What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected চক্ষে আমার তৃষ্ণা -উপন্যাস (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
324
Messages
5,988
Credits
44,826
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
চক্ষে আমার তৃষ্ণা
[FA]pen[/FA] লেখক: হুমায়ূন আহমেদ


০১.

তরু তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার পানির পিপাসা পাচ্ছে। বুক ধকধক করছে। শব্দটা এত জোরে হচ্ছে যে, তরুর মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো, বেতের চেয়ারে বসা বাবাও শব্দটা শুনতে পাচ্ছেন। এক্ষুনি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবেন, হাতুড়ি পেটার শব্দ কে করে? What sound? ভুল-ভাল ইংরেজি বলা তার স্বভাব।

তরুর বিচারসভা বসেছে। সে ভয়ংকর একটা অন্যায় করে ধরা পড়েছে। শাস্তি হবে এটা জানা কথা। শাস্তির জন্যে তার কোনো ভয় লাগছে না। শাস্তি আর কি হবে? ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েকে কোনো বাবা মারধর করে না। একটা চড় হয়তো গালে দেবেন। শাস্তির চেয়ে চড় খাবার লজ্জাটাই হবে প্রধান।

তরুর ভয় করছে অন্য কারণে। বাবা বলে বসতে পারেন, তুমি উচ্ছন্নে যাচ্ছ। তোমাকে আমি পুষব না। কোনো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। নষ্টামি যা করার জামাইয়ের বাড়িতে গিয়ে করো। বদ মেয়ে! Super naughty girl.

তরু মোটেই বদ মেয়ে না। তার ধারণী সে খুবই ভালো মেয়ে। ভয়ংকর অন্যায় সে যা করেছে অন্য কোনো বাবার কাছে এটা হয়তো অন্যায় বলেই মনে হবে না। তার বাবার কাছে সবই অন্যায়। টিভি দেখা অন্যায়। শব্দ করে গান শোনা অন্যায়। রাত এগারোটার পর জেগে থাকা অন্যায়। পরীক্ষায় খারাপ করা অন্যায়। গল্পের বই পড়া অন্যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা অন্যায়।

শামসুন নাহার!

তরু ক্ষীণ গলায় বলল, জি বাবা।

শামসুন নাহার, তরুর ভালো নাম। তরুর বাবা আব্দুল খালেক মেয়েকে নিয়ে বিচারসভা বসালে ভালো নামে ডাকেন।

তোমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে যে বস্তু পাওয়া গেছে তার নাম কী? Toll me name.

সিগারেটের প্যাকেট।

এই সিগারেটের প্যাকেট তুমি কিনেছ?

না বাবা, এটা একটা বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট। দেশে কিনতে পাওয়া যায় না। একেকটা সিগারেট একেক রঙের। প্যাকেট খুলে দেখাব?

প্যাকেট খুলে দেখানোর প্রয়োজন দেখছি না। এই সিগারেট তোমাকে কে দিয়েছে? Who gave?

তরু জবাব দিল না। সত্যি কথাটা বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। সিগারেটের প্যাকেটটা তাকে জন্মদিন উপলক্ষে দিয়েছে আয়েলিতা। অয়েলিতা তার অতি অতি প্রিয় বান্ধবী। আয়েলিতার বাবা থাকেন ইতালির মিলান শহরে। যতবারই দেশে আসেন ম্রায়েলিতার জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস নিয়ে আসেন। তার কিছু কিছু আয়েলিতা তরুকে দেয়। এবার দিয়েছে সিগারেটের প্যাকেট এবং একটা লাইটার। লাইটারটা দেখতে ফুটবলের মতো। চাপ দিলেই হুস করে আগুন বের হয়।

খালেক সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, সিগারেটের প্যাকেট তোমাকে কে দিয়েছে বলছ না কেন? যে দিয়েছে তার নাম বলো। টেলিফোন নাম্বার বলো। আমি তার সঙ্গে এবং তার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলব। নাম বলো। খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে থাকবে না। তুমি খাম্বা না। You are not pillar.

তরু বলল, ওসমান চাচা দিয়েছেন।

বলতে বলতেই সে মেঝে থেকে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। সে জানে ওসমান চাচার প্রতি বাবার বিশেষ দুর্বলতা আছে। বাবার ধারণা এই মানুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ। শুধু তাই না, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। এই মানুষটার উপর রাগ করা তার বাবার পক্ষে অসম্ভব। উনি কোনো অন্যায় কাজ করলেও বাবার কাছে মনে হবে এই অন্যায়ের মধ্যেও কিছু-নাকিছু ন্যায় অবশ্যই আছে।

ওসমান সাহেব দিয়েছেন?

হুঁ। তাকে তাঁর এক ছাত্র পাঠিয়েছে। উনি তো সিগারেট খান না টেবিলে রেখে দিয়েছেন। রঙ-চঙা প্যাকেট দেখে আমি ভাবলাম চকলেট। আমি বললাম, চাচা এটা কি চকলেট চাচা বললেন, না গো মা। সিগারেট। পার্টি সিগারেট। বিদেশের মেয়েরা পার্টিতে ফুকে। তামাক ছাড়া সিগারেট। তুমি নিয়ে যাও।
 
খালেক সাহেব কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলালেন। কপালে ভান হাতের তর্জনি দিয়ে কিছুক্ষণ ঘষলেন। খুকখুক করে কাশলেন। তরু তার বাবার প্রতিটি লক্ষণ চেনে, বাবা কথা খুঁজে না পেলে এরকম করেন।

মনে হচ্ছে খালেক সাহেব কথা খুঁজে পেয়েছেন। মাথা ঝাঁকিয়ে খানিকটা ঝুঁকে এসে ডাকলেন, তরু!

তরু স্বস্তি পেল। ভালো নাম থেকে ডাকনামে চলে এসেছেন। কাজেই তিনি এখন স্বাভাবিক। সিগারেট সমস্যা মনে হয় মিটে গেল। তরু মিষ্টি গলায় বলল, জি বাবা।

তুমি ওসমান সাহেবের স্বভাব জানো না? তুমি কি জানো না তার ঘরের যে কোনো জিনিস নিয়ে তুমি যদি আগ্রহ দেখাও তাহলে সেটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন। জানো কি জানো না? You know or not know?

জানি।

এই স্বভাব জানার পরেও তোমার মতো একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে কী করে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আহ্লাদী করলে?

আহ্লাদী করি নাই বাবা। আমি শুধু বলেছি, চাচা এটা কি চকলেট?

এটা বলাই আহ্লাদী। তুমি কি জীবনে চকলেই দেখো নাই?

বাবা আমি কি উনাকে প্যাকেট ফেরত দিয়ে আসব?

একটা বোকামি করেছ এটাই যথেষ্ট। দুটো বোকামি করবে না। সিগারেট ফেরত দেয়া মানে উনাকে অপমান করা! Do you understand?

তরু বলল, Yes sir.

এমন ভঙ্গিতে বলল যে, খালেক সাহেবের কাঠিন্য পুরাপুরি চলে গেল। হেসে ফেলতে যাচ্ছিলেন, অনেক কষ্টে হাসি থামালেন।

তরু বলল, বাবা তুমি কি আমাকে আরো বকবে?

খালেক সাহেব বললেন, কলাম কখন? সামান্য ওয়ার্নিং। আমাকে এক কাপ চা খাওয়া। চিনি দিবি না। লিকার হালকা।

তরু বলল, Tea is coming sir.

এইবার খালেক সাহেব সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন। তবে তিনি খুশি যে, তার মেয়ে এই হাসি দেখে নি। আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের সামনে গাম্ভীর্য রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আজকালকার বাবাদের কাণ্ড দেখলে তার শরীর চিড়বিড় করে। ছেলেমেয়েরা বাবার গায়ে হাত রেখে কথা বলে। যেন বাবা তাদের ইয়ার-বন্ধু। অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার কুফল ছাড়া আর কিছু না। টেলিভিশন পুরোপুরি বন্ধ করে রেডিওর জগতে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। রেডিওর যুগে সত্যতা জ্ঞান ছিল। মান্যগন্য ছিল।

এই নাও বাবা চা।

খালেক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এত তাড়াতাড়ি চা কীভাবে বানালি?

তরু বলল, কেটলিতে ফুটন্ত পানি ছিল, আমি একটা টি-ব্যাগ ফেলে নিয়ে এসেছি। তুমি তো চায়ে চিনি-দুধ কিছুই খাও না।



খালেক সাহেব চায়ের চাপ হাতে নিলেন। মেয়েটার উপর থেকে সব রাগ চলে গেছে। এখন উল্টো নিজের কঠিন কথাবার্তার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। বেচারির তো দোষ নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাবার ট্রেনিং এই মেয়েকে দেয়া হয় নি।

বাবা এই নাও সিগারেট। প্লীজ একটা খাও।

তরু তার রঙিন সিগারেটের প্যাকেট খুলে বাবার দিকে ধরে আছে। খালেক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সিগারেট খাব?

মেয়েদের সিগারেট। একটা খেয়ে আমাকে বলে খেতে কেমন। প্লিজ বাবা।

খালেক সাহেব সিগারেট নিলেন। তরু লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিল। চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা খেতে কেমন?

খারাপ না। তুই বলেছিলি তামাক নেই। তামাক আছে।

আমি বলি নি বাবা। ওসমান চাচা বলেছেন। আমি উনাকে ধরব।

উনাকে ধরার কিছুই নেই। উনি তো আর খেয়ে দেখেন নি। অনুমানে বলেছেন। তামাক আছে তবে পরিমাণে সামান্য। না থাকার মতই। very small quantity.

খেতে ভালো লাগছে বাবা?

খালেক সাহেব দুরাজ গলায় বললেন, তোর খুব ইচ্ছা করলে একটা খেয়ে দেখ।

সত্যি খেয়ে দেখব? পরে আমাকে প্রবে না তো বাবা?

আমার সামনে ধরাবি না।

ওসমান চাচার সামনে ধরাই। উনার জিনিস উনার সামনে খেলে উনি খুশিই হবেন।

খালেক সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলে।
 
ওসমান সাহেব তরুদের বাড়ির ছাদে তিনটা ঘর নিয়ে থাকেন। তিনি তরুকে ডাকেন মিস্ট্রি। এই নামকরণ তরুর স্বভাব লক্ষ করে না। তরু অর্থ গাছ, ইংরেজিতে ট্রি। মিস তরু থেকে মিস ট্রি। সেটা সংক্ষেপ করে মিস্ত্রি। তরু এই নামের বদলা নেবার চেষ্টা করেছে, ওসমান সাহেবকে ছাচা ডেকেছে। ছাদের চাচা থেকে ছাচা। তরু কিছুদিন এই নামে ডেকে হাল ছেড়ে এখন চাচা ডাকছে।

ওসমান সাহেব বাস করেন হুইল চেয়ারে। তিনি জীবনযাপনের জন্য ছাদটাকে হুইল চেয়ার উপযুক্ত করে নিয়েছেন। বিছানা থেকে হুইল চেয়ারে নিজে-নিজে নামতে পারেন। ছাদে আসতে পারেন। কারোর সাহায্যে লাগে না। ছাদের তিনটি ঘরের একটায় তাঁর শোবার ঘর, একটা পড়াশোনা ঘর অন্যটা রান্নাঘর। হুইল চেয়ারে বসে তিনি চা বা কফি বানাতে পারেন। পাউরুটি টোস্ট করতে পারেন। ডিম সিদ্ধ করতে পারেন। সকালের নাশতা তিনি নিজের হাতে তৈরি করেন। একটা কলা, মাখন মাখা এক পিস রুটি এবং ডিম সিদ্ধ। সারা দিন এর বাইরে কিছুই খান না। রাতে টিফিন কেরিয়ারে করে হোটেল থেকে তার জন্যে খাবার আসে। যে ছেলেটি খাবার আনে তার নাম রফিক। বয়স বারো-তেরো। অতি কর্মঠ ছেলে। সে দেড় ঘণ্টার মতো থাকে। এর মধ্যেই ঘর পরিষ্কার করে, কাপড় ধুয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণ পড়াশোনাও করে।

রফিকের জন্যে বাংলা বর্ণমালার বই এবং ইংরেজি ABCD-র বই কেনা আছে। পড়াশোনা সে যথেষ্ট আগ্রহ করেই চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা যুক্তাক্ষর নিয়ে তার সামান্য সমস্যা হচ্ছে। যুক্তাক্ষর ছাড়া বাংলা সে ভালোই পড়তে পারে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি শেখার দিকে তার ঝোঁক বেশি। প্রতিদিন দুটি করে ইংরেজি শব্দে তার শেখার কথা। রফিক তা শিখছে এবং মনে রাখছে। Night, star, sound-এর মতো শব্দগুলি এবং তার অর্থ সে জানে।

ওসমানের বয়স পঞ্চশি। কিন্তু তাকে সে রকম বয়স্ক মনে হয় না। মাথা ভর্তি চুল। চুলে পাক ধরে নি। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে ব্যস্ত রাখার নানা কৌশল তিনি বের করে রেখেছেন। আকাশের তারা দেখা, বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শুনা। ইদানীং ছবি আঁকা শেখার জন্যে বইপত্র কেনা শুরু করেছেন। চারুকলার মনিকা নামের ফোর্থ ইয়ারের এক ছাত্রী প্রতি পনেরো দিনে একবার এসে তাঁকে ছবি আঁকা শেখায়। ওসমান সাহেব তাকে মাসে এক হাজার টাকা দেন।

ভদ্রলোক বিবাহিত স্ত্রী সুলতানা আলাদা বাস করেন। তিনি হঠাৎ হঠাৎ স্বামীকে দেখতে আসেন। তাদের একটা ছেলে আছে। ছেলের নাম আবীর। বয়স আট। আবীর তার মার সঙ্গে আসে। তার প্রধান আনন্দ পেছন থেকে বাবার হুইল চেয়ার ঠেলা। চলে যাবার সময় সে খুব কান্নাকাটি করে। কিছুতেই যাবে না। ওসমান সাহেব ক্ষীণ গলায় বলেন, থাকুক না একদিন। তখন সুলতানা এমন ভঙ্গিতে তাকান যেন এমন অদ্ভুত কথা তিনি তার জীবনে শুনেন নি। প্রতিবারই আবীরকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যেতে হয়।
 
সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার হাতে তরু ছাদে এসেছে। এই দুই বস্তু কালো হ্যান্ড ব্যাগে লুকানো। ওসমান ছাদে। তার সামনে পায়া লাগানো ছোট্ট টেবিল। টেবিলের উপর টেলিস্কোপের লেন্স, লেন্স ক্লিনার লোশন এর তুলা। ওসমান লেন্স পরিষ্কার করছেন। তরু বলল, চাচা আমি এখন এমন একটা কাজ করব যা দেখে আপনি চমকে যাবেন। অনুমান করুন তো কাজটা কী? ওসমান সাহেব তরুর দিকে না তাকিয়েই বললেন, তুমি একটা সিগারেট খাবে।

তরু কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। মানুষটা তরুর সিগারেটের বিষয় কিভাবে বলছে? ওসমান বললেন, কই সিগারেট তো ধরাচ্ছ না।

তরু বলল, সিগারেট থাকলে তবে তো ধরাব? চাচা আপনি আমাকে কী ভাবেন? গাঁজা-সিগারেট খাওয়া টাইপ মেয়ে? কেন শুধু শুধু বললেন, আমি সিগারেট খাব? আমাকে খারাপ ভেবেছেন, এই জন্য সরি বলুন।

সরি বলব না।

কেন বলবেন না?

আমি গতকাল সন্ধ্যায় ঘর থেকে দেখেছি তুমি ছাদে কালো ব্যাগটা নিয়ে এসেছ। ব্যাগ খুলে সিগারেট বের করে ধরিয়েছ। আগ্রহ করে ধুয়া ছাড়ছ। আমার ধারণা আজও তোমার ব্যাগে সিগারেট আছে। এখন বলো আছে না?

আছে। তবে বাবা আমাকে সিগারেটের প্যাকেট রাখার এবং সিগারেট খাবার পারমিশন দিয়েছেন। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আপনি বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

বিশ্বাস করছি।

তরু সিগারেট ধরিয়ে কায়দা করে ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আজ রাতে কি তারা দেখা হবে?

হুঁ।

তারা-ফারা দেখা খুবই ফালতু কাজ।

তুমি তো দেখছ না। আমি দেখছি।

আপনার কাছে ফালতু লাগে না?

না।

আচ্ছা চাচা আপনি আমাকে সুন্দর দেখে একটা নাম দিন তো।

কীসের নাম?

আমি একটা উপন্যাস লিখব। উপন্যাসের নাম।

উপন্যাস লিখবে?

Yes Sir, আপনার কি ধারণা আমি উপন্যাস লিখতে পারব না। যে টিচার আমাদের চর্যাপদ পড়ান তিনি বলেছেন, আমার বাংলা ঝরঝরে। আমার একটা এসাইনমেন্ট পড়ে বলেছেন।

তাহলে লেখা শুরু করে দাও। আগে নাম ঠিক করব তারপর লিখব। এক্ষুনি একটা নাম দিন তো।

কালপুরুষ নমি দাও। শীতকালের তারামণ্ডল। আকাশের মাঝখানে থাকে।

তরু মাথা ঝাকিয়ে বলল, আকাশের মাঝখানে থাকুক কিংবা সাইডে থাকুক, রা-ফারার নামে আমি উপন্যাসের নাম দেব না। তা ছাড়া আমার উপন্যাসটা হবে প্রেমের উপন্যাস। একটা মিষ্টি নাম দিন।

এসো করো স্নান নাম দেবে?

না। এসো গায়ে সাবান মাখো, করো স্নান ফালতু।

রবীন্দ্রনাথের লাইন। চট করে ফালতু বলা ঠিক না।

ফালতু বললে রবীন্দ্রনাথ রাগ করবেন?

রবীন্দ্র-ভক্তরা করবে। তা ছাড়া তুমি বাংলার ছাত্রী।

তরু বলল, আমি বাংলার ছাত্রী হই বা ফিজিক্সের ছাত্রী হই যেটা ফালতু আমি সেটাকে অবশ্যই ফালতু বলব।

ওসমান বললেন, আচ্ছা বলো।
 
আমি যে সত্যি উপন্যাস লিখব আপনি মনে হয় এটা বিশ্বাস করছেন না, উপন্যাস কীভাবে লিখতে হয় সব নিয়ম-কানুন আমি শিখেছি। একজন লেখকের কাছে শিখেছি। উনি বলেছেন, প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষে লিখতে হবে। নিজের জীবনের কাহিনী দিয়ে শুরু। নিজের চেনা জগতে বিচরণ।

উপন্যাস লেখার মতো কাহিনী কি তোমার জীবনে আছে?

কিছু বানাব। আপনার কি ধারণা আমি লিখতে পারব? একজন ঔপন্যাসিকের যেসব গুণ থাকার কথা আমার কিন্তু তার সবই আছে। যেমন আমি খুব গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারি। গল্প বানাতে পারি। পারি না?

আমার ধারণা পারো।

উপন্যাসের প্রথম লাইনটা আমি লিখে ফেলেছি। শুনতে চান?

পুরো একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলো, তারপর পড়ে দেখব।

প্রথম লাইনটা শুনে দেখুন না। প্রথম লাইনটা হচ্ছে—হ্যালো। আমি আঠারো বছর বয়সের অতি রূপবতী এক তরুণী।

ওসমান বললেন, হ্যালো দিয়ে শুরু করেছ কেন? তুমি তো কাউকে টেলিফোন করছ না।

তরু বলল, ঠিক আছে, হ্যালো বাদ দিলাম। আমি আঠারো বছরের অতি রূপবতী এক তরুণী। এটা কি ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

আমি যা সত্যি তা-ই লিখছি। আসলেই তো আমি অতি রূপবতী একজন। না-কি আপনার ধারণা আমি রূপবতী না? রূপে এক থেকে দশের স্কেলে আপনি আমাকে কত দেবেন?

ছয়।

মাত্র ছয়? কী বলেন এইসব!

মেয়েদের রূপ সময়নির্ভর। একেক সময় তাকে একেক রকম লাগে। এখন তোমাকে ছয় দিলাম অন্য একদিন হয়তো দশে দশ দেব।

আবার তিন-চারও তো দিয়ে ফেলতে পারেন।

এত কম দেব না।

তরু আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। দ্বিতীয় সিগারেট ঠোঁটে দেবার আগে সে বলল, আগের সিগারেটটা আমি আরাম করে খেতে পারি নি। সারাক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলছিলাম তো, এই জন্যে। এখন আর আপনার সঙ্গে কথা বলব না।

তরু ছাদের অন্য মাথায় চলে গেল।





ঘরে টেলিফোন বাজছে। ওসমান হুইল চেয়ার নিয়ে রওনা হলেন। ইদানীং টেলিফোনের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। নির্বাসিত জীবন ঢাকার বাইরে কোথাও হলে ভালো হতো। যেখানে টেলিফোন থাকবে না, চিঠিপত্রের ব্যবস্থা থাকবে না।

হ্যালো ওসমান ভাই বলছেন?

হ্যাঁ।

আমি রাকিব, চিনতে পারছেন?

গলার স্বরেই ওসমান চিনেছেন, তারপরও বললেন, সরি চিনতে পারছি না।

ড্রাফটম্যান রাকিব। মুন্সিগঞ্জ।

ও আচ্ছা।

ওসমান ভাই। অনেক চেষ্টা করে আপনার নাম্বার জোগাড় করেছি। আপনার জন্যে ভালো খবর আছে।

বলুন শুনি।

আপনি করে বলছেন কেন? সারা জীবন তুমি করে বলেছেন। আপনি কি এখনও চিনতে পারেন নি?

চিনতে পেরেছি, বলো। ভালো খবরটা কী?

আপনার জন্য কাজ জোগাড় করেছি। শৌখিন লোক। প্রচুর টাকাপয়সা। স্পেনে থাকে। সাভারে বাগানবাড়ির মতো করেছে। দুশ বিঘা জমির বাগানবাড়ি। সেখানে সে মেডিটেশন ঘর বলে ঘর বানিতে চায়। আপনাকে দিয়ে ডিজাইন করাবে। ভাল টাকা-পয়সা দেবে। টাকার ক্ৰকোডাইল।

আপাতত আমি কোনো ডিজাইন করছি না। মাথায় কিছু আসছে না।

এখন আসছে না। পরে আসবে। আইডিয়া আপনার ভালো লাগবে। স্পেনের আর্কিটেক্ট গডির মতো করে সে মেডিটেশন হাউস করতে চায়, সাগ্রাদা ফ্যামিলি টেম্পলের মতো করতে চায়। এতে ম্যাসিভ না তারপরও…

ওসমান বললেন, হ্যালো হ্যালো …

আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন না? আমি তো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

ওসমান নিজেও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন, তারপরও হ্যালো হ্যালো হ্যালো বলে রিসিভার রেখে দিলেন। সাগ্রাদা থাকুক সাগ্রাদার মতো। আপাতত চা খাওয়া যাক। তিনি হুইল চেয়ার নিয়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হলেন। একবার দরজায় এসে উঁকি দিলেন। তরুর সিগারেট খাওয়া শেষ হয়েছে তবে সে এখনও ছাদেই আছে। ওসমান বললো, তরু চা খাবে?

হুঁ।

দুধ চা না-কি লিকার?

দুধ চা। আমি কড়া চা খাই। দুটা টি ব্যাগ দেবেন। আগে চা খাবার অভ্যাস ছিল না। এখন করছি। লেখকদের ঘনঘন চা খেতে হয়। কড়া লিকারের চা।



ওসমান চা বানিয়ে ছাদে এসে দেখেন তরু নেই। লেখকের একটি গুণ খেয়ালি ভাব তরুর ভেতরে আছে। ওসমান চায়ে চুমুক দিলেন। ছাদে ঘুরতে-ঘুরতে চা খাবার আনন্দ থেকে তিনি বঞ্চিত। এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অন্য হাতে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরানো যথেষ্ট কঠিন। মোটর লাগানো হুইল চেয়ার একটা কিনলে হতো। লাখ টাকার উপরে দাম। ছাদে ঘুরতেঘুরতে চা খাবার আনন্দের জন্যে এতগুলি টাকা খরচ করা ঠিক কি-না বুঝতে পারছেন না।

আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। আজ রাতে তারা দেখা যাবে কি-না কে জানে। বাংলাদেশ তারা দেখার উপযুক্ত জায়গা না। আকাশে সব সময় মেঘ। বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প। টেলিস্কোপের লেন্সে দ্রুত ছাতা পড়ে যায়। ওসমান টেলিস্কোপের লেন্স রাখার জন্যে বড় ডেসিকেটর খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। এই দেশে প্রয়োজনের কিছুই পাওয়া যায় না।
 
০২.
তরু উপন্যাস লেখা শুরু করেছে। শুরুটা আয়োজন করে করা। টেবিল ল্যাম্প অফ করে সে আঠারোটা মোমবাতি জ্বালিয়েছে। তার বয়স আঠারো, এই জন্যে আঠারোটা মোমবাতী। রেডিওবন্ড কাগজ আনিয়েছে। লিখেছে ফাউনটেন পেন দিয়ে। সে লেখা শুরু করেছে রাত বারোটায়। আপাতত উপন্যাসের নাম দিয়েছে ‘নিশি উপন্যাস’।

তরুর লেখা উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতা

আমি আঠারো বছরের রূপবতী তরুণীদের একজন। আমার নাম শামসুন নাহার খানম। ডাকনাম তরু। ক্লাসে আমার বন্ধুরা আমাকে ডাকে শসা। কেন শসা ডাকে আমি জানি না। কেন ডাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেউ বলে না, শুধু হাসে। নিশ্চয়ই বাজে কোনো কারণ আছে। সবচেয়ে বেশি হাসে আয়েলিতা। হাহা হিহি হাহা। আয়েলিতার হাসি পুরুষদের মতো। আয়েলিতার নিক নেম ছাগলের দাড়ি। শুনলে মনে হয় খারাপ কিছু না, আসলে ভয়ংকর।

আমি বাবার সঙ্গে খাকি। বিয়ে হয় নি এই জন্যে বাবার সঙ্গে থাকি। আমার ধারণা বিয়ের পরও আমি বাবার সঙ্গেই থাকব। কারণ বাবা একা। বাবার প্রথম স্ত্রী আমার বড় খালা। বিয়ের দু বছরের মাথায় তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। তখন বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। আমার মা মারা যান আমার জন্মের এক বছরের মাথায়। আমার আর কোনো খলাি ছিলেন না বলে বাবা আর বিয়ে করতে পারেন নি। আমি নিশ্চিত আমার যদি আরেকজন খালা থাকতেন বাবা তাকেও বিয়ে করতেন এবং তিনিও মারা যেতেন। বাবা তার মৃত স্ত্রীদের অত্যন্ত পছন্দ করেন। আমার মা এবং খালা দুজনেরই দুটা ওয়েল পেইনটিং পাশাপাশি সাজানো। দুজনের মৃত্যু দিনে বাড়িতে কোরানখানি হয়। মিলাদ পড়ানো হয়। বাবা মুখ শুকনা করে ঐ দুই দিন ঘরেই থাকেন কোথাও যান না। শুধু তা-না তিনি সেদিন মাওলানার কাছে তওবা করেন। তওবা অনুষ্ঠানে চোখের পানি ফেলেন।

বাবার নাম আব্দুল খালেক খান। তিনি ফালতু ধরনের ব্যবসায়ী। তার তিনটা সিএনজি ট্যাক্সি আছে। ট্যাক্সির গায়ে লেখা শামসুন নাহার পরিবহন। ট্যাক্সি ছাড়াও তার দুটি ট্রাক আছে। ট্রাকের গায়ে লেখা তরু পরিবহন। সমগ্র বাংলাদেশ সাত টন। আমরা যেখানে থাকি সেই রাস্তার শেষ মাথায় বাবার একটা মুদি দোকানের মতো আছে। মুদি দোকানের নাম শামসুন নাহার খানম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে, বাবার একটা নাপিতের দোকানও আছে। তার নাম—নাহার হেয়ার ড্রেসিং। সবই আমার নামে। বাবা যদি কোনদিন রেডিমেড হাফ শার্টের দোকান দেন তাহলে তার নামও হবে তরু রেডিমেড হাফ শার্ট।

ফালতু ধরনের ব্যবসা হলেও বাবার অনেক টাকা। কারণ তিনি অত্যন্ত হিসাবি। আমাদের বাসায় বাজে খরচ করার কোনো উপায় নেই। অনেক খ্যাখ্যান করার পর তিনি আমাকে সবচেয়ে সস্তার একটা মোবাইল কিনে দিয়েছেন। মোবাইলে কাউকে টেলিফোন করা নিষেধ। কেউ টেলিফোন করলে ধরা যাবে। বাবা আমাকে ডেকে কঠিন গলায় বলেছেন, আধুনিক বিশ্বের (বাবা কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার পছন্দ করেন) অপ্রয়োজনীয় একটি আবিষ্কারের নাম মোবাইল টেলিফোন।

আমি বলেছিলাম, কেন অপ্রয়োজনীয়?

বাবা উত্তর দিয়েছেন, কারণ এই বস্তু মানুষকে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে উৎসাহী করে। কর্মবিমুখ করে। তুমি অবশ্যই তোমার মোবাইলের নাম্বার কাউকে দিবে না।

আমি বললাম, কাউকে নাম্বার না দিলে তারা টেলিফোন করবে কীভাবে? ঠিক আছে আমার মোবাইল লাগবে না। এটা তোমার কাছে থাকুক। আমার যখন দরকার হবে তোমার কাছ থেকে নিয়ে টেলিফোন করব।

এরপর বাবা বিরক্ত হয়ে আমাকে টেলিফোন দিয়ে দিয়েছেন। বাবা কথায় কখনও আমার সঙ্গে পারেন না। যখন পারেন না, তখন হামকি-ধামকি করেন।

আমার মোবাইল টেলিফোনের নাম্বার ০১৭৮১১৯২২৩০। আমার উপন্যাস যদি ছাপা হয়, কেউ যদি কিনে পড়েন, তাহলে আমাকে এই নাম্বারে টেলিফোন করে জানাবেন। রাত বারোটার পরে করবেন, তখন কলচার্জ কম। আমি অনেক রাত জাগি।

এখন বলি আমরা কোথায় থাকি। কলাবাগানে। বিশ বছর আগে বাবা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিন কাঠা জায়গা কিনেছিলেন। সেই তিন কাঠায় বাবা দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। আমরা দোতলায় থাকি। বাবার ব্যবসার লোকজন ট্রাক ড্রাইভার, ট্যাক্সি ড্রাইভার, দোকানদার, নাপিত—এরা সবাই একতলায় থাকে।
 
একতলার দুটা কামর বাবা ভাড়া দিয়েছেন। সেখানে জামান নামে এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী এবং শালাকে নিয়ে থাকেন। জামান সাহেব কিছুদিন পরপরই তার শালাকে মারধর করেন। শালাটার নাম সনজু। সে কলেজে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ার। হাবা টাইপের। দুলাভাইয়ের মার খেয়ে সে হাউ হাউ করে দেতিলার সিঁড়িতে বসে কাঁদে। ছেলেটা দেখতে সুন্দর আছে, তবে অতিরিক্ত রোগা। সে যদি আমাদের সঙ্গে পড়ত তাহলে আমি তার নাম দিতাম সুতা কৃমি।

এখন আমি আপনাদের সুতা কৃমির একটা মজার গল্প বলব। উপন্যাসের নিয়মে এই গল্প আরো পরে বসা উচিত কিন্তু পরে ভুলে যাব বলে এখনি বলছি। উপন্যাসের নিয়মে চরিত্রদের চেহারা এবং আচার-ব্যবহার কিছুটা বর্ণনা করা দরকার, যাতে পাঠক চরিত্র সম্পর্কে ধারণা করতে পারে এবং কল্পনায় সে একজনকে দাড়া করাতে পারে। আমি বাবার চেহারা বর্ণনা করতে ভুলে গেছি। সুতা কৃমি সম্পর্কে শুধু বলেছি দেখতে সুন্দর। এখন দুজনের চেহারার বর্ণনা দেব। তারপর সুতা কৃমির গল্পটা বলব।

বাবা

জনাব আব্দুল খালেদ খান

বয়স চল্লিশ মিডিয়াম হাইট। মোটাসোটা। ভুড়ি আছে। মাথায় টাক। গোঁফ আছে। মোটা গোফ। গোঁফ খানিকটা পাকা। কানে লম্বা লম্বা লোম আছে। এইগুলি তিনি কখনও কাটান না। কানের লোম না-কি লক্ষ্মী, কাটতে নেই। মুখ গোলাকার। গায়ের রঙ ফর্সা। চোখে চশমা পরেন। প্রচুর পান খান বলে দাঁতে কালো কালো দাগ আছে। তার কানে যেমন লম্বা লম্বা লোম আছে, নাকেও আছে। চুল কাটার সময় নাপিত নাকের গর্তে কেঁচি ঢুকিয়ে নাকের চুল কেটে দেয়। নাপিত এই কাজটা আমাদের বাসায় এসে করে বলে আমি দেখেছি। কুৎসিত দৃশ্য।

ভুল ইংরেজি অবলীলায় বলা বাবার স্বভাব। ট্রাক ব্যবসায় তিনি Loss খেয়েছেন এর ইংরেজি তিনি করলেন Big lost in truck business.

রাগারাজি, হৈ চৈ করা তার স্বভাব। তার ড্রাইভারদের তিনি বস্তি টাইপ গালাগালি করেন আবার কিছুক্ষণ পরেই, বাবা রে! কেন এরকম করিস বলে পিঠে হাত দেন।



সুতা কৃমি

সনজু

বয়স ১৮-১৯ কিংবা ষোল-সতেরো। রোগা। লম্বায় খুব সম্ভব পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চেহারা বালক বালক। মুখ লম্বাটে। চোখ মেয়েদের মতো। অর্থাৎ চোখের পাপড়ি বড় বড়। নাক সামান্য চাপা। ডান দিকের কপালে লাল তিল আছে। মাথার চুল কোঁকরানো, প্রায় নিগ্রো টাইপ। ঠোঁটও নিগ্রোদের মতো মোটা। তবে দেখতে খারাপ লাগে না।

এখন সুতা কৃমির ঘটনাটা বলি। সেদিন ছিল বুধবার। বুধবার সকালে আমার কোনো ক্লাস নেই। প্রথম ক্লাস এগারোটায়। ক্লাস নেবেন রবীন্দ্রবিশারদ ড. সিদ্দিক। রবীন্দ্রবিশারদরা সাধারণত নজরুলবিদ্বেষী হয়। তিনি নজরুলবিদ্বেষী। তার ধারণা কবি নজরুল একজন মহান পদ্যকার ছাড়া কিছুই না।

সিদ্দিক স্যার কখনও রোল কল করেন না, সবাইকে পার্সেন্টেজ দিয়ে দেন। কাজেই আমি ঠিক করলাম কলেজে যাব দুপুরের পর। টিভি দেখার জন্যে টিভি ছেড়েছি (বাবা বাসায় নেই তো, টিভি ছাড়া যায়)। জিটিভিতে শাহরুখ খানের কি একটা ছবি দেখাচ্ছে। শাহরুখ খানের অভিনয় আমার ভালো লাগে না। তার চেহারা ফাজিলের মতো, অভিনয়ও ফাজিলের মতো। তারপরেও দেখছি। হঠাৎ সুতা কৃমির বোন হাউমাউ করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই বলল, তরু আমার ভাইটাকে বাঁচাও, ওকে মেরে ফেলছে। ওর দুলাভাই ওকে মেরে ফেলছে। আমি ছুটে গেলাম।

গিয়ে দেখি রক্তারক্তি কাণ্ড। বেচারা লুঙ্গি পরেছিল। লুঙ্গি খুলে গেছে। সে মেঝেতে নেংটা হয়ে পড়ে আছে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। হাত কেটে রক্ত পড়ছে। সুতা কৃমির বোন নীলা ভাবী লুঙ্গি দিয়ে ভাইকে ঢাকল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম, কী করছেন আপনি! এখন এ যদি মারা যায় আপনার তো ফাসি হয়ে যাবে। আমি সাক্ষী দেব।
 
ভদ্রলোক বললেন, তরু তুমি জানো না এ কত বড় চোর। আমার বিশ হাজার টাকা চুরি করেছে। নিজের হাতে ব্রাউন পেপারে মুড়ে ড্রয়ারে রেখেছি। আমরা তিন জন ছাড়া ঘরে আর কেউ আসে না …

আমি বললাম, কথাবার্তা পরে শুনব। এখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

আমার কথা শেষ হবার আগেই সুতা কৃমি রক্ত-বমি করা শুরু করল। এই দেখে সম্ভবত তার দুলাভাইয়ের টনক নড়ল। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সুতা কৃমিকে নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালের দিকে।

দুপুরে ভাত খাচ্ছি, নীলা ভাবী এসে জানাল ডাক্তাররা তার ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আর টাকাটা চুরি হয় নাই। পাওয়া গেছে।

আমি বললাম, কোথায় পাওয়া গেছে?

নীলা ভাবী চোখ মুছতে মুছতে বলল, খাটের নিচে। ড্রয়ার থেকে নিচে পড়েছে, পায়ের ধাক্কা লেগে চলে গেছে খাটের নিচে।

জামান ভাই এখন কি বলছেন?

কী আর বলবে। কিছু বলছে না। গম্ভীর হয়ে আছে।

সরি তো বলবে।

আশ্চর্য কথা বললে। তোমার ভাই কি সরি বলার মানুষ। টাকা পাওয়া। গেছে এতেই সে খুশি।

সুতা কৃমি তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে স্বাভাবিকভাবে বাজার সদাই করা শুরু করল। কলেজে যাওয়া শুরু করল, যেন কিছুই হয় নি। আজ এই পর্যন্ত লিখলাম। কারণ আঠারোটা মোমবাতির এগারোটা শেষ হয়ে নিভে গেছে। বাকি সাতটাও যাই যাই করছে। কাজেই প্রিয় পাঠক সমাজ বিদায়।



তরুর লেখা এইটুকুই। আসল ঘটনা সে লেখায় বাদ দিয়েছে। উপন্যাসের শেষের দিকে আসলটা লিখবে। পাঠকদের জন্যে সাসপেন্স জমা থাকুক। একটা ছোট্ট সমস্যা অবিশ্য থাকবে—পাঠকরা বিশ হাজার টাকা চুরির ঘটনা ভুলে যেতে পারে। সবার স্মৃতিশক্তি তো আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো না যে, যা পড়বে সবই মনে থাকবে।

মূল ঘটনা হচ্ছে সুতা কৃমি বিশ হাজার টাকা ঠিকই চুরি করেছিল। এক দুপুর বেলায় তরুদের বাসায় ঘন ঘন কলিং বেল টিপছে। তার মুখে ঘাম। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। মুখ কাঁদো কাঁদো।

তরু বলল, কী সমস্যা?

সে ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে বলল, এই প্যাকেটটা রাখবেন?

তরু বলল, প্যাকেটে কি বোমা, না-কি পিস্তল?

টাকা। একশ টাকার দুটা বান্ডেল।

টাকা রাখব কেন? কার টাকা?

দুলাভাইয়ের।

তোমার দুলাভাইয়ের টাকা থাকবে তোমার কাছে কিংবা তোমার বোনের কাছে। আমার কাছে কেন?

সনজুর চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তরু লক্ষ করল তার হাত কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে টাকার বান্ডেল হাত থেকে পড়ে যাবে।

তরু বলল, টাকাটা কি তুমি চুরি করেছ?

সনজু অন্য দিকে তাকিয়ে হাসূচক মাথা নাড়ল।

তরু বলল, ঝেড়ে কাশতে হবে। খুকখুক করে কাশলে হবে না। ঘটনা কী বলো?

আমি পালিয়ে যাব।

কোথায়?

টেকনাফে আমার এক বন্ধু আছে। কাঠ চিড়াই কলে কাজ করে। তার কাছে যাব।

বন্ধুর নাম কী?

এনামুল করিম।

পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাঠ চেড়াই?



দুলাভাইয়ের কাছে থাকতে পারছি না। তিন মাসের কলেজের বেতন বাকি পড়েছে। কলেজে নাম কাটা গেছে। এই বিশ হাজার টাকা নিয়ে আমি পালিয়ে যাব।

তরু প্যাকেট রেখে দরজা বন্ধ করে দিল। মারামারির মূল ঘটনার পর জামান এবং তার স্ত্রী যখন সনজুকে নিয়ে হাসপাতালে তখন তরু টাকার প্যাকেট খাটের নিচে রেখে এসেছে।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পর কয়েক বারই তরুর সাথে সনজুর দেখা হয়েছে। সনজু টাকার প্রসঙ্গ তুলে নি। তরুও না।

গতকাল তরু সনজুকে একটা সিএনজি ডেকে দিতে বলল। সনজু সিএনজি ডেকে দিল। তরু বলল, লক্ষ করলাম কলেজে যাচ্ছ।

সনজু বলল, হুঁ।

নাম যে কাটা গিয়েছিল, নাম কি উঠেছে?

উঠেছে।

তোমার দুলাভাই বেতনের টাকা দিয়েছেন?

আপা দিয়েছেন।

উনি কোত্থেকে দেবেন? উনার কি আলাদা টাকা আছে?

না। মনে হয় দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে দিয়েছেন।

তোমার বন্ধু এনামুল করিম কেমন আছে?

জানি না।

যোগাযোগ নাই?

না।

তার কি কোনো মোবাইল টেলিফোন আছে?

আছে।

নাম্বার জানা আছে?

আছে। আমার মোবাইলটা নিয়ে তার কাছে টেলিফোন করতে পারো।

দরকার নাই।

তরু হালকা গলায় বলল, তোমার দুলাভাইকে খুন করার কোনো পরিকল্পনা যদি করো, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমার এক বান্ধবী আছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ওর নাম নীলা। ওকে বললেই সে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করে দিবে। তুমি তোমার দুলাভাইয়ের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। পারবে না?

না।

তারপরও আমি জোগাড় করে রাখব। সব ব্যবস্থা করা থাকবে। আমাকে বললেই হবে। ঠিক আছে?

সনজু তাকিয়ে রইল। তার সামান্য ভয় করতে লাগল। এই অদ্ভুত মেয়েটা এসব কি বলছে? ঠাট্টা করছে? না-কি সিরিয়াস? ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস। সনজুর কপাল ঘেমে উঠল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top