ডাক্তারদাদা বললো, পরের পয়সায় খাওয়া দাওয়ার গুণ। চেহারা দেখেছিস এক একটার। সব দুধ ঘি খাওয়া শরীর। নীরু কনিষ্ককে বললো, যেটা ভর্তি হয়েছে সেটাকে দেখেছিস। না। মালটা যেমনি ঢ্যাঙা তেমনি দুবলি পাতলি, শালা এগুলো খেতে দেয়না মালটাকে। ঘরে সব সময় ওদের লোকজন কেন বলতো। উনি কারুর হাতের ছোঁয়া খান না। ফলাহার করছেন। এরাই সব নিয়ে আসে। ভর্তি হওয়ার আগে নাকি এই কন্ডিসনে উনি ভর্তি হয়েছিলেন। ডাক্তারদাদা বললো বেটা সন্ন্যাসী এতো পয়সা পায় কোথায় বলতো। সব থরো চেক আপ করাল। কিচ্ছু ধরা পরল না। তবু বলে পেটে ব্যাথা। তুমি একবার দেখো। আমি বললাম। সেটি হবে না। যতোক্ষণ রাজন না কল করছে। এটা এথিকস। ভদ্রলোক রাজনের পেসেন্ট। আমরা খুব আনন্দ করছি। একজন সন্ন্যাসী এসে বড়মাকে বললো। যিনি পৃথিবীতে নতুন ভূমিষ্ঠ হয়ে এসেছেন মৌনীবাবা তাকে একবার দেখতে চাইছেন। তুই জানিস বড়মাকে, শুনেই এক পায়ে রাজি। সে পর্যন্ত দেখতে এলো। আমরা সবাই বড়মার কথা মতো প্রণাম করলাম কে করে নি। ডাক্তারদাদা খালি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছে। কনিষ্ক আবার ইয়ার্কি মেরে বললো। দেখো এটা আবার অনি হবে না তো। বড়মা বললো ওইরকম একহাত দাড়ি মাথায় তিনহাত জটা। তাও আবার পেঁচিয়ে খোঁপার মতো বাঁধা। ছ্যা ছ্যা ছ্যা অনি হতে যাবে কেন। সেই নিয়ে কতো হাসা হাসি। রাতে তিনবার সুরোকে ফোন করলাম। বাচ্চা ভাল আছে। সুরো বললো হ্যাঁ। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চিকনা এসে হাজির। তখন কটা হবে। সাতটা। আমায় দেখে মিটি মিটি হাসছে। কাছে এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো। বড়মা ছোটমা বেরিয়ে এসে ভূত দেখার মতো থমকে দাঁড়াল। তুই এত সকালে। কার কি হয়েছে। কারুর কিছু হয় নি। ঘটা করে গুরুমাকে পেন্নম করলি। পনেরো বছর পর গুরুর দেখা পেলাম। গুরুকে পেন্নাম করে এলাম। মনটা আজ ভীষন খুশ। তাই গুরুমাকে পেন্মাম করলাম। অনি কলকাতায়! ছিলো, আজ সকালের ফ্লাইটে বম্বে চলে গেল। ওখানে কয়েকদিন থাকবে। তারপর চলে যাবে। তুমি আমাকে একবারও বললে না। আমি কি জানতাম। কাল রাতে ফোন করে বললো, সুরোর বাচ্চাটা খুব মিষ্টি দেখতে হয়েছে। কাল আমি সকালের ফ্লাইটে বম্বে চলে যাচ্ছি। তুই চলে আয়। জায়গা বলে দিল চলে এলাম। চিকনার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি ওর দিকে তাকালাম। গুরু ফোন করে নি। তুমি ভয়েজ অন করো। চিকনা ভয়েজ অন করলো। চিকনাদা। বল। সুরোর গলা। আবার কাঁদে। তুমি কোথায়। এইতো তোর অনিদার বাড়িতে। দাদা কখন গেল। যথা সময়ে। দাদাকে দেখলি। হ্যাঁ। তোর ছেলেটা খুব লাকি বুঝলি। তোর ছেলের জন্য ওর দেখা পেলাম। তুমি এভাবে বোল না। গেট দিয়ে দেখলাম, অনিমেষদা, বিধানদা ঢুকছে। বুঝলাম খবর ওই পর্যন্ত চলে গেছে। আমার ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম অনিকেত। বৌঠান একটা গজব হয়ে গেছে। কি হলো। একটুর জন্য ফস্কে গেল। হাতের কাছে কোন গাড়ি ছিল না যে ফলো আপ করবো। তবে আমি আবিদদাকে চিনতে পেরেছি। বুবুন এসেছিল! হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি। তখন সুরো চিকনার ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। বৌদি। বল। দাদাকে দেখলাম। দাদাকে ছুঁলাম। সুরো কাঁদছে। অনিমেষদারা এসে বারান্দায় দাঁড়াল। দাদাকে আমার ছেলের মাথায় হাত রেখে শপথ করিয়েছি। বলেছে খুব তাড়াতারি ফিরে আসবে। অনিসা কোথায়। ঘুমচ্ছে। অনন্য। এখনো ওঠে নি। যাক কাল ওরা ওদের বাবাকে অন্ততঃ ছুঁয়েছে। কখন এসেছিল বলতো। এসেছিল কিগো গত পাঁচদিন এখানে ছিল। এখানে ছিল মানে! নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। কি হয়েছিল। কিচ্ছু হয় নি। কোন রুমে। আমার পাশের রুমে সেই মৌনীবাবা। মৌনীবাবা! হ্যাঁ। আমার ফোন বাজছে। ছোটমাকে বললাম তুমি ধরো। অনিমেষদা আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। দাদা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করেছি। বিধানজ্যেঠুকে, প্রবীরকাকুকে ফোন করেছি। জানিনা বাবা ধরতে পারল কিনা। দাদা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করো না। অনিমেষদা মাথা দোলাল। পারেনি। চিকনাদা আসবে না। বলো আমি পরে যাচ্ছি। দেখলাম ডাক্তারদাদা ম্রিয়মান মুখে বাগানের রাস্তায় হেঁটে বারান্দার দিকে আসছে।
সুরো ফোনটা রাখল। আমি চিকনার হাতে ফোনটা দিলাম। বার বার কালকের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে আসছে। তুই চুপ চাপ মুখ বন্ধ করে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে আছিস। একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফ। তুই বুড়ো হয়ে গেছিস! না সব তোর ভড়ং! তোর দাড়ি ছিলো না। অনুপ আগে তোর ছবি আমাকে দিয়েছিল, তাতে তুই দারুণ সুন্দর দেখতে হয়েছিস। দারুণ হ্যান্ডসাম। আমি যতদূর জানি তোর কয়েকটা ছাগলদাড়ি ছিল। একমুখ দাড়ি তোর হলো কোথা থেকে ? দেখেতো কখনো মনে হয় নি ওটা ফল্স! তাহলে! বড়মা আবার এই নিয়ে কতো হাসাহাসি করলো। জ্যেঠিমনি তালে তাল দিল। তোর হয়ে তোর চেলা দুটো সমানে উত্তর দিচ্ছে। তুই ইশারায় ওদের কি বলছিস। টক টকে গেড়ুয়া বসন। গলায় রুদ্রাক্ষ। স্ফটিকের বিশাল মালা তিন প্যাঁচে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত ঝুলছে। আমি তোকে ছুঁয়েছি। তুই আমার মাথায় হাত রেখেছিস। আমি তোর স্পর্শটা বুঝতে পারলাম না! তোহলে কি তোর শরীরের গন্ধ স্পর্শ আমি ভুলে গেছি। একি করলাম আমি। তোর মুখশ্রী কি অনেক বদলে গেছে! হবে হয়তো, সতেরো বছর সময়টা কম না। চল ভেতরে চল। অনিমেষদা কাছে এসে দাঁড়াল। কি করবি, কপাল। চোখ তুলে তাকালাম। বড়মা গম্ভীর। ছোটমা অনবরতো ফোনে কথা বলে চলেছে। ফোন আসারও বিরাম নেই। দাদা মল্লিকদা সোফায় হেলান দিয়েছে। আমি পায়ে পায়ে বড়মার কাছে গেলাম। জড়িয়ে ধরলাম। আমি না হয় ভুল করেছি, তুইও ভুল করলি। একই প্রশ্ন তো আমার বড়মা। তুমিতো কতো কথা বললে ওর সম্বন্ধে শেষে বললে ও কিছুতেই তোর বুবুন হতে পারে না। আমি এতটা ভুল করবো না। তাহলে সুরো ভুল কথা বলছে। সে হবে কি করে। তাহলে তুমি বলো। বজ্জাত ছেলে। বড়মা চেঁচিয়ে উঠলো। বলো না। ওর ক্ষতি হবে। সন্ন্যাসী সাজা হয়েছে। মৌনীবাবা। একবার বাড়ির দোরগোড়ায় পা দিক। বড়মাকে নিয়ে ভেতরে এলাম। আবার চেলা গুলো বলে কিনা উনি গুরুজনদের প্রণাম নেন না। ভূমিতে মাথা ঠেকান। ঢং। ছোটমা এগিয়ে এলো। চোখে মুখে কষ্টের ছাপ। তবু চোখের দেখা দেখেছি। এতেই যেন শ্বস্তি। দাদা বসে আছে। মাথা নীচু করে। হ্যাঁগো, তোমার চোখে কি নেবা হয়েছিল। দাদা বড়মার দিকে তাকাল। কালতো অতোক্ষণ ধরে ছেলেটাকে দেখলে, চিনতে পারলে না। দাদা হাসতে গিয়েও, হাসতে পারল না। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সবাই দেখেছে। অনেক সামনা সামনি। বলতে পারিস তোর সেই মুখ এখনকার মুখ হয়তো বদলেছে। দেখছিস মিত্রা দেখছিস মিনষের চাউনি দেখ, যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। সুরো বললো চলে আসবে। সুরোকে যখন ও কথা দিয়েছে, নির্ঘাৎ চলে আসবে। না এসে যাবে কোথায় শুনি। বড়মার গলার স্বর সপ্তমে চড়েগেল। ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি বসো। ইসলামভাই ঘরে ঢুকলো। অনিমেষদা সঙ্গে সঙ্গে বললো, আবিদকে ফোন করেছো। আসছে। আসুক আজ। সবকটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবো। তুই একটা ফোন করতে পারিস নি। চিকনার দিকে তাকাল। চিকনা হাসছে। লজ্জাকরে না তোর। কালতো অতোক্ষণ কথা বললে। ওতো বোবা ছিল, গলার স্বর শুনতে পেয়েছি। ঘরেও গেছিলে। পায়ের কাছে বসে বসে কথা বলেছো। একবার মৌনীবাবার বুকটায় হাত দিয়ে দেখতে পারতে। বুকটা কেমন ধক ধক করছিল। তোকে বলেছে বুঝি। না বললে বলছি কি করে। আমি কি তখন ওখানে ছিলাম। ইসলামভাই মুখে ওর্ণা চাপা দিয়েছে। দাদা, বৌদি কোথায় ? সুরোর ওখানে নামিয়ে এসেছি। আপনি গেছিলেন। গেছিলাম। ফোনে সব জায়গায় খবর পাঠিয়েছি। ওরা কিছু খবর পেলে জানাবে বলেছে। ফলো আপ করা যাবে। চেষ্টা করছি। তোর মেয়েরা উঠলো। সকাল সকাল এতো লোকজন দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেছিল। চিকনাকে পেয়ে তারা খুব খুশী। হাজার প্রশ্ন। চিকনাকে দেখিয়ে দিলাম। যা চিকনাদা উত্তর দেবে। একে একে সবাই এসে হাজির। কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলবো। একমাত্র দামিনীমাসি কাঁদছে। আর সকলের মন খারাপ। তবে সেই রাতের মতো নয়। বড়মার কথায় দামিনীমাসি মৌনীবাবাকে ফল কিনে এনে দিয়েছিল। অনিমেষদার ফোনটা বেজে উঠলো। হ্যাঁ বলুন।….ট্রেস পাওয়া গেছে….এখন কোথায়….ম্যাড্রাস! শুনলাম যে বোম্বাই-এর বিমান ধরেছে।….ইন্টেলিজেন্সব্যুরো!….ফোনে বলা যাবে না। ঠিক আছে আপনি একবার বেলার দিকে একটু আসুন। কি বলছে। বিধানদা অনিমেষদার দিকে তাকাল। পরে বলছি। অনিমেষ খারাপ কিছু। বড়মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো। না। তাহলে। ওর সঙ্গে যারা ছিলো তার সবাই ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর লোকজন, একটা কাজে কলকাতা এসেছিল। দুজন খালি অনির লোক ছিল। চিকনা হাসছে। তুমি হাসছো কেন। ওরা হচ্ছে আমাদের গ্রামের রবি আর নগনা। তুমি ওদের চেন। আমার গ্রামের ছেলে চিনবো না। অনি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। কবে ? সেই যখন প্রথমবার কলকাতায় এলো। তখন ওরা খুব ছোট। আমি ওদের চিনি। চিনবে না। সেই যাদের ও গাছ থেক পিয়ারা পেরে খাইয়েছিল। ওরা আঁখ নিয়ে এসে ওকে দিয়েছিল। সেই বাচ্চা। কতোদিন হয়েছে। তা বছর এগারো হবে। ওরা এখন ওখানে চাকরি করে। ওদের বয়স কতো। বছর পঁচিশ ছাব্বিশ। ওরা কলকাতায় যাতায়াত করে। খবরা খবর নেয়। কই এতো দিন বলনি। বারন ছিলো। এখন ও সবাইকে বলতে বলেছে। আজ কি বললো। ভাল মন্দ খবরা খবর নিল। বললো খুব শিগগির চলে আসবে। কবে আসবে বলেছে। তা কিছু বলে নি। আবিদ ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বড়মা চেঁচিয়ে উঠলো, বেরো এখান থেকে, সব আপদ এসে এখানে জুটেছে। আবিদ এসে বড়মার পায়ে পরেগেল। পরের বার এলে তোমাকে আর ম্যাডামকে নিয়ে যেতে বলেছে। এই যে বলতিস তোদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই। তুমি অনিদাকে আমার থেকে ভাল করে চেন। কি করবো বলো। অনিমষদা হাসছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সব দোষ খালি আমার। তা কার শুনি। তোমাকে কতো লোকের কথা বলবো বলো। অনিমেষদা চায়েরকাপটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখল।
আবিদকে নিয়ে দাদার ঘরে চলে গেল। কি কথা বললো ওরা জানে। প্রায় আধঘন্টা। আজ আর অফিসে যাওয়া হলো না। কানাঘুষো অফিসের সবাই জেনেছে। দুপুরের দিকে সুরোর কাছে গেলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে একচোট কাঁদল। জানো বৌদি রাত তখন দেড়টা বাজে। সবে মাত্র একটু তন্দ্রা এসেছে। আয়াটা ঠেলা মারল। ভাবলাম ছেলেকে দুধ খাওয়াতে হবে। হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। তোর সঙ্গে দেখা করবো। ঘুমিয়ে পরেছিস নাকি ? অনিদা। কি বলবো তোমায় বৌদি, বিছানা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। পাশের ঘরে তখন ফুস ফুস গুজ গুজ চলছে। আয়াকে বললাম কোথায় ? আপনি বললে উনি আসবেন। এখুনি ডেকে আনো। দেখি মৌনীবাবা এসে হাজির। বিকেলের দেখার সঙ্গে অনেক পার্থক্য। তখন কেমন বুড়োটে বুড়োটে দেখতে লাগছিল। কপালে নাকের ওপর একগাদা তিলক মাটি লাগান ছিল। তখন সব পরিষ্কার। তুমি বিশ্বাস করবে না বৌদি দাড়িটা কেটে দিলে সেই মুখ, সেই চোখ।…. কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কিরে দাদাকে চিনতে পারলি না। গলার স্বর শুনে জড়িয়ে ধরলাম। সেই গলা। একটুও বদলায় নি বৌদি। বাচ্চাটাকে কোলে নিল। গলায় একটা হার পরিয়ে দিয়ে গেছে। এই দেখ। আবার একমুখী রুদ্রাক্ষ আছে। আমি বললাম ছেলেকে নিয়ে তোমার একটা ছবি তুলি। বাধা দিল। বিয়ের দিনের কথা বললো। আধঘন্টা ছিল। আমি ছেলের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছি। বললো এটা তুই অন্যায় কাজ করলি সুরো। আমি যদি ফিরতে না পারি। ফিরতে তোমাকে হবেই। না হলে আমি সবাইকে এখুনি চেঁচিয়ে ডাকব। কি হবে, তোর অনিদার এতদিনের সাধনা তুই নষ্ট করবি। তুই চাস তোর অনিদার এত দিনের সাধনা তীরে এসে তরী ডুবে যাক। কবে আসবে বলো। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো, আর ভাললাগছে না। অনিদাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বললো, একটা কাজে কলকাতা এসেছিলাম। তুই যে এই নার্সিংহোমে ভর্তি হবি জানতাম না। তোর বাচ্চা হবে জানতাম। মনে মনে ইচ্ছেছিল তোর বাচ্চাটাকে দেখার। ঈশ্বর ইচ্ছেটা পূরণ করে দিল। কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমি সকালের ফ্লাইটে ফিরে যাব। চিকনাকে আসতে বলেছি। ওকে অনেকদিন চোখের দেখা দেখিনি। তুমি এখানে ভর্তি হয়েছিলে কেন। অভিনয় করতে এসেছিলাম। এখন কি করে যাবে। আবিদকে আসতে বলেছি। তোমার ফোন নম্বরটা দাও। আমার ফোন নেই। তুমি যে কথা বলো। এদের ফোন থেকেই বলি। তোর দাদার একটা রিকোয়েস্ট রাখবি ? বলো। আমি চলে যাবার পর এক ঘন্টার মধ্যে কাউকে ফোন করবি না। কেঁদে ফেলেছিলাম। দাদার কথা রেখেছি বৌদি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। বললাম তোমার তো দাড়ি ছিলো না। বললো অনেক কষ্টে বানিয়েছি। সে অনেক গল্প তোকে ফিরে এসে বলবো। প্রত্যেক বছর দেয়ালে ফোঁটা দিচ্ছিস। আমি এই কথার উত্তর দিতে পারি নি বৌদি। সুরো কিছুক্ষণ কাঁদল। সবাই শুনলো কেউ কোন কথার জবাব দিতে পারল না। জীবনে দ্বিতীয়বার ঠকলাম। তোকে কথা দিলাম থার্ড টাইম তুই আর ঠকাতে পারবি না। হাসিস না। তুই জানিস তোর মিত্রার মাথায় বুদ্ধি কম। তাই মিত্রার জীবনের ওপর দিয়ে এতো ঝড় বয়ে গেলেও সে বুবুনকে ছাড়ে নি। লতাপাতার মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বুবুন যে তার একান্ত আপনার। কতজন তোর মিত্রার কাছ থেকে বুবুনকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে। পারে নি। বিশ্বাস কর বুবুন আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমি জানি তুই নিজের জন্য বাইরে বাইরে পরে থাকছিস না। তুই আমার জন্য বছরের পর বছর বাইরে পরে আছিস। তোর ছেলেটা আমার মত। মেয়েটা তোর মতো। কিছুতেই আটকাতে পারছি না। মাথায় যেটা ঢোকাবে তার শেষ না দেখে ছাড়বে না। কতো উদাহরণ তোকে দিই বলতো। অনিসার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা হয়ে গেলো। এতোক্ষণ কারুর সঙ্গে দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নি। ওঃ লোকাল ট্রেনের যাত্রীগুলোও সে রকম যেন ওকে চেটে পুটে খাচ্ছে। একটা মেয়ে কি কখনো একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ? একা দাঁড়িয়ে আছে বলে ওরকম হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকতে হবে। দু’একজন তো আওয়াজই দিয়ে দিল। কিগো একা কেন। যাবে নাকি। কানের লতিটা গরম হয়ে গেছিল। মনে মনে চ্যাটের ভদ্রলোককে গালাগাল দিল। তবু অনিসা মনে মনে হেসেছে। ছেলেগুলো কি নির্বোধ। এখুনি গিয়ে ও যদি কানটা ধরে ওর পরিচয় দেয়, হয়তো প্যান্টটাই নষ্ট হয়ে যাবে। দূর ছাই, লোকটা যে কি। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করলো। ডায়াল করলো। কিরে, তুই কলেজে এলিনা কেন। গেছিলাম, চলে এসেছি। তুই কোথায় বলতো এতো চেঁচামিচির শব্দ। শিয়ালদা স্টেশন। ওখানে কি করছিস। দাঁড়িয়ে আছি। একজনের সঙ্গে দেখা করবো। আমাকে বললি না। তুই প্র্যাক্টিক্যাল কর। কোথায় আছিস বল, আমি এখুনি যাচ্ছি। আসতে হবে না। প্রেমানন্দের খোঁজ পেয়েছিস। এখনো পাই নি। কালরাতে চ্যাটে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। কটার সময়। সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। আমার সঙ্গেও ওই সময় কথা হয়েছে। তবে আমি আরও এক ঘন্টা বেশি কথা বলেছি। তোর কি মনে হচ্ছে। মনে তো হচ্ছে ইনিই মিঃ অনি ব্যানার্জী। কি করে বুঝলি। এতো সব পটাপট বলে দিচ্ছে। শোন তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি। আপনি অনিসা। একজন ভদ্রলোক কাছে এসে দাঁড়ালেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী। কাপরটা লুঙ্গির মতো করে পড়া। মিস কালো চুল একেবারে ছোট ছোট করে ছাঁটা। দেখলে মনে হয় সদ্য কেউ মরাগেছেন। নেড়া হওয়ার পর চুল উঠেছে। আসুন। অনিসা চারদিক ভাল করে লক্ষ করলো। সেভাবে কাউকে বুঝতে পারছে না। আবিদ আঙ্কেলকে ব্যাপারটা জানালে ভাল করতো। একটু বেশি রিক্স নিয়ে ফেলেছে। রিক্স কেন ? মা যে বলে তোর বাবা তোদের জন্য পাহাড়াদার ঠিক করে রেখেছে। তাহলে কি এখানে বাবার লোকজন কেউ নেই ? মায়ের কথা ঠিক হলে নিশ্চই থাকবে। কাউকে চিনতে পারছে না। ভদ্রলোক অনিসার পাশে পাশে মাথা নীচু করে হাঁটছেন। অনিসার সঙ্গে কোন কথা বলছে না। ও নিজে নিজেই যেচে কথা বললো। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি। বলতে পারব না। আমার ওপর দায়িত্ব আছে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া। তারমানে আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানে যেতে হবে ? ওটা আপনার ইচ্ছে। ভদ্রলোক খুব নরম সুরে বললেন। অনিসা থমকে দাঁড়াল। যতই হোক একটা মেয়ে। দেখতে শুনতেও ও নেহাত খারাপ নয়। চ্যাটে কথা বলে ও গেইজ করেছে। ব্যাপারটা কি খুব রিক্স হয়ে যাচ্ছে না। ভদ্রলোক অনিসার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি তাহলে ফিরে যাই। অনিসা ভদ্রলোকের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো কোন দূরোভিসন্ধি আছে কিনা। মুখ দেখে ও কিছু বুঝতে পারল না। সৌম্য শান্ত মুখশ্রী। চিকনাদা বলেছিল, সাপুরে যখন সাপ খেলায় লক্ষ করেছিস। সাপ খেলায় কখনো দেখি নি। কখনো দেখলে ভালো করে লক্ষ করে দেখবি, সাপুরে সাপের চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে বাঁশি বাজায়। সাপ চোখ দিয়ে শোনে কান দিয়ে দেখে। ধ্যাত সাপের কান আছে নাকি। খোঁজার চেষ্টা করিস পেয়ে যাবি। বলেছিল, যে কোনো মানুষ তার সব কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে কিন্তু চোখের অভিব্যক্তি সে কোনদিন লুকিয়ে রাখতে পারে না। যার সঙ্গেই কথা বলবি চোখে চোখ রাখবি। জিতে যাবি। চোখ হচ্ছে মনের আয়না। এটা আমার কথা নয়, তোর বাবার কথা। তাই তোর বাবাকে গুরু বলি। বুঝলি বুঁচকি সব প্র্যাক্টিস। তুই যতো চর্চা করবি তত জানতে পারবি। এই যে আমি, একসময় ছাগল ছিলাম। শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করতাম। এখন চিকনাদাকে যা দেখছিস সব তোর বাবার দাওয়াই। তোর চিকনাদা তোর বাবা ছাড়া অন্ধ। অনিসা চিকনাদার কথা বহুবার ফলো আপ করেছে, হাতে হাতে ফল পেয়েছে। সে কথা চিকনাদাকে ও জানিয়েছে। কিন্তু এই কথাটা চিকনাদাকে জানান উচিত ছিল। অন্ততঃ পক্ষে একবার ফোন করা উচিত ছিল।
কতোক্ষণ লাগবে যেতে। বেশিক্ষণ না। মিনিট তিনেক। অনিসা হাঁটতে শুরু করলো। শিয়ালদহ ফ্লাইওভারটার তলায় তখন গিজ গিজ করছে লোক। উঃ লোকগুলোর গায়ে কি বোঁটকা গন্ধ। অনিসার চোখে মুখে একটা অস্বস্তি। কলকাতা শহরে এরকম একটা নোংরা ভ্যাট ওপেন এয়ারে থাকতে পারে ওর জানা ছিল না। হৈ হৈ শব্দে চমকে উঠলো। এখুনি ও মাল বোঝাই ট্রলিটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল। লোকটা বাঁদিকে একটা গলির মধ্যে ঢুকলো। অনিসার বমি পেয়ে যাচ্ছে। ইস কি পচা মাছের গন্ধ। এখানে মানুষ থাকতে পারে ? অনিসা চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। সম্পূর্ণ এক নতুন জগৎ। এই এঁদো গলির মধ্যে লোকটা কোথায় নিয়ে চলেছে! একা ছেড়ে দিলে ও চিনে বেরতে পারবে তো ? বেরতে ওকে হবেই। ও এই পথের শেষ দেখে ছাড়বে। একবার যখন নেমে পরেছে, শেষটা ওকে দেখতেই হবে। গলি তস্য গলি। নোংরার বেহদ্দ জায়গা। পায়ের স্লিপারে কাদা লেগে চটচটে হয়ে গেছে। গা ঘিন ঘিন করছে। গলির শেষপ্রান্তে একটা অন্ধকার মতো চায়ের দোকানে এসে লোকটা দাঁড়াল। এই দিনের আলোতেও জায়গাটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার। এই জায়গাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। একেবারে বাজরটার শেষপ্রান্ত। চারিদিকে কাঁচা আনাজের বর্জ্য ডাঁই করে পরে আছে। দুর্গন্ধ ম ম করছে। অনিসা নাকে রুমাল চাপা দিল। ভদ্রলোক ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। অনিসা একবার ভেতরের দিকে তাকাল। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ঝিমচ্ছে। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। ভদ্রলোক দ্বিতায়বার কোন কথা বললো না। সামনে খানিকটা গিয়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পরলেন। অনিসা চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে দুরু দুরু করে উঠছে। কলকাতায় আছে কিন্তু এইরকম একটা জায়গা! অনিসার কাছে কলকাতাটাই কেমন অচেনা অচেনা ঠেকছে। কনিষ্ক মামা বলেছিল বাবা ভাসিলা ভেরিতে যেত। ওখানে টনা মনা বলে কারা যেন আছে। মায়ের লেখায় টনা মনার নাম পেয়েছে। বাবার সঙ্গে সুরো পিসির বিয়েতে পাগল সেজে ছিল। বাবা নাকি এখানে পরাতে আসতো ? হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পরতেই একটা লোক যেন আড়ালে চলে গেলো। মুখটা চেনা চেনা মনে হলো যেন! কোথায় দেখেছে। ঠিক খেয়াল করতে পারল না অনিসা। ভাববার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ মনে পরেছে যখন স্টেসনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই সময় সামনের কাগজের স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজ পরছিল লোকটা আর টেরিয়ে টেরিয়ে ওকে দেখছিল। নিমেষের মধ্যে লোকটা কোথায় উধাও হয়ে গেল ? ফোনটা বেজে উঠলো। শুভ। লাইনটা কেটে দিয়ে স্যুইচ অফ করে দিল। তারমানে ওর পেছনেও লোক লাগান আছে। এরা কারা আবিদ আঙ্কেলের লোক না বাবার ? মায়ের লেখায় ও বাবার গতিবিধি পরেছে। এখন একটু একটু ও ধরতে পারছে। একটা নিপাট গ্রামের ছেলের সঙ্গে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এতোটা রিলেসন কিসের ? বাবা অশিক্ষিত নয়। অনেকের থেকেই বরং বেশি শিক্ষিত। তাহলে! একদিন খুঁজে খুঁজে সুনীত আঙ্কেলের বাড়িতে গেছিল। দেখেছিল ফ্ল্যাটে তালা দেওয়া। পাশের ফ্ল্যাটে বেল বাজিয়ে ভদ্রলোককে সুনীত আঙ্কেলের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিল। ভদ্রলোক কেমন যেন বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল। ডঃ ব্যানার্জীর কথা কেউ খুলে বলতে চাইছে না। অরিত্র মামা একদিন মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল। অনিদাটা না থকলে মালকিন এতদিনে স্বর্গধামে বিচরণ করতেন। মাকে কিছু বলে নি তবে মার সঙ্গে ডঃ ব্যানার্জীর একটা রিলেসন ছিল। এটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কি সেই রিলেসন। প্রেমানন্দ বলেছে সে সব জানে। রাজনাথ, টোডি সব কেমন যেন জট পেকে আছে। অনিসা কিছুতেই বুঝতে পারছে না বাবার কাছে এরা কেন হার্মফুল। বাবার সম্বন্ধে মায়ের কোন তাপ উত্তাপ নেই। নিজের মনের কথা লিখে রেখেছে। বাবা নাকি সবার মধ্যে একটা সেতু রচনা করেছে কিসের সেই সেতু। ইসি মনিকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। ইসি মনি হাসতে হাসতে বলেছিল। বুঝলি আনিসা আমার কাছে সব কিছু ধোঁয়াসা লাগে। অনিসা বুঝেছে ইসি মনি ওকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। বরুণমশাইকে বলেছিল তুমি কিছু জানো। জানলেও তোকে বলা যাবে না। তোর বয়স হয় নি। আর কবে বয়স হবে। একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসছে জায়গাটা। এমনিতেই অন্ধকার জায়গাটা। অনিসার কেমন গা ছম ছম করতে লাগল। যে দু’একটা লোক আশে পাশে দাঁড়িয়েছিল তারাও এখন নেই। না এখন মনে হচ্ছে কাজটা ও ভুল করে ফেলেছে। ও ফিরে যাবে। হটাৎ কাঁধে কে যেন স্পর্শ করলো। পেছন ফিরে তাকাল। তিনটে লোক। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে। সে কুচকুচে কালো। মুখটা ভীষণ হিংস্র। দেখলে ভয় লাগে। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে কি বিশ্রী ভাবে হাসছে। বাঘ যেমন শিকার পেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমনি। ঠোঁটের গোড়া থেকে কানের ডগ পর্যন্ত কাটা। লম্বা কাটা দাগটা ওর মুখটাকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। একটা চোখ কেমন যেন স্থির। নড়াচড়া করছে না। অনিসার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। অনিসা লোকটার চোখে চোখ রাখলো। আর দুজন ওর সারাটা শরীরে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
অনিসা প্রথমে কোন কথা বলতে পারল না। বুকের ভেতরের লাব-ডুব শব্দটা যেন হঠাৎ প্রবল মাত্রায় বেড়ে গেল। তার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। খাসা মাল মাইরি। একেবারে ডবকা। কি নিষ্ঠুর হাসি ওদের চোখে মুখে। লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বললো। চেঁচাতে গিয়েও অনিসা চেঁচাতে পারল না। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরলো না। বুকের সাইজগুলো দেখেছিস। একেবারে হিমসাগর আমের মতো। ছেলেটা হাত বাড়াল। অনিসা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না। দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সজোরে থাপ্পর কষাল ছেলেটার গালে। তারপর হাতের ব্যাগটা দিয়ে মাথায় আঘাত করল। এলোপাথাড়ি হাত পা ছুঁড়তে লাগল। অনিসা তখন আর নিজের মধ্যে নেই। কতোক্ষণ এরকম হাত পা ছুঁড়েছে খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরতে দেখল ছেলেটা ঠায় দাঁড়িয়ে ওর মার খেয়ে যাচ্ছে। আর দুটো ছেলে ওর ঠিক পেছনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। অনিসা হাঁপিয়ে পরেছে। গলা দিয়ে তখনো স্পষ্ট করে আওয়াজ বেরচ্ছে না। কাঁদতেও পারছে না। সামান্য গোঁ গোঁয়ানি। হাপরের মতো বুকটা তখনো ওঠা নামা করছে। অনিসা পেছন দিকে ফিরে পালাবার চেষ্টা করলো। ছেলে দুটো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। অনিসা হাত তুললো। ছেলেদুটোর কোন মুভমেন্ট নেই। স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিসা কেমন যেন হয়ে গেল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিজের ইমোসানকে নিজেই দোষ দিতে চাইল। এ কি করলো ও। আচ্ছা এতো মার খেয়েও ওরা তিনজন কেন প্রতিরোধ করলো না ? ওদের তিনজনের শক্তির কাছে ও তো ফুতকারে উড়ে যেতে পারতো। এখানে কোথাও তুলে নিয়ে গিয়ে…..। অনিসা আর ভাবতে পারছে না। কই তা তো ওরা করলো না! মুখ বুঁজে লোকটা সমানে ওর চড় লাথি ঘুসি খেয়ে গেল। সত্যি তো! বোন। এতো দূর এসে তুই খালি হাতে ফিরে যাবি। অনিসার সারাটা শরীর কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। বোন কথাটা শোনার পর ওর ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। চমকে ফিরে তাকাল। কালো বিশ্রীমার্কা চেহারার ছেলেটা ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। ঠোঁটের কোল বেয়ে রক্ত বেরচ্ছে। মুখটা কেমন হাসি হাসি। অনেক মেরেছিস, আর মারিস না। মাথায় ভীষণ লেগেছে। অনিসা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। অনিসা চোখে চোখ রাখল। লোকটা মাথা নীচু করলো। আর তোকে কোনদিন অপমান করবো না। এই প্রথম এই শেষ। অনিসা কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত আগের ঘটনা। তাহলে কি ও স্বপ্ন দেখছিল ? সারাটা শরীর কেমন আলগা হয়ে আসছে। প্রচন্ড উত্তজনার পর উত্তেজনটা যখন হঠাৎ করে থিতু হয়ে যায়, তখন শরীরের অবস্থাটা যেমন হয় এখন ঠিক তেমনি লাগছে। দু’একজন লোক ডাস্টবিনের ওপাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেগেল। চল। অনিসা তবু লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল। আজ বিশ্বাস হচ্ছে তুই অনি আঙ্কেলের মেয়ে। অনিসা মাথা নীচু করলো। তোর দ্বারা হবে। তুই পারবি। বুকের ভেতরটা কেমন ব্যাথা ব্যাথা করছে। আয়। ছেলেটা সামনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো। অনিসা সম্মোহনের মতো ধীর পায়ে ওদের পেছন পেছন চলতে শুরু করলো। সেই গলি। যে গলিতে ওই ভদ্রলোক অদৃশ্য হয়েগেছিল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গলিটা একজায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পরেছে। এদিকে ওদিকে কোন রাস্তা নেই। ব্লাইন্ড গলি। লোকটা বাঁদিকের দরজায় ঠেলা মারলো। একটা ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। ভেতরে এলো। পুরনো আমলের বাড়ি। বিরাট একটা উঠোন। অনেকটা হস্টেলের মতো। তিনতলা। চারিদিক অপরিষ্কার। অনেকদিন কোন সংস্কার হয় নি। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। অনিসা মনে মনে ভাবলো সিঁড়ির যা অবস্থা যে কেন দিন ভেঙে পরতে পারে। তাছাড়া দিনের বেলাতেও মনে হয় সিঁড়িতে লাইট জালতে হয়। ভিকিদা আমরা এবার যাই। বস কি বলে শুনে নে। তারমানে ভদ্রলোকের নাম ভিকি। এটা কি আসল নাম না নকল। সবাই দোতলার বাঁদিকে বাঁক নিয়ে প্রথম ঘরটার সামনে দাঁড়াল। আয় ভেতরে আয়। কোন ভয় নেই। অনিসা তাকিয়ে আছে। মানুষ নেশা করলে যেমন হয় অনেকটা সেই রকম। ঘরের ভেতরে এলো। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ভেতরে এরকম একটা ঘর থাকতে পারে। ঘরের প্রতিটা কোনে একটা রুচির ছাপ। এসিরুম। আপনি বসুন। একটা ছেলে সোফাটা দেখিয়ে দিল। এখনো বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে। ভিকি বলে ছেলেটা ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা এখনো চিন চিন করছে। অনিসা মুখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নীচু করে বসলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কাঁদতে পারছে না। কিরে খুব মারপিট করেছিস শুনলাম। পরিচিত কণ্ঠ চমকে তাকাল অনিসা। রতন আঙ্কেল! অনিসা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, ছুটে এসে রতনকে জড়িয়ে ধরলো। রতনের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রতন অনিসার পিঠে হাত রেখেছে। এইটুকুতেই যদি কেঁদে ফেলিস তাহলে লক্ষ্য পূরণ হবে কি করে। তোকে আরও অনেক হার্ডেল পেরতে হবে। অনিসার কিছুতেই কান্না থামছে না। ভিকি ওর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আয়। দাঁড়াও আগে মাথায় ডেটল দিই। কেন ? যা জোরে ব্যাগটা দিয়ে মারল। মাথাটা ফেটেছে মনে হয়। অনিসা রতনের বুক থেকে মুখ তুললো। হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। কি আছে তোর ব্যাগে ওর মাথা ফাটালি। মোবাইল আর ছাতা আছে। বাজে কথা বললো কেন। আমি বলতে বলেছি। না হলে তোর মোন বুঝবো কি করে। অনিসা রতনের বুকে মাথা রাখল। যা বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নে। বাবা কোথায় বলো। বাবা বাবার জায়গায় আছে। তুমি সব সময় বলে এসেছো বাবার সঙ্গে তোমার কোন যোগাযোগ নেই। এখনো তোকে সেই কথা বলবো। তাহলে আমাকে যে আসতে বলেছে। তোকে প্রেমানন্দ আসতে বলেছে। ও তোর বাবার খাস লোক। আমরাও তার কথা মতো চলি। তাকে তুমি দেখ নি। না। তোর বাবা ম্যাসেজ করে জানিয়েছিল। বাবার ফোন নম্বরটা দাও। আমার কাছে নেই। তাহলে তোমাকে যে ম্যাসেজ করেছে বললে। সেটা অন্য কারুর মোবাইল থেকে করেছে। অনিসা রতনকে ছেড়ে দিল। ভেতরে আয়। অনিসা রতনের সঙ্গে ভেতরে ঘরে এলো। একটা ছোটখাটো অফিস। ভীষণ সুন্দর সাজান গোছান। ভিকি। বলো। একবার ফাদারকে বলে আসিস একটু পরে যাব। আচ্ছা। ফাদার! অনিসা মনে মনে একবার চিন্তা করলো এখানে ফাদার আবার এলো কোথা থেকে ? অপেক্ষা করতে হবে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। দেয়ালে বাবার একটা বড়ো ফটো। ও একটু অবাক হয়ে গেল। বাবার ফটো এখানে কেন ? তোর বাবা আমার কাছে গড তাই। মালা পরাও নি কেন ? অনিদা কারুর কাছে কোনদিন মালা পরে না। ইসলামদাদাই এখানে কখনো এসেছে। একবার। যেদিন এটা ওপেন হয়। এটা কিসের অফিস। তোর বাবা যে কাজ করতে দিয়েছে তার অফিস। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট। হ্যাঁ। আবিদ আঙ্কেল এখানে আসে। না। আবিদ আঙ্কেলও তোমার মতো কাজ করে। হ্যাঁ। আবিদ আঙ্কেলের কোন অফিস নেই। আছে। কোথায় ? পার্ক সার্কাস। তুমি ওই অফিসে যাও না। মাঝে মাঝে যাই। তোমাদের দুজনের বিজনেস আলাদা। হ্যাঁ। অনিসা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রতনের দিকে। মাথায় ঢুকছে না। না। মুখ চোখটা কেমন যেন লাগছে বাথরুমে গিয়ে জল দিয়ে আয়। অনিসা উঠে গেল। রতন মোবাইলটা বার করে রিং করলো। আবার কেটে দিলো। ভিকি ঘরে ঢুকলো। নিয়ে এসেছিস। হ্যাঁ। যা প্লেটে করে নিয়ে আয়। সবার জন্য নিয়ে এসেছিস ? না। তাহলে ও খাবে না। কেন। ও ঠিক অনিদার মতো। মনগড়া কথা বলছো। ঠিক আছে প্রমান করে নে। ভিকি হাসল। অনিসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ভিকি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নিল। রতন আঙ্কেল আমাকে যে স্টেশন থেকে নিয়ে এলেন তিনি কোথায়। একটা কাজে পাঠিয়েছি। উনি আমার সঙ্গে কথাই বললেন না। উনি কম কথা বলেন। উনি কি সন্ন্যাসী। না। তুমি সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ। আবার কোথায় যেন কিছু লুকচ্ছ। তুই বুঝতে পারছিস। একটু একটু। ভিকি তোর জন্য খাবার এনেছে খেয়ে নে। তোমাদের জন্য আনে নি। আমরা তোর আসার আগে খেলাম। তুমি জানতে না আমি আসব ? জানতাম। তাহলে খেলে কেন ? ভেবেছিলাম তুই এতদূর পর্যন্ত আসবি না। সবার জন্য আনতে পাঠাও। ভিকি একবার রতনের দিকে তাকিয়ে হাসল। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তুই খেতে শুরু কর ও আনছে। আগে আনুক তারপর। রতনের মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যাঁ বলো।…আমার সামনে বসে আছে…ঠিক আছে। প্রেমানন্দ এখন ব্যস্ত আছে তোর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। রাতে তোর সঙ্গে চ্যাটে কথা বলবে। বাবা কোথায়। জানিনা। আমি বিশ্বাস করি না। আমার কিছু করার নেই। এর বেশি তোকে বলতে পারব না। কেন। সে অধিকার আমার নেই। আমার গন্ডী সীমাবদ্ধ তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আবিদ আঙ্কেল ? ওরও এক-ই অবস্থা। আমি কি কাজ করি ও জানে না। ও কি কাজ করে আমি জানি না। জানা জানি হলে। হয়তো এই পৃথিবীতে নাও থাকতে পারি। কেন! এটাই অনিদার শাস্তি। বাবা কখনো এরকম করতেই পারে না। চোখে দেখেছি তাই বলছি। ভিকি ঘরে ঢুকলো। ওদের দিয়েছিস। হ্যাঁ। যা তোরটা আমারটা প্লেটে করে নিয়ে আয়। ভিকি বেরিয়ে গেল। আবার ফিরে এলো। বোস। অনিসার দিকে তকিয়ে। নে খা। আচ্ছা রতন আঙ্কেল। বল। বাবা কি মস্তান। একেবারেই না। তুমি যেভাবে বলছো তাতে বাবাকে মাস্তান বলে মনে হয়। তোর বাবা বিশ্বাসঘাতককে শাস্তি দেয়। আর যারা বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় তাদের নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচায়। ভিকি তার প্রমাণ। অনিসা ভিকির দিকে তাকাল।
ভিকির গালটা ওরকম ভাবে কাটা কেন ? ও অনিদার কথা শোনে নি। নিজে বেশি বুঝেছিল। তাই চোখটা আর গালটা গেছে। ভিকি মাথা নীচু করে নিল। কবে হয়েছিল। কয়েক বছর আগে। বাবাতো এখানে ছিল না, বাঁচালো কি করে। এখানে এসেছিল দিন পাঁচেকের জন্য। কয়েকদিন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। সুরো পিসির ছেলে হওয়ার সময়। হ্যাঁ। তুই জানলি কি করে! প্রেমানন্দ বলেছে। মিথ্যে কথা বললি। তুমি ও ভাবে তাকাবেনা। সত্যি কথা বল। তুমি সত্যি কথা বলছো যে আমি বলবো। রতন হাসলো। চুপ চাপ। রতন আঙ্কেল। রতন আনিসার দিকে তাকাল। তুমি এই জগতে এলে কি করে। সে অনেক কথা। একটু বলো। ছোট করে। শুনবি। অনিসা মাথা দোলাল। তুই চা খাবি না ঠান্ডা খাবি। চা খাব। খুব খিদে লেগেছিল বুঝেছো। আর একটা নিয়ে আসুক। না পেট ভরে গেছে। ভিকি উঠে গেল। বলো। কি বলতো। তুমি এই জগতে এলে কেন। কেউ ইচ্ছে করে আসে। পেটের তাগিদে চলে এলাম। তারপর তোর বাবার পাল্লায় পরে নিজেকে আস্তে আস্তে ওই জগত থেকে সরিয়ে নিলাম। তোমার চায়ের দোকানটায় সেদিন গেছিলাম। আমার চায়ের দোকান! অবাক হচ্ছো। তা একটু হচ্ছি। মির্জা গালিব স্ট্রীটে। রতন একবার ভাইঝির দিকে তাকাল। মেয়েটা মনে হচ্ছে এই কয়মাসে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। ওর পেছনে এবারে লোক লাগাতে হবে। এতোদিন ভাবছিলাম ওর সখ হয়েছে। এখন দেখছি এটা সখ নয়। অনিদার মতো ওরও একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে মনে হচ্ছে। ধরা পরেগেছ। কি বলতো। মিথ্যে কথা বললে আমাকে। ঠিক তা নয় আগে দোকানটা আমার ছিল। এখন আর নেই। এখনো দোকানটা তোমার। কে বললো তোকে। খোঁজ নিয়েছি। কি পেলি। বলবো কেন তোমাকে। রতন তাকিয়ে থাকলো অনিসার দিকে। হাসলো। একেবারে অনিদার মতো চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন একেবারে ভেতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে। প্রেমানন্দর সঙ্গে ওর আলাপ হলো কি করে ? এই ব্যাপারটা ও জানতো না। ওকে জানতে হবে। কয়েকদিন আগে ওর কাছে ইনফর্মেসন আসে। সেই মতো ও কাজ করেছে। এমনও ইনস্ট্রাকসন দেওয়া আছে ও যদি কিছু জানতে চায় ওকে যেন বলা হয়। কিন্তু বুঝে শুনে। বলো। কি বলতো। বাবার কাছে বিশ্বাস ঘতকদের একটাই শাস্তি মৃত্যু। রতন হাসলো। হাসলে কেন। তুই খুব মনে রাখতে পারিস। মনে রাখব না! নে, চা খা। বুঝেছি তুমি এটাও বলবে না। বলছি। কটা বাজে বলতো। ছটা দশ। বাড়ি যাবি না। মা চিন্তা করবে। করুক। ওরা কেউ জানে না তুই এখানে। সব জানাতে হয় নাকি। মাথায় রাখবি তুই একটা মেয়ে। তাতে কি হয়েছে। কিছু একটা অঘটন ঘটলে। তোমরা আছ শাস্তি দেবে। শাস্তি দিলেই কি সব শেষ হয়ে যায়। বলো না। তোমাকে এতোবাড় বলতে হয় কেনো বলোতো। তুই চাইলি আর তোকে দিয়ে দিলাম, তাহলে তোর ইন্টারেস্ট থাকবে না। ঠিক আছে যাও তোমাকে বলতে হবে না। জানিস অনিসা সেদিনের কথাটা মনে পরলে আজও গাটা কেমন শিউরে ওঠে। সেদিন অনিদা সবে দেশের বাড়ি থেকে ফিরেছে। সেই প্রথম ইসলামভাই অনিদার বাড়িতে গেছে। কলকাতায় ঢুকেই আমাকে ফোন করলো। রতন। হ্যাঁ। একবার তুই ওমকে খুঁজে বার কর। ওম কে। পরে বলছি। ঠিক আছে। আমি বললাম, কেন আবার কি হলো। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বার কর, না হলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। আবার কি হলো! পরে বলছি। তখন অনিদার একটা টাফ ফেজ চলছে। ঘরে বাইরে সব জায়গায়। আমরা বুঝতাম কিন্তু খোলসা করে কিছু জানতাম না। ইসলামভাই জানতো আবার জানতো না গোছের। সঙ্গে সঙ্গে ওমকে ফোন করলাম। বললো তুমি পিলখানায় চলে এসো রতনদা। ইসলামভাই আমাকে ফোন করেছিল। আমরা তখন কেউ ভালো লোক ছিলাম না। এখনো নই। তবে অনেক বুঝে শুনে কাজ করি। তোর বাবার কাছ থেকে এটুকু শিখেছি। বলতে পারিস বুদ্ধি দিয়ে কাজ করি। ওখানে এসে দেখি ওম একটা ছেলেকে নিয়ে বসে আছে। আগে আমাদের সঙ্গে ছিল তারপর আমাদের অপনেন্ট দলে ভিড়ে যায়। নাম কি। ছট্টু। তারপর আবার দাদার ফোন এলো। বললো তুই ছট্টুকে নিয়ে থাক। আমি নেপলাকে পাঠালাম। অনি যাচ্ছে। অনিকে নেপলা পিকআপ করবে। অনি না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর শোন কখনো অনিকে বলবি না আমি তোদের পাঠিয়েছি। আচ্ছা। হিসাব বুঝে গেলাম আবার একটা গন্ডগোল। কেন তার আগেও গন্ডগোল হয়েছে। তোকে বললাম না ওই ফেজটাই গন্ডগোলের ফেজ চলছে। সব টালমাটাল অবস্থা। অনিদা এলো। নেপলা নিয়ে এলো। কিছুই জানি না। দাদা যা বলেছে অন্ধের মতো কাজ করছি। অনিদা যে ছট্টুকে চেনে অনিদা আসার আগে পর্যন্ত আমরা কেউ জানতাম না। কথা প্রসঙ্গে জানলাম অনিদার কাছে ছট্টু পড়তো শেয়ালদার পথ শিশুদের স্কুলে। অনিদা ওকে বহুবার পুলিসের হাত থেক বাঁচিয়েছে। ছট্টু কথা প্রসঙ্গে সব স্বীকার করলো। অনিদা ওর সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামো মারলো। আমরা সবাই হাসাহাসি করলাম। তোর মার সঙ্গে অনিদার তখন দিন পাঁচেক হলো বিয়ে হয়েছে। সেই নিয়েও হাসা হাসি হলো। একথা সেকথা বলতে বলতে অনিদা আসল কথাটা মনে হয় জেনে ফেলল। তারপর অনিদা কি কথা জিজ্ঞাসা করতে ছট্টু মনে হয় মিথ্যে কথা বললো (সেটা পরে বুঝতে পারলাম) দাম করে ছট্টুর বুকে একটা লাথি। মুখে একটা সজোরে ঘুসি আছড়ে পরলো। অনিদাকে কোনদিন রাগতে দেখি নি। সেই অনিদা রেগে টং। নেপলাকে চেঁচিয়ে বললো যা দড়ি আর লিউকো প্লাস নিয়ে আয়। নেপলা পরি কি মরি করে জোগাড় করে নিয়ে এলো। ওকে বাঁধা হলো। মুখে লিউকোপ্লাস আটকে দিলো নিজে হাতে। তখন ছট্টু অনিদার পা জড়িয়ে ধরেছে। আমাকে বাঁচাও। আমি আর করবো না। আমি জানি তুমি আমাকে মেরে দেবে। আমি তোমাকে চিনি। কে কার কথা শোনে। অনিদার চোখ মুখ দেখে আমাদের বুক হিম হয়ে গেছে। নেপলাকে বললো আমাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসবি চল। আমার আর আবিদের দিকে তাকিয়ে বললো যতোক্ষণ না আমি ফিরবো এখানে বসে থাকবি না হলে আজই হজম করে দেব দুটোকে। তখন আমাদের হাত পা কাঁপছে। অনিদা চলে যেতে ইসলামভাইকে ফোন করে সব বললাম। ইসলামভাই ছুটে এলো। ছট্টুর পেট থেকে সব কথা টেনে বার করলো। কি কথা। তোকে জানতে হবে না। বলো না। তোর বাবাকে আর ইসলামভাইকে।… বলতে পারিস তোদের পুরো পরিবারকে মারার ছক কষেছিল। আঁ। হ্যাঁ। ওর মুখ থেকে এও জানলাম ছট্টু একবার গুলি খেয়ে রাস্তায় পরেছিল। তোর বাবা পুলিশের হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছিল। কিন্তু খাতা কলমে ছট্টু হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। কনিষ্কদারা রাতে অপারেসন করে সেই গুলি বার করে। যে কিনা এতো করেছে তাকে মারার ছক কষেছে ছট্টু। কেন। সে অনেক কথা। তারপর বলো। ঠিক এক ঘন্টার মাথায় নেপলা এসে খবর দিল তোমরা ফেটে যাও অনিদা ঢুকছে। দূর থেকে দেখলাম প্রায় দশখানা গাড়ি ভর্তি স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। হাতে সব এসএলআর। ছট্টুকে তুলে নিয়ে গেল। কোথায় নিয়ে গেল কি করবে কিছু বুঝলাম না। ছট্টুর মুখ থেকে যেটুকু শুনেছিলাম ঘুটিয়ারি সরিফে কারা আছে। তারা অনিদাকে মারার ছক কষেছে। রাত দেড়টার সময় একটা ম্যাসেজ পেলাম আমি মরি নি। পরে অর্কদার মুখে শুনেছিলাম ওখানে অনিদাকে মারার জন্য তৎকালীন একজন সাংসদ ইউপি থেকে সাত জনকে ভাড়া করে এনেছিল। এমনকি অনিমেষদাকে পর্যন্ত মারার ছক কষেছিল। ওই রাতে অনিদা তাদের এনকাউন্টার করাল। আমরা সবাই ভয়ে মরি। ছট্টুর মুখ থেকে ওইটুকু সময়ে যা শুনেছি। তাতে আমাদের হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। মিঃ মুখার্জী এই অবারেশনটা করেছিল। ছট্টুকেও অনিদা কুত্তার মতো মেরে দিয়েছিল। সেই থেকে অনিদার কথার কোনদিন অবাধ্য হই নি। আজও যা বলছে যেমন ভাবে চলতে বলছে। চলছি। খাওয়া পরার কোনদিন অভাব হয় নি। সমাজে এখন আমি প্রতিষ্ঠিত বিজনেস ম্যান। আর ব্যবসা করতে গেলে তোকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে একটু আধটু ভাব রাখতে হবে। না হলে টিঁকতে পারবি না। বাবা ঠিক কাজ করেছে। তুই বলছিস। হ্যাঁ। আমি হলেও তাই করতাম। কেন। দুধ দিয়ে কাল সাপ পোষার থেকে না পোষা ভাল। রতন হাসলো। তুমি জানো মিঃ মুখার্জী কে ? জানি, শুভর বাবা। উনি মারা গেছেন। মিঃ মুখার্জীকে যারা মেরেছে তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। এটাও বাবা করিয়েছে ? আর কে করাবে, কে জানবে মিঃ মুখার্জীকে কারা মারল। পরে শুনেছি সেদিনও অনিদা মিঃ মুখার্জীকে বারন করেছিল। আজ আপনি ওই জায়গায় যাবেন না। ভদ্রলোকের অত্যাধিক সাহস। একলা বেরিয়ে পরলেন। ভাগ্যিস বাচ্চাটাকে অনিদা তুলে নিয়ে এসেছিল। বাবা শুভকে তুলে নিয়ে এসেছিল! হ্যাঁ। রতন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর ওর দাদু গিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসলো। ইসলামদাদাই এসব জানে। না। আমাকে বললে। তোর হজম শক্তি বেশি তাই। অনিসা হাসলো।