পথে যেতে যেতে মিস্টার সেন বলেন, “কি ব্যাপার, টেন্সান নিচ্ছো কেন? এবারে একটু ফ্রাংক হও আমার সাথে। তুমি আমার উত্তরাধিকারী, আমার হবু জামাই। সবসময়ে আমার এক হাতের মধ্যে থাকবে তার বাইরে একদম যাবে না। সবসময়ে চোখ কান খোলা রেখে দেবে, এই রকম বিজনেস পার্টিতে খুব জরুরি। যদিও খুব কম সংখ্যক লোক আসবে।”
দেবায়নঃ “কে কে আসছে?”
মিস্টার সেনঃ “জার্মানিতে আমার এক বন্ধু থাকে অনিমেশ সাহা, সে আসছে। আসলে এই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট সেই যোগাড় করে দিয়েছে। মিস্টার ড্যানিয়েল হারজোগ আর তার সি.এফ.ও মিস্টার হেলমুট মেরকেল। নিবেদিতা থাকবে আমার তরফ থেকে। আসল প্রেসেন্টেসান আর বেশির ভাগ আলোচনা আগেই হয়ে গেছে। শুধু একবার কোম্পানি দেখতে চায় আর ভবিষ্যতের রোডম্যাপ জানতে চায় এই আর কি। আমার চাহিদা পাঁচশো মিলিয়ন ইউরো, চারশো কোটি টাকার ভেঞ্চার দেখা যাক কোথায় গিয়ে ঠেকে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কোম্পানি তো আড়াইশো কোটি টাকার?”
মিস্টার সেনঃ “হ্যাঁ জানি, তবে ওই সেদিন তোমাকে বলেছিলাম না, তিন ধরনের অডিট রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। যাই হোক, ভদ্রলোক বেশ ঘাঘু, মনে হয়না দেবে। ওদের ফাইনাল অফার সাড়ে তিনশো মিলিয়ন ইউরো, আজকের পার্টি তার জন্য, দেখা যাক কতদুর কি হয়।”
দেবায়নঃ “আমি এখানে কি করবো, বলতে পারেন?”
মিস্টার সেনঃ “তুমি কিছু করবে না, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এরপরে মানুষকে কি করে সামলাতে হয় সেটা এখন থেকেই জানা উচিত তোমার। কার সাথে কি ভাবে কথা বলবে, সামনের মানুষকে কি হিসাবে চিনবে। বুঝলে দেবায়ন, ব্যাবসায় মানুষ চার প্রকারের হয়। গরু, কুকুর, বাঘ আর শেয়াল। এই গরু প্রকৃতির মানুষ হচ্ছে নিরীহ, বুদ্ধিমান এবং আসল শিক্ষিত যাকে বলে। এই সব মানুষের সাথে ভালো ভাবে কথা বলবে, ভালো কাজ দেখাবে, ওদের মন জুগিয়ে চলবে দেখবে ওরা তোমার কাজ করে দেবে অথবা তোমাকে কাজ দিয়ে দেবে। তোমার কর্ম দক্ষতাকে ওরা সন্মান দেবে। দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষ হচ্ছে, কুকুর। ওরা সব সময়ে একটু কিছু চায়, কাজের চেয়ে বেশি চায় একটু তোষামোদি একটু উপহার। ওদের সামনে হাড্ডি রাখলেই ওরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে তোমার কাছে চলে আসবে। মানে ওদেরকে শুধু টাকা দেখিয়ে বশে আনতে পারবে। এদের চেনা বেশ সহজ, কেউ যদি তোমাকে বেশি স্যার স্যার করে, তাহলে বুঝবে সে কুকুর। তাকে টাকা দিয়ে, উপহার দিয়ে সহজে কাজ হাসিল করতে পারবে। সব থেকে কঠিন হচ্ছে এই বাঘ প্রকৃতির মানুষ। এরা শিক্ষিত, এরা পয়সাওয়ালা এরা আদব কায়দা জানা লোক। এরা সহজে গলে না, এদের সাথে মেপে কথা বলতে হয়, ডিপ্লোমেটিক হতে হয়, মন জুগিয়ে চলতে হয় আর ভালো সঙ্গ দিতে হয়। এরা প্রতিপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি। মডেল অথবা হাই ক্লাসের মেয়েদের দিকে এদের নজর নয়, এদের নজর অন্য দিকে। যেটা সহজে পাওয়া যায় না তার দিকে এদের নজর থাকে, সেটাই তারা চায়। বুঝলে কিছু?”
দেবায়ন বুঝতে পারে, কেন মিস্টার সেন পারমিতাকে কাজে লাগিয়েছিল। মনের ভেতরে হাসে দেবায়ন, পাশে বসার মানুষটার মুখোশ অনেকদিন আগেই খুলে গেছে, তাও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে কিঞ্চিত ঘৃণা বোধ জন্মায়। এই মানুষকে দিয়েই ওর কাজ হাসিল হবে, তাই মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিছু বুঝতে পেরেছি। সম্পন্ন বাড়ির ঘরোয়া মহিলা অথবা কোন নামি অভিনেত্রী চাই এদের।”
মিস্টার সেন বাঁকা হেসে বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরে গেছো তুমি। শেষে শেয়াল প্রকৃতির মানুষ। এরা হটাত করে বিত্ত আর শক্তি হাতে পেয়ে যায়। এরা খুব ধূর্ত কুটিল নেতা গোচরের মানুষ। এরা আগে ঠিকভাবে খেতেই পেতো না, কথাবার্তা ঠিক মতন বলতে জানে না, কিন্তু ওই শক্তি হাতে পাওয়ার পরে নিজেদের খুব বড় মনে করে। এদের যা দেবে তাই খাবে, এরা টাকা পয়সা খাবেই তাঁর সাথে মেয়ে দিতেও হয়। যে রকম মেয়ে দাও এদের চলে যায়। শুধু একটু গা গরম করা চাই এদের।”
দেবায়ন বাঁকা হেসে বলে, “হুম বুঝলাম। বেশ প্যাঁচ আছে এই ব্যাবসায় নামতে।”
মিস্টার সেন একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “জানো, নিবেদিতাকে নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেছি।”
দেবায়নঃ “আপনি বলেছিলেন যে পরমিতকে সরিয়ে দেবেন, নিবেদিতাকেও তাহলে সরিয়ে দেওয়া যায়।”
মিস্টার সেনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় দেবায়নের কথা শুনে, “না ব্যাপারটা সেরকম নয়। ঠিক তোমাকে বুঝিয়ে উঠাতে পারছি না। পরমিত দিল্লীতে থাকে, বোর্ড মিটিংয়ের সময়ে মাঝে মাঝে আসে কিন্তু প্রফিট নেবার সময়ে একদম ঠিক। নিবেদিতা কিছুতেই পরমিতকে দেখতে পারে না। নিবেদিতা কোম্পানির সব দেখা শুনা করে আর পঁচিশ পারসেন্ট। বেশ কয়েক বছর ধরে বলে আসছে ওর শেয়ার বাড়ানোর জন্য, কিন্তু তখন আমার কাছে অত টাকা ছিল না যে পরমিতের শেয়ার কিনে ফেলি। নিজের শেয়ার দিতে রাজি নয় মিতা। মিতার সাথেও বনে না নিবেদিতার। মিতা, কোম্পানির জন্য প্রচুর ক্লায়েন্ট যোগাড় করেছে, কিন্তু অফিসে যায় না, অফিসের গণ্ডগোলে মাথা ঘামায় না। সেই বুদ্ধি মিতার নেই। মিতা হচ্ছে গরু, ওকে একটু ভালোবেসে কথা বললে, একটু আদর দিলেই গলে যায়। তুমি সেদিন বলার পরে আমি ফিরে পেলাম ওকে। তাই এইসব থেকে ওকে দুরে সরিয়ে রাখার জন্য এবারের বিজনেস মিটিংয়ে ওকে আনিনি। ওইদিকে নিবেদিতা একটু রেগেই আছে। ও যে ফাইন্যান্সিয়ার এনেছিল তাকে আমি ইচ্ছে করেই নাকচ করে দিয়েছিলাম। ওকে পরমিতের শেয়ার দিলেও ওর মন একটু কেমন কেমন করে থাকবে। দেখা যাক আজকে কিছু বুঝিয়ে উঠতে পারি কিনা। নিবেদিতা একা ছোটো ছেলেকে নিয়ে থাকে, ওকে কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, এই জার্মান ভদ্রলোক কেন, মানে বিদেশি ফাইন্যান্সিয়ার কেন?”
মিস্টার সেন হেসে বলেন, “অনেক দুরের চিন্তা করেই আমি অনিমেশকে একটা ক্যাপিটালিস্ট খুঁজতে বলি। তোমার সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজে দেবে। বাইরের বড় বড় প্রোজেক্ট আসবে ওর হাত ধরে, তুমি একটু মিস্টার হারজোগকে হাতে করার চেষ্টা কর। দেশে যে সব প্রোজেক্ট পাবে তাতে মাসের খরচ, দৈনন্দিন খরচ উঠে আসবে। যতক্ষণ না কোন বড় প্রোজেক্ট হাতে পাবে ততক্ষণ তোমার কোম্পানির নাম হবে না। বড় প্রোজেক্ট মানে বেশি লাভ, বেশি টাকা। বাইরের বড় প্রোজেক্ট পাওয়ার জন্য একজন বাইরের মানুষের দরকার। ইউরোপে আমার বিশেষ জানাশোনা নেই আমার। অনুর মেসো ডাক্তার, ছেলে ডাক্তার ওদের দিয়ে এইসব কাজ হবে না। অনিমেশ ফ্রাংকফারটে বেশ বড় একটা ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কে চাকরি করে, বেশ বড় পোস্টে। অনেক চেনা জানা আছে, সেই সুত্রে বেরিয়ে গেল এই হারজোগের কথা। আর এই হারজোগ হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। অনেক কিছুতে হাত ডুবিয়ে টাকা কামিয়েছে। ওর অনেক চেনাজানা আছে ইউরোপে।”
দেবায়নঃ “আপনি এতো কিছু এতো আগে থেকে ভেবে রেখেছেন?”
মিস্টার সেনঃ “ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রাখতে হয় না হলে কি করে হবে। যদি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন না দেখি তাহলে উড়তে পারবো কি করে, মিস্টার বসাক।”
শীত কাল, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসে গঙ্গাবক্ষে। মিস্টার সেন, নিবেদিতা আর বেশ কয়েক জনকে ফোন করে জেনে নিলেন তারা কোথায়। নিবেদিতা জানাল তিনি পৌঁছে গেছেন, অনিমেশ রাস্তায়, বাকিদের নিয়ে আসছে। বাকিরা পরে রওনা দেবে কোলকাতা থেকে। সন্ধ্যের একটু পরেই মিস্টার সেন আর দেবায়ন রায়চক, গঙ্গার ধারে র্যাডিসন ফোর্ট রিসোর্টে পৌঁছে যায়। ওদের নামে ছয় খানা রুম বুক করাছিল আগে থেকে। ম্যানেজার নিজে এসে, ডাইনিং আর মিটিংয়ের জায়গা দেখিয়ে দেয়। গঙ্গার পাশেই বেশ বড় হোটেল, উঁচু দেয়ালের পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা লন। তার একপাশে খোলা আকাশের নিচে মিটিংয়ের ব্যাবস্থা আর ডিনার। মিস্টার সেন, দেবায়নকে বলে একবার ম্যানেজারের সাথে গিয়ে রুমগুলো দেখে আসতে আর মিটিংয়ের জায়গা দেখে আসতে।
দেবায়ন এগিয়ে যেতেই এক মহিলা হাসি হাসি মুখে মিস্টার সেনের দিকে এগিয়ে আসে। ফর্সা সুন্দরী, আকর্ষণীয়, চোখে মুখে বুদ্ধিদিপ্তের ছটা। বয়স পঁয়ত্রিশের ওপারে নয়, দেহের গঠন বেশ আকর্ষণীয়। ঘিয়ে রঙের বিজনেস সুট আর খোঁপাতে দারুন দেখাচ্ছে মহিলাকে। মহিলার আদব কায়দা দেখে দেবায়ন বুঝতে পারে এই নিবেদিতা।
নিবেদিতা মিস্টার সেনকে দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতো দেরি করে দিলে? শরীর কেমন আছে তোমার?”
মিস্টার সেন হেসে বলেন, “হ্যাঁ শরীর ঠিক আছে। দুই দিনে আর নতুন কি হবে। অঙ্কুশ আসতে চায়নি?”
নিবেদিতা একগাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, বায়না ধরেছিল। বাবার মাথার বাকি চুল ছিঁড়ে ফেলেছে আর কি। আমি বাবাকে আর চাকরকে বলে এসেছি যে বেশি কান্নাকাটি করলে টিভি চালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”
দেবায়নঃ “কে কে আসছে?”
মিস্টার সেনঃ “জার্মানিতে আমার এক বন্ধু থাকে অনিমেশ সাহা, সে আসছে। আসলে এই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট সেই যোগাড় করে দিয়েছে। মিস্টার ড্যানিয়েল হারজোগ আর তার সি.এফ.ও মিস্টার হেলমুট মেরকেল। নিবেদিতা থাকবে আমার তরফ থেকে। আসল প্রেসেন্টেসান আর বেশির ভাগ আলোচনা আগেই হয়ে গেছে। শুধু একবার কোম্পানি দেখতে চায় আর ভবিষ্যতের রোডম্যাপ জানতে চায় এই আর কি। আমার চাহিদা পাঁচশো মিলিয়ন ইউরো, চারশো কোটি টাকার ভেঞ্চার দেখা যাক কোথায় গিয়ে ঠেকে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কোম্পানি তো আড়াইশো কোটি টাকার?”
মিস্টার সেনঃ “হ্যাঁ জানি, তবে ওই সেদিন তোমাকে বলেছিলাম না, তিন ধরনের অডিট রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। যাই হোক, ভদ্রলোক বেশ ঘাঘু, মনে হয়না দেবে। ওদের ফাইনাল অফার সাড়ে তিনশো মিলিয়ন ইউরো, আজকের পার্টি তার জন্য, দেখা যাক কতদুর কি হয়।”
দেবায়নঃ “আমি এখানে কি করবো, বলতে পারেন?”
মিস্টার সেনঃ “তুমি কিছু করবে না, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। এরপরে মানুষকে কি করে সামলাতে হয় সেটা এখন থেকেই জানা উচিত তোমার। কার সাথে কি ভাবে কথা বলবে, সামনের মানুষকে কি হিসাবে চিনবে। বুঝলে দেবায়ন, ব্যাবসায় মানুষ চার প্রকারের হয়। গরু, কুকুর, বাঘ আর শেয়াল। এই গরু প্রকৃতির মানুষ হচ্ছে নিরীহ, বুদ্ধিমান এবং আসল শিক্ষিত যাকে বলে। এই সব মানুষের সাথে ভালো ভাবে কথা বলবে, ভালো কাজ দেখাবে, ওদের মন জুগিয়ে চলবে দেখবে ওরা তোমার কাজ করে দেবে অথবা তোমাকে কাজ দিয়ে দেবে। তোমার কর্ম দক্ষতাকে ওরা সন্মান দেবে। দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষ হচ্ছে, কুকুর। ওরা সব সময়ে একটু কিছু চায়, কাজের চেয়ে বেশি চায় একটু তোষামোদি একটু উপহার। ওদের সামনে হাড্ডি রাখলেই ওরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে তোমার কাছে চলে আসবে। মানে ওদেরকে শুধু টাকা দেখিয়ে বশে আনতে পারবে। এদের চেনা বেশ সহজ, কেউ যদি তোমাকে বেশি স্যার স্যার করে, তাহলে বুঝবে সে কুকুর। তাকে টাকা দিয়ে, উপহার দিয়ে সহজে কাজ হাসিল করতে পারবে। সব থেকে কঠিন হচ্ছে এই বাঘ প্রকৃতির মানুষ। এরা শিক্ষিত, এরা পয়সাওয়ালা এরা আদব কায়দা জানা লোক। এরা সহজে গলে না, এদের সাথে মেপে কথা বলতে হয়, ডিপ্লোমেটিক হতে হয়, মন জুগিয়ে চলতে হয় আর ভালো সঙ্গ দিতে হয়। এরা প্রতিপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি। মডেল অথবা হাই ক্লাসের মেয়েদের দিকে এদের নজর নয়, এদের নজর অন্য দিকে। যেটা সহজে পাওয়া যায় না তার দিকে এদের নজর থাকে, সেটাই তারা চায়। বুঝলে কিছু?”
দেবায়ন বুঝতে পারে, কেন মিস্টার সেন পারমিতাকে কাজে লাগিয়েছিল। মনের ভেতরে হাসে দেবায়ন, পাশে বসার মানুষটার মুখোশ অনেকদিন আগেই খুলে গেছে, তাও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে কিঞ্চিত ঘৃণা বোধ জন্মায়। এই মানুষকে দিয়েই ওর কাজ হাসিল হবে, তাই মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিছু বুঝতে পেরেছি। সম্পন্ন বাড়ির ঘরোয়া মহিলা অথবা কোন নামি অভিনেত্রী চাই এদের।”
মিস্টার সেন বাঁকা হেসে বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরে গেছো তুমি। শেষে শেয়াল প্রকৃতির মানুষ। এরা হটাত করে বিত্ত আর শক্তি হাতে পেয়ে যায়। এরা খুব ধূর্ত কুটিল নেতা গোচরের মানুষ। এরা আগে ঠিকভাবে খেতেই পেতো না, কথাবার্তা ঠিক মতন বলতে জানে না, কিন্তু ওই শক্তি হাতে পাওয়ার পরে নিজেদের খুব বড় মনে করে। এদের যা দেবে তাই খাবে, এরা টাকা পয়সা খাবেই তাঁর সাথে মেয়ে দিতেও হয়। যে রকম মেয়ে দাও এদের চলে যায়। শুধু একটু গা গরম করা চাই এদের।”
দেবায়ন বাঁকা হেসে বলে, “হুম বুঝলাম। বেশ প্যাঁচ আছে এই ব্যাবসায় নামতে।”
মিস্টার সেন একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “জানো, নিবেদিতাকে নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেছি।”
দেবায়নঃ “আপনি বলেছিলেন যে পরমিতকে সরিয়ে দেবেন, নিবেদিতাকেও তাহলে সরিয়ে দেওয়া যায়।”
মিস্টার সেনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় দেবায়নের কথা শুনে, “না ব্যাপারটা সেরকম নয়। ঠিক তোমাকে বুঝিয়ে উঠাতে পারছি না। পরমিত দিল্লীতে থাকে, বোর্ড মিটিংয়ের সময়ে মাঝে মাঝে আসে কিন্তু প্রফিট নেবার সময়ে একদম ঠিক। নিবেদিতা কিছুতেই পরমিতকে দেখতে পারে না। নিবেদিতা কোম্পানির সব দেখা শুনা করে আর পঁচিশ পারসেন্ট। বেশ কয়েক বছর ধরে বলে আসছে ওর শেয়ার বাড়ানোর জন্য, কিন্তু তখন আমার কাছে অত টাকা ছিল না যে পরমিতের শেয়ার কিনে ফেলি। নিজের শেয়ার দিতে রাজি নয় মিতা। মিতার সাথেও বনে না নিবেদিতার। মিতা, কোম্পানির জন্য প্রচুর ক্লায়েন্ট যোগাড় করেছে, কিন্তু অফিসে যায় না, অফিসের গণ্ডগোলে মাথা ঘামায় না। সেই বুদ্ধি মিতার নেই। মিতা হচ্ছে গরু, ওকে একটু ভালোবেসে কথা বললে, একটু আদর দিলেই গলে যায়। তুমি সেদিন বলার পরে আমি ফিরে পেলাম ওকে। তাই এইসব থেকে ওকে দুরে সরিয়ে রাখার জন্য এবারের বিজনেস মিটিংয়ে ওকে আনিনি। ওইদিকে নিবেদিতা একটু রেগেই আছে। ও যে ফাইন্যান্সিয়ার এনেছিল তাকে আমি ইচ্ছে করেই নাকচ করে দিয়েছিলাম। ওকে পরমিতের শেয়ার দিলেও ওর মন একটু কেমন কেমন করে থাকবে। দেখা যাক আজকে কিছু বুঝিয়ে উঠতে পারি কিনা। নিবেদিতা একা ছোটো ছেলেকে নিয়ে থাকে, ওকে কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, এই জার্মান ভদ্রলোক কেন, মানে বিদেশি ফাইন্যান্সিয়ার কেন?”
মিস্টার সেন হেসে বলেন, “অনেক দুরের চিন্তা করেই আমি অনিমেশকে একটা ক্যাপিটালিস্ট খুঁজতে বলি। তোমার সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজে দেবে। বাইরের বড় বড় প্রোজেক্ট আসবে ওর হাত ধরে, তুমি একটু মিস্টার হারজোগকে হাতে করার চেষ্টা কর। দেশে যে সব প্রোজেক্ট পাবে তাতে মাসের খরচ, দৈনন্দিন খরচ উঠে আসবে। যতক্ষণ না কোন বড় প্রোজেক্ট হাতে পাবে ততক্ষণ তোমার কোম্পানির নাম হবে না। বড় প্রোজেক্ট মানে বেশি লাভ, বেশি টাকা। বাইরের বড় প্রোজেক্ট পাওয়ার জন্য একজন বাইরের মানুষের দরকার। ইউরোপে আমার বিশেষ জানাশোনা নেই আমার। অনুর মেসো ডাক্তার, ছেলে ডাক্তার ওদের দিয়ে এইসব কাজ হবে না। অনিমেশ ফ্রাংকফারটে বেশ বড় একটা ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কে চাকরি করে, বেশ বড় পোস্টে। অনেক চেনা জানা আছে, সেই সুত্রে বেরিয়ে গেল এই হারজোগের কথা। আর এই হারজোগ হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। অনেক কিছুতে হাত ডুবিয়ে টাকা কামিয়েছে। ওর অনেক চেনাজানা আছে ইউরোপে।”
দেবায়নঃ “আপনি এতো কিছু এতো আগে থেকে ভেবে রেখেছেন?”
মিস্টার সেনঃ “ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রাখতে হয় না হলে কি করে হবে। যদি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন না দেখি তাহলে উড়তে পারবো কি করে, মিস্টার বসাক।”
শীত কাল, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসে গঙ্গাবক্ষে। মিস্টার সেন, নিবেদিতা আর বেশ কয়েক জনকে ফোন করে জেনে নিলেন তারা কোথায়। নিবেদিতা জানাল তিনি পৌঁছে গেছেন, অনিমেশ রাস্তায়, বাকিদের নিয়ে আসছে। বাকিরা পরে রওনা দেবে কোলকাতা থেকে। সন্ধ্যের একটু পরেই মিস্টার সেন আর দেবায়ন রায়চক, গঙ্গার ধারে র্যাডিসন ফোর্ট রিসোর্টে পৌঁছে যায়। ওদের নামে ছয় খানা রুম বুক করাছিল আগে থেকে। ম্যানেজার নিজে এসে, ডাইনিং আর মিটিংয়ের জায়গা দেখিয়ে দেয়। গঙ্গার পাশেই বেশ বড় হোটেল, উঁচু দেয়ালের পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা লন। তার একপাশে খোলা আকাশের নিচে মিটিংয়ের ব্যাবস্থা আর ডিনার। মিস্টার সেন, দেবায়নকে বলে একবার ম্যানেজারের সাথে গিয়ে রুমগুলো দেখে আসতে আর মিটিংয়ের জায়গা দেখে আসতে।
দেবায়ন এগিয়ে যেতেই এক মহিলা হাসি হাসি মুখে মিস্টার সেনের দিকে এগিয়ে আসে। ফর্সা সুন্দরী, আকর্ষণীয়, চোখে মুখে বুদ্ধিদিপ্তের ছটা। বয়স পঁয়ত্রিশের ওপারে নয়, দেহের গঠন বেশ আকর্ষণীয়। ঘিয়ে রঙের বিজনেস সুট আর খোঁপাতে দারুন দেখাচ্ছে মহিলাকে। মহিলার আদব কায়দা দেখে দেবায়ন বুঝতে পারে এই নিবেদিতা।
নিবেদিতা মিস্টার সেনকে দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতো দেরি করে দিলে? শরীর কেমন আছে তোমার?”
মিস্টার সেন হেসে বলেন, “হ্যাঁ শরীর ঠিক আছে। দুই দিনে আর নতুন কি হবে। অঙ্কুশ আসতে চায়নি?”
নিবেদিতা একগাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, বায়না ধরেছিল। বাবার মাথার বাকি চুল ছিঁড়ে ফেলেছে আর কি। আমি বাবাকে আর চাকরকে বলে এসেছি যে বেশি কান্নাকাটি করলে টিভি চালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”