What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (11 Viewers)

নাকের ওপরে নাক ঘষে আলতো করে বলল “সুকন্যাদিকে জিজ্ঞেস করে এসো?”

আমি দিমের ঠোঁটের ওপরে আলতো চুমু খেয়ে বললাম “পরে বলবো।” আমি দিমের কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেই, পেলব দু’ জঙ্ঘা ফাঁকা করে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। আমার পুরুষ শলাকা কঠিন হয়ে ঠিক দিমের নারীত্বের ওপরে চেপে বসে। কোমল যোনি অধরে আমার শলাকার পরশ পেয়ে কেঁপে ওঠে দিম, আলতো শীৎকারে বলে ওঠে “অনি আমি তোমার... শুধু তোমার জন্য...”

আমি বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিলাম দিমের টিশার্টের ভেতরে, ওর পিঠের ওপরে হাত বোলাতে শুরু করলাম আমি। ডান হাতে নিচে নেমে ওর নিটোল নিতম্বের ওপরে এক থাবা কোমল নারী মাংস নিয়ে টিপতে শুরু করলাম। দু হাত খামচে ধরে আমার জামার কলার, একটানে ছিঁড়ে ফেলে সব বোতাম, ভেতরে খালি বুক, পিষে দিল নিজের কোমল স্তন আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে। আমি ওকে ছেড়ে জামা খুলে ফেললাম, খালি বুক দেখে দু কাঁধে হাত রাখলো দিম। নিজের নিম্নাঙ্গকে আরও জোরে চেপে ধরলো আমার বজ্রকঠিন লিঙ্গের ওপরে। আমি ওর কোমরের দুপাশে হাত রেখে আস্তে আস্তে টিশার্টটাকে ওপর দিকে নিয়ে গেলাম, ধিরে ধিরে নধর স্তনের ওপর থেকে পর্দা সরে গেল। দু’হাত ওপরে করে টি’শার্টটা গায়ের থেকে খুলে ফেললো দিম। আমার মতন ওর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, আমার চোখের সামনে দিমের সুগোল ফর্সা স্তন। দিম আমার মাথা বাঁ হাতে জড়িয়ে আর পিঠের পেছনে ডান হাত দিয়ে নিজেকে আমার বুকের ওপরে চেপে ধরল। আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে দিমে কোমল স্তন পিষে থেঁতলে গেল। দিমের দু’ বুকের মাঝে ফুটে ওঠা দুটি বৃন্ত যেন আমার বুকের ওপরে দাগ কাটছে। কঠিন স্তনবৃন্ত যেন উতপ্ত নুড়ি পাথর, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে আমার বুক।

আমি তৃষ্ণার্ত চাতকের মতন ওর ঘাড়ে, গলায় শত সহস্র চুম্বন বরিষণ করতে থাকি। দু’হাতের থাবায় খামচে ধরি দিমের কোমল দুটি নিতম্ব, পিষে আদর করতে শুরু করে দেই আমি। বুঝতে পারি যে দিম প্যান্টি পরেনি, আমি ওর নিতম্ব টেনে কোমর নাড়িয়ে দিমের জঙ্ঘা মাঝে আমার লিঙ্গ দিয়ে ঘষতে শুরু করে দেই। দু’জনার পরনে শুধু মাত্র প্যান্ট। দিম দু’পায়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে, আমি ওর নিতম্বের নিচে থাবা রেখে ওকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে দেই। আমি উঠে দাড়াই, আমার কোলের ওপরে দিম।

আমি দিমকে বিছানায় শুইয়ে দেই, দিম আমার কোমরের হাত রেখে আমার প্যান্ট নিচে নামিয়ে দেয়। আমি প্যান্ট খুলে ওর সামনে উলঙ্গ হয়ে যাই। সটান বেরিয়ে পড়ে আমার কঠিন সিংহ বাবাজীবন। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শায়িত রমণীর পায়ের ফাঁকে তাক করা। ওর পাজামার ওপরে দিয়ে ওটা যোনির আকৃতি দেখে আমার লিঙ্গ আরও বেশি শক্ত হয়ে ওঠে। আমি ওর যোনির ওপরে আলতো করে হাত রেখে আদর করে দেই।

যোনির ওপরে আমার কঠিন আঙুলের পরশ পেয়ে প্রেমঘন স্বরে বলে “অনি, আমি ভার্জিন।”

আমি হেসে বলি “ডোন্ট ওরি দিম, আমি তোমাকে সুন্দরী করে তুলবো।” ডান হাতের আঙুল দিমের নারীত্বের গহ্বর খুঁজে পেয়ে গেছে। আমার আঙুল দিমের যোনির চেরায় ওপর নিচে খেলতে শুরু করে দেয়। দিম কোমর নাড়াতে থাকে আমার হাতের তালে তালে। ভিজে উঠেছে পাজামা, ঠিক যোনির জায়গায়। আমি বাঁ হাত দিয়ে দিমের কোমল গোল পেটের ওপরে রেখে আদর করতে শুরু করি। দিম দু’হাতে নিজের বুক পিষে ধরে ডলতে শুরু করে দেয়। আমি দিমের পাজামা কোমরের থেকে নিচে নামাতে শুরু করি, ধিরে ধিরে চোখের সামনে দিমের যোনি উন্মিলিত হয়। মসৃণ ত্বক, রুমের আলোতে পিছলে যাচ্ছে, এক কণা রোঁয়া নেই দিমের যোনি প্রদেশে। দু অধর মাঝের চেরা দেখতে বড় সুন্দর লাগে, মনে হলো এই নারীর ভালবাসার গহ্বরে নিজেকে সঁপে দিয়ে জীবন কাটিয়ে দেই। খুলে ফেলি দিমের পাজামা, চোখের সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ আমার প্রানের রাজকন্যে, ধবধবে সাদা নরম বিছানায় শুয়ে আছে যেন এক জলপরী, সদ্য যেন জল থেকে উঠে এসেছে আর কামনার আগুনে কাঁপছে।

আমি আমার শরীরটাকে বিছানার ওপরে টেনে তুলে ওর পাশে শুয়ে পড়ি। শায়িত দিমের মুখের ওপরে ঝুঁকে ওর ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে দীর্ঘ একটি চুম্বন দেই। আমার ডান হাতের আঙুল, দিমের যোনি ছাড়িয়ে ওপরে ওঠে। আমার মধ্যমা আর অনামিকা ভিজে গেছে দিমের যোনি রসে। আমি ওর গভীর নাভির ওপরে সিক্ত আঙুল দিয়ে আদর করে দেই। নিজের মধুতে সিক্ত আমার কঠিন আঙুলের পরশে কেঁপে ওঠে দিম। আমি ওর ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে মুখ নামিয়ে আনি ওর ঘাড়ের ওপরে, চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকি ওর গলা, ওর ওপর বক্ষ। দিম নিজের পুরুষ্টু থাই একে অপরের সাথে দলিত করতে শুরু করে দেয়। কামাগ্নি জ্বলে উঠেছে আমাদের শিরায় শিরায়।

আমি মুখ নামিয়ে আনি দিমের বাম স্তনের ওপরে, ফর্সা গোল স্তনের মাঝে বাদামি বৃত্ত, তার মাঝে উদ্ধত স্তন বৃন্ত যেন তপ্ত নুড়ি পাথর। আমি চেয়ে রই দিমের স্তনের দিকে, ক্ষীণ নীল শিরা বৃত্তের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে যেন সূর্য কিরনের ছটা। আমি জিব বের করে আলতো করে স্তন বৃন্তের ওপরে চেটে দেই, শীৎকার করে ওঠে দিম “অনি আমাকে পাগল করে দিলে তুমি...” শীৎকার শুনে ঠোঁট চেপে ধরি স্তনের ওপরে, ঠোঁট খুলে মুখের মধ্যে যত বেশি স্তন নেওয়া যায় নিয়ে পাগলের মতন চুষতে শুরু করে দেই। দিম আমার মাথা দু’হাতে চেপে ধরে স্তনের ওপরে, আমি স্তনের বৃন্ত, কোমল নারী মাংস সমেত মুখের মধ্যে পুরে ক্ষুধার্ত শিশুর মতন কামড় চোষণ শুরু করে দেই। দিম থেকে থেকে শীৎকার করে ওঠে “খেয়ে ফেল আমাকে, নিঙড়ে নাও যা রস আছে আমার মধ্যে......”

আমি ওর স্তন ছেড়ে মুখ নিচের দিকে নামিয়ে আনি ওর গোল পেটের ওপরে। ঠোঁট যত নিচে যায়, সাথে যায় আমার জিবের থেকে নির্গত লালার ধারা। সারা পেটের ওপরে ছোটো ছোটো চুমু আর জিব দিয়ে এঁকে দেই আমার ভালবাসার ছবি। নাভির চারদিকে আলতো করে জিবের ডগা দিয়ে ভিজিয়ে দেই কোমল মসৃণ ত্বক। জিবটা একবার নাভির গভীরে ঢুকিয়ে চেটে দেই আমি। “উফফফ... আমি পারছিনা আর অনি...” আমার বাঁ হাত ওর ডান স্তনের ওপরে উঠে চেপে ধরে ওর কোমল মাংস। কাটা মাছের মতন ছটফট করতে শুরু করে দেয় দিম। আমি ওর বাঁ জঙ্ঘার ভেতরে হাত রেখে ঠেলে সরিয়ে দেই, খুলে যায় জুড়ে থাকা জঙ্ঘা। আমার ডান হাতের আঙুল দিয়ে ওর বাম থাইয়ের ভেতরের কোমল ত্বকের ওপরে হাঁটু থেকে যোনির পাশ পর্যন্ত আঁচড় কেটে দেই। বারে বারে কঁকিয়ে ওঠে দিম। আমি বিছানা থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসি ওর ফাঁক করা থাইয়ের মাঝে। চোখের সামনে যোনির চেরা নারী রসে সিক্ত হয়ে পাপড়ি দুটি চিকচিক করছে। আমি দু’হাতের তালু সমান করে ওর কোমল পেটের ওপরে চেপে ধরি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, দিমের দু’চোখ বন্ধ, দু’হাত মাথার ওপরে ভাঁজ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে আছে। অধীর প্রতীক্ষায় দিম ক্ষণ গুনছে কখন আমি ওর নারী গহ্বরে চুম্বন আঁকবো।

আমি মুখ নামিয়ে আনি ওর ফোলা যোনির ওপরে, আলতো করে চুমু খাই চেরাটার ঠিক ওপরে। চুম্বন স্পর্শে কোমর তুলে আমার ঠোঁটের ওপরে ধাক্কা মারে দিম। শীৎকার করে ওঠে “কি করছো তুমি, এত কেন পাগল করছো আমাকে...”

আমি দু’হাতে ওর দুই স্তন চেপে ধরি, পিষে ফেলি নরম তুলতুলে বক্ষ। দুই আঙুলের মাঝে স্তন বৃন্ত নিয়ে ডলে দেই, বারংবার কেঁপে ওঠে দিমের পেলব শরীর। ঠোঁট নামিয়ে আনি আমি ওর যোনির চেরায়, জিব বের করে চেটে দেই আমি ওর গহ্বরের ফটক। আমার জিবে লাগে ওর যোনি সুধা, এক মত্ত ঘ্রাণ নির্গত হয় ওর শরীর থেকে। বারবার ওপর থেকে নিচে আমার পিপাসু জিব খেলতে থাকে দিমের যোনির চেরায়। নরম জিবের পেশি শক্ত করে নিয়ে আমি পাপড়ি মাঝে প্রবেশ করিয়ে দেই। শীৎকার করে ওঠে দিম “না না না... প্লিস চেটো না ঐ রকম ভাবে...”

কাটা মৎস্য কন্যে জলের থেকে বের হয়ে আমার বিছানার ওপরে কামাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে ছটফট করছে। আমি ওর শীৎকারে কান না দিয়ে জিব দিয়ে খেলতে শুরু করি যোনির অভ্যন্তরে। প্রবল ভাবে কোমর নিতম্ব নাড়াতে থাকে দিম, চেপে ধরে আমার মাথা নিজের যোনির ওপরে। আমার লোলুপ জিব খুঁজে পায় দিমের যোনির ওপরে ফুটে ওঠা ভগাঙ্কুর, আমি জিব দিয়ে নাড়িয়ে দেই ছোটো দানাটাকে। দিমের শরীর বেঁকে যায় ধনুকের মতন, ছটফট করে দিম আমার নিচে, ঠোঁট চেপে ধরি আমি ওর ভেসে যাওয়া যোনির ওপরে। একের পর এক ঢেউ খেলে যায় দিমের শরীরের ওপরে। শীৎকারে শীৎকারে মুখর হয়ে ওঠে রুমের বাতাস। আমার কামুক জিব থামেনা, চেটে চুষে দিমের যোনি রসে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে থাকি, আমার ঠোঁট, আমার চিবুক ভিজে যায় দিমের নারী মধুতে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় দিমের সারা শরীর টানটান হয়ে যায়, উন্মত্ত হরিণীর মতন মাথা দিয়ে বালিশে মারতে থাকে দিম। কেঁপে ওঠে দিম, থরথর করে, যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে, হটাৎ করে আমার মাথা ছেড়ে দিয়ে প্রানহীন কান্ডের মতন লুটিয়ে পড়ে বিছানার ওপরে।

আমি নিজেকে টেনে তুলে ওর পাশে শুয়ে পড়ি, ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে নিজের ওপরে শুইয়ে দেই। দিমের যেন কোন হুঁশ নেই, বেহুঁশ হয়ে থাকা কোমল দিমের মাথা আমার বুকের ওপরে, পা’দুটি আমার পায়ের দু দিকে ছড়ানো। আমার কঠিন দাঁড়িয়ে থাকা লিঙ্গ দিমের জঙ্ঘা মাঝে আলতো করে আঘাত করে। দিম হাঁপাচ্ছে, হাঁপরের মতন ওঠা নামা করছে পিঠ, নরম স্তন আমার বুকের ওপরে থেঁতলে আছে। আমি ওর পিঠের ওপরে হাত বোলাতে থাকি। মাথা না উঠিয়ে, আবেগ মাখানো সুরে বলে “তুমি আমাকে পাগল করে দিলে... আমার সব কিছু কেমন ভাসা ভাসা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।” দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথা তুলে বুকের ওপরে ঠোঁট দিয়ে এঁকে দেয় ভালোবাসার ছবি।

আমি ওর নিতম্বের ওপরে হাত নিয়ে গিয়ে ধিরে ধিরে পিষতে শুরু করি কোমল মাংস। দিমের আগুন আবার জ্বলে ওঠে। যোনির চেরায় আমার উত্তপ্ত কঠিন লিঙ্গ ধাক্কা মারে। চোখ বন্ধ করে মাথা নামিয়ে নেয় দিম আমার মাথার ওপরে, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে উষ্ণ প্রশ্বাস ছেড়ে বলে “অনি আমি ভার্জিন।”

আমি ওকে বলি “দিম সোনা, আই উইল টেক কেয়ার অফ মাই হানি।”
আমি ওর কোমর জড়িয়ে ধরি, ওকে নিচে শুইয়ে দেই। দিম আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আধ বোজা চোখে। আমি ওর জঙ্ঘা দুটি ফাঁক করে মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি। একটা বালিশ টেনে এনে, ওর কোমরের নিচে রেখে দেই, তার ফলে দিমের কোমর আর নারীত্বের গহ্বর আমার লিঙ্গের সমান্তরালে চলে আসে। আমি বাঁ হাতে দিমের ডান পা ধরে আমার বুকের ওপরে নিয়ে আসি। ডান মুঠিতে নিজ লিঙ্গটাকে ধরে দিমের যোনির চেরায় আলতো করে ছোঁয়াই। পাপড়ি সরিয়ে সিংহের মাথা প্রবেশ করে দিমের নারীত্বের গহ্বরে। দিম আমার পেটের ওপরে হাত রেখে ঠেলে দেয় আমাকে শীৎকার করে ওঠে দিম “উফফফ... এটা কি... অনি...”

আমি কিছুক্ষণ থেমে যাই, চেয়ে থাকি খাবি খাওয়া মৎস্যকন্যের দিকে, একটু একটু করে নিজেকে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করি আমি। ধিরে ধিরে সিংহ মহারাজ প্রবেশ করে যাঁতার মতন চেপে ধরা যোনি গহ্বরে। ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে দিম “না আর পারছিনা... মেরে ফেললে যে আমাকে...” আমি আবার থেমে যাই, দিম দু হাতে আমার পেটের পেশি খিমচে ধরে। দশ খানি নখ আমার পেশিতে বসে গেছে। আমি ওর ডান পা ছেড়ে দিয়ে দিমের শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়ি। দিমের বগলের তলা দিয়ে দু’হাত মাথার দুপাশে নিয়ে মাথা তুলে ধরি। ঠোঁটের ওপরে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াই আমি। সিংহ মহারাজ এখন সম্পূর্ণ গুহায় প্রবিষ্ট হয়নি। দিম ভাসা ভাসা নয়নে আমার দিকে চোখ মেলে তাকায়, ফিসফিস করে বলে “এত গরম আর শক্ত হয় নাকি?”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি “এখনো তো বাকি আছে দিম।”

চোখ বড় বড় করে বলে “মানে...?”
 
হটাৎ করে কোমর নাড়িয়ে পিষে দেই দিমের নিমাঙ্গ, সম্পূর্ণ প্রবিষ্ট হয় লৌহ শলাকা, দিমের সিক্ত গহ্বরে। ঠোঁট কামড়ে সামলে নেয় দিম, তারপরে প্রেমঘন স্বরে বলে “আমি আর পারছিনা যে অনি, আমি মরে যাবো এখানে...” আমি ওর নাকের ওপরে নাক ঘষে, আলতো করে ঠোঁটে চুমু খেলাম। ধিরে ধিরে আমার কোমর নড়তে লাগলো, সিংহ মহারাজ তার রানীর সাথে আদিম কেলিতে রত হলো। মন্থন শক্তি ধিরে ধিরে গতি নিতে শুরু করে, সারা শরীরে থেকে থেকে ঢেউ খেলে যায়। দিম শীৎকার করে বলে “অনি তোমারটা তো আমার পেটে গিয়ে ধাক্কা মারছে গো, আমার মাথা পর্যন্ত আমি তোমাকে অনুভব করতে পারছি...”

সারা ঘরে শুধু বাসনা আর প্রেমের সুবাস ভুরভুর করছে। আমার মন্থনের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলেছে। প্রত্যেক প্রবিষ্ট মন্থনের তালে তালে দিম কোমর দিয়ে ওপরে ঠেলে ধরে, নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রবল চেষ্টা চালায়। উত্তপ্ত লিঙ্গের ত্বকের ওপরে আমি দিমের সিক্ত কোমল যোনির পরশ বারে বারে অনুভব করি। যোনি গহ্বর যেন আমার লিঙ্গটাকে আঁকড়ে ধরে আছে যাঁতা কলের মতন, সিংহ বাবাজীবনকে বের করতে গেলে যেন আরও চেপে ধরে দিম নিজের অভ্যন্তরে। দিম দু পায়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে, পেলব জঙ্ঘা আমার কোমরের সাথে সাপের মতন পেঁচিয়ে যায়। আমার নিতম্বের ওপরে মন্থনের তালে তালে দিম নিজের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করে। দু’হাতে লতার মতন জড়িয়ে ধরে আমাকে, শীৎকার করে ওঠে দিম “আমার আবার কিছু হচ্ছে অনি, জড়িয়ে ধরো আমাকে, পিষে নিঙড়ে ছিঁড়ে ফেলো আমাকে... আমি চোখে আলো দেখছি অনি... আমি কোথায় অনি... আমার শরীরে একি হচ্ছে...”

মন্থনের গতি তীব্র হয়ে ওঠে ওর প্রেমঘন শীৎকার শুনে, হাতের মুঠোতে আমি ওর মাথার পেছনের চুল শক্ত করে ধরি, আর শরীরের সারা শক্তি দিয়ে মন্থন করে চলি আমি। আমার শিরদাঁড়ায় তরল লাভা বইতে শুরু করে, সে লাভা পৌঁছে যায় আমার তলপেটের দিকে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি দিমকে “আই লাভ ইউ দিম... আই রিয়ালি লাভ ইউ...” প্রচণ্ড উত্তেজনায় বেঁকে যায় দিম, দশ আঙুলের নখ বসিয়ে দেয় আমার পিঠের ওপরে, আমার সারা শরীর দুমড়ে মুচড়ে ওঠে, গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ভালোবাসার পাত্রীকে বিছানার সাথে চেপে ধরি আমি। ফেটে যায় আমার ভেতরের আগ্নেয়গিরি, ঝলকে ঝলকে নির্গত হয় লাভা, ধেয়ে যায় মতস্যকন্যের সিক্ত গহ্বরে। মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দুটি চাতক চাতকীর নির্যাস।

প্রেমে শৃঙ্গার শেষে আমি দিমের ওপর থেকে নেমে ওর পাশে শুয়ে পড়ি। দিম আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকের ওপরে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে দেয়। প্রচণ্ড শৃঙ্গারে কপোত কপোতীর রোম রোম হতে ঘামের বিন্দু একে অপরকে স্নান করিয়ে দেয়। আমি দিমের পিঠের ওপরে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকি, দিম শক্তি হারিয়ে ঝরা লতার মতন আমাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে বুকের ওপরে।

এত আদর কোথায় ছিল বিগত চোদ্দ বছরে, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। কেন আমি খুঁজে পাইনি তোমাকে, দিম?

দিম মাথা উঠিয়ে আমার বুকের বাঁদিকে, ঠিক হৃদয়ের ওপরে চুমু খেয়ে বলে “সুকন্যাদি, আমি কোনদিন তোমার স্থান নেবো না, শুধু আমাকে একটু থাকার জায়গা দেবে এখানে?”

=======সমাপ্ত=======
 
রোদে ভেজা তিলোত্তমা
pinuram

(১)

তুমি কি রোদে ভিজতে পারো? আমরা কিন্তু রোদে ভিজেছিলাম। সেসময়ে কলকাতা, কল্লোলিনী তিলোত্তমা ছিলো, আজকের মতন ব্যাঙের ছাতা হয়ে যায়নি। ময়দানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে গঙ্গার জোলো বাতাসে বুক ভরে উঠতো। আউট্ট্রাম ঘাট তখন বাঁধানো ছিল না, গঙ্গার পাড়ে সোঁদা মাটির ওপরে বসে চিনে বাদাম কিনে চিবোতে চিবোতে দু পায়ের নিচে দোল খেতো গঙ্গার জল। ভিক্টোরিয়ার সামনে থেকে দোতলা বাসের সামনের সিটে চেপে সোজা শ্যামবাজার আসার একটা আলাদা মজা ছিল। রাজাবাজার ট্রামডিপো থেকে দৌড়ে ট্রাম ধরে কলেজ স্ট্রীট যাবার এক আলাদা আনন্দ ছিল সেই সময়ে। মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের জায়গা নিলো রকমারি কেক প্যাস্ট্রির দোকান। প্রেসিডেন্সির ঠিক সামনে ফুচকাওয়ালার হাতের ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা হতো। বই কিনতে সবাই বই পাড়ায় যেতো, আজকের দিনের মতন মোবাইলে ইন্টারনেট খুলে বই অর্ডার করতো না। বই পাড়ায় ঢুকলেই নতুন বইয়ের গন্ধ হারিয়ে গেছে আজ। কাকভোরে বাড়ির চাকর হরি কাকা বেরিয়ে পড়তো হাতে থলে নিয়ে দুধ আর রাজারহাটের ভেড়ি থেকে তুলে আনা রুই কাতলা শোল মাগুর কিনে আনতো। সেই কাঁচের বোতলের হরিণঘাটার দুধ হারিয়ে গেছে। আজ নিউটাউনের তলা থেকে সেই রুই কাতলার আর্তনাদ শয়ে শয়ে গাড়ির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেছে। মনে আছে সেবার বর্ষাকালে যদুবাবুর ঘাটে এক জেলের জালে এক জোড়া ইলিশ উঠেছিল, একশো টাকা দাম চেয়েছিল, খবরের কাগজে সেই ছবিও এসেছিল। ছোটকাকা পরেরদিন হেসে বাবাকে বলেছিল “তোমাকে বলেছিলাম এবারে এই গঙ্গায় ইলিশ উঠবে।” সেই ইলিশের আর দেখা মেলেনা, সবুজ রঙের জল ধিরে ধিরে কালো রঙ নিয়েছে।

মনে আছে একবার দুর্গাপুর থেকে হাওড়া নেমে দেখি হাওড়া ব্রিজে বিশাল জ্যাম, হেঁটে হেঁটে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে চিৎপুর রোডে এসে টানা রিক্সা ধরলাম শিয়ালদা আসার জন্য। আজ সেই টুং টাং বেজে ওঠা টানা রিক্সা হারিয়ে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে অসংখ্য তিন চাকা ছোট ছোট অটো। বাতাসে শ্বাস নেওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন সময়ে খুব ভোরে ছোট পিসিমাকে নিয়ে শ্যামবাজারের হরি শার হাটে যেতাম। ভোরে আলো ফোটার আগেই সেই হাট বসে যেতো, দূর দূর থেকে লোকে আসতো কেনা বেচা করতো। ছোট পিসিমার টাকা থাকলেও একটা বাই ছিল কম দামে ভাল জিনিস কেনার, পিসেমশাই আর বাবা খুব বকতো তাও পিসিমা ছাড়তো না, মাসে একবার হরি শার হাটে গিয়ে জামা কাপড় কেনা চাইই। চলত গেঞ্জির দোকানির সাথে বচসা, দশ টাকায় দুটো গেঞ্জি। পিসিমা অনড় কুড়ি টাকায় সাতখানা নিয়েই ছাড়তো। হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ মাথার মোড়ে চলে যেতাম। ঠিক কোনায় একটা চায়ের দোকান ছিল, পিসিমা আমাকে চার আনা দিয়ে বলতো “যা পুটু, বাড়িতে তোর বাবা চা খেতে দেবে না ওই দোকানে খেয়ে আয়।” সেই চার আনায় এক খুরি ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের চুমুকের আনন্দ হারিয়ে গেছে সিসিডি, বারিস্তার মাঝে। পিসিমার সাথে সাথে সেই হরি শার হাটের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। শনিবারের দুপুরে মা কাকিমা জেঠিমা উঠানে বসে রেডিওতে যাত্রাপালা শুনতো, “শনিবারের বারবেলা...” শয়ে শয়ে মাল্টিপ্লেক্স আর ডিশ টিভির আড়ালে সেই বারবেলা হারিয়ে গেছে। দুপুরে এক ফেরিওয়ালা আসতো, ঠিক বাড়ির সামনে এসে হেঁকে যেতো, “হরেক মাল পাঁচ সিকা...” বাড়ির মগ বালতি রুটি সেঁকার জালি সব ওর কাছ থেকেই কেনা হতো। দু’ কান আর্তনাদ করে আবার সেই ডাক শোনার জন্য, সেই আওয়াজ আজ হারিয়ে গেছে।

মহালয়ার পরেই পাড়ার কর্তারা ধর্না দিতো কুমোরটুলিতে, কত দূর হল দুর্গা মায়ের মূর্তি। আজকের দুর্গা হারিয়ে গেছে কর্পোরেট কালচারে, সেই টানাটানা চোখের মাতৃময়ী মূর্তির জায়গা নিয়েছে এ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। ষষ্টির বোধনের আগে মায়ের চক্ষু দান, তার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখ থাকতো কাপড়ে ঢাকা। আমি, নবীন, পিতু, অনু, সুকন্যাদি, ছোড়দি সবাই রাত জেগে বসে থাকতাম, কখন নন্দন পাল এসে সেই চক্ষু দান করবে। বুড়ো নন্দন পালের সাথে সাথে সেই চক্ষু দানের অধির হয়ে বসে থাকা হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে পাড়ায় পাড়ায় পুজোর সময়ে গায়ক গায়িকারা আসতো, ষষ্টি থেকে বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে যেতো। নন্দ কাকিমা, সেন কাকিমা, জেঠিমা আর মায়ের হাতে রান্নার ভার পড়তো। একসাথে বসে পুজোর মাঠের ওপরে রঙিন সামিয়ানার নিচে বসে পাত পেড়ে খাওয়া দাওয়া চলতো দশমী পর্যন্ত। আজ ভিড় হয় শয়ে শয়ে গজিয়ে ওঠা ৩৬ বালিগঞ্জ প্যালেস, অহ ক্যালকাটা, ভজ হরি মান্না ইত্যাদি। মা জেঠিমার হাতের রান্না হারিয়ে গেছে এই বাঙালির মুন্সিয়ানা বাঙালি রেস্টুরেন্টের মাঝে।

বাড়ির পেয়ারা গাছে পেয়ারা হতো, গলির মুখের সেনেদের আম গাছে আম হতো, তার পাশের বাড়ির নন্দদের বাড়িতে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ ছিল। আজ সেই সবুজে ঢাকা পাতা ভরা গাছগুলো নেই, ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা রক্ত মাংসহীন সারি সারি বহুতল দাঁড়িয়ে। নীল আকাশ দেখা বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কল্লোলিনীর বুকে। সে সময়ে আগমনীর সুরের আগেই বৃষ্টি থেমে যেতো, আজকের দিনের গ্লোবাল ওয়ারমিং তখন এই কল্লোলিনীকে ছুঁতে পারেনি। শরতের নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াতো, আজকের দিনের মতন কালো বরষার মেঘের ঘনঘটা ছিল না। পুজোর বাজার করতো মা মাসি পিসিরা সবাই এক না হয় শ্যামবাজার, না হয় হাতিবাগান না হয় গড়িয়াহাট। আজকের দিনের ব্যাঙের ছাতার মতন গজানো এক হাজার এক শপিং মলে যেতো না। বিয়ের শাড়ি কিনতে সবাই কলেজ স্ট্রীট যেতো। ধিরে ধিরে জামা কাপড়ের দোকান বুটিক হয়ে গেল, নাপিত হয়ে গেল হেয়ার ড্রেসার আর দরজিগুলো ফ্যসান ডিজাইনারের তকমা লাগিয়ে নিল গায়ে। স্কুলের ছোট ছেলেরা ছাড়া কেউ হাফ প্যান্ট পরে বাইরে বের হতো না। ছোট মেয়েদের ফ্রক হাঁটু পর্যন্ত থাকলেও বড় মেয়েদের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা থাকতো। বিয়ের পরে মেয়েরা সে সময়ে জিন্স প্যান্ট পরে বের হতো না খুব একটা, বের হলে সবার চক্ষু লজ্জা বলে একটা ভাব থাকতো মনের মধ্যে। বরের সাথে দূর দেশে ভ্রমনে গিয়ে হাফ প্যান্ট পরার শখ, জিন্স প্যান্ট পরার শখ মিটাতো বাঙালি মেয়েরা। আজকের মতন পাছার একটু নিচে এসে তাদের স্কারট থেমে যেতো না। ছেলেরা বাড়িতে লুঙ্গি ছেড়ে বারমুডা পরা শুরু করে দিল, এমন কি বাজারে যেতে হলেও বারমুডা হাফ প্যান্ট। সেই চেক কাটা সাদা কালো নীল রঙের লুঙ্গি হারিয়ে গেল। আজ কাউকে লুঙ্গি পরতে দেখলে লোকে নিম্নবিত্তের মানুষ বলে। বসিরহাটের লাল সাদা ডোরা কাটা গামছার জায়গা নিল রকমারি রঙের তোয়ালে। ছেলেদের জিন্স নিচে নেমে এসে পাছার খাঁজের নিচে, দুই হাতে, কাঁধে পিঠে রঙ বেরঙের উল্কি আঁকা। মেয়েদের স্কারট দুধ খাওয়া বাচ্চার প্যান্টের চেয়ে একটু ছোট, ঝুঁকলেই দেখা যায় সত্যি কিছু পরেছে নিচে না একদম খালি।

কলেজের ফারস্ট ইয়ারে পড়ার সময়ে আমি, দেবু আর পচা মিলে খান্নার কাছে একটা গলির মধ্যের মদের দোকান থেকে মদ কিনে খেয়েছিলাম। ভয়ে সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারিনি তিন বন্ধু, বরানগরের কাছে কুঠির ঘাটের পোড়ো মন্দিরের চাতালে ঘুমিয়ে কাটিয়ে ছিলাম। সকাল বেলায় ওই গঙ্গার ঘাটে হাত মুখ ধুয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। সে সময়ে মোবাইল ছিল না তাই মিথ্যে বলতে বিশেষ অসুবিধে হতো না, সবাই সমস্বরে বলেছিলাম শিবপুরের সমরের বাড়িতে রাতে ছিলাম। আজকের কোলকাতা বাড়িতে বসে মদ গেলে, শহরের আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে বার আর মদের দোকান। মদ খাওয়া আজকের কলকাতার আধুনিকতা বড়লোকি মুন্সিয়ানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা ছেলে একসাথে বসে মদ খায় আজকের কল্লোলিনীর বুকে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব, বাপরে বড় অপরাধ বলে মনে করা হতো। প্রেম যে লুকিয়ে চুরিয়ে করিনি সে নয়, সবাই একটু আধটু করেছে তবে হাতে হাত দিয়ে বাড়ির আগের স্টপেজ পর্যন্ত দৌড় ছিল সেই সময়ে, পাছে পাড়ার কেউ দেখে নেয় আর বাবার কানে খবর চলে যায়। আজকের কল্লোলিনী হাতে হাত কেন কোমরে হাত দিয়ে বাড়ির নিচে ছেড়ে গালে চুমু খেয়ে বলে “ডারলিং রাতে কাপড় খুলে জেগে থেকো আমি ফোন করবো।” ঘুলঘুলির মতন ফ্লাটের, একচিলতে বারান্দা দিয়ে কেউ দেখল কি দেখলো না সেই নিয়ে এই কোলকাতার কোন মাথা ব্যাথা অথবা ভ্রূক্ষেপ নেই।
 
(২)

আজও মনে হয় এই যেন গতকালের কথা। আমি আর নবীন একটু তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে বেরোব ভেবেছিলাম, প্রিয়াতে “গুরুদক্ষিণা” দেখতে যাবার কথা। পচা, দেবু আর অনুসুয়াকে জানানো হয়নি, ওরা জানতে পারলে আর আস্ত রাখবে না আমাদের। আসল কথা সেদিন নবীনের ছোট মামা ওকে দশ টাকা দিয়েছিল আর সেই টাকাতেই ওই সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। নামতে গিয়েই সিঁড়িতে মধুছন্দার সাথে ধাক্কা খেলাম। এমনিতে খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে মধুছন্দা, কিন্তু একবার খোঁচা মারলে যেন বোলতার চাকের মতন তেড়ে ওঠে। পড়াশুনায় বরাবর ভালো, গত দুই বছরে মেয়েদের মধ্যে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবীনার মতন ঝাঁঝিয়ে উঠল মধুছন্দা, “কি রে দেখে চলতে পারিস না? ঠ্যালা দিয়ে মেরে দিবি নাকি?”
বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে আমাকে দেখে মুখ চুপসে গেল, কেন জানি না। উজ্জ্বল ত্বকের সাথে সেদিনের হাল্কা গোলাপি শাড়িটা বেশ মানিয়েছিল। টিকালো নাকের ওপরে চশমাটা একটু ঠেলে দিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল কিছু উত্তরের জন্য। ওই চোখের আগুনের পেছনে উত্তরের উৎসুকতা দেখেছিলাম কিন্তু গলা শুকিয়ে এসেছিল ওই চাহনি দেখে। কেমিস্ট্রি ল্যাবের সব কেমিক্যাল যেন আমার মাথার ওপরে কেউ ঢেলে দিয়েছিল বলে মনে হয়।

মাথা চুলকে বিড়বিড় করে কিছু বলার আগেই নবীন ওর ওপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “এই সিঁড়ি তোর কেনা নাকি যে সারা সিঁড়ি জ্যাম করে নামছিস? মুটকি শ্যামলীকে দ্যাখ, ওই তো সিঁড়ির অর্ধেক জায়গা নিয়ে নামে, বাকিরা নামবে কি করে?”

বলতে বলতে ঝগড়া লেগে যায় নবীন আর শ্যামলীর মধ্যে, “আমি অন্তত তোর মতন হাড়গিলে নই, আমার বাবা খেতে পরতে দেয়। তোকে দেখে মনে হয় যেন একটা হ্যাঙারে একটা শার্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।”

নবীন একটু রোগা গঠনের, শ্যামলীর ওই উক্তির পরে রেগে ওঠে নবীন, “তোর বাপ কি তোকে হাতির খোরাক দেয়?”

পাশেই দাঁড়িয়ে অনুসুয়া, সঙ্গে সঙ্গে নবীনের কলার ধরে বলে, “একদম বাপ তুলে কথা বলবি না। ওর বাপ ওকে কি খেতে দেয় না দেয় তাতে তোর দেখার কি দরকার।”

আমি নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, “অনু প্লিস এখন ছাড়, সিনেমা দেখতে যাবো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গে মধুছন্দার চেহারার আদল বদলে গেল, বড় বড় চোখ করে উৎসুক হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন করে, “কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা, কি সিনেমা?”

ওই বড় বড় চোখ দুটো দেখলেই আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠতো। মিচকি হেসে উত্তরে বলেই ফেললাম, “প্রিয়াতে গুরুদক্ষিণা চলছে, দেখতে যাবি?”

অনুসুয়া প্রায় আমাকে তেড়ে মারতে আসে, “কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হচ্ছে? দাঁড়া কাকিমাকে বলে দেব।”

আমার আর নবীনের ওপরে অনুসুয়ার একটু বেশি জোর খাটে। এক পাড়ায় আমাদের বাড়ি, ছোটবেলা থেকে এক স্কুলে পড়েছি তিনজনে। নবীনের ছোট কাকিমা অনুসুয়ার ছোট মাসি হয়, ওদিকে অনুসুয়ার বাবা আর আমার জেঠু গলায় গলায় বন্ধুত্ব, দুইজনে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে কাস্টমসে চাকরি করেন। বছর পাঁচেক আগে অনুসুয়ার বড়দা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছে, আমার বাবাও ডাক্তার আর বিশ্বজিৎদা বাবার খুব প্রিয় ছাত্র। সব মিলিয়ে তিন বাড়ির মধ্যে অবাধ যাতায়াত। আমাদের বাড়ি আর অনুসুয়ার বাড়ি একান্নবর্তি পরিবার, জেঠা বাবা কাকা সবাই একসাথে থাকে। পুজো পালা পার্বণে একসাথে খাওয়া দাওয়া এমনকি দুই বছর অন্তর বেড়াতে গেলেও একসাথে দল বেঁধে যাওয়া হয়। এক বাস লোক ভর্তি করে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ আলাদা।

পেছন থেকে পচা মানে পরাশর চেঁচিয়ে ওঠে, “শালা, তোরা দু’জনে নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিলি?”

নবীন চেঁচিয়ে ওঠে আমার দিকে, “মুটকি যখন আমার কলার ধরলো তখন মুখে বুলি ফোটেনি আর যেই ন্যাকা সুরে ডাক দিল, কি সিনেমা অমনি সুর পালটে 'আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবি?' বাড়ি চল শালা, তোর গাঁড়ে আস্ত শাল না ঢুকিয়েছি তো আমার নামে কুত্তা পুষিস।”

অনুসুয়া কাছে এগিয়ে মিচকি হেসে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, “কি রে পুটু, কিছু চলছে নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে জানালাম কি বলছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না, যদিও সব কিছু জলের মতন ঘোলাটে আমার সামনে। অনু একবার আমার মুখের দিকে তাকায়, একবার মধুছন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে দেয়। মধুছন্দার কান লাল হয়ে যায় সেই চোরা হাসি দেখে।

ওদিকে দেখলাম এ যে বড় বেগতিক, নবীনকে কিছুতেই খোঁচানো যাবে না। সেই মদ খাওয়ার দিনে আমাদের দেখে ফেলেছিল সেই থেকে আমাকে আর পচাকে ব্ল্যাকমেল করে রোজ এক প্যাকেট চারমিনার কেনে। লুকিয়ে চুরিয়ে বিড়ি সিগারেট খাওয়ার অপরাধ সেইসময়ে মার্জনা করে দিতেন বাড়ির বড়রা। কিন্তু মদ গেলা, গাঁজা টানা নৈব নৈব চ, একবার বাবা জেঠার কানে কথা গেলে পিঠের ছাল গুটিয়ে খোল বানিয়ে তবে ছাড়বে। ভাগ্য ভাল যে সেই মদের কথা অনুসুয়ার কানে যায়নি না হলে আমরা আর আস্ত থাকতাম না। তখন আমাদের ক্ষমতা ওই বিড়ি থেকে চারমিনার পর্যন্ত ছিল তাই নবীন ওর ওপরে কোনোদিন ওঠেনি।

ওদিকে শ্যামলী আর অনুসুয়া বেঁকে বসে, দেবাশিসের সাথে কিছুতেই সিনেমা দেখতে যাবে না। বেশ কয়েকদিন আগে দেবাশিস অনুসুয়াকে ডাকতে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে আর তাতে ওর শাড়ির আঁচল একটু খসে যায়। ধুন্দুমার কান্ড শুধু ঘটতে বাকি ছিল সেইদিন যদি না ওই মধুছন্দা এসে মধ্যস্থতা করতো, শ্যামলী আর অনুসুয়া মিলে দেবুর কাপড় খুলিয়ে ছেড়ে দিতো।

তালে বেতালে ঝগড়া কথা কাটাকাটিতে সেদিন আর সিনেমা দেখা হলো না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে বাঁচিয়ে অনু প্রস্তাব দিল কফিহাউসে যাওয়ার। মেয়েদের দলের মধ্যে আর ছেলেদের দলের মধ্যে ওই একমাত্র যোগসূত্র। যেমন কথা তেমনি কাজ, বাসে চেপে সেই যাদবপুর থেকে সোজা কলেজ স্ট্রিট। মাঝে মধ্যেই একটা ঝগড়া লাগতো এক না হয় পচার সাথে শ্যামলীর না হয় দেবুর সাথে অনুসুয়ার, আমাকে আর নবীনকে সামাল দিতে হতো আর মধুছন্দা চুপচাপ একদিকে দাঁড়িয়ে মিচকি হাসতো ওদের কান্ডকারখানা দেখে। কলেজের বাইরে হোক কি ভেতরে হোক, বিশেষ মিশুকে না হলেও ওকে সবসময়ে সঙ্গে রাখতো অনুসুয়া। তবে আমাদের ঝগড়াঝাটি কোনোদিন কলেজ চৌহিদ্দির বাইরে যায়নি, কলেজের গেটের বাইরে এই সাত জনের এক অন্য রুপ। তার মূলে অবশ্য আমি আর অনুসুয়া, কিছু না কিছু করে সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম। দেবু, অনুসুয়ার সাথে আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে ওস্তাদ, জানে শুধু ঝগড়ার মাধ্যমে ওর সাথে কথা বলতে পারবে কিন্তু মনের কথা বলার সময়ে ওর হাঁটু কাঁপতো। মাঝে মাঝেই আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো ওই সুন্দরী অনুসুয়ার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। গতবারে সরস্বতী পুজোর সময়ে একটা ছোট হাতির দাঁতের লকেট কিনেছিল ভেবেছিল অনুসুয়াকে দেবে শেষ পর্যন্ত নিজে হাতে দিতে পারল না আমার হাত দিয়েই দেওয়া করিয়েছিল। সেই হাতির দাঁতের লকেট পেয়ে বড় বড় চোখে কটমট করে তাকিয়েছিল অনুসুয়া।

আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “কেন তোর এত রাগ ওর ওপরে একবার খুলে বলতো?”

অনুর উত্তর, “দূর শালা, সবসময়ে কেমনভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।”

আমি বললাম, “কেন তাকাবে না বল, তুই ক্লাসের সেরা সুন্দরী তোর দিকে সবার নজর আর আমাদের ব্যাচে কটা মেয়ে বলতো? কড় গুনে সাতজন।”

ঠোঁট উলটে নাক বেঁকিয়ে হেসে বলে, “খুব সুন্দর হয়েছে লকেটটা ওকে বলে দিস। আর হ্যাঁ, তুই কবে কাকে দিচ্ছিস এই রকম একটা লকেট?”

আমি উত্তরে জিজ্ঞেস করি, “কাকে দেওয়া যায় বলতো এই রকম লকেট? তোকে একটা দিলে কেমন হয়?”

ঠোঁট কামড়ে উত্তর দেয় অনুসুয়া, “আমাকেই দিস একটা তোর হয়ে মধুছন্দাকে দিয়ে দেব।”

বর্তমানে অনুসুয়া, দেবুর অফিস ফেরার পথ চেয়ে অধির আগ্রহে বসে থাকে, সেই গল্প আলাদা। সে নিয়ে পরে অবশ্য আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি প্যারিসে দেবুর বাড়িতে বসে। পচা এখন বোরদে থাকে, মাঝে মাঝেই হানা দেয় দেবুর বাড়িতে। সময় পেলেই নবীন ফ্লাইট ধরে ফ্রাঙ্কফারট থেকে চলে আসে দেবুর বাড়িতে। দামী চুরুটের পাতা ছিঁড়ে সেই কল্লোলিনীর চারমিনারের স্বাদ খুঁজতে চেষ্টা করি সবাই। একসাথে বসলেই শ্যামলীকে ফোন করা হয় আর ওন্টারিও থেকে ফোনে আমাদের মুন্ডপাত করে। কোন কোন মাসে লন্ডনের ব্রিক লেনে আমার বাড়িতে আড্ডা বসে। কখন থেমসের জল দেখে অথবা রাইন অথবা গারননের জল দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যাই সবাই, সবার বুকে যে গঙ্গা আঁকা সেই মাধুর্য নেই এই জলে।
 
(৩)

সেই সময়ে হাত খরচ বাবদ প্রতিদিনের বরাদ্দ ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। যদিও অনুসুয়ার বাড়িতে আর আমাদের বাড়িতে দুটো করে গাড়ি কিন্তু সেই গাড়ি আমাদের জন্যে নয়। ট্যাক্সি চাপার বাহুল্য আমাদের কপালে ছিল না তাই বাসে চেপে যাওয়া হল কফি হাউসে। আমি বারেবারে আড় চোখে মধুছন্দার দিকে তাকাই। চশমার আড়ালে ওই দুই উজ্জ্বল চোখের থেকে চোখ ফেরানো বড় কঠিন। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনে পুজো তাই আকাশ বেশ পরিষ্কার আর সেই মৃদু রোদে ওর ত্বক যেন আর শত গুন ঝকমক করছে। মাঝে মাঝেই ওর চোখের সাথে আমার চোখ মিলে যেতো আর ভুরু কুঁচকে মৃদু এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো আমার দিকে, “কি দেখছিস ওইভাবে?” না, কোন উত্তর নেই আমার কাছে। কি করে বলি ওই দুই উজ্জ্বল চোখের হাতছানিতে ভেসে যাওয়ার কথা।

পুজোর গল্পে, গরমের ছুটিতে আমরা সবাই মিলে দেরাদুন মুসৌরি ঘুরতে গেছিলাম সেই গল্পে, কলেজের প্রফেসারদের মুন্ডপাত করা এই সবে কখন যে দুই ঘন্টা কেটে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দুই ঘন্টা টানা আড্ডা মেরে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পচা আর দেবু বাসে চেপে চলে গেল, ওদের বাড়ি বেলুড়। শ্যামলী সেই সময়ে থেকেই লুকিয়ে প্রেম করতো মেকানিকালের ফাইনাল ইয়ারের ঋতুরাজের সাথে। একটু পরে যথারীতি ঋতুরাজের বাইকে চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল শ্যামলী। আমার আর নবীনের বাড়ি ফেরার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না, ভেবেছিলাম হাওড়া ব্রিজের তলায় বসে একটু গাঁজার কলকেতে টান দেব। অনুসুয়াকে বললাম যে আমাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।

সেদিন আবার অনুসুয়ার মনে বান্ধবী প্রীতি জেগে ওঠে আর মধুছন্দাকে নিজের বাড়ি ডাকে। মধুছন্দার বাড়ি বেহালা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। প্রথমে বেশ ইতস্তত করে মধুছন্দা, সন্ধ্যে হলে কি করে বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে বলা নেই, মা চিন্তা করবে ইত্যাদি। অনুসুয়া ওকে বুঝিয়ে বলে যে বাড়ি গিয়ে ওর বাড়িতে একটা ফোন করে দিতে তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেই শুনলাম যে মধুছন্দা অনুর সাথে যাবে অমনি আমার কলকে সেবনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল। একসাথে এক বাসে যাওয়া যাবে সেই ভেবেই যেন মন নেচে উঠল। নবীনকে বলে কয়ে রাজি করালাম যে গাঁজা অন্যদিনে টানা যাবে। অনুসুয়া আমার মনের অভিপ্রায় ধরে ফেলেছিল আর তাই হেসে বললো চলে আসতে।

বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চারজনে, বারেবারে চার চোখ এক হলেই চোরা হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে মধুছন্দা। অনুসুয়া বলল যে অনেকক্ষণ ধরে আমরা দাঁড়িয়ে, একটা ট্যাক্সি করে গেলেই ভালো হয়। মধুছন্দার সাথে এক ট্যাক্সিতে যাবো, আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। নবীন মাথা চুলকে জমানো দশটাকা বের করে দিল, সেই সাথে আমিও পাঁচটাকা বের করলাম। চারজনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে পঁচিশ কি ত্রিশ টাকা জমা হল। যথারীতি ট্যাক্সিতে চাপা হলো, পেছনের সিটে অনুসুয়া, মধুছন্দা আর নবীন। আমি ইচ্ছে করেই আর পেছনের সিটে বসিনি, কিঞ্চিৎ দ্বিধায় কিঞ্চিৎ কাষ্ঠতায়। কফি হাউসে বসে যেমন আমাদের দুইজনের মধ্যে সরাসরি কোন কথাবার্তা হয়নি তেমনি ট্যাক্সিতেও হলো না। মাঝে মধ্যে অনুসুয়ার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ, না বলি।

যেতে যেতে মধুছন্দা অনুকে প্রশ্ন করে, “তোদের বাড়ির মধ্যে তোদের এই মেলামেশা নিয়ে কোন অসুবিধে নেই?”

অনু হেসে জবাব দেয়, “কি যে বলিস না তুই। আমাদের তিন বাড়ির মধ্যে অন্য এক যোগসুত্র আছে, নবীনের কাকিমা আমার ছোট মাসি হয়। আমার দাদা ডাক্তার, পুটুর বাবার ছাত্র। সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি তিন জনে। একসাথে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে ওঠা বসা। পুটুর বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়া থেকে সেনেদের বাড়ির আম গাছ থেকে আম চুরি করে খাওয়া, সব একসাথে করেছি। শীতকালে ওর জেঠিমা ছাদের ওপরে আচার বানিয়ে রাখতো, আমি আর ওর ছোড়দি মিলে অর্ধেক আচার উড়িয়ে দিতাম।”

কলেজের কেউ জানতো না যে আমার বাড়ির নাম পুটু সুতরাং মধুছন্দা প্রশ্ন, “এই পুটু কে?”

অনু আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “পার্থর বাড়ির নাম পুটু, আবার কলেজে গিয়ে ঢাক পিটিয়ে দিসনে যেন।”

মধুছন্দা আমার দিকের পেছনে বসেছিল, সামনে একটু ঝুঁকতেই ওর গায়ের গন্ধে কেমন যেন মাতাল হয়ে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোকে দেখে তো বোঝা যায় না যে তুই এত বাঁদর ছেলে?”

আমি হেসে জবাবে বললাম, “তুই মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিস না তাই জানতে পারিস নি।”

অনুসুয়ার হাতখানি হাতের মধ্যে নিয়ে লাজুক হেসে জবাব দেয়, “কলেজের চৌহিদ্দির মধ্যে আর তোদের মধ্যে থাকলে স্বস্তি পাই তাই।”

অনুসুয়া ওকে বলে, “এক কাজ করিস এইবারে, পুজোতে আমাদের এখানে চলে আসিস। এখানেই খাওয়া দাওয়া সবকিছু। সবথেকে বড় ব্যাপার, অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা, এবারে মন্টু গুপ্ত আসতে পারে।”

মন্টু গুপ্তের কথা ঠিক কানে পৌঁছালো না মধুছন্দার, ওর মাথায় বাড়ি ফেরার চিন্তা ভর করে আসে তাই অনুকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে আমি বাড়ি কি করে যাবো?”

অনু উত্তর দেয়, “তোর চিন্তা করতো হবে না। নবীন না হয় পুটু তোকে দাদার বাইকে করে ছেড়ে আসবে।” নবীনকে একটা গুঁতো মেরে অনু জিজ্ঞেস করে, “তোর মনে হয় সময় হবে না তাই তো? বাড়ি ফিরে তো টিউশানি করার আছে।”

বুঝলাম ইচ্ছে করেই অনুসুয়া আমার পথ পরিস্কার করে দিল, যাতে সন্ধ্যেবেলায় মধুছন্দাকে নিয়ে বাইকে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। বড় রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। অনু আর মধুছন্দা মিষ্টির দোকান থেকে বাঁক নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একবারের জন্য আমার মনে হল যেন মধুছন্দার ঠিক ইচ্ছে নেই অনুর বাড়ি যাওয়ার, থমকে গিয়ে কি আমার দিকে পেছন ঘুরে তাকিয়েছিল না আমার চোখের ভুল?

অনু আমাকে বলল, “এই সাতটা নাগাদ চলে আসিস ততক্ষণে দাদা বাড়ি ফিরে আসবে।”

আহ্লাদে আটখানা কি করে মানুষে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। বাড়ি ফিরে সময় যেন আর কাটে না। আমার ঘর তিনতলায়, খাটে শুয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বিকেলের কথা, ট্যাক্সিতে আসার কথা আর সাতটা কখন বাজবে সেই চিন্তায় ডুবে গেলাম। এর মাঝে বার দুই ছোট বোন এসে ডাক দিয়ে গেল, কারুর কথার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারুর কথাই মাথায় সেদিন আর ঢোকেনি। মাথায় শুধুমাত্র একটাই চিন্তা কখন সাতটা বাজবে আর আমি একদৌড়ে সোজা অনুর বাড়িতে যাবো। ঘড়ির কাঁটা পৌনে সাতটা ছুঁতে পারেনি কি জামা গলিয়ে জেঠিমাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। মা কাকিমার হাতের সামনে পড়লে শত প্রশ্ন, আমাদের সাত ভাই বোনেদের একমাত্র সম্বল জেঠিমা। জেঠিমা নিজে স্কুলের গন্ডি পার হয়নি সেই একটা দুঃখ ছিল তাই মাকে আর কাকিমার পড়াশুনা করাতে ছাড়ায়নি। মা একটা মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আর কাকিমা কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার। বাড়িতে দুই শিক্ষিকা থাকলে যা হয় বাড়িটাও কয়েদখানার মতন মনে হয় তবে ওই জেঠিমার জন্য কয়েদখানা থেকে সব ভাই বোনেরা রেহাই পেয়ে যেতাম।

যাবার আগে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন, “বেশি রাত করিস নে যেন তাহলে কিন্তু সামলাতে পারব না।”

আমি বললাম, “আরে না না বেশি রাত করব না তাড়াতাড়ি চলে আসব।”

এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে অনুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির উঠানে মোটর সাইকেল দেখে বুঝতে পারলাম যে বিশ্বজিৎদা বাড়িতে আছে, তার মানে মধুছন্দাকে নিয়ে অনায়াসে বাইকে চেপে কালিন্দি থেকে বেহালা পাড়ি দেওয়া যাবে। মনের মধ্যে যেন উত্তম সুচিত্রার “এই পথ যদি না শেষ হয়...” বেজে উঠল।

অনুর বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার তাই সোজা ওর ঘরে যেতে কোন অসুবিধে হল না। পর্দা সরিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখলাম দুই বান্ধবী বিছানার ওপরে আধশোয়া হয়ে গল্পে মশগুল। মধুছন্দার পিঠ দরজার দিকে, উপুড় হয়ে বুকের নিচে একটা বালিশ দিয়ে শুয়ে। হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করার ফলে শাড়ির পাড় গুটিয়ে হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। ফর্সা পায়ের মসৃণ গুলি দেখে বুকের রক্তে হিল্লোল লেগে গেল। ক্ষুধার্ত বাঘের মতন লোলুপ দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইলাম ওই মসৃণ পায়ের গুলির দিকে। পাতলা শাড়ির পরতে ঢাকা নধর দেহ পল্লব যেন ঢেউ খেলে বিছানার ওপরে মেলে রয়েছে, জল থেকে সদ্য ওঠা কোন এক অচিনপুরের জলপরী।
 
(৪)

আমি বেশ কিছুক্ষন ওইখানে দাঁড়িয়ে মধুছন্দার অপরূপ মাধুর্য দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে গলা খ্যাঁকরে জানান দিলাম যে সারথি প্রস্তুত। আমার চোখের রক্তিম আভা দেখেই মনে হয় মধুছুন্দা বুঝতে পেরে গেছিল যে আমি ওইখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করে গেছি। আমার গলার আওয়াজ শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসে শাড়ি ঠিক করে নিল সেই সাথে অনু নিজের বেশভূষা ঠিক করে নিল।

অনু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, “কি রে কখন এলি?”

আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, “এই তো এক্ষুনি এলাম।”

অনু আমাকে নিচে বসতে বলল আর বলল যে কিছুক্ষনের মধ্যে মধুছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি কাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে আর সেই পুন্য কর্মের জন্যেই আমার প্রত্যাবর্তন। নিচের বসার ঘরে বসে কাকিমার হাতের চা খেতে খেতে উৎকণ্ঠায় শুধু ঘড়ির দিকে দেখি, কখন যে মধুছন্দা বের হবে আর খালি রাস্তা দিয়ে আমরা দুইজনে বাইকে করে যাবো। দিদিদের নিয়ে বাইকে যাওয়া অথবা অনুকে নিয়ে বাইকে যাওয়া আলাদা কথা, সেই প্রথম সত্যিকারের কোন বান্ধবীকে বাইকে বসিয়ে যাওয়া ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার যোগাড়।

নিচে নেমেও যেন ওদের গল্প আর শেষ হয় না, কিছু বলতেও পারছি না শুধু মাত্র আড় চোখে দুইজনের দিকে মাঝে মাঝে তাকাই। পাঁচ মিনিট করতে করতে প্রায় আধা ঘন্টা পরে অনু মধুছন্দাকে ছাড়লো। বাইকের পেছনে বেশ আড়ষ্ট হয়ে একটু তফাৎ রেখে বসলো। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে অনু আমাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে তবে ছাড়লো। আমাকে ইশারায় জানিয়ে দিল যে এর ঘুস দিতে হবে, আমিও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম যে দিতে প্রস্তুত আমি।

গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত বেশ আস্তে আস্তে চালালাম, ইঁট পাতা রাস্তা বাইক নিয়ে চলা একটু মুশকিল। তাও বেশ সামলে চলতে হল কারন পেছনে যে বসে তাকে বেশি ঘাঁটানো যাবে না পাছে কি ভাবতে কি ভেবে বসে। বড় রাস্তায় বাইক চড়াতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। সিট ধরে বসে থাকা হাতখানি আমার ডান কাঁধে উঠে এল। খোঁপা খুলে এলো চুল আমার ঘাড়ের ওপরে এসে দোল খেতে লাগল।

কিছু মনে হয় বলল কারন আমার কাঁধের ওপরে থাবা বেশ জোরালো হয়ে গেল। গাড়ি একটু ধিরে করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ফিসফিস জড়ানো কণ্ঠে আমাকে একটু ধিরে চালাতে অনুরোধ করল। আমার যেমন এই প্রথম কোন বান্ধবীকে নিয়ে বাইকে চাপা তেমনি মধুছন্দার সেই প্রথম কারুর সাথে বাইকে চাপা। দুইজনের মধ্যেই কেমন একটা আড়ষ্টভাব প্রতি নিয়ত ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠলাম।

কানে ভেসে এল দূর থেকে এক নারীর কণ্ঠস্বর, “তুই কি এর পরেও পড়াশুনা করবি না চাকরি করবি?”

ঠিক শুনতে পারিনি ওর কথা তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কি বলছিস?”

মধুছন্দা জিজ্ঞেস করল, “তুই কি এম টেক করবি না এর পরে চাকরি করবি?”

উত্তরে বললাম, “না রে এখুনি চাকরি করার কোন মতলব নেই আমার। বি টেক করার পরে এম টেক, পি এইচ ডি রিসার্চ যা আছে সব করব আর বাড়ির অন্ন ধ্বংস করব। বাবা জেঠার এত পয়সা খাবে কে? তুই কি করবি?”

মিহি কণ্ঠে উত্তর এল, “না রে এই ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যন্ত আমার দৌড়, এর পরে আমাকে চাকরি করতে হবে। মা অনেক কষ্টে এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর টাকা যোগাড় করেছে। এর পরে বাড়ির দায়িত্ব, ছোট ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ব আমাকেই সামলাতে হবে। দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, বাড়িতে টাকা দেয় না।”

বুঝতে পারলাম যে মধুছন্দার বাবা গত হয়েছেন, কণ্ঠে একটা না বলা অব্যক্ত বেদনা ফুটে উঠল ওর, বেশ কিছু দূর দুইজনেই চুপচাপ থাকলাম।

গাড়ির গোঁগোঁ আওয়াজ বড় একঘেয়ে লাগছিল তাই আবার আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পুজোতে আমাদের এখানে আসবি? আমাদের এখানে যাত্রা নাটক হয়।”

উদাসিন কণ্ঠের উত্তর, “জানি না রে। ভাবছিলাম মামাবাড়ি যাবো, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।”

প্রশ্ন করলাম, “তোর মামাবাড়ি কোথায়?”

উত্তর এল, “জলপাইগুড়ি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই নাটক যাত্রা পালা এই সব দেখিস?”

উত্তরে জানাল, “না সেই সময় কোথায় আমার। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে একগাদা টিউশান থাকে, নিজের পড়াশুনা থাকে এই সবে সময় চলে যায়।”

প্রশ্ন করলাম, “আজকে টিউশান ছিল না?”

উত্তর এলো, “তোর আর অনুর টানাটানিতে আজকে আর হল না, শনিবার ওদের পড়িয়ে দেব খানে।”

সেই সময়ে মেয়েদের সামনে গোঁফে তা দিয়ে সিগারেট খাওয়া খুব বড় ব্যাপার। মনের এককোনে সেই অভিপ্রায় জেগে উঠল তাই বাইক দাঁড় করালাম একটা পানের দোকানের সামনে। বাইক থামাতেই মধুছন্দা কারন জিজ্ঞেস করল, আমি জানালাম যে একটা সিগারেট ধরাব। পকেটে দুটি চারমিনার পরে আছে একটা বের করে ধরাতে যাবো তখন মধুছন্দা আমাকে চারমিনার খেতে বারন করল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল, তুইও কি আমাকে সিগারেট খেতে দিবি না?”

হেসে জবাব দিল, “আমি না বললে তুই শুনবি না তবে ওই সাদা কাগজে মোড়া বিড়ি ধরাস না, ওর গন্ধ বড় বিটকেল। এই নে একটাকা, অন্য কোন সিগারেট নিয়ে আয়।”

আমার চক্ষু চড়ক গাছ, “তুই আমাকে সিগারেট খাবার পয়সা দিবি।”

হেসে জবাব দিল, “জানি জানি তোদের বরাদ্দ বাবদ কত হাত খরচ। আজকে পার্স ঝেড়ে পাঁচ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়েছিস, তোর পকেটে কোন পয়সা নেই সেটা জানা আছে।”

অনু আর ছোড়দি আমার ব্যাঙ্ক কিন্তু সেই কথাও যে অনু ওকে বলে দেবে সেটা ভাবিনি। আমি মনে মনে অনুর মুন্ডপাত করলাম কিন্তু ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিগারেট খাবো সেটা ঠিক মনে ধরলো না। তাই ওই চারমিনার ধরালাম।

ওর একটু অভিমান হলো আর অভিমানিনী কণ্ঠে আমাকে বলল, “অনুর কাছ থেকে টাকা নিতে তোর বাধে না তাহলে আমার কাছ থেকে কেন বাধে?”

কি করে ওকে বুঝাই, অনুসুয়া আর ওর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু আমার বান্ধবী, আমার দিদি, আমার বোন আমার অনেক কিছু আর মধুছন্দা এখন পর্যন্ত ঠিক কোন পর্যায় এসেছে সেটার ঠিক নেই।

আমি হেসে জবাব দিলাম, “আজকে ট্যাক্সিতে তোর টাকাও গেছে, কাল তোর পয়সায় আমাকে সিগারেট খাওয়াস।”

উত্তরে বলল, “না অনু আমাকে পয়সা দিতে দেয়নি।” ঘড়ির দিকে দেখে আমাকে বলল, “এবারে একটু তাড়াতাড়ি চল, বাড়িতে মা একা চিন্তা করবে।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “মাসিমাকে ফোন করে দিয়েছিস তাহলে এত চিন্তা কেন?”

আমার মাথার পেছনে আলতো চাঁটি মেরে জবাব দিল, “তাই বলে কি এই কোলকাতার রাস্তায় তোর সাথে রাত কাটাব?”

আমি ওকে হেসে বললাম, “এবারে বুঝলি তোর আর অনুর মধ্যের তফাৎ। আমি নবীন অনু যদি কোথাও এক রাত কাটিয়ে আসি অথবা এক বিছানায় শুয়ে থাকি তাহলেও ঘুম ছাড়া গল্প ছাড়া কিছু হবার নেই অথবা কেউ আমাদের দিকে আঙুল পর্যন্ত তুলবে না।”

আমি বাইকে বসে পড়লাম, এবারে আগের সেই জড়তা ভাব কাটিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বসল। ওই চাঁপার কলি আঙুলের ছোঁয়ায় আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্ত প্রবাহ শত গুন বেড়ে গেল। বাইক চালিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে গান বেজে উঠল।

আমি ওকে বললাম, “মামাবাড়ি না গেলে চলে আসিস আমাদের এখানে, অনু তো থাকবেই তোর কোন অসুবিধে হবে না।”

মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ অনু থাকবে, ভয় তো আর ওকে নিয়ে নয়। ভয় অতি অচেনা একটা বাঁদরকে নিয়ে। হটাত করে যদি আমাকে খামচে দেয় তাহলে কি হবে?”

এই মস্করার একটা যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আর হচ্ছে না। আমি ওকে বললাম, “বাঁদরকে খোঁচালে তবেই বাঁদর কামড়ায়, হটাত করে কোন জড় বস্তুর ওপরে বাঁদর আচমকা হামলা করতে যাবে কেন?”

খোঁচাটা বেশ হয়েছে তাই খিল খিল করে হেসে বলে, “কে বলেছে আমি জড় বস্তু?”

আমি উত্তরে বললাম, “কলেজে তো সাত চড়ে রা কারিস না।”

উত্তরে বলল, “আমার ওই রকম বেশি কথা বললে বাচাল বলে মনে হয়। তাই নিয়ে মামাবাড়িতে আমাকে সবাই নাক উঁচু বলে ভাবে। কিন্তু কি করার আছে বল?”

এর উত্তরে কিছু বলার নেই আমার। বেহালা, শখেরবাজার চলে এল, বড় রাস্তায় নামিয়ে দিতে হল ওকে, বাড়ির সামনে যদি বাইক থেকে নামে তাহলে আবার পাড়ার কেউ দেখে ফেলতে পারে আর সেই নিয়ে কথা শোনা। আমিও বেশি জোর করলাম না ওকে। যাই হোক দুইজনের মধ্যের জড়তা একটু কেটেছে, আষাঢ়ের মেঘ কেটে শরতের পরশ লেগেছে। চলে যাবার আগে বেশ কিছুক্ষণ আমার কাছে দাঁড়িয়েছিল। কিছু শোনার অপেক্ষায় না কিছু বলার অপেক্ষায়।

আমি তাও আগ বাড়িয়ে বললাম, “এইটুকু ছেড়ে দিলে হতো না? রাত নটা বাজে একা একা যেতে পারবি তো?”

মিষ্টি হেসে জবাবে বলল, “এইটুকু যাবার ক্ষমতা আছে। এই সময়ে তোর সাথে বাড়ির সামনে নামলে অনেকের ভুরু কুঁচকাতে পারে। আর হ্যাঁ, কালকে ইনরগ্যানিকের নোটস দিস তো।”

“ঠিক আছে” বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ না সাপের মতন বেনুনি দুলিয়ে ওই গলির বাঁকে হারিয়ে গেল মধুছন্দা।
 
(৫)

সকালে বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে অনুর প্রশ্ন, “কি ব্যাপার সব ঠিকঠাক? রাতে ঘুম হয়েছে?”

না সেইরাতে আমার দুই চোখে ঘুম আসেনি, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়েছিলাম। আমার সারা গায়ে যেন মধু মধু গন্ধ মিশে ছিল। ডান কাঁধে যেখানে হাত রেখে সারা রাস্তা এসেছিল মনে হচ্ছিল এখন পর্যন্ত সেইখানে ওই কাঁধে চাঁপার কলি আঙুল রাখা।

দিন যায় আর ভোরের ফুটন্ত শিউলির মতন ধিরে ধিরে জড়তা কাটিয়ে কবে দুইজনে বেশ মিশে গেলাম সেটার ঠিক নেই। সবার চোখের আড়াল হলেও অনু ঠিক বুঝেছিল আমাদের দুইজনের মাঝের ওই অদৃশ্য বন্ধন। সর্ব সমক্ষে চোখে চোখ রেখে কথাবার্তা বলতে সাহস পেতো না মধুছন্দা তবে ওই কলেজের মধ্যে একটু দেখা একটু কথা বলা অথবা বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে একটু গল্প করা পর্যন্ত আমাদের সময় সীমা সীমিত ছিল। কোনোদিন যদি বলতাম আজকে একটু দেরি করে বাড়ি গেলে হয় না, হেসে জবাবে বলতো বাসে চেপে বাড়ি পর্যন্ত যেতে। আর তার ফলে যাদবপুর থেকে বেহালা বাসে চেপে যাওয়া আর গল্প করা। কিছু একটা অছিলায় অনুকে ক্ষান্ত করতে হতো কিন্তু ওর শ্যেন নজর এড়ানো বড় মুশকিল। কিছুতেই সময় করে মধুছন্দাকে একা পাওয়া যায় না, অনু না হয় শ্যামলী না হয় বনানী, কেউ না কেউ ওর সাথে সবসময়ে থাকে। কলেজ শেষ হলেই সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বুঝি এই বয়সে মাথায় অনেক চিন্তা আর সেই কারনে ওকে কোনোদিন জোর করার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি।

দেখতে দেখতে কাছে এসে গেল বিশ্বকর্মা পুজো। আমিও ছোড়দির পার্স ঝেড়ে কুড়ি টাকা জমিয়ে ফেললাম, এবারে একান্তে কোথাও একটা যেতেই হবে ওকে নিয়ে।

কলেজের পরে মধুছন্দাকে এক দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, “বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে বেড়াতে যাবি?”

প্রশ্ন করল রমণী, “কে কে যাবে?”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, আমি কিনা ওকে নিয়ে একা কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই, ওদিকে মধুছন্দা সবাইকে নিয়ে যেতে চায়। বার কয়েক ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, “শুধু আমি আর তুই।”

চশমার আড়াল থেকে বড় বড় কাজল টানা চোখে আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে বলল, “মোটেই নয়। অনু, দেবাশিস, পরাশর সবাইকে ডেকে নিলেই হয়, সবাই বেশ মজা করতে করতে যাবো। সবাই যদি যায় তাহলে যেতে রাজি আছি।”

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “এ কিরে সবাই কেন?”

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিচকি হেসে বলল, “ওই যে বলেছিলাম না, একটা বাঁদরকে ভরসা করা বড় দুষ্কর সেই কারনে।”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “একা অনু যেতে পারে অন্য কেউ নয়।”

মুখখানি লাল করে হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “থাক আর ওই বেচারাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” কাছে এসে বাজুর ওপরে চিমটি কেটে বলল, “সবার কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কিছু করার মতলব নেই তো তোর?”

খুব ইচ্ছে করছিল ওকে ওইখানে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলি, লুকিয়ে রাখবো বুকের মধ্যে কারন তুই অমূল্য। ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, “অনেক দূরে কোথাও যাবো তবে এখনো ঠিক করিনি কোথায়।”

ওর চোখ দুটো ভাসা ভাসা হয়ে উঠল, পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই থাকবি পাশে তাহলে যেতে রাজি।”

সেদিন ওকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত সারা রাস্তা একদম চুপচাপ। ওর বাড়ির বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সন্ধে তারার সাথে সাথে একে একে রাস্তার বিজলী বাতি জ্বলে উঠল। সময়টা যদি দাঁড়িয়ে যেতো সেদিন তাহলে বড় ভালো হতো।

অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করল, “শাড়ি পরবো না সালোয়ার কামিজ?”

আমি একটু ওর দিকে ঝুঁকে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ও পেছনে সরে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নাকে ভেসে এলো ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ। সেই গন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে বললাম, “কাপড়ে কি আসে যায় তুই যা পরবি তাতেই সুন্দরী দেখাবি।”

হাত বাড়ালাম ওর হাতের দিকে কিন্তু এপাস ওপাস দেখে হাত টেনে মিষ্টি হেসে বলল, “আজ আসি, পরশু তাহলে ন’টায় এস্প্লানেড ট্রাম ডিপোর সামনে দেখা হচ্ছে।”

দুইদিন পরে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বাড়িতে বললাম যে বন্ধুদের সাথে মায়াপুর ঘুরতে যাচ্ছি। জেঠিমা জিজ্ঞেস করেছিল যে অনু নবীন যাচ্ছে কি না। আমি বলেছিলাম যে না ওরা যাচ্ছে না তবে অন্যরা যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে সেটা জানিয়ে দিলাম। অনু আর নবীন জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে। ঠিক ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটা নাগাদ এস্প্লানেড বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেলাম। জানি আধা ঘন্টা আগেই পৌঁছেছি তাও মন মানে না, একটু কি তাড়াতাড়ি আসতে পারে না? এই ভেবে ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।

ঠিক তখন কাঁধে হাত পড়লো, “সেই চারমিনার? আমার সাথে থাকলে ওই চারমিনার ছাড়তে হবে, ওর গন্ধ মোটেই আমার ভালো লাগে না বলে দিচ্ছি।”

পেছন ঘুরে দেখি মধুছন্দা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে সেই সাথে কপালে ছোট সবুজ রঙের টিপ আঁকা। আমি দাঁড়িয়ে থ বনে গেলাম।

আমার থ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জায় পড়ে গেল, “কি হল সব ঠিকঠাক না কিছু বলবি?”

আমতা আমতা করে আধা পোড়া সিগারেটে শেষ টান মেরে বললাম, “না মানে চল।”

আমার বাঁ পাশ ঘেঁসে রাস্তা পার হয়ে হাঁটার সময়ে চাঁপার কলি নরম আঙুলে ছোঁয়া লাগলো। সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি ধাঁ করে সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আচমকা ট্যাক্সি এসে যাওয়াতে আমি ওর হাত ধরে আমার পেছনে করে দিলাম আর ও আমার জামা খামচে ধরল ভয়ে।

দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাক্সির মুন্ডপাত করতে করতে বলল, “এই পাঞ্জাবী ট্যাক্সিওয়ালা গুলোকে না মারতে ইচ্ছে করে।”

আমি ওকে শান্ত করে বললাম, “ছাড় ওই ট্যাক্সিকে। বল এখন কোথায় যাবি?”

হাত উলটে উত্তর দিল, “আমি কি জানি কোথায় যাবো, তুই কোথায় নিয়ে যাবি?”

বাস স্ট্যান্ডে সবুজ রঙের সারি সারি সরকারি দূরপাল্লার বাস দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে বেশ খানিক্ষন ভেবে বললাম, “গঙ্গা অনেক দেখলাম এবারে ইচ্ছামতি দেখলে কেমন হয়?”

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখানে ইচ্ছামতি নদী কোথায়?”

উত্তর দিলাম, “বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে হাসনাবাদ, যাবি?”

ক্ষণিকের জন্য মধুছন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, গাঢ় গম্ভির কণ্ঠে বলে উঠল, “না ইছামতী নদী দেখার কোন শখ নেই আমার। তুই যদি অন্য কোথাও নিয়ে যাস তাহলে যেতে রাজি না হলে আমি বাড়ি চললাম।”

ওর সুন্দর মুখের হটাৎ পরিবর্তনের কারন ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু দুই ফর্সা কান লাল হয়ে উঠল সেই সাথে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠল। আমি এইটুকু বুঝলাম যে ওই ইছামতী নদীর সাথে ওর পুরানো কোন ব্যাথা জড়িয়ে। আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না।

বললাম, “আরে না না একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি এখুনি বাড়ি ফিরলে মুশকিল হয়ে যাবে। তোর যখন ইচ্ছে নেই তাহলে মায়াপুর নবদ্বীপ ঘুরে আসি।”

চুপচাপ আমার পেছন পেছন বাসে উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে দিল কিন্তু মধুছন্দা মুখ নিচু করে জানালার পাশে বসে রইল। দুই চোখ ছলছল দেখে আমার বুকের ব্যাথা শত গুন বেড়ে গেল।

কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে তোর, হটাৎ এমন থম মেরে গেলি যে?”

কালো মেঘের ছায়া সরিয়ে মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “কই কিছু না, কিছুই হয়নি।”

বাস ততক্ষণে মধ্যমগ্রাম ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে। জানালা থেকে মিষ্টি রোদে ওর সারা মুখ ভিজে গেল, এক অনাবিল স্বাধীনতার আনন্দে চিকচিক করে উঠল ওর চোখ দুটো।

আমার পাশ ঘেঁসে বসে মিহি কণ্ঠে বলল, “এতদিন পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজকে খুব ভালো লাগছে।”

আমি ওকে বললাম, “তোকে একা পাওয়া খুব দুষ্কর, সবসময়ে কেউ না কেউ তোর চারপাশে মাছির মতন লেগে থাকে।”

উত্তর এলো, “কার কথা বলছিস, অনু?”

আমি বললাম, “ওর কথা ছাড় দিকি।”

বারে বারে এক গুচ্ছ চুল ওর মুখের ওপরে এসে দোল খেয়ে যাচ্ছিল আর সেই দুষ্টু চুলের গোছাকে সামলে মিচকি হেসে উত্তর দিল, “ওর নাক কিন্তু বড় কঠিন, কিসে না কিসে গন্ধ শুঁকে ঠিক বের করে নেবে যে আমরা মায়াপুর গেছিলাম।”

আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলাম, “অনু জানলে কি কোন অসুবিধে আছে?”

নিজের আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, “না সে নেই তবে...”

আমার ভেতরে অট্টহাসির কলরব ফেটে পড়ার জোগাড়, জানি অনুকে একদিন জানাতেই হবে, না জানালে আমাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে সেটা বলা কঠিন। বাবা জ্যাঠা কাকার সামনে কোন ভাই বোনের আওয়াজ শোনা যায় না, ওদিকে মা কাকিমার সামনে প্রায় এক রকম অবস্থা। একমাত্র যদি জেঠিমাকে হাত করা যায় আর সেটা সম্ভব ছোড়দি আর অনুকে দিয়েই হবে।
 
(৬)

দুপুর নাগাদ কৃষ্ণনগর পৌঁছে গেলাম সেখান থেকে বাস বদল করে মায়াপুর যেতে হবে। গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোক বোঝাই বাসে চেপে দুপুরের একটু পরেই মায়াপুর পৌঁছালাম। বিলিতি মন্দির তখন সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি, ইঁট কাঠ বালি পাথর বোঝাই মন্দির প্রাঙ্গনে। আশেপাশে অনেক ছোট ছোট মন্দির, আমাদের অবশ্য সেই সব দেখার বিশেষ বালাই ছিল না। দুইজনে শুধুমাত্র কোলকাতার নাগপাশ ছাড়িয়ে নিভৃতে একে অপরের সান্নিধ্য খুঁজতে এসেছিলাম এই গঙ্গাবক্ষে। তাও রমণীর মন্দির দেখা চাই। শেষ পর্যন্ত নৌকায় চেপে গঙ্গা পার করে নবদ্বীপে গিয়ে নিতাই গৌরাঙ্গের মন্দির দেখা হল রিক্সায় চেপে। এই মন্দির দেখা, ঠাকুর প্রনাম করা আমার কোনোদিন পোষাতো না। বাড়িতে কালী পুজো হতো বটে তবে সবার মান রেখে বিগ্রহের সামনে করজোড়ে বসে থাকতাম। বাঙালির পালা পার্বন প্রত্যেক মাসেই লেগে থাকে আর আমাদের বাড়ি এইসব খুব মানে। মধুছন্দা সেই রকমের মেয়ে, যেখানে দেখল একটা মন্দির অথবা বটতলায় একটা পাথর আর কিছু ফুল রাখা, সেখানেই দাঁড়িয়ে চটি খুলে ঢিপ করে একটা প্রনাম ঠোকা ওর চাই। সেই সাথে জোর করে আমাকেও করজোড়ে দাঁড়াতে হতো ওর পাশে।

মনে মনে ওর মুণ্ডপাত করতে করতে বললাম, “সবই তো এটম ইলেক্ট্রনের সমাগম, আচার্য জগদীশচন্দ্র প্রমান করে দিয়েছেন যে গাছের প্রান আছে এখন বল তুই কাকে ছেড়ে কাকে প্রনাম করবি।”

জনা কুড়ি মন্দিরে ঢুকে প্রনাম করে কপালে সিঁদুরের টিপ নিয়ে ওর কপাল রক্ত ললাটের মতন দেখাচ্ছিল। কিছুটা সিঁদুর ওর চশমার ওপরে আর ওর নাকের ডগায় পড়েছিল।

সেই রক্তিম আভাময় মুখখানি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে এইখানে নিয়ে এলি কেন? অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারতিস, এই ধর কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, রায়চক যেখানে খুশি।”

সত্যি বলতে জানিনা কেন মায়াপুরের কথা মনে হয়েছিল সেদিন। তবে ওর মুখখানি দেখে মনে হয়েছিল যে রায়চক, ডায়মন্ড হারবার না গিয়ে মায়াপুরে এসে ওর যেন বেশি ভালো লেগেছে।

বিকেলের আগেই আমাদের ফিরতে হবে। ফিরে যাওয়ার আগে গঙ্গার পাড়ে দুইজনে একটু বসে পড়লাম। পায়ের নিচে ঠাণ্ডা গঙ্গার জল ছলকে ছলকে উঠল আর নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কখন যেন অজান্তেই ওর হাত উঠে এলো আমার হাতের ওপরে, আমার বাম বাজুখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বাম কাঁধে মাথা রেখে দূরে চোখ রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল মধুছন্দা। ওর ওই খেই হারা ভঙ্গিমা ভাঙতে বড় কষ্ট লাগলো আমার।

অনেকক্ষণ না অল্পক্ষণ ঠিক নেই, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজ এলো আমার কানে, “জানিস কেন ইছামতী দেখতে যাইনি।” কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে কাঁপা গলায় ওর বিগত দিনের কাহিনী শুনলাম, “হাসনাবাদের ওই ইছামতীর ওই পাড়ে আমাদের বাড়ি ছিল, সাতক্ষীরার এক গ্রামে। পূর্ববঙ্গ তখন জ্বলতে শুরু করেছে দাউদাউ করে। গ্রামের পর গ্রাম রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ধুসর রঙের মাটি। সত্তরের এক অঘ্রায়নের গভির রাত। একদল মানুষ গভির রাতে আমাদের গ্রামে চড়াও হল। আমাদের গ্রামে হিন্দু সংখ্যা যাও ছিল তারা অনেকেই আগেই এই পাড়ে চলে এসেছিল। কিন্তু আমাদের গ্রামের আজমাল চাচা আমাদের যেতে দিল না, বাবাকে বলল যে এই মারদাঙ্গা কিছু দিনের মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আগুন আর নেভার নাম নিল না, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠল। সেই রাতে আজমাল চাচা আর নজরুল ভাই লাঠি নিয়ে আমাদের বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওই দুষ্কৃতির দলকে রোখা গেল না। ওরা জোর করে আজমাল চাচাকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ি চড়াও হল। ততক্ষণে নজরুল দাদা আমার দাদাকে পিঠে নিয়ে আমাকে আর মাকে নিয়ে বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে মাঠ ধরে দৌড়াতে শুরু করে দিল। আমি মায়ের কোল জাপ্টে ধরে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম, শুধুমাত্র দূরে হইহই মারামারির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাবা আমাদের সাথে আসতে পারেনি, আজমাল চাচা বাবাকে নিজের বাড়িতে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিল। অনেক কষ্টে রেল স্টেসানে পৌঁছে দিয়েছিল নজরুল ভাইজান। তারপরে ট্রেনে করে শিয়ালদা। তিনদিন তিন রাত পেটে এক দানা পড়েনি, শুধু মাত্র কলের জল ছাড়া। ”

ওর কথা শুনতে শুনতে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি বড় হয়েছি প্রাচুর্যে, জন্মের পর থেকে সাদা ধবধবে নরম বিছানা আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। নিজে হাতে খেতে শিখেছি অনেক পরে, অনেক দিন পর্যন্ত বড়দি খাইয়ে দিতো, রাতের খাওয়ার পরে শেষ পাতে মিষ্টি না হলে আমার খাওয়া শেষ হতো না সেই জন্য কাকা রোজ দিন অফিস ফেরত রসগোল্লা নিয়ে আসতো আমাদের সবার জন্য।

কাঁপা কণ্ঠে মধুছন্দা ওর গল্প বলে চলল, “চারদিনের দিন ওই খালি পেটে দাদা কয়েক বস্তা মাল বয়ে চার আনা নিয়ে এলো, সেই চার আনায় এক খুরি মুড়ি আর একটু গুড় খেয়ে কাটালাম আমরা। ওই শিয়ালদা স্টেসানে আমাদের মতন অনেকেই ছিল, বানের জলে ভেসে আসার মতন বর্ডার থেকে যত ট্রেন আসতো সব ট্রেনে গরু ভেড়া খেদানোর মতন মানুষে ভর্তি। কারুর মাথা ফেটে গেছে, কারুর বাবা মারা গেছে, কারুর মা বোনের সাথে জোর জবরদস্তি করা হয়েছে। সব মানুষ ভিটে ছাড়া উদ্বাস্তু। সাতদিনের দিন একটা ট্রেনে চেপে আমার বাবা শিয়ালদা পৌঁছালো। বাবাকে দেখে সেকি আনন্দ, হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেলাম। তারপরে শুরু হল কঠিন জীবন যাত্রা, কোথায় যাই কোথায় ঠাঁই পাবো তার কোন ঠিকানা নেই। স্টেশানের পাশের একটা ক্যাম্পে আমাদের ঠাঁই হল। রোজ সকালে দাদাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতো বাবা, সন্ধ্যে হলে কিছু না কিছু কিনে আনতো খাবার জন্য। যা কিছু ছিল সব এক রাতে খুইয়ে চলে এসেছিলাম তবে আজমাল চাচা বাবাকে বলেছিল যে দাঙ্গা শেষ হলে ফিরে আসতে। কিন্তু ফিরে আর যাওয়া হল না আমাদের ভিটে মাটি সাতক্ষীরায়।”

আমি ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখতেই আমার দিকে সরে এলো, কাঁধে ওপরে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ ধরে। নির্জন এই গঙ্গাবক্ষে ওকে এই প্রশস্ত বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে বড় ইচ্ছে করল।

আমি ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম, “ছাড় ওই সব কথা, অন্য কিছু বল।”

চশমা খুলে চোখের কোল মুছে আমাকে বলল, “তোদের সবার ক্ষোভ যে আমি চুপচাপ থাকি বেশি কথা বলিনা। কাকে কি বলব বল। এতদিন চুপচাপ ছিলাম আর চুপ করেই থাকতাম যদি তুই না এসে আমাকে নাড়িয়ে দিতিস।”

ওর মাথার ঘন কালো চুলে নাক ডুবিয়ে একটু ঘষে আলতো চুমু খেয়ে বললাম, “আমি আছি তোর পাশে তুই এত চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আমার হাতখানি বুকের কাছে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে নাক ঘষে বলল, “আমার সব থেকে বড় ভয় সেখানেই। শুকনো বালির মতন যেটাকে আঁকড়ে ধরতে যাই তাই আঙুলের ফাঁক দিয়ে পিছলে যায়।”

আমি ওকে বললাম, “কেন এইসব উল্টো পালটা চিন্তা ভাবনা করছিস? বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আছে না নেই।”

আমি মজা করে বলিনি অথবা আমার কোন শয়তানি অভিপ্রায় ছিল না ওই বার্তার মধ্যে। কিন্তু মধুছন্দা চোখ মুছে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে বলল, “এত তাড়াতাড়ি এক সাথে রাত কাটাবার ইচ্ছে নাকি শয়তান ছেলে?” দুম করে বুকের ওপরে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “ধরতে এলে কিন্তু কামড়ে দেব তোকে।”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হেসে দিল। সাথে সাথে আমিও উঠে ওর হাত ধরে ফেললাম, “পালাবি কোথায় এখানে আমি আর তুই ছাড়া আর কেউ নেই?”

লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর ফর্সা গোল মুখ। হাত ছাড়ানোর দুর্বল প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল কিছুক্ষণ কিন্তু ততক্ষণে ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এলাম। মিহি কণ্ঠে বারেবারে বলতে লাগলো, “প্লিস ছেড়ে দে।”

আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্তের মাতন লেগেছে, সেই সাথে মধুছন্দার তপ্ত শ্বাসের ঢেউয়ে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে। ডান হাতে ওর পাতলা নরম কোমর জড়িয়ে নিবিড় করে কাছে টেনে নিলাম। শরীরের সাথে শরীর মিশে গেল, বুকের ওপরে পিষে গেল দুই নরম কুঁচ। ধিরে ধিরে মুখ নামিয়ে আনলাম ওর মুখ মন্ডলের কাছে। চশমার পেছনে দুই চোখ শক্ত করে বন্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর সারা শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, আমার বাহু পাশে ছটফট করে চলেছে এক সর্পিল কন্যে। আমি তর্জনী দিয়ে ওর থুতনি ছুঁয়ে আমার দিকে ওর মুখ উঠিয়ে আনলাম। ওর লাল নরম ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে দিল আসন্ন অধর মিলনের আশঙ্কায়। ঠোঁট জোড়া ছুঁতেই ওর ঠোঁট খুলে গেল। ওর হাত উঠে এলো আমার জামার কলারে, প্রাণপণ শক্তি দিয়ে আমার জামার কলার খামচে ধরল। আর সেই সাথে আমাদের দুই জোড়া ঠোঁট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। এই গঙ্গাবক্ষ আমাদের এই মিলনের সাক্ষী হয়ে রইল আদি অনন্ত কালের জন্য।

বাকি সারাটা রাস্তা ওর মুখ দিয়ে কোন বুলি ফুটল না। বাসে উঠে আমার হাতখানা কোলের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এক বারের জন্য আমার দিকে চেয়ে তাকাল না। বুঝতে বাকি রইল না যে লজ্জায় আর আমার দিকে তাকানোর শক্তি নেই। বাস থেকে নেমে আবার বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত গেলাম, ততক্ষণে রাত ঘনিয়ে এসেছে কোলকাতার বুকে। এবারে আর বাস স্টান্ড নয়, হাঁটতে হাঁটতে ওদের পাড়ার গলির মুখ পর্যন্ত চলে গেলাম। পাশাপাশি হেঁটে ছিলাম তবে হাত ধরতে পারিনি। গলির মুখে এসে আধো আলো আধো অন্ধকারে আমার মুখের দিকে তাকালো। সারা মুখে রক্তিম প্রেমের আভা সেই অন্ধকার ম্লান করে দিল।

আমার হাতের ওপরে চিমটি কেটে বলল, “কামড়াতে পারলাম না তাই চিমটি কেটে শোধ নিলাম।”

চিমটি খেয়ে সম্বিত ফিরলো, না যা হয়েছে সেটা সত্যি সত্যি হয়েছে কোন স্বপ্ন নয়, “উরি বাঃবা, এইভাবে কেউ চিমটি কাটে নাকি? এক কেজি মাংস তুলে নিলি যে?”

কাছে এসে মিহি কণ্ঠে বলল, “আর তুই আমার সম্মতি না নিয়ে কি করে দিয়েছিস সেটার কি হবে?”

ওর হাত টেনে কাছে আনতে যাবো কিন্তু সর্ব সমক্ষে সেটা করা ভীষণ বিপদ তাই একটু তফাতে দাঁড়িয়েই বললাম, “এই চিমটির দাম তোর কাছ থেকে সুদে আসলে উসুল করব কিন্তু।”

দুষ্টু মিষ্টি অনুরাগ দেখিয়ে বলল, “এর পরে আসিস, সত্যি যদি না কামড়িয়েছি তাহলে আমার নাম বদলে নিস।”

আমিও কম গেলাম না, “এখুনি নাম বদলাতে রাজি, ছন্দা।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লজ্জা সংবরণ করে বলল, “অনেক হয়েছে এবারে বাড়ি যা। পয়সা আছে না দিতে হবে?”

আমি মিচকি হেসে জবাব দিলাম, “না না আছে।”

ছেড়ে যেতে কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না আমার তাও রাতের গভিরতা দেখে আমাকে বলল, “আমি আসি তাহলে।”

আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না বাড়ির গেট খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বাড়ি ফিরলাম এক ঘোরের মধ্যে, চারপাশের সব কিছু কেমন রঙিন, রাস্তার বিজলী বাতি সেদিন যেন বেশি করে জ্বলছে, আসেপাসের সব মানুষ বেশ খুশি, এই পৃথিবীতে দুঃখ কষ্ট যেন সব উধাও হয়ে গেছে। সেই রাতে আমার আর ঘুম হলো না, তিন তলার আমার ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখে কাটালাম আর খোলা চোখে দেখলাম এই সুন্দরী জলপরীকে। পরের দুই দিন আমার সাথে ঠিক ভাবে কথা পর্যন্ত বলেনি ছন্দা। কালো ভ্রমরের মতন ওর পেছনে লেগে ছিলাম কিন্তু মুখের বুলি ফুটাতে পারিনি।
দুই দিন পরে আমাকে জানিয়েছিল যে সেই রাতে ওর ঘুম হয়নি। সারা রাত জেগে আকাশের তারা গুনেছিল।
 
(৭)

যদিও ষষ্টি থেকে কলেজের ছুটি কিন্তু মহালয়ার পর থেকেই আমাদের কলেজে আসা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেল আর সেই সাথে মধুছন্দার সাথে নিয়মিত দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এমন দুষ্টু মেয়ে শেষ দিনে বলে পর্যন্ত গেল না কোলকাতায় থাকবে না জলপাইগুড়ি যাবে। অনু ঠিক শুঁকে শুঁকে গন্ধ পেয়ে গেল আমাদের ব্যাপারে আর তারপর থেকেই আমার পেছনে লাগতে শুরু করে দিল। ওকে জিজ্ঞেস করলেই খ্যাপাতে শুরু করে দেয়, আমি যে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছি তাই ছন্দার কোন ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানাতে রাজি নয়। ওই পুজোতে আমার ঘাড় ভেঙে এক জোড়া জুতো কিনলো। জুতো কিনতে যাবার দিনেও ওকে কত অনুরোধ করলাম একবারের জন্য ছন্দাকে ডেকে নিতে, কিন্তু শয়তানি হাসি দিয়ে জানিয়ে দিল যে ছন্দার কোন খবর ওর কাছে নেই। আমাদের বাড়িতে একটাই টেলিফোন ছিল, সেই টেলিফোন আবার এক তলার বৈঠক খানায়। একবার রিং বেজে উঠলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কার ফোন এলো কার ফোন এলো। ওই বারোয়ারি ফোন থেকে প্রেমালাপ করা কেন সামান্য কথা বলা অসম্ভব ব্যাপার। বাবা জ্যাঠা কাকা ছাড়া বিশেষ কারুর ফোন আসতো না। মাঝে মাঝে দুর্গাপুর থেকে বড়দির ফোন আসতো আর সেই সময়ে বড়দির সাথে কথা বলার জন্য লাইন লেগে যেতো।

বাবা জেঠা পুজোর কর্তা কিন্তু আমাদের মানে আমি, নবীন, বিষ্টু, বাপ্পা এদের মাথায় সব কাজের ভার এসে পড়তো। ডেকরেটারের কাছে দৌড়ানো থেকে রান্নার লোক খোঁজা। মা জেঠিমার বয়স হয়েছে, রান্নায় যোগদান দিলেও একটু আধটু হাতা খুন্তি নাড়া ছাড়া বিশেষ কিছুই করতে পারে না। মা জেঠিমার পরের প্রজন্মের হাতে তখন রান্নার ভার কিন্তু আমার কাকিমা হেঁসেলে যায় না বললেই চলে। নন্দ কাকিমা আর অনুর ছোট কাকিমা শ্রেয়সী, আজকাল রান্নার তদারকি করে, তবে জেঠিমার হাতের পায়েস আজও অমৃত সবাই পাত চেটে খেয়ে যায়।

চতুর্থীর আগের রাতে শিব মন্দির মাঠের পাশের তাল দীঘির ঘাটে আমি, নবীন, দেবু আর বাপ্পা আয়েশ করে সিগারেট টানছি। মন্দির মাঠের একপাশে দুর্গা মন্ডপ অন্য দিকে যাত্রা পালার জন্য মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। মন্টু গুপ্ত আসতে পারবে না কিন্তু হাতিবাগানের এক নামকরা নাট্য কম্পানি অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা করতে আসছে। ওদিকে দেবুর ঘ্যানর ঘ্যানর আরো বেড়ে গেল।

সিগারেটে টান মেরে দেবু কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে বলল, “প্লিস পুটু আমার একটা হিল্লে করে দে।”

আমি বললাম, “কি হয়েছে, নিজে থেকে বলতে কেন পারিস না।”

দেবু মিন মিন করে বলল, “কথা বলতে গেলেই তেড়ে আসে যে, কি করে মনের কথা বলি বলতো। অত দামী একটা হাতির দাঁতের লকেট দিলাম তাও যে সুন্দরীর মন গলাতে পারলাম না।”

নবীন একটু তফাতে বসে ছিল সেইখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আমাদের দুইজনকে আমিনিয়ায় ভালো করে খাওয়া তবে ভেবে দেখবো।”

দেবু ওর ওপরে খেপে গিয়ে বলতো, “শুয়োর রোজ দিন এক প্যাকেট চারমিনার মারিস তাতেও তোর মন ভরে না?”

আমি ওকে বললাম, “এক কাজ করিস এবারে পুজোতে আমাদের পাড়ায় চলে আসিস, একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোর।”

বাপ্পা ওকে জিজ্ঞেস করল, “শালা পাড়ার মেয়েকে হাতিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবি, আমরা কি পাবো, লবডঙ্কা?”

নবীন হটাৎ সিগারেট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেবুর দিকে শান্ত অথচ গম্ভিরভাবে তাকিয়ে বলল, “শোন দেবু, অনুকে বুঝাতে পারি বলতে পারি এই মাত্র, তবে জোর করব না। যদি অনু মেনে নেয় তাহলে বিয়ে পর্যন্ত তোদের পাশে থাকব, ওর বাড়িকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার আর পুটুর। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস কোনোদিন যদি অনুর চোখে জল দেখেছি কাল হোক কি ত্রিশ বছর পরে হোক, যেখানে থাকবি সেখানে গিয়ে তোকে কেটে ওইখানে পুঁতে রেখে আসব।”

অনু আমাদের চোখের মণি সেটা দেবু সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেল। নবীনের মুখে ওই গুরু গম্ভির বার্তা শোনার পরে গুম মেরে গেল। আমি ওকে দুইজনকে শান্ত করে বললাম, যে জীবনের এখন অনেক বাকি, কে কখন কোথায় কি অবস্থায় থাকবে সেটার ঠিক নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখুনি মাথা ব্যাথা করে কোন লাভ নেই, সময়কে তার নিজের প্রবাহে ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

পঞ্চমীর দিন বিকেলেই বড়দি আর ভাগ্নে ভাগ্নি বাড়িতে এসে গেল। বাড়ির সব থেকে ছোট ভাগ্নি, বুবাই থপথপ করে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। নবীন আসলেই ওর বেশি মজা কারন নবীন ওকে নিয়ে ঘুরতে যায়, কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে দেয়, কাঁধে করে মেলায় নিয়ে যায়। নৈহাটি থেকে বড় মামা সবার জন্য নতুন কাপড় নিয়ে এসে গেছে, বড় মামা মানে জেঠিমার বড় ভাই, সেই সকলের বড় মামা। নৈহাটিতে খুব বড় কাপড়ের দোকান, আমাদের বাড়ির অধিকাংশ জামা কাপড় মামার দোকান থেকেই আসে, কথায় আছে মামা বাড়ির আবদার সেটাই খাটাই তাঁর ওপরে।

ক্লাস টেনের পরে আর চক্ষু দান দেখা হয়ে ওঠেনি আমাদের। ছোড়দি একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল চক্ষু দান দেখতে যাবো কি না। কিছু একটা ভেবে শেষ পর্যন্ত যাবো বলে ঠিক করলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে রাত এগারোটা নাগাদ মন্ডপের দিকে হাঁটা দিলাম, যাওয়ার আগে নবীন আর বাপ্পাকে ডেকে নিলাম। দুইজনে আমাকে জিজ্ঞেস করল অনুকে ডাকতে, আমি জানিয়ে দিলাম পাড়ার পুজো ইচ্ছে হলে আসবে না ইচ্ছে হলে আসবে না, আমি কারুর পায়ে তেল মাখিয়ে ডাকতে যেতে পারছি না।

ওদিকে নন্দন পাল রঙ তুলি নিয়ে তৈরি, চক্ষু দান দেখতে অনেকেই এসেছে। ধিরে ধিরে কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে নন্দন পাল সরু তুলি দিয়ে চোখ আঁকা শুরু করে দিলেন। প্রায় ছয় বছর পরে মায়ের প্রতিমার চক্ষু দান দেখে মন হারিয়ে গেল, আপনা হতেই মাথা নুইয়ে এলো ওই কাঠ মাটির বিগ্রহের সামনে। মাটির প্রতিমা আর মাটির রইলো না, প্রানবন্ত হয়ে উঠে দশ হাতে নির্মল চোখে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আশীর্বাদ করছেন।

আলতো হাতের ছোঁয়াতে সম্বিত ফিরে এলো সেই সাথে নাকে ভেসে এলো অতি পরিচিত সুবাস। কানে এল অতি পরিচিত অতি আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর, “যতই এটম ইলেকট্রন হোক না কেন, এই মাটির বিগ্রহের মহিমা আলাদা, তোর মাথা ঠিক নুয়াতেই হল।”

আমি অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি ছন্দাকে সাথে নিয়ে আমার পেছনে অনু দাঁড়িয়ে। অমি কিছু বলতে যাবার আগেই অনু আমাকে চুপ করে থাকতে বলল কারন আমার বাবা আর জেঠা মশায় মন্ডপে এসে গেছেন, সেই সাথে বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যাক্তি। কাল প্রারম্ভ পুজো শুরু হবে কয়েক ঘন্টা পরেই। আমি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে চুপচাপ মন্ডপ থেকে বেরিয়ে এলাম, সবার চোখ আড়াল করে পেছন পেছন ছন্দাও বেরিয়ে এলো।

আমি ওকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর কি ব্যাপার বলতো? বলা নেই কওয়া নেই।”

আমার গালে আলতো চাপড় মেরে বলল, “কেমন চমক দিয়েছি বল।”

আমি ওকে কাছে টানতে গেলাম কিন্তু কিছুতেই কাছে আসবে না, না না বলে লাজুক হেসে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বলল, “সেই বিকেলে এসেছি আর অনুর ঘরের জানালা থেকে তোকে শুধু ঘর বার করতে দেখে গেলাম।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “একবার ডাক দিলেই পারতিস, ডাকলি না কেন?”

মিচকি হেসে বলল, “তাহলে এই চমকের কি মানে হতো?”

আমি বললাম, “যদি না আসতাম তাহলে কি করতিস?”

আমার কাছে সরে এসে বলল, “অনু প্ল্যান করেই ছিল, যদি তুই না আসতিস তাহলে ও তোকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে আনতো।” আকাশ পানে তাকিয়ে দুষ্টু মিষ্টি কণ্ঠে বলল, “তোর খুব ইচ্ছে ছিল একসাথে রাত কাটানোর, দেখ তোর ইচ্ছে পুরন হয়ে গেল। আমি আর তুই একা এই রাতে এই খোলা আকাশের তলায়।”

আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বললাম, “একা যখন তখন নিশ্চয় সংকোচ বোধ চলে গেছে।”

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “মানে?”

আমি ওকে হেসে বললাম, “মানে আর কি, আমি আর তুই একা নির্জনে নিভৃতে কি হতে পারে সেটা বুঝে নে।”

এই বলেই ওর হাত ধরে টেনে আনলাম। টাল সামলাতে না পেরে আমার শরীরের ওপরে ঢলে পড়ে গেল আর সেই সাথে আমি ওর কোমর জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিলাম। আধো আলো অন্ধকারে ওর চোখ দুটি চকচক করে উঠল সেই সাথে আমার মনে হল ওকে পিষে দেই। ওদিকে ঢাকের বাদ্যি বেশ জোরে বেজে উঠল, মাথা নামাতে গিয়েও আর নামানো হল না ঠোঁটের জায়গায়, ওর নরম গালের ওপরে চুম্বন এঁকে ক্ষান্ত হতে হল।

কোনোরকমে আমার বাহুপাশ ছাড়িয়ে আমাকে একটু ঠেলে দিয়ে বলল, “দিনে দিনে খুব শয়তান হয়ে যাচ্ছিস তুই।”

ঠিক সেই সময়ে অনু এসে গেল আর ধড়মড় করে ছন্দাকে ছেড়ে আমি একটু তফাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনু আমাদের দুইজনকে দেখে হেসে বলল, “সারা রাত কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি না বাড়ি যাবার ইচ্ছে আছে? এই ছন্দা, দেড়টা বাজে কিন্তু।”

ছন্দার অবস্থা ত্রিশঙ্কুর মতন, একদিকে আমি মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে অনু ডাক দিচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না যে অনু ছন্দার সাথে চলে যাক আর সেই এক অভিব্যক্তি ছন্দার সারা চেহারায় ফুটে উঠেছিল, বুঝতে পারলাম যে বিধি বাম। আমি অনুকে অনুরোধ করলাম যে পরে ছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।

ছন্দা মুখ কাঁচুমাচু করে অনুর কাছে গিয়ে বলল, “দয়া করে কিছু একটা কর।”

অনু ওর গাল টিপে মিচকি হেসে বলল, “বাঃরে, এতদিন গাছে জল দিলাম আমি, বড় করলাম আমি আর একদিনে এসে টুক করে ফল পেড়ে খেয়ে নিলি? ওইসবে ভবি ভুলবে না কিছু ঘুস দিতে হবে।”

আমি অনুকে বললাম, “এই মেলা বাজে বকিস না, তোকে জুতো কিনে দিয়েছি আর তুই এইটুকু করতে পারবি না?”

অনু আমাকে বলল, “ঠিক আছে কিন্তু খুব সাবধানে। মন্ডপে কিন্তু বাড়ির অনেকে বসে আছে। একটু পরে কাল প্রারম্ভ শুরু হবে এই ঘাটে কিন্তু জেঠিমা আর মা জল ভরতে আসবে।”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “হুম বড় সমস্যা বটে। তোদের চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা মারা যেতে পারে।”

শেষমেশ তাই ঠিক হল, ওদের চিলেকোঠা ঘরে আড্ডা মারা যাবে। অনু একদৌড়ে আমার ছোড়দিকে জানিয়ে এলো যে আমি রাতে ওদের বাড়িতে থাকব। আমাদের বাড়ির কেউ ছন্দাকে চিনতো না তাই অনুর সাথে ওদের বাড়ি যাওয়াতে কারুর মনে কোন সন্দেহ হলোনা।
 
(৮)

অনুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আমি অনুকে বললাম, “তোর সাথে একটু কথা আছে।”

অনু জিজ্ঞেস করল, “কি কথা?”

আমি ওকে দেবুর ঘ্যানঘ্যানানির কথা, নবীনের সাবধান বাণী সব খুলে বললাম। সব কিছু শুনে অনু চুপ করে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না। তারপরে আমাকে বলল একবার নবীনকে ডেকে দিতে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠ্যালা মেরে বলল তাড়াতাড়ি যেতে আর নবীনকে ডেকে আনতে। আমি নবীনকে ডাকতে গেলাম, নবীনকে বললাম যে অনুকে দেবুর কথা বলেছি কিন্তু অনু একবার ওর সাথে দেখা করতে চায়। আমার কথা শুনে নবীন আমাকে জানিয়ে দিল যে যা বলার অনুকে সব যখন আমি বলেই দিয়েছি তাহলে ওর আর কিছু বলার নেই। আমি পড়লাম মহা মুশকিলে, এই দুইজনের মধ্যে আবার কি ফল্গু ধারা চলছে? যাই হোক পেছনে তাকিয়ে দেখি ছন্দা আর অনু দাঁড়িয়ে।

অনু হাজার প্রশ্ন মাখা চাহনি নিয়ে নবীনকে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি কিছু বলার আছে?”

মাটির দিকে তাকিয়ে ধির কণ্ঠে জবাব দিল, “পুটুর কাছ থেকে সব শুনেছিস আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

দুইজনে চুপ, ছন্দা আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে চুপ থাকতে বলল। আমি ওই দুজনার দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতন চেয়ে রইলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পরে অনু হেসে ওকে বলল, “তুই নাকি দেবুকে কেটে ফেলবি বলেছিস?”

সেই শুনে নবীন জবাবে বাঁকা হাসি দিল, “আমি চাই তুই ভালো থাক তাই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।”

বুক ভরে শ্বাস নিল অনু, তারপরে ছন্দার হাত ধরে বলল, “চল বাড়ির দিকে চল।”

নবীন ওইখানে একা দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপরে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

বাড়ির পথে যেতে যেতে অনু, ছন্দাকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে আমাকে বলল, “তোদের দেখার পরে জীবনে একবারের জন্য প্রেম করতে বড় ইচ্ছে করছে।”

ছন্দা হেসে ওকে বলল, “তুই কি আর সত্যি আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলি? তোর নিজেরই ঠিক নেই দেবুকে হ্যাঁ বলবি না না বলবি।”

অনুকে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখিনি কিন্তু ওইদিন মেয়েটা লাজুক হেসে আমাকে বলল, “আগেকার কথা ছেড়ে দে। দেবুর সাথে ঝগড়া করতাম এই কারনে কেননা ওর বুকে সেই পাটা নেই। বিয়ের পরে হয়তো দেখলাম ওকে আমাকেই খাইয়ে দিতে হচ্ছে।”

কথায় গল্পে অনুর বাড়ি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে এলো। বাড়ি ঢুকতেই অনুর ছোট কাকিমা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল যে আমি রাতে থাকব কি না। আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে রাতে এই বাড়িতেই থাকব। ছোট কাকিমা একবার আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বলল যে আমি যেন এক তলার বসার ঘরের পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমি কিছু বললাম না, আমি কি এখানে ঘুমাতে এসেছি নাকি?

কাকিমা চলে যেতেই অনু আমাকে নিয়ে পা টিপে টিপে দু'তলায় উঠে এলো। ওর ঘর দু’তলার বারান্দার একদম শেষে। অনু ছন্দাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল, আর আমাকে বলল ছাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে যেতে। আমি ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এত রাতে এখানে আমি ঘুমাতে আসিনি। ওই দিকে ছন্দা মিচকি হেসে আমার দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেনুনি দুলিয়ে চলে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ওই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম তারপরে চুপচাপ চারতলার চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলাম।

এই ঘরটায় কেউ শুতে আসেনা, এই ঘরে বরাবর ছেলেদের আড্ডা জমে। বিশ্বজিৎদার বন্ধু, মেজদার বন্ধু, মাঝে মাঝে আমি নবীন পিতু এসে এখানে মেজদার সাথে আড্ডা মেরে বিড়ি খেয়ে যাই। পকেটের শেষ সিগারেটটা ওই মন্ডপে শেষ করে এসেছিলাম। আমি ঘরে ঢুকে এদিক ওদিকে খুঁজে একটা আধা পোড়া সিগারেট পেলাম আর সেটাকে জ্বালিয়ে ছাদে চলে এলাম। ছাদের কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে আয়েশ করে পোড়া সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দিলাম। মাথার ওপরে গাড় নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের মাঝে হাজার হাজার তারায় আলোকিত আকাশের বুক।

পায়ের শব্দে চোখ তুলে দেখি শাড়ি ছেড়ে অনুর একটা ম্যাক্সি পরে ছন্দা দাঁড়িয়ে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলাম।

একটানে আমার হাতের পোড়া সিগারেট ফেলে দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “আর যদি এই সব টেনেছিস তাহলে কিন্তু চলে যাবো। শেষ পর্যন্ত কি না পোড়া বিড়ি?”

এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ে না, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে থাকলেও বেশি কথা বলে না, নতুন মানুষের সামনে একদম মুখে কুলুপ আঁটা। কিন্তু যদি কেউ আমাদের ওইদিন রাতে দেখতো তাহলে বুঝতো যে ছন্দা আসলে কত কথা বলতে পারে। বিগত পাঁচদিনের কথা আর গল্প যেন আর ফুরায় না, ওর পুরানো দিনের গল্প ওর বাড়ির গল্প, যে ছেলে মেয়েগুলোকে পড়ায় তাদের বাঁদরামোর কথা ওর ভাইয়ের কথা আরও কত কি। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেল, ওর ভাই, সত্যজিত ওর চেয়ে বছর দশেকের ছোট, পড়াশুনায় খুব ভালো ভাইয়ের জন্মের এক বছরের মধ্যেই ওর বাবা গত হন। বাবা আগে এস এস কে এম হাসপাতালে কিছু একটা কাজ করতেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মা এস এস কে এম হাসপাতালে আয়ার চাকরি পায়, তারপরে নারসিং পড়ে সেই হাসপাতালে নার্স হয়ে যান। কতক্ষণ ওইভাবে দুইজনে গল্প করেছিলাম সে ঠিকানা নেই।

দূর থেকে শাঁখের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে কাল প্রারম্ভ শুরু হয়েছে আর একটু পরেই বোধন পুজো শুরু হবে। কিছু পরে চোখ ডলতে ডলতে অনু এসে আমাদের একটু বকাঝকা দিল। ছন্দার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সারা রাত জেগে ওর চোখ দুটো তখন চকচক করছে আর একটু বসলে কি এমন হয়ে যেতো। কিন্তু অনুর জন্য সেখানেই ক্ষান্ত হল আমাদের গল্প। ছন্দা চলে যাওয়ার পরে চিলেকোঠার ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে ভাবতে শুরু করলাম যে সব ঠিক কিন্তু বাড়িতে কি করে বলবো যে প্রেম করেছি আর ওই মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে চাই। যাক সে সব না হয় পরে ভাবা যাবে।

সেবার পুজোর সময়ে ছন্দা দুই দিন ছিল অনুর বাড়িতে। একমাত্র সেই রাতে ছোট কাকিমা ছাড়া আর কেউ আমাদের একসাথে দেখেনি তাই অনু ছোট কাকিমাকে হাতে করে নিয়েছিল। সর্ব সমক্ষে ছন্দা অনুর বান্ধবী আমাদের কেউ নয় আমরা চিনিনা, সুতরাং না আমি না নবীন কেউ দিনের আলোতে ওর সাথে কথা বলতে পারতাম না। অবশ্য দিনের বেলায় অনেক কাজ থাকতো আমাদের, পুজোর মন্ডপে বসা, খাওয়া দাওয়া তদারকি করা ইত্যাদি। আগে এই সব বিশ্বজিৎদা, আকাশদা ওরা করতো এখন আমাদের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে ফুল্টুসির মতন সেজে গুজে দুইজনে এসে দেখা দিয়ে যেতো কিন্তু দিনের আলোতে সেই পর্যন্ত দৌড় ছিল। রাতের লোকজনের ভিড়ে একটু সময় পেতাম ওর সাথে গল্প করার আর সেই গল্প চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। অষ্টমীর দিনে সকাল বেলাতেই মধুছন্দা বাড়ি চলে গেল। নবীন বিশ্বজিৎদার বাইকে করে ওকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছিল।

অষ্টমীর দিনে দেবুকে ডাকলাম, ওকে দেখে অনু এমন ভাব দেখালো যেন ওর জন্য প্রতীক্ষা করেছিল সারা জীবন ধরে। ওদের কথার শুরু সেই একটা ঝগড়া দিয়েই, কেন দেবু নিজে থেকে বলতে পারেনি এতদিন সেই নিয়ে ওদের কথা কাটাকাটি। আমি আর নবীন দেখলাম যে এবারে চারচোখ মিলে গেছে, আমে দুধে মিশে গেছে এবারে আঁটির আর কি কাজ। ষষ্টির দিনে যেমন আমি অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে রাত কাটিয়েছিলাম তেমনি অষ্টমীর রাতে দেবু আর অনুকে নিয়ে আমার ছাদের ঘরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারা রাত কি করেছিল জানিনা তবে এইটুকু প্রত্যয় ছিল যে অনু ওকে হাত ধরা ছাড়া বেশি কিছু করতে দেবে না। অনুর আমাদের বাড়িতে থাকা কোন ব্যাপার নয় তবে দেবুকে মাঝরাতে ঘরে ঢুকাতে হয়েছিল আর সকালেই ওকে নবীনের বাড়িতে পাচার করে দিতে হয়েছিল। আমি আর নবীন সারা রাত ধরে যাত্রা পালা দেখলাম। আমার বারেবারে শুধু মনে হয়েছিল ইস যদি ছন্দা থাকতো আমার সাথে তাহলে বেশ মজা হতো।

পুজো ভালোয় ভালোয় শেষ হল। দশমীতে মেয়েদের দেবী বরন, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিসর্জনের পালা। লরি করে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হল, সেদিন আর বাড়ি ফিরলাম না। সেদিন প্লাস্টিক কিনে সেই গিলে সবাই কুঠির ঘাটে রাত কাটালাম। মাঝরাতে মেজদা মানে আকাশদার কি নাচ, সেদিন নবীনকে জোর করে মদ খাওয়ানো হল। সবাই মিলে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম যে কবে প্রেম করবে, শালা মদে টোল হয়েও মুখ থেকে একটা কথাও বের করল না।

বেশ কিছুদিন থেকে ছোড়দির জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিল আর ঠিক কালী পুজোর আগেই বাড়িতে বোমা ফাটাল ছোড়দি। ওর কথা শুনে সবার চক্ষু চড়ক গাছ এমন কি আমি আর অনু তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বিশ্বজিৎদা আর ছোড়দি ডুবে ডুবে এত জল খেয়েছে। বাবার কাছে পড়তে এসে যে একদম ছোড়দিকে হাতিয়ে নেবে সেটা ঠিক কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না। যা হোক দুই বাড়ির যেমন আম দুধের সম্পর্ক তাতে ওদের এই ভালবাসা মেনে নিতে কারুর কষ্ট হল না।

বড় জামাইবাবু ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার এবারে আরেক জামাই হল ডাক্তার। চাপ পড়ে গেল মেজভাই শুভদিপ আর ছোটভাই অনির্বাণের ওপরে। মেজ ভাই এতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আগে আমার ওপরে চাপ ছিল ডাক্তার হও ডাক্তার হও। ঠাকুরদা বড় ডাক্তার ছিলেন, বাবা ডাক্তার আর এই বাড়িতে একজন ডাক্তার হবে না? তবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাওয়ার পরে আমার ওপরে সেই ক্ষোভ একটু কমে গিয়েছিল।

অনু ছোড়দিকে বলল, “এই ছোড়দি, তোকে কিন্তু বৌদি বলে ডাকতে পারবো না, তোকে ছেদি বলে ডাকবো, চলবে তো?”

শুভ বলল, “এ কি রকম ব্যাপার? বউ কি হেঁটে হেঁটে শ্বশুর বাড়ি যাবে নাকি?”

আমি বললাম, “তুই হাগতে আসিস এই বাড়িতে আর ছুচাতে যাস ওই বাড়িতে।”

মেজদা মানে আকাশদা বলল, বর যাত্রীর জন্য বাস ভাড়া করতে হবে, কিছু না হোক নৈহাটি মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসবে বাস চেপে। বরযাত্রী কারা হবে, দুই বাড়ির লোকই তো বর যাত্রী আবার কনে যাত্রী দুটোই।

এসব নিয়ে কি হাসাহাসি। বিয়ে ডিসেম্বরে কিন্তু দুই বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। অনু বায়না ধরল জামদানি দিতে হবে তার কমে কিছু নয়। দুই বাড়িতে লোক সংখ্যা কম নয়, এক হাঁক পাড়লেই জনা চল্লিশ লোক জড়ো হয়ে যাবে শুধু দুই বাড়ি মিলিয়ে।

আমি ভাবলাম যে এই প্রেম ভালবাসা নিয়ে যখন কারুর অমত নেই তাহলে আমাদের সময় বিশেষ কিছু অসুবিধে হবে না। ছন্দাকে সব খুলে বললাম, সব কথা শুনে ছন্দা হাঁফ ছেড়ে বলল, “তোর বাড়ি যা কড়া তাতে কখন কি হয় বলা একটু মুশকিল আছে। সময় হলে দেখা যাবে তবে বেশি দেরি করিস না যেন।”

আমি হেসে বললাম, “আরে না না, তুই অত চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোড়দির পরে আমার নাম্বার আর তোকে মিসেস চট্টোপাধ্যায় করতে বিশেষ দেরি হবে না।”

আমার কথা শুনে লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে সে আর বুঝে পেল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top