What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (1 Viewer)

সত্যজিত ওকে উত্তর দেয়, “মানে এই ষাট থেকে আশি লাখ টাকার মতন লাগবে।”

অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপরে দেবায়ন মিচকি হেসে সত্যজিতের সামনেই অনন্যার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “চার পাঁচ লাখ টাকা হলে না হয় এখুনি দিয়ে দিতাম। কিন্তু আশি লাখ টাকা, এটা বিনিয়োগের ব্যাপার। কি রকম রিটার্ন পাবো সেই বিষয়ে কিছু জানা নেই।”

অনুপমা ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন এইখানে বিজনেস নয়।” অনন্যাকে হেসে উত্তর দেয়, “প্লিস ওর কথায় কিছু মনে কোরো না, তোমাদের লাইন অব বিজনেস, প্রোজেক্সান, স্ট্রাটেজি সব নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে এসো আলোচনা করা যাবে।”

দেবায়ন মিচকি হেসে অনন্যাকে বলে, “আজকে প্রথম কিস্তির রিটার্ন পেলে বড় ভালো হতো।”

অনন্যা ওর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলে, “তুমি না বড্ড শয়তান...” বলেই ওকে আলতো একটা চাঁটি মারে। ওদের ওইভাবে মিশতে দেখে সত্যজিতের একটু কেমন কেমন মনে হয়।

বহু মানুষের চোখ ওদের দিকে, ছোট পর্দার নায়িকা অনন্যাকে দেখে অনেকেই ওর সই নিতে এগিয়ে আসে। অনুপমা আর দেবায়ন ওদের ছেড়ে আবার অন্যদিকে এগিয়ে যায়। দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, ধৃতিমানকে ও মৃদু শাসিয়ে রায়চক থেকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে। অনুপমা মাথা দোলায় আলতো করে। রাত যত বেড়ে ওঠে, তত বেড়ে ওঠে আকাশের গুরগুর চড়চড় ধ্বনি আর তত বেড়ে ওঠে নাচের তাল আর সঙ্গীত। নাচের ফ্লোরে অনেকেই উঠে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অনুপমার নাচের জায়গায়, বেশ কয়েক জন সুন্দরী ছোট চাপা আঁটো পার্টি পোশাক পরিহিত মেয়েদের দেখা পায়। গানের তালে তালে বিদেশী অথবা হোটেলের মালিকদের সাথে বেশ জড়াজড়ি করে নাচছে। ওদের অফিসের লোকজন, ছেলে মেয়েরা উদ্দাম নাচে ব্যস্ত। সবাইকে দেখে আর দেবায়নের বাজু ধরে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

দেবায়ন এখন অফিসে আসেনি। বাবা এইবারে গোয়া গেছে একটা নতুন রিসোর্টের ব্যাপারে। দেবায়নকে সাথে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু অনুপমার অনুরোধে এইবারে আর দেবায়ন যায়নি। সকাল থেকে ঝিরঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টিতে মামনির কাছে থাকলে, সোনামুগ ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাওয়া যেতো। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছেলেটা কোথায় যে বের হলো? সকালে ফোন করে বলেছিল যে অফিসে আসতে একটু দেরি হবে কিন্তু কত দেরি? লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে প্রায়। কোলকাতায় থাকলে এমন দেরি করে না, যদি কেনাকাটা কিছু করার থাকে তাহলে ওকে সাথেই নিয়েই বের হয়। কাজ থাকলে ওকে বলে যেতো কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু না, কি বলল, “এই একটু দোকানে যাবো।” কেন যাবি কোন দোকানে যাবি কিছুই বলল না। বৃষ্টির ভিজে হাওয়ায় হৃদয় বড় উদাস হয়ে যায় অনুপমার। পাগল বাউলের মতন খালি নেচে বেড়ায় এদিক ওদিক।

বেচারি অনুপমার খুব বড় অভিযোগ, সব প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের নানান ধরনের উপহার দেয়, কিন্তু দেবায়ন ওকে আজ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। অবশ্য তাতে ওর ভুল ছিল না যে তা নয়, কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেবায়নকে টাকা খরচ করতে দিতো না, কিন্তু তাই বলে চাকরি পাওয়ার পরে ওকে একটা উপহার দেবে না? না না, এতটা ওর ওপরে অভিযোগ করা ঠিক নয়। গতবার যখন বিন্সার, ডালহৌসি কাজে গেছিল তখন ডালহৌসি থেকে ওর জন্য একটা সুন্দর ফারের জ্যাকেট কিনে এনেছিল। যদিও ওর কাছে প্রচুর জ্যাকেট তাও ওর দেওয়া জ্যাকেট খানা ওর বেশ পছন্দ হয়েছিল।

এইসব ভাবছিল অনুপমা নিজের হাত দেখে, আঙুলগুলো বড্ড খালি শুধু একটা সোনার আংটি ছাড়া কিছুই নেই। ঠিক তখন দেবায়ন কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ওকে দেখে হাসে। কি ব্যাপার, চোখে যেন এক শয়তানি হাসি, আবার কোথায় কি করে এসেছে দেবায়ন? আর পারা গেল না এই ছেলেটাকে নিয়ে, নিশ্চয় কোথাও কোন মেয়ে দেখেছে আর সেই গল্প জুড়ে বসবে, না হয় কোন ডিল ফাইনাল হবে সেই নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এই চেহারা আর এই মিচকি হাসি কেমন যেন ঠেকায়। কোনোদিন এমন ভাবে মাথা চুলকে হাসতে দেখেনি ওকে। না না, একবার ওর সামনে এসেছিল এই ভাবে মিচকি হাসতে হাসতে, সে বহুদিন আগের কথা।

ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে প্রশ্ন করে দেবায়ন, “কি রে কি করছিস?”

অনুপমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে নাকে নাক ঘষে মিষ্টি করে বলে, “তোর কথা ভাবছিলাম।” তারপরে কিঞ্চিত অভিমানী কণ্ঠে ওকে বলে, “সবার বয়ফ্রেন্ডরা কত কিছু দেয়...”

ডান হাতে বাম হাত নিয়ে আলতো চেপে চোখ চোখ রেখে বলে দেবায়ন, “আমি সত্যি তোকে কিছু দেইনি কোনোদিন?”

ওই প্রগাঢ় ভালোবাসার চাহনির সামনে লজ্জায় পড়ে যায় অনুপমা, মাথা নিচু করে আলতো ঝাঁকিয়ে বলে, “না মানে...”

ওর বাম হাত ঠোঁটের কাছে এনে হাতের তালুতে ছোট চুমু খায় দেবায়ন। তপ্ত ভিজে ঠোঁটের পরশে অনুপমার শরীর শিহরিত হয়ে যায়। আপনা হতেই দেবায়নের কলারে হাত উঠে যায়। দেবায়ন ওর দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে, দুই চোখে প্রেমের ধিকিধিকি আগুন, ওকে ঝলসে দেওয়ার আগের মুহূর্তে নিয়ে যায়। নিজেকে ওর প্রশস্ত বুকের ওপরে আছাড় মারতে উদ্যত হয় অনুপমা। দেবায়ন ঝুঁকে ওর বাম হাতের আঙুল একটা একটা করে মুখের মধ্যে নিয়ে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত চুষে দেয়। কেঁপে ওঠে অনুপমা, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কি করছে ছেলেটা, এটা যে অফিস। এইভাবে কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে, নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারবে? ওর দেহের প্রত্যেক স্নায়ু উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবায়নের দেহের সাথে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য। অনুপমার অনামিকা মুখের মধ্যে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুষে দেয় তারপরে অনামিকা বের করে আনে মুখের মধ্যে থেকে।

তিরতির করে ভীষণ প্রেমের জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে দেবায়নকে গভীর আবেগজনিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি করছিস তুই?”

দেবায়ন ওর অনামিকা চেপে ধরে, আঙ্গুলে শক্ত ধাতুর গোলাকার কিছু একটা ঠেকে। দেবায়ন ওর চোখে চোখ রেখে খুব নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “বুড়ি হয়ে আমার মাথার পাকা চুল তুলে দিতে দিতে আমার সাথে ঝগড়া করবি?”

দেবায়ন ওর অনামিকায় কিছু একটা ঠেলে দেয়। হাতের চাপের মধ্যে বুঝতে পারে ওর আঙ্গুলে একটা আংটি। চোখ জোড়া ভরে আসে অনুপমার। চোখের পাতার সাথে সাথে ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে অনুপমার। আলতো মাথা নাড়িয়ে প্রগাঢ় আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে, “করবো রে, খুব ঝগড়া করবো। তুই তোর দাঁতের পাটি ভুলে যাবি আর আমি খুঁজে দেবো।”

দেবায়ন আবেগজড়ানো কণ্ঠে বলে, “সত্যি তুই খুঁজে দিবি? আর তোর চোখের চশমাটার কি হবে?”

দেবায়নের নাকের ওপরে নাক ঘষে বলে, “তুই আমাকে দেখিয়ে দিবি আর কি। আমি ওষুধ খেতে ভুলে গেলে কি হবে?”

উত্তর দেয় দেবায়ন, “ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখবো, মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখবো।”

অনুপমা ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করে, “কবে থেকে শুরু করবো এই খোঁজাখুঁজি?”

দেবায়ন ওর মুখ আঁজলা করে ধরে বলে, “এই ডিসেম্বর থেকে শুরু করলে কেমন হয়?”
 
মাথা উঁচু করে ওর চোখের দিকে তাকায় অনুপমা। আলতো ঠোঁট মেলে এগিয়ে দেয় দেবায়নের দিকে। ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ওই কথা শুনে। দেবায়নের ঠোঁট নেমে আসে ওর লাল নরম ঠোঁটের ওপরে। মিশে যায় দুই জোড়া কপোত কপোতীর ঠোঁট। অনুপমার আঙ্গুলে একটা বড় সলিটায়ার হীরের আংটি।

চুম্বন শেষে, ওর বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে চুপচাপ পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। দেবায়ন ওকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে দেয়। এইবারে ওর রাত আর বড় হবে না, এইবারে ওর আর ঠাণ্ডা লাগবে না। ওর বুক আর খালি থাকবে না। আয়নার সাথে আর কথা বলতে হবে না। রোজ সকালে ওকে ফোন করে উঠাতে হবে না। রাতে “গুড নাইট” কিস হাওয়ায় দিতে হবে না। ওর জামা চুরি করে পরতে হবে না। অনেক কিছু “হবে না” তালিকা শেষ হয়ে যাবে ওর জীবনে।

আঙ্গুলের আংটিটা দেখে, সোনার আংটির ওপরে একটা বড় হীরে। এই কিছুক্ষণ আগেই কত অভিযোগ নিয়ে নিজের সাথে কথা বলছিল আর ঠিক তখনি... পুচ্চু কি ওর মনের কথা শুনতে পারে নাকি? ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কাঁপা আবেগভরা কণ্ঠে বলে, “তুই কি আমার মনের কথা শুনতে পেরেছিলি?”

দেবায়ন আলতো মাথা দোলায়, “হটাত করে আজ সকালে বৃষ্টি দেখে বুকটা বড় ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল তুই কাছে থাকলে দুইজনে বাইকে করে এই বৃষ্টিতে ভিজতে বের হয়ে যেতাম।”

অনুপমা ওর বুকের ওপরে একটা কিল বসিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে, “বললি না কেন?”

ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে দেবায়ন উত্তর দেয়, “তাহলে এই সারপ্রাইস হতো কি করে?”

আবার দেবায়নকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, “খুব সুন্দর হয়েছে রে আংটিটা। মামনিকে বলেছিস?”

দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “না মানে এখন মাকে বলিনি ভাবছি তুই আমার সাথে বাড়ি চলো, দুইজনে একসাথে মাকে বলবো।”

একটু লাজুক হেসে বলে, “আর বাকিদের?”

দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “এখন নয়, বাকিদের না হয় ওই ট্রিপে গিয়ে বলবো যে ডিসেম্বরে আমরা বিয়ে করছি।” ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বলে, “চলো কোথাও বেরিয়ে পড়ি এই বৃষ্টিতে।”

সেই শুনে নেচে ওঠে অনুপমা, চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে ওর, “কোথায় যাবো?”

দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “কোলকাতায় রাস্তার অভাব আছে নাকি? পারলে না হয় দুর্গাপুর হাইওয়ে ধরা যাবে। যতদূর যাওয়া যায় যাবো তারপরে আবার বাইক ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরব।”

“নক নক... কৌন হ্যায়? নক নক... কৌন হ্যায়?” অনুপমার ফোন বেজে ওঠে, এটা মায়ের রিং টোন। এই এমন সময়ে মা ফোন করলো হটাত করে, কি ব্যাপার? হৃদয়ে প্রবল উচ্ছাস, ঠিক পেছনে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে দেবায়ন ওর ঘাড়ের ওপরে নাক ঘষে উত্যক্ত করে তোলে ওকে। আঙুলের আংটি দেখে মাকে বলার জন্য অধীর হয়ে ওঠে।

ফোন তুলেই মাকে বলে, “জানো মা আজকে কি হয়েছে।”

পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”

লাজুক হেসে প্রবল উচ্ছাসে দেবায়নের হাতখানি বুকের কাছে টেনে বলে, “পুচ্চু আমাকে একটা সলিটেয়ার দিয়েছে।”

পারমিতা অন্যপাশ থেকে খুশি হয়ে বলে, “এতদিনে তাহলে তোরা বিয়েটা সারছিস।”

মাথা দোলায় অনুপমা, “হ্যাঁ...”

পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যান্ডসাম কি কাছে আছে নাকি?”

দেবায়ন মিচকি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মিমি, তোমার মেয়েকে এইবারে তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে আমার কাছে রাখবো ভাবছি।”

পারমিতা কিঞ্চিত ধরা গলায় বলে, “বারন কে করেছে, সে তো অনেকদিন আগেই নিয়ে গেছো।”

দেবায়ন উত্তর দেয়, “এইবারে একদম পাকাপাকি ভাবে নিয়ে যাবো।”
 
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি জানে?”

অনুপমা উত্তর দেয়, “না এখন মামনিকে জানানো হয়নি। আজ রাতে জানাবো।”

দেবায়ন বলে, “তুমি আর মা একটা ভালো দিনক্ষণ ঠিক কর, আর তর সইছে না।”

পারমিতা অন্যদিক থেকে হেসে বলে, “ইসসস আর তর সইছে না, সব হয়ে গেল আর কি বাকি আছে?”

অনুপমা হেসে বলে, “অনেক কিছু বাকি, ওর মাথার পাকা চুল তুলে দেওয়া বাকি, আমার চশমা হারিয়ে যাওয়া আর ওর দ্বারা খুঁজে পাওয়া বাকি...”

পারমিতা হেসে বলে, “আচ্ছা হয়েছে, বুঝতে পারছি তোর মনে বিয়ের ফুল ফুটছে। যার জন্য ফোন করেছিলাম। তোরা দুইজনে একসাথে আছিস যখন ভালোই হলো। অনন্যা আর সত্যজিত এসেছে, তোদের সাথে ওর পত্রিকার সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে চায়।”

অনুপমা কপালে করাঘাত করে, দুই দিন আগে অনন্যা ওকে ফোন করে বলেছিল যে পত্রিকার সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য ওর বাড়িতে আসতে চায়। অনুপমা একদম ভুলে গেছে, এমন কি দেবায়নকে বলতেও ভুলে গেছে। আসলে এনুয়াল মিটের পর থেকেই এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট নিয়ে শ্রেয়ার সাথে এতো ব্যস্ত ছিল যে অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবার সময় ছিল না ওর কাছে।

মাকে উত্তরে বলে, “উফফফ একদম ভুলে গেছি... আচ্ছা এক কাজ কর ওদের কিছুক্ষণ বসতে বল আমরা এই এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।”

ফোন ছেড়ে দেবায়নকে সবিস্তারে অনন্যার বিষয়ে জানায়। ফোনে ওর সাথে অনন্যার শুধুমাত্র একটু কথাবার্তা হয়েছিল। প্রোজেক্সান, লাইন অফ বিজনেস, স্ট্রাটেজি এইসব ওর মাথায় ঢোকে না তাই এই বিষয়ে বাবার সাথে আর দেবায়নের সাথে আলোচনা করার কথা বলেছিল। দেবায়ন সব শুনে একটু মনমরা হয়ে যায়, অনুপমাও একটু মনমরা হয়ে যায়। এই ভিজে আবহাওয়ায় ঘুরতে যেতে বেশি ভালো লাগে এর মধ্যে আবার ব্যাবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে বসতে হবে ভেবেই মন কিঞ্চিত ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু কি করা যাবে, অনন্যা একদম বাড়ি পৌঁছে গেছে, আবার মায়ের সাথে অনন্যার বেশ ভালো সম্পর্ক। দেবায়ন আর অনুপমা কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে অনুপমা জানায় ওদের আশি থেকে নব্বুই লাখ টাকার দরকার।

বাড়িতে পা রাখতেই ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে, “বাপ রে শেষ পর্যন্ত আমার মেয়ে বড় হয়ে গেল।” আবেগ জড়িত, মাতৃস্নেহে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “মেয়েটাকে একটু দেখো।”

অনুপমা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “প্লিস মা, এখুনি শুরু কোরোনা তো।”

হাতের বড় হীরের আংটি দেখে পারমিতা ওকে বলে, “তোর ভাগ্য সত্যি ভালো।”

দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “ভাগ্য আমার ভালো। যাই হোক এইবারে আগে কাজ সারি তারপরে বাড়ি ফিরতে হবে। মাকে এখন জানানো হয়নি। আজ রাতে অনু কিন্তু আমাদের বাড়িতে থাকবে।”

পারমিতা দেবায়নের গালে আলতো টোকা মেরে হেসে বলে, “আমার বাড়ির মেয়ে অনেকদিন আগেই শ্বশুর বাড়িতে পা রেখে দিয়েছে, আর কি কিছু বলতে পারি?”

অনন্যা আর সত্যজিত বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের সামনে এই বিষয়ে কিছু আর আলোচনা করা হলো না। সামান্য কুশল সম্ভাষণের পরেই সোজা পত্রিকা সম্বন্ধে আলোচনায় বসে গেল। সত্যজিত ফাইল এনেছিল, ল্যাপটপে বেশ কয়েকটা প্রেসেন্টেসান বানিয়ে এনেছিল, সেইগুলো দেখালো। ইতিমধ্যে ওদের পাব্লিকেশানের একটা নাম ঠিক করা হয়েছে, পত্রিকার একটা নাম ঠিক করে নিয়েছে “ফুলের ঝুড়ি”। সত্যজিত নিজে ফটোগ্রাফার, এই পাব্লিকেসান লাইনে বেশ চেনাজানাও আছে, বেশ কয়েকজন সম্পাদক সম্পাদিকার সাথে ইতিমধ্যে কথাবার্তা আলোচনা সেরে নিয়েছে। আগামী বড়দিনে পত্রিকার শুরু করতে চায়।

সব শুনে দেবায়ন স্মিত হেসে জানায়, “দেখো মিস্টার সত্যজিত, এমনিতে এই পাব্লিকেসান লাইনে বিনিয়োগ করা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, মানুষে বই খুব কম পড়ে। মাসে কয়টা কপি বিক্রি করতে পারবে? তুমি যে প্রোজেক্সান দেখিয়েছো সেটা পাঁচ বছরে এচিভ করতে পারবে বলে আমার সন্দেহ আছে।” সত্যজিত একটু দমে যায় ওর কথা শুনে। অনেক আশা ভরসা নিয়ে অনন্যার কাছে শুনেই এদের কাছে এসেছিল। দেবায়ন তাও ওকে বলে, “আশি লাখ টাকা বিনিয়োগ করা খুব বড় ঝুঁকি। এতো টাকা বিনিয়োগের আগে আমাকে একবার সেন কাকুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।”

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে ওকে বলে, “বাঙ্গালী মেয়েরা এখন বাড়িতে বসে বই পড়ে। আর শুধু যে পত্রিকা বেচে আমাদের টাকা আসবে সেটা নয়। বিজ্ঞাপনেও টাকা আসবে সেই নিয়ে তোমার চিন্তা নেই, শুধু প্রাথমিক ইন্ধন আমাদের নেই।”

পারমিতা দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন, আমি সোমেশকে বুঝিয়ে বলে দেবো, শুধু তুমি না কোরো না। অনন্যা অনেক করেছে, ওর জন্য এইটুকু করতেই হবে।” পারমিতা আর অনন্যা কিভাবে ওদের কন্সট্রাক্সান কোম্পানিতে কাজ এনেছে সেই বিষয়ে দেবায়ন ভালো ভাবেই জানে।

অনুপমা এর মধ্যে নেই তাই স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারবো না, অনন্যাদি। ও আর বাবা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই চূড়ান্ত।”

দেবায়ন খানিক ভেবে স্মিত হেসে বলে, “কাকিমা যখন বলছে তখন দিতে পারি। তবে আমার কয়েকটা শর্ত আছে।” সত্যজিত জিজ্ঞেস করে, “কি শর্ত?” দেবায়ন উত্তরে বলে, “ব্রেক ইভেনে না পৌঁছানো পর্যন্ত কাকিমা তোমাদের এই পাব্লিকেসানের এম ডি হয়ে থাকবে, তারপরে দেখা যাবে। আর বোর্ড অফ ডাইরেক্টরের মধ্যে পায়েলকে নিতে হবে। অনুপমার অত সময় নেই কিন্তু পায়েল মাঝে মাঝে তোমাদের অফিসে যেতে পারে।”
 
সত্যজিত আর অনন্যা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিচু কণ্ঠে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওদের জানায়, এই শর্ত ওরা মানতে রাজি। দেবায়ন জানিয়ে দেয়, কিছুদিনের মধ্যেই মিস্টার সেনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে ওদের এই পত্রিকার টাকা দিয়ে দেবে।

সেই সাথে দেবায়ন অনন্যাকে মিচকি হেসে বলে, “সেই দিন রাতে তুমি বলছিলে ষাট লাখ টাকা আর এই কয়দিনে একেবারে নব্বুই লাখ টাকা হয়ে গেল?”

সত্যজিত হেসে বলে, “না না সেটা একটা ইনিসিয়াল এস্টিমেট মাত্র ছিল, আসলে আমরা সব অঙ্ক কষে নিয়ে তারপরে এসেছি। আর হাতে একটু বেশি থাকলে একটু ভালো হয়।”

দেবায়ন অনন্যাকে হেসে বলে, “বেশ তো ভালো কথা, কিন্তু...” চোখ টিপে হেসে বলে, “এতো বড় অঙ্কের টাকার বিনিয়োগের পরিবর্তে আমার কিছু চাই।”

পারমিতা ওর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে চোখ পাকিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন...”

অনন্যা পারমিতাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে দেবায়নকে বলে, “না না, কি চাও বল? কোথাও যেতে হবে কি?”

দেবায়ন উত্তরে জানায়, “তুমি একবার মিস চৌধুরীর সাথে কথা বলে নিও।”

অনুপমা লক্ষ্য করে অনন্যা বেশ গলে পড়ে আদুরে কণ্ঠে দেবায়নের সাথে কথাবার্তা বলছিল। আলোচনা শেষে খাওয়া দাওয়া শেষে, সত্যজিত স্মিত হেসে দেবায়নের সাথে হাত মিলিয়ে বলে, “একদিন বাড়িতে ডিনারে এসো।”

অনুপমাকে চোখ টিপে হেসে বলে অনন্যা, “ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন রইলো কিন্তু, ভুলে যাস না...”

অনুপমা ওর গালে গাল ঠেকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “সত্যজিত থাকলে হবে না কিন্তু...”

উত্তরে অনন্যা নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, “না না, ডিনারের পরে সত্যজিত থাকে না, বাড়ি চলে যায়। চিন্তা নেই ব্রেকফাস্ট আমরা একসাথেই করবো।”

দেবায়ন হেসে সত্যজিতের সাথে হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে একদিন ডিনারে অনন্যার বাড়িতে দেখা হবে।”

রেডিসনে এনুয়াল মিটেই রূপক, বন্ধুদের কাছে খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিংয়ের কথা বলেছিল। সেই শুনে অনেকে যেতে রাজি হয়ে যায়। পরাশর যেতে রাজি হয়ে যায়, জারিনা জানায় যাওয়ার জন্য ওর আব্বাজানকে রাজি করিয়ে নেবে। সঙ্গীতা লাফাতে শুরু করে দেয় ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে, অগত্যা প্রবালের তাই কিছু আর বলার থাকে না। ঋতুপর্ণা, ধীমান এক কথায় রাজি। শ্রেয়া আর পায়েল এই অজানা অচেনা জায়গায় যেতে একটু দ্বিধাবোধ ব্যক্ত করে, কারন ওদের দলের মধ্যে কারুর ট্রেকিংয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। দেবায়ন বুঝিয়ে বলে, কোন কিছুর প্রথমদিন সবার জীবনে একদিন না একদিন আসে। অনুপমার ভাই, অঙ্কন প্রেয়সী পায়েলের চাপে পড়ে আর না করে না, তবে বড়দের সাথে যেতে একটু দোনামোনা করে, বিশেষ করে জানে রূপক আর দেবায়ন কি রকমের ছেলে। ওর একবার কারুর পেছনে লাগলে তাকে না কাঁদিয়ে ছাড়ে না। রূপকের ওপরে সব কিছু পরকল্পনার করার ভার কারন ওই বেশ উৎসাহী। ইন্টারনেট ঘেঁটে একটা ট্রেকিংয়ের সাইটে লগিন করে একজনের সাথে আলোচনা করে অনেক কিছুর খোঁজ খবর ইতিমধ্যে নিয়ে নিয়েছে। অনুপমা আর দেবায়ন জানায়, খরচের সিংহ ভাগ ওরা দিতে রাজি। সেই সাথে অনুপমা আরো জানায় একজন অভিজ্ঞ চেনাজানা লোক সঙ্গে থাকলে বড় ভালো হয়। অফিসে এই নিয়ে কথাবার্তা চলে, সেই সময়ে ওরা জানতে পারে যে শান্তনু দিল্লীতে থাকার সময়ে বার পাঁচেক বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিংয়ে গেছে। ঠিক হয় যে শান্তনু আর মনীষাকেও সঙ্গে নেওয়া হবে। মনীষা পাহাড়ের মেয়ে কিন্তু কোনোদিন ট্রেকিংয়ে যায়নি তাই বেশ উৎসাহী। সব মিলিয়ে চোদ্দ জনের দল, বেশ বড় দল হলে যাওয়া সুবিধা। শান্তনুকে দলের নেতা হিসাবে মনোনীত করা হয়, আর বড় কারন সে অভিজ্ঞ আর দ্বিতীয়, দলের সব থেকে বড়, ওদের চেয়ে চার বছরের বড়। দলে সব থেকে বড় শান্তনু আর সব থেকে ছোট জারিনা আর অঙ্কন, বাকিদের বয়স মোটামুটি এক সবাই কলেজের বন্ধু।

পুজোর আগেই একদিন বিকেলে অফিসের পরে অনুপমাদের অফিসের কনফারেন্স রুমে ট্রেকিংয়ের আলোচনা পরিকল্পনার সভা বসে। ঠিক হয় একাদশীর দিনে ওরা সবাই কোলকাতা থেকে রওনা দেবে। শান্তনু আর রুপকের ওপরে সব কিছুর ভার। অনুপমা দেশ বিদেশে অনেক পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি ওকে প্রবলভাবে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ঋতুপর্ণা বেশ উৎসাহী ওদের কাছে পাহাড় বলতে দার্জিলিং, সিমলা কুলু মানালি আর সিকিমের চেয়ে বেশি দুর কোথাও যায়নি। জারিনা আর সঙ্গীতা কোনোদিন পাহাড়ে যায়নি। ছেলেদের একমাত্র দেবায়ন ছাড়া মধ্যে অনেকে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে।

ওই টিম মিটিংয়ে দেবায়ন বিশেষ করে জারিনা আর অঙ্কনকে বলে, “দেখ ভাই আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, ওইখানে কিন্তু কেউ বড় কেউ ছোট নয় আর জানিস তো আমাদের অবস্থা...”

রূপক ওর কথা টেনে নিয়ে বলে, “আমাদের কিন্তু কোন ট্যাক্স নেই, না কথাবার্তার না ...”

পায়েল মুখ না খুললেও পাশে বসা অনুপমাকে আলতো ধাক্কা মেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “ওই সব হলে কিন্তু আমি আর অঙ্কন যাবো না।”

অনুপমা ওকে অভয় দিয়ে বলে, “আরে না না এইবারে ওইসব উল্টোপাল্টা কিছুই হবে না সেই নিয়ে তোর চিন্তা নেই।”

দেবায়ন সেটা শুনে ফেলে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আমি তোর জন্য চার প্যাকেট কন্ডোম নিয়ে যাবো, হয়েছে?”

জারিনার কান লজ্জায় লাল হয়ে যায় সেই শুনে। মনীষা হেসে ফেলে দেবায়নের কথা শুনে।

শান্তনু ওদের এই আলোচনা থামিয়ে বলে, “সব থেকে আগে আমাদের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে। খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিং বেশ কষ্টকর ট্রেকিং, দিন দশেকের মতন তাঁবুতে থাকা আর হাঁটা। কখনো উঁচু চড়াই কখন উতরাই। সেই মতন প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রত্যেককে আমি মর্নিং ওয়াক করতে উপদেশ দেবো।”
 
মনীষা ওকে আলতো ঠ্যালা মেরে বলে, “বাপরে, চোরের মায়ের বড় গলা, রোজদিন ঠিক সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠবে আর তড়িঘড়ি করে অফিসে আসবে। তোমার জন্য প্রায় দিন আমার লেট হয়ে যায়।”

শান্তনু কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে বলে, “যার বউ অফিসের এইচ আর সেই অফিসে লেট আসাতে ক্ষতি কি।”

ওই শুনে সবাই হেসে ফেলে।

জারিনা জানায়, বাবার কাছ থেকে সব ওষুধপত্র যোগাড় করে একটা বড় ফার্স্ট এইডবক্স আর বেশ কিছু ঠাণ্ডার জন্য ইঞ্জেক্সান নিয়ে যাবে। সেদিনের মতন সভা শেষ হলে সবাই কেনা কাটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রূপক আর শান্তনুর ওপরে সব ভার, দলের নেতা শান্তনু আর রূপক ডান হাত, অনুপমা আর দেবায়ন ওদের পকেট। সবার একটা করে রাকস্যাক আর একটা ছোট ব্যাগ কেনা হয়। অনুপমার কাছে প্রচুর ভারী জ্যাকেট ছিল তাই শ্রেয়া আর পায়েলকে কোন জ্যাকেট কিনতে হয় না, তবে বাকিদের জন্য জ্যাকেট, দস্তানা ইত্যাদি কেনা হয়। তাঁবুর সরঞ্জাম ঘনসিয়ালি থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, গাইড আর মালবাহক লোকের ব্যাবস্থা ঘুট্টু নামক গ্রামে হয়ে যাবে বলে শান্তনু জানায়। এডমিনে থাকার ফলে এইসবের খবর আর ব্যাবস্থা করার কৌশল ওর বেশ ভালো করেই জানা।

ঠিক হয় একদশীর দিন বিকেলে প্লেনে চেপে সোজা দিল্লী। ধীরে ধীরে ঘুরতে যাওয়ার দিন কাছে চলে আসে। পুজো এক রকম হইহুল্লোড়ে কাটিয়ে একাদশীর দিন বিকেলে সবাই নিজেদের জিনিস পত্র নিয়ে কোলকাতা এয়ারপোর্টে উপস্থিত। ওদের ছাড়তে বাড়ির অনেকে এসেছে, বিশেষ করে জারিনার বাবা মা। প্রথম বার মেয়েকে এইভাবে একা বাইরে ছাড়ছে বলে একটু উদ্বেগ প্রকাশ করে। এয়ারপোর্টে পারমিতা এসেছিল, সেই জারিনার বাবাকে অভয় দিয়ে বলে এতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে যাচ্ছে কোন অসুবিধে হবে না। বিশেষ করে শান্তনু ওদের দলের মধ্যে সব থেকে বড়, বাকিদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।

প্লেন কোলকাতার মাটি ছাড়তেই সবাই নেচে ওঠে, মুক্তির স্বাদ, সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি, হিমশীতল গ্লেসিয়ারের ডাক, পনেরো দিন শুধুমাত্র প্রকৃতির কোলে কাটাবে। এই কয়দিনে অনুপমা আর পায়েল ছাড়া কেউই মর্নিং ওয়াক করেনি সেই নিয়ে একটু হাসাহাসি হয় প্লেনে। প্লেনের বাকি যাত্রীরা চোদ্দ জনের একটা ট্রেকিং টিম দেখে ভির্মি খেয়ে যায়। সাধারনত যে ভারতীয়রা ট্রেকিংয়ে যায় তারা অধিকাংশ ট্রেনে যাতায়াত করে, তাই অনুপমাদের দেখে প্লেনের বাকিরা একটু তাকিয়ে থাকে। ওরা কি আর চুপ করে থাকার মানুষ?

রূপক প্লেনে উঠেই পেছনে বসা পরাশরকে চেঁচিয়ে বলে, “এই শালা কেউ একটু জানালা খুলে দে বড্ড গরম লাগছে। এইখানে মনে হয় এসি নেই।”

সেই শুনে সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। শ্রেয়া একজন বিমান সেবিকাকে ডেকে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আচ্ছা, ওই টয়লেটে কেউ পটি করলে কি নীচে পড়ে যাবে?”

এয়ার হস্টেস হাসবে না কাঁদবে কিছু ভেবে পায় না। ভাবে এইগুলো একদম গেঁয়ো নাকি? ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে বলে, “না না তোর পটি এই শুন্যে উড়তে উড়তে পাখীদের খাদ্য হয়ে যাবে।”

শ্রেয়া হটাত শান্তনুকে বলে, “টিম লিডার আমাদের খিদে পেয়েছে। ডিনারের কি ব্যবস্থা।”

শান্তনু পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে, “সুন্দরীরা একটু চুপচাপ বসে থাকো, একটু পরেই খাবার সারভ করা হবে।”

মনীষা আর ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ আমাদের নিরামিষ।”

এক কোনা থেকে পরাশর চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি কিন্তু মাছের ঝোল আর ভাত।”

দেবায়ন চেঁচিয়ে ওঠে, “টিম লিডার আমার হুইস্কি কোথায়?”

সেই সাথে তাল মেলায় রূপক আর ধীমান, “স্কচ অন রক্স বেবি।”

ওদের চেঁচামেচিতে প্লেনের বাকি যাত্রীরা রিতিমতন ভির্মি খেয়ে যায়।

প্লেনে ওঠার পর থেকে প্রবাল মুখে কুলুপ এঁটে চুপ। হাওয়ার চাপ কমে যাওয়ার ফলে ওর কান ভোঁভোঁ করছে। সঙ্গীতার হাতখানি মুঠি করে ধরে চুপচাপ সিটে বসে। সেটা ধীমান দেখতে পেয়ে মজা করে বলে, “ওরে বাল, তোর বউ নিয়ে কেউ পালিয়ে যাবে না। প্লেনের মধ্যে কেউ নিয়ে আর পালাবে কোথায়। এইবারে একটু ছেড়ে দে।”

সঙ্গীতা উল্টে ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে, “চুপ কর, প্লেনে চাপলে ওর মাথা ঘোরে।”

দেবায়ন সিট থেকে উঠে ওর মাথায় চাঁটি মেরে ইয়ার্কি মেরে বলে, “তোর জিন্স নয় শাড়ি পরে আসা উচিত ছিল। ওকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখতিস তাহলে ভালো হতো।”

অনুপমা ওদের বলে, “আরে আরে আঁচলের তলায় অনেক কিছু লুকানো আছে রে প্রবাল, লাগা একটু মুখ লাগা।”

এই ভাবে মজা করতে করতে ওরা রাতের বেলা দিল্লী পৌঁছায়। শান্তনু জানায়, ভোর বেলা একটা চোদ্দ সিটের বাস ওদের জন্য ঠিক করা হয়েছে। দিল্লী থেকে এই বাসে চেপেই ওরা হৃষীকেশ হয়ে ঘুট্টু যাবে। ঘুট্টু থেকে ওদের ট্রেকিংয়ের শুরু।
 
দিল্লীতে রাত কাটিয়ে তারপরের দিন সকাল বেলায় একটা ছোট বাসে চেপে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দিল্লী ছাড়ার আগে, দেবায়ন রূপক আর ধীমান বেশ কয়েক বোতল হুইস্কি, রাম ইত্যাদি মদ কিনে নিয়েছিল। সারাটা রাস্তা হাসি মজা করতে করতে কেটে যায়। হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দেবায়ন, অঙ্কন আর অনুপমা ছাড়া বাকিদের হৃষীকেশ আগে থেকে ঘোরা ছিল। তাও সন্ধ্যের পরে সবাই হৃষীকেশ ঘুরে বেরিয়ে দেখে। পুজোর পরে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব এসে গেছে পাহাড়ের পাদদেশে। হৃষীকেশ থেকে পাহাড় শুরু, ওদের হোটেলের পেছনে পাহাড়, গঙ্গার জল এইখানে খুব ঠাণ্ডা। এর ওপরে গেলে জলের তাপমাত্রা কত কমবে সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। হৃষীকেশে ওরা দশ দিনের খাবার দাবার কেনাকাটা করে নেয়। ম্যাগি, চাল ডাল, আলু ইত্যাদি। শান্তনু জানিয়েছে, রাতে যদি নিজেরা রান্না না করতে পারে তাহলে একটা রান্নার লোক সাথে নিয়ে যাবে। জারিনা আর ঋতুপর্ণা জানিয়ে দেয় ওরা রান্না করতে রাজি। পরাশর হেসে বলে, পাহাড়ি পথে হাঁটার পরে দেহে আর শক্তি থাকবে না যে রান্না করতে বসবে।

মেয়েদের মধ্যে বিশেষ করে শ্রেয়া, ঋতুপর্ণা আর অনুপমার খুব চিন্তা স্নান করবে কি করে। দেবায়ন মজা করে বলে, “ভিলাঙ্গনা নদীর ঠাণ্ডা জলে তোরা স্নান করে আমাদের কোলে চেপে যাস আমরা তোদের ঠিক গরম করে দেবো।”

ধীমান একটু নেচে নেয় সেই শুনে, “এইবারে কে কার কোলে চাপবে সেটা কিন্তু আমি ঠিক করে দেবো।”

রূপক হেসে শান্তনুর কাঁধ চাপড়ে বলে, “কি বসো, আমরা সবাই কিন্তু ঠোঁট কাটা, মুখে কোন ট্যাক্স নেই।”

মনীষার দিকে চোখ টিপে উত্তর দেয় শান্তনু হেসে বলে, “তাতে অসুবিধে নেই শুধু আমার বউটা যেন বেঁচে ফিরে আসে।”

সেই শুনে লজ্জায় মনীষার কান গাল লাল হয়ে যায়। এমন একটা দলের সাথে আগে কোনোদিন কোথাও যায়নি। ওরা যে এতটা ঠোঁট কাটা আর এই সব বিষয়ে কথাবার্তা বলবে সেটা ভাবেনি।

দেবায়ন চোখ টিপে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করে, “বসো, আজ রাতে কি কান খুঁচাবে না অন্য কিছু?”

শান্তনু মুখ গোমড়া করে বলে, “না রে ভাই কান খুঁচাবো, কি করি বল পাউরুটিতে জ্যাম লেগে আছে। আশা করি কাল শেষ হয়ে যাবে।”

মনীষা সেই শুনে ওকে মারতে শুরু করে দেয় আর বাকিরা সবাই হেসে ফেলে।

হৃষীকেশ থেকে কাক ভোরে ওরা সবাই বাসে চেপে বেরিয়ে পড়ে ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে। একশো সত্তর কিলোমিটার পথ, এরপরে যেতে হবে তেহেরি, ঘনসিয়ালি হয়ে ওদের যেতে হবে ঘুট্টু। তেহেরি শহর আর নেই, বাঁধের ফলে গঙ্গার স্তর বেড়ে গেছে যার ফলে শহর উঠে গেছে। হৃষীকেশ ছাড়াতেই ওদের বাস ধীরে ধীরে সরু আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে ধরে চড়াই উঠতে শুরু করে দেয়। সরু পথ, দুই ধারে উঁচু সবুজ পাহাড়। বাস একবার ডানদিকে মোড় নেয় কিছু পরেই আবার বাম দিকে মোড় নেয়। বারকোট পারো হতেই পায়েল বমি করতে শুরু করে দেয়, সেই দেখাদেখি সঙ্গীতা আর শ্রেয়ার বমি পেয়ে যায়। বারকোটের পরে একটা ছোট বসতি জায়গায় থেমে জল খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। প্রবাল, পরাশরের শরীর একটু খারাপ হয়ে যায় পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথে। শান্তনু দেবায়ন বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। জারিনা সঙ্গে ওষুধ এনেছিল সেইগুলো খেয়ে মোটামুটি সবাই সুস্থ হয়ে যায়। তেহেরি ড্যাম ছাড়িয়ে, গঙ্গা পারো হয়ে আরো দুর ওদের যেতে হবে। তেহেরি পৌঁছাতেই দুপুর, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে আরো বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। ড্যামের জন্য বড় ভারী গাড়ি চলার ফলে তেহেরির পর থেকেই রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। ঘনসিয়ালির পরে বলতে গেলে রাস্তা আর নেই। কালী বাগি থেকে ছোট ব্রিজ পারো করে ভিলাঙ্গনা নদীর ওপাড়ে যায় ওদের বাস। দুর উত্তরে সুউচ্চ তুষারে ঢাকা হিমালয় পর্বত মালা দেখে সবার দেহ মন ভালো হয়ে ওঠে। ওই দুরের তুষারে ঢাকা কোন এক শৃঙ্গের নীচে ওদের গন্তব্য স্থল। খাটলিং গ্লেসিয়ার গলে তৈরি হয়েছে ভিলাঙ্গনা নদী।

ঘুট্টুতে একটা রেস্ট হাউসে ওদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেয়েদের সেই রেস্ট হাউস বিশেষ পছন্দের নয় বিশেষ করে পায়েল আর অনুপমার। সেটা হওয়ার কথা, বড় লোকের মেয়ে সর্বদা ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে এসেছে, ছোট রেস্ট হাউসে কি করে কাটাবে।

এই নিয়ে অনুপমার সাথে শান্তনুর একটু বচসা হয়ে যায়, “এইখানে রাত কাটানো যায় নাকি? সবাই এতো ক্লান্ত হয়ে এসেছে আর এই জায়গায় কিছুই পাওয়া যায় না।”

শেষ মেশ দেবায়ন ওদের বুঝিয়ে বলে, “পুচ্চি আমরা এইখানে ফাইভ স্টার রিসোর্টে কাটাতে আসিনি। এটাই শেষ রেস্ট হাউস এরপরে টেন্টে থাকতে হবে।”

অনুপমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “বেশ তো টেন্টে থাকবো সেটা ভালো।”

দেবায়ন শান্তনুকে অন্যদিকে পাঠিয়ে অনুপমাকে শান্ত করে, “আচ্ছা বাবা, এর চেয়ে ভালো কিছু এইখানে পাওয়া সম্ভব নয়। একটা রাতের ব্যাপার, এরপরে যখন ঘুরে আসবি তখন দেখবি এই রেস্ট হাউস তোর কাছে ফাইভ স্টার মনে হবে।”

কথাটা না বুঝতে পেরে অনুপমা পায়েল ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি করে?”

দেবায়ন হেসে বলে, “এরপরে শুধুমাত্র টেন্ট আর আমাদের মুখ দেখতে পাবি। এই ঘুট্টুর পর থেকে আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাবো। দশ দিন পরে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবো তখন এই বিছানা দেখে মনে হবে, আহহহ... কি আরাম।”

দুইজনেই সেই শুনে হেসে ফেলে। উত্তরের তুষারে ঢাকা পর্বত মালা থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের কাঁপিয়ে দেয়। ঘুট্টুতে ওদের জন্য গাইড, রঞ্জিত আর জনা দশেক পোর্টার তৈরি ছিল। রঞ্জিতের বাড়ি তেহেরিতে ছিল কিন্তু সেই শহর উঠে যাওয়ার পরে নিজের গ্রামে ফিরে যায়। এইখানে অথবা উত্তরকাশিতে গিয়ে বিভিন্ন ট্রেকিংয়ের গাইডের কাজ করে। মালবাহী ছেলেগুলো বাড়ি এই ঘুট্টু, গাঙ্গি, রীহ এইসব ছোট ছোট গ্রামে। রেস্ট হাউসের সামনের খোলা জায়গায় রাতের বেলা ক্যাম্প ফায়ার তৈরি করে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। রঞ্জিত জানিয়ে দেয়, ঘুট্টু থেকে রীহ দশ কিলোমিটার পথ। রাস্তার প্রথম দিকে একটু চড়াই তারপরে বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে ওদের এগোতে হবে। এতটা পথ বাসে যাত্রা করার পরে কারুর দেহে বেশিক্ষণ রাত জাগার শক্তি ছিল না। কোন রকমে খাওয়া সেরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে সবাই সেঁধিয়ে যায়।

ভোর পাঁচটায় ওদের গাইড রঞ্জিত এসে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম চোখে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে অনুপমা কাতর কণ্ঠে বলে, “উঠতে হবে নাকি? কটা বাজে?”

দেবায়ন গভীর নিদ্রায় ছিল তাই ওর কথা শুনতে পায়নি। স্লিপিং ব্যাগে অন্যদিকে ফিরে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। অনুপমা ওকে আরো জড়িয়ে ধরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। এই ঠাণ্ডায় ওর গায়ের গরমে সকালের ঘুম আর কিছুতেই ছাড়তে চায় না। এমন সময়ে শ্রেয়া আর ঋতুপর্ণা এসে ওদের ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বেশি দেরি করলে রীহ পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। সবার এই প্রথম বার ট্রেকিংয়ে যাওয়া তাই সবাই বেশ উৎসাহী। গরম জলে স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই বেরিয়ে পড়ে রীহের উদ্দেশ্যে। খাবারের ব্যাটারি, তাঁবুর সরঞ্জাম, বড় বড় ব্যাগ নিয়ে মালবাহী ছেলেরা অনেক আগেই রীহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। ওরা আগে থেকেই একটা ভালো জায়গা দেখে তাঁবু খাটিয়ে দুপুরের রান্নার যোগাড় করবে বলে ওদের গাইড রঞ্জিত ওদের জানিয়ে দেয়। ছেলেদের পিঠে নিজেদের একটা ব্যাগ আর মেয়েদের কাছে ছোট ব্যাগে শুধুমাত্র জলের বোতল। ঋতুপর্ণা, অনুপমা আর জারিনা বেশ শক্তপোক্ত তাই নিজেদের ছোট ব্যাগ নিজেরাই বহন করে। অন্যদিকে শ্রেয়া নিজের ব্যাগ রুপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, মনীষা এক প্রকার খালি হাতেই নাচতে নাচতে যাত্রা শুরু করে। অঙ্কন পায়েলের পাশ আর ছাড়ে না, সেই নিয়ে ওদের সবার মধ্যে বেশ হাসাহাসি হয়।
 
রঞ্জিত জানায়, প্রথম কিছুটা খুব কষ্ট হবে তারপরে একবার হাঁটার ছন্দ পেয়ে গেলে তখন হাঁটতে আর কষ্ট হবে না। ঠিক তাই হলো, শুরুতে চড়াই, আশেপাশে বিশেষ গাছ পালা নেই শুধুমাত্র উঁচু উঁচু পাইন গাছ ছাড়া। দুর উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের সামনে থেকে দৌড়ে এসে ওদের ঘায়েল করতে প্রস্তুত। একপাশে গভীর খাদের মধ্যে নিয়ে ভিলাঙ্গনা নদী কুলুকুলু শব্দে, মত্ত ছন্দে পাহাড় কেটে, পাথরের বাঁধা উপেক্ষা করে বয়ে চলেছে মোহনার পানে। তেহেরিতে গিয়ে এই নদী ভাগীরথীর সাথে মিশে নীচে নেমে যাবে গঙ্গা হিসাবে। চারাপাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে সবাই ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।

যাত্রা শুরুর পূর্বে রঞ্জিত ওদের সবার হাতে একটা লাঠি দিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল এই লাঠির ভর দিয়ে পাহাড়ে চড়তে বেশ সুবিধা হয়। প্রথমে সবাই লাঠি দেখে হাসাহাসি করেছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঠিটাই সর্বস্ব সম্বল বলে মনে হয় সবার। দলের একদম শুরুতে রঞ্জিত চলছে আর একদম শেষে মনীষা আর শান্তনু।

কিছদুর গিয়ে অনুপমার পা আর চলে না। এক হাত দেবায়নের কাঁধে ভর দিয়ে কোনরকমে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “উফফফ মাগো এই জায়গায় কেউ আসে নাকি?”

শ্রেয়া ওইদিকে রুপকের ওপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “তুমি বেড়ানোর আর জায়গা খুঁজে পেলে না?”

বাকি মেয়েদের চেয়ে ঋতুপর্ণা আর জারিনা বেশ উচ্ছল প্রানবন্ত, ওদের দেখে অনুপমা আর মনীষা বুকে বল পায়। অনুপমা জারিনাকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে মেয়ে এতো নাচছিস কেন?”

জারিনা ওর কথা শুনে হেসে বলে, “অনুদি, সত্যি বলছি এইরকম জায়গায় আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”

অনুপমা হেসে বলে, “ওরে আমি আনিনি তোদের, এই সব প্ল্যান ওই রূপকের।”

শ্রেয়া হেসে বলে, “একবার কোলকাতা ফিরি তারপরে দেখি কে কাকে ধন্যবাদ দেয়।”

পেছন থেকে শান্তনু চেঁচিয়ে বলে, “একবার খাটলিং পৌঁছে এই কথা বল। তখন ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাবে না।”

হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই হাঁপিয়ে ওঠে, একটু থেমে জল মুখের মধ্যে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। এখন আর ওদের বিশেষ ঠাণ্ডা লাগছে না, অনেকেই জ্যাকেট খুলে দিয়েছে। ভোরের আলো সদ্য স্নান করিয়ে দেয় আশেপাশের সবুজে ঢাকা গাছপালা ঝোপঝাড়কে। আরো একটু হেঁটে যাওয়ার পরে সামনে আসে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গল দেখে অনেকের ভয় করে, এই রকম জঙ্গল ওরা শুধুমাত্র সিনেমাতে দেখে ছিল। ওদের মনে হয় সত্যি সত্যি ওরা কোন রোমাঞ্চকর সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

অনুপমার এখন আর ক্লান্তি লাগে না, অন্য মেয়েদের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে চলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। মনীষা শান্তনুকে ছেড়ে ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। একদম শুরুর দিকে ঋতুপর্ণা আর জারিনা, তাদের পেছনে শ্রেয়া, পায়েল অনুপমা সঙ্গীতা আর মনীষা। অনুপমা একবার পেছনের দিকে দেখে। ধীমান, দেবায়ন আর রূপক একদম পেছনে, নিশ্চয় কোথাও বসে সিগারেট ফুঁকছে ওরা। শান্তনু এগিয়ে গিয়ে ওদের হাঁটতে বলে, বলে যে ধীমান দেবায়ন একটু মদ্য সেবন করে আসছে। সেই শুনে অনুপমা একটু রেগে যায়, ঘুরতে এসেও মদ খেতে হবে নাকি?

চেঁচিয়ে ডাক দেয় দেবায়নকে, “পুচ্চু তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

গাছ পালা ভর্তি জঙ্গলের মাঝে সরু পায়ে হাঁটা পথ, রীহ, গাঙ্গি ওইদিকে আরো অনেক ছোট ছোট গ্রাম আছে সেই গ্রামের বাসিন্দারা বাইরের জগত থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন থাকে, এই পথে যেতে যেতে ওদের মনে হয় যেন কোন স্বপ্ন পুরীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা। এক মাস আগেই বর্ষা শেষে গাছ পালা সব সবুজ পাতায় ঢাকা, পায়ের তলায় স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, চারপাশে ছোট ছোট জংলি ফুলের গাছ, লতাপাতা, কোথা থেকে কোন পাখীর ডাক শোনা যায়, একপাশে একটা ছোট নাম না জানা পাহাড়ি নদী গর্জন করতে করতে এগিয়ে চলেছে মোহনার পানে।

শ্রেয়া ওকে বলে, “ইসসস আমার না গান গাইতে ইচ্ছে করছে।”

মনীষা বলে, “গাও, কে বারন করেছে।”

শ্রেয়া গেয়ে ওঠে, “ইয়ে কাঁহা আআআআ গয়ে হম” অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তেরে সাথ চলতে চলতে... তেরি বাহো মে ইয়ে জানম... মেরি জিস্মোওও যা পিঘলতে...”

অনুপমা গায়, “তু বদন মেয় তেরা ছায়া, তু না হো তো মেয় কাঁহা হু... ”

ঋতুপর্ণা সামনে থেকে চেঁচিয়ে বলে, “আরে আরে হলো হলো না, অমিতাভের কবিতা কেউ বলবে না নাকি?”

শান্তনু গেয়ে ওঠে, “ইয়ে রাত হ্যায় ইয়া তুমহারি জুলফে খুলি হুয়ি হ্যায়...”

মনীষা হেসে বলে, “ডার্লিং এটা আমার চুল...”

সবাই হেসে ফেলে। গান গাইতে গাইতে জঙ্গল পারো করতে করতে ওদের রীহ পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। পাহাড়ের কোলে একটা সমতল খাদের পাশে অবস্থিত পটে আঁকা ছবির মতন ছোট গ্রাম রীহ, বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই গ্রামে ছোট একটা রেস্ট হাউস আর বেশ কয়েকটা বাড়ি ঘর আছে। ওদের জন্য আগে থেকেই ওদের গাইড জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। মাল বাহকেরা ওদের অনেক আগেই ওইখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ওরা সবাই এইখানকার বাসিন্দা, রোজদিন এই পাহাড়ি রাস্তায় যাতায়াত করে, ঘুট্টু থেকে রীহ, দশ কিলোমিটার পথ অনুপমাদের ছয় ঘন্টা লেগে যায়, কিন্তু মাল নিয়ে ছেলেগুলো অনায়াসে তিন ঘন্টায় সেই পথ পারো করে উপস্থিত। মাল বাহক ছেলেরা তাঁবু খাটিয়ে দিয়েছে, একজন ওদের জন্য রান্নাও শুরু করে দিয়েছে। সবার আলাদা আলাদা ছোট ছোট তাঁবু, গোল করে বাঁধা হয়েছে, মাঝখানে খালি জায়গা। একপাশে টয়লেট করার তাঁবু, একপাশে রান্না করার তাঁবু, অন্যপাশে মাল বাহকদের জন্য তাঁবু খাটানো হয়ে গেছে।
 
ছয় ঘন্টা হেঁটে অনেকের পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ওদের একটু দূরে দুটো দল তাঁবু গেড়েছে। রঞ্জিত খোঁজ নিয়ে ওদের জানায়, একটা জার্মানি ফ্রান্সের দল, যারা অডেন’স কল যাবে, আর দ্বিতীয় একটা পাঞ্জাবী দল যারা মাসার তাল যাবে। বিদেশী দলটার সরঞ্জাম অনেক বেশি, কারন ওডেন’স কল নাকি রীতিমত মাউন্টেনিয়ারিং করে উঠতে হয়। অডেন’স কল হয়ে ওরা কেদারনাথ যাবে, অনেক দিনের পরিকল্পনা।

তাঁবুর মাঝখানের খালি জায়গায় পৌঁছেই অনুপমা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাটির ওপরে সটান শুয়ে পড়ে, ওর পাশে দেবায়ন শুয়ে পড়ে। দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে প্রেমাবেগে বলে, “ইসসস জীবনটা এইভাবে কেটে গেলে বড় ভালো হতো।”

দেবায়ন ওকে জড়িয়ে গালে ছোট চুমু খেয়ে বলে, “কি করতিস এইখানে?”

দুরের ছোট ছোট বাড়ি দেখিয়ে বলে, “ওর একটার মধ্যে আমাদের একটা বাড়ি হতো, তুই ওই খেতে কাজ করতিস আমি তোর জন্য ঘরে বসে রান্না করতাম।”

দেবায়ন হেসে ওর বাম হাতের অনামিকা দেখিয়ে বলে, “আর এটার কি হতো?”

অনুপমা স্মিত হেসে বলে, “তুই পাশে থাকলে এই হীরের আংটি জলে ফেলে দিতে পারি।” বলেই ওর গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খায়।

ওদের ওইভাবে জড়াজড়ি করে ঘাসে শুয়ে থাকতে দেখে ঋতুপর্ণা আর শ্রেয়া কাছে এসে ফেরিওয়ালার মতন একটা সুর টেনে বলে, “চাই... নাকি কন্ডোম চাইইইই... দশ টাকায় তিনটে কন্ডোম... বেশ ভালো কন্ডোম, ঢুকলে পরে মনে হবে না...”

দেবায়ন ঋতুপর্ণার হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে বলে, “রাতে চলে আসিস কন্ডোম ছাড়াই ঢুকিয়ে দেবো...”

গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসে যায়। আলুসিদ্ধ আর খিচুড়ি রান্না করেছিল সঙ্গে আসা রান্নার লোক। সবাই বেশ ক্লান্ত, খেয়েদেয়েই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তাঁবুতে ঢুকে অনুপমা দেবায়নকে জড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়ে।

ছেলেরা অনেক আগেই উঠে গিয়েছিল। অনুপমা উঠে দেখে পাশে দেবায়ন নেই, বাইরে ওদের হাসির আওয়াজ শোনা যায়। চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরিয়ে দেখে মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় অনেক শুকনো কাঠ জড় করা হয়েছে, রাত বাড়লে ওই কাঠে আগুন জ্বালিয়ে বনফায়ার করা হবে। বেশ মজা হবে। বিকেলে যখন সবাই ওঠে ততক্ষণে সূর্য পাটে বসার সময় হয়ে গেছে। চারপাশের ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আরো কত রকমের পোকা মাকড়ের গুনগুন শব্দ, একপাশ থেকে ভেসে আসা একটানা নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, পরিবেশটাকে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়।

রঞ্জিত জানায়, দুটো মালবাহি ছেলের বাড়ি এই গ্রামেই তাই বাকি মালবাহি ছেলেরা আজ রাতে ওর বাড়িতে থেকে যাবে। আগামী কাল সকালে রীহ থেকে গাঙ্গি যাওয়া হবে।

চা খাবার দাবার খেতে খেতে সন্ধ্যে নেমে যায়। শুকনো কাঠে আগুন জ্বালিয়ে বনফায়ার জ্বালানো হয়। চারপাশে গোল করে সবাই জোড়ায় জোড়ায় বসে গল্পে মেতে ওঠে। রূপক ধীমান ইতিমধ্যে মদ তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েরা জানিয়ে দেয় ওর মদ খাবে না, তবে শ্রেয়া আর অনুপমার একটু রাম নিতে আপত্তি নেই।

কি করা যায়, কি করা যায়, ঋতুপর্ণা বলল, “একটা খেলা খেললে কেমন হয়?” সবাই জিজ্ঞেস করে, “কি?” ঋতুপর্ণা উত্তর দেয়, “ট্রুথ ওর ডেয়ার।”

দেবায়ন বলে, “খেলতে পারি তবে যা বলা হবে সেটা যেন কেউ না না করে আর যা জিজ্ঞেস করা হবে তার যেন সঠিক উত্তর পাওয়া যায়।” সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠে, বেশ মজা হবে।

ধীমান বাকিদের মানে, প্রবাল, অঙ্কন শান্তনু মনীষা এদের বলে, “দেখ ভাই আমরা সবাই বন্ধু আর খুব খোলামেলা। এইখানে সঙ্কোচ করলে কিন্তু চলবে না।” মনীষা আর জারিনা একটু দোনামনা করার পরে সম্মতি জানায়।

সঙ্গীতাকে প্রবাল এক প্রকার পেঁচিয়ে ধরে। অনেকক্ষণ পরে প্রবাল মুখ খোলে, “ঠিক কি করতে হবে এই খেলায়?” সঙ্গীতা ওকে খেলার নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দেয়। প্রবাল স্মিত হেসে মেনে যায়।

দেবায়ন মনীষাকে দেখে বলে, “তুমি টিম লিডারের বউ সুতরাং তোমার থেকেই শুরু করা যাক।” মনীষা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলে দেবায়ন ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বল, ট্রুথ ওর ডেয়ার?”

মনীষা উত্তর দেয়, “ট্রুথ।”

রূপক হাঁ হাঁ করে হেসে ওঠে, “ওকে ম্যাডাম, শুনেছিলাম তোমার ব্রেডে গতকাল জ্যাম লাগানো ছিল সেটা কি এখন লাগানো চলছে না হয়ে গেছে?”

মনীষা মুখ কাঁচুমাচু করে মিচকি হেসে বলে, “লাগানো শেষ হয়ে গেছে।”

দেবায়ন শান্তনুর কাঁধ চাপড়ে বলে, “ব্যাস তাহলে পাঁচদিনের কাজ আজ রাতে পূরণ করে নিও।”

ওর পাশে শান্তনু বসে, রূপক ওকে জিজ্ঞেস করে, “ট্রুথ ওর ডেয়ার?”

শান্তনু বলে, “ডেয়ার।”
 
ধীমান ওকে বলে, “আচ্ছা বেশ, তোমার সুপারম্যান পছন্দ না অরন্যদেব পছন্দ? যাকে পছন্দ সেই মতন কাপড় পর।”

শান্তনু হেসে বলে, “আরে বাবা এটা কলেজে অনেকবার হয়ে গেছে অন্য কিছু দাও।”

মনীষা হাঁ হাঁ করে ওঠে, “কলেজে হয়েছে তো কি হয়েছে। তোমাকে করতে হবে এটাই নিয়ম।”

উত্তর থেকে ভেসে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওরা সবাই পাশের সঙ্গীর কোলে সেঁধিয়ে যায়। দেবায়ন একপ্রকার অনুপমাকে কোলের মধ্যে বসিয়ে নিয়েছে। হাতে মদের গেলাসের সাথে সাথে সঙ্গে আনা মাংসের কাবাব খেতে খেতে সবাই হেসে ফেলে মনীষার কথা শুনে।

অগত্যা শান্তনু উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “অরন্যদেব করতে পারি।” সবাই হেসে বলে তাই কর। শান্তনু প্যান্ট খুলে, জ্যাকেট খুলে জামা আর জাঙ্গিয়া পরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ঠাণ্ডায় ওর লিঙ্গের অবস্থা খারাপ, সেটা আর নিজের জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায়না।

সেই দেখে ধীমান হেসে মনীষাকে বলে, “ম্যাডাম, ওর যে বাঁড়া নেই আজ রাতে কি করে কাটাবে?” আবার হাসির কলতান ওঠে।

তার পাশে ধীমান আর ঋতুপর্ণা। এইবারে মনীষা ঋতুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করে, “ট্রুথ অর ডেয়ার।” ঋতুপর্ণা উত্তরে ট্রুথ বলে। শ্রেয়া সঙ্গে সঙ্গে ওকে জিজ্ঞেস করে, “প্রথমবার তোর পেছনে কে ঢুকিয়েছিল?”

ঋতুপর্ণা লজ্জায় পড়ে ধীমানের দিকে তাকায়। ধীমান ভুরু কুঁচকে ওকে বলে, “আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে কি হবে ডারলিং, উত্তর দাও।”

ঋতুপর্ণা মাথা চুলকে মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দেয়, “নারসিং পড়ার সময়ে একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল, সঞ্জীব।”

সবাই হিহি করে হেসে ওঠে। ধীমান চোখ বড় বড় করে বলে, “ওই ছোট্ট বাঁড়া শেষ পর্যন্ত তোমার পেছনে ঢুকিয়েছিল?” ঋতুপর্ণা ওকে মারতে মারতে বলে, “উত্তর দিয়ে দিয়েছি ব্যাস আর নয়।”

এরপরে ধীমানের পালা, ধীমান সঙ্গে সঙ্গে ডেয়ার করতে রাজি হয়ে যায়। খেলা এইভাবে চলতে থাকে একের পর এক। প্রবালকে বলা হয়, সঙ্গীতার যোনি রসের ভিস্কোসিটি কত। জারিনাকে বলা হয়, পরাশরের লিঙ্গের ভলিউম মেপে জানাও। পায়েল বুঝতে পারে অঙ্কনকে ওরা সবাই বেশ ফাঁদে ফেলবে। এইভাবে এক এক করে সবাইকে বেশ বেকায়দায় ফেলে খেলা ঘুরে চলে।

খেলা চলতে চলতে অন্ধকার চিরে একটা ছেলের আবির্ভাব হয়। ভুর দেখার মতন সবাই চমকে ওঠে। ছেলেটা মনে হয় ওদের পোর্টার দলের কেউ, জ্যাকেট পরা, মাথায় টুপি।

দেবায়নকে এসে বলে, “বাবু কিছু টাকা চাই।”

দেবায়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “তুই কে?”

রঞ্জিত ওদের সঙ্গে ছিল না, অনেক আগেই খেয়ে দেয়ে নিজের তাঁবুতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছে। পোর্টারদের কারুর নামধাম ওদের জানা নেই। তাও ছেলেটাকে দেখে ওদের দলের পোর্টার বলেই মনে হয় দেবায়নের। ছেলেটা উত্তরে বলে ওদের দলের রাজু পোর্টার। মদ খাওয়ার জন্য একটু টাকা চায়।
দেবায়ন পকেট থেকে টাকা বের করে দিতে গেলে ছেলেটা বলে, “না বাবু, মানে আপনাকে একটু আমার সাথে আসতে হবে। মানে ওইদিকে আমাদের পোর্টার দলের সর্দার দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাতে টাকা দিলে ভালো।”

দেবায়ন অনুপমাকে কোল থেকে নামিয়ে বলে, “এই শোন আমি ওদের টাকা দিয়ে আসছি, ব্যাস এই যাবো আর আসবো।”

অনুপমা ওর হাত ধরে বলে, “তাড়াতাড়ি আসিস, তুই না থাকলে একদম ভালো লাগে না।”

ওর কপালে চুমু খেয়ে দেবায়ন চলে যায়। ট্রুথ আর ডেয়ার খেলা আবার শুরু হয়ে যায়। খেলা চলতে থাকে কিন্তু অনুপমার মন পড়ে থাকে দেবায়নের জন্য। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এখন আসার আর নাম নেই। কোথায় গেল ছেলেটা, বলে গেল এখুনি আসছি। বাকিরা এখন খেলায় মত্ত, কিন্তু অনুপমা বারেবারে দেবায়নের যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে দেখে। নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, পাহাড় থেকে ভেসে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওর মনের গভীরের উৎকণ্ঠা আরো চাগিয়ে দেয়। বারেবারে বাম হাতের অনামিকার জ্বলজ্বলে আংটির দিকে তাকায় আর পেছন ঘুরে যেদিকে দেবায়ন গেছে সেদিকে চেয়ে থাকে। সামনে আগুন জ্বলছে, সবাই বেশ মজা গল্প করছে কিন্তু অনুপমার মন আর কিছুতেই মানে না। পোর্টারদের টাকা দিতে এতো দেরি লাগে নাকি?

শ্রেয়া ওর পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, “কি রে মন খারাপ লাগছে নাকি?”

অনুপমা ম্লান হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে এতক্ষণ হয়ে গেল এখন আসছে না।” আরো কিছুক্ষণ কেটে যায়। দেবায়ন গেছে প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল, এতো দেরি করা উচিত নয়। শুধুমাত্র টাকা দেবে আর চলে আসবে। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে রূপক আর ধীমানকে বলে, “এই প্লিস তোরা একটু দেখে আয় না দেবু কোথায় গেছে।”

রূপক হেসে ওর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলে, “আরে বাবা এই নির্জন স্থানে আর কি হবে। শালা ওই পোর্টারদের সাথে হয়তো দেশী গিলতে বসে গেছে চলে আসবে।”
 
অনুপমা কাতর কণ্ঠে ওকে অনুরোধ করে, “প্লিস, একবার, এক ঘন্টা হয়ে গেল।”

ধীমান কিছু একটা বলতে যায়, ঋতুপর্ণা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “তোমাদের একবার যেতে কি হয়েছে? গিয়ে দেখো না দেবায়ন কোথায় গেল।”

পরাশর প্রবাল উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা আমরা যাচ্ছি।”

পরাশর চলে গেল, ধীমান রূপক চলে গেল। ওদের খেলা ভেঙে গেল। অনুপমা প্রবল উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়িয়ে যেদিকে ওরা গেছে সেদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। একপাশে পায়েল অন্য পাশে শ্রেয়া ওকে প্রবোধ দেয়, এই তো চলে আসবে এতো চিন্তা করছিস কেন? কিন্তু অনুপমার মন আর মানে না। বারেবারে আঙুলের আংটি ঘষে দেখে আর বুকের মধ্যে চেপে ধরে। হটাত করে এক দমক ঠাণ্ডা হাওয়া ওকে এসে কাঁপিয়ে দেয়।

অঙ্কন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দিদির সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “দিদিভাই দিদিভাই, দেবায়নদাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

শ্রেয়ার ভাবে অঙ্কন মজা করছে তাই জিজ্ঞেস করে, “কি উল্টোপাল্টা বলছিস তুই। কেন বেচারির সাথে এই সময়ে মজা করছিস?”

অনুপমা ওই কথা শুনে কেঁপে ওঠে, হটাত করে ওর বুক ফাঁকা হয়ে যায়। অঙ্কন হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের বলে, “দিদিভাই ওদিকে চলো...” বলে দুর নদীর দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।

আপনা হতেই অনুপমার হাত মুঠি হয়ে যায়, ওর চোখ জোড়া ভরে ওঠে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পুচ্চুকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কি বলতে চাইছে ভাই? না, মদ খেয়ে কিছু হয়ে গেল নাতো? যদি অঙ্কন মজার ছলে বলে থাকে তাহলে ওকে মেরে ফেলবে।

ধীমান এমন সময়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের কাছে আসতেই অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে ওকে জিজ্ঞেস করে, “দেবুকে পেলি?”

ধীমান মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “না রে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।”

শ্রেয়া ওকে জিজ্ঞেস করে, “রূপক আর শান্তনু কোথায়?”

ধীমান ওদের উত্তর দেয়, খাদের কিনারায়, নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা। খাদের কথা শুনে অনুপমার মাথা ঘুরে যায়, শরীর টলতে শুরু করে দেয়। না, এটা হতে পারে না। মাথার ওপরে আকাশ বনবন করে পাক খেতে শুরু করে, ধীমানের চেহারা, শ্রেয়া পায়েলের চেহারা ধীরে ধীরে কেমন আবছা হয়ে যায় অনুপমার চোখের সামনে। টলতে টলতে পড়ে যাওয়ার আগেই ধীমান ওকে ধরে ফেলে।

পর্ব সাতাশ সমাপ্ত।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top