দ্বিপঞ্চাশৎ পর্ব
রেসের মাঠে যখন যাওয়া হয়, তখন এ সি সুমোর মাঝের সিটে লাল্টুদা হাত পা ছড়িয়ে বসেন, সেখানে আর কারো বসার অধিকার নেই। সামনের সিটে টাকা ভর্তি ফোলিও ব্যাগ নিয়ে বসে শানু। পিছনের সিটে বসে বাচ্চা ঠাকুর এবং ছোটে মিয়া। প্রত্যেকর দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। শানুর দায়িত্ব টাকাপয়সা সামলে রাখা, যে রেসে লাল্টুদা যতো টাকার বাজী ধরবেন, সেই টাকা বাচ্চা ঠাকুরকে গুনে দেওয়া এবং কোনো রেসে জিতলে, যদিও এই ঘটনা খুব কমই ঘটে, জেতা টাকা ব্যাগে গুছিয়ে তুলে রাখা। বাচ্চা ঠাকুরের কাজ লাল্টুদার নির্দেশ অনুযায়ী যে রেসে যত টাকার বাজী খেলবেন, সেই মতো কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটা, জিতলে টিকিট দেখিয়ে টাকা নিয়ে আসা, লাল্টুদার জন্য বিয়ার, সিগারেট ইত্যাদি নিয়ে আসা, আরো সব টুকিটাকি ফরমায়েশ খাটা। লাল্টুদা বসে বসে বিয়ারের জাগে চুমুক দেন, ছোটে মিয়ার সাথে আলোচনা করে, কোন রেসে কোন ঘোড়ার উপর বাজী ধরবেন, তার ডিশিসন নেন, আর রেস শুরু হলে, চেয়ার ছেড়ে, রেলিং-এর পাশে দাড়িয়ে, খুব দামী একটা বাইনোকুলারে চোখ রেখে পুরো রেসটা দেখেন। উত্তেজনায় নিজের উরুতে দুমদুম করে কিল মারতে থাকেন, আর রেস শেষ হলে “হার্ডলাক, হার্ডলাক” বলে বিড়বিড় করতে করতে, আবার নিজের সিটে ফিরে যান।
হারলে অবশ্য তার খুব একটা কিছু যায় আসে না, কারণ এই মাঠে তিনি যে টাকা ওড়ান, সবটাই হারামের টাকা – চিটিংবাজী, তোলাবাজি করে কামাই করা টাকা। তার তৈরী বাড়িতে ১:৪ অনুপাতের প্লাস্টারিং-এর বদলে, ১:৮ অনুপাতের প্লাস্টারিং করে কামানো টাকা; লো গ্রেড সিমেন্ট, লো স্ট্রেন্থ রি-রোলড স্টিল, নোনাধরা ইট, পাতলা বালি, পুওর কোয়ালিটি স্টোনচিপ ব্যবহার করে কামানো টাকা, সর্বোপরি পার্টিফান্ডের নাম করে তোলা চাঁদার সিংহভাগ নিজের পকেটস্থ করা টাকা। আর কে না জানে, “উৎপাতের টাকা চিৎপাতে যায়”। কচ্চিৎ কদাচিৎ একটা রেসে, লাল্টুদা যে ঘোড়ারউপর বাজী লড়েছেন, সে ঘোড়া যদি জিতে যায়, তাহলে আর তাকে পায় কে। হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে, চেঁচাতে থাকেন, “এ ঘোড়ার মৃত্যু নেই”, “ঘোড়া তো নয় বাঘের বাচ্চা, লেজ ছুঁতে দেয় নি কাউকে”, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আগেই বলেছি, প্রত্যেকটি রেসে কোন ঘোড়ার উপর বাজী ধরবেন, তার ডিশিসন লাল্টুদা, ছোটে মিয়ার সাথে আলোচনা করেই নেন। এই ছোটে মিয়া আদতে একজন অভিজ্ঞ পান্টার। প্রত্যেকটি রেসে প্রত্যেকটি ঘোড়ার কুষ্ঠীঠিকুজী তার নখদর্পনে। কোন ঘোড়ার মা কোন ডার্বি জিতেছিলো, কোন ঘোড়ীর বাবা কোন গিনি জিতেছিলো, টাইমিং কি ছিলো, হ্যান্ডিক্যাপ কতো ছিলো, জকি কে ছিলো, ট্রেনার কে ছিলো, এ সবের চলতি-ফিরতি এনসাইক্লোপেডিয়া হলো এই ছোটে মিয়া। এ ছাড়া সে একজন খবরিলালও বটে। এই মাঠে অনেক দু নম্বরি কাজকম্মোও চলে। সে সব গোপন সংবাদ সে যোগাড় করে। যেমন কোন ঘোড়ার মালিকরা, নিজেদের মধ্যে understanding করে, ফেবারিট ঘোড়ার বদলে আপসেট ঘোড়া জেতাবে, কোন জকি অন্য ঘোড়ার মালিকের থেকে দানা (রেসের মাঠের ভাষায় এর অর্থ ঘুষ) খেয়ে ঘোড়াকে টেনে দেবে অর্থ্যাৎ ইচ্ছে করে slow করিয়ে দেবে এইসব information রাখা এবং যৎসামান্য পয়সার বিনিময়ে বেচা, এটাই ছোটে মিয়ার জীবিকা।
অথচ এক সময় খিদিরপুরে ছোটে মিয়ার রমরমা দর্জির দোকান ছিল। কিন্তু সর্বনাশা রেসের নেশায়, সেই দোকান, ওয়াটগঞ্জে তার তিনতলা বাড়ী, সব খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে সে। এমন কি তার বিবিও তাকে তালাক দিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেছে। আজকাল সে লাল্টুদার আশ্রয়েই আছে। তিনি তাকে ভরসাও করেন খুব, অন্ততঃ রেস খেলার ব্যাপারে। কিন্তু শানুর কেমন যেন মনে হয়, ছোটে মিয়ার স্পেকিউলেশনগুলো খুবই আনসাইন্টিফিক। যদি তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতো, তাহলে সে নিজে কেন তার সর্বস্ব গাঁড় মারিয়েছে, আর লাল্টুদাই বা তার টিপস-এ খেলে, প্রায় প্রতি রেসে হারেন। স্ট্যাটিস্টিক্সে শানু পড়েছে “Law of Uncertainty”, যেটা অনুযায়ী অবশ্যম্ভাবী ঘটনা কখনোই ক্রমাগত ঘটতে পারে না, মাঝেমধ্যে অনিশ্চিত ঘটনা ঘটবেই। আবার অনিশ্চিত ঘটনাও কখনো ক্রমাগত ঘটতে পারে না, অবশ্যম্ভাবী ঘটনা মাঝে ঘটবেই। এটা শুধু বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত সত্য নয়, একটা জীবনদর্শনও বটে।
যদি রেসের মাঠে এই সূত্র প্রয়োগ করা যায়, দেখা যাবে এর উপযোগিতা। এক দিনে যে সাত-আটটি রেস হয়, প্রত্যেকটিতেই টপ ফেবারিট ঘোড়া জেতে না, মাঝেমধ্যেই দু’একটা রেসে আপসেট হয়। আবার উল্টোটাও সত্যি। প্রতিটি রেসেই নন-ফেভারিট ঘোড়া জেতে না। খুব প্রসপেকটিভ ঘোড়াও তার জীবনে অনেক রেস হারে, আবার খুব দুর্বল ঘোড়াও সারা জীবনে, দু’চারটে বাজী তো জিতেই যায়। ফেবারিট ঘোড়ার উপর বাজী ধরলে, সেই ঘোড়া জিতলে, তার উপর ডিভিডেন্ড খুব কম পাওয়া যায়, হয়তো টাকায় কুড়ি পয়সা বা বড়জোর তিরিশ পয়সা। কিন্তু নন-ফেবারিট ঘোড়ার উপর থাকে সাত কিংবা আটের দর, কখনো কখনো আরও বেশী অর্থ্যাৎ সেই ঘোড়া জিতলে, তার উপর বাজী ধরা পান্টার, যত টাকা বাজী ধরেছে, তার তত গুন ডিভিডেন্ড পাবে। শানুর কাছে রেসের এই আপসেট ইভেন্টগুলোর আকর্ষণ সব থেকে বেশী।