Chapter 8: দাবার 64 ছক। (#3)
অভি ওর মাথার চুল আঁচড়ে বলে, “পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে, তাই না?”
অভির কোল ঘেঁসে বসে দুষ্টু, “হ্যাঁ, পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে আমার। আমার সাথে খেলতো, আমাকে খাইয়ে দিতো, আমার চুল আঁচড়ে দিতো, স্নান করিয়ে দিতো আমাকে। ঘুম না পেলে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো পরী পিসি। পিসি চলে যাবার পরে আমার খুব একা একা লাগে।”
বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সেই ছোট্ট ছেলেকে, “তোর পরী পিসি কোথাও যায়নি।” ছোটো বুকের বাম দিকে আদর করে হাত রেখে অভি ওকে জানায়, “তোর পরী পিসি সর্বদা এখানে থাকবে।”
দুষ্টু ওর কথা শুনে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “পরী পিসির সাথে দেখা করার জন্য আমি তোমার বাড়ি যেতে পারি?”
অভির গলা ধরে আসে, “হ্যাঁ বাবা, তুই যখন খুশি আমার বাড়িতে আসতে পারিস। সারা জীবন আমার বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা।”
আনন্দের আবেগে দুষ্টু ওর গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, “তুমি না আমার সব থেকে ভালো কাকু, অভি কাকু।” নিষ্কলঙ্ক নিষ্পাপ সেই মিষ্টি হাসি দেখে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে।
সূর্য বেশ খানিকক্ষন আগেই ডুবে গেছে। মাথার ওপরে পাখীর কিচির মিচির, বাসায় ফিরে যাওয়ার তাড়া সবার। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে ওদের। জামা কাপড় পরে বাড়ি ফিরে আসে ওরা, সারাটা পথ, অভির হাত আঁকড়ে ধরে থাকে দুষ্টু। বাড়িতে ঢুকেই পরীকে দেখে লাফিয়ে কোলে চড়ে যায় আর কানে কানে কিছু বলে। পরী অভির দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে দুষ্টুর কথা শুনে হেসে ফেলে।
পরী ওকে বলে, “হ্যাঁ রে, তুই যখন তখন আমার বাড়িতে আসতে পারিস।”
বাড়িতে অভির উপস্থিতি যেন আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। বিশেষ করে সুব্রত আর অভির মধ্যে যে একটা মনোমালিন্য চলছে সেটা দিদা আর সুমন্ত মামার চোখ এড়ায় না। এক বিকেলে সুমন্ত মামা আর অভি বারান্দায় বসে মুড়ি আর চা খাচ্ছিল, সুমন্ত মামা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি সুব্রতর বিয়ের সময়ে ওর সাথে সারা রাত ছিলে, তাই না?”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অভি জানায়, “হ্যাঁ ছিলাম।”
সুমন্ত মামাঃ “তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, তোমরা দুজনে একে অপরের সাথে ঠিক করে কথা বলছো না কেন? বউমাকেও তোমার সামনে বের হতে দেখলাম না, কি ব্যাপার?”
অভি ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। চা মুড়ি খাওয়া ভুলে যায় অভি, কিছুক্ষণ মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে মামা কতটুকু খবর জানেন।
তারপরে অভি চালাকি করে উত্তর দেয়, “হয়তো আমার কোন কথায় একটু বোঝার ভুল হয়ে থাকবে, আমি আমার দিকে থেকে ঠিক আছি। অপেক্ষা করছি ও কখন আমার সাথে কথা বলে। যদি কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের মধ্যে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”
সুমন্ত মামা মাথা দোলায়, “ঠিক কথা, এখুনি ওকে ডেকে কথা বলা যাক।” তারপরে সুমন্ত মামা চেঁচিয়ে সুব্রতকে ডাক দেয়, “সুব্রত বারান্দায় আয় একবার, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
সুমন্ত মামার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে সুব্রত, এসেই দেখে দাদার পাশে অভি বসে। ওকে দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুব্রত। দু’চোখে ভয় আর বিতৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে এসেছে সুব্রতর, ধির পায়ে সুমন্ত মামার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ভয়ার্ত গলায় মাথা নিচু করে সুমন্ত মামাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “কি হয়েছে দাদা?”
সুমন্ত মামা একবার অভির দিকে তাকায় তারপরে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই অভির সাথে কথা বলছিস না কেন? তোদের মধ্যে কোন মনোমালিন্য হয়েছে নাকি?”
অভি অনুধাবন করে যে এখুনি সুব্রতকে বিব্রত করা বিচক্ষণের কাজ নয়। অভি সুব্রতর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বলে, “কিছু হয়নি, তাই না মামা। সব ঠিক আছে।” সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “সুব্রত হয়তো সময় পায়নি কথা বলার, নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই, বউকে নিয়ে ব্যাস্ত আছে।”
অভির কথা শুনে সুব্রতর বুকের থেকে এক বিশাল পাথর সরে যায়, স্বস্তির শ্বাস নেয় সুব্রত। কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
কিছু পরে সুমন্ত মামা অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী তোমাদের বাড়িতে ঠিক আছে তো?”
অভি সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার বাড়ি আর কোথায়, এখন তো ওটা পরীর বাড়ি। মাকে ছোটো মা বলে ডাকে বাবাকে বাবু।”
সুমন্ত মামাঃ “আমি কাউকে ঠিক ভাবে দেখতে পারিনি সেই সময়ে। কি করবো, বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমাকেই কাজে নামতে হয় পেটের ভাত যোগাড় করার জন্য। আমি যখন সময় পেলাম মাথা তুলে তাকানোর, ততদিনে আমার সেই মিষ্টি ছোট্ট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাথা তুললাম বটে, কিন্তু আমার কথা আর কেউ শোনেনা। এই পৃথিবী কাঁচের ঝকমকিতে উজ্জ্বল, অভি। আসল হীরের মর্যাদা বোঝে না, আসল হীরে তো চমকায় না, না কাটা পর্যন্ত শুধু একটা সাদা পাথর মাত্র। কিন্তু কাঁচ, কাটা হোক বা আস্ত হোক, সর্বদা চমকায়।”
অভিঃ “এসব কথা কেন বলছো মামা?”
সুমন্ত মামাঃ “তোমার মা, উলুপিদি আর আমাদের পরিবার; আমাদের মাঝে রক্তের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই, হ্যাঁ, অনেক দূর সম্পর্কের দিদি হন উলুপিদি। এই বাড়িতে থাকতেন কেননা তুমি তখন ওনার পেটে আর ওনার স্কুল এখানে তাই। সেই সম্পর্ক না থাকার পরেও তিনি যা করেছেন সেই সময়ে আমাদের নিজের কোন আত্মীয় আমাদের জন্য করেনি।”
অভিঃ “মামা, ছাড়ো ওসব কথা, পরী এখন ভালো আছে, আনন্দে আছে।”
সুমন্ত মামাঃ “হ্যাঁ ওর মুখের হাসি দেখে মনে শান্তি লাগে। তবে ভয় হয়, কতদিন ওই হাসি ওর মুখে থাকবে।”
অভিঃ “কেন? হাসি কেন চলে যাবে, এই রকম কেন ভাবছো তুমি?”
সুমন্ত মামাঃ “মেয়ে হয়ে জন্মেছে, একদিন না একদিন বিয়ে করে পরের বাড়ি চলে যাবে। কে জানে, ভাগ্য বিধাতা কি লিখে গেছে ওর কপালে।”
অভিঃ “ওর মুখে হাসি ফুটুক, এটা তুমি চাও, এইতো।” সুমন্ত মামা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” অভি বলে, “ও যেখানে আছে এখন বড় ভালো আছে, শান্তিতে আছে। তুমি চিন্তা কোরোনা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
সুমন্ত মামাঃ “অভি, এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর।”
অভিঃ “মামা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি যতদিন ওর পাশে আছি ততদিন ওর কিছু হতে দেব না।”
মামা কি বুঝলো জানেনা, ম্লান হেসে অভিকে বললেন, “কতদিন, কতদিন থাকবে ওর পাশে তুমি? এক না এক দিন তো বিয়ে করে ওকে চলে যেতে হবে।”
মনে মনে বলে অভি, “না মামা, পরী কোনদিন আমার চোখের সামনে থেকে যাবেনা, তুমি একবার বলো, আমি কোনদিন ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেব না।” সুমন্ত মামাকে মজা করে বলে, “মামা, চিন্তা কোরোনা, পরী কোথাও যাবে না, সর্বদা তোমার ছোটো বোন, তোমার বুকের কাছেই থাকবে। যেখানেই থাকুক না কেন, বড় সুখে থাকবে ও।”
একদিন রাতে, অভি ছাদে উঠে সিগারেট টানছিল। মাথার ওপরে অন্ধকার, গাড় নীল আকাশের বুকে অজস্র নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। গীষ্মের রাতের দখিনা বাতাস ওর মন বিচলিত করে তোলে। বাড়ির সবাই হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, সময় প্রায় মধ্যরাত্রি। অভি দিগন্তের দিকে তাকায়, দিগন্তে কালো কালো নারকেল গাছ যেন ভুতের মতন মাথা দুলিয়ে ওকে কাছে ডাকে। পাশে কোথাও কোন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুরে রাস্তার মোড়ে একটা কুকুর ডেকে ওঠে মনে হয় বিড়াল দেখে তাড়া করেছে কুকুরটা।
সিগারেট শেষে, অভি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই সামনে পরীকে দেখে অবাক হয়ে যায়। আকাশের বাঁকা চাঁদের মৃদু আলোয় পরীর সুন্দর মুখ যেন গাঁদা ফুলের মতন দেখায়। পরী ওর দিকে হেসে বলে, “কি রে দুষ্টু ছেলে, ঘুম আসছে না?”
অভি পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে নিয়ে নিজের দিকে টেনে আনে, “শয়তান হাড়গিলে, তোরও তো ঘুম আসছে না।”
ছাদে উঠে, ছাদের এককোনে পরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নরম পেটের ওপরে আদর করে অভি আর পেছনে মাথা হেলিয়ে ওর হাত দুটি ধরে দাঁড়িয়ে আদর খায় পরী। অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের অপরূপ দৃশ্যে হারিয়ে যায়।
মৃদুকন্ঠে বলে পরী, “এত রাতে ছাদে কি করছিলে?”
গালে গাল ঘষে উত্তর দেয়, “তোমারও তো ঘুম আসছিল না, কেন জেগে?”
পরীঃ “সিঁড়িতে তোমার পায়ের শন্দ শুনে দেখতে এলাম তুমি কি করছো।”
অভিঃ “মিথ্যে বোলোনা সোনা, পায়ের শব্দে তোমার ঘুম ভাঙেনি। তুমি আগে থেকেই জেগে ছিলে, তাই না?”
পরী ওর বাঁধা হাতের মাঝে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বুকের ওপরে হাত রেখে চোখের দিকে তাকায়। পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভির মনে সংশয় জাগে, পরীর দু’চোখে সংশয়ের ছায়া। অভি ভুরু কুঁচকায় পরীর দিকে তাকিয়ে, “কি হলো?”
পরী উত্তর দেয়, “মৈথিলী তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু কারনে বলতে পারছিলো না।”
অভিঃ “পুরো ব্যাপারটা বলবে কি আমাকে?” পরীকে নিবিড় করে টেনে নেয় বুকের কাছে, “তোমার মনে ভেতরে এত চাপা উত্তেজনা কেন?”
পরী কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, “তোমার আর সুব্রতদার ব্যাবহারের জন্য আমি চাপা উত্তেজনায় ভুগছি। তুমি কি নিজে বুঝতে পারছো না, তুমি আসার পর থেকে এক বারের জন্যেও ওরা দুজনে তোমার সামনে আসেনি।”
দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে বলে, “ওরা আমার সামনে আসেনি তো আমি কি করতে পারি তাঁর জন্য।”
পরী অভির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি নিজে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতে পারো তো।”
অল্প বিরক্ত হয়ে ওঠে অভি, বাহুর বাঁধন আলগা করে নেয় পরীর কোমরের থেকে, “আমি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবো? আমি যদি আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে যাই তাহলে মনে হবে যেন আমি দোষী। আমি তো কিছু করিনি।”
পরী ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে বলে, “মেঘনা বৌদি আর মা, তোমাদের দুজনের মধ্যের এই ব্যাবধান নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। আমি কি উত্তর দেব ওদের?”
আরও একটা সিগারেট জ্বালায় অভি, বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে, “মৈথিলী তোমাকে কি বলেছে বা কি বলতে চেয়েছে?”
পরীঃ “কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল আমাকে, তবে কিছু না বলে শুধু আমাকে বললো যে, অভিকে বলে দিও আমি খুব পরিতপ্ত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে কি ঘটনা ঘটেছে। তাঁর উত্তর আমাকে শুধু বললো যে ও তোমার সামনে আসতে পারবে না। ওর মুখের পরিতাপের ছায়া ছিল।”
পরীর কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় অভির, “কি দরকার ছিল ওর ঘরে যাওয়ার?”
পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে অভির বকুনি শুনে, “আমি কি করতে পারি। আমাকে তো দেখাতে হবে যে আমি কিছু জানিনা। তুমি কেন কিছু না বুঝেই চেঁচাতে শুরু করে দাও আমার ওপরে?”
অভি দেখলো যে প্রেয়সী রেগে উঠেছে, হাত ধরে কাছে টেনে নেয় পরীকে, “ঠিক আছে যেকোন একদিন রাতে আমার সাথে দেখা করতে বলো। আর হ্যাঁ, ওয়াকম্যানটা আনতে ভুলবে না, আর তুমি আমার সাথে সেখানে উপস্থিত থাকবে।”
পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কেন? তুমি ওদের সাথে কথা বলবে, হয়তো আমি থাকলে ওরা ঠিক ভাবে খুলে কথা বলতে পারবে না।”
অভি ওর মাথার চুল আঁচড়ে বলে, “পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে, তাই না?”
অভির কোল ঘেঁসে বসে দুষ্টু, “হ্যাঁ, পরী পিসিকে খুব মনে পড়ে আমার। আমার সাথে খেলতো, আমাকে খাইয়ে দিতো, আমার চুল আঁচড়ে দিতো, স্নান করিয়ে দিতো আমাকে। ঘুম না পেলে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো পরী পিসি। পিসি চলে যাবার পরে আমার খুব একা একা লাগে।”
বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সেই ছোট্ট ছেলেকে, “তোর পরী পিসি কোথাও যায়নি।” ছোটো বুকের বাম দিকে আদর করে হাত রেখে অভি ওকে জানায়, “তোর পরী পিসি সর্বদা এখানে থাকবে।”
দুষ্টু ওর কথা শুনে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “পরী পিসির সাথে দেখা করার জন্য আমি তোমার বাড়ি যেতে পারি?”
অভির গলা ধরে আসে, “হ্যাঁ বাবা, তুই যখন খুশি আমার বাড়িতে আসতে পারিস। সারা জীবন আমার বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা।”
আনন্দের আবেগে দুষ্টু ওর গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, “তুমি না আমার সব থেকে ভালো কাকু, অভি কাকু।” নিষ্কলঙ্ক নিষ্পাপ সেই মিষ্টি হাসি দেখে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে।
সূর্য বেশ খানিকক্ষন আগেই ডুবে গেছে। মাথার ওপরে পাখীর কিচির মিচির, বাসায় ফিরে যাওয়ার তাড়া সবার। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে ওদের। জামা কাপড় পরে বাড়ি ফিরে আসে ওরা, সারাটা পথ, অভির হাত আঁকড়ে ধরে থাকে দুষ্টু। বাড়িতে ঢুকেই পরীকে দেখে লাফিয়ে কোলে চড়ে যায় আর কানে কানে কিছু বলে। পরী অভির দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে দুষ্টুর কথা শুনে হেসে ফেলে।
পরী ওকে বলে, “হ্যাঁ রে, তুই যখন তখন আমার বাড়িতে আসতে পারিস।”
বাড়িতে অভির উপস্থিতি যেন আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। বিশেষ করে সুব্রত আর অভির মধ্যে যে একটা মনোমালিন্য চলছে সেটা দিদা আর সুমন্ত মামার চোখ এড়ায় না। এক বিকেলে সুমন্ত মামা আর অভি বারান্দায় বসে মুড়ি আর চা খাচ্ছিল, সুমন্ত মামা ওকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি সুব্রতর বিয়ের সময়ে ওর সাথে সারা রাত ছিলে, তাই না?”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অভি জানায়, “হ্যাঁ ছিলাম।”
সুমন্ত মামাঃ “তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, তোমরা দুজনে একে অপরের সাথে ঠিক করে কথা বলছো না কেন? বউমাকেও তোমার সামনে বের হতে দেখলাম না, কি ব্যাপার?”
অভি ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। চা মুড়ি খাওয়া ভুলে যায় অভি, কিছুক্ষণ মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে মামা কতটুকু খবর জানেন।
তারপরে অভি চালাকি করে উত্তর দেয়, “হয়তো আমার কোন কথায় একটু বোঝার ভুল হয়ে থাকবে, আমি আমার দিকে থেকে ঠিক আছি। অপেক্ষা করছি ও কখন আমার সাথে কথা বলে। যদি কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের মধ্যে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”
সুমন্ত মামা মাথা দোলায়, “ঠিক কথা, এখুনি ওকে ডেকে কথা বলা যাক।” তারপরে সুমন্ত মামা চেঁচিয়ে সুব্রতকে ডাক দেয়, “সুব্রত বারান্দায় আয় একবার, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
সুমন্ত মামার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে সুব্রত, এসেই দেখে দাদার পাশে অভি বসে। ওকে দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুব্রত। দু’চোখে ভয় আর বিতৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে এসেছে সুব্রতর, ধির পায়ে সুমন্ত মামার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ভয়ার্ত গলায় মাথা নিচু করে সুমন্ত মামাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “কি হয়েছে দাদা?”
সুমন্ত মামা একবার অভির দিকে তাকায় তারপরে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই অভির সাথে কথা বলছিস না কেন? তোদের মধ্যে কোন মনোমালিন্য হয়েছে নাকি?”
অভি অনুধাবন করে যে এখুনি সুব্রতকে বিব্রত করা বিচক্ষণের কাজ নয়। অভি সুব্রতর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বলে, “কিছু হয়নি, তাই না মামা। সব ঠিক আছে।” সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “সুব্রত হয়তো সময় পায়নি কথা বলার, নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই, বউকে নিয়ে ব্যাস্ত আছে।”
অভির কথা শুনে সুব্রতর বুকের থেকে এক বিশাল পাথর সরে যায়, স্বস্তির শ্বাস নেয় সুব্রত। কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
কিছু পরে সুমন্ত মামা অভিকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী তোমাদের বাড়িতে ঠিক আছে তো?”
অভি সুমন্ত মামার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার বাড়ি আর কোথায়, এখন তো ওটা পরীর বাড়ি। মাকে ছোটো মা বলে ডাকে বাবাকে বাবু।”
সুমন্ত মামাঃ “আমি কাউকে ঠিক ভাবে দেখতে পারিনি সেই সময়ে। কি করবো, বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমাকেই কাজে নামতে হয় পেটের ভাত যোগাড় করার জন্য। আমি যখন সময় পেলাম মাথা তুলে তাকানোর, ততদিনে আমার সেই মিষ্টি ছোট্ট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে। মাথা তুললাম বটে, কিন্তু আমার কথা আর কেউ শোনেনা। এই পৃথিবী কাঁচের ঝকমকিতে উজ্জ্বল, অভি। আসল হীরের মর্যাদা বোঝে না, আসল হীরে তো চমকায় না, না কাটা পর্যন্ত শুধু একটা সাদা পাথর মাত্র। কিন্তু কাঁচ, কাটা হোক বা আস্ত হোক, সর্বদা চমকায়।”
অভিঃ “এসব কথা কেন বলছো মামা?”
সুমন্ত মামাঃ “তোমার মা, উলুপিদি আর আমাদের পরিবার; আমাদের মাঝে রক্তের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই, হ্যাঁ, অনেক দূর সম্পর্কের দিদি হন উলুপিদি। এই বাড়িতে থাকতেন কেননা তুমি তখন ওনার পেটে আর ওনার স্কুল এখানে তাই। সেই সম্পর্ক না থাকার পরেও তিনি যা করেছেন সেই সময়ে আমাদের নিজের কোন আত্মীয় আমাদের জন্য করেনি।”
অভিঃ “মামা, ছাড়ো ওসব কথা, পরী এখন ভালো আছে, আনন্দে আছে।”
সুমন্ত মামাঃ “হ্যাঁ ওর মুখের হাসি দেখে মনে শান্তি লাগে। তবে ভয় হয়, কতদিন ওই হাসি ওর মুখে থাকবে।”
অভিঃ “কেন? হাসি কেন চলে যাবে, এই রকম কেন ভাবছো তুমি?”
সুমন্ত মামাঃ “মেয়ে হয়ে জন্মেছে, একদিন না একদিন বিয়ে করে পরের বাড়ি চলে যাবে। কে জানে, ভাগ্য বিধাতা কি লিখে গেছে ওর কপালে।”
অভিঃ “ওর মুখে হাসি ফুটুক, এটা তুমি চাও, এইতো।” সুমন্ত মামা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” অভি বলে, “ও যেখানে আছে এখন বড় ভালো আছে, শান্তিতে আছে। তুমি চিন্তা কোরোনা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
সুমন্ত মামাঃ “অভি, এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর।”
অভিঃ “মামা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি যতদিন ওর পাশে আছি ততদিন ওর কিছু হতে দেব না।”
মামা কি বুঝলো জানেনা, ম্লান হেসে অভিকে বললেন, “কতদিন, কতদিন থাকবে ওর পাশে তুমি? এক না এক দিন তো বিয়ে করে ওকে চলে যেতে হবে।”
মনে মনে বলে অভি, “না মামা, পরী কোনদিন আমার চোখের সামনে থেকে যাবেনা, তুমি একবার বলো, আমি কোনদিন ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেব না।” সুমন্ত মামাকে মজা করে বলে, “মামা, চিন্তা কোরোনা, পরী কোথাও যাবে না, সর্বদা তোমার ছোটো বোন, তোমার বুকের কাছেই থাকবে। যেখানেই থাকুক না কেন, বড় সুখে থাকবে ও।”
একদিন রাতে, অভি ছাদে উঠে সিগারেট টানছিল। মাথার ওপরে অন্ধকার, গাড় নীল আকাশের বুকে অজস্র নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। গীষ্মের রাতের দখিনা বাতাস ওর মন বিচলিত করে তোলে। বাড়ির সবাই হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, সময় প্রায় মধ্যরাত্রি। অভি দিগন্তের দিকে তাকায়, দিগন্তে কালো কালো নারকেল গাছ যেন ভুতের মতন মাথা দুলিয়ে ওকে কাছে ডাকে। পাশে কোথাও কোন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুরে রাস্তার মোড়ে একটা কুকুর ডেকে ওঠে মনে হয় বিড়াল দেখে তাড়া করেছে কুকুরটা।
সিগারেট শেষে, অভি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই সামনে পরীকে দেখে অবাক হয়ে যায়। আকাশের বাঁকা চাঁদের মৃদু আলোয় পরীর সুন্দর মুখ যেন গাঁদা ফুলের মতন দেখায়। পরী ওর দিকে হেসে বলে, “কি রে দুষ্টু ছেলে, ঘুম আসছে না?”
অভি পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে নিয়ে নিজের দিকে টেনে আনে, “শয়তান হাড়গিলে, তোরও তো ঘুম আসছে না।”
ছাদে উঠে, ছাদের এককোনে পরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নরম পেটের ওপরে আদর করে অভি আর পেছনে মাথা হেলিয়ে ওর হাত দুটি ধরে দাঁড়িয়ে আদর খায় পরী। অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের অপরূপ দৃশ্যে হারিয়ে যায়।
মৃদুকন্ঠে বলে পরী, “এত রাতে ছাদে কি করছিলে?”
গালে গাল ঘষে উত্তর দেয়, “তোমারও তো ঘুম আসছিল না, কেন জেগে?”
পরীঃ “সিঁড়িতে তোমার পায়ের শন্দ শুনে দেখতে এলাম তুমি কি করছো।”
অভিঃ “মিথ্যে বোলোনা সোনা, পায়ের শব্দে তোমার ঘুম ভাঙেনি। তুমি আগে থেকেই জেগে ছিলে, তাই না?”
পরী ওর বাঁধা হাতের মাঝে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বুকের ওপরে হাত রেখে চোখের দিকে তাকায়। পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভির মনে সংশয় জাগে, পরীর দু’চোখে সংশয়ের ছায়া। অভি ভুরু কুঁচকায় পরীর দিকে তাকিয়ে, “কি হলো?”
পরী উত্তর দেয়, “মৈথিলী তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু কারনে বলতে পারছিলো না।”
অভিঃ “পুরো ব্যাপারটা বলবে কি আমাকে?” পরীকে নিবিড় করে টেনে নেয় বুকের কাছে, “তোমার মনে ভেতরে এত চাপা উত্তেজনা কেন?”
পরী কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, “তোমার আর সুব্রতদার ব্যাবহারের জন্য আমি চাপা উত্তেজনায় ভুগছি। তুমি কি নিজে বুঝতে পারছো না, তুমি আসার পর থেকে এক বারের জন্যেও ওরা দুজনে তোমার সামনে আসেনি।”
দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে বলে, “ওরা আমার সামনে আসেনি তো আমি কি করতে পারি তাঁর জন্য।”
পরী অভির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি নিজে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলতে পারো তো।”
অল্প বিরক্ত হয়ে ওঠে অভি, বাহুর বাঁধন আলগা করে নেয় পরীর কোমরের থেকে, “আমি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবো? আমি যদি আগ বাড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলতে যাই তাহলে মনে হবে যেন আমি দোষী। আমি তো কিছু করিনি।”
পরী ওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে বলে, “মেঘনা বৌদি আর মা, তোমাদের দুজনের মধ্যের এই ব্যাবধান নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। আমি কি উত্তর দেব ওদের?”
আরও একটা সিগারেট জ্বালায় অভি, বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে, “মৈথিলী তোমাকে কি বলেছে বা কি বলতে চেয়েছে?”
পরীঃ “কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল আমাকে, তবে কিছু না বলে শুধু আমাকে বললো যে, অভিকে বলে দিও আমি খুব পরিতপ্ত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে কি ঘটনা ঘটেছে। তাঁর উত্তর আমাকে শুধু বললো যে ও তোমার সামনে আসতে পারবে না। ওর মুখের পরিতাপের ছায়া ছিল।”
পরীর কথা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় অভির, “কি দরকার ছিল ওর ঘরে যাওয়ার?”
পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে অভির বকুনি শুনে, “আমি কি করতে পারি। আমাকে তো দেখাতে হবে যে আমি কিছু জানিনা। তুমি কেন কিছু না বুঝেই চেঁচাতে শুরু করে দাও আমার ওপরে?”
অভি দেখলো যে প্রেয়সী রেগে উঠেছে, হাত ধরে কাছে টেনে নেয় পরীকে, “ঠিক আছে যেকোন একদিন রাতে আমার সাথে দেখা করতে বলো। আর হ্যাঁ, ওয়াকম্যানটা আনতে ভুলবে না, আর তুমি আমার সাথে সেখানে উপস্থিত থাকবে।”
পরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কেন? তুমি ওদের সাথে কথা বলবে, হয়তো আমি থাকলে ওরা ঠিক ভাবে খুলে কথা বলতে পারবে না।”