ডায়াবেটিস জন্মের পর থেকে যেকোনো সময় হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের হার বেশি হওয়ায় আমাদের কাছে ডায়াবেটিস বলতে মনের মধ্যে বড়দের চিত্রই ভেসে ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ডায়াবেটিসের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয় বিলম্বিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭০ লাখের অধিক রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ২০ হাজারের মতো শিশু ডায়াবেটিসে ভুগছে। এই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। শিশুদের বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিস হতে পারে।
- নবজাতক বা নিওনেটাল ডায়াবেটিস
এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে হয়, যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে হয়। এই ডায়াবেটিস কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক হতে পারে, যা বড় হলে ভালো হয়ে যেতে পারে আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা স্থায়ী ডায়াবেটিসে রূপ নেয়।
- বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিস বা মডি
এটাও নবজাতক বা নিওনেটাল ডায়াবেটিসের মতো একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে হয়। এটা বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে হয়। এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণত পরিবারের তিন জেনারেশনে এ ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকে। নবজাতক ডায়াবেটিস ও বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিসকে একত্রে মনোজেনিক ডায়াবেটিস বলে। - টাইপ-১ বা জুভেনাইল ডায়াবেটিস
শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয় এ ধরনের ডায়াবেটিস। তবে বড়দেরও হতে পারে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন তৈরি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অথবা পুরোপুরি ব্যাহত হওয়ার কারণে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস
শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তা রেসিস্ট্যান্সের জন্য কোষে কাজ করতে না পারার কারণে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত বড়দের বেশি হয় এবং বিশ্বব্যাপী এ ডায়াবেটিসের হার সবচেয়ে বেশি। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। শিশুদের ডায়াবেটিস হলে বড়দের তুলনায় ডায়াবেটিস–সংক্রান্ত জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
- শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ
এ রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা, অতিরিক্ত পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে সমস্যা, ওজন হ্রাস পাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী ঘা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি, শুষ্ক ত্বক, পা অবশ বোধ হওয়া বা ঝিমঝিম করা, মনোযোগ হ্রাস পাওয়া, উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন বমি, পেটের পীড়া ইত্যাদি। অনেক সময় বাচ্চাদের ডায়াবেটিসে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না কিংবা মা-বাবা ব্যাপারটি খেয়াল করেন না। তাই বাচ্চাদের একটি বড় অংশ প্রথম অবস্থাতেই খিঁচুনি, পেটব্যথা, পানিশূন্যতা ও অজ্ঞান হয়ে অর্থাৎ কিটো এসিডোসিস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। উল্লিখিত যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
- শিশুদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ
বড়দের ডায়াবেটিস হলে নিজেরাই এর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত ডায়াবেটিস প্রতিরোধের চেষ্টা করা। পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থাকলে তার সন্তানেরও হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে তাই সতর্ক থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, প্রাথমিক অবস্থায় যেন শিশুর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো জানা থাকলে এ কাজ অনেক সহজ হয়।
ডায়াবেটিসের ব্যাপারে নিশ্চিত হলে ভেঙে না পরে মনোবল দৃঢ় করতে হবে এবং সঠিকভাবে সন্তানের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হতে হবে। প্রথমেই পুষ্টিবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিতে হবে, কারণ খাদ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নির্ভরশীল।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের জন্য অধিক আঁশ ও শর্করাযুক্ত সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা তৈরি করতে হবে, যা শিশুর রক্তের সুগার লেভেল ঠিক রাখবে এবং শিশুর শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকেও ব্যাহত করবে না। শিশুকে তিনবেলা প্রধান খাবারের পাশাপাশি দুই বা তিনবেলা হালকা নাশতা দিতে হবে। খাবার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সন্তানের পর্যাপ্ত শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। শুয়ে-বসে, টিভি দেখে, কম্পিউটার গেমস খেলে সময় কাটানোর চেয়ে বাইরের খেলাধুলার দিকে সন্তানকে আকৃষ্ট করতে হবে। শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিসে হঠাৎ রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ অবস্থা শিশুর জন্য খুবই জটিল। তাই ইনসুলিন দেওয়ার পর পর্যাপ্ত খাবার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শর্করা পরিমাণ দেখে নিয়ে শিশুকে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। সন্তান স্কুলে যাওয়ার সময় তার পকেটে বা ব্যাগে মিষ্টিজাতীয় খাবার রেখে দিতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে অবহিত করতে হবে। সঠিকভাবে ইনসুলিন প্রয়োগবিধি জানতে হবে এবং শিশুকে তা উপযুক্ত বয়সে শেখাতে হবে। সঠিকভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
- ডায়াবেটিস প্রতিরোধে পরিবারের করণীয়
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০১৮-এর স্লোগান ছিল ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের উদ্বেগ’। বিশেষ করে শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে পরিবারের সচেতনতাই মুখ্য।
পরিবারের মধ্যেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা গড়ে তোলার মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব। ছোটবেলা থেকেই সুষম খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খাবার তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি থাকতে হবে। ফাস্ট ফুড খাবার, চিপস, চকলেট, ড্রিংকস–জাতীয় খাবার থেকে শিশুদের যথাসম্ভব বিরত রাখতে হবে।
মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি বর্তমানে শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ, মুঠোফোন, কম্পিউটার ও টিভির সহজলভ্যতা, খেলার মাঠের অভাব ইত্যাদি শিশুদের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিশুরা যাতে মুটিয়ে না যায় এবং স্বাভাবিক ওজনের হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। খোলা মাঠে প্রতিদিন এক ঘণ্টা খেলাধুলা বা হাঁটা, জগিং, সাঁতার, সাইক্লিংয়ের মতো ব্যায়াম করার ব্যাপারে শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে। মুঠোফোন বা কম্পিউটারে গেমস খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে। টিভি বা কম্পিউটারে বেশি সময় কাটানো বন্ধ করতে হবে।
পরিশেষে শিশুদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডায়াবেটিস হলে ভীত না হয়ে সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে শিশুদের পূর্ণ বিকাশ ও সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।
[FA]pen[/FA] লেখক: — ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ | ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।