What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (2 Viewers)

পর্ব ২৮ (প্রতিশোধ না পরিণতি)

ট্রুথ এন্ড ডেয়ার ঘুরতে ঘুরতে অনুপমার কাছে চলে আসে। রূপক ওকে জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা একবার দেবায়নের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “ট্রুথ।”

সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতা ওকে প্রশ্ন করে, “দেবায়ন অনেকের সাথে শুয়েছে, এইবারে বুকে হাত দিয়ে বল এই সব জানার পরে তোর কোনোদিন হিংসে হয়নি?”

অনুপমা বড় বেকায়দায় পড়ে যায়, দেবায়নের হাত বুকের কাছে টেনে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। সত্যি বলতে একবার খুব খারাপ লেগেছিল যখন জানতে পারে দেবায়ন ওর মায়ের সাথে সহবাস করেছে। ওর চোখের ভাষা দেবায়ন পড়ে ফেলে কানে কানে বলে, আসল সত্য বাঁচিয়ে অতি কৌশলে যেন উত্তর দেয়।

অনুপমা মিচকি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ একবার হয়েছিল তবে আমি প্রান দিয়ে জানতাম যে পুচ্চু শত জনের সাথে শুয়ে আসার পরেও ওর বুকের মধ্যে শুধুমাত্র আমার জায়গা থাকবে, তাই পরে আর হিংসে হয়নি।”

রূপক, ধীমান একসাথে ওকে প্রশ্ন করে, কে কে। অনুপমা সুকৌশলে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে বলে, “একবার প্রশ্নের উত্তর দেবো ব্যাস হয়ে গেছে উত্তর, এইবারে পুচ্চুর টার্ন।”

এমন সময়ে একটা অন্ধকার ফুঁড়ে একটা ছেলের আবির্ভাব হয়। ছেলেটাকে দেখে মনে হলো ওদের মাল বাহকের মধ্যে কেউ। ছেলেটা দেবায়নের কাছে এসে অনুরোধ করে, “বাবু কিছু টাকা চাই।”

দেবায়ন একবার আপাদমস্তক ছেলেটাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “তুই কে?”

ছেলেটা অবাক হয়ে উত্তর দেয়, “বাবু আমি রাজু পোর্টার। আপনাদের খাবারের ব্যাটারি নিয়ে একদম আগে ছিলাম।”

দেবায়ন মাথা দোলায়, “আচ্ছা, কিসের জন্য টাকা চাই?”

ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দেয়, “বাবু আমরা একটু মদ খাবো তাই টাকা চাই।”

এতক্ষণ অনুপমাকে কোলে জড়িয়ে ধরে আগুনের সামনে বসে ছিল দেবায়ন, তাও পকেট থেকে পার্স বের করে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, “কত টাকা চাই তোদের?”

ছেলেটা একটু হেসে আমতা আমতা করে বলে, “না মানে, ওইপাশে আমাদের দলের লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। ওইখানে গিয়ে দিলে বড় ভালো হয়।”

“আচ্ছা” দেবায়ন মুখ কাঁচুমাচু করে অনুপমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অনুপমা কিছুতেই ওকে ছাড়তে চায় না, উল্টে ছেলেটাকে বলে, “তোমরা টাকা নিয়ে চলে যাও আবার ওকে ওইখানে কেন যেতে হবে।”

ছেলেটা আমতা আমতা করে বলে, “না মানে একটু কথা ছিল তাই।”

দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে অনুপমাকে বলে, “আচ্ছা বাবা, দেখি না ওরা কি বলতে চাইছে।” বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোরা চালিয়ে যা, আমি একটু আসছি।”

ছেলেটার সাথে দেবায়ন গ্রামের অন্যপাশে, ঘন জঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগায়। যেতে যেতে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে ওর বাড়ি কোথায়, কবে থেকে এই পোর্টারের কাজ করছে ইত্যাদি। ছেলেটা উত্তর দেয়, কিছু ওর কানে ভেসে আসে কিছু শুনতে পায়না। দেবায়ন একটু তাড়াতাড়ি হাঁটছিল আর ছেলেটা ওর পেছনে পেছনে হাঁটছিল।

কথাবার্তা থামিয়ে দেবায়ন হাঁটতে হাঁটতে রাতের সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে, চারপাশে তাকিয়ে দেখে। মাথার ওপরে ঘন কালচে নীল আকাশে কোটি কোটি তারার ঝিকিমিকি, আকাশ গঙ্গা পরিস্কার এই আকাশে দেখা যায়, যেটা শহরের আকাশে এক দুর্লভ দৃশ্য। উত্তরের সুউচ্চ হিমালয় থেকে ভেসে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওর শরীর কাঁপিয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুইজনে একটা খাদের কিনারায় চলে আসে। একপাশ থেকে ছোট ছোট ঝর্না বয়ে গভীর খাদের নীচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর সাথে মিশে গেছে। সরু রাস্তার অন্যপাশে ঘন বন, রডোডেন্ড্রন, পাইন কেদার ইত্যাদি উঁচু উঁচু পাহাড়ি গাছপালায় ঘেরা, একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে ভেসে আসে।

হাঁটতে হাঁটতে খাদের কিনারায় এসে দেখে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। পেছন ঘুরে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, কি রে... কিন্তু পেছনে কেউ নেই। হটাত ওর বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। আসলে কে এই ছেলেটা, কি কুমতলবে ওকে এই নির্জনে ডেকে এনেছে? দূরে গ্রামের ছোট ছোট ঘর বাড়িগুলোর আলো অনেক আগেই নিভে গেছে। আরো দূরে ওদের বন ফায়ারের আলো দেখা যাচ্ছে। আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদুরে চলে এসেছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না।

হটাত ওর পেছনে জঙ্গলের মধ্যে থেকে খসখসে পাতার ওপরে কারুর পা ফেলার আওয়াজে চমকে ওঠে। ঘুরে গাছের দিকে তাকানোর আগেই ওর মাথার পেছনে কেউ একজন একটা লাঠি দিয়ে সজোরে বাড়ি মারে। এমনিতে চারপাশ অন্ধকার, তারপরে এই ঠাণ্ডায় আচমকা মাথার পেছনে লাঠির বাড়ি খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখে দেবায়ন।

মাথা ধরে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এক পুরুষের মূর্তি, হাতে একটা লোহার রড। মাথার পেছনে হাত দিয়ে গরম রক্ত অনুভব করতে পারে। হাত মুঠি করে দাঁতে দাঁত পিষে আগন্তকের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক তখনি ওই আগন্তুক দ্বিতীয় বার ওর মাথার ওপরে রড দিয়ে বাড়ি মারে। চোখে সর্ষে ফুল দেখে দেবায়ন।

ওই অন্ধকারে ঢাকা আগন্তুকের দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “মাদারচোদ, তুই কে?”
 
পরিস্কার ইংরেজিতে গম্ভির চাপা কণ্ঠে গর্জে ওঠে অন্ধকারে ঢাকা সেই আগন্তুক, “তোকে মারার জন্য অনেকদিন থেকেই ফন্দি করছিলাম। শেষ পর্যন্ত এইখানে তোকে একা পেয়ে গেলাম।”

দেবায়ন মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে এটা কার কণ্ঠস্বর। বেশ চাপা গভীর কণ্ঠস্বর, শুনেই মনে হচ্ছে আসল আওয়াজ ঢাকার জন্য গলার স্বর ভারী করে কথা বলছে সেই আগন্তুক। ইংরেজিতে কথা বলছে, নিশ্চয় বুঝতে দিতে চায় না কোথাকার মানুষ, বাঙালী হতে পারে অবাঙালী হতে পারে। মুখের ওপরে মাফলার বাঁধা, অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই, গায়ে লম্বা ওভারকোট, কত বয়স সেটাও জানা সম্ভব হচ্ছে না। কপাল বেয়ে সরু রক্তের রেখা দেখা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে দেবায়ন সামনের আগন্তুকের দিকে ঢলে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে ওই আততায়ী ওর কলার ধরে গলা টিপে ধরে চাপা ভারী কণ্ঠে বলে ওঠে, “সবাই ভাববে তুই পা ফসকে এই নদীতে পড়ে গেছিস। কেউ জানবে না তোর আততায়ী কে।” বলেই এক ধাক্কা মেরে খাদের মধ্যে ফেলে দেয়।

হটাত করে শুন্যে ভাসমান মনে হয় নিজেকে। চোখের সামনে শুধুমাত্র অনন্ত অন্ধকার, তাও হাতড়ে হাতড়ে কিছু বুনো ঝোপ ঝাড় আঁকড়ে ধরে প্রানে বাঁচতে চেষ্টা করে দেবায়ন। ওপরে দিকে তাকিয়ে দেখে ওই আততায়ী খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঠিক ওর ওপরে। এক হাত বাড়িয়ে আততায়ীর পা ধরে নিচের দিকে টানতে চেষ্টা করে কিন্তু ওই আততায়ী লোহার রড দিয়ে ওর হাতে বাড়ি মারে এবং সেই সাথে হাতের ওপরে পা দিয়ে পিষে দেয়।

ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে দেবায়ন সেই সাথে গর্জে ওঠে, “তোকে হাতে পেলে দেখে নেব।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আততায়ী, “বাঁচলে তবে তো দেখবি। আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছিস, মৃত্যুই তোর আসল পরিণতি। এটাই আমার প্রতিশোধ।” বলেই ওর মাথায় রডের বাড়ি মারতে যায়, দেবায়ন মাথা সরিয়ে নিতেই রডের বাড়ি সোজা ওর কাঁধে এসে লাগে আর ওর কাঁধের একটা হাড় নড়ে যায়। ধরে থাকা ঝোপের ওপর থেকে ওর হাতের থাবা হাল্কা হয়ে যায়। লম্বা চওড়া দেহের ভার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিচের দিকে টানতে শুরু করে দেয়। শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে না পেরে ওর হাত আপনা হতেই সেই মাটি ছেড়ে দেয়। শুন্যে ভাসমান হয়ে দেবায়নের দেহ নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে দেয়।

নীচে নদীর জলে পড়ার আগে একবার ওর বুক ডাক ছাড়ে, “পুচ্চি ইইইইইইইইই....” হয়তো এই আওয়াজ কোনোদিন ওর পুচ্চির কানে যাবে না, হয়তো এই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে চলে যেতেও পারে।

ঝপাং করে দেবায়নের অর্ধ অচৈতন্য দেহ কনকনে বরফ গলা জলের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে। ওর জ্যাকেট ভিজে যায়, ওর জামা ওর জিন্স ভিজে যায়। পিঠের পেছনে একটা পাথর এসে ধাক্কা খায়, মনে হলো শিরদাঁড়ার কয়েকটা হাড় নড়ে উঠলো। প্রবল স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী ওর দেহ ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক অজানা পথের দিকে। জানে না কোথায় যাচ্ছে জানে না ওর পুচ্চি কোনোদিন ওর সন্ধান পাবে কি না।

ধীরে ধীরে দেবায়নের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। চারপাশে শুধু ঘন কালো অন্ধকার আর মৃত্যুর হাতছানি ছাড়া আর কিছু নেই। কানে ভেসে আসে নদীর গর্জন তা ছাড়া আর কোন আওয়াজ দেবায়নের অচৈতন্য কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। এই জীবনে অনেক পাপ করেছে, নিজের প্রেমিকা অনুপমার মায়ের সাথে যৌন সহবাসে লিপ্ত হয়েছে। এক সময়ে নিজের গর্ভধারিনী মাকেও সেই চরম কামের বশে জড়িয়ে ধরেছিল। বড় পাপ, এ যে বড় পাপ। কামের বশে অনেকের সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। ব্যাবসার ক্ষেত্রে অনন্যার দেহ, এমন অনেক মডেলের দেহ ব্যবহার করেছে। পুনের হোটেলের মালিক রজত পানিক্করের থেকে ওর হোটেল ছিনিয়ে নিয়েছে, এমন ভাবে বহু জায়গায় ব্যাবসার মারপ্যাঁচে কাজ হাসিল করেছে। যেখানে টাকা দিয়ে কাজ হয়েছে সেখানে টাকা দিয়েছে, যেখানে মেয়েদের শরীর দিয়ে কাজ হয়েছে সেখানে অনন্যা, তনুজার মতন মেয়েদের ব্যবহার করেছে, যেখানে ওকে হুমকি দিতে হয়েছে সেখানে রীতিমতন হুমকি দিয়ে কাজ হাসিল করেছে। অনেকের অনেক গোপন খবর জেনে ফেলেছে এর মধ্যে, তাহলে কি তাদের মধ্যে কেউ ওকে খুন করলো? কে হতে পারে এই আততায়ী? সোমেশ কাকু? ধৃতিমান, সূর্য, সত্যজিত অনিমেশ না ভাড়া করা কেউ? কে ভাড়া করতে পারে একে? উত্তর জানা নেই দেবায়নের কারন ওই আততায়ী ওকে মারার আগে উত্তর দিয়ে যায়নি। ওই আততায়ীর পরিচয় পাওয়া আর সম্ভব নয় কারন ওর দেহ এই প্রবল নদীর ধারায় এক অজানা পথে পাড়ি জমিয়ে দিয়েছে। ওই আততায়ী আসলে কে? কি কারনে ওর এই ভীষণ পরিণতি ঘটল? কে নিল প্রতিশোধ, না ওর দুষ্কর্মের পাপের পরিণতি?

কনকনে ঠাণ্ডা জলে ভাসতে ভাসতে দেবায়নের শরীর নিঃসাড় হয়ে যায়। একটুক্ষণ না অনেকক্ষণ, সময়ের ঠিক পায় না। একসময়ে দেবায়ন চোখ মেলে অবাক হয়ে যায়। চারপাশের অন্ধকার কেটে ওর চারপাশে জোরালো সাদা আলো আর মৃদু কুয়াশায় ঢাকা। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, হাল্কা মোলায়ম মেঘের ভেলার ওপরে দেবায়ন বসে। চারপাশে তুলোর মতন হাল্কা মোলায়ম মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেদিকে তাকায় সেদিকে শুধুমাত্র জোরালো সাদা আলোয় ভর্তি। নির্মল শীতল মলয় বইছে চারপাশে, আলোয় কোন ঠাণ্ডা ভাব অথবা গরম ভাব নেই, মনে হলো যেন চির বসন্তের এক স্থানে পৌঁছে গেছে। হাতের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে, ছোট ছোট দুটো হাত, আঙুলগুলো ছোট ছোট। পঁচিশ বছরের একটা ছেলের এতো ছোট আঙুল কি করে হতে পারে? মুখে গালে হাত দিয়ে দেখে, না এই চেহারা ওর নয়। এই গাল বেশ ফুলো ফুলো, বুকের দিকে, নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারে দেবায়ন আর পঁচিশ বছরের যুবক নয়, ছোট এক শিশু দেবায়ন শুধুমাত্র একটা লাল প্যান্ট আর একটা সাদা গেঞ্জি পরে মেঘের ভেলায় বসে।

এমন সময়ে সামনের কুয়াশা কাটিয়ে এক সুঠাম পুরুষের আবির্ভাব হয়। সেই সুপুরুষ ব্যাক্তিকে দেখেই দেবায়ন চিনতে পারে, ওর বাবা, সায়ন্তন বসাক দাঁড়িয়ে। ওর বাবা ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মিষ্টি হেসে দেবায়ন ছোট ছোট পায়ে বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়।

ঠিক তখনি বহু দুর থেকে এক মিষ্টি নারী কণ্ঠের আর্তনাদ ওর কানে ভেসে আসে, “পুচ্চুউউউউউউ... তুই কোথায়?”

শিশু দেবায়ন এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে। ওই নারীকণ্ঠ কাকে ডাক দেয়? এই পুচ্চুকে? পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর মা দুই হাত বাড়িয়ে ছল ছল চোখে ওর দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। দুই বড় বড় কাজল কালো চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে ওর মা ওকে ডাক দেয়, “আয় বাবা আমার কোলে ফিরে আয় সোনা। তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই রে...”

সামনে ওর বাবা ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। দেবায়ন একবার মায়ের দিকে তাকায় একবার বাবার দিকে তাকায়। কার কাছে যাবে কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বাবার দিকে তাকিয়ে আধো আধো কণ্ঠে বলে, “তুমি চকোলেট এনেছো?”

ওর বাবা হাতের মুঠি মেলে একটা চকোলেট দেখিয়ে মাথা দুলিয়ে ওকে ডাক দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকায় দেবায়ন। মায়ের ঠিক পেছনে এক অতীব সুন্দরী বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মাকে চিনতে অসুবিধে হয় না কিন্তু পেছনে দাঁড়ানো, রুপোলী সুতোর বোনা জালের পোশাক পরিহিত সেই সুন্দরী কন্যের পরিচয় জানে না দেবায়ন। ওই সুন্দরী মেয়েটার টানাটানা চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে ওকে দেখে।

ওর মা আবার ওকে ডাক দেয়, “বাবারে আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই রে বাবা।”

পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটার ঠোঁট জোড়া ফুলে ওঠে, গোলাপি গাল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়ে পড়ে। দেবায়ন একবার বাবার হাতের দিকে দেখে, একটা ছোট চকোলেট হাতে ওর বাবা স্মিত হেসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

দেবায়ন মিষ্টি হেসে মাকে বলে, “মা মা, বাবা আমার জন্য চকোলেট এনেছে। এইবারে আমি বাবার সাথে যাই।”

ওর মা আর্তনাদ করে ওঠে, “না বাবা দয়া করে আমাকে একা ফেলে যাস নে...”

দেবায়ন ধীরে ধীরে বাবার দিকে হাঁটতে শুরু করে দেয়। আবার কানে ভেসে আসে বহুদুর থেকে ভেসে আসা এক নারী কণ্ঠের আর্তনাদ, “পুচ্চুউউউউউউ তুই কোথায়?”

দেবায়ন জানে না কে এই পুচ্চু। দেবায়ন জানে না হটাত করে এতো ছোট কি করে হয়ে গেল। দেবায়ন জানে না, কি করে বাবার দেখা পেল। দেবায়ন জানে না কি করে এই সাদা মেঘের রাজ্যে এসে পৌঁছে গেল। অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবায়নের অজানা রয়ে যায় তাও বাবার দিকে এগিয়ে যায়।

প্রতিশোধ না পরিণতি?
 
পর্ব ২৯

মুখের ওপরে জলের ছিটা পড়তেই অনুপমার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে শ্রেয়াকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে অনুপমা, “পুচ্চুকে পেলি?”

শ্রেয়া ওর কপালে হাত বুলিয়ে মৃদু মাথা নাড়িয়ে বলে, “না রে এখন পাওয়া যায়নি। তবে তুই চিন্তা করিস না...”

চারপাশে সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, সবার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই এইখানে আনন্দ ফুর্তি করতে এসেছিল, অকস্মাৎ এই দুর্ঘটনায় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। রূপক, শান্তনু, রঞ্জিত খাদের চারপাশে খুঁজে খুঁজে কোন চিহ্ন না পেয়ে হয়রান হয়ে ফিরে এসেছে। অনুপমা চুপচাপ বসে ভাঙা বুক আর অসীম বেদনা নিয়ে সবার দিকে ছলছল চোখে তাকায়। এক ধাক্কায় ওর সাধের পৃথিবী উজাড় হয়ে গেছে। ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দেবায়ন ছাড়া কোলকাতা ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। দেবায়ন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারছে না কিছুতেই। ওর অঙ্গে, ওর হৃদয়ের সর্বত্রে ওর ভালোবাসার ছাপ অঙ্কিত। অনামিকার আংটি ওকে বারবার মনে করিয়ে দেয় এই ডিসেম্বরে ওদের বিয়ের কথা চলছিল। স্বপ্ন দেখেছিল এই পাহাড়ের কোলে ঘর বাঁধবে। শ্রেয়ার বাহুপাশ থেকে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কুঁকড়ে বসে যায়। ওকে ছাড়া ওর জীবনে রঙ উবে গেছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে গাইড রঞ্জিতকে অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “তোমার দলের একটা পোর্টার এসেছিল ওকে ডাকতে, সে নিশ্চয় জানে দেবায়ন কোথায়। তাকে ডাক।”

রূপক উত্তরে বলে, “না রে ওই ছেলেটা ভুয়ো। রাজু নামে আমাদের দলে কোন পোর্টার নেই। আমার মনে হয়...”

অনুপমা বিস্ফোরিত চোখে রূপকের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “ওই নামে পোর্টার নেই মানে? তাহলে পুচ্চুকে...” দৃষ্টি আবার ঝাপসা হয়ে আসে অনুপমার, কিছু আর ভাবতে পারছে না। কম্পিত কণ্ঠে রূপককে জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় কোথায় পুচ্চুকে খুঁজেছিস?”

রূপক, শান্তনু সবাই জানায় ওরা চারদিকে দেবায়নকে খুঁজেছে কিন্তু কোথাও ওর চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অনুপমা নিজেই ওকে খুঁজতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকট করে। সবার মানা করা সত্ত্বেও অনুপমা একাই যেদিকে দেবায়ন গিয়েছিল সেদিকে হাঁটা দেয়। ওকে ওইভাবে উন্মাদিনীর মতন হাঁটতে দেখে পায়েল আর শ্রেয়া দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেলে। কিন্তু অনুপমা ওদের হাত ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাদের কিনারায় চলে আসে। চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা, শুধুমাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর গভীর খাদের নীচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না।

গলা ছেড়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউউউ.... তুই কোথায়?”

ওর হৃদয় ভাঙা বেদনা যুক্ত কণ্ঠস্বর সামনের পাহাড়ে আর জঙ্গলে প্রতিধ্বনি হয়ে ওর কানে ফিরে আসে। অনুপমা বারেবারে ডাক দেয় কিন্তু পাথরের পাহাড় থেকে কোন উত্তর আসে না। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে খাদের নিচের দিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেবায়নের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এপাশ ওপাশ খুঁজতে খুঁজতে অঙ্কন কিছু একটা দেখতে পেয়ে বাকিদের ডাক দেয়। অনুপমা দৌড়ে যেতেই অঙ্কন ওর হাতে দেবায়নের পার্স ধরিয়ে দেয়। পার্স দেখেই অনুপমার চোখ ছলছল করে ওঠে, বুকের মধ্যে পার্স লুকিয়ে দেবায়নের নাম ধরে বারেবারে ডাক দেয়। কিন্তু ওর শূন্য ডাকের সাড়া আর পাওয়া যায়না। টর্চের আলোয় খাদের পাশে রক্তের দাগ দেখে অনুপমার বুক আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পুচ্চু কি সত্যি সত্যি ওকে ছেড়ে চলে গেছে?

দেবায়নের বিরহে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায় অনুপমা। বাম হাত বুকের কাছে চেপে পুনরায় গলা ফাটিয়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউ প্লিস সোনা তুই এইভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না।”

টর্চের আলোয় চারপাশে খুঁজে দেবায়নের পার্স ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়না। খাদের কিনারা থেকে বেশ কিছু মাটি পাথর ধসে গেছে। ওই দেখে বাকিদের ধারনা হয় যে দেবায়ন এই খাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কিন্তু অনুপমার হৃদয় কিছুতেই মানতে নারাজ যে দেবায়ন আর ওদের মাঝে নেই। অনুপমা খাদের কিনারায় চুপচাপ কুঁকড়ে বসে পড়ে, দেবায়নের পার্স বুকের কাছে চেপে ধরে উচ্চস্বরে বারেবারে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ওকে ধরে থাকে পাশে বেদনায় অনুপমা খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয় এই আশঙ্কায়। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে এপাশ ওপাশ খুঁজে ক্লান্ত এক সময়ে টেন্টের দিকে হাঁটা দেয় কিন্তু অনুপমা ওই জায়গা থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। অনুপমা জেদ ধরে বসে থাকে, দড়ি নিয়ে আসো, এই রাতেই দড়ি বেয়ে ওই খাদের মধ্যে নামতে চায়। নদীর তীরে নিশ্চয় কোথাও দেবায়নকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই কনকনে ঠাণ্ডা জলে দেবায়ন বেশিক্ষণ থাকলে ওর হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে, ওর মৃত্যুর আশঙ্কা আরো বেড়ে যাবে।

অনুপমাকে কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব হয় না দেখে শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওকে খুব বকুনি দিয়ে বলে, “এই রাতে এই খাদের মধ্যে নামবি, তুই পাগল হয়েছিস নাকি?”

সারা রাত অনুপমা ওই খাদের কিনারায় কনকনে ঠাণ্ডায় বসে থাকে। নিরুপায় হয়ে শ্রেয়া আর পায়েল একটা স্লিপিং ব্যাগ ওর শরীরে জড়িয়ে দেয়। জানে ওই খাদে না নামা পর্যন্ত অনুপমাকে এইখান থেকে নড়ানো সম্ভবপর নয়। অগত্যা বাকিরাও সবাই পালা করে অনুপমাকে পাহারা দেয়।
সারা রাত বসে ভাবে অনুপমা, কে ওর দেবায়নকে এই নির্জন স্থানে এসে মারতে চেষ্টা করতে পারে। ওর সন্দেহের তালিকার মধ্যে অনেকের নাম আসে, কিন্তু কারুর দিকে সন্দেহের তীর হানার আগে তথ্য প্রমান সংগ্রহ করতে হবে। ওকে এইভাবে কাঁদলে চলবে না। এই খবর মামনির কানে পৌঁছালে মামনি খুব ভেঙে পড়বে, মামনিকে সামলাতে হবে।

সকালের সূর্য পুব দিক থেকে উঁকি মারতেই অনুপমা রঞ্জিতকে অনুরোধ করে দেবায়নকে খোঁজার জন্য। নিজেই খাদের কিনারা ভালো ভাবে তল্লাসি চালিয়ে বেশ কিছু তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দেবায়নের পায়ে স্নিকার পরা ছিল, সেই পায়ের ছাপের সাথে সাথে আরো এক জোড়া জুতোর ছাপ পাওয়া যায়। জুতোর ছাপে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে দেবায়ন আর আততায়ীর মাঝে বেশ ধস্তাধস্তি হয়েছিল। আশেপাশে ঝোপ ঝাড়ে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েই অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। খাদের বেশ নীচে বেশ কিছু ঝোপ ঝাড় উপড়ে গেছে, মাটি ধসে নিচের দিকে নেমে গেছে। একদিকের একটা ঝোপের মধ্যে একটা সিগারেট প্যাকেট আর একটা আধা খাওয়া সিগারেট পাওয়া যায়। সিগারেট প্যাকেট দেখে অনুপমা জানায় এই ব্রান্ডের সিগারেট দেবায়ন খায়। আততায়ীর পায়ের ছাপ জঙ্গলের দিকে মিলিয়ে গেছে। রূপক ধীমান প্রবাল সবাই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেই আততায়ীকে খোঁজার জন্য কিন্তু পায়ের ছাপ কিছু দুর গিয়ে পাতা ভর্তি মাটির ওপরে হারিয়ে যাওয়াতে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে ফিরে আসে জঙ্গল থেকে।

রঞ্জিত গ্রাম থেকে আরো ছেলে জোগাড় করে দড়ি দিয়ে খাদের মধ্যে নদীর কিনারায় নামিয়ে তল্লাসি চালায়। শান্তনু জানায় এটা খুনের মামলা সুতরাং একবার পুলিসকে খবর দেওয়া উচিত। রীহ থেকে সব থেকে কাছের পুলিস স্টেসান, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে একদিন লেগে যাবে। শান্তনু আর পরাশর, একজন পোর্টার নিয়ে ঘুট্টু হয়ে ঘনসিয়ালি চলে যায় পুলিসকে খবর দিতে।

সন্ধ্যের পরে অনুপমার বাবা, মিস্টার সোমেশ সেন রীহতে এসে হাজির হন। সেই সাথে শান্তনু আর পরাশর পুলিস নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। বাবাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় অনুপমা। বাবাকে কে খবর দিয়েছে, বাবা কি করে এতো তাড়াতাড়ি এইখানে এসে পৌঁছালো।

অনুপমা অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এই ঘটনার খবর কে দিল?”

শান্তনু জানায়, “আমি তোমার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কাকিমা জানালেন যে সেন কাকু দেরাদুনে কাজের জন্য এসেছিলেন।” অনুপমার মনে ভয় ঢোকে, যদি এই দুর্ঘটনার খবর মামনির কানে পৌঁছায় তাহলে কি হবে। চরম উৎকণ্ঠায় শান্তনুর দিকে ছলছল চোখে তাকাতে শান্তনু জানায়, “চিন্তা নেই দেবায়নের মাকে এই বিষয়ে কিছুই এখন জানানো হয়নি।”

অনুপমা হিমশীতল চাহনি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “তোমার দেরাদুনে আসার কথা ছিলোনা। হটাত এমন কি কাজ পড়ল যে তুমি দেরাদুনে এসেছো?”

মেয়ের হিমশীতল কণ্ঠস্বর শুনে সোমেশবাবু অবাক হয়ে গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “কি বলতে চাস তুই?”

অনুপমা একভাবে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয়, “না কিছু না, এখন কিছুই বলতে চাই না আমি।”
 
পুলিস ইনস্পেকটর রোহন কাটিয়াল ঘটনাস্থল তল্লাসি করে সুত্র প্রমান একত্রিত করে ফেলেন। অনুপমা পুলিসকে জানায় একটা পাহাড়ি কম বয়সী ছেলে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, ওকে খুঁজে বের করতে পারলে দেবায়নের খবর আর আততায়ীর পরিচয় জানা সম্ভব হবে। পুলিস খুনের মামলার দায়ের করে জানায় ওদের থানায় স্কেচ আর্টিস্ট নেই। আততায়ীর সাথের ছেলেটার স্কেচ তৈরি করার জন্য ওদের নিউ তেহেরি থানায় অথবা দেরাদুনে অথবা হৃষীকেশে যেতে হবে। রূপক একটু আধটু আঁকতে জানতো, যে ছেলেটা এসেছিল তার একটা স্কেচ বানিয়ে পুলিসের হাতে তুলে দেয়। পুলিস ইন্সপেক্টর অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে ওর কাকে সন্দেহ। অনুপমা ছলছল চোখে সবার দিকে একবার তাকায়। কাকে সন্দেহ করবে অনুপমা? ওর যে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। অনুপমা পুলিসকে জানায় ওদের ব্যাবসা অনেক বিস্তৃত, ব্যাবসা ক্ষেত্রে দেবায়নের প্রচুর শত্রু থাকতে পারে কিন্তু এই নির্জন স্থানে এসে একেবারে ওকে খুন করার মতন পরিকল্পনা করতে পারে এমন কাউকে ওর সন্দেহ হয় না। তবে কারুর দিকে সন্দেহের আঙুল তোলার আগে নিজেই একবার খুনের উদ্দেশ্য যাচাই করে দেখতে চায়। প্রাথমিক তদন্ত সেরে পুলিস ইন্সপেক্টর জানায় এই ছেলেটার খোঁজ পেলে ওদের জানিয়ে দেবে।

সেদিন সারাদিনে নদীর দুইপাড় খানাতল্লাসি চালিয়েও দেবায়নের কোন খোঁজ পাওয়া যায়না। সন্ধ্যের পরেও অনুপমাকে কিছুতেই ওই খাদের কিনারা থেকে নড়ানো সম্ভব হয়না। দুইদিন টানা অনুপমা ওইখানে একভাবে বসে থাকে দেবায়নের প্রতীক্ষায়। ওর মন যে কিছুতেই মানতে নারাজ যে ওর পুচ্চু আর এই পৃথিবীতে নেই।

শ্রেয়া আর পায়েল, ঋতুপর্ণা সঙ্গীতা সবাই ওকে একা ছাড়তে নারাজ। যা হবার সবাই একসাথে মোকাবিলা করবে বলে বদ্ধপরিকর। আশায় বুক বেঁধে বসে থাকে অনুপমা এই বুঝি হটাত করে ওর পুচ্চু ওর পাশে এসে দাঁড়াবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে, ওর গালে চুমু খেয়ে বলে উঠবে, “এই একটু লুকিয়ে মজা দেখছিলাম।” কিন্তু না, আরো একদিন কেটে যায় দেবায়নের পরশ ওর কাঁধে আর স্পর্শ করে না।

দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার দুর্ঘটনায় সবার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, সবাই সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে। কেউই আর রীহতে ওইভাবে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। পরের দিন পুলিসের লোকের সাথে রঞ্জিতের লোকেরাও খাদের মধ্যে নেমে নদীর দুই পাড়ে খানা তল্লাসি চালায় কিন্তু দেবায়নের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়না দেখে সবার সংশয় হয় যে দেবায়ন সলিল সমাধি নিয়েছে। সেই কথা অনুপমা কিছুতেই মানতে চায় না, ওর মন বলছে দেবায়ন এখুনি কোথা থেকে বেরিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে। পুলিস, রঞ্জিত শান্তনু সবাই অনুপমাকে অনুরোধ করে কোলকাতা ফিরে যেতে। সবার ধারনা বদ্ধমূল হয় যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই, এই উঁচু খাদ থেকে ওই পাহাড়ি নদীতে পড়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।

ভগ্ন হৃদয়ে চতুর্থ দিন সকালে সবাই রীহ থেকে ঘুট্টুর পথ ধরে। ভাঙা বুক নিয়ে অনুপমা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আর বারেবারে দেবায়নের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলে। বারেবারে ওর আর্ত কণ্ঠস্বর পাহাড়ের গায়ে লেগে ওর কানে ফাঁকা আওয়াজ হয়েই ফিরে আসে। ওদের গাড়ি ঘুট্টুতে অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়ি করে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ঘুট্টু ছাড়তেই ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে অনুপমা। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে চেপে ধরে সিটে বসিয়ে দেয়। একদম সামনের সিটে চুপচাপ ওর বাবা বসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে খুব মুষড়ে পড়েন। কি কারনে মেয়ে ওনাকে সন্দেহ করে বসল সেটা এখন তাঁর কাছে পরিস্কার হলো না।

হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বেশ রাত হয়ে যায়। সারা রাত অনুপমা চোখের পাতা এক করতে পারে না, যেই ওর চোখ বুজে আসে তখনি ওর মনে হয় এই বুঝি দেবায়ন এসে ওকে ডাকবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে। সারা রাত শ্রেয়া আর পায়েল ওকে ঘিরে বসে থেকে থেকে শেষ রাতে দুইজনে ওর পাশে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালের দিকে অনুপমা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেয়, এইভাবে দেবায়নকে ফেলে চলে যেতে ওর মন মানতে চায় না।

সকালে অনুপমা শ্রেয়াকে ডেকে বলে, “আমি পুচ্চুকে ছাড়া এইখান থেকে এক পা নড়বো না।”

শ্রেয়া আর পায়েল প্রমাদ গোনে, একা একা ওকে এইভাবে এইখানে ছাড়তে কিছুতেই ওদের মন মানতে চায় না। শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “তুই না গেলে আমিও কোথাও যাবো না।”

শ্রেয়ার এই গভীর বন্ধু প্রীতি দেখে অনুপমার ভগ্ন হৃদয় আরো ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওর হাত ধরে বলে, “তুই কেন এইখানে আমার সাথে পড়ে থাকবি? তুই বাড়ি যা।”

পায়েল ওর হাত ধরে ধরা গলায় উত্তর দেয়, “আমাকে দেবায়ন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, ওকে না ফিরিয়ে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমিও তোর পাশ ছাড়ছি না।”

ম্লান হেসে উত্তর দেয় অনুপমা, “তুই একটা পাগলী মেয়ে।” ভাইয়ের হাত কাছে টেনে ওর হাতের মধ্যে পায়েলের হাত দিয়ে বলে, “তোর সাথে ভাই আছে রে পায়েল। পুচ্চু ছাড়া আমার আর কে আছে, বল? আমাদের সম্বন্ধে তুই অনেক কিছু জানিস না, সেইগুলো তোর অজানা থাকাই ভালো। শুধু এইটুকু জেনে রাখ পুচ্চু আর মামনি ছাড়া আমার নিজের বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। ওকে যদি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি তাহলে কোলকাতা ফিরব না হলে আর ফিরব না।”

পায়েল আর অঙ্কন কেঁদে ফেলে ওর কথা শুনে, “দিদিভাই প্লিস এইভাবে আমাদের ছেড়ে যাস না।”

শ্রেয়া ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “ফিরবি না মানে? আমার মন বলছে দেবায়নের কিছু হয়নি, ওই শয়তানটা এইখানে কোথাও লুকিয়ে আমাদের সাথে মজা করছে।” চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “একবার শালাকে হাতের কাছে পাই পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে তবে ছাড়বো।”

অনুপমা ওর হাত ধরে বলে, “শোন শ্রেয়া, তুই আমার একটা কাজ করবি?” শ্রেয়া ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করে, “কি?” অনুপমা ওর হাত ধরে অনুরোধ করে, “লক্ষ্মীটি তুই বাড়ি ফিরে যা। আমি ওকে খুঁজে তবেই ফিরব। যদি আমি না ফিরি...” বলতে বলতে ওর গলা ধরে আসে। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ে। অনুপমা শ্রেয়াকে বলে, “তাহলে তুই মামনির খেয়াল রাখিস। দেবায়ন ছাড়া মামনির আর কেউ নেই রে...” ভেঙে পড়ে অনুপমা। ওর কানে মামনির হাহাকার আর্তনাদ ভেসে আসে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে সেটা অনুধাবন করতে পেরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। চোখের জল মুছে শ্রেয়ার হাত ধরে অনুরোধ করে, “দয়া করে তুই পায়েল আর ভাইয়ের খেয়াল রাখিস আর অফিসের সবার খেয়াল রাখিস।”

কথাটা শেষ করে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে অনুপমা। শ্রেয়া আর পায়েল দৌড়ে এসে ওকে বাধা দিতে যায় কিন্তু অনুপমা মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় দেবায়নের আততায়ীকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরবে না। অনুপমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল, সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতন ওর দিকে চেয়ে থাকে হাঁ করে। রূপক আর ধীমান এগিয়ে আসে ওর সাথে যাওয়ার জন্য।

অনুপমা রূপককে থামিয়ে দিয়ে বলে, “না রে রূপক, শ্রেয়াকে, পায়েলকে সামলাতে তোর দরকার পড়বে। তুই চলে গেলে ওরা সবাই অথৈ জলে পড়ে যাবে।”

পরাশর তখন নিজের ব্যাগ কাঁধে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “তুই একা কেন যাবি, আমিও তোর সাথে যাবো চলো।”

অবাক চোখে অনুপমা ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করে, “তুই আবার কেন এতো কষ্ট করবি?”

পরাশর ওর কাঁধ চাপড়ে নিচু কণ্ঠে উত্তর দেয়, “তোর অত মাথা ব্যাথা নিতে হবে না। চলো বেরিয়ে পড়ি অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে। ঘুট্টু পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে হয়ে যাবে।”

অনুপমা ওকে আর মানা করতে পারে না। গাড়িতে ওঠার আগে একবার সবার দিকে তাকিয়ে দেখে অনুপমা। পায়েল, অঙ্কন, শ্রেয়া সবার চোখে জল। জারিনা, সঙ্গীতা ঋতুপর্ণা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওর বাবা, সোমেশবাবু নির্বাক হয়ে গেছেন। অঙ্কন ছলছল চোখে দিদির দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে, হয়তো দিদির সাথে এটাই শেষ দেখা।

গাড়ি ছাড়ার আগে অঙ্কন দৌড়ে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই কথা দে ফিরে আসবি।”
 
ভাইকে কি ভাবে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায়না অনুপমা। নিজেও জানে না যে পথে নেমেছে তাঁর শেষ কোথায়, তাও ভাইকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রবোধ দেয়, “আমি ফিরবো, নিশ্চয় ফিরবো আর দেবায়নকে সাথে নিয়েই ফিরবো।”

আর বেশি দাঁড়ায় না অনুপমা, জানে বেশি দাঁড়ালে ওদের দেরি হয়ে যাবে। পরাশর আর অনুপমা, হৃষীকেশ থেকে আবার ঘনসিয়ালির রাস্তা ধরে। গাড়ি আবার হৃষীকেশ থেকে পাহাড়ি সঙ্কীর্ণ পথ ধরে উঠতে শুরু করে দেয়। এইবারে এই পাহাড় আর ওকে টানে না। চুপচাপ অঙ্ক কষতে শুরু করে অনুপমা। দেবায়নের নিরুদ্দেশের পেছনে কার হাত হতে পারে। ওর বাবা সোমেশ সেন, এতো তাড়াতাড়ি রীহতে কি করে পৌঁছাল? বাবার ওপর থেকে সন্দেহ দুর করার জন্য অনুপমা মাকে ফোন করে।

পারমিতা মেয়ের গলা শুনেই উদ্বেগ জনিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুই কেমন আছিস? কি হয়েছে।”

সংক্ষেপে মাকে সব কথা জানিয়ে এটা জানাতে ভোলে না যেন ওর মামনিকে কিছু না জানানো হয়। পারমিতা জানায় দেবশ্রীকে এখুনি কিছুই জানাবে না কিন্তু কতদিন এই সংবাদ দেবশ্রীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে। অনুপমা জানায় ঘনসিয়ালি থেকে ফিরে এসে নিজেই মামনিকে জানাবে সম্পূর্ণ ঘটনা তারপরে যা হবার নিজেই মোকাবিলা করবে। জানে একবার এই খবর মামনির কানে পৌঁছালে মামনি মূর্ছা যাবে, কিন্তু কিছুই করার নেই। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, ওদের চলে যাওয়ার পরের দিন দেরাদুনের হোটেলের মালিকের সাথে কোন এক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সোমেশ বেরিয়ে পড়েন। যাওয়ার সময়ে বলে যান ফিরতে বেশ কয়েকদিন দেরি হবে। বাবা কি সত্যি দেরাদুনে গিয়েছিলেন না দেবায়নের পিছু নিয়েছিলেন? দেবায়ন বাবার অনেক ক্ষতি করেছে, চাকরি ছাড়তে হয়েছে, হয়তো বাবা এর মধ্যে জেনে ফেলেছে যে ওর মায়ের সাথে এক সময়ে দেবায়নের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। দেবায়নের নামে যদিও কোন কোম্পানি নেই তবুও দেবায়ন বাবার পথ থেকে সরে গেলে কোম্পানির সব কিছুর ওপরে বাবার একছত্র আধিপত্য হবে। কিন্তু বাবার কাছে দেবায়ন সোনার ডিম দেওয়া হাঁস, এমত অবস্থায় কি বাবা সত্যি দেবায়নকে নিজের পথ থেকে সরাতে চাইবে?

পরাশর ওকে জিজ্ঞেস করে, “এর পেছনে তোর কাকে সন্দেহ হয়।”

বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, “সন্দেহ অনেক কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না কে হতে পারে।”

পরাশর ওকে বলে, “সব সন্দেহ ভাজনদের একটা তালিকা বানানো যাক, তারপরে খুনের উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে।”

অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। ওকে খুন করার পেছনে আসল উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা যদি সঠিক ভাবে জানা যায় তাহলে আততায়ীকে ধরা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে যাবে।”

ওদের গাড়ি বারকোট পৌঁছাতেই অনুপমার ফোনে ইনস্পেক্টর রোহণের ফোন আসে। ফোনে ইনস্পেকটর জানায় নদীতে একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সেই শুনে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে, চরম আশঙ্কায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করে অনুপমা। পরাশর জানতে চায় সেই মৃতদেহের পরনে কি ছিল। জামা কাপড়ের বিবরন আর দেহের বিবরন শুনে অনুপমা স্বস্তির শ্বাস নেয়, বুঝে যায় ওই মৃতদেহ দেবায়নের নয়। তাও ইনস্পেক্টর ওদের নিউ তেহেরির হসপিটালে এসে মৃতদেহ সনাক্ত করতে অনুরোধ করে।

ঘনসিয়ালি থানায় গিয়ে সব থেকে আগে পুলিস ইন্সপেক্টিরের সাথে দেখা করে ওরা। তারপরে পুলিসের সাথে নিউ তেহেরির হসপিটালে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে। অনুপমা আর মর্গে ঢুকতে চায় না, পরাশর শনাক্ত করে এসে জানায় ওই মৃতদেহ দেবায়নের নয়। ইনস্পেকটর রোহন জানায় এই দুইদিনে ওরা সেই ছেলের কোন সন্ধান পায়নি। অনুপমা জানায় নিজেই একবার রীহতে গিয়ে আবার দেবায়নের খোঁজ করবে। অনুপমা বদ্ধ পরিকর আগে দেবায়নের খোঁজ করবে তারপরে আততায়ীর খোঁজে যাবে। অনুপমা জানে এই অভিপ্রায় ইনস্পেকটরকে জানালে সে বাধা দেবে তাই আর তাকে কিছু না জানিয়েই পরাশরকে নিয়ে ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

ঘুট্টূ পৌঁছে সব থেকে আগে গাইড রঞ্জিতের খোঁজ করে অনুপমা। রঞ্জিতকে জানায় দেবায়নকে খুঁজতে যেতে চায়।

সব শুনে রঞ্জিত ওকে বলে, “ম্যাডাম, স্যারকে খুঁজতে আমাদের কোন আপত্তি নেই তবে আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি। এই পাহাড়ি নদী আর ওই উঁচু খাদ থেকে কেউ পড়ে গেলে তার বাঁচার আশঙ্কা খুব কম। যদি বেঁচে থাকেন স্যার, তাহলে এতদিনে এই আশেপাশের গ্রামের কোন লোক ইতিমধ্যে খুঁজে বের করে নিতো। কিন্তু এই চার পাঁচ দিনে আশেপাশের কোন গ্রামের কেউই স্যারকে দেখেনি। তবে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখছি একজন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে কয়েকদিন আগে এই এলাকায় দেখা গিয়েছিল।”

অনুপমা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেই লোকের বিষয়ে কি কিছু জানতে পেরেছেন?”

রঞ্জিত ওদের নিয়ে একজনের বাড়িতে যায়। টালির ছাউনি দেওয়া পাহাড়ের এক গ্রাম্য বাড়ি। ওদের এতো রাতে দেখে এক বৃদ্ধ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রঞ্জিত ওই এলাকার লোক, সেই ওই বৃদ্ধের সাথে পাহাড়ি ভাষায় কথাবার্তা বলে অনুপমাদের জানায়, এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কয়েকদিন আগে এক পাঞ্জাবী লোককে একা একা এইখানে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল। তারপরে অবশ্য সেই পাঞ্জাবী লোকের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সেই পাঞ্জাবী ভদ্রলোক এক একা একটা ব্যাগ, তাঁবু ইত্যাদি নিয়ে একাই এইদিকে ঘুরতে এসেছিল বলে ওই বৃদ্ধকে জানায়। সোজা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ আর জঙ্গলের পথ ধরে রীহের দিকে যাত্রা করে। বৃদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে ছাগল চরাতে গিয়ে সেই পাঞ্জাবী লোকের দেখা পায়। আরো জিজ্ঞাসাবাদ করে ওরা জানতে পারে যে কয়েকদিন পরে, অর্থাৎ যেদিন এই দুর্ঘটনা ঘটে তাঁর আগের দিন পর্যন্ত ওই পাঞ্জাবী লোকটাকে জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। সেই লোকের উচ্চতা মাঝারি, দেহের গঠন মাঝারি, বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশের মাঝামাঝি। বৃদ্ধ এক উল্লেখযোগ্য তথ্য ওদের দেয়। দাড়ি গোঁফ থাকা সত্ত্বেও সেই পাঞ্জাবীটা ঘনঘন সিগারেট টানছিল। সাধারনত পাঞ্জাবীরা এতো সিগারেট খায় না। সেই শুনে অনুপমা পরাশরের দৃঢ় বিশ্বাস হয়, আসলে বেশ ভুষা বদলে নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে পাঞ্জাবী সেজে আততায়ী এই জায়গায় দেবায়নের অপেক্ষা করেছিল। বৃদ্ধ ওদের এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলতে পারল না।

সেই রাতে রঞ্জিতের অনুরোধে পরাশর আর অনুপমা ওর বাড়িতে রাত কাটায়। রঞ্জিত জানায় ওর পক্ষে যতদূর সম্ভব সাহায্য সে করবে।

রাতের বেলা পরাশর ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোর কাকে সন্দেহ হয়? কে দেবায়নের সব থেকে বড় শত্রু?”

অনুপমা কিছুক্ষণ ভাবতে বসে, এমন প্রচুর গোপন বিষয় আছে যা গোপন থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই পরাশরকে সব কিছু জানানো উচিত হবে না। বিশেষ করে বর্তমানে অনুপমার সন্দেহ নিজের বাবার ওপরে প্রবল। দেবায়ন বাবার সব থেকে বড় পথের কাঁটা হতে পারে, দ্বিতীয় সূর্য, নিজের আর স্ত্রী মনিদিপার অপমানের বদলা নিতে দেবায়নকে মারতে পিছপা হবে না। তৃতীয়, ধৃতিমান; দেবায়ন এক সময়ে একেও অপদস্থ করেছিল তার বদলা নিতে ধৃতিমান নিশ্চয় মুখিয়ে থাকবে। চতুর্থ, ইন্দ্রনীল আর অনিমেশ আঙ্কেল, যেভাবে ওদের হাত থেকে রূপক আর দেবায়ন সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে তাতে তারাও দেবায়নের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়ার ফাঁক খুঁজবে। পঞ্চম, পুনের হোটেলের মালিক রজত পানিক্কর, এক রকম ব্ল্যাকমেল করেই ওর কাছ থেকে হোটেল হাতিয়ে নিয়ে পথে বসিয়ে দিয়েছে দেবায়ন। বাবাকে ছাড়া বাকি সবার নাম আর উদ্দেশ্য পরাশরকে জানায়। অনুপমা বলতে শুরু করে আর একটা পরাশর একটা প্যাডের মধ্যে সব কিছু লিখতে শুরু করে।

সব শুনে পরাশর ওকে বলে, “একবার ওই ছেলেটাকে পেলে বড় ভালো হতো কিন্তু যখন ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন আমাদের মনে হয় রীহের ওই জঙ্গলে একবার যাওয়া উচিত। এক রাতে নিশ্চয় ওই আততায়ী রীহ থেকে ঘুট্টু হেঁটে আসেনি। এই রাস্তা ওর অজানা সুতরাং যতদূর মনে হয় এই কয়দিন ওই আততায়ী ওই জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছিল।”

অনুপমা মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। তবে আমাদের আসল উদ্দেশ্য দেবায়নকে খুঁজে পাওয়া। আগে আমরা দেবায়নকে খুঁজতে নামবো ওই খাদের মধ্যে তারপরে আততায়ীকে খুঁজবো।”

পরের দিন সূর্যের আলো ফোটা মাত্রই ওরা রীহের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এইবারে দশ কিলোমিটার যেতে ওদের আর ছয় ঘন্টা লাগলো না। অনুপমার বুকে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে দেয়, ওর শরীরে নতুন রক্তের সঞ্চার হয়, দেবায়নকে খোঁজার এক নতুন সাহস আর শক্তি নিয়ে দুপুরের আগেই রীহ পৌঁছে যায় ওরা। সাথে দুইজন পোর্টার নিয়ে গিয়েছিল।
 
রঞ্জিতের সাথে খাদের কিনারায় এসে পুনরায় ওই জায়গাটা তদারকি করে দেখে। প্রথম দিনে যে যে পায়ের ছাপ গুলো ওরা দেখেছিল এতদিনে বহু পায়ের ছাপের ফলে সেই ছাপগুলো মাটিতে মিশে গেছে। তাও কিছুটা আন্দাজ করে যেদিকে আগে আততায়ীর পায়ের ছাপ গিয়েছিল সেদিকে ওরা হাঁটতে শুরু করে দেয়। বেশ কিছুটা দুর গিয়ে আন্দাজ মতন আততায়ীর পায়ের ছাপ অনুসরন করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এদিক ওদিক ভালো ভাবে দেখতে দেখতে পরাশর আর অনুপমা এগিয়ে চলে, পেছনে রঞ্জিত আর দুটো ছেলে। ঘন জঙ্গল, উঁচু উঁচু দেবদারু পাইন ইত্যাদি গাছে ভরা, ভিজে মাটি নরম পাতা আর ঘাসে ঢাকা। বেশ কিছদুর গিয়ে একটা খালি জায়গা দেখে ওরা থেমে যায়। ঘন জঙ্গলের মাঝে বেশ কিছুটা জায়গা সদ্য পরিষ্কার করে তাঁবু খাটানোর আর থাকার চিহ্ন দেখতে পায়। অনুপমার সন্দেহ দুর হয়ে যায়, এই জায়গায় নিশ্চয় ওই আততায়ী বেশ কয়েকদিন থেকেছে। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জিত পরাশর আর অনুপমা চারপাশে তথ্য প্রমান যোগাড় করার জন্য লেগে পড়ে। খুঁজে খুঁজে একটা খালি সিগারেট প্যাকেট পায়, বেশ কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ, বেশ কিছু বিস্কুটের প্যাকেট, ম্যাগির প্যাকেট, জলের বোতল ইত্যাদি খুঁজে পায়। রঞ্জিত সব কিছু একটা প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে জড় করে অনুপমার হাতে তুলে দেয়। আরো বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খুঁজে নদীর দিকে চলে আসে। রঞ্জিত জানায় বৃদ্ধের বিবরনের কোন পাঞ্জাবী লোককে নিচের দিকে নামতে দেখেনি সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ওই আততায়ী রীহ ছাড়িয়ে উপরের দিকে হয়তো উঠে গেছে নয়ত আরো গভীর জঙ্গলের পথ ধরে অন্যপাশ দিয়ে নেমে গেছে।

ওইখানে আরো বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি করার পরে তিনজনে তাঁবুতে ফিরে আসে। পরাশর ব্যাগের মধ্যে থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে অনুপমাকে প্রশ্ন করে, “তোর জানাশোনার মধ্যে কেউ কি এই সিগারেট খায়?”

বেশ দামী সিগারেট প্যাকেট দেখে অনুপমা স্মিত হেসে বলে, “তুই নিজেই এই সিগারেট খাস...”

পরাশর হেসে ফেলে, “বেশ বলেছিস। সাধারন অথচ দামী সিগারেট। ধরে নেওয়া যেতে পারে আততায়ী বড়লোক, রুচিবোধ সম্পন্ন ব্যাক্তি। আমাদের সন্দেহের তালিকা অনুযায়ী কে কে এই সিগারেট ব্যবহার করতে পারে?”

অনুপমা একটু ভেবে বলে, “সবাই এই সিগারেট ব্যবহার করতে পারে। যদিও আমি রজত পানিক্করের সাথে আমাদের বিশেষ পরিচয় হয়নি তবে আমাদের সামনে সে কখন সিগারেট ধরায়নি। অনিমেশ, ধৃতিমান সূর্য সবাই এই সিগারেট খেতে পারে।” মনে মনে অঙ্ক কষে, ওর বাবা সাধারণত চুরুট খায়, তবে মাঝে মধ্যে সিগারেট খায়। বাবার নাম এখন পর্যন্ত পরাশরকে জানানো হয়নি।

পরাশর জিজ্ঞেস করে, “এর পরের কি করনীয় আমাদের?”

অনুপমা বলে, “কাল রঞ্জিতকে বলে আমি নিজেই ওই খাদের মধ্যে রেপ্লিং করে নামবো আর নদীর কিনারা ধরে নিচের দিকে খুঁজতে খুঁজতে যাবো।”

পরাশর ওকে বলে, “খুব বিপদজনক হয়ে যাবে ব্যাপারটা।”

দুঃখিত, ভারাক্রান্ত মনে অনুপমা ওকে বলে, “বিপদ বলে আমার জীবনে আর কিছু নেই। যখন দেবায়ন আমার পাশেই নেই তখন আর বেঁচে থেকে কি লাভ।” বলতে বলতে ওর গলা ধরে আসে। বারেবারে হাতের আংটি গালে ঘষে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দেবায়নের পরশ খুঁজতে চেষ্টা করে।

সারা রাত অনুপমা ঘুমাতে পারে না, পরাশর অনেকক্ষণ জেগে বসে ওকে পাহারা দিয়েছিল কিন্তু শেষ রাতের দিকে পরাশরের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। শেষ রাতের দিকে অনুপমা তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে দুর পাহাড়ের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। হয়তো ওই দূরে পাহাড়ে কোথাও ওর পুচ্চু লুকিয়ে আছে, হয়তো ওর সাথে লুকোচুরির খেলা খেলে যাচ্ছে। একবার যদি ছেলেটাকে ধরতে পারে তাহলে খুব বকুনি দেবে। কখন যে মাটিতে বসে বসে ওর চোখ লেগে গিয়েছিল সেটা আর টের পায়না। ঘুম ভাঙে সকালের পাখীর ডাকে। পুবের আকাশের সূর্যের লালিমার ছটা সোজা ওর চেহারায় এসে পড়তেই চোখ খুলে যায়। সামনে বিস্তীর্ণ বনভূমি, একপাশে নদী।

পরাশর তৈরি হয়ে ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুমোসনি নিশ্চয়। একা একা এইখানে বসে কি করছিলি?”

অনুপমা ম্লান হেসে বলে, “অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করার আছে আমার বল।”

এমন সময়ে রঞ্জিত দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওকে বলে, “ম্যাডাম একটা খবর পাওয়া গেছে।”

চাপা উত্তেজনায় অনুপমার বুকের ধুকপুকানি থেমে যায়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কি খবর।”

রঞ্জিত ওকে বলে, “ঘুট্টুর নিচের দিকের এক গ্রামের একজন গত রাতে নদীতে একজন ছেলেকে ভেসে যেতে দেখে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছে। এইমাত্র আমাকে একজন খবর দিল। যতদূর মনে হয় দেবায়ন হতে পারে।”

অনুপমার ওই শুনে রঞ্জিত আর পরাশরকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের দিকে। ওর পা আর মাটিতে পড়ে না, হাঁটার বদলে দৌড়াতে শুরু করে অনুপমা। কি অবস্থায় দেখবে, কি রকম আছে, বেঁচে আছে না শেষ দেখা দেখতে পাবে সেই আশঙ্কায় ওর হৃদপিণ্ড বারেবারে লাফিয়ে উঠে গলায় চলে আসে।

রীহ থেকে ঘুট্টু প্রায় ওরা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। ওদের ওইভাবে দৌড়ে আসতে একজন দৌড়ে এসে রঞ্জিতকে খবর দেয় নদীতে ভেসে আসা লোকের ব্যাপারে। সেই ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে সেই বাড়ির মধ্যে যায় অনুপমা। নদীর পাশে পটে আঁকা ছবির মতন গ্রাম। একটা ছোট পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়ি দেখিয়ে সেই ছেলেটা বলে ওই বাড়িতে নদীর থেকে উঠিয়ে আনা দেহকে রাখা হয়েছে। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনজনে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে বাড়িতে ঢোকে। ছোট বাড়ির মধ্যে লোকজন উপচে পড়ছে।

অনুপমাদের দেখে বাড়ির কর্তা বেরিয়ে আসতেই ওকে জিজ্ঞেস করে দেবায়নের ব্যাপারে। বাড়ির কর্তা ওদের নিয়ে ভেতরের ঘরের মধ্যে ঢুকতেই বিছানায় শুয়ে থাকা দেবায়নকে দেখে অনুপমা কেঁদে ফেলে। চেহারা সাদা হয়ে গেছে, বাম পা দুমড়ে গেছে, কপালে গভীর ক্ষতের দাগ। বাড়ির কর্তা দেবায়নের শরীর একটা মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে আর বিভিন্ন ক্ষতের জায়গায় পাহাড়ি জড়িবুটির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে।

দেবায়নকে দেখেই অনুপমা ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে। বারেবারে ওর গালে কপালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “প্লিস একবার চোখ খোল সোনা, দেখ তোর পুচ্চি এসে গেছে, প্লিস একবারের জন্য চোখ খোল।”

বাড়ির কর্তা, রাজীব ওদের জানায়, “চারদিনের মতন মনে হয় এই নদীর জলে ভেসে এসেছিল। খুব শক্ত প্রান আর আপনার ভালোবাসা খুব প্রবল, নচেৎ কেউ ওই খাদের মধ্যে এই পাহাড়ি নদীতে পড়ে গিয়ে প্রানে বাঁচে না। একে এখুনি কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমি যতদূর সম্ভব বাঁচাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, হাত ভেঙে গেছে, মাথায় গভীর চোট লেগেছে, মনে হয় শিরদাঁড়ায় চোট পেয়েছে। এক্সরে না করা পর্যন্ত ভেতরের ক্ষয় ক্ষতি কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব নয়।”
 
অনুপমা ওকে জড়িয়ে ধরে গালে কপালে চুমু খেয়ে বারেবারে ডাক দেয়, কিন্তু সেই ডাক আর দেবায়নের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। দেবায়ন অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় ঘাড় কাত করে শুয়ে থাকে। অনুপমাকে ওই অবস্থায় দেখে পরাশর কি করবে কিছুই ভেবে পায়না। দেবায়নকে ফিরে পেয়ে অনুপমার বুক ভরে ওঠে, শেষ পর্যন্ত ওর পুচ্চু আবার ফিরে এসেছে।

দেবায়নের অতি সঙ্গিন শারীরিক অবস্থা দেখে অনুপমার খুব ভয় হয়। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি খুব ধীরে ধীরে চলছে, মাথায়, হাতে পায়ে সব জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওর চঞ্চল পুচ্চুকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। অনেকক্ষণ দেবায়নের ঠাণ্ডা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসে থাকে। পরাশর ততক্ষণ রঞ্জিত আর বাড়ির কর্তার সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। বাড়ির কর্তা ওদের জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে কোন বড় হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে। রঞ্জিত জানায় দেরাদুনে ভালো হসপিটাল আছে সেইখানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে নিয়ে ওদের রওনা হওয়া উচিত। অনুপমা আর দেরি করেনা, রঞ্জিত দেরাদুনের একটা বড় হস্পিটালের সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। ওদের সঙ্গের যে গাড়ি ছিল সেই গাড়িতে দেবায়নকে নিয়ে ওরা দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সামনের সিটে পরাশর আর রঞ্জিত পেছনে দেবায়নের মাথা কোলে অনুপমা। বাড়ির কর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা চারজনে দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

অসাড় দেবায়নের মাথা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে অনুপমা চাপা আশঙ্কায় প্রহর গুনতে গুনতে দেরাদুনের দিকে যাত্রা শুরু করে। পথে যেতে যেতে পরাশরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয়, “শোন এই খবর যেন কোন মতে কোলকাতা না পৌঁছায়, বুঝলি।”

পরাশর জিজ্ঞেস করে, “কেন রে, দেরাদুনে কেমন চিকিৎসা হবে সেটা ঠিক জানি না। কোলকাতা নিয়ে গেলে ভালো হতো না? আর কাকিমাকেও এই বিষয়ে জানাতে হবে তো না কি?”

অনুপমার গলা ধরে আসে, বুকের কাছে দেবায়নের মাথা চেপে ধরা গলায় পরাশরকে বলে, “খুব ভয় লাগছে রে, কি করবো?”

পরাশর ওকে অভয় দিয়ে বলে, “কিছু হবে না। অত ওপর থেকে পড়ে যখন বেঁচে গেছে তখন ওর জীবন অনেক শক্ত। তুই চিন্তা করিস না দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”

দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে পরাশরকে উত্তর দেয়, “জানিনা রে, ওকে চোখের আড়াল করতে একদম ইচ্ছে করছে না। তুই একটা কাজ করবি?” পরাশর মাথা দুলিয়ে জানায় সব কিছু করতে রাজি। অনুপমা ওকে বলে, “ওকে হসপিটালে ভর্তি করে তুই কোলকাতা চলে যাস। মামনিকে বিশেষ কিছু এখন জানাস না। তুই প্লিস কিছু করে মামনিকে নিয়ে দেরাদুনে চলে আসিস।” কিছুক্ষণ থেমে বলে ভাবুক কণ্ঠে ওকে বলে, “কে আসল আততায়ী সেটা না জানা পর্যন্ত আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। দেবায়ন বেঁচে আছে জানতে পারলে আততায়ী সতর্ক হয়ে যাবে, দ্বিতীয় বার ওর ওপরে হামলা করতে পারে। আমরা এখন জানিনা আততায়ী আমাদের নিজেদের কেউ না বাইরের কেউ সুতরাং এই খবর কোন মতেই যেন কোলকাতা না পৌঁছায়। আততায়ী নিশ্চয় আমাদের ওপরে কড়া নজর রেখে চলেছে না হলে আততায়ী এতো দুর এসে দেবায়নকে মারতে চেষ্টা করতো না। সুতরাং শ্রেয়া পায়েলকেও এই খবর জানানো যাবে না। ওরা জানতে পারলে নিশ্চয় এইখানে আসতে চাইবে আর ওদের পিছু নিয়ে আততায়ী এইখানে এসে পৌঁছে যাবে।”

পরাশর বলে, “কিন্তু সেটা কাকিমার খেত্রেও হতে পারে। আমি যদি কাকিমাকে নিয়ে বের হই তাহলে আততায়ীর সন্দেহ হতে পারে। তার চেয়ে ভালো আমি এইখানে থাকি আর তুই কোলকাতা ফিরে যা। তোকে একা কোলকাতা ফিরতে দেখলে আততায়ী সন্দেহ দুর হয়ে যাবে যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই। আর কাকিমাকে বলে বুঝিয়ে আনা একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। এরপরে দেবায়নকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়, মানে কোলকাতার বাইরে কোথাও যদি কোন বিশ্বস্ত লোক থাকে তার কাছে হলে ভালো হয়।”

কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা ওকে বলে, “হ্যাঁ তুই ঠিক বলেছিস। দেখি একবার ব্যাঙ্গালোর ফোন করে। আমাদের এক হোটেলের মালিক দিলিপ বাবু নিশ্চয় আমাদের এই অবস্থায় সাহায্য করবেন।”

পরাশর ওকে বলে, “ঠিক আছে তুই দিলিপ বাবুকে ফোন করে দে আর আমি কাকুকে একটা ফোন করে দেই। আততায়ীকে খুঁজতে কাকুর সাহায্য আমাদের খুব দরকার পরবে।”

অনুপমা মাথা দোলায়, পরাশরের কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেকটর নিরঞ্জন বাবু, পায়েলের সময়ে ওদের খুব সাহায্য করেছিল। পরাশর সঙ্গে সঙ্গে কাকাকে ফোনে দেবায়নের নিরুদ্দেশের বিষয়ে কিঞ্চিত খবর দিয়ে বলে এই বিষয়ে যেন কাউকে না জানায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের জানায়, সব রকমের সাহায্য করবেন তিনি।

অনুপমা দিলিপ বাবুকে ফোন করে বিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে দিলিপ বাবু খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তিনি জানিয়ে দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি দেরাদুনে পৌঁছে যাবেন। এক সময়ে অনুপমা আর দেবায়ন তাঁর জন্য যা করেছিল তাঁর প্রতিদান এখনো শোধ করা হয়নি। দেরাদুনে পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। হসপিটালে আগে থেকে কথা বলা ছিল তাই ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ওদের।

ডাক্তার দেবায়নকে পরীক্ষা করে জানায়, বেশ কয়েক জায়গায় হাড় ভেঙে গেছে, চার পাঁচ দিন ঠাণ্ডা জলে থাকার ফলে হাইপোথারমিয়া আর ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে। লিভারে আর ফুসফুসে জল ঢুকে গেছে। হৃদয় খুব ধীরে ধীরে চলছে। মাথার পেছনে আর ঘাড়ে বেশ জোর আঘাত পেয়েছে। দেবায়নকে বেশ কিছুদিন আই.সি.ইউ তে পর্যবেক্ষণের জন্য রাখতে চায়, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অথবা বাহাত্তর ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা অসম্ভব। সব শুনে অনুপমার কেঁদে ফেলে, দাঁতে দাঁত পিষে ছলছল চোখে দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে। পরাশরের সাথে ডাক্তারের কথাবার্তা হয়। অনুপমা চুপচাপ আই.সি.ইউ তে বসে থাকে। ওইদিকে ওর ফোনে শ্রেয়া, পায়েল, জারিনা, রূপক এরা সবাই ফোন করে করে হয়রান। পরাশর ভেবে পায়না কি উত্তর দেবে। কাঁচের ঘরের মধ্যে শায়িত অচৈতন্য দেবায়ন আর তার পাশে কঠিন রক্তশূন্য থমথমে চেহারা নিয়ে বসে অনুপমা। পরাশর সবাইকে এক কথা জানায় ওরা এখন দেবায়নের খোঁজ করছে। দেবশ্রীর খবর জানতে চাইলে সবাই জানায়, কেউই আর ভয়ে দেবায়নের বাড়ি যায়নি।

পরেরদিন বিকেল নাগাদ দিলিপ বাবু দেরাদুনে এসে হাজির হন। পরাশর সংক্ষেপে দেবায়নের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানায়। দেবায়নকে নিস্তেজ নির্জীবের মতন পড়ে থাকতে দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। দেবায়নের চোখ আর খোলে না দেখে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। ডাক্তারেরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায় দেবায়নের জ্ঞান ফেরাবার জন্য কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়না।

দিলিপ বাবুকে দেখে অনুপমার মনে কিঞ্চিত শক্তির সঞ্চার হয়, ছলছল চোখে দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুরোধ করে, “আমার খুব ভয় করছে। কার কাছে যাবো কিছুই ঠিক করতে পারছি না, একটু সাহায্য করবেন?”

দিলিপ বাবু ওর হাত ধরে অভয় দিয়ে বলে, “এইভাবে কেন বলছো? আমার ওপরে তোমার অধিকার আছে, তুমি একবার আদেশ করো, সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।”

পরাশর ওর হাত ধরতেই অনুপমা ভেঙে পড়ে, “কি হবে রে, দুই দিন হয়ে গেল পুচ্চু যে চোখ খুলছে না।”

পরাশর ওকে জড়িয়ে ধরে অভয় প্রদান করে বলে, “এই মেয়ে, তুই চোখের জল ফেললে হবে কি করে? তোর বিয়ের পিঁড়ি উঠানো বাকি, ওর বিয়েতে নাচতে বাকি। এতো তাড়াতাড়ি তুই ভেঙে পড়লে কি করে হবে?”

অনুপমা কাতর কণ্ঠে দিলিপ বাবুকে বলে, “আপনি প্লিস দেবায়নকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যান, ওইখানে ওর চিকিৎসা করাতে শুরু করুন। আমি ওর মামনিকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবো।”

সারাটা রাত কঠিন চাপা উৎকণ্ঠায় আর বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। অনুপমা ক্ষণিকের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারে না। দেবায়নের পাশে ঠায় বসে থাকে, এই অপেক্ষায় কখন চোখ খুলবে। ভোরের দিকে অনুপমার চোখে একটু তন্দ্রা ভাব লেগেছিল কিন্তু ওর তন্দ্রার ঘোর একটা যান্ত্রিক আওয়াজে কেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নার্সদের ডাক দেয় অনুপমা। নার্স এসে যন্ত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তার নার্সদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। অনুপমাকে বলা হয় রুমের বাইরে যেতে। ডাক্তারেরা বেশ কিছুক্ষণ অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধপত্র ইত্যাদি চালিয়ে দেবায়নকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যায়। চাপা উৎকণ্ঠায় অনুপমার প্রান ওষ্ঠাগত। হটাত দেবায়নের কি হলো? অপারেশান থিয়েটারের সামনে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। একজন ডাক্তার বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে অপারেশান থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে ওদের খবর দেয় দেবায়ন কোমায় চলে গেছে। সেই খবর শুনে অনুপমা চোখে অন্ধকার দেখে। তিন রাত ঠিক ভাবে ঘুমায়নি, ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি। এমনিতে নিজে খুব ক্লান্ত আর দুর্বল ছিল। তাই ওই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরাশর ওকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে।
 
জ্ঞান ফেরার পরে অনুপমা চোখ খুলে দেখে নিজেই একটা হস্পিটালের বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলেই দেখে ওর পাশে মাথা নিচু করে পরাশর আর দিলিপ বাবু বসে। ওদের এইভাবে নত মস্তক হয়ে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। পরাশর কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। একা একা কত দিক সামলাবে কিছুই ঠিক করতে পারে না।

অনুপমা ছলছল চোখে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তারেরা কি বলছে রে?”

পরাশর আর দিলিপ বাবু দুই জনেই মাথা নিচু করে থাকে। ওদের ওইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমা নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।

পরাশর ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে, “এখন আমাদের হাতে বিশেষ কিছু নেই রে অনুপমা।”

অনুপমা বুক ভাঙা চিৎকার করে ওঠে, “না......”

দিলিপ বাবু ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রবোধ দিয়ে বলেন, “এইখানে এই অবস্থায় দেবায়নকে রেখে লাভ নেই। আমি তোমাদের ব্যঙ্গালোর নিয়ে যেতে চাই। ওইখানে ভালো ডাক্তার আছে, ওইখানে না হলে বাইরে যাওয়া যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”

অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সবার মুখে এক কথা দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু দেবায়ন যে কোমায় চলে গেছে। মামনিকে কি উত্তর দেবে, কতদিন পরে দেবায়ন চোখ খুলবে, আদৌ কি আর চোখ খুলবে?

অনুপমা অনেকক্ষণ পরে চোখের জল মুছে পরাশরকে বলে, “আমি একাই আততায়ীকে এর শাস্তি দেবো।”

পরাশর প্রমাদ গোনে, এই অবস্থায় অনুপমার পক্ষে একা সব দিক সামলানো অসম্ভব ব্যাপার, নিজেও একা কি ভাবে কি সামলাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। পরাশর ওকে শান্ত করে বলে, “মাথা ঠাণ্ডা কর। তুই একা নস, আমিও তোর পাশে আছি। যা হবার দেখা যাবে। আততায়ীর যদি সূর্য অথবা ধৃতিমান হয় তাহলে পরের আঘাত কাকিমার ওপরে আসবে। যত তাড়াতাড়ি কাকিমাকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলা ভালো। আর আততায়ী যদি অন্য কেউ হয় তাহলে পরের আঘাত তোর ওপরে হানবে, সেই মতন আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।”

অনুপমা দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “এর শেষ কোথায় দেখতে চাই।”

দিলিপ বাবু হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলে, আলোচনা সেরে দেবায়নকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে নেন। দিলিপ বাবু জানান ব্যাঙ্গালোরে তাঁর অনেক চেনাজানা ডাক্তার আর হসপিটাল আছে। সেখানে নিয়ে নিজস্ব তত্বাবধানে দেবায়নের চিকিৎসা শুরু করবেন।

পরেরদিন সকালে প্লেনে দেবায়নকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় সবাই। দিল্লী হয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। ব্যাঙ্গালোরে দিলিপ বাবুর চেনাশোনা একটা বড় হসপিটালে দেবায়নকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই কয়দিনে দেবায়নের আর অনুপমার খবর নেওয়ার জন্য সবাই কোলকাতা থেকে ফোন করে, কিন্তু অনুপমার নির্দেশ অনুযায়ী পরাশর সবাইকে এক কথা জানায়, যে এখনো ওরা দেবায়নকে খুঁজে পায়নি। পারমিতা, সোমেশ বাবু মেয়ের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অনুপমা কারুর সাথে কথা বলেনা। ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তা, এই দুর্ঘটনার পেছনে আসল দোষী কে আর কি তার উদ্দেশ্য।

পরেদিন চাপা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে পরাশরকে সঙ্গে করে অনুপমা কোলকাতার উদ্ধেশ্যে রওনা দেয়। বুকের মধ্যে চাপা ভয়, এই খবর শুনে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্লেনে চড়ার আগেই ফেরার টিকিট কেটে নিয়েছিল পরাশর, জানে, একবার এই খবর দেবায়নের মায়ের কাছে পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ এক মা তাঁর ছেলের কাছে আসতে চাইবে। প্লেনে ওঠা মাত্রই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। কোলকাতা নেমে মামনিকে কি বলবে, কি ভাবে মামনির সামনে দাঁড়াবে, কি বলে মামনিকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসবে, এই ভাবতে ভাবতে ওদের প্লেন কোলকাতা এয়ারপোর্টে নামে। পরাশর শুধুমাত্র জারিনাকে জানিয়ে রেখেছিল যে ওরা কোলকাতা আসছে। তাই জারিনা তার বাবাকে নিয়ে ওদের জন্য কোলকাতা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিল। পরাশরের মুখে দেবায়নের বিষয়ে সব কিছু শোনার পরে জারিনার বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি জানান তাঁর জানাশোনা ডাক্তারদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন।

গাড়িতে উঠে লেকটাউনে দেবায়নের বাড়ির সামনে আসতেই অনুপমার হৃদপিণ্ড গলায় এসে আটকে যায়। বাড়ির মধ্যে মামনি নিশ্চয় নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজে ব্যস্ত। ছেলে বেড়াতে গেছে, যেখানে গেছে সেখানে মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যায়না। ওদের কথা ছিল, খাটলিং থেকে ঘুট্টু ফিরে প্রায় দশ দিন পরে সবাই বাড়িতে ফোন করবে। ইতিমধ্যে যে এতো কান্ড ঘটে গেছে সেই খবর দেবায়নের মাকে জানানোর সাহস কারুর মধ্যে কুলায়নি। পরাশর আর অনুপমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।

পরাশর ওর কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়ে বলে, “ভেতরে যা, আমি পেছনে আছি।”

অনুপমা চোখ বুজে একবার দেবায়নের নির্জীব চেহারা বুকের মধ্যে এঁকে নেয় তারপরে কলিং বেল বাজিয়ে চাপা উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজা খোলার অপেক্ষায়।

এই অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠতে দেবশ্রী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে অনুপমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। স্মিত হেসে ওর গালে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস, “কেমন ঘুরলি রে তোরা? শরীর খারাপ করেনি তো?” তারপরে পেছনে পরাশরকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁরে বাকিরা কোথায়?” মামনির মিষ্টি হাসি আর মাতৃসুলভ আচরন দেখে অনুপমার চোখ ফেটে জল চলে আসে। সেই মুক বেদনা দেবশ্রীর চোখ এড়াতে পারেনা। বুক কেঁপে ওঠে দেবশ্রীর কম্পিত কণ্ঠে অনুপমা আর পরাশরকে প্রশ্ন করে, “দেবু কোথায় রে? তোদের সাথে আসেনি কেন?”

বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, এইবারে ওকে গভীর জলে ঝাঁপ দিতে হবে। কি ভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারে না অনুপমা। মামনির দুই হাত ধরে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে বলে, “দেবায়ন কিছু কারনে আসতে পারেনি, মামনি।”

অনুপমার ধরা গলা আর ছলছল চোখ দেখে দেবশ্রীর সন্দেহ হয়, ওকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে দেবায়নের?”

মামনির প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনুপমার অজানা তাই চোয়াল চেপে অশ্রু সংবরণ করে চুপচাপ মাথা নিচু করে মামনির হাত ধরে বসে থাকে।

পরাশর বুক ঠুকে দেবশ্রীকে বলে, “তোমাকে আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
 
শূন্য চোখে একবার পরাশরের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায় দেবশ্রী। ওর চোখের সামনে সারা পৃথিবী নড়তে শুরু করে দেয়। দেবশ্রী কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার দেবু, ঠিক আছে না...” আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না দেবশ্রী। মায়ের হৃদয় ফাঁকা হয়ে যায় সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। খুব কম বয়সে নিজের স্বামীকে হারিয়েছে, একমাত্র ছেলেকে বুকে করে ধরে মানুষ করেছে। চোখ বন্ধ করে ইষ্ট নাম নিয়ে কাতর প্রার্থনা জানায়, একমাত্র সন্তানের চিতায় অগ্নি প্রদানের শাস্তি যেন ভগবান ওকে না দেয়।

পরাশর দেবশ্রীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত ধরে বলে, “তুমি গেলে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চলো আমাদের সাথে।”

দেবশ্রীর প্রশ্ন করার মতন কোন শক্তি ছিল না। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে অনুপমার কোলে ঢলে পড়ে। পরাশর রান্না ঘর থেকে জল এনে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। শূন্য চাহনি নিয়ে অনুপমা আর পরাশরের দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে দেবশ্রী, ওর পৃথিবী খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে।

অনুপমার হাত ধরে দেবশ্রী প্রশ্ন করে, “সত্যি বল কি হয়েছে দেবুর?”

অনুপমার জানে ও ভেঙে পড়লে ওর মামনি ভেঙে পড়বে তাই অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে অভয় দিয়ে বলে, “তুমি চলো না আমাদের সাথে, তুমি গেলেই দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”

দেবশ্রী আর কথা বাড়ায় না, মেয়েটা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। কোন রকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ওদের সাথে বেরিয়ে পড়ে। আসার সময়ে রাতের প্লেনে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছিল। প্লেনে ওঠার আগেই পরাশর দিলিপ বাবুকে জানিয়ে দেয় যে ওরা দেবায়নের মাকে নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবে। ওদের নির্দেশ অনুযায়ী দিলিপ বাবু গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে সোজা হসপিটালে নিয়ে যায় দেবশ্রীকে। একমাত্র ছেলেকে নির্জীবের মতন বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে দেবশ্রীর পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। ছলছল চোখে শুধুমাত্র অনুপমার রক্ত শূন্য বেদনা যুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। অনুপমা এক এক করে সবিস্তারে দেবায়নের দুর্ঘটনা মামনির সামনে তুলে ধরে।

অনুপমার সাহস আর অনুপমার ধৈর্য শক্তি দেখে দেবশ্রী অবাক হয়ে যায়, ওকে প্রশ্ন করে, “তুই কি করে নিজেকে সামলে রেখেছিস?”

অনুপমা আর নিজেকে সামলাতে পারে না, “তোমার সামনে কি করে...” মামনিকে জড়িয়ে ধরে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে অনুপমা। ওর আশা ওর ভরসা ওর সব কিছু যেন জলে ভেসে যাচ্ছে বলে মনে হয়।

পরেরদিন সকালে দিলিপ বাবু আর তাঁর স্ত্রী কণিকার তত্বাবধানে মামনি আর দেবায়নকে রেখে অনুপমা আর পরাশর আততায়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কোলকাতা ফিরে আসার আগে দিলিপ বাবু ওদের জানিয়ে দেয় আর কোন সাহায্যের দরকার হলে যেন তাঁকে জানাতে না ভোলে।

যাওয়ার আগে দেবশ্রীর পায়ে হাত দিয়ে সংকল্প করে অনুপমা, “আমি কথা দিচ্ছি মামনি...”

দেবশ্রী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ছেলের কি হবে জানিনা তবে তোকে হারাতে আমি চাই না রে।”

পরাশর দেবশ্রীকে অভয় দিয়ে বলে, “আপনার ছেলেও হারাবে না আর অনুপমাও হারাবে না। দুই জনেই ভালো হয়ে ফিরে আসবে কথা দিলাম।”

প্লেনে উঠে অনুপমাকে প্রশ্ন করে পরাশর, “এইবারে কি করনীয়? কাকিমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর ফলে তোর ওপরে আততায়ীর নজর আরো বেড়ে যাবে। যেভাবে আততায়ী জঙ্গলের পথে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পালিয়ে গেছে তাতে মনে হয় ওই আততায়ী এক হয় ভাড়া করা পাহাড়ি লোক না হয় অনেকদিন থেকেই দেবায়নকে মারার ষড়যন্ত্র করেছে।”

অনুপমা ভাবতে বসে, “ঠিক বলেছিস, যে ভাবে আততায়ী সোজা রাস্তা না ধরে পাহাড়ি জঙ্গল ধরে পালিয়েছে তাতে দুটো তথ্য আমাদের সামনে আসছে। এক, আততায়ী ভাড়া করা পাহাড়ি লোক যে ওই এলাকা ভালো করে চেনে আর দ্বিতীয়, আততায়ী নিজেই ওই পাহাড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু এইভাবে ঘুরে বেড়াতে হলে আততায়ী নিশ্চয় অনেকদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। কোলকাতা ফিরে সব থেকে আগে আমাদের এইটা দেখতে হবে কে কে কতদিন ধরে বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। আর তাঁর সাথে সাথে আমাদের দেখতে হবে দেবায়নকে খুন করার পেছনে আসল কি কি কারন হতে পারে। কয়েকটা কারন অবশ্য আমাদের জানা কিন্তু কয়েকটা বিষয় আমাকে নিজেই একবার খুঁজে বের করতে হবে।”

এয়ার হোস্টেস এসে খাবার দিয়ে গেল, কিন্তু সেই খাবার কিছুতেই আর অনুপমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। ওর মন পড়ে থাকে ব্যাঙ্গালোরে, ওর দেবায়নের পাশে আর ওর মামনির পাশে। কোলকাতা ফিরে নিজের বাড়িতে না দেবায়নের বাড়িতে, কোথায় উঠবে সেটা এখন ঠিক করে উঠতে পারেনি। চুপচাপ বসে খাবার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে উদাস চাহনি নিয়ে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

পরাশর ওর মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে ওকে বলে, “এইভাবে খাওয়া দাওয়া যদি ছেড়ে দিস তাহলে কি হবে বল। কোথায় যাবি কিছু ঠিক করলি? এখন পর্যন্ত কাউকে জানানো হয়নি যে আমরা কোলকাতা ফিরছি।”

শূন্য চোখে পরাশরের দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অনুপমা, “হ্যাঁ রে, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে তো?”

পরাশর ওর হাতের ওপরে হাত রেখে শক্তি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, আজকে আমার বাড়িতে চলো। কাল সকালে দেখা যাবে কি করা যায়।” কিছুক্ষণ থেমে কিছু চিন্তা করে ওকে বলে, “আমি বলছিলাম যে...” অনুপমা ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। পরাশর ওকে বলে, “কোন নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করালে ভালো হয়, মানে কাকুকে বলে। আমরা এমনিতে এফ.আই.আর করে এসেছি। এইবারে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অনায়াসে সেই তদন্তের ভার নিতে পারবে।”

কঠিন কণ্ঠে অনুপমা জানায়, “না, আমি একাই খুনিকে শাস্তি দেবো।”

পরাশর ওকে বলে, “এতে অনেক ঝুঁকি আছে অনু। হিতে বিপরিত হতে পারে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার, আমরা হয়তো এমন আসল লোককে এড়িয়ে যেতে পারি। হয়তো আততায়ী আমাদের খুব কাছের মানুষ যার ওপরে আমাদের সন্দেহ একদম হচ্ছে না।”

অনুপমা প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছিস একটু খুলে বল।”
 
পরাশর উত্তরে বলে, “না মানে, এই দেখ। দেবায়ন কার পথ থেকে সরে গেলে সে বেশি লাভবান হবে।”

“বাবা” বলতে গিয়েও থেমে গেল অনুপমা, উল্টে প্রশ্ন করে, “কেন, ওকে সরাবার উদ্দেশ্য অনেকের থাকতে পারে। এই যেমন, ধৃতিমান, সূর্য, ইন্দ্রনীল, অনিমেশ, রজত পানিক্কর এরা।”

পরাশর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলে, “আরো একজন হতে পারে, রূপক আর শ্রেয়া।”

অনুপমা আঁতকে ওঠে, “না না, ওরা কখনই হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সব থেকে ভালো বান্ধবী, আমার জন্য অনেক করেছে।”

পরাশর ওকে বলে, “জানি, কিন্তু সেটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের একটা চাল হতে পারে। একটু ভালো ভাবে চিন্তা করে দেখ। এই খাটলিং গ্লেসিয়ার যাওয়ার পরিকল্পনা কার? রুপকের। আর কি কেউ জানতো যে আমরা খাটলিং গ্লেসিয়ার যাচ্ছি? হয়তো নয়।” মাথা নাড়ায় অনুপমা, সত্যি, ওদের এই ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে শুধুমাত্র ওর বাবা আর রূপক জানে। অন্য কেউ হয়তো জানেই না এই বিষয়ে। পরাশর আরো বলে, “কে সব থেকে বেশি লাভবান হলো? রূপক আর শ্রেয়া। একটু ভালো ভাবে চিন্তা কর। তুই আসার আগে ওদের হাতে কোম্পানির ভার তুলে দিয়ে এলি। দেবায়ন না ফিরলে তোর কি হতো সেটা অবশ্য জানা নেই। পায়েল প্রচন্ড শান্ত প্রকৃতির মেয়ে হয়ে গেছে আর অঙ্কন অনেক ছোট। ওদের অতি সহজে হাত করে নিতে পারবে রূপক আর শ্রেয়া। যদি বলি, ওরা এটাই চেয়েছিল?”

বাকশুন্য হয়ে যায় অনুপমা, এতো গভীর দুরভিসন্ধি করবে ওর বিরুদ্ধে? অনুপমা মাথা ঝাঁকায়, “না না, এটা হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সাথে এতো বড় প্রতারনা করতে পারে না। কিন্তু দেবায়নের দুর্ঘটনার সময়ে, রূপক আর শ্রেয়া আমাদের সাথেই ছিল। ওদের চেহারা...”

পরাশর ওকে বলে, “আমি বলছি না যে এটাই হয়েছে, তবে এটা হতে পারে। সুতরাং সর্ব প্রথম ওদের ওপরে আমাদের খুব কড়া নজর রাখতে হবে। নিজে হাতে করেনি তবে টাকা দিয়ে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে এই কাজ অনায়াসে করা যেতে পারে।”

অনুপমা চিন্তায় পড়ে যায়, “তাহলে কাকে বিশ্বাস করবো, বল?”

পরাশর স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “কাউকে নয়, এমন কি আমাকেও নয়।” ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইয়ার্কির সুরে বলে, “দেবায়ন সরে গেলে আমার বড় লাভ হতো, তোকে একা পেয়ে একটু প্রেম করতে পারতাম।”

অনুপমার চোখে অনেকদিন পরে খানিক হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। পরাশরের কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “হ্যাঁ, আর বলিস না তুই শয়তান ছেলে...”

অনেকদিন পরে অনুপমার চেহারায় হাসি দেখে পরাশরের বেশ ভালো লাগে, ওর হাতের ওপরে হাত রেখে মনে সাহস দিয়ে বলে, “এই হাসিটাকে আর লুকাস না প্লিস, দেবু বড় কষ্ট পাবে।”

চোখ জোড়া ছলকে ওঠে অনুপমার, “বলছিস? কিন্তু কোলকাতা নামলে আমাদের চেহারার অভিব্যক্তি একদম বদলে ফেলতে হবে। দেবায়ন যে নেই এটা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।”

পরাশর স্মিত হেসে বলে, “এই হাসি ভেতরে রাখ সেটাই অনেক কাজে দেবে। মনমরা হয়ে থাকলে উৎসাহ খুঁজে পাবি না।”

কোলকাতা নেমেই ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে দেবশ্রীকে জানিয়ে দেয় ওরা ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে, সেই সাথে দেবায়নের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এখন ওর শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে... বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে হলো না অনুপমার। ওইদিকে মামনির ভাঙা কণ্ঠ এদিকে ওর ভগ্ন হৃদয়। অনুপমা ঠিক করে রাতে দেবায়নের বাড়িতে কাটাবে। দেবায়ন না থাকুক, ওর বিছানায় শুয়ে ওর জামা পরে ওর ছোঁয়া গায়ে মেখে এক রাতের জন্য দেবায়নের শরীরের পুরাতন ঘ্রাণ নিতে চায়।

দেবায়নের বাড়ির দরজা খুলে ফাঁকা ঘর দেখে অনুপমার হৃদয় হুহু করে কেঁদে ওঠে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নেয় অনুপমা। আলো জ্বালিয়ে দেবায়নের ঘরে ঢুকে ওর জামা পরে চুপচাপ ওর বিছানার ওপরে শুয়ে ভাবতে বসে। সত্যি কি শ্রেয়া আর রূপকের চাল এটা না বাবার কোন ষড়যন্ত্র। দেবায়ন সরে গেলে শ্রেয়া আর রূপক সব থেকে বেশি লাভবান হবে অথবা হয়েছে। বাবাও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ওরা যে খাটলিং যাবে এই কথা শুধুমাত্র বাবার আর রূপকের পক্ষেই জানা সম্ভব। কিন্তু বাবা কি শুধু প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে সরিয়েছে না এর পেছনে আরো কোন গভীর কারন আছে? হয়তো বাবার কোন গোপন কথা দেবায়ন জেনে ফেলেছে আর তাই হয়তো বাবাকে ব্ল্যাকমেল করেছে দেবায়ন যার ফলে ওর বাবা দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু যদি দেবায়ন ওর বাবাকে ব্লাক মেল করে থাকে তাহলে তার পরিবর্তে কি চেয়েছে? টাকা পয়সা, সম্পত্তি? দেবায়নের দুটো ব্যাংক একাউন্ট আছে যার মধ্যে একটা দেবায়নের নিজের। ল্যাপটপ খুলে সেই একাউন্ট চেক করে দেখে তাতে এমন কিছু টাকা নেই অথবা টাকার লেনদেন হয়নি। দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক একাউন্ট ওর সাথে জয়েন্ট, সেই ব্যাঙ্ক একাউন্ট বেশির ভাগ সময়ে নিজেই চালায়। দেবায়নের টাকার দরকার পড়লে ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়। তাহলে কি সম্পত্তি চেয়েছে দেবায়ন? এতটা নীচ কাজ কি দেবায়ন করবে? ভাবতেই ওর শরীর ঘৃণায় শিউরে ওঠে। না, এতটা নীচ দেবায়ন হয়তো হবে না। আসল কারন জানতে হলে বাবার ওপরে আর রূপকের ওপরে কড়া নজর রাখা দরকার।

সারাটা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা, ওর মাথা আর কাজ করছে না। আলমারি খুলে কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখে যদি কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই সম্পত্তির বিষয়ে। কাগজ পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হটাত একটা ফাইলে ওর নজর পড়ে যায়। হলদে ফাইল, ওপরে লেখা “অফিস ওয়ার্কস” ভেতরে অজস্র কাগজ পত্র। ফাইল হাতে নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে বসে পড়ে। কাগজ গুলো সব ব্যাবসা সংক্রান্ত। একটা কাগজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। পুনের হোটেলের কাগজ। রজত পানিক্করের দুটো হোটেলের মালিকানার কাগজের জেরক্স। বহুদিন আগে মেহেকের সাহায্যে একটা হোটেল দেবায়ন হাতিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তারপরে আরো একটা হোটেল কি ভাবে করায়ত্ত করেছে সেই খবর জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। হতে পারে সেই প্রতিশোধে রজত পানিক্কর দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে এর সদুত্তর পাওয়া যাবে, কিন্তু বাবাও সন্দেহের ঘেরে রয়েছে।

কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পরে অনুপমা ঠিক করে একবার নিজের পরিচয় দিয়ে হোটেলে ফোন করবে। হোটেলের রিসেপসানে ফোন করে ম্যনেজারের সাথে কথা বলে অনুপমা জানতে পারে যে রজত পানিক্কর দুই মাস আগেই দেহ রক্ষা করেছেন। তাঁর দুই ছেলে রজত পানিক্করের দুটো হোটেল মিস্টার সোমেশ সেনকে বিক্রি করে দেন। এই খবর ওর জানা ছিল না, দেবায়ন অথবা ওর বাবা ব্যাবসার বেশির ভাগ খবর ওকে জানায় না। ওর সন্দেহের তালিকা থেকে রজত পানিক্করকে বাদ দিতে হয়।

কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরো একটা কাগজ উদ্ধার করে। ওদের কস্ট্রাক্সান কোম্পানির একটা ইনিসিয়াল ড্রাফট। কাগজ খানা পড়ার পরে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। নিবেদিতার কন্সট্রাক্সান কোম্পানির সাথে ওদের কন্সট্রাক্সান কোম্পানি মিলিত হয়ে একটা কোম্পানি হয়ে যাবে, এবং সেই কোম্পানির কর্ণধার স্বয়ং নিবেদিতা। যদিও ওই কোম্পানি ওদের গ্রুপ কোম্পানির অধীনে থাকবে কিন্তু সিংহ ভাগ মালিকানা, সত্তর শতাংশের মালিকানা নিবেদিতার হাতে। হটাত দেবায়ন নিবেদিতার ওপরে এতটা সহৃদয় কেন? ওর পেছনে কি নিবেদিতার সাথে দেবায়নের কোন গোপন সম্পর্ক গঠন হয়েছে? দুই কম্পানিকে মিলিত করার আসল চিন্তা ধারা কি নিবেদিতার না দেবায়নের? ওর বাবা কি আদৌ জানেন এই বিষয়ে? হয়তো এই বিষয়ে জেনে গেছেন ওর বাবা আর সেই জন্যেই দেবায়নকে সরিয়ে দিয়েছে। বহু প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে ভর করে আসে, কিন্তু সঠিক উত্তর কিছুতেই খুঁজে পায় না। দেবায়নের এই পরিনতির পেছনে কি আসলে দেবায়ন নিজেই দায়ী? ওর পুচ্চু কি সত্যি এক খলনায়ক? উত্তরগুলো ওকে জানতে হবেই।

সকাল বেলা পরাশরের ফোনে ওর ঘুম ভাঙে। অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছিল, তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়। পরাশর জানায় গত রাতে কাকুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। ওর কাকা একবার অনুপমার সাথে দেখা করতে চায়। অনুপমা জানিয়ে দেয়, বিকেলের দিকে দেখা করবে। এখন নিজের বাড়িতে যেতে চায়। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে, ব্যাঙ্গালোর ফোন করে মামনি আর দেবায়নের খবর নিয়ে নেয়। তারপরে বাড়িতে প্রথমে মাকে ফোন করে।

পারমিতা ওর ফোন পেয়েই প্রশ্ন করে, “এতদিন একটা খবর নেই। পরাশরকে ফোন করলে ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যায়না, তুই আমাদের কি ভেবেছিস? আমরা কি তোর পর যে আমাদের ফোন উঠাস না?”

মায়ের এই উদ্বেগজনিত কণ্ঠস্বরকে ক্ষান্ত করে উত্তর দেয়, “পর নয়, তবে...” মনে পড়ে যায়, কেউ জানে না দেবায়নের বিষয়ে সুতরাং সেই বেদনা ভাঙা হৃদয় সবার সামনে প্রস্তুত করতে হবে। ধরা গলায় বলে, “মা... ওকে...”
 

Users who are viewing this thread

Back
Top