What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (9 Viewers)

অগ্নিহোত্রী শেষ পর্যন্ত সত্যি কথা বলে, “আসলে আমি পায়েলকে ভুলিয়ে বিয়ে করার মতলবে ছিলাম। বিনয়ের মুখে শুনেছিলাম ওদের বিশাল বাড়ি, সেই বাড়ির দাম প্রায় এক কোটির মতন। আমি বিয়ে করার পরে পায়েলকে বেশ কয়েক মাস ভোগ করতাম আর তারপরে বাড়ি পেয়ে গেলে পায়েলকে বিক্রি করার মতলবে ছিলাম। আমরা পায়েলকে এখানে এনে ওকে খাবার দাবার দিয়ে সুস্থ করে তারপরে একটু ভোগ করার মতলবে ছিলাম। কারন পায়েলের যা অবস্থা ছিল তাতে ওকে ভোগ করার মতন কিছু ছিল না, হয়তো মরেই যেতো। ওকে এতো তাড়াতাড়ি আমরা মারতে চাইনি।”

দেবায়ন ঘুরিয়ে এক ঘুসি মারে অগ্নিহোত্রীর মুখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় অগ্নিহোত্রীর মুখ থেকে। রুদ্র রাগে কাঁপতে কাঁপতে অগ্নিহোত্রীর গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে গর্জে ওঠে, “অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিস তুই। কালকের সূর্য দেখতে পাবি না, এটা আমি বলছি। তোকে মেরে ফেললে ভাববো যে পৃথিবী থেকে একটা পাপ কম হয়েছে।”

প্রচন্ড মার খেয়ে মেঝেতে পড়ে কুঁকড়ে যায় অগ্নিহোত্রী। দেবায়ন অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে বলে, “তোরা অনেক পাপ করেছিস। পায়েলকে অনেক কষ্ট দিয়েছিস এমন কি খুন করতে চেষ্টা করেছিস। তবে একজন আরও আছে যার সাজা পাওয়া উচিত। পায়েলের বাবা, ডক্টর কমলেশ সান্যাল।” রূপক আর রুদ্র জিজ্ঞাসু চোখে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেবায়ন বলে, “ওর বাবা, সুজাতা কাকিমাকে মেরেছে। পুলিস খুঁজে কোন প্রমান পাবে না কেননা তোরা কাকিমাকে পুড়িয়ে দিয়েছিস আর সব প্রমান শেষ করে দিয়েছিস।”

বিনয় মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ। মামিমার ডেথ সারটিফিকেটে হার্ট এটাক লেখা।”

দেবায়ন বলে, “পায়েলের বাবাকে মারতে হবে তোদের।”

রুদ্র আর রূপক হাঁ করে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেটা কি করে সম্ভব?”

দেবায়ন বলে, “সব সম্ভব হবে। তার আগে পায়েলের বাড়ির দলিল আমার চাই। পায়েলের ভবিষ্যৎ আমার চাই।”

বিনয়ঃ “পায়েলের বাড়ির দলিল আমি নিয়ে আসছি এখুনি, আমাদের ছেড়ে দে। আমরা কথা দিচ্ছি কোনদিন পায়েল কেন, মামাবাড়ির মুখ দেখবো না।”

দেবায়নঃ “উঁহু, তোদের ছেড়ে দিলে পাপ হবে। সুজাতা কাকিমার আত্মা শান্তি পাবে না।”

রূপক গর্জে ওঠে, “তোদের ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। পায়েলকে যেমন ভাবে কষ্ট দিয়েছিস, তারপরে তোদের মরে যাওয়া উচিত।”

দেবায়নঃ “বিনয় আমাদের কাছে বাঁধা থাকবে। অগ্নিহোত্রী ঢুকবে বিনয়ের বাড়িতে, আগে ওই দলিল এনে আমাকে দেবে, তারপরে পায়েলের বাবাকে খুন করবে অগ্নিহোত্রী।”

বিনয় আর অগ্নিহোত্রী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, “না খুন আমাদের দ্বারা হবে না।”

রূপক বিনয়কে এক লাথি মেরে বলে, “খুনের চেয়ে বড় পাপ, এমন ভাবে ধরে রেখে একজনকে কষ্ট দেওয়া। জ্যান্ত একটা মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তার আত্মাকে মেরে ফেলা। তোরা পায়েলকে এক রকম মেরেই ফেলেছিলিস, ওই দিকে তোর মামা তোর মামীকে মেরে ফেলেছে। তোরা সবাই দোষী। দেবায়ন যা বলছে সেটা কর। এমনিতেও তোরা ধরা পড়বি, কেননা পায়েলকে দেখে পুলিস কেস হবে। পায়েল পুলিসকে সব বলে দেবে।”

অগ্নিহোত্রী বলে, “আচ্ছা যদি খুন করি ওর মামাকে তাহলে আমাদের ছেড়ে দেবে তোমরা।”

দেবায়ন হেসে বলে, “আমি ছেড়ে দেবো।”

রূপক আর রুদ্র, রেগে যায় দেবায়নের ওপরে, “তুই কি বলছিস? এদের ছেড়ে কেন দেবো? না মারলেও পুলিসের হাতে দেবো।”

দেবায়ন রূপক আর রুদ্রকে শান্ত করে বলে, “আগে আমার কাজ শেষ হোক তারপরে দেখছি।” অগ্নিহোত্রীকে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তোর বাবা বেশ বড়োলোক। তার মানে তোদের বাড়িতে নগদ টাকা আছে?”

অগ্নিহোত্রীঃ “হ্যাঁ আছে, তোমাদের কত টাকা চাই বল, আমি দেবো। এক লাখ, দুই লাখ পাঁচ লাখ? এই পুজোর মরশুমে কাপড়ের ব্যাবসা দারুন চলেছে। বাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা ক্যাস পড়ে আছে, আমি বাবার দেরাজ খুলে সব টাকা চুরি করে আনতে পারি এখুনি। সব টাকা তোমাকে দিয়ে দেবো যদি আমাদের ছেড়ে দাও।”

দেবায়ন হাসতে হাসতে বলে, “হ্যাঁ, আমার টাকা চাই। বিনয় যাবে তোর বাড়িতে টাকা চুরি করতে আর অগ্নিহোত্রী যাবে বিনয়ের বাড়িতে পায়েলের বাবাকে মারতে। তারপরে তোদের ছেড়ে দেবো আমি। এবারে বল, কার বাড়িতে কি করে ঢুকতে হয়?”

অগ্নিহোত্রী বিনয়কে বুঝিয়ে বলে, “ওই দু’তলার আমার রুমের জানালার একটা শিক খুলে যায়। সেই শিক সরিয়ে আমার রুমে ঢুকে যাবি। তারপরে নিচে চলে যাবি সিঁড়ি বেয়ে। বাবার রুম দেখেছিস তুই, বাবার কোমরে দেরাজের চাবি থাকে একটা দড়িতে বাঁধা। বাবা এখন আফিং মেরে মড়ার মতন ঘুমাচ্ছে। আমার টেবিলে কাঁচি পেয়ে যাবি, সেই কাঁচি দিয়ে খুব সহজে ওই দড়ি কেটে চাবি নিয়ে নিবি। বাবার মাথার কাছে যে দেরাজ আছে, তার নিচের তাকে একটা সিন্দুক দেখতে পাবি। চাবির থোকায়, সব থেকে বড় চাবিটা ওই সিন্দুকের। ওর মধ্যে পেয়ে যাবি পাঁচ লাখ টাকা।”
 
বিনয় দেবায়নকে বলে, “ওই টাকা দিলে আমাদের ছেড়ে দেবে তো?”

দেবায়ন বলে, “আগে অগ্নিহোত্রী পায়েলের বাবাকে খুন করে আসুক তারপরে।” অগ্নিহোত্রীকে বলে, “তুই আগে বিনয়ের বাড়িতে ঢুকে পায়েলের বাড়ির দলিল আমার হাতে এনে দিবি। তারপরে আবার ঢুকে পায়েলের বাবাকে খুন করে বেরিয়ে আসবি। পায়েলের বাবাকে যে খুন করেছিস তার প্রমান স্বরুপ ওই মৃতদেহের ছবি তুই তোর মোবাইলে তুলে আনবি। ছুরি মারিস না, তাতে চেঁচামেচি হবে তুই ধরা পড়ে যাবি। পায়েলের বাবার মুখের উপরে বালিস চাপা দিয়ে মারবি। আর সব ঘটনা মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়ে আসবি।”

অগ্নিহোত্রীঃ “ঠিক আছে তাই হবে, কিন্তু আমাদের ছেড়ে দিতে হবে তারপরে।”

দেবায়ন বিনয়কে বলে, “আগে বল কি করে তোর বাড়িতে ঢোকা যায়? কোথায় পায়েলের বাড়ির দলিল? কোথায় পায়েলের বাবা ঘুমিয়ে আছে?”

বিনয় বলে, “মামা নিচের ঘরে ধুমিয়ে। মামার ঘরের পাশেই আমার ঘর। দলিল আমার আলমারিতে রাখা, আলমারিতে কোন তালা দেওয়া নেই, সুতরাং দলিল আনতে কোন কষ্ট হবে না। মামা ঘরের দরজা ভেজানো থাকে, সহজে খুলে যাবে। আমার বাড়িতে ঢুকতে হলে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছনের দরজায় শুধু খিল দেওয়া আছে, তালা মারা নেই। একটা তার দরজায় ঢুকিয়ে দিয়ে, একটু উপরের দিকে টান মারলে খিল খুলে যাবে আর অতি সহজে বাড়িতে ঢোকা যাবে।”

পরিকল্পনা মতন রুদ্র আর রূপক, বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে আবার বেঁধে ফেলে। রুদ্র ওর বন্ধুদের ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে আসে। ওর বন্ধুরা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার। রুদ্র সংক্ষেপে সব ঘটনা বলে, দেবায়নের পরিকল্পনার কথা বলে। রুদ্রের বন্ধুরা, ওদের ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে দেবায়নের ওপরে রেগে যায়। ওদের মধ্যে রুদ্রের এক বন্ধু, দেবাশিস, সে একটা খাঁড়া হাতে নিয়ে এসেছিল। তার রাগ অগ্নিহোত্রীর ওপরে বেশি ছিল। সে বলে, অগ্নিহোত্রীকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, ওকে খুন করবে। দেবায়ন সবাইকে ঠাণ্ডা করে বলে ওর কাজ এখন শেষ হয়নি। পরে জানাবে ওর পরিকল্পনা।

ছেলেরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে রাতের ঘন অন্ধকারে, বিনয়ের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাত প্রায় তিনটে বাজে। তখন পর্যন্ত ধিমানের ফোন পায়নি। দেবায়ন একটু চিন্তিত, কি হলো ওদের সাথে। কিন্তু গাড়িতে কারুর কাছে ফোন নেই যে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে কত দূর পৌঁছেছে। দলের সব থেকে আগে, দেবাশিসে খাঁড়া নিয়ে হাঁটছে, মাঝখানে বাকি ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর মুখ হাত বেঁধে একরকম টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। রুদ্র, রূপক আর দেবায়ন দলের সব থেকে পেছনে।

রূপক আর থাকতে না পেরে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই মাদারচোদ শেষ পর্যন্ত টাকার জন্য ওদের ছেড়ে দিবি? তুই শালা আরো জাত শয়তান।”

দেবায়ন রূপকের কাঁধে হাত রেখে শান্ত করে বলে, “আমি ছেড়ে দেবো বলেছি। কিন্তু পায়েল তোর বান্ধবী, তুই ছেড়ে দিবি বা রুদ্র ছেড়ে দেবে, সেই কথা কি কেউ ওদের বলেছে?”

রুদ্র হেসে বলে, “তোর শালা শকুনের মাথা।”

রূপক বলে, “না রে। এই ছেলেটা না হলে অনেক কিছুই হতো না। এর মাথা শকুনের নয়, এ শালা অনেক বুদ্ধি ধরে। যাই হোক, টাকা গুলোর কি হবে?”

দেবায়ন রুদ্রকে বলে, “দেখো, বিনয় আর অগ্নিহোত্রী পায়েলকে ধরে রেখেছে। আইনের চোখে ওদের এমন কিছু বড় সাজা হবে না। ওদের সাজা আমরাই দেবো। কাছেই গঙ্গা তাই তো?” রুদ্র মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” দেবায়ন বলে, “ওর পাশে নিশ্চয় পুরনো কোন কারখানা থাকবে। যেমন ইঁট ভাটা অথবা লোহার কারখানা অথবা পাটের কারখানা?” রুদ্র মাথা নাড়িয়ে জানায়, গঙ্গার পাড়ে বেশ কয়েকটা খালি পুরনো কারখানা আছে। সেখানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। দেবায়ন পরবর্তী পরিকল্পনা জানায়, “ওই দুইজনকে ওইখানে নিয়ে গিয়ে দুই জনের হাতে ছুরি দিয়ে বলা হবে পরস্পরকে খুন কর। যদি ওরা পরস্পরকে খুন না করে তাহলে ওদের গলায় পাথর বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে ব্যারাকপুর। ওইখানে ওদেরকে গঙ্গায় ডুবিয়ে দেবো আর টাকা ডুবিয়ে দেবো। আর যদি এখানে খুন করে তাহলে সব টাকা জ্বালিয়ে দেবো সেখানে। কেউ যদি দেখে তাহলে এই ভাববে, যে টাকার জন্য একে অপরকে খুন করেছে। সকালে এক বাড়ির লোক জেগে দেখবে যে পায়েলের বাবা খুন হয়েছে। অন্য বাড়ি জেগে দেখবে যে পাঁচ লাখ টাকা চুরি গেছে। বাড়ির দুই ছেলেই নেই, পুলিস আসবে। ছেলেদের খোঁজ করা হবে। খুঁজে পাবে গঙ্গার ধারে দুটি লাশ আর পোড়া টাকা। অগ্নিহোত্রীর মোবাইলে পেয়ে যাবে পায়েলের বাবাকে কি ভাবে খুন করা হয়েছে। কেমন লাগলো আমার পরিকল্পনা?”

রূপক, দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে বলে, “গুরু, তোর পোঁদ মেরে একদিন তোকে সুখ দেবো বাঞ্চোত।”

দেবায়ন বলে, “সমস্যা এখানেই শেষ নয় গুরু। পায়েলের বাবার খুন হবার পরে, পায়েলের পিসি পায়েলকে খুঁজতে কোলকাতা আসবে। এইখানে ততক্ষণে পুলিস কেস হয়ে যাবে। পায়েলের বাবা নিশ্চয় পায়েলের পিসিকে অনুপমা আর অঙ্কনের কথা বলেছে। সুতরাং পুলিস পায়েলের খোঁজে অনুপমার বাড়িতে আসতে পারে। সুতরাং পায়েলকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। শেষ সম্বল আমাদের এই রেকর্ড করা ভিডিও। পায়েলকে নিয়ে আর টানাটানি নয়। ওর পিসিকে বলবো যে পায়েলের ধারে কাছে আসলে এই ভিডিও পুলিসের হাতে তুলে দেবো। পায়েলের জীবনে কেউ আর বাধা হয়ে আসবে না।”

কল্যাণী হাইওয়ের কাছে আসতেই রুদ্রের ফোন বেজে ওঠে। ওপাশে পরাশরের গলা পেয়ে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার।

পরাশর বলে, “হ্যাঁ সব ঠিক আছে। আমি ওদের পেয়ে গেছি। পায়েলকে আব্বাজান একটা প্রাইভেট নারসিং হোমে নিয়ে গেছে। স্যালাইন চলছে। অবস্থা একটু সঙ্গিন তবে বেঁচে যাবে।” পরাশরের কথা শুনে দেবায়নার রূপকের মনে শান্তি হয়।

দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “অনু কোথায়?”

পরাশরঃ “অনুপমা পায়েলের পাশে বসে। কিছুতেই বেডের পাশ থেকে ওঠানো যাচ্ছে না। তোর মা, মানে কাকিমা ফোন করে করে হয়রান। আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম যে সব ঠিক আছে, তাও কাকিমা জেদ করে। শেষ পর্যন্ত কাকিমাকে নারসিং হোমে নিয়ে আসতে হলো। কাকিমাকে পেয়ে অনুপমা এখন একটু ঠিক আছে। অঙ্কন বেশ ভেঙে পড়েছে।” পরাশর তারপরে গলা নিচু করে বলে, “শালা কেস খেয়ে গেছি।” দেবায়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাল, কি করেছিস তুই?”

পরাশরঃ “শালা এতো রাতে বাড়ি থেকে বার হওয়াতে বাবা মায়ের সন্দেহ হয়। জিজ্ঞেস করে কারন, আমি আমতা আমতা করি। ততক্ষণে কাকা চলে আসে। কাকা চেপে ধরে আমাকে।”

পরাশরের হাত থেকে ফোন নিয়ে ওর কাকা, ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন বলে, “শোনো দেবায়ন, এমন কিছু করবে না যাতে তোমরা মুশকিলে পড়ো। তুমি ওদের ধরে থাকো, আমি এক ঘন্টার মধ্যে ফোর্স নিয়ে পৌঁছে যাবো। আমি ধিমান আর ঋতুপর্ণার মুখ থেকে সব ঘটনা শুনেছি, পায়েলেকে দেখেছি। তুমি চিন্তা কোরো না, এটা পুলিস কেস। এখান থেকে পুলিসকে হ্যান্ডেল করতে দাও।”

দেবায়ন চিবিয়ে বলে, “এতদিন পায়েল যখন বেপাত্তা ছিল তখন পুলিস কিছু করেনি। পুলিসের কাছে গেলে পায়েলের কিছুই হতো না। সুজাতা কাকিমা আজ বেঁচে থাকতেন আর পায়েলের এই দুর্দশা হতো না। সব শেষ হয়ে যাবার পরে পুলিস কি করবে? আমি পুলিস চাই না, এইখানে এদের খুন করবো আমি। আপনার যা করার আছে করে নিন।”
 
নিরঞ্জন বাবু কড়া কণ্ঠে ধমকে বলেন, “কিছু করবে না। আমি নৈহাটি থানার ওসিকে ফোন করে দিয়েছি, ওরা এতক্ষণে বিনয়ের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তোমরা এক পা এগোলে তোমাদের ধরবে। তোমরা কোথায় আছো সেটা বলো?”

দেবায়ন আসেপাশের সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিয়ে পরাশরের কাকাকে বলে, “কেন বলবো আমরা কোথায় আছি? আমরা অনুপমার বাড়িতে আড্ডা মারছি। কোন প্রমান আছে আপনার কাছে যে আমরা নৈহাটিতে? আমি জানি আপনার কাছে কোন প্রমান নেই। বাড়ির সবাই এক কথায় বলবে যে আমরা অনুপমার বাড়িতে আড্ডা মারছি। আমাদের অ্যালিবাই আছে, আপনার পুলিস আমাদের চুলের ডগা ধরতে পারবে না। কয়জনকে ধরবেন আপনি?”

ইন্সপেটর নিরঞ্জন আহত কণ্ঠে বলেন, “আমি জানি, তোমার বিরুদ্ধে কোন প্রমান আমি পাবো না তবে তুমি কেন একজনের রক্তে নিজের হাত নোংরা করতে চাও। আমি আসছি ওইখানে, তোমার যেখানে আছো সেখানে দয়া করে দাঁড়িয়ে থাক। আমি এসে সব ঠিক করে দেবো।”

দেবায়ন কিছুতেই মানতে নারাজ, চিবিয়ে চিবিয়ে পরাশরের কাকুকে বলে, “পায়েলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? কি করে বলেন এর পরে যে এদের আমি ছেড়ে দেবো? আমি পায়েলের বাবাকে পর্যন্ত খুন করবো। সুজাতা কাকিমার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠাবো ওকে আর এই বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে।”

ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন আহত কণ্ঠে বলে, “তুমি কিছুতেই শুনবে না তাহলে?”

দেবায়ন চাপা গর্জন করে ওঠে, “আপনার একটা ছোটো মেয়ে আছে তাই না? একবার ভেবে দেখুন এই অত্যাচার আপনার মেয়ের সাথে হয়েছে? কি করতেন আপনি? পুলিসের অপেক্ষা করতেন, না পাপীদের শাস্তি দিতেন?”

দেবায়ন মানতে নারাজ কিছুতেই, মাথায় রক্ত চড়ে যায় পুলিসের কথা শুনে। অগ্নিহোত্রীকে এক লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে গলার উপরে পা বসিয়ে দিয়ে ফোনে গর্জন করে ওঠে, “আপনার পুলিসকে বলবেন বড় রাস্তার ধারে দুটি লাশ পড়ে আছে, যেন তুলে নিয়ে যায়। পায়েলের বাবাকে মারতে পারলাম না বলে দুঃখ হচ্ছে তবে যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাবে সেদিন খুন করবো আমি। তার জন্য যদি আমাকে চোদ্দ বছর অপেক্ষা করতে হয় রাজি আছি।”

অগত্যা নিরঞ্জন বাবু কিছুতেই দেবায়নকে শান্ত করতে পারে না। পুলিসের হস্তক্ষেপের খবরে দেবায়নের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ফোন রূপককে ধরিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে দেয় বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে। বিনয়ের নাক ফেটে রক্ত বের হয় আর অগ্নিহোত্রী দেবায়নের লাথি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। দেবায়নের রুদ্র মূর্তি দেখে দেবাশিস, রুদ্র আর বাকি ছেলেরা ঘাবড়ে যায়। ওরা খুনের মতলব করে আসেনি। ওরা ভেবেছিল এই সব কান্ডের পরে ছেলেগুলোকে পুলিসের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু দেবায়ন তখন কারুর কথা শোনার মতন অবস্থায় নেই। দেবাশিস আর রুদ্র জড়িয়ে ধরে দেবায়নকে। রাগে ক্ষোভে দুঃখে দেবায়নের শরীরে শত অসুরের শক্তি ভর করে।

দেবায়ন চাপা গর্জন করে ওঠে, “পুলিস আসার আগে তোদের মেরেই ফেলবো। শালা, শুয়োরের বাচ্চা, তোদের বাঁচিয়ে রাখলে আমি কোনদিন পায়েলের সামনে দাঁড়াতে পারবো না।”

নিরঞ্জন বাবুর সাথে রূপকের কথা হয়। রূপক, দেবাশিস আর রুদ্রকে নির্দেশ দেয় যে দেবায়নকে ওইখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। দেবাশিস কোনোরকমে দেবায়নকে টেনে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। রূপক কিছু পরে ওর কাছে এসে বলে যে দেবায়নের মা একবার দেবায়নের সাথে কথা বলতে চায়।

দেবশ্রী ফোন ধরে বলে, “বাবা, আমার কথা একবার শোন মন দিয়ে। নিরঞ্জন বাবু যাচ্ছেন যখন তখন আর এই সব উলটোপালটা কাজ করিস না। উনি বলেছেন যে উনি সব দেখে নেবেন, কি করতে হয় বিচার করে করবেন। নিরঞ্জন বাবু বিচক্ষণ ব্যাক্তি, ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর, পরাশরের কাকু, একবার অন্তত তাঁর কথা শুনে দেখ।”

দেবায়নের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পায়েলের অর্ধনগ্ন ক্ষত বিক্ষত দেহ। কানে বাজে অঙ্কনের কাতর আর্তনাদ, “মিষ্টি, আমি এসে গেছি সোনা। একবার চোখ খোলো।” প্রেয়সী অনুপমার চোখের জল, “তুমি শুধু আমার কাছে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসো।” ঋতুপর্ণার ডাক, “এরা যেন কালকের সূর্য না দেখতে পায়।” দেবায়ন মাকে বলে, “পরাশর ওর কাকাকে বলেছিল পায়েলের কথা। তখন কোথায় ছিল ওর কাকা? কার পেছনে পুলিসের রুল ঢুকাচ্ছিল? ওর কাকা যা পারবে করে নিক আমার। আমাকে পুলিস দেখাতে যেও না, আমি আজকে এদের খুন করবই।”

দেবশ্রী ছেলেকে ধমক দেয়, “পায়েল ফিরে এসেছে, পায়েলের সাথে রেপ হয়নি। ওর মায়ের জন্য সত্যি খারাপ লাগছে। কিন্তু তুই কিছু করবি না। ওদের যা করার আইন করবে, এই আমার শেষ কথা।”

রুদ্র বেগতিক দেখে দেবাশিস আর বাকি বন্ধুদের বলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে মাঠের দিকে চলে যেতে। রূপক আর রুদ্র ক্ষুধ, রুদ্ররুপী দেবায়নের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋজু দেবায়ন শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে, অন্ধকার মাঠের মধ্যে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে পায়েলের জন্য। এক ভালো বান্ধবীর এই সর্বনাশের প্রতিশোধ নিতে পারলো না। সময় চলে যায়, দুরে মাঠের মধ্যে ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তার পাশে দেবায়ন বসে। রূপক আর রুদ্র নিরুত্তর হয়ে চুপচাপ বসে থাকে নিরঞ্জন বাবুর অপেক্ষায়।

রুদ্র বেগতিক দেখে, দেবাশিস আর বাকি বন্ধুদের বলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে মাঠের দিকে চলে যেতে। রূপক আর রুদ্র ক্ষুধ, রুদ্ররুপী দেবায়নের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋজু দেবায়ন শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে, অন্ধকার মাঠের মধ্যে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে পায়েলের জন্য। এক ভালো বান্ধবীর এই সর্বনাশের প্রতিশোধ নিতে পারল না। সময় চলে যায়, দুরে মাঠের মধ্যে ছেলেরা বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তার পাশে দেবায়ন বসে। রূপক আর রুদ্র নিরুত্তর হয়ে চুপচাপ বসে থাকে নিরঞ্জন বাবুর অপেক্ষায়।

সময়ের কেটে যায় বন্যার জলের মতন, সবাই নিস্তব্ধ। দুরে দুটি জিপ, লাল আলো জ্বালিয়ে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসে। রূপক রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতে থাকে। দুটি জিপ ওদের দেখে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিস গাড়ি থেকে নেমে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়। নিরঞ্জন বাবু এগিয়ে এসে রূপককে জিজ্ঞেস করে দেবায়নের কথা। দেবায়ন মাথা নিচু করে রাস্তার পাশে, মাটিতে বসে।

নিরঞ্জন বাবু কাছে এসে দেবায়নের কাঁধে হাত রাখে। দেবায়ন জল ভরা ক্লান্ত চোখে নিরঞ্জন বাবুর দিকে তাকায়। সেই চোখের চাহনি দেখে নিরঞ্জন বাবু বুঝতে পারে যে দেবায়ন ফোনে যা বলেছিল এক বিন্দু বানিয়ে বলেনি, নিজের মনের কথাই বলেছিল। রুদ্র মাঠের মাঝে ওর বন্ধুদের দেখিয়ে বলে যে ওইখানে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ধরে রাখা হয়েছে।

নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে আস্বস্ত করে বলে, “দেখো দেবায়ন, এইখানে পুলিসের হাত পা বাঁধা ছিল। কোন কমপ্লেন ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না। ওর বাবা মা কেউ কমপ্লেন করেনি। ছেলে মেয়েদের উপরে বাবা মায়ের অধিকার বেশি। কি করতে পারে আইন? আইন কানুন যে অন্ধ দেবায়ন।”

দেবায়ন চিবিয়ে বলে, “সর্বনাশ হয়ে যাবার পরে আইনের চোখ খোলে? রেপিস্টদের ধরে ধরে সবার সামনে ফাঁসি দেওয়ায় উচিত, তাহলে দেখবেন যে দেশে রেপ কমে যাবে, মেয়েদের ওপরে যে অত্যাচার হয় সব কমে যাবে। আর সুজাতা কাকিমা? তাঁর আত্মার কি হবে? আপনি পায়েলকে দেখেছেন? কথা বলেছে আপনার সাথে? কি বলেছে শুনি একবার?”

নিরঞ্জন বাবু চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। পায়েলকে দেখে তাঁর মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল, শরীরে শুধু হাড় ছাড়া কিছু বেঁচে নেই পায়েলের, কথা বলার শক্তি নেই পায়েলের। ততক্ষণে পুলিস টিমের বাকিরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে ধরে জিপের কাছে নিয়ে আসে। নিরঞ্জন বাবু রেডিওতে খবর নিয়ে জেনে নেন যে বিনয়দের বাড়ি থেকে পায়েলের বাবা আর বিনয়ের মাকে গ্রেফতার করেছে নৈহাটি পুলিস। ওইখানে খুব হইচই চলছে। বিনয়ের বাবা আর সমীর বাবু লোকজন জড়ো করে পুলিসকে বাধা দিচ্ছে। নিরঞ্জন বাবু সঙ্গে সঙ্গে ব্যারাকপুরে কথা বলে পুলিস ফোর্সের ব্যাবস্থা করেন। বুঝে যান যে, অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে নিয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকলে চলবে না। একটা গাড়িতে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে তুলে দিয়ে ওইখানে অপেক্ষা করতে বলে। অন্য একটা গাড়িতে, রুদ্র রূপক আর দেবায়নকে নিয়ে নিরঞ্জন বাবু, মীরা বাগানের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথে যেতে যেতে, রূপকের কাছে সব ঘটনা জানতে চান। রূপক, দেবায়নের মোবাইলে তোলা ভিডিও নিরঞ্জন বাবুকে দেখায়। ভিডিও দেখে নিরঞ্জন বাবু স্তব্ধ হয়ে যায়, চোয়াল বারেবারে শক্ত হয়ে আসে। মীরা বাগানে ঢুকতেই ওদের বেশ বেগ পেতে হয়। রাত চারটে বাজে, কিন্তু প্রায় সারা মীরা বাগান জেগে উঠেছে। পুলিস হিমসিম খাচ্ছে লোকজন সামলাতে। নৈহাটি থানার ওসি, নিরঞ্জন বাবুদের গাড়ি দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন। নৈহাটি থানার ওসি বলেন যে, ডক্টর কমলেশ আর তাঁর দিদিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু কেউ মানতে চাইছে না।
 
নিরঞ্জন বাবু গাড়ি থেকে নেমে, পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসিকে দেখে। সমীর বাবু আর বিনয়ের বাবা এগিয়ে এসে নিরঞ্জন বাবুকে বলেন যে এরা নির্দোষ। দেবায়ন গাড়ি থেকে নামতে চায় কিন্তু বাকিরা ওকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে দেয়। নিরঞ্জন বাবু ওদের বলে যে, সমীর বাবুর ছেলে অগ্নিহোত্রী আর বিনয় ধরা পড়েছে পুলিসের কাছে। ওরা সব কবুল করেছে এবং তার প্রমান আছে নিরঞ্জন বাবুর কাছে। নিরঞ্জন বাবু ওদেরকে দেবায়নের মোবাইলে তোলা ভিডিও দেখিয়ে বলে যে এরপরে যা কিছু বলার, থানায় গিয়ে বলতে পারে। নিরঞ্জন বাবুর কথা শুনে আর ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে লোকেরা। পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি ভেঙে পড়ে তখন। নিরঞ্জন বাবু, নৈহাটি থানার ওসিকে নির্দেশ দেন যে এটা ক্রাইম ব্রাঞ্চের কেস, সুতরাং এদের লাল বাজারে নিয়ে যেতে হবে। পুলিসের একটা জিপে, পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসিকে নিয়ে পুলিস কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রুদ্রকে নামিয়ে দেওয়া হয় ওর বাড়িতে। সঙ্গীতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দাদাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে। দেবায়ন আর রূপকের সাথে দেখা করে সঙ্গীতা। নিরঞ্জন বাবু সঙ্গীতাকে জিজ্ঞেস করে যদি ওদের সাথে কোলকাতা ফিরতে চায় তাহলে বাড়ি পৌঁছে দেবে সঙ্গীতাকে। রুদ্র জানিয়ে দেয় যে ওর বোনকে পরের দিন কোলকাতা পৌঁছে দেবে।

নিরঞ্জন বাবু গাড়িতে উঠে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “এবারে একটু শান্ত হবে? সবাই গ্রেফতার হয়ে গেছে। ওদের বিরুদ্ধে সব সাক্ষ্য প্রমান আমাদের কাছে আছে। পায়েলের বাবার যাতে যাবজ্জীবন হয় সেই মতন চার্জসিট ফাইল করা হবে।”

দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ছেড়ে দেবেন? কত বছর জেল হয় একটা মেয়েকে এমন ভাবে ধরে রেখে কষ্ট দিলে? আপনার আইন কি বলে?”

নিরঞ্জন বাবু গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। দেবায়ন রাগে গজগজ করতে থাকে, রূপক চুপচাপ পাশে বসে থাকে। দেবায়নের চোখে মুখে হেরে যাওয়ার ছাপ পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

রূপক ওকে বলে, “দ্যাখ ভাই, পায়েলকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি এটা বড় কথা নয় কি? তুই কেন তোর হাত কারুর খুনে নোংরা করতে চাস। একবার নিরঞ্জন কাকুর কথা মেনে দ্যাখ, আমার মন বলছে যা হবে ঠিক হবে। পায়েলের বাবা গ্রেফতার হয়েছে, আইন তাকে উচিত সাজা দেবে। আইন আমাদের হাতে তুলে নেওয়া একদম উচিত নয়। একটু বুঝতে চেষ্টা কর। আমাদের সামনে অনেক বড় একটা জীবন পড়ে আছে, কেন ফালতু ফালতু পুলিসের খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে বদনাম নিতে চাস তুই? একবার ভেবে দ্যাখ, সায়ন্তন কাকুর কথা। তুই কি ভাবছিস, কাকুর আত্মা শান্তি পাবে কোনদিন? কাকিমার কথা ভাব, তোর নাম পুলিসের খাতায় উঠলে সারা জীবন একটা খুনের অপবাদ তোর সাথে থেকে যাবে।”

দেবায়ন চুপ করে শুনে যায় রূপকের কথা। বিচার করার শক্তি লোপ পেয়েছে দেবায়নের, তাও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে চুপচাপ থাকবে। গাড়ি বড় রাস্তায় দাঁড় করায় নিরঞ্জন বাবু। সামনের গাড়িতে, অগ্নিহোত্রী আর বিনয় বসে। পেছনে পুলিসের দুটো জিপ, একটাতে বিনয়ের মা আর পায়েলের বাবা। নিরঞ্জন বাবু পেছনের পুলিসদের নির্দেশ দেয় যে সোজা লাল বাজারে নিয়ে চলে যেতে। বিনয়ের মা আর পায়েলের বাবাকে নিয়ে রওনা দেয় পুলিসের জিপ। নিরঞ্জন বাবু অন্য জিপ থেকে একজন ইন্সপেক্টরকে ডেকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করেন। পাশের ইন্সপেক্টর একটা রিভলভার নিরঞ্জন বাবুকে দেয়। নিরঞ্জন বাবু আবার চুপচাপ গাড়িতে বসে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দেয়। গাড়ি আবার কল্যাণী হাইওয়ে ধরে কোলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

দুই পাশে ফাঁকা মাঠ, রাতের অন্ধকার কেটে দুটি গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। ব্যারাকপুর পেরিয়ে যাবার কিছু পরে নিরঞ্জন বাবু গাড়ি দাঁড় করাতে নির্দেশ দেয়। রূপক আর দেবায়নকে নিরঞ্জন বাবু গাড়ি থেকে নামতে অনুরোধ করেন। রূপক আর দেবায়ন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।

নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে বলে, “আইন ওদের শাস্তি দেবে আমি জানি।” দেবায়ন আর রূপকের কাঁধে হাত রেখে বলে, “পায়েলকে আমি দেখেছি। অঙ্কনের কান্না আমি দেখেছি। পরাশর আমাকে আগেই বলেছিল এই সব কিন্তু আইনের হাত পা বাঁধা ছিল সেই সময়ে। আইন পুলিস তখন নিরুপায় ছিল, কিছু করার ছিল না আমাদের। পায়েলের আগের জীবন আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো না, দেবায়ন আমাকে ক্ষমা করে দাও।” নিরঞ্জন বাবু অন্য ইন্সপেক্টরকে বলেন, “ওই দুটোকে নিয়ে মাঠের মধ্যে যাও, আর দৌড়াতে বল।”

ইন্সপেক্টর বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর হাতকড়া খুলে মাঠের মধ্যে দৌড়াতে বলে, বলে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিনয় আর অগ্নিহোত্রী দাঁড়িয়ে থাকে, পা নিঃসাড় হয়ে আসে ওদের। নিরঞ্জন বাবু গর্জে ওঠে, “যা পালা, কত জোরে পালাতে পারিস পালা। তোদের ছেড়ে দিলাম। তোদের বিরুদ্ধে এমন কিছু প্রমান নেই আমার কাছে, যা বলেছিস সব পায়েলের বাবার বিরুদ্ধে। তোদের ধরে নিয়ে গিয়ে কিছু করার নেই।” অগ্নিহোত্রীকে বলে, “তোর বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হাবড়ার দিকে একটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই মাঠ ধরে দৌড়াতে থাক।” অগ্নিহোত্রী আর বিনয় এক বার পরস্পরের দিকে তাকায়। নিরঞ্জন বাবু আবার বলেন, “তোর বাবা আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে তোদের ছেড়ে দেবার জন্য।” ম্লান হেসে বলে, “কি করতে পারি বল, সমীর বাবুর কথা রাখতে হয় যে।”

হতভম্ব হয়ে দেবায়ন চেঁচিয়ে ওঠে নিরঞ্জন বাবুর দিকে, “কি করলেন আপনি? শালা পুলিসকে একদম বিশ্বাস করতে নেই।”

বিনয় আর অগ্নিহোত্রী, পাঁচ লাখ টাকার কথা শুনে নিরঞ্জন বাবুর কথা বিশ্বাস করে নেয়। মাঠে নেমে প্রানপন দৌড়াতে শুরু করে দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের একপাশে একটা জঙ্গলের দিকে যায় অগ্নিহোত্রী আর বিনয়। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দুই খানা রিভলভার গর্জে ওঠে, দুম দুম দুম দুম দুম দুম... পর পর বেশ কয়েকটা গুলি। নিরঞ্জন বাবু আর অন্য ইন্সপেক্টর একসাথে গুলি চালায় অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের দিকে। দেবায়ন আর রূপক পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বাকি পুলিসেরা দৌড়ে যায় বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর দিকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না ওরা মরেছে না বেঁচে আছে। আরোও দুটো গুলির আওয়াজ শুনতে পায় দেবায়ন। তারপরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে হাইওয়েতে। দুরে কয়েকটা লরি দেখা যাচ্ছিল। তারা দুরেই দাঁড়িয়ে পড়ে পুলিসের লাল বাতি দেখে। নিরঞ্জন বাবু দেবায়নের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে রেডিওতে খবর দেয় এম্বুলেন্স পাঠাতে। খবরে বলেন দুই কিডন্যাপিং কেসের আসামি পালাতে গিয়ে পুলিসের গুলিতে মারা গেছে, তাদের লাশ পড়ে আছে ব্যারাকপুরের কাছে একটা জঙ্গলে।

ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিরঞ্জন বাবু দেবায়নকে বলে, “আমার মেয়ের সাথে এই রকম হলে আমি কারুর অপেক্ষা করতাম না। নিজে হাতে সব কটাকে গুলি করে মারতাম। সুজাতাদির আত্মার আর পায়েলের মুক কান্নার জন্য করেছি। এরা তোমাদের নার্সিং হোমে পৌঁছে দেবে। দুপুরে আমি আসবো, তখন সব বুঝিয়ে বলে দেবো।”

বাকি পুলিস দল আসার আগেই অন্য গাড়িতে করে দেবায়ন আর রূপককে কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয় নিরঞ্জন বাবু। কোলকাতা পৌঁছাতে ওদের সকাল হয়ে যায়। গাড়ি সোজা ডক্টর মিসবাহুলের নার্সিং হোমের সামনে নামিয়ে দেয় ওদের।

নামিয়ে দেবার আগে একজন ইন্সপেক্টর ওদের বলে, “তোমরা একটা কথা মনে রাখবে। তোমরা কিছু দেখোনি তোমরা কিছু জানো না। তোমরা খবর পেয়ে পায়েলকে বাঁচাতে গেছিলে। পায়েলকে বাঁচিয়ে তোমরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে ধরে রেখেছিলে আর পুলিসকে খবর দিয়েছিলে। বিনয়ের কথা মতন ওর মাকে আর মামাকে গ্রেফতার করে পুলিস। তারপরে তোমাদের নিয়ে আমরা চলে আসি।” রূপক আর দেবায়ন মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় ওরা সব বুঝে গেছে।

নার্সিং হোমে ঢুকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে। দেবায়নের মা, মিস্টার সেন, অনুপমা, শ্রেয়া, পরাশর, জারিনা আর ধিমান। শ্রেয়া দৌড়ে এসে রূপকের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে নৈহাটির ঘটনা। রূপক সংক্ষেপে সবাইকে নৈহাটির কথা জানায়, সেই সাথে জানায় যে পায়েলের বাবা আর পিসিকে পরাশরের কাকু গ্রেফতার করেছে। ওদের বিরুদ্ধে সুজাতা কাকিমাকে খুনের মামলা চলবে। রূপক পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করে। ঋতুপর্ণা, আই.সি.ইউ বেরিয়ে এসে জানায় যে পায়েল এই যাত্রায় বেঁচে যাবে। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত ওর মানসিক অবস্থা বলা কঠিন। দেবায়ন অনুপমাকে অঙ্কনের কথা জিজ্ঞেস করে। অনুপমা জানায় যে ভাই পায়েলের পাশেই বসে, ওকে ওইখান থেকে নড়ানো যাচ্ছে না একদম। সবাই চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু ভাই বলেছে যে যতক্ষণ না পায়েল চোখ খুলবে ততক্ষণ ও ওর পাশে বসে থাকবে।

বারো ঘণ্টা পরে পায়েল চোখ খোলে। পারমিতা সকালেই নার্সিং হোমে চলে এসেছিল। অঙ্কন সারা সময়ে পায়েলের পাশেই বসে ছিল। সেদিনের রাতে বন্দুকের গুলিতে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর মৃত্যু হয় সেই কথা শুধুমাত্র দেবায়ন আর রূপক জানে। ইন্সপেক্টর নিরঞ্জন, ডক্টর মিসবাহুলের কাছে পায়েলের মানসিক অবস্থার কথা জানতে চায়। ডক্টর মিসবাহুল জানান যে পায়েলের মানসিক অবস্থা খুব সঙ্গিন, স্টেটমেন্ট দেবার মতন অবস্থায় পৌঁছায়নি তখন। নিরঞ্জন বাবু চিন্তায় পড়ে যান, চার্জসিট ফাইল করতে হলে পায়েলের স্টেটমেন্টের খুব দরকার।

নিরঞ্জন বাবু, দেবায়ন ধিমান আর রূপককে থানায় ডাকেন। নিরঞ্জন বাবু এবং বাকি পুলিসের সামনে দেবায়ন আর রূপক সব কথা জানায়। মোবাইলের ভিডিও এবং রূপক আর দেবায়নের কথা মতন স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয়। পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি, ক্রাইম ব্রাঞ্চের কাছে সব কথা স্বীকার করে সেই মতন চার্জসিট তৈরি হয়। নিরঞ্জন বাবু সবাইকে নিয়ে পায়েলের বাড়িতে যায়। দরজার তালা ভেঙে ঢুকে বাথরুমের জরিপ করে। পায়েলের বাবা দেখিয়ে দেয় যেখানে পায়েলকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। একতলার চেম্বারের পেছনে একটা ছোটো বাথরুম, বাথরুমের অবস্থা দেখে বোঝা যায় ওইখানে বিশেষ কারুর যাতায়াত নেই। প্রমান স্বরুপ সেখানে একটা দড়ি আর একটা গ্লাস পাওয়া যায়। তারপরে উপরে সুজাতা কাকিমার ঘরে ঢুকে তদারকি করে বাকি তথ্য প্রমান যোগাড় করে নিয়ে চলে যায় পুলিস। পুলিস ইতিমধ্যে পায়েলের মামা বাড়িতে খবর দেয়। পায়েলের মামা মামী এবং মামাতো দাদা নার্সিং হোমে পৌঁছে যান।

ডক্টর মিসবাহুল পায়েলের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। পায়েল একটু সুস্থ হওয়ার পরে নিরঞ্জন বাবুকে খবর দেওয়া হয়। নিরঞ্জন বাবু নার্সিং হোমে চলে আসেন পায়েলের স্টেটমেন্ট নিতে। পায়েল ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে, কারুর মুখে কোন কথা নেই সবাই পরস্পরের মুখ চাওচাওয়ি করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

পায়েল বড় বড় ক্লান্ত চোখে জিজ্ঞেস করে, “মা কোথায়?”

পারমিতা পায়েলের পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই ভালো হয়ে যা, তারপরে সব কথা বলবো।”

পায়েল পারমিতার কোল ঘেঁষে জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলো, আমার মা কোথায়?”

পারমিতা দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেবশ্রীদিকে একবার ডাকলে বড় ভালো হতো।”
 
অনুপমা ওর মামনিকে ফোন করে। দেবায়নের মা অফিস থেকে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে নার্সিং হোমে চলে আসে। পায়েল দেবায়নের মাকে আগে কোনদিন দেখেনি। অনুপমা পরিচয় করিয়ে দেয় দেবায়নের মায়ের সাথে। নিরঞ্জন বাবু দেবায়নের মাকে ডেকে বলেন যে ওর স্টেটমেন্ট নেওয়া দরকার।

দেবশ্রী পায়েলের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “তোমার শরীর কেমন আছে এখন?” পায়েল মাথা নাড়ায়, আগের থেকে একটু ভালো। দেবশ্রী ধিরে ধিরে পায়েলের কাছে সব কিছু জানতে চায়। পায়েল অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে থাকে জল ভরা চোখে। অঙ্কন ওকে সাহস দিয়ে সব কিছু বলতে বলে। পায়েল এক এক করে সব কথা দেবশ্রীকে জানায়। পায়েলের বেদনা ভরা কাহিনী শুনে সবাই স্থম্ভিত হয়ে যায়। জন্মদাতা পিতা এতো নিষ্ঠুর হতে পারে, সেটা ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পিঠে বেল্টের কালসিটে দাগ দেখায়, কব্জিতে দড়ির দাগ। দিনে একটা রুটি আর এক গ্লাস জল ছাড়া কিছু খেতে দেওয়া হয়নি ওকে। ওর বাবা বলেছিল যেদিন অঙ্কনের চিন্তা ছেড়ে দেবে সেদিন ওকে বাথরুম থেকে মুক্তি দেবে। পায়েল জানতো ওর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে তাই জেদ ধরে বসে ছিল। অঙ্কনের চোখে জল চলে আসে সেই সব কথা শুনতে শুনতে। নিরঞ্জন বাবুর চোয়াল রাগে শক্ত হয়ে ওঠে, তিনি জানিয়ে দেন যে একটা স্টেটমেন্ট তিনি পরে তৈরি করে নিয়ে আসবেন সেখানে পায়েলের সই দিয়ে দিলে হয়ে যাবে। পায়েল বারেবারে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। দেবায়নের মা শেষ পর্যন্ত পায়েলের মায়ের মৃত্যুর কথা জানায়। পায়েল ডুকরে কেঁদে ওঠে তারপরে অজ্ঞান হয়ে যায়।

জ্ঞান ফেরার পরে পায়েল মামা, মামীর দিকে তাকিয়ে থাকে নিরুপায় হয়ে। পায়েলের অবস্থা দেখে ওর মামা ওকে তার সাথে নিয়ে যেতে চান। অনুপমা আর শ্রেয়া, পায়েলকে তার আত্মীয় স্বজনের সাথে ছাড়তে নারাজ। নিজের বাবা আর নিজের পিসি যদি ওর সাথে এমন অত্যাচার করতে পারে তাহলে বাকিরা কেন পারবে না। অনুপমা আর শ্রেয়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। ওর মামা বলেন যে নিকট আত্মীয় হিসাবে পায়েলের ওপরে তার অধিকার আছে। নিরঞ্জন বাবু অবস্থার সামাল দেবার জন্য বলেন যে পায়েল সাবালিকা হয়ে গেছে। পায়েলের মতামত ছাড়া কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারে না। সবার চাপে পড়ে ওর মামা বিরক্ত হয়ে বলেন যে তারা পায়েলের দায়িত্ব গ্রহন করতে চায় না ভবিষ্যতে।

কলেজ শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন কেউ না কেউ পায়েলের সাথে নার্সিং হোমে থাকে। কোনদিন অনুপমা, কোনদিন সঙ্গীতা, কোনদিন শ্রেয়া। পায়েলকে ফিরে পেয়ে সবাই বেশ খুশি। পায়েল মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ে। বারেবারে মায়ের কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যেতো। ডক্টর খুব চিন্তায় পড়ে যায়। এইমত অবস্থায় পায়েলের দায়িত্ব গ্রহনের জন্য কে এগিয়ে আসবে সেই চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। সেই সময়ে পারমিতা বলে যে, পায়েলের সব দায়িত্ব গ্রহন করতে রাজি আছে। অনুপমা আর অঙ্কন খুব খুশি হয় মায়ের কথা শুনে। মিস্টার সেন স্ত্রীর আর কন্যের কথা মেনে নিয়ে পায়েলকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুপমার রুমেই পায়েলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। অনুপমাই ওর সব দেখাশনার ভার নেয়। রাতের পর রাত অনুপমা ওর জন্য জেগে কাটিয়ে দেয়। পায়েল শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও, কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছে। ওর মন মানতে চায় না যে ওর মা ইহলোকে আর নেই। রাতে ঘুম আসে না পায়েলের, ছোটো বাচ্চা যেমন থেকে থেকে মাকে খোঁজে, বিছানায় শুয়ে পায়েল মাকে খোঁজে। সারা রাত অনুপমা ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। অঙ্কন পায়েলের মানসিক অবস্থা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। পায়েল শরীর ঠিক হলেও ওর মানসিক পরিবর্তন ঘটে। উচ্ছল, চঞ্চল পায়েল আর সেই মেয়ে নয়। পায়েল খুব চুপচাপ এবং স্তিমিত হয়ে যায়। পায়েল আর নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায় না, পারমিতা ওকে যেতে দিতে চায় না। জানে পায়েল নিজের বাড়িতে ফিরে গেলে ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যাবে, একা অত বড় বাড়িতে থাকা অসম্ভব পায়েলের পক্ষে। পায়েলের বাড়িতে তালা বন্ধ, মাঝে মাঝে পায়েলের মামা ফোনে পায়েলের খবরাখবর নেয় তবে ধিরে ধিরে সেটাও কমে আসে।

!!!!!!!!!! বিংশ পর্ব সমাপ্ত !!!!!!!!!!
 
একবিংশ পর্ব।

কম্পিউটার ক্লাসের প্রথম সেমেস্টার পার হয়ে যায়। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি, শীতকাল কোলকাতায় বেশ জাঁকিয়ে নেমে আসে। অনুপমাদের কম্পিউটারের প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষা শেষ। ভালো অঙ্কে দুই জনে উত্তীর্ণ হয়।
ছেলের কঠিন পরিশ্রমের ফল দেখে দেবশ্রী বেশ খুশি হয়। দেবশ্রী দিল্লী হেড অফিসে জানিয়ে দেয় যে তিনি দিল্লীতে জয়েন করতে পারবে না। দেবশ্রী বুঝতে পারে যে এই সিদ্ধান্তের জন্য মিস্টার ঠাকুর আর মিস্টার ব্রিজেশ ত্রিপাঠি বেশ আহত হবেন। তাই দেবশ্রী আগে থেকেই নতুন কাজ খুঁজছিল। দেবশ্রী পুরানো চাকরি ছেড়ে এক এয়ারলাইন্স অফিসে ডি.জি.এম এইচ.আর হিসাবে জয়েন করেন। নতুন অফিস, খুব বড় এবং দেশের নামকরা এয়ারলাইন্স কোম্পানি। কাজের ভার অনেক কম, তবে যে কাজগুলো তাঁর কাছে আসে সেইগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেবায়নের ফাইনাল পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকি। তার পড়াশুনা, তার খাওয়া দাওয়া, তার শরীর, সব দিকে দেবশ্রীর কড়া নজর। দেবশ্রী বারেবারে ছেলেকে বলে যে সব কিছু মাথা থেকে বের করে দিয়ে শুধু কলেজের পড়াশুনায় মন দিতে। স্নাতক না হলে এই বাজারে চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার।

পায়েল আর বাড়ি থেকে বের হয় না। অনুপমার রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখে দেয় সারাদিন। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। পারমিতার দুশিন্তা দিনে দিনে বেড়ে ওঠে পায়েলের মানসিক অবস্থা দেখে। সাইকিয়েট্রিস্টের ওষুধ আর কাউন্সিলিং নিয়মিত চলে। কিন্তু পায়েলের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন খুব ক্ষীণ। অঙ্কন ওকে নিয়ে বাইরে যেতে বললে কিছুতেই বাড়ির বাইরে যেতে চায় না। পারমিতা বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পায়েলের জন্য। অনুপমার কলেজ, ক্লাস ইত্যাদির জন্য শুধু রাত ছাড়া পায়েলের সাথে দেখা হয় না। শুধুমাত্র ওকে আর অঙ্কনকে দেখলেই পায়েল একটু হাসে তাছাড়া আর কারুর সাথে কথা বলে না। প্রায় বন্ধু বান্ধবীরা এসে খবর নেয়, কিন্তু পায়েল পারমিতার আঁচলের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে।

একদিন রাতে খাবার সময়ে মিস্টার সেন অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোদের কম্পিউটার ক্লাসের কি খবর?”

এতোদিন পরে ওর বাবা ওর পড়াশুনা, ওর কলেজ ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে দেখে অনুপমার খুব ভালো লাগে, “প্রথম সেমেস্টার শেষ হয়ে গেছে। ভালো মার্কস পেয়েছি আমরা।”

মিস্টার সেনঃ “কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা কবে?”

অনুপমাঃ “আগামী বছর, গরমের ছুটির আগেই আশা করি।”

মিস্টার সেনঃ “পড়াশুনা কেমন চলছে আজকাল?”

অনুপমা হেসে বলে, “তুমি সত্যি জানতে চাও না মজা করছো?”

মিস্টার সেন হেসে ফেলেন মেয়ের কথা শুনে, “না রে মা। আমি সত্যি জিজ্ঞেস করছি। আর হ্যাঁ, একবার দেবায়নের ফোন নাম্বার দিস আমাকে। ওর সাথে কিছু কথা আছে।”

অনুপমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি এমন কথা যেটা তুমি আমাকে বলতে পারবে না?”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “বাঃ রে, শ্বশুর জামাইয়ে কি নিজস্ব কিছু কথাবার্তা হতে পারে না।”

অনুপমা হেসে ফেলে বাবার কথা শুনে, “ঠিক আছে কালকে আমি ওকে কলেজে বলে দেবো বাড়িতে আসতে।”

মিস্টার সেন বলেন, “না না তুই ওর ফোন নাম্বার আমাকে দে। আমি কথা বলে নেব।”

সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পরে বসার ঘরে বসে থাকেন মিস্টার সেন। পায়েলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অনুপমা নিচে নেমে আসে। অনুপমা ওর বাবার সামনে একটা সোফায় বসে পড়ে।

মিস্টার সেন ড্রিঙ্কের গ্লাস টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার তুই ঘুমাতে যাসনি এখন?”

অনুপমা বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

মিস্টার সেনঃ “কি কথা? তুই কি কোম্পানির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চাস?”

অনুপমা মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ। তুমি বলেছিলে, এই বছরে কোম্পানি বিক্রি করে দেবে আর তুমি তোমার চাকরি বদলে অন্য চাকরি নেবে। কিছুই হয়নি, বাবা।”

মিস্টার সেন হুইস্কির গ্লাসে ছোটো চুমুক দিয়ে হেসে বলে, “কোম্পানির একটা গতি করবো আমি। সেই সাথে অনেক কিছু ভেবেছি এই কয় মাসে। নতুন বছর, নতুন দিগন্তে পা রাখতে চাই আমি। তুই এতো চিন্তা করছিস কেন? তুই কলেজের পড়াশুনা নিয়ে থাক। তুই ভাবছিস তোদের আই.টি কোম্পানির কথা, তাই তো? তার জন্য পয়সা চলে আসবে। আমি একবার দেবায়নের সাথে কথা বলতে চাই। তোর কি আমার অথবা দেবায়নের ওপরে বিশ্বাস নেই?”

কি উত্তর দেবে অনুপমা, ম্লান হেসে বলে, “ঠিক আছে, তুমি আর দেবায়ন যা ভালো বুঝবে তাই করো। এরপরে আমার আর কিছু বলার নেই।”
 
বিছানায় শুয়ে নিত্যদিনের মতন দেবায়নকে ফোন করে অনুপমা। ফোনে জানায় যে ওর বাবা ওর সাথে দেখা করতে চায়। দেবায়ন একটু চিন্তিত হয়ে যায়, সেই সাথে অনুপমা বলে যে বাবার কথায় সে নিজেও বেশ চিন্তিত। অনুপমা বলে দেয় যে, যাই করুক নিজের বিবেক বুদ্ধিকে সামনে রেখে যেন পা বাড়ায়।

পরের দিন দুপুর বেলা মিস্টার সেন দেবায়নকে ফোন করে। মিস্টার সেনের ফোন পাবে সেটা দেবায়নের জানা ছিল। আগে থেকে প্রস্তুত ছিল উত্তরের জন্য। দেবায়ন অনুধাবন করেছিল যে ওর সাথে নিশ্চয় ব্যাবসা নিয়েই কথা হবে। মিস্টার সেন বলেন যে আগামী শনিবার, কম্পিউটার ক্লাসের পরে হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারনেশানালে চলে আসতে। বিকেলে দুইজনে ওইখানে ডিনার করতে চায় সেই সাথে মিস্টার সেন কিছু কথা বলতে চান।

শনিবার কম্পিউটার ক্লাসের পরে বিকেলে হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাসানালে চলে যায় দেবায়ন। অনুপমাকে আগে জানিয়ে দিয়েছিল যে ওর বাবা ওর সাথে দেখা করতে চায়। সেই মতন অনুপমা হেসে বলে যে বাবা ওকে বলেছে, আর বাবার কথা একটু বুঝে শুনে যেন পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। আগে থেকে একটা টেবিল রিসার্ভ করে রেখেছিলেন মিস্টার সেন। দেবায়নের আগেই মিস্টার সেন হোটেলে পৌঁছে ওর জন্য লবিতে অপেক্ষা করে।

মিস্টার সেন দেবায়নকে দেখে হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলে, “বেশ ঝড় গেল আমাদের সবার উপর দিয়ে তাই না?”

দেবায়ন হেসে বলে, “তা গেল। কিসের জন্য আমাকে ডাকা?”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “কেন? আমাদের মাঝে কিছু কথা থাকতে পারে না?”

দেবায়নঃ “হ্যাঁ নিশ্চয় পারে, তবে বাড়িতে হতে পারতো সেই সব কথা।”

মিস্টার সেনঃ “হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়িতে হতে পারতো। এখানের শেফ আমার চেনা জানা। আমি লবস্টার আর সার্ক ফিন সুপের অর্ডার দিয়েছিলাম। পারমিতা আর অনুপমা, সার্ক ফিন সুপ খেতে ভালোবাসে না একদম। আমি ভাবলাম আমি একা কেন টেস্ট করবো, তোমাকে ডেকে একবার টেস্ট করাই।”

দেবায়নঃ “সার্ক ফিন সুপ! বাপরে যে হাঙ্গর আমাদের খায়, আমরা এখন তাকেই খাবো?”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “জীবন অনেকটা সেই রকম। আজকে যে তোমাকে খেলো, সময় পেলে তুমি তাকে খাবে। বসো বসো।”

দেবায়ন চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বললেন না তো? কি কারনে আমাকে ডাকা হয়েছে?”

মিস্টার সেনঃ “তুমি কি এখন পর্যন্ত কারুর সাথে তোমার আই টি কোম্পানির ব্যাপারে কথা বলেছো? মানে তুমি এক বার বলছিলে যে রূপক যাদবপুরে আই.টি তে বি.টেক করছে?”

দেবায়নঃ “না, শ্রেয়া আর রূপকের সাথে এখন পর্যন্ত কোন কথা হয়নি। তবে মায়ের সাথে আর অনুপমার সাথে কথা হয়েছে।”

মিস্টার সেনঃ “এই কয়দিনে রূপককে দেখলাম। বেশ ভালো ছেলে, মনের দিক থেকে বেশ ভালো। বন্ধুবৎসল, ওর সাথে কাজ করতে ভালোই লাগবে। শ্রেয়া মেয়েটা বেশ শক্ত, আমার মেয়ের চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। অনু হৃদয় থেকে ভাবে আর শ্রেয়া মাথা খাটিয়ে ভাবে। তোমার কি মনে হয়?” দেবায়ন হেসে ফেলে সেই সাথে মিস্টার সেন হেসে ফেলেন। মিস্টার সেন জিজ্ঞেস করেন, “দেবশ্রীদি কি বলল তোমাকে?”

দেবায়নঃ “মা একবার আপনার সাথে কথা বলতে চান এই সফটওয়্যার কোম্পানির বিষয়ে।”

ততক্ষণে ওয়েটার সার্ক ফিন সুপ দিয়ে যায়। মিস্টার সেন দেবায়নকে সার্ক ফিন সুপ চেখে দেখতে বলে, বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সময় হলে কথা বলে নেব দেবশ্রীদির সাথে। এখন সব বাড়ির ব্যাপার স্যাপার, দেবশ্রীদিকে না জানিয়ে তো কিছু করা যাবে না। হয়তো ভবিষ্যতে দেবশ্রীদির সাহায্য লাগতে পারে।”

দেবায়নঃ “হ্যাঁ, মায়ের সাহায্য লাগবে। একা আমি সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করতে পারবো না। আমি শুধুমাত্র টেকনিকাল দিক হয়তো দেখতে পারবো বাকি দিক দেখার আছে।”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “আমাকেই ভুলে গেলে নাকি?”

দেবায়ন লজ্জায় পড়ে যায়, যে টাকা দিচ্ছেন তার কথা প্রথমে মাথায় আসেনি। দেবায়ন লজ্জিত মুখে বলে, “না না, মানে আপনি বলছিলেন যে এই সব ছেড়ে দেবেন তাই মানে।”

মিস্টার সেন বলেন, “দেখো, তোমাকে একটা কথা আজকে জানাতে চাই। আমি ভাবছি, আমার এই বিজনেসের গন্ডী একটু বড় করতে। ভালো ভাবে শোনো, তারপরে তোমার মতামত জানাবে।” দেবায়ন সুপ খেতে খেতে মন দিয়ে শোনে মিস্টার সেনের কথা। মিস্টার সেন বলেন, “তোমার আই.টি কোম্পানি তৈরি করতে প্রাথমিক ইনভেস্টমেন্ট কুড়ি কোটি টাকার মতন লাগবে। তারপরে যতদিন না ব্রেক ইভেনে পৌঁছাবে ততদিন ওই টাকা শুধু খরচার খাতায় যাবে। ব্রেক ইভেনে পৌঁছাতে একটা কম্পানিকে প্রায় পাঁচ সাত বছর লেগে যায়। ততদিনে এই টাকার পাহাড় কমে আসবে, আয় বিশেষ কিছুই হয়তো হবে না। সেই সব কথা কি একবার চিন্তা করেছো?” দেবায়ন এতসব কথা চিন্তা করার সময় পায়নি। আসলে দেবায়ন এইসব ব্যাপার জানেই না, ওর পরিবারে কেউ কোনদিন ব্যাবসা করেনি অথবা কেউ অত বড়োলোক নয় যার নিজের একটা কোম্পানি থাকবে। দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে জানায়, এই সব ব্যাপার কোনদিন চিন্তা করে দেখেনি। মিস্টার সেন বলেন, “আমাদের কন্সট্রাক্সান কোম্পানি অনেক দিনের। আগে বাবার কাছে ছিল, সেইখান থেকে আমার দাদা পায়। তারপরে সেটা আমাদের হাতে এসে পড়ে। সুতরাং এই কোম্পানি এখন অনেক টাকা লাভ করে। এক একটা প্রোজেক্টে পঞ্চাস থেকে ষাট শতাংশ লাভ হয়। সেই টাকা দিয়ে আরও একটা প্রোজেক্টে বিনিয়োগ করা হয়। এইভাবে এই লাইনে টাকা ঘোরে। কন্সট্রাক্সানে প্রচুর কাঁচা টাকা উড়ে বেড়ায়। কোলকাতার বাইরে অনেক কাজ করেছে আমাদের কোম্পানি। এই কোম্পানি সোনার ডিম দেওয়া হাঁস, এই কোম্পানি বিক্রি করা বোকামোর কাজ।”
 
দেবায়ন মিস্টার সেনের কথা শুনে বলে, “কাকু, আপনি কিন্তু কাকিমা আর অনুপমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কোম্পানি বিক্রি করে দেবেন।”

মিস্টার সেন হেসে ফেলেন, “আরে বাবা, সেটা না হয় একটু ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছিলাম। কিন্তু একটা সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে মেরে ফেলা সম্পূর্ণ বোকামো। তোমার ব্রেক ইভেনে পৌঁছাতে যদি দেরি হয় আর তার মাঝে তোমার টাকার দরকার পড়ে তখন তুমি কোথায় যাবে? কন্সট্রাক্সান কোম্পানি পুরোদমে লাভে চলছে। তোমার কোম্পানিতে টাকার দরকার পড়লে খুব সহজে এই কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তোমার কোম্পানিতে লাগানো যাবে।”

দেবায়ন চুপ করে ভাবতে শুরু করে এই ব্যাবসার মারপ্যাঁচ। তারপরে মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ তা সত্যি, কিন্তু আপনার মেয়ের চোখে আর কাকিমার চোখে আপনি যে অনেক নিচু হয়ে যাবেন। আপনি তাদের কথা দিয়েছিলেন। আর যদি কোম্পানি বিক্রি না করেন তাহলে সফটওয়্যার কোম্পানি যে খুলতে টাকা দেবেন, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে?”

মিস্টার সেন দেবায়নের চোখে চোখ রেখে বলে, “দেবায়ন, কাকে কিভাবে বুঝাতে হয় সেটা ভালো ভাবে জানি। তোমার আর অনুর স্বপ্নের আই.টি কোম্পানির ইনিসিয়াল ইনভেস্মেন্ট, সেই টাকা আমার কাছে আছে। কুড়ি ত্রিশ কোটি টাকা বাজারে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দিকে। আমার কন্সট্রাক্সান কোম্পানি বিক্রি না করলেও চলবে। আমি চাইছি নতুন বছরে নতুন কিছু করার, আমার ব্যাবসার দিগন্ত একটু একটু করে বাড়াতে চাই। একা পেরে ওঠা সম্ভব নয়, বাইরের কাউকে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। অঙ্কন অনেক ছোটো, মিতা আর অনুকে এতো বড় পরিকল্পনার ব্যাপারে কিছুই জানাই নি। তুমি আমার একমাত্র ভরসা।” দেবায়ন একটু চিন্তায় পড়ে যায়। মিস্টার সেন হেসে জিজ্ঞেস করেন দেবায়নকে, “তুমি কি ভাবছো দেবায়ন? দেবশ্রীদি কিন্তু আমার কাছে জিজ্ঞেস করবে এই আই.টি কোম্পানির টাকার ব্যাপারে। এতদিনে দেবশ্রীদিকে যতটা বুঝেছি, আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা দেবশ্রীদি যে খুব সহজে মেনে নেবেন সেটা মনে হয় না। তাঁকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার ওপরে ছেড়ে দাও, কেমন? তুমি আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাও না শুধু নিজের সফটওয়্যার কোম্পানি নিয়ে থাকতে চাও?”

দেবায়ন মহা ফাঁপরে পড়ে যায়। মা নিশ্চয় মিস্টার সেনের সাথে কথা বলবেন, সেই সময়ে যদি মিস্টার সেন বেঁকে বসেন তাহলে ওর সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করার স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। অনুপমাকে কি বুঝাবে, অথবা পারমিতা কি মিস্টার সেনের এই ব্যাপারে সম্মতি দেবে সেই নিয়ে প্রবল সংশয়ে ভোগে দেবায়ন। মিস্টার সেন দেবায়নের মুখের অভিব্যক্তি দেখে অমনের কোথা বুঝে যায়। দেবায়ন চুপ করে সার্ক ফিন সুপ শেষ করে আর ভাবতে থাকে পরবর্তী পদক্ষেপ। না চাইতেই, ধন লক্ষ্মী ওর সামনে হেঁটে এসেছে। অনুপমার সাথে প্রেম করেছিল কারন অনুপমাকে খুব ভালবাসতো, তার বাবার সম্পত্তির ওপরে কোনদিন ওর নজর ছিল না। কারন সেই সময়ে অনুপমা নিজেই জানতো না যে ওদের একটা কন্সট্রাক্সান কোম্পানি আছে। সাত পাঁচ ভেবে অবশেষে দেবায়ন মনস্থির করে যে মিস্টার সেনের সাথে হাত মিলিয়ে নেওয়া শ্রেয়। ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

দেবায়ন সার্ক ফিন সুপ শেষ করে মিস্টার সেনকে হেসে বলেন, “আপনি তাহলে নতুন বছরে একটা বিজনেস এম্পায়ার গড়তে চলেছেন? তার মানে শুধু এই কন্সট্রাক্সান আর সফটওয়্যার ছাড়াও অন্য কিছু নিশ্চয় আপনার মনের মধ্যে আছে। আমাকে কি করতে হবে তার জন্য?”

মিস্টার সেন ওয়েটারকে ডেকে বলে লবস্টার আর রেড ওয়াইন নিয়ে আসতে। দেবায়ন হাঁ করে মিস্টার সেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিস্টার সেন হেসে বলেন, “তুমি ওই রকম ভাবে দেখছো কেন আমার দিকে? আমি জানতাম তুমি আমার কথা মেনে নেবে, তাই আগে থেকেই লবস্টার অর্ডার করেছিলাম আর এবারে রেড ওয়াইনের সাথে লবস্টারের মজা নিতে নিতে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপের আলোচনা করবো। কাল রবিবার, বাড়িতে যাবার আশা করি তাড়া নেই আর তোমার বাইক আছে। তুমি তো আর অন্য কারুর সাথে নেই। তুমি আমার সাথে আছো। অত চিন্তা কিসের?”

দেবায়নঃ “কিন্তু কাকু, আমি বিজনেসের ব্যাপারে সত্যি কিছু জানি না। সত্যি বলতে, আমি সফটওয়্যার কোম্পানি খুললে শুধু টেকনিকাল দিকটাই হয়তো দেখতাম।”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “না, এই রকম করলে চলবে না। তুমি আমার এম্পায়ারের উত্তরাধিকারী। তুমি একটা আনকোরা হীরে, আমি তোমাকে কাটবো, তোমাকে পলিশ করবো। তুমি আমার চেয়ে বেশি চকচক করবে।”

দেবায়নঃ “মানে?”

মিস্টার সেনঃ “আদব কায়দা, ব্যাবসার প্যাঁচ, কোথায় কার সাথে কি ভাবে কথা ববে, এই সব। তাহলে এবারে আমার পরিকল্পনা খুলে তোমাকে বলি।” লবস্টার আর রাসিয়ান স্যালাডের সাথে, ওয়েটার রেড ওয়াইন দিয়ে চলে যায়। মিস্টার সেন বলেন, “পরের বছর একটা নতুন বছর হবে আমাদের জন্য। তোমার হবে সফটওয়্যার কম্পনি, সেই সাথে কন্সট্রাক্সান আছেই। আমি হস্পিটালিটি সেক্টর মানে হোটেল বিজনেসে ঢুকতে চাই। কন্সট্রাক্সানের লাভের অনেক টাকা সরিয়ে আমি হোটেল বিজনেসে লাগিয়ে দিয়েছি, কেউ জানে না এই বিষয়ে কারন সব ব্ল্যাক মানি। ছয় খানা খুব ভালো ভালো রিসোর্টে আর হোটেলে আমার শেয়ার আছে তবে কারুর মালিকানা নেই। উত্তরাখন্ডের বিন্সারে একটা, একটা হিমাচলের ডালহৌসিতে, একটা মানালির কাছে সোলাং ভ্যালিতে, একটা ব্যাঙ্গালোরে বেশ বড় থ্রি স্টার হোটেল, একটা উটিতে রিসোর্ট এবং পুনেতে বড় থ্রী স্টার হোটেলে।” দেবায়ন থ বনে যায় মিস্টার সেনের কথা শুনে। সামনে বসা ভদ্রলোক আর কোথায় কোথায় কি কি লুকিয়ে রেখেছে সেটা ভাবতে চেষ্টা করে। মিস্টার সেন হেসে বলেন, “তুমি অবাক হয়ে গেলে নাকি? এই গুলোতে শুধু আমার বেনামে শেয়ার কেনা ছিল তাই আর পারমিতাকে বলিনি।”

দেবায়ন হেসে ফেলে, “আরো কিছু আছে নাকি কাকু? বলেই ফেলুন আজকে।”

মিস্টার সেনঃ “না না, আর নেই। এবারে আসল কথায় আসি। আমি চাই পরমিতকে কোম্পানি থেকে সরিয়ে দিতে আর সেই শেয়ার নিবেদিতাকে দিতে। নিবেদিতা কিছু ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট যোগাড় করেছিল, তবে কেউ পঁচাত্তর শতাংশের জন্য রাজি হয়নি। আসলে আমি চাইনি তখন। পরমিতের শেয়ার নিবেদিতাকে দিয়ে দিলে আশা করি শান্ত হয়ে যাবে। এমনিতে নিবেদিতার আর পারমিতার একদম বনে না। কিন্তু তোমার কাকিমা অনেক করেছে, আর নয়। এবারে ওকে কন্সট্রাক্সান থেকে সরিয়ে নিয়ে পরিষ্কার কাজে লাগিয়ে দেবো, হোটেলে। আর নিবেদিতা আমাদের এই কন্সট্রাক্সান দেখবে। তবে ওর কাছে থাকবে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ, বাকিটা তোমার কাকিমার নামেই থাকবে। তবে তোমার কাকিমা আর কাজ করবে না। এবারে আসি হোটেলের কথায়। এই যে নতুন প্ল্যান করেছি, সেইখানে অনেক টাকার দরকার। কিছু হোটেল বেশ ভালো চলে, কিছু হোটেল ঠিক চলে না। সব হোটেলগুলো আমি মালিকানা মানে একান্ন শতাংশ কিনতে চাই। কিন্তু এই মালিকানা সত্ত্বা কিনতে গেলে টাকার দরকার পড়বে। আমি কন্সট্রাসানের জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট যোগাড় করেছি। সেই টাকা আমি সাইফন করবো এই হোটেল গুলোর শেয়ার কেনার জন্য। তোমার সফটঅয়ারের টাকা বাজারে পড়ে আছে, যে কোন সময়ে তোলা যাবে।”

দেবায়ন মন দিয়ে সব কথা শুনে বলে, “আমি এখানে কোথায়?”

মিস্টার সেন হেলে বলেন, “তুমি আমার পাশে থাকবে, আবার কোথায়? অঙ্কনের এই কাজে মন লাগবে কি না সন্দেহ আর অঙ্কন এখন অনেক ছোটো। অনুপমা সফটওয়্যার দেখবে, শ্রেয়া আর রূপকের সাথে। পারমিতা হোটেল ইন্ডাস্ট্রি সামলাবে, নিবেদিতা কন্সট্রাক্সান সামলাবে। আমি আর তুমি, এই গ্রুপের মাথায় থাকবো, তুমি এই গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাই একবার বলছিলাম যে গ্রাজুয়েশানের পড়ে এম.বি.এ করে নাও। অবশ্য আজকাল ডিস্টান্সে এম.বি.এ করা যায়। পরের বৃহস্পতিবার, রায়চকের র‍্যাডিসন ফোর্টে একটা বিজনেস পার্টি আছে। সেখানে একজন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট আসবে, জার্মান ভদ্রলোক। তিনশ কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট। নিবেদিতা ওইখানে থাকবে, তখন পরিচয় করিয়ে দেবো নিবেদিতার সাথে। আর বাকি কথা তোমাকে পরে বলবো।”

দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “সব ঠিক আছে কাকু। কিন্তু আমার একটা কিন্তু আছে। এতো কিছু বলছেন, আমি পারবো তো?”

মিস্টার সেন বলেন, “আজকে তুমি লবস্টার আর ওয়াইনের স্বাদ নাও। পরের বৃহস্পতিবার গাড়িতে যেতে যেতে বাকি কথা বলবো। আর হ্যাঁ, অনুপমাকে এতো কিছু আবার বলতে যেও না। একটু মাথা খাটাও, তুমি সব কিছুতে বড্ড হৃদয় লাগিয়ে ফেলো। সেটা করলে কি আর বিজনেস করা যায়, মিস্টার বসাক?”

দেবায়ন লাজুক হাসে, “আপনি যা বলবেন করতে রাজি আছি।”

মিস্টার সেন হেসে বলেন, “তুমি আমার উত্তরাধিকারী। আমার একমাত্র জামাই যার ওপরে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়।”

মিস্টার সেন আর দেবায়ন ডিনার শেষ করে। বাকি কথা, ওর পড়াশুনা আর কম্পিউটার শিক্ষা দিক্ষা নিয়ে হয়। ওরা টেবিল ছেড়ে উঠতে যাবে এমন সময়ে একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হয়। দেবায়ন বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে, কোথায় যেন দেখেছে মেয়েটাকে। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, চোখ দুটি বড় বড়, ভুরু জোড়া ধনুকের মতন বাঁকা, নাক টিকালো, মুখবয়ব অতি মধুর আকর্ষণীয়। মাথার চুল একপাশে ছাড়া বাম ঘাড়ের উপর দিয়ে সামনে এলিয়ে এসেছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, ঠোঁট দুটো গাড় বাদামি লিপ্সটিকে মাখা। বাম কব্জিতে একটা সোনার ব্রেসলেট। পরনে হাত কাটা, হাঁটু পর্যন্ত কালো রঙের চাপা পোশাক। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে লেপটে। বুকের দিকে তাকাতেই দেবায়নের বুক ছ্যাঁক করে ওঠে, চাপা পোশাকের ভেতরে সুউন্নত দুই স্তন জোড়া মুক্তি পাবার জন্য যেন ছটফট করছে। বুকের দিকে গভীর খাঁজ, স্তনের ভেতরের নরম ফর্সা ত্বকের উপরে রেস্টুরেন্টের হলদে আলো পিছল খেয়ে যায়। শরীরের গঠন অতি লোভনীয়। নরম তুলতুলে পাছা জোড়া দেখে দেবায়নের শরীরের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। দেবায়ন আড় চোখে মেয়েটার দিকে বারেবারে তাকায়। বয়সে ওর থেকে বছর তিন চার বড়ই হবে। কিন্তু কোথায় যেন দেখেছে মেয়েটাকে।
 
মেয়েটা মিস্টার সেনের দিকে এগিয়ে হেসে বলে, “কি ব্যাপার সেন স্যার আজকে ম্যামকে ছাড়াই ডিনার করছেন?”

মিস্টার সেন মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে অভিবাদন করে বলে, “তুমি এখানে, কি ব্যাপার। কারুর সাথে ডিনারের নিমন্ত্রন নাকি?”

মেয়েটা হেসে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে মিস্টার সেনকে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আজকে হটাত আপনার নেচার বদলে গেল বলে মনে হচ্ছে? কি ব্যাপার। পারমিতা ম্যাম জানে তো?”

মিস্টার সেন হেসে ফেলেন, “আরে না না। তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বিজনেস পার্টনার, মিস্টার দেবায়ন বসাক।” আর মেয়েটাকে দেখিয়ে দেবায়নকে বলে, “একে চিনতে পারছো না? টি.ভি সিরিয়াল করে, অনন্যা বাসু।”

দেবায়ন এবারে চিনতে পারে মেয়েটাকে। অনন্যা বাসু, বাংলা টি.ভিতে বেশ কয়েকটা সিরিয়াল করেছে, সেই সাথে গোটা দুই সিনেমাতেও নায়িকার বোন, বান্ধবীর পার্ট করেছে। হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় অনন্যার সাথে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই আপনাকে দেখে তখন থেকে মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি।”

অনন্যা দেবায়নের হাতে হাত মিলিয়ে বলে, “আপনার সাথে দেখা হয়ে বড় ভালো লাগলো। গ্ল্যাড টু মিট সাচ অ্যা হ্যান্ডসাম এন্ড ড্যাসিং ইয়াং ম্যান। কিসের বিজনেস আপনার?”

দেবায়ন হেসে বলে, “আমাকে কেন আর আপনি বলে ডেকে কষ্ট দিচ্ছেন...”

মিস্টার সেন সঙ্গে সঙ্গে দেবায়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “আমার সাথে বিজনেসে আছে মিস্টার বসাক। আচ্ছা, তুমি তাহলে বৃহস্পতিবারে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেও র‍্যাডিসন ফোর্টে। তনুজার কি খবর? কালকে তনুজাকেও নিয়ে এসো।”

দুষ্টুমি ভরা ভুরু নাচিয়ে অনন্যা মিস্টার সেনকে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি রাত নটার মধ্যে পৌঁছে যাবো। বাকি দুইজনকে বলা আছে ওরা আমার আগেই পৌঁছে যাবে। তনুজার সাথে না হয় আমি কথা বলে নেব, আপনি চিন্তা করবেন না। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার।” দেবায়নের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আসছেন কি র‍্যাডিসন ফোর্টে?”

মিস্টার সেন দেবায়নের হয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ও আসবে। যাই হোক ওই কথা রইল, বাকি কথা ফোনে বলে নেব।”

হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারনেশানাল থেকে বেরিয়ে মিস্টার সেন দেবায়নকে বলে, “এবারে রাতে ভালো করে ঘুমাবে, বুঝেছো? রাত পোহালে বুদ্ধি বাড়ে। আর এখুনি সব কথা সবাইকে জানাতে হবে না। আগে এক এক করে পদক্ষেপ নেই আমরা। ধিরে ধিরে সিঁড়িতে চড়ি। সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক হয়ে গেলে সবাইকে জানাবো। দেবশ্রীদিকে সময় হলে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ভালো কথা, তোমার সুট আছে?” দেবায়নের কোনদিন সুটের দরকার পড়েনি, তাই মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে সুট নেই। মিস্টার সেন বলেন, “আমি অনুকে বলে দেবো। আগামী কাল ক্লাসের পরে তোমাকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের রেমন্ড শপে কিম্বা রেইড এন্ড টেলরে নিয়ে যাবে। বেশ পছন্দ মতন দুটি ভালো সুট কিনে নিও। আবার এটা ভেবে বোসো না যে শ্বশুর দিচ্ছে বলে নেবে না।”

হেসে ফেলে দেবায়ন, “না না। সেই রকম কিছু নয়। ওকে তাহলে গুড নাইট।”

মিস্টার সেন চলে যাবার পরে দেবায়ন বাইকে চেপে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই ওর মা জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে এতক্ষণ মিস্টার সেনের সাথে কি কথা বলছিল? মায়ের প্রশ্ন যথাসম্ভব এড়িয়ে উত্তর দেয় যে, ওদের সফটওয়্যার কোম্পানির ব্যাপারে কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন মিস্টার সেন। দেবশ্রী দেবায়নের কথা শুনে আহত হয়ে বলেন যে আগে পড়াশুনা তারপরে বাকি সব। তিনি মিস্টার সেনের সাথে কথা বলার অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেন। মাকে বুঝিয়ে বলে দেবায়ন যে এখুনি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় নি, তবে আগামী বৃহস্পতিবার মিস্টার সেনের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে কিছু কাজের জন্য। রাতে বাড়ি ফিরবে না। দেবশ্রীর সন্দেহ হয়, বলে যে অনুপমার সাথে কথা বলবে, সত্যি কি মিস্টার সেনের সাথে যাবে না অন্য কারুর সাথে। দেবায়ন হেসে বলে, সোজা মিস্টার সেনকে ফোনে জিজ্ঞেস করতে পারে।

দেবশ্রী ছেলের গালে আদর করে হাত বুলিয়ে বলে, “বাবা, যাই করিস। নিজের মান সন্মান বজায় রেখে করিস। তোকে এইখানে নিয়ে আসতে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেছে।”

দেবায়ন মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এতো ভেবো না মা। একবার আমার সফটওয়্যার কোম্পানি দাঁড়িয়ে যাক, তোমাকে মাথায় করে রাখবো আমি আর অনু।”

দেবশ্রীঃ “দেখিস বাবা। যা শুতে যা। কাল আবার কম্পিউটার ক্লাস আছে তোদের।”

রাতের বেলা বিছানায় পড়তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো চাপা পোশাকে পরিহিত অনন্যার দুষ্টু মিষ্টি মুখ। নধর গোলগাল বাঙালি ছাপে ভরা সুন্দরী। স্তন জোড়া বেশ বড় বড়, হাঁটা চলায় এক মত্ততার ছন্দ। মাথায় প্রশ্ন ঢোকে দেবায়নের, একটা বিজনেস মিটিংয়ে এক জন অভিনেত্রীর কি দরকার? আর যে তনুজার কথা বলছিল অনন্যা সে কি নামকরা বাঙালি মডেল, তনুজা রায়? চোখ বুজে তনুজার নধর দেহপল্লবের স্বপ্ন দেখে দেবায়ন। একটা সাবানের বিজ্ঞাপন করেছে, মসৃণ খোলা পিঠের উপর দিয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে কোমর পর্যন্ত, কোমরের নিচে ফোলা নিতম্ব তোয়ালেতে ঢাকা। ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে ডিম্বাকৃতি মুখাবয়বের কিছু অংশে দোল খায়। ফ্যাকাসে গোলাপি ঠোঁট জোড়া ঈষৎ খোলা, এক তীব্র যৌন আবেদন মাখা হাসি নিয়ে টি.ভি স্ক্রিনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় শেষে। মনে পড়ে যেতেই প্যান্টের ভেতরে শিথিল লিঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে। আপনা হতেই প্যান্টের ভেতরে হাত চলে যায়, লিঙ্গ মুঠি করে ধরে নাড়াতে শুরু করে।

বাধ সাধে অনুপমার ফোন, “কি গো তুমি। বাড়ি ফিরে একটা ফোন পর্যন্ত করতে ভুলে গেলে? কি ব্যাপার তোমার? বাবার সাথে এতো কি কথা হলো?”

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে দেবায়ন, “না মানে, আমি তোমার বাবার কথাগুলো ভাবছিলাম।”

অনুপমাঃ “কি কথা হলো তোমাদের?”

দেবায়নঃ “কিছু না এমনি ওই সফটওয়্যার কোম্পানি নিয়েই কথা হলো। কাকু জিজ্ঞেস করছিলেন যে এখন পর্যন্ত আমরা রূপক শ্রেয়ার সাথে কথা বললাম না বলিনি। আমি বলেছি, এখন পর্যন্ত কোন কথা হয়নি। এই সব আর কি। তোমার কি খবর? পায়েল ঘুমিয়ে পড়েছে?”
 
অনুপমাঃ “হ্যাঁ, পায়েল অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকে ভাইয়ের সাথে একটু সামনের পার্কে বেড়াতে গেছিল, তাই মনটা অনেকদিন পরে বেশ ভালো আছে। আচ্ছা একটা কথা বল, বাবা বলল কালকে তোমাকে নিয়ে রেমন্ড শপে না হয় রেইড এন্ড টেলর যেতে। কি ব্যাপার হটাত সুটের কি প্রয়োজন পড়লো যে বাবা নিজে থেকে বললো?”

দেবায়নঃ “পরের বৃহস্পতিবার একটা বিজনেস মিটিং আছে সেখানে যেতে হবে কাকুর সাথে তাই সুটের দরকার।”

অনুপমাঃ “তোমার সাথে কাল বিস্তারিত ভাবে কথা বলবো। কিছু লুকাবে না, তাহলে মাথা ফাটিয়ে দেবো একদম।”

দেবায়ন হেসে বলে, “না মা লক্ষ্মী তোমার কাছে কিছুই লুকাবো না। কালকে ক্লাসের আগে সব বলবো।”

পরের দিন কম্পিউটার ক্লাসে আসার পরেই অনুপমা দেবায়নকে গত রাতের আলোচনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। দেবায়ন ক্লাসের পরে অনুপমাকে সব কথা খুলে বলে। অনুপমা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে ওর বাবার কথা শুনে। সব বলার পরে দেবায়ন অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে ওদের করনীয় কি।

অনুপমা বলে, “বাবা ঠিক যে রকম বলছে, ঠিক সেই রকম করে যাও। দেখা যাক বাবা কি করতে চান। আমাকে কিছুই জানাওনি তুমি। আমি আর এই ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলবো না। ঠিক সময়ে ব্রেক লাগিয়ে বেরিয়ে আসাটা জরুরি। এই সময়ে বাবার কথা না মানলে, মামনিকে বলে দেবে বাবা আর মামনি খুব আহত হয়ে পড়বে, খুব ভেঙে পড়বে। আমার মনে হয়, মা এই সব জানে তাই বাবা বলেছে যে মাকে ঠিক করে বুঝিয়ে নেবে। জানো, সত্যি বলছি বড় কষ্ট পেলাম। এখন মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি মামনির কাছে যেতে পারলে বেঁচে যাই।”

দেবায়ন অনুপমার কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয়, “এই কয়দিনে ঠিক যেমন চলেছে ঠিক তেমনি তুমি ব্যবহার করবে।”

অনুপমা একটা বুদ্ধি দেয় দেবায়নকে, “বাবার সাথে গাড়িতে যাবে, সব কথাবার্তা আর ওখানে যা হবে তার কিছু কিছু ছবি অথবা ভি.ডি.ও করে রাখবে। আমি একবার দেখতে চাই। শেষ পর্যন্ত পুরাতন পন্থায় চলতে হবে, দল ভেঙে রাজত্ব করা।”

দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “মানে?”

অনুপমা হেসে বলে, “কোথাও একটা ভাঙন ধরিয়ে এদের আসল অভিসন্ধি জানতে হবে। এখন শুধু অপেক্ষা করা আর চোখ কান খোলা রাখা ছাড়া উপায় নেই। কলেজ শেষ হোক, আমাদের সফটওয়্যার কোম্পানির কি করছে সেটা দেখা যাক। তারপরে সবার আচার ব্যবহার দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবা যাবে।”

দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে অনুপমার কথা মেনে চলবে। রেইড এন্ড টেলরের দোকানে ঢুকে দুটো দামী সুট কেনা হলো দেবায়নের জন্য, একটা ছাই রঙের অন্যটা ঘিয়ে রঙের। রঙ দুটো অনুপমার পছন্দ মতন কেনা হলো, সেই সাথে দুটো শার্ট আর দুটো টাই। অনুপমা বলল যে এই সব যদি বাড়িতে নিয়ে যায় তাহলে ওর মামনি দেবায়নের ওপরে সন্দেহ করবে এবং বকাবকি শুরু করে দেবে। তাই অনুপমা বলল আগামী বৃহস্পতিবারে সোজা বাড়িতে চলে আসতে। সেখানে ড্রেস করে বাবার সাথে বেরিয়ে যেতে। ও বাবাকে বলে রাখবে যে দেবায়ন বাড়িতেই আসবে। দেবায়ন অনুপমাকে নিবেদিতার কথা জিজ্ঞেস করে। অনুপমা জানায় যে নিবেদিতাকে ভালো চেনে না। কয়েক বার বাবার পার্টিতে এসেছে কিন্তু কোনদিন বাড়িতে আসেনি নিবেদিতা চৌধুরী।

মিস্টার সেন দেবশ্রীকে ফোনে বলেন যে দেবায়নের সাথে বিশেষ কিছু কাজের জন্য একটা রাতের জন্য চাই। দেবশ্রী সেদিন রাতে দেবায়নকে প্রশ্ন করে এই কাজের ব্যাপারে। দেবায়ন মাকে বলে ওদের সফটওয়ার কোম্পানির ব্যাপারে একটা বিজনেস মিটিং রাখতে চান মিস্টার সেন তাই তাদের সাথে দেখা করার জন্য র‍্যাডিসন ফোর্ট হোটেলে যাওয়া। দেবশ্রী বিশেষ ঘাঁটায় না ছেলেকে, শুধু একবার বলে যে পড়াশুনা মাথায় রেখে তবে যেন বাকি কাজ করে।

বৃহস্পতিবারে দুপুরের একটু আগেই দেবায়ন, অনুপমার বাড়িতে পৌঁছে যায়। অনুপমা সেদিন আর কলেজে যায়নি। দেবায়ন উপরে অনুপমার রুমে ঢুকে দেখে পায়েল বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে। কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে শুকনো পায়েলকে দেখে। ওকে দেখে বড় কষ্ট হয় দেবায়নের। অনুপমা ওকে ডেকে নিচে নিয়ে যায়।

পারমিতা দেবায়নকে দেখে বলে, “তুমি বেশ বড় হয়ে গেছো এই কয়দিনে। ব্যাবসা সামলাতে শিখে গেছো। অনুর পছন্দ করা সুটগুলো দেখলাম। বেশ দারুন মানাবে তোমাকে।” একসময়ে একটু একান্ত পেয়ে কাছে এসে বলে, “আমাকে কি সত্যি ভুলে গেলে? এই কয় মাসে একবারের জন্য আমাকে মনে পড়েনি?”

দেবায়ন মৃদু হেসে বলে, “মিমি, তোমাকে ভুলি কি করে। তুমি কি ভোলার? সময় হাতে বড় কম, মিমি তাই কারুর দিকে ঠিক নজর দিতে পারছি না। সত্যি বলছি, সময় পেলেই তোমার কাছে আসবো।”

পারমিতা দেবায়নের গা ঘেঁষে চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি মাখিয়ে বলে, “আমি ঠিক সময় চুরি করে নেব তোমার জন্য। অনেকদিন তোমাকে পাইনি। মিষ্টি মিমি কিন্তু এখন শুধু তোমার কাছেই মিমি আছে।” দেবায়ন পারমিতার চোখের দিকে তাকায়। পারমিতা নিচের ঠোঁট কামড়ে এক আবেদন মাখা হাসি দিয়ে বলে, “আজকে যেখানে যাচ্ছো সেখানে বেশ মজা করতে পারবে। দেখো বাবা, সেখানে এক সুন্দরী আসবে মন ভুলাতে।”

দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “কার কথা বলছো, অনন্যা?”

পারমিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে অনন্যার কবে দেখা হলো?”

দেবায়নঃ “গত শনিবার, হোটেল হিন্দুস্তানে।”

পারমিতাঃ “না না অনন্যা নয়। গেলেই জানতে পারবে কে সেই চোর। একটু সাবধানে থেকো।”

অনুপমার ইচ্ছেতে দেবায়ন ছাই রঙের দামী সুটখানা পরে। কোনদিন টাই বাঁধেনি তাই অনুপমা ওর টাই বাঁধতে সাহায্য করে দেয়। মিস্টার সেন তৈরি, অনুপমা তখন দেবায়নকে সাজিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিকে চুলের একটা গোছা কপালে একটু নামিয়ে দেয় কোনসময়ে তারপরে হেসে ফেলে আবার সেটা ঠিক করে দেয়। দেবায়ন বিরক্ত হয়ে বলে তাড়াতাড়ি করতে। অনুপমা দেবায়নের গালে চুমু খেয়ে একটা পেন জামার পকেটে গুঁজে দেয়। দেবায়ন জিজ্ঞেস করে এই পেন আবার কোন কাজে লাগবে। অনুপমা বলে এই পেনটা ক্যামেরা ওয়ালা পেন, সাথে থাকলে দরকার পড়বে। দুপুরের কিছু পরেই গাড়িতে করে মিস্টার সেন আর দেবায়ন রায়চকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top