What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

দেখি নাই ফিরে (উপন্যাস) (2 Viewers)

হ্যাঁ।
কাল কখন আসছিস।
ছটা নাগাদ।
রেবাকে নিয়ে আসবি।
বলেছি। তোকে আর নেমন্তন্ন করতে হবে না। দাদাও ফোন করেছিলেন। তুই কি বলতো।
কি করবো বল। আমার গার্জন বলতে এখন দাদা ছাড়া কেউ নেই।
তা বলে দাদাকে দিয়ে আমাকে ফোন করাতে হবে।
বিশ্বাস কর আমি বলিনি। বলেছি তুমি যাকে যাকে মনে করবে বলবে।
আমার খুব খারাপ লাগছিল।
শোন একটা কথা আছে।
বল।
কাল অনিমেষদার বাড়িতে গেছিলাম।
কেনরে।
বৌদিকে নেমন্তন্ন করতে। আর মিত্রাকে দেখাতে।
কেন সেদিন বৌদির দেখে আশ মেটে নি।
শোন না।
বল।
অনিমেষদা টাকা চেয়েছে। দেড়কোটি দেব বলেছি। ওদের চেক নিতে অসুবিধে নেই কি করবো।
পুরটাই ট্যাক্সের আওতায় চলে আসবে। তুই বরং ক্যাশ দে।
আমি মিত্রাকে অফিসে পাঠাচ্ছি। ওর হাত দিয়েই নিয়ে আসব। প্রয়োজন পরলে তুই একবার সনাতন বাবুর সঙ্গে কথা বলে নিবি।
ঠিক আছে।
ফোনটা কেটেই অনাদিকে ফোন করলাম। বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো।
বুঝলাম সবাই এসে পরলো।
কিরে কোথায় তুই।
নিজের ঘরে বসে আছি।
ঘরে বসে আছিস মানে, শরীর খারাপ নাকি!
কাজ করছি।
ম্যাডামরা কোথায়।
সকালে বেরিয়েছিল এই ফিরছে।
গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পেলাম।
এখনো ওপরে আসে নি।
বল।
রবিবারের প্রোগ্রাম কি করেছিস।
আমরা চারজন যাব।
কে কে আসবি।
আমি চিকনা বাসু সঞ্জীব।
এক কাজ কর।
বল।
গোরাকে একটু বল দুটো গাড়ির ব্যবস্থা করতে। সবাই চলে আয় কাঞ্চন কে নিবি লতাকে নিবি উনা মাস্টারকে বলবি আসার জন্য সঙ্গে মিনতিকে নিয়ে নিবি। স্যারকে বলবি আমি বলেছি। আর শোন সেদিন অনিমেষদারা সবাই আসবে।
সেদিন সকালে চলে এলাম। তোর সঙ্গে দেখা হলো না। কি হলো শেষ পর্যন্ত শোনা হলো না।
পরে শুনিস।
কিরে কিরকম দিলাম বল। মিত্রা গেটের সামনে।
ওমা তুই কার সঙ্গে একা একা প্রেম করছিস। মিত্রা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।
ম্যাডম ঢুকলো, তাই না। অনাদি বললো।
হ্যাঁ।
মিত্রা ছুটে এসে আমার হাত থেকে ফোনটা কেরে নিল। কাকে চাই।
অনাদি মনে হয় হেসে ফেলেছে।
ও তুমি। কেমন আছো। দাঁড়াও একটু পরে তোমাকে ফোন করছি।
ফোনটা কেটেই আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকাল।
চল চল নিচে চল।
কেন বলবি তো।
জানি না। বড়মা বললো ওটাকে ধরে আনবি।
মাথায় লাল টিপ্পা লাগিয়েছিস। ব্যাপারটা কি বলতো।
আগামীকাল বিয়ে না।
বিয়ের আর বাকি কি রেখেছিস।
সেতো তুই। তোর জন্যই সব গন্ডগোল। চল চল।
আমাকে টেনে খাট থেকে নামাল।
তোকে কিন্তু পাঞ্জাবীটা পরে দারুণ মানিয়েছে।
তুই কিনেছিস ?
আমি না, বড়মা। নিজে হাতে।
কোথায় গেছিলি।
দক্ষিণেশ্বর।
হঠাৎ।
বড়মা কাল রাতে বললো মানত করেছি। আমি বললাম তাহলে চলো। প্রোগ্রাম বানিয়ে নিলাম।
ভালো করেছিস। কটা বাজে দেখেছিস।
আমি তোর কাজ করে এসেছি।
তোকে এই বাসন্তী কালারের শাড়িটা কে দিল।
ছোটমা। যা পরেছি, সব ছোটমা।
ভেতরেরটাও।
এক থাপ্পর।
দু’জনে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম একপাশে ডাক্তারদা, দামিনীমাসি এবং ইসলামভাই বসে আছে। আর একদিকে দেবা, নির্মাল্য।
আমাকে দেখেই দেবা বললো, আমাকে কিছু বলবি না। সব বড়মা, যা কিছু বড়মাকে বল।
তাহলে বড়মা তোর হয়ে কাজ করে দেবে।
বড়মা দেখছো। অনি কি আরম্ভ করেছে।
দামিনী মাসির দিকে তাকালাম। কিগো সব একসঙ্গে, কোথায় দেখা হলো।
এই এলাম।
মিত্রা তোমায় খাতাটা দিয়ে এসেছে ?
নিয়ে গেছিল, বলেছি কয়েকদিন রেখে দে।
বড়মা পূজোর প্রসাদ আর ফুল নিয়ে এলো। আমার মাথায় পূজোর ফুল ঠেকাল। একটা পেঁড়া দিল। আমি মাথায় ঠেকিয়ে খেয়ে নিলাম। তাহলে পূজো ভালই দিলে বলো।
হ্যাঁ।
গঙ্গার স্নানটাও জমিয়ে করলে।
তা করেছি।
মন পুরো শুদ্ধ।
তোকে আর পাকাম করতে হবে না।
দামিনী মাসির ঘরটা কেমন দেখলে য
বড়মা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল।
মিত্রা বলে নি। এটা তোমায় নিশ্চিত করে বলতে পারি।
দামিনী মাসির দিকে তাকাল।
দামিনী মাসি অবাক হয়ে বড়মার দিকে তাকিয়ে।
ওরা কেউ বলে নি, আমার কিছু লোকজোন আছে।
দাঁড়া ওই দুটো মক্কেল আসুক ঝেঁটিয়ে আজ বাড়ি পাঠাব।
ডাক্তারদাদা জোড়ে হেসে উঠলো।
তুমি হাসছো কেন।
তোমার কথা শুনে। ও যতোটা না শিওর ছিল এখন পুরো পুরি শিওর হয়ে গেল।
মানে!
ওর কোন লোকজন ছিল না, পুরটা ভাঁওতা।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ।
ও এখুনি ছিপ ফেলেছিল। মাছটা খেল। ও একটু খেলিয়ে মাছটাকে তুলে নিল।
বড়মা আমার কানটা সজোরে মুলে দিল। তোর পেটে পেটে এতো বুদ্ধি।
বুদ্ধি আছে বলেই ও মুখার্জীর মতো লোককে পকেটে পুরে রেখেছে।
তুমি কি করে জানলে।
ও ঢোকার পর থেকে ওকে ফলো করলাম।
ওর চাল চলন কথাবার্তা।
বড়মা ডাক্তারদার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে।
ও একটা জাল বিস্তার করলো। বলতে পার চাড় ফেললো। তারপর ঝুপ করে বড়শি ফেললো। মাছ খেল। ও মাছটাকে খেলিয়ে তুলে নিল।
বড়মা টেবিলের ওপর প্রসাদের থালাটা রেখে আমার পাশে বসলো।
ছোটমা আমার আর এক পাশে এসে বসলো। মিত্রা আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বলো ডাক্তার, তুমি বেশ ভলো বুঝতে পেরেছ, ওই জন্য ও চুপ করে আছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
ডাক্তারদাদা তুমি বলবে না। আগে কচুরি আসুক। মাসি তুমি ওরকম ভেটকে গেলে কেন।
তোকে দেখছি।
দেখে কোন লাভ নেই বুঝলে মাসি। একসময় তুমি আমাকে যা বলেছ আমি চোখ কান বুঁজে শুনেছি। এখন তোমার বয়স হয়ে গেছে। আমি যা বলবো তোমাকে শুনতে হবে।
আমি কি শুনি না।
শোন, মাঝে মাঝে বেগড়-বাই করো।
ছোটমার দিকে তাকালাম।
সকাল থেকে এককাপ চা পেটে পরেছে আর কিছু পরে নি। তোমরা বেশ ফুলকো ফুলকো লুচি সাঁটিয়ে এলে।
তোর জন্য নিয়ে এসেছি।
বড়মা, দাদা-মল্লিকদা কোথায় ?
অফিসে গেছে এখুনি চলে আসবে। ও ডাক্তার বলো। না হলে আবার ভুলে যাব।
ছোট একটু চা।
আগে বলো। বড়মা বললো।
অনির লুচি খাওয়া হোক তারপর।
ছোটমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
দাদা এখন না আমি যাই আগে।
দেখছিস তোর ডায়গনসিসের কি ভ্যালু।
আমি হাসছি।
মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো।
কিরে বল, কাজ হয়েছে।
মিত্রা ভয়েজ অন করে দিল। মিলির গলা।
দারুণ একটা সুখবর আছে মিত্রাদি।
তোর কথা সবাই শুনছে।
অফিসে যেতে আর ভালো লাগছে না।
চলে আয়। সুখবরটা কি বল।
কালকে আমরা অনিদার ওপর রাগ করছিলাম না।
হ্যাঁ।
সত্যি অনিদা কখনো চুপচাপ বসে থাকে না বুঝলে। ঠিক একটা কাজ বার করে নিয়ে চলে এসেছে। আমরা খালি কাগজটা নিতে এসে ছিলাম, কয়েকটা বড় বড় রসোগোল্লা খেলাম।
আমার জন্য নিলি না।
দুর চাওয়া যায়। আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।
চলে আয়।
বড়মা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল।
কিরে কাল এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছিলি।
ওই যে সুখবর আনতে, শুনলে না। আজও বেরবো।
আজ তুই একপাও বেরবি না।
ছোটমা লুচি তরকারি নিয়ে এলো।
আজ বেরবার নাম করলেই ঠ্যাং ভাঙবো।

আমি লুচির প্লেট নিলাম।
 
ছোটমা মিত্রাকে সরিয়ে পাশে বসলো।
দাদা এবার বলুন ওর বুদ্ধিটা শুনি।
ইসলাম তুমি ধরতে পেরেছ।
আমি এতোক্ষণ শুনলাম কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না। কোন কথার ও কি মানে করলো।
ও বলে না দাবা খেলে। ডাক্তারদাদা বললো।
ইসলামভাই ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে।
সত্যি ও দাবা খেলে। ঠিক কথাটা ঠিক জায়গায় পুট করে দেয়। ও উত্তর পেয়ে যায়।
দেবাশীষ, নির্মাল্য হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নিশ্চিন্তে লুচি খাচ্ছি। মিত্রা একটা লুচি অলরেডি তুলে সাঁটিয়ে দিয়েছে। আবার হাত বাড়াতে গেল, আমি প্লেট সরিয়ে নিলাম।
দিবিনা কেনরে, তোর একার নাকি। মিত্রা চিল্লিয়ে উঠলো।
মিত্রা তুই কালকে দামিনীর ওখান থেকে কোন খাতা নিয়ে এসেছিলি। ডাক্তারদাদা বললো।
মিত্রা লুচিটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো, হ্যাঁ!
দামিনী মাসি হেসে ফেললো।
এবার ধরতে পেরেছ দামিনী ?
সত্যি দাদা আমি ভাবতেই পারছি না।
মাসি হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকাল। দিদি ঠিক বলে তোর পেটে পেটে এতো বুদ্ধি!
আমি গম্ভীর হয়ে লুচি চিবচ্ছি।
এবার তুমি বান্ধবীদের বলে দাও। সকাল বেলা তোমরা ওকে না বলে চলে গেছ। ওতো জানবেই তোমরা কোথায় গেছিলে। প্রথম অস্ত্র ও প্রয়োগ করেছে। তাতেই কাজ হয়ে গেল, না হলে নির্মাল্যকে ও জবাই করতো। দেখলে এখানে ঢোকা তক নির্মাল্যকে ও একটা প্রশ্নও করে নি।
দামিনী মাসি হাসতে হাসতে বড়মার দিকে তাকাল।
কালকে ওরা যখন গেছিল, তখন অনি ওর বাক্সটা কবিতাকে দিয়ে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করালো, আপনাকে বাক্সটা দেখালাম না।
হ্যাঁ।
ওর থেকে অনির একটা খাতা মিত্রা নিয়ে এসেছিল। আসার সময় বললো, মাসি আমি নিজে এসে তোমায় ফেরত দিয়ে যাব। কালকে ওরা চলে আসতে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। আমি ইসলাম ছাদের ওপর মাদুর পেতে বসেছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত।
আজ ও ঢুকেই আমাকে বললো কিগো সব একসঙ্গে, কোথায় দেখা হলো।
আমি বললাম, এই এলাম।
তারপরই ও বললো, মিত্রা তোমায় খাতাটা দিয়ে এসেছে।
আমি বললাম না।।
তারপরেই আপনাকে বললো, কিগো দামিনী মাসির ঘরটা কেমন দেখলে।
ওরে বাবা! তুই কি সাংঘাতিক! তোকে তো কোন কথা লোকান যাবেনা।
ছোটমা মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো।
বড়মা আমার মুখের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে। পরিতৃপ্ত মুখখানি আমার কৃতিত্বে খুশি। আমার মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
তখনই তোমায় বললাম বড়মা, একটা ফোন করে দাও বুবুনকে।
আমি কি তোকে বারণ করেছিলাম।
আমি ছোটর দিকে তাকালাম, এবার চা হোক।
ছোট কিল বাগিয়ে আমার মুখের কাছে এগিয়ে এলো, আমি বড়মার বুকের কাছে সরে গেলাম।
নীপা যাতো মা চা-টা ঢেলে আন।
বুবুন।
বল।
কাল তোর আর ভজুর কীর্তি বড়মাকে বলেছি।
সবাই হেসে ফেললো। হাসি আর থামে না।
হাসতে হাসতে দামিনী মাসির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল, ছোটমারও একি অবস্থা।
ভজুরামও হাসে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বলিনি অনিদা।
হাসিটা একটু থামতে আমি গম্ভীর হয়ে তাকালাম মিত্রার দিকে।
তুই এটা ভালো করলি।
তুইতো কাল বৌদিকে বলেছিস। তারমানে সবাইকে বলে দিলি। তুই বললি না, আমি বললাম।
বুঝলি মিত্রা আমার ঘরটা ভালো করে খুঁজলে তুই ওরকম একটা ছেঁড়া নেগড়া এখনো পাবি। বড়মা বললো।
তুমিও কি স্মৃতি করে রেখেছ।
নারে তোর দাদার একবার সখ হয়েছিল।
আবার হাসি, এবার আর থামান যায় না।
টিনা, মিলি, অদিতি এসে ঘরে দাঁড়াল। ওরা ঢুকে অবাক। এতো হাসির চোট কিসের।
কিগো তোমরা এতো হাসছো কেন। টিনা বললো।
মিত্রা হাসতে হাসতে বললো কালকেরে সেই বুবুনের জাঙ্গিয়া….তারপর কৌপিন।
টিনা মিলি হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছে।
দাদারও শখ হয়েছিল কৌপিন পরার। বড়মা বললো এখুনি।
প্রাণখোলা হাসিতে ঘরটা গম গম করে উঠলো। মিলি হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পরলো।
অদিতি হাসতে হাসতে বললো সত্যি অনিদা তুমি জিনিষ একটা, বাঁধিয়ে রাখার মতো।
কলেজে দেখেছি, তুইতো তখন এতটা ধুর ছিলিনা। দেবা হাসতে হাসতে বললো।
দুর ধুরের কি আছে, চেয়েছি প্যাকেট করে দিয়ে দিয়েছে। খুলে দেখেছি নাকি। তাই পেয়ে ভজুরামের কি আনন্দ। মাসির কাছে রাম কেলানি খেয়ে ভজুরাম তারপর বুঝতে পেরেছে। তার আগে আমার বোঝা হয়ে গেছে।
হাসির রেশ কিছুটা কমতে টিনা মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
তুমি কি খাওয়াবে অনিদাকে।
কেন আবার কি আনলি ?
মিলি ব্যাগ থেকে খামটা বার করলো।
ডাক্তারদাদা খুলুক এখানে সিনিয়ার মোস্ট।
দে।
মিলি খামটা ডাক্তারদাদার হাতে দিল।
কিরে অনি সাপ না ব্যাঙ। ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকাল।
সাপ গো সাপ। অদিতি বললো।
ডাক্তারদাদা চিঠিটা পরে আর হাসে।
কিগো ডাক্তার, কি লেখা আছে ওতে, তুমি হাস কেন নিজে নিজে। বড়মা বললো।
তোমার ছেলে কালকে আবার একজনকে জবাই করেছে। এবার রাজ্য সরকারে কোষাগার লুঠ। তিনকোটি টাকা।
অ্যাঁ। বলো কি।
হ্যাঁ। এই দেখো তার কনসাইনমেন্ট।
মিত্রা উঠে দাঁড়িয়ে মিলিকে জড়িয়ে ধরলো। সত্যি।
সত্যি নাতো কি মিথ্যে।
সেই জন্য কালকে ও কাজের হিসাব দিচ্ছিল ওদের। কি এবার তুমি ওর ওপর রাগ করবে।
বড়মা আমার থুতনি ধরে চুমু খেলো।
তুইতো চম্পকের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিলি। দেবাশীষ বললো।
এটা কি আমি নিয়ে এসেছি, ওরা তিনজনে নিয়ে এসেছে। সরকারী খাতায় ওরা রিসিভ করেছে।
সত্যি অনি তোর মাথাটা ফাটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।
আর তোমাকে মাথা ফাটাতে হবে না। অদিতি বললো।
চল এবার ওপরে গিয়ে একটু বসি। ছোটমা।
আমি ছোটমার দিকে তাকালাম।
ছোটমা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে। চোখের ভাষা, এই জন্য তোকে আমরা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। এটা বুঝিস না।
তারপরেই কপট রাগ মুখে।
যাও চা পাঠাচ্ছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, মিত্রাকে ইশারায় ডাকলাম। মিত্রা আমার পেছন পেছন বারান্দায় এলো। মুখে হাসি হাসি ভাব। পরিতৃপ্ত মুখ। আমার সামনে দাঁড়াল, চোখে জিজ্ঞাসা।
কাগজগুলো কোথায় ?
বড়মার ঘরে।
চল।
আমরা দুজনে বড়মার ঘরে এসে ঢুকলাম।
মিত্রা একটা ফাইল বার করে আমার হাতে দিল।
এতে সব আছে।
এতো কি ?
অনেক দলিল আছে। এগুলো দেখাইনি। সবতো গেছে। এটুকু লুকিয়ে রেখেছিলাম।
তুই আগে ওই কাগজটা দে।
মিত্রা খামটা বার করলো। আমি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলাম। হাসলাম।
এই একটা মাত্র তুই পাকা কাজ করেছিস।
তাও অনেক কাঠ খর পুরিয়ে।
তুইতো নিজে মুখে কিছু বলিসনি, আমাকে উদ্ধার করতে হচ্ছে।
বিগত আট মাসে বলার সময় দিয়েছিস।
তাও ঠিক।
সার্টিফিকেটটা খামে ভরে ওর হাতে দিলাম।
ফাইলে রাখ। আর একটা কাজ করতে হবে।
বল।
কাল ব্যালেন্স চেক করেছিস।
হ্যাঁ।
লকারে কতো আছে।
সাড়ে চার কোটি।
চাবি কার কাছে।
সনাতন বাবুর কাছে।
আমাকে দেড়কটি টাকা দিবি।
কেন!
এই প্রথম মিত্রা আমার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করলো। ফিক করে হেসে ফেললাম।
হাসিসনা, বল।
বিয়ে করছি, যৌতুক দিবি না।
যাঃ, বল না। ওরকম করছিস কেন।
অনিমেষদা চেয়েছে।
অনিমেষদা! তোকে ?
হ্যাঁ। কাল রাতে আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো। পার্টি ফান্ডে দিতে হবে। আমি তোকে আবার ফেরত দিয়ে দেব।
মিত্রার মুখের রং বদলে গেল। কেমন যেন মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
তুই একথা বললি কেন। আমি কি এখনো তোর আপন হতে পারলাম না।
মুখটা নীচু করে নিল। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।
আমার দিক থেকে আমি কোন খামতি রাখি নি।
মিত্রার গলাটা কেমন ভাড়ি ভাড়ি।
এই দেখো।
কিরে চা এখানে দেব না টেবিলে রাখব।
ছোটমা গেটের কাছে। মিত্রার দিকে তাকাল। ছোটমা বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে। এগিয়ে এলো।
কিরে মিত্রা চোখটা ছল ছল করছে কেন।
না কিছু না।
নিশ্চই তোকে কিছু বলেছে।
না।
তাহলে।
এমনি।
দাঁড়া আমি দিদিকে ডাকছি।
না তুমি ডাকবে না।
ছোটমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি ওর দিকে তাকালাম।
ঠিক আছে তোকে দিতে হবে না। আমি বেরিয়ে আসতে চাইলাম। ও আমার হাতটা ধরলো।
আমি তোকে দেবনা বলেছি।
তাহলে সব কিছুতে তোর চোখে জল আসে কেন ?
কেন আমি কি অপরাধ করেছি, এখনো তোর আপন হতে পারলাম না।

আমি এখনো এই জিনিষগুলো নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারি নি।
 
তোকে কে বলেছে। আমি ?
না। আমার মন বলছে।
আমি তোর কাজে কোনদিন বাধা দিয়েছি ?
না।
তোর সব কাজ মেনে নিয়েছি। আমি জানি তুই আমার জন্য, আমাদের ভালর জন্য করছিস।
একটু থেমে।
নিজের জন্য নয়।
মাথা নীচু করে রইলাম।
তাহলে তোর এতো সংকোচ কেন।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কালকে তুই ফর্মগুলো সই করতে চাস নি। কেন ?
আমি সই করে দিয়েছি।
দাদা বলার পর।
চুপ করে রইলাম।
তুই যেমন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিস, তোকে নিয়ে আমারও কিছু স্বপ্ন আছে, আমারও কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছা আছে। শুধু আমার একার নয়, সবার। কেন তুই সেটা মেনে নিবি না।
আমি তোর যোগ্য হতে পারি নি।
তাহলে আমার সঙ্গে নিজেকে জড়ালি কেন।
আমার ভেতর থেকে কে যেন বললো তোর বিপদ তোকে সাহায্য করা উচিত।
আমার বিপদ তোর কি, তুই কি দেশোদ্ধার করতে এসেছিস।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তুই নিজের জীবন বিপন্ন করে সব করছিস। আমরা কেউ তোর পাশে থাকি না। বাড়িতে থেকে গুমড়ে মরি। কার জন্য তুই এই সব করছিস। তোর নিজের জন্য।
আমি চুপ। মাথাটা মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে মিশে যাবে।
তাহলে তোর এতো সংকোচ কেন। কেন তুই ভাবছিস এটা শুধু আমার, তোর নয়।
বুঝলাম বেশি চুপ করে থাকলে আরও কথা বেরবে। দীর্ঘদিন মনে এই কথা গুলো ও পুষে রেখেছে। বলার সুযোগ পায় নি।
আমি গিয়ে ওর দুই কাঁধ হাত রাখলাম। চোখ দুটো যেন গনগনে কয়লার এক একটা টুকরো।
আমি কথা দিচ্ছি। আর কখনো বলবো না।
তুই প্রায়ই বলিস এই কথা। আমি বুঝি। চুপ করে থাকি। তুই আমার আর তোর মাঝে একটা সূক্ষ্ম দেয়াল তুলে রেখেছিস। তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না। তোকে আমি নিজের টাকায় শেয়ার হোল্ডার করেছি। তুই তার ঋণ শোধ করছিস।
তুই বিশ্বাস কর। আমি কখনো এই সব ভাবি নি।
তাহলে তুই কেন বার বার একই কথা বলিস।
নিজের মনের মধ্যে এখনো একটা খটকা রয়ে গেছে। আমি এর যোগ্য কিনা ?
যাচাই কে করবে তুই না আমি।
আমি মাথা নীচু করে রইলাম।
আমার কষ্টটা তুই স্বীকার করলি। তোর কষ্টটা আমাকে স্বীকার করতে বাধা দিচ্ছিস কেন।
আমার কোন কষ্ট নেই।
সেটা সাদা চোখে দেখার ক্ষমতা তোর নেই। নিজের আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিস। আমি তোকে ভালবাসিনি। তোর ভেতরে যে যাযাবরটা আছে তাকে ভালবসেছি। তাকে আমি এখন খুঁজে পাচ্ছি না। তাই তোর মনটাকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার মাথা হেঁট।
বুঝতে পারছি আমার একটা ছোট্ট ভুলে কি হলো। ওর কথা শুনে কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করছে। নিজেকে নিজে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিনা।
তুই একটা পাথর। ভাবছিস তোকে আমি একদিন ভালবাসতাম তার অধিকারে তোকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছি। তুই তা পালন করছিস।
না আমি কখনো তা মনে করিনি।
মুখ তুললাম।
মিত্রা আমার চোখে চোখ রাখলো। হয়তো আমার চোখের ভাষা ও পরতে পারলো।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।
নিজেকে কষ্ট দিয়ে কেন এতো আনন্দ পাস। আর একজনও তো কষ্ট পায়। সে শুধু একা নয়, তোর সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছে, তারা সকলে। এটা ভেবেছিস কখনো।
আমি শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মিত্রার হাত থেকে নিজেক ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে ফিরলাম। দেখলাম বড়মা ছোটমা ঘরের মধ্যা দাঁড়িয়ে। কারুর দিকে তাকালাম না। সোজা বেরিয়ে এলাম।
দেখলাম বসার ঘরে ওরা সবাই বেশ খোশ মেজাজে কথা বলছে। মৃদু স্বরে আমাদের একটা কথাও ঘরের দরজার বাইরে আসে নি। যা শুনেছে বড়মা ছোটমা। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে সোজা ওপরে চলে এলাম।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজালাম।
টেবিলের কাছে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলাম। একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। সোজা চলে গেলাম জানলার কাছে। আমগাছের একটা ডাল একেবারে জানলার কাছে। হাত বারালেই ডালটার স্পর্শ পেয়ে যাব। কচি পাতা সবে মাত্র ধরেছে। তার ঠিক ওপরে আমের বকুল হয়েছে। বেশ দেখতে লাগছে। প্রত্যেকটা প্রাণের মধ্যে সন্তান ধারণের কি প্রবল লিপ্সা। এই গাছটা কথা বলতে পারেনা। বোবা। তবু ওরও বেঁচে থাকার কি ইচ্ছে। নিজের বংশ বিস্তারের স্বপ্ন।
মিত্রা এভাবে আমাকে আগে কনোদিন বলেনি। ও আমার বুকের ভেতরটা প্রবল ঝড়ে ওলট পালট করে দিল। বার বার চোখের সামনে মিত্রার মুখটা ভেসে আসছে। ওর কথা কানের কাছে বার বার শব্দ তরঙ্গ তৈরি করছে। এই কটা মাস আমার মধ্যে একটা জেদ চেপে বসেছিল। নেশার ঘোরে আমি খালি কাজ করে গেছি। কেনো ?
আমি মিত্রাকে সেফ্টি দেখতে চেয়েছি। হ্যাঁ আমি অনেক ঝুঁকি নিয়েছি। কখনো কখনো নিতে বাধ্য হয়েছি। কিসের জন্য ? আগু পিছু কিছু ভাবি নি। যেটা নিজে থেকে ঠিক মনে করেছি, সেটাই করেছি। কারুর বাধাকে গ্রাহ্য করিনি। সত্যিতো ওরাও আমাকে বাধা দেয় নি। একবারও প্রতিরোধের কোন দেয়াল আমার সামনে খাঁড়া করে নি।
আমি যেমন ভাবে ভাবছি, ওরাও তো ঠিক তেমন ভাবেই ভাবতে পারে। এটা আগে কখনো ভাবি নি কেন ?
আবার একটা সিগারেট বার করে ধরালাম।
আর সিগারেট খাবি না।
কর্কশ একটা কন্ঠ কানে এসে ধাক্কা দিল। এ গলা আমার পরিচিত নয়। আমার অচেনা অজানা।
ফিরে তাকালাম।
মিত্রা ঘরের দরজা বন্ধ করছে। চায়ের কাপের ট্রেটা বিছানার ওপর রাখা। পায়ে পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। জ্বলন্ত সিগারেটটা হাত থেকে টেনে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চোখ দুটো আগের মতোই গনগনে।
তোকে এই পৃথিবীতে আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমি বুঝেছি।
আমি ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম।
কাকে কাকে ফোন করলি টাকার জন্য।
কাউকে করি নি।
করবি। এটা ভেবেছিস তো।
মাথা নীচু করলাম।
আমি সনাতনবাবুকে ফোন করে দিয়েছি। দাদার হাতে টাকা পাঠিয়ে দেবে। কাউকে আর ফোন করতে হবে না।
আমি মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তোর তো অনেক ক্ষমতা, মলকে সরিয়ে দিয়েছিস, সুনীতদাকে শাস্তি দিয়েছিস, রাজনাথের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিস, প্রবীরবাবুকে রিজাইন দিতে বাধ্য করিয়েছিস, ডাক্তারের এমন হাল বানিয়েছিস এই জীবদ্দশায় আর করেকম্মে খেতে হবে না, ছট্টুকে এনকাউন্টার করিয়েছিস এইবার তোর মিত্রা সেফ। এইবার মিত্রাকে আর কেউ ছুঁতে পারবে না। শেষ যেটা ছুঁতে পারবে বলে তুই মনে করছিস, তাকে তুই তোর হেফাজতে রেখে দিয়েছিস। সময় বুঝে তাকেও তুই সড়িয়ে দিবি। কাক পক্ষী কেউ টের পাবে না। কেউ তোকে ছুঁতেও পারবে না। পারবি ছট্টুর মতো আমাকে এনকাউন্টার করতে। আমাকে নিয়ে তোর অনেক চিন্তা। একবারে শান্তি পেয়ে যাবি।
মিত্রার প্রত্যেকটা কথা আমার শরীরের মাংস ভেদ করে ছুঁচের মতো আমার হাড়ে বিঁধছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। সত্যি আজ আমি ওর মনের সংবেদনশীল অংশে নাড়া দিয়ে ফেলেছি। এই জায়গাটা আমারও আছে। ওরও থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
মিত্রা ওর মতো বলে চলেছে। আমার কানের মধ্যে দিয়ে এক বর্ণও আমার মাথার মধ্যে ধাক্কা মারছে না।
আমার হলে আমিও যে এই ব্যাব্যহারই করতাম। মিত্রা ঠিক সেই ব্যাবহার টুকু জাস্ট আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাকে এটা শুনতে হবেই। এছাড়া আমার কনো উপায় নেই। উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক এই ব্যাপারগুলোর ওপরই গড়ে ওঠে। লোকে বলে বোঝাপড়া। না হলে সম্পর্ক ভেঙে যায়।
আমি মিত্রার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে চাই নি। চাইলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকতাম না। নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ আমি বহু বার পেয়েছি। আর শরীর! দামিনী মাসির ওখানে যখন থাকতাম, চাইলেই পেতাম। হয়তো জীবনটা অন্য খাতে বইতো। কিন্তু মিত্রার কলেজ লাইফের চিঠি গুলো ছিলো আমার সবচেয়ে বড়ো বল ভরসা।
ওর চিঠি গুলো আমাকে কারুর মুখের দিকে তাকাতে বারণ করতো।
বার বার ও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতো আমি মরিনি বুবুন।
আমি তোর কাছে ফিরে আসবই। তুই শুধু মাত্র আমার।
কতোদিন ওর কথা ভেবে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে দিয়েছি। কোন অসুবিধে হয় নি। বরং পরেরদিন পূর্ণ উদ্যমে কাজ করেছি। রাতে ক্লান্ত কাকের মত বাসায় ফিরেছি। কনো দিন খাবার জুটেছে কনোদিন জোটেনি। কই কনো অসুবিধে হয়নি। বার বার মন বলেছে মিত্রা তোর সঙ্গে আছে, বুবুন তোর চিন্তা কিসের।
তাহলে আমার মধ্যে এই সংকোচ কেন। মিত্রা কোন অন্যায় কথা বলছে না।
আমি একি করলাম। তাহলে কি আমি আমার আধিপত্য এদের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি ? আমি কারুর কাছে কোন দিন ঋণী থাকব না। আমি সকলকে ঋণী করবো। সেই জায়গাটা মিত্রা মেনে নিতে পারছে না।
জানি না তখন সেই মুহূর্তে আমি কি করছিলাম।
একটা প্রবল ঝাঁকুনিতে আমার সম্বিত ফিরে এলো।
বুবুন, বুবুন এই বুবুন।
আমার চোখ বন্ধ মাথা নীচু। বুঝতে পারছি আমার চোখের জলে মিত্রার মুখটা ঝাপসা দেখছি।
কিরে আমি তোকে কি বললাম, তুই কাঁদছিস!
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এটুকু বলার অধিকার কি আমার নেই!
আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলাম।
আচ্ছা বাবা আমার অন্যায় হয়েছে। আর কোন দিন তোকে কিছু বলবো না। আমি মেয়ে ভ্যাঁ করে কাঁদতে পারি, তুই কাঁদতে পারিস এটা জানা ছিল না।
ছাড় ছাড় এখুনি ছোটমা চলে এলে কেলো হয়ে যাবে। বলবে আবার, আধ দামড়া ছেলে, বউকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে।
আমি ওকে ছাড়লাম না। আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলাম।
আমি তো তোর শত্রু। আমি কি তোর নিজের। তাই আমার কাছে কিছু চাইতে তোর লজ্জা হয়, সঙ্কোচ হয়। আমার কোন লজ্জা নেই দখ। তাই তোর কাছে দু’হাত পেতে খালি নিয়েই যাচ্ছি। তুই আমাকে ঘড় দিয়েছিস, বড়মা-ছোটমাকে দিয়েছিস, দাদা-মল্লিকদাকে দিয়েছিস। আমার মৃত বাবা-মার কথা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিস।
সর্বোপরি আমাকে তুই নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিস।
আর আমি এখনো তোর বাবা-মার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারলাম না। অনেক কষ্টে তোর কাছ থেকে একটা জীবন পেয়েছি। জানিনা সেটা বেঁচে আছে কিনা। জানিনা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব কিনা।
আমি মিত্রাকে ছেড়ে দিলাম। জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আমরা এখন বেরবো তুই কি যাবি ?
না।
গেলে ভালো লাগতো।
যাব না।
কোথাও বেরোবি।
বলতে পারছি না।
ওদের সঙ্গে কি বসবি।
না। ওদের চলে যেতে বল।
দেবা নির্মাল্য আসুক।
ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যা। কালকে আসতে বল।

বুঝতে পারলাম মিত্রা দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে গেল।
 
আমি বাথরুমে গেলাম। মুখটা ভালো করে ধুলাম, চোখে জল দিলাম। টাওয়েল দিয়ে ভালো করে মুখটা মুছলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলার সামনে দাঁড়ালাম। মাথার মধ্যেটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। সিগারেটটা খেতে ভালো লাগল না। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বিছানার ওপর মোবাইলটা পরে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম, দেখলাম স্যুইচ অফ। অন করলাম। গাদা খানেক মিস কল আর ম্যাসেজ। সবাই আছে। কার নাম বাদ দেব।
কিরে সত্যি তুই যাবি না।
একবারে আমার পেছন থেকে শব্দটা ভেসে এলো। ঘুরে তাকালাম। মিত্রা একটা নতুন শালোয়াড় পরেছে। টিয়া পাখির গায়ের রংয়ে। ঠোঁট দুটো লাল টুক টুকে। কপালে ম্যাচিং করে একটা বিন্দির টিপ লিগিয়েছে।
মন ভালো হয়েছে।
আমি ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
তুই থাকলে সব সময় জার্নিটা একটু অন্য রকমের হয়।
তবু আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
দাদা নিয়ে এসেছে। দাদার ঘরে আছে।
আমার মুখ থেকে কোন শব্দ নেই।
তুই কি বোবা হয়ে গেলি। আমার সঙ্গে কথা বলবি না।
তোরা যা। আমার ভালো লাগছে না।
একা একা নিজের সঙ্গে বোঝা-পড়া করবি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি জানি আমরা বেরিয়ে যাবার পর তুই বেরিয়ে যাবি। যেতে পারতিস আমাদের সঙ্গে।
এখন বিরক্ত করিস না।
বুঝেছি।
তোর খাবারটা এখানে দিয়ে যাব।
খেতে ভালো লাগছে না। তোর ফাইলটা দিয়ে যা।
ওটা নিয়ে এখন কি করবি।
কাজ আছে।
আমার জন্য তোকে আর কিছু করতে হবে না। যেদিন নিজের মনে করবি সেদিন করবি।
বেশি বক বক করিস না। যা বলছি কর।
কেনো তুই কি ভাবিস, আমি তোকে ভয় পাই।
না আমি সে কথা বলিনি। সকাল থেকে তুই অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলছিস।
আমি বলিনি তুই আমাকে বলাচ্ছিস।
এখন যা কথা বলতে ভালো লাগছে না।
যেখানেই থাকিস নটার মধ্যে আসবি।
সেটা নাও হতে পারে।
তাহলে মাথায় রাখবি আজ রাত নটার পর থেকে তোর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না।
কথাটা বলেই মিত্রা গট গট করে বেরিয়ে গেল।
আমি মিত্রার চলে যাওয়াটা ধীর স্থির ভাবে দেখলাম।
আমার ওপর কি আধিপত্য! কি ডিকটেটরশিপ! কই আমি ওর ওপর এতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারিনি! তাহলে কি ও আমাকে একতরফা ভালবাসে ?
আমি কি এখনো সেইভাবে ওকে ভালবাসতে পারিনি ? আমার সব কিছু মেকি। আমার ভালবাসার মধ্যে কি কনো প্রাণ নেই ? সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
মিত্রা আবার ফিরে এলো। ফাইলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল। কিছুক্ষণ আমার চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে আঁচড়ে কামরে টুকরো টুকরো করে দিই। মিত্রার চোখে বক্র হাসি।
ঘর থেক বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম সকলে বেরিয়ে গেল।
আমি আলমাড়িটা খুলে ফাইলটা তুলে রাখলাম। পাঞ্জাবী খুলে আমার পেটেন্ট সেই পোষাক পুরনো জিনসের প্যান্ট আর আধময়লা গেঞ্জিটা লাগালাম। আঃ কি আরাম। মনে মনে বললাম অনি নতুন পোষাকে তোমায় দারুণ দেখতে লাগে, তবে এই পুরোনো গুলোয় অনির আসল রূপটা ফুটে বেড়োয়। এইখানেই অনির বিশেষত্ব, অনি নিজেকে নিজে খুঁজে পায়।
গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ছগনলাল আমায় দেখে হাসলো। কোনদিন হাসে না। আজ হাসলো।
কি ছগনলাল হাসছো কেন ?
কাল তোমার বিয়ে। বড়বাবু মা সব বাজারে গেল। আমাকে বললো তোমার সঙ্গে যারা গল্প করে তাদের কাল আসতে বলবে।
তুমি খুশি ছগনলাল।
তোমাকে দিদিমনিকে ভালো লাগবে।
আমি হাসলাম।
ট্র্যাংগুলার পার্ক বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস ধরলাম। সোজা চলে এলাম পার্কস্ট্রীট। এশিয়াটিক সোসাইটির ফুট ধরে চলে এলাম আস্থার অফিসে। অনেকদিন সুজিতদার সঙ্গে দেখা হয়নি। সাংবাদিকতার প্রথম জীবনে সুজিতদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। একটা প্রোডাক্ট লঞ্চের ক্যাম্পেনিংয়ে কভার করতে গিয়ে সুজিতদার সঙ্গে প্রথম আলাপ।
তারপর জানতে পারলাম সুজিতদার এ্যাডএজেন্সি আছে। তখন সুজিতদা আমাকে দিয়ে কপি লেখাত। বেশ কিছু পয়সা পাওয়া যেত। কিন্তু ওই যে, আমার যেহেতু কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। যোগাযোগের অভাবে ঠিক মতো কাজ করে উঠতে পারতাম না। তবে রিলেসন নষ্ট হতে দিই নি। মাঝে মাঝে আসতাম।
বিল্ডিংটার সামনে আসতে চিনতেই পারলাম না। কোথায় সেই আদ্যিকালের পুরনো বিল্ডিং! এখানে দেখছি একটা মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং হয়েছে। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললো এই বিল্ডিং-এর ফিফথ ফ্লোরে চলে যান। অগত্যা মধুসূদন তাই করলাম। ফিফথ ফ্লোরে আনেক অফিস। আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললো, ওই কর্নারের অফিসটা আস্থা।
কাঁচের দরজার সামনে এলাম। পুরনো অফিসের সঙ্গে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই কোন যুগে এসেছিলাম। এখন সব বদলে গেছে। সেই মোটা ভ্যাটকা রিসেপসনিস্ট মেয়টা এখন আর নেই। দেখলাম রিসেপসনে একজন তরতাজা তরুণী বসে আছে। বেশ সুন্দর, শোকেশের ডল পুতুলের মতো। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। যা হয় আর কি। আমি এগিয়ে গেলাম।
সুজিতদার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেন আমি কে হরিদাস পাল, সুজিতদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
আপনি ঠিক বলছেন।
কেন সুজিতদা এখানে নেই!
হ্যাঁ আছেন।
তাহলে।
আপনার এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
সুজিতদার সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ঢুকতে হয় এখন ?
আপনি কতোদিন আগে এসেছিলেন।
ধরুন বছর আটেক আগে। তখন এই বাড়িটা হয় নি।
তরুণী মুখের কাছে হাত নিয়ে মুখ টিপে হাসলেন।
আপনার নাম।
পকেট থেকে মানিপার্সটা বার করে কার্ডটা দিতে যাচ্ছিলাম। কি খেয়াল হতে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।
আপনার ভিজিটিং কার্ড আছে।
না। বলুন অনি এসেছে।
নাম বললেই হয়ে যাবে।
না হলে ফিরে যাব।
বসুন।
আমি গিয়ে ভিজিটরদের জন্য রাখা সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। চারিদিকে সব সুন্দরী মেয়ে। ছেলগুলোও দেখতে খারাপ নয়। ভদ্রমহিলা ইন্টারকমে কার সঙ্গে কথা বললেন। দেখলাম কাঁচের ঘর থেকে সবাই আমাকে মাপছে। আড়চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে একবার দেখলাম আমার প্যান্টের চেন খোলা আছে কিনা। প্রায়শই আমার এটা হয়। বহুবার মিত্রা হাসতে হাসতে আমাকে ইশারা করেছে। অসতর্কের ভান করে হাত দিয়ে দেখলাম, না চেনটা টানাই আছে।
কোথায় অনি, কোথায় অনি।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ভেতর থেক বেরিয়ে এসে চেঁচা মিচি শুরু করেদিলেন।
সেই রেসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ালেন, বার পাঁচেক স্যার স্যার বলে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এলেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোকের মাথায় বেশ টাক পরেছে। চোখে চশমা। হ্যাঁ, মুখের আদলের সঙ্গে সুজিতদার মুখটা মিলে যাচ্ছে। আমি হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছি। ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। সুজিতদা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টি ফললো।
ওইতো, কিরে ব্যাটা ?
সুজিতদা এগিয়ে এলো।
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে ফটা ফট তিন চারটে চাপর মেরে দিল।
আমি তোমাকে চিনতেই পারি নি! তোমার মাথার সেই কুচকুচে কালো চুল গেল কোথায় ?
সুজিতদা হাসছে।
তুমি একেবারে বুড়ো মেরে গেছো। তোমার চুলের অবস্থা এখন এপার ওপারের মতো।
বয়স কি কম হলো।
তাহলে বৌদিও বুড়ী হয়ে গেছে।
তা হবে না।
তাহলে দেখা করবো না। আট বছর আগের দেখা বৌদির মুখটাই আমার চোখে থাক।
কি লীনা তোমরা চিনতে পারছ না।
সুজিতদা রিসেপসনিস্ট মেয়াটার দিকে তাকাল।
তারপর আমার দিকে ফিরে।
তুই কিন্তু আগের মতোই রয়েছিস। একবারে মডেলদের মতো ফিগারটাকে ধরে রেখেছিস।
না খেয়ে খেয়ে।
আমার কথা শুনে, লীনা মেয়েটি আগের মতোই মুখের ওপর হাত রেখে মুখ টিপে হাসছে।
কাঁচের দেওয়ালের ওপাশ থেকে যারা এতোক্ষণ আমাকে দেখছিল, তারা বেশ অবাক।
আমি ভাবতেই পারছি না তুই আমার কাছে আসবি।
কিছু কপি দাও না লিখে দিয়ে যাই। ভীষণ টাকার দরকার।
মারব এক থাপ্পর।
সুজিতদা হাত তুললো, আমি হাত তুলে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।
গুটি গুটি করে বেশ কয়েকজন সেই কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
মেয়েগুলো আমায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে। এ কেমন জোকার!
আর যারা ভিজিটার আছেন অপেক্ষা করে তারা অবাক।
আমাদের কাগজের নাম করে একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে সুজিতদা বললো, কিরে সাগ্নিক মেটিরিয়ালটা কাগজে পাঠিয়ে দিয়েছিস।
দিয়েছি স্যার, কিন্তু রবিবারে ছাপতে পারবেনা বলেছে। কে যেন একজন ম্যাডাম নতুন জয়েন করেছেন। তিনি না বললে ছাপা যাবেনা, চম্পকদা বললেন।
রাখ তোর ম্যাডাম, কিরে মালিক আমার বিজ্ঞাপন ছাপা হবে না ?
আমি হাসছি।
এবার সবার চোখ প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড়। কেউ যেন হাজার পাওয়ারের বাতি জেলে দিয়েছে ওদের চোখের সামনে।
এ কি শুনলো।
আবার সাগ্নিকের দিকে সুজিতদা ঘুরে তাকাল। ওরে ওই কাগজের ওয়ান অফ দেম পার্টনার আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আর তুই বলছিস কিনা বিজ্ঞাপন যাবে না।
উনি অনি ব্যানার্জী। লীনা বলে মেয়েটি বিষ্ময়ে বলে উঠলো।
কেন তোমায় কার্ড দেয়নি ?
না।
তাহলে।
উনি একবার মানি পার্টসটা বার করেছিলেন তারপর পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন, বললেন, বলুন অনি এসেছে। আমি বললাম, এতেই উনি চিনতে পারবেন। উনি বললেন, না চিনতে পারেলে চলে যাব।
ইস কি মিস করলে লীনা, তুমি ওর কাছ থেকে কার্ডটা আদায় করতে পারলে না। একজন অতোবড়ো কাগজের মালিক তোমায় কার্ড দেবে তুমি ভাবতে পার।
লীনা মাথা নীচু করলো, সরি স্যার।
আর সরি, এ সুযোগ বার বার আসবে তোমার জীবনে।
গত পর্শু ওর ঝড়তোলা লেখাটা পরেছো।
হ্যাঁ স্যার, উনিই যে সেই ব্যক্তি বুঝবো কি করে।
ও চিরটাকাল একরকম থেকে গেল।

আমার হাতটা চেপে ধরলো।
 
চল চল ভেতরে চল। তুই যখন এসেগেছিস তখন সামনা সামনি তোর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যাবে। একজন ক্লায়েন্ট এসেছেন ভেতরে।
সুজিতদা আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল।
ছোট ঘর, কিন্তু দারুণ ডেকরেসন। কর্পোরেট হাউসের মালিকের ঘর যেমন হয় আর কি।
তুই আমার চেয়ারটায় বোস।
একবারে ফালতু কথা বলবে না, তাহলে ফুটে যাব।
কতোদিন পর তোর সঙ্গে দেখা। সুজিতদা আবার বুকে জড়িয়ে ধরলো।
প্রায় আট বছর। তোমার পুরনো অফিসে কপি লিখতে আসতাম।
ভুলে যা। সেতো এক যুগ। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। তখন কাজ করেও মজা ছিল। এখন কম্পিটিসনের মার্কেট টিঁকে থাকতেই দম হাল্কা হয়ে যায়।
তোমার তো ভালোই ব্যাবসা হচ্ছে।
তোদের কাগজটা আছে বলে টিঁকে যাচ্ছি। তাও চম্পক এতো হারামী গিরি করছে, কি বলবো।
কেন!
আজ না কাল কাল না পরশু। জায়গা নেই। পার্টির চয়েস মতো যদি ডেট না পাই, জায়গা না পাই, বিজ্ঞাপন দিই কি করে বল।
তুমি ইয়ার্লি কনট্র্যাক্টে যাচ্ছনা কেন ?
কতবার বলেছি, চম্পক বলেছে কাগজের লস। হবেনা। যদিও বা হাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো। শুনলাম সব ওলোট পালট হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজমেন্ট। তাদের রেটও নাকি বেশ হাই। ভেবেছিলাম তোর কাছে একবার যাব। অতি কষ্টে তোর ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। ওমা দেখি সারাক্ষণ স্যুইচ অফ।
তাহলেই বোঝ আমি কেমন মালিক।
সুজিতদা হেসে ফেললো।
সুজিতদা নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললো, তুই হঠাৎ আমার অফিসে।
সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ, ভাল লাগছে না। ভাবলাম আমার পুরনো আত্মীয়স্বজন কারা আছে। প্রথমেই তোমরা মুখটা ভেসে উঠলো। চলে এলাম।
এটা তোর গল্প, আসল কথা বল।
হ্যাঁগো বিশ্বাস করো।
আমার মুখটা তোর হঠাৎ মনে পরলো কেন ?
বলতে পারব না। মনকে জিজ্ঞাসা করিনি।
কি খাবি।
যা বলবো খাওয়াতে পারবে।
বলনা দেখি পারি কিনা।
আসার সময় মোড়ের মাথায় দেখলাম ছেঁড়া পরোটা তৈরি করছে। আর ঘুগনি। খাওয়াবে ?
তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলাম করছিস।
উঠে দাঁড়ালাম, তাহলে চলি।
আরে বোস বোস খেপে যাচ্ছিস কেন, সত্যি তুই খাবি!
সুজিতদা অনি এখনো মালিক হয় নি। হলে তোমার কাছে সে আসতো না।….
আমার গলার স্বরটা সামান্য হলেও পরিবর্তন হলো।
সুজিতদা আমার দিকে তাকিয়ে।
….মালিক হলে সে তোমাকে ডেকে পাঠাত। মালিক ডাকলে তুমি যেতে না ?
মালিক অনির কাছে যেতাম, ছোটভাই অনির কাছে যেতাম না।
এই তো তোমার মুখ থেকে আসল কথাটা বেরিয়ে গেল।
তাহলে ছেঁড়া পরোটা নিয়ে আসতে বলি।
অবশ্যই। আর একটা কাজ করবে।
বল।
পাশেই গরম গরম জিলিপি ভাজছে। গোটা কতক নিয়ে আসতে বলো।
সত্যি অনি, তুই এখনো সেরকম আছিস।
বাড়ি থেকে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড, সেখান থেকে পাবলিক বাসে পার্ক স্ট্রীট, হেঁটে তোমার অফিস। এর মধ্যে একটুও ভেজাল নেই, ফাঁকি নেই।
তোকে দেখে আমার ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে।
তোমাকে দেখেও। মনের মধ্যে একটা শান্তি বোধ করছি। বৌদি ভালো আছে।
দাঁড়া।
সুজিতদা মোবাইল বার করে পটাপট বোতাম টিপলো। ভয়েজ অন করতে রিংটোনে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে এলো। আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি।
হ্যালো, বলো।
তুমি কোথায়।
একটু মার্কেটিংয়ে এসেছি।
আমার কাছে একজন এসেছে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছে, তুমি কেমন আছ।
কে গো।
অনি।
অনি! ওটা বেঁচে আছে।
বালাই ষাট ও কথা বলতে আছে।
বলবো না, দাও ওকে ওর চুলের মুটিটা ধরি।
তোমার কথা ও শুনতে পাচ্ছে।
কিরে ছাগল, পথ ভুলে।
না গো বৌদি, পৃথিবীটা যে গোল আজ অনুভব করলাম।
এভাবে তোর সঙ্গে কথা বলবো না। কবে আসবি।
হঠাৎ কোন একদিন।
হ্যাঁগো ও কি সেরকমই দেখতে আছে। না মুটিয়েছে।
আরি বাবা একেবারে সেরকম কোন পরিবর্তন নেই, সেই ময়লা ময়লা গেঞ্জি, আর ছেঁড়া ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট।
মাথার চুল।
এখনো সেই রকম। দাড়ি গোঁফ তো ওর কনো দিন ছিল না। একটু একটু ছাগল দাড়ি, সেটা আজ কেটেছে।
আমি হেসে ফেললাম। ওর একটা ছবি তুলে আনো।
আমি ওকে বললাম কি খাবি। ও কি বললো জানো।
কি খেতে চেয়েছে রুটি আলুর দম।
সেরকমই। ছেঁড়া পরোটা ঘুগনি আর জিলিপি।
ও ওই হাউসের মালিক হওয়ার যোগ্য নয়।
সুজিতদা হাসছে।
কিরে অনি কবে আসবি।
দাদাকে একটা দিন ঠিক করে দিচ্ছি, সেদিন আসব।
আয় জমিয়ে গল্প করবো। বিয়ে করেছিস।
না। মেয়ে পাচ্ছি না।
এই যে শুনলাম তুই তোর মালকিনকে পটিয়েছিস।
তোমার কি বিশ্বাস হয়।
বিশ্বাস হয় না। অবিশ্বাসই বা করি কি করে।
ঠিক আছে এই বিষয় নিয়ে পরে কথা হবে।
শোনো ও যা খেতে চায় ওকে খাওয়াও।
আচ্ছা।
রাখি।
হ্যাঁ।
একজন এসে ঘরে ঢুকলেন।
স্যার।
হ্যাঁ বলুন।
আমরা ওনাকে বোঝালাম। উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কি বুঝলে।
মনে হচ্ছে উনি ঠিক সেটিসফায়েড নন।
নিয়ে এসো।
ছেলেটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুজিতদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁরে অনি তুই এখনো স্ক্রিপ্ট তৈরি করিস।
কেন বলো।
একটা পার্টিকে কিছুতেই পটাতে পারছি না।
অনেক দিন স্ক্রিপ্ট লেখা ছেড়ে দিয়েছি। আঁকি বুকিও চুলোর দরে গেছে।
একটা ভালো পার্টি এসেছে বম্বে থেকে, ওরা এখানে প্রোডাক্ট লঞ্চ করবে। কাজটা করবি।
সব।
তুই করলে আমি নিশ্চিন্ত হই। তাছাড়া তুই এখন মালিক বলে কথা। ওয়েট ক্যারি করবে।
কতো দেবে।
প্রোজেক্টটা পঞ্চাশ কোটি। ওরা একবছরে খরচ করবে। পুরো ইষ্টার্ন রিজিয়ন আমাকে দেবে। তোদের কাগজের জন্য আমি ওয়ান থার্ড ধরে রেখেছি। তোকে এটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বাকিটা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যানার সব কিছুতে।
আমি কিন্তু লে আউট প্ল্যানিং করে ছেড়ে দেব। বাকি তোমাকে করতে হবে।
অবশ্যই তুই ভিজুয়ালি যেমন করে দিতিস আমাকে সেই রকম করে দে।
তাই হবে।
আমি কি পাব।
তোর পেছনে আমি চার খরচ করতে পারি।
চার লাখ না কোটি।
তুই কি এখন লাখে সীমাবদ্ধ, তোকে ধরতে গেলে কোটি দরকার।
গুল মের না।
ঠিক আছে ভদ্রলোককে আসতে দে, কথা বল।
রাজি হলে, তোর কাগজের ব্যাপরটা আজই কিন্তু ওনার সামনে ফাইন্যাল করে নেব।
আমার কিন্তু ক্যাশ চাই হাফ এ্যাডভান্স।
তাই হবে।
পটাতে পারলে আজকেই দিতে হবে।
তুই যদি আমার হয়ে পটাতে পারিস, আমি কথা দিলাম যত রাত হোক তোর ঘরে পৌঁছে দেব।
ডাকো। তাহলে আমার ছেঁড়া পরোটা এখন খাওয়া হবে না।
পরে খাস। আগে কাজ।
সুজিতদা ইন্টারকমে কথা বললো।
সেই ভদ্রলোক, আর একজন স্যুট টাই পরিহিত টিপ টপ একজনকে নিয়ে সুজিতদার ঘরে এলেন। আমি ভ্যাবলার মতো ওনার দিকে তাকালাম। সুজিতদা প্রথমে ব্যবসায়িক ভাষণ দিলেন। নাম বললেন মিঃ নেওটিয়া। বাংলা হিন্দী ইংরাজী মিশিয়ে কথা বলছেন। আগামী মাস থেকে উনি ক্যাম্পেনিং করতে চান।
সুজিতদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক প্রথমে আমাকে দেখে ভ্রু-কোঁচকালেন। তারপর আমার নাম শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আপনার জন্য রাজনাথ আর ওই মিনিস্টার….।
সুজিতদা তাকিয়ে আছে।
আমি ঠিক হাসলাম না। আবার গম্ভীরও থাকলাম না।
ভদ্রলোক আমার হাতটা ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিলেন।
প্রায় একঘন্টা কথা হলো। ভদ্রলোককে পটিয়ে নিলাম। দুটো কনট্রাক্ট লেটার তৈরি হলো। একটা আমার কাগজের সঙ্গে, আর একটা আমার সঙ্গে। উনি একটা পাঁচ কোটি টাকার চেক আর আমাকে বাই নেম দু’কোটি টাকার চেক দিলেন। কনট্রাক্টগুলো আমি নিলাম। কাজ বুঝলাম। সুজিতদা সব ফাইল করে আমাকে দিল। ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ভদ্রলোককে অফিসের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সুজিতদা হৈ হৈ করতে করতে ঘরে ঢুকলো। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। তোর জন্য আজকে ব্যাবসাটা পেলাম। তোর কি কনসেপ্টরে। তুই জানিষ ওই ভদ্রলোককে আমার অপনেন্ট এম এস এ্যাড এজেন্সি নিয়ে চলে গেছিল। আজও কোন মতে ওকে সেটিসফায়েড করতে পারেনি এরা কেউ।
সকাল থেকে দুটো সেসন পার করে দিয়েছে এরা। তুই এক ঘন্টায় মালটাকে কুপকাত করে দিলি! তুইতো এখন অনেক বড় খেলোয়াড়।
আমার ছেঁড়া পরোটা।
আনছি আনছি। ওরে শালা! এখন বুঝছি তোকে কেন ম্যাডাম মালিক বানিয়েছে। যার হাত থেকে সহজে মাল গলে না এককথায় কুড়ি কোটির চেক দিয়ে চলে গেল।
মাথায় রাখবে আমি ক্যাশ চেয়েছি, কাগজেরটা পুরো এ্যাডভান্স চেয়েছি।
ও দিয়ে দেবে।
দিয়ে দেবে না। বুধবারের মধ্যে অফিসে চেক পৌঁছন চাই।….
এই তুই ঝামেলা শুরু করছিস।

….না হলে পুরো সিডিউল ক্যানসেল করে দেব।
 
তুই কি আমাকে মারবি।
মাল পেয়ে গেলে মারব না।
তাড়াতাড়ি খাবার বলো।
ও দিকটা একবার তাকা।
দেখলাম কাঁচের দরজার ওপাশে সকলে দাঁড়িয়ে আছে।
সারাটা অফিস রাষ্ট্রহয়ে গেছে।
সুজিতদা ইশারা করলো ভেতরে আসার জন্য।
দুজন ভেতরে এলো।
স্যার আমরা সকলে অনিবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে চাই। সবাই করিডরে জড়ো হয়েছে।
কি বুঝছিস। সবাই জেনে গেছে তুই আজ অফিসের হয়ে মাল ফাঁসিয়েছিস।
আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমার কমিশন।
পেয়ে যাবি।
ধার বাকি নেই। ক্যাশে নেব।
তোকে যখন কথা দিয়েছি, দেব।
ফুল ক্যাশ।
তাই হবে। তুই আমার ছ’মাসের মাসের ব্যবসা তুলে দিলি। তোকে দেব না তো কাকে দেব।
ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে, তোরা সবাই বোস, ও তোদের সঙ্গে মিট করবে।
ওরা বেরিয়ে গেল।
সুজিতদা বৌদিকে ফোন করে সব জানাল।
বৌদি খুশিতে ডগমগ করছে।
আমার আর্ট ডিপার্টমেন্টের ছেলেগুলোর সঙ্গে তুই একটু মিটিং করে যা।
তাই চলো ওখানে বসে সবার সঙ্গে আলাপও করা যাবে, আবার কথাও বলে নেওয়া যাবে।
আমি সুজিতদা ওই ঘরে এলাম। সুজিতদার চেম্বারের থেকে বড়ো।
সবাই আমার সঙ্গে এসে আলাপ করলো। মেয়েগুলো আমাকে দেখে মুচকি হাসে। বিশেষ করে লীনা বলে মেয়েটি।
আমাদের প্রথম ক্যাম্পেনিং সেই চায়ের বিজ্ঞাপনটা তোমাদের মনে আছে।
ওরা সুজিতদার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বহুবার গল্প বলেছি তোমাদের।
হ্যাঁ স্যার, চুমুকে চমক।
ঠিক বলেছো।
ওটা অনির কনসেপ্ট। সেইদিন আস্থার নাম সবাই জেনেছিল। আজ আট বছর পর ও আবার এই কাজে হাত দিল। আশা রাখছি তোমরা নতুন কিছু পাবে।
আমরা স্যার অনিদার সঙ্গে কাজ করতে পারি না।
সবই তোমরা করবে, ও খালি লে-আউট ডিজাইন প্ল্যানিং করে দেবে। তোমাদের সঙ্গে ও এখনি একটা ছোট্ট মিটিং করবে।
তাহলে খুব ভাল হয় স্যার।
ছেঁড়া পরটা ঘুগনি আর জিলিপি এলো।
আমার খাওয়ার বহর দেখে মেয়েগুলো হাসাহাসি করলো।
খেতে খেতে ওদের সঙ্গে মিটিং করলাম, ছবি আঁকলাম, ওদের যে আর্ট ডিরেক্টর তার সঙ্গে বসে আমার চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদান করলাম।
আবার সুজিতদার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গেঁজাবার পর উঠলাম।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন ঘন্টা কোথা থেকে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।
সুজিতদাকে আমার কার্ডটা দিলাম।
মেটেরিয়াল গুলো আটটার সময় এই এ্যাড্রেসে নিয়ে এসো আমি থাকব।
এতো ট্র্যাংগুলার পার্কের ঠিকানা।
হ্যাঁ।
আমার বাড়ির থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব।
আমি এখন এখানেই থাকি। চলে এসো।
আমি ঠিক ওই টাইমের মধ্যে যাব।
তুই একটু চম্পককে বলে দে।
বলে দেব।
বেরিয়ে এলাম।
সুজিতদা গেটের বাইরে করিডর পর্যন্ত এল।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তার নিওন আলো সবে জ্বলে উঠেছে।
পার্কস্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে অন করলাম।
মিস কল আর ম্যাসেজ।
দেখলাম তার মধ্যে মিত্রার মিস কল সব চেয়ে বেশি। একটা ম্যাসেজও করেছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস। বড়মাকে কথা দিয়েছিলি আজ বেরবি না।
আবার ম্যাসেজ ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিস কেন।
অনেক জিনিষ কিনেছি। তোকে কাল সাজাব। আমার মনের মতো করে।
ম্যাসেজ দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। পথচলতি লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম।
সরি।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।
হঠাৎ রাস্তার ধারে ডাস্টবিনে বসে থাকা পাগলটার দিকে চোখ পরতেই হেসে ফেললো।
থমকে দাঁড়ালাম।
এঁঠো পাতা থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। চিনতে পারলাম। চোখ মারলাম। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে দুটো সিগারেট কিনলাম।
এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির সিঁড়িতে বসলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। একটা হাতে রাখলাম। সুমন হেলতে দুলতে হাঁসতে হাঁসতে আমার কাছে এসে বসলো। আমি যে সিঁড়িতে বসলাম তার তিনধাপ নিচে। সিগারেটটা ইচ্ছে করে ফেলেদিলাম। সুমন কুড়িয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলো।
চারদিকে রাস্তার নিওন আলো গুলো ঝক ঝক করছে। হোর্ডিং-এর আলো এসে পরেছে সোসাইটির সিঁড়িতে।
আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে সিগারেটটা দিতে বললাম। ও চোখ মারলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর সিগারেট থেকে আমার গোটা সিগারেটটা ধরালাম। দু’একজন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাঁকা চোখে দেখে হাসলো।
সিগারেট খাচ্ছি আর নিজের মনে কথা বলছি।
কিরে এখানে কি করতে ?
সুমনও সিগারেট খাচ্ছে, মাথা নীচু করে ধুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার কথার উত্তর দিয়ে চলেছে।
তোমার লেখার রি-অ্যাকসন। ঘুম করে নিয়েছ। ওদিকে সাদা পোষাকের মাল তোমায় আমায় লক্ষ করছে।
আমাকে চেনে।
না। মাপছে।
তাহলে ফুটে যাই।
বসো অসুবিধে নেই।
তাহলে আর দুটো সিগারেট কিনে আনি। আমি উঠে চলে গেলাম। সিগারেটের দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনলাম সুমন আমার পেছন পেছন এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলো।
একজন নোংরা পাগল একজন ভদ্রলোকের গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলে যা করে আমি সুমনকে তাই করলাম। উপরন্তু একটা সিগারেট দিলাম। আবার এসে বসলাম।
সুমন আমার পেছন পেছন এসে একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। চোখ চারিদিকে সজাগ।
গুরু দারুণ এ্যাকটিং করলে। মাল পুর হাওয়া।
তোর কি আজকে এখানে ডিউটি।
হ্যাঁ। তোমাকে যাবার সময় দেখেছি।
লক্ষ্য করিনি।
জানতাম। তোমার চোখ। দেখলে একবার থমকে দাঁড়াতে।
তখন কোথায় ছিলি।
ব্লু-ফক্সের ধারে।
এখানে কিসের গন্ধ।
শুনছি আমেরিকান হাউসে এ্যাটাক হবে।
খবরটা দিস। আমার নম্বর আছে।
না।
ইচ্ছে করে মানি পার্টসটা বার করে উঠে দাঁড়ালাম কার্ড বার করতে গিয়ে মানিপার্টসটা হাত থেকে ফেলে দিলাম। কাগজপত্র টাকা পয়সা পরে গেল। সুমন নিজের জিনিষটা নিয়ে নিল।
আমি একটা একটা করে সময় নিয়ে গুছিয়ে তুলে মানি পার্টসে রাখলাম।
আরও কিছুক্ষণ বসে ওর সঙ্গে গেঁজালাম।
প্রবীরদার থেকে তুমি একটু সাবধানে থেক।
কেনরে!
তোমাকে স্কিম করার ধান্দা করছে।
পারবেনা।
জানি তোমার হাতটা অনেক চওড়া। আজও চারটে গাড়ি অশ্বিনীনগরে ঢুকেছে। সব অটো মাল।
এখন কি সব ছেড়ে ছুড়ে ওই ব্যবসা শুরু করেছে!
ওটা রাজনাথের।
এ্যাড্রেস।
লোকটার ফার্মাসির ডিস্ট্রিবিউটর সিপ আছে।
মুখার্জী জানে।
না। চেপে আছি। স্টেটের ব্যাপার ওরা আগে খবর করে কিনা দেখি।
সেদিনের মালটা ?
যখন জানলাম, তখন তুমি খেল খতম করে দিয়েছ।
মোবাইলের ঘরিটা দেখলাম সাতটা বাজে।
আজ চলিরে।
যাও।
ওখান থেকে উঠে সোজা রাস্তার এপারে কালীঘাট মাঠে এসে দাঁড়ালাম।
বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না।
সুজিতদাকে একটা ফোন লাগালাম।
কথায় তুমি।
তোর মালটা জোগাড় করতে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর এসে পরবে।
শোনো আমি একটা কাজে ফেঁসে গেছি। তুমি আমার বাড়ির গেটে যে দারোয়ান আছে, ওর নাম ছগনলাল ওর কাছে রেখে আসবে।
যদি কিছু হয়।
কিছু হবে না।
তুই যখন বলছিস রেখে আসবো।
সোজা একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম গঙ্গার ধার।
আমার সেই জায়গা। এই রাতে এই জায়গায় বড় একটা কেউ আসে না।
দূরে জেলে নৌকগুলোয় রান্না চাপিয়েছে। স্টিমারের ছেঁড়া ছেঁড়া আলো গঙ্গার বুকে পিছলে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
মিঃ মুখার্জীকে ফোন করলাম।
কি স্যার কি খবর।
মুখার্জী হাসছে।
রবিবার একবার সময় রাখবেন। সন্ধ্যার পর আমার এখানে একবার আসতে হবে।
মুখার্জী জোড়ে হেসে ফেললো।
হাসছেন যে।
নেমন্তন্ন এই তো ?
হ্যাঁ।
জানি।
কি করে।
দাদা ফোন করেছিলেন।
তাহলে সবই জেনেছেন। টোটাল টিম নিয়ে আসবেন।
যাক পাখি এবার দাঁড়ে বসবে।
পার্ক স্ট্রিটে লোকজন ঘুরতে দেখলাম।
এ খবর পেলেন কোথা থেকে!
বলুন না, আমি যা বলছি সত্যি কিনা।
সত্যি।
আমেরিকান হাউস টার্গেট।
সেরকমই খবর।
আমি যেন আগে পাই মাথায় রাখবেন।
মুখার্জী হাসছেন।
আচ্ছা আপনি খবরটা পেলেন কোথা থেকে ?
পেয়েছি।
সত্যি, এবার আপনার পেছনে আমাকে লোক লাগাতে হবে।
লাগান। কে বারণ করেছে।
সত্যি আপনি ইনভিজিবিল ম্যান।
হাসলাম। রাখি।

আচ্ছা।
 
ফোনটা পকেটে রাখতেই একটা ছায়া মূর্তি সামনে এসে দাঁড়াল।
দাদা চা আনি।
আবিদ রতন ছাড়া ইসলামবাই-এর দলের আমি কাউকে সেই ভাবে চিনি না। তবে ইসলামভাই-এর দয়ায় এদের অনেকেই আমাকে চেনে।
দেখলেই মনে হবে নিপাট ভাল ছেলে। এদের চোখই অনেক কথা বলে।
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
চা-এর সঙ্গে কিছু আনি।
শুধু চা আন।
ছেলেটা চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা চা ওয়ালাকে ধরে আনল। চা দিয়ে ছেলেটা এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। আলো আঁধারি পথে মিশে গেল।
একা থাকলেই বার বার মিত্রার কথাটা মনে পরে যাচ্ছে।
তাহলে কি আমি কোথাও ভুল করে ফেললাম ?
কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না।
হাজারটা বাজে চিন্তা আমার সামনে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। আমাকে যেন বিদ্রূপ করছে।
ধ্যুস। উঠে পরলাম।
পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলাম। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবু ঘাটের মুখটায় এলাম।
একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।
দাদা যাবেন নাকি ?
কোথায় ?
ট্র্যাংগুলার পার্ক।
চলুন।
উঠে বসলাম।
বেশ বুঝতে পারছি একটা ঘোড়ের মধ্যে আঠি। এতটা পথ চলে এলাম কিছুই বুঝতে পারলাম না। ট্র্যাংগুলার পার্কের কাছে এসে ছেলটি বললো দাদা কোনদিক দিয়ে ঢুকবেন। ওকে পথনির্দেশ দিলাম।
গেটার মুখ যখন এসে দাঁড়ালাম তখন রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে।
ছগনলাল আলো জালায় নি। একমাত্র বড়মার ঘরে আলো জলছে।
দুটো দরজা চেন দিয়ে আটকান একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলাম।
ছোটবাবু।
ছগনলাল এগিয়ে এসেছে। ওর মুখের দিকে তাকালাম।
একটু আগে একজন বাবু এসিছিলেন। অনেক জিনিষপত্র আর একটা ব্যাগ দিয়ে গেলেন। বড়মার ঘরে রেখেছি।
ঠিক আছে।
ঘোরের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় উঠে এলাম।
বাগানটা এখনো বেশ অপরিষ্কার। চারিদিকে জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
বড়মার ঘরে এলাম। ছগনলাল সব ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে রেখেছে।
ড্রইং-এর মেটিরায়ালস গুলো নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম।
ছগনলাল গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।
দাও আমি নিয়ে যাচ্ছি।
থাক আমি নিয়ে যাচ্ছি। তবু ছগনলাল এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ড্রইং-এর বোর্ডটা নিল।
আমাকে একটু চা খাওয়াবে।
তুমি সকাল থেকে কিছু খাও নি।
খেয়েছি, তুমি একটু চা করো।
আমার বিছানায় বোর্ডটা রেখে ছগনলাল চলেগেল।
হঠাৎ নিজের ভেতরে কেমন যেন একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম।
হাতটা ভীষণ উসখুস করছে ছবি আঁকার জন্য। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নিলাম। বিছানা ময় সব ছড়িয়ে দিলাম। বাথরুম থেকে বালতি করে জল আনলাম। মগটা নিয়ে এসে একমগ জল আলাদা করে রাখলাম। তুলিগুলো সব ডুবিয়ে দিলাম। জামা প্যান্টটা টেনে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। টাওয়েলটা পরে নিলাম। নিমেষের মধ্যে ঘরের চেহারাটাই বদলে গেল।
ড্রেস মেটিরিয়ালসের ছবি আগে এঁকে ফেলতে হবে।
আমার দীর্ঘদিনের অভুক্ত খাবার আজ পেয়েছি। সুজিতদার কাছেই শেষ কাজটা করেছিলাম। মাথার মধ্যে সব কেমন যেন কিল বিল করতে আরম্ভ করলো।
ছগনলাল চা দিয়ে গেল। আমি ড্র করতে শুরু করলাম। বার বার পিঙ্কি চুর্ণী তিয়া রিমঝিমের মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে তিয়ার মুখটা।
পারফেক্ট মডেলের মত চেহারা।
হাতের পেন্সিল হ্যান্ড মেড পেপারের ওপর চলতে শুরু করলো। পর পর অনেক গুলো স্কেচ করে ফেললাম ঘরের চারদিকে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি আর এঁকে যাই।
একজন মানুষ দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকার পর যখন খেতে পায়, সে যেভাবে খায় আমিও যেন সেই ভাবে এঁকে চলেছি।
মিঃ নেওটিয়া বলছিলেন প্রথমে উনি মেয়েদের ড্রেস মেটিরিয়াল দিয়ে শুরু করবেন। আমাকে তারও ড্রইং করে দিতে হবে। সিকোয়েন্স গুলো মনে মনে একবার সাজিয়ে নিলাম। হ্যান্ড মেড পেপারগুলো আগে ভালো করে বালতির জলে ডুবিয়ে নিলাম। প্রথমে একটা প্রকৃতির দৃশ্য আঁকলাম, না হাতটা ঠিক আছে। তারপর ক্যাটওয়ার্ক গুলো তৈরি করলাম। এবার রাম্পে হাঁটার থেকে আরম্ভ করে পর পর সিকয়েন্স গুলোর স্কেচ আঁকতে শুরু করলাম।
অনেকদিন পর তুলি হাতে পেয়ে মনেহচ্ছে আমি যেন স্বর্গ হাতে পেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে স্কেচগুলো আমার সবচেয়ে বেশি আপনজন। কনোদিকে খেয়াল নেই। আমি আমার সাধনায় নিমগ্ন।
কতোক্ষণ এঁকেছি, কতগুলো ছবি এঁকেছি জানি না। পর পর মনে যা এসেছে, যে ভাবে ভেবেছি তুলির রং-এ তাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আঁকা শেষ হলে একটা একটা করে খাটের ওপর রেখে এসেছি।
আঁকতে আঁকতে হঠাৎ দেখলাম কে যেন আমার ড্রইং বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার ছায়া আমার ড্রইং বোর্ডে পরেছে। চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম মিত্রা। হেসে ফেললাম।
ঝট করে রং-এর প্লেটটা রেখে ওকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একপাক ঘুড়ে নিলাম। ওকে কোলে তুলে নিলাম।
মিত্রা, মিত্রা আমার মিত্রা।
ছাড় ছাড় পরে যাব। তোর কোথাও লেগে যাবে আবার।
আমি ছাড়লামনা ওকে জাপ্টে ধরে বললাম, জানিষ আজ আমি জিতে গেছি।
তখনও ও আমার কোলে। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।
আমাকে নিচে নামা আমি পড়ে যাব।
আমি আছি, কেন তুই পড়ে যাবি ? তুই পড়ে গেলে আমি তোকে ধরে ফেলবো।
প্লিজ তুই নিচে নামা।
আমি ওকে নিচে নামালাম।
ওর দিকে তাকালম। চোখে জল টল টল করছে।
এমা তুই কাঁদছিস কেন ? আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। তুই বিশ্বাস কর, তুই তখন বললি না। জানিস আমি আজ একটা বিরাট কাজ পেয়েছি। আট বছর পর।
ও আমার দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে।
কাঁদিস না। তাহলে মনটা খারাপ হয়ে যাবে। আমি কিন্তু তোর কথা রেখেছি।
আমার দু’হাতের আঁজলায় ওর মুখ তুলে ধরলাম। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর চোখ মোছালাম। কপালে একটা চুমু খেলাম।
আমি হরে গেছি বুবুন।
কে বললো তুই হেরেগেছিস! তুই জিতেছিস। দেখ আমি তোর কথা রেখেছি। তারাতারি চলে এসেছি। আর কোথাও বেরই নি। খালি ছবি আঁকছি। অনেকদিন তুলি ধরিনি বুঝলি।
মিত্রা আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
এই দ্যাখো আবার কাঁদে, তুই সুজিতদাকে চিনিস ?
তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলাম।
সত্যিতো তুই সুজিতদাকে চিনবি কি করে। আমি তোকে সুজিতদার কথা আগে বলিনি। জানিস সুজিতদা আমাকে একটা বিরাট কাজ দিয়েছে। কততো টাকা দিয়েছে জানিস।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
এমা, এই দ্যাখো আবার বোকার মতো কাঁদে। আমি তোর কথা রেখেছি। এবার তুই নিশ্চই আমার সঙ্গে থাকবি। আমাকে ছেড়ে যাবি না।
মিত্রা আরও জোড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, তুই আর বলিস না।
কেন। আমি কি আবার অন্যায় করলাম ?
তোকে আমি সকালে অনেক খারাপ কথা বলেছি।
কই না! ওগুলো তোর মনের কথা নয়। তখন তুই আমার ওপর রাগ করেছিলি। আমি সত্যি তখন অন্যায় করেছিলাম। তাই তুই বলেছিস। তুই বিশ্বাস কর আমি একটুও রাগ করিনি।
ওকে খাটের কাছে নিয়ে গেলাম।
দেখনা দেখ, আমি এরি মধ্যে কতগুলো ছবি এঁকেছি। কেমন এঁকেছি বল।
মিত্রা ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকাল। ভাল।
শুধু ভাল! আর কিছু নয় ?
মিত্রা আমার বুকে ঠোঁট রাখল।
হেসে ফেললাম এইবার বুঝলাম, শুধু ভাল নয়, তার থেকেও যদি কিছু থাকে, তাই।
মিত্রা হেসে ফেললো।
চা খাসনি কেন।
খেয়েছি, ছগনলাল একবার দিয়েছে।
তুই খেয়েছিস!
হ্যাঁ।
তাহলে ওটা কি।
কই দেখি।
আমি চায়ের কাপটা দেখলাম।
যেমন দিয়ে গেছিল তেমন পরে আছে।
তাহলে হয়তো ছগনলাল পরে আর একবার দিয়ে গেছে। এখন আমাকে একটু চা খাওয়াবি।
কটা বাজে জানিস।
কটা ? তুই এখন এলি, নটা বাজে।
মিত্রা আমার মুখে হাত দিল। কিছু খোঁজার চেষ্টা। চোখদুটো জলে টলটল, স্থির।
সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
তোরা অনেকক্ষণ এসেছিস!
হ্যাঁ।
আমাকে ডাকলি না কেন।
তোর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটুক কেউ তা চায়নি।
হেসে ফেললাম।
ডাক ডাক সকলকে ডাক।
মিত্রা এগিয়ে গেল।
দাঁড়া দাঁড়া পাজামাটা পরে নিই, টাওয়েল পরা আছে। ওরা আবার কে কি মনে করবে।
ওরা সবাই তোকে এই অবস্থায় দেখে গেছে।
এ-মা, তুই বারন করতে পারলি না।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
আমি তাড়া হুড়ো করে পাজামা পাঞ্জাবীটা পরে নিলাম।
মিত্রা গিয়ে দরজা খুললো। দেবারা সবাই ঘরের মধ্যে এলো। আমি হাসলাম।
তুই এগুলো কি করছিস!
জানিস দেবা আজ হঠাৎ একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একটা এ্যাড প্রমোসনের।
তুমি এ্যাড প্রমোসনের কাজ করছো!
হ্যাঁগো টিনা। আগে করেছি কয়েকবার। অনেক দিন পর আবার একটা সুযোগ পেলাম, ছাড়লাম না, লোভ হলো কাজটা করতে, নিয়ে নিলাম।
এই ছবি গুলো তো ড্রেস মেটিরিয়ালের। মিলি বললো।
হ্যাঁ। ওরা প্রথমে ওদের ড্রেস মেটেরিয়াল লঞ্চ করবে। মডেলরা রাম্পে হেঁটে সেই ড্রেস মেটিরিয়াল শো করাবে। আমি খালি এ্যাঙ্গেল গুলো ঠিক করে স্কেচ গুলো ড্র করে দিচ্ছি।
তুমি আগে করেছো কখনো!
অনেকদিন আগে করেছিলাম। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, একটা চায়ের বিজ্ঞাপনে একটা ক্যাপসান খুব হিট করেছিল, চুমুকে চমক।
হ্যাঁ। মনে আছে।
ওই চায়ের টোটাল প্রোমোশনটা আমি করেছিলাম। সেই থেকে সুজিতদার ব্যাবসার উন্নতি।
সুজিতদা! আস্থা! দেবাশীষ বললো।
হ্যাঁ। তুই চিনিস।
চিনব না মানে!
আমি ধীর পায়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

বাইরেটা অন্ধকার। পাঁচিলের বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির লাইট পোস্ট থেকে যে টুকু আলো আসছে তাতেই বাগানটা আলোকিত। আকাশের তারা ফ্যাকাশে।
 
তখন আমি স্বাধীন সাংবাদিক বুঝলি দেবা। সুজিতদার সঙ্গে আলাপ হলো পার্ক হোটেলের একটা প্রোগ্রামে। দাদা কভার করতে পাঠিয়েছিল। কথায় কথায় বললাম আমাকে কিছু কাজ দিন না। তখন খেতে পাই না। যদি কিছু আসে।
তা বললো তুমি কপিরাইট করতে পারো। বললাম পারি না, তবে দিলে একবার চেষ্টা করবো। উনি দিলেন, পাশ করে গেলাম।
সেই থেকে শুরু। তারপর হৃদ্যতা, এমনকি একদিন সুজিতদার অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছেগেলাম। অনেকগুলো কাজ করেছি সুজিতদার। মাঝে সুজিতদার সঙ্গে একবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
তবে আস্থা যে তার নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে চলেছে তার খোঁজখবর রাখতাম। তোর শ্রেণিকদাকে মনে আছে। রেডিফিউসন যার হাতে তৈরি।
হ্যাঁ। খুব ভালো করে চিনি।
শ্রেণিকদা খুব ভালো স্পোর্টসের ওপর লিখতেন।
উনি স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন। সুজিতদার মতো শ্রেণিকদার সঙ্গেও আমার আলাপ খেলার মাঠে। তখন শ্রেণিকদারও প্রচুর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, কপিরাইট, চারলাইনের বিজ্ঞাপণী গান লিখে দিয়েছি। এককথায় বলতে পারিস দেহপসারিণী। যেখানে দুটো পয়সা সেখানেই অনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
জানিস দেবা, আজ সকালে মিত্রার কয়েকটা কথায় মনটা খুব খারাপ লাগলো। এতে মিত্রার কনো দোষ নেই। দোষ সম্পূর্ণ আমার। তোরা সবাই চলে যাবার পর, নিজের সঙ্গে নিজে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলাম। একবার ভাবলাম গঙ্গার ধারে আমার পুরনো ঠেকায় চলে যাই। কিছুক্ষণ জলে ভেসে চলে আসবো। তারপর নিজের মনে খুঁজতে শুরু করলাম আমার পুরনো ভালোবাসার লোকজন কে আছে, যার কাছে গিয়ে আমি দু’দন্ড শান্তি পাব। এক কথায় বলতে পারিস ব্রেক।
ট্র্যাংগুলার পার্ক থেকে বাসে উঠলাম। কোথায় নামবো জানি না। পার্ক স্ট্রীটে এসে ভাবলাম এখানে নেমে পরি। বাস থেকে নামলাম। একবার ভাবলাম মিত্রার ক্লাবে যাই। ওখানে আমার এক পুরনো বন্ধু আছে। তারপর ভাবলাম না, তাতে মিত্রার সম্মানহানি হতে পারে। আফটার অল আমি মিত্রার একজন পার্টনার। তারপরই সুজিতদার মুখটা ভেসে উঠলো। অনেকদিন সুজিতদার সঙ্গে দেখা হয় নি। গেলে চিন্তে পারবে কি ? তবু গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি সুজিতদার কাছে কিছু টাকা চাইতে গেছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার কিছু টাকার দরকার ছিল।
একটু থামলাম।
নিশ্চিত তুই মনে মনে হাসছিস। অনি তোর আবার টাকার দরকার, তার জন্য সুজিতদা! হ্যাঁ দেবা, আমার হাতের মুঠোয় রাজ্য এবং রাজকন্যা। আমার আবার কিসের টাকার দরকার ? আচ্ছা বলতো দেবা, আমি এখনো পর্যন্ত যা পেয়েছি, যা করেছি তার একটা পয়সাও আমার ?
সুজিতদাকে মনের কথাটা বলেছিলাম। সুজিতদা থাপ্পর মারতে এলো। এটাই স্বাভাবিক। অনেকটা তোর মনে মনে হাসির মতো। আমি সুজিতদাকে আমার মনটা খুলে দেখাতে পারি নি।
তারপর গঙ্গাদিয়ে অনেক জল গরাল। আলটিমেট সুজিতদা কাজটা আমাকে অফার করলো। ভালো টাকা দেবে বললো, লোভ সামলাতে পারলাম না।
ফিরে তাকালাম ওদের দিকে, হয়তো চোখ দিয়ে দু’এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এসেছিল। ডান হাতের তালু দিয়ে তা মুছলাম।
সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিত্রাকে দেখতে পেলাম না।
জানিস আমর এসব কিছুই ছিলো না। সুজিতদা কিনে দিয়ে গেল।
আদিতি আমার কাছে এগিয় এসে বললো, তুমি এতো ভালো স্কেচ করতে পার!
এগুলো আর ভালো কোথায়, মনের ভাবটা প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। বাকিটা ওরা করে নেবে।
টিনার দিকে তাকালাম।
টিনা তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে।
আমাদের জন্য!
হ্যাঁ। ওই ফাইলটা দাও।
আমরা দেখেছি।
তোমরা দেখেছো! কখন ?
তখন তুমি একমনে স্কেচ করছিলে।
এ-মা আমাকে ডাকো নি কেন ?
কিভাবে সাধনা করতে হয় তোমার কাছ থেকে শিখছিলাম। বড়মা বললো ওকে দেখে তোরা শেখ। এখন বিরক্ত করিস না, ওর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটবে। টিনা বললো।
বোকা বোকা কথা।
ওরা কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাল।
জানো মিঃ নেওটিয়া কাজটা অন্য একটা এজেন্সীকে দিতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি আজ সুজিতদার কাছে গেছিলাম। সুজিতদা আমার সঙ্গে ওনার আলাপ করিয়ে দেবার পর উনি একেবারে গদ গদ হয়ে পরলেন, আফটার অল কাগজের মালিক বলে কথা। ওনার প্রোডাক্টগুলো শোনার পর, আমি ওনাকে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বোঝালাম। উনি আমার কনসেপট এ্যাকসেপ্ট করলেন। সুজিতদাকে দিয়ে প্রমিস করালেন অনিবাবু যদি নিজে দায়িত্বে কাজটা করেন, তাহলে উনি কাজটা দিতে পারেন। সেই সময় সুজিতদার সেই চোখের চাহুনি আমি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। সম্মতি দিলাম। উনি সুজিতদাকে কাজটা দিলেন।
দাদা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল পেছন পেছন সবাই।
আমি ছুটে গিয়ে দাদাকে প্রণাম করলাম। হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলাম।
জানো দাদা আজ অনি হঠাৎ অনেক টাকা রোজগার করে ফেলেছে।
দাদা হাসল, অনেক টাকা!
দেখো দেখো নিচের ব্যাগে টাকা আছে, এই দেখো চেক।
তোর তো টাকার দরকার নেই, কি করবি এগুলো।
আমি মিত্রাকে সব দিয়ে দিয়েছি। বলেছি, এটা তোর।
দাদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
সকাল বেলা মিত্রা কি বললো যানো, ও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। গলাটা ধরে এলো।
তাই বুঝি।
হ্যাঁগো। মনটা খুব খারপ হয়ে গেল। ভাবলাম কিছু একটা করতে হবে, কাজটা নিয়ে নিলাম। বলো ঠিক করিনি ?
দেখলাম দাদার চোখটা ছল ছল করছে।
এ-মা তোমার চোখেও জল।
ছোটমা বড়মার দিকে তাকালাম।
ধ্যুস, বুঝেছি আমি কাজটা নিয়েছি তোমাদের কারুর পছন্দ নয়। কালকে সুজিতদাকে ফেরত দিয়ে দেব।
দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
বড়মা ছোটমার কাছে গেলাম, কিগো তোমরাও আমার এই কাজটাকে অপছন্দ করছো ?
ডাক্তারদাদা এগিয়ে এলো, তুই ছবি আঁক, আমরা পরে আসবো।
না ডাক্তারদাদা, এখন আর ছবি আঁকা হবে না।
কেন ?
ব্রেক হয়ে গেল।
তাহলে নিচে চল।
যাও, আমি যাচ্ছি।
ওরা সবাই আস্তে আস্তে চলে গেল। শুধু মিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ড্রইংগুলো একজায়গায় পর পর সাজিয়ে রাখলাম। নিজের আঁকা স্কেচ গুলো বেশ দেখতে লাগছে। মিত্রা এগিয়ে এলো, আমাকে সাহায্য করলো। আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মিটি মিটি হাসছে।
তোর ছবিগুলো ভালো লাগেনি।
ও আমাকে জড়য়ি ধরলো।
তোর এই গুণটা আছে, আগে জানতাম না।
তোর ভালো লেগেছে।
হাঁ।
ব্যাশ, তাহলে আমি এই পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দেব।
পারবি।
আলবাত পারব।
তোর জন্য একটা জিনিষ নিয়ে এসেছি।
কিরে ?
একটা কথা দে।
বল।
কালকে আমি তোকে যেভাবে দেখতে চাইবো তুই সেই ভাবে আমাকে দেখাবি, বলতে পারিস আমার স্বপ্ন। তোর যেমন কিছু কিছু স্বপ্ন আছে, আমারও আছে। আমি তোকে কালকে দু’চোখ ভরে দেখতে চাই।
ধ্যুস আমি কি পুতুল, তুই পুতুল খেলবি।
ধরনা কালকের দিনটা আমি পুতুল খেলব।
সে দেখা যাবে।
দেখা যাবে কেন ?
আমি মিত্রার গালটা একটু টিপে দিলাম।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা, তাই হবে। খিদে পেয়েছে।
নিচে চল।
জানিস মিত্রা একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
কি অন্যায় করেছিস।
তোকে না জানিয়ে সুজিতদার সঙ্গে ছ’মাসের এগ্রিমেন্ট সাইন করে ফেলেছি।
বেশ করেছিস।
তুই রাগ করলি না।
তোর ওপর রাগ করে নিজেই বেশি কষ্ট পাই। দেখলাম চেকও নিয়ে এসেছিস।
বাকিটা আগামী বুধবার দিয়ে দেবে। পরিষ্কার বলে দিয়েছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট এ্যাডভান্স।
নিচে চল, খিদে পেয়েছে বললি। সকাল থেকে কি খেলি।
ছেঁড়া পরটা ঘুগনি, কয়েকটা জিলিপি।
মিত্রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
তোর কথা মনে পরে নি।
মিত্রা হাসলো।
কোথায় খেলি ?
সুজিতদার ওখানে।
সুজিতদা খাওয়ালো না তুই খেতে চাইলি।
হেসে ফেললাম।
চল।
দাঁড়া তুলি গুলো একটু ধুয়ে নিই।
তুই বালতি নিয়ে কি করছিলি।
কাগজগুলো জলে চোবালাম।
হ্যান্ডমেড পেপারগুলো জলে চুবিয়ে ছবি আঁকছিলি!
হ্যাঁরে, কালার গুলো তাতে দারুণ খোলে।
টাকা গুলো কি করবি।
ওটা তোর, তোকে তো কিছু দিতে পারিনি কোন দিন।
আমি নিয়ে কি করবো। আমার অনেক টাকা। এটা তোর পরিশ্রমের টাকা।
মিত্রা আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম। স্বগোতক্তির সুরে বললাম।
ধার শোধ করবি।
তার জন্য তুই বিজ্ঞাপন এনে দিয়েছিস।
তোর যা খুশি করিস, ভাবতে ভালো লাগছে না।
এখনো ওই বিজ্ঞাপনের সিকোয়েন্স গুলো তোর মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই না ?
হেসে ফেললাম।
ডাক্তারদাদা ঠিক কথা বলেছে, ও এখন আর ওর মধ্যে নেই, তোমরা কোন প্রশ্ন করলে ঠিক ঠিক জবাব পাবে না।
কেন আমি কি কোন অসংলগ্ন কথা বলছি ?
বলছিস না, বলা হয়ে যাচ্ছে।
কি খুচুর খুচুর করছিস দু’জনে, নিচে চল।
ছোটমার গলা, দারজার মুখে দাঁড়িয়ে, আমি ছোটমার দিকে তাকালাম।
বুঝলে ছোটমা, গর্ধভটাকে নিয়ে চলা বড় কষ্ট, একটু মেরামত করার চেষ্টা করছি। মিত্রা বললো।
কি মনে হচ্ছে, পারবি ?
হাল ছাড়িনি, ছাড়বও না।
দেখ চেষ্টা করে, আমি দিদি হাল ছেড়ে দিয়েছি।

আমি একবার ছোটমা একবার মিত্রার মুখের দিকে তাকাই। কি বলছে ঠিক এই মুহূর্তে মগজে ঢুকছে না। মিত্রা ঠিক বলেছে। এ্যাডের সিকোয়েন্সগুলো এখনো মাথায় রিনিঝিনি তালে সুর রচনা করে চলেছে।
 
বুঝেছি, তোর এখন মাথায় কিছু ঢুকবে না। তুই এখন সব কিছুর মধ্যে রাম্প দেখছিস, মডেলদের ড্রেস মেটিরিয়াল দেখছিস।
চলো ছোটমা। খিদে লেগেছে।
মিত্রা মুখ টিপে হাসল।
আমি ছোটমাকে টেনে নিয়ে নিচে চলে এলাম। দেখলাম সোফায় বসে সবাই গল্প করছে। দেবা অদিতি নির্মাল্যকে দেখতে পেলাম না। বড়মাকে দেখলাম রান্নাঘরে। এগিয়ে গেলাম। পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বড়মা আমার মুখের দিকে তাকাল।
খিদে পেয়েছে।
তোর কাজ শেষ হলো।
কই হলো, ওরা চলে এলো।
দুপুরে কোথায় গেছিলি ?
তুমি জানো না!
না।
পরে বোলবো।
কিরে তুই যে দেখবি বললি। মিত্রা এসে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়াল।
কি বলতো ?
আমরা যা নিয়ে এলাম।
চল। দাঁড়া টিনাকে একটা কথা বলে নিই।
বড়মার ঘরে চল আগে।
তাই চল।
আমি মিত্রার পেছন পেছন বড়মার ঘরে এলাম। বড়মার খাটের ওপর ডাঁই করা কাপর জামার প্যাকেট। আমি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম।
এতো জামা কাপড়! কার ?
তোর আছে, আমার আছে, সবার আছে। মিত্রা বললো।
এতো কি হবে ?
দরকার আছে। মিত্রা আমার দিকে দুষ্টুমি চোখে তাকিয়ে। মিটি মিটি হাসছে।
তুই দুপুর বেলা ওই প্যান্ট গেঞ্জিটা পরে বেরিয়েছিলি কেন। তোর আর জামা প্যান্ট নেই।
কি জানি, ভালো লাগলো, পরে নিলাম।
ওই জামা প্যান্ট পরলে অনিকে ঠিক অনির মতো লাগে তাই না।
মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
অন্য জামা প্যান্ট পরলে অনিকে বড্ডবেশি চক চকে মনে হয়।
তুই আমায় দেখেছিস!
মিত্রার স্থির চোখ আমার মুখে, হাসি হাসি চোখ দুটোয় না বলা অনেক কথা।
তুই একটা ভিখিরীর সঙ্গে এ্যাশিয়াটিক সোসাইটির সিঁড়িতে বসে কথা বলছিলি।
ও ভিখারী নয়।
আমার গলার স্বরটা হঠাৎ কর্কশ হয়ে গেল। মিত্রা চমকে আমার দিকে তাকাল।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলাম। দেখলাম টিনা মিলি ছোটমা বড়মা ঘরের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে।
টিনা। তোমায় কেউ ফোন করেছিল।
না অনিদা।
তোমায় একজন ফোন করতে পারে। ওদের একটা এ্যাড সানডের পেজে যাওয়ার কথা। চম্পকদা তোমার কথা বলেছে, তোমার পার্মিসন ছাড়া এ্যাডটা যাবে না।
ওরা আমার গলার স্বরে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার পার্মিসন ছাড়া এ্যাড যাবে না!
সেই রকমই বলা হয়েছে অফিস থেকে।
আমি এরকম কথা কখনো বলিনি অনিদা। টিনা বললো।
চম্পকদার সঙ্গে ওর দেখাই হয়নি কাল থেকে। মিত্রা বললো।
মিত্রার দিকে ঘুরে তাকালাম।
তাহলে বুঝতে পারছিস।
পারছি।
তুই ওদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সাইন করে দিয়েছিস।
হ্যাঁ।
টিনার দিকে ঘুরলাম।
কাল তুমি চম্পকদাকে ফোন করবে। বলেদেবে আস্থা থেকে যে এ্যাডটা গেছে, ওটা রবিবার ছাপা হবে। যখন কথা বলবে তখন গলার ভলুমটা যেন হুইপের ঢঙে থাকে। মাথায় রাখবে তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চম্পকদার মতো যারা আমাদের অফিসে আছেন, তাদের বস হিসাবে দেওয়া।
টিনা মাথা নীচু করলো।
তোমরা তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কি লেখা আছে পরেছো।
না।
কেন! না পরেই এক কপি সই করে দিয়েছ।
তুমি আছো।
চিরটা কাল নয়।
টিনা মিলি আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকাল।
তুমি অদিতি মিলি এখন থেকে এ্যাডের পার্টটা একটু একটু করে দেখতে শুরু করো। দেখবে, তোমাদের সাবতাচ করার মতো লোক ওখানে অনেক পাবে। সব বাস্তু ঘুঘু। সবার সঙ্গে কথা বলে লোক চেন। একটু কিছু গন্ধ পেলে আমাকে জানাবে। আজ আমি আগামী ছয় মাসের একটা এ্যাডকেম্পেন নিয়ে এসেছি, ফাইলটা ওপরে আছে, পারলে দেখ নাও।
দেখেছি।
তোমরা কখন এলে, কখন আমার ঘরে ঢুকলে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিছু বললেই, বলো দেখেছি।
তুই কি তখন তোর মধ্যে ছিলি। বড়মা বললো।
তাহলে কোথায় ছিলাম, আকাশে ডানা মেলে উড়ছিলাম।
তাই হবে। সকলে তোর ঘরে গেল এটা ওটা দেখল, তুই কিছুই জানলি না।
হবে হয়তো।
টিনার দিকে তাকালম।
আগামী এক সপ্তাহ তোমাদের আমি সময় দিতে পারব না। অসুবিধা হলে ফোন করবে।
আচ্ছা।
বড়মা জায়গা হয়েছে।
হ্যাঁ।
এগুলো দেখবি না। মিত্রা বললো।
আগে খেয়ে নিই, তারপর।
বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলে না বসে সোফাতে দাদা আর মল্লিকদার মাঝখানে বসলাম। অপরজিটের সোফায় ডাক্তারদাদা বসে।
কিরে, অশান্ত মন শান্ত হলো।
ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম। মাথা নীচু করলাম।
হাসলাম।
তোকে কিন্তু আজকে দারুণ দেখাচ্ছিল। ভাবলাম একবার গাড়ি থেকে নেমে যাই।
কোথায় দেখলে ?
এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির তলায়।
নামতে পারতে।
তুই তখন আমাকে পাত্তাই দিতিস না।
কেন।
তাহলে ওই ভিক্ষারী বেশী ভদ্রলোক উঠে চলে যেত।
হাসলাম।
আমি এদের তখনই বলেছি। ও ভিক্ষারী নয়, ও নিশ্চই অনির পরিচিত।
কি করে বুঝলে ?
তোর কথা বলার ধরণ দেখে। লোকে জানছে তুই একটা আধ পাগলা, কিন্তু আসলে তা নয়।
সত্যি বুবুন ও ভিক্ষারী নয়! মিত্রা আব্দারের ঢঙে বললো।
কেন।
ডাক্তারদাদার সঙ্গে আমারা চ্যালেঞ্জ করেছি।
তাহলে হেরে গেছিস।
ও ভিক্ষারী নয়!
না। ও একজন আইবির সিনিয়ার অফিসার। নাম সুমন চৌধুরি।
ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছিল!
প্রয়োজনে আরও অনেক কিছু ওরা করে।
কি বলছিস তুই!
ঠিক বলছি। ভেক না ধরলে ভিক্ষা পাওয়া যায় না।
সবাই চুপ। মুখ দিয়ে কারুর কোন কথা বেরচ্ছে না।
ওদের ইনফর্মেসনের ওপর তোরা বেঁচে আছিস। না হলে অনেকদিন আগে মরে হেজে যেতিস।
বড়মার দিকে তাকালাম। খেতে দাও।
ছোট জায়গাটা করে ফেল, ও অনেক্ষণ থেকে খেতে চাইছে।
ঘরে পা দিয়েই দেখলাম বিছানায় নতুন চাদর পাতা। বালিশের ওয়ারগুলোও নতুন লাগান হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো দেখে। চাদরের কালারটা এতো সুন্দর, মন ভরে গেল। কিছুতেই বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না। টান টান করে পাতা চাদরটার দিকে এক দৃষ্টে তাকালাম। বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
কাকা স্কুলফাইন্যাল পাশ করার পর একটা বেড কভার কিনে দিয়েছিল। মনে পরে না কয়দিন ওই বেড কভারে শুয়েছি।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে মানিপার্টসটা থেকে আলমাড়ির চাবিটা নিলাম। জামাকাপড়ের পেছন থেকে পুরনো এ্যালবামটা বার করলাম। কাকা কলকাতায় আসার সময় এ্যালবামটা দিয়েছিল। এতে আমার বাবা মা আমার কিছু ছবি আছে।
এই এ্যালবামে এবাড়ির কারুর হাত এখনো পরে নি। সেদিন ফ্ল্যাট থেকে এটা নিয়ে এসেছিলাম।
পাতা উল্টে প্রথম ছবিটার দিকে তাকালাম। বাবা মা একসঙ্গে, মায়ের কোলে আমি। এই একটা ছবি আমি বহুবার দেখেছি। তখন আমার বয়স আঠারো মাস। বাবা কলকাতায় এসেছিলেন স্কুলের কাজে। আমাকে মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। স্টুডিওতে তুলেছিলেন। মার খুব গঙ্গায় স্নান করার শখ হয়েছিল। পেছন দিকে স্টুডিওর স্ট্যাম্পটা এখনো রয়েছে। আলো স্টুডিও। এই এ্যাড্রেস ধরে ওখানে গেছি। স্টুডিও খুঁজে পাইনি তার জায়গায় একটা খাবার দোকান পেয়েছি। লোককে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে, যিনি ছবি তুলতেন সেই ভদ্রলোক মারা যেতে তার ছেলেরা দোকান বিক্রি করে দিয়েছে।
চোখ বন্ধ করে বহুবার আমার এই আঠেরো মাস বয়সে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। বহুবার মায়ের কোলে বসে থাকার অনুভূতি পাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। ছবিটা দেখলেই বুকটা ভীষণ টন টন করে, তাই দেখি না।
আজ হঠাৎ কেন দেখার ইচ্ছে হলো ?
প্রশ্ন করে কনো উত্তর পেলাম না। একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখলাম, একবার ছবির দিকে তাকিয়ে আমার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মায়ের মুখের আদল আমার মুখশ্রীর সঙ্গে কিছুটা মেলে।
জানো মা তোমার ছেলের আজ অনেক পয়সা। অনেক ক্ষমতা তার। লোকে ফিস ফাস করে। বলে রবিনহুড। একচ্যুয়েলি ওরা আমার মতো এতো ভ্যারাইটি লাইফ লিড করে নি। নিজের বলতে তার কিছু নেই। শুধু বিদ্যেটুকু ছাড়া। এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয় আজও পর্যন্ত কাউকে পাই নি। তোমরা তার ক্লুও কোনদিন রেখে যাও নি, যে খুঁজে বার করবো। তবে এখনো আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের একটা শেকড় আছে। শুধু আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কলমকরা গাছ। ওই গাছ থেকে কেটে ঘষে মেজে এই গাছে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বড়মা ছোটমা আমার জন্য যথেষ্ট করে। আমি তাদের ঋণ আমৃত্যু শোধ করতে পারব না। এখন মাঝে মাঝে ভীষণ ভাবে তোমার কথা অনুভব করি। মিত্রা আমার মধ্যে অনেক কিছু দেখতে চায় বুঝলে মা। কিন্তু ওকে আমি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনা, না পেতে পেতে আমার মনের সব আনন্দ গুলো শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। সেখানে এক সমুদ্র জলটাও নস্যি।

আমি জানি মা ওরও অনেক স্বপ্ন আছে। আমি যেমন ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি ও নিশ্চই আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। আজকে ও অনেক কথা আমাকে বলেছে। যার একটা কথারও আমি উত্তর দিইনি। কেন যানো ? ও অবুঝপনা করবে। বড়মা ছোটমা ওর দলে। ওরা আমার জীবনের ছটা বছর দেখেছে। কিন্তু বাকি বাইশটা বছর কি ভাবে কি পরিবেশে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি, সেটা ওরা দেখে নি। ওরা আমার মুখ থেকে শুনেছে কিন্তু সেটাই সব নয়। সেই বাইশটা বছরের একটা প্রভাব আমার ওপর থাকবেই। কি করে বোঝাই ওদের বলো। বড়ো যন্ত্রণা।
 
জান মা, মিত্রা আজ ওর মনের মতো করে জামাকাপড় কিনে এনেছে। কালকে আমাকে সাজাবে। পীরবাবার থানের মাটি ওর কপালে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার গলার চেনটা ওকে দিয়েছি। তোমার সিঁদুর কৌটটা ওকে দিয়েছি। তাতেও মনে হয় ও পরিতৃপ্ত হতে পারে নি।
আজ একগাদা জামা কাপড় কিনে এনেছে। তিনদিন ধরে আমাকে সাজাবে। আমি ওকে বাধা দেব না। ওরও কিছু কিছু শখ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা কি জানো মা ও স্থূলো সুখে সুখী।
মা, জান আমি ওকে ভীষণ ভীষণ ভালবাসি।
তোমাকে দেখিনি, চোখ বুঁজে তোমার অনুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করি। আর মিত্রা আমার শয়নে স্বপনে আমার শরীরের প্রতিটা তন্তুতে মিশে আছে। ও কষ্ট পেলে আমি ভীষণ কষ্ট পাই। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি কোন জন্মে। খুব কষ্ট পেলে দু’এক ফোঁটা জল এমনি বেরিয়ে আসে। মিত্রা এখনো কাঁদতে ভালবাসে। ওর সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য তবু কোথায় যেন ওর সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। দুজনেই মাতৃ পিতৃ হারা সন্তান।
কেউ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তার নরম হাতের বন্ধনে আমি ধ্যানভ্রষ্ট হলাম। এ্যালবামটা বন্ধ করে হাতের অর্গল খুললাম, বুঝলাম মিত্রা। টেবিলে এ্যালবামটা রেখে মুখো মুখি দাঁড়ালাম। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
তুই কাঁদছিস!
হাসলাম। না।
তোর চোখে জল!
এমনি। নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করছি।
আজা সারাদিন তোর চোখে দু’বার জল দেখলাম। আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা!
না।
তাহলে ?
তোর সব প্রশ্নের উত্তর এইভাবে দিতে পারব না। কিছু প্রশ্নের উত্তর কাজের মাধ্যেম দেব। কিছু অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হবে।
মিত্রা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। চোখের মনি স্থির, কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
এই এ্যালবামটা কোনদিন আমাকে দেখাস নি ?
ফ্ল্যাটে ছিল, কয়েকদিন আগে নিয়ে এসেছি।
মা বাবার সঙ্গে তুই।
হ্যাঁ।
তখন তুই ভীষণ কিউট দেখতেছিলি।
তুই দেখেছিস।
অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি। তুই তোর মধ্যে ছিলি না।
মাঝে মাঝে আমার এমন হয়।
মাঝে মাঝে না প্রায়ই হচ্ছে।
আমি চুপ করে থাকলাম।
তখন তুই দেবাদের তোর কষ্টের কথা বলেছিস, দাদাকেও বললি।
বলতে চাই নি, বলা হয়েগেল। কেন জানি না।
আমি তোকে সকালে খুব কষ্ট দিয়েছি।
হয়তো ওটা আমার প্রয়োজন ছিল। সত্যি তোর স্বপ্নের দিকটা আমি কখনো ভাবিনি।
সকালবেলা তুই সবচেয়ে বেশি অপমানিত বোধ করেছিস, ফাইলটা তোর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াতে।
না।
তুই না বললে হবে কি করে। আমি তখন তোর চোখ দেখেছি।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
তোকে কষ্ট দিলে আমিও কষ্ট পাই বুবুন। কেন তুই অমন করিস।
তুইতো ইচ্ছে করে দিতে চাস না। কখনো সখনো হয়ে যায়।
তখন যে আমার কি হলো। কেন তুই তোর আমার ভাগ করিস। আমি তো পারি না।
চুপ করে থাকলাম।
ডাক্তারদাদাকে বলেছিলাম।
কি বললো ডাক্তারদাদা।
ডাক্তারদাদা হাসল।
আচ্ছা বুবুন তোর কি মনে হয় আমি তোকে ভালবাসিনা।
আমি ওর মুখটা চেপে ধরলাম।
ও কথা বলতে নেই।
বলনা আমার জানার দরকার আছে।
কেন তোর মনের মধ্যে এই প্রশ্নটা এলো।
আজ সারাদিন অনেকে অনেক ভাবে তোকে নিয়ে আলোচনা করলো। তাতে আমার হঠাৎ মনে হলো আমার দিক থেকে মনে হয় কিছু খামতি থেকে যাচ্ছে।
ভুল কথা। তুইই একমাত্র আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
আমি মিত্রাকে বুকের কাছে টেনে নিলাম।
আমি তোর কাছ থেকে ডিমান্ড করি। তুই কখনো আমার কাছে কোন ডিমান্ড করিসনা।
কে বললো করিনা, সকাল বেলা তোর কাছ থেকে টাকা চাইলাম।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল। চোখের পলক পরছে না।
তুই কি শুধু আমার থেকে টাকা চাস।
তোর কি তাই মনে হয়।
আমি তোকে জিজ্ঞাসা করছি।
ওটা ওই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল। আমার থাকলে তোকে চাইতাম না।
কে বললো তোর নেই।
মাথা নীচু করলাম।
এই দেখ এখনো তোর মধ্যে আমাকে গ্রহণ করা নিয়ে সংকোচ বোধ রয়েছে।
তুই বিশ্বাস কর।
তুই আমাকে গ্রহণ করতে পারছিস, আর আমার টাকা নিতে পারবি না।
আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলাম।
বিশ্বাস কর মিত্রা ওটা পুরুষের অহম বোধের জায়গা। তোকে কি করে বোঝাই।
সেই জন্য বিগত ছয়মাস তুই সেলারি নিয়েছিস। তোর ডিরেক্টর শিপের রেমুনারেসন রিফিউজ করেছিস।
তোকে কে বললো।
হিমাংশু। কেন তুই নিস নি ?
তুই আমাকে ক্ষমা কর।
কিসের ক্ষমা। আমি যদি তোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। তুই যদি মনে নিতে পারিস, আর আমি যদি আমার ব্যবসার অংশীদার তোকে করতে চাই তাহলে তুই মনে নিবিনা কেন। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তুই এটা করতে পারতিস।
আমি মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
তুই একা একা গুমড়ে মরবি, আমি ফুর্তি করবো তা হয়না। আজ না হোক কাল সকলে আমাকে কাঠ গোড়ায় দাঁড় করাবে। আমি তখন স্বার্থপর, তুই তখন মহান।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মিত্রার কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়েছি।
তোকে বলতে হবে বুবুন। আমার দিকে তাকা।
আমি মিত্রার কাঁধ থেকে মুখ তুললাম।
বল, কি জানতে চাস।
কেন তুই রিফিউজ করছিস।
তুই তখন বললি না, আমি মহান হতে চাইছি তুই স্বার্থপর। বলতো আমাকে, তোর কাগজের মালিকনা স্বত্ব গ্রহণ করার এক কনাকড়ি গুণ আমার আছে।
কে বললো নেই। অনেকের থেকে বরং বেশি আছে।
তুই আমাকে অন্ধের মতো ভালবাসিস তাই বলছিস। লোকে তা বলে না। বলে কি আমি তোর ভালবাসার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি।
কে কি বললো তাতে কি এসে যায়।
আসে মিত্রা আসে। তুই মানুষের খোলা মুখ চলা পথ সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেও আটকাতে পারবি না। আমরা তথাকথিত সামাজিক জীব। আধুনিকতা আমাদের শরীরে, মনে নয়। এতদিন আমরা একসঙ্গে থেকেছি লোকে বলেছে লিভ টু গেদার। বিদেশে এ ব্যাপারটার কোন গুরুত্ব নেই, ওখানে লিভ টু গেদার করতে করতে সন্তান এসে গেলে কারও যায় আসে না।
সেই সন্তান বহাল তবিয়েতে বড়ো হয়। এখানে কোন সন্তানের জন্ম হলে প্রথমে তার পিতৃ পরিচয়ের দরকার হয়। তবে বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। কেন, তোর নিকট আত্মীয় বলেনি তোকে ফুসলিয়ে নিয়ে চলে গেছি। তুই তো নিজের কানে শুনেছিস সেই কথা। আমাদের সমাজটা বড় জটিল, বুঝেছিস।
আমি মিত্রার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
কালকে যে কাজটা তোর সঙ্গে করতে যাচ্ছি, সেটা সামাজিক দায়বদ্ধতা মেটাতে, পাশাপাশি তোর সঙ্গে আমার যে একটা রিলেসন তৈরি হয়েছে সেটা দশজনকে বোঝাতে। বলতে পারিস একটা সরকারী শিলমোহর।
মিত্রা আমার মুখে হাত বলাচ্ছে।
তুই যতটুকু কর্পোরেট লাইভ লিড করেছিস আমি তার এক তিলার্ধও এখনো পর্যন্ত করিনি। কেন জানিষ ? পকেটের রেস্তো কোনদিন ছিল না। আমাকে তুই তোর কাগজের মালিক বানিয়ে দিয়েছিস। কর্পোরেট লাইফের কেতা শিখতে আমার এখনো এক বছর লাগবে। তাই আমাকে দেখবি আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই।
মিত্রার একটা হাত আমার পাঞ্জাবীর ভেতর দিয়ে আমার বুকে।
টিনারা যেটুকু কর্পোরেট লাইফ লিড করেছে আমি সেটুকুও করিনি। একদিন তাজে বসেই আমি ব্যাপারাটা ধরে ফেলেছিলাম। ওটা একটা আলাদা জগৎ। আমি কোনদিন এ্যাবজর্ভ করতে পারব না। যদিও বা পাড়ি মাঝে মাঝে পা হড়কে পরে যাব। এখন যেটুকু করছি মনে রাখবি আমার পরিচিত লেভেলে। তাদের প্রতি আমার জোড় আছে। এটা বেশিদিন চলতে পারে না। দেখবি আমি খুব ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি।
আমি মিত্রার কপালে চুমু খেলাম।
আমাদের মানসিক মিলন হয়ে গেছে সেদিন, যেদিন পীরসাহেবের থানে তোর গলায় মায়ের গলার চেনটা পরিয়ে দিয়েছিলাম। ভূমি থেকে মাটি তুলে তোর সিঁথিতে লেপে দিয়েছিলাম। আগামীকালের থেকে সেই দিনের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। তোর কোন কিছুকে আমি অস্বীকার করিনি, করবও না কোনদিন। কিন্তু কি জানিষ, তুই আমার জীবনের আট বছর দেখেছিস বাকি কুড়ি বছর দেখিস নি। আমিও তোর জীবনের আট বছর দেখেছি বাকি কুড়ি বছর এর তার কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, অনুভব করেছি তোর কষ্টটা, তাই আমি হিংস্র হয়ে উঠেছি। যে মেয়েটা ফুলের মতো বাঁচতে পারত, লোভের আগুনে সেই ফুলের পাঁপড়ি গুলো ছেঁড়ার অধিকার কে দিয়েছে ওদের।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। আমাকে নিয়েও তোর অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না। তুই একভাবে মানুষ হয়েছিস। আমি আর এক ভাবে মানুষ হয়েছি। আমার জীবনবোধ আর তোর জীবনবোধের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তোকে এগুলো অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হবে। তোকে একটা ছোট্ট কথা বলবো মন খারাপ করবি না।
বল।
আমি ভুল কি ঠিক জানিনা তবে আমার কথাটা খারাপ লেগেছিল। হয়তো সেই থেকেই বেশ কিছু কথা চাপান উতোরে বেরিয়ে এলো। হয়তো এটা ভালো, হয়তো এটা খারাপ। তুই হয়তো না ভেবেই বলেছিস। আমি কথাটা অন্য ভাবে ধরেছি। পরে নিজের সঙ্গে নিজে সারাদিন যুদ্ধ করলাম। এই মুহূর্তে তোকে বুকে জড়িয়ে ধরেও সমানে যুদ্ধ করছি বলতে পারিস।
কি কথা বল।
তোকে তখন টাকাটা চাইতে তুই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলি।
আমাকে বলেছিলি, কেন!
অনিমেষদার নামটা শুনে তুই আরও ঘাবড়ে গেছিলি। তুই বিশ্বাস করতে পারিস নি অনিমেষদা আমার কাছে টাকা চাইতে পারে।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন। আমি সেই ভেবে বলিনি।
আমি কথাটা বলার আগে তোর অনুমতি চেয়ে নিয়েছি। আমি কিন্তু বলেছি তুই হয়তো সেই ভেবে বলিস নি, আমি ভেবে নিয়েছি।
কেন তুই ভাবলি।
এটা একটা দামী কথা।
বলতে পারিস এই সমস্যাটা আমার আছে। ছোট থেকে স্নেহ ভালবাসা কি জিনিষ জানি না। অনেক দিন গেছে, আমার কোন কাজে কাকা কাকীমা রাগ করে আমাকে খেতে দেয়নি। আমি চিকনার বাড়িতে গিয়ে দুটো পান্তা খেয়ে স্কুলে গেছি।
হয়তো সেই দিনটা বাড়ি ফিরি নি। চিকনার বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছি। কখনো কখনো বাসুদের বাড়িতে থেকেছি। কাকা কাকীমা কেউ আমার খোঁজ নেয় নি। আমি কেমন আছি কি খাচ্ছি। তারপর হয়তো পাড়া প্রতিবেশীর চাপে কাকা মেনে নিয়েছে।

তুই আমার প্রথম ভালবাসা। আমি তোকে অন্ধের মতো ভালবাসি। তোর কিছু হলে আমি হয়তো চোট খাওয়া সিংহের মতো হয়ে যাব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top