What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

দেখি নাই ফিরে (উপন্যাস) (2 Viewers)

বলা যাবে না।
অন্যদিন কাজটা করলে হতো না।
না।
আমায় জিজ্ঞাসা করলে কি জবাব দেব।
বলবে সকালে উঠে চলে গেছে, দেখা হয়নি।
কখন আসবি।
বলতে পারছিনা।
তারমানে!
কাজটা শেষ করে আসতে হবে।
কালকেই করতে হবে।
ভেবেছিলাম তোমাকে বলবো না। তোমরা কেউ জানতেই পারবে না। তখন কথায় কথায় বললে একটু বললে যদি ঝামেলা কমে তাহলে বলবিনা কেন তাই হিন্টস দিলাম।
ফোনটা অন্ততঃ পক্ষে খোলা রাখিস।
হয়তো হবে না।
দুপুরে এসে খাবি।
চেষ্টা করবো।
আবার কোন গন্ডগোল পাকাচ্ছিস।
না।
ঠিক।
তুমি বিশ্বাস করতে পার।
ভজুরাম মাথাটা বেশ ভালো ম্যাসাজ করে। এমনভাবে টেপে মাথাটা একেবারে হাল্কা হয়ে যায়। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। ঠিক সময়ে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখলাম ওরা দু’জনে অঘোরে ঘুমচ্ছে। আমি মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেস হলাম। জামা প্যান্ট পরলাম। আলমাড়ি থেকে জাঙ্গিয়া বার করে পরতে ভুললাম না। ফ্ল্যাটের চাবিটা দেখে নিলাম টেবিলের ওপর আছে কিনা। মোবাইলের ঘরিতে দেখলাম, পৌনে পাঁচটা বাজে। বাইরে হাল্কা আলো। আমি বেরিয়ে এলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজকের কাজটা আমার জীবনের একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আমাকে এই কাজটা ঠিক মতো শেষ করতেই হবে।
দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে লক করে দিলাম। সোজা নিচে নেমে এলাম। এখনো ঠিক ঠিক আলো ফোটে নি। রাস্তার নিওন আলো গুলো সমান তেজে জ্বলছে। গেটের মুখে সেই ছেলেটি। ঝিমচ্ছে। ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম। চমকে উঠে পরলো।
দাদা আপনি! এত সকালে ?
একটু বেরবো দরজাটা একবার খুলে দাও।
ছেলেটি চাবি নিয়ে এসে দরজা খুললো। আমি বেরিয়ে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এলাম গড়িয়াহাট। সকালে সবাই মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। মোটা মোটা থল থলে চেহারার মানুষ। সব বয়সের। কেউ কেউ আবার গোল পার্কের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো লেকে ঢুকবে। সকাল হতে না হতে কতো লোকের কতো কাজ। আমি যেমন চলেছি মানুষ খুঁজতে।
নিজের মনে নিজে হাসলাম। একটু জোরে হেসে ফেলেছি। একবার পেছন ফিরে দেখলাম। না আমার আশে পাশে কেউ নেই।
চায়ের দোকনটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। এককালে রোজ এখানে চা খেতাম। এখন খাই না। তাই আমাকে চেনার বালাই নেই। জলের মগটা নিয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেলাম। তারপর একভাঁড় চা একটা বিস্কুট সহযোগে মারলাম। বাড়িতে থাকলে একটু আতিথেয়তা পেতাম, এখানে তার বালাই নেই।
পয়সা ফেকো তামাসা দেখো। ভাঁড়টা সঠিক জায়গায় ফেলে একটা সিগারেট কিনলাম। কালকের কেনা বেশ কয়েকটা ক্যান্ডি পকেটে পরে আছে। সিগারেট ধরালাম। এতো সকালে কোনদিন সিগারেট খাই না। গলায় লাগলো, খক খক করে কেশে উঠলাম।
দুর শালা বলে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলদিলাম।
আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দেশপ্রিয় পার্কের মুখে এসে বাস উঠলাম।
কন্ডাকটর টিকিট চাইল। বললাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। কলকাতায় বিখ্যাত কালীবাড়ি। আমাদের কলেজের সামনে।
বলতে গেলে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। মিত্রা আমি দু’একবার এখানে এসেছি। পূজোও দিয়েছি। ঘন্টাখানেক লাগল এখানে আসতে। বাস থেকে নামলাম। বিশেষ ভিড় নেই। মন্দিরে ঢুকে প্রণাম করলাম। আমার খুব একটা ধর্মে মতি নেই। তবু মনকে প্রশ্ন করলাম আজ এলাম কেন ? উত্তর পেলাম না। যেটুকু আচার ধর্ম পালন করার দরকার, তাই করলাম।
তিনটে প্যাকেটে পূজো দিলাম একটা মিত্রা আমার নামে, একটা বড়মা দাদার নামে আর একটা ছোটমা মল্লিকদার নামে। ব্রাহ্মণ মশাই গোত্র জিজ্ঞাসা করলেন বলতে পারলাম না। পূজোর প্রসাদী আমার হাতে দিলেন। আমি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
ঠিক পাশেই বীণা সিনেমা। হলের নীচের সিঁড়িতে একটু বসলাম। হুড় মুড় করে কতো কথা মনে পরে যাচ্ছে। নিজের মনেই হেসে বললাম, থামনা বাপু। অনেক হয়েছে। আর ভালো লাগছে না। তবু চোখের সামনে মিত্রা আমার হাত ধরে বুকে রেখেছে, বোঝার পর আমার হাত সরিয়ে নেওয়ার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে মনে হাসলাম। দূর, উঠে পরলাম। আমার চেনা রাজপথ। আমার কলেজ জীবন কেটেছে এই রাজপথে। অলিতে গলিতে কত স্মৃতি আঁকি বুকি কাটা হয়ে রয়েছে।
সোজা কলেজ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শ্যামবাজার চলে এলাম। গোলবাড়ির বড়ো ঘরিতে দেখলাম সোয়া সাতটা বাজে। এতোক্ষণে বাড়িতে হুলুস্থূলুস কান্ড বেঁধে গেছে। ইসলামভাই-এর সাপ-সাপান্তর চলছে। শ্যামবাজার বাটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। এই প্রথম আমি মনে হয় ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
চোখ বন্ধ করতেই ঠনঠনিয়া কালীমার মুখটা ভেসে উঠলো। মনে মনে বললাম আজ আমি যেখানে যাচ্ছি, আমাকে সেখানে জিততেই হবে। তুমি আমার সঙ্গে থেকো। মায়ের হাসি হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে এলো।
যেন মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে বল পাচ্ছি। কেন এমন হচ্ছে ? এটা হওয়ার কথা নয়। এর আগে বহু সমস্যা সঙ্কুল কাজ আমি করেছি। তখন এমন মনে হয় নি।
তাহলে আজ কেন হচ্ছে ? পায়ে পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
গলি পথ পেরিয়ে সেই বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। না এখনো সেই রকম আছে। গত দশ বছরে তার কোন পরিবর্তন হয় নি। হয়তো পলেস্তরা খসিয়ে দেয়ালে নতুন পলেস্তরা পরেছে। সেই দরজা। কড়া দুটোও সেই রকম। আমি আস্তে করে কড়া নারলাম। একবার দুবার তিনবার। দরজা খুলে গেল।
বছর পাঁচেকের একটা ছেলে। এক মাথা ভর্তি চুল। কি মিষ্টি দেখতে।
তুমি কাকে খুঁজছো।
আমি ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি।
বলোনা আংকেল, তুমি কাকে খুঁজছো।
কি বলবো এই দুধের শিশুকে। আমি কিসের টানে এই বাড়িতে, এই সাত সকালে ছুটে এসেছি।
কেরে পিকু কার সঙ্গে কথা বলছিস।
ভেতর থেকে মহিলা কন্ঠ ভেসে এলো। দশবছর আগে এই গলার স্বর শুনেছি। মেলাবার চেষ্টা করলাম। সেই কিনা।
একটা আংকেল এসেছে। কথা বলছে না। বোবা।
হেসে ফেললাম।
আবার হাসছে দেখো না।
মুখ বাড়িয়ে ভেতরে তাকালাম। না কারুর দেখা নেই। আমি পকেট থেকে একটা ক্যান্ডি বার করলাম। পিকুর চোখের সামনে ধোরলাম।
আমি খাই না। দাঁতে পোকা হবে।
হাসলাম। মনে মনে বললাম কি পাকা পাকা কথা রে বাবা।
নাও না এটা খেলে পোকা হবে না। সব পোকা মরে যাবে।
মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো, তুমি কথা বলতে পার।
হাসলাম।
মা বকবে।
বকবে না। আমি মাকে বকে দেবো।
তুমি আমার মাকে চেনো।
হুঁ।
কেরে পিকু।
দরজার সামনে এই মুহূর্তে যে এসে দাঁড়াল তাকে আমি দশ বছর আগে দেখেছি। মুখশ্রীর কোন পরিবর্তন হয় নি। সিঁথির সিঁদুর বেশ ঝকঝকে। এখুনি স্নান করে উঠে এসেছে, গায়ার রং আগের মতোই। মাজা মাজা। আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে, আমিও তাকিয়ে আছি। চোখের দৃষ্টিতে বিষ্ময়। চেনা চেনা মুখ, তবু যেন অচেনা।
আংকেল তুমি যে বললে মাকে চেন।
ইসিতা পিকুকে হাত ধরে ভেতরে টেনে নিল। মুখের রং বদলে গেল। কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
কেন এসেছিস ?
ইসিতা গলার কাঠিন্য তবু লোকাতে পারল না।
মা তুমি আংকেলকে বকছো কেন ?
থামো, পাকা পাকা কথা বলতে হবে না।
কেগো ইসিতা। ভেতর থেকে পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
ইসিতা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
বাইরে দাঁড়িয়েই সব কথা বলবো।
আমি খুব মৃদু স্বরে ইসিতার দিকে তাকিয়ে বললাম।
পেছনে একজন বছর পঁয়ত্রিশের ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন।
স্টাউট ফিগার। একটা বাটিক প্রিন্টের লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবী পরা।
কাকে চান আপনি ?
ইসিতা মাথা নীচু করে আস্তে করে বললো, ও অনি।
অনি! তোমাদের সেই অনি।
হ্যাঁ।
আশ্চর্য, ওনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন, ভেতরে আস্তে দাও।
পিকু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আসুন আসুন।
ইসিতা গেট থেকে সরে দাঁড়াল, আমি ধীর পায়ে ভেতরে এলাম। নিচের বসার ঘরটা সেরকমই আছে। সেই টেবিল। এখানে কতো স্মৃতি আঁকা হয়ে রয়েছে। এই দু’বোনের সঙ্গে কতো কথা বলেছি এই টেবিলে বসে। হুড়মুড় কর সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি চারিদিকে একবার তাকালাম। আট দশবছর আগেকার স্মৃতি। ফাইন্যালের রেজাল্টটা নিয়ে আমি শেষবারের মতো এই বাড়িতে পা রেখেছিলাম। সেদিন মিত্রার তথাকথিত মা আমার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেন নি। তারপর দু’একবার মিত্রার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মাস খানেকের মধ্যে। তারপর আমি হারিয়ে গেলাম।
বসুন।
ইসিতা নিশ্চই আপনার সহধর্মিনী।
আমি বরুন মুখার্জী।
আমি অনি….।
আপনার গল্প বহু শুনেছি ইসির মুখ থেকে। তাছাড়া আপনি একজন রিনাউন্ড পার্সেন। আপনাকে কলকাতায় একডাকে সকলে চেনে। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন বসুন।
উনি টেবিলের অপর্জিট চেয়ারে বসলেন। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। আগেকার দিনের কাঠের চেয়ার। অযত্নে মলিন।
বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিস। ইসিতা বললো।
গতকাল সন্ধ্যায়।
তার মানে!
হাসলাম।
এতো সকালে কোথা থেকে আসছিস!
এইতো, ঘুরতে ঘুরতে এসে পরলাম।
সেতো দেখতে পাচ্ছি।
আমি বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছি। ভদ্রলোক আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। পরিষ্কার মাপছে।
ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
দশবছর সময়টা নেহাত কম নয়। একটু অপেক্ষা কর, বোধগম্য হবে।
ইসিতা আমার কথায় চমকে উঠলো।
যাও তুমি চা করে নিয়ে এসো। উনি….।
প্লীজ বরুনদা আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি ইসিতার সমবয়সী।
প্রথম প্রথম হবে না। একটু সময় লাগবে।
পিকুকে দেখতে পেলাম না।

ইসিতা বেরিয়ে গেল। এই বাড়ির নিচেরটা বসারঘর, খাবারঘর, রান্নাঘর, গেস্টরুম, ওপরে সব থাকার ঘর। বেশ মনে আছে। ওপরে আমি দুবার উঠেছি। তিনতলায় মিত্রাদের পড়ার ঘর।
আপনার লেখা আমি পড়ি।
বরুনদার দিকে তাকালাম।
সরি তোমার লেখার হাতটা দারুণ।
হাসলাম।
কাগজে চাকরি করি। যে যেভাবে বলে লিখে দিই।
তুমি চাকরি করো!
হ্যাঁ।
তাহলে যে লোকে বলে তুমি ওই কাগজের মালিক!
লোকে বলে। আমি বলি না। আমায় দেখে কি তাই মনে হয় ?
সেটা ঠিক বলেছ। তোমাকে দেখে কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না।
তাহলে।
আমি আমার অফিসের কাজে প্রায় তোমাদের কাগজের অফিসে যাই।
তাই! কেন ?
আমাদের কোম্পানীর কাজে।
আপনি কোথায় আছেন।
আইবিএম। তোমাদের কমপিউটার ডিভিসনটা আইবিএমকে মেনটেনান্সের দায়িত্ব দেওয়া আছে।
সফটওয়ার না হার্ডওয়ার।
সফটওয়ার।
তার মানে আপনি সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার।
বরুণদা হাসলেন।
ওটা আপনাদের কাগজ।
শুনেছি, একসময় ছিলো। এখন নেই।
কে বললো।
এদের মুখ থেকেই শুনি।
একটু খানি নাড়া চাড়া করেই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক খুব অমায়িক। রাখঢাক নেই।
ইসিতা ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকলো।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ইসিতা সকালে ঠনঠনিয়াতে গেছিলাম। প্রসাদ আছে। জ্যেঠিমনিকে দিয়ে আয়। পিকুকে দেখতে পাচ্ছি না।
ইসিতা আমার দিকে তাকিয়ে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে অনি কি ভাবে অন্দরমহলে প্রবেশ করতে চাইছে। আমি ওর চোখ দেখে বুঝতে পারছি। ও কিছুতেই আমাকে অন্দরমহলে প্রবেশ করতে দেবে না।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম অনি তুই যখন একবার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে পেরেছিস। তোকে জিততেই হবে। যে করেই হোক। কারুর বাধা তুই শুনবি না।
মা পূজো না করে কিছু খান না।
জানি। এটা কিন্তু পূজোরই প্রসাদ।
ইসিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো।
নাও চা খাও। বরুণদা বললো।
হ্যাঁ নিচ্ছি।
একটা কাপ এগিয়ে নিলাম। চায়ে চুমুক দিলাম।
প্রশ্ন করলি না এতোবছর পরে হঠাৎ কেন এতো সকালে এসে উপস্থিত হলাম।
ইসিতা আমার চোখে চোখ রেখেছে। শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি।
বিয়ে করছিস তাই নেমন্তন্ন করতে এসেছিস। ইসিতা টেরা টেরা কথা বলা শুরু করলো।
বৌভাতের দিন কেউ নেমন্তন্ন করতে আসে।
তোর আজকে বৌভাত!
কেন তুই জানতিস না।
বরুণদার দিকে তাকালাম।
দাদা ইসিতার সামনে আপনি একটা সত্যি কথা বলবেন।
বলো।
আমি অনি। এই নামটা আপনি শুনেছেন। হয়তো আমার সম্বন্ধে অনেক গল্পও আপনি ইসিতার মুখ থেকে শুনে থাকবেন। ভালো খারাপ দুটোই। এটা কি আপনি শোনেন নি আমি পর্শুদিন বিয়ে করেছি, ইসিতার আর এক বোন মিত্রাকে ? আর আজ আমার বৌভাত।
বরুণদা মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইল।
ও কিছু জানে না।
ইসি বরুণদার থেকেও তুই আমাকে ভাল করে চিনিস। কেন আমি এসেছি এই সাত সকালে, নতুন করে বলতে হবে ?
আমাদের সঙ্গে মিত্রার কোন সম্পর্ক নেই।
সেটা আমি জেনেছি পর্শুরাতে। কেন নেই সেটাও জেনেছি।
ইসিতা চুপ করে রয়েছে। চায়ে চুমুক দিল।
আমি মিত্রাকে বিয়ে করছি এটা জানলি কি করে ?
আমি চায়ে চুমুক দিলাম। নিস্তব্ধ ঘর। পিন পরলে শব্দ হবে। বরুণদা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পরছে না।
তোকে বলতে হবে না। আমি বলছি।
ইসিতা আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। চোখ দুটো জিঘাংসায় পরিপূর্ণ। পারলে আমাকে এখুন ছিঁড়ে খাবে যেন।
বুড়ীমাসি এসে বলেছে।
বুড়ীমাসি এ বাড়িতে আসে না। ইসিতা চেঁচিয়ে উঠলো।
বরুণদা মুখ নামিয়ে নিল।
আমি কিন্তু এ বাড়িতে এসেছি তোদের নিয়ে যেতে।
কোনদিন হবে না।
আমি এই কাজ করবোই।
আমার গলার স্বরে ঘরটা গম গম করে উঠলো।
তুই কি বলতে চাস।
আমি এই পরিবারের আত্মীয়। বরুণদার মতো আমিও এই বাড়ির জামাই। সেই দৃষ্টিকোন থেকে আমার কিছু ডিমান্ড আছে। আমি আমার সেই ডিমান্ড জানাতে এসেছি।
জানাতে এসেছিস জানালি, এবার চলে যা।
আমি চলে যেতে আসি নি ইসি।
ইসির চোখে প্রতিহিংসা।
কাল সারাটা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ছটফট করেছি। জ্যেঠিমনির সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে।
করুণা দেখাতে এসেছিস। বেরো এখান থেকে।
ইসিতা দপ করে জ্বলে উঠলো।
বরুণদা উঠে দাঁড়াল।
এ কি বলছো ইসি। অনি আমাদের….।
রাখো। আজ আট বছর কোথায় ছিল অনি। কে খোঁজ খবর নিয়েছে, আমরা কেমন আছি।
ইসিতা রাগে কাঁপছে।
তুই এখুনি আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। ইসিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
আমি যাব না ইসি। তুই আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেও আমি যাব না। আজ থেকে দশবছর আগে আমি যেটা মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছি। আজ আমি কিছুতেই সেটা মানব না।
তুই মানিস কি না মানিস তোর ব্যাপার, তুই এখন বেরিয়ে যা।
ইসিতা উঠে দাঁড়াল। ছুটে এসে আমার হাত ধরলো।
এই ইসি, এ তুমি কি করছো! তুমি অনির হাত ছাড়ো।
ও এখুনি বেরিয়ে যাবে, আর একমুহূর্ত এই বাড়িতে ওর থাকা হবে না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি ওপরে চলো। অনি তুমি একটু বসো।
বরুণদা ইসিতাকে ধরে ওপরে নিয়ে চলে গেল।
আমি বসে রইলাম। একা।
কতোক্ষণ বসে আছি জানি না। নানা কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইসিতা যে ব্যবহারটা আমার সঙ্গে করলো, আমি তাতে একটুও দুঃখ পাই নি। কেননা আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম তাহলে এর থেকেও খারাপ ব্যবহার করতাম।
মিত্রার বাবা ইসিতাদের ফাঁকি দিয়েছে। তার লক্ষ্য চরিতার্থতার জন্য। অতএব বাবার কৃতকর্মের ফল মিত্রাকে ভোগ করতে হতেই পারে।
যতো সময় যাচ্ছে আমার মধ্যে তত জেদ চেপে বসছে। আমাকে যে ভাবেই হোক জ্যেঠিমনিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি এই কাজ করবই। এইটুকু কথা বলে যেটুকু বুঝলাম ইসি সব জানে না যা মিত্রা জানে। বরুণদাও জানে না। পারিবারিক এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা জামাইদের জানান যায় না। এমনকি তাদের পরিবারের কেউ জানতেও পারে না।
সময়ে সেটা আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতে দাউ দাউ করে জলে ওঠে তারপর একসময় সেই আগুন ছাই চাপা পরে যায়। কালের নিয়মে তা মাটিতে পরিণত হয়।
মিত্রা আমাকে যা জানিয়েছে, তা ইসি জানে কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মিত্রা তার বাবার দিনলিপি পরে সব জেনেছে। ইসি তা কোনদিন হাতে পায় নি। এমনকি জ্যেঠিমনি পর্যন্ত মিত্রার বাবার দিনলিপির হদিস জানতেন না। ওদের অনেক কিছুই অজানা। আমার হাতে প্রচুর অস্ত্র। যে কোন অস্ত্রের বিনিময়ে আমাকে জিততেই হবে।
অনি।
বরুণদার ডাকে মুখ তুলে তাকালাম।
দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তাঁকে আমি আজ থেকে দশ বছর আগে দেখেছি। সেই পাকা গমের মতো গায়ের রং এখনো অটুট। সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো টিকলো নাক। মাথার চুলে এখোনো সেইভাবে পাক ধরে নি। দু’একটা রূপালি তার এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি মারছে।
সাদা ধবধবে কালো পাড় শাড়ি পরা। গালদুটো সামান্য ভেঙেছে।
আমি এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
থাক বাবা থাক।
আমায় চিনতে পেরেছ জ্যেঠিমনি ?
ইসি না বললে পারতাম না। বয়স হয়েছে, চোখের জ্যোতি কেমেছে।
তুমি কেমন আছ।
ভালো।
আমি মিত্রাকে বিয়ে করেছি।
ইসি বললো।
আমি জ্যেঠিমনির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। বুঝতে পারলাম জ্যেঠিমনি সত্যি বলছে না। উত্তেজনা হীন চোখ। পোর খাওয়া মানুষ। আমি হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম। জ্যেঠিমনি বসলো।
তোমরা কথা বলো। আমি একটু চা নিয়ে আসি।
বুঝলাম বরুণদা আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে গেলেন।
তোমার জন্য পূজোর প্রসাদ নিয়ে এসেছি, খাবে ?
জ্যেঠিমনি আমার দিকে তাকাল। অনেক না বলা কথা এই চোখে।
রাখো, পরে খাচ্ছি।
বরুণদা বেরিয়ে গেল।
পিকু কোথায়। ?
ওর কথা আর বোলো না। ওপরে দুষ্টুমি করছে।
আমার আজ বৌভাত, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
জ্যেঠিমনি আমার দিকে তাকাল। এ চোখে অনেক জিজ্ঞাসা।
আমি কোথাও বেরোই না বাবা।
আজ বেরবে, শুধু মাত্র আমার জন্য বেরবে। মাত্র দশমিনিটের জন্য আমার সঙ্গে যাবে। আমি তোমায় আবার পৌঁছে দিয়ে যাব।
না বাবা থাক, আর একদিন যাব।
ইসিতা বরুণদা ঘরে ঢুকলো। মিষ্টিরপ্লেট এবং চা হাতে। ইশিতা মুখ নীচু করে আছে। বুঝলাম ওপরে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছে। মুহূর্তের উত্তেজনা। তার রেশ ওর চোখের পাতায়।
আমি তাকালাম না।
আমি কিছু খাব না ইসি, খালি চা খাব।
কেন বাবা, তুমি আজ প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে।
আজ প্রথম নয় জ্যেঠিমনি, এর আগেও বহুবার এসেছি। তোমার হাতের তৈরি বাটি চচ্চড়ি লুচি খেয়ে গেছি।
সেতো বহুকাল আগে।
আজ আমি এবাড়িতে নতুন নয়।
তুমি নতুন জামাই বলে কথা।

এটা তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ না জ্যেঠিমনি। ইসিও মানতে চাইছে না।
 
জ্যেঠিমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
যদি তাই হতো আমার সঙ্গে একবার যেতে।
না বাবা তা হয় না।
কেন হয় না জ্যেঠিমনি, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না….।
সে তুই জানিস না। তোকে তো বলেছি আমাদের সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নেই। ইসিতা খুব নীচু স্বরে বললো।
আমি ইসিতার দিকে তাকালাম। চেয়ার থেকে উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। ওর চোখে চোখ রাখলাম।
আমার ওপর তুই রাগ করতে পারিস, অভিমান করতে পারিস। আমি হয়তো তোকে অনেক ছোটবড়ো কথা বলে ফেলেছি। কিন্তু তুই তোর বনের ওপর রাগ করতে পারিস না।
কে বলেছে ও আমার বোন। একটা নোংরা মেয়ে। বাজারের….। ইসি দপ করে জ্বলে উঠলো।
আমি ততধিক নরম, খুব আস্তে ধীরে বললাম।
ঠিক বলেছিস। এটা ওর প্রাপ্য।
ইসি।
জ্যেঠিমনির গলার কঠিন স্বরে ঘরটা গম গম করে উঠলো।
তোমার মুখ থেকে ওর সম্বন্ধে আর কোন কথা যেন না শুনি।
মা! তুমিই তো….।
জ্যেঠিমনির স্থির চোখে শাসনের ছোঁয়া।
ইসি চুপ করে গেল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
নাও বাবা খাও। সকাল থেকে কিছু খাওনি।
জ্যেঠিমনির গলা থেকে স্নেহ ঝরে পরছে।
না জ্যেঠিমনি, আমি চা ছাড়া কিছু খাব না।
কেন।
খেতে আমি পারি জ্যেঠিমনি একটা সর্তে।
জ্যেঠিমনি আমার চোখের দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো আমি কি বলতে চাই।
আমাকে তোমার ঘরে একবার নিয়ে যেতে হবে।
সে যাবে খোন। এটা আবার বলতে হয় নাকি।
তাহলে চলো। তোমার ঘরে যাই। তারপর নিচে নেমে এসে নতুন জামাই হিসেবে মিষ্টি মুখ করে আমি বেরিয়ে যাব। অনি তোমাদের কাছে আর কোনদিন আসবে না।
ঠিক আছে তুমি চাটা খাও।
এখন খাব না। ওই যে বললাম তোমায়।
ইসিতা আমার দিকে তাকিয়ে।
ইসি আমি যদি জ্যেঠিমনিকে নিয়ে কিছুক্ষণ ওপরে সময় কাটাই তোদের আপত্তি আছে।
এমা ওদের আপত্তি থাকবে কেন। তুমিতো আমার ঘরে যাবে।
হয়তো থাকতে পারে। যদি থাকে তাহলে যাব না। আমি এখান থেকেই চলে যাব।
পাগল ছেলের কান্ড দেখ। ঠিক আছে তুমি চলো আমার সঙ্গে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বরুণদা ইসি নিশ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে। আমি জ্যেঠিমনির পেছন পেছন ওপরে উঠে এলাম। ইসি আমার দিকে একবার ড্যাব ড্যাব করে তাকাল। বুঝতে পারছি, ওর চোখের আগুন আমাকে পুরিয়ে মারবে।
দশ বছর আগের স্মৃতিটাকে একবার ঝালিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। জ্যেঠিমনির ঘরে তিনটে ছবি আছে একটা মিত্রা আর ইসির বছর দশেক বয়সের একটা ছবি। আর একটা ইসির বাবার আর একটা মিত্রার বাবার।
এই তিনটে ছবি ছাড়া দু’একটা ক্যালেন্ডার, আর ঠাকুর দেবতার ছবি।
এছাড়া আছে একটা পুরনো দিনের খাট দুটো কাঠের আলমাড়ি।
আমি পায়ে পায়ে জ্যেঠিমনির ঘরে এসে ঢুকলাম। অবাক হয়ে গেলাম। দশ বছর আগে যেখানে যে ভাবে দেখেগেছি ঠিক সেই ভাবেই আছে। সব কিছুই মলিন। ঝকঝকে তকতকে নয়। সেই ইজিচেয়ার। আমার ঘরে যেরকম একটা আছে। আমি চারিদিক একবার ভাল করে লক্ষ্য করলাম। আমার মুখ থেকে কোন কথা সড়ছে না।
আমি মিত্রা আর ইসির ছবিটার কাছে এলাম। ফ্রক পরে দু’বোন ছাদে দাঁড়িয়ে। দু’জনেরই মুখ অনেক ভেঙেচুড়ে গেছে। কিন্তু আদলটা এখনো সেই রকম। শুনেছি ইসির থেকে মিত্রার বয়সের ডিফারেন্স বেশি নয়। পিঠো পিঠি।
বোসো।
ফটোর সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম। কোথা থেকে শুরু করবো। মনে মনে ঠিক করার চেষ্টা করলাম। মনকে বোঝালাম অনি তোর এটা শেষ সুযোগ। তুই এখন একা জ্যেঠিমনির সামনে। তোকে বোঝাতেই হবে কেন তুই এখানে ছুটে এসেছিস, কেন তুই আজই জ্যেঠিমনিকে নিয়ে যেতে চাস।
তোকে জ্যেঠিমনির দুর্বল জায়গাটায় দারুণ ভাবে আঘাত করতে হবে। অনেক দিনের জমান আক্রোশ তোকে একধাক্কায় টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিতে হবে। তবেই তুই জিতবি। এবার তোর খেলা। তুই এই খালায় দারুণ পটু।
জ্যেঠিমনি।
জ্যেঠিমনি আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমি আবার ছবিটার দিকে ঘুরলাম।
আচ্ছা। এই ছবিদুটো (মিত্রার বাবার ছবিটারও উল্লেখ করলাম) তুমি আজও টাঙিয়ে রেখেছ কেন।
আছে, থাক। জ্যেঠিমনি খুব আস্তে কথা বললো।
কেন থাকবে ? এদের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক নেই যেখানে।
কে নামাবে বলো। লোকের অভাব।
আমি নামিয়ে দিই।
না। ওরা ছবিতেই থাকুক।
আমি দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা সামান্য ভেজিয়ে দিলাম। ফিরে এসে জ্যেঠিমনি সামনে দাঁড়ালাম। জ্যেঠিমনি আমাকে দেখছে। বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে অসীম যুদ্ধ চলছে। আমি আবার মিত্রা আর ইসির ফটোটার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
জ্যেঠিমনি আবার সেই অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না। দুই বোন একসঙ্গে তোমার কাছে আসবে, থাকবে, খুনসুটি করবে। তুমি তাদের সন্তানদের সঙ্গে খেলা করবে গল্প করবে, যেমন তুমি পিকুর সঙ্গে করো।
সে হয় না অনি।
কেন হয় না জ্যেঠিমনি। একটা ভুলকে গেড়ো দিয়ে রেখে লাভ কি।
ভুল সেটা ভুল, তাকে শোধরান যায় না।
কেন যায় না জ্যেঠিমনি, আমি শুনেছি মেনেনেওয়া মানিয়ে নেওয়া মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। আমি যদি সব জানার পর মেনে নিতে পারি, তোমাদের আপত্তি কোথায় ?
তুমি কি জান।
মনে মনে বললাম এই সুযোগ অনি, তুই হাত ছাড়া করিস না। তোর কথার ফাঁদে জ্যেঠিমনি পা দিয়ে ফেলেছে। এই সুবর্ণ সুযোগ তুই আর পাবি না।
নিজেকে উজার করে দে। তুই জিতে যাবি।
আমি ওই ফটোর দিকে মুখ করেই ধীরে ধীরে শুরু করলাম। একে একে সমস্ত কথা বলতে শুরু করলাম। কখনো গলা ভাড়ি হয়ে আসছে কখনো ধরে যাচ্ছে। কখনো গলা বুঁজে আসছে। আমি থামি নি। থামলাম না। কতোক্ষণ বলেগেছি জানি না। নিজের কথা বলেছি। অফিসের কথা বলেছি। মিত্রার কথা বলেছি। মিত্রা কোথা থেকে কোথায় তলিয়ে গেছিল তা বলেছি। সেখান থেকে কিভাবে তাকে উদ্ধার করে এনেছি তা বলেছি। বুঝতে পেরেছি কথা বলতে বলতে কখনো আমি ভীষণ ইমোশনাল হয়ে পরেছি।
শেষে পর্শুরাতে মিত্রার বলা সমস্ত কথা আমি উগড়ে দিলাম।
একটু থামলাম।
এরপরও কি তুমি বলবে জ্যেঠিমনি যে মেয়েটা তার সবচেয়ে আনন্দের দিনে তার গর্ভধারিণী মাকে একটিবার দেখতে চায়, সে খুব অপরাধ করছে। তার তো কনো অপরাধ নেই। কেন সে অন্যের অপরাধ নিজের ঘারে সারাজীবন বয়ে বেরাবে ?
তাই যদি হয়, কেন তুমি ন’মাস দশদিন তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলে ?
কিসের লোভ, কিসের লালসা ? কি জন্য নিজেকে আত্মবলিদান দিয়েছিলে ? কেন তুমি তার জন্মের পর তাকে মেরে দাও নি ? কেন তুমি সেই নবজাতক শিশুর কচি ঠোঁটে তোমার স্তন গুঁজে দিয়েছিলে ? কেন তুমি তাকে কলে পিঠে করে মানুষ করেছিলে ? কি তার অপরাধ ?
আবার একটু থামলাম।
আমি জানি জ্যেঠিমনি আমার এত প্রশ্নের উত্তর তুমি দিতে পারবে না। গলাটা বুজে এলো।
আমি মিত্রার অনুরোধে তোমার কাছে আসে নি। মিত্রা জানেও না আমি এখন তোমার কাছে তোমার ঘরে। আমি এসেছি নিজের মনের তাগিদে। এক মাতৃহারা স্ত্রীকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেব। ও জানে না আমি কোথায় এসেছি। কখন এসেছি। ওর মুখ থেকে সব কথা শোনার পর। মনটা ভীষণ ছটফট করছিল তোমার সঙ্গে দাখা করার জন্য।
সুযোগ খুঁজছিলাম।
কিছুতেই বাড়ির বাইরে আসতে পারছিলাম না। ছোটমার কথায় সুযোগ পেয়েগেলাম। ছোটমা বললো আজ কালরাত্রি আমাদের দু’জনকে এক ভিটেতে থাকতে নেই। সেই যা বেরিয়ে এসেছি।
জ্যেঠিমনি আমি তোমার কাছে আসিনি, আমি এসেছি মিত্রার জন্মদাত্রী মায়ের কাছে, আমার মাকে আমি ছবিতে দেখেছি। জ্ঞানতঃ তার কথা মনে পরে না। যাক, সব যখন জেনেই ফেললাম তাই মেয়ের কাছে মাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম।
মনে হয় এতো সৌভাগ্য মিত্রার কপালে নেই। তোমায় আজকে যা বলে ফেললাম, কথা দিচ্ছি এ কথা কেউ কনোদিন জানতে পারবেনা। অনি যে এ বাড়িতে এসেছিল তাও কেউ জানতে পারবে না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।
কতক্ষণ দুই বনের ফটোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম জানি না।
ফটোর দিক থেকে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। চোখে হয়তো জল এসে গেছিল।
মানুষ এই জায়গাটায় ভীষণ দুর্বল। আবঝা দেখতে পেলাম গেটের কাছে ইসি আর বরুণদা। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওরা কখন এসেছে! আমি দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিলাম ? জ্যেঠিমনি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে। চোখ ছল ছলে।
হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে হন্তদন্ত হয়ে আমি গেটের কাছে এগিয়ে গেলাম।
তুই যাবি না। তুই এবাড়ি থেকে এভাবে যেতে পারিস না।
ইসির কথায় মাথা নত করলাম।
না ইসি। আমাকে যেতে হবে।
ওরা আমার জন্য ভীষণ চিনতা করছে। আমি যদি কোন অপরাধ করে থাকি। তার জন্য আমাকে শাস্তি দিস। আমি মাথা পেতে নেব।
পিকু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। পকেট থেকে একটা ক্যান্ডি বার করে ওর হাতে দিলাম।
নাও, এটা খেলে দাঁতে পোকা হবে না।
পিকু আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বরুণদা কেমনভাবে যেন আমাকে দেখছে।
ওরা কিছুতেই গেট ছেড়ে সরে দাঁড়াচ্ছে না।
ইসি আমায় ছাড়, আমি যাই।
ইসি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। চোখে জল টল টল করছে।
বড়কি আমি অনির সঙ্গে ছুটকির কাছে যাব। তোরা যাবি ?
জ্যেঠিমনির গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম গম করে উঠলো। বরুণদা চমকে তাকাল আমার দিকে।
আমার কাঁধটা ধরে বার কয়েক ঝাঁকিয়ে দিল।
ইসি ছুটে গিয়ে জ্যেঠিমনিকে জড়িয়ে ধরে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
আংকেল তুমি আমার মাকে বকলে কেন।
পিকুর কথায় বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। ওর বয়সে আমি আমার মা বাবাকে দেখি নি। একদিন ও বড়ো হবে। যদি এই স্মৃতিটুকু ওর মনে থেকে যায় সেদিন ও নিজের বোধ বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করবে, ওর আংকেল কতটা সত্যের দাসত্ব করে।
আমি পিকুকে কোলে তুলে নিলাম। সিঁড়িদিয়ে নিচে নেমে এলাম।
বাইরের গেটে তালা দিতে দিতে ইসি বললো, কিরে তোর গাড়ি কোথায় রেখেছিস।
হাসলাম।
হাসছিস যে।
আমার গাড়ি নেই। আমি বাসে চড়ি। প্রয়োজনে অটোতে ট্যাক্সিতে।
তারমানে! কাগজের মালিক হয়েছিস, গাড়ি নেই। লোকে শুনলে কি বলবে।
আমি মালিক নই। মন থেকে আমি এখনো কর্মচারী। তোর বোন জোর করে আমার গলায় মালিকের মাদুলি ঝুলিয়ে দিয়েছে।
তোমায় একদিন অফিস থেকে এসে এই কথাটা বলেছিলাম ইসি, তোমার খেয়াল আছে। তুমি তখন বলেছিলে, ছাড়ো, বড়ো লোকেদের বড়ো বড়ো খেয়াল। আজ প্রমাণ পেলে।
সত্যি তোর গাড়ি নেই!
চলনা, এই টুকুতো, গলির মুখ থেকে ট্যাক্সি পেয়ে যাব।

আমার একহাতে পিকু আর একহাত জ্যেঠিমনির একটা হাত। ওরা দুজনে সামনে। পিকু তরতর করে কথা বলে চলেছে। ওর অনেক প্রশ্ন। তার অর্ধক উত্তর আমার জানা অর্ধেক জানা নেই। ওর মহা আনন্দ, আংকেলের সঙ্গে মাসির বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছে।
ইসিকে বললাম, কটা বাজে।
ইসি ঘড়ি দেখে বললো, দেড়টা বাজে।
মনে মনে বললাম সাড়ে ছ’ঘন্টা ধরে যুদ্ধ করে অনি তুই জিতলি এটা মনে রাখিস।
তোর মাবাইল নেই ? ইসি জিজ্ঞাসা করলো।
আছে, পকেটে স্যুইচ অফ অবস্থায়।
খোল।
অসুবিধে আছে।
কিসের ?
তুই বুঝবি না।
ইসি চুপ করে গেল।
গলির মুখে এসে একটা ট্যাক্সি ধরলাম। বললাম ট্র্যাংগুলার পার্ক। এককথায় রাজি হয়ে গেল। আমি সামনে পিকুকে নিয়ে বসলাম। পেছনে ওরা তিনজন। আসার সময় পিকুকে দেখাতে দেখাতে নিয়ে এলাম সব কিছু। ওরা তিনজনে পেছনে বসে আমার কথা শোনে আর হাসে।
মাঝে মাঝে ইসি বললো, তুইতো পিকুর সঙ্গে বেশ জমিয়ে গল্প করছিস। আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় ওর সঙ্গে বক বক করতে।
দু’জনেই ক্যান্ডি মুখে দিয়েছি। চিবচ্ছি।
বাড়ির গেটে যখন গাড়ি এসে দাঁড়াল, তখন আড়াইটে বাজে। আমি ট্যাক্সির গেট খুলে প্রথমে নামলাম। দেখলাম আজ বাড়ির গেট খোলা। ভতরে অনেক লোকজন। চিকনা প্রথম আমাকে দেখতে পেয়েছে। ছুটে গেটের বাইরে চলে এলো।
তারপর আমার সঙ্গে অপরিচিত লোক দেখে থমকে দাঁড়াল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ও হাসলো। কোন কথা বললো না। ট্যাক্সিভাড়া মেটালাম। জ্যাঠিমনিকে হাত ধরে আস্তে আস্তে নামালাম। গেটের মুখে আসতেই ছগনলাল বললো, ছোটাবাবু বহুত গজব হো গায়া।
কেন ছগনলাল।
তুমি সকাল থেকে নেই আছো।
হাসলাম।
দেখলাম মিত্রা তীরবেগে বারান্দা থেকে বাগানের পথে ছুটে আসছে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য।
আমার একহাতে পিকু অন্য হাতে জ্যেঠিমনি। কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। হাঁপিয়ে গেছে। ওর বুক ওঠা নামা করছে। চোখদুটো কেমন যেন হয়ে গেল। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা ওর চোখে মুখে ফুটে উঠলো। না পাওয়ার বেদনার মধ্যে আনন্দ।
চিকনা ছুটে ভেতরে চলে গেল। একটা হৈ হৈ শব্দ ভেতর থেকে ভেসে এলো। বুঝলাম আমার আসার আগমন বর্তা পৌঁছল। মিত্রা জ্যেঠিমনিকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইসিতা মিত্রাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি স্থানুর মতে দাঁড়িয়ে।
বরুণদা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি সকলে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে।
কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলবো। বরুণদা অপ্রস্তুত।
বেশ কিছুক্ষণ পর জ্যাঠিমনি কথা বললো। চোখের দু’কোল বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
কাঁদিস না। আমি এসেছি। অনি আমার সব রাগ, যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে।
মিত্রা জ্যেঠিমনির বুকে মুখ ঘসছে।
সেই তুমি এলে, এতো দেরি করে এলে কেন।
কোথায় দেরি করলাম। দেখ আমি ঠিক সময়ে এসে পরেছি। আজ আনন্দের দিন, তুই কাঁদিস না। ওই ছেলেটার দিকে একবার তাকা। জানিস না ও সকাল থেকে কতো লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করেছে।
আংকেল চলো নেমন্তন্ন খাই।
মিত্রা জ্যেঠিমনির বুক থেকে মুখ তুললো। আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো। এ হাসি কোটি টাকা দিলেও পাওয়া যায় না। মিত্রা পিকুর গাল টিপে দিল।
কোথায় নেমন্তন্ন খেতে যাবে।
মাসির বিয়ে। গাল থেকে মিত্রার হাতটা সরিয়ে দিল।
সবাই ঘিরে ধরেছে। আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকাচ্ছে। বড়মা এগিয়ে এলো। চোখা চুখি হলো জ্যেঠিমনির সঙ্গে। বুঝতে পারলাম দু’জনে দু’জনকে কোথায় যেন দেখছে চিনি চিনি করেও চিনতে পারছে না। বত্রিশ বছর আগের একরাতে কয়েক ঝলকের দেখা। স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে। তবু ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।
জ্যেঠিমনি, বড়মা। বড়মা ইনি মিত্রার জ্যেঠিমনি।
দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরলো।
ভাবগম্ভীর পরিবেশ।
আমি সবার সঙ্গে একে একে আলাপ করিয়ে দিলাম। দাদা, ডাক্তারদাদা, মল্লিকদা কাউকে দেখতে পেলাম না। ছোটমা সন্দেহের চোখে আমাকে দেখছে। অনি মিত্রার জ্যেঠিমনিকে কোথা থেকে ধরে আনল। এর গল্প আগে কখনো শুনি নি। ছোটমার চোখ তাই বলছে। আমি এমন ভাবে হাসলাম, যেন কেমন দিলাম এক্সক্লুসিভ নিউজ।
ছোটমা হেসে চেখের ইশারায়, আমার গালে থাপ্পর মারল।
ভেতরে এলাম। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারান্দায় আমার ঘরের সামনে আমার বন্ধুরা। সবাই আমাকে মাপছে। ভেতরে এসে দেখলাম দাদারা বসে। কাকা, উনা মাস্টারও আছে।
আমি সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম জ্যেঠিমনি ইসিতা আর বরুণদার সঙ্গে। ওরা প্রথমে একটু অবাক হলো। চোখ দেখে বুঝতে পারলাম। পিকু বলে উঠলো।
আংকেল আমরা কোথায় নেমন্তন্ন খেতে বসবো। মাসিকে দেখাও।
ঘর ভর্তি সবাই হেসে উঠলো। ইসিতা আমার হাত থেকে পিকুকে নিয়ে মিত্রার কোলে তুলে দিল।
এইযে তোর মাসি। নে হয়েছে।
সবাই পিকুর গাল টেপে। ও হাত সড়িয়ে দেয়। বক বক করছে।
তাহলে এডিটর, কথাটা তাহলে সত্যি।
কি।
যার বিয়ে তার হুঁস নেই, পারাপড়শির ঘুম নেই।
ডাক্তারদাদার কথায় জ্যেঠিমনি পর্যন্ত হেসে ফেললো। আস্তে করে বললো।
ওর দোষ নেই। ও সকাল থেকে অনেক যুদ্ধ করছে।
কি অনিবাবু মনে হচ্ছে যুদ্ধটা তাৎক্ষণিক সময়ের মধ্যে মাথায় এসেছিল।
দেখলে তো তোমার মাথাও তোমায় কেমন বিট্রে করলো।
তোমরাই বা কেমন বাপু এক কথায় চলে এলেই হতো। তাহলে ওকে যুদ্ধ করতে হতো না। বড়মা বললো।
আমি পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমে দুধে মিশে গেছে, আমি আঁটি এবার গড়াগড়ি খাব। চিকনা আমার পেছন পেছন। বাসু অনাদিকে দেখলাম শিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে মুচকি হাসল। আমি ওপরে উঠে এলাম। দেখলাম কনিষ্ক বটা নীরু।
কিরে আর সব কোথায় ?
তোর বিয়ে বলে কি হাসপাতাল বন্ধ থাকবে।
হাসলাম।
ঘরে এলাম।
মনে হচ্ছে একটা এক্সক্লুসিভ মারলি। কনিষ্ক বললো।
হাসলাম।
একটা সিগারেট দে।
চিকনা তোমার গুরুকে একটা সিগারেট দাও।
চিকনা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো।
খুব জমিয়ে নিয়েছিস বলে মনে হচ্ছে।
বুঝলি অনি, চিকনা হচ্ছে ফ্রেস অক্সিজেন। নিলে হার্টের জোড় বারে।
কিরে চিকনা কনিষ্ক কি বলে।
কনিষ্কদা বাড়িয়ে বলছে।
চিকনা সিগারেট বার করে সবাইকে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
হাসলি যে।
তোর কাউন্টার আমার।
সঞ্জু কোথায় রে।
নিচে। ইসলামদার সঙ্গে কাজ করছে।
তুই।
আমি হাওয়া খাচ্ছি।
মিনতিকে দেখতে পেলাম না।
এতো ভিড়ে দেখবি কি করে।
সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিস।
কাছে এলে তো।
কনিষ্ক।
বল।
কাকাকে দেখলি।
দেখলাম। তার থেকেও বড়ো সরেষ জিনিষ তোর উনা মাস্টার।
হেসে ফেললাম।
চিকনা একটু চা হবে।
দাঁড়া, বলে চিকনা হন হন করে হেঁটে চলে গেল।
তোদের খাওয়া হয়েছে।
তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
কিরে নীরু।
দাঁড়া তোকে একবার ভালকরে দেখি।
কেন।
গেট পেরিয়ে বাগানের লনে, দেখেই ম্যাডামের হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্ট। একেবারে প্রথম স্থান।
অলিম্পিকে সোনা জিতেছে। তারপরেই ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়া। তুই….।
বটা ঝেড়ে একটা লাথি কষালো নীরুর পেছন দিকে।
তুই মারলি কেন।
তোর কমেন্ট্রি শুনে।
সবাই হাসছে।
অনি ব্যাপারটা তোলা রইলো মনে রাখিস।
অনাদির দিকে তাকালাম।
কখন এলি।
আটটা।
বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিস।
সাড়ে চারটে।
ওখানে কাকে রেখে এলি।
তোর এতো চিন্তা কিসের। কনিষ্ক খেঁকিয়ে উঠলো।
তুই গিয়ে পাহাড়া দিবি। বটা বললো।
অনাদি হাসছে।
বলুনতো ওকে।
মিলি গেটের মুখে এসে দাঁড়াল। আমাকে দেখে ফিক করে হেসে বললো। তোমার সঙ্গে পরে একচোট ঝগড়া হবে। কনিষ্কদা, ছোটমা সবাইকে নিচে খেতে ডাকছে।
কনিষ্ক আমর দিকে তাকাল।
সকাল থেকে কিছু পেটে পরেছে।
না।
খালি পেটে লড়ে গেলি।
হ্যাঁ।
এসেই দেখলাম তুই নেই। বড়মার মুখ হাঁড়ি।
কিছুক্ষণের মধ্যে সবাইকে চাঙ্গা করলাম। ছোটমার মুখ থেকে সব শুনলাম। বুঝলাম নিশ্চই কারুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছিস। জিজ্ঞাসা করিস বড়মাকে, আমি এই কথা বলেছি কিনা।
ঠিক বলেছিস কনিষ্ক, এই বোঝাপড়াটা আমার জীবনের একটা মাইলস্টোন।
জানি, আবহাওয়া তাই বলছিল। ম্যাডামের এ্যাকসন, রি-এ্যাকসনে তার প্রতিফলন ঘটলো।
আর কথা নয় এবার চলো। মিলি বললো।
ওরা নিচে চলে গেল।
বাসু বললো, তুই আবার কোথাও বেরবি নাতো।
হেসে ফেললাম।

ওরা চলে গেল। আমি টেবিলের কাছে গেলাম। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলাম। স্যুইচ অফ। নিজে থেকেই জিভ বার করলাম। মোবাইলটা অন করলাম। দেখলাম পঞ্চাশটা মিস কল। আর দেখার ইচ্ছে হলো না। সবাই একবার করে টিপেছে। মনে হচ্ছে কেউ বাদ যায় নি। মনটা হাল্কা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এখনো পাথর চাপা।
 
আর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। টেবিলের ওপর পরে থাকা প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমগাছে ছোট ছোট আম ধরেছে। এখন আর আমের বোল একটাও চোখে পড়ছে না। গাছের ডালে আলো লাগানো হয়েছে। ওপর থেকে নিচের দিকে তাকালাম। সারা বাগানে ছোট ছোট ছাতা লাগান হয়েছে। এক একটা ছাতার তলায় দুটো করে চেয়ার। মনে হয় ইসলামভাই বুফে সিস্টেমে খাওয়াবে।
এইনে, ধর।
পেছন ফিরে তাকালাম।
চিকনা চায়ের কাপ হাতে।
নিজে বানালাম।
খেয়ে গালাগালি করবি না। সিগারেটটা দে। দু’টান মেরে নিবিয়ে দিই, পরে খাবো।
কেন।
সবাই ছোটমার ঘরে ঢুকেছে, এবার তোর ঘরে আসবে, আমি কেটে পরি।
হাসলাম।
চিকনা এই কদিনে কতো বোঝদার হয়ে গেছে। ভাবতেই ভালো লাগছে।
জানলার সামনে দাঁড়িয়েই চা খাচ্ছিলাম। আবার ভাব সাগরে ডুবে গেলাম।
মানুষের জীবন নদীর মতো, কোথা দিয়ে যে বইবে কেউ জানে না। উপন্যাসে বহু চরিত্র পড়েছি। আমার জীবনটাই যেন একটা উপন্যাস হয়ে যাচ্ছে। যতো ভেতরে ঢোক তত রস।
কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোথায় ডুব মারলি। ছোটমার গলা।
ও বুঝি মাঝে মাঝেই এরকম ডুব মারে। জ্যেঠিমনি বললো।
ফিরে তাকালাম।
গেটের মুখে সবাই। বড়মা, ছোটমা, জ্যেঠিমনি, বৌদি, মিত্রা, ইসিতা।
দিদি এইটা ছোটবাবুর ঘর। আগে মাসের পর মাস বন্ধ থাকত, মিত্রা আসার পর থেকে মাসের মধ্যে কুড়িদন বন্ধ থাকে বাকি দশদিন খোলা হয়।
আমি তাকালাম। ছোটমার মুখে বাঁকা হাসি। মিত্রার দিকে তাকালাম। ওর ডাগর নবীন চোখে বিশ্বজয় করার হাসি।
আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নীচু করলো।
ভাবতেই পারে নি ওর বুবুন এইরকম একটা কান্ড করতে পারে।
কিরে সকলকে প্রসাদ দিয়েছিস। জ্যেঠিমনি কিন্তু আমার হাত থেকে নেয়নি।
জ্যেঠিমনি আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি জ্যেঠিমনির থেকে একহাত লম্বা।
তুই আমার সব বাঁধ ভেঙে দিলি আজকে।
কই পারলাম, চেষ্টা করলাম মাত্র। সফল হই আগে।
এখনো তোর সন্দেহ আছে।
সন্দেহ না, এখনো অনেক কাজ বাকি আছে।
সে তুই তোর মতো করিস।
এইবার ঠিক কথা বলেছো।
কেন।
এতোক্ষণ তুমি আমাকে সম্মান দিচ্ছিলে, তুমি সম্বোধন করছিলে। যতই হোক আমি মিত্রা নই। সম্মান পেতেই পারি। চ্যাটুজ্জে বাড়ির ছোট জামাই বলে কথা।
দেবো কান মূলে, আবার বড়ো বড়ো কথা। ছোটমা বললো।
ইসিতা ফিক করে হেসে ফেললো।
ও ছোট আজ থাক, ওর বৌভাত। সখ করে বিয়ে করলো। বৌদি বললো।
বড়মা হেসেও হাসে না।
হ্যাঁরে তোর আবার ধর্মে মতি গতি কবে থেকে হলো।
কেন।
তুই নাকি ঠনঠনেতে গেছলি।
হ্যাঁ।
কেন।
মানত করেছিলাম।
কিসের!
মিত্রাকে বিয়ে করলে পূজো দেব।
ও হরি দেখেছো ছেলের কান্ড।
ছোটমার কথায় সবাই হাসে।
তুই কবে মানত করেছিলি শুনি।
সে তুমি বুঝবে না।
বোঝার আর কি বাকি রেখেছিস শুনি।
ছোটমার কটকটে কথায় ইসিতা হেসে গড়িয়ে পরে।
জ্যেঠিমনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
তুইকি আজ সারাদিন এই জামাকাপর পড়ে কাটাবি ঠিক করেছিস। বৌদি বললো।
চসসোর কোথাকার। ছোটমা বললো।
আমি হাসছি।
বড়মার কাছে এগিয়ে গেলাম। খালি শুনলে হবে, কিছু বলো।
দাঁড়াবাপু সকাল থেক বড়ো জ্বালিয়েছিস।
নির্জলা।
তাহলে কি মন্ডা মিঠাই খাবে। ছোটমা ছেঁচকিয়ে উঠলো।
ইসিতার দিকে তাকালাম।
কি ইসি ছুটকির বাড়িতে তোমাদের নিয়ে এসে অন্যায় করেছি।
ইসিতা মাথা নীচু করলো। বুঝলাম চোখ ছল ছল করে উঠেছে।
ছুটকি আবার কার নাম রে। ছোটমা বললো।
আমি হাসছি।
জ্যেঠিমনি হেসে ফেললো। ছোটোবেলায় ওদের দুজনকে বড়কি আর ছুটকি বলে ডাকতাম।
ছোটমা চোখ বড়ো বড়ো করে, কিরে মিত্রা আগে বলিসনি কখনো ?
ছোটমার কথার ধরণে ইসিতা কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললো।
দু’বোন দু’জনকে জড়িয়ে ধরেছে।
এখন আর তোর কি কি বাকি আছে।
কিসের।
বুঝতে পারছিস না।
একটুও না।
বোঝাচ্ছি।
আপনি ও ভাবে তাকাবেন না দিদি, ওর কীর্তি কলাপ শুনলে আপনার গা হিম হয়ে যাবে।
ওর সঙ্গে কাল যদি কেউ না থাকত, তাহলে আমরা কেউ জানতেও পারতাম না ও কোথায় গেছে। এবার বুঝুন।
জ্যেঠিমনি হাসছে।
আধ ঘন্টার মধ্যে রেডি হবি। ওদের খাওয়া হলে খেতে বসবো।
আর একটা কথা নিজের পছন্দ মতো জামা কাপর পরা চলবে না।
আমি হাসছি।
ছোটমার শাসনে ওরাও হাসে।
ওরা সবাই চলে গেল।
আমি দরজাটা ভেজিয়ে জামা প্যান্ট খুলে টাওয়েলটা কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ভালো করে স্নান করলাম। দেহের সমস্ত ময়লা যেন ধোয়া হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম সত্যি আমার জীবনটা যেন কি রকম। নিজের কাছে নিজে যে কিছু প্রত্যাশা করবো, তার কোন উপায় নেই।
বাথরুম থেকে বেরতেই দেখলাম দুই বোন খাটে বসে বসে কথা বলছে।
আমি আবার বাথরুমের ভেতরে ঢুকে গেলাম।
উঃ লজ্জাশীলা নারী। ইসিতা বললো।
আয় চলে আয় আর লজ্জা পেতে হবে না। মিত্রা বললো।
বাথরুমের গেট থেকে মুখ বার করে হাসলাম।
মিত্রা মুখ টিপে হাসছে।
তোর কীর্তি কলাপ শুনছিলাম ওর মুখ থেকে।
দে দে তাড়াতাড়ি গেঞ্জিটা দে শরীর ঢাকি।
একিরে তুই বিয়ে করা বৌকে কি বলে সম্বোধন করলি।
তুই বুঝবি না। দারুণ মজা।
দাঁড়া আমি মাকে গিয়ে বলছি।
শোধরাতে পারবি না।
আমি গেঞ্জিটা পরলাম। জাঙ্গিয়াটা পরতে গিয়ে ওদের দিকে তাকালাম।
মিত্রা ফিক করে হেসে ফেললো।
আমরা কেউ দেখবো না।
আমার আপত্তি নেই, ভয় না পেলেই হলো।
কি শয়তান রে, শালি বসে আছে।
আমি টেবিলের কাছে গেলাম।
দেখে পর, কারটা পরছিস। ইসিতা চোখ পাকিয়ে বললো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
গল্প হয়ে গেছে ?
মিত্রা হাসছে। সদ্য কালকের ঘটনা, না বলে পারি।
বেশ বেশ। মাথায় রাখিস, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় শোধ করে দেব।
রেডি হলাম। আজও নতুন পাজামা পাঞ্জাবী। বেশ লাগছে। ঘন ঘন নতুন নতুন পোষাক।
এটা কার স্পনসর।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
জ্যেঠিমনি।
তারমানে!
এটা অনেক দিন আগে কেনা হয়েছিল। মানুষটা তৈরি হয়নি, তাই ভাঙা হয় নি।
সেই জন্য ন্যাপথালিনের গন্ধ।
চোখ নাচিয়ে বললাম, কি ইসিতা ম্যাডাম।
ইসি খাট থেকে উঠে এলো। আমি পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাচ্ছিলাম। ইসি আমার হাত সড়িয়ে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে লাগাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফললো।
কি হলো ম্যাডাম। এটা ঠিক নয়। অনি অনির কাজ করেছে।
মিত্রা উঠে এলো।
এই দিদি কাঁদিস না।
তোকে আমি সকালে অনেক নোংরা কথা বলেছি।
ওটা আমার প্রাপ্য ছিল ইসি। নাহলে তোদের নিয়ে আসতে পারতাম না।
তুই আগে কেন বললি না।
তুই সেই পরিবেশ দিস নি। আমি সাড়ে ছ’ঘন্টা তোদের বাড়িতে ছিলাম। তাগিদ আমার, আমাকে পরিবেশ রচনা করতে হলো। আমার মনে হয় তুই পুরো শুনিসও নি।
ইসি মাথা নাড়ছে। শোনে নি।
আমি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে নিয়ে চলি। এবার ছাড়, নাহলে এখানে সেখানে হাত দিয়ে ফেলবো। ভাববো মিত্রা জড়িয়ে ধরেছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়াস নি। খালি গাল দিয়েছিস মনে মনে।
ইসি কোমরে একটা চিমটি কাটলো।
মিত্রা হাসছে।
ইসি হাসতে হাসতে চোখ মুছলো।
টাওয়েলটা দিয়ে মুখটা মুছে নে।
মিত্রা চিরুণি এগিয়ে দিল। চুল আঁচড়ালাম। চুলে চিরুনি চলে না। এবার সময় করে কাটতে হবে।
তিনজনে নিচে নেমে এলাম। খুব হৈ হৈ হচ্ছে। পিকু বাবুকে দেখলাম কনিষ্কদের টেবিলের সামনে। বটা চেঁচিয়ে উঠলো। অনি এসে গেছে এবার ঝেড়ে দে।
কেন, না বললে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না। নীরু দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে উঠলো।
তখন থেকে তোরা খেও-খেয়ি করছিস, কি হয়েছে বলতো। ছোটমা বললো।
দাঁড়িয়ে যাও, এবার নীরুর আর একটা পর্দা ফাঁস। বটা বললো।
কনিষ্ক হাসছে।
ইসিতা মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
এগুলোর সঙ্গে ইসির আলাপ করিয়ে দিয়েছিস।
হ্যাঁ।
আমি কিন্তু খেতে খেতে উঠে যাব ছোটমা।
নীরু চেঁচাচ্ছে সকলে হাসছে।
কেন তোরা ওর পেছনে লাগছিস বলতো। ছোটমা আবার বললো।

তাহলে একটা এক্সক্লুসিভ মিস করবে।
 
ছোটমা কনিষ্কর দিকে তাকাচ্ছে। মিটি মিটি হাসছে।
আচ্ছা বড় ম্যাডাম।
কনিষ্ক ইসিতার দিকে তাকাল।
না বলছি, একবারে বলবি না। নীরু আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
নীরুর কথায় সকলে হাসছে।
তাহলে অনির প্রোগ্রাম ক্যানসেল। কনিষ্ক বললো।
নীরু চুপ করে গেল।
কিরে বলবি তো অনির প্রোগ্রাম ক্যানসেল, না তোরটা বলবো।
অনির প্রোগ্রাম হবেতো ? নীরু লজ্জা লজ্জা ভাবে বললো।
আমি কথা দিচ্ছি, হবে।
কিরে তোরা কি শয়তান, অনির নাম করে….। ছোটমা বললো।
ছোটমা তুমি সাক্ষী রইলে। নীরু বললো।
কনিষ্ক হাসছে। আমিও হাসছি।
ব্যাপারটা কি রে ? আমি বললাম।
মিত্রা আমার হাতটা ধরেছে। টিনারা তাকিয়ে কনিষ্কর দিকে। ফিক ফিক করে হাসছে।
আঙ্কেল মিষ্টিটা দাও। পিকু বলে উঠলো।
ইসি হো হো করে হেসে ফেললো।
দাঁড়া ব্যাটা দিচ্ছি। কনিষ্ক বললো।
কিরে তোকে….! আমি বললাম।
আর বলিস না। প্রথমে নীরুকে ঝামেলা করছিল, তারপর আমার কাছে চলে এসেছে। ম্যাডাম আপনি একটু এদিকে আসুন।
কনিষ্ক ইসির দিকে তাকিয়ে বললো।
ইসি এগিয়ে গেল।
মিত্রা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো। নীরুর অবস্থা খারাপ। তাকিয়ে দেখ।
কেন রে।
আপনি ওই ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন। কনিষ্ক নীরুকে দেখিয়ে বললো।
আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরে গেলাম।
হো হো করে হেসে ফেলেছি।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। ঘরের মধ্যে আমিই একা হাসছি।
তুই একেবারে আমাকে চাটবি না।
নীরু আমার দিকে কট কট করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
তার মানে! মিত্রা আমার হাত ধরে। চোখে জিজ্ঞাসা।
দেখেছিস সমঝদারকে লিয়ে ইশারা ভি কাফি। কনিষ্ক বললো।
ইসি আমার দিকে তাকিয়ে।
কিরে অনি।
তুই নীরুকে চিনতে পারছিস না।
না।
বছর পাঁচেক আগে দেখেছিস। কচি কচি দেখতে ছিল তখন, সেই জন্য চিনতে পারছিস না।
নীরুর দিকে তাকালাম।
কিরে নার্সিংহোম না হাসপাতাল ?
মিত্রা আমার হাতটা ধরে খিল খিল করে হেসে আমার গায়ে ঢলে পরলো।
দেখলি, দেখলি কনিষ্ক, এবার অনি মালটা রসিয়ে রসিয়ে ঝারবে। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
মিত্রা ইসির কানে কানে ফিস ফিস করছে।
ইসি হো হো করে হেসে উঠলো।
তুই সব গজব করে দিলি। নীরু গজ গজ করছে।
কনিষ্ক বটা হাসছে।
সোনাবাবা, রসোগোল্লা খাওয়া হয়েছে। কনিষ্ক পিকুকে বললো।
আরও জরে সবাই হেসে ফেললো।
মিত্রার কাছ থেকে এবার সবার কাছে সংবাদটা পৌঁছে গেছে।
তখন ও আরও রোগা ছিল। হাসতে হাসতে ইসি বললো।
কেন মোটা হলে ভালো লাগতো। আমি বললাম।
দেখবি রে শয়তান। ইসি এগিয়ে এলো আমার কাছে।
নীরু এটা তোর কতো নম্বর।
নীরু লজ্জা পেয়ে গেছে।
পার্সোনালি তিন নম্বর।
খবরটা ঘর ময় রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সবাই হাসছে।
বরুণদা খেতে খেতে নীরুর কাছে উঠে গেল।
সত্যি নীরুবাবু সেদিন আপনি না থাকলে, আমি ইসি আর পিকুকে ফিরে পেতাম না।
বরুণদা একেবারে গদোগদো।
আমি ঘরথেকে বেরিয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় নীরুর দিকে তাকিয়ে বললাম। ওপরে চল কিমা বানাব।
কনিষ্ক, আমার কিছু হলে তুই দায়ী থাকবি, মাথায় রাখিস।
সকলে নীরুর কথায় হাসা হাসি করছে।
ঘর থেকে বারান্দায় এলাম। চারিদিকে লোকজন। দাদাদের দেখলাম লনে একটা ছাতার তলায় বসে গল্প করছে। সঙ্গে উনা মাস্টার, কাকা, ডাক্তারদাদা।
পায়ে পায়ে পেছন দিকে গেলাম।
দেখলাম ইসলামভাই রান্নার লোকেদের সঙ্গে কথা বলছে। কাছে যেতে বললো, কিরে খাওয়া হয়েছে।
না।
আর কখন খাবি, তিনটে বেজে গেল।
এবার বসবো। তুমি খেয়েছো ?
বড়দি জোরকরে খাইয়ে দিয়েছে। তুই আজকে আর একটা দিদিকে এনে হাজির করলি। এটাই তোর সকাল থেকে উঠে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।
হাসলাম।
সেই জন্য সকালে উঠে দৌড়লি।
তোমায় কেউ কিছু বলেনিতো ?
শুরু করেছিল, ডাক্তারদাদা ধমক মারল। সবাই থেমে গেল। নাহলে পিন্ডি একবারে চটকে দিত।
আমি হাসছি।
হাসিস না। তুই কেশ করবি আমাকে তার ঝাল পোহাতে হয়। এই খবরটা কি পর্শু সারারাত কালেকসন করেছিস ?
তোমায় কে বললো।
তুই সারারাত জাগলি, এমনি এমনি, তা হয় ?
হেসেফেললাম।
সেই জন্য কালকে তোকে বাধা দিই নি। না হলে জেগে বসে থাকতাম। তোর কালকের মুখ আর এ্যাকসনের দিনের মুখের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল।
বাবা তুমিও দেখছি এখন মুখ দেখে বিচার করতে শিখে গেছ।
আগে একটু একটু জানতাম তোর পাল্লায় পরে এখন পুরো জেনে ফেলতে হচ্ছে।
তারপর ডাক্তারদাদা সাহায্য করছে।
সাগির, অবতার, কবিতা, লক্ষ্মীকে দেখতে পাচ্ছিনা।
কবিতা ভেতরে কোথাও আছে। ওরা তিনজনে আর একটু পরে আসবে।
রতন, আবিদ।
সকাল থেকে ছিল। একবার বললো খোঁজ খবর নেব অনিদার।
নিতে বলতে পারতে।
ওরা খোঁজ নিলেও তোকে পেত না।
আমি হাসছি।
ইসলামভাই আমার পেটে একটা খোঁচা মারল। তুই এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের ডন।
তাহলে ইসলামভাই কি।
অনির চেলা।
মাথায় রাখবে।
ওই দেখ, তোকে মামনি ডাকছে।
পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম মিত্রা ইসলামভাইকে ইশারা করছে আমাকে পাঠাবার জন্য।
যাই, তুমি কাজ শেষ করো।
আমি এগিয়ে এলাম। মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতে বললো।
এক থাপ্পর।
আবার কি করলাম।
মাথায় খালি ফিচলে বুদ্ধি।
আমি হাসছি।
পিকু নীরুর হাতে ডেলিভারি তুই বুঝলি কি করে।
কনিষ্কর কথার ভাঁজে। দেখলি না নীরু কিরকম লজ্জা পাচ্ছিল।
শালা ওপরে চলুক ওকে দেখাচ্ছি।
কেন ও কি অন্যায় করলো।
তুই বুঝবি না।
তোকে এমন দেব না। আমি কিছু বুঝি না, না।
তাহলে জিজ্ঞাসা করছিস কেন। ওটা মেয়েদের ব্যাপার নয়, ছেলেদের।
এখনো আশ মিটছে না।
মেটে, তুই বল। নীরুর চোখ দিয়ে দেখা হয়ে যাবে।
দাঁড়া আমি দিদিভাইকে বলছি।
বলিসনা, কোথায় কি হয়ে যাবে।
তোকে একবারে খেয়ে ফেলবো।
বাকি কি রেখেছিস।
পায়ে পায়ে চলে এলাম, ঘরে ঢুকতেই দেখলাম কনিষ্ক বটা কোমরে টাওয়েল জড়িয়েছে।
কিরে টাওয়েল পরেছিস ?
তোদের খাইয়ে দিই। না হলে দেরি হয়ে যাবে।
বড়মা পার্মিসন দিয়েছে।
দেয়নি, জোগাড় কেরে নিলাম। মাসি একটু ঝামেলা করছিলো। নীরু ধমক দিলো।
নীরু ধমক দিলো!
বলছি কি, দেখনা রান্না ঘরে গিয়ে, একবার উঁকি মার।
দখি টিনা, মিলি, অদিতি সকলে লেগে পরেছে। মৈনাক, দেবা পাতা পাতছে।
তাড়া তাড়ি খা। একটা ছোট প্রোগ্রাম আছে।
আবার কি ?
দেখতে পাবি।
তোরা মনে হচ্ছে আবার কিছু ঘোটালা পাকাচ্ছিস।
দেবা হাসছে।
আমরা সবাই একসঙ্গে বসলাম। আজ দেখছি কয়েকটা এক্সট্রা টেবিল ঘরে ঢুকেছে। সবাই এক সঙ্গে বসলাম। খাওয়া শুরু করলাম। সুরো এসে পাতের সামনে দাঁড়াল। মিটি মিটি হাসছে।
কিরে। তোর আবার কি হলো।
আমার পাতের দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে।
তোমার একটা ঠ্যাং দাও।
আমার ঠ্যাং!
ওই হোল, মুরগীর।
ওকিরে এখুনি একপেট খেলি। বৌদি চেঁচিয়ে উঠলো।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
কনিষ্কদা বৌদির জন্য আর একটা দিচ্ছে, তুমি ওটা দাও না। সুরো হাসছে।
আমি সুরোর মুখে তুলে দিলাম। সুরে নাচতে নাচতে চলে গেলো। ইসি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ফিক ফিক করে হাসছে।
নীপা একটা বাটি নিয়ে এগিয়ে এলো।
একবারে ওকে দিবি না। আদর না। মিত্রা খেঁকিয়ে উঠলো।
আমি ঠিক বুঝে ওঠার আগেই বড়মা বলে উঠলো।
ওরকম করিস না। ওর জন্য কতোদূর থেকে বয়ে এনেছে সুরোমাসি বল।
আমি হাসছি, মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি।
একবারে তাকাবি না, চোখ গেলে দেব। তোর জন্য সুরোমাসি চিংড়িমাছের মোলা আর টক নিয়ে এসেছে। এতো খেয়েও আস মিটছে না।
আমি হাসছি।
কনিষ্ক। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

কি হলো ম্যাডাম।
 
কনিষ্ক সামনে এসে দাঁড়াল।
নীপার হাত থেকে বাটিটা নাও।
কেন!
নাওনা, আমি বলছি।
নীপা হাসছে।
সুরোমাসি এগিয়ে এলো।
ও মিত্রা যেটুকু আছে আমি সবাইকে ভাগ করে দিচ্ছি।
আগে দাও, তারপর ওর বাটি বসবে। কতো খায়। মিত্রা মুখ ভেঙচে বললো।
জ্যেঠিমনি এতোক্ষণ শুনছিলো কিছু বুঝতে পারছিল না। এইবার হেসে ফেললো।
তুই কি সব সময় ওর সঙ্গে এরকম করিস।
তুমি জানো না ও কিরকম তেঁদড়। সুরোমাসি কারুর জন্য নিয়ে আসে নি। খালি বুবুনের জন্য নিয়ে এসেছে।
তুই তো তখন খেলি। ছোটমা হাসতে হাসতে বললো।
একটু খানি টেস্ট করেছি।
অতোটা খেলি। ওটা টেস্ট!
ছোটমার কথাকে পাত্তাই দিলো না মিত্রা।
কনিষ্ক তুমিতো পাওনি। একটু টেস্ট করো।
সুরোমাসি মাটির খাবরি রান্নাঘর থেকে নিয়ে এলো। সবাইকে একটু একটু দিলো।
কনিষ্ক মুখে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। মার্ভেলাস, কি টেস্টরে অনি।
নীরু বটা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো।
হাগুড়ে। কনিষ্ক গম্ভীর হয়ে বললো।
তুই খেলে দোষ নেই, আমি খেলেই হাগুড়ে। নীরু বললো।
হাসাহাসি চলছে।
জ্যেঠিমনি একবার মুখে দিয়ে দেখো। মিত্রা বললো।
এটা অনিদা স্পেশাল। মিলি বললো।
ওখানে গেলে এই দিয়ে এক জাম পান্তা খায়। মিত্রা বললো।
তুই খাস না। ছোটমা বললো।
আমার বাটি টেবিলে রাখা মাত্র বটা, নীরু, মিলি, টিনা, অদিতি, দেবা, মৈনাক সবাই হাত মারলো। আমি হাসছি।
কিরে তোরা সবাই খেয়ে নিলে ও খাবে কি।
বৌদি থাকনা, আমি অনেক খেয়েছি।
আ-মোলো ধর্মাবতার যুধিষ্টির। বড়মা এমন ভাবে বললো হাসির ঢেউ উঠলো।
বড়মা আমরা খেলেই অনির খাওয়া হয়ে যাবে। কনিষ্ক আঙুল চাটতে চাটতে বললো।
ইসি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যাপারটা এরকম তুই পারিসও বটে। তোকে যতো দেখছি, তত অবাক হচ্ছি।
ওরা তিনজনে একদিকে। তারপাশে বৌদি। আমি বড়মা ছোটমা দামিনী মাসি।
তুই কি মেয়ে এতো টক খাস। ইসি বললো।
এতে তবু পোঁয়াজ কুঁচি, কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা সরষের তেল পরে নি। পরলে দেখতিস। টকাস করে জিভ দিয়ে আওয়াজ করলো মিত্রা।
সবাই হাসছে।
নীরু এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
তোর আবার কি হলো।
বটা, নীরুকে একটা ঝেড়ে দেতো। কনিষ্ক চেঁচিয়ে উঠলো।
দাঁড়ানা, এই মালটা খাওয়ার জন্য ওর ওখানে যেতে হবে না।
তোর চেম্বার ?
রাখ তোর চেম্বার।
সবাই হাসছে।
ও নীরু ওকে ছাড় বেচেরা সকাল থেকে কিছু খায় নি। বৌদি বললো।
কর্পোরেশনের প্রচুর জল টেনেছে। ওই জন্য খিদে পায় নি।
নীরুর কথা বলার ঢঙে সবাই হাসছে।
বড়মা।
কিরে।
নীরু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বড়মার পাতে।
নীরু চোখ গেলে দেবো। একবারে তাকাবে না। মিত্রা চেঁচালো।
নীরু মিটি মিটি হাসে।
দেবো। একটু অপেক্ষা কর। বড়মা বললো।
এতো খেয়ো না সোনা। অনেক রাত পর্যন্ত টানতে হবে। কনিষ্ক নীরুর পিঠে হাত দিয়ে বললো।
বটা সত্যি সত্যি এগিয়ে এলো।
বড়মা এটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি বটাকে কিছু বলো। এতো অত্যাচার সহ্য হয়। নীরু বললো।
তুই তুলবি, আমি খাবো। বটা বললো।
তার মানে! হাঁস ডিম পারবে খাবে দারোগা।
এবার হাসি আরো জোরে। জ্যেঠিমনি খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। হাসছে।
দিদি খাওয়া থামিয়ে লাভ নেই, এটা নিত্যকার ব্যাপার। ছোটমা বললো।
বুঝতে পারছি তোমাদের দু’জনের খুব কষ্ট। জ্যেঠিমনি হাসতে হাসতে বললো।
কষ্ট মানে, মাঝে মাঝে এদের জ্বালায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ছোটমা বললো।
মিত্রা নিজের পাত ছেড়ে উঠে এসে আমার পেছনে দাঁড়াল। বড়মা একবার আমার দিকে তাকাল। ইসারা করলো কিরে ?
আমি হেসে ইশারায় বললাম। যেটুকু চিংড়ি মাছের মোলা পরে আছে নেবে।
বড়মা হেসে ফেললো।
কিরে কি নালিশ করছিস বড়মাকে। মিত্রা কট কট করে বললো।
কিছু না।
আমি দেখলাম তুই বড়মাকে ইশারা করছিস।
আমি ওর দিকে তাকালাম। তুই বাটিটা নিবি, আমার ভালো লাগছে না খেতে।
কি ভালোরে তুই। আমার গালটা টিপে মিত্রা ছোঁমেরে বাটিটা তুলে নিল।
বড়মা মিত্রার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।
বুঝলি মিত্রা।
বলো।
অনি ইশারা করে এই কথাটা বলছিল।
ও বলুক।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
দেখলাম বটা, নীরু, কনিষ্ক মিত্রাকে ঘিরে ধরেছে। বাটিটা আজ আর মাজতে হবে না।
আমি হাসতে হাসতে বেসিনে গিয়ে মুখ ধুলাম।
বৌদি চেঁচিয়ে বললো তুই ওপরে যা আমরা যাচ্ছি।
বুঝলাম আমার কপালে আজ শনি লেখা আছে।
আমি দামিনী মাসির কাপরে হাতটা মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরোবার সময় ছোটমার গলা শুনতে পেলাম, তোর পকেটে রুমাল নেই।
গলার শব্দ শুনে একবার পেছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম দামিনী মাসি হাসছে।
বারান্দায় এসে দেখলাম বাসু, সঞ্জু, চিকনা, অনাদি কথা বলছে। আমাকে দেখে সঞ্জু হাসলো।
কিরে কোথায় ছিলি এতোক্ষণ, দেখতে পাই নি।
ওইতো পেছনে ছিলাম।
চিকনা, সঞ্জু সত্যি কথা বলছে।
একটু জল মেসানো আছে। অনাদি বললো।
হ। চিকনা হাসছে।
সঞ্জু কট কট করে তাকাচ্ছে চিকনার দিকে।
শিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম। ওরা আমার পেছনে।
মিনতি কোথায়রে সঞ্জু, দেখতেই পাচ্ছি না।
বড়মার ঘরে।
কি করছে।
কি করে বলবো।
তুই দেখ গিয়ে। ওর দায়িত্ব এখন তোর।
চিকনা জোড়ে হেসে উঠলো। অনাদিও হাসছে।
ঘর চ, জুতায় ছাল খিঁচবো।
এবার আমি হেসে ফেললাম, সঞ্জু একেবারে গাঁইয়া ভাষা মুখ থেকে বার করে ফেলেছে।
আয়।
ঘরে ঢুকতেই চিকনা সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। আমি একটা বার করে নিয়ে ওর হাতে দিলাম। চিকনা পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
কিরে!
ওরা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। একমাত্র তুই আর আমি খাই।
সঞ্জু হাঁটু দিয়ে চিকনাকে গোঁতা দিল।
অনি সব জেনে ফেলেছে। বাকিটুকু অনিকে বলে দেব।
বলনা, বল। ওখানে গিয়ে পানা পুকুরে পুঁতবো।
আমি হাসছি।
কিরকম খেলি।
বার বার খেতে ইচ্ছে করছে।
চিকনার কথায় বাসু হাসছ।
সেই যে পর্শুদিন থেকে খাওয়া শুরু করেছিস, থেমেছিস। বাসু বললো।
থামবো মানে, অনির বিয়ে বলে কথা, প্রাণভরে খেয়ে যাব।
তোর পেট থেকে সব টেনে বার করবো। সঞ্জু বললো।
অনি আর টানিসনা এবার দে, আমি সঞ্জু দু’জনকে টানতে হবে।
কেন আর সিগারেট নেই, সঞ্জুকে একটা দে।
ভাগা ভাগি।
তুইতো অনাদিকে একটা দিলি না।
পকেটটা দেখ ইসলামদা দিয়েছে। রেখে দিয়েছে। পঞ্চায়েত না, ওখানে গিয়ে ফুটানি মারবে।
আমি হাসছি।
ওখানে গিয়ে যদি হামবড়ক্কি দেখিয়েছিস। আন্দোলন করে মাটি কাটা বন্ধ করে দেব। এবার অনিমেষদা আছে বুঝলি।
চিকনার কথায় অনাদি বাসু এতোজোড়ে হেসে ফেললো মিত্রা মিলিরা পর্যন্ত চলে এলো। আমি হাসির চোটে খাটে বসে পরেছি। অনাদি বাসু তখনো হাসছে।
মিত্রা ভেতরে ঢুকলো।
কিরে এতো হাসির চোট কিসের।
চিকনা গম্ভীর হয়ে বললো। একটা ছোটো করে দিলাম তাতেই অনি কুপোকাত।
তার মানে।
আমি তখনো হাসছি।
কিরে বলবি তো।
আমি হাসতে হাসতেই বললাম চিকনাকে জিজ্ঞাসা কর।
চিকনা লজ্জা পেয়ে বললো, যাঃ বার বার বলা যায়।
এমনভাবে বললো এবার মিত্রা মিলি হেসে ফেললো।
আস্তে আস্তে সকলে ঘরে এসে জড়ো হলো। ঘর ভড়ে গেল। যে যার মতো বসলো।
সবার হাতেই কিছুনা কিছু জিনিসপত্র। আমি বুঝলাম ব্যাপারটা।
সবাই মিত্রার হাতে দিল সব। বেশ মজা লাগছে। জ্যেঠিমনির মুখে সকালের কালো মেঘ নেই।
ইসিতা এগিয়ে এলো।
পিকু কোথায় ?
নীচে।
কি করছে।
কতো দাদাই বলতো, খেলছে। এই নে তোর বরুণদা তোকে এটা দিয়েছে।
কি এটা।
খুলে দেখ।
আমি কাগজে মোড়া প্যাকেট খুলতেই ছবিটা বেরিয়ে এলো। সকালে যে ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আমার কথা বলেছি। বরুণদার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
মিত্রাকে ছবিটা দিলাম। ওর চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
না ম্যাডাম না, আজ এসব কিছু হবে না। কনিষ্ক চেঁচিয়ে উঠলো।
বৌদিও একটা ফটো ফ্রেম আমার হাতে দিলো। আমি মৃদু হেসে বৌদির দিকে তাকালাম।
তুমি এ ছবি পেলে কোথায়!
বৌদি হাসছে।
যার কাছে ছিলো তার কাছ থেকে নিয়ে এসে তৈরি করেছি।
আমি মাথা নীচু করলাম, জান বৌদি স্যারের কাছে যাওয়া হয়নি।

আজ আসবে।
 
স্যার আসবে!
ছবিটা মিত্রার হাতে দিলাম।
মিত্রা ছবিটা দেখে আমার দিকে তাকাল।
কোন ইয়ারের ছবি চিনতে পারিস।
আর চিন্তে হবে না, এই খাতাটা নে এবার শুরু কর।
ওই ছবিতে বসে যেটা করে ফার্স্ট হয়েছিলি। কনিষ্ক চেঁচিয়ে উঠলো।
ছবিটা মিত্রার হাত থেকে ইসিতার হাতে গেল, জ্যেঠিমনি বরুণদাও দেখল। আস্তে আস্তে সবার হাতে চলে গেল। সবার চোখেই বিষ্ময়। মিলি দৌড়ে এসে বৌদিকে জড়িয়ে ধরলো।
জানো বৌদি সে বছর আমরা সবে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছি। মাঠে ছিলাম আমি অদিতি টিনা। প্রথমে ভেবেছিলাম কি শ্রুতি নাটক শুনবো। অনিদার গলা শুনে দৌড়ে অডিটোরিয়ামে চলে এসেছিলাম।
পনেরো মিনিটের ডুয়েট, নিস্তব্ধ হলঘর, আমরা সব যেন গিলে খাচ্ছিলাম দু’জনকে।
সারা ঘর নিস্তব্ধ। মিলির কথা শুনছে।
টানা দু’মিনিট হাততালি। আমরা সবাই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম থ্রি চিয়ার্স ফর অনিদা, থ্রি চিয়ার্স ফর মিত্রাদি। ইন্টার কলেজ কমপিটিসনে আমাদের কলেজ ফার্স্ট।
আমি মিলির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।
ওর স্বতঃস্ফূর্ততা আমাকে যেন সেই দিনের অডিটেরিয়ামে নিয়ে গেল। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম আমি মিত্রা স্টেজে বসে আছি। দু’জনের ডুয়েটে চলছে কচ দেবযানী শ্রুতি নাটক। কেউ কাউকে এক তিলার্ধ মাটি বিনাযুদ্ধে সেদিন ছেড়ে দিইনি।
কিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস, শুরু কর শুরু কর। কনিষ্ক এগিয়ে এলো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। ওর চোখ বলছে ওর ইচ্ছে আছে। হাসলাম।
বুড়ী বয়সে এখনো শখ আছে।
তার মানে। বৌদি বলে উঠলো।
তুই ওকে বুড়ী বলছিস। তাহলে তুই কি ?
যা খাতাটা নিয়ে আয়। ওই কারণে দামিনী মাসির ওখানে রাখা ভাঙা বাক্স থেকে খাতটা বার করে এনেছিলি।
মিত্রা মাথা নীচু করে হাসছে।
কনিষ্ক খাতাটা মিত্রার হাতে দিল।
তুই শুরু কর। মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম।
সবটা পারবো না একটুখানি করব।
এরা মানবে।
মানবে।
আমি শুরু করলাম।
কচঃ দেহো আজ্ঞা, দেবযানী, দেবলোকে দাস
করিবে প্রয়াণ। আজি গুরুগৃহবাস
সমাপ্ত আমার। আশীর্বাদ করো মোরে
যে বিদ্যা শিখিনু তাহা চিরদিন ধরে
অন্তরে জাজ্জ্বল্য থাকে উজ্জ্বল রতন,
সুমেরুশিখর শিরে সূর্যের মতন
অক্ষয়কিরণ।
দেবযানীঃ মনোরথ পুরিয়াছে
পেয়েছ দুর্লভ বিদ্যা আচার্যের কাছে,
সহস্রবর্ষের তবে দুঃসাদ্য সাধনা
সিদ্ধ আজি, আর-কিছু নাহি কি কামনা,
ভেবে দেখো মনে মনে।
….. ……. …… ……. ……
দেখলাম মিত্রা আর কনটিনিউ করছে না।
আমি খাতা থেকে মুখ তুললাম। ও মাথা দোলাচ্ছে। ওর চোখ চিক চিক করছে। বুঝলাম এটা দুঃখের অশ্রু নয়, অনন্দের অশ্রু। মিলিরা এসে জড়িয়ে ধরলো মিত্রাকে। দেখলাম দরজার সামনে দাদা, মল্লিকদা, কাকা, উনা মাস্টার, ডাক্তারদাদা।
বিস্ময় চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে। ছোটমা দৌড়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। ডাক্তারদাদার হাত ধেরে ভেতরে আনলো। পেছন পেছন সবাই।
বাবাঃ, অনিবাবু যে আবৃত্তি টাবৃত্তি করেন এটা জানতাম না।
আমরাও জানতাম না। বৌদির আনা ছবিটা দেখে জানলাম।
ছোটমা ফটো ফ্রেমটা এগিয়ে দিলো ডাক্তারদাদার হাতে।
কলেজ লাইফের ছবি, এই দুটোর, দেখুন চিনতে পারেন কিনা ?
ডাক্তারদাদা দেখে হেসে ফেললেন।
কিরে কনিষ্ক তোরা জানতিস।
আমাদের কলেজের ফেস্টেও এইটা করে ওরা প্রথম হয়েছিল। তখন অনি-মিত্রা জুটির একটা কদর ছিল সব কলেজে।
কিগো এডিটর বান্ধবীকে কিছু বলো। সকাল থেকে অনেক বকছিলো।
মরণ। ও আবার কি বলবে গা।
বড়মার কথায় ঘর ভর্তি লোক হাসে।
আমায় কিছু বলতে হলো ? দাদা ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো।
ডাক্তারদাদা মাথা দোলাচ্ছে। হাসছে।
বটা একটা বিশাল কিছু নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
নীরু এগিয়ে গেলো। দে দে অনিকে আমাদের উপহার।
দাঁড়া স্যার তুলে দেবে ওর হাতে। কনিষ্ক বললো।
আমি কেন বাবা, তোদের জিনিষ তোরা দে। ডাক্তারদাদ বললো।
না স্যার, এটা আপনি আমাদের হয়ে অনির হাতে তুলে দিন।
তারমানে! নিশ্চই এমন কিছু আছে যার জন্য অনির কাছে মার খেতে পারিস।
তা আছে।
আমি নীরুর দিকে তাকিয়ে আছি।
রাতের খাওয়াটা খেয়ে নিই, তারপর তুই কিমা করিস।
সবাই হাসছে।
ডাক্তারদাদা এগিয়ে এসে লেমিনেট করা ফটোটা দিল। বুঝলাম এটা নিশ্চই আমার কনো ফটো।
কাগজটা খুলেই আমি হেসে ফেললাম। ছোটমা উঁকি মেরে আরও জোরে হেসে উঠলো।
আ মোলো ও ছোটো তুই অমন ভাবে হাসিস কেন। বড়মা বলে উঠলো।
ছোটমা কনো কথা বলে না খালি হাসে।
কি ছোটমা কেমন দিয়েছি বলো ? নীরু বললো।
ছোটমা আমার হাত থেকে নিয়ে সবার দিকে ফটোটা ঘুরিয়ে দিল। জ্যেঠিমনির দিকে তাকিয়ে বললো, দেখুন তো দিদি এই ওঝাটাকে চিনতে পারেন কিনা।
জ্যেঠিমনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো।
ঘরের সবাই হাসছে। এমনকি কাকা উনা মাস্টার পর্যন্ত।। পিকুও ছবিটা ভালো করে দেখছে।
হ্যাঁরে এটা তুই কবে সেজেছিলি। কাকা বলে উঠলো।
এটা অনির লেটেস্ট কালেকসন কাকা, পর্শুদিন। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি হাসছি।
ইসি আমার কাছে এগিয়ে এলো।
এটা জেনুইন।
তোর ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা কর।
সে ঝেঁটার বাড়ি আপনি খাননি ম্যাডাম। তাহলে ডাক্তার হয়ে যেতেন।
নীরুর কথায় ঘর ভর্তি সবাই হাসে।
একমাত্র তুই খেয়েছিলি কি বল। বটা বললো।
তোকে কথা বলতে বলেছি। একবার বলেছি, বড়রা যখন কথা বলবে ছোটেদের শুনতে হয়।
হঠাৎ আমার গলা আর মিত্রার গলায় শ্রুতি নাটকটা বেজে উঠলো। দেবা মোবাইলে রেকর্ড করেছে।
তুই রেকর্ড করেছিস! কনিষ্ক বললো।
লাইভ।
সবাই দেবার কাছে গেল। ওর মোবাইলে উঁকি মারছে। আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। মিত্রা হাসছে। ইসি পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
পাগলদের কান্ড দেখছো।
ইসি আমার দিকে তাকাল।
জানিস অনি এই পাগলামির মধ্যে একটা আনন্দ আছে। এই আনন্দটা আবার সকলে উপভোগ করতে পারে না।
মিত্রা ইসির দিকে তাকিয়ে।
অনেকদিন পর মন খুলে একটু আনন্দ উপভোগ করছি। তোর বরুণদাকে দেখেছিস। কেমন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
তুই আবার ইমোশন্যাল হয়ে পরছিস ?
হচ্ছিনারে, তুই এমন ভাবে পরিবেশ রচনা করলি বাধ্য হচ্ছি ইমোশন্যাল হয়ে যেতে। মায়ের মুখের দিকে একবার তাকা। আনন্দটা যে এই ভাবে উপভোগ করা যায় এতদিন জানত না। তুই সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে সেই আনন্দটা শেয়ার করে নিচ্ছিস।
ছোটমা। চেঁচিয়ে উঠলাম।
ছোটমা তখন দেবাদের মোবাইলে হামলে পরেছে। আমার দিকে তাকাল।
চা হবে না এখন, ভাগ।
ও কবিতা, মা একটু দেখনা ওরা চা করেছে কিনা নিয়ে আয়। বড়মা বললো।
দেখলে ডাক্তার, গলার স্বর কি নরম। ছেলে বলেছে। আমি বললে এখুনি ছেঁচকে উঠতো।
বড়মা এমন ভাবে দাদার দিকে তাকাল, ডাক্তারদাদা হেসে ফেললো।
সবাই ঘুরে তাকিয়েছে। ইসি আমার মুখের দিকে তাকাল।
তুই পারিশও বটে।
জানিশ ইসি মিত্রাকে জিজ্ঞাসা কর এই ডুয়েটটা দারুন এনজয়বেল।
নীরু আমার টেবিলে ওঝার ছবিটা নিয়ে এসে রাখল। বেশ ব্রাইট লাগছে। সবাই ছবিটার দিকে তাকায় আর হাসে। বটা নীরুর পেছনে এঁটুলে পোকার মতো লেগে আছে।
আচ্ছা অনি এরা ডাক্তার ?
ইসি আমার দিকে তাকিয়ে।
তোর কি মনে হয়।
ইসি হাসছে।
বাইরের জানলায় চোখ পরেগেল দেখলাম আমগাছে লাইট জ্বলছে। এখন গোধূলি। কবিতা চা নিয়ে এলো। অনেকগুলো থার্মোকলের কাপ। ঘরে কম লোক নেই। নীরু ছুটে এগিয়ে গেল।
কিরে তুই কি করছিস ওখানে। ছোটমা চেঁচিয়ে উঠলো।
ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ।
কনিষ্ক, নীরুকে করকে দে। বটা চেঁচিয়ে উঠলো।
কবিতাকে আর চা দিতে হল না। এখন ওটা মৈনাক কনিষ্কর হাতে চলে গেছে।
অর্ক, অরিত্র, লক্ষ্মী হৈ হৈ করতে করতে ঢুকলো।
তোমার সঙ্গে ঝগড়া আছে অনিদা। সেদিন করতে পারি নি। বিয়েতে বসেগেছিলে।
অর্ক এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অরিত্রও। লক্ষ্মী প্রণাম করতে গেল।
আজ করিস না। আমাকে করলে সবাইকে করতে হবে। তোর কোমর ব্যাথা হয়ে যাবে।
লক্ষ্মী লজ্জা লজ্জা চোখে আমার আর মিত্রার দিকে তাকাল, মাসি বকবে।
আমি দামিনী মাসির দিকে তাকিয়ে। মাসি হাসছে।
আমি বলছি মাসি বকবে না।
সবাইকে এই ভাবে একসঙ্গে পাব না একটু করি। লক্ষ্মী প্রণাম করতে শুরু করলো।
এট কি হলো অনিদা। অর্ক বললো।
ইসি আমার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের তিনজনকে দেখছিল।
কি বলবি তো।
তুমি অরিত্রকে আমার পেছনে লাগিয়েছিলে কেন।
আমি হাসছি।
লক্ষ্মী প্রণাম করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলো। অরিত্রদা না বৃহন্নলাদি।
সবাই একবার লক্ষ্মীকে দেখে, একবার আমাকে দেখে।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
লক্ষ্মী সেদিনও এই কথাটা বলেছিল, ব্যাপারটা কি বলতো।
অনিদাকে আপনি জিজ্ঞাসা করুণ ম্যাডাম। অর্ক বললো।
আমি হাসছি।
ইসি ইসারায় মিত্রাকে জিজ্ঞাসা করলো এরা কারা।
তুই একদিনে সব জানতে পারবি না দিদিভাই, অনেক কীর্তি, খালি দেখে যা পরে সব বলবো।
বৌদি চেঁচিয়ে উঠলো কিরে বলবিতো অরিত্রর নাম বৃহন্নলা হলো কি করে ?
কিরে অরিত্র বলে দে।
অরিত্র আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে হাসে।

লক্ষ্মী এগিয়ে এলো।
 
এই দিদিকে চিনতে পারলাম না।
ইনি তোর বৌদিমনির দিদিভাই।
আমি লক্ষ্মী, দাদার বোন।
ইসি তাকিয়ে লক্ষ্মীর দিকে।
কিরে লক্ষ্মী অরিত্রকে বৃহন্নলাদি বললি কেন। মিত্রা বললো।
দাদা জানে, তুমি দাদাকে জিজ্ঞাসা করো।
দেখবেন ম্যাডাম কেন অরিত্র বৃহন্নলাদি। অর্ক বললো।
টিনারা এবার এদিকে তাকাল।
অর্ক চেঁচিয়ে উঠলো, টিনাদি তোমার ল্যাপটপটা একটু নিয়ে এসো।
অনিদার টেবিলে আছে দেখো। টিনা চেঁচিয়ে বললো।
তুমি এসে একটু চালাও না।
টিনা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো। ওর পেছন পেছন সবাই। আমি হাসছি।
অরিত্র কেশ খেলে তুই খাবি। এটা জানলো কি করে।
আর বোলোনা সেদিন লক্ষ্মী মুখ ফসকে ম্যাডামের বাড়িতে বলে ফেলেছে। ব্যাশ।
ম্যাডাম একবারে অরিত্রর কথায় ভুলবেন না। অনিদা বহুত ঘাঘু মাল।
মিত্রা ইসি ওখান থেকেই আমার দিকে তাকাল।
দাদা মল্লিকদা ডাক্তারদাদ চা খেতে খেতে উঠে এলো।
অর্ক এরি মধ্যে ফিট করে ফেলেছে।
একটা হাসির রোল উঠলো ওই ভিড় থেকে, বুঝলাম অরিত্রর সাজ পোষাক দেখে হাসছে।
অরিত্র আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
দাদা মল্লিকদা ডাক্তারদা সবাই উঠে টেবিলের কাছে ভিড় করেছে। অর্ক বোঝাচ্ছে। ও এমন রসিয়ে রসিয়ে বোঝাচ্ছে সকলে হাসছে।
মিত্রা ভিড় থেকে বেরিয়ে আমার কাছে এলো।
তুই সেদিন অরিত্রকে মেয়ে সাজিয়ে ওই লোকটার গাড়িতে বসিয়ে রেখেছিলি।
কেন, লক্ষ্মীকে দেখলি না।
সেতো আগে জেনেছি। অরিত্র যে ছিল সেটা জানতাম না।
অরিত্র মাথা নীচু করে আছে।
আস্তে করে বললো।
সেদিন আমাদের দশজনের টিম ছিল। আপনি আমাদের তিনজন ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারবেন না ম্যাডাম।
ওরা কারা ইসলামভাই-এর লোক।
একদম না। সব অনিদার কালেকসন। শিয়ালদায় মাঝে মধ্যে ওদের দেখা পাওয়া যায়।
ইসি পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের কথা শুনছে।
তখন তোকে যেটা বলছিলাম। গত সপ্তাহে কাগজে যেটা বেরিয়েছিল।
মিত্রা ইসির দিকে তাকিয়ে বললো।
হ্যাঁ।
তার নায়ক নায়িকা এরা। ও পরিচালক।
ইসির চোখ বড়ো বড়ো।
এই টুকু টুকু পুঁচকে ছেলে মেয়ে!
ওরা সব অনিদার অংশ। কাজের সময় এদের চেহারা দেখলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমি বড়মা ছোটমা খালি ঠাকুরের নাম করি।
দেখবি খোন একটু পরে সব আসবে। এক এক পিস।
ভিড় থেকে মিলি ছিটকে বেরিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়াল।
অনিদা আমি কাল রিজাইন দেব, তুমি আমাকে সাংবাদিকতার কাজে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দাও।
মিত্রা হেসে ফেললো।
সেদিন অনিদার চেহারা দেখে কাপর নষ্ট করে ফেলছিলি, আবার সাংবাদিক হবি। যা বেরো।
ধ্যাত তুমিনা কি মিত্রাদি।
অদিতি টিনা ইসি হেসে গড়াগড়ি খায়।
চিকনা এসে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
এইজন্য তোকে গুরু বলি, তোর জন্য এক কিলো পাটালি।
তারমানে! চিকনা, আমি বাদ ? মিত্রা বললো।
না না ম্যাডাম আপনিও পাবেন, একশো গ্রাম।
দরকার নেই আমি সঞ্জুকে বলছি।
পাবে কোথা থেকে, ও যে এখন….।
একবার দেখে নিলো উনা মাস্টার কোন দিকে তাকিয়ে আছে।
খালি বগলে নিয়ে ঘুরছে।
সঞ্জু কট কট করে তাকিয়ে। কিছু বলতে পারছে না। বাসু অনাদি হাসছে।
তুমি পাহাড়া দিচ্ছ।
চিকনা ফিক করে হেসে ফেললো।
ইসি ওদের রকম সকম দেখে হাসছে।
অরিত্র।
অরিত্র আমার দিকে তাকাল।
তোর রাত্রি আর দিনকে বলেছিস।
মিত্রা ইসি আমার দিকে তাকিয়ে।
দিন না খুশী।
ওই হলো।
তুমি অর্ককে বলো।
কেন।
ও বারন করেছে।
ওরা আবার কে রে।
তুই চিনবি না।
অরিত্র মাথা নীচু করে মিটি মিটি হাসছে।
কিগো অরিত্র ওরা কারা।
সব জেনে ফেললে হবে কি করে। আমি বললাম।
তুই থাম তোকে জিজ্ঞাসা করেছি।
যা একটা ফোন করে দে, বল আমি ডেকেছি। আসতে পারবে।
ট্র্যাংগুলার পার্ক থেকে নিয়ে আসতে হবে।
তাই কর।
অর্ক। অরিত্র ডাকলো।
অর্ক টেবিলের কাছ থেকেই পেছন ফিরে তাকাল।
অনিদা খবর দিতে বলেছে। এখুনি নিয়ে আয়।
অর্ক কট কট করে অরিত্রর দিকে তাকাচ্ছে।
অরিত্র মুখ নীচু করে হাসছে।
বলনা তোর রাত্রি আর খুশী কে।
দুটো মেয়ে। অফিসে নতুন জয়েন করেছে।
এই মিসনে ওরাও ছিল ?
হ্যাঁ।
আরও কিছু আছে তুই চেপে যাচ্ছিস।
অর্ক এদের মধ্যে একটাকে পটকেছে।
মিত্রা হো হো করে হাসছে।
কি বুঝলি দিদিভাই। কতটা খোঁচাবার পর একটু পেলি।
ইসি আমার হাতটা ধরেছে।
জ্যেঠিমনি বিয়ের দিনে তোলা ছবি দেখছে। টিনা সব বোঝাচ্ছে। বড়মা, ছোটমা, বৌদি, দামিনীমাসি হাসা হাসি করছে।
ছোটমা ছিটকে বেরিয়ে এলো। আমার কাছে এসে বললো।
তোর মতো বিচ্চু দ্বিতীয় কেউ নেই।
ইসি হাসছে।
মিত্রা।
হ্যাঁ ছোটমা।
চল চল নিচে চল। সন্ধ্যে হয়ে গেল।
ঘর আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল।
আমরা ছেলেরা কয়েকজন। খাটে এসে বসলাম। চিকনার দিকে তাকিয়ে বললাম দেখনা একটু চা ম্যানেজ করা যায় কিনা। তখন নীরু কি যে দিল, বুঝতে পারলাম না।
হ্যাঁ, নীরু দিল। নীরু চেঁচাল।
তুইতো তো দিলি। বটা বললো।
তোকে কতোবার বলেছি বটা, সিনিয়াররা যখন কথা বলবে জুনিয়রদের কথা বলতে নেই।
শালা সিনিয়ার মারাচ্ছ।
নীরু আমার পেছনে।
সিনিয়ার নয় ? তুই বিয়ে করেছিস ? নীরু বললো।
সত্যিতো বটা, নীরুর বৌ কোথায় গেল।
আমি বলবো। মৈনাক বললো।
কেন তোমার অতো চুলকুনি কিসের। বিচুতি পাতা লেগেছে। নীরু বললো।
আমি নীরুর দিকে তাকালাম।
তুই কিছু ভাবিস না চলে আসবে। কনিষ্ককে জিজ্ঞাসা কর, সকালে একবার এসে ঘুরে গেছে।
কোথায় গেছে।
নার্সিংহোমে।
খেপ।
একটা জরুরি কাজ আছে।
বলনা খালাস করাতে গেছে। মৈনাক চেঁচিয়ে উঠলো।
আস্তে করে গালাগালি দিল, তোর বৌ-এর।
আমি কনিষ্ক হাসছি।
কনিষ্ক হাসতে হাসতেই বললো, নীরু হাইড দিয়েছে এইটা।
আমি নীরুরু দিকে তাকালাম। হাসছি।
শালিরটা কেমন দেখলি।
দেখলি দেখলি কনিষ্ক। অনিটা কি হারামী হয়ে গেছে।
কনিষ্ক হাসছে।
আমি চেষ্টা করলেও দেখতে পাব না। তুই তবু দেখেছিস। তোর চোখ দিয়েই দেখি।
দাঁড়া ম্যাডামকে বলছি গিয়ে।
মনে থাকে যেন, তোর বউ আসছে।
কি করবি তুই।
সবার সামনে চুমু খাব।
নীরু হাসতে গিয়েও হাসল না। হাসিটা মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।
বল, আমার বৌকে তো তুই চুমু খেয়েছিস। কনিষ্ক বললো।
ভালো দেখতে টাইট। নীরু বলেই ফিক করে হাসলো।
সবাই হেসে ফেললাম। মৈনাক দেবা এগিয়ে এলো।
শালা হারামী।
কেন তোর বৌ বাদ যাবে নাকি, তোর বৌ-এরটাও বলবো অনিকে।
হারামী তোর কাছে গেলে তো। দেবা বললো।
আচ্ছা মৈনাকের এখনো কিছু জুটলো না কেন নীরু।
জুটলোনা কে বলেছে।
তার মানে।
ও শালা প্রথমদিনই যদি বলে চলো দীঘায় ঘুরে আসি, বগলে হাত দেয়, সেই মেয়ে থাকে।
হ্যাঁরে ফিস ফিস করে গালি দিল, তোর মতো।
আমিতো বিয়ে করেছি। তুই করেছিস।
অমি কনিষ্ক বটা হাসছি। অনাদি বাসু গম্ভীর নেই।
নীরুর ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে বার করেই বললো, দেবীর আগমন ঘটেছে। আমি এবার নিচে গিয়ে নিয়ে আসি।
উঠে দাঁড়াল।
এখন নিচেই রেখে আসিস। পরে নিয়ে আসিস।
কেন চুমা দেবে না।
আমি হাসছি।
মৈনাকের দিকে তাকালাম।
তুই শালা বহুত হারামী আছিস। নীরুর পেট থেকে টেনে টেনে কথা বার করছিস।
সত্যি বলনা মালটা কে, একটু দেখা ?
বলছি নেই, হলে দেখাতাম।

দেবা। আমি চেঁচালাম।
 
আমি ঠিক জানি না।
ওর দ্বারা প্রেম হয়, কেন হেজাচ্ছিস বলতো। কনিষ্ক বললো।
হারামী, তোমার দ্বারা খালি হয়। মৈনাক খেপে গেল।
আমি হাসছি।
চিকনা চা নিয়ে এসে ঢুকলো।
তাড়াতাড়ি সাঁটা।
কেন।
লোক জন এসে পরেছে।
এই অবেলায় কে এলো আবার।
তোর কে সুজিতদা না কে এসেছে। টিনা ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ আছে, কথা বলছে।
দেবা দাঁড়িয়ে পরলো।
আমি যাই সুজিতদার সঙ্গে কথা বলি।
যা।
নীরুদার বৌ এসেছে। খুব হাসাহাসি চলছে। চলে এলো বলে।
কনিষ্ক চিকনাকে দেখছে আর হাসছে।
নেক্সট নিউজ চিকনা।
ম্যাডাম পাজামা পাঞ্জাবী বার করেছে সবার জন্য, নিয়ে আসছে।
কাদের জন্য ?
অনি তোমাদের আমাদের সবার জন্য।
আমরা পাজামা পাঞ্জাবী পরবো ?
সবাইকে পরাবে।
চা খা চা খা। বেশি কথা বলিস না এতে বিপদ বারবে।
কিরে শালা নিজেরা খেয়ে নিলি আমারটা কোথায়। নীরু ঢুকলো।
আর নেই।
মানে।
বটাদা খেয়ে নিয়েছে।
কনিষ্ক হাসছে।
কিছু বুঝলি নীরু ? কনিষ্ক বললো।
এতো বটার থেকে আর এক কাঠি ওপরে।
কার শিষ্য দেখতে হবে।
চিকনা চায়ের কাপটা নীরুর দিকে এগিয়ে দিল।
কনিষ্ককে বললাম তোরা বোস আমি একটু নিচ থেকে আসি। সুজিতদার সঙ্গে দেখা করে আসি।
যা। একটা টান মেরে যা।
আর ভালো লাগছে না।
নিচে নেমে এলাম।
বসার ঘরে ঢুকতেই দেখলাম চম্পকদা, সুজিতদা, বৌদি, দাদা, সনাতনবাবু, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা সবাই গোল টেবিল হয়ে বসেছে। বড়মার ঘরে মহিলাদের ভিড়।
আমি গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম।
চম্পকদা হাসছে, সনাতনবাবু হাসছে।
যাক দাদা অনিবাবু তাহলে বিয়ে করলেন। চম্পকদা বললেন।
বিয়ে করলো মানে! একটু খানি নয়, পুরপুরি।
আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম কি বলুন দাদা। সনাতনবাবু বললেন।
নিশ্চিন্ত হলাম কিনা বলতে পারবো না, তবে ছাড়া গরু বাঁধা পরলো।
হাসাহাসি হচ্ছে।
মিত্রা কাছে এগিয়ে এলো।
কিগো সুজিতদা গুবলুবাবু কোথায় ?
এইতো পিকুবাবুর সাথে বাগানের দিকে গেলো।
ছোটমা চায়ের কাপ ট্রেতে করে নিয়ে এলো।
ছোটমার দিকে তাকালাম।
এক ফোঁটাও পাবি না। তুইতো দাদাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিস।
ছাড়িয়ে যাচ্ছে কিগো ছাড়িয়ে গেছে। ডাক্তারদাদা বললো।
সুজিতদা, ছোটমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে ?
তোকে আর আলাপ করাতে হবে না।
শোন আমাদের লোকে বেচুবাবু বলে ডাকে। যেচে আলাপ করি।
আমি হাসছি।
বুলাবৌদি বলে উঠলো, উঁ মুরোদ কতো।
সরি সরি অনি আমার ভুল হয়ে গেছে বলাটা। ক্ষমা কর, আমি বেচেরাম, তুই বেচুবাবু।
সুজিতদা এমন ভাবে কথা বললো সবাই অবাক হয়ে গেল।
আমাদের চারপাশে ভিড় জমছে। সবাই বড়মার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কেন তুই অনিকে বেচুবাবু বলছিস সুজিত। চম্পকদা বললো।
আমি সারা জীবনে যা সেল করতে পারিনি ও তিনদিন আগে করে তা দেখিয়ে দিয়েছে। তাহলে নিজেকে কি করে বেচুবাবু বলি বল চম্পক।
তারমানে!
দিন তিনেক আগে হঠাৎ বাবুগিয়ে আমার অফিসে হাজির। তাও ধর ছয় থেকে সাতবছর পর। আমি দু’মাস ধরে একটা পার্টিকে নিয়ে ঘসরাচ্ছিলাম। বলতে পারিস আমার অফিসের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভগুলো পর্যন্ত ফেল মেরে গেছিল। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। মানে উনি সেইদিন আমাদের বিদায় দিয়ে চলে আসছেন। ব্যাপারটা নেগেটিভ বলতে পারিস।
ও একঘন্টায় পটকে দিল। কি বুজুং বাজুং দিল সব শুনলাম কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তারপর ভদ্রলোক অনির প্রতি গদোগদো হয়ে কন্ট্রাকটা দিল। সর্ত একটা অনিকে পুরো দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করতে হবে।
কত কামালি।
পঞ্চাশ।
এ্যাঁ।
এ্যাঁ না হ্যাঁ।
সকলে হাসছে।
অনিকে কি দিলি।
সঙ্গে সঙ্গে তিন দিয়ে দিলাম। আর তোদের কাগজকে পনেরো দিলাম।
হয়ে গেল।
কি হয়েগেল!
আমার সব্বনাশ করলি।
চম্পকদার কথায় সবাই হাসছে।
কেন তোর আবার কি সব্বনাশ করলাম।
সব্বনাশ করলি না। তুইতো ওটা অনিকে দিয়েছিস। আমাকে দিয়েছিস ?
তাতে কি হয়েছে।
দুদিন পরেই অনি আমাকে ডেকে বলবে চম্পকদা টার্গেট কতদূর। আমি কিন্তু আপনার টার্গেটের এতোটা এনে দিলাম। তারপর একটা চিঠি ধরাবে, আমার চাকরি খতম। তোর অফিসে একটা চাকরি দিস।
সবাই হাসছে।
সুজিতদা চোখ বড়োবড়ো করে বললো, অনি আজকাল এসব করছে নাকি!
পুরো দমে। এগুলোকে দেখেছিস।
মিলি, অদিতি, টিনা, দেবাদের দিকে তাকিয়ে বললো।
টিনাইতো ভেতরে ডেকে এনে সবার সঙ্গে আলাপ করাল।
এগুলো কোথায় কোথায় ছিল তুই জানিস।
হ্যাঁ জানি।
সবকটাকে তুলে এনে কাগজে জড়ো করেছে। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা। ভাই আমাকে একটা চাকরি দিস, না হলে বৌ বাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব।
হাসি থেমে নেই।
সুজিতদা মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
কিরে মিত্রা চম্পক যা বলছে সত্যি।
ওটা চম্পকদা আর বুবুন জানে।
বুবুন আবার কেরে।
তুই এটাও জানিস না। চম্পকদা বললো।
না।
ম্যাডাম অনিবাবুকে এই নামে ডাকেন, সেই কলেজ লাইফ থেকে। আর আমরা এখন অনিকে ছোটবাবু বলে ডাকি।
দাঁড়া দাঁড়া চম্পক, আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
বৌদির দিকে তাকিয়ে।
কিগো বুলা তুমি কিছু জান।
বৌদি হাসছে।
কি সাংঘাতিক তুমি, কই আগে কখনো আমাকে বলোনি!
আহা, সব বলা যায়। কি বল মিত্রা।
বৌদি এমন ভাবে বললো, সবাই হাসছে।
কি সনাতনবাবু আমি যা বললাম একবর্ণও মিথ্যে ? চম্পকদা বললেন।
একবারে না।
দাদাও হাসে, মল্লিকদাও হাসে।
তোকে কি বলবো সুজিত, আমরা কোন ছাড়, অনি আজকাল দাদাকে পর্যন্ত হুকুম করে।
করবে না। তোমরা সব এক গোয়ালের গরু। বড়মা খেঁকিয়ে উঠলো।
কাম সেরেছে। চম্পক এবার তুই চুপ কর। ছেলের নামে বলে ফেলেছিস, গায়ে লেগে গেছে। দাদা বললো।
সবাই হাসা হাসি করছে।
কইরে ওকে জামাকাপরটা দে।
বড়মা মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
তোমরা একটু বোস। আমি আসছি।
আজ একটু গায়ে সেন্ট দিস। চম্পকদা চেঁচিয়ে বললো।
আবার হাসি।
আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। মিত্রা আমাকে রাজ বেশ পরাল। সুরো এসে একবার পাঞ্জাবী ঠিক করে একবার চোস্তা ঠিক করে। নীপা সামনে দাঁড়িয়ে। দারুন সেজেছে সব। কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেখবো।
একে একে সবাই আসতে আরম্ভ করেছে। অনিমেষদা এলেন বিধানদা এলেন। আমার পেছনে কিছুটা লাগলেন। বিধানদা একরাশ বই আমার জন্য নিয়ে এসেছে।
আমি হলফ করে বলতে পারি এগুলো তোর পড়া হয় নি।
আমি সবাইকে প্রণাম কে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ভেতরে তখন তুমুল আড্ডা শুরু হয়েগেছে।
একফাঁকে গিয়ে আমি ইসলামভাই আবিদ, রতন, সাগির, অবতার, নেপলাদের সঙ্গে দেখা করে এলাম। ওরা ভীষণ খুশী। সবাই যে যার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। সবার পরনে নতুন কুর্তা পাঞ্জাবী। এ যেন মিত্রার হুকুম।
সুরো, নীপা, মিনতি সাজগোজ করে ঘুরছে। জ্যাঠিমনির চোখে প্রশান্তি। যে যেরকম পারছে ছবি তুলে যাচ্ছে। ইসলামভাই বাড়িটাকে বেশ সুন্দর সাজিয়েছে। চারিদিকে রুচির ছাপ স্পষ্ট। বড়মা ছোটমা, বৌদি সবার মধ্যমনি। বাইরের অতিথিদের সামলাচ্ছেন।
ভেতরের অতিথি সামলাচ্ছে লক্ষ্মী, কবিতা, দামিনীমাসি। দেখলাম মিত্রাও তার ক্লাবের কিছু বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। আমাকে আজকে যা রাজবেশ পরিয়েছে, তাতে আমার মাথা খারাপ। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি।
আমি বাগানের পেছনে ছিলাম। চিকনা ছুটতে ছুটতে এসে বললো। তোকে এখুনি বৌদি ডাকছে। তোর স্যার এসেছে।
আমি তাড়াতাড়ি এলাম। ডঃ রায় ওনার স্ত্রী সুনন্দাদি ও শুভঙ্করবাবু। কলকাতায় আজ যাঁদের জন্য আমি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি। কাছে গেলাম।
মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নীচু করে। স্যারকে ঘিরে অনিমেষদা, বিধানদা, ডাক্তারদাদা, দাদা, মল্লিকদা সবাই। আমি সবাইকে প্রণাম করলাম।
যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত অনি মিত্রাকে খুঁজে পেয়েছে, কি বলো সুতপা। ডঃ রায় বললেন।
আমি মিত্রা মাথা নীচু করে। সবাই হাসছে।
আমি নিশ্চিন্ত হলুম, আমার একটা চিন্তা দূর হলো বুঝলে অনিমেষ, কি পাগলামোটাই না করছিল তখন দু’জনে। শুভঙ্কর আমার মাথা খেয়ে ফেলে। সুনন্দাকে বলি তুমি অনি এলে চেপে ধরো।
আর বলবেন না স্যার। গত সপ্তাহের কথা একবার ভাবুন। বৌদি বললো।
আর মনে করিয়ে দিও না সুতপা। সেদিনটা বড়ো কষ্ট পেয়েছি।
কি মিনু তুমি যে আমার ছাত্রী, সেটা অনিকে বলেছো।

স্যার বড়মার দিকে তাকিয়ে বললেন।
 
না স্যার।
ওকে বলো।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম বড়মার দিকে।
এ কথাটা আগে কোনোদিন জানতাম না। আজ প্রথম শুনলাম।
অনিমেষ।
হ্যাঁ স্যার বলুন।
এবার ওকে তোমরা একটু জব্দ করো।
ওর মাথায় অনেক বড়ো বড়ো বুদ্ধি, বুদ্ধি গুলোকে একটু ঘসে মেজে তোমরা ছোট করে দাও।
বিধানবাবুকে সব কথা বলেছি।
বিধানবাবু আপনার সঙ্গে আলাপ ছিলো না। এই মুহূর্তে আলাপ হলো। আপনাকে আর কি বলবো। আমার ছাত্রটিকে একটু দেখুন।
বিধানদা হাসছেন।
যাও আমরা বুড়োরা একটু গল্প করি। তোমরা অতিথিদের দেখ।
আমি মিত্রা ভিড় থেকে বেরিয়ে এলাম। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে। পরিতৃপ্ত চোখে সুখের ঝলকানি। ইসি পাশে।
জানিস অনি ডঃ রায় কোথাও কোনদিন যান না! ইসি বললো।
জানি।
তোর বিয়েতে এসেছে, আমি ভাবতেই পারছি না।
মিত্রা অনিমেষদার সঙ্গে ইসিতার আলাপ করিয়ে দিয়েছিস।
দিয়েছেরে দিয়েছে। সত্যি অনি এখন নিজের খুব খারাপ লাগছে। সকালে জেদ ধরে যদি না আসতাম খুব মিস করতাম।
ইসি সকালেও কথাটা একবার তোকে বলেছি, আমার কাছে অতীতটা অতীতই। আমি তার কাছ থেকে শিক্ষা নিই। চলি বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে। বরুণদা কোথায় ?
কাজ খুঁজছিল, ইসলামদা ওকে অতিথি আপ্যায়ন ঠিক হচ্ছে কিনা তার দায়িত্ব দিয়েছে।
পিকু ?
সে কোথায় খেলে বেরাচ্ছে গুবলুর সঙ্গে। তার মহা আনন্দ।
পায়ে পায়ে তিনজনে এগিয়ে এলাম, কনিষ্করা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। নীরুর পেছনে কিছুটা লাগলাম। নীরুর বৌ হেসে খিল খিল।
অনিদা তুমি ওকে নিয়ে যা করো না।
আর টেলাতে হবে না। তোমরা সব বেইমান, আসার আগে বলেছিলে আমার পাশে থাকবে, এখন অনির দলে ভিড়ে গেছ। নীরুর কথায় সবাই হাসছে।
ওইতো অনিদা।
খালি এই কথাটা কানে এলো। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেখলাম একটা মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘসে দিলো। এরপর তিনজন একিভাবে।
পিঙ্কি, চুর্ণী, তিয়া, রিমঝিম।
মিনাক্ষীদেবীকেও দেখলাম। বুঝতে পারলাম নীরুর চোখ কপালে উঠে গেছে। আমি সবার সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিলাম, মিত্রাকে ওরা জড়িয়ে ধরলো। এক একজন যা পোষাক পরেছে। সবাই তাকিয়ে আছে। চিকনা সঞ্জুর চোখ যেন আগুনে ঝলসে গেছে।
আমি ওদের নিয়ে বড়মা ছোটমাদের কাছে এলাম। আসার সময় নীরুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারলাম।
ওদের সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। মিনাক্ষী দেবী এদিক ওদিক তাকালেন যেখানে অনিমেষদা স্যার দাদারা বসে আছেন সেদিকে চোখ যেতেই বললেন, ডঃ রায় না।
হ্যাঁ।
উনি এগিয়ে গেলেন।
ছোটমা আমার সঙ্গে এই কচি কচি সখীদের দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
মিত্রাকে ইশারা করে বললো ওরে ওকে সামলে রাখ। আমি হাসছি।
সুজিতদা এক দৃষ্টে ওদের দেখছে।
মিনাক্ষী দেবী স্যারের কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।
তুমি কোথা থেকে ?
অনি কাল ফোন করেছিল। ও নাকি একটা বিয়ে করেছে।
সবাই হাসছে।
ওরা চারজনে প্রণাম করলো সকলকে।
অনিমেষদা হাসতে হাসতে বললেন তাই বলি, আমাদের সরকার অথচো আমাদের পার্টি মুখপত্রে কেন বিজ্ঞাপন নেই। সব বিজ্ঞাপন কেন অনির কাগজে।
আমাদের কাগজের সার্কুলেসন বেশি তাই আমরা সরকারী বিজ্ঞাপন বেশি পাব। টিনা, মিলি, অদিতি একযোগে বলে উঠলো।
দেখছেন বিধানবাবু দেখছেন, অনির গ্রুপবাজি।
সবাই হাসছে।
ওরা চারজন মিত্রাকে যেন চেটে খাবে। এমন অবস্থা।
আমি ওদের রেখে আবার কনিষ্কদের কাছে গেলাম।
যেতেই চিকনা আর সঞ্জু আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষলো।
কনিষ্ক হেসে মাঠে গড়িয়ে পরে। নীরু আমার দিকে কট কট করে তাকিয়ে।
কি হলোরে।
আমরা অভাগা এরকম ছোঁয়া স্বপ্নে দু’একবার পাই। তাই তোর গালে গাল ঘোষলাম। চিকনা বলে উঠলো।
কনিষ্ক তখনো হাসছে।
মিত্রারা কাছে এলো। সবাই তখনো হাসছে।
চিকনা সঞ্জু গিয়ে মিত্রার হাত ধরলো।
কি হলো চিকনা।
দাঁড়ান ম্যাডাম, একবারে কথা বলবেন না।
বটা, কনিষ্ক, মৈনাক, দেবা হেসেই চলেছে।
কি হলো কনিষ্ক ব্যাপারটা কি।
বুঝতে পারছেন না।
মিত্রা অবাক চোখে তাকাল কনিষ্কর দিকে।
ওইযে চারপিশ আপনাকে আর অনিকে….।
মিত্রা এবার হেসে ফেললো।
অদিতি ইসিরাও হাসছে।
আমরা চেষ্টা করলেও পাব না ম্যাডাম। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। চিকনা বললো।
নীরু কিন্তু রাগে ফুঁসছে অনি। কনিষ্ক বললো।
কেন।
তোর বৌ থাকতেও কচি কচি মেয়েগুলো তোর গালে গাল ঘসলো, ওর বৌ থাকতেও পেল না। ও বলছে আজকেই শ্রীপর্ণাকে ডিভোর্স করবে।
আমি হাসছি। অনাদি বাসুর হাসি থামে না।
ঠিক আছে নীরুকে দুঃখ করতে হবে না।
তুই এককাজ কর অনি, ওদের পেসেন্ট বানিয়ে দে। কনিষ্ক বললো।
কনিষ্ক খুব খারাপ হয়ে যাবে। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
দেখলি অনি।
তুমি বটা একটা একটা করে নিয়ে নাওনা। মিত্রা বললো।
ফিট করে দিন।
মিলি, টিনা আড়চোখে একবার বটা কনিষ্কদের দিকে তাকাল।
তাহলে মৈনাককে বাদ দিলি কেন। আমি বললাম।
ওর চেন খুলে যাবে। মিত্রা এমন ভাবে বললো।
আবার সকলে হেসে ফেললো।
দেখলি দেখলি কনিষ্ক মিত্রা কি থেকে কি বললো।
মৈনাক মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
একবার পরিচয় করিয়ে দে। আজই নীরুর পেসেন্ট বানিয়ে দেব।
দে মৈনাক তাই দে আমার আত্মা একটু শান্তি পাক। নীরু বললো।
সবাই হাসছে।
আমি তাহলে অনিদার কাছে চলে যাব। শ্রীপর্ণা বললো।
ম্যাডামকে দেখেছ, ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবে।
মিত্রা ইসি হাসতে হাসতে দু’জনে দু’পাশ থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
মিলিরা হাসতে হাসতে মাঠে বসে পরেছে।
একি মিলি ম্যাডাম এরকম চকমকি পোষাক পরে মাঠে বসলেন। চিকনা এমন ভাবে বললো। আবার হাসি।
অনিদা।
পেছন ফিরে তাকালাম। ওরা চারজন এদিকে আসছে।
অনিরে তোর পায়ে পরি একটু কথা বলিয়ে দে। চিকনা দাঁতে দাঁত চিপে বললো।
আমি বাদ যাই কেন। নীরু বললো।
তাহলে পেসেন্ট দেব না। মৈনাক বললো।
ঢ্যামনা।
মিত্রা কট কট করে তাকাল, নীরুর দিকে।
ওরা কাছে এলো।
অনিদা তুমি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না।
তোমাদের সঙ্গে তো আলাপ করিয়ে দিলাম, কথা বলো।
হায় বলে ওরা শুরু করলো। সবার সঙ্গে হাতে হাত মেলালো। আমি লক্ষ্য করছি সবার মুখ। এক একজনের এক একরকম জিওগ্রাফি।
চিকনাকে হায় বলে হাতে হাত রাখতেই চিকনা সিঁটিয়ে গেল। দেঁত হাসি হেসে বললো, হেয়।
সঞ্জু একবার কট কট করে তাকাল চিকনার দিকে।
মৈনাক ওদের সঙ্গে ইংরাজীতে কথা বলা শুরু করেছে।
কনিষ্ক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আস্তে করে বললো। এরা মডেল নাকিরে ?
মিত্রা শুনতে পেয়েছে। আমার দিকে তাকাল।
আমি মাথা দোলালাম।
সেই জন্য।
কি সেই জন্য ?
সব ট্রান্সপারেন্ট ব্রা পরেছে।
মিত্রা মুখের কাছে হাত নিয়ে হাসল।
হারামী। লক লক করছে।
আজ মনে হচ্ছে কুমার থেকে লাভ নেই বুঝলি অনি।
মিত্রা কনিষ্কর দিকে তাকাল।
রিমঝিম আমার দিকে এগিয়ে এলো।
অনিদা বৌদিকে কিন্তু তোমার থেকেও কিউট লাগছে।
আমার যে আবার বৌদির থেকে তোমাকে বেশি মিষ্টি লাগছে।
দুষ্টু।
মিত্রা রিমঝিমের কথায় হাঁসবে না কাঁদবে। ওর চোখের ভাষায় তাই বোঝাচ্ছে।
তুমি আমাদের কবে ক্লাস নেবে।
দেখি। একটা সপ্তাহ আমাকে একটু সময় দাও।
তিয়া এগিয়ে এলো। ডাগর চোখে আমার দিকে তাকাল। ওদের পেছনে চিকনা। চিকনা বুকে হাত দিয়ে অভিনয় করছে।
আমার বুক ফেটে গেল রে অনি।
আমি না পারছি হাসতে না পারছি গম্ভীর থাকতে। মৈনাক দেবা সবাই আমাকে ইসারা করছে ওরে তুই এদের নিয়ে কোথাও যা। মিলি টিনার চোখের ভাষাও তাই।
আমি বললাম চলো তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দিই, তোমাদেরই ফিল্ডের।
তাই! কি সুইট তুমি অনিদা। চুর্ণী বললো।
চলো সেই ভালো। তোমাকে তো কিছুক্ষণ একা পাওয়া যাবে।
আমি সুজিতদাকে খুঁজে বারকরলাম। সুজিতদা দেখেই হেসে ফেললো।
জোগাড় করে ফেলেছিস।
হ্যাঁ। তোমার পছন্দ।
পছন্দ মানে। তোকে একা পেলেই কথাবলবো ভেবেছিলাম।
কথাবলো সবার সঙ্গে। তোমার ভিজিটিং কার্ড দেবে। তারপর তোমার সঙ্গে আমি আলাদা করে কথাবলে নেব। সকলকে নিয়ে আমার আলাদা আলাদা পরিকল্পনা আছে।
ওদের দিকে তাকালাম। সুজিতদার পরিচয় দিলাম।

ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
 
আমি বললাম, আমি ওদের একটু সময় দিই, তোমরা কথা বলো।
কথা বলেই তোমার কাছে যাচ্ছি।
আচ্ছা এসো।
আমি আবার ফিরে এলাম।
আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিকনা সাষ্টাঙ্গে মাঠে শুয়ে পরে আমাকে প্রণাম করলো। তারপর উঠে পাঞ্জাবীটা ঝেড়ে নিলো।
এটা কি হলো কনিষ্ক।
গুরু প্রণাম। যদি প্রসাদ পাওয়া যায়।
মিত্রা বড়ো বড়ো চেখ করে কনিষ্কর দিকে তাকাচ্ছে।
তোকে কি সুন্দর দুষ্টু বললো, আমাকে বলেনা কেন অনি।
চিকনার কথায় ওরা হেসে গড়িয়ে পরে।
তুই এগুলোকে কোথা থেকে জোগাড় করেছিস বলতো। মিত্রা বললো।
ওইযে মীনাক্ষী ম্যাডামকে দেখলি, সেইদিন টিনাদের পাঠিয়েছিলাম।
হ্যাঁ।
রিমঝিম ওনার মেয়ে, আর একটা ঝিমলি ভাইজ্যাকে আছে। আর তিনটে রিমঝিমের বন্ধু।
ওরে বাবা তুইতো অনেক হিসেব নিকেষ করে জাল ফেলেছিস। কনিষ্ক বললো।
কনিষ্কের কথায় ওরা হাসছে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে। চিকনা আমার হাতটা শুঁকে মিত্রার দিকে তাকাল।
একবার হাতটা শুঁকুন ম্যাডাম ওই মেয়েটার গন্ধ এখনও পাবেন।
মিত্রা হাসছে, ইসিও হেসে গড়িয়ে পরে।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে বার করলাম।
ওদের ইসারায় বললাম একমিনিট। একটু দূরে চলে গেলাম।
হ্যালো।
ঠাস হিন্দিতে ভেসে এলো কঠিন কন্ঠস্বর, শালা….ছেলে বেজন্মার বাচ্চা, বিয়ে করে খুব মজমা নিচ্ছ। কালকেই তোমার ভবলীলা সাঙ্গ করবো।
আমাকে কথা বলার কোন সুযোগই দিল না। লাইনটা কেটে গেল।
মুখটা কঠিন হয়ে গেল। এই ভাবে আমাকে এখনো পর্যন্ত কেউ কোনদিন বলে নি। ভাবলাম একবার রিং ব্যাক করি। নিজেকে নিজে সামলালাম। না ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। এই সময় মোটেই মাথা গরম করা চলবে না। সব পন্ড হয়ে যাবে। স্রেফ অভিনয় করে যেতে হবে। কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া করলে চলবে না। পাখি একবার হাত থেকে উড়েগেলে বিপদ। হতে পারে কিছুই হবে না। তবু আমাকে এখন অনেক অঙ্ক কষে চলতে হবে। ফিরে দাঁড়ালাম। হাসি হাসি মুখ করে বললাম, তোরা একটু দাঁড়া আমি আসছি।
তুই কোথায় যাচ্ছিস। মিত্রা কাছে এগিয়ে এলো। সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখেছে।
একটু আসছি।
কে ফোন করেছিল ?
ওর চোখে গভীর জিজ্ঞাসা।
চিনবি না, বাইরের লোক।
তাহলে তুই ওইদিকে যাচ্ছিস।
পাঁচ মিনিট, এখুনি চলে আসব।
আমাকে বলবি না।
বলার হলে বলে দিতাম।
আমি দাঁড়ালাম না। মনে হয় অভিনয়টা ঠিক হল না। ধরা পরে গেলাম। কারুর প্রতি দুর্বলতা জন্মালে সব কিছু গোপন করা যায় না।
সোজা চলে এলাম রতনের কাছে। আস্তে করে ইশারায় ওকে কাছে ডেকে নিলাম।
কি হয়েছে অনিদা! কোন গড়বড় ?
না। সেরকম কিছু না।
তাহলে! তোমাকে কেমন ফিউজ দেখাচ্ছে।
তুই এই নম্বরে একটা ফোন কর।
কি হয়েছে আগে বলো।
এই নম্বর থেকে এখুনি একটা ফোন এলো।
কি বলেছে বলো।
কি বলতে পারে, বুঝতে পারছিস না।
শুয়োরের বাচ্চা। দাও নম্বরটা।
আমি মোবাইল দেখে ওকে নম্বরটা বললাম।
গলা নামিয়ে বললাম, চেঁচা মিচি করিস না। বাড়ি ভর্তি লোক।
ও নম্বরটা ডায়াল করতেই ওর মোবাইলে একটা নাম ভেসে এলো।
এতো বসিরের এসটিডি বুথের নম্বর। কাশীপুরে থাকে।
জিজ্ঞাসা কর পাঁচ মিনিটের মধ্যে কারা এই নম্বর থেকে ফোন করেছে। সাউন্ড অন কর।
কেরে বসির।
হ্যাঁ গুরু।
তোর ওখানে কে এসেছে।
কেউ না।
শুয়োর, সত্যি কথা বল।
খুব চেঁচা মিচি হচ্ছে গুরু, কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
চল ওইখানে যাই। আমি বললাম।
দুজনে বাগানের শেষপ্রান্তে চলে এলাম। দেখলাম আবিদ নেপলা পেছন পেছন এসে হাজির।
কি হয়েছে রতনদা। আবিদ বললো।
দুজনেরি চোখের রং বদলে গেছে।
মনে মনে বললাম, এরা গন্ধও পায়।
দাঁড়া একটু।
বল বসির কে এসেছিল তোর এসটিডি বুথে।
কেউ না।
এখুনি কে এসে ফোন করছিল তোর এসটিডি বুথ থেকে।
দু’জন এসেছিল। চলে গেল।
তুই চিনিস।
না।
সত্যি কথা বল।
তুমি বিশ্বাস করো।
তুই আমাকে দে রতনদা। তোর দ্বারা হবেনা।
আবিদ ফোনটা কেরে নিল রতনের হাত থেকে। প্রথমেই মা মাসি উদ্ধার করে দিল। এবার বল বসির। আমি আবিদ।
তুই বিশ্বাস কর আবিদ। আমি চিনি না।
ঝাঁপ বন্ধ করে এখুনি তুই ওদের পাত্তা লাগা, আমি যাচ্ছি।
ওরা পাশের একটা রেস্ট হাউসে আছে। কাশীপুর গানসেল ফ্যাক্টারির সামনে।
নজর রাখ। কজন এসেছিল।
দুজন। গুরু সেরকম কিছু। মাল পত্র সব বার করবো ?
ওরা যখন ফোন করে, কিছু শুনিস নি।
বললো কাল কাকে ওরাবে।
কোন নম্বরে ফোন করেছিল ?
দাঁড়া দেখে বলছি।
বসির নম্বরটা বললো।
আমার মোবাইলেরই নম্বরটা বললো।
ওরে খান….ছেলে। তুই এখুনি মালপত্র বার কর। আমি যাচ্ছি। পাখী যেন উড়ে না যায়। তাহলে তোকে ঝেড়ে দেব।
আমি কি করলাম।
কাঁচা কাঁচা খিস্তি, কি করলি। যা বলছি কর।
এখুনি ঝাঁপ বন্ধ করছি।
পেছন ঘুরে দেখলাম চিকনা পাশে দাঁড়িয়ে। ওর চোখ মুখের চেহারা বদলেগেছে।
আবিদ ওগুলোকে যে কোন প্রকারে গ্যারেজ কর। মনে হচ্ছে এখনো কিছু বাকি আছে। কথা শুনে মনে হলো ইউপির লোক। মন বলছে রাজনাথের চেলুয়া, ইউপি থেকে এসেছে।
সেরকম বুঝলে উড়িয়ে দেব।
ঘাউড়ামি করবি না।
আবিদ মাথা নীচু করলো।
ওমপ্রকাশ কোথায় ?
ও বাড়িতে আছে।
আর কে আছে।
আরও লোক আছে, তোমাকে ভাবতে হবে না।
ওমপ্রকাশকে আগে ওখানে পাঠিয়ে দে। তোর যেতে যেতে ওম পৌঁছে যাবে। ওই বাড়ি থেকে স্পটটা কাছে। অনিমেষদাকে এখন কিছু জানান যাবে না।
তুমি পাগল হয়েছো।
ইসলামভাই কোথায় ?
ওখানে আছে।
রতন বাইরেটা ভালো করে দেখে নে একবার। নেপলা ভেতরে থাকুক।
বাইরে সব লোক আছে, তোমাকে ভাবতে হবে না। তাছাড়া থানা থেকেও লোক এসেছে।
আচ্ছা।
যা বেড়িয়ে যা, আমাকে একটা ফোন করবি।
আচ্ছা।
আমি যাব আবিদদা। চিকনা বললো।
না দাদা এইকাজ তোমার নয়। দাদাকে দেখছ না। কতো কুল।
আবিদ বেরিয়ে গেল।
নেপলা একটা ঠান্ডা আনতো।
নেপলা দৌড় লাগাল। ওখানে গিয়ে কিছু বলিসনা যেন।
তুমি পাগল হয়েছো অনিদা।
চিকনা একটা সিগারেট দে।
সাগির, অবতার কোথায় ?
দাদার কাছে। ব্যাটারা পুরো চেঞ্জ।
হাসলাম।
ঠিক হয়ে যাবে দেখিস রতন। একটা ধাক্কা ওদের দরকার ছিল।
নেপলা একটা ঠান্ডার বোতল নিয়ে এলো। আলগোছে কিছুটা ঢক ঢক করে খেলাম। তারপর রতনের হাতে দিলাম। ওরা তিনজন ভাগাভাগি করে খেল।
তোমাকে কি বললো ? রতন বললো।
কয়েকটা খারাপ কথা বললো।
ঠিক আছে তুমি যাও। দাদা নাহলে সন্দেহ করবে। চোখ তো নয় চারদিকে বনবন করে ঘুরছে।
হেসে ফেললাম।
পায়ে পায়ে আবার ওদের কাছে চলে এলাম। তাল কেটেছে বুঝতে পারছি, তবু হাসি মস্করা চালিয়ে গেলাম।
মিত্রা একদৃষ্টে আমাকে দেখে যাচ্ছে।
দেখলাম গেট দিয়ে নিরঞ্জনদা, অনুপদা, রূপায়ণদা ঢুকলো।
আমি এগিয়ে গেলাম। মিত্রা আমার পেছন পেছন। কাছে গিয়ে সবাইকে প্রণাম করলাম।
বাবাঃ অনিবাবুকে আজ চেনাই যাচ্ছেনা তাই না অনুপ। রূপায়ণদা বললেন।
বিয়ে বলে কথা।
যাঃ বিয়ে হয়ে গেছে। নিরঞ্জনদা বললো।
আমি হাসছি।
কি ম্যাডাম এখন নো টেনসন, ডু ফুর্তি।
মিত্রা হাসলো।
আমি ওদের সঙ্গে করে অনিমেষদাদের কাছে এলাম। তারপর ঘুরে ঘুরে যারা যারা খাচ্ছেন তাদের কাছে গেলাম। কুশল বিনিময় করলাম। ওরা সবাই পাশে আছে। নীপা সুরোকে দেখলাম রিমঝিমদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে গল্প করছে। আমায় দেখে হাত নারলো। আমিও হাত নারলাম। আমি একটু এগিয়ে গেছি। পেছনে মিত্রা চিকনা কথা বলছে। বুঝলাম মিত্রা চিকনাকে চেপে ধরেছে। চিকনা হাসছে। মিত্রার সঙ্গে ফাজলাম করছে।
ডঃ রায় চলেগেলেন রিমঝিমরাও চলে গেল। আস্তে আস্তে মিত্রার ক্লাবের বন্ধুরাও চলে গেল। যাওয়ার সময় হেসে বললো আপনার সঙ্গে ঠিক ভাবে কথা বলা হলো না। তবে আপনার বন্ধুরা ভীষণ লাইভ।
হাসলাম।
একদিন ক্লাবে আসুন না।
মিত্রা মুখ বেঁকিয়ে বললো। ক্লাবে! হয়েছে তাহলে।

একজন বললো, কি আপনি যাবেন না ?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top