What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (12 Viewers)

পারমিতা আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে? তুই কোথায়? দেবায়ন...”

অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে, “না খুঁজে পাইনি। আমি এয়ারপোর্টে, একটু পরেই বাড়ি আসছি।”

পারমিতা মেয়েকে কি সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায়না, “আচ্ছা... আয়... মনে হয় এটা আমাদের অদৃষ্টে ছিল, হয়তো আমাদের পাপের ফল যে ছেলেটা এইভাবে চলে গেল।”

দাঁতে দাঁত পিষে নিজের মনের ভাব সংবরণ করে নেয় অনুপমা, কার পাপের ফল জানা নেই তবে যদি বাবা অথবা রূপক দোষী হয় তাহলে ওর অনুপমা মরেও শান্তি পাবে না। তবে এই দুইজনার দিকে আঙুল তোলার আগে ভালো ভাবে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখতে হবে।

সকালের দিকেই ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি পৌঁছায় অনুপমা। ওকে দেখে পারমিতা, পায়েল, অঙ্কন সবাই দৌড়ে আসে। ওর বাবা সেদিন আর অফিসে যায়না। মেয়েকে এই ভাবে ভেঙে যেতে দেখে পারমিতার বুক ফেটে যায়। অনুপমা কি করবে ভেবে পায় না। বাবার চেহারায় কঠিন চিন্তার ছাপ, মেয়ের এই অভাবনীয় কষ্ট দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে। মনের এক কোনায় প্রশ্ন জাগে, বাবাও কি ওর মতন মুখোশ এঁটে না সত্যি মেয়ের জন্য চিন্তিত।
সবাই ওকে চেপে ধরে জানার জন্য। অনুপমা মিথ্যে গল্প বানিয়ে ওদের জানায় ঘুট্টুতে, ঘনসিয়ালিতে বিভিন্ন জায়গায় অনেক খুঁজেছে, এমন কি রেপ্লিং করে খাদের মধ্যে নেমে নদীর দুই পাড়ে অনেকদিন ধরে তল্লাসি করেও দেবায়নের সন্ধান পাওয়া যায়নি, এমন কি আততায়ীর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ঘনসিয়ালির পুলিসের কাছে এফ.আই.আর করা আছে, পুলিস আস্বাস দিয়েছে যে সেই ছেলেটার খোঁজ পেলে ওদের খবর দেবে।

এই গল্প বলার সময়ে বারেবারে ওর সাথে পায়েলের চোখাচুখি হয়ে যাচ্ছিল। মনে হয় পায়েল কিছু বলতে চায় অথবা পায়েল হয়তো ওর মিথ্যে গল্প ধরে ফেলেছে। শ্রেয়া যে ইন্দ্রনীলের সাথে ছলনার খেলা খেলেছিল সেটা পায়েল জানতো কিন্তু ওকে বলেনি, হতেও পারে এইবারে পায়েল অনেক কিছু জানে কিন্তু ওকে বলার কিছু সময় পায়নি। বাবা, মাকে সব ঘটনা বলার পরে পায়েলকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে অনুপমা। ওকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়েই পায়েল ওকে জড়িয়ে ধরে দুঃখ প্রকাশ করে কেঁদে ফেলে। অনুপমা কাকে সান্ত্বনা দেবে ঠিক করে উঠতে পারে না, পায়েলকে সত্যি বলবে কি না সেটাও ভেবে উঠতে পারে না।

পায়েল ওকে বলে, “তুই চলে যাওয়ার পর থেকে শ্রেয়া আর রূপক বসে নেই জানিস।”

আবার ওর অবাক হওয়ার পালা, প্রশ্ন করে অনুপমা, “মানে?”

পায়েল উত্তর দেয়, “তুই ঘুট্টু চলে গেলি, আর শ্রেয়া আর রূপক সোজা জলপাইগুড়ি গিয়েছিল সূর্যের খবর নেওয়ার জন্য।”

অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে, “এতো কিছু করেছে ওরা?”

পায়েল আরো জানায়, “জলপাইগুড়িতে ওদের না পেয়ে আশে পাশের লোক জনের কাছ থেকে খবর যোগাড় করে জানতে পারে যে সূর্য আর মনিদিপা কোলকাতা চলে এসেছে। তারপরে শ্রেয়া আর রূপক দুইজনে সূর্যের বাড়ি যায়। তুই নাকি কয়েকদিন আগে ওদের টাকা দিয়েছিলি?” বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, “হ্যাঁ।” পায়েল ওকে বলে, “রূপকের রুদ্র মূর্তি দেখে সূর্যের অবস্থা খারাপ।”

অবাক অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “সূর্যের সাথে আর কি করেছে ওরা?”

পায়েল মাথা নাড়ায়, “না না, মারপিট এই সবে যায়নি, শুধুমাত্র খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কবে কোথায় ছিল, ইত্যাদি। তবে ওরা দেবায়নকে মারেনি ওদের সেই ক্ষমতা নেই। সূর্যের পরে রূপকের সন্দেহ ইন্দ্রনীল আর ওর বাবার ওপরে পড়ে। টালিগঞ্জে ওদের ফ্লাটে গিয়ে দেখে মিস্টার অনিমেশ শ্রেয়ার ওই ঘটনার পরে ফ্লাট বিক্রি করে জার্মানি চলে গেছে। সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের জন্য শ্রেয়া সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার হেরজোগকে ফোন করে। মিস্টার হেরজোগকে শ্রেয়া সবিস্তারে সব কিছু খুলে বলে। মিস্টার হেরজোগ খবর লাগিয়ে ওদের জানায় যে ইন্দ্রনীল স্থায়ী ভাবে লন্ডনে চলে গেছে আর ওর বাবা মিস্টার অনিমেশ আবার ব্যাঙ্কে চাকরি করছে।”

অনুপমা শূন্য চাহনি নিয়ে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন ধরে যাদের যাদের সন্দেহের তালিকাভুক্ত করেছিল তাদের সবাই সন্দেহের ঘের থেকে পারো পেয়ে গেল। নিজের বান্ধবী শ্রেয়া, ওর সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্তি পায়নি। শ্রেয়া আর রূপককে ওর বিষয়ে এতটা চিন্তিত জানতে পেরে ওর দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। বাকি থাকে শুধুমাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর। আততায়ী কি তাহলে আসলে ওর বাবা?

অনুপমার চিন্তার গতিতে বাধা প্রাপ্তি হয় পায়েলের হাতের ছোঁয়ায়, “কোথায় হারিয়ে গেলিরে? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি রে। আমারো খুব দুঃখ লাগছে, কিন্তু কি করতে পারি বল। পুলিস কি কিছু করছে?”

অনুপমা ছলছল চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে, একে কি দেবায়নের বিষয়ে বলা ঠিক হবে? শ্রেয়া আর রূপকের ওপরে সন্দেহ করেছে ভেবেই মনের ভেতরে কুণ্ঠাবোধ জেগে ওঠে। মন পড়ে থাকে নির্জীব শায়িত দেবায়নের পাশে। চোখ মুছে বহু কষ্টে হাসি টেনে বলে, “না রে, হারিয়ে যাইনি আমি। তোর সাথে একটু গোপন কথা আছে। ভাই ছাড়া আর কাউকে বলিস না যেন।” পায়েল অধীর চিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধরা গলায় বলে, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি।”

কথাটা কানে যেতেই দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পায়েলের, অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কোথায় কেমন আছে, আমাকে এখুনি নিয়ে চলো আমি ওকে দেখতে চাই।”

নির্জীব দেবায়নের মুখ মনে পড়তেই কেঁদে ফেলে অনুপমা, “কোমায় চলে গেছে রে আমার পুচ্চু...”

আঁতকে ওঠে পায়েল, “না...” বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে।

ধীরে ধীরে এক এক করে সব ঘটনা ব্যক্ত করে পায়েলের কাছে। পায়েল ওকে প্রবোধ দেয় যে একদিন দেবায়ন ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। এই প্রবোধ নিশ্চিত কিনা জানা নেই তাও বান্ধবীর মুখে সান্ত্বনা বাক্য শুনে অনুপমার মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয়। শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, পায়েল জানায়, অনুপমার নির্দেশ মতন ওদের দেখাশোনার ভার শ্রেয়া করে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে এসে পায়েলকে সঙ্গে নিয়েই অফিসে যায়। নিজেকে অনুপমার স্থানে বসাতে চেষ্টা করেনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই অফিস আর পায়েল, অঙ্কনকে সামলে রেখেছে।
 
রোজদিনের মতন একটু পরেই শ্রেয়া ওদের বাড়িতে আসে। অনুপমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিরে তুই এলি আর আমাদের খবর পর্যন্ত দিলি না? কি হয়েছে? কেমন আছিস? দেবুকে খুঁজে পেলি?”

ঝড়ের মতন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অনুপমা উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়ার ওপরে অহেতুক সন্দেহ করেছিল ভাবতেই ওর চোখে জল চলে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে শেষ পর্যন্ত দেবায়নের বিষয়ে বিস্তারে সব কথা জানায়। সব কিছু শোনার পরে শ্রেয়াও পায়েলের মতন অধৈর্য হয়ে ওঠে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য। অনুপমা জানায় এখন ওর কোলকাতায় কিছু কাজ বাকি আছে। ওরা জানতে চাইলে সত্য লুকিয়ে জানায় যে ধৃতিমানের বিষয়ে বিস্তারে খোঁজ নিতে চায়। এখুনি সবাই মিলে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুই করার নেই। পায়েল আর শ্রেয়াকে অফিসে চলে যেতে বলে।

পায়েল আর শ্রেয়া অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনুপমা ব্যাগ খুলে দেবায়নের বাড়ি থেকে আনা ফাইল খুলে বসে পড়ে। কন্সট্রাক্সান কোম্পানির কাগজখানা বারেবারে পড়ে দেখে। এই কাগজের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই কাগজের আসল অর্থ বের করতে পারলে দেবায়নের আসল উদ্দেশ্য অথবা খুনির আসল উদ্দেশ্য হয়তো জানা যাবে। দেবায়ন বিশেষ কিছুই জানায়নি নিবেদিতার সম্পর্কে। যদিও ওর বাবার সাথে নিবেদিতার অনেকদিনের পরিচয় কিন্তু কোনোদিন ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিল না নিবেদিতার। আর তার আসল কারন, মায়ের আর নিবেদিতার মনোমালিন্য। কি কারনে এই মনোমালিন্য, আর কি কারনে বাবার সাথে এতো সুহৃদ সম্পর্ক। নিবেদিতার বিষয়ে বিস্তারে জানা দরকার। নিবেদিতার বিয়ে চোদ্দ বছর আগে একজন এন.আর.আইয়ের সাথে হয়েছিল, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নিবেদিতার ছেলে, অঙ্কুশের জন্ম ডিভোর্সের এক দেড় বছর পরে হয়। অঙ্কুশের পিতার পরিচয় অনুপমার অজানা, হয়তো এই পৃথিবীর অজানা। কোন গুপ্ত প্রেমের ফল স্বরূপ অঙ্কুশের জন্ম। হয়তো দেবায়ন এই বিষয়ে জেনে গিয়েছিল আর নিবেদিতাকে ব্ল্যাকমেল করেছে। তাই কি নিবেদিতা ওকে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কোম্পানির কাগজ অন্য কথা বলছে। এই কাগজ অনুযায়ী, দুটি কন্সট্রাক্সান কোম্পানি মিলিত করে একটা বড় কোম্পানির মালিক হতে চলেছে নিবেদিতা। কিন্তু কন্সট্রাক্সান কোম্পানি মালিকানা নিবেদিতার নামে তাহলে দেবায়নের কি লাভ এইখানে?

ভাবতে ভাবতে হটাত মাথায় ঝিলিক খেলে যায় অনুপমার। অঙ্কুশ অবিকল ভাইয়ের ছোট বেলার মতন দেখতে, ঠিক সেই নাক সেই রকম কোঁকড়ানো চুল, গাল দুটো টোপাটোপা আর চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তের ছটা। বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক। অঙ্ক মেলাতে অসুবিধে হয় না। অঙ্কুশের পিতার সম্বন্ধে জানা দরকার। এই উত্তর পেয়ে গেলে ওর কাছে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।

মা নিবেদিতাকে দেখতে পারে না। মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখে। নিবেদিতার সম্বন্ধে মায়ের কাছ থেকে হয়তো অনেক কিছু জানা যেতে পারে ভেবেই অনুপমা কাগজ হাতে পারমিতার কাছে যায়।

পারমিতার ঘরে ঢুকে অনুপমা মাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

মেয়েকে ওইভাবে বিদ্ধস্ত রূপে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিতা প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ, বল কি হয়েছে?”

অনুপমা একটু খানি থেমে জিজ্ঞেস করে, “নিবেদিতার সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল। তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনিবনা হয়না, তার কারন কি জানতে পারি?”

পারমিতা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে জরিপ করে উত্তর দেয়, “হটাত নিবেদিতার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিস কেন? নিবেদিতার ওপরে কি তোর সন্দেহ হচ্ছে নাকি?” একটু থেমে, ওকে বসতে বলে, “দেখ অনু, পায়েলের কাছ থেকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি সব শুনেছি। আমি জানিনা আততায়ী কে। কিন্তু আর যাই হোক নিবেদিতা এই কাজ করতে পারে না, ও সেই রকমের মেয়ে নয়।”

অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না মা, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক কিন্তু তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনে না?”

পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, নিবেদিতার সাথে কোনোদিন আমার সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। তোকে শুরু থেকে বলি তাহলে। শ্বশুর মশায় মানে তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় থেকেই নিবেদিতার বাবা, মিস্টার চৌধুরী আর তোর জেঠু, রাজেশ এই কোম্পানি চালাতো। তারপরে এই কন্সট্রাক্সান কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে আমার হাতে চলে আসে। কিভাবে আসে সেটা তোর অজানা নয়।” কথাটা বলার সময়ে কুণ্ঠাবোধে পারমিতার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, “ততদিনে নিবেদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে নিবেদিতার বাবার হার্ট এটাক হয়। তারপরে নিবেদিতার ডিভোর্স আর নিবেদিতা কোলকাতা ফিরে এসে কোম্পানির ভার সামলায়। আমার মাথায় এই ব্যাবসার প্যাঁচ কলাকৌশল কোনোদিন ঢুকতো না তাই আমি বিশেষ কোনোদিন অফিসে যেতাম না। আমার কাজ ছিল অন্য, ক্লায়েন্ট ধরার জন্য আমি কি করতাম সেটাও তোর অবিদিত নয়। তোর বাবা নিজের অফিস আর এই কন্সট্রাক্সান কোম্পানি নিয়েই পড়ে থাকতো। তবে তোর বাবার চেয়ে নিবেদিতা নিজের ঘাড়ে পুরো কন্সট্রাক্সান কোম্পানির তত্ত্বাবধানের ভার তুলে নেয়। এতো কিছু করার পরেও ওর অংশ খুব কম ছিল আর সেই নিয়ে অখুশি ছিল। মাস গেলে আমার একাউন্টে মোটা টাকা আর তার তুলনায় যে সব কাজ করে তার একাউন্টে আমার চেয়ে অনেক কম টাকা। আমি অফিসে গেলেই আমার থেকে দূরে থাকতো, আমার দিকে এক ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাতো। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোন বচসা হয়নি কিন্তু নিবেদিতা আমাকে দেখতে পারতো না। আমি অফিসের মালিক হয়েও কর্মচারীদের মধ্যে আমার বিশেষ কোন স্থান ছিল না। ওর এই নাক উঁচু ভাব, অফিসে সবাই ওকে সমীহ করে, সেই হিংসা, এইসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে নিবেদিতা খুব কর্মঠ মেয়ে, মার্জিত কিন্তু কঠোর, সুনিপুণ দক্ষতায় কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে।”

মায়ের মুখে নিবেদিতার স্তুতি শুনতে পাবে সেটা অনুপমার পক্ষে আশাতীত ছিল। ভেবেছিল হয়তো মা নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, কিন্তু নিবেদিতার চরিত্রে কোন খুঁত ওর মা ওকে জানাতে পারলো না। সব শুনে অনুপমা একটু চিন্তায় পড়ে যায়, “হুম, বুঝলাম সব কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাচ্ছি না। নিবেদিতার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তাই না?” পারমিতা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।” অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “ডিভোর্সের এক থেকে দেড় বছর পড়ে অঙ্কুশের জন্ম। অঙ্কুশের পিতা কে, সেই নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি?”

পারমিতার চেহারা হটাত করে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। বার কতক ঢোঁক গিলে মেয়েকে প্রশ্ন করে, “হটাত এই নিয়ে প্রশ্ন করলি কেন? কি জানিস তুই?”

মায়ের চেহারার এই ফ্যাকাসে রঙ অনুপমার তীক্ষ্ণ চাহনি এড়াতে পারে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি জানো, অঙ্কুশের বাবা কে?”

পারমিতা কঠিন ভাবে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে, “এই খবর তোর জেনে কি লাভ? অঙ্কুশের পিতার পরিচয়ের সাথে দেবায়নের এই দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক?”

পারমিতার চোখের এই কঠোর চাহনির পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে। এর উত্তর জানার জন্য ওকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কাগজ বের করতে হয়। কোম্পানির কাগজ হাতে নিয়েই পারমিতা রুদ্ধশ্বাসে অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জোড়া ছলকে ওঠে পারমিতার, অস্ফুট কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই কাগজ কোথা থেকে পেয়েছিস তুই?”

অনুপমা মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে প্রশ্ন করে, “আমি শুধু এর উত্তর জানতে চাই মা। আততায়ী যেই হোক কিন্তু এই কাগজ পড়ার পরে আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছে। কে আসল দোষী। এই দেবায়ন কি আসলে আমার ভালোবাসার পুচ্চু নয়?”

পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে অস্ফুট আঁতকে ওঠে, “না, হ্যান্ডসামের মতন ছেলে হয় না। তোর পুচ্চু তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে অনু।” ওর দেবায়ন যে ওকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে কিন্তু সেই কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার পরে ওর চোখ জোড়া ভেসে যায়। পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে মনে শক্তি জুগিয়ে বলে, “হ্যান্ডসাম ওর বিশাল হাতের মাঝে সবাইকে আগলে রাখতে চায়। সবাইকে মানে, তোকে, আমাকে, তোর বাবাকে, পায়েল, অঙ্কন সব্বাইকে। কোন কিছু ভেঙে যাক সেটা কিছুতেই হ্যান্ডসাম চায় না। এই সম্পর্কের সম্বন্ধে আর এই কাগজের ব্যাপারে কিছু নাই বা জানলি।”

মায়ের চোখের জল দেখে অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না, অঙ্কুশ কেন অবিকল ওর ভাইয়ের মতন দেখতে। মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে, “তাহলে তুমি জানতে আগে থেকে?”

সম্মতি জানিয়ে মৃদু মাথা দোলায় পারমিতা, “হ্যাঁ, আমি সব জানি তবে আগে জানতাম না। দেবায়ন কি ভাবে যেন এই সব কিছু জেনে গিয়েছিল আর সেই আমাকে বুঝিয়ে বলে। প্রথমে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু হ্যান্ডসামের কথা শুনে মনে হলো, ভালো কি শুধু একটা মাত্র মানুষকেই বাসা যায়? তোর বাবা আগে আমাকে সেইভাবে ভালবাসতো না, আর সেই কারনেই নিবেদিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আমি এতোদিন তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমি এতোদিন এর তার বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি। নিবেদিতা আর তোর বাবা একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে আর এই দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে কাটাতে সাথে তোর বাবার সাথে নিবেদিতার প্রেম হয়ে যায়। আর...”

অনুপমা ছলছল চোখে কম্পিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, “অঙ্কুশ তাহলে আমার ভাই?”
 
পারমিতা সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, অঙ্কুশ তোর ভাই, তোর রক্ত।” অনুপমার মাথার শিরা ঝনঝন করে ওঠে। পারমিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তবে দেবায়ন কাউকে আঘাত করতে চায়নি তাই তোকে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করায়। শুরুতেই যদি দেবায়ন তোকে সব কিছু বলে দিতো তাহলে তুই কাউকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতিস না তাই তোর সাথে নিবেদিতার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তুই যেমন আমাকে ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল অন্তত নিবেদিতার সাথে তোর বান্ধবীর মতন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। অঙ্কনকে যেমন ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল ঠিক সেইভাবে অঙ্কুশের ওপরে তোর যেন সেই স্নেহ গড়ে ওঠে। তারপরে তোর হাত ধরে নিবেদিতার সাথে পায়েল আর অঙ্কনের সুহৃদ সম্পর্ক গড়ে উঠতো। এই গ্রুপ কোম্পানি আমাদের পরিবারের মধ্যেই রয়েছে। নিবেদিতাকে কন্সট্রাক্সান কোম্পানির সম্পূর্ণ ভার দেওয়া দেবায়নের মাথার উপজ। তোর বাবা আর দেবায়ন হোটেল নিয়ে থাকবে এই ঠিক হয় আর তুই, পায়েল আর অঙ্কন তোর আই.টি কোম্পানি নিয়ে থাকবি। এই ভাবেই দুই পরিবার এক করতে চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তোর বাবা সব শুনে সেদিন দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই প্রথম সোমেশকে ওইভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভালোবাসা বড় কঠিন বস্তু, তাই নয় কি অনু?”

সব কিছু শোনার পরে অনুপমা চোখ বন্ধ করে বসে পড়ে। ওর দুই চোখ বেয়ে অঝোর ঝারায় অশ্রুর বন্যা বয়ে চলে, এতো ভালোবাসা রাখবে কোথায়? একটি মাত্র জীবন ওর কাছে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, অবুঝের মতন কিছু না জেনেই বাবাকে, নিবেদিতাকে, রূপককে সন্দেহ করেছিল। এরা সবাই ওর জন্য ভাবে, ওর জন্য চিন্তা করে, ওর দুঃখে দুঃখিত হয়, ওর হাসিতে হাসে।

পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “জানি দেবায়ন চলে যাওয়াতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি তোর জীবনে দেবায়নের জায়গা আমরা কেউই পূরণ করতে পারবো না তবে আমরা সবাই তোর পাশে আছি রে অনু।”

অনুপমা ফুঁপিয়ে ওঠে, মায়ের সান্ত্বনা বাক্য শোনার পরে মনে হয় মাকে সত্যি বলা ভালো। “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি। তবে...”

পারমিতা ওই শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এই কথা কেন আমাদের জানাস নি?”

অনুপমা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কে আসল দোষী তাই।”

পারমিতা ওকে প্রশ্ন করে, “দেবায়ন কোথায়, কেমন আছে?”

অনুপমা ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “খুব খারাপ অবস্থায় আছে মা। জানি না কি হবে। ওর অনেক হাড় ভেঙে গেছে। দেবায়ন কোমায় চলে গেছে, মা। আমি কি করবো মা?” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনুপমা।

মেয়ের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “দেবায়নকে যখন খুঁজে পেয়েছিস তখন কোমায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক ও তোর কাছে ফিরে আসবেই। তুই চিন্তা করিস না। দেবশ্রীদি এই বিষয়ে জানে?”

অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ জানে। মামনি খুব ভেঙে পড়েছে।”

পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি কোথায়, দেবায়ন কোথায়?”

চোখের জল মুছে অনুপমা উত্তরে বলে, “দেবায়নকে আমি দিলিপ বাবুর কাছে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মামনি দেবায়নের কাছে।” তারপরে মাকে সব কথা বিস্তারে জানায় অনুপমা।

সব কিছু শোনার পরে পারমিতা ব্যস্ত হয়ে যায়, ওকে বলে, “আমি এখুনি তোর বাবাকে ফোন করছি। আমরা থাকতে এই সময়ে দেবশ্রীদি একা থাকতে পারে না। আমি এখুনি তোর বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেতে চাই।”

পারমিতা সঙ্গে সঙ্গে সোমেশ বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনুপমার বাবা সব কিছু শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে যান। বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে বাবার সামনে যেতে দ্বিধা বোধ করে অনুপমা। কিন্তু ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এই কথা ওর বাবা জানতে পারবে না। পারমিতা ওকে সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অনুপমা জানায় ওর বদলে পায়েলকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাক। অনুপমা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। ওর সন্দেহের তালিকার শেষ ব্যক্তি, ধৃতিমানের বিষয়ে কিছুই তল্লাসি করা হয়নি। হয়তো এইবারে ওর তীর সঠিক স্থানে লাগবে।

ঠিক সেই সময়ে পায়েল অফিস থেকে একাই ফিরে আসে। ওকে দেখে অনুপমা ওকে মা বাবার সাথে ব্যাঙ্গালোর যেতে বলে। পায়েল সেই শুনে খুব খুশি হয় সেই সাথে অনুপমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে যে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। শ্রেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে পায়েল ওকে জানায়, কিছু আগে রূপকের নামে অফিসে কুরিয়ারে একটা চিঠি আসে। সেই চিঠি পড়ে রূপক আর শ্রেয়া তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায়। খবর শুনে অনুপমা ওকে ওই চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।

পায়েল ওর হাতে একটা সাদা খাম দিয়ে জানায়, “এই খামটা আসার পরেই শ্রেয়া আর রূপক বেরিয়ে পড়েছে। তুই অহেতুক চিন্তা করে শরীর খারাপ করবি তাই রূপক তোকে জানাতে বারন করেছিল। তুই চিন্তা করসি না, রূপক ঠিক ওই আততায়ীকে খুঁজে বের করবে। তুই আমাদের সাথে ব্যাঙ্গালোর চলো।”

সাদা খামের মধ্যে কাগজটা হাতে ধরে দেখে অনুপমা। একটা সাদা কাগজে ইংরেজি হরফে কম্পিউটার প্রিন্টে লেখা, “যদি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানতে চাও তাহলে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে কাল ভোরের মধ্যে লাভা পৌঁছাও। একা আসবে, কাউকে সাথে নিয়ে এলে বিপদ।”

অনুপমা চোখের জল মুছে দৃঢ় কণ্ঠে ওকে বলে, “না আততায়ীকে খুঁজে ওকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না রে।” ওর হাতে হাত রেখে বলে, “আমার কিছু কাজ আছে পায়েল। তুই মায়ের সাথে ব্যাঙ্গালোর যা। আমি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি যদি আততায়ীর আসল পরিচয় জানা যায়।”

অঙ্কন বাড়ি এলে বিকেলের মধ্যে সোমেশ বাবু পারমিতা, পায়েল আর অঙ্কনকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ফাঁকা বাড়িতে থাকতে একদম ভালো লাগে না অনুপমার। ধৃতিমানের বিষয়ে এখন কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। নিবেদিতার ওপরে সন্দেহ করেছিল, ওর কাছে একবার যাওয়া উচিত। সাত পাঁচ ভেবে গাড়ি নিয়ে নিবেদিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে অনুপমা।

পথে যেতে যেতে রূপককে ফোন করে, “তুই কোথায়?”

রূপক গাড়ি চালাচ্ছিল তাই শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে উত্তর দেয়, “কেমন আছিস তুই?”
 
অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কোথায়?”

শ্রেয়া উত্তর দেয়, “এই একটু বেরিয়েছি, কাল বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবো।”

অনুপমা ধরা গলায় বলে, “আমাকে জানাতে দোষ? পায়েল আমাকে সব বলেছে।”

শ্রেয়া ওকে উত্তর দেয়, “নারে সোনা, তুই একা নস। আমরা সবাই মিলে ঠিক দেবায়নের আততায়ীকে খুঁজে বের করবো। তুই একটু বিশ্রাম কর আমরা কাল বিকেলের মধ্যে কোলকাতা ফিরে এসে তোকে সব কিছু জানাব।”

অনুপমা ওদের সাবধানে যেতে বলে দেয় আর লাভা পৌঁছে যেন একটা ফোন করে বলে জানিয়ে দেয়। শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা সাবধানেই যাবে বলে ফোন রেখে দেয়। অনুপমা ভাবতে বসে কি ভাবে নিবেদিতার সামনে যাবে। বাবা আর নিবেদিতার সম্পর্কের বিষয়ে জানার পরে ওর সামনে দাঁড়ানো ওর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর। নিবেদিতা এতদিন হাসিমুখে ওর সাথে বান্ধবীর মতন ব্যবহার করে গেছে। এর মূলে দেবায়নের মাথা ছিল সেটা অনুপমা এতদিন জানতো না, আর অহেতুক দেবায়ন আর নিবেদিতার মাঝের এক বিতর্কিত সম্পর্কের আভাস খুঁজে বেড়াচ্ছিল বলে নিজেকে ধিক্কার দেয়।

এমন সময়ে ওর কাছে পরাশরের ফোন আসে, “তুই কোথায়? আজকে আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল তোর। বেশ কিছু খবর পাওয়া গেছে।”

অনুপমা উৎসুক হয়ে ওঠে, “কি খবর?”

পরাশর উত্তর দেয়, “আজকে কাকা ঘনসিয়ালির পুলিস ইনস্পেকটর রোহনকে ফোন করেছিল। যে ছেলেটা সেই রাতে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, সেই ছেলেটার লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের মধ্যে। তবে ওই ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেছে কিন্তু তাতে বিশেষ কিছুই লাভ হয়নি। ওই ছেলেটা ওই এলাকার ছেলে। রঞ্জিতের সাথেও কথাবার্তা বলেছে কাকু। আমরা যে সব জিনিস পত্র ওই জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেইগুলো নিয়ে তুই যদি একবার বাড়িতে আসিস তাহলে বেশ ভালো হয়।”

অনুপমা ওকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখুনি তোর বাড়িতে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ এইদিকে আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। কেউ একজন আজকে অফিসে রূপকের নামে একটা কুরিয়ার করে চিঠি পাঠিয়ে বলেছে যে সে নাকি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানে। তাই শ্রেয়া আর রূপক লাভার জন্যে বেরিয়ে গেছে।”

পরাশর খানিকক্ষণ ভাবার পরে বলে, “রূপকের নামে চিঠি? ঠিক মিলছে না। হটাত রূপকের নামে কেন চিঠি পাঠাতে যাবে? তুই কি সেই চিঠি দেখেছিস?”

অনুপমা উত্তরে জানায়, সেই চিঠি ওর হাতে। বাড়ি ফিরে যে সব জিনিসপত্র জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছিল সেই সব নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বাড়ি পৌঁছে যাবে। গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি থেকে প্লাস্টিক ভর্তি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে পরাশরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিবেদিতার বাড়ি আর এই যাত্রায় যাওয়া হয় না। পরাশরের বাড়ি যাওয়ার পথে নিজেই একবার সেই চিঠি খুলে দেখে। বারেবারে পড়েও বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারে না। তারপরে ওর মনে হয়, হটাত এই চিঠি রূপকের নামে কেন এসেছে? আততায়ী কি রূপককে চেনে? যদি আততায়ী রূপক আর দেবায়ন দুই জনকে চেনে তাহলে ওদের অফিসের লোক ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কারন রূপক যাদবপুর থেকে পাশ করেছে আর দেবায়ন অন্য একটা কলেজ থেকে পাশ করেছে। দুইজনের দেখা সাক্ষাৎ শুধুমাত্র এই অফিস ছাড়া আর কোথাও নয়। আততায়ী নিশ্চয় এই দুইজনার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চায়। সেই রকম হলে একমাত্র ইন্দ্রনীলকে সন্দেহ হয় কিন্তু ইন্দ্রনীল অনেকদিন থেকেই দেশে আসেনি আর মিস্টার হেরজোগ খবর নিয়েছেন যে ইন্দ্রনীল বর্তমানে লন্ডনে। ইন্দ্রনীল ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তি যার সাথে দেবায়ন আর রূপকের শত্রুতা হতে পারে সে মানুষ সূর্য। কিন্তু রূপক খবর নিয়ে দেখেছে যে সূর্য সেই সময়ে কোলকাতায় ছিল আর ওর এই কাজ করার ক্ষমতা নেই। খাম খানা উল্টে পাল্টে দেখে অনুপমা। কোথা থেকে এসেছে সেটা একমাত্র অফিসের রেজিস্টারে খুঁজে পাওয়া যাবে। রাত হলেও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারকে অফিসে নিয়ে যেতে বলে। অত রাতে অফিসে শুধুমাত্র নেটওয়ার্কের ছেলেরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। গার্ড ওকে দেখে রীতিমতন অবাক হয়ে যায়। অনুপমা রিসেপসানে বসা গার্ডের কাছে কুরিয়ারের রেজিস্টার চেয়ে ওই চিঠির ঠিকানা খুঁজে বের করে। চিঠিটা দুই দিন আগে, লাভা থেকে রূপকের নামে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠি আততায়ী নিজেই পাঠিয়েছে, নিশ্চয় এইবারে রূপকের ওপরে হামলা করবে। খাটলিং, লাভা সব পাহাড়ি এলাকা খুঁজেছে আততায়ী। বেশ বুদ্ধি ধরে যাতে নির্জনে আততায়ী নিজের কাজ হাসিল করতে পারে। অফিসের কারুর সাথে দেবায়ন আর রূপকের একত্রে শত্রুতা হতে পারে না তবুও একবার সন্দেহ দুর করার জন্য মনীষাকে জিজ্ঞেস করা। সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা মনীষাকে ফোন করে জানতে চায় ওদের অফিসের কেউ কি লম্বা ছুটিতে গেছে? মনীষা উত্তর দেয়, কেউই লম্বা ছুটিতে যায়নি। আরো জানায় যেদিন দেবায়নের এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেদিন অফিসে সবাই এসেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা, আবার শ্রেয়াকে ফোন করে। বার কতক ফোন বেজে যাওয়ার পরে শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে কি হয়েছে?”

অনুপমা উদ্বেগজনিত কণ্ঠে ওকে বলে, “তোরা এখন কোথায়?”

শ্রেয়া বলে, “এই বহরমপুর পেরিয়েছি। কেন কি হয়েছে?”

অনুপমা উত্তর দেয়, “তোরা লাভা যাস নে। ওই চিঠি আততায়ী নিজে লিখেছে যাতে রূপককে মারতে পারে। তোরা ফিরে আয় এখুনি ফিরে আয়।”

শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে? না আমরা এর শেষ দেখে তবেই ফিরবো। যদি আততায়ী নিজেই দেখা করতে চেয়েছে তাহলে ওকে শেষ করেই ফিরবো। তুই চিন্তা করিস না অনু...”

অনুপমা কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে, “প্লিস শ্রেয়া, আমার কথা শোন। আমি জানি তোরা সবাই দেবায়নের জন্য চিন্তিত কিন্তু এই আততায়ী দেবায়ন আর রূপক, দুইজনের শত্রু। আততায়ী দুইজনকে মারতে চায় তাই তো আর কারুর নামে চিঠি পাঠায়নি শুধুমাত্র রূপকের নামে পাঠিয়েছে। প্লিস আমার কথা শোন তোরা ফিরে আয়।”

শ্রেয়া উত্তর দেয়, “ঠিক আছে আমরা ফিরে আসছি। কাল সকালে দেখা হবে।”

কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা বলে, “না তোরা আমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা কর। আমি আসছি আর দেরি করলে চলবে না, হাতেনাতে আততায়ীকে ধরতে হবে এইবারে।”

শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা অনুপমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা করে থাকবে। অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে পরাশরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ও বহরমপুরের জন্য যাত্রা করছে। পরাশর সঙ্গে যেতে চাইলে জানায় ওকে পথে উঠিয়ে নেবে। পরাশরকে উঠাতে গিয়ে ওর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেক্টর নিরঞ্জন বাবুর সঙ্গে দেখা হয়। নিরঞ্জন বাবু জানিয়ে দেন তিনি তার টিম নিয়ে ওদের পেছনে থাকবেন। অনুপমা আর পরাশর গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করে দেয়। ওদের অনেকদিনের ড্রাইভার, কমল এতদিনে বুঝে গেছে দেবায়নের কি হয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার তীর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়।
 
অনুপমা পরাশরকে বলে, “আমরা এতদিন ভুল পথে তদন্ত করছিলাম। আমাদের শেষের দিক থেকে তদন্ত না শুরু করে শুরুর দিক থেকে তদন্ত শুরু করা উচিত ছিল। আসল তদন্তের সব কিছু তোমার হাতের কাছে। দেখা যাক আমরা কি কি খুঁজে পেয়েছি।”

অনুপমা সিটের ওপরে প্লাস্টিকের ব্যাগ রেখে জঙ্গল থেকে আনা জিনিস পত্র গুলো এক এক করে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে দেয়। সিগারেট প্যাকেট দেখে পরাশরকে বলে, “আততায়ী বেশ বড়লোক না হলে ক্লাসিক রেগুলার খায় না।” কয়েকটা কাগজের টুকরো ঘেঁটে দেখে বলেন, “আততায়ী এই কোলকাতার লোক, এই দেখ।” বলে একটা খবরের কাগজের টুকরো পরাশরের হাতে ধরিয়ে কোনার দিকে দেখিয়ে বলে, “এটা স্টেটসমান কাগজ। গ্রামের লোকটা বলেছিল যে আততায়ী পাঞ্জাবী কিন্তু আততায়ী বাঙ্গালী আর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য পাঞ্জাবী সেজেছে। আততায়ী আমাদের ওই খাটলিং যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল। রূপকের ইমেলগুলো যদি চেক করা যায় তাহলে আই পি এড্রেস পাওয়া যাবে।” কুরিয়ারের চিঠিটা হাতে নিয়ে ভালো ভাবে দেখে বলে, “হুম, এই চিঠি লাভা থেকে পাঠানো হয়েছে। ওইখানে এই কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুব কম হবে নিশ্চয়। এই চিঠির ডকেট নাম্বার দেখালে অনায়াসে দুই দিন আগে কে এই চিঠি পাঠিয়েছে সেটা জানা যাবে। আততায়ীর একটা চেহারা পাওয়া যাবে। লাভা খুব ছোট জায়গা, আততায়ীকে দিনের আলোতে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ অসুবিধে হবে না।”

পরাশর অবাক হয়ে অনুপমার তারিফ করে বলে, “তুই একেবারে শারলক হোমস হয়ে গেছিস দেখছি।”

অনুপমা স্মিত হেসে মাথা দোলায়, “না রে অতদুর সাগর পাড়ে কেন যাচ্ছিস। আমাদের গড়পার ফেলুদা হতে একটু চেষ্টা করছি আর তুই আমার তোপসে।”

কমল হুহু করে গাড়ি চালিয়ে রাত বারোটার মধ্যে বহরমপুরে পৌঁছে যায়। ওদের দেখে রূপক আর শ্রেয়া ওদের থেমে যাওয়ার কারন জিজ্ঞেস করে। অনুপমা বিস্তারে সব কিছু খুলে বলার পরে ওরা সবাই আবার যাত্রা শুরু করে দেয়। কমল, রূপকের গাড়ি চালায় আর ওরা চারজনে অনুপমার গাড়ি করে লাভার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পেছনে নিরঞ্জন বাবু একটা গাড়িতে কয়েক জন সাদা পোশাকের পুলিস নিয়ে ওদের অনুসরন করেন। সবার মধ্যে টানটান চাপা উত্তেজনা কারুর চোখে মুখে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। রূপক চরম ক্ষোভে এক প্রকার গজগজ করতে করতে দ্রুত বেগে গাড়ি চালায়।

অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুই অত টাকা পেলি কোথা থেকে রে?”

শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, “সেটা নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছিস কেন। তোর জন্য সব কিছু দিতে রাজি।”

অনুপমার দুই চোখ ছলকে ওঠে, “একবার আমাকে জানাতে পারলি না?”

শ্রেয়া ওর গালে আলতো চাপড় মেরে বলে, “তুইও আমাদের দেবুর ব্যাপারে জানাস নি তাই না? তোর মাথার অবস্থা আমি বুঝি রে অনু। ছাড় সেই সব কথা এখন ওই আততায়ীকে ধরাটা আমাদের আসল উদ্দেশ্য।”

ভোরের দিকে জলপাইগুড়ি হয়ে ওদের গাড়ি লাভার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শিলিগুড়ি থেকে সেবক রোড ধরে। কমল জানায়, কালিম্পং হয়ে লাভা যাওয়ার চেয়ে গরুবাথান হয়ে লাভা পৌঁছাতে অনেক সহজ তাই ওরা মালবাগান টি এস্টেটের রাস্তা ধরে গরুবাথান হয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ লাভা পৌঁছে যায়। এই লাভাতেই ওদের জন্য আততায়ী অপেক্ষা করে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা চারপাশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগোতে থাকে। সাদা পোশাকে নিরঞ্জন বাবু ওদের সাথে থাকেন। আড়াল থেকে নিশ্চয় আততায়ী ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা কিছুই জানায় নি আততায়ী। তার অর্থ, আততায়ী নিশ্চয় এইবারে ওদের সাথে যোগাযোগ করে জানাবে কোথায় দেখা করতে চায়। কিন্তু ওদের দেরি দেখে নিশ্চয় আততায়ী সতর্ক হয়ে গেছে।

কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুঁজে পেতে ওদের বেশি দেরি লাগে না। চিঠি আর ডকেট নাম্বার দেখতেই কুরিয়ার নেওয়ার মেয়েটা খাতা দেখে জানায় যে তিন দিন আগে একজন এই চিঠিটা দুপুর বেলায় কুরিয়ার করেছে। নিরঞ্জন বাবু মেয়েটাকে বলেন এটা খুনের কেস এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ওই লোকটার বিষয়ে জানতে চান। মেয়েটা জানায় যে লোকটা কোন পাঞ্জাবী নয়, তিনি দাড়ি গোঁফ ওয়ালা একজন বাঙ্গালী মুসলমান, নাম মহম্মদ ইকবাল হোসেন। রেজিস্টার খুঁজে ইকবালের মোবাইল নাম্বার ওদের লিখে দেয়। নিরঞ্জন বাবু ওই মোবাইল নাম্বারে ফোন করে দেখেন মোবাইল নাম্বার ভুয়ো। তার অর্থ এই নাম এই বেশ ভুষা সব মেকি। মেয়েটা আরো জানায় যে আগন্তুকের বয়স পঞ্চাসের কাছাকাছি, মাঝারি গড়ন, ঘন ঘন সিগারেট খান। ওদের কুরিয়ার কোম্পানির সামনে একটা চায়ের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তারপরে এদিক ওদিক দেখে অনেক পরে ওদের দোকানে কুরিয়ার করতে ঢুকেছিল। মেয়েটার দেওয়া আগন্তুকের বিবরন অনুযায়ী একটা ছবি আঁকে রূপক। সেই ছবি দেখে মেয়েটা জানায় যে আগন্তুক অনেকটা এই ছবির মতন দেখতে। একটা ছবি যখন পাওয়া গেছে তাহলে এইখানে খুঁজে বের করতে বিশেষ অসুবিধে হবে না ওদের। ওই ছবিটার বেশ কয়েকটা জেরক্স করিয়ে নিয়ে নিরঞ্জন বাবু তার সাথে আসা সাদা পোশাকের অফিসারদের হাতে দিয়ে আশে পাশের হোটেল গুলোতে খোঁজ নিতে বলেন।

খুঁজতে খুঁজতে একটা হোটেলের লোকের কাছ থেকে জানতে পারে যে এই রকম দেখতে একজন দুই দিন আগে ওদের হোটেল ছিল। তবে সেই আগন্তুকের নাম মহম্মদ ইকবাল নয়, তার দাড়ি গোঁফ ছিল না, তিনি একজন বাঙ্গালী, নাম রাজেশ সেন। অনুপমা চমকে ওঠে, এই নাম ওর প্রয়াত জেঠুর নাম। কিন্তু জেঠু প্রায় কুড়ি বছর আগে মারা গেছেন।

নিরঞ্জন বাবু অনুপমাকে শান্ত করে বলেন, “অত চমকে যাওয়ার কিছু নেই অনুপমা। এটা নিতান্ত কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। এখন পর্যন্ত যা যা নামধাম পাওয়া গেছে তার সবটাই ভুয়ো, সুতরাং এই হোটেলে যে ঠিকানা অথবা নাম আগন্তুক লিখিয়ে গেছে সেটাও ভুয়ো হবে। তবে লাভা বেশি বড় জায়গা নয় আততায়ীকে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না।”

হোটেলের লোকের কাছ থেকে আগন্তুকের ছবি চায় নিরঞ্জন বাবু। ছবি দেখে চমকে যাওয়ার পালা এইবারে নিরঞ্জন বাবুর। ছবি হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পড়ে তিনি অবাক হয়ে বলেন, “এই লোক?” এই বলে তিনি অনুপমার হাতে ছবি ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “চিনতে পারছো একে?”

অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না, এই ব্যাক্তিকে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”

নিরঞ্জন বাবু স্মিত হেসে বলেন, “হুম, তোমার না চেনার কথা তবে রূপক আশা করি চিনতে পারবে।” বলে রূপকের হাতে ছবি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কি রূপক চিনতে পারছো?”

রূপক মাথা নাড়ায়, “ঠিক মনে পড়ছে না।”

নিরঞ্জন বাবু বলেন, “ভুলে গেলে একে? তোমাকে আর দেবায়নকে খুন করার এনার কাছে সব থেকে বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। তোমাকে এই আগন্তুক রাস্তায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল এই লাভাতে নয়। তাই ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা লেখা নেই। তোমাকে সকালে এই জায়গায় আসতে বলার একটা মাত্র কারন কেননা সকালের দিকে রাস্তায় কুয়াশা হয়, পাহাড়ি রাস্তায় কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানো দুঃসাধ্য। তোমার গাড়িকে খাদে ফেলে দুর্ঘটনার রূপ দিয়ে দিতো আততায়ী, তুমি জানতে পারতে না কে তোমাকে মারল। আমি হলফ করে বলতে পারি আততায়ী আমাদের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল। সাধারণত সব মানুষ কালিম্পং হয়ে লাভা আসে। যেহেতু আমরা গরুবাথান হয়ে লাভা এসেছি সেই জন্য আততায়ী আর সুযোগ পায়নি আক্রমন করার। চলো এইবারে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। আততায়ী ট্রেনে করে ফিরবে বলে মনে হয় না, নিশ্চয় প্লেন ধরবে। বাগডোগরা গিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলেই বোঝা যাবে।”

রূপক বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলে, “আচ্ছা এইবারে চিনেছি কে। শালা এইবারে আর আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।”

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “কে এই লোক?”

রূপক উত্তর দেয়, “অগ্নিহোত্রীর বাবা, সমীর বাবু।”
 
অনুপমার মনে পড়ে যায় পায়েলের অপহরনের ঘটনা। পায়েলের পিসির ছেলে, বিনয় আর তার বন্ধু অগ্নিহোত্রী পায়েলকে অপহরন করে নৈহাটি নিয়ে গিয়েছিল। রূপক দেবায়ন দলবল নিয়ে গিয়ে পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছিল, কিন্তু অগ্নিহত্রীর বাবা কেন ওদের মারতে চায় সেটা ঠিক বুঝতে পারে না তাই জিজ্ঞেস করে, “সমীর বাবু কেন তোদের মারতে চায়?”

রূপক উত্তর দেয়, “আসলে সেদিন অগ্নিহোত্রী আর বিনয় পালায়নি। দেবায়ন সেইদিন ওদের খুন করে দিতো। কিন্তু আমরা সবাই বাধা দিয়েছিলাম তাই আর দেবায়ন খুন করেনি। কিন্তু অগ্নিহোত্রী বেঁচে যাবে সেই দেখে আমার আর দেবায়নের খুব দুঃখ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটা নকল পলাতকের ঘটনা তৈরি করা হয় আর ফাঁকা মাঠে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওরা যখন পালাতে যায় তখন নিরঞ্জন বাবু ওদের পলাতক ঘোষণা করে গুলি করেন। যাকে পুলিসের ভাষায় এনকাউন্টার বলে।”

অনুপমার কাছে এইবারে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। নিরঞ্জন বাবু বলেন, “এইবারে সমীর বাবুকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এখন পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধে অকাঠ্য প্রমান পাওয়া যায়নি। আর সমীর বাবু সেই ছেলেটাকেও খুন করেছে সুতরাং এই কেস উত্তরাখন্ড পুলিসের কাছেও যাবে। আমি একবার রোহনকে ফোন করে দিচ্ছি আর সেই সাথে বাগডোগরা গিয়ে ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলে সব পরিস্কার হয়ে যাবে।”

রূপক জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কি করে ধরবো?”

অনুপমা খানিক চিন্তা করে বলে, “এইবারে আমাদের চাল চালতে হবে, ফাঁদ আমাদের পাততে হবে। তোর কাছে যে ইমেলগুলো এসেছিল সেই ইমেলগুলোর সেন্ডার আই পি এড্রেস দেখ। মনে হয় ওই আই পি এড্রেস থেকে সারভিস প্রোভাইডারের খবর পাওয়া যাবে, সেই থেকে অনায়াসে আমরা ওই আই পি এড্রেসের লোকেসান বের করে নিতে পারবো। এর পরে তুই ওই ইমেলে একটা উত্তর দে, যে কোন এক দুর্ঘটনা জনিত কারনে তোদের খাটলিং ভ্রমন সুখকর হয়নি। সমীর বাবু তাহলে ধরতে পারবেন না যে আমরা তাকে সন্দেহ করেছি। তুই ধন্যবাদ জানিয়ে লেখ যে তুই ওর সাথে দেখা করতে চাস। আমি হলফ করে বলতে পারি একা একা দেখা করার কথা শুনে এই ফাঁদে সমীর বাবু পা দেবেন আর তিনি তোকে মারার জন্য তৈরি হয়েই আসবেন।”

শ্রেয়া আঁতকে ওঠে, “না ও একা যাবে না আমিও যাবো।”

নিরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, “ও অথবা তুমি কেউই একা যাবে না। আমি নৈহাটি থানায় ফোন করে বলে দিচ্ছি সমীর বাবুর ওপরে নজর রাখার জন্য। যদি সমীর বাবু ফাঁদে পা দেয় তাহলে আমরা সবাই ওর পিছু নেব। হাতেনাতে ধরতে পারলে ওর বিরুদ্ধে আর বেশি প্রমানের দরকার নেই। একবার আমার হাতে পড়ুক তারপরে ওর মুখ থেকে কি করে কবুল করাতে হয় সেই উপায় আমাদের বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে।”

নিরঞ্জন বাবু নৈহাটি থানায় ফোন করে সমীর বাবুর বাড়ির ওপরে নজর রাখতে বলে দেয়। সেই সাথে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ফোন করে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফ্লাইটের লিস্ট জানতে চান। তিনি জানান সকালের ফ্লাইট সব চলে গেছে এরপরের ফ্লাইট বিকেল পাঁচটায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের বলেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লে এয়ারপোর্ট পৌঁছানো যাবে, কিন্তু প্রমান ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। সুতরাং ওদের শুধুমাত্র অনুসরন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। লাভা থেকে গাড়ি নিয়ে সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বাগডোগরাতে নিরঞ্জন বাবু একজন অফিসারকে নামিয়ে দিয়ে ফ্লাইটে করে সমীর বাবুকে অনুসরন করতে বলে দেন। তারপরে ওরা সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। পথে যেতে যেতে ল্যাপটপ খুলে রূপক ওর ইমেল দেখতে বসে যায়। ইমেল থেকে সেন্ডার আই পি এড্রেস বের করে ট্রেস করে ইন্টারনেট সারভিস প্রোভাইডারের নাম বের করে ফেলে। নিরঞ্জন বাবু সেই সারভিস প্রোভাইডারকে ফোন করে নিজের পরিচয় আর খুনের তদন্ত করছেন জানিয়ে আই পি এড্রেসের ঠিকানা জানতে চায়। সারভিস প্রোভাইডার জানায়, এই আই পি এড্রেস ডাটা কার্ডের, ওদের ডেটাবেস খুঁজে সমীর বাবুর নাম ঠিকানা পেয়ে নিরঞ্জন বাবুকে জানায়। রূপক সাথে সাথে একটা ইমেল করে দেয় যে এক দুর্ঘটনার জন্য ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু সুন্দর একটা জায়গার খবর দিয়েছে বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। সেই সাথে আরো লেখে যে রূপক এই আগন্তুকের সাথে দেখা করতে চায়। ওইদিকে যে অফিসার বাগডোগরা এয়ারপোর্টে থেকে গিয়েছিল সে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওদের ধারনা অনুযায়ী সমীর বাবু ফ্লাইটে করেই কোলকাতা ফিরছে। ওদের কোলকাতা ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে, তাই সেই অফিসারকে ফ্লাইটে করেই সমীর বাবুকে অনুসরন করে কোলকাতা ফিরতে নির্দেশ দেয়।

কোলকাতা ফিরতে ওদের মধ্যরাত হয়ে যায়। অনুপমাকে একা বাড়িতে ফিরতে দেয় না শ্রেয়া। ওকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়। ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে মামনিকে, মাকে, বাকি সবাইকে জানিয়ে দেয় যে আততায়ীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই শুনে সবাই বেশ খুশি কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার উন্নতির খবর নেই শুনেই অনুপমা মুষড়ে পড়ে। রূপক, শ্রেয়া আর অনুপমাকে ব্যাঙ্গালোর দেবায়নের কাছে চলে যেতে অনুরোধ করে। এবারে যখন আততায়ীর আসল পরিচয় জানা গেছে আর নিরঞ্জন বাবু সাথে আছেন তাহলে সমীর বাবুকে ধরতে ওদের কোন অসুবিধে হবে না। শ্রেয়ার সাথে থাকলেও ওর মন পড়ে থাকে দেবায়নের কাছে।
 
রাতের বেলা চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা। একা বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে বুকের অশ্রু ঝরায়। কি পাপ করেছে দেবায়ন যে ওকে এই মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হলো? দেবায়ন কখন দোষ করেনি, বরং সবার ভালোই চেয়ে এসেছে। ওদের পরিবারের মধ্যে, বাবা মায়ের মধ্যে, ওর আর মায়ের মধ্যে যে কঠিন দেয়াল এতদিনে গড়ে উঠেছিল সেটা ভেঙে দিয়েছে। ওর সব থেকে ভালো বান্ধবী পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছে। একটা হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে চাগিয়ে তুলেছে। ওর এক ভাই আছে সেটা জানতো না, তাকেও খুঁজে বের করেছে আর অতি সুকৌশলে ওর সাথে নিবেদিতার বন্ধুত্ব করিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে ওদের মাঝে কোন দ্বন্দ না হয়। তাহলে কোন পাপের শাস্তি পেয়েছে ওর পুচ্চু।

সকাল বেলায় শ্রেয়া আর নিজের জন্য ব্যাঙ্গালোরের টিকিট কাটে। খাবার টেবিলে শ্রেয়ার বাড়ির লোকের সাথে দেখা হয়। সবাই দুঃখ ব্যাক্ত করে। শ্রেয়া সবাইকে জানিয়ে দেয় কেউ যেন কোন দুঃখ না প্রকাশ করে, দেবায়ন ভালো আছে, দেবায়ন ভালো হয়ে আবার অনুপমার কাছে ফিরে আসবে।
অনুপমা আর শ্রেয়া দুপুরের পরে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। রূপক ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিল।

গাড়িতে যাওয়ার সময়ে অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, ওই পঞ্চাশ লাখ টাকা কোথা থেকে যোগাড় করলি বললি না তো?”

শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, “তোর জেনে কি দরকার।” অনুপমার জোরাজুরির পরে শ্রেয়া উত্তর দেয়, “রূপক আর আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আততায়ীর খবর জানার জন্য কিন্তু আমাদের হাতে অত টাকা নেই। ফোন করলাম সব বন্ধু বান্ধবীদের, যার যতটা ক্ষমতা সে ততটা দিল, ধীমান, প্রবালের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা, সঙ্গীতা আর তনিমা এক লাখ করে দিল। আমার কাছে তিন সাড়ে তিনের মতন ছিল কিন্তু তাতেও কুলায় না।” কথা গুলো শুনতে শুনতে অনুপমার চোখে জল চলে আসে। ওর পাশে সত্যি অনেকে দাঁড়িয়ে কিন্তু এতো ভিড়েও যে অনুপমা একা, বড় একা। দেবায়ন পাশে না থাকলে এই ভিড় এই বন্ধু বান্ধবী এই সুখ দিয়ে কি করবে? শ্রেয়া তারপরে বলে, “রূপকের কাছে পাঁচ লাখ টাকা ছিল কিন্তু সব মিলিয়ে পঞ্চাসের কাছাকাছিও যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রূপক একজনের কাছে হাত পাতে। সেই অবশ্য আমাদের সবার টাকা ফেরত দিয়ে নিজেই পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাদের দেয়।”

অনুপমা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে, “কে দিয়েছে?”

রূপক স্মিত হেসে বলে, “না রে নাম বলা বারন, তাই বলতে পারছি না। তবে ওই নিয়ে চিন্তা করিস না, তুই নিশ্চিন্ত মনে ব্যাঙ্গালোর যা আর দেবায়নকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। এইবারে তোদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোদের চোখে চোখে রাখবো, যেমন ভাবে বেহুলা লখিন্দরকে আটকে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই মতন এক বাড়ি বানিয়ে তোদের রেখে দেবো।”

অনুপমার চোখ জোড়া ছলকে ওঠে, শ্রেয়া ওকে প্রবোধ দিয়ে বলে, “প্লিস সোনা কাঁদিস না আর, আমার মন বলছে দেবু এইবারে ঠিক উঠে দাঁড়াবে।”

অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, “এইবারে না ওঠা পর্যন্ত আর আমি ওর পাশ ছাড়বো না।”

ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দিলিপ বাবু ওদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিল, এয়ারপোর্টে অঙ্কন ওদের নিতে এসেছিল। অঙ্কনের মুখে জানতে পারে যে দেবায়নের অবস্থা এখনো আগের মতন, নাকে অক্সিজেনের নল, ওষুধপত্র সব কিছু আই ভি করে দেওয়া হচ্ছে, শ্বাসের গতি অতি ধীরে। পারমিতাকে কাছে পেয়ে দেবশ্রী একটু সুস্থ হয়েছেন না হলে এই কয়দিনে ছেলের এই অবস্থায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলেন। দিলিপ বাবুর বাড়ি আর বাড়ি নেই, ছোট খাটো নারসিং হোম হয়ে গেছে, সকাল বিকেল ডাক্তারদের আনাগোনা, সর্বদার জন্য তিনটে নার্স মোতায়ন করা।

বাড়িতে ঢুকে ওকে দেখে সবাই শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা সোজা দেবায়নের ঘরে ঢুকে পড়ে। বিছানায় শায়িত নিস্তেজ একটা শরীর, কোন সাড়া শব্দ নেই, নড়ন চড়ন নেই, দুই চোখ বোজা, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। দিলিপ বাবু জানালেন, কোমা থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত ডাক্তারেরা অপারেশান করতে পারছে না। সবাই বড় চিন্তায়, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না কি ভাবে দেবায়নের জ্ঞান ফিরিয়ে আনবে। প্রেমিকার চেয়ে বেশি এক মায়ের হৃদয় তার একমাত্র ছেলের জন্য বেশি ভেঙে পড়েছে। তাও দেবশ্রী মন শক্ত করে অনুপমাকে শক্তির জোগান দেয়।

দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, “এইবারে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। এইখানে দিলিপ বাবুর কাছে কত দিন রাখা যায় বল।”

অনুপমা মাথা দোলায়, হ্যাঁ এইবারে দেবায়নকে কোলকাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা দরকার। সেই খবর শুনে দিলিপ বাবু জানিয়ে দিলেন যে ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তারদের যখন শুরু থেকে দেখানো হচ্ছে তখন দেবায়ন ঠিক না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার বাড়িতে রেখে দেওয়া হোক। সোমেশ বাবু বলেন, যে দেবায়ন কবে এই কোমা থেকে চোখ খুলবে... কথাটা বলে ফেলে বুঝতে পারলেন যে বড় ভুল করছেন। দেবশ্রী ছলছল চোখে ছেলের বিছানার এক পাশে বসে অন্যপাশে অনুপমা দেবায়নের নিস্তেজ হিমশীতল হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে বসে। দিলিপ বাবু জানিয়ে দেন, যতদিন না দেবায়ন চোখ খুলবে ততদিন তার সেই সামর্থ আছে যে অনুপমা, দেবশ্রী, দেবায়ন আর ওর চিকিৎসা সব করাতে পারবেন। দিলিপ বাবু আর কণিকা দেবী কিছুতেই ওদের যেতে দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সবাই হাল ছেড়ে দেয়।

দেবশ্রী বাদে বাকি সবার জন্য হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। হোটেল অবশ্য বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় তাই সকালে উঠেই সবাই বাড়িতে চলে আসে। সারা রাত অনুপমা দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাতের ডিউটির জন্য যে নার্সকে রাখা হয়েছিল সে বসার ঘরে বসে একটা গল্পের বই পড়ছিল।

অনুপমা, দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে আলতো করে নিস্তেজ হাতের মধ্যে হাতে বুলাতে বুলাতে কাতর কণ্ঠে কেঁদে ওঠে, “পুচ্চু, তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না...” বারেবারে বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত বিছানায় উঠে ওর বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে, “পুচ্চু প্লিস সোনা একবার চোখ খোল...” বুকের ওপরে কান চেপে অতি ধীরে চলা হৃদপিণ্ডের ধ্বনি একমনে শোনে, হুপ হুপ হুপ হুপ ... ভয় হয় যদি এই শব্দ থেমে যায়।

কতক্ষণ ওইভাবে দেবায়নের বুকের ওপরে মাথা গুঁজে একমনে ওর হৃদয়ের ডাক শুনছিল সঠিক মনে নেই অনুপমার। তবে হটাত দেবায়নের হৃদয়ের ধ্বনি বেড়ে যাওয়াতে ওর সম্বিত ফেরে, সেই সাথে একটা যান্ত্রিক টি টি আওয়াজে বেজে চলে। হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ বেড়ে উঠতেই অনুপমা সতর্ক হয়ে দেবায়নের বুক থেকে উঠে ওর মুখের দিকে তাকায়। বন্ধ চোখের পাতা ঝরা পাতার মতন ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে। হিমশীতল শরীরে উত্তাপের সঞ্চার হয়।

অনুপমা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে, “কাবেরি!” নার্সের নাম কাবেরি।

ওর ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে নার্স, দেবশ্রী দিলিপ বাবু কণিকা দেবী সবাই দৌড়ে আসে। কাবেরি, সঙ্গে সঙ্গে দেবায়নকে পরীক্ষা করে, দেবায়নের হাত একটু একটু করে নড়ে ওঠে, চোখের পাতা নড়ে ওঠে। অনুপমার চোখ জোড়া ভরে আসে জলে। অবশেষে ওর হৃদয় ডানা মেলেছে। নার্সের চেহারায় উদ্বিগ্ন ভরা। দেবায়ন বহু কষ্টে চোখ খুলে সবার দিকে তাকায়। দেবশ্রী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। দেবায়ন আলতো মাথা দুলিয়ে মাকে কাছে ডাকে। দেবশ্রী দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।

বহু কষ্টে দেবায়ন মায়ের কানে কানে বলে, “মা,” ছেলের মুখে অনেক দিন পরে “মা” ডাক শুনে দেবশ্রী কেঁদে ফেলে, “হ্যাঁ বাবা বল, এই তো আমি।”
দেবায়ন অতি কষ্টে ফিসফিস করে মায়ের কানে বলে, “বাবা চকোলেট দিতে চেয়েছিল মা কিন্তু তোমাকে একা ফেলে যেতে পারলাম না মা।” ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে দেবশ্রী।

সবার চোখে জল চলে আসে। অনুপমা ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে, “পুচ্চু...”

নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হয় দেবায়নের তাও বহু কষ্টে অনুপমার কানেকানে বলে, “তুই...”

অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, “আর তোকে ছেড়ে যাবো না কোথাও।”
 
কাবেরি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের ফোন করে দেয়। সেই রাতেই ডাক্তারেরা দিলিপ বাবুর বাড়িতে ওকে দেখতে চলে আসে। দিলিপ বাবু সোমেশ, পারমিতাকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের জ্ঞান ফিরে এসেছে। রাতের মধ্যে দিলিপ বাবুর বাড়িতে লোক জনের সমাগম বসে যায়, খুশির ছোঁয়া লাগে সবার বুকে। অবশেষে দেবায়ন আবার ওদের মাঝে ফিরে এসেছে। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে জানায়, এইবারে অপারেশান করা যেতে পারে। দেবায়নের ডান পায়ের হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হাড়ের বদলে স্টিল রড অথবা টাইটেনিয়াম রড বসাতে হবে, না হলে দেবায়ন আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। সেই শুনে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। টাইটেনিয়াম রড বসাতে অনেক খরচ পড়ে যাবে বলে ডাক্তারেরা জানায়। টাকার ব্যাপারে সেই সময়ে কারুর মাথা ব্যাথা ছিল না। দিলিপ বাবু, সোমেশ বাবু সমস্বরে জানিয়ে দেয় টাকার চেয়ে দেবায়নের উঠে দাঁড়ানো ওদের কাছে বেশি জরুরি। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পরে দেবশ্রী জানায় হাড়ের বদলে টাইটেনিয়াম রড বসানোর জন্য। দিন দুয়েক পরে দেবায়নের পায়ের অপারেশান করা হয়। তারপরে ওর শরীরে বেশ কয়েক জায়গায় অপারেশান করা হয়, শিরদাঁড়ার, হাতের। এই অপারেশান করতে করতে আরও বেশ কয়েকদিনে লেগে যায়। ডাক্তারেরা জানায়, দেবায়নের উঠে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। কোলকাতা ফিরে যেন এক ফিজিওথেরাপিস্ট নিযুক্ত করে যাতে দেবায়ন আবার চলাফেরা করতে পারে। দেবায়ন চোখ খোলার পরের দিন শ্রেয়া কোলকাতায় খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়।

সোমেশ বাবুর অফিস আর অঙ্কনের কলেজের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটার জন্য অনুপমা ওদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে দেয়। সোমেশ বাবু, অঙ্কন আর পায়েলকে নিয়ে কোলকাতা ফিরে আসে।

বেশ কয়েকদিন পরে রূপক ব্যাঙ্গালোর চলে আসে। ততদিনে দেবায়ন বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু তাও শয্যাশায়ী। দেবায়ন অনুপমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, “আমাকে কে ঠেলে দিয়েছিল রে, জানিস?”

অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, আততায়ী এতদিনে ধরা পড়েছে। অগ্নিহোত্রীর বাবা সমীর বাবু।”

রূপক উত্তরে জানায়, আততায়ী শেষ পর্যন্ত ওদের জালে ধরা দেয়। রূপক ইমেল করে উত্তরে জানিয়েছিল যে কোন এক কারনে ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু ওই জায়গার সম্বন্ধে আগন্তুক ওদের খবর দিয়েছিল বলে রূপক ওর সাথে দেখা করে ধন্যবাদ জানাতে চায়। সমীর বাবু ভাবতে পারেনি যে রূপক ওকে চিনে ফেলবে তাই রূপকের ইমেলের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে দেখা করবেন। সেই সাথে তিনি জানান যে তিনি বাঙ্গালী নন, উত্তর ভারতের লোক তাই মুসৌরির কাছে ধনোল্টি নামক এক জায়গায় দেখা করার কথা ব্যক্ত করেন। রূপক, পরাশর, নিরঞ্জন বাবু, ঘন সিয়ালির ইনস্পেকটর রোহন সবাই তক্কেতক্কে ছিল। ওদের পরিকল্পনা মাফিক আগে থেকে নিরঞ্জন বাবু আর রোহন ধনোল্টি পৌঁছে যায় আর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। রূপক একাই ধনোল্টি যায় সমীর বাবুর সাথে দেখা করতে। সমীর বাবু গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে পাঞ্জাবী সেজে ওর সাথে দেখা করতে আসে। সেইখানে রূপককে দেখে সমীর বাবু ছুরি বের করে রূপককে আক্রমন করতে যায় আর সেই সময়ে রোহন আর নিরঞ্জন বাবু ওকে ধরে ফেলে। ধরা পড়ে যাওয়াতে সমীর বাবু মুষড়ে পড়ে। ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া আর হলো না। নিরঞ্জন বাবু বলেন, সমীর বাবুর ছেলে নিজের দোষে নিজের পাপে প্রান হারিয়েছে। অগ্নিহোত্রী পাপী, অগ্নিহোত্রী দোষী, দেবায়ন আর রূপক নয়।

ধরা পড়ার পরে সমীর বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সমীর বাবু জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই সমীর বাবু ফাঁক খুঁজছিলেন কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই এক বিশাল ষড়যন্ত্রের রচনা করেন। নির্জন স্থান খোঁজার জন্য এক বছর ধরে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দেন। তারপরে কম্পিউটার, ইন্টারনেট শেখেন যাতে রূপক অথবা দেবায়নের সাথে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ইমেল করতে পারে। এই ট্রেকিং বিষয়ের বেশ কয়েকটা ইমেল দেবায়নকে প্রথমে পাঠিয়েছিলেন সমীর বাবু, কিন্তু দেবায়ন তার কোন উত্তর দেয়নি দেখে পরে রূপকের কাছে পাঠায়। রূপক তার জালে ফেঁসে যায় আর উত্তরে জানায় ট্রেকিংয়ে যেতে রাজি। ইমেলের মাধ্যমে রূপকের সাথে প্রথমে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে সমীর বাবুর, শেষ পর্যন্ত একটা ট্রেকিংয়ের সাইটের খবর দেয় সমীর বাবু। আগে থেকে সমীর বাবু সেই ওয়েব সাইটে লগিন করে একটা ভুয়ো নামের একাউন্ট বানিয়ে রেখেছিলেন। রূপকের সাথে সেই ভুয়ো নামের একাউন্ট থেকে চ্যাটিং করেন আর এই ভাবে জানতে পারেন যে রূপক ঠিক কোথায় ট্রেকিংয়ে যাবে। সমীর বাবু ওদের ওপরে নজর রেখেছিল, আর আগে থেকেই একা একাই ঘুট্টু পৌঁছে গিয়েছিল। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য তিনি জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

নিউ তেহেরিতে, কুমার নামের পাহাড়ি ছেলেটার সাথে আলাপ হয়। তিনি কুমারকে সঙ্গে নিয়ে বলেছিলেন যে খাটলিং যেতে চায়। কুমারকে আসল উদ্দেশ্য জানায়নি সমীর বাবু, দেবায়ন আর রূপকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন যে এদের একজনকে ডেকে আনতে আর ডেকে আনার পরে যেন পালিয়ে যায়। কুমার ওদের তাঁবুর কাছে গিয়ে দেবায়নকে ডাকে। সমীর বাবু ভেবেছিলেন, যেহেতু রূপক আর দেবায়ন ভালো বন্ধু সুতরাং দুইজনে একসাথেই আসবে। সমীর বাবু চেয়েছিলেন দুইজনকে একসাথে সেদিন রাতে খুন করবেন কিন্তু দেবায়ন একাই কুমারের সাথে আসে। তাই ওকেই প্রথমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। খুন করার আগে সব কিছু খুলে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই দেবায়ন ওই খাদের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারপরে সমীর বাবু জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। কোলকাতা ফিরে খবরের কাগজে দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।

এরপরে তক্কে থাকেন কি ভাবে রূপকের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত একদিন রূপককে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে তিনি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানেন। রূপক সেই ফাঁদে পা দেবে সেটা নিশ্চিত ছিলেন। সমীর বাবু চেয়েছিলেন রাস্তার মধ্যেই রূপকের গাড়ির এক্সিডেন্ট ঘটাতে। সাধারনত লাভা যেতে সবাই কালিম্পং হয়েই যায় আর ভোরের দিকে রাস্তায় কুয়াশা থাকে। কিন্তু রূপক কালিম্পং হয়ে লাভা যায়নি দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি কোলকাতা ফিরে এসে আবার সুযোগের অপেক্ষা করেন। তারপরে রূপক ইমেল করে জানায় সে দেখা করতে চায়। ইমেল পড়ে সমীর বাবুর প্রত্যয় হয় যে রূপক এখন আসল আততায়ীকে চিনতে পারেনি। তাই তিনি নিজের পরিচয় একজন পাঞ্জাবী হিসাবে দিয়ে নির্জন ধনোল্টিতে দেখা করার কথা জানায়। তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি যে ওরা আগে থেকেই ওর পরিচয় জেনে ফেলেছে। কুমারকে হত্যা করার দায়ে আর দেবায়নকে খুন করার দায়ে রোহন সমীর বাবুকে গ্রেফতার করে। এই কেস উত্তরাখন্ডে ঘটেছে তাই উত্তরাখণ্ডের আদালতে এই মামলা চলবে।

পঞ্চাশ লাখ টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, রূপক কিছুতেই জানাতে নারাজ কোথা থেকে ওই টাকা যোগাড় করেছে। অনুপমার দৃঢ় প্রত্যয়, এক কথায় পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দেবে এমন মানুষ শুধুমাত্র দুইজন আছে, এক ওর বাবা, কিন্তু বাবা দিলে ওর মা ওকে জানিয়ে দিতো, আর দ্বিতীয় নিবেদিতা। কিন্তু অনুপমা যেটা বুঝে উঠতে পারে না, রূপক কেন নিবেদিতার কাছে গেল।

অনুপমা শেষ পর্যন্ত রূপককে বলে, “আম জানি কে তোকে টাকা দিয়েছে।” রূপক জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা উত্তর দেয়, “নিবেদিতা তোকে টাকা দিয়েছে, তাই না। কিন্তু নিবেদিতাকে তুই কোথায় পেলি?”

শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আমাদের আর কিছু মাথায় আসছিল না, কোথায় যাবো কি করবো কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নিবেদিতার কথা মনে পড়ে গেল। তুই এনুয়াল মিটে সবার সামনে জানালি যে নিবেদিতা তোর ভালো বন্ধু। তাই ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দিলেন আর সেই সাথে আমরা যারা যারা টাকা দিয়েছিলাম তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হলো।”

সব কিছু বলার পরে শায়িত দেবায়নকে দেখে রূপক ওকে বলে, “শালা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়া, বিয়ে করতে হবে না?”

দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুপমা স্মিত হেসে বলে, “আর ওকে চোখের আড়াল করছি না।”

-----সমাপ্ত-----
 
অসীম তৃষ্ণা


পর্ব এক

আকাশটা দুপুরের পর থেকেই গুমরে রয়েছে। এই বৃষ্টি মাথায় করে নিয়ে বের হতে হবে ভেবেই গা জ্বলে যায়। একে বৃষ্টি হলে রাস্তা ঘাটের ঠিক থাকে না, তার ওপরে আবার বাস ট্যাক্সি ঠিক মতন পাওয়া যায় না এই তিলোত্তমা কল্লোলিনীর বুকে। বাসে লোকের ভিড় আর ট্যাক্সিগুলো উলটো পাল্টা ভাড়া চেয়ে বসে। তবে বর্ষা রানীর মাদকতা আলাদা। ভীষণ গ্রীষ্মের পরে আষাঢ় গগনের ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ, পোড়া মাটির ওপরে জলের ছোঁয়ায় সোঁদা মাটির গন্ধ। মাঠের নতুন ধানের চারা, ঘাস নতুন ডগা গজানো, পেছনের গাছগুলোতে সবুজ পাতায় ভরে যাওয়া, চড়াই, পায়রা, কাক, সবাই একত্রে সামনের বাড়ির কার্নিশে বসে গা ঝাড়া দেয়, সেইগুলো একমনে দেখা আর বুকের মাঝে এবং মানসচক্ষে আঁকা এক ভীষণ সুন্দরীকে।

কুড়িখানা বর্ষা এই পৃথিবীর বুকে কাটিয়ে এই মহানগরের দক্ষিণে এক বহুতল বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল আদি, আদিত্য সান্যাল। এই বহুতল ফ্লাট বাড়ির চারতলায় চার ঘরের বেশ বড়সড় ফ্লাটে মা আর ছেলের বাসস্থান। বাবা ফটোগ্রাফি করে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়িয়ে বেশ ভালো টাকা অর্জন করেছিলেন। দুই হাজার স্কোয়ার ফুটের চারখানা শোয়ার ঘর আর একটা বিশাল লবি। একটা মায়ের শোয়ার ঘর আর অন্যটা আদির। একটাতে মায়ের নাচের ক্লাস হয় আর একটা গেস্টরুম যেটা বেশির ভাগ সময়ে খালি পড়ে থাকে।

এই মহানগরের নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেকানিকালের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আদি, আদিত্য সান্যাল। মেধাবী ছাত্র বলে একটু বদনাম আছে। বাবার মতন লম্বা চওড়া দেহের গঠন পেয়েছে। গায়ের রঙ তামাটে তবে মা বলে একদম মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিড। মায়ের চাপে পড়েই এক প্রকার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছে। ইচ্ছে ছিল বাবার মতন নামকরা ফটোগ্রাফার হবে। সুন্দরী মেয়েদের ছবি তুলবে, কেউ শাড়ি পরে, কেউ চাপা জিন্স আর চাপা টি-শার্ট পরে, কোন মেয়ে শুধুমাত্র বিকিনি পরিহিত, কেউ হয়তো ব্রা পরেনি, চুলগুলো সামনে এনে উন্নত কচি নিটোল স্তন জোড়া ঢেকে রেখেছে। বাবা ফ্যাশান ফটোগ্রাফির সাথে সাথে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফিও করে অনেক টাকা কামিয়েছেন।

ক্লাস এইটে পড়তো আদিত্য, যখন বাবা আর মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। তার কারন কলেজে পড়ার সময়ে জেনেছে আদি। ফ্যশান ফটোগ্রাফি করতে করতে বাবা বেশ কয়েকজন মডেলের সাথে এফেয়ারে জড়িয়ে পড়ে। তারপরে কি হয়েছিল সেটা অবশ্য আদির জানা নেই। তবে ছুটিতে কোন কোন সময়ে বাবার সাথে মুম্বাইয়ে কাটায় আর বাকি সময় মায়ের সাথে কোলকাতায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর থেকে এই শহরে মায়ের সাথেই থাকে তবে মাঝে মাঝে গরমের অথবা পুজোর ছুটিতে মুম্বাই যায়। বর্তমানে বাবা এক সুন্দরী অবাঙ্গালী কচি মডেল আয়েশার সাথে লিভ-ইন সম্পর্কে থাকে। সে নিয়ে মায়ের দ্বিরুক্তি নেই, মা সেই বিষয়ে কোন উচ্যবাচ্য করেন না। বাবা আলাদা নিজের মতন থাকেন মুম্বাইয়ে আর মা ছেলে নিজের মতন এই শহরে।

কলেজে আদির বদনাম একটু এদিক ওদিকে দেখা, মানে মেয়েদের প্রতি একটু বেশি নজর দেওয়া। ওর নজর কচি সহপাঠিনী থেকে একটু পাকা বয়সের মেয়েদের প্রতি বেশি। ছোট বেলা থেকে এক পাহাড়ি স্কুলে পড়াশুনা করে কাটিয়েছে। সম্পূর্ণ ছেলেদের স্কুল, মেয়েদের দেখা পায়নি কিন্তু নারীদের প্রতি আকর্ষণ ছোটবেলা থেকে বুকের মধ্যে ছিল। বিশেষ করে পাকা বয়স্ক মহিলাদের ওপরে। ছোটবেলা থেকে স্কুলে মেয়েদের দেখা না পেলেও চুরি করে ডেবোনেয়ার, ফ্যান্টাসি, চ্যাসটিটি, প্লেবয় এই সব বই পড়েছে এবং দেখেছে। বইয়ের তাকে এখন প্রচুর প্লেবয় লুকানো, ল্যাপটপে প্রচুর পর্নোগ্রাফি সিনেমা ভর্তি যা এখনকার ছেলেদের সব থেকে বেশি জরুরি। সুপ্ত কামনা বয়স্ক মহিলাদের সাথে কম বয়সী ছেলেদের যৌন সঙ্গমের ছবি দেখে আত্মরতি করা।

সিগারেটের সাথে আদি হারিয়ে গিয়েছিল একটা বিশেষ দিনে। সুন্দরী লাস্যময়ী সহপাঠিনী বান্ধবী, একদা প্রেমিকা তনিমা ঘোষ। সত্যি কি তনিমার কথা ভাবছিল, না অন্য কারুর কথা ভাবছিল? তনিমা যথেষ্ট লাস্যময়ী সুন্দরী, কেমিক্যালের ছাত্রী। বেশ সুন্দরী তনিমা, হাসলে আরো বেশি মিষ্টি দেখায়। জোড়া ভুরু, টিকালো নাক, উজ্জ্বল গমের রঙের ত্বক, দেহের গঠন নধর গোলগাল। মুখখানি বেশ মিষ্টি, তবে তনিমাকে পছন্দের আরো এক বিশেষ কারন আছে আদির। তনিমাকে পছন্দ হওয়ার পেছনে একটা বিশেষ কারন আছে, ওর উন্নত নিটোল স্তনযুগল আর নরম ভারী পাছা। তনিমার তীব্র আকর্ষণীয় নধর দেহের গঠন আদিকে এক সুন্দরী মহিলার কথা বারেবারে মনে করিয়ে দেয়। যখন তনিমাকে দেখতো অথবা যৌন সঙ্গমে মেতে উঠতো, মানসচক্ষে সেই সুন্দরী মহিলাকে খুঁজে বেড়াতো তনিমার মধ্যে। তাই তনিমাকে বড় ভালো লাগতো।

লাগতো? অতীত কাল কেন? ছোট্ট একটি ভুলের জন্য তনিমা ওকে নিজের জীবন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে চিরতরে। একটু ক্ষোভ হয়েছিল কিন্তু দুঃখ ছিল না মনে কারন... এই সেদিন, কয়েক মাস আগের কথা। এক বিকেলে তনিমার সাথে শহরের আরো দক্ষিণ দিকে একটা রিসোর্টে একটা সুন্দর বিকেল কাটিয়েছিল। সেদিন তনিমা একটা সাদা রঙের জিন্স আর চাপা শার্ট পরে কলেজে এসেছিল। সাদা চাপা জিন্সে ঢাকা নরম সুডৌল নিতম্ব দেখে আদির স্নায়ু উত্তেজনায় শিরশির করে ওঠে। পারলে এখুনি ওই নিতম্ব জোড়া হাতের মধ্যে নিয়ে একটু চটকে দেয়। হাঁটলেই ওই নিতম্ব জোড়া দুলকি চালে দুলে ওঠে সেই দেখে কলেজের সবার বুকের রক্তে হিল্লোল দেখা দেয়।

লাঞ্চের পরে তনিমা ওর পাশে এসে ফিসফিস করে বলে, “এই আমার সাথে একটু বের হবি?”

আদি সেটাই চাইছিল, সারাটা সকাল তনিমাকে ওই চাপা সাদা জিন্স আর নীল রঙের শার্টে দেখে থাকতে পারছিল না। বারেবারে মনে হচ্ছিল একটু একা পেলে দুই হাতে চটকে দেয় ওর সুউন্নত কোমল স্তন জোড়া। মরালী গর্দানে দাঁত বসিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে খায় আর গাড় লাল রঙের রসালো ঠোঁট জোড়া চুষে চুষে সব অধর সুধা এক নিমেষে পান করে নেয়। কয়েকদিন আগেই জোকার দিকে একটা রিসোর্টে গিয়ে আচ্ছাসে দুইজনে মনের সুখে নিজেদের দেহ নিয়ে খেলা করেছে, দেহের ক্ষুধা মিটলেও ওর মন ভরেনি অথবা ভরতো না ঠিক ভাবে। সেইবারে চরম যৌন সঙ্গমে মেতেছিল আদি আর তনিমা, কিন্তু শেষ বারে একটা ভুল হয়ে যায়।

আদি ওর কাঁধে কাঁধ দিয়ে ঠ্যালা মেরে মিচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “গরমে বেশ গরম হয়ে আছিস মনে হচ্ছে? কোথায় যাবি?”

তনিমা চোখ পাকিয়ে বলে, “যা যত্তোসব যাবো না তোর সাথে।”

তনিমার চোখ পাকানো আর সুডৌল নিতম্বের দুলুনি দেখে ঊরুসন্ধিতে বেশ চাপ অনুভব করে আদি। লিঙ্গ ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে, জিন্সের সামনের দিক একটু ফুলে উঠেছে। তনিমার গায়ের ঘামের সাথে একটা পারফিউমের গন্ধে মাতাল হয়ে যায় আদি।

একটু নড়েচড়ে প্যান্টের সামনের দিকটা ঠিক করে ওকে বলে, “জোকা যাবি?”

তনিমার কান লাল হয়ে যায় লজায় আর কিঞ্চিত কামোত্তেজনায়, “ইসসস শখ দেখো ছেলের।” গলা নামিয়ে কানে কানে বলে, “চল দুইজনে পালাই।”

আদিও সেটাই চাইছিল তাই ওর কানেকানে বলে, “নতুন স্ট্রবেরি ফ্লেভারের কন্ডোম কিনেছি।”

তনিমা নিচের ঠোঁট চেপে চোরা হাসি দিয়ে বলে, “উফফ শয়তান, আচ্ছা চল।”

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যাক্সি চেপে সোজা জোকার একটা রিসোর্টে। অবশ্য আদি তনিমাকে নিজের ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতো কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন বন্ধুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। জোকাতে রিসোর্টের রুমে ঢুকেই আদি ঝাঁপিয়ে পড়ে লাস্যময়ী তরুণী তনিমার ওপরে। পাঁজাকোলা করে তনিমাকে নিয়ে খাটের ওপরে শুইয়ে দেয়। জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বনে মেতে ওঠে আদি। তনিমার হাত উঠে আসে আদির জামার কাছে। এক এক করে বোতাম খুলে জামা খুলে দেয় আদির। তনিমার শার্টের বোতাম খুলে দিতেই ছোট কাপ ব্রার বাঁধনে থাকা নিটোল কোমল স্তন যুগল আদির দিকে উঁচিয়ে যায়। ট্যাক্সির মধ্যে আদি ওর কোমল শরীর নিয়ে এত খেলা করেছে যে আর থাকতে পারছে না। ইতিমধ্যে ঊরুসন্ধি ভিজে গেছে, পাতলা প্যান্টি যোনির ওপরে লেপ্টে গেছে। গতকাল যোনিকেশ কাচি দিয়ে ছোট ছোট করে ছেঁটে নিয়েছিল। সম্পূর্ণ কামানো যোনি নিজের পছন্দ নয় আর আদিরও পছন্দ নয়।

চুমু খেতে খেতে ধীরে ধীরে আদি তনিমাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। জামা গেঞ্জি খুলে ওর ওপরে চড়ে যায় আদি। দুই ঊরু মেলে আদিকে নিজের পায়ের মাঝে আঁকড়ে ধরে তনিমা। দুইজনের প্যান্ট তখন পরা, তাও তনিমা আদির কঠিন লিঙ্গের ধাক্কা নিজের যোনির ওপরে অনুভব করে। বিশাল কঠিন লিঙ্গ এখুনি যেন ওকে ফুঁড়ে মাথা থেকে বেরিয়ে আসবে। প্রবল ধাক্কা দেয় আদি, মত্ত ষাঁড়ের মতন সঙ্গমে মেতে ওঠে বারে বারে। প্রথম প্রথম ওদের যৌন সঙ্গমে এতটা তীব্রতা ছিল না, ইদানিং কয়েকমাস ধরে আদির মনোভাব বদলে গেছে। বিশেষ করে যৌন সহবাসের সময়ে কেমন যেন পাগল হয়ে যায়, দুই পা কাঁধের ওপরে তুলে কোমর টেনে টেনে ওকে শেষ করে দেয়। তনিমার বেশ ভালো লাগে এই ষাঁড়ের নীচে পড়ে মাছের মতন ছটফট করতে।

তনিমার বুক থেকে ব্রা একটানে খুলে ফেলে আদি। একটা স্তন হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আলতো কচলিয়ে বলে, “খাসা দুধে ভরা মাইগুলো রে তোর।”

তনিমা ওর মাথা নিজের স্তনের ওপরে চেপে ধরে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে, “সব তোর জন্য রে।”

আদি একটা স্তনের বোঁটা আঙ্গুলের মাঝে ধরে ঘুরিয়ে চেপে শক্ত করে বলে, “বোঁটা দুটো কিসমিস, চুষে খাবো না কামড়াবো বুঝে পাচ্ছি না।”

স্তনের বোঁটার ওপরে শক্ত আঙ্গুলের পেষণে তনিমা ছটফট করে ওঠে। ওর দেহ আর যেন নিজের নয়, আদির হাতের ওপরে হাত রেখে ওর থাবা নিজের স্তনের ওপরে চেপে ধরে বলে, “পিষে চটকে ধর রে আদি।”
 

Users who are viewing this thread

Back
Top