Chapter 5: লাহুল স্পিতি ভ্রমন। (#5)
সুপ্রতিমদা ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... শুয়োর, কুত্তা হারামি, রাত দেড়টায় দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করছিস যে ডিস্টার্ব করলাম নাকি? শালা তোর কি চাই এত রাতে?”
রিতিকা ওদিকে ফিকফিক করে হাসছে, সুপ্রতিমদার রাগ দেখে আর অভির অবস্থা দেখে।
মাথা চুলকায় অভি, “না মানে...”
সুপ্রতিমদাঃ “বোকা... মানে কি... তোর কি কন্ডম চাই?”
অভিঃ “না রে বোকা..., আমার বিয়ার চাই।”
সুপ্রতিমদাঃ “বিয়ারের ক্যারেট গাড়িতে।”
অভিঃ “তাহলে গাড়ির চাবি দে।”
সুপ্রতিমদাঃ “গাড়ির চাবি বলবিন্দারের কাছে। বোকা... এখন যা এখান থেকে আর আমাদের একটু শান্তিতে শুতে দে।”
অভি মুখ বাড়িয়ে রিতিকার দিকে চোখ টিপে বলে, “ডারলিং, তোমার রাতের ঘুম হয়ে গেছে।” অভির মুখে ওই কথা শুনে রিতিকা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে কম্বলের নিচে মুখ ঢেকে নেয়।
সুপ্রতিমদা অভির ওপরে চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... এখান থেকে যা না হলে মেরে ফেলব তোকে।”
বলবিন্দারে কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে অরুনার রুমে ঢুকে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল আর এক হাতে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে থাকে। পরীর জন্য অধীর অপেক্ষায় সময় যেন আর কাটেনা। বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও যখন দেখে যে পরী আর আসেনা, তখন রুম থেকে বেরিয়ে পরীর রুমে যায়। রুমের দরজা আলতো করে ভেজানো দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে রুমের মধ্যে।
বিছানায় একটা কম্বলের নিচে পরী শুয়ে আর একটা কম্বলের নিচে অরুনা। পরী ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে আর অরুনা ওর বুকের কাছে মাথা রেখে শান্তির নিদ্রা যাপন করছে। অরুনা পরীর বুকের কাছের জামা শক্ত করে মুঠিতে ধরে যেন ছাড়লেই যদি পালিয়ে যায় সেই ভয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে পরীর রাত্রিবাস। অভি দুজনার মুখের দিকে তাকালো, পরীর স্নেহময়ি মূর্তি দেখে মন অনাবিল আনন্দে ভরে গেল। পরীর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে গালে একটা ছোট্ট চুমু খেলো আর অরুনার মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিল। দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে অরুনার রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লো অভি।
পরের দিনের বেশির ভাগ সময়ে সবাই চিতকুল ঘুরেই কাটিয়ে দেয়। সকালে খেতে বসে কল্যাণী আর রিতিকা অভিকে প্রশ্ন করে যে কি ভাবে ও এই জায়গার কথা জানে, তাঁর উত্তরে অভি জানায় যে বেশ কিছু বই আর ম্যাপ পড়াশুনা করে ও এই জায়গার কথা জেনেছে।
অরুনার গলায় মৃদু রাগ, “এটাকে সাহসী বলে না বুঝলি, এটা পাগলামি, শুচিদিকে নিয়ে এই রকম একটা জায়গায় আসা। এই জায়গা তো মনে হয় পৃথিবী থেকে বাইরে।”
পরী সবার দিকে হেসে বলে, “আর এই জন্যেই প্রথম রাতে আমাদের ঝগড়া হয়েছিল।”
অভি পরীকে ক্ষেপানোর জন্য বলে, “আর পরেরদিন সকালে কি হয়েছিল?”
পরী লাজুক হেসে অভিকে আদর করে চাঁটি মারে। ওর মুখের লালিমা দেখে কারুর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সকালের কি ঘটেছিল।
তাও রিতিকা পরীকে ছাড়ে না, জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কি হয়েছিল পরেরদিন সকাল বেলায়, শুনি।”
পরী অভির দিকে তাকিয়ে নিচু সুরে বলে, “নাও এবারে ম্যাও সামলাও...”
অভি রিতিকার দিকে চোখ টিপে বলে, “ডারলিং, কাল রাতে তুমি যা করছিলে, সেটাই ওর সাথে সেদিন রাতে হয়েছিল।”
রিতিকার গাল লাল হয়ে ওঠে লজ্জায়, খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে যেন ফাঁক খোঁজে একটু মুখ লুকানোর জন্য।
সকালের খাওয়ার পর্ব শেষে, পরী মেয়েদের নিয়ে বিয়াস নদীর দিকে যায়। ছেলেরা হোটেলের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে চারপাশের পাহাড় দেখে আর সিগারেট টানতে টানতে গল্প করে। হোটেলের সামনে থেকে নদীর তীর বেশ পরিস্কার দেখা যায়, দূর থেকে লক্ষ্য করে যে মেয়েরা বেশ মজা করছে। সুপ্রতিমদা আর দীপঙ্কর অভিকে পরবর্তী জায়গার কথা জিজ্ঞেস করে। অভি জানায় যে পরবর্তী স্থান, নাকো। আগামিকাল সকাল সকাল ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে তবেই রাতের আগে নাকোতে পৌঁছে যাবে ওরা। মেয়েরা বেশ খানিকখন পরে নদীর ধার থেকে ঘুরে হোটেলে ফিরে আসে।
দুপুরের খাওয়ার সময়ে পরী অভিকে বলে, “গ্রীষ্ম কালে পাহাড় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে, চারদিক সবুজে ঢাকা, শিতকালের চেয়ে একদম আলাদা সৌন্দর্য। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ যে আমাকে দুই ঋতুতেই এখানে এনেছো।”
অভিঃ “সব তোমার জন্য হানি, তোমার সেই অদৃশ্য চিঠি না পেলে এখানে কোনদিন আসা হতোনা।”
অরুনা ওদের কথাবার্তা শুনে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “অদৃশ্য চিঠি? সেটা কি?”
অভি ওকে সেই চিঠির কথা বলে আর এই জায়গার আসার সেই পরিকল্পনার গল্প বলে। অভি মজা করে বলে যে ওর হবু বউয়ের শিক্ষয়িত্রী না হয়ে গোয়েন্দা হওয়া উচিত।
বিকেলে হোটেলের ম্যানেজার অভিদের জিজ্ঞেস করে যে রাতে বনফায়ার করতে চাই কিনা। বনফায়ারের কথা শুনে পরী আর রিতিকার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, এক কথায় সব মেয়েরাই নেচে ওঠে রাতের বনফায়ারের কথা শুনে। রাতে বনফায়ারের চারপাশে গোল করে সবাই বসে, মাঝে কাঠের আগুন জ্বলছে। পরী চেয়ারে বসে, ওর পায়ের কাছে অভি বসে ওর কোলে মাথা রেখে। পরী অভির চুলে আদর করে দেয়। পরীর একপাশে অরুনা অন্য পাশে রিতিকা। রিতিকার পায়ের কাছে সুপ্রতিমদা বসে ওর কোলে মাথা রেখে। অরুনার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় অভি, অরুনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে, আবার সেই পুরানো অরুনাকে দেখতে পেয়ে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে। অভি নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে আগুনের লাল হলদে আলোয় আলোকিত অরুনার হাসিহাসি মুখের দিকে। পরী অভির দৃষ্টি অনুসরন করে অরুনার দিকে তাকায়।
পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, “অরুনা এখন অনেকটা ভাল আছে। তবে আরও কিছু সময় লাগবে ওর মনের অবস্থা ঠিক হতে, চিন্তা কোরোনা ধিরে ধিরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরীর কোলের ওপরে মুখ ঘষে বলে, “সত্যি তোমাকে যে কি করে ধন্যবাদ জানাবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”
অভির চুলে বিলি কেটে বলে, “আমাকে কেন ধন্যবাদ জানাবে? তোমার কষ্ট কি আমার কষ্ট নয়?”
অভি মুখ তুলে ওর গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে কি আজ রাতে আমরা সেলিব্রেট করছি?”
চুলের মাঝে আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “না হানি, এখন ওর মানসিক অবস্থা ঠিক নয়। তোমার চেয়ে আমাকে ওর বেশি দরকার, একটু বুঝতে চেষ্টা করো সোনা।”
অরুনা ওদের কথা শুনে ফেলে জিজ্ঞেস করে, “এই তোরা কি বলছিস রে?”
পরী আদর করে ওর গালে চাঁটি মেরে বলে, “কিছু না, তুই আনন্দ কর, আমরা একটু আসছি।”
পরী অভিকে টেনে তুলে হোটেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বলে, “গতকাল রাতে, অরুনা পুবালিকে স্বপ্নে দেখে যে ও ডাকছে। ভয়ে আঁতকে ওঠে ও, আর সেইজন্য আর ঘুম আসেনা। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেছিল, আমাকে একদম ছাড়ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে ওকে আমি সান্তনা দেই আর বুঝাই, তবে গিয়ে ওর চোখে ঘুম আসে। এমত অবস্থায় কি করে ওকে আমি একা ফেলে দেই বলো?”
অভি পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সারা চেহারায় যেন এক মাতৃময়ী রুপের আলোক ছটা বিচ্ছুরিত হয়। রাতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যায়, কারন সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে পড়তে হবে নাকোর দিকে। পরী অরুনাকে নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকে যায়। দরজা বন্ধ করার আগে অভির দিকে আদর করে ম্লান হেসে বলে, “ব্যাস আর কিছু দিন হানি। তোমার ওর বেশি জরুরি আমাকে কাছে পাওয়া। আমি জানি তুমি বুঝে নেবে।” অভি বুকের কাছে হাত এনে চেপে ধরে জিজ্ঞেস কর, “তুমি কে? তুমি কোন সময়ে স্নেহময়ী মাতৃ মূর্তি আবার কোন সময়ে আমার প্রেয়সী সুন্দরী। কি করে তুমি এত রুপ ধারন করো?”
পরীর গালে আদর করে অভি, “আই লাভ ইউ।”
পরী ওর ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, “মনে আছে তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে এই পাহাড়ের মাঝে আমার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর বানিয়ে দেবে।”
মাথা নাড়ায় অভি, ওর সেসব কথা বেশ ভালো করে মনে আছে।
পরদিন সকাল আটটার মধ্যে খাওয়া সেরে অভিরা বেরিয়ে পড়ে নাকোর উদ্দেশ্যে। গাড়ির চালক সুপ্রতিমদা, পাশে বসে ওর প্রেয়সী, রিতিকা। অভি, পরী আর অরুনা পেছনে বসে। একসময়ে রিতিকা সুপ্রতিমদার কোল ঘেঁসে বসে গালে আলতো করে চুমু খায়।
অভি সেই দেখে রিতিকাকে খেপিয়ে বলে, “রিতু ডার্লিং, সুপ্রতিমদার গিয়ার বদলাতে যেও না।”
সুপ্রতিমদা চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... চুপচাপ পেছনে বসে থাক।”
গালাগালি শুনে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। পরী ভাবতেই পারেনি ওদের মুখ থেকে এইরকম সব গালাগালি বের হবে। রিতিকার মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়, সুপ্রতিমদার কাছ থেকে সরে, লজ্জা লুকাতে জানালার বাইরে দেখে।
পোয়ারিতে থামে গাড়িতে তেল ভরানোর জন্য। ইনোভা ওদের গাড়ির ঠিক সামনে। রেকংপিও পার হবার পরেই পাহাড়ের রঙ বদলাতে শুরু করে। এতক্ষণ দুপাশে সবুজ ঘাসে বা গাছে ঢাকা পাহাড় ছিল, পিওর পরে পাহাড়ের রঙ হয়ে যায় ধুসর। ব্রিজ পার হবার পরেই চারপাশে ন্যাড়া পাহাড়, কোথাও ঝুরঝুরে পাথর রাস্তার ওপরে পরে। সুপ্রতিমদার গাড়ি চালাতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, এবড়োখেবড়ো রাস্তার ওপরে গাড়ি যেন ঢেউয়ের মতন দোল খায়। শতদ্রু নদী রাস্তার একপাশ দিয়ে নিজের মনে বয়ে চলে। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে বসে, অভি একহাতে পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে। অরুনা চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর কঠিন সৌন্দর্য দেখে।
অরুনা কিছু পরে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে একটা কথা বলবি আমাকে? পঞ্চাশ ক্যান বিয়ার আর পাঁচ বোতল ভদকা এনেছিস। তোরা দুজনে কি সারাটা রাস্তা গলায় ঢালতে ঢালতে যাবি?”
অভি নির্লজ্জের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
অরুনা বিরক্ত হয়ে ওঠে, “যাচ্ছেতাই মানুষ তোরা...”
সুপ্রতিমদা অরুনা কথা শুনে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, “আরে, আমি তো বিয়ারের কথা একদম ভুলে গেছিলাম, তোমার কথা শুনে মনে পড়ে গেল। এবারে তো এক এক ক্যান মারতেই হয়।” অভিও মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
পরী ওকে আদর করে মারতে শুরু করে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা খাব ব্রিজ পৌঁছে যায়। ইনোভা সামনে দাঁড়িয়ে, কল্যাণী আর রানীরা গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের পাহাড় দেখছে। একদিক দিয়ে শতদ্রু নদী একদিকে স্পিতি নদী এখানে মিশেছে। রিতিকা ওদের দেখে সুপ্রতিমদাকে গাড়ি দাঁড় করাতে অনুরোধ করে।
সুপ্রতিমদা গাড়ি দাঁড় করাতেই গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়ে। সামনে রাস্তার অবস্থা দেখে সুপ্রতিমদা একটু থমকে যায়। ব্রিজের ওপারে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি, মাথার ওপরে ছাদের মতন ঝুলে আছে পাহাড়, একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে উত্তাল তরঙ্গিণী স্পিতি নদী। ব্রিজের নিচে, স্পিতির আর শতদ্রুর জল মিলেমিশে যেন যুদ্ধে রত। অভি গাড়ির পেছনে গিয়ে দুটি ক্যান বিয়ার নিয়ে একটা সুপ্রতিমদার হাতে ধরিয়ে দেয়। পরী মেয়েদের নিয়ে স্পিতির দিকে হেঁটে নেমে যায়। দুরে দেখা যায়, নাকোর খাড়া রাস্তা। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে। সুপ্রতিমদা পরীর কাছে গিয়ে রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করে। দুরে দাঁড়িয়ে অভি পরীকে দেখে, বেশ ভালো ভাবে রাস্তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়।
সুপ্রতিমদা ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... শুয়োর, কুত্তা হারামি, রাত দেড়টায় দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করছিস যে ডিস্টার্ব করলাম নাকি? শালা তোর কি চাই এত রাতে?”
রিতিকা ওদিকে ফিকফিক করে হাসছে, সুপ্রতিমদার রাগ দেখে আর অভির অবস্থা দেখে।
মাথা চুলকায় অভি, “না মানে...”
সুপ্রতিমদাঃ “বোকা... মানে কি... তোর কি কন্ডম চাই?”
অভিঃ “না রে বোকা..., আমার বিয়ার চাই।”
সুপ্রতিমদাঃ “বিয়ারের ক্যারেট গাড়িতে।”
অভিঃ “তাহলে গাড়ির চাবি দে।”
সুপ্রতিমদাঃ “গাড়ির চাবি বলবিন্দারের কাছে। বোকা... এখন যা এখান থেকে আর আমাদের একটু শান্তিতে শুতে দে।”
অভি মুখ বাড়িয়ে রিতিকার দিকে চোখ টিপে বলে, “ডারলিং, তোমার রাতের ঘুম হয়ে গেছে।” অভির মুখে ওই কথা শুনে রিতিকা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে কম্বলের নিচে মুখ ঢেকে নেয়।
সুপ্রতিমদা অভির ওপরে চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... এখান থেকে যা না হলে মেরে ফেলব তোকে।”
বলবিন্দারে কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে অরুনার রুমে ঢুকে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল আর এক হাতে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে থাকে। পরীর জন্য অধীর অপেক্ষায় সময় যেন আর কাটেনা। বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও যখন দেখে যে পরী আর আসেনা, তখন রুম থেকে বেরিয়ে পরীর রুমে যায়। রুমের দরজা আলতো করে ভেজানো দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে রুমের মধ্যে।
বিছানায় একটা কম্বলের নিচে পরী শুয়ে আর একটা কম্বলের নিচে অরুনা। পরী ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে আর অরুনা ওর বুকের কাছে মাথা রেখে শান্তির নিদ্রা যাপন করছে। অরুনা পরীর বুকের কাছের জামা শক্ত করে মুঠিতে ধরে যেন ছাড়লেই যদি পালিয়ে যায় সেই ভয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে পরীর রাত্রিবাস। অভি দুজনার মুখের দিকে তাকালো, পরীর স্নেহময়ি মূর্তি দেখে মন অনাবিল আনন্দে ভরে গেল। পরীর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে গালে একটা ছোট্ট চুমু খেলো আর অরুনার মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিল। দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে অরুনার রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লো অভি।
পরের দিনের বেশির ভাগ সময়ে সবাই চিতকুল ঘুরেই কাটিয়ে দেয়। সকালে খেতে বসে কল্যাণী আর রিতিকা অভিকে প্রশ্ন করে যে কি ভাবে ও এই জায়গার কথা জানে, তাঁর উত্তরে অভি জানায় যে বেশ কিছু বই আর ম্যাপ পড়াশুনা করে ও এই জায়গার কথা জেনেছে।
অরুনার গলায় মৃদু রাগ, “এটাকে সাহসী বলে না বুঝলি, এটা পাগলামি, শুচিদিকে নিয়ে এই রকম একটা জায়গায় আসা। এই জায়গা তো মনে হয় পৃথিবী থেকে বাইরে।”
পরী সবার দিকে হেসে বলে, “আর এই জন্যেই প্রথম রাতে আমাদের ঝগড়া হয়েছিল।”
অভি পরীকে ক্ষেপানোর জন্য বলে, “আর পরেরদিন সকালে কি হয়েছিল?”
পরী লাজুক হেসে অভিকে আদর করে চাঁটি মারে। ওর মুখের লালিমা দেখে কারুর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সকালের কি ঘটেছিল।
তাও রিতিকা পরীকে ছাড়ে না, জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, কি হয়েছিল পরেরদিন সকাল বেলায়, শুনি।”
পরী অভির দিকে তাকিয়ে নিচু সুরে বলে, “নাও এবারে ম্যাও সামলাও...”
অভি রিতিকার দিকে চোখ টিপে বলে, “ডারলিং, কাল রাতে তুমি যা করছিলে, সেটাই ওর সাথে সেদিন রাতে হয়েছিল।”
রিতিকার গাল লাল হয়ে ওঠে লজ্জায়, খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে যেন ফাঁক খোঁজে একটু মুখ লুকানোর জন্য।
সকালের খাওয়ার পর্ব শেষে, পরী মেয়েদের নিয়ে বিয়াস নদীর দিকে যায়। ছেলেরা হোটেলের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে চারপাশের পাহাড় দেখে আর সিগারেট টানতে টানতে গল্প করে। হোটেলের সামনে থেকে নদীর তীর বেশ পরিস্কার দেখা যায়, দূর থেকে লক্ষ্য করে যে মেয়েরা বেশ মজা করছে। সুপ্রতিমদা আর দীপঙ্কর অভিকে পরবর্তী জায়গার কথা জিজ্ঞেস করে। অভি জানায় যে পরবর্তী স্থান, নাকো। আগামিকাল সকাল সকাল ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে তবেই রাতের আগে নাকোতে পৌঁছে যাবে ওরা। মেয়েরা বেশ খানিকখন পরে নদীর ধার থেকে ঘুরে হোটেলে ফিরে আসে।
দুপুরের খাওয়ার সময়ে পরী অভিকে বলে, “গ্রীষ্ম কালে পাহাড় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে, চারদিক সবুজে ঢাকা, শিতকালের চেয়ে একদম আলাদা সৌন্দর্য। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ যে আমাকে দুই ঋতুতেই এখানে এনেছো।”
অভিঃ “সব তোমার জন্য হানি, তোমার সেই অদৃশ্য চিঠি না পেলে এখানে কোনদিন আসা হতোনা।”
অরুনা ওদের কথাবার্তা শুনে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “অদৃশ্য চিঠি? সেটা কি?”
অভি ওকে সেই চিঠির কথা বলে আর এই জায়গার আসার সেই পরিকল্পনার গল্প বলে। অভি মজা করে বলে যে ওর হবু বউয়ের শিক্ষয়িত্রী না হয়ে গোয়েন্দা হওয়া উচিত।
বিকেলে হোটেলের ম্যানেজার অভিদের জিজ্ঞেস করে যে রাতে বনফায়ার করতে চাই কিনা। বনফায়ারের কথা শুনে পরী আর রিতিকার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, এক কথায় সব মেয়েরাই নেচে ওঠে রাতের বনফায়ারের কথা শুনে। রাতে বনফায়ারের চারপাশে গোল করে সবাই বসে, মাঝে কাঠের আগুন জ্বলছে। পরী চেয়ারে বসে, ওর পায়ের কাছে অভি বসে ওর কোলে মাথা রেখে। পরী অভির চুলে আদর করে দেয়। পরীর একপাশে অরুনা অন্য পাশে রিতিকা। রিতিকার পায়ের কাছে সুপ্রতিমদা বসে ওর কোলে মাথা রেখে। অরুনার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় অভি, অরুনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে, আবার সেই পুরানো অরুনাকে দেখতে পেয়ে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে। অভি নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে আগুনের লাল হলদে আলোয় আলোকিত অরুনার হাসিহাসি মুখের দিকে। পরী অভির দৃষ্টি অনুসরন করে অরুনার দিকে তাকায়।
পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, “অরুনা এখন অনেকটা ভাল আছে। তবে আরও কিছু সময় লাগবে ওর মনের অবস্থা ঠিক হতে, চিন্তা কোরোনা ধিরে ধিরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরীর কোলের ওপরে মুখ ঘষে বলে, “সত্যি তোমাকে যে কি করে ধন্যবাদ জানাবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”
অভির চুলে বিলি কেটে বলে, “আমাকে কেন ধন্যবাদ জানাবে? তোমার কষ্ট কি আমার কষ্ট নয়?”
অভি মুখ তুলে ওর গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে কি আজ রাতে আমরা সেলিব্রেট করছি?”
চুলের মাঝে আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “না হানি, এখন ওর মানসিক অবস্থা ঠিক নয়। তোমার চেয়ে আমাকে ওর বেশি দরকার, একটু বুঝতে চেষ্টা করো সোনা।”
অরুনা ওদের কথা শুনে ফেলে জিজ্ঞেস করে, “এই তোরা কি বলছিস রে?”
পরী আদর করে ওর গালে চাঁটি মেরে বলে, “কিছু না, তুই আনন্দ কর, আমরা একটু আসছি।”
পরী অভিকে টেনে তুলে হোটেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বলে, “গতকাল রাতে, অরুনা পুবালিকে স্বপ্নে দেখে যে ও ডাকছে। ভয়ে আঁতকে ওঠে ও, আর সেইজন্য আর ঘুম আসেনা। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেছিল, আমাকে একদম ছাড়ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে ওকে আমি সান্তনা দেই আর বুঝাই, তবে গিয়ে ওর চোখে ঘুম আসে। এমত অবস্থায় কি করে ওকে আমি একা ফেলে দেই বলো?”
অভি পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সারা চেহারায় যেন এক মাতৃময়ী রুপের আলোক ছটা বিচ্ছুরিত হয়। রাতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যায়, কারন সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে পড়তে হবে নাকোর দিকে। পরী অরুনাকে নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকে যায়। দরজা বন্ধ করার আগে অভির দিকে আদর করে ম্লান হেসে বলে, “ব্যাস আর কিছু দিন হানি। তোমার ওর বেশি জরুরি আমাকে কাছে পাওয়া। আমি জানি তুমি বুঝে নেবে।” অভি বুকের কাছে হাত এনে চেপে ধরে জিজ্ঞেস কর, “তুমি কে? তুমি কোন সময়ে স্নেহময়ী মাতৃ মূর্তি আবার কোন সময়ে আমার প্রেয়সী সুন্দরী। কি করে তুমি এত রুপ ধারন করো?”
পরীর গালে আদর করে অভি, “আই লাভ ইউ।”
পরী ওর ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, “মনে আছে তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে এই পাহাড়ের মাঝে আমার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর বানিয়ে দেবে।”
মাথা নাড়ায় অভি, ওর সেসব কথা বেশ ভালো করে মনে আছে।
পরদিন সকাল আটটার মধ্যে খাওয়া সেরে অভিরা বেরিয়ে পড়ে নাকোর উদ্দেশ্যে। গাড়ির চালক সুপ্রতিমদা, পাশে বসে ওর প্রেয়সী, রিতিকা। অভি, পরী আর অরুনা পেছনে বসে। একসময়ে রিতিকা সুপ্রতিমদার কোল ঘেঁসে বসে গালে আলতো করে চুমু খায়।
অভি সেই দেখে রিতিকাকে খেপিয়ে বলে, “রিতু ডার্লিং, সুপ্রতিমদার গিয়ার বদলাতে যেও না।”
সুপ্রতিমদা চেঁচিয়ে ওঠে, “বোকা... চুপচাপ পেছনে বসে থাক।”
গালাগালি শুনে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। পরী ভাবতেই পারেনি ওদের মুখ থেকে এইরকম সব গালাগালি বের হবে। রিতিকার মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়, সুপ্রতিমদার কাছ থেকে সরে, লজ্জা লুকাতে জানালার বাইরে দেখে।
পোয়ারিতে থামে গাড়িতে তেল ভরানোর জন্য। ইনোভা ওদের গাড়ির ঠিক সামনে। রেকংপিও পার হবার পরেই পাহাড়ের রঙ বদলাতে শুরু করে। এতক্ষণ দুপাশে সবুজ ঘাসে বা গাছে ঢাকা পাহাড় ছিল, পিওর পরে পাহাড়ের রঙ হয়ে যায় ধুসর। ব্রিজ পার হবার পরেই চারপাশে ন্যাড়া পাহাড়, কোথাও ঝুরঝুরে পাথর রাস্তার ওপরে পরে। সুপ্রতিমদার গাড়ি চালাতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, এবড়োখেবড়ো রাস্তার ওপরে গাড়ি যেন ঢেউয়ের মতন দোল খায়। শতদ্রু নদী রাস্তার একপাশ দিয়ে নিজের মনে বয়ে চলে। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে বসে, অভি একহাতে পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে। অরুনা চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর কঠিন সৌন্দর্য দেখে।
অরুনা কিছু পরে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে একটা কথা বলবি আমাকে? পঞ্চাশ ক্যান বিয়ার আর পাঁচ বোতল ভদকা এনেছিস। তোরা দুজনে কি সারাটা রাস্তা গলায় ঢালতে ঢালতে যাবি?”
অভি নির্লজ্জের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
অরুনা বিরক্ত হয়ে ওঠে, “যাচ্ছেতাই মানুষ তোরা...”
সুপ্রতিমদা অরুনা কথা শুনে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, “আরে, আমি তো বিয়ারের কথা একদম ভুলে গেছিলাম, তোমার কথা শুনে মনে পড়ে গেল। এবারে তো এক এক ক্যান মারতেই হয়।” অভিও মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
পরী ওকে আদর করে মারতে শুরু করে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা খাব ব্রিজ পৌঁছে যায়। ইনোভা সামনে দাঁড়িয়ে, কল্যাণী আর রানীরা গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের পাহাড় দেখছে। একদিক দিয়ে শতদ্রু নদী একদিকে স্পিতি নদী এখানে মিশেছে। রিতিকা ওদের দেখে সুপ্রতিমদাকে গাড়ি দাঁড় করাতে অনুরোধ করে।
সুপ্রতিমদা গাড়ি দাঁড় করাতেই গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়ে। সামনে রাস্তার অবস্থা দেখে সুপ্রতিমদা একটু থমকে যায়। ব্রিজের ওপারে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি, মাথার ওপরে ছাদের মতন ঝুলে আছে পাহাড়, একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে উত্তাল তরঙ্গিণী স্পিতি নদী। ব্রিজের নিচে, স্পিতির আর শতদ্রুর জল মিলেমিশে যেন যুদ্ধে রত। অভি গাড়ির পেছনে গিয়ে দুটি ক্যান বিয়ার নিয়ে একটা সুপ্রতিমদার হাতে ধরিয়ে দেয়। পরী মেয়েদের নিয়ে স্পিতির দিকে হেঁটে নেমে যায়। দুরে দেখা যায়, নাকোর খাড়া রাস্তা। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে। সুপ্রতিমদা পরীর কাছে গিয়ে রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করে। দুরে দাঁড়িয়ে অভি পরীকে দেখে, বেশ ভালো ভাবে রাস্তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়।