শহরের নামকরা স্কুলের প্রিন্সিপাল এর সামনে বসে আছি। যতটা মাথা নিচু করে থাকলে, চোখের দিকে তাকানো লাগে না, ততটাই মাথা নিচু করে আছি। প্রিন্সিপাল ভীষণ রাগী মানুষ । বাচ্চা বয়সের মত ভয় পাচ্ছি। অথচ ঐ বয়সে কোন টিচারের ভয় কখনো পাইনি। কোন এক অজানা কারণে, আমার টিচাররা সব সময় খুব স্নেহ করতেন আমাকে। সেই আমি আজ ভয়ে কুঁকড়ে আছি, আমার ছেলের জন্য। আমার ছেলের এবার, ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন এ ওঠার কথা। আমার ছেলে আইয়ান, ক্লাস সেভেনে উঠতে পারছে না । ব্যাপারটা সেটুকু হলে তবু সহ্য করা যেত। কিন্তু প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকেছেন, আমার ছেলে কে স্কুল থেকে টি সি দিয়ে দেবেন, তাই। এমন নামকরা স্কুলে ভর্তি করার জন্য কত কাঠখড় পুড়িয়ে ছিলাম এক সময় । আইয়ান সেই ভর্তি যুদ্ধে অনায়াসে টিকে গিয়েছিল । কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে কেন জানি পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আমি সারাক্ষণ পড়, পড় করতাম, কিন্তু লাভ হতো না । কিন্তু তাই বলে স্কুল থেকে কখনো বের করে দেবে, চিন্তাই করিনি ।
এই স্কুলের নিয়ম হচ্ছে, দুই সাবজেক্ট এ ফেল করলে, আবার আগের ক্লাস এ রেখে দেবে। আর তিন সাবজেক্ট এ ফেল করলে, স্কুল থেকে বের করে দেবে । আইয়ান তিন সাবজেক্ট এ ফেল করেছে । অংকে ১৪ পেয়েছে। অংকে ১৪ !!! আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ওর বাবা এবং আমি অংকে কোন দিন ৮০ এর নিচে পাইনি। আমাদের ছেলে কিভাবে পেলো ? আমি পড়াশোনা দেখিয়ে দিইনি? আমাদের বাবা মা ও তো কোন দিন আমাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়নি ? তাহলে আমাদের রেজাল্ট এত ভালো হতো কি করে ? আমি খুব সাবধানে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছি, যাতে প্রিন্সিপাল দেখতে না পারেন, আমি কাঁদছি । প্রিন্সিপাল স্যার কে রিকোয়েস্ট করলাম, যেন স্কুল থেকে বের করে না দেন। প্রিন্সিপাল স্যার খুব বাজে ব্যবহার করলেন আমার সাথে । আমি নিজে একজন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা । আমি অবাক হয়ে ভাবছি, উনি আমার সাথে এমন দুর্ব্যবহার কেমনে করছেন ?! আমি তো ওনার ছাত্র নই ? নিজেকে কন্ট্রোল করলাম । এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মা।
ছেলে কে টি সি দেওয়ার পরে, কিছুদিন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম । আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছিলাম । ভাবতাম, লোকের সামনে মুখ দেখাবো কি করে ? একবার ভেবেছিলাম, ছেলে কে মারধোর করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও ইচ্ছা করেনি। শুধু বেশ কিছুদিন কথা বলতাম না ওর সাথে । কত রাত যে কেঁদে কাটিয়েছি, বলতে পারবো না । আমার এই একটা মাত্র ছেলে। ওর আদর যত্নে ঘাটতি পড়বে ভেবে, আর কোন বাচ্চা নিইনি । অথচ সেই ছেলের জন্যই আমাকে এত অপমানিত হতে হলো ?!
নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এইভাবে, কত জনের বাচ্চা হয় না, কত জনের অটিস্টিক বাচ্চা নিয়ে কত কষ্ট , আমার তো তবু সুস্থ সবল একটা বাচ্চা আছে। না হলো পড়াশোনা, কি এসে যায় ? আমাদের সম্পত্তি যা আছে, তা দিয়ে বসে খেতে পারবে । বাড়ির পাশে একটা সাধারণ স্কুলে আবার ভর্তি করিয়ে দিলাম ক্লাস সিক্স এ। ছেলের পড়ালেখার কোন খবর, আমি আর রাখতাম না । আর কোন দিন পড় পড় বলিনি । স্কুল থেকে দুই দিন পর পর নালিশ আসে না, তাতেই আমি খুশি। এ রকম স্কুলে দেওয়ার একটা সুবিধা আছে, ছেলে মেয়েরা পাশ করলো না ফেল করলো, তাতে কিছু যায় আসে না কারোর। আমিও রেজাল্ট দেখতে চাই না । তবে সব ক্লাসে পাশ মনে হয় করে।
এস এস সির রেজাল্ট যেদিন দিলো, সেদিন আমার স্বামী আসিফ, আমাকে ফোন দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো, " নীতু, আইয়ান এর রেজাল্ট দেখেছো ? কোন ভুল হলো না তো ?! " অনেক দিন পরে আবার আমার গা হাত পা কাঁপা শুরু হলো। বললাম, " ফেল করেছে? " আসিফ কাঁদতে কাঁদতে বললো, " আরে না। সে তো রেকর্ড মার্কস তুলেছে । স্কুলের হেড মাস্টার আমাকে ফোন দিয়েছে। সে নাকি স্কুলের প্রত্যেক ক্লাসেই ফার্স্ট হতো ! "
আইয়ান পরবর্তীতে নটরডেম কলেজে পড়েছে । ঢাকা মেডিকেল কলেজে কোন দিন আমার ছেলে পড়বে, এক সময় স্বপ্নেও ভাবিনি। সেই যে ক্লাস সিক্স এ লেখা পড়ার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করেছিলাম, আর কোন দিন খোঁজ নিইনি। ছেলে আমার নিজে নিজেই পড়তো। সবগুলো প্রফে প্রথম হওয়ায়, আইয়ান কে গোল্ড মেডেল দেওয়া হবে । আইয়ান এই প্রথম, আমাকে তার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললো।
কোন বার এমন হয়নি, এই প্রথম স্টুডেন্টদের কে গোল্ড মেডেল দেওয়ার সাথে সাথে, মা দেরকে রত্নগর্ভা সার্টিফিকেট দিলো। আমি কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না ।
আইয়ান আর আমি রিক্সায় করে বাড়ি ফিরছি। প্রচুর বৃষ্টি নেমেছে । বৃষ্টির পানি এসে, আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে । আমি সার্টিফিকেটটা বুকের সাথে চেপে ধরে আছি, যেন কোন ক্রমেই ভিজে না যায়। আইয়ান বলছে, " তোমাকে খুব ভালোবাসি মা। ভালো রেজাল্ট করে কি হবে, এটাই বুঝতাম না । কিন্তু যেদিন প্রিন্সিপাল স্যার, তোমাকে ডেকে খুব অপমান করে স্কুল থেকে বের করে দিলো, সেদিন বুঝলাম, তোমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই পড়তে হবে । রাতে তোমরা যখন ঘুমিয়ে পড়তে, তখন আমি পড়তে বসতাম। আমি হয়তো তেমন ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম না, কিন্তু প্রচুর পরিশ্রমী ছিলাম । তোমাদের কে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম, যাতে তোমরা কখনো আশা করে, আশাহত না হও তাই। " আমি কাঁদতে কাঁদতেই রিক্সা ওয়ালা কে বললাম, " এইদিক দিয়ে যাও ভাই। " আইয়ান অবাক হয়ে বললো, " কোথায় যাবা মা ? আমাদের বাড়ির রাস্তা তো ঐদিকে ?! " আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, " ঐ প্রিন্সিপাল এখনো ঐ স্কুলেই আছে। তাকে একটু এই সার্টিফিকেটটা দেখিয়ে আসবো। " আইয়ান হাসতে হাসতে বললো, " কি সব ছেলেমানুষি করো মা ?!!! " আমি কিছু বললাম না । আজ আমার খুব ছেলেমানুষি করতে ইচ্ছা করছে।
(সমাপ্ত)
এই স্কুলের নিয়ম হচ্ছে, দুই সাবজেক্ট এ ফেল করলে, আবার আগের ক্লাস এ রেখে দেবে। আর তিন সাবজেক্ট এ ফেল করলে, স্কুল থেকে বের করে দেবে । আইয়ান তিন সাবজেক্ট এ ফেল করেছে । অংকে ১৪ পেয়েছে। অংকে ১৪ !!! আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ওর বাবা এবং আমি অংকে কোন দিন ৮০ এর নিচে পাইনি। আমাদের ছেলে কিভাবে পেলো ? আমি পড়াশোনা দেখিয়ে দিইনি? আমাদের বাবা মা ও তো কোন দিন আমাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়নি ? তাহলে আমাদের রেজাল্ট এত ভালো হতো কি করে ? আমি খুব সাবধানে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছি, যাতে প্রিন্সিপাল দেখতে না পারেন, আমি কাঁদছি । প্রিন্সিপাল স্যার কে রিকোয়েস্ট করলাম, যেন স্কুল থেকে বের করে না দেন। প্রিন্সিপাল স্যার খুব বাজে ব্যবহার করলেন আমার সাথে । আমি নিজে একজন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা । আমি অবাক হয়ে ভাবছি, উনি আমার সাথে এমন দুর্ব্যবহার কেমনে করছেন ?! আমি তো ওনার ছাত্র নই ? নিজেকে কন্ট্রোল করলাম । এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মা।
ছেলে কে টি সি দেওয়ার পরে, কিছুদিন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম । আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছিলাম । ভাবতাম, লোকের সামনে মুখ দেখাবো কি করে ? একবার ভেবেছিলাম, ছেলে কে মারধোর করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও ইচ্ছা করেনি। শুধু বেশ কিছুদিন কথা বলতাম না ওর সাথে । কত রাত যে কেঁদে কাটিয়েছি, বলতে পারবো না । আমার এই একটা মাত্র ছেলে। ওর আদর যত্নে ঘাটতি পড়বে ভেবে, আর কোন বাচ্চা নিইনি । অথচ সেই ছেলের জন্যই আমাকে এত অপমানিত হতে হলো ?!
নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এইভাবে, কত জনের বাচ্চা হয় না, কত জনের অটিস্টিক বাচ্চা নিয়ে কত কষ্ট , আমার তো তবু সুস্থ সবল একটা বাচ্চা আছে। না হলো পড়াশোনা, কি এসে যায় ? আমাদের সম্পত্তি যা আছে, তা দিয়ে বসে খেতে পারবে । বাড়ির পাশে একটা সাধারণ স্কুলে আবার ভর্তি করিয়ে দিলাম ক্লাস সিক্স এ। ছেলের পড়ালেখার কোন খবর, আমি আর রাখতাম না । আর কোন দিন পড় পড় বলিনি । স্কুল থেকে দুই দিন পর পর নালিশ আসে না, তাতেই আমি খুশি। এ রকম স্কুলে দেওয়ার একটা সুবিধা আছে, ছেলে মেয়েরা পাশ করলো না ফেল করলো, তাতে কিছু যায় আসে না কারোর। আমিও রেজাল্ট দেখতে চাই না । তবে সব ক্লাসে পাশ মনে হয় করে।
এস এস সির রেজাল্ট যেদিন দিলো, সেদিন আমার স্বামী আসিফ, আমাকে ফোন দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো, " নীতু, আইয়ান এর রেজাল্ট দেখেছো ? কোন ভুল হলো না তো ?! " অনেক দিন পরে আবার আমার গা হাত পা কাঁপা শুরু হলো। বললাম, " ফেল করেছে? " আসিফ কাঁদতে কাঁদতে বললো, " আরে না। সে তো রেকর্ড মার্কস তুলেছে । স্কুলের হেড মাস্টার আমাকে ফোন দিয়েছে। সে নাকি স্কুলের প্রত্যেক ক্লাসেই ফার্স্ট হতো ! "
আইয়ান পরবর্তীতে নটরডেম কলেজে পড়েছে । ঢাকা মেডিকেল কলেজে কোন দিন আমার ছেলে পড়বে, এক সময় স্বপ্নেও ভাবিনি। সেই যে ক্লাস সিক্স এ লেখা পড়ার খোঁজ নেওয়া বন্ধ করেছিলাম, আর কোন দিন খোঁজ নিইনি। ছেলে আমার নিজে নিজেই পড়তো। সবগুলো প্রফে প্রথম হওয়ায়, আইয়ান কে গোল্ড মেডেল দেওয়া হবে । আইয়ান এই প্রথম, আমাকে তার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললো।
কোন বার এমন হয়নি, এই প্রথম স্টুডেন্টদের কে গোল্ড মেডেল দেওয়ার সাথে সাথে, মা দেরকে রত্নগর্ভা সার্টিফিকেট দিলো। আমি কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না ।
আইয়ান আর আমি রিক্সায় করে বাড়ি ফিরছি। প্রচুর বৃষ্টি নেমেছে । বৃষ্টির পানি এসে, আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে । আমি সার্টিফিকেটটা বুকের সাথে চেপে ধরে আছি, যেন কোন ক্রমেই ভিজে না যায়। আইয়ান বলছে, " তোমাকে খুব ভালোবাসি মা। ভালো রেজাল্ট করে কি হবে, এটাই বুঝতাম না । কিন্তু যেদিন প্রিন্সিপাল স্যার, তোমাকে ডেকে খুব অপমান করে স্কুল থেকে বের করে দিলো, সেদিন বুঝলাম, তোমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই পড়তে হবে । রাতে তোমরা যখন ঘুমিয়ে পড়তে, তখন আমি পড়তে বসতাম। আমি হয়তো তেমন ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম না, কিন্তু প্রচুর পরিশ্রমী ছিলাম । তোমাদের কে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম, যাতে তোমরা কখনো আশা করে, আশাহত না হও তাই। " আমি কাঁদতে কাঁদতেই রিক্সা ওয়ালা কে বললাম, " এইদিক দিয়ে যাও ভাই। " আইয়ান অবাক হয়ে বললো, " কোথায় যাবা মা ? আমাদের বাড়ির রাস্তা তো ঐদিকে ?! " আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, " ঐ প্রিন্সিপাল এখনো ঐ স্কুলেই আছে। তাকে একটু এই সার্টিফিকেটটা দেখিয়ে আসবো। " আইয়ান হাসতে হাসতে বললো, " কি সব ছেলেমানুষি করো মা ?!!! " আমি কিছু বললাম না । আজ আমার খুব ছেলেমানুষি করতে ইচ্ছা করছে।
(সমাপ্ত)