What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (4 Viewers)

Chapter 8: দাবার 64 ছক। (#3)

অভি ওর মাথার চুল আঁচড়ে বলে, “পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে, তাই না?”

অভির কোল ঘেঁসে বসে দুষ্টু, “হ্যাঁ, পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে আমার। আমার সাথে খেলতো, আমাকে খাইয়ে দিতো, আমার চুল আঁচড়ে দিতো, স্নান করিয়ে দিতো আমাকে। ঘুম না পেলে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো পরী পিসি। পিসি চলে যাবার পরে আমার খুব একা একা লাগে।”

বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সেই ছোট্ট ছেলেকে, “তোর পরী পিসি কোথাও যায়নি।” ছোটো বুকের বাম দিকে আদর করে হাত রেখে অভি ওকে জানায়, “তোর পরী পিসি সর্বদা এখানে থাকবে।”

দুষ্টু ওর কথা শুনে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “পরী পিসির সাথে দেখা করার জন্য আমি তোমার বাড়ি যেতে পারি?”

অভির গলা ধরে আসে, “হ্যাঁ বাবা, তুই যখন খুশি আমার বাড়িতে আসতে পারিস। সারা জীবন আমার বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা।”

আনন্দের আবেগে দুষ্টু ওর গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, “তুমি না আমার সব থেকে ভালো কাকু, অভি কাকু।” নিষ্কলঙ্ক নিষ্পাপ সেই মিষ্টি হাসি দেখে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে।

সূর্য বেশ খানিকক্ষন আগেই ডুবে গেছে। মাথার ওপরে পাখীর কিচির মিচির, বাসায় ফিরে যাওয়ার তাড়া সবার। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে ওদের। জামা কাপড় পরে বাড়ি ফিরে আসে ওরা, সারাটা পথ, অভির হাত আঁকড়ে ধরে থাকে দুষ্টু। বাড়িতে ঢুকেই পরীকে দেখে লাফিয়ে কোলে চড়ে যায় আর কানে কানে কিছু বলে। পরী অভির দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে দুষ্টুর কথা শুনে হেসে ফেলে।

পরী ওকে বলে, “হ্যাঁ রে, তুই যখন তখন আমার বাড়িতে আসতে পারিস।”

বাড়িতে অভির উপস্থিতি যেন আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। বিশেষ করে সুব্রত আর অভির মধ্যে যে একটা মনোমালিন্য চলছে সেটা দিদা আর সুমন্ত মামার চোখ এড়ায় না। এক বিকেলে সুমন্ত মামা আর অভি বারান্দায় বসে মুড়ি আর চা খাচ্ছিল, সুমন্ত মামা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি সুব্রতর বিয়ের সময়ে ওর সাথে সারা রাত ছিলে, তাই না?”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অভি জানায়, “হ্যাঁ ছিলাম।”

সুমন্ত মামাঃ “তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, তোমরা দুজনে একে অপরের সাথে ঠিক করে কথা বলছো না কেন? বউমাকেও তোমার সামনে বের হতে দেখলাম না, কি ব্যাপার?”

অভি ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। চা মুড়ি খাওয়া ভুলে যায় অভি, কিছুক্ষণ মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে মামা কতটুকু খবর জানেন।

তারপরে অভি চালাকি করে উত্তর দেয়, “হয়তো আমার কোন কথায় একটু বোঝার ভুল হয়ে থাকবে, আমি আমার দিকে থেকে ঠিক আছি। অপেক্ষা করছি ও কখন আমার সাথে কথা বলে। যদি কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের মধ্যে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”

সুমন্ত মামা মাথা দোলায়, “ঠিক কথা, এখুনি ওকে ডেকে কথা বলা যাক।” তারপরে সুমন্ত মামা চেঁচিয়ে সুব্রতকে ডাক দেয়, “সুব্রত বারান্দায় আয় একবার, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

সুমন্ত মামার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে সুব্রত, এসেই দেখে দাদার পাশে অভি বসে। ওকে দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুব্রত। দু’চোখে ভয় আর বিতৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে এসেছে সুব্রতর, ধির পায়ে সুমন্ত মামার কাছে এসে দাঁড়ায়।

ভয়ার্ত গলায় মাথা নিচু করে সুমন্ত মামাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “কি হয়েছে দাদা?”

সুমন্ত মামা একবার অভির দিকে তাকায় তারপরে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই অভির সাথে কথা বলছিস না কেন? তোদের মধ্যে কোন মনোমালিন্য হয়েছে নাকি?”

অভি অনুধাবন করে যে এখুনি সুব্রতকে বিব্রত করা বিচক্ষণের কাজ নয়। অভি সুব্রতর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বলে, “কিছু হয়নি, তাই না মামা। সব ঠিক আছে।” সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “সুব্রত হয়তো সময় পায়নি কথা বলার, নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই, বউকে নিয়ে ব্যাস্ত আছে।”

অভির কথা শুনে সুব্রতর বুকের থেকে এক বিশাল পাথর সরে যায়, স্বস্তির শ্বাস নেয় সুব্রত। কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

কিছু পরে সুমন্ত মামা অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী তোমাদের বাড়িতে ঠিক আছে তো?”

অভি সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার বাড়ি আর কোথায়, এখন তো ওটা পরীর বাড়ি। মাকে ছোটো মা বলে ডাকে বাবাকে বাবু।”

সুমন্ত মামাঃ “আমি কাউকে ঠিক ভাবে দেখতে পারিনি সেই সময়ে। কি করবো, বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমাকেই কাজে নামতে হয় পেটের ভাত যোগাড় করার জন্য। আমি যখন সময় পেলাম মাথা তুলে তাকানোর, ততদিনে আমার সেই মিষ্টি ছোট্ট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাথা তুললাম বটে, কিন্তু আমার কথা আর কেউ শোনেনা। এই পৃথিবী কাঁচের ঝকমকিতে উজ্জ্বল, অভি। আসল হীরের মর্যাদা বোঝে না, আসল হীরে তো চমকায় না, না কাটা পর্যন্ত শুধু একটা সাদা পাথর মাত্র। কিন্তু কাঁচ, কাটা হোক বা আস্ত হোক, সর্বদা চমকায়।”

অভিঃ “এসব কথা কেন বলছো মামা?”

সুমন্ত মামাঃ “তোমার মা, উলুপিদি আর আমাদের পরিবার; আমাদের মাঝে রক্তের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই, হ্যাঁ, অনেক দূর সম্পর্কের দিদি হন উলুপিদি। এই বাড়িতে থাকতেন কেননা তুমি তখন ওনার পেটে আর ওনার স্কুল এখানে তাই। সেই সম্পর্ক না থাকার পরেও তিনি যা করেছেন সেই সময়ে আমাদের নিজের কোন আত্মীয় আমাদের জন্য করেনি।”

অভিঃ “মামা, ছাড়ো ওসব কথা, পরী এখন ভালো আছে, আনন্দে আছে।”

সুমন্ত মামাঃ “হ্যাঁ ওর মুখের হাসি দেখে মনে শান্তি লাগে। তবে ভয় হয়, কতদিন ওই হাসি ওর মুখে থাকবে।”

অভিঃ “কেন? হাসি কেন চলে যাবে, এই রকম কেন ভাবছো তুমি?”

সুমন্ত মামাঃ “মেয়ে হয়ে জন্মেছে, একদিন না একদিন বিয়ে করে পরের বাড়ি চলে যাবে। কে জানে, ভাগ্য বিধাতা কি লিখে গেছে ওর কপালে।”

অভিঃ “ওর মুখে হাসি ফুটুক, এটা তুমি চাও, এইতো।” সুমন্ত মামা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” অভি বলে, “ও যেখানে আছে এখন বড় ভালো আছে, শান্তিতে আছে। তুমি চিন্তা কোরোনা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

সুমন্ত মামাঃ “অভি, এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর।”

অভিঃ “মামা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি যতদিন ওর পাশে আছি ততদিন ওর কিছু হতে দেব না।”

মামা কি বুঝলো জানেনা, ম্লান হেসে অভিকে বললেন, “কতদিন, কতদিন থাকবে ওর পাশে তুমি? এক না এক দিন তো বিয়ে করে ওকে চলে যেতে হবে।”

মনে মনে বলে অভি, “না মামা, পরী কোনদিন আমার চোখের সামনে থেকে যাবেনা, তুমি একবার বলো, আমি কোনদিন ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেব না।” সুমন্ত মামাকে মজা করে বলে, “মামা, চিন্তা কোরোনা, পরী কোথাও যাবে না, সর্বদা তোমার ছোটো বোন, তোমার বুকের কাছেই থাকবে। যেখানেই থাকুক না কেন, বড় সুখে থাকবে ও।”

একদিন রাতে, অভি ছাদে উঠে সিগারেট টানছিল। মাথার ওপরে অন্ধকার, গাড় নীল আকাশের বুকে অজস্র নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। গীষ্মের রাতের দখিনা বাতাস ওর মন বিচলিত করে তোলে। বাড়ির সবাই হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, সময় প্রায় মধ্যরাত্রি। অভি দিগন্তের দিকে তাকায়, দিগন্তে কালো কালো নারকেল গাছ যেন ভুতের মতন মাথা দুলিয়ে ওকে কাছে ডাকে। পাশে কোথাও কোন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুরে রাস্তার মোড়ে একটা কুকুর ডেকে ওঠে মনে হয় বিড়াল দেখে তাড়া করেছে কুকুরটা।

সিগারেট শেষে, অভি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই সামনে পরীকে দেখে অবাক হয়ে যায়। আকাশের বাঁকা চাঁদের মৃদু আলোয় পরীর সুন্দর মুখ যেন গাঁদা ফুলের মতন দেখায়। পরী ওর দিকে হেসে বলে, “কি রে দুষ্টু ছেলে, ঘুম আসছে না?”

অভি পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে নিয়ে নিজের দিকে টেনে আনে, “শয়তান হাড়গিলে, তোরও তো ঘুম আসছে না।”

ছাদে উঠে, ছাদের এককোনে পরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নরম পেটের ওপরে আদর করে অভি আর পেছনে মাথা হেলিয়ে ওর হাত দুটি ধরে দাঁড়িয়ে আদর খায় পরী। অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের অপরূপ দৃশ্যে হারিয়ে যায়।

মৃদুকন্ঠে বলে পরী, “এত রাতে ছাদে কি করছিলে?”

গালে গাল ঘষে উত্তর দেয়, “তোমারও তো ঘুম আসছিল না, কেন জেগে?”

পরীঃ “সিঁড়িতে তোমার পায়ের শন্দ শুনে দেখতে এলাম তুমি কি করছো।”

অভিঃ “মিথ্যে বোলোনা সোনা, পায়ের শব্দে তোমার ঘুম ভাঙেনি। তুমি আগে থেকেই জেগে ছিলে, তাই না?”

পরী ওর বাঁধা হাতের মাঝে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বুকের ওপরে হাত রেখে চোখের দিকে তাকায়। পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভির মনে সংশয় জাগে, পরীর দু’চোখে সংশয়ের ছায়া। অভি ভুরু কুঁচকায় পরীর দিকে তাকিয়ে, “কি হলো?”

পরী উত্তর দেয়, “মৈথিলী তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু কারনে বলতে পারছিলো না।”

অভিঃ “পুরো ব্যাপারটা বলবে কি আমাকে?” পরীকে নিবিড় করে টেনে নেয় বুকের কাছে, “তোমার মনে ভেতরে এত চাপা উত্তেজনা কেন?”

পরী কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, “তোমার আর সুব্রতদার ব্যাবহারের জন্য আমি চাপা উত্তেজনায় ভুগছি। তুমি কি নিজে বুঝতে পারছো না, তুমি আসার পর থেকে এক বারের জন্যেও ওরা দুজনে তোমার সামনে আসেনি।”

দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে বলে, “ওরা আমার সামনে আসেনি তো আমি কি করতে পারি তাঁর জন্য।”

পরী অভির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি নিজে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতে পারো তো।”

অল্প বিরক্ত হয়ে ওঠে অভি, বাহুর বাঁধন আলগা করে নেয় পরীর কোমরের থেকে, “আমি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবো? আমি যদি আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে যাই তাহলে মনে হবে যেন আমি দোষী। আমি তো কিছু করিনি।”

পরী ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে বলে, “মেঘনা বৌদি আর মা, তোমাদের দুজনের মধ্যের এই ব্যাবধান নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। আমি কি উত্তর দেব ওদের?”

আরও একটা সিগারেট জ্বালায় অভি, বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে, “মৈথিলী তোমাকে কি বলেছে বা কি বলতে চেয়েছে?”

পরীঃ “কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল আমাকে, তবে কিছু না বলে শুধু আমাকে বললো যে, অভিকে বলে দিও আমি খুব পরিতপ্ত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে কি ঘটনা ঘটেছে। তাঁর উত্তর আমাকে শুধু বললো যে ও তোমার সামনে আসতে পারবে না। ওর মুখের পরিতাপের ছায়া ছিল।”

পরীর কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় অভির, “কি দরকার ছিল ওর ঘরে যাওয়ার?”

পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে অভির বকুনি শুনে, “আমি কি করতে পারি। আমাকে তো দেখাতে হবে যে আমি কিছু জানিনা। তুমি কেন কিছু না বুঝেই চেঁচাতে শুরু করে দাও আমার ওপরে?”

অভি দেখলো যে প্রেয়সী রেগে উঠেছে, হাত ধরে কাছে টেনে নেয় পরীকে, “ঠিক আছে যেকোন একদিন রাতে আমার সাথে দেখা করতে বলো। আর হ্যাঁ, ওয়াকম্যানটা আনতে ভুলবে না, আর তুমি আমার সাথে সেখানে উপস্থিত থাকবে।”

পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কেন? তুমি ওদের সাথে কথা বলবে, হয়তো আমি থাকলে ওরা ঠিক ভাবে খুলে কথা বলতে পারবে না।”
 
Chapter 8: দাবার 64 ছক। (#4)

অভি দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “ওই বেশ্যা মেয়েছেলেটা আমার সামনে কাপড় খুলে দাঁড়াতে পারে আর তোমার সামনে কথা বলতে পারবে না? আমি ওই শুয়োরটাকে আর ওর নিচ বউকে উচিত শিক্ষা দেব, চিরকাল মনে রাখবে।”

পরী অভির গালে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “আরে এত রেগে যায় না, মাথা ঠাণ্ডা করো আর শুতে চলো।” অভির ঠোঁটে চুমু খেয়ে দুজনে শুতে চলে আসে।

দিদার বাড়িতে অভিদের বেড়ানোর দিন ফুরিয়ে আসে। বাবা মা রবিবার সকালের প্লেনে বম্বে থেকে ফিরে আসছে। শনিবার বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কোলকাতা ফিরে যাবার ঠিক আগের দিন, দিদা ঠাকুর ঘরে বসে সন্ধ্যে প্রদিপ দিচ্ছিলেন ঠাকুরকে। অভি চুপিচুপি এসে দিদার পেছনে বসে পড়ে। দিদা খুব মন দিয়ে একটা ধার্মিক বই পড়ছিলেন। সন্ধ্যে প্রদিপের আলোয় দিদার চোখের কোল চিকচিক করতে দেখে। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে অভির, দিদার ব্যাথা ভরা চোখ দেখে, ছোটো মেয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাথা। পুজো শেষে দিদা বুঝতে পারেন যে অভি ওর পেছনে বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অভির দিকে স্নেহ সুলভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন।

সেই কুড়ি বছর আগেকার অভিকে যেন দেখতে পায় দিদা। অভি হাত বাড়িয়ে ধরে, “প্রসাদ দেবে না আমাকে?”

দিদা ওর দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন, “কখন এলি তুই?”

অভিঃ “অনেক আগে। তুমি বই পড়তে এত ব্যাস্ত ছিলে তাই তোমাকে ব্যাঘাত করিনি।”

অভির হাতে সন্দেশের প্রসাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “হ্যাঁরে, পরী তোদের বাড়িতে ঠিক করে থাকে তো?”

অভিঃ “তোমরা সবাই ওই রকম প্রশ্ন করো কেন বলতো? ওটা ওর আরও একটা বাড়ি, এখানে যা করে ওখানেও তাই করে। তুমি ওর জন্য এত চিন্তা কেন করছো?”

দিদা ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করেন, “কাল তোরা চলে যাবি। আবার কবে আসবি?”

অভি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তোমার মেয়ের বাড়িতে যাবার জন্য তোমাকে জানিয়ে যেতে হবে নাকি? তুমি যখন খুশি যেতে পারো। আমার মাও তো তোমার মেয়ের মতন।”

দিদা মাথা নাড়ায়, “না রে, উলুপি আমার মেয়ে নয় আমার বোনের মতন।”

অভি দিদাকে সান্তনা দেয়, “আহ দিদা ছাড়ো না ওই সব কথা, অন্য কিছু বলো।”

হেসে ফেলেন দিদা, “এই বুড়িটার কাছ থেকে আর কি চাস তুই?”

হাঁটু গেড়ে দিদার সামনে বসে পড়ে অভি, দিদার কুঁচকানো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি একদিন এসে তোমার পুতুল চাইব।”

দিদা বুঝতে পারেনা অভির কথা। ঠাকুরের সিংহাসনে রাখা পিতলের লক্ষ্মী ঠাকুরের দিকে দেখিয়ে বলে, “কোনটা, এটা?”

হেসে ফেলে অভি, “দিদা, এটাও হতে পারে, অন্য কোন পুতুলও হতে পারে।”

দিদা মাথা নাড়িয়ে অভির মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, “তুই কি যে হেঁয়ালি করছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কিন্তু তুই যা চাইছিস সেটা যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে তাহলে আমি তোকে দিয়ে দেব। আমার অমুল্য রতন তুই।”

“দিদা, আমি তোমার মেয়ে শুচিস্মিতাকে ভালবাসি, আমি তোমার কাছে সেই মোমের পুতুলের আব্দার করছি দিদা, দেবে আমাকে তোমার সাধের পুতুলের হাত।” না সে কথা অভির ঠোঁটে আসেনি, বুকের মাঝে থেকে গেছিল সেদিন, কোনদিন সেই কথা দিদাকে বলতে পারেনি অভিমন্যু।

খাওয়ার পরে পরী ব্যাগ গুছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। অভি পেছন থেকে দেখে পরীকে আর মাঝে মাঝে খুনসুটি করে আদর করে দেয় পরীকে। ব্যাগ গুছানো কম আর ছোটো বেড়াল ছানার মতন মারামারি করে বেশি। ব্যাগ গুছানোর পরে দিদার সাথে পরী শুতে চলে যায়।

অভির চোখে ঘুম আসেনা তাই বিছনায় বসে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়তে বসে। ঠিক সেই সময়ে পরী দরজায় টোকা দিয়ে বিচলিত চোখে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই বালিশের তলায় কিছু একটা গুঁজে দেয়। অভি জিজ্ঞেস করাতে, ইশারায় জানায় যে বালিশের তলায় ও ওয়াকম্যানটা লুকিয়েছে। অভি জিজ্ঞেস করে এত বিচলিত কেন দেখাচ্ছে ওকে।

পরী উত্তর দেয়, “সুব্রত আর মৈথিলী তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”

অভি ইশারায় বলে যে ওদের ভেতরে ডাকতে। রাত অনেক, বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছিল। সুব্রত মাথা নিচু করে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। অভি ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যে কি বলতে চাইছে সুব্রত, মাথার মধ্যে রক্ত চড়ে গেছে ওর মুখ দেখে, কান গরম হয়ে গেছে অভির, রাগে।

সুব্রত মুখ নিচু করে মিনমিন সুরে বলে, “আমরা তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই।”

দাঁতে দাঁত পিষে চশমার ওপর দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকায় অভি। পরী একবার সুব্রতর দিকে তাকায় তারপর অভির দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হতে যায়। অভি ওকে থাকতে ইশারা করে, বিছানায় বসতে বলে। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে রাগত সুরে বলে, “যা কিছু বলার আছে পরীর সামনে বলো।”

সুব্রত চুপ করে থাকে। বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে চুপি চুপি ওয়াকম্যান চালিয়ে দেয় অভি। গম্ভির সুরে দাঁতে দাঁত পিষে সুব্রতকে বলে, “চুপ কেন? কি বলার আছে বল?”

সুব্রত অভির দিকে তাকায় আর চাপা স্বরে বলে, “তোমার সাথে একা কথা আছে আমাদের। পরীর সামনে সে সব কথা বলা যাবে না।”

বিছানা ছেড়ে সুব্রতর সামনে উঠে দাঁড়ায় অভি, পরীকে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে সুব্রতকে বলে, “পরী কোথাও যাবেনা। তোমার যা কিছু বলার আছে তোমাকে পরীর সামনেই বলতে হবে। কোন কিছু বোকামো করার চেষ্টা কোরো না।”

পরী অভির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুকের মাঝে দুরুদুরু করতে শুরু করে। পেছন থেকে অভির কাঁধ খামচে ধরে থাকে। পরীর তপ্ত শ্বাস ওর কাঁধ পুড়িয়ে দেয়।

কিছু পরে সুব্রত ওকে বলে, “যা কিছু ঘটে গেছে সব কিছু একটা বড় ভুল বোঝাবুঝির কারনে ঘটে গেছে।”

অভি রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুব্রতর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, “ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়েছ, মশকরা করার জায়গা পাওনি তুমি? কোন কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়নি, তুমি আর তোমার বেশ্যা বউ মিলে খুব মেপে জুকে চাল খেলেছিলে। তুমি আগে থেকেই জানতে তোমার বউ কি করতে চলেছে আর তুমি ওকে বারন করোনি, কেন করোনি? তোমার বউ কোথায়, ডাকো ওকে?”

অভির মুখে বেশ্যা শুনে সুব্রত রেগে যায়, দাঁতে দাঁত পিষে অভির দিকে তাকায়। অভি ওর দিকে হাত মুঠি করে চাপা গর্জন করে ওঠে, “বেশি কিছু বললে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে দেব। শালা, তোমার মাথা দেয়ালে ঠুকে যাবে।”

সুব্রত চাপা স্বরে বলে, “তুমি আগে আমার বউয়ের দিকে পা বাড়িয়েছো। তুমি গান গেয়েছিলে আমার বউকে দেখে, সেটা ভুলে গেছো এখন?”

ঘাড় ঘুরিয়ে পরীর দিকে তাকায় অভি, তারপরে সুব্রতকে বলে, “আমি তোমার বউয়ের জন্য গান গাইনি। আর যদি গেয়ে থাকি, তাহলে মজা করে গেয়েছিলাম, তুমি মজাও বোঝোনা? সত্যি কথাটা বল তো বাপু, তোমার বউ আমার পেছনে কেন পড়েছিল? এমনি এমনি তো এই সব হয়নি, এর মধ্যে কোন গুঢ় চাল লুকিয়ে আছে।”

সুব্রতর উত্তর অভি আর পরীকে কাঁপিয়ে দিল, শুনে ওদের বুক ঘৃণায় রিরি করে ওঠে। সুব্রত বলে ওদেরকে, “বিয়ের কিছু দিন পরে মৈথিলী আমাকে আর অরুনিমাকে একসাথে দেখে ফেলে। অরুনিমা মৈথিলীকে বোঝায় যে এমন কোন মানুষের সাথে ও প্রেম করবে যাতে মৈথিলী নিজেও নিজের শরীরের ক্ষুধা মিটাতে পারে। যাতে আমাদের চারজনের মধ্যেই এই সব ঘটনা সীমিত থাকে।” ওর কথা শুনে পরী ঘৃণায় থাকতে না পেরে অভির কাঁধের মাংসে নখ বসিয়ে দেয়। রাগে দুঃখে ওর চোখে জল এসে যায়, অভির পিঠের ওপরে কপাল ঠুকতে থাকে। সুব্রত আরও জানায় যে, “যখন তুমি গান গাইলে বা মৈথিলীর দিকে একটু ওই রকম ভাবে তাকালে তখন আমরা ভাবলাম যে তোমাকে আমাদের দলে টেনে নেই। কিন্তু আমরা মানুষ চিনতে বড় ভুল করে ফেলি। তুমি যাকেই ভালোবাসো, তাকে যে তুমি ভুলে যাওনি, সেটা অনেক বড়।”

সব কথা শুনে অভির মনে হলো যেন, সুব্রতর মাথা ধরে দেয়ালে ঠুকে দেয়। চাপা গর্জন করে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বউ কোথায়?”

সুব্রতঃ “দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।”

অভিঃ “ভেতরে ডাকো।”

সুব্রত মৈথিলীকে হাত ধরে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে। মৈথিলীর দু চোখ বেয়ে অবিরাম জলের ধারা বয়ে চলে, মাটির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মৈথিলী, মনে মনে মা ধরিত্রির কাছে প্রার্থনা জানায় যে “মা তুমি দ্বিধা হও, আমাকে তোমার কোলে টেনে নাও।” সেই পরিতাপের অশ্রু অভির মন গলাতে পারেনা। বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওয়াকম্যানটা বের করে এনে, সুব্রতর নাকের নিচে নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “জানো এটা কি?”

অভি ওয়াকম্যান চালিয়ে ওদের সব কথা শুনিয়ে দেয়। স্বামী, স্ত্রীর দুজনের বুক শুকিয়ে যায় ভয়ে, সারা শরীর রক্তশূন্য হয়ে যায়, মনে হয় যেন চোখের সামনে নিজেদের মৃত্যুকে দেখছে।

সুব্রত কেঁদে ফেলে প্রায়, অভির হাত ধরে কাকুতি মিনতি করে, “দয়া করে আমার সাথে ওই রকম কোরোনা। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমরা মারা পড়বো।”

অভি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সুব্রতকে জিজ্ঞেস করে, “একটা কারন বল, কেন আমি করবো না।”

ঘরের মধ্যে মধ্য রাতের নিঝুমতা নেমে আসে, কারুর মুখে কোন কথা নেই। অভি অধির অপেক্ষা করে থাকে সুব্রতর উত্তরের জন্য। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে অভি ওদের বলে, “তোমাকে আমার একটা কাজ করতে হবে।”

ভয়ে স্বামী স্ত্রী অভির দিকে তাকায়, আবার কি করতে বলে ওদের, সেই চিন্তায় মরমে যেন মরে যায়।

পরীর দিকে তাকায় অভি, তারপরে সুব্রতদের দিকে তাকায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অভি, ওকে কিছু একটা পদক্ষেপ নিতে হবে, “সেই রাতে আমি যে গান গেয়েছিলাম, সেটা পরীকে দেখে গেয়েছিলাম। তোমার বিয়ের রাতে আমি থেকে গেছিলাম শুধু মাত্র পরীর জন্য। আমি পরীকে খুব ভালবাসি। তুমি ভালো ভাবে জানো, যে আমাদের পরিবারের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু যেহেতু আমার মা ওকে মেয়ের মতন দেখে আর পরী আমার চেয়ে দু বছরের বড়, সুতরাং আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কোন বাড়ি মত দেবে না। সবাই আমাদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করবে। তোমার হাতে দু বছর আছে। পরী মাস্টার্স শেষ করবে আর ইতিমধ্যে আমাকে একটা ভালো চাকরি খুঁজতে হবে। এই দুই বছরের মধ্যে তোমাদেরকে দুই বাড়িকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। কি করে করবে, আমি জানি না, তবে আমি ফল চাই। আমি যদি ওকে না পাই, তাহলে তোমাদের জীবন আমি নরক বানিয়ে দেব। দিদাকে আর সুমন্ত মামাকে সব বলে দেব, আমি রানাঘাটের মৈথিলীর বাড়ি চিনি, আর ঢাকুরিয়ায় অরুনিমার বাড়িও চিনি। সুতরাং আমার সাথে কোন রকমের চালাকি করার চেষ্টা করবে না।”

পরী অভির কথা শুনে কেঁপে ওঠে, “কি বলছে ও, কেন বলছে?” হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “তোমার মাথার ঠিক আছে তো? কি বলছো তুমি?”

পরীর দিকে দেখে হেসে বলে, “আমি যা বলেছি ওদের সেটা করতে হবে, না করে ওদের আর কোন রাস্তা নেই সোনা।” সুব্রত আর মৈথিলী যেন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে অভিমন্যু, শুচিস্মিতাকে ভালবাসে, হাঁ করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা দুই স্বামী স্ত্রী।

অভি ওদেরকে বলে, “এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি ওকে ভালোবাসি। এখন যাও আমার ঘর থেকে, আমি বিশ্রাম নেব। আর হ্যাঁ, তোমার ওই শয়তান বউকে বেঁধে রেখো যেন, না হলে আমি কিন্তু তোমাদের জীবন নরক বানিয়ে দেবো।”

মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় সুব্রত আর মৈথিলী, যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করে যায় যে অভির কথা ওরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।

সুব্রত বেরিয়ে যাবার পরেই পরী অভির গালে সপাটে এক চড় মেরে চাপা চিৎকার করে ওঠে, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” অভির চোখের চশমা উড়ে বিছানার ওপরে গিয়ে পড়ে। অভি ওর হাত ধরে সান্তনা দেয়, রাগে কাঁপতে শুরু করে পরী। অভি পরীকে বুকের কাছে টেনে এনে বলে, “এত রাগ করছো কেন? আমার সাথে যেমন চাল চেলেছে আমিও একই রকম চাল চেলেছি।”

পরী অভির বুকের ওপরে কিল মেরে কঁকিয়ে ওঠে, “একি করলে তুমি? এখন আমাদের কথা সবাই জেনে যাবে আর সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

অভিঃ “কিছুই হবে না সোনা, বিশ্বাস করো। আমাদের কথা কাক পক্ষীতেও টের পাবে না, ওরা আমাদের কথা কাউকে জানাবে না, কেননা আমাদের হাতে ওদের প্রান ভ্রমর আটকে আছে।”

বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে অভিকে। অভি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। বুকের ওপরে ঠোঁট চেপে আলতো চুমু খায় পরী, মৃদুকন্ঠে অভিকে জানায়, “আমি তোমাকে ভালোবাসি সোনা, তোমাকে না পেলে আমি সত্যি মরে যাবো।”

বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরীকে, মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে চুমু খেয়ে বলে, “সোনা ভয় পেও না, আমি আছি। আমি আমার ভালবাসার জন্য যা কিছু ক্করতে রাজি আছি। এভরি থিং ইস ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।” দুজনে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরে পরী ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে শুতে চলে যায়।

পরদিন, শনিবার, অভি আর পরী কোলকাতার বাড়িতে ফিরে আসে। বিদায়ের ক্ষণ বড় বেদনাময় হয়ে ওঠে। সবাই জল ভরা চোখে পরীকে বিদায় জানায়। সময় কারুর জন্য অপেক্ষা করে থাকেনা, ওদের এক সময়ে বিদায় নিতেই হতো। সারাটা সময়, পরী বাড়ির কথা আর ঘুরে বেড়ানোর কথা বলে নিজের মনের বিদায়ের ব্যাথাটাকে দুরে করে রাখে। বিকেলে বাড়ি পৌঁছে অভি ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। সন্ধ্যে নাগাদ অভির মা, ফোন করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওদের কথা।

রাতের খাওয়া শেষ, পরীর ডিভানে শুয়ে, আর ওর পেটের ওপরে মাথা রেখে অভি শুয়ে শুয়ে সত্যজিৎ রায়ের “কাঞ্চনজঙ্ঘা” সিনেমা দেখছিল। অভির বাঁ হাত বুকের কাছে রেখে আঙুল নিয়ে খেলা করছিল পরী আর মাঝে মাঝে ওপরে চেপে ধরে চুমু খেয়ে দিচ্ছিল।

পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বাড়ির সবার ওপরে কি জাদু করেছো?”

অভি জিজ্ঞেস করে, “আমি জাদু? কেন জিজ্ঞেস করছো?”

পরী মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “জীবনের প্রথম বার দেখলাম বড় বউদিকে রান্না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে কোন আত্মীয়কে বিদায় জানাতে। এই প্রথম বার বড়দা মাঠে না গিয়ে আমাদের যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুষ্টু দৌড়ে এসে কোলে চেপে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওকে কবে নিয়ে আসব কোলকাতায়। এর আগেও দিদিরা যখন বাড়ি থেকে বিদায় নিতো, তখন কেউ কাঁদতো না, কিন্ত আজ সবার চোখে জল ছিল। কি জাদু করেছো তুমি সবার ওপরে?”

অভি পরীর হাত টেনে ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে বলে, “সোনা, পরী, আমি কারুর ওপরে কোন জাদু করিনি। জীবনটাই একটা বড় দাবার ছক। বত্রিশটা সাদা ছক আর বত্রিশটা কালো। দাবায় কেউ সৈনিক, কেউ ঘোড়া, কেউ গজ, তোমাকে সবসময়ে মেপে চাল চালতে হয় সোনা, না হলে হেরে যাবে। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি যা কিছু করতে রাজি পরী।”

পরী অভির চোখে তাকিয়ে বলে, “আমি দাবা খেলা জানিনা অভি, আমি শুধু জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, ব্যাস। তোমাকে ছাড়া আমি যে বাঁচতে পারবোনা অভি।”
 
Chapter 9: দিবস, রজনীর খেলা। (#1)

জুন মাসের শেষ। একদিন রাতের খাওয়ার সময়ে অভি বাবা মাকে জানায় যে পরেরদিন ওর কিছু ইন্টারভিউ আছে। একটা চাকরি বড় জরুরি অভির পক্ষে। ছোটোবেলা থেকে অভি বাবা মার কাছে শুনে এসেছে যে বাবা মা ওর জন্য অনেক পয়সা খরচ করেছে আর তাঁর সঠিক ফলাফল অভি তাদের দিতে পারেনি। বাবা মায়ের ভর্ৎসনা শুনে শুনে অভির মন বিষিয়ে গেছে, অন্যদিকে পরীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ওকে সমাজের সমকক্ষ হয়ে দাঁড়াতে হবে না হলে কেউ ওর আওয়াজ শুনবে না।

রাতের খাওয়ার পরে বসার ঘরে বসে টি.ভি দেখছিল। পরী ওকে দুধ দেবার জন্য ঢুকে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কাল কোথায় কোথায় ইন্টারভিউ আছে?”

অভিঃ “অনেক জায়গায় পাঠিয়েছিলাম শুধু দু জায়গা থেকে ডাক এসেছে। পি.ডাব্লু.সি আর এন.আই.আই.টি থেকে কল এসেছে। কাল ক্যামাক স্ট্রীট যাবো, দেখি কি হয়।”

সোফায় ওর পাশে বসে অভির মাথার চুলে বিলি কেটে বলে, “আমার বিশ্বাস তুমি কিছু না কিছুতে পেয়ে যাবে। কিন্তু অভি, রেসাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত তো কেউ তোমাকে চাকরি দেবে না। একটু অপেক্ষা করো, গ্রাজুয়েসানের রেসাল্ট বের হওয়া পর্যন্ত।”

অভিঃ “না পরী, আমাকে কোন রকমে একটা চাকরি পেতেই হবে। যা পাব তাতেই ঢুকে যাবো আমি।”

পরীঃ “এত উতলা হচ্ছো কেন? আর দুই মাস বাকি রেসাল্ট বের হতে, তারপরে ইন্টারভিউ দাও। এখন তোমাকে কেউ চাকরি দেবে না অভি, গ্রাজুয়েসান ডিগ্রি চাইই চাই।” পরী ঠিক কথাই বলেছিল। ওর দিকে হেসে বলে, “কাল এমনি এমনি বের হবে? শুধু আমি আর তুমি, খালি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব দুজনে। এখননো তোমার শহর, কোলকাতাকে ঘুরিয়ে দেখাওনি কিন্তু।”

অভিঃ “হাঃ কোলকাতা আমার শহর নয়, আমি এখানে বেশি সময় থাকিনি। এই শহরকে ঠিক নিজের বাড়ি বলে মেনে নিতে কষ্ট হয় আমার।”

পরীঃ “ঠিক আছে বাবা। কাল আমি তোমার সাথে ইন্টারভিউর জায়গায় যাবো, তারপরে না হয় দুজনে কোথাও বেড়াতে যাবো, হলো। এখন মাথা ঠাণ্ডা করে ঘুমাতে যাও।”

অভিঃ “আমার সাথে এসো না প্লিস।”

পরীঃ “কেন?”

অভিঃ “আমি এমনিতেই অনেক উত্তেজিত কালকের ইন্টারভিউর ব্যাপারে, তুমি সাথে থাকলে আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। তাঁর চেয়ে বরং তুমি বাড়িতে থাকো, আমার ইন্টারভিউ শেষ হলে আমি ফোন করে দেব, তুমি ট্যাক্সি নিয়ে তিনটে নাগাদ নন্দনে চলে এসো। একসাথে মুভি দেখব, স্পিলবার্গের সিন্ডলারস লিস্ট।”

পরী নাক কুঁচকে বলে, “ইস, ইংরাজি সিনেমা? ধুর আমি ইংরাজি সিনেমা দেখিনা, একে তো কিছু বুঝিনা। তুমি আমাকে যদি হিন্দি অথবা বাংলা সিনেমা দেখাতে চাও তাহলে আসতে পারি।”

ঠিক তখনি মা ওদিক থেকে পরীকে শুতে যেতে বলে। অভি টি.ভি বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে যায়। যাবার আগে পরীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমি কিন্তু কাল তোমার জন্য নন্দনে অপেক্ষা করবো। আসা না আসা তোমার ব্যাপার।”

পরদিন, ইন্টারভিউর পরে অভি নন্দনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরীর জন্য অপেক্ষা করে। পরীর দেখা না পেয়ে, অভি মর্মাহত হয়ে পড়ে। মাথায় রাগ চড়ে যায় অভির, সাথে সাথে মনে ভয় ঢোকে। কিছু হয়নি তো ওর, কোলকাতায় নতুন, একা একা ট্যাক্সি চেপে ঠিক ভাবে পৌঁছাতে পারবে তো নন্দনে। পরীর যদি কিছু হয় তাহলে মা ওকে কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফোন করে পরীর খবর নেওয়ার জন্য। পরী ফোন তোলে, আর অভি রেগে যায় এই ভেবে যে শেষ পর্যন্ত পরী ওর কথা রাখলো না।

অভি ফোনে পরীর ওপরে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি তিন ঘন্টা ধরে তোমার জন্য নন্দনে অপেক্ষা করছি আর তুমি বাড়িতে বসে কি করছো?”

পরী বিরক্তির সুরে উত্তর দেয়, “একদম চেঁচাবে না আমার ওপরে।”

অভি থামেনা, “তুমি আসবেনা, সেটা সকালে জানিয়ে দিলেই হতো। অত আদিখ্যেতা দেখানোর কি ছিল? আমি তোমার জন্য তাহলে নন্দনে অপেক্ষা করে থাকতাম না।”

পরীঃ “তোমাকে অপেক্ষা করতে কে বলেছিল, আমি কি বলেছিলাম? আমি তো তোমাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিলাম যে যদি তুমি আমাকে হিন্দি বা বাংলা সিনেমা দেখাও তাহলে আমি তোমার সাথে যেতে রাজি আছি।”

অভিঃ “তার মানে তুমি আসছো না তাই তো। আমি এতক্ষণ তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আর তুমি এখন বলছো যে তুমি আসবে না।”

পরীঃ “আমি আগেই বলেছি যে আমার ওপরে ওই রকম ভাবে চেঁচাবে না।”

অভিঃ “আমি কিছু জানিনা, আমি আরও এক ঘন্টা তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করবো। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসো।”

পরীঃ “তুমি কি আমাকে আদেশ করছো তোমার সাথে সিনেমা দেখতে যেতে? আমি আসছি না, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো।” এই বলে ফোন রেখে দেয়।

অভি অনেকক্ষণ এদিক ওদিকে ঘুরে ফিরে একটা সিনেমা দেখে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে যায়। সিনেমায় অভির মন বসেনা, সামনের পর্দায় সিনেমা চলতে থাকে কিন্তু মাথার মধ্যে পরীর ওপরে খুব রাগ হয়। সন্ধ্যের পরে বাড়ি পৌঁছে দেখে যে বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। পরী চেহারা অস্বাভাবিক ভাবে শান্ত, মনের মধ্যে যেন অশান্তির মেঘ জমে উঠেছে, অভির সাথে ঠিক ভাবে কথা বলছেনা পরী। বসার ঘরে বসে টি.ভি চালায় অভি। কিছু পরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে ধুপ করে ওর সামনে চায়ের কাপ রেখে ওর দিকে বিরক্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। অভি চোখ তুলে তাকাতেই, মুখ ঘুরিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়। অভি জল খাওয়ার ছুতো করে রান্না ঘরে ঢোকে।

গলা নামিয়ে পরীকে জিজ্ঞেস করে, “কথা বলছো না কেন আমার সাথে?” পরী কিছু সবজি কাটছিল, পেছন ফিরে ভুরু কুঁচকে বিরক্তি ভরা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকায়, যেন জিজ্ঞেস করে, “কি চাই তোমার?” অভি ওকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে, “হা ভগবান, কেন মরতে আমি প্রেয়সীকে রাগাতে গেলাম?” হাত বাড়িয়ে ছুঁতে যাবে পরীকে, ঠিক সেই সময়ে বাবা অভিকে ডাক দেন।

বাবাঃ “তোর ইন্টারভিউ কেমন গেল?”

অভিঃ “মটামুটি গেছে।”

বাবাঃ “কোথায় গেছিলি?”

অভিঃ “এন.আই.আই.টি, ক্যামাক স্ট্রীট।”

বাবাঃ “ব্যাঙ্কিং, ডাব্লু.বি.সি.এস এই সবে চেষ্টা করিস না কেন? কোন সরকারি চাকরি দেখ।”

অভি তখন রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে, পরী ওর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে, “ওই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও এখান থেকে।”

বাবা থেমে থাকেন না, নিজের ঘর থেকেই অভির ওপরে বকতে শুরু করেন, “সারা জীবন তো তুই আমাদের কথাই শুনলি না, নিজের মতন চলে গেলি। কত টাকা পয়সা খরচ করে তোকে পড়ালাম, কিন্তু কি রেসাল্ট করলি তুই? এমনি কি আই.আই.টি বা জয়েন্ট পেলি না। কি চাস তুই? তুই ভাল করে জানিস কি করে তোকে কলেজে ভর্তি করেছি, সেখানেও মন দিয়ে যদি একটু পড়াশুনা করতিস। পড়াশুনা করতে চাস, না ভেগাবন্ডের মতন ঘুরে বেড়াতে চাস?”

শুরু হলো অভিকে বাক্য বাণে বেঁধা। কিছু পরে মা স্কুল থেকে ফিরে অভিকে জিজ্ঞেস করেন ইন্টারভিউর কথা, মাকে জানায় যে ওরা বলেছে রেসাল্ট বের হবার পরে আসতে। রান্না ঘরের দরজায় তখন দাঁড়িয়ে অভি, একদিকে মা অন্যদিকে বাবা, দুজনে মিলে ওকে বকতে শুরু করে দেন। প্রথমত, ইন্টারভিউ ভালো যায়নি, তারপরে পরী আসেনি নন্দনে, তারপরে বাবা মায়ের বকুনি, মাথা যেন আর ঠিক রাখতে পারে না অভি।

চেঁচিয়ে ওঠে সবার ওপরে, “আমাকে একটু কি একা একা বাঁচতে দেবে?” শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে রেগে মেগে নিজের ঘরে চলে যায়।

পশ্চিম আকাশে বর্ষা কালের ঘন কালো মেঘ, অভির বুকের ভেতরে দুখের কালো মেঘ জমে ওঠে। আলমারির এক কোনা থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে অভি, স্কুলে পড়ার সময়ে এক বন্ধু ওকে উপহার দিয়েছিল। কাঁচের ছোটো ছোটো গুলি ভর্তি সেই কাঠের বাক্সে, ছোটো বেলায় হস্টেলে থাকতে গুলি খেলতো অভি। সব গুলিগুলো বিছানার ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে, ওর ওপরে শুয়ে পড়ে, নিজের সেই হারানো ছোটো বেলা ফিরে পেতে চায়। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে, বুকের মাঝে অব্যক্ত এক বেদনা। কিন্তু সময়কে যে কেউ ধরে রাখতে পারেনা, চেষ্টা করেও ফিরে পাবেনা ওর সেই বাল্যকাল বা ওর মনের সেই অব্যক্ত ইচ্ছে গুলো। রাতে মা খেতে ডাকতে আসেন, অভি চুপ করে বালিশে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে। একবার ভাবে হয়তো মা বা পরী ওর জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসবে, কিন্তু কেউ ওর জন্য খাবার নিয়ে আসে না।

না খেয়ে শেষ পর্যন্ত বিনিদ্র রজনী কাটায় অভি, সকালের দিকে ঘুম পায়। সকালেও কেউ ওকে ডাকতে আসেনা। অনেক দেরি করে ঘুম ভাঙে অভির, চোখ খুলে ঘড়ি দেখে, এতক্ষনে বাবা মা কাজে বেরিয়ে গেছেন। বাইরে তাকিয়ে দেখে, বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বাড়িতে শুধু অভি আর পরী, চুপচাপ নিচে নেমে লক্ষ্য করে যে নিজের ঘরের বিছানার ওপরে বসে পরী। জানালার বাইরে একমনে তাকিয়ে আছে আর জানালার বাইরে গাছের ওপরে বৃষ্টির জল পড়া দেখছে। চুপ করে বসে, হাঁটু ভাঁজ করা, হাঁটুর ওপরে থুতনি রাখা, দু’চোখে অব্যক্ত কোন বেদনা ছলকে পড়ছে। ধিরে ধিরে ওর পাশে গিয়ে বসে অভি। লক্ষ্য করে যে, গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। পরী নিজের খেয়ালে এতই মগ্ন ছিল যে বুঝতেই পারেনি যে অভি ওর পাশে এসে বসেছে। পরীর কাঁধে হাত রাখতেই পরী নিজের সম্বিৎ ফিরে পায়। জল ভরা লাল চোখে অভির দিকে তাকায়, সারা চেহারায় এক ব্যাথা ফুটে উঠেছে পরীর, বুকের ভেতরে যেন কোন বেদনা ওকে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিয়েছে।

অভি চিন্তিত হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তোমার?”

মাথা নাড়ায় পরী, “কিছু না।”

অভিঃ “ওইরকম ভাবে বসে আছো কেন?” বুকের ভেতরে যেন দামামা বাজতে শুরু করেছে।

আবার মাথা নাড়ায় পরী, “কিছু হয়নি, বলছি তো।” পায়ের দিকে তাকিয়ে বিছানার ওপরে নখ দিয়ে খোঁটে। দু’কাঁধে হাত রাখে অভি, পরীর হাঁটুর কাপড় চোখের জলে ভিজে উঠেছে।

বেদনার চাপা চিৎকার করে ওঠে অভির দিকে, “তোমরা সবাই স্বার্থপর। আমার আশেপাশের সব মানুষ স্বার্থপর।”

চিবুকে আঙুল দিয়ে মাথা তুলতে চেষ্টা করে অভি, ঘাড় শক্ত করে রাখে পরী। বার বার অনুরোধ করে, কি হয়েছে জানাতে, পরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, বাইরে অঝোরে শ্রাবনের ধারা।

শেষে ধরা গলায় বলে, “যখন ছোটো ছিলাম, আমাকে চন্দ্রানিদির কাপড় পরতে হতো। ওর বই আমাকে পড়তে হতো। আমার জন্য কোনদিন নতুন বই কেনা হতো না, আমি কোনদিন কোন নতুন জামা কাপড় পাইনি। মায়ের কাছে নতুন জামা চাইতেই মা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেন। বড় হলাম আমি, বড় বৌদি আমাদের বাড়ি এলেন। সেই প্রথম আমি পুজোর সময়ে নতুন জামা পাই, বড় বৌদি আমায় নতুন জামা কিনে দেয়। ইন্দ্রানিদি আর চন্দ্রানিদির বিয়ে হয়ে গেল। ওরাই আমাদের বাড়ির খরচ উঠাতো। সুমন্তদা শুধু মাত্র এক চাষি, বাকি দুই দাদাও ছোটো ছোটো, কেউ তখন কোন টাকা অর্জন করেনা। আমি বাড়ির ছোটো তাই সবাই নিজেদের মতামত আমার ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইতো।”

দু’চোখে অবিরাম শ্রাবনের ধারা বয়ে চলে পরীর, অভি ওর মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে যায়। বিরক্ত হয়ে পরী ওর হাত সরিয়ে দেয়। পরী থামেনা, “আমি আরও বড় হলাম। কোনোরকমে আমার পড়াশুনা করানো হলো। দিদিরা আমার বিয়ের জন্য মেতে ওঠে। মা আর সুমন্তদা আমার বিয়ের কথা শুনে প্রথমে বাধা দেন। ইন্দ্রানিদি ওর দেওরের সাথে আমার বিয়ের ঠিক করে, আমি তখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। শশাঙ্কদা বিয়েতে মত দেননা, আমাকে গ্রাজুয়েশানে ভর্তি করে দেন। গ্রাজুয়েশানের শেষে শশাঙ্কদা আমার বিয়ের ঠিক করে মেঘনা বউদির এক খুড়তুতো ভাইয়ের সাথে। সারা জীবন সবাই মিলে আমার ওপরে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়, একবারের জন্য কেউ আমাকে আমার মনের কথা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমি কে? আমি কি একটা জ্যান্ত পুতুল নাকি? সবার কথা সারা জীবনভর আমাকে শুনে যেতে হবে? আমার নিজের কি কখনো কোন মতামত থাকতে পারেনা? ছোটমাকে শেষ পর্যন্ত ডাকা হয় আর তুমি এলে আমার জীবনে। আজ তুমিও আমার ওপরে চেঁচিয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত। আমি কি তোমাদের সবার হাতে একটা কাঠের পুতুল নাকি? সবাই যা বলবে তাই আমাকে মেনে নিতে হবে। আমার নিজের কোন চাহিদা থাকতে পারেনা? ছোটবেলা থেকে দিদিরা, তারপরে দাদাদের, আর এখন তোমার কথা মানতে হবে আমাকে? আমার কি হৃদয় বলতে কিছু নেই? আমার কি নিজের কিছু ইচ্ছে থাকতে পারেনা অভি?”
 
Chapter 9: দিবস, রজনীর খেলা। (#2)

পরীকে কাছে টেনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ক্ষমা চায় অভি, “আমি দুঃখিত পরী, ক্ষমা করে দাও।”

অভিকে ঠেলে সরিয়ে দেয় পরী, “তার মানে তুমি যদি জানতে যে আমার খারাপ লাগবে তাহলে তুমি করতে না, তাই তো? তুমি নিজে থেকে একবারের জন্য ভেবে দেখেছো কি, যে আমি তোমার সাথে যখন ওই অজানা জায়গায় গেছিলাম তখন আমার মনের অবস্থা কি ছিল? একবারের জন্য নিজে ভেবেছো কি যে তুমি অরুনিমার সাথে কি করছো সেটা আমি জানতে পারলে আমার মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে? না তুমি নিজে থেকে একবারের জন্যেও ভাবোনি। তোমাকে না বললে তুমি ভাবতে পারো না, কেন? অভি কেন? তোমরা সবাই স্বার্থপর, শুধু নিজেদের কথাই ভাবো।”

কি বলবে অভি, ভাষা যেন গলার কাছে দুমড়ে আটকে থাকে, কোনোক্রমে উত্তর দেয়, “অরুনিমা একটা ভুল মাত্র, পরী।”

চিৎকার করে ওঠে পরী, “ও, ভুল। পুরুষ মানুষ ভুল করলে ভুল নয় সেটা পুরুষত্ব আর মেয়েরা করলে সেটা ছেনালিপনা, তাই না? কেন এইরকম আলাদা মনের ভাবো অভি?”

অভি পরীর মাথা বুকের ওপরে চেপে ধরে, ডুকরে কেঁদে ফেলে পরী, “পরী, প্লিস, ক্ষমা করে দাও, প্লিস। আমি প্রতিজ্ঞা করছি জীবনে কোনদিন আমি তোমাকে আঘাত করবো না। কখনই না, পরী। আমি তোমাকে সব দুঃখ কষ্ট থেকে অনেক অনেক দুরে রাখব, দুহাতে আগলে রাখবো তোমাকে।” বুকের কাপড় দু’হাতে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় অভির বুক। পরীর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে অভি, “দেখো, আর কেঁদো না, নাহলে এবারে আমি কিন্তু কেঁদে ফেলবো। একটি বারের জন্য হাসো পরী। দেখ, আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে কোনদিন কিছু করতে বলবো না, তোমাকে জিন্স পরতে বলবো না, তোমাকে ইংরাজি সিনেমা দেখতেও বলবো না। যেখানে তোমার ইচ্ছে হবেনা সেই জায়গায় পর্যন্ত যাবো না আমি।”

ওর কথা শুনে চোখের জল মুছে তাকায় অভির দিকে, “কে বলেছে তোমাকে যে আমি জিন্স পরতে ভালোবাসি না? আমি তোমার জন্য কাজাতে পরেছিলাম না।”

পরীর মুখে হাসি দেখে অভি স্বস্তির শ্বাস নেয়, “যাক বাবা, বাঁচালে। তা দুপুরে কি রান্না করেছো?”

পরী বিছানার ওপরে ঠেলে ফেলে দেয় অভিকে, “সকাল থেকে এত মন খারাপ ছিল যে রান্না ঘরে ঢুকতে মন করেনি তাই কিছুই রান্না করিনি। ছোটমা বাবু চলে যাওয়ার পরে এখানে বসে বসে শুধু বৃষ্টি দেখেছি। খুব একা মনে হচ্ছিল তখন, জানো।”

অভি ওর হাত ধরে টান দেয় আর পরী ওর বুকের ওপরে পড়ে যায়, “কে বলেছে তুমি একা? আমি আছি যে তোমার সাথে।”

অভির বুকের ওপরে হাত রেখে, থুতনি রাখে বুকের ওপরে, ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে পরী। অভি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে শক্ত করে। অভি চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে, “সিনেমা দেখতে যাবে?”

বুকের ওপরে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “মাথা খারাপ নাকি, তোমার সাথে আবার সিনেমা দেখতে যাওয়া। রান্না করতে হবে না? দুপুরে খাবে কি?” কোনোরকমে অভির দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।

অভি বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, জানালার সামনের জামরুল গাছের পাতায় টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়ছে, সামনের কার্নিশে একটা চড়ুই পাখি জবুথবু হয়ে বসে, মাঝে মাঝে পাখা ঝেড়ে গায়ের জল শুকিয়ে নিচ্ছে। অভি বুকের ওপরে হাত বোলায়, ঠিক যেখানে ওর প্রেয়সী আদর করে চাঁটি মেরে গেছে, মনে হয় যেন সেই নরম আঙুলের ছোঁয়া এখন লেগে।

“এই এখন পড়ে পড়ে কি ভাবছো? খাবার তৈরি, চলে এসো।” খাবার ঘর থেকে পরী ওকে ডাক দেয়।

খাবার ঘরে ঢুকে পরীকে বলে, “আমি এখনো স্নান করিনি, বেবি।”

কাছে এসে পেছনে আদর করে এক লাথি মেরে বলে, “তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসো, খিদেতে আমার পেট জ্বলছে।”

অভি ওর পেছনে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “আমি কিন্তু তোমার পেছনে লাথি মারব না, অমন রসালো মন্ড একেবারে কামড়ে খেয়ে নেব।” খিলখিল করে হেসে ফেলে পরী, অভিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় বাথরুমের ভেতরে।

বাবার আদেশ অনুসারে কিছুদিন পরে অভি ব্যাঙ্কিং পরীক্ষার আর অন্য কিছু সরকারি চাকুরির পরীক্ষার ফর্ম কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হবার উদ্যোগ করে। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ গুমোট বেঁধে, যেকোনো সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। কোলকাতায় একবার বৃষ্টি নামলে ধরতে অনেক সময় লাগে। এমন সময়ে পরী এসে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যাচ্ছে ও। অভি জানায় যে কলেজ স্ট্রিট যাবে ফর্ম কেনার জন্য, পরীও ওর সাথে বের হবার জন্য জেদ ধরে।

অভি ওকে বুঝিয়ে বলে, “দেখ, আকাশ গুমোট বেঁধে বৃষ্টি যেকোনো সময়ে নামতে পারে। তুমি বাড়িতে থাকো, আমি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসব।”

বিষাদের ছায়া নেমে আসে পরীর চেহারায়, “সারাদিন একা একা বাড়ি বসে কি করবো আমি? কোথাও যেতে পারিনা। আমি যদি তোমার সাথে যাই তাহলে তোমার কি অসুবিধে হবে? আমাকে আজ পর্যন্ত কলেজ স্ট্রীট নিয়ে গেলে না।”

অভি ওর বিষণ্ণ চেহারা দেখে শেষ পর্যন্ত মত দেয়, “ঠিক আছে বাবা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।”

তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বেরিয়ে এলো পরী, দেখে মনে হলো যেন কোলকাতার রাস্তায় আগুন ধরাবে। গাড় নীল রঙের স্কার্ট, জানু পর্যন্ত চেপে বসা তাঁর নিচে ঘাগরার মতন ফুলে উঠেছে। পরনের কাপড় চেপে বসে পরীর কোমরের নিচের অংশ যেন ফুটে বেরিয়েছে। গায়ে আঁটো গোলাপি জামা, গলায় গাড় নীল স্টোল, নিজের অপরূপ যৌবন ঢেকে রাখার জন্য গায়ের ওপরে জড়িয়ে নিয়েছে। মাথার চুল একপাশে সিঁথে করে আঁচড়ানো, ঘাড়ের কাছে আলতো এক খোঁপায় বাঁধা। কানে দুটি ক্রিস্টালের লম্বা দুল। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অভি, ওর গাড় বাদামি রঙের ঠোঁটের দিকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ওই মধুর ঠোঁট জোড়া।

অভির চোখে ভালবাসার তীব্র চাহনি দেখে লাজুক হেসে বলে, “দেখছো কি ওইরকম ভাবে?”

অভি কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন, “যেতেই হবে, তুমি তো মেরে ফেললে আমাকে, পরী।”

লজ্জা পেয়ে যায় অভির কথা শুনে, “উফ, বাবা, আর পারিনা। চাবি নাও, তালা দাও আর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো।”

কলেজ স্ট্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা পরীক্ষার জন্য কিছু বই আর চাকরির ফর্ম কেনে। সেটা পরী প্রথম বার কলেজ স্ট্রীট যাওয়া, আসে পাশের শত শত বইয়ের দোকান দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ও। সরু সরু রাস্তা, তাঁর ভেতরেও বইয়ের দোকান দেখে অবাক হয়ে যায়। ওদিকে আকাশে মেঘ বেশ একটু জমে আসে। পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, কত বইয়ের দোকান হবে এখানে? ওকে উত্যক্ত করার জন্য অভি উত্তর দেয় যে প্রায় আট হাজার ছয়শ বাইশ খানা বইয়ের দোকান।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে, “সত্যি, তুমি গুনেছো?”
অভি হাসি চাপতে পারেনা, “বিশ্বাস করছো না তো, ঠিক আছে গুনে দেখ তাহলে।”

তখন পরী বুঝতে পারে যে অভি ওকে বোকা বানিয়েছে আর সেই রাস্তার মাঝেই ছাতা পেটা শুরু করে অভিকে, “শয়তান ছেলে আমার বোকা বানানো হচ্ছে।”

বাঁ হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে, “আহ, দারুন, না না তুমি বোকা নও। তুমি কি করে আমার কথা বিশ্বাস করে নিলে সেটাই প্রশ্ন।”

ফর্ম কেনা শেষ, ও অভিকে জিজ্ঞেস করে, “ফর্ম কেনা হয়ে গেছে তো, এখন কি করা যায়?”

অভি জিজ্ঞেস করে, “কফি হাউস যাবে?”

পরী, “না গো, আমি তোমার ওই অরুনা বা সমুদ্রনীলের মতন আঁতেল নই গো।”

ঠিক সেই সময়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, আর কোলকাতার বৃষ্টি, একেবারে মুষলধারে নেমে আসে ওদের ওপরে। ঠিক সেই সময়ে বউবাজারের দিক থেকে একটা ট্রাম আসতে দেখে ওরা। পরী ট্রামের দিকে দেখিয়ে অভিকে বলে চড়ে যেতে। অভির জন্য না দাঁড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্রামে লাফিয়ে উঠে পড়ে আর অভির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। অগত্যা অভি দৌড় লাগিয়ে পরীর পেছন পেছন ট্রামে চড়ে যায়। পরীর ওই বাচ্চা সুলভ আচরন দেখে অভির মনে দোলা লাগে।

ট্রামে উঠে ওর গালে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “কোন ধারনা আছে কি এই ট্রাম কোথায় যাচ্ছে?”

খিলখিল করে হেসে দেয় পরী, “না একদম নয়। জেনে কি হবে তুমি আছো তো আমার সাথে, ব্যাস।”

কন্ডাক্টারকে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে যে ট্রাম শ্যামবাজার যাবে। হাতিবাগানের কাছে এসে গেছে ট্রাম। পরী বাইরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “এই নামো নামো নামো...”

অবাক হয়ে যায় অভি, “কেন কি হলো?”

পরী অভির জামা টেনে ধরে বাইরে দেখায়, “দেখ, দর্পণে 'হটাত বৃষ্টি' চলছে, চলো না দেখি।”

অভি নাক কুঁচকে বলে, “ধুর বাবা, বাংলা সিনেমা।”

অভির হাত ধরে টেনে কন্ডাক্টারকে ট্রাম থামাতে বলে, “ও দাদা দাঁড়ান।” অভিকে বলে, “চলো না, প্লিস। তুমি যদি আমাকে এই সিনেমা দেখাও তাহলে আমি তোমার সাথে ওই ছাই পাঁশ ইংরাজি সিনেমা দেখতে যাব। কি নাম সেই ইংরাজি মুভিটার।”

মুখ বেঁকায় অভি, “সিন্ডলারস লিস্ট।”

পরীঃ “আচ্ছা বাবা, যারই লিস্ট হোক, আমি দেখতে যাবো, কথা দিচ্ছি। যতক্ষণ তুমি পাশে আছো ততক্ষণ আমার কোন চিন্তা নেই।”

শেষ পর্যন্ত আকাশের বৃষ্টি আর প্রান প্রেয়সীর দৌলতে অভিকে বাংলা সিনেমা, “হটাত বৃষ্টি” দেখতে হয়। সিনেমা দেখে বাইরে বেরিয়ে দেখে যে আকাশ কালো, বৃষ্টির ধারা অবিরাম ঝরে চলেছে, আর বৃষ্টির চোটে কোলকাতার রাস্তা ঘাটের কথা আর নাই বা জানানো হলো আলাদা করে। চারদিকে জলে থই থই। ওদের কাছে একটা ফোল্ডিং ছাতা, মুষলধার বৃষ্টি বাগ মানেনা, কিন্তু দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ধরার অপেক্ষা করার জো নেই। বাবা মা বাড়ি পৌঁছানোর আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে না হলে, আবার কখন আগ্নেয়গিরি ফেটে লাভা নির্গত হবে তাঁর নেই ঠিক। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে পরী আর গায়ের কাপড় খুব বাজে ভাবে ত্বকের সাথে লেপটে রয়েছে। চারিদিকে হায়নার চোখের আড়াল করে ছাতা দিয়ে পরীকে আগলে রাখে অভি। গায়ে স্টোলটা ভালো করে জড়িয়ে নিতে বলে। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি চেপে বাড়ি ফেরে।

বাড়ি ফিরে দেখে যে বাবা বাড়ি পৌঁছে গেছেন। বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যায় শতগুন। বাবা জিজ্ঞেস করাতে অভি উত্তর দেয় যে, পরীক্ষার ফর্ম কিনতে কলেজ স্ট্রীট গেছিল। বাকি উত্তর পরী দেয় যে, রাস্তায় অরুনার সাথে দেখা হয়ে যায় তাই দেরি হয়ে যায় ওদের। কিছু পরে কাপড় বদলে নিচে এসে দেখে যে মা বাড়ি ফিরে এসেছেন। পরী ঘন ঘন হাঁচি দিচ্ছে। মা পরীকে জিজ্ঞেস করে যে কেন এত হাঁচি দিচ্ছে। পরী জানিয়ে দেয় যে ওরা কলেজ স্ট্রীট গেছিল অভির ফর্ম কিনতে সেখানে অরুনার সাথে দেখা হয়ে যায় তাই দেরি হয় আর সেই সময়ে বৃষ্টি নামে আর ওরা ভিজে যায়। মা শাল এনে ওর গায়ে জড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে যে মেয়ের গায়ে জ্বর।

অভির দিকে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কোন জ্ঞান বুদ্ধি নেই। মেয়েটার শেষ পর্যন্ত জ্বর হয়েছে।”

অভি হাঁ, পরীর জ্বর হয়েছে তার জন্য মা ওকে দায়ী করছেন, ঠিক বুঝতে পারে না। বাবা নিজের ঘর থেকে বলেন, “হাঁদা ছেলেটা, এই বৃষ্টিতে পরীকে নিয়ে কলেজ স্ট্রীট যাবার কি দরকার ছিল।”

অভিঃ “ছাতা নিয়ে গেছিলাম আমরা।”

মা রেগে মেগে বলেন, “ওকে নিয়ে যাবার কি দরকার ছিল তোর?”

ওর সামনে ছোটো মা অভিকে বকুনি দিচ্ছে, ছোটো মায়ের কথা শুনে পরীর মনে বড় আঘাত লাগে। পরী অভির পক্ষ নিয়ে ছোটমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অভি আঙুল নাড়িয়ে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করে। পরী ব্যাথা ভরা চাহনি দেয় অভির দিকে। পরীকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে অভিকে ডাক্তারের কাছে নাম লেখাতে বলে।

বাবার বন্ধু, বাড়ির ডাক্তার, রাতে পরীকে দেখে যান আর কিছু ওষুধ লিখে দেন। বলেন যে কিছু না শুধু একটু সর্দি জ্বর হয়েছে, কিন্তু মেয়ের জ্বর দেখে পরীর ছোটমা অতি বিচলিত হয়ে ওঠেন। অভি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে শুধু মাত্র একটু সর্দি জ্বর হয়েছে, অতো চিন্তা করার কিছু নেই, কিন্তু মায়ের মন মানেনা। রাত বেড়ে চলে, পরীর জ্বর বেড়ে যায়। দরজার ফাঁক থেকে দেখে যে পরী জ্বরের তাপে কাঁপছে আর মা ঠায় ওর মাথার কাছে বসে জল দিয়ে কপাল ধুয়ে দিচ্ছেন। সারা রাত জ্বরের বেদনায় কাতরায় পরী, মাথার কাছে মা বসে থাকেন, চিন্তায় ঘুম আসেনা, ওদিকে বসার ঘরে জেগে বসে অনুতপ্ত অভি, দু’চোখে ঘুম নেই। সকালের দিকে পরীর জ্বর কমে আর একটু ঘুমাতে পারে পরী। ওদিকে অভি শুধু মাত্র দূর থেকে দেখে ব্যাথায় কাতরানো হৃদয়কে, মায়ের সামনে ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বোলানোর উপায় পর্যন্ত নেই।
 
Chapter 9: দিবস, রজনীর খেলা। (#3)

সকাল বেলায় মা অভিকে বলেন যে, পরীর জ্বর একটু কমেছে, মা স্কুল যাচ্ছেন, অভি যেন সারাদিন বাড়িতেই থাকে। অভিকে না বললেও পরীকে ছেড়ে ও কোথাও যেতো না। বাবা মা চলে যাওয়ার পরে, পরীর ঘরে ঢোকে। আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা। পাশে বসে ঝুঁকে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে এক ভাবে চেয়ে থাকে। আদর করে গালে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। গালের লালিমা যেন নেই, একরাতের জ্বরে যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। গায়ে জ্বর না থাকলেও, বিছানা ছেড়ে ওঠবার শক্তিটুকু ছিলনা ওর। চুপ করে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়, নিজের খাবার কথা ভুলে গিয়ে। মা আদেশ দিয়ে গেছেন সময় মতন ওষুধ খাওয়াতে পরীকে। বিছানা ছেড়ে উঠে ওর জন্য খাবার আনতে যায়, আর হাতে টান পড়ে। ঘুরে দেখে পরী ওর দিকে তাকিয়ে কষ্টে হেসে মৃদু সুরে বলে, “একটু বসে যাও।”

ওর হাসি হাসি চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “একটু কিছু খেয়ে নাও তারপরে ওষুধ খেতে হবে। আজ আমি আর কোথাও যাচ্ছি না, তোমার কাছেই থাকব সারাদিন।”

বিছানা মাথার দিকে বালিশ দিয়ে পরীকে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়, গলা পর্যন্ত টেনে দেয় গায়ের চাদর। রুটি দুধ মেখে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসে। অভি ওকে মুখ ধুতে বলে, পরী অনুনয় সুরে বলে, “না।”

অভি মৃদু বকুনি দেয়, “মুখ না ধুলে হবে? যা বলছি তাই করো।” তোয়ালে ভিজিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দেওয়ার পরে খাইয়ে দেয়। হাত মুখ মুছিয়ে দেওয়ার পরে যেন পরীর একটু ভালো লাগে, গালের লালিমা যেন কিঞ্চিত ফিরে আসে।

“ভালো লাগছে?” ওকে জিজ্ঞেস করে। শুধু মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, ঠিক আছে। খাওয়ানোর পরে ওষুধ খাইয়ে দেয়।

অভি পরীকে বলে, “মাথা ধুইয়ে গা হাত মুছিয়ে দেই ভালো লাগবে।”

পরীকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে সাহায্য করতে হবে নাকি, পরী দরজা বন্ধ করে জোর গলায় বলে, “না।” অভি ওর কথা শোনে না, গরম জল করে এনে হাত পা মুখ মুছিয়ে দেয়, পরী বারবার অনুনয় করে, পায়ে যেন হাত না দেয়। হাত পা ধোয়ানোর পরে, পরীর শরীর বেশ হাল্কা লাগে।

“রবীন্দ্রনাথের সাজাহান পড়ে শোনাবে আমাকে?” অভির কাছে আব্দার করে।

অভি বিছানায় উঠে বসে, পরী গায়ের ওপরে চাদর টেনে ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বাম হাত দিয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে, এক হাতে খুলে ধরে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। সাজাহান কবিতার কিছু অংশ পড়ে শোনানর চেষ্টা করে অভি। পরী ওর বাংলা কবিতা পড়া শুনে হেসে ফেলে, “থাক অনেক পড়ে ফেলেছো, আর কবিতার পিন্ডি চটকাতে হবে না।”

অভি নিরুপায় হয়ে পরীকে জানায়, “তুমি জানতে যে আমার বাংলা খুব সুন্দর, তাও আমাকে পড়তে বললে কেন?”

হেসে উত্তর দেয় পরী, “দেখতে চেয়েছিলাম তুমি সত্যি বাংলা পড়তে পারো কিনা।”

মাথার ওপরে চুমু খেয়ে বলে, “হা ভগবান।”

মাথার ওপরে ঠোঁটের পরশ পেয়ে বুকের কাছে আরও জড়সড় হয়ে বসে বলে, “শক্ত করে জড়িয়ে ধরোনা আমায়।”

অভি বই ছেড়ে, দু’হাতে নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে পরীকে। বুকের কাছে যেন লেপটে যায় পরী।

অভি ওর কানে কানে বলে, “আমি হিন্দিতে তোমার জন্য কবিতা লিখেছি, শুনবে?”

পরী মাথা নোয়ায়, “হ্যাঁ।” অভি আবার বলে, “হিন্দিতে কিন্তু।” পরী জানায়, “প্রেমের কি ভাষা হয় নাকি, তুমি বলবে আমি ঠিক বুঝে নেব।”
ডায়রিতে কি লিখেছিল, একবার চোখ বন্ধ করে মনে করে নেয় তারপরে ওর হিন্দি কবিতা শোনায়। কবিতা শোনার পরে পরী অভির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে, দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। মুখ উঁচু করে অভির ঠোঁট ছুঁতে যায়। পরীর ঠোঁট ছোঁয়ার বদলে ওর মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে অভি।
অভিঃ “তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাও, তারপরে আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হবে সোনা।”

পরীঃ “আমাকে তোমার বুকের কাছে লুকিয়ে নাও অভি।”

বুকের ওপরে মাথা চেপে ধরে অভি বলে, “তুমি এখানেই থাকবে পরী, সবসময়ে এখানে থাকবে।”

দিন দুই পরে পরীর জ্বর সেরে গেলে অভি “সিন্ডলারস লিস্ট” দেখতে যাবার কথা বলে। পরী এক উপায় বের করে এবারে যাতে ওরা ধরা না পড়ে। অভিকে বলে যে ওরা বাবু, ছোটমা বেরিয়ে যাবার পরেই সিনেমা দেখতে বেরিয়ে পড়বে আর ওদের ফিরে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসবে। সুকৌশল পরিকল্পনা, যেমন ভাবা তেমনি কাজ, কিন্তু বাদ সাধে বর্ষা কাল। তাই আর সেদিন যাওয়া হয়ে ওঠে না।

কিন্তু পরদিন যেই বাবা মা বেরিয়ে যান কাজে, ঠিক তারপরেই অভি তৈরি হয়ে নেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পরীকে অনুরোধ করে যে ও যেন বৃষ্টির জন্য তৈরি থাকে আর সেই মত কাপড় পরে। কিন্তু লাজুক সুন্দরী পরী, শাড়ি ছাড়া যেন জগতে ওর কাছে আর কোন সুন্দর পোশাক হয় না। যথারীতি হাল্কা গোলাপি রঙের শিফন শাড়ি আর ছোটো হাতার কাঁচুলি পরে বেরিয়ে এলো। ফর্সা গায়ের রঙ আর তাঁর সাথে শাড়ির রঙ বেশ মিলিয়েছে। লাল ঠোঁট, চোখের কোলে কাজল, কপালে ছোটো গোলাপি টিপ সব মিলিয়ে অভির সেদিন মনে হয়েছিল যে, সিনেমা না হয় আর কোন একদিন দেখা যাবে আজ পরীকেই দেখি। হাতে ধরে কালো ক্লাচ ব্যাগ আর বাঁ হাতের সরু কব্জিতে সোনার টাইটান ঘড়ি, ছোটমা কয়েকদিন আগেই কিনে দিয়েছে। হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে যায় পরীকে, মিষ্টি হেসে পরী ওকে বলে, “না, একদম কোন শয়তানি না, চল বেরিয়ে পরি।”

উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে অভি, অন্য হাতের তর্জনী দিয়ে চিবুক ছুঁয়ে সুন্দর মুখখানি ওপরে তোলে। অভির বুকের ওপরে হাত রেখে জামা ধরে নেয়, প্রেমঘন গভীর কালো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

অভিঃ “তুমি এত সুন্দর কেন পরী?”

পরীঃ “সৌন্দর্য সবসময়ে যে দেখে তাঁর চোখে লুকিয়ে থাকে। সুন্দরী আমি নই, তোমার দৃষ্টি, তোমার চাহনি আমাকে সুন্দরী করে তুলেছে অভি।”

সারা রাস্তা পরী ওর একদম পাসে পাসে ছিল, একবারের জন্যও যেন ওকে আলাদা করতে মন করছিল না অভির। নন্দনে তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল। আকাশে কালো মেঘের খেলা শুরু হয়ে গেছে, বৃষ্টি যেকোনো সময়ে নামতে পারে।

পরী ওকে জিজ্ঞেস করে, “সিনেমাটা কি ধরনের?”

অভি উত্তর দেয়, “সত্য ঘটনা অবলম্বে এই সিনেমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এক জার্মান ইহুদী প্রায় এক হাজার ইহুদীদের হিটলারের অত্যাচার থেকে বাঁচায়।”

অস্ফুট চেঁচিয়ে ওঠে পরী, “তুমি আমাকে হরর সিনেমা দেখাতে এনেছো? কেউ কি তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এইরকম সিনেমা দেখতে যায়?”

অভি হেসে ওঠে, “না বেবি, হরর সিনেমা নয় এটা।”

পরীঃ “তুমি আস্ত পাগল, এটা হরর নয়তো কি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী তারপরে আবার সত্য ঘটনা অবলম্বনে, তাঁর মানেই তো ভয়ের গল্প, দুঃখের গল্প।”

অভি অনেক নাম শুনেছে ওই সিনেমাটার তাই ওকে দেখতে হবেই, কোনোরকমে পরীকে রাজি করায় সিনেমা হলে ঢুকতে। শেষ পর্যন্ত ওর কাতর মিনতির সামনে পরী হার মানে। নন্দনে খুব কম মানুষ সেইদিন ওই সিনেমা দেখতে এসেছিল, একে বর্ষাকাল তার ওপরে একটু অন্যধরনের সিনেমা বলে হলে লোকসংখ্যা কম। পরী ওর ডানদিকে বসে কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে সিনেমা দেখতে থাকে।

সিনেমায় এক দৃশ্য ছিল যে, রাফ্ল ফিয়েন্স এক সকালে কাঁধে বন্দুক নিয়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। তারপরে সেই বন্দুকের নল তাক করে সামনের জেলের খোলা জায়গার দিকে, যেখানে অনেক ইহুদী মজুর কাজ করছিল। একটা ছোটো ছেলে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটা ছোটো ঘরের সিঁড়িতে বসে একটু বিশ্রাম করছিল। রালফ ফিয়েন্স তাঁর দিকে বন্দুক তাগ করে সেই ছোটো ছেলেটার মাথার মধ্যে গুলি চালিয়ে দেয়, প্রানহীন রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটির ওপরে। সেই দৃশ্য দেখে পরী ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। অভির বুকের জামা খামচে ধরে বুকের ওপরে মুখ লুকিয়ে ফেলে।

পরীঃ “না না না, আমি এইরকম বীভৎস সিনেমা দেখতে পারব না। আমাকে এখানে থেকে নিয়ে চলো, আমি আর এই সিনেমা দেখব না, প্লিস নিয়ে চলো আমাকে।”

অভি মিনতি করে, “বেবি, এটা শুধু একটা মুভি।”

পরী মুখ না উঠিয়েই বলে, “সত্য ঘটনার অবলম্বনে তৈরি, আমি আর দেখতে পারবোনা।”

অভিঃ “প্লিস বেবি।”

পরী বিরক্তি ভরা চাহনি নিয়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, “তুমি কেমন ধারা মানুষ? প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাদের নিয়ে কোথায় রোম্যান্টিক সিনেমা দেখতে যায় আর তুমি কিনা তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে এই রকম উদ্ভট একটা বেদনাদায়ক সিনেমা দেখাতে এনেছো।”

অভিঃ “ওকে বাবা, কি চাও তুমি? দেখতে চাও না চলে যেতে চাও?”

পরীঃ “না আমি আর এই সিনেমা দেখতে চাই না। আমাকে প্লিস এখান থেকে নিয়ে চলো।”

সিনেমার মাঝখানেই ওরা হলো ছেড়ে বেরিয়ে এলো, অভির মন খারাপ হলো বটে কিন্তু পরীকে দুঃখ দিয়ে সিনেমা দেখতে মন চাইলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে পরী লক্ষ্য করলো যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

অভির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলে, “অভি, বৃষ্টি নামলো বলে, কি করবো? আমার শাড়ি ভিজে যাবে যে?”

অভিঃ “বাড়ি ফিরে যাই চলো।”

বাড়ি ফিরে যাবার কথা শুনে পরীর মন খারাপ হয়ে গেল। পরী ওকে বললো, “একদিনের জন্যও ঠিক করে বের হতে পারিনা। চলো না সেই আইস্ক্রিম পার্লারে যেখানে অরুনাকে নিয়ে গেছিলে।”

অভি আর পরী, ট্যাক্সি চেপে আউট্ট্রাম ঘাটের স্কুপ আইসক্রিম পার্লারে চলে আসে। পরীকে নিয়ে সেই একই জায়গায় বসে অভি, যেখানে অরুনাকে নিয়ে বসেছিল। পরী বড় কাঁচের জানালার বাইরে তাকিয়ে গঙ্গার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে, আকাশ কালো, জল কালো, মাঝে দিগন্তের দিকে একটু খোলা আকাশ, নয়নাভিরাম দৃশ্য।

পরী হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “এই রকম রোম্যান্টিক জায়গা থাকতে তুমি কিনা আমাকে নিয়ে সিন্ডলারস লিস্ট দেখতে গেছো, কি মানুষ তুমি অভি?”

পরীর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে থাকে অভি, পরী আইস্ক্রিম খেতে খেতে মাঝে মাঝে ওর মাথার গাল ঘষে দেয়। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে। পরী ওকে বলে যে এবারে বাড়ি ফেরা উচিত। তাড়াতাড়ি আইস্ক্রিম শেষ করে ট্যাক্সি চেপে বাড়ি পৌঁছায় ওরা। বাড়িতে কেউ ফিরে আসার আগেই বাড়ি ঢুকে পড়ে। সারাটা রাস্তা দু’জনে বেড়াল ছানার মতন মারামারি করতে থাকে, পরী ওকে খেপিয়ে তোলে যে প্রেমিকাকে নিয়ে কেউ কি ওই রকম উদ্ভট সিনেমা দেখতে যায়, আর অভি রেগে যায় কেননা ওই সিনেমাটা ওর খুব প্রিয়।

দরজা খুলে পরী সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে, পেছনে অভি। হাল্কা গোলাপি রঙের সিফন শাড়িটা যেন আষ্টেপিষ্টে কমনীয় দেহের সাথে লেপে গেছে। ফুলে ওঠা নিতম্বের দোলা দেখে অভির মন নেচে ওঠে, শাড়ির আঁচল একদিক থেকে সিঁড়িতে পড়ে পরীর পেছন পেছন ধাওয়া করছে যেন। অভি শাড়ির আঁচল টেনে ধরে আর আঁচল ওর বুক থেকে খসে যায়। আচমকা অভির এই ব্যাবহারে পরী চমকে ওঠে, শাড়ির অপর প্রান্ত ধরে মিনতির সুরে অভিকে বলে, “সোনা, প্লিস ছেড়ে দাও।” অভি ওর কথায় কান না দিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে ধরে সিঁড়ির দেয়ালের ওপরে চেপে ধরে পরীর কমনীয় দেহ। বুক থেকে আঁচল খসে গেছে, কাঁচুলি অনাবৃত উন্নত বক্ষ যুগল যেন কাঁচুলির ভেতর থেকে ঠেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অভি নিজেকে আর সামলাতে পারে না। অভি নিজের শরীর ওর দেহের ওপরে চেপে ধরে। লজ্জা পেয়ে যায় পরী, হাত উঠে আসে বুকের ওপরে, ঢেকে নিতে চায় নিজের লজ্জা। শ্বাসের ফলে উন্নত বক্ষ ওঠা নামা করে আর মনে হয় যেন এই ফেটে পড়বে। অভি দু’হাত নিয়ে যায় অনাবৃত কোমরে, মৃদু চাপ দিতে শুরু করে পেটের দুপাশের নরম তুলতুলে নারী মাংস। প্রেমিকের হাতের ছোঁয়ায় পরীর শ্বাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভির কামনা ভরা চোখের সামনে পরীর মুখ। দু হাতে অভির জামার কলার মুঠি করে ধরে আর ওর প্রেমঘন চোখের দিকে তাকায়। লাল ঠোঁট জোড়া অল্প খোলা, অভির সারা মুখের ওপরে তপ্ত কামনার শ্বাস বয়ে যায়। অভির সিংহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
 
Chapter 9: দিবস, রজনীর খেলা। (#4)

প্রকাশ্য দিবালোক সিঁড়ির জানালা দিয়ে ওদের ওপরে পড়ে, পরী লজ্জায় লাল হয়ে ওকে বলে, “প্লিস সোনা এখানে নয়।”

অভির ভেতরে যেন এক ক্ষিপ্ত হায়না জেগে ওঠে, চেপে ধরে নিজের তলপেট পরীর তলপেটের ওপরে। কঠিন শলাকার পরশ বুঝতে দেরি হয়না পরীর। ঠিক তলপেটের ওপরে কঠিন অভি, মৃদু শীৎকার করে ওঠে পরী, “আহহহ... প্লিস সোনা এখানেই আমাকে পাগল করে তুলো না... প্লিস হানি...”

ঠোঁট চেপে ধরে ওই রসালো ঠোঁটে জোড়ার ওপরে, থামিয়ে দেয় পরীর শীৎকার, মুখের ভেতরে টেনে নেয় পরীর শ্বাস আর লালার মধু। পরী দুহাতে ওর মাথা আঁকড়ে ধরে। কম্পিত উন্নত বক্ষ যুগল, অভির প্রশস্ত বুকের ওপরে লেপে যায় মাখনের মতন, পরী যেন গলে গিয়ে প্রলেপ লাগিয়ে দেয় নিজেকে। তীব্র কামনার আগুনে পরী অভির নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁতের মাঝে আর আলতো আলতো চাপ দিতে শুরু করে। কামড়ের সেই স্পর্শ অভিকে উন্মাদ করে তোলে, হাত নামিয়ে নিয়ে আসে পরীর কোমল সুগোল নিতম্বের ওপরে আর চেপে ধরে দুই নারী মন্ড কঠিন থাবার মাঝে। নখ বসিয়ে দেয় শাড়ির ওপরে দিয়ে আর পিষে ধরে কোমল নারী মাংস। দুহাতে চেপে ধরে পরীকে মাটি থেকে উঠিয়ে নেয়, পরী নিজের ভার অভির ওপরে ছেড়ে দেয় আর দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। কোলে তুলে বসার ঘরে ঢুকে ডিভানের ওপরে ছুঁড়ে দেয় পরীর কমনীয় শরীর। ডিভানে শুয়েই পরী ওর আঁচল গুটিয়ে নিয়ে বুকের কাছে জড় করে ধরে মিনতি করে অভির কাছে, “প্লিস এখুনি শুরু কোরো না সোনা, বাবু যেকোন মুহূর্তে বাড়ি ফিরে আসবে।”

এক টানে জামার বোতাম খুলে ফেলে অভি, জামা ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। প্রেমিক অভি লালসার লেলিহান শিখায় জ্বলে এক বুভুক্ষু হায়নার ন্যায় হয়ে উঠেছে। হিংস্র চোখে ক্ষুধার্ত দানবের মতন তাকিয়ে থাকে পরীর দিকে। বিছানার ওপরে চড়ে পরীর দিকে এগিয়ে যায় আর পরী ওর চোখের ভাষা দেখে ভয়ে দেয়ালের দিকে পিছিয়ে যায়। এ কোন অভিমন্যু, এতো ওর প্রানের অভি নয়, কেঁপে ওঠে পরীর বুক। ওর পা ধরে টান মারে অভি, এক লাথি মারে অভির বুকের ওপরে। অভির হাত পৌঁছে যায় শাড়ির গিঁটের ওপরে, নাভির চারদিকের নরম মাংসে নখ বসিয়ে খামচে ধরে। পরী বারংবার অভিকে শান্ত হতে কাতর মিনতি জানায় কিন্তু ক্ষুধার্ত অভি উন্মাদ হয়ে উঠেছে। পেটের ফর্সা ত্বকের ওপরে নখের আঁচড়ে লাল হয়ে ওঠে।

পরী চিৎকার করে ওঠে ক্ষিপ্ত নাগিনীর মতন, “আমাকে ছেড়ে দাও অভি। আমার লাগছে।”

কি হয়েছিল সেদিন অভির, কিছুই জানে না, কোন কারন নেই তাও পরীর ওপরে যেন ওকে খুবলে খাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরীর চিৎকারে অভির সম্বিৎ ফেরে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে, পরীর গাল বেয়ে প্রচন্ড বেদনার অশ্রু গড়াচ্ছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে পরী, কম্পিত ঠোঁটে ধিক্কার জানায়, “ছেড়ে দাও আমাকে, তুমি আমার অভি নও।” অভি তাও ছাড়েনা পরীকে, ওর কাতর মিনতি অভির কানে পৌঁছায় না। বুকের কাঁচুলি হাতের মুঠির মধ্যে নিয়ে একটান মারে আর পড়পড় করে ছিঁড়ে ফেলে হাল্কা গোলাপি রঙের বক্ষ আবরন। ভেতরের অন্তর্বাস সরে যায় বুকের অপর থেকে। বাম হাতে চেপে ধরে পরীর কোমল অনাবৃত বক্ষ।

বুকের আবরন ছিঁড়ে যেতেই, মর্মাহত পরী প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে, “দূর হয়ে যাও তুমি, তুমি কিছুতেই আমার অভিমন্যু হতে পারো না, তুমি একটা জানোয়ার।” এক হাতে বুকের কাপড় বুকের ওপরে কোন রকমে গুটিয়ে, ডান হাতে সজোরে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় অভির গালে। চোখের চশমা খুলে মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অভি ওর বুক ছেড়ে দেয়। পরী আবার এক থাপ্পড় কষিয়ে দেয় অভির গালে। আবার চিৎকার করে ওঠে ওর দিকে, “তুমি একটা জানোয়ার, তুমি পশু হয়ে গেছ অভি। আমি যে অভিমন্যুকে চিনতাম সেই অভি তুমি নও, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও, অভি। দূর হয়ে যাও, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

থাপ্পড় খেয়ে অভির গাল লাল হয়ে যায়, ওর পশু সুলভ ঘোর কেটে যায়। চোখ বন্ধ করে পায়ের কাছে মাথা নিচু করে পড়ে যায়। কোনোরকমে গায়ের কাপড় বুকের কাছে গুটিয়ে নিয় কেঁদে ফেলে পরী। অভি আর ভাবতে পারেনা, কি হয়েছিল ওর, কেন ওর মধ্যে হটাত করে এক বুভুক্ষু হায়না জন্ম নিয়েছিল? উত্তর নেই অভির কাছে।

দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদে পরী, “কেন কেন, তুমি আমার সাথে এই রকম ব্যাবহার করলে? কেন?”

পরিতাপের জল অভির চোখে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। পরীর পায়ের ওপরে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে অভি, ফর্সা পা ভিজে যায় অভির চোখের জলে। অনেকক্ষণ ধরে দুজনে কাঁদে, পরীর কাছে ভর্ৎসনা জানাবার ভাষা নেই আর অভির কাছে ক্ষমা চাইবার ভাষা নেই। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অনেক পরে পরী কোন রকম নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, নিজের ঘরে ঢুকে যায় আর দরজা বন্ধ করে দেয়। পরিতপ্ত অভি দেয়ালে মাথা ঠোকে বারবার। বারংবার নিজেকে প্রশ্ন করে, “কেন অভিমন্যু কেন, তুমি তোমার প্রেমিকার সাথে এই জানোয়ারের মতন ব্যাবহার করলে।” উত্তর নেই অভির কাছে।

ভাগ্যবশত অভির কাছে আরও একটা চশমা ছিল। বাবা মা ফিরে আসার পরে, সারা বিকেল ওরা একে অপরের দিকে তাকাতে পারেনি। দুজনেই অবিশ্বাস্যভাবে চুপ করে যায়। কান্নার জন্য পরীর চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। মা পরীকে কারন জিজ্ঞেস করাতে, পরী জানায় যে বিকেলে একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই চোখ মুখ লাল।

কোনরকম রাতের খাবার খেয়ে শুতে চলে যায় অভি। সারা রাত ঘুমাতে পারেনা অভি, ওর কানে পরীর কান্না বার বার ধাক্কা দেয়, “তুমি একটা জানোয়ার, তুমি পশু হয়ে গেছ অভি। আমি যে অভিমন্যুকে চিনতাম সেই অভিমন্যু তুমি নও।”

সকালে অভির দেরি করেই ঘুম ভাঙে। নিচে নেমে দেখে যে বাবা মা কাজে বেরিয়ে গেছেন, ঘরের মধ্যে কোথাও কোন আওয়াজ নেই, সারা বাড়ি যেন অস্বাভাবিক ভাবে নিস্তব্ধতার আঁচলে মোড়া। চুপ করে বসার ঘরে গিয়ে বসে, দেয়ালগুলো যেন ওর দিকে রেগে মেগে তাকিয়ে আছে, মাথার ওপরের ছাদ যেন ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। দরজা জানালা যেন ওকে বারংবার ধিক্কার জানাচ্ছে যে ও একটা নোংরা বীভৎস বুভুক্ষু জানোয়ার। টি.ভি চালায় অভি, কিন্তু সেই টি.ভির আওয়াজ ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।

কিছু পরে পর্দার আড়ালে পরীর পায়ের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে। বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে পরী চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। লজ্জায় আর পরিতাপে অভি মাথা তুলে তাকাতে পারেনা। মুখ নিচু করে পাথরের মতন সোফায় বসে থাকে চুপ করে। কিছু পরে মাথা উঠিয়ে পরীর দিকে তাকায়। পরী ওর দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। সামনে এসে টেবিলের ওপরে সায়ের কাপ রেখে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কাল কি হয়েছিল তোমার?”

ওর গলার আওয়াজ শুনে আর থাকতে পারেনা অভি। পরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে পেটের ওপরে মুখ লুকিয়ে নেয়। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, “আমি জানিনা পরী, আমি সত্যি জানি না আমার কি হয়েছিল।”

পরী ওর মাথা নিজের দিকে তুলে ধরে আবার জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছিল তোমার?” চিকচিক করছে পরীর চোখ, ঠোঁটে লেগে মৃদু হাসি। অভির হৃদয় যেন কেউ মুঠির মধ্যে করে নিয়ে মুচড়ে দেয় আর বিবেক ওকে ধিক্কার জানায়। আবার জিজ্ঞেস করে পরী, “আমার অভি তো ওইরকম ছিল না। তুমি কেন আমার সাথে হায়নার মতন ব্যাবহার করলে সত্যি বলোতো?”

কেঁদে ফেলে অভি, “আমি সত্যি বলছি পরী, আমি জানিনা কেন আমি কাল তোমার সাথে ওইরকম ব্যাবহার করেছিলাম। এই শেষবারের মতন আমাকে ক্ষমা করে দাও পরী।”

পরী সোফায় বসে অভির মুখ দুহাতে আঁজলা করে ধরে ওর চোখের দিকে তাকায়। আঙুল দিয়ে গালের জলের দাগ মুছিয়ে বলে, “তুমি একটা ভীষণ শয়তান ছেলে।” নাকে নাক ঘষে বলে, “তুমি একটা জানোয়ার, একটা পশু তুমি।” চোখের থেকে চশমা খুলে টেবিলের ওপরে রেখে দেয়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অভির ঠোঁটের কাছে এনে ধরে, ওকে চা খেতে বলে। অভি ওর কোমর প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে ওকে মিনতি করে বলে, “আমার এই ব্যাবহারের জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেনা তো?”

হেসে ফেলে পরী, “কি করে যাই বলো তোমাকে ছেড়ে? তুমি শয়তান, তুমি পশু হতে পারো, কিন্তু তুমি যে গাধা একটা। আমাকে ছাড়া তুমি জীবনে এক পাও চলতে পারবে না। আমি কি করে আমার সেই ছোট্ট রাজকুমারকে ছেড়ে চলে যাই বলো তো? আমি তো তাকে ছেড়ে যেতে পারিনা। ওই কথা কখনো মুখে আনবে না যে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। এবারে চা খেয়ে নাও।” অভির ঠোঁটের কাছে চায়ের কাপ ধরে চা খাইয়ে দেয়। চা খাওয়ানোর পরে বাইরে তাকিয়ে দেখে যে ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে অভিকে বলে, “বাইরে দেখ, মেঘের দেবতারা আকাশ থেকে আমাদের আশীর্বাদ করছেন। চলো না ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে মজা করি।”

পরী অভির হাত ধরে ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। ওর মুখের হাসি ফিরে এসেছে দেখে অভির মরা গাঙে জোয়ার এলো যেন। ছাদে উঠেই ওর হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির মাঝে। চোখ বন্ধ করে মাথা উঁচু করে, হাত দুটি দুপাশে ছড়িয়ে যেন বৃষ্টিকে আহবান জানায় ওকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য। অভি হাসে আর পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পরনের কাপড় ভিজে গিয়ে কোমরের নিচ থেকে পুরো অঙ্গে লেপটে গেছে। পরী যেন শিশির ভেজা জুঁই। লম্বা ঘন কালো চুল বেয়ে টপ টপ করে জল বেয়ে চিবুকের নিচে গিয়ে অল্প জমে ওঠে তারপরে টপ টপ করে নিচে পড়তে থাকে। সামনে দাঁড়িয়ে যেন স্বর্গের অপ্সরা মেনকা, এই যেন সাগর জলে স্নান সেরে ওর চোখের সামনে উঠে এসেছে।

চোখে মুখের জল মুছে অভির দিকে তাকিয়ে জোরে ডাক দেয়, “কি হলো, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এখানে এসো।”

মৃদু হেসে অভি উত্তর দেয়, “ভুলে গেছো? কয়েক দিন আগেই কিন্তু তুমি জ্বর থেকে উঠেছো।”

খিলখিল করে হেসে ফেলে পরী, “না না ভুলিনি, আবার পড়লে তুমি আছো তো আমাকে দেখার জন্য।”

মাথা নাড়ায় অভি, “তুমি শুধরাবে না তাই না।”

অভি বৃষ্টির মধ্যে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরী ওর চোখে দেখে বুঝতে পারে যে অভি কি করতে চলেছে, দু পা পেছনে সরে যায়। অভি আবার দু’পা ওর দিকে এগিয়ে যায় আর পরী আবার দু’পা পিছিয়ে যায়, এ যেন এক বিড়াল আর ইঁদুরের খেলা। অভির চোখে দুষ্টুমির হাসি, একবার হাতে পেলে হয় পরী।

পরী ওর চোখের হাসি দেখে এক দৌড়ে অভির ঘরে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। অভি মাথা দোলায়, “দুষ্টু মেয়ে, কত লুকোচুরি খেলবে আমার সাথে।” বন্ধ দরজার অন্য পাশ থেকে পরী জোরে বলে ওঠে, “এসো না, দেখি কেমন ধরতে পারো।”

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে অভি, পরী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে থাকে। চোখে মুখে সেই পুরানো হাসি।

অভি ওর হাসি দেখে জিজ্ঞেস করে, “শয়তান মেয়ে, আমার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তারপরে আবার দুরে ঠেলে দেওয়া হয় কেন?”

পরী ওকে উলটো প্রশ্ন করে, “সবসময়ে কি তোমার শয়তানি করার ইচ্ছে জাগে? কখনো কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে না, একবার অন্তত্ত আদর করে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে। তুমি জড়িয়ে ধরলে মনে যেন এক অনাবিল শান্তির ছায়া নেমে আসে, আমি নিরুদ্বেগে তোমার কোলে মাথা রেখে যেন ঘুমিয়ে পড়তে পারি।” পরীর কথা শুনে অভির মন ভারী হয়ে যায়, পরিতাপ ঢেকে দেয় ওর হৃদয়কে। অভি ওর দিকে দু’পা এগিয়ে যায়, পরী বলে ওঠে, “আমি কিন্তু একদম ভিজে গেছি, একদম কাছে আসবে না।”

অভি হাত ভাঁজ করে মাথার ওপরে বাড়ি মারে, পরীর দিকে এগোতে আর সাহস করেনা। ভারাক্রান্ত মনে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে তুমি আমাকে ক্ষমা করোনি, তাই তো?”

বিছানার ওপরে ভিজে তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে অভির সামনে এগিয়ে আসে। অভির কলার ধরে উঁচু হয়ে নাকে নাক ঠেকায়। অভির নিস্পলক কাতর চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি তো ক্ষমার যোগ্য নও। তবে একটা শর্তে ক্ষমা করতে রাজি আছি, যদি তুমি আমার ছবি আঁকো।”
 
Chapter 10: ময়ুর সিংহাসন। (#1)

পর দিন, পরী অভির জন্য রঙ তুলি সব কিনে আনে। অভি জিজ্ঞেস করে, কি রকম ভাবে নিজের ছবি আঁকাতে চায় পরী। অভি জানতো যে পরীর ছবি আঁকতে হলে বাবা মায়ের চোখের আড়াল করেই আঁকতে হবে না হলে তাঁরা একবার জেনে ফেললে সর্বনাশ হতে দেরি হবে না।

পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে, “পেন্টার কে, তুমি না আমি? আমি কি করে জানব?”

অভি মজা করে বলে, “ঠিক আছে না একটা নুড পোট্রেট আঁকা যাবে।”

আদর করে মারতে শুরু করে দেয় অভিকে, “তুমি একটা শয়তান, কুত্তা। আমি আর কোন দিন তোমাকে ক্ষমা করবো না। আমি চাই না আমার ছবি কোন নোংরা লোক আঁকুক।”

অভি ওকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে, চোখে চোখ রেখে বলে, “সোনা পরী, আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম।” পরীর পেছনে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ওকে কোলে তুলে নেয়।

পরী জোরে বলে, “আঃ ছাড়ো ছাড়ো, আমার ছবি আঁকবে কি না?”

অভি ওকে ছেড়ে দেয়। পরী ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি পরে আসবো, কি থিম নিয়ে ছবি আঁকবে?”

অভিঃ “তুমি তোমার ওই গাড় নীল রঙের শাড়িটা পরে এসো, ঠিক যেন ময়ুরের মতন দেখায়। কানে মুক্তোর দুল পড়বে। পেছনের ছবি আমি চিতকুলের পাহাড় আঁকবো, আর সামনে তুমি। তাড়াতাড়ি যাও, আমি ততক্ষণে আঁকার জিনিস পত্র ঠিক করি।”

অভি কাগজ, পেন্সিল, চারকোল ইত্যাদি বের করে তৈরি পরীর ছবি আঁকার জন্য। ইসেল ব্যাবহার করতে পারবেনা কেননা মাঝে মাঝে মা আসেন ওর ঘরে, আর যদি ইসেলে পরীর ছবি দেখে তাহলে কথা নেই...

এক ঘণ্টা পরে পরী একদম ময়ুরের মতন সেজে ওর ঘরে ঢোকে। জানালার পাশের চেয়ারে বসতে বলে ওকে। এক পা অন্য পায়ের ওপরে দিয়ে, বাঁ হাত মুড়ে তাঁর ওপরে থুতনি রাখতে বলে, আর অন্য হাত যেন ওর জানুর ওপরে আলতো করে পড়ে থাকে। পরীকে চেয়ারে বসিয়ে আঁকার জায়গায় দাঁড়িয়ে এক ভাবে দেখতে থাকে। হাতের পেন্সিল হাতে থেকে যায়, কাগজে দাগ কাটতে ভুলে যায় অভি।

পরীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে একবারের জন্য মন একবারের জন্য বিচলিত হয়ে ওঠে কিন্তু নিজেকে সামলে নেই অভি, এই সৌন্দর্য দেখার, শুধু নয়নে উপভোগ করার। পরনে ময়ুরের গলার নীল রঙের শাড়ি, ছোটো হাতা কাঁচুলি। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা। বাঁকা ধনুকের মতন ভুরু জোড়া, চোখের কনে অল্প কাজল। ঠোঁট জোড়ায় হাল্কা গোলাপি রঙ করেছে। দু’কানে সোনার দুল মুক্তো বসানো, গলায় মায়ের দেওয়া সোনার হার আর লকেটটা বুকের খাঁজে ঝুলছে। কবজিতে কয়েক গাছি সোনার চুড়ি। তাও অভির কেন জানেনা মনে হলো কিছু যেন নেই পরীর ওই চেহারায়।

হাঁটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে পরীর সামনে দাঁড়ায় অভি হাতে নীল রঙ মাখানো তুলি। পরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “রঙ নিয়ে কি করছো?”

আদর করে নাকে নাক ঘষে উত্তর দেয়, “এই সুন্দর মুখে কিছু যেন নেই, কিছু যেন বাদ পড়ে গেছে।”

পরীঃ “কি?”

শূন্য ব্রাস দিয়ে ভুরুর মাঝে একটা টিপ এঁকে বলে, “হ্যাঁ একদম ঠিক আছে।”

পরীঃ “এখন শান্তি?”

ওর গালে চুমু খেয়ে বলে, “না, এখনো যেন কিছু নেই নেই বলে মনে হচ্ছে।” অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে পরীর চোখের দিকে, মাথা চুলকায় অভি, চিন্তা করে পায়না, কি নেই।

পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে, “আর কি করতে বলো আমাকে?”

অভি ওর তর্জনী দিয়ে পরীর গালে আদর করে বলে, “তোমার ঠোঁটগুলো যেন একটু বেশি গোলাপি মনে হচ্ছে, যদি আমি একবার চেটে নেই তাহলে রংটা ঠিক হয়ে যাবে।”

আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “ধুর, তুমি না যখন তখন শুরু হয়ে যাও। আঁকতে বসবে না আমি চলে যাবো? তুমি যে রকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো না, বেশিক্ষণ ওই রকম ভাবে তাকালে কিন্তু আমার কিছু একটা হয়ে যাবে। প্লিস ওই রকম ভাবে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি আঁকা শুরু করো।”

অভি ওর মাথার পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে খোঁপা খুলে দেয়। পরী কঁকিয়ে ওঠে, “এই সোনা, কি করছো?” অভির শ্বাস গতি নেয়, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ধিরে ধিরে। আধা বোজা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে পরী।

অভিঃ “তোমাকে একটু বেশি লাস্যময়ী করে তুলছি বেবি।”

পরীর বুক ওঠা নামা করতে শুরু করে, গাল লাল হয়ে ওঠে অভির আঙুলের ছোঁয়ায়। মৃদুকন্ঠে বলে, “প্লিস অভি, কোরো না। আমার বুকের মাঝে কিছু হচ্ছে।”

অভিঃ “কি হচ্ছে বুকের মাঝে, একটি বারের জন্য বলো, আমি তোমার ওই সব স্বপ্ন আমি পূরণ করে দেব।”

পরীঃ “আমি কিন্তু এবারে রেগে যাবো অভি। ”

অভি ওর চুল খুলে ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনের দিকে এলিয়ে দেয়। চুলের এক গুচ্ছ তর্জনীতে নিয়ে গালের ওপরে এলিয়ে দেবার পরে পরীর চেহারা দেখে পরিতৃপ্ত হয়। মনে হয় যেন এক ময়ুর ওর সামনে এক সিংহাসনে বসে আছে। অভি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের লোভ সংবরণ করে নেয়, পরীর চোখ, পরীর ঠোঁট যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। শুরু করে আঁকা, সাদা কাগজে ফুটে ওঠে পরীর রুপ রেখা।

পরী ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, বসে বসে পা ধরে গেছে। ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই শয়তান, তুমি আঁকছোতো, না শুধু শুধু আমাকে বসিয়ে রেখে আমাকে গিলে খাচ্ছো?” স্কেচ শেষ করার পর একবার পরীর দিকে তাকায় একবার সামনে কাগজের দিকে। পরী ওর দিকে জোর গলায় বলে ওঠে, “কি হলো, আঁকা কি শেষ? বসে বসে কিন্তু আমার পা ব্যাথা করছে।” অভি ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। পরী সাদা কাগজে নিজের রুপ রেখা দেখে অবাক হয়ে যায়। অভির গলা জড়িয়ে ধরে দুহাতে। পরীর পাতলা কোমর জড়িয়ে ধরে অভি, মাটি থেকে ওপরে তুলে নেয় কমনীয় দেহ। পরী মৃদুকন্ঠে বলে ওঠে, “আমি সত্যি এত সুন্দরী, না তুমি আমাকে এই রকম এঁকেছো?”

পরীর গায়ের গন্ধ বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার জলপরীতো এর চেয়েও সুন্দরী।”

পরী নিজের শরীর আবেগের বশে অভির বুকের ওপরে চেপে ধরে। কোমল সুগোল উন্নত বক্ষ যুগল পিষে দেয় অভির প্রশস্ত বুকের ওপরে। অভির কঠিন বাহু পাশে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। অভি ঝুঁকে পড়ে পরীর গোলাপি ঠোঁটের ওপরে, চেপে ধরে নিজের ঠোঁট ওই কোমল গোলাপ পাপড়ির ওপরে। চুষে নেয় পরীর ঠোঁটের মধু। পরী আবেগে দুচোখ বন্ধ করে নেয়, হাত নিয়ে আসে অভির মাথার ওপরে আর টেনে ধরে মাথা যাতে ওদের চুম্বন আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। বুকে মাঝে উত্তাল প্রেমের ঢেউ বারে বারে এসে ধাক্কা মারে, দুজনের শ্বাস গতি নেয়।

পরী মৃদুকন্ঠে বলে, “সোনা, যখনি তুমি আমার দিকে তাকাও, আমার বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ খেলে বেড়ায় যেন। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা অভি, আমি তোমাকে চাই। আমি জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে, কি করে তুমি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবে। খুব ভয় করে অভি। যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি কিন্তু মারা যাবো, আমি নিজেকে মেরে ফেলবো অভি।”

অভি ঝুঁকে পড়ে পরীর বক্ষ বিভাজনের ওপরে চিবুক দিয়ে আদর করে বলে, “সোনা, কখনো এই রকম কথা বলবে না। আমি তোমাকে এই জায়গা থেকে অনেক অনেক দুরে নিয়ে চলে যাবো। তোমার সেই চোর, তাঁর প্রেয়সী পরীকে নিয়ে দূর উঁচু পাহাড়ে পালিয়ে যাবে, যেখানে কেউ ওদের খুঁজে পাবেনা।”

ওর কথা শুনে পরীর চোখে জল এসে যায়। অভি জিব দিয়ে চেটে নেয় পরীর গালের ওপরে গড়ানো অশ্রু। পরী ওর দিকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, “সোনা, আমার খিদে পেয়েছে।”

অভিঃ “আমাকেই খেয়ে নাও না কেন?”

পরীঃ “ছোট্ট রাজকুমার, তুমি তো আমার খাবার পরের পায়েস।”

পরীকে মাটিতে নামিয়ে দেয় অভি, পরী তাও ওকে ছাড়ে না, জড়িয়ে ধরে ওর বুকের ওপর মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। পরী কিছু পরে নিজেকে অভির বাহু পাশ থেকে মুক্ত করে বলে, “সোনা আমি কিন্তু এখন তোমাকে ক্ষমা করিনি। পেন্টিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু তুমি আমার ক্ষমা পাবে না।” খিলখিল করে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

অভি দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলে, “দুষ্টু মেয়ে, আমাকে ক্ষমা না করলে কিন্তু আমি তোমাকে মেরে ফেলব।”

পরী হেসে উত্তর দেয়, “আমি সেইদিনের অপেক্ষায় থাকব।”

রাতের খাওয়ার পরে নিজের ঘরে গিয়ে অভি পরীর ছবি খুলে বসে। ড্রয়িং বোর্ডে কাগজ এঁটে টেবিল ল্যাম্পের তলায় আবার আঁকা শুরু করে। কিন্তু সামনে পরীর ছবি দেখে হাত থেমে যায়, কাগজের ওপরে পেন্সিলের দাগ, পরীর চোখ যেন ওকে দেখে হাসে। অভি রঙ মিশাতে ভুলে একমনে ছবিটা দেখে, মিষ্টি পাতলা ঠোঁট, কাজল কালো আঁখি যেন জীবন্ত মনে হয়। ঝুঁকে পড়ে পরীর ছবির ওই সাদা কালো ঠোঁটে চুমু খায়। ঠিক সেই সময়ে দুটি কোমল হাত পেছন থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরে।

পরীঃ “কাগজে চুমু খাচ্ছো কেন, জলজ্যান্ত পরী তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে।”

পরীর হাত অভির বুকের ওপরে, পেশির ওপরে আদর করে নখের আঁচড় কেটে দেয়। অভি ওর হাত দুটি বুকের ওপরে চেপে ধরে। পরী ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে এসে, কানের লতিতে আলতো করে দাঁত দিয়ে কেটে দেয়। সিক্ত জিবের ডগা আর মুক্তোর মতন দাঁতের পরশে অভির সারা শরীর কেঁপে ওঠে। চোখ বন্ধ করে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয় অভি। ঘাড়ের পেছনে পরীর কোমল বক্ষ পিষে যায়, উষ্ণ নরম পরশে অভির গা গরম হয়ে ওঠে। পরী ওর কানের লতি চুষে নেয় বারবার।

কানে কানে বলে, “এবারে বুঝতে পারছো, তুমি যখন আমাকে এই সব করো তখন আমার কি হয়।”

অভিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে পরী, ঘাড়ের ওপরে জিবের ডগা আলতো করে বুলিয়ে দেয়। অভি শক্ত করে ধরে থাকে পরীর হাত, ফর্সা ত্বকে অভির আঙুলের ছাপ পরে লাল হয়ে ওঠে কোমল কবজি।

পরীর আদরে অভি আর থাকতে না পেরে চাপা গোঙানি করে ওঠে, “পরী ইইইইইইই...”
 
Chapter 10: ময়ুর সিংহাসন। (#2)

চেয়ার ঘুরিয়ে পরীর দিকে ফিরে বসে অভি, জোর করে কোলের ওপরে টেনে বসায় প্রেয়সীকে। ধুপ করে বসে পরে কোলের ওপরে আর তারপরে নিজেকে ঠিক করে ভালো করে বসে পড়ে। সুগোল নিতম্ব অভির জানুর ওপরে যেন দুই মাখনের তালের মতন লেপে যায় আর তার নিচে থাকা অভির তপ্ত সিংহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। পরীর পরনে হাতকাটা লম্বা রাত্রিবাস, তার নিচে কোন অন্তর্বাস নেই সেটা বুঝতে অভির অসুবিধে হয়না। অভির প্রশস্ত বুকের ওপরে পরীর কোমল বক্ষ যুগল পিষে যায়। দুই বক্ষ যেন একে ওপরের সাথে মারামারি করে জামার ভেতরে, ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে আছে দুই কোমল বক্ষ। নিচে অন্তর্বাস না থাকার ফলে, পাতলা কাপড় ভেদ করে বক্ষের মাঝের কঠিন হয়ে ওঠে দুই বৃন্ত ফুটে ওঠে পরিষ্কার। অভির দিকে উঁচু হয়ে উঠে যেন ওই দুই বৃন্ত হাতছানি দিয়ে ডাকে।

পরী অভির গলা জড়িয়ে ধরে কানের লতিতে আঙুল দিয়ে আলতো করে আদর করে দেয়। কোমল তর্জনীর স্পর্শে অভির সারা শরীর কেঁপে ওঠে। অভি বাম হাতে পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে, ওর ফুলে ওঠা বুকের ওপরে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। উষ্ণ নরম ত্বকে ভিজে ঠোঁটের পরশে পরী চোখ বন্ধ করে নেয়। অভি ওর নরম মাংসে আলতো করে কামড় দিতে শুরু করে। দুই প্রেমঘন কপোত কপোতীর বুকে কামনার ঢেউ এসে দোলা দেয়। পরী কেঁপে ওঠে অভির দাঁতের কামড়ে, দাঁতে দাঁত পিষে মাথা পিছনে হেলিয়ে দেয় আর অভির প্রশস্ত বুকের পেশি খামচে ধরে। অভির ঠোঁট, ওর কাপড় ঠেলে নিচে করে বুকের বৃন্তের কাছে নিয়ে জিব দিয়ে চেটে দেয়। ঠিক ঠোঁটের নিচে পরীর কঠিন বৃন্ত খোঁচা দেয়। ডান হাত দিয়ে অভি পরীর পেটের ওপরে নিয়ে পেটের কোমলতা নিয়ে খেলা করতে শুরু করে দেয়। বারে বারে মুঠি করে নিয়ে চেপে ধরে কোমল পেট আর পিষে দেয় নরম মাংস। পরী দুই জানু একে অপরের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে, সারা শরীরে আলোড়ন শুরু হয়ে যায় পরীর আর তাঁর সাথে অভির সিংহ মাথা উঁচু করে জানান দেয় পরীর কোমল নিতম্বের নিচে। অভির জিব বৃন্তের চারপাশে আলতো করে ভিজিয়ে দেয়, পরীর শরীর শক্ত হয়ে ওঠে।

পরী কঁকিয়ে ওঠে, “সোনা আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, সোনা আমাকে বুকে টেনে নাও। আমি তোমার আলিঙ্গনে সর্বদা আদর খেতে চাই।”

ভাঁজ করা দুই পায়ের নিচে হাত গলিয়ে দিয়ে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় পরীকে, চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় শুইয়ে দেয় প্রেয়সীর উষ্ণ দেহ। উন্মত্ত আদরের ফলে পরীর ডান বক্ষ রাত্রিবাস থেকে বেরিয়ে পরে আর বাম বক্ষের বৃন্তের কাছে আটকে থাকে রাত্রিবাস, যেন একটা আলতো টানে উন্মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় ওর দিকে চেয়ে আছে। পরী ওর দিকে কামঘন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।

মৃদুকন্ঠে চিকচিক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ওই রকম করে কি দেখছো তুমি?”

অভি চাপা গলায় বলে, “আমার জলপরীকে দেখছি, তপ্ত জলপরী উষ্ণ সাগর জল ছেড়ে আমার বিছানার ওপরে বসে আমার প্রেমে ডুব দেবার জন্য।”

অভি বিছানায় উঠে ওর পাশে শুয়ে পড়ে ওর মাথার পেছনে হাত নিয়ে যায়। মাথা টেনে ধরে নিজের মুখের ওপরে আর ওর ওপরের ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে নেয়। পরীর দু চোখ অভির মুখের ওপরে নিবদ্ধ। দুহাতে ওর মাথা নিয়ে চুলে, গালে নরম আঙুল বুলিয়ে দেয়। উষ্ণ নগ্ন বক্ষ অভির তপ্ত বুকের পেশির ওপরে চেপে ধরে, কঠিন হয়ে থাকা বৃন্ত যেন খোঁচা মারে বুকের পেশির ওপরে। অভি ওর মাথার পেছনে নখের আঁচড় কাটে। ওর সারা মুখের ওপরে পরীর উষ্ণ শ্বাস ঢেউ খেলে বেড়ায়। দুজনে যেন ঠোঁট দিয়ে মারামারি শুরু করে, কে ভাল চুম্বন দিতে পারে তার প্রেমের মানুষকে সেই প্রতিযোগিতায় যেন দুজনে একে অপরকে হারানোর প্রানপন চেষ্টা চালায়। অভির হাত নেমে আসে পরীর কোমল গোল পেটের ওপরে নাভির চারপাশের ফুলে ওঠা পেটের ওপরে চাপ দিতে থাকে।

দুই জানু একে অপরের সাথে পিষে রাখে পরী। অভির হাতের আদরের ফলে, জানুর মাঝের সিক্ত হয়ে আসে নারী সুধায়। সারা শরীরে যেন তরল লাভা বয়ে চলেছে। হাঁটু ভাঁজ করে অভির শরীরের ওপরে উঠিয়ে আনে আর তার ফলে রাত্রিবাস নিচের দিক থেকে উঠে এসে কোমরের কাছে চলে আসে। অভির হাতের সামনে পরীর উন্মুক্ত পেলব জানু। চোখের সামনে উন্মুক্ত পরীর নারীসুধার দ্বার।

অভি এই প্রথম পরীর মিলনের উন্মুখ চাহিদা টের পায়, পরী হাত নিয়ে আসে অভির কোমরের কাছে, বোতাম খুলে অভির সিংহকে মুক্ত করার জন্য উন্মুখ পরী। পরীর নরম আঙুলের ছোঁয়ায় অভির সিংহ শত গুন বেড়ে ওঠে, কেশর ফুলিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। আলতো করে কাঁধ নাড়িয়ে কাঁধের থেকে রাত্রিবাস নামিয়ে দেয় পরী, সারা ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। রাত্রিবাস কোমরের কাছে সরু এক বেষ্টনীর মতন জড়িয়ে। অভি বিছানায় শুয়ে পড়ে, পরীকে ওর ওপরে টেনে নেয়। পায়ের ফাঁকে কঠিন শলাকার পরশ পেয়ে পরী দুচোখ বন্ধ করে নেয়। অভি ওর কোমল নিতম্ব দুই হাতের মুঠিতে নিয়ে পিষে ফেলে আর ওর কোমর চেপে ধরে নিজের কোমরের ওপরে। অভির কঠিন শলাকা প্রেয়সীর সুখের দ্বারে বারে বারে ধাক্কা মারে। পরী অল্প ঠোঁট খুলে মৃদু শীৎকার করে ওঠে। অভি দুই হাতের থাবায় পরীর কোমল নিতম্ব চেপে পিষে একাকার করে দেয়। ফর্সা ত্বক লাল হয়ে ওঠে অভির কঠিন পেষণের ফলে।

ওকে জড়িয়ে ধরেই অভি ঘুরে শুয়ে যায়, পরীকে নিচে ফেলে দেয়। পরী দুই পা ফাঁক করে, জানু ভাঁজ করে অভিকে আহবান জানায় ওকে গ্রহন করার জন্য। অভির কোমর থেকে প্যান্ট নিচে ঠেলে নামিয়ে দেয়, বেরিয়ে পড়ে অভির কঠিন অঙ্গ, সোজা গিয়ে স্পর্শ করে পরীর সিক্ত নারী দ্বার। কঁকিয়ে ওঠে তপ্ত কঠিন পরশে। অভি ওর বাহুর নিচ থেকে হাত নিয়ে গিয়ে মাথার পেছনে ধরে নিজেকে পরীর জানু মাঝে নিবিষ্ট করে। ধিরে ধিরে অভির সিংহ পরীর সিক্ত কোমল গুহার মধ্যে প্রবেশ করে। সিক্ত গুহার দেয়ালে তপ্ত শলাকার পরশে পরীর কমনীয় দেহে ধনুকের মতন বেঁকে ওঠে। ঠেলে ধরে জানুসন্ধি অভির কঠিন অঙ্গের ওপরে। সুখের শীৎকার করে ওঠে পরী। অভি যেন উন্মত্ত এক প্রেমিক, মত্ত খেলায় মেতেছে প্রেমিকার কোমল শরীর নিয়। বারে বারে আছড়ে পিছড়ে একাকার করে দেয় পরীর কোমল শরীর।

মত্ত খেলার চুড়ান্ত সময়ে পরী ওর পিঠের ওপরে উত্তেজনায় দশ নখ বসিয়ে দেয়, আঁচড় কেটে রক্ত বার হয়ে যায়। অভির লাভা সিক্ত করে দেয় পরীর গহ্বর। অভি ওর ঘাড় কামড়ে ধরে, দাঁতের দাগ বসে যায় পরীর নরম ফর্সা ত্বকের ওপরে। উন্মত্ত প্রায় প্রেমের খেলার ফলে দুই কপোত কপোতীর সারা শরীরে সহস্র আঁচড় কামড়ের দাগ পড়ে যায়। খেলা শেষে দুজনে হাঁপিয়ে ওঠে, অভি চুপ করে পরীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। পরী ওর বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে চিবুক রেখে ওর আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একে অপরের নগ্ন দেহের উত্তাপ নেয়।

পরী ওর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে, “আমার মিষ্টি শয়তান আজ যেন একটু বেশি উত্তেজিত ছিল। সবসময়ে যেন একটু বেশি বেশি রকমের উত্তেজিত থাকে। এবারে আমার ছোটো রাজকুমার তার পরীকে নিয়ে থাকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে।”

অভিঃ “আগে কি তোমার মনে কোন সংশয় ছিল নাকি?”

মাথা দোলায় পরী, “না না, আমার সোনা কখনো উদ্দাম হয়ে ওঠে আবার কখন শান্তি মনে প্রেম করে।”

অভির সারা শরীর উদ্দাম খেলার বশে অবশ হয়ে আসে, চোখ বুজিয়ে দুই হাতে চেপে ধরে পরীর কোমর।

পরী ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলে, “সোনা এবারে আমাকে যেতে হবে, আমার ঘুম পাচ্ছে।” বুকের ওপরে চুমু খেয়ে উঠে পড়ে পরী, “বাকিটুকু কাল রাতে হবে অভি। কাল যখন তুমি কাগজে রঙ করতে শুরু করবে, তারপরে।”

চোখ বন্ধ করে নেয় অভি, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।

End of Part 4
 
Part Omega: বুকভাঙা অশ্রু। (#1)

জীবন বড় বেদনাদায়ক, ঠিক যেন দাবার ৬৪ ছকে বাঁধা, একটা ছোটো ভুল কত বড় রুপ নিয়ে দাঁড়ায় সেটা কি আর কেউ জানতো? অভির আর পরীর জীবনে এই রকম একটা ছোটো ভুল পদক্ষেপ ওদের জীবন তছনছ করে দেয়।

সকাল বেলা, প্রায় দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ, অভি বসার ঘরে বসে চায়ের কাপে আরাম করে চুমুক দিচ্ছিল। পরী রান্না ঘরের কাজে ব্যাস্ত ছিল। আকাশ সকাল থেকে মেঘলা, কোলকাতার বৃষ্টির ঠিক ঠিকানা নেই কখন কি ভাবে এসে পড়ে। মা সেইদিন আর স্কুলে যাননি, তাঁর আগের দিন মায়ের শরীর একটু খারাপ ছিল। এমন সময়ে ওপরে নিজের ঘর থেকে মায়ের গলা শুনতে পেল অভি, মনে হয় অভির ঘরে বিছানার চাদর বদল করছিলেন।

মা নিচে নেমে অভির দিকে রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে পরীকে ডাক দিলেন, “পরী এদিকে আয়।” মায়ের হাতে বালিশের কভার।

পরী ওর ছোটমায়ের গলা এত গম্ভির হতে পারে, ভাবতে পারেনি। হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে ছোটমা?”
মা ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই সকাল থেকে তোর মুক্তোর কানের দুল খুঁজছিলিস, পেয়েছিস সেটা?”

পরী অভির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, অভি জানেনা যে পরী ওর কানের দুল হারিয়েছে। মাকে উত্তর দেয়, “না ছোটমা, এখনো খুঁজে পাইনি।”

মা বালিশের কভার থেকে কানের দুল বের করে পরীর সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি তোর কানের দুল?”

মায়ের হাতে পরীর মুক্তোর কানের দুল দেখে, অভির গলা শুকিয়ে যায়, বুকের মাঝে এক ভয় ঢুকে খা খা করে দেয়, সারা শরীরের রক্ত যেন মুখের ওপরে এসে জমা হয়ে যায়। ওর মাথায় যেন কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে। পরীর কান মুখ লাল, ভয়ে মৃদু কাঁপছে পরী। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের দিকে তাকিয়ে।

মা অভির দিকে তাকিয়ে হিম শিতল কণ্ঠে বলেন, “পরীর কানের দুল, তোর বালিশের কভারে, কেন? এর কি ব্যাখা আছে শুনি?”

বড় নিঃশ্বাস নেয় অভি, “পরী হয়তো আমার ঘরে কোন কাজ করতে গেছিল সেই সময়ে ওর কানের দুল হয়তো পড়ে গেছে। আমি কি করে জানবো কখন পড়েছে।”

মা দাঁতে দাঁত পিষে অভির দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাল রাতে খাওয়ার সময়ে ওর কানে আমি দুল দেখেছিলাম আর আজ সকালে সেই দুলের একটা তোর বিছানায়।” মা পরীর দিকে দু পা এগিয়ে, ঘাড়ের কাছ থেকে চুল সরিয়ে দেখে যে ঘাড়ে অভির দাঁতের লাল দাগ। মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, “তোর ঘাড়ে এই লাল দাগ কিসের?” পরী দুচোখ বন্ধ করে নেয়, দাঁতে দাঁত পিষে বুকের মাঝের ভয়টাকে সংবরণ করতে প্রবল চেষ্টা করে। ভয়ে গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় পরীর। মা পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় গর্জে ওঠেন, “তাহলে ব্যাপার এত সঙ্গিন যে, তোর কাঁধে দাঁতের দাগ। হ্যাঁ?”

অভি মাথা নিচু করে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে জল, কান গরম হয়ে গেছে অভির, গলা শুকিয়ে এসেছে। মা সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দেন অভির গালে আর রাগে চিৎকার করে ওঠেন, “আমার নাকের নিচে থেকে এই কান্ড?” রাগে কাঁপতে কাঁপতে মা সোফায় বসে পড়েন। মাথায় হাত দিয়ে বলেন অভিকে বলেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে তুই ওর সাথে এই রকম করবি।” পরী মায়ের কাছে এসে কিছু বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু মায়ের লাল চোখ দেখে সাহসে কুলায় না পরীর, চুপ করে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের পাসে।

মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এটা কি পরী, তুই ওর চেয়ে বড়, আর তুই... সম্পর্কে তুই ওর মাসি।”

পরী মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে, মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ভাবে। অভি পরীর হাঁটু গেড়ে থাকা দৃশ্য সহ্য করতে পারেনা, বুক ফেটে যায় ওর।

মা অভির দিকে রোষ কষিত নয়নে দেখে বলেন, “তোর একবারের জন্যেও মনে হলো না যে পরী তোর মাসি আর তুই পাপ করছিস? এই সব শুধু তোর লালসার কারন, তোর গায়ের গরম রক্তের জন্যে তুই মেয়েটার জীবন অপবিত্র করে দিলি?”

পরীর চোখের জল মায়ের পায়ের কাছে মেঝেতে টপ টপ করে পড়ে। কারুর মুখে কোন কথা নেই কিন্তু মনে হলো যেন ওই চোখের জলের বুক ফাটা শব্দ ওদের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিচ্ছে। পরীর বুক কেঁপে ওঠে থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মা অভির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “কুলাঙ্গার তুই, আমাদের মুখে মুখে কালি দিয়ে দিলি। এই সব কিছু তোর পাপের ফল।”

আর থাকতে না পেরে অভি জোর গলায় উত্তর দেয়, “আমি পরীকে ভালোবাসি।”

মা বিশ্বাস করতে পারেন না, জোর গলায় জিজ্ঞেস করেন, “কি? তুই শেষ পর্যন্ত এই দিলি আমাকে আর ওকে? তুই ভালোভাবে জানিস যে পরী তোর চেয়ে বয়সে বড়, সম্পর্কে তোর মাসি হয়। আমার সম্পর্কে বোন আর তোর দিদার মেয়ে।”

অভি মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, “মা, পরী আমার মাসি নয় মা। ও তোমার বোন হতে পারে, কিন্তু আমার মাসি নয়। ও তোমার অনেক দূর সম্পর্কের বোন মা সেটা তুমি ভালো করে জানো মা। মা আমাদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই মা। ও আমার মাসি নয়, আমি ওকে ভালোবাসি।”

মা মাথা নাড়ান, “না না না, এ হতে দিতে পারি না আমি।” মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোর মাথায় কি চলছিল, যখন অভি তোর সাথে এই সব করছিল? তোর একবারের জন্য কিছু মনে হয়নি পরী? বল পরী, তুই কি অভিকে ভালবাসিস?”

পরী মাথা দোলায়, হ্যাঁ অভিকে ও ভালবাসে।

ওই কথা জানার পরে মায়ের দুচোখে জল চলে আসে। দুঃখে বা ভালবাসায় নয়, রাগে আর ঘৃণায় চোখে জল আসে মায়ের। পরীর চিবুকে আঙুল দিয়ে পরীর মুখ উঁচু করে নিজের দিকে ফেরায়। পরী দুচোখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে। মা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “একবারের জন্যেও তোর আমার কথা, তোর মায়ের কথা মনে পড়েনি? একবারের জন্যেও না? আমি যে তোদের দুজনকে একসাথে বড় করেছি রে।”

পরীর বুক ফাটা আর্তনাদ যেন শুধু একা অভি শুনতে পায়। দুচোখে অবিরাম স্রাবনের ধারা বয়ে চলে। অভির বুকের মাঝে যেন এক বিশাল রেল গাড়ি ঝম ঝম করে দৌড়ে চলে যায়।

মাকে আবার একবার বুঝানোর চেষ্টা করে অভি, “মা, পরী তোমার মায়ের মামার ছোটো মেয়ের ছোটো মেয়ে মা। দেখতে গেলে আমাদের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই মা। হ্যাঁ আমার চেয়ে বড় হতে পারে পরী, কিন্তু মা আমি ওকে ভালোবাসি আর বয়সের ব্যাবধান কোন বাধা নয় মা।”

মা ওর দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠেন, “তুই চুপ কর। তুই সত্যি আমাদের জন্য এক কলঙ্ক। সেই ছোটো বেলা থেকে তুই কোন দিন আমাদের কথা শুনিস নি, নিজের কথা মত সবসময়ে কাজ করিস।”

মায়ের কথা আর সহ্য করতে পারেনা অভি, সব সময়ে শুধু একই কথা যে ও কুলের নাম ডুবিয়েছে।

মায়ের দিকে চিৎকার করে ওঠে অভি, “আমি তোমার ছেলে হয়েও কেন তোমার ভালোবাসা পেলাম না মা, কেন?”

অভির কানে সেই প্রথম অকাঠ সত্য কথা প্রবেশ করে। মা ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, “আমি আর তোর বাবা, কোনদিন ছেলে চাইনি, কিন্তু ভগবান বিরূপ। সেই আমাকে ছেলেই দিল। আমাদের শারীরিক কিছু কারনে আর আমার কোন সন্তান হলো না। আমি ছেলে চাইনি।”

হাতের মুঠি শক্ত করে নেয় অভি, একি শুনছে, “আমার জন্মে আমার কি দোষ মা। আমি সারা জীবন শুধু দুঃখ পেয়ে গেলাম তোমাদের কাছে। আমার যা কিছু ভালো লাগে তাই তোমরা কেড়ে নিয়েছো। আমার মনের শান্তি, আমার পেন্টিং আরও অনেক কিছু। মা দয়া করে পরীকে আমার কাছে থেকে কেড়ে নিও না মা। আমি মরে যাবো, পরীও বাঁচবে না মা।”

সারা ঘর নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। বাইরের আকাশ যেন আরও কালো হয়ে আসে। থেকে থেকে মেঘ গর্জন করে ওঠে। ঘরের পরিবেশ মেঘের সাথে সাথে, কালো হয়ে আসে। পরী বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে মায়ের হাতে হাত রেখে মায়ের দিকে তাকায়।

মা পরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি বলার আছে?”

পরী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “ছোটমা, অভিকে আমার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিওনা ছোটমা, আমি বাঁচবো না ছোটমা।”

মা দাঁতে দাঁত পিষে মাথা নাড়ান, “না না, আমি বেঁচে থাকতে এ পাপ হতে দিতে পারিনা। সমাজ কি বলবে? আমাদের আত্মীয় স্বজন কি বলবে?”

অভি চিৎকার করে ওঠে, “কোথায় ছিল তোমার সমাজ যখন দাদু মারা যান? কোথায় ছিল তোমার আত্মীয় যখন পরীর মুখে দুধ জোটেনি? কেউ আসেনি ওকে দেখতে। তুমি ওকে দুধ খাইয়েছিলে মা, তুমি ওকে বড় করেছিলে। আমি সমাজের কথা জানিনা মা, আমি আত্মীয় স্বজনদের কথাও শুনি না। তুমি কি ভাবো সেটা বলো মা।”

মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেন, “আমি আর তোর বাবা এই সমাজের এক স্বনামধন্য ব্যাক্তি। আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন মিলে সমাজ তৈরি। আমি বেঁচে থাকতে এই পাপ হতে দিতে পারিনা। অভি, তুই পরীর ধারে কাছে থাকতে পারবি না। তোরা দুজনে একসাথে থাকতে পারিস না। আমি চাই না তুই পরীর হাজার মাইলের মধ্যে আয়। আজই তোকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।” মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অভি, মা কি বলছেন? মা ওকে বাড়ি ছাড়া হতে বলছেন? মা বলে চলেন, “আমি মাসিমাকে, পরীর মাকে কথা দিয়েছি যে আমি ওকে দেখবো। যত দুঃখ কষ্ট হোক, আমি আমার কথা রাখবো। আজ থেকে তেইশ বছর আগে, আমি এই বুক কেটে দু ভাগ করে পরীকে বড় করেছিলাম যাতে ও বেঁচে থাকে। আজ আবার আমি সেই বুক কাটতে রাজি, যাতে ওর স্বপ্ন পূরণ হয় আর ও বড় হতে পারে।”
 
Part Omega: বুকভাঙা অশ্রু। (#2)

পরী দুঃখে কঁকিয়ে ওঠে, বেদনায় চিৎকার করে ওঠে গলা ফাটিয়ে, “ছোটমা, আমি মাস্টারস করতে চাই না, আমি কিছু চাই না, শুধু অভিকে আমার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিওনা ছোটমা। কে কি বলে আমি তার ধার ধারিনা ছোটমা, শুধু ওকে আমার কাছ থেকে দুরে করে দিও না, ছোটমা, আমি বাঁচবো না।”

মায়ের কানে পরীর কান্না ভেজা আর্তনাদ প্রবেশ করে না, চুপ করে বসে থাকেন।

অভি মায়ের দিকে তাকিয়ে রেগে যায়, চিৎকার করে ওঠে, “তুমি তোমার আত্মসন্মান আর স্বাভিমান নিয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকলে। আমি যদি এই বাড়ি থেকে চলে যাই তাহলে আমি পরীকে সাথে নিয়ে যাবো।”

মাঃ “না, কারুর ক্ষমতা নেই ওকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে নেওয়ার। পরীর মাথায় হাত রেখে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তুই কোনদিন কোলকাতা আসবি না, তুই কোনদিন ওর সামনে আসবি না।”

মায়ের আদেশ শুনে অভি পাথরের মূর্তির মতন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মা ওর হাত টেনে ধরে পরীর মাথায় রাখে, অভির বুক ফেটে যায় হাতের ওপরে পরীর চুলের পরশ পেয়ে। এক ভীষণ ভুমিকম্প এসে যেন ওদের জীবন টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়ে চলে যায়। পরী ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে, মাথায় অভির হাত। মরমে যেন মরে যায় পরী।

চাপা কঁকিয়ে ওঠে, “না......” মায়ের কোলে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলে। মা ওর দিকে তাকায় না।

মা পরীকে বলেন, “তোর মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, যে তোকে আমি আগলে রাখবো। আমার মান সন্মান আজ সমাজের কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সেই জন্যেই অভিকে বাড়ি ছাড়তে হবে, এমনকি কোলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে ওকে। আমি চাই না ওর ছায়া পর্যন্ত তোর কাছে আসুক।” মা অভির দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন, নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে। আমি তোর বাবাকে এখুনি ফোন করে কাল সকালের দিল্লীর জন্যে প্লেনের টিকিট কাটতে বলে দিচ্ছি। আর এক দিনের জন্যেও তুই এই ছাদের তলায় থাকতে পারবি না। কথা দে, আমি যত দিন না বলবো, তত দিন তুই কোলকাতা আসবিনা আর আমাদের বাড়িতে ফোন করবি না। যদি আমার কথা না রাখিস তাহলে তুই পরীর মরা মুখ দেখবি।”

মায়ের কথা শুনে অভির যেন দুই পা কেউ মেঝের সাথে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে, নড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলে অভি। পরী মুখ নিচু করে কাঁদে, বুকের মাঝে এক বিশাল আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়েছে ওর। শক্ত করে হাত চেপে ধরে পরী, হাতের সরু সোনার চুড়ি বেঁকে গিয়ে কবজিতে ফুটে যায় আর রক্ত বের হতে শুরু করে, কিন্তু সেই বেদনা যে মনের বেদনার কাছে খুব কম। অভির চোখের সামনে সারা পৃথিবী বন বন করে ঘুরতে শুরু করে দেয়।

অভিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা চিৎকার করে ওঠেন, “দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে, আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।”

কোনোরকমে টলতে টলতে অভি নিজের ঘরে ঢোকে। জানেনা, পরীর কি হবে বা বাবাকে মা কি বলবেন। বাকি সারাদিন নিজেকে নিজের ঘরে বন্ধ করে রাখে। শেষ পর্যন্ত মৈথিলীর অভিশাপের কথা মনে পড়ে যায়, মৈথিলী যেন ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে, “জীবন যুদ্ধে তুমি শেষ পর্যন্ত হেরে গেলে অভিমন্যু।”

বিকেলে বাবা ওর ঘরে আসেন। হাতে একটা খাম আর দিল্লীর টিকিট দিয়ে বলেন, “আমরা তোর বাবা মা, আমরা তোর ভালোই চাইবো। যতদিন তুই চাকরি না পাস, তত দিনের জন্য আমি সুপ্রতিমের অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব।”

বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়, আকাশ যেন সেদিন জলের বদলে রক্তের বৃষ্টি করে। পরীর আর অভির বুকের রক্ত যেন আকাশ কেঁদে কেঁদে জল করে সারা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু কেউ সেই কান্না শুনতে পায় না।

রাত একটা নাগাদ, জামা কাপড় পরে, ব্যাগ হাতে নিচে নেমে আসে অভি। আসার আগে নিজের ঘরে সেই ডায়রি খোঁজে, কিন্তু পায় না, ভাবে হয়তো পরীর কাছে থাকবে।

শেষ বারের মতন বাড়ি থেকে অরুনাকে ফোন করে। অরুনা অত রাতে ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, কি হয়েছে? এত রাতে ফোন করেছিস কেন?”

অভিঃ “আমি কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, সকালের ফ্লাইট। আমার সাথে পারলে এয়ারপোর্টে দেখা করিস।”

চাপা চিৎকার করে ওঠে অরুনা, “কি হয়েছে?”

অভিঃ “ফোনে বলতে পারছিনা, সকালে এয়ারপোর্টে বলবো।” শেষ বারের মতন বাড়ির ফোনে কথা বলে রিসিভার রেখে দেয়।

সারা রাত বসার ঘরে চুপ করে বসে থাকে অভি। মায়ের ঘরে মা জেগে, পরীর ঘরে পরী দরজা বন্ধ করে কাঁদে। শেষ বারের মতন পরীর সাথে দেখা করার অবকাশটুকু পায়না অভি, বুকের মাঝে হুহু করে কেঁদে ওঠে যখন পরীর বন্ধ দরজার দিকে চোখ যায়।

সকাল চারটে নাগাদ মায়ের দরজায় টোকা মারে অভি, জানায় যে এবারে ও চলে যাবে। মা কোন উত্তর দেন না। বাবা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, “প্লেন তো সাতটায়, এখুনি বের হবি কেন?”

বুকের পাঁজর ভেঙে যায় অভির তাও উত্তর দেয় বাবাকে, “এই বাড়িতে আমার থাকার সময় শেষ হয়ে এসেছে।”

মাথা নিচু করে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে অভি, শেষ বারের জন্য মেঝে ছুঁয়ে মাকে শেষ প্রনাম জানায়। ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় দরজা দিয়ে। বাবা বাইরের গেট পর্যন্ত ওর সাথে আসেন। গেট থেকে বেরিয়ে যাবার আগে, শেষ বারের জন্য বাড়ির দিকে তাকায় অভি। দুতলার বসার ঘরের জানালার পর্দা হাল্কা নড়ে ওঠে। তাকিয়ে দেখে যে পরী জল ভরা চোখে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। কাজল কালো চোখ দুটি রক্ত জবার মতন লাল হয়ে উঠেছে। বুক ফেটে কান্নার সুর অভির কানে এসে বাজে। পরীর বুকের পাঁজর ওর কাছ থেকে দুরে চলে যাচ্ছে, পরী বাঁচবে কি নিয়ে।

অভি নিচু হয়ে বাগানের একটু মাটি তুলে নিয়ে পরীর সেই সিল্কের রুমালে বেঁধে নেয়। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে জানালার দিকে শেষ বারের মতন তাকায় অভি। ওর দিকে তর্জনী উঠিয়ে ইশারায় জানায় “আই”, ইশারা দেখে পরী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তারপরে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল মেলে ধরে ইশারা করে, “এল”, পরীর বুকে কেঁপে ওঠে, প্রানপন নিজেকে থামাতে চেষ্টা করে। তারাপরে অভি, মধ্যমা আর অনামিকে মেলে ধরে ওর দিকে ইশারা করে, “ইউ”। পরী জানালার গ্রিল শক্ত করে ধরে থাকে, প্রানপন চেষ্টা করে সেই লোহার গ্রিল ভেঙে অভির কাছে ঝাঁপিয়ে চলে যাওয়ার, কিন্তু লোহার গ্রিল আর সমাজের কঠিন বন্ধন পরীকে ঝাঁপ দিতে দেয় না। পরী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা, সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক বার আগেও পরী সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল, তখন অভিকে সবাই ডেকে ছিল, কিন্তু সেই সময় আর আজকের সময় অনেক ভিন্ন। সেদিন চেয়েও অভি দৌড়ে পরীর কাছে গিয়ে ওর মাথা নিজের কোলে তুলে নিতে পারে না।

জল ভরা চোখ, ভাঙা বুক নিয়ে অভি ট্যাক্সি চাপে। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায় যে, পরীকে যেন শান্তি দেয় ওকে যেন সুখে রাখে, নিজের জীবনে তো কিছুই পেলোনা শেষ পর্যন্ত। পরীর কাছে হয়তো ওর একমাত্র চিহ্নস্বরুপ ওর ডায়রি থেকে যাবে আর অভির কাছে ওর রুমাল, তার সাথে পরীর এক বিন্দু রক্ত ওর শিরা উপশিরায় মিশে।

21শে জুলাই, 2001, শনিবার। সকাল চারটে নাগাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছে লক্ষ্য করে যে অরুনা আর সমুদ্রনীল উপস্থিত। অরুনা অভির কাছে দৌড়ে এসে কলার ধরে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তোর বাড়িতে? তুই কেন কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? শুচিদির কি হবে?”

অভিঃ “আমি চিরদিনের জন্য কোলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”

চাপা চিৎকার করে ওঠে অরুনা, “কেন?” অভি পুরো ঘটনা জানায় অরুনাকে।

সব শুনে অরুনা কেঁদে ফেলে, “আমাকে আগে কেন জানাস নি তুই?”

অভিঃ “কি করে জানাতাম রে। সবকিছু কেমন ঝড়ের বেগে এসে আমাদের জীবন তছনছ করে দিয়ে চলে গেল। মা জেগে বসে আমি কি করে তোকে জানাই এই সব কথা।”

অরুনা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে অভিমন্যু কোলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। অভির দিকে তাকিয়ে সমানে কেঁদে চলে অরুনা, পেছনে সমুদ্রনীল দাঁড়িয়ে, যেন কিছু বলার ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করে।

অরুনাঃ “আমি কাকিমার সাথে কথা বলবো, তুই যাস না।”

অভিঃ “সেই পথ বন্ধ অরুনা। মা এতক্ষনে ভালভাবে বুঝতে পেরে গেছেন যে তুই আগে থেকে আমার আর পরীর ভালবাসার কথা জানতিস, তাই আমার মা হয়তো তোকে আমাদের বাড়ি ঢুকতে পর্যন্ত দেবে না। পরীর মাথায় হাত রেখে আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে যে আমি কোনদিন পরীর সাথে দেখা করতে পারবোনা বা কোনদিন কোলকাতা ফিরতে পারবোনা। আমি মরে যাবো কিন্তু পরীর গায়ে কোন আঁচ আসুক আমি চাই না, অরুনা।”

অরুনা অভিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বুকের জামা ভিজে যায় অরুনার চোখের জলে। অভির বুক ফেটে যায় পরীর দুঃখে আর অরুনার কান্না দেখে। দুহাতে শেষ বারের মতন অরুনাকে জড়িয়ে ধরে অভি, মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে সমুদ্রনীলের দিকে ঝাপসা চোখ নিয়ে তাকায়।

কাঁপা গলায় বলে সমুদ্রনীলকে, “আমি চেক ইন করার আগে অরুনাকে নিয়ে চলে যা।”

সমুদ্রনীল উত্তর দেয়, “তুই ওকে ভালো ভাবে চিনিস অভি। ওই বোর্ডে যতক্ষণ না লেখা ফুটবে যে আই সি 264 Departed. ততক্ষণ অরুনা এখান থেকে নড়বে না। আমি জানি না রে অভি, তুই যাবার পরে অরুনার কি হবে। ও শুচিদিকে খুব ভালবাসতো রে।”

অভিঃ “আমাকে কথা দে তুই ওকে দেখবি, দয়া করে ওর চোখে জল আনিস না রে। আমার হয়ে, পরীর হয়ে ওকে ভালবাসিস তুই, আমি পুবালিকে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথা আমি তো আর রাখতে পারলাম না, তুই রাখিস।”

কোনোরকমে জোর করে অরুনাকে ছাড়িয়ে ওর হাত সমুদ্রনীলের হাতে তুলে দেয়। অরুনা কিছুতেই অভিকে ছাড়তে চায় না, প্রাণপণে জামার কলার আঁকড়ে ধরে থাকে। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে বুকের পাঁজর ভেঙে দিয়ে অভি পেছনে সরে আসে আর জামার একটা বোতাম ছিঁড়ে অরুনার হাতে থেকে যায়। অভি পেছনে না তাকিয়ে সোজা, চেক ইন করার দিকে হাঁটা দেয়।
পেছন থেকে অরুনা ডুকরে কেঁদে ওঠে, “আজ আমি আমার জীবনের সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি অভি।”

সিক্যুরিটি চেক করার আগে শেষবারের মতন অরুনার জল ভরা চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণি, প্রিয় বান্ধবী অরুন্ধুতি ব্যানার্জির জল ভরা চোখ ওর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে।

প্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড়তে শুরু করে। অভি দাঁতে দাঁত পিষে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। প্লেনের ঝন ঝন আওয়াজ যেন ওর বুকের পাঁজরের ভাঙা আওয়াজ মনে হয়। একটা একটা করে ভাঙে ওর শরীরের হাড়। বারে বারে মাথা পেটায় সিটের পেছনে। আগে এক বার এই প্লেন অভিকে নিয়ে উড়েছিল পরীর সাথে অজানার পানে ভ্রমনে। সেই একই প্লেনে করে উড়ে ও ফিরে পেয়েছিল প্রানের বান্ধবীকে। কিন্তু সেইদিনের উড়ান বাকি দিনের উড়ানের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা, এবারে ওকে সবকিছু ছেড়ে যেতে হবে, সাধের প্রান প্রেয়সী আর চোখের মনি দেবী অরুন্ধুতি।

শেষ পর্যন্ত প্লেনের চাকা উঠে গেল প্লেনের দেহে। অভির শরীর যেন এক বিশাল ধাক্কা খেল, যেন এক লোহার শেকল ছিঁড়ে গেছে অবশেষে। মাথার মধ্যে সেই লোহার শেকলের শত সহস্র টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিন যা যা প্রতিজ্ঞা করেছিল অভি, সব যেন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল প্লেনের ওড়ার সাথে সাথে।

অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে ওর প্রেয়সীর জন্য একটা কুটির বানিয়ে দেবে।
অভির সুটকেসে ভাঁজ করে রাখা প্রেয়সীর ছবি যেটা শেষ করতে পারেনি।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে বুড়ো হলে ওরা দুজনে মিলে একসাথে বসে ওর ডায়রি পড়বে।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে প্রেয়সীর সাথে দোলনায় বসে বিকেলের চা খাবে সেই পাহাড়ের কুটিরের সামনে।
অভি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে বয়স কালে ওরা বৃদ্ধাশ্রমে একসাথে থাকবে।

অভির সব প্রতিজ্ঞা সেইদিন ভেঙে যায়।

ঝাপসা চোখের সামনে তিনখানি চেহারা ভেসে ওঠে।

পরীর জল ভরা লাল চোখ, দু গাল বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে, হৃদয় ভেঙে সহস্র টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে পরীর।
অরুন্ধুতির হৃদয় বিদারক কান্নার আর সেই ডাক।
মায়ের ক্রোধিত নয়ন।

বিদায় শুচিস্মিতা, বিদায় অরুন্ধুতি, বিদায় কোলকাতা।
দেখি নাই ফিরে।

সুপ্রতিমদা ওকে চাকরি পেতে সাহায্য করে আর দিল্লীর একটা বড় আই টি কম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। অভি নিজেকে কাজে আর মদে ডুবিয়ে ফেলে। ভালোবাসা শব্দটি ওর জীবনের খাতা থেকে মুছে ফেলে।

একদিন অভি রিতিকাকে বাড়িতে ফোন করতে বলে। রিতিকা কোলকাতায় অভির বাড়ি ফোন করে, ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিল যাতে সবাই কথা শুনতে পারে।

বাবাঃ “কে বলছেন?”

রিতিকাঃ “আমি রিতিকা, শুচিস্মিতার বান্ধবী। ওর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”

বাবাঃ “কোথা থেকে বলছো?”

রিতিকাঃ “দিল্লী থেকে বলছি আমি।”

বাবা ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দেন, “শুচিস্মিতা এখানে আর থাকে না। কিছু কারনে শুচিস্মিতা এ বাড়ি থেকে চলে গেছে।”

বাবা হয়তো অনুধাবন করে ফেলেছিলেন যে রিতিকার ফোনের পেছনে অভি দাঁড়িয়ে। হয়তো পরী বাবার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সেই সত্য কোনদিন অভি জানতে পারেনা। সেই রাতে একা একা কাঁদে অভি, দুঃখের সাথি এক বোতল মদ।

কয়েক মাস পরে রিতিকা আর সুপ্রতিমদার বিয়ে হয়ে যায় আর ওরা ব্যাঙ্গালোর চলে যায়। তারপরে অভির সাথে তাদের বিশেষ কোন যোগাযোগ থাকেনা।

প্রতি রাতে পরী অভির স্বপ্নে এসে দেখা দিতো। পরী এক বিশাল নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দেয়, আর সেই নৌকার মাস্তুল দিগন্তের কোলে ধিরে ধিরে লুকিয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও অভি সেই নৌকার দিকে সাঁতরে যেতে পারে না। রোজ রাতে পরীর সেই সিল্কের রুমাল খানি মুখের ওপরে মেলে ধরতো আর সকাল বেলা সেটা আবার মানি ব্যাগের পকেটে গুছিয়ে রেখে দিতো। প্রত্যেক রাতে সেই রুমাল থেকে পরীর গায়ের জুঁই ফুলের গন্ধ নেবার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতো অভি, কিন্তু হায়, সিল্কের রুমাল, গন্ধ তো অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে, যে গন্ধের আভাসটুকু বেঁচে থাকে সেটা অভির ভাঙা হৃদয়ের এককোনে বেঁচে থাকে।

অরুনার সাথে অনেক দিন পর্যন্ত অভির যোগাযোগ ছিল। মাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার ফলে অরুনার বিয়ের সময়ে কোলকাতা আসতে পারেনি অভি।
জুলাই 2009, এক শনিবারের সকালে অভির সেলফোন বেজে ওঠে, অন্যদিকে সমুদ্রনীল।

সমুদ্রনীলঃ “হ্যাঁরে, তুই মামা হয়ে গেছিস। এই মাত্র একটি মেয়ে হয়েছে আমাদের। কথা বলবি অরুনার সাথে?”

অভিঃ “উফফফফ দারুন খবর শোনালি তুই, কুত্তাটা একটা রাজকুমারীর মা হয়ে গেছে দেখছি যে। দে দে তাড়াতাড়ি ফোন দে।”

অরুনার সেই পুরানো মিষ্টি গালাগালি, “কিরে শুয়োর, কুত্তা, হাড়গিলে, কেমন আছিস?”

অভিঃ “আমি ভালো আছি রে কাক, হাড়গিলে। শেষ পর্যন্ত আমার চোখের মনি মা হয়ে গেল আর আমি চোখের দেখা পর্যন্ত দেখতে পারলাম না।” অভির গলা ধরে এসেছিল কথা বলার সময়ে।

কিছু থেমে অরুনা অভিকে ধরা গলায় উত্তর দেয়, “হ্যাঁ রে কুত্তা। আমরা ওর নাম রেখেছি শুচিস্মিতা, ডাক নাম পরী।”

অভি ফোন চেপে ধরে কেঁদে ফেলে।

ছোট্ট পরী জন্মাবার কয়েক মাস পরে অরুন্ধুতি আর সমুদ্রনীল অস্ট্রেলিয়া চলে যায় আর তাদের সাথে অভির শেষ বন্ধনটুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

দশটি বছর কেটে যায়। এপ্রিল 2011, শীতকাল, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। অভি দিল্লীর T-3 টারমিনালের আন্তর্জাতিক জায়গায় প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছিল। অফিসের কাজে অভি কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া যাচ্ছে। হাতের ট্যাবলেটে মেইল দেখছিল অভি আর অপেক্ষা করছিল কখন প্লেনে ওঠার ডাক আসে।

ঠিক সেইসময়ে ওইখানে কেউ ওর নামে ধরে ডাক দেয় তাও বাঙলায়। ভদ্রমহিলার আওয়াজ, “অভিমন্যু ওই রকম দৌড়ায় না সোনা, পড়ে যাবে।”

অত রাতে, দিল্লীর টারমিনালে দাঁড়িয়ে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে অভি। মাথা উঁচু করে খুঁজতে চেষ্টা করে সেই ভদ্রমহিলাকে। আবার সেই ভদ্রমহিলার আওয়াজ কানে আসে, “অভি, ওখানে যায় না সোনা।”

কেঁপে ওঠে অভি, এই মিষ্টি সুর তার খুব চেনা, এই স্বর অনেক অনেক দিন আগেই ওর হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল। বুকের মাঝে ধুকপুকানি শত গুন বেড়ে যায়, সত্যি কি সামনে, কি করে হতে পারে যার কথা চিন্তা করছে অভি?

ঠিক সেই সময়ে প্লেনের গেটের কাছের মহিলা ওকে প্লেনে ওঠার জন্য অনুরোধ করে। অভি ওর দিকে হাত নাড়িয়ে বলে, “এক মিনিট ম্যাডাম।”

মাথা ঘুরিয়ে আসেপাশে দেখে অভি, শেষ পর্যন্ত সেই সুরেলা কন্ঠস্বরের ভদ্রমহিলাকে খুঁজে পায়। বেশি দুরে দাঁড়িয়ে নয় সেই ভদ্রমহিলা, ওর দিকে পেছন ফিরে সামনে এক ছোটো বাচ্চাকে ডাক দেয়। ছোট্ট শাবক, খিল খিল করে হেসে উঠে সেই ভদ্রমহিলার থেকে দুরে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

সেই ভদ্রমহিলা একটি নীল রঙের জিন্স পরে আর গায়ে সাদা কোট। মাথার চুল ঘাড়ের একটু নিচ পর্যন্ত নেমে এসে চওড়া পিঠের ওপরে দুলছে। অভির দিকে পেছন ফিরে থাকার জন্য অভি ওনার মুখ ঠিক ভাবে দেখতে পারে না। কিন্তু পাশ থেকে বুঝতে পারে যে চোখে সোনালি চশমা। মাথার চুল একটু বাদামি রঙের, ভদ্রমহিলা সম্ভবত তিরিশের মাঝামাঝি বয়স। বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের দেখে মনে হলো কেননা গায়ের কোট অনেক দামী। ভদ্রমহিলার শরীরের অবয়ব বেশ সুন্দর। বাম হাতের কব্জিতে দামী ওমেগা ঘড়ি আর অনামিকায় একটা হীরের আঙটি জ্বলজ্বল করছে।

ভদ্রমহিলা সেই ছোট্ট শাবককে দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে। ডাক শুনে সেই ছোট্ট শাবক খিলখিল করে হেসে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভদ্রমহিলার কোলে। সেই ছোট্ট শাবকের মুখখানি নিস্পাপ ফুলের মতন আর খুব মিষ্টি। যে ভাবে সেই বাচ্চাটা ভদ্রমহিলাকে আঁকড়ে ধরে তাতে অভির মনে হলো যে ভদ্রমহিলা সেই বাচ্চার মা। ব্যাগের ভেতরে ট্যাবলেট রেখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসে অভি। অভির হাসি দেখে সেই ছোট্ট ছানা হেসে ফেলে। অভি সেই ছোট্ট ছানার দিকে একটা চুমু ছুঁড়ে দেয়। মায়ের কোল থেকে সেই ছোট্ট ছানা, ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ায়।

হাতে ব্যাগ নিয়ে অভি দাঁড়িয়ে পড়ে, প্লেনের দিকে যাবার জন্য পা বাড়ায়, কিন্তু চোখ থেকে যায় সেই মায়ের কোলে বাচ্চাটার দিকে। ভদ্রমহিলা কোলের ছানাকে কানে কানে কিছু জিজ্ঞেস করেন, আর সেই ছোট্ট বাচ্চা ওর দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।

ভদ্রমহিলা ঘুরে দাঁড়ান দেখার জন্য যে কে ওর হৃদয়ের পাঁজরের দিকে হাত নাড়ায় এই অজানা ভুমিতে।

ভদ্রমুহিলার চোখে চোখ মেলে অভির। পা বাড়াতে ভুলে যায়, শ্বাস নিতে ভুলে যায় অভিমন্যু, ভুলে যায় যে অফিসের কাজে ওকে কোথাও যেতে হবে, ভুলে যায় যে ওর জন্য প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মাঝে যেন সহস্র ঘোড়া একসাথে টগবগ করে দৌড়াতে শুরু করে দেয়। সারা শরীরের সব শিরা উপশিরা একসাথে ওর বুকের মাঝে রক্ত ঢালতে শুরু করে। বুকের মাঝে দামামা বেজে ওঠে অভিমন্যুর।

চোখের সামনে সেই মাতৃ মূর্তি ওর দিকে তাকিয়ে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়ে। কোলের সেই ছোট্ট শাবক তাঁর মায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সেই মাতৃ মূর্তি বাচ্চাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে ওর, চোখের সামনে অভিমন্যুকে দেখে। সেই পুরানো স্মৃতি ভরে আসে দু নয়নে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে কান্না সামলানোর জন্য। ফর্সা নাকের ডগা গোলাপি হয়ে ওঠে। বুক কেঁপে ওঠে ওর কোন এক অভূতপূর্ব বেদনায়।

প্রশান্ত মহাসাগরের তলে ডুবে থাকা মহাদ্বীপে যেন ভাঙন ধরে, চোখের সামনে সেই পুরানো স্মৃতি ফুটে ওঠে সেই ফাটলের ভেতর থেকে।

সোনার চশমার পেছনে থাকা সেই চোখ দুটিকে অভির মনে পড়ে, সেই টোল পরা গোলাপি গালের দৃশ্য, সেই চুলের এক গুচ্ছ, গালের ওপরে দোলা খায়, না অভিমন্যু কিছুই ভোলেনি তার প্রান প্রেয়সীর রুপ। আজ পর্যন্ত প্রতি রাতে ওই কাজল কালো চোখ ওকে জাগিয়ে রাখে।

কোটের পকেটে রাখা মানি ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায় অভিমন্যু, সেই পকেটে এখনো সেই সিল্কের রুমাল রাখা। একবার বার করতে চেষ্টা করে সেই রুমাল, কিন্তু অনামিকায় জ্বলজ্বল করে হীরের আঙটি। সেই দেখে অভিমন্যু আর সেই রুমাল বের করে না, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

প্লেনের দরজায় দাঁড়ানো সেই মহিলা আবার অভিমন্যুকে ডাক দেয়, “স্যার, প্লিস বোর্ড দা প্লেন।”

প্লেনের দিকে পা বাড়ানোর আগে শেষবারের মতন সেই মাতৃময়ী মূর্তির জল ভরা চোখের দিকে তাকায় অভিমন্যু।

সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সী, দশ বছর আগে সেই প্রেয়সীর গালে চুম্বন এঁকে দিয়েছিল।

কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সী আজ এক মমতাময়ী মাতৃমূর্তি, কোলে তার প্রানের ধন, চোখের মনি তার শাবক যাকে সে “অভিমন্যু” নামে ডাকছিল।

কোন প্লেনে চেপে, কোন দেশে পাড়ি দেবে সে কথা এই দাঁড়িয়ে থাকা অভিমন্যু জানেনা। জানে শুধু একটা কথা, আজও তাঁর বুকের মাঝে খুঁজে বেড়ায় সেই পুরানো পরীকে।

সামনে দাঁড়িয়ে সেই মমতাময়ী মাতৃমূর্তি এখন মিসেস শুচিস্মিতা... অভিমন্যু তালুকদার তাঁর পদবি জানে না।

*******The End*******
 

Users who are viewing this thread

Back
Top