What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

উপন্যাস: কেবল প্রান্তর জানে তাহা by নির্জন আহমেদ (1 Viewer)

[HIDE]

অধ্যায় ৬ঃ প্রত্যাবর্তন
সপ্তাহের প্রথম দিন থেকেই চাতকের মতো শুক্রবার কামনা করতে করতে, শুক্রবারটা চলেই আসে। সপ্তাহের মাঝে, সোম কিংবা মঙ্গলবার ওর মনে হয়, শুক্রবার বুঝি আর আসবেই না, ওকে আজীবন সকাল আটটা পাঁচটা কামলা খাটতে হবে হাবসি গোলামদের মতো আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে শরীর ছেড়ে দিতে হবে ক্লান্ত বিছানায়। যেদিন সত্যিই চলে আসে বৃহস্পতিবার, সেদিন ও বুঝতে পারে না কী করবে! যে অবসর ও প্রার্থনা করে, যে অবসরের জন্যে হাপিত্যেশ করা পুরো সপ্তাহ, সেই অবসরই ওর শত্রুতে পরিণত হয়।
কী করবে ও এই অখণ্ড অবসরে? এখানে ওর কোন বন্ধু হয়নি। সবাই ওকে পরপর ভাবে। ওদের দলে মেশার চেষ্টা করে দেখেছে নির্জন। পারেনি। কী একটা দেয়াল ওকে আলাদা করে রেখেছে গার্মেন্টসের আর সব শ্রমিকদের থেকে।
কয়েকটা অবিবাহিত খেটে খাওয়া টান টান ফিগারের মেয়ে আর বিবাহিত দুএকজন শুধু ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, বাঁকা চোখে তাকায়- হরমোনের টান, জানে নির্জন- আর কিছুই হয়।
আজও তেমন এক বৃহস্পতিবারে কী করবে বুঝতে না পেরে একের পর এক সিগারেট ফুঁকতে থাকে ও। সারাদিন ভ্যাঁপসা গরমের পর সন্ধ্যার আকাশটা হঠাত ম্যাদা মেরে যাওয়ায়, স্বস্তি ফিরেছে একটু জনমনে। নির্জনের প্রতিবেশী কয়েকটা তেলাপোকা ঘরের দেয়ালে দেয়ালে পাখা মেলে উড়ছে, দেখছে তাদেরই নির্জন শূন্য চোখে, নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। কাফকার কোন যেন এক গল্প নাকি উপন্যাসে, একজন শুঁয়োপোকা হয়ে যায় না? তেমন হতে পারলে ভালো হতো। এদেরই জীবনই বাড়া কাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিত। শুধু জন্মানো, খাওয়া, রমণ, সন্তানোৎপাদন আর মৃত্যু। মাঝে শালার কিছুই নেই। প্রত্যাশা, দায়িত্ব, চাপ নেই। আশাভঙ্গের প্যারা নেই। অন্তত সারা সপ্তাহ অপেক্ষার পর অখণ্ড অবসরে কী করবে, সেটা ভেবে মরার কারণ নেই!
"ভাই সাহেব, আছেন নাকি?"
দরজায় আফজাল মোহাম্মদের ছায়া দেখতে পায় নির্জন। এমন খারাপ সময়ে, ঠিক যেটা ও চায় না, সেটাই হয়ে থাকে ওর সাথে। আফজাল মোহাম্মদের সঙ্গ প্রথমদিন থেকেই অসহ্য লাগে ওর। ভাবির স্বামী না হলে, ভাবি ওকে সপ্তাহে অন্তত দুতিন বার লাগাতে না দিলে, ওকে এমন ঠাট্টা করে "ভাইসাহেব" বলার কারণে হয়তো রক্তারক্তি করে ফেলতো নির্জন।
"আছি। আসেন!"
সিগারেটটায় একটা টান দিয়ে একটা ভাঙ্গা প্লেটে, যেটাকে ও ব্যবহার করে আসছে এসট্রে হিসেবে, মোতাটা ফেলে দেয়।
খালি গায়ে পান চিবুতে চিবুতে ঘরে এসে নির্জনের সামনে থাকা চেয়ারে আয়েস করে বসে আফজাল মোহাম্মদ। ওর বসার ধরণ দেখেই নির্জন বুঝতে পারে, দু মিনিটের মধ্যে এর চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই!
আফজাল মোহাম্মদ বলে, "তা কী করতেছিলা? ফ্রি আছো তো নাকি?"
"ফ্রি বলতে, যাচ্ছি এক জায়গায়। অনেকদিন ক্যাম্পাস যাই না। ভাবলাম একটু আজ ক্যাম্পাস থেকে ঘুরে আসি!"
কথাটা বলে নির্জন নিজেই চোদনা হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিলো না ওর। এখন এই ভর সন্ধ্যায় সাভার থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি পৌঁছাতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক লাগবে!
আফজাল মোহাম্মদ বোধহয় এই উত্তর আশা করেনি। তাকে বেশ আশাহতই লাগে। বলে, "ইউনিভার্সিটি যাইবা? তা যাও সমস্যা নাই। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো আরকি!"
নির্জন আফজাল মোহাম্মদের মুখের দিকে তাকায়।
লোকটা নির্জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, লম্বা দাঁড়িতে ঢাকা মুখে ফুটে নেই কোন অভিব্যক্তি। চাহনি শীতল।
আমচকা নির্জনের বুক ধুকপুক করতে থাকে। এই লোক নাসরিন ভাবি আর ওর পরকীয়ার ব্যাপারটা জেনে ফেলেছেন নাকি? সেদিন তো ওর ছেলে ছিল দাঁড়িয়ে- ছেলেকে দরজায় রেখেই নির্জন চুদেছে ওর মাকে। ও কিছু বুঝতে পারেনি তো? বলে দিয়েছে কথাটা আফজাল মোহাম্মদকে? নাকি আফজাল মোহাম্মদ নিজেই জেনেছে কোন উপায়ে? সেদিন বেশ জোরে চাপড় মেরেছিলো নির্জন ভাবির পাছায়, সম্ভবত দাগ বসে গিয়েছিলো। আফজাল মোহাম্মদ সে রাতে ভাবিকে চুদতে গিয়ে খেয়াল করেনি তো সে দাগ?
আবার ভাবে, "ওটা হলে কী এমন শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলার কথা?
নির্জন আমতা আমতা করে বলে, "বলেন, কী বলবেন?"
"এসব কথা আসলে তাড়াহুড়ার না। তুমি না হয় আসো। তারপর বলবো!"
নির্জন বলে, "না না। আপনি বলেন। সমস্যা নাই। সেদিনও কী যেন বলতে চাইছিলেন..."
"তাই বইলাই ফেলি। দেড়ি করনের দরকার নাই!"
নির্জন উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায়। ভাবির কথা বলতে বলতে যদি লোকটা ক্ষেপে যায়, পালাতে হবে তো!
আফজাল মোহাম্মদ বলে, "আমার ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে। বড় ভাই আরকি। মেয়েটা এইবারে অনার্স ভর্তি হইব। এডমিশন টেস্ট ফেস্ট দিবো। মেয়েটা সুন্দরী। অনেক সুন্দরী। বিয়ার কথাবার্তা চলতাছে।"
ধরে প্রাণ আসে যেন নির্জনের। কী না কী ভেবেছিলো ও!
আফজাল মোহাম্মদ থামে, এবং থেমে নির্জনের মুখের দিকে তাকায়। বলে, "কী হুনতাছো তো?"
"হ্যাঁ, আপনি বলেন।"
"বিয়ার যেহেতু কথাবার্তা চলতাছে। ভাই আমাকেও কইছে, ভালো পাত্র থাকলে তারে জানাইতে। তা আমি ভাবলাম, ভালো পাত্র তো আমার জানাই আছে। তুমি তো আর খারাপ ছেলে না। তা তুমি চাইলে মেয়েটাকে একবার দেখবার পারো। কসম খ্যায়া কইতা পারি, মেয়ে আমাদের অপছন্দ করার মতন না। এক্কেবারে পরীর মতোন সুন্দরী!"
আফজাল মোহাম্মদ আবারও থেমে প্রতিক্রিয়ার আশায় নির্জনের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ও কিছু বলছে না দেখে বলেন, "কী কথা কইতেছো না কেন? শরম খাইতেছো নাকি?"
লজ্জা ওর পাওয়া উচিত কিনা সেটা ভাবে নির্জন। জীবনে এই প্রথম কেউ একজন ওর সাথে বিয়ের আলোচনা করছে, অথচ ও লজ্জা পাচ্ছে না, এটা কি অস্বাভাবিক কিছু? ও কি প্রতিদিন একটু একটু করে স্বাভাবিকতা বর্জিত মানুষে পরিণত হচ্ছে?
আফলাল মোহাম্মদ তার পানে খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসার মতোন একটা মুখভঙ্গি করে বলে, "আসলে শরম খাওয়ারই কথা। এইসব তো আমার বলার কথা তোমার মুরুব্বির সাথে। মুরুব্বি যেহেতু নাই, কাজেই..."
নির্জন বলে, ওকে বলতেই হয়, "আসলে, ভাই, আমার বিয়া করার ইচ্ছা এখন নাই। এই চাকরি করে নিজেরই চলে না। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। এক বোন আছে অবিবাহিত..."
নির্জনকে শেষ করতে দেয় না আফজাল মোহাম্মদ। বলে ওঠে, "আরে এইসব তো আমি জানি। খোঁজ নিছি আমি তোমার ভাবির কাছে। এইসব সমস্যা তো সবারই থাহে। আমারে দেইখ্যা কিন্তু আমার বড় ভাইরে বিচার কইরো না। ভাই আমার গেন্ডারিয়ায় থাকে। কাঠের ব্যবসা আছে। বড় ব্যবসা। টাকা আছে। আমি তো কপালের দোষে আজ গার্মেন্টস খাটতে আসছি। আর ছুডো ভাইটার অবস্থাও ভালো!"
নির্জন কিছু না বলে শুনতে থাকে। আফজাল মোহাম্মদ চালাতেই থাকে তার বাকযন্ত্র!
"তোমার দাবি-দাওয়া মিটাইতে পারবে। সেই ক্ষমতা আমার ভাইজানের আছে। আর মেয়ে ভাইয়ের একটাই! ভাইয়ের ইচ্ছা, একটা ভালো পাত্র পাইলে মেয়েকে নিজের কাছেই রাখবে। জামাইও থাকবে। ব্যবসায় সাহায্য টাহায্য করবে!"
"মানে, ঘর জামাই?", এবারে থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করে নির্জন।
আফজাল মোহাম্মদ ব্যস্ত হয়ে বলে, "আরে ঘর জামাই না। ঘর জামাই না। নিজের কাছে রাখতে চায় আরকি। ঢাকায় নিজের বাড়ি আছে। ছেলে তো নাই। বাড়ি ব্যবসা সব তো মেয়েরই। মেয়ে থাকবে নিজের বাড়ি। জামাইয়ের ইচ্ছা করলে অন্য ব্যবসা করবে। খালি ভালো একটা পাত্র দরকার। ছেলে ভালো হইলে ভাই ব্যবসা করার পুঁজিও দেবে বলছে!"
এবারে খোলসা হয় নির্জনের কাছে। এতক্ষণে অরিন্দম বুঝিলা বিষাদে!

[/HIDE]
 
[HIDE]

আফজাল মোহাম্মদের ব্যবসায়ী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, আফজাল মোহাম্মদেরই ভাষ্য মোতাবেক, তাহার অতীব সুন্দরী একমাত্র সুকন্যার সহিত বিবাহ প্রদানের নিমিত্তে জন্য একজন বোকাচোদা ধরণের শিক্ষত গরীব পাত্র খুঁজিতেছেন যাহাতে সে ঘরজামাই হইয়া তাহার মেয়ের গোলাম হইয়া থাকিতে পারে এবং তাহার সম্পত্তি পুত্রের মতো দেখাশোনা করিবার সহিত মেয়েকেও বছরান্তে একটি করিয়া সন্তান দান করিয়া বংশ রক্ষা করিতে পারে!
নির্জন, "ঘর জামাই'ই! এটাকে আর ভালো করে বলার উপায় নাই! আপনার মিয়া কেমন করে মনে হলো, আমি এমন প্রস্তাবে রাজী হব?"
আফজাল মোহাম্মদ বলে, "আরে বাবা, না। ভাই আমার বড়লোক। আর দরকার একটা ভালো পাত্র। আর কিছু না। ছেলে কিছু না করলেও তার যায় আসে না!"
এমন ঘটনার কথা অনেক শুনেছে নির্জন। শুনেছে, একসময় নাকি কন্যাদায়গ্রস্থ বাবারা সলিম্মুল্লাহ হল আর ইকবার হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। গ্রাম থেকে দরিদ্র পরিবারের কোন সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেই খোঁজ লাগাতো তার জন্যে। দরিদ্র পরিবারের সেসব ছেলে ধরাও দিতো সেসব ফাঁদে। বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে করে সংসার ফেঁদে ফেলার ঘটনাও কম ঘটেনি। সেসময়ে বেশিরভাগ ছেলেই অল্প বয়সে বিয়ে করতো বলে, অনেকেই ঢাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করার সুযোগও পেয়েছিলো এ কারণেই। এটাও সেইম কেইস।
নির্জন বলল, "আপনি আমার কথা বুঝছেন না। আমার এখনো বিয়ার বয়সই হয় নাই! এই তো কেবল অনার্স শেষ হলো। চাকরি টাকরি করি আগে!"
"চাকরি তো একটা করতাছো। এইটা কী চাকরি না? বেতনও তো কম না শুনছি!"
নির্জন কী করে এই সাভারেই অর্ধেক জীবন কাঁটিয়ে দেয়া অর্ধশিক্ষিতকে বোঝাবে, এদেশে সম্মানজনক আরো অনেক চাকরি আছে যেখানে অন্তত এখানকার মতো গতর খাটাতে হয় না!
নির্জন বলে, "না ভাই। এখন না। আমার এইখানে পড়ে থাকার কোন ইচ্ছা নাই। আমি সরকারী চাকরির চেষ্টা করছি!"
নাছোড়বান্দার মতো আফজাল মোহাম্মদ বলে, "মেয়েটাকে একবার দেখো খালি। আমি তো কইতাছি, এই মেয়েরে তোমার অপছন্দ হবে না। অতীব সুন্দরী। এতো সুন্দরী মেয়ে আমি চর্মচক্ষে দেখি নাই।"
আফজাল মোহাম্মদ এতোবার "অতীব" শব্দটা ব্যবহার করায় বিরক্ত হয় নির্জন। আর কি কোন বিশেষণ জানার নেই লোকটার? অত্যন্ত, খুব, অনেক, অপূর্ব এমন অঢেল প্রচলিত শব্দ তো ব্যবহার করতে পারে! "আমার ভাবিজান, বড় ভাইয়ের বৌ, অনেক বড় ঘরের মাইয়া। তিনিও অতীব সুন্দরী ছিলেন বয়সকালে। তার বাপে পাকিস্তান আমলে একবার স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে খাড়াইছিলো। মুসলিম লিগ থাইকা। অনেক বড় ঘর আছিল। মেয়ে পাইছে তার মায়ের রূপ! কোন দিক থাইকাই তোমার অপছন্দ হওয়ার কারণ নাই! আর আমার বড় ভাই তো তার শ্বশুরের ব্যবসাই করে এহনো। এই কইরাই তো আজ কোটিপতি!"
অতীব সুন্দরী কন্যার বাপ, আফজাল মোহাম্মদের ভাই, নিজেও তবে ঘর জামাই! বংশ পরাম্পরা রক্ষা করতে চায় নাকি?
মেয়েটাকে দেখার যা'ও বা একটু ইচ্ছে ছিলো, তার নানার মুসলিমলীগের সাথে সম্পৃক্ততার কথা শুনে, সেটুকুও মরে গেল নির্জনের।
বললো, "বিয়া করবোই না যেখানে, সেখানে দেখে কী লাভ? আর এতো সুন্দর মেয়ে, বাপের এতো সম্পত্তি, ছেলের কী আর অভাব হবে? কতো ছেলে হাঁ করে আছে এমন মেয়ের জন্যে!"
আফজাল মোহাম্মদ উঠে দাঁড়ায় এবারে। তার মুখে অসন্তুষ্টি চাপা থাকে না।
"তাইলে আর কী করার। তোমার অনেক বড় ইচ্ছা। চাকরি করবা। অফিসার হবা। দেখো। খোয়াব দেখতে তো অসুবিধা নাই। তয় কিনা এমন সুযোগ আর পাইবা না কইলাম!"
জবাবে বলে না কিছুই নির্জন।
দরজা ঠেলে বাইরে চলে যাচ্ছিলেনই- আফজাল মোহাম্মদ ফিরে দাঁড়ায় কী মনে করে।
জিজ্ঞেস করে, "সেদিন তোমার ভাবির কাছে শুনলাম। কীসের একটা ইন্টারভিউ না কী যেন দিতে গেছিলা? হইছে চাকরি ঐটার?"
"হয় নাই!"
"ও আচ্ছা। আচ্ছা তাইলে থাকো..."
যেমন এসেছিলেন, হাতির মতো মন্দ্রগমনে, গেলেন তার ঠিক উল্টো গতিতে, গটগট করে।
শেষের প্রশ্নটার উত্তর তিনি জানতেন নিশ্চয়ই, ভাবিকে ঐ স্কুলে চাকরি না হওয়ার কথাটাও বলেছে নির্জন। সে খোঁচাটা মারতে আফজাল মোহাম্মদ ভুললেন না। যাওয়ার সময় যেন বলে গেলেন, "খুব তো চাকরি করবো, আফিসার হবো হবো করতাছো। পাইতাছো কৈ? সামান্য স্কুলের একটা মাস্টারির চাকরি- সরকারিও না আবার সেইডা, পাইলা? পাইলা না!"
নির্জন গুম হয়ে বসে থাকে।
হঠাত আফজাল মোহাম্মদকে বলা কথাটা মনে পড়ে ওর।
হ্যাঁ। ক্যাম্পাসেই যাবে ও। এখানে আর এক মুহূর্ত না। অন্তত কয়েকটা ঘণ্টা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে আসবে। হলের সিটটা তো এখনো যায়নি। হলের ফ্লাইওভারে বসে খোলা আকাশের নিচে, আর দশজন মধ্যবিত্ত স্বপ্নবাজের মতো সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে ও। এতোদিন যেমন দেখতো, এখানে চাকরি নেয়ার আগে। বড় স্বপ্ন দেখে আসবে ও। সুন্দর, সললিত স্বপ্ন। এখানে এই কানাগলিতে ও কোন স্বপ্ন খুঁজে পায় না, আলোর আভাস দেখতে পায় না। এখানেই কেউ স্বপ্ন দেখে না। ভাগ্যের সাথে লড়াই করে, সকাল সন্ধ্যা খেটে কারো আর শক্তি অবশিষ্ট থাকে না স্বপ্ন দেখার।
বড় স্বপ্ন দেখতে ওকে ঢাবির মুক্ত প্রান্তরেই যেতে হবে।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে নির্জন!


[/HIDE]
 
[HIDE]


অধ্যায় ৭ঃ কথা ছিল সুবিনয়

ঢাকা কলেজের সামনের বিশাল জটলায় বাসটা থেমে যায় বলে নির্জন নেমে পড়ে। ও নীলক্ষেতেই নামবে ঠিক করেছিলো। শহরের নতুন মাতবরটা ঠিক করেছে রাত আটটার মধ্যেই খাবারের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুতের অপচয় রোধে, শুনেছে নির্জন। কবে থেকে হবে তা কার্যকর, জানে না।
নামলো যখন বাস থেকে, শরীরে যখন লেগে আছে বাসের গুমোট শ্বাস আর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধের বিড়ির গন্ধ, তখন ঘড়িতে বাজে দশটা। প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা লেগেছে সময়- পুরোটা রাস্তা ও এসেছে ঘুমিয়ে। এ অসময়ে, যদিও ঠিক এই প্রথম রাতের ঘুমটাকেই বলা হয় বিউটি স্লিপ, ও ঘুমোয়নি কয়েক হাজার বছর। বাসটা যখন ছাড়লো নবিনগর থেকে, জানলা দিয়ে হাওয়া এসে ওর নাকে, মুখে, কপালে, গালে আছড়ে পড়তে লাগলো স্রোতের মতো- চোখ খোলা রাখতে পারেনি আর ও সারাদিন খাটনির পর। ঘুমে অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে ওর মনে আফজাল মোহাম্মদের বলা কথাগুলো ইলিবিলি কাটছিলো শুধু।
বাস থেকে নেমেই সিগারেট ধরায় নির্জন। বেশ হাওয়া দিচ্ছে সন্ধ্যার পর, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এই মাঝ আষাঢ়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে পূর্বজন্মের শরতের কথা। ধোঁয়া ছেড়ে বড় একটা শ্বাস নেয় নির্জন। এইতো আর কয়েক পা এগুলেই মুক্তির সিংহদ্বার- মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ। তারপর? তারপর ও আর কোন স্বপ্নহীন, ভবিষ্যৎহীন পোশাক শ্রমিক নয়!
ওর শরীর থেকে উবে যাবে ক্লান্তির গন্ধ!
নীলক্ষেতের খাবারের দোকানের ছেলেগুলো খদ্দের ডাকছে। "এই কাচ্চি, মোরগ পোলাও এদিকে... পরোটা, রুটি, মাংস, মামলেট... এদিকে আসেন ভাই... উপরে স্পেশাল ব্যবস্থা আছে... এই কাচ্চি, মোরগ পোলাও, তেহারি..."
আগের মতোই আছে সব। এই অর্ধবৎসরে বদলায়নি কিছুই। গাইডের দোকানগুলোয় সমান ভিড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শিংগুলোকে এখানে ওখানে দল বেঁধে বই দেখছে। বিশ টাকার বইয়ের স্তূপে ঝুঁকে পছন্দের বই খুঁজছে কয়েকজন।
না, খাবারের দোকানগুলোয় কোন স্মৃতি নেই নির্জনের। ওর স্মৃতিরা সব হেঁটেছে এই গলিগুলো দিয়ে। বই দেখেছে, দেখেছে ম্যাগাজিন- পাতা উল্টাতে উল্টাতে আড় চোখে দেখেছে কোন কিশোরীর মুখের গড়ন, কবিতার লাইন থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি হেনেছে কোন অপরূপার নিলাজ চোখের কাজলে অথবা স্তনের উদ্বেল উচ্ছ্বাসে।
স্মৃতিময় গলিগুলোর দিকেই আবার পা বাড়ায় ও।
"ভাই, কী লাগবে বলেন... এই আইন বই এদিকে... ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেলের বই এদিকে... বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, বিসিএস, ব্যাংক ম্যাথ, জব সল্যুশন..."
বরাবরের মতো ওদের কারো ডাকেই সাড়া দেয়না নির্জন।
ও এসে থামে মোস্তফা চাচার দোকানে। না, এটা আর এখন মোস্তফা চাচার দোকান নয়। কোভিডের আগেই মোস্তফা চাচা দোকানটা বিক্রি করে চলে গিয়েছে। কিন্তু এখনো নির্জন দোকানটাকে মোস্তফা চাচার দোকান হিসেবেই চেনে। এই গাইড বই আর জব সল্যুশনের যুগে এখনো কেরোসিনের মৃদু কুপির মতো জ্বলে আছে কয়েকটি সাহিত্যের দোকান। সাহিত্যের দোকানই বটে! এই বাজারে এরা এখনো গাইড বইয়ের বদলে গল্প উপন্যাস বেচে জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করছে, এটাও অনেক সাহসের কথা বৈকি!
কী পায়নি এখানে সে? এই পুরাতন দুতিনটি দোকানে ও মিলন-হুমায়ুন-আনিসুলের সস্তা প্রেমের উপন্যাস থেকে শুরু করে পেয়েছে আখতারুজ্জাম ইলিয়াসের খোয়াবনামার প্রথম সংস্করণ। পেয়েছে শামসুর রাহমান, রফিক আজাদের কবিতার রাজপথ থেকে রুদ্রের আকাশের ঠিকানা।
দোকানের সাজানো পুরাতন বইগুলো থেকে রুদ্রের একটা কবিতা সংগ্রহ খুঁজে নেয় নির্জন। পাতার সোঁদা গন্ধে বুক ভরে যায় ওর। পাতাগুলো খুলে খুলে আসছে, বইপোকা করেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র। নিউজপ্রিন্টে ছাপানো বইয়ের অক্ষরগুলো ওকে যেন নিয়ে গেল গত শতাব্দীতে। বিগত শতাব্দীর এক তরুণ কিংবা তরুণী কোন এক ভালোবাসার চনমনে দিনে হয়তো মৃত কবির কথা ভেবে কম্পিত চিত্তে হাতে তুলে নিয়েছিলো বইটি। কবিতাগুলো থরথর কাঁপিয়েছিল তাকে। তারপর হয়তো এই কবিতাগুলিই একদিন তার কাছে হয়ে গিয়েছে অর্থহীন। কিংবা কোন ভুলে হয়ে গেছে হাতছাড়া। আজ এতদিন পর, অনেক হাত ঘুরে বইটি যখন উঠেছে নির্জনের করতলে, ততোদিনে এসেছে আরেক শতাব্দী আর খুলে খুলে আসছে পাতাগুলো, বইপোকা করেছে ছিদ্র কয়েকশো।
"খুব কাছে এসো না কোন দিন
যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে...
যে কাছাকাছির মাঝে বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে
মেঘের মেয়ে অতো কাছে এসোনা কোন দিন
দিব্যি দিলাম মেঘের বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির..."
পাতা ওল্টায় নির্জন। আরেকটি কবিতা। এবং আরেকটি তারপর। নামহীন কোন শাখানদীর চোরা স্রোত যেভাবে দোলায় তীরে বাঁধানো ডিঙি সেভাবেই দোলে ও। পুঁইডগা যেন। কবিতার রূপচিত্র ভেসে ভেসে ওঠে চোখে।
"কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বসবে না,
চিত্রল তরুণ হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না
রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।"
"এই, নির্জন না?"
চমকে ওঠে নির্জন। খুব চেনা গলার স্বরটি শুনে কেঁপে ওঠে ও। যতটা কাঁপছিল কবিতাগুলো পড়ে, তার চেয়ে বেশি। চোরা স্রোতের জায়গায় এবারে এসে আঘাত করে সুনামি। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তোলার আগে ও খুব করে চায়,

, এই স্বর যার বলে জানে না, সে যেন না হয়।
"নির্জনই তো! কতো দিন পর! তুমি তো একদম নাই হয়ে গেছো!"
আজকের দিনটা এমন হবে কে জানতো? প্রথম বর্ষের জুন মাসের ৭ তারিখ থেকে- তারিখটাও মনে আছে ওর- যাকে এড়িয়ে চলতো, যার দিকে চোখ পড়লেও নামিয়ে নিত, সেই এসে দাঁড়িয়েছে আজ ওর সামনে। আজই কেন? আজ যখন ও প্রায় মাস চারেক পর পা রাখছে ক্যাম্পাসে, কেন ওকে ভাগ্য মনে করিয়ে দিলো সেই অপমানের স্মৃতি?
"এমনটা তো কথা ছিলো না, সুবিনয়!"
নির্জন মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টা করে।
"এইতো এলাম! অনেকদিন পর। কেমন চলছে মাস্টার্সের ক্লাস?"
অদ্বৈতা তাকিয়ে সরাসরি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁটে চিলতে রোদের হাসি, নাকের পাশে ছোট্ট তিল, গালে আগুনের হালকা আঁচ, ফাগুণের কৃষ্ণচূড়ার মতো ঠোঁট।
উত্তরের আগে অবাধ্য চুল মুখ থেকে সরিয়ে নেয় অদ্বৈতা।
"একদিন খুঁজছিলাম তোমাকে। পরে স্বাধীন মোল্লার কাছে শুনলাম, তুমি নামি মাস্টার্স করছো না!"
নির্জন বইটা হাত থেমে নামিয়ে রাখে।
"হ্যাঁ। তোমাদের সাথে আর মাস্টার্স করা হলো না। দেখি পরের বছর!"
পরের বছর? যেমন চলছে, তেমন চললে, জীবনেও আর মাস্টার্স করা হয়ে উঠবে না ওর।
অদ্বৈতা আশেপাশে তাকায়। নির্জন অনুসরণ করে ওর চোখ। কান্তারের বেত কি নাটাফল নয় ওদুটো। নির্জনের মনে হয়, অদ্বৈতার চোখ শান্ত জলসিঁড়ি।
জুনের সাত তারিখ থেকে- হ্যাঁ, সে দিন থেকেই, নির্জন সরাসরি আর তাকাতে পারেনি ওই চোখের দিকে। কিন্তু আড়চোখে দেখেছে ঠিকই। অদ্বৈতা হেসেছে যখন, কুঁচকে গেছে তখন চোখের চামড়া, নির্জন খেয়াল করেছে। ক্লাসে স্যারের বিরক্তিকর লেকচারে মৃদু মুদে এসেছে যখন ওর চোখ, নির্জন চোখ রেখেছে সে চোখে। কিংবা অন্য সব বন্ধুদের সাথে যখন অদ্বৈতা ব্যস্ত চায়ের আড্ডায়, কি লিখছে পোস্টারে কোন বিপ্লবীর জ্বালাময়ী বানী, নির্জন দেখেছে ওকে।
[/HIDE]
 
[HIDE]

অদ্বৈতার চোখ এখন বইয়ের নামগুলো পড়ছে বোধহয়। নির্জনকে যে ও কী ভেবে ডেকেছে হয়তো নিজেই জানে না। বেশ তো চলে যেতে পারতো পাশ কাঁটিয়ে, অন্যান্য হাজার, অযুত বা কোটি বারের মতো। গেলো না কেন?
"কোন বই খুঁজতে এসেছো?"
"হ্যাঁ।"
"কী বই?"
"শুদ্ধতম কবি। আব্দুল মান্নান সৈয়দের।"
নির্জন আবার রুদ্রের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি হাতে তুলে নিয়ে বলে, "ওটা তুমি পুরাতন পাবে না। এরা তো যা পায় তাই কালেক্ট করে, লেখক ধরে, প্রকাশনী ধরে বই তো পাবে না এদের কাছে!"
অদ্বৈতা হাসে। ও রাজহাঁসের পালকের মতো দাঁতে আলো লাগে- চিকচিক করে।
বলে, "পাবো না জানি। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, খুঁজে যাই। বইটা না পেলেও, তোমাকে তো পেলাম। এটাও একটা আবিষ্কার!"
নির্জন চমকে যায়। এভাবে আজ কথা বলছে কেন অদ্বৈতা? মালটাল খেয়েছে নাকি? যার সাথে এতোদিন কথা নেই, যে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছে মুখোমুখি পড়ে গেলেও, সে কেন বলবে এমন কথা? মার্ভেলের ম্যাডনেস অফ মাল্টিভার্সের চরিত্র হয়ে গেছে নাকি ও?
"তাই নাকি? আমাকে এভাবে অবশ্য পাওয়ার দরকার ছিলো না। আমি তো দুর্লভ কেউ নই!"
এলোমেলো হাত চালিয়ে একটা বই তুলে নেয় অদ্বৈতা। বইটার মলাটের দিকেও তাকায় না, বইটি নাড়ানাড়া করতে করতে বলে, "ফোন করলেও পারতাম। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়া খুব দরকার ছিলো!"
নির্জনের সবকিছুকে, নীলক্ষেত, রুদ্রের কবিতা, মেঘের মেয়ে ও অদ্বৈতাকে, পরাবাস্তব মনে হয়। যেন সুখস্বপ্ন, যেন কল্পনা, যেন কোন কাঁচা গদ্য লেখকের রোম্যান্টিক গল্প। কিংবা মার্কেজের জাদুবাস্তবতা।
"হঠাত আমি এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলাম? বিশ্বাসই হচ্ছে না!"
ঠেস দিয়ে কথাটা বলে নির্জন!
এভাবে অদ্বৈতাকে খোঁচা মেরে কথা বলবে, স্বপ্নেও তো কোনদিন ভাবেনি নির্জন!
অন্য দিকে তাকিয়ে এখন অদ্বৈতা। এবারে নির্জন ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে না।
অদ্বৈতা বলে, "আসলে তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো!"
আরো অবাক হয় নির্জন। কিন্তু বিস্ময়ের ঠেলায় ও ছিটকে যায় না। গত কয়েক মিনিটের অপার্থিব ঘটনাক্রম ওর কাছে স্বাভাবিক লাগতে শুরু করেছে এখন।
"বলে ফেলো। প্যারা নেয়ার কিছু নাই!"
"আসলে আমি ভাবিনি, তোমার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। গুছিয়ে বলতে পারবো না। এখন না বলি বরং!"
অদ্বৈতাকে ওর দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে।
ওর চোখে আটকে থাকা চোখ নির্জন সরিয়ে নেয় না। বলে, "বলবে না?"
"বলব!"
"বলছো না যে?"
"আরেকদিন!"
"আমি চলে যাবো পরশু!"
"তাহলে কাল বলি?"
নির্জন এবারে হাসে। বলে, "কাল তো আমি নীলক্ষেতে আসবো না! তোমার সাথে দেখাও হবে না!"
হেসে ফেলে অদ্বৈতাও।
বলে, "আমি কি ছাই প্রতিদিন নীলক্ষেত আসি নাকি?"
নির্জন বলে, "কী বলবে তুমি?"
মাথা কাঁত করে অদ্বৈতা বলে, "কাল বলি?"
"হ্যাঁ। সমস্যা নেই!"
"তুমি তো হলেই আছো, তাই না?"
"হ্যাঁ। এখনো হল ছাড়িনি।"
"আমি তোমার হলের সামনে আসবো? বিকেলের দিকে?"
নির্জন আবারও হতচকিয়ে যায়। অদ্বৈতা আসবে ওর হলের সামনে, ওর সাথে দেখা করার জন্যে? এটাও হওয়ার ছিলো? মনে হয়, কোন এক অমোঘ বল কিংবা অদৃশ্য কোন জাদুকর অদ্বৈতাকে দিয়ে এসব বলিয়ে করিয়ে নিচ্ছে।
নির্জন উচ্চারণ করে বলে, "এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর !"
অদ্বৈতা বলে ওঠে, "কী বললে?"
কবিতার লাইনদুটো আবার উচ্চারণ করে নির্জন।
"তোমার লেখা নাকি? খুব সুন্দর তো!"
নির্জন পিছিয়ে যাওয়ার ভান করে বলে, "ও বাবা! এ কবিতা আমার হলে তো জীবনটাই স্বার্থক হয়ে যেত। এটা সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা। পরানের গহীন ভিতর সিরিজের নাম কবিতা। পড়ে দেখতে পারো।"
অদ্বৈতা বলে না কিছুই, আশেপাশে অনিশ্চিত তাকায় শুধুই। তারপর পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলে, "কাল তবে আমি তোমার হলের সামনে যাচ্ছি? বিকেলে?"
"নীল শাড়ি পরে এসো?"
"কীহ?"
"আরে না। এমনি ঠাট্টা করলাম!"
অদ্বৈতা কিছু বলে না।
"সমস্যা নেই। এসে আমাকে একটা কল দিলেই আমি হলগেটে চলে যাবো!"
"আচ্ছা। তাহলে থাকো, আমি যাই। কাল দেখা হবে!"
মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করে অদ্বৈতা।
"বই আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে না যে? শুদ্ধতম কবি লাগবে না?", নির্জন দ্রুত বলে।
ফিরে তাকায় অদ্বৈতা। নির্জনের ইচ্ছে করে, "ফ্রিজ" বলে পাথর করে রাখে ওকে। তারপর একজন স্কাল্পচার ডেকে প্রতিমূর্তি গড়িয়ে নেয় ওর। এমন শিল্পিত স্টাইলে অথচ এমন অবহেলায় মুখ ফেরাতে হয়তো শুধু অদ্বৈতাই পারে!
"তুমিই তো বললে, বইটা এখানে পাবো না!"
"জিজ্ঞেস করে দেখো অন্তত। বিখ্যাত বই, থাকতেও তো পারে?"
দোকানদারটা এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো কিনা কে জানে, সে জিজ্ঞেস করে, "কী বই, আপা। নাম বলেন!"
এবারে পুরো শরীর ফিরিয়ে, নির্জনের দিকে তাকিয়ে অদ্বৈতা বলে, "থাক, আজ লাগবে না। আরেকদিন। ঐ বই না পড়লে তো অশিক্ষিত থেকে যাবো না!"
"সিরিয়াস কিছু?", নির্জন জিজ্ঞেস করে।
"কী সিরিয়াস?"
"কাল কী বলবে? ব্যাপারটা সিরিয়াস নাকি নাকি লাইট?"
"মাঝামাঝি। তবে জীবনমরণ কোন ব্যাপার না। নিশ্চিন্ত থাকো!"
আর দাঁড়ায় না অদ্বৈতা। গলির ভেতর প্রায় ছুটে যাওয়ার মতো চলতে থাকে। নির্জনের ইচ্ছে করে ওর পিছে পিছে যেতে। কিন্তু রুদ্রের কবিতার কথাগুলো মনে পড়ে যায় তখনই।
"খুব কাছে এসো না কোন দিন
যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে..."

[/HIDE]
 
[HIDE]

অধ্যায় ৮ঃ কাশীরাম দাস ভনে
"তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধহয় বাসি...
তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধহয় চিনি...
কাউকে আমি ডাকি না, আবার বোধহয় ডাকি..."
কনফিউশন গানটার এই কয়েকটা লাইন বারবার ঘিরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে রিদম। নির্জনের মনে হয়, বাংলা ফাইভের ভোকালের চেয়ে বেশি ভালো গাইছে ও- ভরাট গলা, লম্বা চুল, বুক খোলা শার্ট ভেজা ঘামে- ওকে লাগছে জর্জ হ্যারিসনের মতো।
নির্জনের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে রিদম বলে, "কেউ আমায় ডাকে না সত্যি। ক্যাম্পাসে এতো প্রোগ্রাম হয়, এতো গানের অনুষ্ঠান- কোন শালাই আমাকে ডাকে না!"
"তোর ব্যান্ডের কী হলো? কী যেন নাম ছিলো?"
"উদ্বাস্তু! নামটা সার্থক দেয়া হইছে!"
"ভেঙ্গে গেছে?"
"ভেঙ্গে গেছে। প্যাড করার জায়গা নাই। মেম্বারদের মধ্যে প্রোফেশনালিজম নাই। সব শালারা চাকরির পিছনে ছুটছে। সবাই চাকরি করলে মিউজিক করবে কে? অবসরে পাবলিক গান শুনবে না?"
চাঁদ নেই বলে আকাশে কয়েকটি তারা স্পষ্ট জ্বলে আছে, মেঘে ডুবছে আর ভাসছে। সেদিকে তাকিয়ে নির্জন বলল, "তুই চাকরির চিন্তা করছিস না?"
ওর পাশেই বসে ছিলো আলীর তরবারি, জুলফিকার। বলল, "ওর চাকরির কী দরকার রে, ভাই? বাপ ব্যাঙ্কের ম্যানাজার, মা নাকি শুনছি কলেজের প্রিন্সিপাল। ও তো গান গাইবেই। চাকরি দরকার তোর আমার মতো পাবলিকের!"
রিদম তেঁতে ওঠে। বলে, "বাপ ম্যানাজার না হলেও আমি গানই করতাম। কাউকে তো গান করতে হবে, গল্প লিখতে হবে, সিনেমা বানাতে হবে, নাকি?"
"করবি তো। গান করবি, সিনেমা বানাবি, গল্প, উপন্যাস, কবিতা লিখে বছর বছর বইমেলায় শতশত বই প্রসব করবি। তোরাই তো করবি। আমরা করতে পারবো না!", বলে জুলফিকার।
"গান করতে টাকা লাগে নাকি? কেন আগের যুগে বাউলেরা গান গায় নাই? কবিয়ালেরা ছড়া লেখে নাই?"
"লিখেছে তো। খোঁজ নিয়ে দেখ, ওদের বেশিরভাগেরই বাপ মা ছিলো না, মরেটরে গেছিলো বা সংসার ত্যাগ করছে। পরিবারের ঝামেলা নিয়ে কেউ এসব করে নাই! শিল্প করতে বাড়া পেটে ভাত লাগে!"
"তুই বাড়া এতো প্যাসিমিস্ট কেন? সব কিছুতেই তো বাল এসব টানা লাগবে কেন?", বিরক্ত রিদম জিজ্ঞেস করে জুলফিকারকে।
জুলফিকারের মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। নির্জনের মনে হয়, জুলফিকারের হাসিটা সত্যিই সুন্দর। হয়তো এই প্রথম কোন পুরুষের হাসি ওর সুন্দর বলে মনে হয়।
"আমি প্যাসিমিস্ট? এই জুলফিকার?", হাসি অবিকৃত রেখে জিজ্ঞেস করে ও।
"অবশ্যই। না হইলে এমন বলতি না। সবার জীবনে সমস্যা আসে, তাই বলে শালা গান বাদ দিয়ে দেবে?"
"তোর বোন দেখতে কেমন, রিদম?"
জুলফিকারের এই প্রশ্নে রিদম হতচকিয়ে যায়। নির্জন।
"এটা এই প্রসঙ্গে কীভাবে রিলেভেন্ট?"
"রিলেভেন্ট। তুই বল, দেখতে কেমন?"
রিদম বলে, "আমার বোন নাই!"
"এইজন্যেই! আমার বোন আছে। দুইটা আছে। দুইটারই চেহারা খারাপ। এক্কেবারে খারাপ। আল্লাহ এদের বানানোর সময় রূপ দিতে ভুলে গেছেন!"
নির্জন বিরক্ত হয়ে বলে, "কী আলবাল বকতেছিস রে ভাই? এভাবে কেউ নিজের বোন সম্পর্কে বলে নাকি?"
জুলফিকার জোর গলায় বলে, "আমিও বলি না। লোকে বলে। আমার বড় বোনের তিন মাস আগে ডিভোর্স হইছে, দুইটা বাচ্চা। ছোট বোনও দেখতে খেমির মায়ের মতো। বাপ মা দুইজনই অসুস্থ- তাদের এক পয়সা ইনকাম নাই। আমি টাকা পাঠাইলে ওরা খায়, না পাঠাইলে খায় না। আমি বাড়া ছয়টা টিউশন করাই, প্রতিদিন তিনটা করে। টিউশন করাইতে করাইতে, অন্যের বাচ্চাকে পড়াইতে পড়াই আমার মাথা চুল শালা পড়তে শুরু করছে। বড় বোনের আবার বিয়া হবে এই আশা নাই। ছোট বোনটারে কোন মতন পাড় করাইতে হবে। কুত্তার বাচ্চাটা পড়া লেখায় পারলেও হইতো, সেটাও পারে না। কমপ্লিট বোঝা এক্কেবারে। তাও, আবার কইতেছি, তাও, এই সিচুয়েশনে থেকে বাড়া আমি রিডিংরুমে যাই, দিনে ছয় ঘণ্টা পড়ার চেষ্টা করি আর খোয়াব দেখি একদিন সিভিল সার্ভেন্ট হবো। আর এই বাড়া কিনা আমারে পেসিমিস্ট বলে! আমার জায়গায় থাকলে শালা তোর মতো তিন চারটা রিদম সুইসাইড করতো! তুই বোকাচোদা সংগ্রামের কী বাল বুঝিস রে?"
জুলফিকারের এই বিশাল বারোমাস্যায় দুজনই চুপ করে যায়।
জুলফিকার বলে, "সিগারেট দে একটা!"
নির্জন পকেট থেকে প্যাকেট বের করে দেয়।
রিদম গান শুরু করে আরেকটা।
"হাসতে দেখো গাইতে দেখো..."
আরো কয়েকজন এসে রিদমের সাথে গাইতে শুরু করে, রিদম উৎসাহ পেয়ে আরো জোরে স্ট্রাম করে, এতক্ষণ হাত দিয়ে বাজাচ্ছিলো, এবারে পিক নেয় আঙুলে।
জুলফিকার নির্জনকে বলে, "তোর কী অবস্থা বল। চাকরি বাকরি চলছে কেমন?"
রিদম সিগারেটটা নিয়ে নিয়েছে বলে, নির্জন আরেকটা সিগারেট জ্বালায়। অনেকদিন পর গোল্ডলিফ সুইচ টানছে ও।
বলে, "চলছে কোনরকমে। কোন রকমে শুধু বেঁচে থাকা!"
নির্জন জবাব দেয় ছোট করে। এমন পরিবেশে- খোলা আকাশ, কয়েকটা তারা, ছেঁড়া কিছু মেঘ, দুধেল জোছনার মতো মাঝ মাঠ থেকে আসা আলো- ওর চাকরির কথা, দারিদ্র্যের কথা তুলতে ইচ্ছে করে না। যথেষ্ট হয়েছে, জুলফিকারের কাহিনীতে হতাশার অভারডোজ হয়ে গেছে নির্জনের।
ও রিদমের গান শুনতে চায়, রিডিং রুমে অধ্যয়নরত ছাত্রগুলোর স্বপ্নের কথা শুনতে চায়, প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে কট্টর সমর্থকদের বচসা শুনতে চায়, বার্সেলোনার ইউরোপা খেলা নিয়ে কোন মাদ্রিদিস্তার বাঁকা হাসি দেখতে চায়।
জুলফিকার কিন্তু প্রসঙ্গ বদলায় না। বলে, "তাও ভালো, তুই কিছু করছিস। আমাদের তো সেটাও নাই!"
রিদমের গান থামে। যে কয়েকজন আইয়ুব বাচ্চুর অতি পরিচিত গান শুনে গলা মিলিয়েছিলো, ওরা নিজেদের কাজে চলে যেতেই, রিদম বোধহয় গাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
"থামলি কেন? খুব ভালো গাইছিলি তো!"
রিদম গিটারটা পাশে সরিয়ে রেখে বলে, "ভালো লাগে না, বাড়া। অন্যের গান আর কতোদিন। নিজের গান গাইতে পারি না। গাইলে কেউ শোনে না!"
"শোনে না?"
নির্জনের কাছ থেকে সিগারেটটা নিয়ে নেয় রিদম। ধোঁয়া ছেড়ে বলে, "না শোনে না। একে তো শো পাই না, তার উপর কোন চান্দে শো পাইলে, ওদের একটাই কথা, কমন গান গাইতে হবে। দর্শক যাতে মজা পায়, গায়কের সাথে গাইতে পারে। শো হিট করতে হবে না? আর আমার নিজের গান, মৌলিক গান? সেটার কথা বললে বলে, মাঝে একটা চালায় দিয়েন। চালাই তো মাঝেমাঝে। তখন দেখি পাবলিক নিজেদের ভিতরে কথা কচ্ছে। শুনছে না। শালার কেউ শালার সাপোর্ট করে না!"
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত প্রাণবন্ত একটা ছেলে, রীতিমতো মাথার চুল ছিড়ছে ওর গান কেউ ঠিকমতো গ্রহণ করছে না বলে। তবুও ভালো লাগে ওর এটা ভেবে যে, রিদম বেকারত্ব নিয়ে বুক চাপড়াচ্ছে না। কেউ তো একজন গাইছে, গিটার বাজাচ্ছে, গান লিখছে, নারীদের প্রেমের কথা ভেবে রাত জাগছে বিসিএসের বই মুখস্তের বদলে!

[/HIDE]
 
[HIDE]

নির্জন বলে, "তুই একদিন অনেক বড় গায়ক হবি দেখিস। কেউ মিউজিক করে রাতারাতি মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়নি!"
সিগারেটটা আবার নির্জনকে ফেরত দেয় রিদম। বলে, "কে বলছে হয়নি? ঐ যে বাদাম বাদাম, ওটা রাতারাতি ফেমাস হলো না? কতজন তো হচ্ছে ভাইরাল- কি সাকিব যেন নাম, রবীন্দ্র সংগীত গায়, ও হলো না?"
জুলফিকার হেসে বলে, "তুইও ভাইরাল হতে চাইস নাকি? সোজা তো। ন্যাংটা হয়ে গিটার বাজিয়ে গান গা। দেখবি কালই কোটি কোটি ভিউ। তোর আসলে কোনটা দরকার? ভাইরাল হওয়া নাকি গান করা?"
"সেটাই। এভাবে ভাইরাল হয়েই বা লাভ কী?!"
নির্জন রিদমের একুস্টিকটা তুলে নেয়। হলে ওঠার পর, ফার্স্ট ইয়ারে, রিদমের কাছেই কয়েকদিন গিটার শিখেছিলো ও- সেই হিসেবে রিদম ওর গুরু। শিখেছিলো কয়েকটা কর্ড মাত্র। দুই একটি স্কেল। ডরিয়ান, লিডিয়ান- আরো কী কী যেন মোডস। তারপর তো ঐ ঘটনাটা ঘটলো।
"আজকে জানিস, অদ্বৈতার দেখা হয়েছিলো?"
আচানক বলে ফেলে নির্জন।
"কৈ দেখা হইছে?", জিজ্ঞেস করে জুলফিকার।
"নীলক্ষেতে। বলল, আমার সাথে নাকি কাল দেখা করবে!"
জুলফিকার উত্তেজিত হয়ে গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলে, "বলিস কী? তুই আবার কিছু করছিস নাকি? ও তো তোর সাথে কথাও বলতো না ঐ ঘটনার পর!"
"হুম। ফেসবুকেও আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলো!"
"কী ঘটনা, মামা। আমিও শুনি!"
রিদম নির্জনের ডিপার্টমেন্টের নয় বলে জানে না কিছুই।
জুলফিকার বলে, "নির্জনের ঘটনা মহাভারত সমান/ জুলফিকার দাস ভনে শুনে পুণ্যবান!"
"মহাভারত শোনার সময় নাই আমার! তুই সংক্ষেপে বল!"
অস্বস্তি লাগে নির্জনের। বাস্তুহারা ইহুদিরা যেমন শিউড়ে ওঠে গেটোর কথা শুনলেই, তেমনি শিউড়ে ওঠে ও। ফেরত যেতে চায় না ও সেই দিনটাতে। অথচ এই দিনটাকে ভোলাও অসম্ভব- ৭ জুন- এই ৭ জুনই তো পৃথিবীতে প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছিলো ও! ঘটনাটা সেই তারিখেরই।
নির্জন বলে, "বাদ দে না, ভাই...অন্য কথা বল!"
কিন্তু জুলফিকার নির্জনের কথা শুনবে কেন? অলস সিংহ পেট ভর্তি থাকলে ছেড়ে দিতে পারে সহজ শিকার, কিন্তু জুলফিকার খোঁচা মারার সুযোগ পেলে ছাড়বে না কোনদিন। এই যে একটু আগে বলছিলো নিজের দুর্দশার কথা, সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে ও। আর কথাটা তুলেছে নির্জন নিজেই!
"সে বিশাল কাহিনী। ঘটনা ফার্স্ট ইয়ারের..."
আরেকটু রসিয়ে বলার জন্যেই বুঝি জুলফিকার ঘাসে প্রায় শুয়েই পড়ে।
"প্রথম সেমিস্টারের একটা কোর্সের এসাইনমেন্ট করতে হবে- দুই জন দুই জন করে গ্রুপ। লটারি হইছে, নির্জন আর অদ্বৈতা এক গ্রুপে পড়ছে। অদ্বৈতারে দেখলে বুঝতি কী মাল। মাল বলায় মন খারাপ আবার করিস না নির্জন! এক্কেবারে ঝাক্কাস সুন্দরী। টপ টু বটম এক্কেবারে শিল্পীর হাতে গড়া। একমাস একসাথে বসে এসাইনমেন্ট করছে ওরা একসাথে। ইন্টারভিউ নিছে, যা যা করে আরকি। আর ফার্স্ট ইয়ার তখন। ছেলেপেলের তো পাখনা একটু বেশি থাকবেই। নির্জনও আবেগ সামলাইতে পারে নাই। এতো সুন্দর একটা মেয়ে, এতো ভালো ব্যবহার। ওর সাথে কতো ফ্রিলি কথা টথা বলে। এ তো মনে করে প্রেমে একবারে হাবুডুবু খাইতেছিলো আরকি!"
নির্জন লজ্জায় হাঁটুতে মুখ রাখে। ঘটনাটা পুরো এমন না হলেও, সংক্ষেপে এমনই। জুলফিকারের জায়গায় ও থাকলেও হয়তো এমন স্থূলভাবে বর্ণনা করতো।
"নির্জন গ্রাম থেকে আসছে। বোঝে নাই। আবেগ তো থাকেই ঐ বয়সে। বুঝিসই তো। তখন তো আবার ওয় গিটারও শিখতো তোর কাছে। তো এসাইনমেন্টের পর ডিপার্টমেন্টের কালচারাল প্রোগ্রাম। নির্জনের তখন সেই আবেগ। অদ্বৈতা কালচারাল প্রোগ্রামে হোস্ট করবে থার্ড ইয়ারের এক বড় ভাইয়ের সাথে। কী যেন নাম ছিলো ভাইটার? এখন তো ব্যাংকে জব করে..."
"সাজ্জাদ", মনে করিয়ে দেয় নির্জন।
জুলফিকার বলতে শুরু করে আবার। "তো নির্জনও কালচারাল প্রোগ্রামে গান গাইবে। ইম্প্রেস করবে আরকি। তোর কাছে তো গিটার শিখতেছিলো তখন। এইদিকে অদ্বৈতাকে এর মধ্যেই দুই তিনজন বড় ভাই, আমাদের এক ক্ল্যাসমেট প্রোপোজ করে ফেলছে। সুন্দরী মেয়ে। করবেই তো। এইটা দেখে তো ওর মাথা খারাপ। আমারে কইল, "দোস্ত, আর পারছি না। কী করব বল!"
আমি কইলাম, বইলা দে। যা হওয়ার হবে। মারবে না তো অন্তত!
নির্জনের আর তর সয় নাই। ও প্রোগ্রামের আগের দিন করে ফেলছে প্রোপোজ!"
"আরে শালা। গুড গুড। তারপর?", আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে বলে রিদম।

জুলফিকার বলতে শুরু করে আবার। "তো নির্জনও কালচারাল প্রোগ্রামে গান গাইবে। ইম্প্রেস করবে আরকি। তোর কাছে তো গিটার শিখতেছিলো তখন। এইদিকে অদ্বৈতাকে এর মধ্যেই দুই তিনজন বড় ভাই, আমাদের এক ক্ল্যাসমেট প্রোপোজ করে ফেলছে। সুন্দরী মেয়ে। করবেই তো। এইটা দেখে তো ওর মাথা খারাপ। আমারে কইল, "দোস্ত, আর পারছি না। কী করব বল!"
আমি কইলাম, বইলা দে। যা হওয়ার হবে। মারবে না তো অন্তত!
নির্জনের আর তর সয় নাই। ও প্রোগ্রামের আগের দিন করে ফেলছে প্রোপোজ!"
"আরে শালা। গুড গুড। তারপর?", আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে বলে রিদম।
"অদ্বৈতা একসেপ্ট করে নাই। করবে না, জানা কথা। একসাথে এসাইনমেন্ট করছে, দুইদিন শালা হেসে কথা বলছে আর নির্জন শালা ভেবে বসছে, ওয় ওর প্রেমে পড়ে গেছে। টিপিকাল বাঙালি ছেলের স্বভাব যেমন হয় আরকি। কিন্তু বাঙালি ছেলে বাংলা সিনেমাও তো কম দেখে নাই... এ বাড়া আবার বাংলা সিনেমার স্ট্রাটেজি ফলো করছে!"
নির্জন এবারে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আরে না। বাংলা সিনেমা না... আমার যে কী হইছিলো ঐ সময়। আমার মাথা আরকি ঠিক ছিলো না!"
জুলফিকার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে বলে, "সিনেমার স্ট্রাটেজি ফলো কর আর নাই কর, ব্যাপারটা বাংলা সিনেমার মতোই হইছে। যাক। আসল কথায় আসি। এ করছে কি শোন। পরের দিন সমাজবিজ্ঞানের হলরুমে প্রোগ্রাম। অদ্বৈতা হোস্ট করতাছে। তো অনুষ্ঠানের মাঝখানে নির্জনের গান। নির্জন গান গাওয়ার জন্যে উঠছে। আমি তো শালা এর গান শুনবো না বলে উঠেই চলে গেছি। এ গান গাওয়ার আগে কী করছে শোন। কইছে মাইকে, "এই গানটা অদ্বৈতার জন্য। প্রথম দিন থেকেই ওর জন্যে যে অনুভুতিটা চেপে রেখেচি, গানটা তারই প্রকাশ। ভালোবাসি, অদ্বৈতা!"
"আরেহ শালা! পুরাই সিনেম্যাটিক ব্যাপার। শাকিল খান অথবা সালমান শাহ'র একটা সিনেমায় এমনটা দেখছিলাম!"
প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে রিদম। ওর লম্বা চুল এলোমেলা হয়ে যায়। নির্জন লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকাতে পারে না ওদের কারো দিকে।
বলতে থাকে জুলফিকার, "কি যেন গান গাইছিলি রে? হ্যাঁ মনে পড়ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন। উত্তম কুমারের সিনেমার গান!"
[/HIDE]
 
[HIDE]

"আরেহ শালা! পুরাই সিনেম্যাটিক ব্যাপার। শাকিল খান অথবা সালমান শাহ'র একটা সিনেমায় এমনটা দেখছিলাম!"
প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে রিদম। ওর লম্বা চুল এলোমেলা হয়ে যায়। নির্জন লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকাতে পারে না ওদের কারো দিকে।
বলতে থাকে জুলফিকার, "কি যেন গান গাইছিলি রে? হ্যাঁ মনে পড়ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন। উত্তম কুমারের সিনেমার গান!"
রিদম উৎসাহিত হয়ে বলে, "হ্যাঁ হ্যা, এই গান তো আমি শেখাইছি ওকে। সহজ গান, কোন বার কর্ড লাগে না!"
"ঐ কর্ড ফর্ড বাদ দে। আমি ঐসব বুঝি না। তো এ তো গান গাইছে। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তো মারাত্মক উত্তেজিত। এমন করে সবার সামনে নির্জন এটা করবে, কেউ কল্পনাও করে নাই। স্যারেরাও মুচকি মুচকি হাসছিল। নির্জন গান শেষ করে, আমাকে এসে কইতেছে, "থাকতে পারলাম না, মামা। গান কেমন হইছে বল!"
আমি কই, "গান কেমন হইছে সেটা বড় ব্যাপার না। তোর এই গলায় গান গাওয়ার সাহস পাইছিস, সেটাই বিশাল। জেতা বড় কথা না পার্টিসিপেট... আমি হলে তো বাথরুমেও গাইতাম না। গানের চেয়ে বড় যেইটা সেই হইলো, যা করলি, সেইটার ফলাফল পজিটিভ হয় না নেগেটিভ হয়, সেটা দেখ!"
আমার বাড়া কাল জিহ্বা। যা কৈ, সেইটাই ফলে। রাতে গালা ডিনার ছিলো। প্রত্যেক ব্যাচ আলাদা আলাদা বসছে। ঘটনা ঘটছে ডিনারের পর। আমাদের ব্যাচের সবাই ডিনারের পর কথাটথা কইতেছিলাম, চলে যাবো আরকি। তখন অদ্বৈতা এসে শুরু করলো তাণ্ডব!"
"মামা, হইছে। আর কইস না!", প্রায় অনুনয় করে বলে নির্জন। স্বভাববিরুদ্ধ আঞ্চলিকেই বলে ফেলে ও।
"না বল, মামা, তুই। ইন্টারেস্টিং লাগতাছে আমার!", স্যাডিস্টের মতো বলে রিদম।
জুলফিকারও থামে না। বলতেই থাকে, "স্যারেরা চলে যাওয়ার পর অদ্বৈতা এসে সবার সামনে নির্জনরে ধরছে। অনেকক্ষণ রাগ ধরে ছিলো। বলে, "তুমি সাহস পাও কীভাবে? তোমাকে আমি একবার না বলছি না? কী ভাবছিলা, গান শুনে আমি ফিদা হয়ে যাব? তুমি কে, হ্যাঁ? এন্ড্রু কিশোর নাকি বব ডিলান? খুব রোমান্স জাগছে? এতো প্রেম যে সবার সামনে বলতে হবে? ডিপার্মেন্টের কালচারাল প্রোগ্রামকে তুমি ভাবছিলা ব্রিটেইন্স গট ট্যালেন্ট? সবার সামনে প্রোপোজ করে ইন্টারন্যাশনাল সেনসেশান হয়ে যাবা?" এক্কেবারে যা-তা বলছিলো। মুখের ভাষা খারাপ করে খালি গালি দেয় নাই! আমরা তো অবাক। অনেক ধরাধরি করে তারপর থামাইলাম অদ্বৈতাকে!"
"শিট, ম্যান। ডিজ্যাস্টার! তারপর কী হইলো?", রিদম জিজ্ঞেস করে।
"তারপর আবার কী? ঘটনা ওটাই। বন্ধু নির্জন আমার সালমান শাহ হওয়ার জন্যে গান গাইলো, হয়ে গেলো বাপ্পারাজ। পাখি যায় উড়ে যায়!"
নির্জনের না চাইলেও সেদিনকার ঘটনাগুলো ভেসে ওঠে ওর চোখে। কী রুদ্র রূপ দেখেছিলো অদ্বৈতার! মারতে বাকি রেখেছিলো শুধু অদ্বৈতা। এতোগুলো লোকের সামনে! নির্জনে ডেকেও তো এভাবে বলতে পারতো ও।
"আমিও তো কম করিনি। মাইকে রীতিমতো ঘোষণা করে প্রপোজ করেছি!"
কথাটা অদ্বৈতার সেদিনের ব্যবহার জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে নির্জন।
"কাজটা ঠিক করি নাই। ও তো রিজেক্ট করেই দিয়েছিলো আগের দিন। আমি কেন বাড়াবাড়ি করতে গেলাম? ও নিশ্চয়ই লজ্জা পেয়েছিলো খুব!"
রিদমের প্রশ্নে বাস্তবে ফেরে নির্জন। রিদম জিজ্ঞেস করে, "তুই নিশ্চয়ই খুব খারাপ গাইছিলি, মামা। না হইলে তো এমন হওয়ার কথা না!"
নির্জন জবাব দেয় না।

জুলফিকার বলে, "অনুষ্ঠানটার ভিডিও আছে আমার কাছে। তোকে দেখাবো। নির্জনের গান শুনলে মাহফুজুর রহমানের কথা মনে পড়বে তোর। মাহফুজুর রহমান নির্জনের চেয়ে ভালো গায়!"
"ধুর বাড়া। এতোটাও খারাপ হয় নাই!"
"তবে ব্যাপারটা খুব খারাপ হইছে, আই মাস্ট সে। একজন, হোক সেটা অনেক লোকের সামনে, ভালোবাসার কথা, ভালো লাগার কথা প্রকাশ করতেই পারে। তাই বলে এভাবে রিয়্যাক্ট করতে হবে? আর একটা ছেলে তোর জন্যে মাইকে অনুভূতি প্রকাশ করছে, এটা তো একটা অর্জনও বটে!"
নির্জনের পক্ষে সাফাই গাইতে চেষ্টা করে রিদম।
নির্জন বলে, "বাদ দে, মামা। এসব, ফার্স্ট ইয়ারের ঘটনা। মাঝখানে মেলা বছর গেছে, একটা প্যান্ডামিক গেছে, জীবন আর আটকে নাই ঐ জায়গায়!"
জুলফিকার জিজ্ঞেস করে, "তা কাল তো দেখা করবে তোর সাথে। কী বলবে জানিস? তোর কাছে মাফটাফ চাইবে নাকি?"
নির্জন সত্যিই জানে না অদ্বৈতা কাল কী বলবে ওকে। হয়তো ক্ষমাই চাইবে। এটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আকাশের মেঘগুলো চলে গেছে কোথায় যেন। একটা ফুটফুটে শিশুর হাসির মতো তারার দিকে তাকিয়ে নির্জন জবাব দেয়, "মেবি!"
[/HIDE]
 
[HIDE]

অধ্যায় ৯ঃ স্মরণ করো খৈয়ামে
"আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে বন্ধুদল, একটি ফোঁটা অশ্রু ফেলো মোর নামে!
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন, সাকির পাশ,
পেয়ালা একটি উলটে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে... "


টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় যে যার রুমের দিকে চলে গেলে নির্জন ফ্লাইওভারের নিচে প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন খামগুলোর আড়ালে বসে। হাওয়া দিচ্ছে খুব, ছাট লাগছে গায়ে, ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে ওর। ও জানে, এখন বিছানায় গেলেই কাঁথার উষ্ণ গহ্বরে আর পাঁচ মিনিটও টিকবে না, ঘুম টেনে নেবে বিস্মৃতিতে। অথচ এই রাতের একটা সেকেন্ডও ঘুমিয়ে কি হাই তুলে নষ্ট করতে চায় না নির্জন। ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ রেখে শুষে নিতে চায় ও এই পরিবেশ। থমথমে নিস্তব্ধতা, ছাত্রদের কোলাহল, এই আলো আঁধার, আচমকা আসা ইলশে গুঁড়ি আর মাটিতে বৃষ্টি পড়ার সরসর শব্দ- সব কিছু শুষে নিতে চায় ও।
রিডিং রুমের বারান্দায় অনেকে পড়ছে। অনেকেই চা বানানোর সরঞ্জাম রাখে সাথে, যাতে ঘুম এলেই চায়ের উষ্ণতায় চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে মুহূর্তেই। কেউ বালিশ নিয়ে এসেছে- ঘুমাবে রিডিংরুমেই।
যারা এভাবে পড়ছে, দিনে চৌদ্দ কি পনেরো ঘণ্টা, তাদের সাথে পরীক্ষায় কী করে পারবে নির্জন সারাদিন কাজ করে? জুলফিকারই বা কী উপায় প্রতিযোগিতায় তাদের টেক্কা দেবে ছয়টা টিউশন করিয়ে?
একটা বছর যদি সময় দিত কেউ ওকে! বারোটা মাস! রোজগারের চিন্তা নেই, বাড়িতে টাকা পাঠানোর চাপ নেই, কাজের ক্লান্তি নেই, ঘুপচি ঘরের গরমের তীব্রতায় সামান্য হাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ নেই- শুধু পড়া, পড়া আর পড়া!
সিগারেটের তেষ্টা বোধ করে নির্জন।
এই সামান্য চাহিদাটাও নির্জনের কাছে ইউটোপিয়া মনে হয় এখন!
ঘুমানোর আগে নিম্বাসদার সাথে একবার দেখা করবে ভেবেছিলো, রাত একটার পর। কিন্তু এখন আশেপাশে কেউ নেই বলে আর একা থাকলেই মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘশ্বাস প্রসব করবে, এমন সম্ভাবনা থাকায়, নির্জন নিম্বাসদার রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
নিম্বাসদা এই মাঝরাতে জুতা পরে ফিটফাট হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফ ছাটছেন। নির্জনকে অবতল আয়নায় দেখেই বলে উঠলেন, "তোর কথাই শালা ভাবছিলাম! বহুত দিন বাঁচবি!"
নিম্বাসদা সিঙ্গেল রুমে থাকেন। একা। এমন সৌভাগ্য খুব কম ছাত্রেরই হয়।
"হঠাত আমার কথা মনে পড়ল? একবারও তো খোঁজ নেননি!"
অভিযোগের সুরে কথাগুলো বলে তার লম্বা ছোট্ট ঘরে ঢুকলো নির্জন।
ঘরের কোণে সারি সারি মদের বোতল, পড়ার টেবিলে পাশেই। টেবিলে বিশাল একটা হুলো- দেশী বিড়াল এতো বড় হতে পারে- প্রায় ৬ মাস বয়সী পাঠার সমান, এই হুলোকে না দেখলে ও জানতো না- তাকিয়ে আছে ঘুম চোখ। বোধহয় বিরক্ত নিম্বাসদার এই অসময়ের রূপচর্চায়। বিছানায় বাকমার্ক করে রাখা একটা বই উল্টো পড়ে আছে।
"আমি তো জানি, তুই খারাপ আছিস। একারণে ফোনটোন দেই না। কেউ ভালো নেই, এটা ফোনে শুনতে আমার ভালো লাগে না!"
"আমার কথা কেন ভাবছিলেন?"
আয়না থেকে সামান্য মুখ তুলে নিম্বাসদা বললেন, "আজ একটা হেব্বি খাওয়াদাওয়া আছে। ফরেন মাল থাকবে। তুই একদিন আমার কাছে ফরেন খাইতে চাইছিলি, খাওয়াইতে পারি নাই। আজ সুযোগ আছে!"
নির্জনের মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। বলে, "খাওয়ানোর কথা আপনার। আপনি নিজের বদলে আরেকজনের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গতে চাইছেন?"
"আমার কি তোকে ফরেন খাওয়ানোর সামর্থ হইছে নাকি? দাম জানিস? আমি শালা ভুল দেশে জন্মাইছি!"
"কোন দেশে জন্মানো উচিত ছিল?"
"ইন্ডিয়ায়। ওখানে মাল কতো সস্তা জানিস? আমি ইন্ডিয়ায় থাকলে পানির বদলে শালা মাল খেতাম!"
হুলোটা আড়মোড়া ভাঙ্গছে এখন। মিনিয়েচার বাঘের এই প্রজাতিকে যতই দেখে ততই অবাক হয় ও। অলস, স্বার্থপর ও খুঁতখুঁতে এই প্রাণীটি স্রেফ সৌন্দর্যের জোরে মনুষ্য সমাজে রাজার হালে বাস করছে। কোন শালা বলেছে সৌন্দর্যের চেয়ে গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
"তুই চল আমার সাথে। যত ইচ্ছা মাল টানবি! অনেক মেয়েও থাকবে।"
নির্জন বলে, "ধুর মিয়া, এত রাতে কোথায় যাব? আপনি যাচ্ছিলেন যান। ভাবলাম গল্প করে আসে, সেটা দেখছি হচ্ছে না!"
আয়নাটা রেখে নির্জনের দিকে পুরোপুরো ফিরে নিম্বাসদা বলেন, "গার্মেন্টসে ঢুকে তুই ভেড়া হয়ে গেলি নাকি? তোর এডভেঞ্চার স্প্রিট কৈ গেলো? বারোটা কোন রাত? রাতের ঢাকা এখনো ঘোমটাই তোলে নাই, আর তুই ঘুমাবি!"
নির্জন বাঁকা হেসে বলে, "আপনার মেয়র তো ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর ছলে রাত আটটার মধ্যে দোনাকপাঠ সব বন্ধ করাচ্ছে। আপনার রাতের ঢাকা তো নয়টার মধ্যেই এখন বাচ্চাদের মতো দুদু খেয়ে ঘুমাবে!"
"রাতের ঢাকা মেয়রের কথায় চলে না, নির্জন!", গর্বিত স্বরে জবাব দেন নিম্বাসদা। "তোদের মেয়রের বাপেরা চালায় রাতের ঢাকা!"
তারপর নির্জনের দিকে তাকিয়ে বলেন, "যা রেডি হয়ে আয়। শার্ট পরিস না আবার। টিশার্ট পরিস! আমিও ততোক্ষণে রেডি হয়ে নেই!"
"আরে যাবো কোথায়, সেটা তো বলবেনন অন্তত?", তাগদা দিয়ে বলে নির্জন।
"কেপ অফ গুড হোপে!"
"কেপ অফ গুড হোপ? এটা তো বাড়া সাউথ আফ্রিকায়!"
মিচমিচে একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তোলেন নিম্বাসদা। বলল, "তোর মতো বিসিএস প্রার্থীর কাছে এইটা সাউথ আফ্রিকাতে। আমার কাছে এটা ধানমন্ডির বার কাম হোটেল! তাড়াতাড়ি যা এখন..."

***
রুমে গিয়ে শরীরটা সামান্য সম্পাদনা করে হলগেটে যখন নির্জন উঠল নিম্বাসদার ইয়ামাহা আরএক্স ১০০ এর পিছনে, তখন বৃষ্টি গেছে থেমে, ঘড়িতে বেজে গেছে বারোটা। অনেকেই রাতের সিগারেট কেনার জন্য ছুটছে পলাশী মোড়ে।
প্রাচীন ইয়ামাহা আরেক্স দেখতে যতোটা সুন্দর, সাউন্ড যতোটা মন্দ্র, পিলিয়ন বসার জন্য ততোটাই বদখৎ। কোনমতে নিম্বাসদাকে ধরে বসে রইল নির্জন।
"তুই আরওয়ান ফাইভ ভিথ্রি বা জিএসএক্স আর নিয়া ক্যাম্পাসে ঘুরবি, কেউ তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না। এসব এখন অহরহ। কিন্তু আমার এই বাইক স্টার্ট মারলেই সবাই ফিরে তাকায়। ওল্ড ইজ গোল্ড, যাই বলিস না কেন?"
"আপনার টাকা থাকলে কি ভিথ্রি বা GSX R এর বদলে এইটা কিনতেন?", খোঁচা মারার লোভটা এবারে সামলাতে পারে না নির্জন।
নিম্বাসদা জবাবে কিছুই বলেন না।



[/HIDE]
 
[HIDE]

বৃষ্টি ভেজা রাজপথ চকচক করছে সদ্য পুকুর থেকে তোলার রুইয়ের আঁশের মতো। ভেজা গাছগুলো নতমুখ। নীলক্ষেত সিগনালে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে একা, কয়েকটা ভিখারি হার জিরজিরে একটা কুকুরের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে নিউমার্কেট ফ্লাইওভারের নিচে।
নির্জন জিজ্ঞেস করল, "কেপ টাউনে, না থুড়ি, কেপ অফ গুড হোপে কী আছে এখন? কেউ ট্রিট দিচ্ছে নাকি?"
"না রে, বাড়া। আমাদের এডিটরের জন্মদিন ছিলো আজ, মানে ছিলো গতকাল আরকি। আর সেটার পার্টি। গতকাল উনি বাইরে ছিলেন!"
"আপনার পত্রিকার নাম যে কী? ভুলে গেছি!"
নিম্বাসদা তার পত্রিকার নাম* বলেন।
নির্জন জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা দাদা, এই পত্রিকা কেউ পড়ে? মানে আমি তো কোন হকারকে বিক্রি করতে দেখি নাই! এরা চলে কেমনে?"
হো হো করে হেসে ওঠেন নিম্বাসদা। উল্টো দিকের হাওয়ার সাথে নিম্বাসদার হাসিও এসে যেন নির্জনের মুখে ঝাপটা মারতে থাকে!
"চলে না। কেউ কেনে না। মাগার সরকারী বিজ্ঞাপন পায় মাসে লাখলাখ টাকার!"
"মানে?"
"মানে আমাদের পত্রিকার ছাপানোই হয় অল্প। কিন্তু সরকাররের কাছে হিসাব দেয়া আছে, এই পত্রিকার সার্কুলার মোর দ্যা দু হান্ড্রেস থাউজেন্ড। সরকারী বিজ্ঞাপনের টাকাও আসে সেই অনুপাতে। সেই টাকা দিয়েই চলে! আর পত্রিকার অনলাইন ভার্সন তো আছেই!"
"সরকার জানে না এসব? কেউ জানায় না?"
"তোর কী মনে হয়, এসব দেখার কেউ আছে? যারা দায়িত্বে আছে এসবের, হয়তো তাদের ঘুষটুস দিয়ে চুপ করিয়ে রাখে!"
"লোকে প্রথম সারির নিউজ পোর্টাল বাদ দিয়ে তোমাদের পোর্টালে ঢোকে?"
নিম্বাসদা আবার অট্টহাস্য করে ওঠেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো তার হাসি দীর্ঘসময় ধরে নির্জনের কানে বাজে না।
বলেন, "শতকরা একজনও হয়তো এখন সার্চবারে ইউআরএল টাইপ করে কোন পোর্টালে যায় না! সবাই ফেসবুকে এসেই খবর দেখে। সব পত্রিকারই লায়ন্স শেয়ার ভিজিটর এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আসে। বাসর রাতে কি করলেন মিথিলা? বা শবনাম ফারিয়ার কত নম্বর স্বামী হতে চলে অমুক- এমন শিরোনামে কোন মূলধারার পোর্টাল, অনন্দবজর ছাড়া, নিউজ করে? আমরা করি। পাবলিক খায়। দেশের ৯৯% মানুষের অর্থনীতির খবরের দরকার নেই। প্রতিদিন আমাদের সাইটে ইউনিক ভিজিটর কতো জানিস? আঠারো লাখ! কোন নিউজ ভাইরাল হলে তো কোটি পাড় হয়ে যায়!"
"এসব করেই চলছে?"
"চলছে মানে? দৌড়াচ্ছে। এই দেশে অন্তত ৫০টা পত্রিকা দাবি করে তাদের সার্কুলার দৈনিক ১ লাখের উপরে। এত পেপার কেনে কে ভাই? পত্রিকাগুলো চলছেই সরকারের টাকা মেরে!"
জবাবে নির্জন এবারে কিছুই বলে না। বাইক সাইন্সল্যাবে মোড় নিয়েছে।
রাস্তার দুধারের ঘুমন্ত উঁচু বাড়িগুলোর কোন কোন ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে এখনো। কয়েকজন পথচারী এখনও হন্তদন্ত হয়ে পথ চলছে।
"তোকে কিন্তু ভেতরে গেলে সময় দিতে পারব না, বলে রাখতেছি এখন। তুই নিজে নিজেই থাকিস। মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকিস না আবার। লিমিটে টানিস!", বলেন নিম্বাসদা।
"আমি তো মাল খাবো না!"
"মানে? মাল খাবি না কেন? এমন সুযোগ আর পাবি?"
নির্জন বলে, "অনেক কষ্টে এসব মদ গাঁজার নেশা ছাড়ছি, দাদা। আর না। কোনদিন নিজের টাকায় মাল খাওয়ার সামর্থ হলে খাবো, না হলে আর না। এই বাড়া খুঁজে খুঁজে চেয়েচিন্তে মাল খাওয়ার মধ্যে আর আনন্দ পাই না!"
"আরে শালা! তোর দেখি আত্মসম্মান জন্মাইছে। আমারই আত্মসম্মান জন্মাইলো না এখনো!"
কিছুক্ষণ পর নিম্বাসদা বাইকটা যেখানে দাঁড় করালো, সে জায়গায় নির্জন আগেও এসেছে। কিছু দূরেই সরকারী দলের অফিস। সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে এখানেই একটা টিউশনি করাতো ও। নতুন বোধহয়- এই বার চোখে পড়েনি ওর কোনদিন। পড়লে একবার, আরেকজনকে হয়তো আমড়াগাছি করেই, এখানে এসে অন্তত একটা পেগ মেরে যেতো।
হোটেলের সামনে সার সার গাড়ি। কিছু সরকারী গাড়িও চোখে পড়ল নির্জনের।
নির্জন বলল, "ভাই, এ কোথায় নিয়ে এলেন? এ তো সব বড় লোকদের কারবার। একটা এম্পির গাড়িও দেখলাম। এইখানে শালা আমি কী করব?"
নিম্বাসদা হিসহিসিয়ে উঠল এক্কেবারে, "তুই নিজেকে ছোট ভাবছিস কেন? এই নিজেকে ছোট ভাবার প্রবণতাই জাতটাকে ডোবাল। শালা টিপিকাল বাঙ্গালির মতো ম্যাও ম্যাও করলে পাছায় লাত্থি মারবো তোর সবার সামনেই!"
নিম্বাসদার কথা মেনে নিয়েই সিনা টান করে পা বাড়ালো নির্জন কেপ অগ গুড হোপের ভেতরে।
একজন খাকি উর্দি পরিহিত দারোয়ান মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানালো ওদের।
"তুই যদি জানতি আমি শালা গার্মেন্টসের শ্রমিক, তাইলে আমার কলার ধরে সালাম ফেরত চাইতি!"
মনে মনে দারোয়ানটাকে বলল নির্জন।
রিসেপশনে নিম্বাসদার ইনভিটেশন কার্ডটা দেখাতে হলো, লিখতে হলো নাম ধাম।

নিম্বাসদার পিছু পিছু নির্জন তিনতলার বিশাল ফ্লোরে এসে পৌঁছল। যে অল্প কয়েকটা বারে নির্জনের আনাগোনা ছিলো একসময় কিছু উদার বড় ভাইয়ের কল্যাণে, সে কয়েকটার থেকে এর চেহারায় সামান্য অমিল রয়েছে। প্রথম অমিলটাই চোখে লাগে বেশি। এটা যেন অতিরিক্ত খোলামেলা- বারের চেয়ে রেস্টুরেন্ট রেস্টুরেন্ট ভাবটারই প্রাধান্য। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেবিলগুলোতে পানোন্মত্তের চেয়ে ফরমাল পোশাক পরিহিত ভদ্রলোকেরাই বেশি। বেশিরভাগেরই হাতে যদিও গ্লাস শোভা পাচ্ছে! কয়েকটা মেয়ে- কেউ শাড়ি, কেউ ওয়েস্টার্ন পরে এখানে ওখানে বসে জায়গাটার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য সব একসাথে বাড়িয়ে তুলেছে।
"কীরে ভাই? কৈ ভাবলাম, ঝাকানাকা পার্টি চলতেছে, নাচ হচ্ছে, মাল খাচ্ছে। এ তো দেখি শালা সুশীল- গল্প করছে বসে বসে!"
নিম্বাসদা বললেন, "এজন্যেই তো বললাম, রাত কেবল শুরু। মাল পেটে পড়লেই প্রতেকটা সক্রেটিস একেকটা জানোয়ারে পরিণত হবে! অবশ্য খুব বেচাল কিছু হওয়ার চান্স কম! হাজার হোক একজন পত্রিকা সম্পাদকের জন্মদিনের পার্টি!"
"এইটারে তো বার মনেই হচ্ছে না!"
"বার দুই তলায়। এইটা মেবি কনফারেন্স হল।"
ওরা যখন হল রুমের মাঝামাঝি এলো, তখনই নিম্বাসদা বললেন, "আমি এখন যাই। ঐ যে কাউন্টার দেখছিস, ওখানে গিয়ে যা চাইবি দেবে, যদি মন চায়, খাইস। আমি সময় পাইলে তোর কাছে আসব!"
"আর যদি ভালো না লাগে?"
"ভালো না লাগলে আমাকে ফোন দিস, ব্যবস্থা করব!"
[/HIDE]
 
[HIDE]

নির্জন নিম্বাসদার কথা মতো হাঁটতে লাগলো কাউন্টারের দিকে। নিজের পোশাকের কথা ভেবে একবার লজ্জা এসে গ্রাস করেছিলো ওকে। এখানকার ওয়েটারেরা পর্যন্ত তার চেয়ে ভালো পোশাক পরিহিত। পরে সে ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়েছে ও। ভেবে লাভ কী? কোন দৈব বলে ও তো নিজের পোশাক পাল্টে ফেলতে পারবে না মুহূর্তেই!
ভেবেছিলো, এক ফোঁটা সুরার গন্ধও নেবে না নাকে। এখন চারদিকে, প্রায় সবাইকে হাতে গ্লাস নিয়ে বসে থাকতে দেখে সাধু হওয়ার ইচ্ছেটাকে দমালো নির্জন। এমন সুযোগ হেলায় হারানোর মানে নেই কোন। কোন্‌ দেবতা বা ঈশ্বর ওকে পুরস্কৃত করার জন্যে বসে আছে যদি না ডোবায় ঠোঁট পানপাত্রে?
ওমর খৈয়ামের রুবাঈয়াত মনে পড়ে গেলো নির্জনের। নজরুলের অনুবাদে। খৈয়াম জিজ্ঞেস করেছে নবিকে, "হে নবি, হে শ্রেষ্ঠ মানব, আঙুরজল কী দোষ করল? কেন করলে মদকে হারাম?"
খৈয়ামের কল্পনায় নবি দিয়েছেন জবাব। তিনি বলেছেন-
তত্ত্ব-গুরু খৈয়ামেরে পৌঁছে দিয়ো মোর আশিস
ওর মতো লোক বুঝল কিনা উল্টো করে মোর হদিস!
কোথায় আমি বলেছি, যে, সবার তরেই মদ হারাম?
জ্ঞানীর তবে অমৃত এ, বোকার তবে উহাই বিষ!
ওর জন্য মদ অমৃত না গরল, তাই ভাবছিলো নির্জন, তখনই চোখ গেলো নিম্বাসদার দিকে। নিম্বাসদা ওকে ইশারায় ডাকছেন। ওর পাশে কয়েকজন মধ্যবয়সী, একজন বৃদ্ধ।
নির্জন সেদিকে দ্রুত পা চালালো।
কাছে যেতেই নির্জন শুনতে পেলো, নিম্বাসদা বলছেন, "এর কথাই বলছিলাম, স্যার। খুব ব্রাইট ছেলে। ডিইউ থেকে ফ্রেশ গ্রাজুয়েট, এর একটা জবের খুব দরকার!"
নির্জন হতচকিয়ে গেলো। মাল খেতে এনে নিম্বাসদা চাকরির তদবির করছেন কেন? ও তো নিম্বাসদাকে এমন করতে বলেনি। তবে?
নির্জন লোকগুলোর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়ায়।
"জবের কার দরকার নেই বলো? আগে তো দেখতে হবে, ওর ক্যালিবার কতোটা।"
বৃদ্ধ লোকোটার পাশের স্যুটেড ব্যক্তিটি বলল কথাগুলো। এ'ই কি সম্পাদক? তাগড়া গোঁফ, মুখে টকটকে হাসি- তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে একদৃষ্টে। তার হাতটা ধরে আছে তার স্ত্রী। স্ত্রীই হবে- নইলে এভাবে কেউ হাত ধরে না কারো। স্বামী চারপাশের বেগানা নারীদের অমৃত হ্রদে হুট করে ডুব যেন না মারতে পারেন, সেজন্যেই বোধহয় ছাড়ছে না হাত!
নিম্বাসদা তেলতেলে স্বরে জবাব দেন, "এর ক্যালিবার আপনারা টেস্ট করেই নেবেন, স্যার। আমি মিথ্যে বলছি না। আপনারা এক্সামিন করে দেখতে পারেন।"
রাগ হয় প্রচণ্ড নির্জনের নিম্বাসদার উপর। এমন করবেন উনি, জানলে জীবনেও আসতো না এখানে। নির্জন চাকরির জন্য অনেক পরীক্ষা দিয়েছে, লাইনে দাঁড়িয়েছে, ভাইভা দিয়েছে। কিন্তু কোনদিন কারো কাছে তদবির নিয়ে যায়নি, হাত পাতেনি কারো কাছে। অথচ নিম্বাসদা কী অবলীলায় বলছেন কথাগুলো।
স্যুটেড ব্যক্তিটি বলে উঠল, "এডিটর সাহেব, আপনি বরং একদিন সময় করে এই ছেলের পরীক্ষা নিয়ে নিন। নিম্বাস এমন করে যখন ধরছে!"
এই লোক তবে এডিটর নন। লোকটা এডিটর বলে সম্বোধন করল যাকে, সেই চুলপাকা বৃদ্ধটি জবাবে বললেন না কিছুই। হাসলেন শুধু।
কিছুক্ষণ পর, ওরা যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, নিম্বাসদা নির্জনকে নিয়ে চলে এলেন একটু আড়ালে।
"এটা কিন্তু ঠিক করলেন না, নিম্বাসদা। আপনাকে আমি চাকরির কথা বলতে বলেছি?"
নিম্বাসদা একটা শতবতের গেলাস হাতে নিয়েছেন তুলে। সেখান থেকে একটা সিপ নিয়ে বললেন, "জানি তো বলিস নাই। নিজের রেস্পনসিবিলিটি থেকে বললাম। তুই বাড়া গার্মেন্টসে কাজ করিস, আমার ভালো লাগে না। যদি এখানে হয়ে যায়!"
"ঐ মোচওয়ালা লোকটা শালা কীভাবে কথা বলছিল, দেখলেন? চিবিয়ে চিবিয়ে! যেন ও নিজের পকেট থেকে টাকা দেবে আমার বেতনের।"
"আরে ওর কথা বাদ দে। হস্তীমূর্খ আমলা! ও তো নিজে তদবির নিয়া আসছে। ওর পাশে যে মহিলাটাকে দেখলি, সেটা ওর বৌ। ইউটিউবার। ফুড ভ্লগিং করে। আমাদের পত্রিকায় ওনাকে নিয়ে একটা ফিচার ছাপাতে বলে। ভাব! টাকাও নাকি দেবে!"
নির্জন এবারে হেসে একবার মহিলাটার দিকে তাকায়। মাঝবয়সী। স্বাভাবিক ফিগার। তবে মুখটা বেশ ভালো গঠনের। বলে, "এই মহিলার ভ্লগ কোনদিন দেখছি বলে তো মনে পড়ছে না!"
"দেখবি কী করে? দেশে তো এখন ফুড ভ্লগারের সংখ্যা ছাগলের চেয়ে বেশি। তাও ভালো কবির সংখ্যাটা কমেছে ভ্লগার বাড়ায়!"
"সেটা বড় কথা না", বলে নির্জন; "বড় কথা হলো, কাজটা ভালো করেন নাই আপনি! এইখানে তদবিরের দরকার ছিল না!"
নিম্বাসদা বলেন, "আচ্ছা, রাগ করিস না। তুই গিয়ে মাল খা। আমি দেখি, যদি তোর কিছু করতে পারি! চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তোকে তো কিছু করতে হচ্ছে না। মনে কর, আমি তোকে ডাকি নাই। ঐ লোকদের সাথে তোর কথাই হয় নাই! তবে আমি তোর ভালোর জন্যেই বলছি। একবার এই লাইনে ঢুকতে পারলে, তোর মতো ছেলে তরতর করে উপরে উঠবে!"
ওয়েটারকে বলে নিম্বাসদা নিজেই ওকে ব্ল্যাক ডগের পেগ বানিয়ে দিয়ে "তুই থাক। আমি ওনার সাথে সাথেই আছি। দরকার হলে ফোন দিস!" বলে গেলেন চলে।
নিম্বাসদা গিয়ে আবার এডিটরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওকে কেমন লোকটার পোষা কুকুরের মতো লাগছে। দুহাত পিছনে, দাঁড়িয়ে আছেন দেহরক্ষীর মতো। এতোটা তেল মারতে কবে থেকে শুরু করেছেন নিম্বাসদা? সামান্য আগেই নির্জনকে বললেন নিজেকে ছোট না ভাবতে। অথচ এখন সমাপদকের সামনে এমন আচরণ করছেন, এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন- এভাবে ও শুধু মোসাহেবদেরই দাঁড়াতে দেখেছে, দেখেছে রাজনৈতিক নেতাদের পাশে চামচাদের দাঁড়াতে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক নির্জন এখানে ওখানে বসে, লোকগুলোর মুখ দেখে চরিত্র অনুমান করার চেষ্টা করে, কয়েকটা ওর বয়সী মেয়েকে ভদ্রতার হাসি উপহার দিয়ে, কিছু নাসরিন ভাবির বয়সী মিলফের বুক, পাছা মেপে ও মাঝেমাঝে দুএকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে কাঁটিয়ে দিলো। বেশ বিরক্ত লাগছে ওর। এই জন-অরণ্যে সময় নষ্টের বদলে হলের বারান্দায় বসে মেঘে ঢাকা তারাদের কথা ভাবলেও ওর বেশি ভালো লাগতো!
"হে, তুমি সেই মালটা না?"

[/HIDE]
 

Users who are viewing this thread

Back
Top