কাপড়ের জমিন অলংকরণ মাধ্যমগুলোর একটি হ্যান্ড পেইন্টিং। কাপড়ের ওপর তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা হয় নানা কিছু। এর চাহিদা ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে ওঠানামা করে। কখনো হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাকের বেশ কদর থাকে, আবার কখনো কমে আসে। তবে নিভৃতে কিছু মানুষ কাজ করে যান, যাঁরা মূলত শিল্পী। তাঁদের নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি থাকে। তাঁরাই কিনে থাকেন। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ফরমাশ দিয়েও বেশি পরিমাণে পোশাক তৈরি করিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে শাড়িই থাকে চাহিদার শীর্ষে। তবে অন্য পোশাকেও হ্যান্ড পেইন্ট করা হয়।
শাড়িতে পলাশ ও রক্তকাঞ্চন; পরেছেন সাগরদীপা ও নীতু
ফ্যাশন ডিজাইন আর হ্যান্ড পেইন্টের মেলবন্ধনে জমিন হয় দৃষ্টিনন্দন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অবশ্য পড়ে একজন চিত্রশিল্পীর। এই যুগলবন্দী ছাড়া পোশাক আকর্ষণীয় হয়না। এই প্রসঙ্গে একটু অতীতে দৃষ্টি ফেরালে মন্দ হয় না। কারণ, মানুষ পোশাকে রং করার আগে নিজের শরীরকে রাঙিয়েছে। পরে কাপড়ের ওপর রং চড়ানোর চল শুরু হলেও শরীর রাঙানোর বিষয়টা লুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং নানা মাত্রা যোগ হয়েছে।
সে যাহোক, শিল্পী তাঁর ভাবনাকেই তুলির ছোঁয়ায় মূর্ত করে থাকেন। যেখানে থাকে নিবিষ্টতা, শিল্পবোধ আর অবশ্যই মমতা। আমাদের এই উপমহাদেশে কাপড় রাঙানোর প্রথা অনেক পুরোনো। ইতিহাসের শরণাপন্ন হয়ে জানা যায় আলেকজান্ডার ভারতে অভিযানে হ্যান্ড পেইন্ট দেখেছেন। সে হিসাবে তিন হাজার বছর পেরিয়েছে আমাদের এই অঞ্চলের হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের ধারা।
সোনালুর রঙে উজ্জ্বল শাড়ি; পরেছেন কুঁড়ি
হ্যান্ড পেইন্টিং প্রথমে চীনারা শুরু করে রেশমবস্ত্রে। রাজদরবারে তখন সবচেয়ে সমাদৃত এই শিল্প। জাপানিও পরে এই ধারায় যুক্ত হয়েছে। চীনাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক চেংসাম আর জাপানিদের কিমোনোতেও হ্যান্ড পেইন্ট করা হয়ে থাকে। এখনো সেই প্রথা রয়েছে।
এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্পীরা পোশাকে হ্যান্ড পেইন্ট করে থাকেন। এমনকি বিভিন্ন সংগ্রহ তৈরির সময়ও জমিন অলংকরণ মাধ্যম হিসাবে হ্যান্ড পেইন্ট করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নানা ধরনের কাপড় আর মাধ্যমে হ্যান্ড পেইন্ট হয়ে থাকে। এই ধারার পথিকৃৎ অবশ্যই পটুয়া কামরুল হাসান। ঢাকার নিউমার্কেটে তাঁর হাউস রূপায়ণে তিনি হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাক করেছেন। অনেক পরে এসে প্রয়াত ফ্যাশন ডিজাইনার শাহরুখ শহীদ হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাক নিয়ে কাজ করেছেন। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবিতে তিনি নিজে যেমন আঁকতেন, তেমনি আঁকিয়েও নিতেন। তিনি মূলত প্রকৃতির নানা উপাদান নিয়ে কাজ করতেন। পাখি, প্রজাপতি তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল। দুই চিত্রশিল্পী তরুণ ঘোষ আর স্বপন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য অবদান বাংলাদেশের রেখেছেন হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাকে।
নিশাতের শাড়িতে ফুটেছে রক্তকাঞ্চন
তবে এটাকে পেশা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজটা শুরু করেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিল্পী দম্পতি কাজী রকিব ও মাসুদা কাজী। সেই নব্বই দশকে তাঁরা রাজশাহী থেকে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করতেন ঢাকার একাধিক ফ্যাশন হাউসের জন্য।
বর্তমানে অনেকেই হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাক তৈরি করছেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য কাজ করছেন পীযূষ কান্তি সরকার। তিনি একজন তরুণ চিত্রশিল্পী। ঢাকার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছবি আঁকার শিক্ষক। পাশাপাশি পেইন্টিং ছাড়াও তৈরি করেন হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়ি। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেছেন শাড়িতে আঁকা। সে বছর বনানীর যাত্রাবিরতিতে একটা প্রদর্শনীও করেছিলেন ‘জলের ফোঁটা’ শিরোনামে। বেশ সাড়াও মেলে।
তাঁর হ্যান্ড পেইন্টিং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কারণ, তিনি পুরো শাড়িতে পেইন্ট করেন না। বরং শাড়ির একটি বিশেষ অংশে তুলি বোলান, যাতে সেই অংশটা সামনের দিকে থাকে। শাড়িতে তাঁর আঁকার বিষয়ও নির্দিষ্ট। তিনি দেশি ফুল নিয়ে কাজ করেন। সেসব ফুল যেগুলোর উল্লেখ আমাদের কবিতায় মেলে। তিনি সফেদ জমিনেই আঁকতে পছন্দ করেন। তাতে ছবির বিষয় চমৎকারভাবে প্রতীয়মান হয়। সাদা আর কোরা শাড়িতেই তিনি আঁকেন। এই শাড়িগুলো আবার শতভাগ সুতি। ফলে তা পরিবেশবান্ধবও। একই সঙ্গে তাঁর ব্যবহার করা রংও বিশেষভাবে ত্বকবান্ধব। শাড়ির জমিনজুড়ে আঁকেন না বলে শাড়িতে মাত্রা আনতে মাঝে মাঝে আঁচলকে নানা রঙে ডাই করেন। তাতে শাড়িটাও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
চারটি শাড়িতে বসন্তের চার ফুল
‘জলের ফোঁটা’ প্রদর্শনীর পরে তিনি তাঁর চলমান কাজকে একটি শব্দের ব্র্যাকেটে বন্দী করেছেন। রেণুবালা। তাঁর মায়ের নাম। ফলে তাঁর সব সংগ্রহই পরিচিতি পায় রেনুবালা নামে। পরিচিতজনেরাই নিয়ে থাকেন তাঁর শাড়ি। এ ক্ষেত্রে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই প্রচারবিমুখ এই শিল্পীর। বরং ওয়ার্ড অব মাউথই তাঁর বড় শক্তি।
সম্প্রতি তিনি চারটি শাড়ি করেছেন। এই চারটিতে স্থান পেয়েছেন সোনালু, শিমুল, রক্তকাঞ্চন ও পলাশ। বসন্তে কত ফুল ফোটে। সেখান থেকে তিনি এই চতুষ্টয়কে চয়ন করেছেন শাড়ির ক্যানভাস রাঙাতে।
সব শাড়িরই বিশেষ একটি অংশে পেইন্ট করা হয়েছে
সম্প্রতি কথা হচ্ছিল পীযূষের সঙ্গে। বললেন, ফুলকে চেনাতে চান তিনি। পোশাক কেবল পরিধানের নয়, বরং সেটা শেখার মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই তাঁর এই পরিক্রমা।
বাংলাদেশের রয়েছে অসংখ্য নয়নাভিরাম ফুল। সব ফুলের নামও আমরা জানি না। আমাদের নবীন প্রজন্মও জানছে না। এ জন্যই আমি এই পথ বেছে নিয়েছি। আর যাঁরা পরছেন তাঁরা যেমন জানছেন, তেমনি তাঁদের পরিচিতজনদের বলতে পারছেন বলেই অভিমত পীযূষের।