চতুঃপঞ্চাশৎ পর্ব
(২)
নেহাৎ তার আগের লোকটি লাইন থেকে বেরিয়ে গেলো, কারণ তার সঙ্গী অন্য কাউন্টারে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে নিয়েছে। পাঁচ-ছ সেকেন্ড বাকি থাকতে, কাউন্টারের সামনে পৌঁছালো শানু। এই প্রথম সে রেসের টিকিট কাটছে, উত্তেজনায় দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। কি যেন খেলবে সে, সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার। কাউন্টারে বসা ভদ্রমহিলা অধৈর্য্য হয়ে বললেন, “কি খেলবেন বলুন? সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে তো”। হাতের মুঠোয় রাখা একশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিয়ে, কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোরকমে শানু বলতে পারলো, “পিঙ্ক অর্কিড, দশ টিকিট, উইন”। পোঁ করে সাইরেন বেজে উঠলো, অর্থ্যাৎ রেস শুরু হয়ে গিয়েছে, আর টিকিট বার হবে না। কিন্তু তার আগেই কাউন্টারের মহিলাটি বোতাম টিপে দিয়েছেন, আর চ্যাঁক চ্যাঁক, চ্যাঁক চ্যাঁক শব্দ করে ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টার থেকে বেরিয়ে আসছে, শানুর কাঙ্খিত টিকিট।
টিকিটটা হাতের মুঠোয় চেপে স্ট্যান্ডে ফিরে এলো শানু। রেস শুরু হয়ে গেছে। ১৬০০ মিটারের রেস এটা, ঘোড়াগুলো খাঁচা থেকে বেরিয়ে, দুশো মিটারের বেশী ছুটেও নিয়েছে। শানুর কাছে তো আর বাইনোকুলার নেই, তাই সে সিসি টিভিতেই রেস দেখতে লাগলো। উইনিং পোস্টের কাছাকাছি এলে, রেলিং-এর সামনে গিয়ে দাড়াবে। পিঙ্ক অর্কিড ঘোড়াটার নম্বর ৭, প্রথম চার-পাঁচটা ঘোড়ার মধ্যে পিঙ্ক অর্কিড নেই। সবথেকে সামনে ৬ নম্বর ঘোড়া টার্ফ এম্পেরর, তার ঠিক পেছনে, সেকেন্ড ফেবারিট, মানালি ম্যানিয়া, তারপর মিস ওয়ান্ডার, সিক্রেট হার্ট, পিঙ্ক অর্কিড একদম পিছনের দুটো ঘোড়ার মধ্যে একটা। তাহলে কি ভুল করলো শানু! Guesstimation-এর মতো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, রেসের মাঠে অচল! ছোটে মিয়ার আনতাবড়ি অন্ধকারে ঠিল ছোঁড়াই, রেসের মাঠে প্রযোজ্য! চোখের সামনে ধূর্জটিবাবুর খ্যাচামার্কা মুখটা ভেসে উঠলো। লাল্টুদা বাইনোকুলার চোখে, রেলিং-এর সামনে, পাশে বাচ্চা ঠাকুর আর ছোটে মিয়া। ওরা যদি ঘুণাক্ষরে টের পায়, শানু লাল্টুদার পয়সায় জুয়ো খেলে, টাকা উড়িয়েছে, তাহলে তার জিনা হারাম করে দেবে। হাতের চেটো ঘেমে উঠছে তার, টিকিটটা কি ফেলে দেবে! তাহলে আর প্রমাণ থাকবে না যে, সে রেসের টিকিট কেটে পয়সা নষ্ট করেছে। বললেই হবে টাকাটা হারিয়ে গেছে।
বেন্ড ঘুরেই টার্ফ এম্পেরর একটু থমকালো, বোধহয় শার্প টার্নিং নেওয়ার পর একটু ধাতস্থ হচ্ছে, কিন্তু এই ফাঁকে তাকে টপকে গেলো মানালি ম্যানিয়া, মিস ওয়ান্ডার এবং আরো দুটো ঘোড়া। সারা মাঠ “টার্ফ এম্পেরর, টার্ফ এম্পেরর” করে গলা ফাটাচ্ছে, আবার মানালি ম্যানিয়ার নামেও আওয়াজ উঠছে, কিন্তু কারো মুখে পিঙ্ক অর্কিডের নাম নেই। বারোর দরের ঘোড়ার পিছনে কে পয়সা লাগাবে! কমেন্টেটরের গলা শোনা যাচ্ছে, “মানালি ম্যানিয়া গোয়িং আ্যহেড, নেক্স্ট কামিং মিস ওয়ান্ডার, টুডে’স ফেবারিট টার্ফ এম্পেরর লেংথস বিহাইন্ড, সিক্রেট হার্ট গ্যালপিং ফাস্ট …….”, কিন্তু তার মুখেও পিঙ্ক অর্কিডের উল্লেখ পর্য্যন্ত নেই। রেস শেষ হতে আর মাত্র শ’ তিনেক মিটার বাকি, অর্থ্যাৎ আর মাত্র পনেরো-কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যেই ‘খেল খতম, পয়সা হজম’। হতাশায় মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিলো শানুর। কেন যে মরতে ঘোড়ার গাঁড়ে টাকা ঢোকাতে গেল। লাল্টুদার সাথে আসছিলো, ফ্রি ফান্ডে রেসের মাঠের উত্তেজনার মজা নিচ্ছিলো, সেটাই ভালো ছিল। কথায় বলে, “খাচ্ছিলো তাঁতি তাঁত বুনে, কালহলো তার এঁড়ে গরু কিনে”। প্রবাদ বাক্যটার মর্মার্থ আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলো শানু। না, একটু গাঁজায় দম না দিলে, নার্ভ স্টেডী হবে না। অশ্বথগাছটার পেছনে কিছু ছেলে ধুমকি করছিলো। স্ট্যান্ড থেকে সে দিকেই পা বাড়ালো সে।
হঠাৎই মাঠে একটা শোরগোল উঠলো। পিছন ফিরে দেখলো, একটা কালো ধুলোর ঝড় যেন উল্কার মতো এগিয়ে আসছে। কি হলো ব্যাপারটা বোঝার আগেই কমেন্টেটরের উত্তেজিত গলা শোনা গেলো, “পিঙ্ক অর্কিড গ্যালপিং আ্যট লাইটনিং স্পিড, ওভারটেকিং টার্ফ এম্পেরর, ওভারটেকিং সিক্রেট হার্ট, ওভারটেকিং মিস ওয়ান্ডার, টাচেস মানালি ম্যানিয়া, পিঙ্ক অর্কিড-মানালি ম্যানিয়া, মানালি ম্যানিয়া-পিঙ্ক অর্কিড, গোয়িং সাইড বাই সাইড, পিঙ্ক অর্কিড ওভারটেকিং মানালি ম্যানিয়া, মানালি ম্যানিয়া ওভারটেকিং পিঙ্ক অর্কিড, পিঙ্ক অর্কিড-মানালি ম্যানিয়া, মানালি ম্যানিয়া-পিঙ্ক অর্কিড”। দুটো ঘোড়া একদম পাশাপাশি ছুটছে, শানুর বুকের ভিতর হৃৎপিন্ডটা এত জোরে লাফাচ্ছে, বোধহয় ঘোড়াগুলোর পা-ও এত জোরে ছুটছে না। মানালি ম্যানিয়ার জকি আরশাদ আলম হুইপ করলো, ঘোড়াটা কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। ক্রিস্টোফার কিছু করছে না কেন? আর তো মাত্র কয়েক লেংথ বাকি। মনে পড়লো পিঙ্ক অর্কিড আজ “নো হুইপ” ঘোড়া, উঁচু ক্লাস থেকে ডিগ্রেডেশন হয়ে নিচু ক্লাশে আসা ঘোড়াকে চাবুক মারা যায় না। তাহলে কি হবে? তীরে এসে তরী ডুববে পিঙ্ক অর্কিডের আর তার সাথে সাথে শানুর!
হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো ক্রিস্টোফার। একেই বলে পোড় খাওয়া জকি। হুইপ মারতে পারবে না বলে, ঘোড়াকে আ্যডভান্টেজ দিতে, ঘোড়ার উপর ভার কমিয়ে দিলো। এবার উড়তে লাগলো পিঙ্ক অর্কিড, এক লেংথ, দু লেংথ, পাশাপাশি তীরবেগে ছুটে আসছে মানালি ম্যানিয়া। সারা মাঠ নিঃশব্দ; শুধু সিসি টিভিতে কমেন্টেটরের চরম উত্তেজিত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, “পিঙ্ক অর্কিড-মানালি ম্যানিয়া, মানালি ম্যানিয়া-পিঙ্ক অর্কিড”। দুটো হাত মুঠো করে শুন্যে ছুঁড়ে শানু চেঁচিয়ে উঠলো, “কাম অন পিঙ্ক অর্কিড, আজ তেরা দিন হ্যায়”।