একদিন গল্পে গল্পে শাশুড়িমাকে বল্লাম,
"মা জানেন, আমি বিয়ের আগে সব মিলিয়ে এগারোটা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা ছেলের কাছ থেকে একমাস সময় নিতাম। এই একমাসের মধ্যে তাদের ফ্যামিলির খোঁজখবর নিতাম তারপর রিজেক্ট করে দিতাম।"
- তাই নাকি? তা আমার ছেলেরও কি খোঁজখবর নিয়েছিলে?
- না মা। দরকার মনে করিনি। এখন আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর, শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী। কোন পরিবেশের সাথে যদি খাপখাওয়াতে না পারি তবে সেটা আমারই ব্যর্থতা!
- সেটাতো হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছিগো সোনা! সেদিন তোমার জামাইকে যেভাবে বল্লে, লবণ না হলে দিয়ে খাও। কাঁচা মাছ যে খেতে দিই নাই, সেটার জন্য ধন্যবাদ দাও অন্তত"!
হি হি...তুমি পারো বটে! ভীষণ মজা লাগে আমার।
বিয়ের পরদিন থেকেই আমার শাশুড়ির সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমাদের শাশুড়ি বউয়ের এইটাইপ সম্পর্ককে অনেকে ঠিকঠাক মতন হজম করতে পারেনি। আবার অনেকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বুদ্ধিমতী। নিজের ভালো আমি খুবই ভালো বুঝি। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেছিতো অনেককিছু দেখেছি, বুঝেছি। দেখে দেখে অনেককিছুই শিখেছি। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠার সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হচ্ছে সমাজের যেকোন মানুষের সাথে সুবিধামতভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখা যায়।
আমার বিয়ের পরদিনই আমি আমার শাশুড়িকে বলে দিয়েছি,
"আমি কিন্তু একটু বেশি কথা বলি। সারাক্ষণ কথা বলি। কথা বলতে না পারলে আমার দম বন্ধ লাগে। আমার এত বকবক শুনতে শুনতেতো আপনার মাথা ধরে যাবে!"
শাশুড়ি সাথে সাথে হেসে বলে,
"আরে না না। কি বল বউমা! মাথা ধরবে কেন? ঘরে শুধু আমরা দুজন মানুষ, কথা না বল্লে কেমনে থাকবো?"
মা যখন আমাকে বউমা বউমা করে ডাকতে শুরু করলেন, আমি তখন নির্বিকার কণ্ঠে উনাকে প্রশ্ন করে বসলাম,
"আমি কি আপনাকে শাশুড়িআম্মা ডাকবো নাকি আন্টি ডাকবো? না মানে, আপনিতো আমাকে বউমা ডাকছেন! তাই আরকি আমিও কনফিউজ!"
আমার এই কথা শুনে মনেহলো উনি মনে মনে একটা ধাক্কার মতন খেয়েছে! প্রায় একমিনিটের মতন আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আমার শাশুড়ি বলে উঠে -
"আরে... কি বলে পাগলটা! তুইতো আমার আরেকটা মেয়ে! ঠিক আছে, আজ থেকেই তোকে আমি নাম ধরেই ডাকবো।"
সেদিন থেকেই মোটামুটি মা আর আমি অনেকটুকুই কাছাকাছি চলে এসেছি।
এরপর ঘরের, বাইরের সবাই কিছুটা অবিশ্বাস ভরা চোখ নিয়েই আমাদের মা মেয়ের নিচু স্বরের গুটুর গুটুর গল্প করা দেখতো। সেসব গুটুর গুটুর গল্পের বেশীর ভাগই আমি বলতাম আর মা শুনত।
এক সপ্তাহ পর থেকেই মা আমাকে শিখিয়ে দিতে শুরু করেছে কিভাবে সরাসরি আগুণের তাপেও চিতই পিঠার পিঠ পুড়ে না, কিভাবে কলাপাতায় মুড়ে কাঁচাপেঁয়াজ আর ছোটমাছের ভাপা করলে একটুই মাছের বা পেঁয়াজের গন্ধ থাকেনা!
এক দুপুরের জন্য মুরগীর মসলা কষাতে কষাতে মাকে বল্লাম,
"মা, মুরগীর কষাটা যদি ভাল না হয়! ভয় লাগছে আমার।"
- শোন ফাহিমা, সংসারটা এতই ঠুনকো একটা জায়গা নয় যে, সামান্য একটা মুরগীর তরকারির জন্য একজন মানুষের মনে ভয় থাকতে হবে। যার ভাল লাগবে না সে ডাল দিয়ে খেয়ে উঠবে। তুমি এত চিন্তা কইরোনাতো, আমি আছি।"
সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছি, সব মেয়েদেরই আমার মতন বুদ্ধিমতী হওয়া খুব দরকার। ভীষণ দরকার।
আগেই বলেছি আমি খুবই বুদ্ধিমতী! আমি জানি, খুব ভালভাবেই জানি কোন সম্পর্ককে কিভাবে শুরু করতে হয়!
কিছুকিছু সম্পর্ক আছে, মুহূর্তেই লাইনে নিয়ে আসতে হবে। সময় দেয়া যাবেনা। সময় দিলেই এসব সম্পর্ক ট্র্যাক থেকে পিছলে যাবে।
আমি যে খুব বুদ্ধিমতী এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মা খুব টেনশনে থাকে। মা প্রথমদিকে দিনে অন্তত পাঁচ ছয় বা তারও বেশি বার ফোন দিতো। শাশুড়ির সাথে আমি কি করছি, কি বলছি, কোন গ্যাঞ্জাম বাধাচ্ছি কিনা এসব নিয়ে মায়ের প্রেশার মোটামুটি আকাশচুম্বী হয়ে থাকতো প্রথমদিকে। থাকারই কথা। বিয়ের দিনক্ষণ কনফার্ম হবার পর থেকে কয়েকশবার মাকে আমি বলছি, "সংসার কিভাবে আমি আমার কন্ট্রোলে আনবো তুমি শুধু দেখবা।"
আমার মা খুবই লক্ষ্মীমন্ত একজন গৃহিণী। কিন্তু আমার এই লক্ষ্মীমন্ত ঠাণ্ডা স্বভাবের সহনশীল বোকা মাকে আমি কোনদিনও মেনে নিতে পারিনি।
বোকা মেয়েদের জন্য আমার কোন মায়া লাগেনা। বরং রাগ লাগে। মায়ের উপরও আমার প্রচণ্ড রাগ হতো। তবে মাকে দেখে দেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে তৈরি করেছি।
বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখে আসছি মা কিভাবে সকাল থেকে রাত অবদি পুরো সংসারটাকে হাতের তালুতে নিয়ে ছুটোছুটি করে!
আমার পঁচাশি বছর বয়সী দাদির গোসলের পানি হতে হবে নাঠাণ্ডা, নাগরম। দাদির গামছাতে থাকতে হবে সাবানে গন্ধ। অর্থাৎ প্রতিদিন চুল মোছার পর সেই গামছা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
বাবার পাতের ভাতে ধোঁয়া থাকতেই হবে এবং সেই ধোঁয়া উঠা আগুন গরম ভাত প্লেটে বাড়ার পরপরই অতি সাবধানে মাকে এক চিমটিরও কম লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে। আমার ধারণা, এই পৃথিবীতে এই কাজটা একমাত্র আমার মা ছাড়া আর কেউ পারেনা। সেই লবণের একটা একটা দানা আলাদা আলাদা করে পরা চাই ভাতের উপরে।
চাচুর পছন্দের কষা মাংসতে আস্ত কাঁচামরিচ,
চট্টগ্রামে থাকা ছোটফুফুার জন্য রসুনতেঁতুলের আচার, বড়ফুফুর অস্ট্রেলিয়াতে থাকা একমাত্র ছেলের পছন্দের আলুবোখারার চাটনি আমার রন্ধনশিল্পী মায়ের হাতের হওয়া চাই।
প্রতি সকালে ঝিরিঝিরি করে কাটা আলুভাজির সাথে তুলতুলে ফুলকো রুটি, দুপুরের পাবদা মাছের ঝোল আর তিতা করলার মুচমুচে ভাজি, সপ্তাহে তিন/চারবার ভুনা গরু বা মুরগী....এরপরও বহুদিনের পুরোনো বুয়া ময়নাকে মনে করিয়ে দিতে হয় গোসলখানা কিভাবে ঘষে মেজে সাফ করতে হবে, বিদ্যুৎ আর খবরের কাগজের বিল, অমুকের নাতনির আকিকার জন্য সোনার চেইন, তমুকের ছেলের বউভাতের দাওয়াত......
৪০ বছর ধরে এসব হিসেব রাখতে গিয়ে আমার মা ভুলেই গেছে কবে তাঁর মাথার তালুর চুলগুলো সব উধাও হয়ে গেছে!
মা ভুলেই গেছে, কবে পায়ের ব্যাথাটা গোড়ালি বেয়ে বেয়ে কোমরে উঠে গেছে! মা সময়ই পায়না আয়না মেলে দেখতে যে তাঁর গাল জুড়ে মেছেতা বসত গেড়েছে!
আমার মা এখনো জানতে পারেনি, শাশুড়ির কুসুম গরম পানি আর ফ্রেশ গামছাতে মায়ার চেয়েও তাঁর ভয় বেশী গুলিয়ে থাকে!
মা কোনদিনও জানতে চেষ্টা করেনি আচারে লবণ ঠিকঠাক না হলেও যেখানে মমতা আর মায়ার হেরফের হয়না সেটাই সংসার!
মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করে, "মা শোন, গুনগুন করে নয়, তুমি গলা ছেড়ে গাইতে পারবে। সেই অধিকার নিয়েই তুমি জন্মেছো। ওই যে ওই গানটার কথা বলছি, বাবার জন্য উলের সোয়েটারটা বুনতে বুনতে তুমি যে নিচু গলায় গাও...
আমারে রচিত কাননে বসিয়া
পরাণো পিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া
আপনারে গলে দোলে হায়।
কিন্তু মাকে এসব কথা বলে কোন লাভ নাই। আমার মা খুব বোকা। কিন্তু আমি ভীষণ বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। তবে এটা একটা খুব সত্যিকথা, এসব বোকা মানুষদের জন্যই আমাদের মতন বুদ্ধিমতী মেয়েরা জন্মাতে পারে!!
(সমাপ্ত)
"মা জানেন, আমি বিয়ের আগে সব মিলিয়ে এগারোটা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা ছেলের কাছ থেকে একমাস সময় নিতাম। এই একমাসের মধ্যে তাদের ফ্যামিলির খোঁজখবর নিতাম তারপর রিজেক্ট করে দিতাম।"
- তাই নাকি? তা আমার ছেলেরও কি খোঁজখবর নিয়েছিলে?
- না মা। দরকার মনে করিনি। এখন আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর, শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী। কোন পরিবেশের সাথে যদি খাপখাওয়াতে না পারি তবে সেটা আমারই ব্যর্থতা!
- সেটাতো হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছিগো সোনা! সেদিন তোমার জামাইকে যেভাবে বল্লে, লবণ না হলে দিয়ে খাও। কাঁচা মাছ যে খেতে দিই নাই, সেটার জন্য ধন্যবাদ দাও অন্তত"!
হি হি...তুমি পারো বটে! ভীষণ মজা লাগে আমার।
বিয়ের পরদিন থেকেই আমার শাশুড়ির সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমাদের শাশুড়ি বউয়ের এইটাইপ সম্পর্ককে অনেকে ঠিকঠাক মতন হজম করতে পারেনি। আবার অনেকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বুদ্ধিমতী। নিজের ভালো আমি খুবই ভালো বুঝি। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেছিতো অনেককিছু দেখেছি, বুঝেছি। দেখে দেখে অনেককিছুই শিখেছি। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠার সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হচ্ছে সমাজের যেকোন মানুষের সাথে সুবিধামতভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখা যায়।
আমার বিয়ের পরদিনই আমি আমার শাশুড়িকে বলে দিয়েছি,
"আমি কিন্তু একটু বেশি কথা বলি। সারাক্ষণ কথা বলি। কথা বলতে না পারলে আমার দম বন্ধ লাগে। আমার এত বকবক শুনতে শুনতেতো আপনার মাথা ধরে যাবে!"
শাশুড়ি সাথে সাথে হেসে বলে,
"আরে না না। কি বল বউমা! মাথা ধরবে কেন? ঘরে শুধু আমরা দুজন মানুষ, কথা না বল্লে কেমনে থাকবো?"
মা যখন আমাকে বউমা বউমা করে ডাকতে শুরু করলেন, আমি তখন নির্বিকার কণ্ঠে উনাকে প্রশ্ন করে বসলাম,
"আমি কি আপনাকে শাশুড়িআম্মা ডাকবো নাকি আন্টি ডাকবো? না মানে, আপনিতো আমাকে বউমা ডাকছেন! তাই আরকি আমিও কনফিউজ!"
আমার এই কথা শুনে মনেহলো উনি মনে মনে একটা ধাক্কার মতন খেয়েছে! প্রায় একমিনিটের মতন আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আমার শাশুড়ি বলে উঠে -
"আরে... কি বলে পাগলটা! তুইতো আমার আরেকটা মেয়ে! ঠিক আছে, আজ থেকেই তোকে আমি নাম ধরেই ডাকবো।"
সেদিন থেকেই মোটামুটি মা আর আমি অনেকটুকুই কাছাকাছি চলে এসেছি।
এরপর ঘরের, বাইরের সবাই কিছুটা অবিশ্বাস ভরা চোখ নিয়েই আমাদের মা মেয়ের নিচু স্বরের গুটুর গুটুর গল্প করা দেখতো। সেসব গুটুর গুটুর গল্পের বেশীর ভাগই আমি বলতাম আর মা শুনত।
এক সপ্তাহ পর থেকেই মা আমাকে শিখিয়ে দিতে শুরু করেছে কিভাবে সরাসরি আগুণের তাপেও চিতই পিঠার পিঠ পুড়ে না, কিভাবে কলাপাতায় মুড়ে কাঁচাপেঁয়াজ আর ছোটমাছের ভাপা করলে একটুই মাছের বা পেঁয়াজের গন্ধ থাকেনা!
এক দুপুরের জন্য মুরগীর মসলা কষাতে কষাতে মাকে বল্লাম,
"মা, মুরগীর কষাটা যদি ভাল না হয়! ভয় লাগছে আমার।"
- শোন ফাহিমা, সংসারটা এতই ঠুনকো একটা জায়গা নয় যে, সামান্য একটা মুরগীর তরকারির জন্য একজন মানুষের মনে ভয় থাকতে হবে। যার ভাল লাগবে না সে ডাল দিয়ে খেয়ে উঠবে। তুমি এত চিন্তা কইরোনাতো, আমি আছি।"
সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছি, সব মেয়েদেরই আমার মতন বুদ্ধিমতী হওয়া খুব দরকার। ভীষণ দরকার।
আগেই বলেছি আমি খুবই বুদ্ধিমতী! আমি জানি, খুব ভালভাবেই জানি কোন সম্পর্ককে কিভাবে শুরু করতে হয়!
কিছুকিছু সম্পর্ক আছে, মুহূর্তেই লাইনে নিয়ে আসতে হবে। সময় দেয়া যাবেনা। সময় দিলেই এসব সম্পর্ক ট্র্যাক থেকে পিছলে যাবে।
আমি যে খুব বুদ্ধিমতী এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মা খুব টেনশনে থাকে। মা প্রথমদিকে দিনে অন্তত পাঁচ ছয় বা তারও বেশি বার ফোন দিতো। শাশুড়ির সাথে আমি কি করছি, কি বলছি, কোন গ্যাঞ্জাম বাধাচ্ছি কিনা এসব নিয়ে মায়ের প্রেশার মোটামুটি আকাশচুম্বী হয়ে থাকতো প্রথমদিকে। থাকারই কথা। বিয়ের দিনক্ষণ কনফার্ম হবার পর থেকে কয়েকশবার মাকে আমি বলছি, "সংসার কিভাবে আমি আমার কন্ট্রোলে আনবো তুমি শুধু দেখবা।"
আমার মা খুবই লক্ষ্মীমন্ত একজন গৃহিণী। কিন্তু আমার এই লক্ষ্মীমন্ত ঠাণ্ডা স্বভাবের সহনশীল বোকা মাকে আমি কোনদিনও মেনে নিতে পারিনি।
বোকা মেয়েদের জন্য আমার কোন মায়া লাগেনা। বরং রাগ লাগে। মায়ের উপরও আমার প্রচণ্ড রাগ হতো। তবে মাকে দেখে দেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে তৈরি করেছি।
বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখে আসছি মা কিভাবে সকাল থেকে রাত অবদি পুরো সংসারটাকে হাতের তালুতে নিয়ে ছুটোছুটি করে!
আমার পঁচাশি বছর বয়সী দাদির গোসলের পানি হতে হবে নাঠাণ্ডা, নাগরম। দাদির গামছাতে থাকতে হবে সাবানে গন্ধ। অর্থাৎ প্রতিদিন চুল মোছার পর সেই গামছা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
বাবার পাতের ভাতে ধোঁয়া থাকতেই হবে এবং সেই ধোঁয়া উঠা আগুন গরম ভাত প্লেটে বাড়ার পরপরই অতি সাবধানে মাকে এক চিমটিরও কম লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে। আমার ধারণা, এই পৃথিবীতে এই কাজটা একমাত্র আমার মা ছাড়া আর কেউ পারেনা। সেই লবণের একটা একটা দানা আলাদা আলাদা করে পরা চাই ভাতের উপরে।
চাচুর পছন্দের কষা মাংসতে আস্ত কাঁচামরিচ,
চট্টগ্রামে থাকা ছোটফুফুার জন্য রসুনতেঁতুলের আচার, বড়ফুফুর অস্ট্রেলিয়াতে থাকা একমাত্র ছেলের পছন্দের আলুবোখারার চাটনি আমার রন্ধনশিল্পী মায়ের হাতের হওয়া চাই।
প্রতি সকালে ঝিরিঝিরি করে কাটা আলুভাজির সাথে তুলতুলে ফুলকো রুটি, দুপুরের পাবদা মাছের ঝোল আর তিতা করলার মুচমুচে ভাজি, সপ্তাহে তিন/চারবার ভুনা গরু বা মুরগী....এরপরও বহুদিনের পুরোনো বুয়া ময়নাকে মনে করিয়ে দিতে হয় গোসলখানা কিভাবে ঘষে মেজে সাফ করতে হবে, বিদ্যুৎ আর খবরের কাগজের বিল, অমুকের নাতনির আকিকার জন্য সোনার চেইন, তমুকের ছেলের বউভাতের দাওয়াত......
৪০ বছর ধরে এসব হিসেব রাখতে গিয়ে আমার মা ভুলেই গেছে কবে তাঁর মাথার তালুর চুলগুলো সব উধাও হয়ে গেছে!
মা ভুলেই গেছে, কবে পায়ের ব্যাথাটা গোড়ালি বেয়ে বেয়ে কোমরে উঠে গেছে! মা সময়ই পায়না আয়না মেলে দেখতে যে তাঁর গাল জুড়ে মেছেতা বসত গেড়েছে!
আমার মা এখনো জানতে পারেনি, শাশুড়ির কুসুম গরম পানি আর ফ্রেশ গামছাতে মায়ার চেয়েও তাঁর ভয় বেশী গুলিয়ে থাকে!
মা কোনদিনও জানতে চেষ্টা করেনি আচারে লবণ ঠিকঠাক না হলেও যেখানে মমতা আর মায়ার হেরফের হয়না সেটাই সংসার!
মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করে, "মা শোন, গুনগুন করে নয়, তুমি গলা ছেড়ে গাইতে পারবে। সেই অধিকার নিয়েই তুমি জন্মেছো। ওই যে ওই গানটার কথা বলছি, বাবার জন্য উলের সোয়েটারটা বুনতে বুনতে তুমি যে নিচু গলায় গাও...
আমারে রচিত কাননে বসিয়া
পরাণো পিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া
আপনারে গলে দোলে হায়।
কিন্তু মাকে এসব কথা বলে কোন লাভ নাই। আমার মা খুব বোকা। কিন্তু আমি ভীষণ বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। তবে এটা একটা খুব সত্যিকথা, এসব বোকা মানুষদের জন্যই আমাদের মতন বুদ্ধিমতী মেয়েরা জন্মাতে পারে!!
(সমাপ্ত)