকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।
কচি কচি ঠোঁটে নিপিল দুটো নিয়ে কি খামচা খামচি। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক খুঁজে পেয়েছে। কি শুরশুরি লাগছিল। হঁ হঁ করছে।
কচি কচি হাত দুটো চোখ বন্ধ করে কিছু ছুঁতে চাইছে। কিছুতেই সামলাতে পারি না। সিস্টার দুটো সাহায্য করলো। মিনিট তিনেক নিপিল দুটো চোষাচুষির পর ঘুমিয়ে পরলো।
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সিস্টারকে বললাম ওরা আর খাবে না।
পেট ভরে গেছে আবার এক ঘন্টা পর।
ওদের নিয়ে চলে গেল।
বার বার মনে হচ্ছে তুই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস।
আমাকে গুছিয়ে গাছিয়ে বেডে নিয়ে এলো।
ঘরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। ঘর ভর্তি লোক। ওই সাত সকালে বড়মা, ছোটমা, জ্যেঠিমনি সবাই হাজির। কারুর আর গুছিয়ে কাপর পড়ার সময় হয় নি। দেখে মনে হলো যা পরেছিল সেই ভাবেই চলে এসেছে। কার কথা বাদ দেব।
তুই এলি দাদু দিদা কোথায়। বড়মা কট কট করে উঠলো।
আমি হাসি।
এখন ওর কাছে দেওয়া যাবে না। ডাক্তারদাদা বললো।
ওমনি বড়মার সে কি মুখ রে, ডাক্তারদাদার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দেয় আর কি। ডাক্তারদাদা বাধ্য হয়ে বললো। নীরু ওদের একবার নিয়ে আসতে বল। বড়মার দিকে তাকিয়ে বললো, মনে রাখবে, মাত্র পাঁচ মিনিট। গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। তারপর ওদের নিয়ে চলে যাবে।
তাহলে তোমরা আছো কি করতে।
ডাক্তারদাদার হাসিটা তুই যদি এই সময় দেখতিস।
সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে।
বেবিকট ঠেলতে ঠেলতে দুজন সিস্টার ওদের নিয়ে এলো। গুঁটু শুঁটি মেরে দুজনে চোখ বন্ধ করে ঘুমচ্ছে। মাথা ভর্তি চুল। মুখ দুটো লাল। পাশ ফিরে আছে।
সবাই হুমরি খেয়ে পরলো।
তোকে কি বলবো বুবুন, আমি তখন ফাউ। এই পৃথিবীতে আমার কোন দাম নেই।
তোর কথা মনে পরে গেল। আসলের থেকে সুদের দাম বেশি।
যে যা খুশি নামে ডাকছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমি তখন যথেষ্ট ফিট।
বড়মা নাতি নাতনির মুখ দেখে, আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো। ব্যাগ থেকে একটা ফুল বার করে আমার কপালে গায়ে বুলিয়ে দিলো।
এতো সকালে কোথায় পূজো দিলে।
তুই ভর্তি হয়েছিস শুনে, চিকনা কাল এসেছে। পীরসাহেবের থানে নিজে পূজো করেছে।
বোঝ একবার। তোর শিষ্য।
চিকনা কোথায় ?
নিচে আছে।
এলো না।
বললো বাড়িতে গেলে দেখবে।
কাকারা আসে নি।
খবর দিয়েছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।
বড়মারা কেউ ঘর থেকে নড়লো না। সবাই একে একে আসছে। আমার সঙ্গে দেখা করছে। চলে যাচ্ছে। পিকুর নাচ তো তুই দেখলি না। আমি দেখলাম।
দিদিভাই ওকে বলেছে মনিকে ভগবান দুটো পুতুল দিয়েছে। পুতুল দুটো ওর।
নীরু আমাকে চেকআপ করতে এসে ফিস ফিস করে বললো, জানো ম্যাডাম সেই বানজারা গুলো তল্পি-তল্পা গুটিয়ে চলে গেছে।
আমি নীরুর দিকে তাকালাম।
কনিষ্কটা কতো বড়ো গাঢ়ল, এবার বুঝতে পারলে।
আমি নীরুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
তুমি জানলে কি করে।
সিকুরিটির ছেলেটা এখন এসে বললো। সকালে ওরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে।
ছেলেটা ওদের সঙ্গে কথা বলেছিল।
কি জানি।
লোকের আসা যাওয়ার কোন বিরাম নেই। আমার থেকেও ভিআইপি এখন তোর ছেলে মেয়ে।
কাকা, কাকী, সুরোমাসি এলো একটু বেলার দিকে। দেখলাম উনা মাস্টার এসেছে।
সবার চোখ ছল ছল।
নাতি নাতনির মুখ দেখলো। উনা মাস্টার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করলো।
জানিস মা সুযোগ থাকলে ও দুটোকেও অনি বানাতাম।
না তুমি বুবুনের মতো ওদেরকেও মারবে।
উনামাস্টার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
কাকা উনামাস্টারকে সামলাল।
নীপা কাছে এগিয়ে এলো। মাথা নীচু।
আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম।
আমি বিশ্বাস করিনা অনিদা নেই। তুমি চিকনাদাকে ধরো। ও সব জানে।
আমি ওর দিকে তাকালাম।
তুমি বিশ্বাস করো মিত্রাদি।
যে শ্মশানকে ও ভয় পেত সেই শ্মশানে ও মাঝরাতে যায়। পীর সাহেবের থানে গিয়ে বসে থাকে। ওর কে বন্ধু আছে, মাঝরাতে কামরপাতায় বসে ওকে গল্প করতে হবে।
তুই দেখেছিস!
আমি খোঁজ নিয়েছি। সব সত্যি।
অনাদিকে বলেছিস।
বলেছি। অনাদিদাকে বলেছে বেশি বাড়াবাড়ি করবি গাইপ করে দেব। ওকে সকলে ভয় পায়।
ঠিক আছে আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।
দুপুরে ইসলামভাই এলো। তখন সবে খেয়ে উঠেছি।
প্রায় সাত মাস পর। ঘরে তখন কেউ নেই। একমাত্র দামিনী মাসি বসে ছিল। বুড়ি সারাদিন একটু বাথরুম পর্যন্ত করতে যায় নি। বড়মা কতো বার বললো চলো একটু মুখে জল দিয়ে আসি, বললো তোমরা যাও দিদি, আমি মামনিকে পাহাড়া দিই।
ইসলামভাই-এর মুখটা কে যেন কালি ঝুলি লেপে দিয়েছে। মিশ কালো মুখখানা। কিছুক্ষণ গেটের মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আমাকে দেখলো। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এই প্রথম ইসলামভাই আমার শরীর স্পর্শ করলো।

সে কি কান্না।
 
ইসলামভাই-এর চোখের জল আমার কপালে টপ টপ করে পরছে। ইসলামভাই-এর চোখ বন্ধ। আবিদ রতন পেছনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।
কান্না ভেঁজা গলায় বললো, আমি হেরে গেলাম, বুঝলি মামনি। পাঠানের সব অহংকার আজ মাটিতে চুরমার হয়ে ভেঙে পরেছে। জং এর ময়দানে অনি জিতে গেছে, তোর ইসলামভাই আজ মৃত সৈনিক।
আমি অবাক হয়ে ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।
ইসলামভাই-এর স্নেহের স্পর্শ তখন আমার কপালে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পরছে।
কেন তুমি মন খারপ করছো। আমি করছি না।
আর মন খারাপ করবো না। আজ আল্লার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, সব ছেড়ে দেব।
আমি ইসলামভাই-এর হাতটা শক্ত করে ধরলাম। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল।
তোকে একটা জিনিষ দেখাব কাউকে বলবি না।
মাথা দোলালাম। না।
এতদিন বিশ্বাস করতে পারি নি, আজ বিশ্বাস করছি।
কেন!
মনটা মরে গেছিল, আজ হঠাৎ যেন বেঁচে উঠলাম। আমাকে তুই কয়েকদিনের জন্য ছুটি দে।
না।
তোকে দিতে হবে। আমাকে শেষ কাজটুকু করতে দে।
যাদের কাজ তারা করুক, তুমি আমার পাশে থাকবে। কি দেখাবে বললে।
ইসলামভাই রতনের ফোনটা চাইল। একঘন্টা আগে রতনের মোবাইলে ম্যাসেজটা এসেছে।
কে পাঠিয়েছে ?
তুই দেখ।
বুকের ভেতরটা দুর দুর করে উঠলো।
রতন ম্যাসেজটা ওপেন করে মোবাইলটা আমার হাতে দিল।
রতনদা বসকে বলবে নেপলা বেঁচে থাকতে অনিদার গায়ে কেউ কোনদিন হাত তুলতে পারবে না। অনিদার শরীর হাত লাগাবার আগে নেপলাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
ম্যাসেজটা পরার পর আমার শরীরটা কেমন ভারি হয়ে গেল। শরীরটা কেমন যেন আনচান করতে লাগল। আমার চোখে মুখে সেটা ফুটে উঠেছিল।
আবিদ মনেহয় বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা, ছুটে বাইরে চলে গেল। মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই নীরু, কনিষ্ক, বটা ছুটে ঘরে ঢুকলো।
তখন আমি নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে নিয়েছি।
এনি প্রবলেম ম্যাডাম।
না।
তাহলে।
ওদের হাত দেখিয়ে ইশারায় থামতে বললাম।
আমি তখনো ইসলামভাই-এর হাতটা শক্ত করে ধরে আছি। ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
দামিনীমাসি উঠে এসে আমার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথা দামিনীমাসির বুকে।
কি হলো ইসলামভাই।
আমি কনিষ্কর দিকে হাত তুলে একটু দাঁড়াতে বললাম।
কনিষ্ক চুপ করে গেল।
নিজেকে সামলে নিলাম। কনিষ্কর হাতে মোবাইলটা দিলাম। ইসলামভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাকে কিছু পাঠায় নি।
রতনকেই আরও দুটো ম্যাসেজ করেছে।
কনিষ্করা ততক্ষণে পড়ে ফেলেছে। মুখটা হাসিতে ভরে গেল।
এটা আমি জানতাম ইসলামভাই, আজ এক্কেবারে সিয়োর হয়ে গেলাম। কনিষ্ক বললো।
ইসলামভাই ওগুলো জানে না ? কনিষ্ক আমার দিকে তাকালো।
না।
ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকাল।
তুই আগে জানতিস।
ঠিক জানতাম না। কনিষ্কর মতো বিশ্বাস করতাম ও আছে। আজ কনফার্ম হলাম।
দামিনীমাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। গালে গাল ঘোষল।
পরের দুটো কি আছে।
রতন আবার মোবাইলটা আমার হাতে দিল।
মঞ্জিল আভি তক বহুত দূর রতনদা। কবে ফিরবো জানি না। আজ বহুত খুশ রতনদা, আজ ভাইপো ভাইঝির বার্থডে। অনিদা ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
পরের ম্যাসেজটা।
অনিদা জানে না আমি তোকে ম্যাসেজ করছি। কেউ যেন জানতে না পারে। বস খুব মনেমনে কষ্ট পাচ্ছে তাই না। পাক। এই কাজ বস সারাজীবনেও করতে পারত না।
ম্যাসেজগুলো পরার পর আমার চোখে জল ভরে এলো। দামিনী মাসি আমার মাথাটা ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিল।
কোথা থেকে ম্যাসেজগুলো এসেছে কিছু খোঁজ খবর নিলে।
আবিদ জেনে এসেছে।
কোথা থেকে।
দুবাই থেকে।
আমার পিঠে সপাং করে কে যেন চাবুক মারলো বুঝলি বুবুন। তার মানে তুই টোডির পেছনে ধাওয়া করেছিস!
রাতে আমার কাছে জ্যেঠিমনি থাকবে বলেছিল। দামিনীমাসিকে কিছুতেই নরানো গেল না। আমি যতো দিন এখানে থাকবো দামিনীমাসি থাকবে। আমার ঘরে। ডাক্তারদাদার কাছ থেকে সেই পার্মিসন করিয়ে নিল।
বিকেলে ঘর ভর্তি লোক। সারাদিন সময় পাই নি মোবাইলটা খুলে দেখার। রাতে দামিনী মাসিকে বললাম। ব্যাগ থেকে আমার মোবাইলটা এনে দাও।
দামিনী মাসি এনে দিল।
আমি মোবাইলটার স্যুইচ অন করতেই বহু ম্যাসেজ। একটা ম্যাসেজের নম্বর বুঝতে পারলাম না। প্লাস সাইন মাত্র তিনটে ডিজিট। খুললাম।
তুই আমাকে আমার জীবনটা ফিরিয়ে দিলি। আমি পিতৃত্ব লাভ করলাম। আমার সবচেয়ে আনন্দর দিন। তোর পাশে নিজে থাকতে পারলাম না। তবে আমার লোক জোন তোর চারপাশে আছে। তোকে কথা দিয়েছিলাম, আমার ভালবাসাকে যারা ধূলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। তারা আমার হাত থেকে কোন দিন ছাড়া পাবে না। আমার শরীরের শেষ বিন্দু দিয়ে তাদের সঙ্গে যুঝে যাবো। এই যুদ্ধ যতদিন শেষ না হচ্ছে ততদিন তুই আমার মুখ দেখতে পাবি না। আমি ভালো আছি। ছেলে মেয়ের দায়িত্ব তোকে দিলাম। ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। বুবুন।
ম্যাসেজটা পাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। নিমেষের মধ্যে আমার হাতপাটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল। শরীরটা এত ভারি হয়ে গেল নড়া-চড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। তোকে কি বলবো। যেন আমি দশমনি বস্তা। মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা।
দামিনীমাসি মনে হয় বুঝতে পেরেছিল। কাছে এসে দাঁড়াল।
কার ম্যাসেজ পরলি, অনির।
মাথা দোলালাম।
শয়তান ছেলে। একবার ফিরুক। দেখাচ্ছি মজা।
মাসির কথা শুনে হেসে ফেললাম।
সিস্টার আবার তোর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসে হাজির করলো। ওদের দুধ খাওয়ালাম। মাসি ওদের দুটোকে একসঙ্গে কোলে নিয়ে আদর করলো।
বাড়িতে চল তেল মাখিয়ে তোদের শক্ত করে দেব।
মাসির কথায় আমি হাসছি।
মিটি মিটি চোখে মাসির দিকে তাকায়। আবার হাই তুললো। তোকে কি বলবো জিভটা লাল টুকটুকে। আবার ঠোঁট চাটলো। আমি যেই হাতটা নিয়ে গেছি ওমনি আমার একটা আঙুল চেপে ধরলো।
দিলো মাসির কোলে মুতে।
ওরা নিয়ে চলে গেল।
নীরু এলো চেকআপ করার জন্য।
এখনো চেকআপ করার কিছু আছে।
আছে ম্যাডাম আছে। পান থেকে চুন খসলে। ঘ্যাচাং।
কেন।
সকালের খবরটা আপটুডেট নিলাম।
কি পেলে।
ব্যাটারা নির্ঘাৎ অনির লোক। তুমি যেদিন ভর্তি হয়েছো। সেদিন মাঝরাতে নিচে বাসা বেঁধেছিল। যেই শুনেছে তোমার খাল্লাস, সেই ভেগে পরেছে।
আমি নীরুর দিকে তাকালাম। ভাবলাম তোর ম্যাসেজটা একবার ওকে দেখাই। তারপর নিজেই চেপে গেলাম।
তুমি কি আজ থাকবে।
কাল সকালে আবার চলে আসছি। কনিষ্ক, বটা থাকবে। তুমি বাড়ি ফিরে চলো তোমাকে একটা কথা বলবো।
এখন বলো।
না।
কবে ছাড়বে।
যে রকম আছো সেরকম থাকলে কাল ছেড়ে দেব।
ওরা দুজন ঠিক আছে।
তোমার থেকে ভালো আছে।
কেন।
তুমিতো বেগড়বাই করছো। ঠিক আছে গুড নাইট।
গুড নাইট।
নীরু চলে গেল।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত এগারটা।
মনটা ভীষণ আনচান করছে। অনিমেষদাকে ফোন করলাম। বুঝলি অনিমেষদা ফোন পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।
কিরে মামনি ? এত রাতে! তোর কাছে কেউ নেই ?
দামিনীমাসি আছে।
কি হয়েছে বল।
আপনার খাওয়া হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। নিউজ দেখছি। তোর শরীর।
ভাল।
বাচ্চাদুটো।
ভাল।
বল কি হয়েছে।
আপনি একবার আসবেন।
কে ফোন করেছো গো।
মিত্রা।
এতরাতে!
আমি পরিষ্কার বৌদির গলা শুনতে পেলাম।
কি হয়েছে!
মিত্রা।
হ্যাঁ বৌদি।
কি হয়েছে রে।
একবার দাদাকে নিয়ে একটু আসবে।
কি হয়েছে আগে বল।
আমি আর পারছিনা বৌদি।
আবার কান্নাকাটি করে।
তুমি দাদাকে নিয়ে একটু এসো না। একবার।
আচ্ছা যাচ্ছি।
কিছুতেই ঘুম আসছে না। কনিষ্ক এলো। আমার থম থমে মুখের দিকে তাকিয়ে। একটু অবাক হয়ে গেল।
এরকম করলে হবে না ম্যাডাম। ঘুমতে হবে।
ঘুম আসছে না কনিষ্ক।
তাহলে ইঞ্জেকসন দেব।
এখন না একটু পরে দিও।
মাসি তুমি ম্যাডামের হাতে মোবাইল দিয়েছ কেন।
শয়তানটা ম্যাসেজ করেছে।
কে!
কে আবার গুনধর।
অনি!
কই দেখি দেখি।
বুঝলি কনিষ্ক ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে মোবাইলাটা নিয়ে নিল। এক নিঃশ্বাসে ম্যাসেজটা পরে, দুহাত ওপরে তুলে একবার ঝাঁকিয়ে নিল।
শালা। বাবা হয়েছো।
অনিমেষদা আসছে।
এতরাতে!
আমি ডেকে পাঠালাম।
কাল সকালে বললে হতো না। সকাল থেকে শরীরের ওপর দিয়ে এতটা জার্ক গেল। কেন তুমি অবুঝপনা করছো।
আমি পারছিনা কনিষ্ক।
কেন এককথা বার বার বলো। আমাদেরও কি ভালো লাগছে। তবু লড়ে যেতে হবে। স্যার শুনলে আমাকে একেবারে চিঁড়ে ভাজা করে দেবে।
অনিমেষদা বৌদি সুরঞ্জনা এলো।
আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বৌদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। অনিমেষদা প্রথমে একটু ভড়কে গিয়েছিল। তারপর কনিষ্ক সব গুছিয়ে বললো।
অনিমেষদা হো হো করে হেসে ফেললো।
কাঁদিসনা মামনি। এতদিন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। তুই বিশ্বাস কর। তোর দাদা বসে থাকেনি।
অনিমেষদা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
নিজে থেকেই ইসলামভাইকে ফোন করলো।
তুমি কোথায় আছো….একবার নার্সিংহোমে এসো….না ভয়ের কিছু নেই….হ্যাঁ। রতনকে সঙ্গে এনো।
তুই একটু ঘুমো মা। বাচ্চাগুলোকে দেখতে হবে।
আমার ঘুম আসছে না।
তোকে এই বিষয়ে চিনতা করতে হবে না। আমি দেখছি।
কনিষ্ক আমাকে ইঞ্জেকসন দিল।
আজ সারাটা দিন আমার শরীরের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল।
শরীর বইছে না। লিখতে ইচ্ছে করছে না। তবু লিখছি। তুই ছাড়া আমার কে আছে বল। তাই লেখার মধ্যে দিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলি।
লেখার আগে কতো কথা মনে আসে এটা লিখব সেটা লিখব। যেই লিখতে বসি কিছুতেই মনে পরে না। অর্ধেক মনে পরে তো অর্ধেক মনে পরে না।
আজ তোর ছেলে মেয়ের ষষ্ঠীপূজ হলো।
নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর লোকের আর শেষ নেই। সারাদিন লোক আর লোক।
কাল থেকে সব এসে হাজির। সেই বিয়ের দিনের মতো। সবাই তোর ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত।
সকালে প্রথমে আসে বটাদা, হরিদা।
দুজনে সাত সকালে এসেছে লক্ষ্মী-নারায়ণকে দেখতে। দুটো সোনার চেন নিয়ে এসেছে। লকেটটা জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার। দাদা বকাবকি করলো। এতো দাম দিয়ে এসব নিয়ে আসার কি দরকার।
দুজনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তারপর দাদাকে বললো। অনেক নুন খেয়েছি। এইটুকু দিলাম। দিদিমনির দাদুর সময় এসেছি। দিদিমনির কাছে লক্ষ্মী-নারায়ণ এসেছে। তুমি রাগ করো কেন।
ওদের দুটোকে নিয়ে দুই বুড়ো কিছুক্ষণ বসে থাকল।
দুজনের খুনসুঁটি দেখে সকলে হাসে।
তারপর খেয়ে দেয়ে অফিসে চলে গেল।
তুই বিশ্বাস করবি না। দুজনের কেউ ঘুণাক্ষরেও তোর নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করল না। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম।
অনিমেষদারা সবাই এলো। প্রবীরদা একটু মন খারাপ করলো। বললো জানিষ মিত্রা এবারও ফেল করে গেলাম। সব উদ্ধার করলাম, কিন্তু ওকে পেলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম ও আছে।
নম্বরটা পেয়েছো।
পেয়েছি।
দাও একবার ট্রাই করি।
তুই কি ভেবেছিস আমি বসে ছিলাম।
যদি আমি করতে ধরে।
নম্বরটা এমন কারুর যে ওখানে বসবাস করে। সে ওকে চেনে না।
সব বলতে সে বললো আপনি ভুলভাল বলছেন, ঠিক করে নামটা বলুন তাহলে আপনাকে হেল্প করতে পারব।
নেপলারটা।
ওটা স্যুইচ অফ।
আমার পরিচিত একজনকে বলেছি। সে ওখানেই থাকে। এক সপ্তাহ টাইম নিয়েছে।
বিধানদা খালি দুজনকে চেয়ে চেয়ে দেখল। আর হাসলো।
যাই বল মিত্রা, এদুটো মনে হয় ওর বাপের মতো হবে না।
হাসলাম।
কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি বলতো।
সুরঞ্জনা তোর মেয়েকে নিয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ দেখি দৌড়ে বৌদির কাছে চলে গেল।
ধরো ধরো।
কেনরে শখ মিটে গেল।
উঃ ধরো না তুমি।
বৌদি ধরলো সুরঞ্জনা দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
তারপর দেখি তোর মেয়ে টিঁ টিঁ করে উঠেছে।
দামিনী মাসি গিয়ে ধরলো।
হেসে ফেললো।
সত্যি তোর মেয়েটে একেবারে অসভ্য। সুরঞ্জনার কোলে পটি করে দিয়েছে।
বাথরুম থেকে সুরঞ্জনা বেরতে সকলে হাসাহাসি করলো।
সুরঞ্জানা বলে প্রথমে দেখি ও চুপ করে গেল।
তারপর দেখি ওর নাকটা কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। আমার দিকে কেমন পিট পিট করে তাকিয়ে।
ভাবলাম নতুন মানুষ দেখেছে হয়তো। ওমা তারপর দেখি আমার হাতটা গরম গরম ঠেকছে। একটা পড় পড় আওয়াজ ব্যাশ মায়ের কোলে দিয়ে সিধে বাথরুম।
সুরঞ্জনা বলে সবাই হেসে গড়িয়ে পরে যায়।
জানিষ বুবুন এখন আমার সহ্য শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এখন আর সেইভাবে মন খারাপ হয় না। কেউ কিছু বললে ভাবি। চিন্তা করি কেন এই কথা বললো। নিশ্চই কোন কারণ আছে তাই।

কাকা উনা মাস্টারকে ধরে এনেছে। উনা মাস্টার নাকি তোর ষষ্ঠীপূজো করেছিল। তাই তোর ছেলে মেয়ের ষষ্ঠীপূজো সেইই করবে।
 
জ্যোতিষদাদা এসেছিল। তোর ছেলেমেয়ের জন্মের আগে দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছিল। সেই সময়তো হয় নি। তার আগেই হয়েছিল।
সব দেখে টেখে বললো মিত্রা তুই ছেলেকে আটকে রাখতে পারলেও মেয়েকে আটকে রাখতে পারবি না। এ ওর বাপের মতো স্বভাব পাবে। আর দেখবি এইই ওর বাপকে ধরে আনবে।
তারমানে! কবে মেয়ে বড় হবে তবে ওর বাবা ফিরবে!
তোকে আমি আগেই বলেছিলাম। অনি থাকবার ছেলে নয়। ও তোর জীবনে বেশি দিন থাকবে না। ওকে তুই বেশি দিন ধরে রাখতে পারবি না। একরোখা। মাথায় যেটা ঢুকবে সেটা যতোক্ষণ পর্যন্ত শেষ না দেখছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার পেছনে ও পরে থাকবে।
তোকে এও বলেছিলাম তোর দুই সন্তান হবে। তুই তখন বিশ্বাস করিস নি।
দেখ মিত্রা, কে কি বলে জানিনা। তবে পড়াশুনটা ঠিক মতো করলে কিছু বলা যায়।
না হলে নস্ত্রাদমু কি করে এতো ভবিষ্যৎবাণী করে গেল। তার কিছু তো মিলে যাচ্ছে।
তোর ছেলে শান্তশিষ্ট অতো ঘোর প্যাঁচোয়া হবে না। কিন্তু মেয়ের থেকে সাবধান। বাবার লাইফলাইন ওর ওপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করবে।
তুমি কিছু দাও।
দিয়ে লাভ নেই। ওর বাবাকে দিয়ে কিছু হয়েছে।
জ্যোতিষদা খাওয়া দাওয়া করে চলে গেল। যাওয়ার আগে বড়মার কানে ফুস মন্ত্র দিল।
তুই যখন চলে গেলি। তোকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর শুনলাম তোর ডেডবডি পাওয়া গেছে কল্যানী হাইওয়ের একটা ঝোপে।
আর সেই দিনটার কথা চিন্তা করতে ভাল লাগছে না। সেদিন কিন্তু একজনই বলেছিল তুই মরিস নি। সে হচ্ছে জ্যোতিষদাদা। তুই বেঁচে আছিস। কোথায় আছিস বলতে পারবে না। জোড় দিয়ে বলেছিল তুই বেঁচে আছিস। বড়মা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিল।
কিন্তু মন কি মানে। সব সময় কু গাইত।
বড়মার সে কি তাড়া।
তুমি আগে বলো অনির কি করলে।
ফিরে আসবে। ওর কাজ সারতে দাও।
কতদিন লাগবে।
কোন ঠিক নেই। তোমাদের আগেও বলেছি। ওকে সহজে কেউ মারতে পারবে না।
ওর গ্রহ-নক্ষত্র প্রচন্ড স্ট্রং।
ছেলের কথা বলো।
ছেলে ভালো। মেয়ে ঠিক নয়।
কেন। ওর বাপের মতো জ্বালাবে।
জ্বালাতে পারে।
ব্যাশ আগুনে ঘৃতাহুতি পরলো।
এখনি তুমি ওর একটা ব্যবস্থা করো। ডোমরা টোমরা কি লাগবে বলো।
এখন লাগবে না। যখন লাগবে বলবো।
জানিস আজ বসিরহাট থেকে সবাই এসেছিল। দাদু দিদা পর্যন্ত।
তুই চলে যাবার পর দাদুর দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদাদা অনেক ওষুধ খাইয়ে তবে স্বাভাবিক করতে পেরেছিল। বুড়ো বলে কি আমি অনির ছেলেকে না দেখে মরবো না।
বুড়ো তোর ছেলেকে মেয়েকে কোলে নিয়েছে। পারে নাকি। আমি ধরলাম। তোর মেয়ে সত্যি অভদ্র। বুড়োর কোলে মুতে দিয়েছে।
সকালবেলা উনা মাস্টার ঘন্টাদুয়েক পূজো করেছে। আমি ঠায় ওদের দুটোকে নিয়ে বসেছিলাম। কোমড় পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছিল।
শেষে সবাই লাঠি দিয়ে কুলো ভাঙলো। তোর সেই গানটা গাইল।
আট কড়াই বাট কড়াই ছেলে আছে ভাল ছেলের বাবার কাঁচা ধরে টানা টানি করো।
শুধু তুই নেই।
অনিসা আড়মোড়া ভাঙলো এতোক্ষণ ল্যাপটপের থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিল। ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একবার জানলার কাছে এলো।
নিশুতি রাত। নীচের ঝোপ থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ।
নীচের দিকে তাকাল। অন্ধকার ঘুট ঘুট করছে। ভাবল একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর ভাবল না। স্ক্যান ইমেজগুল পরে ফেলি। যতো তাড়াতাড়ি পরা শেষ করতে পারব তত জানতে পারব।
এতোক্ষণে এটা ও বুঝে গেছে ওর বাবা মরে নি। বেঁচে আছে।
টোডি কে।
রাজনাথ কে।
কেনই বা বাবা রাজনাথকে মেরেছে।
মা দামানি দাদুর কথা বলেছে। কিন্তু রাজনাথের কথা কোন দিন বলে নি।
বাবার সঙ্গে মায়ের আলাপ।
দামিনীদিদার গল্প।
দুদুন (দাদা) দিদানের (বড়মা) গল্প।
দাদাই (মল্লিকদা) দিদাই-এর (ছোটমা) গল্প।
ডাক্তারদাদাই-এর গল্প।
আবিদ আঙ্কেল কনিষ্ক মামাকে গিয়ে বলেছে, রাজনাথ মায়ের ক্ষতি করেছে!
বাবা কেনই বা টোডির পেছনে ধাওয়া করতে গেল।
মা লিখেছে। বাবা বলেছে তার ভালবাসার যে অপমান করেছে তার শোধ তুলতে গেছে।
কিসের অপমান! কেনই বা বাবা শোধ তুলতে যাবে ?
মা বলেছে বাবা এই কাগজের মালিক।
মালিকরা এরকম মস্তান হয় নাকি।
নেপলা কে ? কেনই বা নেপলা বলেছে তাকে মেরে তবে অনিদার গায়ে হাত দিতে হবে।
কিসের জন্য বাবাকে মার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে হবে।
মা কার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতি সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন অনর্গল কথা বলে।
ওকে বার করতেই হবে। এর একটা শেষ ও দেখতে চায়।
কার হেল্প নেবে ?
ইসলামদাদাই কিছু বলবে না। হেসে উড়িয়ে দেবে। আবিদ আঙ্কেলকে ধরতে হবে।
ভজুমামা বলছিল বাবার সঙ্গে থাকতো। তারমানে ভজুমামা অনেক কিছু জানে।
ঠিক আছে সব নোট ডাউন করি। একটা কোশ্চেনইয়ার তৈরি করতে হবে। এনকোয়ারি গুলো আগে লিখে রাখি, তারপর দেখা যাবে।
অনিসা আবার ডাইরীর পাতায় চোখ রাখল।
আজ সকালে ঘরে ঢুকে আমার আলমাড়িটা একটু গোচ্ছাছিলাম। সকালেই তোর ছেলে মেয়ের ডাক্তারদাদু, দুটো আলমাড়ি নিয়ে এসেছে কোথা থেকে।
দুজনের দুটো আলমাড়ি।
শোন মামনি দুজনের জিনিষপত্র সব আলাদা আলাদা রখবি। এক সঙ্গে কোন কিছু রাখবি না।
তথাস্থ।
ওদের যা জামা কাপর হয়েছে একটা আলমাড়িতে হবে না। তিনটে করে আলামাড়ি হলে ঠিক হবে। আমার এখন স্থান হয়েছে বড়মার ঘর।
দামিনী মাসি তোর ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর থেকে আর এবাড়ি ছেড়ে নরে নি। আমার দেখভাল, ছেলে-মেয়ের দেখভাল করছে। আমার ডিউটি টাইমে টাইমে গিয়ে দুধ খাওয়ান।
ডাক্তারদাদা বলেছে। বুকের দুধ ছাড়া এই মুহূর্তে কোন সিনথেটিক দুধ খাওয়ান যাবে না। রতন কোথা থেকে প্রত্যেক দিন তিনলিটার করে গরুর দুধ এনে দিয়ে যাচ্ছে।
আমাকেও একেবারে গরু বানিয়ে দিয়েছে বুঝলি। খালি খাচ্ছি আর দুধ দিয়ে যাচ্ছি। তুই থাকলে তবু কিছুটা হেল্প পেতাম। এখন দিদিভাই জ্যেঠিমনি পর্যন্ত বড়মার দলে।
চিকনা আজ পাঁচকিল সরষের তেল নিয়ে এসেছে। নিজেদের খেতের সরষেদিয়ে কাঠের ঘানিতে মেরে নিয়ে এসেছে। সে কি কাদানি কাদানি দেখতে। বোঝাই যায় না সরষের তেল। নিজে নিজেই তাকে গরম করে শুদ্ধ করলো। ভাই আর বোনের বোতল ভাগাভাগি করে দিল।
বড়মাকে বললো নিশ্চিন্তে মাখাও আমি মাসে মাসে এসে দিয়ে যাব।
চিকনা আজকাল কলকাতায় এলেই এই বাড়িতে তিন চারদিন থাকছে। কোথাও নড়ছে না। সারাক্ষণ দুটোর মুখের কাছে বসে থাকে।
আজ দেখি আমার ঘরের বারান্দায় সামনে ঘোরা ঘুরি করছে। দরজা হাট করে খোলা। বুঝলাম কিছু বলতে চায়। সুযোগ পাচ্ছে না।
ইশারায় ভেতরে ডাকলাম।
ঘরে এলো।
কিছু বলবে।
এমাসে তিনলাখ টাকা প্রফিট হয়েছে।
আমি কি করবো, তোমার গুরুকে ফোন করো।
তুই বিশ্বাস করবি না, আমিযে ওই ভাবে বলতে পারি ও বিশ্বাস করতে পারে নি। মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি খাটে গিয়ে বসলাম।
আজকাল একা একা শ্মসানে যাচ্ছ। সময় পেলেই পীরসাহেবের থানে যাচ্ছ। মাঝ রাতে কামরপাতায় গিয়ে কার সঙ্গে ফুস ফুস করে কথা বলছো।
তুই বিশ্বাস করবিনা বুবুন, একটা কথা মুখ থেকে বেরলো না।
তোর ছেলের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলো। কোন আওয়াজ হচ্ছে না। খালি ফুপিয়ে যাচ্ছে। শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছে। টপ টপ করে জল পরছে।
আমার কথার জবাব দাও। না হলে যা ভালো বোঝো নিজে করবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। ওটা তোমার আর তোমার গুরুর ব্যাপার।
ওমা দেখি আমার পা ধরে আমার কোলে মাথা রেখে। সে কি কান্না।
বলে কিনা, তুমি আমার মা। তোমাকে আমি মিছে কথা বলতে পারবো না। তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করো না।
ওর কান্নার আওয়াজে দেখি বড়মা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু অবাক হয়েছে।
বড়মাকে ইশারা করলাম। চুপ। আড়ালে যাও।
বড়মা কি বুঝলো গেটের পাশে দাঁড়াল।
কেঁদে কোন লাভ নেই চিকনা। তুমি যখন আমাকে মা বলছো, মায়ের কাছে সন্তান কিছু গোপন করে না।
আমি বলতে পারবো না। অনির খতি হবে।
আমার কোল থেকে কিছুতেই মুখ তোলে না।
বুবুন কোথায় আছে।
জানিনা।
কার সঙ্গে তুমি কথা বলো।
তনু দিদির সঙ্গে।
ওর কথা শুনে আমার সারাটা শরীর কেঁপে উঠলো। খুব জোড় সামলে নিলাম।
তনুদিদিকে তুমি পেলে কোথায় ?
অনি চিনিয়ে দিয়েছে।
কি করে চেনাল।
ও যাওয়ার আগে তনু দিদি কলকাতা এসেছিল।
তুমি সব জানতে।
জানতাম। আমি যেতে চেয়েছিলাম। আমাকে নেয় নি। বলেছে তোর এখানে অনেক কাজ।
তনু এখন কোথায় ?
লন্ডনে।
তোমার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে।
ভাইবোন যেদিন হয়েছে সেদিন।
সেদিন সকালে!
না।
তাহলে।
আগের দিন কলকাতায় এসেছিল। তারপর রাতে আমাদের ওখানে গেছিল।
তনু ওখানে গেছিল!
হ্যাঁ।
কি করে গেলো।
লাস্টট্রেনে গেছিল। আমি মটোর বাইকে করে নিয়ে যাই।
কেউ জানে না।
না।
কেন এসেছিল।
অনি কাকা-কাকীর (মা-বাব) জন্য ফুল পাঠিয়েছিল। প্রথমে শ্মশানে যাই, তারপর পীরসাহেবের থানে। ওখান থেকে কলকাতায় আসি।
কি করে এলে।
ফার্স্ট ট্রেনে।
তারপর।
তনুদিদ হাওড়া থেকে একটা মেমসাহেবের গাড়িতে উঠে চলে গেল।
কোথায় গেল।
জানি না।
তনুদিদি আমার কাছ থেক সব খবর নিয়ে দুপুরের প্লেন ধরে লন্ডন চলে যায়।
সঙ্গে আর কে ছিল।
মেমসাহেব ছাড়া আর কেউ ছিল না।
বুবুন কোথায় ?
তুমি বিশ্বাস করো, আমি জানি না। আমার সঙ্গে তনুদিদির কথা হয়। ও নাকি শুনতে পায়।
অনিসার সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন দপ দপ করছে। একটা মানুষ কেন এতটা জটিল হতে যাবে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এর মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে। যা ওর কাছে অজানা।
অনিসা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে খোলা জানলার দিকে তাকাল।
চোখ কান নাক ভোঁ ভোঁ করছে। মাথায় কিছু ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না।
কেমন যেন সব মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। কোথাথেকে যে সারারাত কেটে গেলো বুঝতেই পারল না। স্ক্যান ইমেজগুলো পরতে পরতে অনিশা কখনো হেসেছে কখনো কেঁদে ফেলেছে। কখনো ওর পিঠের শিড়দাঁড়া দিয়ে গরম শ্রোতের মতো দ্রুত কিছু ছুটে গেছে।
মা ভীষন ভাল লিখেছে। যেন মনে হচ্ছে চোখর সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে এলো। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে একবার এপাশ ওপাশ করলো। কালই আবিদ আঙ্কেলকে ধরতে হবে। ইসলামদাদাইকে এখন ঘাঁটান চলবে না। মনে হচ্ছে মিলি মাসি টিনা মাসিও এর মধ্যে ইনভলভ।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনিসা ঘুমিয়ে পরলো।
আমি রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রেটা নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলাম।
দাদা একবার আমার দিকে তাকাল। চোখমুখটা কেমন শুকনো শুকনো।
দাদা, শরীরটা খারাপ লাগছে ?
না।
তাহলে চোখমুখটা কেমন কেমন যেন লাগছে।
কাল সারারাত ঘুমোয় নি।
আমি বড়মার দিকে তাকালাম।
কেনো!
জিজ্ঞাসা কর। খালি অনন্য কোথায় গেছে ? কেনো তোমরা ওকে একা একা যেতে দিলে।
ও তো ডাক্তারদাদার সঙ্গে গেছে।
বিশ্বাস করলে তো।
ছোটমা চায়ের পট থেকে সকলকে চা ঢেলে দিল।
অনিসা উঠেছে। দাদা জিজ্ঞাসা করলো।
না।
আমি একবার দাদার দিকে তাকালম।
মেয়াটাকে ডাক।
থাকনা এইতো সবে পরীক্ষা শেষ হলো।
দাদা একবার বড়মার মুখের দিকে তাকাল।
জানো মিনু এখন এই দুটো আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বুকে যন্ত্র বসিয়ে কতদিন বেঁচে থাকা যায় বলো।
আমি মাথা নীচু করে নিলাম। ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। কাজের মাসিকে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে গেলাম….।
মিত্রা।
দাদার ডাকে ফিরে তাকালাম।

অনন্য কখন আসবে।
 
ডাক্তারদাদা বলেছে সকালের দিকেই ফিরে আসবে।
কোথায় গেছে।
বুবুনের বাড়িতে গেছে।
পরীক্ষা দিয়েই চলে গেছে!
হ্যাঁ।
তিনদিন হয়ে গেল। ফোন করেছো ?
আজ সকালে কথা হয়েছে। ডাক্তারদাদা বললো কিছুক্ষণ পর বেরবে।
ডাক্তারের কান্ডজ্ঞান দেখ, ওকে ছাড়া যাওয়া যায় না।
ডাক্তারকে দোষ দিচ্ছ কেন। ও অনেকদিন থেকে বলে রেখেছে। পরীক্ষা শেষ হলেই যাবে।
আমি দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। বেরিয়ে এলাম।
বারান্দায় আসতেই ভজু এগিয়ে এলো।
দিদিমনি ছোটবাবু কবে আসবে ?
আমি ভজুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আজ আসবে।
মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো।
ছোট দিদিমনি ঘুমচ্ছে ?
ডাকতে যাচ্ছি।
তাড়াতাড়ি ডাকো।
কেন।
ও বাড়িতে যাবে বলেছে।
আমি পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম।
দরজা ঠেলতেই হাট হয়ে খুলে গেল। অনিশা আষ্টেপৃষ্ঠে পাশবালিশ জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। এলো চুল বিছানায় লুটপুটি খাচ্ছে।
সত্যি এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। কতবার বলেছি মা শোয়ার সময় চুল বেঁধে শুবি। কে কার কথা শোনে।
আমি চেয়ে চেয়ে ওকে দেখছি। ভরা যৌবনের স্পর্শ সারাটা শরীরে। মুখটা একেবারে বুবুনের মতো। সেই চোখ সেই ঠোঁট। একেবারে বাবার মতো। মাঝে মাঝেই কথা বলতে বলতে চুপ করে যায়। স্থির চোখে দেখে।
মাস দেড়েক এই পরিবর্তনটা আরও বেশি করে চোখে পরছে।
আমি ধীরে ধীরে খাটে উঠে এলাম। অনিশার কপালে হাত রাখলাম।
এবার ওঠ মা।
অনিশা চোখ মেলে তাকাল, আমাকে গলাটা জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চকাত চকাত করে চুমু খেল।
ইস তোর মুখে গন্ধ।
অনিশা মার গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষল।
যদি অনি ব্যানার্জী চুমু খেতো, এ কথা বলতে পারতে।
আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অনিসা কি কথা বললো!
কপট গাম্ভীর্যে মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম।
ওমনি মুখটা শুকিয়ে গেল।
আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
জানো মা আজ একটা দারুণ স্বপ্ন দেখলাম।
মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম।
কি দেখলি।
মিঃ অনি ব্যানার্জী এসেছেন।
আমাকে দাদাভাইকে চিনতেই পারছে না। তোমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, মিত্রা এরা কারা। যেন আমরা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।
আমিও তেমনি গম্ভীর ভাবে বললাম আমার মাকে নাম ধরে ডাকার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে।
দেখি মিঃ অনির মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।
আপনি চিনতে পারছেন না। আমি অনিশা ব্যানার্জী আর আমার দাদা অনন্য ব্যানার্জী। আচ্ছা মা বাবার সঙ্গে তোমার কোন যোগাযোগ আছে ?
মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কল কল করছে। বুকের ভেতরটা আবার দুরু দুরু করে কেঁপে উঠলো। কি বলতে চায় ও ?
বলোনা। তোমার সঙ্গে বাবার কোন যোগাযোগ নেই ?
না।
সামথিংস রং।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি বোঝার চেষ্টা করছি।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
পিকুদা কখন আসবে ?
ও ফার্স্ট আওয়ারে অফিসে যাবে।
ভজু আমার ফোনটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
দিদিমনি, মিলিদিদি ফোন করেছে।
আমার হাতে ফোনটা দিল।
হ্যালো।
তুমি কি আজ অফিসে আসছো।
বলতে পারছি না। কেন বলতো ?
দুটো থেকে মিটিং আছে। কামিং ইয়ারের বাজেট।
তাহলে যাব। তোরা সামলাতে পারবি না ?
পারব। তবে তোমার থাকা জরুরি।
দাদার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
দশ মিনিটের জন্য। ওখান থেকে মেল এসেছে।
তাই! কখন ?
তুমি মেল চেক করনি! দেখো তোমাকেও ফরোয়ার্ড করা হয়েছে। পুরো গাইড লাইন দেওয়া রয়েছে।
এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটা অবাস্তব।
অবাস্তব বলি কি করে, আজ সতেরো বছর ধরে আমাদের সমস্ত ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে তো।
আমার আর ভাবতে ভালো লাগছে না।
তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি একবার এসো।
দেখি।
দেখিনা আসবে।
মিলি ফোনটা কেটে দিল। অনিসা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের পাতা পরছে না।
কিরে ?
মিলি মাসি ফোন করেছিল।
হ্যাঁ।
নিজের ফোনটা বালিশের তলা থেকে টেনে বার করলো। পটা পট বোতাম টিপে ডায়াল করলো।
আবিদ আঙ্কেল….এক ঘন্টার মধ্যে বাড়িতে আসবে….কি বললে….ওসব কাজ ফাজ অন্য কাউকে দিয়ে দাও। যা বলছি তাই করবে।….ঠিক আছে দেড়ঘন্টা সময় দিলাম তার বেশি হলে আমি আমারটা বুঝে নেবো….মনে থাকে যেনো। ভাইদাদাই কোথায় ?….দাও….শোনো, আবিদ আঙ্কেলের সঙ্গে তুমিও আসবে।….মনে থাকে যেনো….হ্যাঁ আমি অনি ব্যানার্জী আর কিছু জানতে চাও।
আমি মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত গলার স্বরে এরকম তীক্ষ্ণতা ছিল না। মাস খানেক হলো ওর চলন বলন একেবারে বদলে গেছে। পুরো বাপকা বেটি!
কি দেখছো।
কার সঙ্গে কথা বললি।
ভাইদাদাই-এর সঙ্গে।
তুই ইসলামভাই-এর সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলছিলি!
কি হয়েছে।
কি হয়েছে মানে!
আমার প্রয়োজন আছে তাই। এইতো নয় আজই বলছি। আজ থেকে সাতদিন আগে বলে রেখেছি। আজ যদি বলে সময় দিতে পারবে না। তাহলে হয় কি করে।
তাই বলে তুই!…….
তুমি নিচে যাও। আমি রেডি হয়ে নামছি। ভজুমামাকে বলো গাড়িটা ধুয়ে দিতে।
ভজুমামা তোর চাকর।
ঠিক আছে তোমাকে বলতে হবে না আমি বলে দিচ্ছি।
হন হন করে বারান্দায় বেরিয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠলো, ভজুমামা ভজুমামা বলে।
নিচ থেকে ভজু চেঁচিয়ে উঠলো। ও নিজের কথা বলে ভেতরে চলে এলো। হন হন করে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি কিছুক্ষণ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম।
একেবারে বাবার মতো স্বভাব। সেই তেজ। ইদানিং মাঝে মাঝে দাদাকে পর্যন্ত এমন ভাবে ক্রশ করে, দাদা পর্যন্ত চুপ করে যায়।
দাদা প্রায়ই বড়মাকে বলে, দেখেছো, নিজে কেটে পরেছে, একটা দিয়ে গেছে।
বোঝ এবার তোরা।
এটা তবু একটা পদের ওটা আরো মিট মিটে। নিজের কাজ নিজে করে যাচ্ছে। বললেই বলবে কিছু হয়নি।
কিরে মুখটা শুকনো কেন।
বড়মা কাছে এগিয়ে এলো।
নিশ্চই বুঁচকি কিছু বলেছে।
না।
তাহলে।
ও দিন দিন একেবারে বুবুনের মতো হয়ে যাচ্ছে।
আমি বড়মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলাম।
কি করবি বল। সব কপাল। তুই ওর পেট হোস নি। ও তোর পেটে হয়েছে।
আমি আর পারছি না বড়মা।
এতদিনেও ভুলতে পারছিস না।
ভুলি কি করে বলো।
ছোটমা এগিয়ে এলো।
বুঁচকি কোথায় ?
আসছে।
সোফায় এসে বসলাম। যতোক্ষণ কাজের মধ্যে থাকি, ততক্ষণ কিছু মনে হয় না। যখনই একলা হয়ে যাই। তখনি বার বার মনে পরে যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে সমস্ত দিক দিয়ে যেন আমাকে বেঁধে রেখেছে। পালাবার কোন উপায় নেই।
আবার ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম অনন্য। ফোনটা ধরলাম।
মা আমরা বাড়ির রাস্তায় ঢুকছি। তুমি টেনসন কোরো না। দুদুন ফোন করেছিল। তোমার নাকি মন খারাপ।
না।
বোন উঠেছে ?
উঠেছে।
ঠিক আছে যাচ্ছি।
আয়।
কিরে তুই কখন এলি।
এইতো মিনিট পাঁচেক।
গিয়ে একটা ফোন মারতে পারতিস।
সময় পাই নি।
খুব ঘুরেছিস।
শুধু ঘোরা। যা খেলাম না।
আমার জন্য নিয়ে এসেছিস।
দাদু আনতে দেয় নি।
অনিশা সোফায় গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।
মনে রাখিস এক মাঘে শীত যায় না।
তুই চলে যা।
অবশ্যই যাব। তোকে বলতে হবে নাকি। সময় হোক দেখতে পাবি।
তাল পাটালি খেলাম বুঝলি। ছোটঠাকুমা যা বানিয়েছিল না।
লোভ দেখাস না। তোকেই হয়তো কামরে খেয়ে নেব।
দুই ভাই বোনের তরজা চলছে। সবাই নির্বাক দর্শক। আমি হাসছি।
তুই এতো সকাল সকাল এতো ড্রেস লাগিয়ে কোথায় বেরচ্ছিস।
ডাক্তারদাদা অনিশার মুখের দিকে তাকাল।
দিদান।
বড়মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
বল কি হয়েছে।
খিদে লেগেছে। রুটি না লুচি।
কোনটা তোমার মুখে রুচবে বলো।
আমার কোন ফ্যাসিনেসন নেই, তোমার নাতির আছে।
আমি মেয়ের দিকে তাকালাম।
তাকিয়ে কোন লাভ নেই। যা বলছি সত্যি বলছি।
তুই আমার কথার উত্তর দিলি না। ডাক্তারদাদা বললো।
এখনো সময় হয় নি। খাওয়ার টেবিলে প্রশ্ন করবে উত্তর পাবে।
তুমিই আদর দিয়ে ওদের মাথায় তুলেছো।
দাদা ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে বললো।
অনিশা কট কট করে দাদার দিকে তাকাল।
রাতে ডেকো দিদিভাই বলে, সেলো টেপ আটকে দেব।
দাদা অনিশার কথা শুনে হেসে ফেললো।
হ্যাঁরে বুঁচকি সকালে মাকে কি বলেছিস।
অনিসা ছোটমার দিকে তাকাল।
কই। কিছু বলিনি।
আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।
তুমি রাগ করেছো। ঠিক আছে আর কোনদিন হবে না।
আমি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
দাদা তুই আজ কোথায় যাবি।
এখন খাবো দাবো, তারপর ঘুম।
দুপুরে স্নান করে খাওয়া, তারপর দাদাই-এর সাথে দামিনীদিদার ওখানে।
কিগো দিদান তোমার হলো।
কেন ঘোঁড়ায় জিন দেওয়া আছে।
হ্যাঁ আছে।
বড়মা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রাখল।

দাদা তুই আজ দিদাই-এর পাশে আমি দিদানের পাশে। নো ঝামেলা।
 
দিদানের ভাগ আমার।
ঠিক আছে মায়েরটা আমার।
কেন তুই দুটো নিবি।
আর বক বক করতে হবে না। এবার এসে বসে পরো।
বড়মা খেঁক করে উঠলো।
সবাই এসে বসে পরলো।
দাদা ওদিকের দুটো চেয়ার খালি রাখিস।
কেন।
ইসলামদাদাই, আবিদ আঙ্কেল আসবে।
কেনরে।
সব কেনর উত্তর হয় না।
বাবাঃ তুই আজ বেশ স্মার্টলি কথা বলছিস। মল্লিকদা বললো।

বয়স হোক বুঝতে পারবে।
ডাক্তারদাদা জোরে হেসে ফেললো।
হেসো না হেসো না বুড়ো, তোমরও সময় আসবে, মনে রেখো।
বান্ধবী ওকে একটু পাটালি দিও।
সত্যি নিয়ে এসেছো!
অনিশা ছুটে গিয়ে ডাক্তারদাদার গলা জড়িয়ে ধরলো।
সরি।
তাহলে এবার বল। এতো সব ড্রেস-ট্রেস লাগিয়ে কোথায় যাচ্ছিস।
প্রথমে একটু আবিদ আঙ্কেলকে নিয়ে বেরোব। তারপর অফিস।
অফিসে কি করতে যাবি ?
তোমাকে এখন বলবো না। সময় হোক তারপর বলবো।
এখনো সময় হয় নি।
শুরুই করলাম না।
কি শুরু করবি।
একটা কাজ স্টর্ট করছি বুঝলে দাদাই। বলতে পারো রিসার্চ ওয়ার্ক।
সাবজেক্ট ?
অনিশা ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো।
একজনের ওপর।
পরিচিত না অপরিচিত।
নাম বলা যাবে না।
কেন!
বড়মা আমি মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
আমি তোকে সাহায্য করতে পারি ?
অবশ্যই তোমাকে লাগবে। তবে ইনিসিয়ালি লাগবে না।
অনিশা প্রথমেই মায়ের পাত থেকে একটা আলুর দমের আলু তুলে নিল। অনন্য একবার কট কট করে তাকাল।
এদিকে তাকাবি না তুই দিদান। আমি দিদাই-মা অনেক খেয়ে এসেছিস ওখান থেকে।
মিত্রার মনে পরে যাচ্ছে বুবুনের কথা। ও ঠিক খেতে বসে এরকম করতো। তখন মিত্রা ছোটমার ভাগেরটা আর বুবুন বড়মার। মিত্রা মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।
কিরে খাচ্ছিস না কেন।
মিত্রা বড়মার দিকে একবার তাকাল।
বড়মা বুঝতে পারলো। মুখে কিছু বললো না।
অনিশা কিছুই লক্ষ করলো না।
আচ্ছা দুদুন তোমাকে বাবা ভয় পেত।
দাদা অনিশার দিকে তাকাল।
কেন বলতো ?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
ভয় পেতো না। তবে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো।
ওই হলো, শ্রদ্ধার আর এক নাম ভয়।
তুই কি করে বুঝলি।
ডাক্তারদাদা অনিশার দিকে তাকাল।
যান দাদাই কয়েকদিন ঠেসে পড়াশুন করলাম। হাতের সামনে যা পেলাম তাই পরলাম।
কি কি পরলি।
গোটা দশেক উপন্যাস পরে ফেললাম। সব এ্যাডভেঞ্চার। তার মধ্যে দুটো জেমস বন্ড।
কোথায় পেলি।
কেন, নেটে।
তা হঠাৎ জেমস বন্ড।
তোমাদের মুখ থেকে বাবার কিছু ঘটনা শুনেছিলাম। তাতে মনে হলো বাবা জেমস বন্ডের মতো।
একটু থেমে।
বাবার মাথাটা ভীষণ কাজ করতো।
তোরও কাজ করতে শুরু করেছে।
অনিশা ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
তুমি কি করে বুঝলে।
ওই যে বললি বয়স হোক।
তুমি বহুত চালাক পুরিয়া আছ।
ডাক্তারদাদা জোড়ে জোড়ে হাসছে।
হেসো না। হেসো না।
তোর বাবা এই সময় হলে কি করতো বলতো।
কি করতো ?
চুপ করে যেতো। আস্তে করে প্রসঙ্গটাই পাল্টে দিতো। ওই প্রসঙ্গটার মধ্যেই আর ঢুকতো না।
গুড এন্টিসিপেসন।
একটা জিনিষ শিখলি বল।
সিওর।
মিত্রা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
আজ তুই অফিসে গিয়ে তোর বাবার পাস্ট লাইফ নিয়ে ঘাঁটা ঘাঁটি করতে চাস।
মোটেই না। ওখানে ঢুকলে তল খুঁজে পাব না। তার থেকে বেশ আছি। ও সব মা বুঝবে।
তোর শেখাটা বেশ ভালো ইমপ্লিমেন্ট করলি।
অনিশা একবার ঠান্ডা চোখে ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
ডাক্তারদাদা বললো।
এ্যাম আই রাইট অর রং।
রং।
দিস ইজ ট্রু।
অফকোর্স।
সার্টেনলি নট।
প্রমাণ পেয়ে যাবে।
সবাই শ্রোতা। একমাত্র ডাক্তারদাদার সঙ্গে অনিসার ডুয়েট চলছে।
মিত্রা সব বুঝতে না পারলেও কিছু কিছু বুঝতে পারছে। ডাক্তারদাদা অনিশার মনের কথাটা ধরে ফেলেছে। মনে মনে বললো ওরে ডাক্তারদাদাই তোর বাবার চাল মাঝে মাঝে ধরে ফেলত, আর তুই কোন ছাড়। তোর নাক টিপলে এখনো দুধ বেরবে।
ইসলামভাই আবিদ এসে ঘরে ঢুকলো।
বড়মা বললো চেয়ার খালি আছে বসে পরো।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকালো।
চুবরি ঢাকা দেওয়া আছে তুলে বসে পরো।
সব একেবারে রেডি।
তোমার গুণমন্ত্র নাতনিকে জিজ্ঞাসা করো।
কেন ও সব রেডি করে রাখতে বলেছে।
হ্যাঁ ঘোড়ায় জিন দেওয়া আছে।
যাই বলো দিদি অনিশা আজ পাঞ্জাবীটা দারুণ লাগিয়েছে।
তোমার পছন্দ।
অনিসা ইসলামভাই-এর দিকে তাকাল।
পাঞ্জাবীটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
বাবার। মাকে বললাম, বাবার পাঞ্জাবীগুলো পরে পরে নষ্ট হচ্ছে, দাওতো একটা পড়ি।
তাই বল।
মিত্রা মেয়ের কথায় হাসছে।
তুই হাসছিস কেন মামনি। ইসলামভাই বললো।
ওকে জিজ্ঞাসা করো।
মা প্রথমে দিতে চায় নি। আমি জোর করে নিয়েছি তাই।
আমার জন্য একটা বার করে দেবে। অনন্য পাশ থেকে বলে উঠলো।
কেন তোর সখ হয়েছে।
অনিশা টিপ্পনি কাটলো।
তোর সখ হতে পারে, আমার হয় না।
ঠিক আছে, মা আমি যেগুলো বেছে রেখেছি সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য গুলো দেবে।
কেন।
যা না ঘুরতে যা।
অনন্য গুম করে একটা ঘুসি দিল বোনের পিঠে।
ছোটমা অনন্যর কান ধরলো।
বোন এখন বরো হয়ে গেছে।
অনন্য উঃ আঃ করে চেঁচিয়ে উঠলো।
যা আমি এখানে বসে খাবোই না। আমি দাদাই-এর পাশে গিয়ে বসবো।
অনিসা উঠে চলে গেল।
বোস। তিনজনেরটা আমার।
তুই তিন আমি পাঁচ।
মিত্রা দুজনের দিকে চেয়ে আছে। মনে মনে হাসছে।
আবিদ আঙ্কেল তাড়াতারি সাঁটাও, বেরতে হবে।
আমার কিন্তু আজ অনেক কাজ।
আমাকে দুটো পর্যন্ত সময় দেবে। তারপর তোমার ছুটি।
আমার কাজটা কি বল।
ইসলামভাই বললো।
ভেবেছিলাম তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে বসবো। আজ ওটা ক্যানসেল করলাম।
তাহলে আমার ছুটি।
হ্যাঁ। তবে ফোন করতে পারি। প্রোগ্রাম চেঞ্জ হতে পারে।
তুই যাবি কোথায় বল ?
দাদা জিজ্ঞাসা করলো।
একটু ঘুরতে বেরবো।
কোথায় ?
তোমাকে বলতে যাব কেন।
ইসলাম ও একজনের সম্বন্ধে রিসার্চ শুরু করছে। তোমাকে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করবে।
অনিশা ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
দাদাই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অনিশা পাটালিটা হাতে নিয়ে মায়ের কাছে এলো। মায়ের মুখের কাছে এগিয়ে দিয়ে বললো।
কামড়াও।
মিত্রা একটু কামড় দিল।
কেমন টেস্ট বলো।
মিত্রা হাসছে।
মাকে ঘুস দিলি।
বড়মা বলে উঠলো।
ঘুস ঠিক না। শেয়ার করলাম।
পাটালিটা কেমন খেলি বল।
ডাক্তারদাদা বললো।
দারুণ।
তোর একটা থ্যাঙ্কস দেওয়া উচিত চিলো।
ডিউ স্লিপ দিলাম।
অনিশার কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠলো।
অনিশা বেসিনের দিকে চলে গেল। হাত ধুয়ে ঘরের বাইরে চলে এলো। সোজা নিজের ঘরে। ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে তর তর করে নিচে নেমে এলো। মায়ের ঘরে ঢুকলো।
পায়ে পায়ে ববার ফটোটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এক দৃষ্টে বাবার চোখের দিকে তাকাল।
কাল তোমার কিছু জিনিষ পরলাম। আজ চেষ্টা করবো শেষ করতে। তোমার সঙ্গে আমার অনেক বোঝা পড়া আছে।
দাঁতে দাঁত চিপে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো। আই মাস্ট উইন দ্যাট গেম। আই মাস্ট ডু ইট।
টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলো।
ঘুরে দাঁড়াতেই মায়ের মুখো মুখি হলো। মা এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে।
কি বললি বাবাকে।
অনিসা মাথা নীচু করলো।
নীচু হয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
কি হয়েছে বল।
কিছু না।
প্রণাম করলি যে।
একটা শুভ কাজে যাচ্ছি, তাই।
বলা যাবে না।
এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত।
মাকেও বলা যাবে না।
সময় হোক বলবো। তুমি আমাকে বাধা দিও না।
আমার যে হারাবার ভয়।
আমি বাবার মতো ভীরু নয়।
মিত্রা মেয়ের মুখটা চেপে ধরলো।
অনিশা মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মায়ের চোখদুটো ছল ছল করছে।
সারাজীবন কেঁদেছ। কিছু করতে পেরেছ।
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বুঝলো ওর হাতের বাইরে মেয়ে চলে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু উপায় নেই। দোষ ওর। ওর বাবার সম্বন্ধে অনেক কিছু ও গোপন করেছে।
তুমি কাঁদো, আমি আসি। তবে তোমায় একটা কথা দিলাম। কাজটা আমি করবোই। সময় নেবো ওনলি থ্রি মান্থস।
আবিদ আঙ্কেল আমরা প্রথমে যাব প্রিন্সেপঘাট।
ওখানে কি করতে যাবি।
গঙ্গার হাওয়া খেতে।
আবিদ একবার অনিশার দিকে তাকাল। ভাইঝির মতি গতি ঠিক ভাল ঠেকছে না। মনে হচ্ছে ও নিশ্চই একটা কিছুর গন্ধ পেয়েছে।
আবিদ বুঝতে পারল, এবার অনিশা ওকে ছাড়বে না।
আবিদও মনে মনে ঠিক করলো সড়াসরি ওকে ধরা দেবে না।
আবিদ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় অনিসা একটা কথাও আবিদের সঙ্গে বললো না। শুধু ভিউংগ্লাস দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
প্রিন্সেপঘাটে গাড়িটা দাঁড় করাতেই পরিচিত সব মুখগুলো দূর থেকে আবিদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সবাই দেখছে। অনেকে আবিদকে দেখে কাছে আসতে চাইল আবিদ ইশারায় সকলকে না বলে দিল।
অনিশা গাড়ি থেকে নেমে এলো।
আবিদ ভাইঝির দিকে তাকাল আজ অনিদার পাঞ্জাবী আর জিনসের প্যান্টটা পরে ওকে দারুণ লাগছে। চোখে একটা সানগ্লাস লেগিয়েছে। হাইট অনেকটা অনিদার মতো। অতোটা না হলেও মেয়েদের জেনারেল হাইটের থেকে ও একটু লম্বা। ওর মাথার লম্বাচুল পিঠ ছড়িয়ে পরেছে। হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুলটা আটকান। ঠিক কালো নয়। একটু ব্রাউনিস।
কোথায় যাবি ?
অনিসা আবিদের সামনে এসে দাঁড়াল।
তুমি বলোতো আবিদ আঙ্কেল আমি হঠাৎ এখানে এলাম কেন।
কি করে জানবো, তুই বললি একটু ঘুরতে যাব গঙ্গার ধারে, তাই এলাম।
তার জন্য তোমাকে সঙ্গে নেব কেন। ভজুমামাকে নিয়ে চলে আসতে পারতাম।
আবিদ ভাইঝির মনের কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো। পোড় খাওয়া আবিদ অনিসার চোখের ভাষা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না।
তাকিয়ে আছো কেন, আমার কথার উত্তর দিলে না।
আমার মাথাটা তোর মতো পরিষ্কার নয়। আমি তোর মতো লেখাপড়া শিখি নি।
বাবা এখানে এসে কোথায় বসতো। তোমার সঙ্গে কোথায় বসে কথা বলতো।
আবিদ চমকে তাকাল ভাইঝির দিকে।
আমাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে চলো।
আবিদ এবার মাথা নীচু করলো।
নিয়ে যাবে না ?
কি করবি ওখানে গিয়ে।
তোমার সঙ্গে বসে দু’ঘন্টা গল্প করবো।
এখানে না বসে অন্য কোথাও যাই চল।
কেন!
জায়গাটা ভাল নয়।
বাবা কেন এই খারাপ জায়গায় তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসত ?
তোর বাবা সাংবাদিক। সংবাদ সংগ্রহ করতে আসত।
আমিও নিউজ কালেক্ট করতে এসেছি।
আবারও আবিদ চমকে উঠলো।

চলো।
 
এবার আবিদ আর না করলো না। পায়ে পায়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে এগিয়ে এলো। পাঁচিলের ধারে সেই বেঞ্চটায় গিয়ে বসলো।
অনিসা বসলো না। চারদিকটা একবার ঘুরে ঘুরে দেখলো। নিজের মোবাইলে ছবি তুলে নিল। স্টিল ভিডিও।
বুঝলে আবিদ আঙ্কেল বাবার টেস্ট ছিল।
আবিদ চেয়ে চেয়ে ভাইঝির রকম সকম দেখছে। একেবারে ডিটো অনিদার চোখ। সব সময় যেন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে।
আবিদ আঙ্কেল বাবা এখানে এসে বসলে তুমি বাবাকে বাদাম দিতে আসতে। তোমাকে দেখে কেউ বাদাম দিতে আসছে না কেন।
আমাকে কেউ চেনে না। তাই।
ইকবাল দাদাই-এর নৌক কোনটা।
আমি চিনি না।
ভাইদাদাই-এর বুজুম ফ্রেন্ড। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর তুমি চেন না। তা হয় ? আমাকে লুকিয় না আমি সব জানি। বলতে পার জেনে ফেলেছি।
আবিদ চুপ করে থাকলো।
আমাকে একটু বাদাম খাওয়াও।
অনেক বাদাম ওয়ালা আছে ডেকে নে।
আমি ডাকবো না তুমি ডাকো।
আমি ডাকলে আসবে না।
কেন আসবে না। তোমাকে সবাই চেনে বলে।
তুই কি করে জানলি।
আমি জেনেছি। কি করে জেনেছি তোমাকে বলবো না।
তাহলে আমিও বলবো না।
অনিসা আবিদের কোল ঘেঁসে বসলো। আবিদের মুখের দিকে তাকাল।
তুমি ধরা পরে গেছো। তোমার মুখ বলছে। আমার দিকে তাকাও।
আবিদ ভাইঝির মুখের দিকে তাকাল।
আমি বাবাকে ছবিতে দেখেছি। তোমরা বাবার কাছে থেকেছো। বাবার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছো। বলোনা বাবা কোথায় আছে ?
আবিদের চোখটা হয়তো ছল ছল করে উঠেছিল। নিজেকে সামলে নিল।
তুমিই তো কনিষ্ক মামাকে প্রথমে বলেছিলে, বাবা মরে নি বাবা বেঁচে আছে। বাবাকে সহজে কেউ মারতে পারবে না।
আবিদ এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।
ধমকে উঠলো, তুই চুপ করবি।
আমি চুপ করার জন্য আসি নি। আমার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতে হবে।
আমি জানি না যা।
তুমি চলে যাও, আমি একা এখানে থাকব।
না তোর এখানে থাকা হবে না।
তাহলে ইকবালদাদাই-এর কাছে নিয়ে চলো।
ইকবালভাই এখানে নেই।
আছে। বাবা ইকবালভাই-এর আত্মীয়ের কাছে আছে।
তুই ভুল জানিষ।
ঠিকটা তাহলে কি বলো।
আবিদ চুপ করে রইলো।
অনিসা লক্ষ করেছে এরি মধ্যে দু’চারজন সাদা ধুতি পাঞ্জাবী ওয়ালা বাদাম ওয়ালা ওদের দিকে তাকাতে তাকাতে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেছে। সকলের চোখে একটা সন্দেহ।
এক কাজ করো।
বল।
তুমি আমাকে ইকবালদাদাই-এর কাছে নিয়ে চলো। তারপর তোমার ছুটি।
তুই অফিসে চল।
আমি একা চলে যেতে পারব। তুমি চলে যাও।
আবিদ কিছুক্ষণ অনিসার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
অনিসা মুচকি মুচকি হাসছে।
তুমি হেল্প না করলে আমি ঠিক খুঁজে নেবো। তখন তুমি কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।
আচ্ছাই তো পাগলকে নিয়ে পরলাম।
অনিসা হাসছে।
ঠিক আছে চল কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারবি না।
ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবেতে হবে না। ওটা আমি বুঝে নেব।
ইসলামভাইকে একটা ফোন কর।
ফোন করতে হবে না। আমি তোমাকে নিয়ে কোথায় এসেছি। খবর চলে গেছে।
কি করে বুঝলি।
আমি অনি ব্যানার্জীর মেয়ে, তাই।
আবিদ হেসে ফেললো।
খুব পাকা পাকা কথা শিখেছিস। দেবো একটা ঝাঁপ্পড়।
তুমি মারতেই পারবে না।
তুই ইকবালভাই-এর কথা জানলি কি করে।
তোমাকে সব বলবো, আগে একটু গুছিয়ে নিই।
আবিদ উঠে দাঁড়াল। ঠিক আছে চল।
অনিসা আবিদকে জড়িয়ে ধরলো।
এইতো গুড বয়। আর একটা কথা আছে আঙ্কেল।
বল।
তুমি কাউকে বলতে পারবে না।
কি।
আমি কোথায় যাচ্ছি কি করছি।
এইতো বললি ভাইদাদাই সব জানতে পারছে।
পারবে না।
কেন।
সে তোমাকে পরে বলবো।
সব পরে বললে আমি কি উত্তর দেবো।
তোমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না।
অনিসা আবিদের হাত ধরে গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
গাড়িটা ওখানে থাকবে।
ও কিছু হবে না।
তারমানে!
আমিতো বললাম কিছু হবে না।
তোমার দেখার লোক আছে।
আবিদ হেসে ফেললো।
তুইতো বহুত জালাস। আছে। হয়েছে এবার।
অনিসা হাসছে।
এবার বাদাম খাওয়াও।
যেখানে যাচ্ছিস সেখানে খাওয়াবে।
তোমাকে এখানে কারা কারা চেনে একটু দেখাবে না।
একটু অপেক্ষা কর জানতে পারবি।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা মসজিদের সামনে এসে দাঁড়াল। আবিদকে দেখে অনেকেই আসলাম আলেকম সালাম বলছে। আবিদও আলেকম সালাম বলছে।
অনিসা চেয়ে চেয়ে দেখছে। ও শুনেছে বাবা ধর্ম বলে কিছু মানতো না। বাবার কাছে সব ধর্ম সমান। অনিসা শুনেছে বাবা নাকি একসময় ইসলামদাদাইকে কি একটা জটিল ব্যাপার থেকে বাঁচিয়েছে। কেউ ওকে ভেঙে বলেনি সব ভাসা ভাসা। সেই থেকে নাকি ইসলামদাদাই বাবাকে খুব ভালবাসে। আবিদ আঙ্কেল রতন আঙ্কেলও বাবার খুব নেওটা।
তুই এখানে একটু দাঁড়া, আমি ভেতর থেকে আসছি।
অনিসা মাথা ঝাঁকালো।
আবিদ ভেতরে চলেগেলো।
অনিসা চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। কতো লোক নমাজ পরে বেরচ্ছে, আবার কতো লোক নমাজ পরতে যাচ্ছে। সবই কি রকম এক ছন্দে বাঁধা। কেউ কেউ ওকে যে দেখছেনা তা নয়। অনিসা গা করলো না।
হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাতেই ও দেখলো একটা সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পড়া বাদামওয়ালা আস্তে করে নিজেকে আড়াল করে নিলো। অনিসা বুঝলো এ আবিদ আঙ্কেলের লোক।
অনিসা চারদিক ভালো করে দেখছে। কেউ কিন্তু ওকে কোন প্রশ্ন করছে না। কিছুক্ষণ পর একজন সাদা লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবী মুখ ময় সাদা দাড়ি ফর্সা একজন আবিদ আঙ্কেলের সঙ্গে মসজিদের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা এসে ওর সামনে দাঁড়াল।
দেখো চিন্তে পার কিনা।
অনিসা মনে মনে ভেবে নিলো এ নিশ্চই ইকবালদাদাই।
নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
থাক থাক মা।
অনিসা সোজাসুজি ইকবালদাদাই-এর চোখে চোখ রাখলো। চেখদুটো কি অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে।
মুখটা বড়ো চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিন্তে পারছি না।
অনিসা হাসছে।
ভালো করে মুখটা দেখো চিন্তে পারবে।
কে বলতো, অনির কেউ ?
অনিদার মেয়ে।
এবার বুড়ো আবেগে অনিসাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
তুই এতোবড়ে হয়েগেছিস!
অনিসার কপালে চুমু খেলো।
কতোদিন পর তোকে দেখছি। তুই যখন ছোট ছিলি তখন ইসলাম তোকে একবার নিয়ে এসেছিল। আর তুই যেদিন জন্মেছিলি সেদিন দেখতে গেছিলাম। আয় আয় ভেতরে আয়।
অনিসা ইকবালদাদাই-এর বুক থেকে উন্মুক্ত হলো।
ওর অনেক প্রশ্ন, আমি তার একটারও উত্তর দিতে পারব না। তুমি পারলে দাও।
ইকবালভাই হাসছে।
আবিদ অনিসার দিকে তাকাল।
এবার আমি যাই।
যাও।
আবিদ হাসছে।
কাজ হয়েগেছে তাই না।
অনিসা মাথা দোলাচ্ছে।
মসজিদের পেছনে একটা ছোট্ট ঘরে ওরা তিনজনে এলো। সাধারণ একটা ঘর। কয়েকজন ঘরে বসে আছে। ইকবালভাই নিজের আসনে গিয়ে বসলো।
আয় মা আয় এখানে এসে বোস।
ইকবালভাই নিজের পাশে জায়গা দেখাল।
অনিসা গিয়ে ইকবালভাই-এর পাশে গিয়ে বসলো।
আবিদ একবার সেলিমকে ডাক না।
আবিদ বেরিয়ে গেল।
ইকবালদাদাই যারা বসেছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
অনিসা বুঝতে পারলো, এখানে যারা এসেছে তারা তাদের নানা সমস্যা নিয়ে এসেছে ইকবালদাদাই-এর কাছে। বেশ মজা লাগছিল অনিসার।
কারুর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। কোন বাচ্চাটা রাতে ভয়পায়। আরও কতো সমস্যা।
ইকবালদাদাই কাউকে মাদুলি দিচ্ছে, কাউকে জলের বোতলে মন্ত্র পড়ে দিচ্ছে। কাউকে বলছে একটা ধুপের প্যাকেট কিনে নিয়ে আয়। আমি ফুঁ দিয়ে দিই। সবাই সরল বিশ্বাসে সেইগুলো নিয়ে আসছে। ইকবালদাদাই তা মন্ত্রপূতঃ করে দিচ্ছে, ওরা সেইগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আবিদ আঙ্কেল একজনকে নিয়ে ঘরে এলো। তাকে দেখতে বেশ সুন্দর। ইকবালদাদাই-এর মতো পোষাক পরা। কিন্তু বয়সটা আবিদ আঙ্কেলের মতো।
আয় সেলিম। দেখ একে চিনতে পারিস কিনা।
সেলিম অনিসার দিকে কিছুক্ষণ তাকাল। কিছুটা সন্দেহের চোখে।
মুখের আদলটা অনেকটা অনিদার মতো লাগছে। অনিদার কেউ ?
অনির মেয়ে।
অনিসা উঠে দাঁড়াল। প্রণাম করার জন্য নীচু হলো। সেলিম ওর হাতটা চেপে ধরলো।
একবারে বাপের মতো। গুরুজন দেখলেই কোমড় নীচু করে ফেলবে।
ওরে সেলিম রক্তের দোষটা যাবে কোথায় বল।
সবাই ইকবালদাদাই-এর কথায় হাসছে।
সেলিম ওকে নিয়ে গিয়ে কিছু খেতে দে। তারপর আমি যাচ্ছি।
চল।
ইকবালভাই এবার আমি যাই। অবিদ আঙ্কেল বললো।
দাঁড়া, যাস নি। কিছু কথা আছে।
তাড়াতারি এসো।
যা যাচ্ছি।
অনিসারা চলে এলো।
তিনজনে গিয়ে সেলিম আঙ্কেলের ঘরে গিয়ে বসলো। সেলিম আঙ্কেল ঘড়ে ঢোকার সময় একজনকে ডেকে কিছু বললো। তারপর ভেতরে এলো।
হ্যাঁরে তোর নাম কি।
অনিসা।
বাবাঃ তুই একবারে তোর বাবার নামে নাম রেখেছিস।
আমার বাবতো নেই।
কে বললো তোর বাবা নেই।
আমিতো জম্মের পর থেকে বাবাকে দেখলামই না।
তোর বাবা তোকে দেখে।
ওপর থেকে।
সেলিম আঙ্কেল জিভ বার করলো।
ও কথা বলতে নেই।
তুমি আমার বাবাকে একটু দেখাবে।
সেলিম আঙ্কেল হাসছে।
তুই ভীষণ চালাক।
কেন।
তুই মন থেকে তোর বাবাকে দেখতে চাইছিস। একটু অপেক্ষা কর সময় হলেই তোর বাবাকে দেখতে পাবি।
অনিসা বুঝতে পারল সেলিম আঙ্কেল কথাটা ঘোরাবার চেষ্টা করলো।
তুমি কি করে জানলে।
জানি বলেই বলছি।
আমার সঙ্গে বাবার একবার কথা বলিয়ে দেবে।
তোর বাবা বলবে না।
কেন।
তোর বাবা এখন সাধনা করছে। একটু ধৈর্য ধর চলে আসবে।
তোমরা সবাই বলো বাবা আছে। কোথায় আছে আমাকে একটু বলো না। আমি ঠিক চলে যাব। মাঝে মাঝে বাবার জন্য খুব মন খারাপ হয়।
অনিসার গলাটা ধরে এলো।
সেলিম কাছে এগিয়ে এলো।
তোর মন খারাপ হয় তোর বাবার হয় না ?
সেলিম অনিসার মাথায় হাত রাখল।
তুই তো খোঁজার চেষ্টা করছিস।
অনিসা ডাগর চোখে সেলিমের দিকে তাকাল।
আস্তে করে মাথা দোলাল।
তোর বাবা তোকে কিছুদিনের মধ্যে নিজে থেকে রেসপন্স করবে।
আমি বিশ্বাস করি না।
রেসপন্স করলে বিশ্বাস করবি।
হ্যাঁ।
ইকবালদাদাই ঘরে ঢুকলো।
কিরে মা চোখ ছল ছল করছে কেন।
ওর বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
শক্ত কাজ।
কেন ও কথা বলছো।
মনে এলো তাই।
জানো দাদাই মা কাল রাতে বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাঁদছিল। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হয়।
তোর বাবা তোর মায়ের কাজ করতে গেছে।
এমন কি কাজ বাবার সতেরো বছর সময় লাগছে।
হয়ে এসেছে। আর মাস তিনেক সময় লাগবে হয়তো। কেন তোর মা সব জানে।
মা যে বলে এখন আমার আর বিশ্বাস হয় না।
সেটাও মিছে কথা বলে না।
তাহলে সত্যিটা বলো।
তুই আমাকে চিনলি কি করে।
তুমি আমাকে বাবার কথা না বললে, আমি তোমাকে বলবো কেন।
ওরে দুষ্টু মেয়ে। বাবার মতো প্ল্যান করেছ।
সবাই তোমরা আমাকে বাবার মতো বলো কেন আমি আমার মতো হতে পারি না।
তুই তোর মতো। কেন তুই বাবার মতো হতে যাবি। তুই তোর বাবার থেকেও আরও বড়ো হবি। আমি বলছি। আমি সব শুনেছি।
আমার সঙ্গে বাবার একটু কথা বলিয়ে দাও না।
সেটা পারব না।
কেন! বাবাকে তোমরা ভয় পাও।
ইকবালদাদাই হেসে ফেললো।
তা বলতে পারিস। ভয়ও পাই আবার ভালোবাসি।
সবার এক কথা।
অনিসা মাথা নীচু করে থাকলো।
যাও তোমাদের কিছু বলতে হবে না। আমার বাবাকে আমিই খুঁজে বার করবো।
এইতো তুই তোর বাবার মতো কথা বলছিস।
অনিসা একবার ইকবালদাদাই-এর দিকে তাকাল।
চোখ দুটো চক চক করছে। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। সৌম্য মুখটায় কোন উত্তজনা নেই।
ধর তোর বাবা যদি এক্ষুনি তোর সামনে এসে দাঁড়ায় তুই চিনতে পারবি।
অনিসা ইকবালদাদাই-এর চোখে চোখ রাখলো।
তোর চোখ বলছে তুই পারবি না। তাই তো।
হ্যাঁ।
আগে তুই এইটুকু চিনতে শেখ দেখবি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
অনিসা ইকবালদাদাই-এর চোখ থেকে চোখ সরাল না। মনে মনে ভাবল, বুড়ো তুমি বহুত গভীর জলের মাছ, আমি তোমাকে জালে ধরতে না পারি ডুব সাঁতারে ধরবার চেষ্টা করবো। তবে তোমায় কথা দিচ্ছি তোমরা সাহায্য করো আর না করো আমি আমার বাবাকে খুঁজে বার করবো।
কিরে তুই ওরকম ঠান্ডা হয়ে গেলি।

না মানে।….
 
একজন একটা ট্রেতে করে সরবতের গ্লাস নিয়ে এলো। প্রথমে অনিসাকে দিল। অনিসা হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নিল। তারপর সবাই নিল।
এই সরবৎটা এরকম দেখতে কেন।
তোর বাবা খেতে খুব ভালবাসতো। পেস্তা আর বাদাম দিয়ে তৈরি।
বাবা খেতে ভালবাসতো বাবাকে দেবে, আমাকে দিচ্ছো কেন।
তুই বাবার রিপ্রেজেন্টেটিভ। তাই।
ইকবালদাদাই-এর কথায় অনিসা চুপ করে গেল।
জানিস নিসা।
অনিসা ইকবালদাদাই-এর দিকে তাকালো।
তোকে এই নামে আজ থেকে ডাকবো।
অনিসা হাসলো।
তুই যে মসজিদে বসে আছিস। এটা তোর বাবার পয়সায় তৈরি। বিশ্বাস করবি।
অনিসা অবাক হয়া গেল।
আজ এখানকার কেউ জানে না তুই অনির মেয়ে। যদি জানতে পারে এখানে তোকে দেখার জন্য ভিড় হয়ে যাবে। ভাবছিস ইকবালদাদাই কি সব আজে বাজে কথা বলছে।
হ্যাঁরে, আজেবাজে কথা।
তোর বাবা এখানে নেই তবে সবার মনের মধ্যে আছে।
তার কাজ সবার মন চুরি করে নিয়েছে।
দেখেতো মনে হচ্ছে এই মসজিদটার বয়স আট দশ বছর। তাই না।
অনিসা মাথা দোলালো।
তোর কথা ঠিক। তুই খোঁজ কর জানতে পারবি। তোর বাবা সব সময় চাইতো কারুর ওপর নির্ভরশীল হবে না। নিজে থেকে জানার চেষ্টা করো জানতে পারবে। পারলে সাহায্য নাও।
আমি একসময় গঙ্গায় নৌক চালাতাম। আজ আমি এই মসজিদের ইমাম। তোদের ধর্মমতে এই মন্দিরের পুরোহিত। এটাও তোর বাবার অনুপ্রেরণায়।
আজ ইসলামকে রতনকে আবিদকে যে অবস্থায় তুই দেখছিস, ওরা এরকম ছিল না। ওরা খুব খারাপ লোক। তোর বাবা ওদের ভালো করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ তোর বাবা এখানে নেই।
তুই যখন আমার কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিস, তুই পারবি। চেষ্টা কর।
অনিসা মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলো।
অনেক কথা মাথার মধ্যে ঘুর পাক খাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। বাবার প্রসঙ্গ এলেই সবাই কেমন সুন্দর ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ও ইকবালদাদাই সেলিম আঙ্কেলের সঙ্গে গল্প করলো। বাবার অনেক অজানা কথা ওদের কাছ থেকে জানল। ওর মনে হচ্ছে ওর বাবা একটা ইনভিজিবিল ম্যান।
ঘন্টা খানেক ওদের সঙ্গে কাটিয়ে অনিসা বেরিয়ে এলো।
আবিদ আঙ্কেল মাকে একটা ফোন করে বলে দিল। ওকে অফিসের সামনে নামিয়ে দিচ্ছে।
মা নিশ্চই আবিদ আঙ্কেলকে জিজ্ঞাসা করলো কোথায় গেছিলে।
আবিদ আঙ্কেল হাসতে হাসতে ইকবালদাদাই-এর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল।
অনিসা সব বুঝতে পারল। আবিদ আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

তুমি কামিং সানডে আমার জন্য একটু সময় রেখো।
কেন।
তোমাকে নিয়ে বেরবো।
হবে না।
কেন।
আমি অনিদার দেশে যাব, কাজ আছে।
ওআও।
আবিদ ভাইঝির দিকে তাকালো। চোখে মুখে খুশি গলে গলে পরছে।
কবে ফিরবে।
তিন চারদিন লাগবে।
দারুণ।
কি দারুণ।
আমি তোমার সঙ্গে যাব।
না।
কেন।
সে তোকে জানতে হবে না।
ও সব শুনছিনা। আমি যাব।
তুই তো ভারি বজ্জাত। আমি আর আসবই না।
পারবে।
আবিদ ভাইঝির কথায় হাসছে।
নিজের বাড়িতে যাব তাতে তোমার আপত্তি কোথায়।
আমি তোর পেছন পেছন ঘুরতে পারব না।
তোমায় ঘুরতে হবে না। আমি নিজে নিজে ঘুরবো। তুমি তোমার কাজ করবে আমি আমার কাজ করবো।
মা পার্মিসন দিলে তবে যেতে পারবি তা না হলে হবে না।
ঠিক আছে পার্মিসন আমি নিয়ে নেব।
অফিসের গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। অনিসা নেমে গেল।
গেট দিয়ে রিসেপসনিস্ট কাউন্টারে আসার সময় দু’একজনের কথা কানে ভেসে এলো।
একেবারে অনিদার হাইট, অনিদার মুখটা যেন বসানো।
অনিসার একবার ইচ্ছে হচ্ছিল পেছন ফিরে দেখে। এদের বয়স কতো।
তারপর নিজেকে সামলে নিলো। সোজা গট গট করে ভেতরে ঢুকে এলো।
ম্যাডাম।
রিসেপসনিস্ট মেয়েটার মিহি ডাকে ফিরে তাকাল।
আপনার জন্য একজন কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছে।
আমার জন্য!
হ্যাঁ ম্যাডাম।
কই ডাকুন।
মেয়েটি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির পেছন পেছন শুভদীপ এসে ওর সামনে দাঁড়াল।
তুই এখানে! জানলি কি করে আমি এখানে আসব!
তোর মোবাইল অফ।
সরি।
আন্টিকে ফোন করেছিলাম। বললো তুই দুটোর পর অফিসে আসবি।
তাই নাচতে নাচতে চলে এলি।
তাহলে চলে যাই।
এলি যখন যাবি কেন। মার সঙ্গে কথা বলেছিস।
ফোনে কথা বলেছি। এখানে এসে আর জানাই নি।
কেন।
শুভদীপ চুপ করে থাকলো।
চল ওপরে চল।
দুজনে লিফ্ট বক্সের সামনে দাঁড়াল। ওপরে উঠে এলো। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনিসা শুভদীপের দিকে একবার তাকাল।
তুই এরকম একটা আলখোল্লা পরেছিস কেন।
তোর অসুবিধে আছে।
অবশ্যই।
তাকাবি না।
অনিসা চুপ করে গেল।
মায়ের ঘরের সামনে এসে দেখলো কেউ নেই। লকে হাত দিয়ে দরজাটা ফাঁক করতেই দেখলো বেশ কয়েকজন বসে আছে। একমাত্র মিলিমনি আর টিনামনিকে চিনতে পারলো। আর কাউকে চিনতে পারলো না।
মিত্রা একবার ওদের দিকে তাকাল।
তুমি ব্যস্ত আছো।
ভেতরে আয়।
শুভ আছে।
ওকে নিয়ে আয়।
তোমাদের অসুবিধা হবে না।
দেখেছিস টিনা কেমন পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছে।
মিত্রাদি ও এখন এ্যাডাল্ট।
অনিসারা ভেতরে এলো।
মিত্রা একবার মেয়ের দিকে একবার শুভদীপের দিকে তাকাল।
শুভকে পেলি কোথায়।
উনি নাকি তোমাকে ফোন করে জেনেছেন আমি দুটোর পর আসব, নীচে অপেক্ষা করছিলেন।
তুই যদি না আসতিস।
ওকে জিজ্ঞাসা করো। গবেট কোথাকার।
মিত্রা মুচকি হাসলো।
শুভদীপ একবার অনিসার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকালো।
তোর ফোন অন করা আছে।
সরি মা। এখুনি অন করে দিচ্ছি।
বন্ধ কেন।
অনিসা হাসলো।
মিত্রা ঘরে যারা আছে তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনারা এখন যান। আমি ডিসিসান নিয়ে আপনাদের জানাব। ফাইল গুলো রেখে যান।
সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। একমাত্র টিনা মিলি বসে থাকল।
শুভদীপ চুপ চাপ বসে আছে।
শুভকে আজ খুব গম্ভীর গম্ভীর লাগছে। মিলি হাসতে হাসতে বললো।
দিয়েছি ঝাড়।
মিত্রা আবার হাসলো।
কেন রে! টিনা বললো।
ওর বাড়িতে আর কোন প্যান্ট জামা নেই। কি একটা পরেছে দেখ। কোন টেস্ট আছে ?
মিত্রা হাসছে।
বললাম এরকম একটা আলখাল্লা পরেছিস কেন।
বললো তাকাবি না।
এবার টিনা মিলি জোড়ে হেসে ফেললো।
সেই জন্য শুভ গম্ভীর।
ওর যে কখন কি হয় বোঝা মুস্কিল। দাদুকে বলে এসেছিস।
না।
ঠাম্মাকে।
বলেছি।
এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবি এই তো।
শুভ চুপ করে রইলো।
মিত্রা মেয়ের শাসন দেখছে। মনে মনে হাসছে। কি জোড় ছেলাটার ওপর। ও চুপচাপ মেয়ের ধমক খেয়ে যাচ্ছে। ওর যতো হম্বিতম্বি শুভর ওপর।
আবার শুভ যখন গুম হয়ে যায় তখন অনিশা কি তেল মাড়ে।
বেশ মজা লাগে মিত্রার।
শেষের আট দশ দিন মিত্রা লক্ষ্য করেছে শুভ খুব ঘন ঘন ওদের বাড়িতে আসছে। কমপিউটার নিয়ে দুজনে বসে কি সব যেন করে। তারপর চলে যায়।
ছোটমাকে ও ব্যাপারটা বলে ছিল।
ছোটমা বললো। থাক, মাঠে ঘাটে তো যাচ্ছে না। বাড়িতেই থাকে। তুই বুঁচকিকে কিছু বলিস না।
মিত্রা চুপ করে গেছে।
কি খাবি।
আমার পেট ভড়া। তুই খেয়ে বেরিয়েছিস ?
শুভ মাথা দোলাল।
কিভাবে মাথা দোলাল দেখলে। অনিসা মার দিকে তাকাল।
ও নির্ঘাৎ খেয়ে আসে নি।
কি করে বুঝলি।
মথাটা কেমন দ’র মতো দোলাল দেখলে না। হ্যাঁ নার ঠিক মাঝা মাঝি।
মিত্রা হাসছে।
দাদাই-এর ঘরে কে আছে ?
অনিসা মার দিকে তাকাল।
দাদাই আছে।
দাদাই এসেছে ?
হ্যাঁ।
আমাকে একটা বসার জায়গা দাও।
এতো জায়গা আছে তোর বসার জায়গা নেই।
দূর।
মিলির ঘরে চলে যা।
মিলি মনি এখুনি আবার যাবে।
মিলির যেতে দেরি আছে।
তাহলে তুমি দুটো চিকেন প্যাটিস আর কোল্ড ড্রিংকস পাঠিয়ে দাও।
এই যে বললি পেট ভড়া আছে।
ও খাবে আমি চেয়ে চেয়ে দেখব নাকি।
মিত্রা হাসছে।
অনিসা উঠে দাঁড়াল।
চল।
শুভদীপও উঠে দাঁড়াল। দুজনের হাইটই সমান। উনিস বিশ। মিত্রার বুকটা হঠাৎ যন্ত্রণায় মোচর দিয়ে উঠলো। ইস যদি বুবুন থাকতো।
অনিসা ঘর থকে বেরিয়ে শুভর দিকে তাকাল।
দাদুকে একটা ফোন কর।
ফোন করে বলে দিয়েছি।
এখানে এসেছিস বলেছিস।
না।
কেন।
সবাইকে সব কিছু জানাতে নেই।
পেকো রাম। লিফ্টে যাবি না হেঁটে উঠবি।
হেঁটে।
দুজনে সিঁড়ি ভাঙা শুরু করে দিল।
কখন বেরিয়েছিস।
সাড়ে দশটা।
কোথায় ছিলি এতোক্ষণ!
তুই যে কাজগুলো দিয়েছিলি সেগুলো করছিলাম।
নেগেটিভ না পসিটিভ।
কয়েকটা নেগেটিভ আছে।
আমিও আজ গেছিলাম।
কি পেলি।
যা বুঝলাম সবাই বাবাকে কম বেসি ধ্বসে। কেউ মুখ খুললো না।
একটা কেলো হয়েছে।
কি।
কয়েকদিন ধরে আমার পার্সোনাল ই-মেল আইডিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল কে যেন হ্যাক করেছে। আজ দেখি আবার আছে। ভাবলাম কেউ হয়তো ঘাঁটা ঘাঁটি করেছে। দেখলাম, না সব ঠিক আছে।
ওই আইডিটা আর ইউজ করিস না। একটা নতুন বানিয়ে নে।
বানিয়েছি। আবার সকলকে মেল করে জানাতে হবে।
শিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে কেউ চোখাচুখি হলে অনিসার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কেউ আবার বলছে গুড আফটারনুন ম্যাডাম।
অনিসাও মাথা দুলিয়ে সম্বোধনের প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।
অনিসারা ওপরে চলে এলো। মিলি মনির ঘরে ঢুকে কাঁধ থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে রাখল। মিলি মনির ঘরটা একেবারে নিউজ রুমের গায়ে। এখান থেকে পুরে নিউজরুমটা দেখা যায়। নিউজরুমটা এখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা। দাদাইকে টেবিলে দেখতে পেল না। হয়তো দুদুনের ঘরে গেছে।
ফোনটা তুলে নিয়ে দুদুনকে বলে দিল আমি মিলি মনির ঘরে আছি। তোমার কাছে পরে যাচ্ছি। দুদুন বললো তোর মা জানিয়েছে।
অনিসা ফোনটা রেখে দিল।
দুজনে চেয়ারে বসলো।
বল তোর আপডেট।
শিয়ালদহ, পিলখানা দু’জায়গাতেই গেলাম। নাম শুনে সবাই কেমন সন্দেহের চোখে দেখে। একজনতো আমাকে এমন এক জায়গায় টেনে নিয়ে গেল, কলকাতায় যে ওই রকম একটা জায়গা থাকতে পারে তা কল্পনাই করতে পারি না।
সে কি জেরা রে। প্যান্ট প্রায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলি।
পরিচয় দিই নি। বললাম উনি আমার আঙ্কেল। জন্ম থেকে আঙ্কেলকে দেখি নি। তাই দেখার খুব ইচ্ছে।
কি বললো।
আমার নাম বাড়ির ঠিকানা বললাম।
কিছুতেই বিশ্বাস করে না।
তারপর আন্টির নাম বলতে ছাড়ল।
শুভ চুপ করে গেল। অনিসা শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে।
বুঝলি অনিসা আঙ্কেলের দম আছে। আজ সতেরো বছর কলকাতায় নেই। মনেই হচ্ছে না। আমার মন বলছে আঙ্কেল মাঝে মাঝে কলকাতায় আসে।
কি করে বুঝলি।
ওদের কথা বার্তায়।
আমারও কেমন কেমন যেন মনে হয়। শেষ যে দিন প্রিন্সিপ্যাল আন্টির কাছে গেছিলাম। আন্টি বললো। মন খারাপ করো না। তোমার বাবা কোনোদিন খারাপ কাজ করে নি। ঈশ্বর তার কোনদিন ক্ষতি করবেন না।
কথাটা শোনার পর বার বার ভেবেছি। আন্টি হঠাৎ কেন ওই কথা বললেন।
কোন উত্তর পাই নি।
একটুভাব উত্তর পেয়ে যাবি।
আজ ইকবালদাদাই হঠাৎ একটা কথা বললো, তুই তোর বাবাকে কোন দিন দেখিস নি। আজ যদি তোর বাবা তোর সামনে এসে দাঁড়ায় চিনতে পারবি।
তখন থেকে আমি খালি এই কথাটা চিন্তা করে যাচ্ছি। ইকবালদাদাই কেন এই কথা বললো।
একটা কাজ করলে হয় না।
বল।
আঙ্কেলের ওই সময়কার কোন ছবি তোর কাছে আছে।
আছে।
চল একজন আর্টিস্ট খুঁজে বার করি।
আবার আতলামো শুরু করে দিলি।
কথাটা শোন না।
বল।
তাকে একটা প্রোপোজাল দিই।
কি।
এই ছবিটা দেখে এই মানুষটা আঠারো বছর পর কেমন দেখতে হবে ড্র করে দিন।
ছাগল।

কেন ও কথা বললি।
 
ভেবে দেখ। পাগলাম করার আর জায়গা পেলি না। আঁতেল কোথাকার।
ডায়নোসারের জীবাশ্ম আবিষ্কার হওয়ার পর যদি ডাইনোসার দেখতে কেমন ছিল তা জানতে পারি, এটা হবে না কেন।
অনিসা একবার শুভর দিকে তাকাল। শুভর চোখ দুটে চক চক করছে।
এইতো তোর মাথার গোবর গুলো আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে আমার কথা শুনবি উপকার পাবি, নিজেক সবজানতা হরিদাস পাল ভাববি না।
দেব পিঠে একটা গুম করে।
আমার কথা পছন্দ না হলে তুই দিয়েই থাকিস। আমার তোর মতো অতো ইনটেলেক্ট নেই।
এইতো, সেন্টু ঝাড়তে শুরু করলি।
অনন্য কোথায়।
ও এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। মা আস্তে আস্তে ওকে সব বোঝাচ্ছে।
তুই।
বাবাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি।
স্ক্যানগুলো সব পরা হয়ে গেছে।
না। আজ আবার রাতে ধরবো।
আমাকে পেন ড্রাইভে করে দে।
আজ না পর্শুদিন দেব।
একজন বেয়ারা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। অনিসা যা বলেছিল ঠিক তাই পাঠিয়েছে মা। খাবারের প্লেটটা টেবিলের ওপর রেখে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেল।
নে খেয়ে নে। একবার লাইব্রেরী যাব।
কেন।
বাবার পুরনো লেখাগুলো একবার দেখব। ওখান থেকে কিছু মেটিরিয়ালস পাওয়া যেতে পারে।
এটা একটা ভালো সাজেসন।
আর একটা নাম পেলাম মায়ের ডাইরী পরতে পরতে।
কি।
মিঃ টোডি। বাবা তার পেছনে ধাওয়া করে মিডিলইস্টে গেছে। তারপর আর ফিরে আসে নি।
দাঁড়া দাঁড়া নামটা খুব শোনা শোনা মনে হচ্ছে।
তুই কোথায় শুনলি!
দাদুর কাছ থেকে।
দাদুর কাছ থেকে!
হ্যাঁ।
কি বললো দাদু।
দাদুর কাছে কয়েকদিন আগে বাবা-মার মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়েছিলাম। তখন আমার বছর খানেক বয়স। আমারও খুব ইন্টারেস্টিং লাগে পার্টটা। দাদু কথা প্রসঙ্গে টোডির নাম করলো। বললাম ভদ্রলোক কোথায় আছেন এখন। দাদু বললেন মিডিলইস্টে। তারপর দাদু প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। জানিস আমার জন্ম দুবাইতে।
ভারি ইন্টারেস্টিং।
দাদুর কাছে অনেক মাল আছে বুঝলি।
কিন্তু কিছুতেই বার করতে পারছি না। সিন্দুকটা এমনভাবে আগলে রাখে।
এখন চেপে যা। আগে এদিকটা একটু গোছাই। তারপর দেখছি।
আবিদ আঙ্কেল কি বললো।
খালি পিছলে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কিরে এখনো খাওয়া হয় নি, কি গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিস দুজনে।
মিলিমনি ঘরে ঢুকলো।
তুমি এখন কাজ করবেতো।
হ্যাঁ।
ভালো, আমরা একটু লাইব্রেরীতে যাব। তোমার এখানে আমার ল্যাপটপটা থাকলো।
রেখে যা।
আচ্ছা মনি, বাবার সঙ্গে তোমার কবে পরিচয় হয়।
কেন, আবার বাবাকে নিয়ে পরেছিস নাকি।
বড়ো হয়েছি, বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে।
তাহলে তুই বড়ো হয়েছিস বলছিস।
কেন তোমার কি মনে হয় আমি ছোট আছি।
এইতো সেদিন জন্মালি।
কামিং মান্থ এইট্টিন কমপ্লিট করবো।
ওরে বাবা তাহলে তুই এ্যাডাল্ট।
বলো না।
কি বলবো।
তোমার সঙ্গে বাবার কবে পরিচয় হয়।
কলেজে।
তারপর তোমাদের সঙ্গে বাবার যোগাযোগ ছিল না।
হুঁ।
তারপর কিভাবে তোমাদের সঙ্গে বাবার রিলেসনটা এতটা ডিপ হলো।
মিলি একবার অনিসার দিকে তাকাল। কি বলতে চায় মেয়েটা। ও খুব সহজ সরল ভাবে মিলিকে প্রশ্ন করছে কিন্তু এর মধ্যেও কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে।
পরে বলবো। এখন মেলা বকাস না অনেক কাজ।
এই তুমি ঘুঁটি বসিয়ে দিলে, আর বলবে না বুঝেছি।
তুই জেনে কি করবি।
তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে, আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করতাম কি উত্তর দিতে।
দাঁড়া মিত্রাদিকে ফোন করছি। তুই বড্ড পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছিস।
বলোনা, মাকে আমি সব বলেছি।
মিলি চুপ করে গেল।
জানো মনি কাল রাতে মা কাঁদছিল।
কে বললো তোকে।
আমি মায়ের কান্নার আওয়াজ পেয়েছি।
মিলি গম্ভীর হয়ে গেল।
কোথায় যাবি বলছিলি।
তারমানে তুমি বলবে না।
একটু অপেক্ষা কর সব জানতে পারবি।
বুঝেছি যাও, তোমাকে বলতে হবে না। নিজের কাজ নিজে করে নেব।
মিলি তাকিয়ে তাকিয়ে অনিসাকে দেখছে। আর মনে পরে যাচ্ছে অনিদাকে। অনিদা ঠিক এরকম এক রোখা ছিল। যে কাজটা হাত দেবে করে ছাড়বে। অনিসা কি তাহলে কিছু বুঝতে পেরেছে ? কই মিত্রাদি কিছু বললো না। একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে।
অনিসা শুভ দু’জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো।
একটা কথা বলবো মনি, এটা না করবে না।
মিলি হাসলো।
বল শুনি।
তোমার কাছে বাবার কিছু ভিডিও ক্লিপিংস আছে। আমাকে দেবে।
টিনামনিকে বল। ওর কাছে সব গোছান আছে।
টিনামনি আবার বলবে ওসব নিয়ে তুই কি করবি।
ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি।
তুমি নিয়ে এসে রাখ আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।
তুই চাইলেই কি দিতে পারব। একটু সময় দে।
দিলাম তো। বললাম তো যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।
আচ্ছা। যা।
রাতে খাওয়ার টেবিলে মা ভীষণ চুপচাপ। অনিসা ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। ফেরার সময় মা ওর সঙ্গে আজকের ব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞাসা করে নি। এমনি এটা সেটা গল্প করেছে।
বরং দুদুন বললো তোর আজকের কাজ শেষ হলো। লাইব্রেরীতে বাবার লেখা গুলো পরলি। কতদিন অনির লেখা পরিনি।
কেন সুমন্তমামা তো লিখছে।
দূর। দুধের সাধ ঘোলে মেটে। ওর লেখার টাচটাই আলাদা।
অনিসা চুপ করে গেছে।
খাবার টেবিলে ডাক্তারদাদাই প্রথম মুখ খুললো।
ছোটোম্যাডাম আজ কাজ গোছালে।
তুমি আমাকে ম্যাডাম বললে, তোমার সঙ্গে কথা বলবো না যাও।
আচ্ছা তাহলে ছোটগিন্নী বলি।
না তাও বলতে পারবে না।
মিত্রা হাসলো।
তাহলে কি বলবো।
তুমি যে নামে ডাকো সেই নামে ডাকবে।
তাহলে বুঁচকি বলি।
ওটা ছোটদিদান আর দুদুনের জন্য।
বাবাঃ সব আলাদা আলাদা রেজিমেন্ট আছে।
অফ কোর্স।
আজকে কতো ডাটা কালেকসন করলি।
কিছুটা করেছি। এবার তোমার সঙ্গে বসতে হবে।
আমার থেকেও দুদুন অনেক কিছু জানে।
ঘেঁচু।
অনিসার কথায় সবাই হাসে।
তারমানে! দাদা বলে উঠলো।
তুমি কাগজছাড়া কিছু বোঝ না। একটা কাগজ চালাতে গেলে বহুত স্কিম করতে হয়। তোমার ঘটে ওসব বুদ্ধি নেই।
দেখলে দেখলে বড়ো তোমার নাতনির কতোগুলো পাখনা গজিয়েছে।
হুঁ হুঁ কার মেয়ে দেখতে হবে। নারে তুই তোর কাজ কর। আমি যতটুকু জানি বলবো। তুই ধরে আন শয়তানটাকে।
আচ্ছা দিদান। বাবা তোমাকে সবচেয়ে বেসি ভালবাসতো।
ভালোবাসলে কি ওই ভাবে পালিয়ে যেতো।
বড়মার গলাটা ভারি হয়ে এলো।
অনিসা ওপরজিটের চেয়ার থেকে উঠে এলো। দিদানের গলাটা জড়িয়ে ধরলো। তোমায় কথা দিলাম বাবাকে আমি ঠিক খুঁজে বার করবো।
সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে এতদিনে সেটাই জানতে পারলাম না।
কেন সবাই যে বলে বাবা বেঁচে আছে।
বেঁচে থাকলে এই কয় বছরে আমার সঙ্গে একবার কথা বলতো।
তোমার সঙ্গে একবারও কথা বলে নি।
একবারও না।
অনিসা চুপ করে গেল, মায়ের মুখের দিকে একবার তাকাল।
মিত্রা অনিসার দিকে তাকাল মাথাটা নীচু করে নিল। অনিসা মায়ের চোখের ভাষা পরে ফেললো।
অনিসা নিজের জায়গায় এসে বসলো। চুপ চাপ খেয়েদেয়ে উঠে গেল। নিজের ঘরে চলে এলো। ল্যাপটপটা টেবিলে অন করে দরজা বন্ধ করলো।
আজ মনটা ভীষণ খারাপ বুঝলি বুবুন। সকাল থেকে মনের ভেতর একটা কু গাইছিল। কেন জানিনা। অফিস থেকে খবর নিলাম তোর ছেলে মেয়ে ঠিক আছে। কয়েকদিন আগে শরীরটা খারাপ হয়েছিল। সে এক হুলুস্থূলুস কান্ড। বড়মাকে বললাম আমি আজ অনিমেষদার কাছে যাব।
বড়মা বললো যা। বুঁচকি বোচন ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি ফিরিস।
অফিস থেকে সোজা অনিমেষদার বাড়িতে এলাম।
প্রত্যেকটা দিন কি যে অসীম যন্ত্রণায় কাটাচ্ছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। নিজে আর সামলে উঠতে পারছি না।
মাঝে মাঝে এমন হচ্ছে, যেন মনে হচ্ছে সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও চলে যাই।
তারপর ভাবি পালিয়েই বা যাব কোথায়।
যে অবস্থায় ছিলাম এখন তার থেকে যথেষ্ট ভালো আছি।
আমি গেছি শুনে অনিমেষদা তাড়াতারি পার্টি অফিস থেকে ফিরে এলো। সঙ্গে সবাই।
জানিস মিত্রা, সবাই মিলে একটা গেম খেলে ফেললাম।
আবার কি গেম খেললে। বৌদি বললো।
জান সুতপা, অনিদের সিটটা খালি ছিল। বাই ইলেকসনে ওটাকে জুড়ে দিল। আমরা অনাদিকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। জানি ওই সিটটাতে জিততে পারব না। তবু একটা রিক্স নিলাম।
অনির কাজগুলো প্রজেক্ট করো।
ঠিক ধরেছো। সেই জন্য রিক্সটা নিলাম।
বিধানদা বললো হ্যাঁরে মিত্রা ভুল করলাম নাকি।
চুপ করে থাকলাম।
কি উত্তর দেব বল বুবুন। আমি তোর মতো রাজনীতি বুঝি না।
প্রবীরদা খালি বললো, আমি ফলোআপ করে যাচ্ছি মিত্রা, তুই কিছু ভাবিস না।
পরটা আলুভাজা খাওয়া হলো। সেদিনটার কথা খুব মনে পরে গেল। তুই আমি মিলি টিনা নীপা দামিনীমাসির ওখান থেকে অনিমেষদার বাড়িতে গেছিলাম, বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিল। কাউকে বুঝতে দিই নি। সবকটা পরটা খেতে পারিনি জানিস। তোর কথা মনে করে দুটো রেখে এসেছিলাম।
বাঁদর ছেলে কোথাকার।
আচ্ছা তোর কি একটুও আমার কথা মনে পরে না।
অনিমেষদার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। তোর হদিস পায় নি। তোর ফোন কল ধরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই তল্লাটে ওই নামে কেউ থাকে না। তবে একটা দুঃসংবাদ দিল। মিঃ মুখার্জী এবং তার স্ত্রীকে কারা যেন খুন করেছে। বাচ্চাটা কোন প্রকারে বেঁচে গেছে। ওর দাদু ঠাকুমা ওখান থেকে বাচ্চাটাকে কলকাতা নিয়ে এসেছে।
আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। মিঃ মুখার্জীকে প্রায় ভুলে গেছিলাম। হঠাৎ করে মনে পরে গেল। নার্সিংহোমে থাকতে অনিমেষদা বলেছিল। মিঃ মুখার্জী ট্রান্সফার নিয়ে ওখানে গেছে। তারপর খবরটাপেয়ে একেবারে মুষড়ে পরলাম।
তারমানে তুই কোথায় ? আর ভাবতে পারছি না।
কখনো মনে হয় তুই আছিস। কখনো মনে হয় তুই নেই। সব সময় একটা দোলাচলের মধ্যে থাকি। আমি একা বললে ভুল হবে। তোকে সবাই যারা ভালোবাসে সববাই।
ইসলামভাই সব সময় বলে তোকে বলেছিলাম মামনি অনি আমার বাবা।
সত্যি অনি আমার বাবা কিনা প্রমাণ পাচ্ছিস।
মিঃ মুখার্জীর খোঁজ করেছিলাম। পাই নি। তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছি।
ইসলামভাইও অনেক খোঁজ করেছে।
মিঃ মুখার্জীর যে সব আত্মীয়স্বজন আছে তারা সব কলকাতার বাইরে চলে গেছে। জানিনা বাচ্চাটা কেমন আছে। মনটা খুব খারাপ লাগে যখন মনে পরে যায় বাচ্চাটা তোর মতো অনাথ হয়ে গেল।
আমি জানি এই ঘটনারও তুই প্রতিশোধ নিবি। অপেক্ষা অপেক্ষা শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আমার এই জীবনে আর কিছু নেই। তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।
আচ্ছা তুই একবার বড়মাকে ফোন করতে পারিসতো। তোকে পেটে ধরে নি বলে এতো কষ্ট দেওয়ার অধিকার তোর নেই।
ওদের দুটোর দিকে একবার তাকা। ওরা তোর কোন ক্ষতি করে নি। আমার সামনে কাঁদে না আড়ালে চোখের জলে বুক ভিঁজে যায়।
ইদানিং ছোটর কি যে হয়েছে কি জানি তোর ছেলে মেয়ে ছাড়া পৃথিবীটা তার কাছে অন্ধকার।
দুজনে দুটোকে নিয়ে শোয়। আমি বড়মার ঘরের সোফাতে আলাদা বিছানা করে।
দামিনীমাসি প্রত্যেকদিন আসবে তোর ছেলেমেয়েকে তেল মাখিয়ে স্নান করাতে।
সেদিনকে আমার হাতটা ধরে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি মামনি।
কি হয়েছে বলবে তো।
অনির ভাঙা বাক্সটা থেকে তোর লেখা চিঠিগুলো পরেছি। ওর কয়েকটা লেখাও পরলাম। ছেলেটা নেই হাতের লেখাগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে ওর অনুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করলাম।
দুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। লিখতে ভালো লাগছে না।
আচ্ছা তুই আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবি। খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আমি তোকে তোর জীবনটা একটু চেয়েছিলাম বলে তুই কি খুব রাগ করেছিলি। তাই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে সব মায়া মমতা বন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলি।
অনিসা টেবিলের ওপর রাখা বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল। একবার জানলার কাছে গেল। না মাকে দেখতে পেল না। সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ।
অনিসা জানলা থেকে সরে এলো। একবার বাথরুমে গেল। ঘরের দরজাটা খুলে একবার বারান্দায় এলো। দেখলো দাদার ঘরের দরজা বন্ধ।
পায়ে পায়ে একবার দাদার ঘরের দিকে গেল। না দাদার ঘরের লাইট জ্বলছে না। ও ঘুমোচ্ছে।
আবার টেবিলে এসে বসে পরলো। আজকে যতটা হোক পরে শেষ করতে হবে।
আচ্ছা তখন শুভ লাইব্রেরী থেকে হঠাৎ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলো কেন ?
বাড়িতে এসে ও ফোন করেছে। ওর ফোনের স্যুইচ অফ।
বহুবার রিং করেও পায় নি।
ব্যাপারটা ওর ঠির মাথায় ঢুকছে না।
কাউকে না জানিয়ে চলে আসাটা অনিসার ভাল ঠেকছে না। কাল সকালে ওর বাড়িতে একবার ঢুঁ মারতে হবে।
আবার টেবিলে এসে বসলো।
জানিস বুবুন তোর ছেলে মেয়ে এখন সরাটা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। সবার চোখের মনি। বিশেষ করে ভজুরাম।
কেউ ওদের বকতে পারবে না। তাহলে ভজুরাম হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করে দেবে। লুকিয়ে লুকিয়ে দামিনীমাসিকে ফোন করে ডেকে আনবে। বিচার সভা বসাবে।
কেন বোচন আর বুঁচকির গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে। তার মান ভাঙানো খুব মুস্কিল।
ভজুরাম হচ্ছে ঘোড়া আর তোর ছেলে মেয়ে হচ্ছে তার সওয়াড়ি। সারাটা বারান্দা ওদের ঘোড়া চড়াচ্ছে।
বেশ লাগে। মাঝে মাঝে আমি মোবাইলে ছবি তুলে রাখি।
জানিনা তোর সঙ্গে দেখা হবে কিনা। দেখা হলে তোকে সব দেখাব।
ও তোকে বলতে ভুলে গেছি।
আমি এখন বেশ ভালো কমপিউটার জেনে ফেলেছি।
সব টিনা আর বরুণদার সৌজন্যে। এমনকি মোবাইল থেকে ছবিগুলো ল্যাপটপে ট্রান্সফার করে সিডি করে রাখি। আর একটা পৌর্টেবল হার্ডডিক্স কিনেছি। শুধু মাত্র তোর জন্য। তুই যদি কোন দিন ফিরে আসিস, তোকে সব সব দেখাব।
আজ বাড়িতে প্রচুর লোকজন তাই আমি তাড়াতাড়ি অফিসে চলে এলাম। কাল থেকে ভীষণ টেনসনে আছি। ওখানে বাই ইলেকসন হলো পর্শুদিন। আজ রেজাল্ট।
দাদা সকাল থেকে হুলুস্থূলুস বাদিয়ে দিয়েছে।
সন্দীপকে ফোনে ফোনে এই মারে তো সেই মারে। অর্ক ওখানে পৌঁচেছে কিনা।
ইসলামভাই নাওয়া খাওয়া ভুলে আদা জল খেয়ে ওখানে পরে আছে। সকাল থেকে আমি দুবার ফোন করেছিলাম। নট রিচেবল বলে দিয়েছে।
অফিসে চলে এলাম।
নিজের কাজে মন দিলাম। এসে দেখে যাস এখন আমি সেই মিত্রা নেই। মালকিন বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।
তুইতো এটাই চেয়েছিলি। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াই।
কথাটার কতটা গুরুত্ব তখন বুঝি নি। আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
শোননা যেটা বলছি।
দুটো নাগাদ হঠাৎ দেখি আমার ঘরের দরজা খুলে তিন মক্কেল হাজির।
ইসলামভাই, বাসু, অনাদি।
বুঝলাম কিছু একটা আনন্দ সংবাদ আছে।
ঠিক তাই।
ছটা সিটের মধ্যে ছটাই অনিমেষদারা জিতে গেছে।
অনাদি ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আমি উঠে গেলাম।
কাঁদছো কেন আজ আনন্দের দিন। বুবুন তোমাকে বলেছিল। এমএলএ বানাবে।
ম্যাডাম জানিনা আজ ওর কথাটা বড্ড বেশি করে মনে পরছে।
শুধুকি তোমার। আমাদের সবার। এবার অনেক কাজ অনাদি। ওর স্বপ্নগুলো সফল করতে হবে।
আমি করবো ম্যাডাম আপনাকে কথা দিচ্ছি। ব্যাঙ্কটা মোটামুটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এবার ফার্মিংটা নিয়ে লড়ে যাব। কাজতো অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছি।
মনে থাকে যেন। ওর অনেক স্বপ্নছিল ওখানে একটা ভালো ইস্কুল তৈরি করতে হবে।
আমি কথা দিচ্ছি ম্যাডাম।
বসো। তোমাদের আর এক মক্কেল কোথায় ? গুরুর শিষ্য।
রেজাল্ট বেরোবার পর ও চলে গেল। বললাম আমরা ম্যাডামের কাছে যাচ্ছি।
কিছু বললো না।
আসার সময় খবর নিলাম। পীরসাহেবের থানে বসে আছে। আজ যা কিছু সব চিকনার জন্য।
ওর মাথায় এতো বুদ্ধি কোথা থেকে এলো বুঝতেই পারছি না।

কেন!
 
শেষ মুহূর্তে ইসলামভাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি হেরেগেছি। ও কোথা থেকে পাঁচু পচাকে নিয়ে সারারাত্রি কি হুইসপারিং ক্যাম্পেনিং করলো কি জানি।
এতোভোটে জিতবো আসা করি নি। অমূল্য যেভাবে বিট্রে করলো শেষ পর্যন্ত। ওমা দেখি ভোটের দিন অমূল্যের লোকজনই সবচেয়ে বেশি খাটা খাটনি করছে।
তাহলে শেষ তাসটা চিকনাই খেললো বলো।
তাস মানে একেবারে ট্রাম্প কার্ড।
আচ্ছা তোমাদের কিছু মনে হয় না।
মনে হলে কাকে জিজ্ঞাসা করবো। ও তো এখন অনির ছায়া।
নিজেকে অনি বলে মনে করে। কিছু বললেই বলে কথা কম বল যা করছি খালি দেখে যা।
আমি হাসছি।
পর্শুদিন ইসলামভাইকে পর্যন্ত ধমকাল।
বলে কিনা, তুমি এতদিন কি করে তোমার সাম্রাজ্য চালালে।
ইসলামভাই হাসবে না কাঁদবে।
একমাত্র ওই বলেছিল সব সিট হারলেও তোর সিটটা আমার চাই। আমি তোকে জেতাবই।
সারাক্ষণ ভোটগণনা কেন্দ্রের বাইরে ছিল। একবারের জন্য ভেতরে যায় নি।
কি খাবে বলো। সকাল থেকে নিশ্চই কিছু খাওয়া হয়নি।
দেখলাম ফোনটা কেঁদে উঠলো। দেখলাম অনিমেষদা। ভয়েস অন করলাম।
হ্যাঁ দাদা বলুন।
তোর কাছে অনাদি ইসলাম গেছে।
হ্যাঁ।
ওদের ফোন বন্ধ কেন।
সবাই বুবুনের গুণ পেয়েছে।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে একহাত জিভ বার করলো। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ফোনটা বার করে অন করলো।
রেজাল্ট শুনেছিস।
হ্যাঁ শুনলাম। ছেলেটা রিয়েলি মিরাক্যেল।
এখানে নেই তবু যেন সব সময় আছে। আমি যেগুলো নেগেটিভ ধরে ছিলাম সেগুলো পর্যন্ত পজিটিভ করে দিয়েছে।
আমি চুপ করে রইলাম, মনটা ভারি হয়ে গেল।
এই দেখো চুপ করে গেলি কেন। তোর মন খারাপ হয়, আমার হয় না।
না দাদা আপনি বলছেন আমি শুনছি।
চিকনা এসেছে।
না।
কেন ?
ও অনির ফেভারিট জায়গায় গিয়ে বসে আছে।
হয়তো গুরুদেবের সঙ্গে টেলিপ্যাথিতে কথা বলছে।
বুঝলি শেষ খেলাটা ওইই খেলে দিল।
আমি চুপ করে আছি।
দে ইসলামকে একবার দে।
ভয়েজ অফ করে ইসলামভাই-এর হাতে ফোনটা দিলাম।
বুঝলাম নিরঞ্জনাদার কথা জিজ্ঞাসা করছে। ওখানে কাকে দায়িত্ব দিয়ে আসা হয়ছে। এই সব। পারলে একবার রাতে বাড়িতে যেতে বললো। সবার সঙ্গেই কথা বললো।
খাওয়া দাওয়া করে আজ একটু বিকেল বিকেল সবাই ফিরে এলাম।
গেটের মুখে এসে রবীন গাড়ি দাঁড়করাতেই আমি নেমে এলাম।
অনাদি, বাসু, ইসলামভাইও নেমে এলো।
দেখলাম তোর ছেলে মেয়ে মাঠের ধুলো মাথায় মেখে একেবারে ধবল হয়ে গেছে। সে কি হাসির চোট। তাদের সাহায্য করছে ভজুরাম।
আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালাম। অনাদি আমার পাশে।
চোখের কোল জলে ভরে গেল।
অনাদি আমার হাতটা চেপে ধরলো।
ম্যাডাম এটা কি হচ্ছে।
আমি অনাদির দিকে তাকাতে পারলাম না।
আমি জানি ম্যাডাম আপনার সেই দিনকার কথা মনে পরে যাচ্ছে। আমার বাড়িতে আমার ছেলে মেয়েদের কথা মনে পরে যাচ্ছে। সেদিন আপনার পাশে অনি ছিল আজ নেই।
অনাদির ফিলিংসটা আমার মনে ভীষণ দাগ কাটল।
সত্যি সত্যি আমার সেদিনকার কথাটা মনে পরে যাচ্ছিল।
অনাদির বাড়ি, খামার, খুঁটিতে গরু বাঁধা, আমি তুই দাঁড়িয়ে অনাদি ঘুম চোখে উঠে এলো।
অনাদির বাচ্চদুটো খামারে খেলছে। ধুলো মাখছে। আমি ছুটে গেলাম।
আজ কিছুতেই ছুটে যেতে পারলাম না। বুঝলি। খালি তুই আমাকে হাত ধরে টেনে রেখে দিলি।
বার বার তোর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তুই বার বার বলতিস আমি প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত হয়েছি আমার সন্তানও সেই ভাবে বড়ো হোক।
ওদেরকে ওদের মতো বড়ো হতে দাও।
আজ তোর নিজের বাড়িতে এলাম। প্রায় তিন বছর পর। সবাই এসেছে। কেউ বাদ যায় নি। তিনবছর পর শ্বশুর বাড়িতে এলাম।
যে ভাবে তুই নিয়ে আসতিস ঠিক সেই ভাবে। প্রথমে সেই ধাবাতে। তারপর পরিদার দোকান। পরিদা তোর ছেলে মেয়েকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা।
গাড়ি থেকে নামতে দেরি তোর ছেলে মেয়েকে কোলে তুলতে দেরি নেই।
অনেক লোক আজ। সবাই এসেছে। ছখানা গাড়ি।
পরিদা নিজে হাতে তোর ছেলে-মেয়েকে গরম দুধ, দুটো রসোগোল্লা খাওয়ালো। বললে আমার দোকানে আজ লক্ষ্মী-নারায়ণ এসেছে।
আমি বাধা দিই নি। ওরা দুটোতে বেশ গপ গপ করে গিললো।
গাল দুটো সবার টেপার চোটে লাল হয়েগেছে।
জন্মের পর এই প্রথম তোর ছেলে মেয়ে নিজের বাসভূমিতে এলো। এখন ওদের বয়স চব্বিশ মাস। আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করে দেব বলেছি।
আমার কথা শুনে বড়মা হাঁই হাঁই করে উঠেছিল। একমাত্র মল্লিকদা আমাকে সাপোর্ট করলো। মিত্রা ঠিক কথা বলেছে।
সেই ক্যালভার্ট, সেই শ্মসান, তোর সেই স্কুল। যেমন দেখে গেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। রাস্তায় আসার পথে উনা মাস্টারের বাড়ির সামনে এসে একটু দাঁড়াতে হয়েছিল। কাকীমা এলেন। তোর ছেলে মেয়েকে কোলে নিলেন।
তোর ছেলে মেয়টাও সেরকম কারুর কাছে না নেই। আবার চলা শুরু। একটাই নতুনত্ব দেখলাম মোরাম রাস্তাটা খালি পিচে ঢাকা হয়েছে।
সঙ্গে কে আসে নি। সবাই এসেছে। দেবা, নির্মাল্য এই কদিন প্রানপাত করলো। আগামীকাল তোর স্বপ্নের প্রজেক্টের উদ্বোধন। অনিমেষদা এই প্রথম তোর বাড়িতে আসবে।
কাল উদ্বোধনের পর তোর ভিটেতে রাত কাটাবে বলেছে।
বৌদি সুরো আমাদের সঙ্গেই এসেছে। প্রবীরদারা সবাই ডাইরেক্ট প্রজেক্টে চলে গেছে। রাতে আসবে বলেছে। এক এলাহি ব্যাপার।
গাড়ি থেকে নেমে ট্রলিতে ওঠার পর দেখলাম ছেলে মেয়ে আর আমার কাছে নেই। বড়মা চেঁচামিচি শুরু করেদিল।
ডাক্তারদাদা বোঝালো।
কে কার কথা শোনে।
সেই তরজা।
খামারে এসে ট্রলি থামলো। যেমন দেখিছিলাম ঠিক তেমনই আছে। খালি বাঁশবাগানের একটা জায়গায় মেসিনটা বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি হলো। আমি সব শুনে যাচ্ছি।
নীপা এখন এই বাড়ির গার্জেন।
মৌসুমি মাসিকে জীবনে প্রথম দেখলাম।
দিদিভাই, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি সব দেখে শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ওরা কোনোদিন এরকম সহজ সরল জীবন দেখে নি।
তুই নেই কিন্তু তুই সব জায়গায় আছিস।
এতোক্ষণ পর তোর ছেলে মেয়ের দেখা পেলাম। একজন কাকার কোলে, একজন উনা মাস্টারের কোলে বসে আছে। উনা মাস্টার সকাল থেকে এসে বসে আছে। তোর ছেলে মেয়ে আসবে শুনেছে। হাতে কি যেন একটা আছে, খাচ্ছে।
মনে মনে ভাবলাম নির্ঘাত পেট খারাপ করবে।
আমার সব হাতের বাইরে বুঝলি।
সবাইকে প্রণাম করে আমি নিজের ঘরে এলাম। সঙ্গে দিদিভাই।
ঘরের ভেতর এসে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। যেখানকার যা জিনিস সেখানেই আছে। কেউ একটুও হাত দেয় নি। ঝকঝকে তকতকে। কাঁদতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ভীষণ যন্ত্রণা। খালি চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।
দিদভাই আমার পিঠে হাত রাখল।
তুই মন খারাপ করলে, আমার ঠিক থাকি কি করে।
আমি মন খারাপ করতে পারব না, কি জ্বালা বোঝ। আমার কোন সুখ-দুঃখ তাপ-অনুতাপ থাকতে নেই। তাহলে সকলের মন খারাপ হবে।
হঠাৎ সিঁড়িতে মা মা শব্দ শুনে ঘরের বাইরে এলাম।
দেখলাম চিকনার কোলে তোর ছেলে মেয়ে।
ওদের নিচে নামিয়ে আমাকে প্রণাম করলো।
এটা কি হলো চিকনা।
বন্ধুর স্ত্রীকে পেন্নাম করলাম না। আমার গুরুমাকে পেন্নাম করলাম।
দিদভাই হেসে ফেললো।
সবাই আসছে। তুমি এখন অনি। সেইভাবে চলবে। সাতটার সময় তোমাকে নিয়ে একজায়গায় যাব। যাবে আমার সঙ্গে ?
যাব।
আর কাউকে নিয়ে যাবে না।
দিদিভাই বললো।
না সেখানে গুরুমা আর তার সন্তানের প্রবেশ আছে, আর কারুর নেই।
চিকনা তোর ছেলে মেয়েকে কোলে তুলে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়া হলো, হাসাহাসি হলো।
তোর ছেলেকে একটু চিংড়ি মাছের মোলা দিয়েছিলাম উঃ আঃ করে ঝামেলা পাকাল, চিনি মুখে দেবার সময় দেয় না। মেয়ে দিব্যি খেয়ে গেলো। চোখ ছল ছল তবু নোলা কমে না।
বিকেলে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগতো। গ্রাম শুদ্ধ ঝেঁটিয়ে সবাই অনির ছেলে মেয়েকে দেখতে এসেছে। ওরে তোর ছেলে মেয়ে কতো শাক-সব্জি, ফল-মূল পেল তার কোন ইয়ত্তা নেই।
দিদভাই তো অবাক হয়ে বলেই ফেললো এগুলো কি রে।
আমি বললাম এখানকার সাধারণ মানুষের ছেলে মেয়ের মুখ দেখে দেবার মতো ক্ষমতা নেই তাই খেতের আনাজ-পাতি গাছের লেবু কুমড়ো আঁখ বুবুনের ছেলে মেয়ের জন্য নিয়ে এসেছে।
জ্যেঠিমনি দামিনীমাসি চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।
বরুণদা খুব এনজয় করছে।
সে এক জনস্রোত। সবাই হিমসিম খায়। কাকা মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে।
সন্ধ্যার দিকে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হলো।
কনিষ্করা জাল টানল পাঁচুদের সঙ্গে দারুণ এনজয় করছে সবাই।
সাতটা বেজে গেল, আটটা বেজে গেল, চিকনার দেখা নেই।
কাউকে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও পারছি না।
জেনারেটর চলছে। সঞ্জুর ছলেগুলো সব দেখভাল করছে। অনাদি হোলটাইম ডিউটি দিচ্ছে। সবাই আছে। বাসু বাইরেটাই বেশি সামলাচ্ছে।
আমি নিজের ঘরে এসে একটু নির্জনে বসলাম।
মনে একটা চাপা টেনসন।
চুলটা আঁচড়ানোর আর সময় পাই নি। তাই আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা আঁচড়াচ্ছিলাম। কত স্মৃতি আমাদের এই ঘরে লেখা রয়েছে।
হঠাৎ দেখি একটা মিশ কালো ছেলে ঘরে ঢুকলো।
প্রথমে বুঝতে পারি নি। তারপর মুখের কাছে আঙুল দেখিয়ে চুপ করতে বলে একটা মোবাইল এগিয়ে দিলো।
হাতে নিলাম।
হ্যালো।
হ্যালো।
গুরুমা তোমাকে নিয়ে আসতে পারলাম না। বড্ড রিক্স হয়ে যেত। রাতে তোমার ঘরে একা থাকবে। ফোনটা সব সময় অন করে রাখবে। পারলে সারারাত জেগে থাকবে। আমি যখন তখন তোমায় ফোন করতে পারি।
লাইনটা কেটে গেল।
ছেলেটা আমার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে একবার ঠক করে প্রণাম করল। নিমেষে চাল টপকে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
তুই বিশ্বাস করবি না বুবুন আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কি নিস্তব্ধে কাজ করে গেল ছেলেটা। কাক পক্ষীও টের পেল না।
তখনি বুঝলাম তুই আজ চিকনাকে ফোন করতে পারিস।
সেই মুহূর্তটা এতো আনন্দ হচ্ছিল তোকে কি বলবো। সব দুঃখ যেনো জুড়িয়ে গেল।
নাচতে নাচতে কোন প্রকারে এই বাড়িতে চলে এলাম।
আমার খুশি মনে হয় চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছিল।
ডাক্তারদাদার চোখ বুঝলি। একবারে মাইক্রস্কোপ।
ঠিক ধরতে পারল। আমি বুঝলাম আর ডাক্তারদাদা বুঝলো।
তোর ছেলে মেয়ের আজ চোখে ঘুম নেই। পিকু আর দুটোতে মিলে পাগল করে দিচ্ছে। সঙ্গে অনাদির বাচ্চা দুটো বাসুর ছোট ছেলেটা।
তোর বাড়িতে ধানের সাম্রাজ্য। তাই সবার এই বাড়িতে শোবার আয়োজন। আমারও।
আমি বললাম না আমি ওবাড়িতে শোব।
একা একা কি করে ও বাড়িতে শুবি!
বড়মা বললো।
আমি পারবো।
ডাক্তারদাদা বললো ও যখন ও বাড়িতে শুতে চাইছে যাক না।
সঞ্জুর ডাক পরলো। সে পাহাড়া দেবে নিচে।
বড়মা চিকনার কথা জিজ্ঞাসা করলো।
কাকা বললো, চিকনা!
সে এখন অনাদির থেকে বড়ো নেতা। লোকে অনাদির থেকে ওকে এখন বেশি খোঁজে।
ঘরে চলে এলাম। ছেলে মেয়ে তার দিদাই দিদানের কাছে।
সময় আর কাটতে চায় না। ঘর অন্ধকার করে মোবাইলটা ভাইব্রেট মুডে রেখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। সেই মিশ কালো অন্ধকার।
জেনারেটরের তারস্বর শব্দ। ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক। ঝলমলে জ্যোৎস্নারাত। সব একরকম আছে। কোথাও কোনো পরিবর্তন হয় নি। জোনাকিগুল মাঝে মাঝে জলছে আর নিবছে।
হঠাৎ একটু ঝিমুনি এসেছিল। ভঁ ভঁ শব্দে চমকে তাকিয়ে উঠলাম। দেখলাম মোবাইলটা প্রায় খাট থেকে নিচে পরে যাচ্ছিল। খপ করে চেপে ধরলাম। দেখলাম চিকনার নম্বর ব্লিঙ্ক করছে।
হ্যালো।
বলো।
ঘুমিয়ে পরেছিলে।
না।
তাহলে! দুবার রিং করলাম। লাইনটা কেট না। ধরে রাখো।
চুপ করে রইলাম।
আমার কথা শুনতে পাচ্ছো।
পাচ্ছি।
টুঁ শব্দটি করবে না। পারলে মুখে কাপর বেঁধে নাও। গুরুকে লাস্ট আপডেট দেব।
আচ্ছা।
বিশ্বাস করবি না, বুকের ভেতরটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।
আড়াই বছর আগে ছেলে-মেয়ের জন্মদিনে তোর এসএমএস পেয়েছিলাম। আজ তোর গলা শুনবো, প্রায় সাড়ে তিন বছর পর। চোখ ফেটে জল আসছে। জানিনা এটা দুঃখের না আনন্দের।
তোর সঙ্গে কতো কথা বলার আছে।
দূর ছাই।
কথা বলা আর লেখা দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য। লিখতে আর ভালো লাগে না। সব সময় গুছিয়ে লিখতেও পারি না। হাত ব্যাথা হয়ে যায়। তবু না লিখে পারি না। ভুলে যাব যে।
তোকে অনেক দিন থেকেই বলবো বলবো ভেবেছিলাম বলা হয় নি।
যদিও তুই একদিন কথার ফাঁকে হিন্টস দিয়েছিলি।
বলেছিলি পরে বলবো।
সে বলা আর তোর হয়ে ওঠে নি।
আচ্ছা বুবুন সত্যি করে বলতো তুই বিয়ে করার পর আমাকে কতটা সময় দিয়েছিস।
বলবি, দেবো কোথা থেকে। তুই আমাকে এমন চক্করে ফেললি। বিয়ের মজাটাই ভুলে গেলাম।
তারপরে আরও বলবি, একজন্মে যদি সব পাওয়া হয়ে যায়, পরের জন্মে কি করবি।
আমার দরকার নেই। আমি এই জন্মেই সব কিছু পেতে চাই, তুই ফিরে আয়।
জানিস আজ কনিষ্ক বটা বিয়ে করলো। পাত্রী কে জানিষ মলি আর টিনা। কনিষ্ক মিলিকে বিয়ে করলো বটা টিনাকে।
ভেতরে ভেতরে ওদের একটা ইন্টু-মিন্টু চলছিলি সেটা বুঝতে পারতাম কিন্তু ওরা কেউ এসে কিছু বলতো না। আমিও জিজ্ঞাসা করতাম না।
সত্যি কথা বলতে কি, তুই ওদের সঙ্গে যে ভাবে মিসতিস আমি পারতাম না।
গত সপ্তাহে কনিষ্ক বটা বাড়িতে এলো। সকালের দিকে।
প্রথমে একটু অবাক হলাম। দেখলাম নীরুও কিছুক্ষণ পর এলো।
তোমার সঙ্গে একটা ছোট্ট মিটিং আছে।
আমার সঙ্গে!
হ্যাঁ। তোমাকে একটা গুরু দায়িত্ব নিতে হবে।
আবার অবাক হলাম।
কনিষ্ক বটা মিটি মিটি হাসে।
বলো।
নীরু সব বললো।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
হেসো না। অনি নেই তাই তোমাকে সব দায়িত্ব নিতে হবে।
কি দায়িত্ব নিতে হবে বলো।
সবার কাছে প্রথমে পার্মিসন আদায় করতে হবে। তারপর বিয়েটা এই বাড়িতে হবে।
তাই হলো। আমি দায়িত্ব নিলাম।
নীরুকে এই সময় দেখতে হয়।
ও শোন, নীরু বাবা হতে চলেছে।
কনিষ্ক বলেছে তোরটা আমি ডেলিভারি করবো।
নীরু বলেছে মিলিকে নিয়ে তাহলে পালিয়ে যাবে।
সে কি হাসি রে।
জানিস জানিস তোর ছেলে মেয়ে আর পিকু নিধ বর আর নিধ কনে।
সব এই বাড়ি থেকে হলো।
মিলির বাবা-মা দাদা বৌদি এসেছিল।
টিনার মা-দাদ-বৌদি এসেছিল।
বিয়ে বলতে রেস্ট্রি ম্যারেজ। আমাদের পরিচিত লোক জন ছাড়া কেউ আসে নি।
ইসলামভাই সব কিছুর দায়িত্ব নিল।
বেশ ছিলাম সারাটা দিন। খাওয়ার সময় তোর কথা উঠলো।
ব্যাশ আমার এতো সুন্দর মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে।
আচ্ছা তোর কথা না তুললেই কি হতো না ?
অনিকেতটা ভীষণ বদমাস ওইই তোর কথা তুললো।
অনিটা থাকলে এই সময় নীরুর অবস্থাটা দেখতিস।
তারপর শুরু হয়ে গেলো।
আমি কেমন যেন হয়েগেলাম, কিছু আর ভালো লাগলো না।
কাউকে বুঝতে দিই নি। তবে বৌদি বুঝতে পেরেছিল। যাওয়ার সময় বললো, মনখারাপ করিস না। তোর আর সুরোর একই অবস্থা।
তোর দাদাকে কতো বার বললাম। তোমরা কি সরকার চালাচ্ছ বলো তো। একটা ছেলেকে ধরে আনতে পারছো না।
আমার কথা শুনে বললো, যে ধরা দিয়ে বসে আছে, তাকে কি করে ধরবো বলো।

আমি কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top