#এক ঃ
আম্মু বিয়ে করবেন শুনে আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ।
আম্মুর সাথে খুব সাধারণ বিষয়ে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি বিয়ের প্রসঙ্গটা এমনভাবে তুললেন যেন বিয়ে নয়, আম্মু কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন ।
আমার দৃষ্টিতে রাগ ঘৃণা না কি অনুকম্পা খেলা করছে আমি জানিনা । কিন্তু আম্মু বাধ্য হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন ।
এই প্রথম আমি আম্মুকে পরাজিত হতে দেখলাম । কঠিন এই মহিলা সহজে মাথা নিচু করেন না ।
তিনি চোখ না তুলে অনেকটা জবাবদিহিতার সুরে বললেন ; দেখ মোনা, আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
আব্বু মারা গেছেন ঠিক উনিশ মাস তেইশ দিন আগে । আমি আঙুলে হিসেব করে রাখিনি । আমার গোপন একটা ডায়েরি আছে । খুব নিয়মিত না হলেও সেখানে আমি দুই তিনদিন অন্তর অন্তর অনেককিছু লিখে রাখি । বেশিরভাগ লেখায় ঘুরেফিরে আব্বুর স্মৃতিটাই ফিরে আসে ।
আমার বয়স এবার চৌদ্দ ছাড়িয়েছে । আমি এখন অনেককিছু বুঝতে পারি এবং টের পাই । আমার আশপাশের অনেকে আমাকে বোকা ভাবায় আমার সুবিধা হয়েছে । আমি তাঁদের বোকামি আগ বাড়িয়ে ভেঙে দিতে চাইনি কখনো ।
মানুষ বোকা থাকলে অনেক সুবিধা । যদিও আমি আগে তেমন ছিলাম না ।
কিন্তু আম্মু যে বিয়ে করবেন, আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি । তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটটাতে আমরা দুই ভাইবোন এক রুমে থাকি । মুনিমের বয়স মাত্র আট। আব্বু মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পর থেকে সে আমার সাথে থাকে ।
আম্মু মাঝেমাঝে অনেক রাত জেগে আব্বুর কম্পিউটারে কীসব কাজ করেন । মুনিমের ভালো লাগেনা ।
আমার সাথে থাকায় তার একটা সুবিধা হয়েছে । আমার পুরোনো ল্যাপটপটা সে সচল রেখেছে । আব্বু যেদিন আমার জন্য ল্যাপটপটা কিনে এনেছিলেন, আমি সেই ল্যাপটপ নিয়ে চিৎকার করে পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলেছিলাম । ল্যাপটপ কিনে টাকা নষ্ট করার জন্য আম্মু প্রথমে আব্বুর সাথে একটু রাগারাগি করলেন ।
সেই সন্ধ্যা রাতের স্মৃতি আমার পরিষ্কার মনে আছে। আম্মু আব্বুর সাথে রাগ করছেন । আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন । একসময় আম্মুর রাগ কমে এলে আমি আব্বুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ।
আব্বুর শরীরটা খুব ফিট ছিল । তিনি অনায়াসে আমাকে গলায় ঝুলিয়ে রাখলেন ।
আমাদের বাসায় ছোটখাটো কিছু কেনা হলে আমরা রাতে বাইরে খেতে যেতাম । সেইরাতেও ব্যতিক্রম হয়নি । চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি ল্যাপটপটা আমার বিছানার নিচে ময়লা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম ।
আমি জানি চোর ময়লা কাপড় দেখলে ভাববে এটা দামি কিছু নয় ।
আমরা মোটামুটি সাধারণ মানের একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম । আমি খুব তাড়াতাড়ি খাচ্ছিলাম দেখে আম্মু মৃদু ধমক দিয়েছিলেন ।
ল্যাপটপ নিয়ে আমার দুঃশ্চিন্তা তো আম্মু জানেনা।
আব্বু তাঁর দুজন বন্ধুর সাথে বায়িং হাউজের ব্যবসা করতেন । আব্বুর বোধহয় তেমন লাভ হচ্ছিল না । নইলে আব্বুও নিশ্চয় রাশেদ আংকেল আর জুবের আংকেলের মতো গাড়ি কিনতেন ।
আমাদের সংসারে টাকার জৌলুস ছিলনা । কিন্তু আমরা সুখী ছিলাম । আব্বু মাঝেমাঝে আমাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন । দিনেদিনেই ফিরে আসতাম আমরা । একবার কক্সবাজার গিয়ে তিনদিন ছিলাম। রাতে ফেরার সময় প্রায়ই বাইরে খাওয়া হতো ।
আমি খেয়াল করে দেখেছি আব্বু চায়নিজ কিংবা সাধারণ রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের সাথেও ভালো ব্যবহার করতেন । আমাকেও তাদের সামনে থ্যাংকস দিতে বলতেন ।
আব্বু আমাকে আধুনিক মনমানসিকতায় বেড়ে ওঠার পাশাপাশি বিনয়ী আর আর ভদ্র ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন । আমি এগারো বছর বয়সে কোরান শরীফ পড়া শিখে ফেললাম ।
যে সপ্তাহে আমার কোরান শরীফ খতম হলো, সেই সপ্তাহের শুক্রবার বিকেলে আব্বু নিজে মাঝারি সাইজের বেশকিছু গোলগোল হালুয়া বানিয়ে আমাদের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের সব বাসায় পাঠালেন । মাগরিবের নামাজের সময় মসজিদেও নিয়ে গেলেন।
আব্বুর খুশি দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি আসছিল । বিকেলে আমার হুজুরের কাছে পড়তে ভালো লাগত না । আমি বরং ছাদে আমার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে পছন্দ করতাম । অবশেষে সপ্তাহে চারদিন করে দুই বছরে আমি কোরান শরীফ খতম করলাম ।
আমার কান্না আব্বু আম্মু কোনদিন দেখতে পাননি । আমার কান্নার জন্য প্রিয় ছিল বাথরুম । ট্যাপের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতাম আমি । বেশি কাঁদলে চোখ দুটো লাল হলে আম্মুর কাছে এসে বলতাম চোখে কী যেন কামড় দিয়েছে ।
আম্মু খুব একটা হাসতেন না । কিন্তু চোখে কামড় শুনলে মৃদু হেসে আঁচলে জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে আঁচলটা চোখে চেপে ধরতেন ।
আব্বু যে রাতে মারা গেলেন, সেই রাতের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে । খাওয়া শেষ হলে টেবিলে বসে আমরা গল্প করছিলাম ।
আব্বু হঠাৎ আম্মুকে ডেকে বললেন ; লায়লা, আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা ।
আম্মু চোখ তুলে তাকালেন । ততক্ষণে আব্বুর চোখেমুখে বেদনার ছাপ পড়তে শুরু করেছে । আব্বু বুকটা খামচে ধরে আছেন । বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি ।
আম্মুর কাঁধে ভর দিয়ে আব্বু বিছানায় শুয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালেন ।
আম্মু বড় মামাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য ফোন দিলেন । আমার বড় মামা এমনিতে রাগী মানুষ । কিন্তু খুব খারাপ পরিস্থিতিতে ওনার মাথা খুব ভালো কাজ করে ।
বড় মামা এম্বুলেন্স কল করে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে রওয়ানা হলেন ।
আমি আব্বার পাশে বসে মুখস্থ সব দোয়া দুরুদ পড়ছি । আমার চোখ দিয়ে এই প্রথম আব্বুর সামনে পানি পড়ছিল ।
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল । ভয় পাইনি কিন্তু প্রচন্ড হতাশা আর অবসাদ আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল । কীভাবে যেন টের পাচ্ছিলাম আব্বু মারা যাচ্ছেন ।
হটাৎ করে আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ; কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে ? আমি কি মারা যাচ্ছি না কি ?
আব্বু প্রাণপণে হাসতে চেষ্টা করছেন । কয়েকদিন ধরে আমাদের কলিংবেল কাজ করছেনা । দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ পেয়ে আমার ভেতর অদ্ভুত এক নিরাপত্তাবোধ কাজ শুরু করল ।
বড় মামা এসে গেছেন । আমি দরজা খোলার জন্য উঠতে গেলে আব্বু আমার বাঁহাত ধরে একটু কাছে টানলেন । আব্বুর চোখেমুখে অপার্থিব বেদনার ছাপ । তিনি সব কষ্ট উপেক্ষা করে আমাকে বুকে টেনে নিলেন ।
অনেকদিন পর আব্বুর বুকের ধুকধুক ধুকধুক শব্দ শোনার জন্য আমি জড়িয়ে ধরে আব্বুর বুকে কান পাতলাম । ক্ষীণ সেই শব্দটা ক্রমশ কমে যাচ্ছে । আব্বু আমাকে প্রাণপণে ধরতে চাইছেন ।
ওনার পেটানো শরীরের হাতদুটো সময়কালে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলো । তিনি আমার কপালে ঠোঁট রাখলেন । ক্রমশ শীতল হয়ে আসা ঠোঁটের স্পর্শে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি ।
আব্বু শ্বাস টেনে টেনে বললেন ; আম্মু, তোমাদের বড় ভালোবাসিরে মা । আব্বুর জন্য সবসময় দোয়া কর । আব্বু না থাকলেও তোমাদের কষ্ট হবে না ।
কথার সাথে আব্বুর হেঁচকি উঠল । তিনি বড় মামার দিকে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকালেন ।
বড় মামা আব্বুর বুকে এক হাতের উপর অন্যহাত রেখে জোরে জোরে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি কলেমা পড়ছেন । সেইসাথে চিৎকার করে বললেন ; রাজু, স্টে উইথ আস ।
অনেকদিন পর আব্বুকে কেউ নাম ধরে ডাকলেন ।
আব্বু বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে আমার দিকে তাকালেন । আব্বুর চোখের ভেতর আমি অসীম এক শূণ্যতা দেখলাম ।
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল ; আব্বু, তুমি ছাড়া আমার জীবন অচল হয়ে যাবে । আমি বলতে পারিনা ।
মানুষ কখনোই সময়মতো সঠিক কথা বলতে পারেনা ।
আমার মন বলছিল আব্বু পৃথিবীর কিছু দেখছেন না ।
একসময় এম্বুলেন্স এল । ততক্ষণে আব্বু ডানদিকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন । ওনার চোখ দুটো একটু খোলা ছিল ।
নাটক সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো বড় মামা চোখের পাতা দুটো আস্তে করে বুজিয়ে দিলেন ।
আমরা ঘন্টাদুয়েকের ভেতর ক্লিনিক থেকে আব্বুর লাশ নিয়ে ফিরে আসলাম ।
আব্বু মারা গেছেন বড়জোর বিশ মিনিটের ভেতর । অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমরা অনন্তকাল আব্বুর সামনে ছিলাম ।
আম্মু বিয়ে করবেন শুনে আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ।
আম্মুর সাথে খুব সাধারণ বিষয়ে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি বিয়ের প্রসঙ্গটা এমনভাবে তুললেন যেন বিয়ে নয়, আম্মু কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন ।
আমার দৃষ্টিতে রাগ ঘৃণা না কি অনুকম্পা খেলা করছে আমি জানিনা । কিন্তু আম্মু বাধ্য হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন ।
এই প্রথম আমি আম্মুকে পরাজিত হতে দেখলাম । কঠিন এই মহিলা সহজে মাথা নিচু করেন না ।
তিনি চোখ না তুলে অনেকটা জবাবদিহিতার সুরে বললেন ; দেখ মোনা, আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
আব্বু মারা গেছেন ঠিক উনিশ মাস তেইশ দিন আগে । আমি আঙুলে হিসেব করে রাখিনি । আমার গোপন একটা ডায়েরি আছে । খুব নিয়মিত না হলেও সেখানে আমি দুই তিনদিন অন্তর অন্তর অনেককিছু লিখে রাখি । বেশিরভাগ লেখায় ঘুরেফিরে আব্বুর স্মৃতিটাই ফিরে আসে ।
আমার বয়স এবার চৌদ্দ ছাড়িয়েছে । আমি এখন অনেককিছু বুঝতে পারি এবং টের পাই । আমার আশপাশের অনেকে আমাকে বোকা ভাবায় আমার সুবিধা হয়েছে । আমি তাঁদের বোকামি আগ বাড়িয়ে ভেঙে দিতে চাইনি কখনো ।
মানুষ বোকা থাকলে অনেক সুবিধা । যদিও আমি আগে তেমন ছিলাম না ।
কিন্তু আম্মু যে বিয়ে করবেন, আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি । তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটটাতে আমরা দুই ভাইবোন এক রুমে থাকি । মুনিমের বয়স মাত্র আট। আব্বু মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পর থেকে সে আমার সাথে থাকে ।
আম্মু মাঝেমাঝে অনেক রাত জেগে আব্বুর কম্পিউটারে কীসব কাজ করেন । মুনিমের ভালো লাগেনা ।
আমার সাথে থাকায় তার একটা সুবিধা হয়েছে । আমার পুরোনো ল্যাপটপটা সে সচল রেখেছে । আব্বু যেদিন আমার জন্য ল্যাপটপটা কিনে এনেছিলেন, আমি সেই ল্যাপটপ নিয়ে চিৎকার করে পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলেছিলাম । ল্যাপটপ কিনে টাকা নষ্ট করার জন্য আম্মু প্রথমে আব্বুর সাথে একটু রাগারাগি করলেন ।
সেই সন্ধ্যা রাতের স্মৃতি আমার পরিষ্কার মনে আছে। আম্মু আব্বুর সাথে রাগ করছেন । আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন । একসময় আম্মুর রাগ কমে এলে আমি আব্বুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ।
আব্বুর শরীরটা খুব ফিট ছিল । তিনি অনায়াসে আমাকে গলায় ঝুলিয়ে রাখলেন ।
আমাদের বাসায় ছোটখাটো কিছু কেনা হলে আমরা রাতে বাইরে খেতে যেতাম । সেইরাতেও ব্যতিক্রম হয়নি । চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি ল্যাপটপটা আমার বিছানার নিচে ময়লা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম ।
আমি জানি চোর ময়লা কাপড় দেখলে ভাববে এটা দামি কিছু নয় ।
আমরা মোটামুটি সাধারণ মানের একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম । আমি খুব তাড়াতাড়ি খাচ্ছিলাম দেখে আম্মু মৃদু ধমক দিয়েছিলেন ।
ল্যাপটপ নিয়ে আমার দুঃশ্চিন্তা তো আম্মু জানেনা।
আব্বু তাঁর দুজন বন্ধুর সাথে বায়িং হাউজের ব্যবসা করতেন । আব্বুর বোধহয় তেমন লাভ হচ্ছিল না । নইলে আব্বুও নিশ্চয় রাশেদ আংকেল আর জুবের আংকেলের মতো গাড়ি কিনতেন ।
আমাদের সংসারে টাকার জৌলুস ছিলনা । কিন্তু আমরা সুখী ছিলাম । আব্বু মাঝেমাঝে আমাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন । দিনেদিনেই ফিরে আসতাম আমরা । একবার কক্সবাজার গিয়ে তিনদিন ছিলাম। রাতে ফেরার সময় প্রায়ই বাইরে খাওয়া হতো ।
আমি খেয়াল করে দেখেছি আব্বু চায়নিজ কিংবা সাধারণ রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের সাথেও ভালো ব্যবহার করতেন । আমাকেও তাদের সামনে থ্যাংকস দিতে বলতেন ।
আব্বু আমাকে আধুনিক মনমানসিকতায় বেড়ে ওঠার পাশাপাশি বিনয়ী আর আর ভদ্র ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন । আমি এগারো বছর বয়সে কোরান শরীফ পড়া শিখে ফেললাম ।
যে সপ্তাহে আমার কোরান শরীফ খতম হলো, সেই সপ্তাহের শুক্রবার বিকেলে আব্বু নিজে মাঝারি সাইজের বেশকিছু গোলগোল হালুয়া বানিয়ে আমাদের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের সব বাসায় পাঠালেন । মাগরিবের নামাজের সময় মসজিদেও নিয়ে গেলেন।
আব্বুর খুশি দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি আসছিল । বিকেলে আমার হুজুরের কাছে পড়তে ভালো লাগত না । আমি বরং ছাদে আমার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে পছন্দ করতাম । অবশেষে সপ্তাহে চারদিন করে দুই বছরে আমি কোরান শরীফ খতম করলাম ।
আমার কান্না আব্বু আম্মু কোনদিন দেখতে পাননি । আমার কান্নার জন্য প্রিয় ছিল বাথরুম । ট্যাপের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতাম আমি । বেশি কাঁদলে চোখ দুটো লাল হলে আম্মুর কাছে এসে বলতাম চোখে কী যেন কামড় দিয়েছে ।
আম্মু খুব একটা হাসতেন না । কিন্তু চোখে কামড় শুনলে মৃদু হেসে আঁচলে জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে আঁচলটা চোখে চেপে ধরতেন ।
আব্বু যে রাতে মারা গেলেন, সেই রাতের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে । খাওয়া শেষ হলে টেবিলে বসে আমরা গল্প করছিলাম ।
আব্বু হঠাৎ আম্মুকে ডেকে বললেন ; লায়লা, আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা ।
আম্মু চোখ তুলে তাকালেন । ততক্ষণে আব্বুর চোখেমুখে বেদনার ছাপ পড়তে শুরু করেছে । আব্বু বুকটা খামচে ধরে আছেন । বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি ।
আম্মুর কাঁধে ভর দিয়ে আব্বু বিছানায় শুয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালেন ।
আম্মু বড় মামাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য ফোন দিলেন । আমার বড় মামা এমনিতে রাগী মানুষ । কিন্তু খুব খারাপ পরিস্থিতিতে ওনার মাথা খুব ভালো কাজ করে ।
বড় মামা এম্বুলেন্স কল করে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে রওয়ানা হলেন ।
আমি আব্বার পাশে বসে মুখস্থ সব দোয়া দুরুদ পড়ছি । আমার চোখ দিয়ে এই প্রথম আব্বুর সামনে পানি পড়ছিল ।
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল । ভয় পাইনি কিন্তু প্রচন্ড হতাশা আর অবসাদ আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল । কীভাবে যেন টের পাচ্ছিলাম আব্বু মারা যাচ্ছেন ।
হটাৎ করে আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ; কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে ? আমি কি মারা যাচ্ছি না কি ?
আব্বু প্রাণপণে হাসতে চেষ্টা করছেন । কয়েকদিন ধরে আমাদের কলিংবেল কাজ করছেনা । দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ পেয়ে আমার ভেতর অদ্ভুত এক নিরাপত্তাবোধ কাজ শুরু করল ।
বড় মামা এসে গেছেন । আমি দরজা খোলার জন্য উঠতে গেলে আব্বু আমার বাঁহাত ধরে একটু কাছে টানলেন । আব্বুর চোখেমুখে অপার্থিব বেদনার ছাপ । তিনি সব কষ্ট উপেক্ষা করে আমাকে বুকে টেনে নিলেন ।
অনেকদিন পর আব্বুর বুকের ধুকধুক ধুকধুক শব্দ শোনার জন্য আমি জড়িয়ে ধরে আব্বুর বুকে কান পাতলাম । ক্ষীণ সেই শব্দটা ক্রমশ কমে যাচ্ছে । আব্বু আমাকে প্রাণপণে ধরতে চাইছেন ।
ওনার পেটানো শরীরের হাতদুটো সময়কালে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলো । তিনি আমার কপালে ঠোঁট রাখলেন । ক্রমশ শীতল হয়ে আসা ঠোঁটের স্পর্শে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি ।
আব্বু শ্বাস টেনে টেনে বললেন ; আম্মু, তোমাদের বড় ভালোবাসিরে মা । আব্বুর জন্য সবসময় দোয়া কর । আব্বু না থাকলেও তোমাদের কষ্ট হবে না ।
কথার সাথে আব্বুর হেঁচকি উঠল । তিনি বড় মামার দিকে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকালেন ।
বড় মামা আব্বুর বুকে এক হাতের উপর অন্যহাত রেখে জোরে জোরে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি কলেমা পড়ছেন । সেইসাথে চিৎকার করে বললেন ; রাজু, স্টে উইথ আস ।
অনেকদিন পর আব্বুকে কেউ নাম ধরে ডাকলেন ।
আব্বু বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে আমার দিকে তাকালেন । আব্বুর চোখের ভেতর আমি অসীম এক শূণ্যতা দেখলাম ।
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল ; আব্বু, তুমি ছাড়া আমার জীবন অচল হয়ে যাবে । আমি বলতে পারিনা ।
মানুষ কখনোই সময়মতো সঠিক কথা বলতে পারেনা ।
আমার মন বলছিল আব্বু পৃথিবীর কিছু দেখছেন না ।
একসময় এম্বুলেন্স এল । ততক্ষণে আব্বু ডানদিকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন । ওনার চোখ দুটো একটু খোলা ছিল ।
নাটক সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো বড় মামা চোখের পাতা দুটো আস্তে করে বুজিয়ে দিলেন ।
আমরা ঘন্টাদুয়েকের ভেতর ক্লিনিক থেকে আব্বুর লাশ নিয়ে ফিরে আসলাম ।
আব্বু মারা গেছেন বড়জোর বিশ মিনিটের ভেতর । অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমরা অনন্তকাল আব্বুর সামনে ছিলাম ।