What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

নেপোলিয়নকেও হারতে হয়েছিল (1 Viewer)

মানুষ অপরাজেয় নয়। বারংবার ইতিহাস সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসের অবিসংবাদী সেনানায়ক তথা রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ান বোনাপার্টকেও তাই বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে। মেনে নিতে হয়েছে পরাভব। প্রবল পরাক্রমশালী থেকে হয়ে উঠেছেন নির্বাসিত এক নৃপতি। ওয়াটারলু আজও বহন করছে সেই পরাজয়ের স্মৃতি। ওয়াটারলু ঘুরে আসার সেই স্মৃতির আলোয় ১৮ জুনের তর্পণ। স্মরণ নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে।

GjdEuOc.jpg


ওয়াটার লু যুদ্ধক্ষেত্রের প্রবেশ পথ

সে বছর ইউরোপের গ্রীষ্ম বেশ কড়া ছিল। গরম সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়েছিল। এসি কিংবা ফ্যান ব্যবহারের সংস্কৃতি তো সে তল্লাটে নেই, তাই খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমি তখন বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব এনটর্পের ছাত্রী। আমার প্রবাসজীবনের শহর এনটর্প। এটি একটি বন্দর নগর। স্বভাবতই রাস্তাঘাটে অভিবাসীদের ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। আমার সে ছাত্রজীবনে পড়ালেখার চাপও খানিকটা বেড়ে যাচ্ছিল। মনস্থির করলাম সামনের শনিবার ব্রাসেলস যাব।

সে সময়ে এনটর্প থেকে ব্রাসেলস যাওয়া ছিল আমার কাছে এক কাঙ্ক্ষিত বিনোদন। মন তাড়া দিচ্ছিল 'ওয়াটারলু' দেখার। ব্রাসেলস থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। ব্রাসেলসের অদূরে অবস্থিত ওয়াটারলু শহরটির বিশেষত্ব হলো এখানে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র আছে। সে যুদ্ধের নায়ক সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। শুক্রবার ক্লাস শেষ করেই এনটর্প ট্রেন স্টেশনে হাজির হলাম। এ রেলস্টেশনটিতে এলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। কারণ, এর নান্দনিকতা একে ইউরোপের সেরা কয়েকটি ট্রেন স্টেশনের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছে।

ব্রাসেলস পৌঁছাতে মিনিট পঞ্চাশের মতো লেগে যায়, তবু এ যাত্রাকে থামাতে মন চায় না। ইউরোপের রেলে চড়ার এই আনন্দ। কিছুতেই মন কিংবা শরীর অবসন্ন হয় না। ব্রাসেলস থেকে ওয়াটারলু যেতে ব্রাসেলস-মিধি স্টেশন থেকে বাস ডাবলিউ নাকি বাস ৩৬৫–তে উঠেছিলাম, এখন আর মনে করতে পারি না।

NkosnP0.jpg


ওয়াটারলু স্টেশন, ছবি: উইকিপিডিয়া

ওয়াটারলু শহরের রাস্তাঘাট দেখলেই এর আভিজাত্যের নমুনা টের পাওয়া যায়। এক মিনিটের জন্যও মনোযোগ হারাইনি। রাস্তার দুই ধারের শহর দেখছিলাম। চারদিক পরিপাটি। এ সুন্দর রোমান্টিকতার, এ সুন্দর নান্দনিকতার। শহরও যে প্রশান্ত হতে পারে, মৌন হতে পারে, তা এখানে না এলে জানা যেত না। বেলজিয়ামে বসবাসরত বাঙালিদের মুখে শুনেছি, ওয়াটারলু ধনীদের পাড়া। বাস নামিয়ে দিল সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই। যতটুকু মনে করতে পারছি, মিনিট চল্লিশেক সময় লেগেছিল পৌঁছাতে।

যুদ্ধক্ষেত্রটি সবুজে সবুজে সুশোভিত। বহু দূর থেকে সে সবুজ দৃষ্টিতে ধরা দেয়। এ এক দিগন্তহীন খোলা প্রান্তর। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। কড়া সবুজ। এ সবুজ প্রান্তরে আমাদের গ্রামের ধানগাছের মতো লম্বা ঘাস জন্মেছে। প্রথমে মনে হলো হয়তো এ দেশের কোনো ফসল, কিন্তু না। এই সবুজ ময়দানটির ঠিক মাঝে একটি উঁচু ঢিবির মতো বা একটু টিলার মতো।

9VnC0jn.jpg


ওয়াটার লু যুদ্ধক্ষেত্র

একটি দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে সেই টিলার মাথা অবধি যাওয়া যায়। ঠিক চূড়ায় একটি বৃহৎ ধাতব মূর্তি, সিংহের। সিংহমূর্তিটি ফ্রান্সের দিকে মুখ করে তাকিয়ে, একটি পাথরখণ্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে। দর্শনার্থীরা বিনা মূল্যে এটি পরিদর্শন করতে পারেন। এই ছোট পাহাড় বা টিলার শীর্ষে পৌঁছাতে দর্শনার্থীকে ২২৬টি ধাপ আরোহণ করতে হয়। আজ থেকে ২০৬ বছর আগে ১৮১৫ সালের ১৮ জুন এই প্রান্তরেই ঘটে গিয়েছিল একটি ইতিহাসখ্যাত যুদ্ধ।

ইতিহাসের কাছে গেলে বিষণ্নতা আমায় আচ্ছন্ন করে, আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় থাকি। ঘন সবুজ ঘাসে আবৃত টিলাটি ১৮১৫ সালের ওয়াটারলু যুদ্ধের হতাহত ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত স্মৃতিফলক। টিলার পাদদেশে আছে একটি শ্বেত রোটুন্ডা। রোটুন্ডা হচ্ছে একধরনের বৃত্তাকার ছাদযুক্ত ঘর। সে ঘরে আছে যুদ্ধের আরও কিছু স্মৃতিচিহ্ন। দুর্ভাগ্য আমার, আমি সে ঘরে প্রবেশ করতে পারিনি। আমি ওয়াটারলু পৌঁছনোর আগেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আমার চারদিকে সবুজের আবাহন। মন আমায় প্রশ্ন করে, কবে এবং কীভাবে এখানকার লাল রক্ত ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠল? আমি বাকরুদ্ধ। কত কত রক্ত গড়িয়েছে এ পথে। হুম, ঠিক এখানেই তো সম্রাট নেপোলিয়নের বাহিনী যুদ্ধে নেমেছে। আজকের তারিখে, ১৮ জুন, যেটি ছিল নেপোলিয়নের শেষ যুদ্ধ। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন একাধারে ফ্রান্সের সম্রাট ও সেনাপ্রধান, যিনি ফরাসি বিপ্লবের শেষের দিকে ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ করে ফ্রান্সকে শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেন। আমার মন ইতিহাসের কাছে আশ্রয় খোঁজে। কীভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেরাদের সেরা হয়ে ওঠেন?

সেকালে সেনাবাহিনী ছিল ফ্রান্সের সেরা উপাদান, যুদ্ধ করেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হতো। বোনাপার্টের সাংগঠনিক প্রতিভা ঈর্ষণীয়। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ব্রিটেন একবার ফ্রান্সের বন্দর নগর টুলো দখল করে, ১৭৯১ সালে। নেপোলিয়ন মাত্র দুই বছর পর সেটি উদ্ধার করে প্রথম নজর কাড়েন সবার।

GdWzhkR.jpg


নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ছবি: উইকিপিডিয়া

সে সময় তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি পুরস্কৃত হলেন। ক্যাপ্টেন পদ থেকে হয়ে যান সরাসরি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। এখানেই তিনি থামেননি। ১৭৯৭ সালে ইতালির যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে হয়ে ওঠেন মেজর জেনারেল। এর দুই বছর পর ফ্রান্সের সেনাপ্রধান, ১৭৯৯ সালে। পরের বছর সেনা অভিযান ঘটিয়ে ফ্রান্সের সম্পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সর্বদা তাঁর সহায়ক ছিল।

এর পরের এক দশক নেপোলিয়ন কেবল যুদ্ধই করেন। সে সময় রোমান সম্রাজ্য, ডাচ, ইংল্যান্ড, প্রুশিয়া মিলে একজোট ছিল। বোনাপার্ট এ জোটকে পরাজিত করেন। কিন্তু ভাগ্যের দৌড়ে হঠাৎ খানিক ছন্দপতন ঘটে। ১৮১২ সালে রাশিয়া আক্রমণ এবং সেখানে পরাজিত হওয়া কিংবা যুদ্ধ শেষ না করে ফিরে আসা তাঁর জন্য অশনিসংকেত একটি। ফ্রান্সের জনগণ এটা একেবারেই মেতে নিতে পারেনি। বীরের বীরত্বে ভাটা পড়ে। এরপর ১৮১৪ সালে ইউরোপের প্রায় সাতটি দেশ মিলে একধরনের মৈত্রী হয় এবং নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

zfMdHqk.jpg


সিংহ ভাস্কর্য, ছবি: উইকিপিডিয়া

এর আগে রাশিয়ার আক্রমণে তাঁর বেশ কিছু সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। নেপোলিয়নের বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বিপক্ষ দল দ্রুত প্যারিস ঘিরে ফেলে। তাঁর কিছুই করার ছিল না। তাঁর প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান অভিযোগ তিনি ইউরোপের শান্তি কিংবা মৈত্রীর পথে প্রধান বাধা তিনি। তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয় এলবা দ্বীপে। সেটি ছিল প্রথম নির্বাসন। ব্রিটিশরা রাজা অষ্টাদশ লুইকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন। কিন্তু তাঁকে কে রুধিতে নারে! নির্বাসনের দশ মাস পর ১৮১৫ সালে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন এলবা দ্বীপ থেকে রাষ্ট্রের হাল ধরতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নেপোলিয়নের অনুপস্থিতিতে ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি হয় ফ্রান্সে। কথিত আছে, সে সময়ে তাঁর আবেগঘন বক্তৃতায় জনগণ সিক্ত হয়ে তাঁকে আবার রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী লুইয়ের পক্ষ পরিবর্তন করে তাঁর পক্ষ নেন। তবে নেপোলিয়নের এই ফিরে আসা ইউরোপের অন্য রাজারা মেনে নেননি।

এ ঘটনার পর তিনি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন। তিনি ১০০ দিনের একটি যুদ্ধ অভিযানের পরিকল্পনা করেন। যাকে ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে 'হান্ড্রেড ডেজ' অভিযান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি ব্রাসেলসের অদূরে ওয়াটারলু নামক স্থানে পরাজিত হন, যেখানটায় আমি দাঁড়িয়ে। ব্রিটিশ বাহিনী আর প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী একসঙ্গে লড়েছিল নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে।

oam9w9s.jpg


সিংহ ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থিত শ্বেত রোটুন্ডা

ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল ডিউক অব ওয়েলিংটন, আর প্রুশিয়ান বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল গবার্ড ভন বুচার। এই দুই বাহিনী আবার গড়ে উঠেছিল ইউরোপের সাতটি বাহিনীর সৌজন্যে। কিন্তু কী এমন ঘটে ছিল যে সে সময়ের সেরা যুদ্ধনায়ক হেরে গেলেন? যুদ্ধের আগের রাতে প্রবল বৃষ্টিজনিত আবহাওয়া বিপর্যয়ের কারণে স্থানটি বেশ কর্দমাক্ত ছিল। পরিস্থিতি অনুকূলে নেওয়ার জন্য নেপোলিয়ন দুই দিন অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু না, ফরাসিদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার সপ্তম দিনে ক্ষমতা থেকে সরে যান নেপোলিয়ন। তাঁর জায়গা হয় সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নেপোলিয়নের হান্ড্রেড ডেজ অভিযানের পরিসমাপ্তি হয়।

বোনাপার্টের রাজনৈতিক জীবনে ঢুঁ মারলে আমি আমার জাতীয়তাবাদের স্পর্শ পাই, আমার দেশাত্মবোধ প্রকট হয়; কারণ তাঁর ভারতবর্ষপ্রীতি ছিল। তাঁর সঙ্গে ভারতবর্ষের মৈত্রী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ধ্বংস করতে টিপু সুলতানকে হাত করে ব্রিটিশদের হটানোর পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলগামী শিশু নেপোলিয়নের যে উক্তিটি পড়ে পড়ে বড় হয়েছে, সেটা হলো 'তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।' আমি আমার শিশু বয়সে শোনা এ কথার মর্মবাণী বুঝতে পেরেছি বড় হয়ে।

EtB7lZY.jpg


ওয়াটার লু যুদ্ধক্ষেত্রের প্রবেশ পথে লেখক

জীবদ্দশায় মোট ৬০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নেপোলিয়ান। তিনি বলতেন, আমার অভিধানে 'অসম্ভব' নামে কোনো শব্দ নেই। বিখ্যাত সব মানুষকে নিয়ে কিংবদন্তি তৈরি হয় ইতিহাসে। সে রকম একটি জনশ্রুতি হলো তাঁর দাঁত মাজার ব্রাশ ঘোড়ার চুলের তৈরি। শত্রুকে পরাস্ত করতে যিনি অদ্বিতীয়, তাঁকেও হারতে হয়েছে। যুদ্ধবিদ্যা যাঁর প্রিয়পাঠ ও নেশা, তাঁকেও হারতে হয় বৈকি!

বিকেল গড়িয়েছে। ওয়াটারলুর সূর্যটা ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, দিগন্তে আবীর ছড়িয়ে সূর্য তার প্রস্থানের জানান দিচ্ছে। যে ঘাস সূর্যের আলোয় সবুজ, তাকে তখন লালচে সোনালি মনে হচ্ছে। ২০০ বছর আগে তো এ প্রান্তরের মাটিও লাল ছিল।

লেখক: মহুয়া রউফ, গবেষক ও পরিব্রাজক | তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, রোর মিডিয়া
 

Users who are viewing this thread

Back
Top