মিত্রা ফাইল খুললো, অনেকগুলো দলিল। তার মধ্যে থেকে একটা খাম বের করে নিয়ে এলো। একটা ছবি আমার হাতে দিল। ফটোটা লাল হয়ে গেছে। আমি কাছে নিয়ে এসে ভালো করে দেখলাম। বছর বাইশ তেইশ বয়স হবে মেয়েটার। ছবিটা স্টুডিওতে তোলা। বড়মার মুখশ্রীর সঙ্গে কিছুটা মিল আছে।
আমি অনেকক্ষণ ফটোটা লক্ষ করলাম। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
চিনতে পারছিস।
মনে হচ্ছে বড়মাকে যদি এই বয়সে নিয়ে যাই, তাহলে ছবিটার সঙ্গে বড়মার মুখশ্রী মিলে যাবে।
মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো।
দ্যাটস রাইট বুবুন, তুই একেবারে ঠিক কথা বলেছিস।
তাই!
মিত্রা চোখের ভাষায় আর ঘাড় দুলিয়ে, হ্যাঁ বললো।
তুই পেলি কোথায় ?
প্রশ্ন করবি না। খালি দেখে যা। আমি তোর মতো হতে পারছি কিনা বল।
এবার এই ছবিটা দেখ।
বিবাহ বাসরে তোলা ছবি। সবে বিয়ে হয়েছে। একজন মিত্রার বাবা আর একজন সেই ভদ্রমহিলা মানে বড়মা। তারমানে বড়মার সঙ্গে মিত্রার বাবার বিয়ে হয়েছিল! আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। মিত্রা আমার চোখের দিকে জুল জুল করে চেয়ে আছে। আমি কি বলি।
তোর বাবার সঙ্গে বড়মার বিয়ে হয়েছিল!
ইয়েস ইয়েস বুবুন তুই একেবারে ঠিক।
মিত্রার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো।
তুই প্রমাণ পেলি কি করে।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তোকে সব বলবো বুবুন, তুইযে আমার সব, তোকে বলতে না পারলে আমি শান্তিতে মরতেও পারব না।
এই দেখ একটা পোস্ট কার্ড।
হাতে নিয়ে পরলাম। ফর্মাল চিঠি কন্যাদায় গ্রস্ত পিতা আর একজনের পুত্রের সঙ্গে তার মেয়ের বিবাহ দিতে চান। নিচে বসিরহাটের ঠিকানা। আর মিত্রাদের বাড়ির ঠিকানা।
পড়লি।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
জানিস বাবা এরপর বড়মাকে দেখতে যান, পছন্দ হয়, বিবাহ হয়। বাবা তার দিনলিপিতে এটা লিখে গেছে। তোকে পরাব। তারপরের ঘটনা তুই জানিস। বড়মা পীর সাহেবের থানে নিজে মুখে সব স্বীকার করেছে। তোকে নতুন করে কি বলবো। বাবা আর কোনদিন বিবাহ করেন নি।
আমি চমকে মিত্রার দিকে তাকালাম।
ভাবছিস আমি পৃথিবীর আলো দেখলাম কি করে।
আমি এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি তোকে ফাঁকি দিতে চাইনি বুবুন, তুই বিশ্বাস কর। আমি ভীষণ লোভী।
মিত্রা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো।
আমি মিত্রাকে কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
মিত্রা আমার বুকে মাথা রেখেছে। চোখ বন্ধ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি মিত্রার গালে আস্তে করে থাপ্পর মারলাম। মিত্রা চোখ খুললো।
কিরে, শরীর খারাপ লাগছে।
মিত্রা অস্ফুট কিছু বলতে চাইল, বলতে পারল না।
আমি জলের বোতলটা কাছে টেনে নিয়ে মিত্রার চোখে জল দিলাম। আমার পরনের কাপরটা দিয়ে মুছিয়ে দিলাম।
কষ্ট হচ্ছে।
মিত্রা আমর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
যে কথা ছ’বছর ধরে নিজের বুকের মধ্যে বয়ে বেরিয়েছি, আজ তোকে বললাম। তুই ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জানে না।
একটুক্ষণ থেমে।
বুকের ভেতরটা ভীষণ ব্যাথা করছে, জানিস বুবুন।
হুকটা একটু খোল আমি হাত বুলিয়ে দিই।
না থাক, একটু সহ্য করতে শিখি। তুই আমার থেকে আরও কষ্ট পেয়েছিস।
আমি মিত্রার মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
নারে বুবুন সত্যি। এখন তুই আছিস, আমার আর ভয় নেই। আমার আর কিছু হবে না, দেখিস।
আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো, প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু কষ্ট আছে। যা সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজস্ব। সেটা ভাগ করে নেওয়া যায় না। হয়তো অনুভব করা যায়। তার কষ্টের সমব্যাথী হওয়া যায়। কিন্তু শেয়ার করা যায় না।
জানিস বুবুন, বড়মা যে দাদার সঙ্গে থাকেন, বাবা সেটা জানতেন।
উনি জানতেন! তা সত্বেও….
বাবার দিনলিপি তার প্রমাণ।
জানিস, বাবা মারা যাবার আগে আমার আর মার মধ্যে প্রপার্টি ভাগ করে দিলেন।
মিত্রা আমার ডানহাতটা ওর হাতে তুলে নিল।
তখনি আমার একটা খটকা লেগেছিল। কিন্তু কাউকে বলিনি। বাবা আমার বয়ফ্রেন্ড। বাবার কাছে আমি কখনো কনো কথা কোনদিন গোপন করিনি। সিনেমা হলে তোর হাত নিয়ে যেদিন বুকে রেখেছিলাম বাবাকে এসে অকপটে সব স্বীকার করেছি।
বাবা হেসে বলেছিলেন ছেলেটাকে তুমি একবার আমাকে দেখাতে পার। আমি মাথা দুলিয়ে বলেছিলাম পারব। উনি বলেছিলেন কবে ? আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ও ভীষণ মুডি, আমার ইচ্ছের ওপর আসবে না। বাবা হেসেছিলেন। একটু মনে করে দেখ তারপর তোকে প্রথম আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম।
স্বরস্বতী পূজোর দিন।
এইতো তোর মনে আছে।
সেইদিন বাবার আচার আচরণে তুই কিছু বুঝতে পেরেছিলি।
কাঁচা মন, তখন এতো সব ঘোর-প্যাঁচ বুঝতাম না। সত্যি কথা বলতে কি তখন আমার চোখে সব রঙ্গীন। গ্রাম থেকে একটা ছেলে শহরে এসেছে। কেরিয়ার তৈরি করতে হবে। কলেজে দাদা হতে হবে, একটা হামবড়ক্কি ভাব। মাঝে মাঝে সেই দিন গুলর কথা মনে পরলে হাসি পায়।
বাবা তোকে দেখার পর, তোর সঙ্গে কথা বলার পর বলেছিলেন আমার অমত নেই।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
তুই একটু ভেবে দেখ, তখন আমাদের সেকেন্ড ইয়ার চলছে।
হ্যাঁ।
আমাদের ঘনিষ্ঠতা এরপর আরও বেড়েছে। তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস কম, কিন্তু আমি তোর হোস্টেলে প্রায় গেছি।
ঠিক।
জানিস বুবুন, বাবা মারা যাবার পর আমি নিজেকে নিজে আবিষ্কার করলাম, আমি কে ?
কলেজে পড়ার সময় আমি জানতাম না কে আমার মা ? ছোট থেকে জানতাম আমার মা আমার জন্মের পর আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি জ্যেঠিমনির কাছেই মানুষ। জ্যেঠিমনি আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।
মিত্রা!
হ্যাঁ। বুবুন তুই বিশ্বাস কর। আমি তোকে….
মিত্রার চোখ দুটো জলে টল টল করছে। আমি ঠোঁট দিয়ে তা মুছে দিলাম।
তুই আমার মা বলে যাকে আজ সকালে প্রণাম করলি, সে আমার মা নয়।
আমি মিত্রার চোখের দিকে স্থির চোখে তাকালাম। কি বলতে চায় মিত্রা ?
আমি বাবার ঔরস জাত জ্যেঠিমনির সন্তান। বাবার সঙ্গে জ্যেঠিমণির অবৈধ সম্পর্ক ছিল।
আমি মিত্রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
একমাত্র বাবা আর জ্যেঠিমনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ জানত না। আমি হওয়ার পর বাবা আইনত জ্যেঠিমনির কাছ থেকে আমাকে দত্তক নিয়েছিল।
মিত্রা থামলো।
তুই বিশ্বাস কর আমি এতোসব জেনেছি বাবার দিনলিপি পরে। বাবা ডে টু ডে ডিটেলসে সব লিখেছে। এমনকি জ্যেঠিমণির সঙ্গে কবে কবে সেক্স করেছে তাও।
জ্যেঠু।
জ্যেঠু আমার হওয়ার মাস তিনেক আগে মারা গেছেন। সেটা সুসাইড ছিল।
কেন ?
তুই বুঝে নে।
তোর যে আর এক বোন ছিল।
ওটা জ্যেঠুর।
তাহলে তোর মা বলে যাকে দেখেছি ?
উনি আমার বাবার সেক্স পার্টনার। বলতে পারিস ক্যাশ বাক্স। আমি যেমন ছিলাম শয়তানটার। বাবার সঙ্গে ওনার বয়সের ডিফারেন্স প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের। ওনার সঙ্গে বাবার আলাপ ক্লাবে। পয়সা ওয়ালা ঘরের মেয়ে। বাবা কনোদিন ওনাকে বিয়ে করেন নি। এই বাড়িটা কিনে উনি এখানে ওনাকে রেখেছিলেন।
কিন্তু আমি তো ওনাকে ও বাড়িতে দেখেছি।
দাদু খুব স্ট্রিক্ট প্রিনসিপালের লোক ছিলেন। দাদু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন ওনার প্রবেশাধিকার ছিল না। দাদু মারা যাবার পর উনি ওই বাড়িতে প্রবেশাধিকার পান।
তারপর।
এনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জ্যেঠিমনির সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়েছে। জ্যেঠিমনি প্রথমে আমাকে দিতে চান নি। পরে দাদুর চাপে আর বাবার ব্ল্যাকমেলিংয়ে আমাকে দিতে বাধ্য হন। হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। তুই ওপর থেকে কিছু বুঝতে পারিস নি।
তুই কাকে মা বলতিস।
জ্যেঠিমনিকে। ওনার কাছেই তো ছোট থেকে মানুষ।
তাহলে এই মা।
কলেজ লাইফে এসে পেলাম।
তখন তুই কিছু বলিসনি।
একথা কাউকে বলা যায়। আমার বাবা বিয়ে করেছেন।
তাহলে তুই তোর বাবাকে ভালো লোক বলিস কি করে ?
শোন আমার কথা।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
বড়মার সঙ্গে ওই ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর। বাবা মেন্টালি ডিসব্যালেন্সড হয়ে যান। তারপর জ্যেঠিমনির জন্য সুস্থ হন। বলতে পারিস তারপর থেকে জ্যেঠিমনি বাবা ক্লোজ হয়ে পরেন।
জ্যেঠু কি করতো।
পারিবারিক ব্যবসা, কাগজ। তখন শেয়ার অত্যন্ত কম ছিলো। পাঁচ পার্সেন্ট।
তোর বাবা কি করতেন।
কাগজ দেখতেন। আর শেয়ারের কারবার। বলতে পারিস ব্রোকার। আমার তথাকথিত মার পরিবারেরও শেয়ারের ব্যবসা। বাবার প্রচুর উচ্চাকাঙ্খা ছিল। বাবা মার বাড়ির সম্পত্তি পায়। কাগজের ভাগটাও কিছুটা সেই পরিবারের।
মানে!
আমার মার পরিবার দামানি। ওরা অবাঙালি।
তারপর।
বাবা মার কাছ থেকে তার সম্পত্তি জোড় করে লিখিয়ে নেন। মানে কাগজের ভাগ। তারপর কাগজটাকে আস্তে আস্তে কুক্ষিগত করেন। আমাদের পরিবারের ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ারও নিয়ে নেন। বাড়িটা জ্যেঠিমনিকে ছেড়ে দেন।
টোটাল প্রপার্টি!
হ্যাঁ ফাইভ পার্সেন্টের যা মূল্য।
বাবা জানতেন বড়মা অমিতাভদার স্ত্রী হিসাবে অমিতাভদার কাছে থাকেন। দাদা দামানিদের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। মিঃ দামানি আর আমার দাদু দুজনে খুব বন্ধু মানুষ। মিঃ দামানি দাদুকে শেয়ারটা কিনিয়ে দিয়েছিলেন। ওদের হাতেই সিংহভাগ শেয়ার ছিল। বাকিটা আর তিন চারজনের কাছে।
তারপর।
বাবা অমিতাভদাকে কব্জা করার জন্য ছলে বলে কৌশলে সব শেয়ার কিনে নিলেন। বলতে পারিস ঘুরিয়ে বড়মাকে শাস্তি দান। কিন্তু মার বাবা আমার মামাদাদু খুব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন তা করতে দেন নি। বাবা মারা যাবার বছর খানেক আগে মামাদাদু মারা যান। বাবা দামানিদের পুরো শেয়ারটা নিয়ে নেয়।
তখন বাবার অনেক পয়সা। দারুণ প্রতিপত্তি। কাগজটা বাবা পুরো পুরি কব্জা করে ফেলেছেন। কিন্তু আমার তথাকথিত মার সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়ে যায়। মা আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। বাবার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করতেন। সেই সময় বাবার ক্যানসার ধরা পরলো। মার নতুন বন্ধু ডাক্তারের প্রবেশ। মার সঙ্গে রেগুলার ঝগড়া। বাবার অসহায় মুখটা মনে পরে যায়।
জ্যেঠিমনির কাছে যাই। দু’একদিন এসেছিলেন। মা বাবার অমতে জোর করে সেই শয়তানটার সঙ্গে আমার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করায়, তলারও খাবে গাছেরও কুরবে। এটা বলতে পারিস বাবার প্রতি মার রিভেঞ্জ। আমি তখন দিশেহারা। এক কথায় বলতে পারিস বলির পাঁঠা। আমি না পারছি ও বাড়িতে ফিরে যেতে, না পারছি এ বাড়িতে থাকতে। তখন আমার মনের কি পরিস্থিতি তোকে বোঝাতে পারব না।
তারপর।
আমি অনেকক্ষণ ফটোটা লক্ষ করলাম। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
চিনতে পারছিস।
মনে হচ্ছে বড়মাকে যদি এই বয়সে নিয়ে যাই, তাহলে ছবিটার সঙ্গে বড়মার মুখশ্রী মিলে যাবে।
মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো।
দ্যাটস রাইট বুবুন, তুই একেবারে ঠিক কথা বলেছিস।
তাই!
মিত্রা চোখের ভাষায় আর ঘাড় দুলিয়ে, হ্যাঁ বললো।
তুই পেলি কোথায় ?
প্রশ্ন করবি না। খালি দেখে যা। আমি তোর মতো হতে পারছি কিনা বল।
এবার এই ছবিটা দেখ।
বিবাহ বাসরে তোলা ছবি। সবে বিয়ে হয়েছে। একজন মিত্রার বাবা আর একজন সেই ভদ্রমহিলা মানে বড়মা। তারমানে বড়মার সঙ্গে মিত্রার বাবার বিয়ে হয়েছিল! আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। মিত্রা আমার চোখের দিকে জুল জুল করে চেয়ে আছে। আমি কি বলি।
তোর বাবার সঙ্গে বড়মার বিয়ে হয়েছিল!
ইয়েস ইয়েস বুবুন তুই একেবারে ঠিক।
মিত্রার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো।
তুই প্রমাণ পেলি কি করে।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তোকে সব বলবো বুবুন, তুইযে আমার সব, তোকে বলতে না পারলে আমি শান্তিতে মরতেও পারব না।
এই দেখ একটা পোস্ট কার্ড।
হাতে নিয়ে পরলাম। ফর্মাল চিঠি কন্যাদায় গ্রস্ত পিতা আর একজনের পুত্রের সঙ্গে তার মেয়ের বিবাহ দিতে চান। নিচে বসিরহাটের ঠিকানা। আর মিত্রাদের বাড়ির ঠিকানা।
পড়লি।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
জানিস বাবা এরপর বড়মাকে দেখতে যান, পছন্দ হয়, বিবাহ হয়। বাবা তার দিনলিপিতে এটা লিখে গেছে। তোকে পরাব। তারপরের ঘটনা তুই জানিস। বড়মা পীর সাহেবের থানে নিজে মুখে সব স্বীকার করেছে। তোকে নতুন করে কি বলবো। বাবা আর কোনদিন বিবাহ করেন নি।
আমি চমকে মিত্রার দিকে তাকালাম।
ভাবছিস আমি পৃথিবীর আলো দেখলাম কি করে।
আমি এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি তোকে ফাঁকি দিতে চাইনি বুবুন, তুই বিশ্বাস কর। আমি ভীষণ লোভী।
মিত্রা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো।
আমি মিত্রাকে কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
মিত্রা আমার বুকে মাথা রেখেছে। চোখ বন্ধ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি মিত্রার গালে আস্তে করে থাপ্পর মারলাম। মিত্রা চোখ খুললো।
কিরে, শরীর খারাপ লাগছে।
মিত্রা অস্ফুট কিছু বলতে চাইল, বলতে পারল না।
আমি জলের বোতলটা কাছে টেনে নিয়ে মিত্রার চোখে জল দিলাম। আমার পরনের কাপরটা দিয়ে মুছিয়ে দিলাম।
কষ্ট হচ্ছে।
মিত্রা আমর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
যে কথা ছ’বছর ধরে নিজের বুকের মধ্যে বয়ে বেরিয়েছি, আজ তোকে বললাম। তুই ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি জানে না।
একটুক্ষণ থেমে।
বুকের ভেতরটা ভীষণ ব্যাথা করছে, জানিস বুবুন।
হুকটা একটু খোল আমি হাত বুলিয়ে দিই।
না থাক, একটু সহ্য করতে শিখি। তুই আমার থেকে আরও কষ্ট পেয়েছিস।
আমি মিত্রার মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
নারে বুবুন সত্যি। এখন তুই আছিস, আমার আর ভয় নেই। আমার আর কিছু হবে না, দেখিস।
আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো, প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু কষ্ট আছে। যা সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজস্ব। সেটা ভাগ করে নেওয়া যায় না। হয়তো অনুভব করা যায়। তার কষ্টের সমব্যাথী হওয়া যায়। কিন্তু শেয়ার করা যায় না।
জানিস বুবুন, বড়মা যে দাদার সঙ্গে থাকেন, বাবা সেটা জানতেন।
উনি জানতেন! তা সত্বেও….
বাবার দিনলিপি তার প্রমাণ।
জানিস, বাবা মারা যাবার আগে আমার আর মার মধ্যে প্রপার্টি ভাগ করে দিলেন।
মিত্রা আমার ডানহাতটা ওর হাতে তুলে নিল।
তখনি আমার একটা খটকা লেগেছিল। কিন্তু কাউকে বলিনি। বাবা আমার বয়ফ্রেন্ড। বাবার কাছে আমি কখনো কনো কথা কোনদিন গোপন করিনি। সিনেমা হলে তোর হাত নিয়ে যেদিন বুকে রেখেছিলাম বাবাকে এসে অকপটে সব স্বীকার করেছি।
বাবা হেসে বলেছিলেন ছেলেটাকে তুমি একবার আমাকে দেখাতে পার। আমি মাথা দুলিয়ে বলেছিলাম পারব। উনি বলেছিলেন কবে ? আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ও ভীষণ মুডি, আমার ইচ্ছের ওপর আসবে না। বাবা হেসেছিলেন। একটু মনে করে দেখ তারপর তোকে প্রথম আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম।
স্বরস্বতী পূজোর দিন।
এইতো তোর মনে আছে।
সেইদিন বাবার আচার আচরণে তুই কিছু বুঝতে পেরেছিলি।
কাঁচা মন, তখন এতো সব ঘোর-প্যাঁচ বুঝতাম না। সত্যি কথা বলতে কি তখন আমার চোখে সব রঙ্গীন। গ্রাম থেকে একটা ছেলে শহরে এসেছে। কেরিয়ার তৈরি করতে হবে। কলেজে দাদা হতে হবে, একটা হামবড়ক্কি ভাব। মাঝে মাঝে সেই দিন গুলর কথা মনে পরলে হাসি পায়।
বাবা তোকে দেখার পর, তোর সঙ্গে কথা বলার পর বলেছিলেন আমার অমত নেই।
মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
তুই একটু ভেবে দেখ, তখন আমাদের সেকেন্ড ইয়ার চলছে।
হ্যাঁ।
আমাদের ঘনিষ্ঠতা এরপর আরও বেড়েছে। তুই আমাদের বাড়ি এসেছিস কম, কিন্তু আমি তোর হোস্টেলে প্রায় গেছি।
ঠিক।
জানিস বুবুন, বাবা মারা যাবার পর আমি নিজেকে নিজে আবিষ্কার করলাম, আমি কে ?
কলেজে পড়ার সময় আমি জানতাম না কে আমার মা ? ছোট থেকে জানতাম আমার মা আমার জন্মের পর আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি জ্যেঠিমনির কাছেই মানুষ। জ্যেঠিমনি আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।
মিত্রা!
হ্যাঁ। বুবুন তুই বিশ্বাস কর। আমি তোকে….
মিত্রার চোখ দুটো জলে টল টল করছে। আমি ঠোঁট দিয়ে তা মুছে দিলাম।
তুই আমার মা বলে যাকে আজ সকালে প্রণাম করলি, সে আমার মা নয়।
আমি মিত্রার চোখের দিকে স্থির চোখে তাকালাম। কি বলতে চায় মিত্রা ?
আমি বাবার ঔরস জাত জ্যেঠিমনির সন্তান। বাবার সঙ্গে জ্যেঠিমণির অবৈধ সম্পর্ক ছিল।
আমি মিত্রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
একমাত্র বাবা আর জ্যেঠিমনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ জানত না। আমি হওয়ার পর বাবা আইনত জ্যেঠিমনির কাছ থেকে আমাকে দত্তক নিয়েছিল।
মিত্রা থামলো।
তুই বিশ্বাস কর আমি এতোসব জেনেছি বাবার দিনলিপি পরে। বাবা ডে টু ডে ডিটেলসে সব লিখেছে। এমনকি জ্যেঠিমণির সঙ্গে কবে কবে সেক্স করেছে তাও।
জ্যেঠু।
জ্যেঠু আমার হওয়ার মাস তিনেক আগে মারা গেছেন। সেটা সুসাইড ছিল।
কেন ?
তুই বুঝে নে।
তোর যে আর এক বোন ছিল।
ওটা জ্যেঠুর।
তাহলে তোর মা বলে যাকে দেখেছি ?
উনি আমার বাবার সেক্স পার্টনার। বলতে পারিস ক্যাশ বাক্স। আমি যেমন ছিলাম শয়তানটার। বাবার সঙ্গে ওনার বয়সের ডিফারেন্স প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের। ওনার সঙ্গে বাবার আলাপ ক্লাবে। পয়সা ওয়ালা ঘরের মেয়ে। বাবা কনোদিন ওনাকে বিয়ে করেন নি। এই বাড়িটা কিনে উনি এখানে ওনাকে রেখেছিলেন।
কিন্তু আমি তো ওনাকে ও বাড়িতে দেখেছি।
দাদু খুব স্ট্রিক্ট প্রিনসিপালের লোক ছিলেন। দাদু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন ওনার প্রবেশাধিকার ছিল না। দাদু মারা যাবার পর উনি ওই বাড়িতে প্রবেশাধিকার পান।
তারপর।
এনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জ্যেঠিমনির সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়েছে। জ্যেঠিমনি প্রথমে আমাকে দিতে চান নি। পরে দাদুর চাপে আর বাবার ব্ল্যাকমেলিংয়ে আমাকে দিতে বাধ্য হন। হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। তুই ওপর থেকে কিছু বুঝতে পারিস নি।
তুই কাকে মা বলতিস।
জ্যেঠিমনিকে। ওনার কাছেই তো ছোট থেকে মানুষ।
তাহলে এই মা।
কলেজ লাইফে এসে পেলাম।
তখন তুই কিছু বলিসনি।
একথা কাউকে বলা যায়। আমার বাবা বিয়ে করেছেন।
তাহলে তুই তোর বাবাকে ভালো লোক বলিস কি করে ?
শোন আমার কথা।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
বড়মার সঙ্গে ওই ব্যাপারটা ঘটে যাবার পর। বাবা মেন্টালি ডিসব্যালেন্সড হয়ে যান। তারপর জ্যেঠিমনির জন্য সুস্থ হন। বলতে পারিস তারপর থেকে জ্যেঠিমনি বাবা ক্লোজ হয়ে পরেন।
জ্যেঠু কি করতো।
পারিবারিক ব্যবসা, কাগজ। তখন শেয়ার অত্যন্ত কম ছিলো। পাঁচ পার্সেন্ট।
তোর বাবা কি করতেন।
কাগজ দেখতেন। আর শেয়ারের কারবার। বলতে পারিস ব্রোকার। আমার তথাকথিত মার পরিবারেরও শেয়ারের ব্যবসা। বাবার প্রচুর উচ্চাকাঙ্খা ছিল। বাবা মার বাড়ির সম্পত্তি পায়। কাগজের ভাগটাও কিছুটা সেই পরিবারের।
মানে!
আমার মার পরিবার দামানি। ওরা অবাঙালি।
তারপর।
বাবা মার কাছ থেকে তার সম্পত্তি জোড় করে লিখিয়ে নেন। মানে কাগজের ভাগ। তারপর কাগজটাকে আস্তে আস্তে কুক্ষিগত করেন। আমাদের পরিবারের ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ারও নিয়ে নেন। বাড়িটা জ্যেঠিমনিকে ছেড়ে দেন।
টোটাল প্রপার্টি!
হ্যাঁ ফাইভ পার্সেন্টের যা মূল্য।
বাবা জানতেন বড়মা অমিতাভদার স্ত্রী হিসাবে অমিতাভদার কাছে থাকেন। দাদা দামানিদের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। মিঃ দামানি আর আমার দাদু দুজনে খুব বন্ধু মানুষ। মিঃ দামানি দাদুকে শেয়ারটা কিনিয়ে দিয়েছিলেন। ওদের হাতেই সিংহভাগ শেয়ার ছিল। বাকিটা আর তিন চারজনের কাছে।
তারপর।
বাবা অমিতাভদাকে কব্জা করার জন্য ছলে বলে কৌশলে সব শেয়ার কিনে নিলেন। বলতে পারিস ঘুরিয়ে বড়মাকে শাস্তি দান। কিন্তু মার বাবা আমার মামাদাদু খুব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন তা করতে দেন নি। বাবা মারা যাবার বছর খানেক আগে মামাদাদু মারা যান। বাবা দামানিদের পুরো শেয়ারটা নিয়ে নেয়।
তখন বাবার অনেক পয়সা। দারুণ প্রতিপত্তি। কাগজটা বাবা পুরো পুরি কব্জা করে ফেলেছেন। কিন্তু আমার তথাকথিত মার সঙ্গে বাবার দূরত্ব বেড়ে যায়। মা আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। বাবার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করতেন। সেই সময় বাবার ক্যানসার ধরা পরলো। মার নতুন বন্ধু ডাক্তারের প্রবেশ। মার সঙ্গে রেগুলার ঝগড়া। বাবার অসহায় মুখটা মনে পরে যায়।
জ্যেঠিমনির কাছে যাই। দু’একদিন এসেছিলেন। মা বাবার অমতে জোর করে সেই শয়তানটার সঙ্গে আমার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করায়, তলারও খাবে গাছেরও কুরবে। এটা বলতে পারিস বাবার প্রতি মার রিভেঞ্জ। আমি তখন দিশেহারা। এক কথায় বলতে পারিস বলির পাঁঠা। আমি না পারছি ও বাড়িতে ফিরে যেতে, না পারছি এ বাড়িতে থাকতে। তখন আমার মনের কি পরিস্থিতি তোকে বোঝাতে পারব না।
তারপর।