What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (2 Viewers)

পায়েলের পরে সবাই সঙ্গীতাকে ছেঁকে ধরে ওদের প্রেমের গল্প শোনার জন্য। সঙ্গীতা চোরা চোখে একবার প্রবালের দিকে তাকায়, অনুপমা সঙ্গীতার থুতনি নাড়িয়ে বলে, “বাপরে, যে মেয়ের মুখে কিনা সকাল বিকেল খই ফুটতো সেই মেয়ের চোখে লাজুক হাসি। ও মা গো, রাখি কোথায় এই মেয়েকে।” প্রবালের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “মাল আমার জন্মদিনে রান্না করতে করতে আমার সুন্দরী বান্ধবীকে হাতিয়ে নিলি। আমি কি পেলাম? আমার প্রেসেন্ট চাই।”

প্রবাল মাথা নিচু করে লাজুক হেসে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি চাস বল।”

ধিমান চেঁচিয়ে ওঠে, “অনুপমার জন্মদিনের মতন একটা ধাসু পার্টি চাই।”

ওই দিনের পার্টির কথা সব বন্ধু বান্ধবীদের মনে গাঁথা। সঙ্গীতা আর প্রবাল ছিল না কিন্তু সঙ্গীতা জানে সেই রাতে পার্টিতে কি হয়েছিল। সেই কথা মনে পড়ে যেতেই সঙ্গীতার সাথে সাথে অনুপমার মুখ লাল হয়ে যায়। দেবায়ন অনুপমার কানেকানে জিজ্ঞেস করে যে পার্টি একটা করা যেতেই পারে।

পেছন থেকে সমুদ্র চেঁচিয়ে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ সেদিনের মতন পার্টি চাই।”

ধিমান আর দেবায়ন হেসে ফেলে সমুদ্রের কথা শুনে। দেবায়ন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “শালা চুপ করে যা। বেশি বকলে যেখান থেকে বেরিয়েছিস সেখানে ঢুকিয়ে দেবো আবার। বোকাচোদা, নিজের মুরোদ নেই ফাউ খেলে সেদিন পার্টিতে টিঁকে গেলি।” তনিমার দিকে সবার নজর চলে যায়। তনিমা কোন রকমে শ্রেয়ার পেছনে মুখ লুকিয়ে নেয় লজ্জায়।

অনুপমা সঙ্গীতা আর প্রবালকে বলে, “তোদের বিয়ে যেদিন হবে সেদিন একটা প্রেসেন্ট নেব।”

দেবায়ন এবারে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে বাল, তুই শালা কি চুপ করে থাকবি?”

রজতঃ “শালা প্রেম করলি তো করলি শেষ পর্যন্ত জারিনা, একজন মুসলিম মেয়েকে? তোর বাড়ির লোক ওর বাড়ির লোক মেনে নেবে? শালা তোকে কেটে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবে দুই বাড়ির লোক, সেটা ভেবেছিস।”

পরাশরঃ “প্রেম ভালোবাসা ভাই ধর্ম মানে না। জারিনা আর আমি ভালোভাবে জানি আমরা কি করছি, এর পরিণতি তুই যা বলেছিস, সেটা ঘটার সম্ভাবনা আশি থেকে নব্বুই শতাংশ। তবে ওই যে বাকি থাকে দশ শতাংশ, আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে নিজেদের আত্মীয় স্বজন পরিবারকে বুঝাতে চেষ্টা করবো। যদি শেষ পর্যন্ত না হয় আমাদের মিল, তাহলে দেখা যাবে।”

সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠে। বাধ্য হয়ে পরাশর মাথা চুলকিয়ে ওদের প্রেমকাহিনী গোড়া থেকে বলতে শুরু করে, “গত অক্টোবরে ঠিক পুজো শেষ হয়ে গেছে। এক সন্ধ্যেবেলায় আমি পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে দাঁড়িয়ে, বাড়ি যাবো বলে বাসের অপেক্ষা করছি। ঠিক পাশ দিয়ে একদল মেয়ে হেঁটে গেল, তার মধ্যে একজন ভারী সুন্দরী দেখতে। পাশের মেয়েদের সাথে দেখে বুঝলাম যে ও মুসলিম, কিন্তু জারিনাকে দেখে একদম মনে হয় না। জারিনাকে দেখে মনে হলো যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে একটা ডানা কাটা পরী, ওর দিক থেকে আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। হাতে স্কুলের ব্যাগ, পরনে স্কুল ড্রেস দেখে বুঝতে পারলাম যে স্কুলে পড়ে, কিন্তু বেশ ডাগর দেহের কাঠামো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কিছু দুর ওদের পেছন পেছন হাঁটলাম। ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ওরা কোচিং থেকে ফিরছে। তারপরে কলেজ ছুটি হলেই আমি পার্ক সার্কাস মোড়ে চলে যেতাম। প্রায় দিন আমি ওখানে ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম ওই সময়ে। কোনদিন দেখা হতো, কোনদিন হতো না। মাঝে মাঝে জারিনা হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকাতো, আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। আবার যেই ওরা হাঁটতে শুরু করতো আমি ওদের পিছু নিতাম। ওই দুই পা চলেই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম আমি, জানি না তখন কি করবো। কিন্তু জারিনার চোখের অধরা ভাষা আর রুপের টান প্রতিদিন বিকেলে আমাকে টেনে নিয়ে যেতো ওই পার্ক সার্কাস মোড়ে। রোজদিন চোখে চোখে কথা হতো কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পেতাম না।”

অনুপমা, শ্রেয়া সবাই মাথা নাড়ায়, “তুই শালা সত্যি একটা সুন্দরীকে লাইন মেরেছিস। এবারে শালা বিয়ের পিঁড়িতে যাবি না কবর খানায় যাবি সেটাই দেখার।”

দেবায়ন অনুপমাকে থামিয়ে দিয়ে পরাশরকে বলে, “বাল, শুধু চোখেই দেখা না আরও কিছু হলো। শালা, লাইনে আনলি কি করে?”

পরাশরঃ “বলছি বাড়া, বলছি। প্রত্যেক দিন ওর জন্য অপেক্ষা করতে যেন আমার ভালো লাগতো। জারিনা মাঝে মাঝে হাঁটার গতি কমিয়ে দিতো, আমি বুঝতে পারতাম বেশ। ওই শুধু চলার পথের সাথী হিসাবে একটু বেশিক্ষণ দেখা হতো আমাদের। এর মাঝে ব্যাগড়া বাধায় চার পাঁচ খানা ছেলে, রোজ ওরা ওইসময়ে ওই খানে দাঁড়িয়ে থাকে আর মেয়েদের দেখে কমেন্ট মারে। মেয়েগুলো কোনোরকমে ওদের না দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে জারিনা আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকতো যখন ওই ছেলেরা কমেন্ট করতো। একদিন মাথা খারাপ করা ব্যাপার হলো। রাস্তায় কিছু একটা পড়েছিল আর তাতে হোঁচট খেয়ে জারিনা পড়ে গেল। বইয়ের ব্যাগ হাত থেকে ছিটকে গেল ওই ছেলেদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলোর হাসি আর লুটোপুটি। একটা ছেলে ব্যাগ তুলে দিতে এসে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বেশ উগ্র মন্তব্য করলো। আমার মাথায় রক্ত চেপে গেল সেই দেখে। শালা একদম ফিল্মি হিরোর মতন একটাকে ধরলাম আর কষিয়ে গালে একটা চড় কসালাম। ছেলে গুলোর বয়স বেশি না তবে শালা বাঞ্চোতদের দেখে মনে হচ্ছিল চুল্লু খাওয়া মাল। একটা ছেলে ছুরি বের করে আমাকে মারতে তেড়ে আসে। আমি যাকে ধরেছিলাম, তার শ্বাস নলি চেপে বললাম ছুরি দেখালে ওখানেই ওর গলা টিপে দেবো। হই হট্টগোলে মেয়েরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। এমন সময়ে একজন মাথার পেছনে বাড়ি মারল, আমি তাও যে ছেলেটাকে ধরেছিলাম তাকে ছাড়লাম না। ততক্ষণে জারিনা আর বাকি মেয়েরা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলে। বাকি ছেলেগুলো পালিয়ে যায় কিন্তু একটাকে ধরে রেখেছিলাম। লোকজন জড়ো হয়ে যে ছেলেটাকে ধরেছিল তাকে মারতে মারতে চলে গেল। আমার মাথায় যে বাড়ি মেরেছিল সেখানে বেশ ব্যাথা করছিল, ফুলে উঠেছিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখি রক্ত পড়ছে। জারিনা আর মেয়েরা আমার মাথা থেকে রক্ত দেখে ঘাবড়ে যায়। আমি মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম, জারিনা দৌড়ে এল আমার দিকে। ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে আমার রক্ত বন্ধ, ব্যাথা বন্ধ হয়ে গেল। জারিনা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে আর একজনের জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ভিজিয়ে আমার মাথায় চেপে ধরে। ওর নরম তুলতুলে আঙুলের স্পর্শে, মাথার ব্যাথা উধাও হয়ে বুকের ব্যাথা শুরু করে দেয়।”

রজতঃ “উরি বাস, একদম শাহরুক খান স্টাইল মেরেছিস। তারপরে কি মাথা ফাটা নিয়ে বাড়ি গেলি নাকি?”

পরাশর, “না রে, একবার ভেবেছিলাম যে কাকাকে একটা ফোন করি। আমার ছোটো কাকা, লালবাজার ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর, তারপরে ভাবলাম এতো ছোটো ব্যাপারে আর কাকাকে জ্বালাতন করা কেন। জারিনা জানাল ওর বাবা ডাক্তার, পাশেই ওদের বাড়ি। ওর বাবা বাড়িতেই আছেন। আমাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গেল। ব্যাস, একদম মাথায় বাড়ি খেয়ে রক্ত নিয়ে হিরোর এন্ট্রি নিলাম। জারিনাদের বেশ বড় দোতলা বাড়ি, পার্ক সার্কাস মোড় থেকে একটু ভেতরে। একতলায় ভাড়াটে আর ওর বাবার একটা চেম্বার। বিকেলে ওর বাবা চেম্বারে ছিলেন। বাড়িতে ঢোকার পরে জারিনার একদম অন্য রুপ। রাস্তায় বান্ধবীদের সাথে কোনদিন বেশি কথা বলতে শুনিনি কিন্তু বাড়িতে ওর মুখে যেন খই ফুটছে। ওর আম্মিজানের কাছে আমার কত তারিফ, কত কিছু। ওর আব্বাজান, ডক্টর মিসবাউল মতিন আন্সারি, পিজি হস্পিটালের মেডিসিনের প্রফেসার। ওর বড় ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিচে গিয়ে ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে আসে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলো, মিষ্টি খাওয়ানো হলো। পরিচয় পর্ব শেষ হলো। ওর দাদা, দানিস আন্সারি, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। ওর মা, নাজমা আন্টি খুব ভালো একদম মাটির মানুষ। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে ঢাকায় ওদের মামাবাড়ি। ওর মায়ের সাথে কথাবার্তা পরিচয়ে বিশেষ গোঁড়া বলে মনে হলো না। কেননা ওকে অথবা ওর মাকে বোরখা পড়তে দেখিনি। কথার ছলে একসময়ে জারিনা আমার ফোন নাম্বার নেয়।”

দেবায়নঃ “বোকাচোদা গাঁড় মেরেছে। প্রপোসালের আগেই শ্বশুর বাড়ি এন্ট্রি মেরে দিলি? তোকে কিমা বানিয়ে দেয়নি ওর বাবা? তুই মাল বাড়িতে কি বললি বে? তোর বাবা জেঠা কি বলল?”

পরাশরঃ “না রে ওদের বাড়িতে ওদের দেখে আমার সেই রকম মনে হয়নি। মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি বলে আর জারিনার হাসির ফোয়ারা দেখে মনে হয় আঙ্কেলের আমাকে একটু ভালো লেগে যায়। বাড়ি ফিরে আসার পরে মা জিজ্ঞেস করলো আমার মাথা ফাটার কথা, আমি বানিয়ে একটা গল্প বললাম। ঘুমাতে গেলাম কিন্তু চোখের সামনে জারিনার মুখ ভেসে ওঠে। কিন্তু আমার মনে সংশয় থেকে গেল, সত্যি কি জারিনা আমার প্রেমে পড়বে? সংশয় দূর হয় গভীর রাতে। প্রায় রাত একটা বাজে, এক অজানা নাম্বার থেকে ফোন এল আমার কাছে। অন্য দিকে একটা মেয়ের গলা, প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কেমন আছি, আমার মাথার ব্যাথা কেমন আছে। আমি থ, রাত দেড়টার সময়ে একটা মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি কেমন আছি। আমি তখুনি ভেবে দেখলাম মেয়েটা জারিনা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ব্যাস আর কি, শুরু হলো আমাদের লুকিয়ে প্রেম। আমি রোজ কলেজ ফেরত পার্ক সার্কাস মোড়ে ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। ঠিক সময়ে ওরা যখন আসতো, তখন বাকিরা জারিনাকে ছেড়ে একটু এগিয়ে যেতো। বাস স্টান্ড থেকে ওর বাড়ির দরজা পর্যন্ত পাশাপাশি হাঁটা। এইটুকু আমাদের হাতে প্রেমের সময়, গল্প করার সময়। আমি শুধু ওর সারাদিনের গল্প শুনতাম, কানের মধ্যে ওর গলার আওয়াজ ভরে উঠতো কিন্তু মন ভরতো না। তাই রাতে ওর বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমি ওকে ফোন করতাম, রাত দেড়টা দুটো কোনদিন সকাল চারটে পর্যন্ত ফোনে গল্প করে কাটিয়েছি।”

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “উম্মম্ম দারুন প্রেম করেছিস মাইরি। প্রোপোস করেছিস কবে? কি ভাবে করলি একটু শুনি?”

পরাশরঃ “দাঁড়া দাঁড়া, এতো তাড়াহুড়ো করলে গল্পের ধারা মাটি হয়ে যাবে। প্রোপোস করেছিলাম এক অদ্ভুত ভাবে, ঠিক ভাবিনি সেদিন যে আমি ওকে প্রোপোস করবো। প্রথম দিকে একা বের হতে বেশ ভয় ভয় করতো, ওই যা রাস্তায় কথা। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম আমার সাথে একা ঘুরতে যেতে ওর কোন অসুবিধে আছে নাকি। একা আমি আর ও বেড়াতে যাবো শুনে ওর চোখেমুখে খুশির ছোঁয়া লাগে। আমি ওকে পরীক্ষার আগে একবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একটু সংশয় ছিল, জারিনা যাবে কি না। ভয়ে ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মন্দিরে যাবার কথা। আমাকে হেসে বলল, নিশ্চয় যাবে বলল আমি ওকে নিয়ে যদি জাহান্নামে যাই তাহলে ও সানন্দে আমার সাথে যেতে রাজি। সেদিন আমাকে আরেকটা কথা বললো, বললো যে ভগবান মানুষের বিশ্বাসে থাকে, ভগবান মানুষের ভালোবাসায় থাকে। ভালোবাসা যেমন মন্দির মসজিদ দেখে না, তেমনি ভগবান হিন্দু মুসলিম শিখ ক্রিস্টান দেখে না। অনেক বড় কথা বলেছিল ওই ছোটো মেয়েটা আমাকে। সত্যি বলছি, মন্দিরে গিয়ে আমি দেখলাম ওর ভক্তি। মন্দিরে বেশির ভাগ মানুষকে দেখলাম শুধু পাথরের মূর্তিকে প্রনাম করতে, সেখানে জারিনাকে দেখলাম যেন নিজের মাকে প্রনাম করছে। কপালে মন্দিরের সিঁদুরের টিপ পরে তাকিয়েছিল আমার দিকে, হাঁ হয়ে গেছিলাম ওর মুখ দেখে। সেদিন মনে হয়েছিল ওই মন্দির প্রাঙ্গনে ওকে জড়িয়ে ধরি। তারপরে ওর পরীক্ষা চলে এল মার্চে, খুব ভয়। সে কয়দিন আর দেখা হলো না। পরীক্ষার পরে দেখা সাক্ষাৎ একটু কমে যায়, বাড়ি ছেড়ে বের হতে পারে না। বাড়ি থেকে বের হলে সাথে ওর এক বান্ধবী, আহীদাকে নিয়ে আসতো। লুকিয়ে চুরিয়ে বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখতে গেছি তিনজনে, ব্যাস আর কি। তবে মাঝে মাঝে আহীদা আমাদের ছেড়ে দিতো, শুধু বলে দিতো যে বাড়ি ফেরার আগে যেন ওকে একটা ফোন করে দেওয়া হয় তাহলে আহীদা পার্ক সার্কাস মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
 
অনুপমা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ধুর বাড়া, প্রোপোস করলি কি করে সেটা বল?” সবাই একসাথে চেপে ধরে পরাশরকে।

পরাশর হেসে বলে, “ওর পরীক্ষার পরে একদিন ওদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। এক বিকেলে মেট্রোতে একটা হিন্দি সিনেমা দেখার পরে আউট্রাম ঘাটের স্কুপে বসেছিলাম আমরা তিনজনে। আহীদা নিচে গেছিল আমাদের আইস্ক্রিম নিয়ে আসার জন্য। বিকেলের সূর্য ঠিক দ্বিতীয় হুগলী সেতুর পেছনে পাটে বসতে চলেছে। ঘোলা গঙ্গার জলে কমলা রঙ লেগেছে, জারিনা চুপ করে বসে সেই গঙ্গার জল দেখে চলেছে। আমি আলতো করে ওর কাঁধে হাত ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে কি ভাবছে। আমার দিকে তাকিয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল, আমি চমকে গেলাম ওর শুকনো মুখ দেখে। আমি ওকে শুকনো মুখের কারন জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, যে কারন ওর জানা নেই। আমি ওকে নিজের দিকে টেনে নিলাম, বাম বাজুর উপরে মুখ ঘষে আমাকে বলল যে ওর খুব ইচ্ছে করছে এইভাবে বসে থাকতে। আমি তখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে সারা জীবন আমার সাথে এই রকম ভাবে বসতে চায় কি না। চুপ করে আমার দিকে না তাকিয়ে বুকের উপরে মুখ গুঁজে মাথা নাড়িয়ে বলে, ওই রকম ভাবে লুকিয়ে থাকতে চায়। আমি ওর মাথায় ছোটো চুমু খেয়ে বলেছিলাম যে ওকে আমি বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখবো। সেদিন দুই জনেই জানতাম আমাদের ভবিষ্যৎ অত প্রশস্ত নয়, আমাদের সম্পর্কের ধারা অতি সহজে সাগর সঙ্গমে মিলিত হবে না। হয়তো কোনদিন হবে না, কিন্তু ওই টুকু প্রেম, ওই টুকু ভালোবাসা দিয়ে বুক ভরিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। আহীদা এসে দেখে যে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বসে। আহীদার হাতের ছোঁয়ায় জারিনার সম্বিৎ ফেরে। চোখ মুছে হেসে আহীদাকে বলে সব কথা। আহীদা চুপ করে শুনে বলে যে এই ভয় পেয়েছিল, জানতো এইরকম কিছু একটা হতে চলেছে। সাবধান করে দেয় জারিনাকে কিন্তু সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে আমাদের পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। জারিনা পালিয়ে বিয়ে করতে নারাজ, ওর আব্বাজানের বুকের পাঁজর, আম্মির চোখের মণি। আমাকে বলে যে ওর বাড়িতে যেতে, বাড়ির সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করতে। আমি তখন ওকে আমাদের বাড়ির ব্যাপারে কিছুই জানাই নি।”

“আমাদের বাড়ি একদম গোঁড়া, জেঠু পুরানো দিনের মানুষ, বাবাকে হয়তো কিছু বুঝালেও বুঝবে কিন্তু জেঠুকে বুঝিয়ে ওঠা অসম্ভব। কাকার কথা কেউ কানে নেয় না বললেই চলে। আমি কাকিমাকে সব কথা জানিয়েছিলাম, কিন্তু কাকিমার কথা কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেনা। মাকে বলেছিলাম যে আমি যদি অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসি তাহলে আমার বাড়ি কি সেই সম্পর্ক মেনে নেবে? মা এক কথায় মানা করে দিয়েছিল আমাকে। বলেছিল মায়ের ঠাকুর ঘরে ভিন্ন ধর্মের মেয়ের প্রবেশ নিষেধ। বাবাকে অথবা জেঠুকে জানাবার প্রশ্ন ওঠে না। একাত্তরে আমার ঠাকুরদাকে নাকি মুসলমানেরা মেরে ফেলে দিয়েছিল, সেই রাগ আজ পর্যন্ত বুকে পুষে রেখেছে। ওদিকে জারিনা এখন ওর বাবার কাছে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি। জারিনার মা কিছুটা জানেন তবে আন্টি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আব্বাজানকে একদিন না একদিন জানাতে হবে, সেইদিনের আশঙ্কায় দিন গুনছে জারিনা। জারিনা জানে ভালো ভাবে যে আঙ্কেলকে জানালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে, জারিনা প্রস্তুত সেই বিশ্বযুদ্ধ সামাল দিতে। সব মিলিয়ে, আমার বাড়ি নাকচ করে দিয়েছে এক প্রকার আর ওইদিকে হয়তো আঙ্কেল জানলে কি হবে সেটা জানা নেই।”

ধিমান মাথা চুলকে বলে, “শালা, তুই বাল একটা প্রেম করেছিস। হ্যাঁ গল্প শুনে মনে হচ্ছে প্রেম কাহিনী হচ্ছে একদম। লুকিয়ে চুরিয়ে প্রথম দেখা, লুকিয়ে চুরিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া, আর বড় কথা হচ্ছে বাড়ির সাথে যুদ্ধ। আমি শালা তার মানে ঠিক মতন প্রেম করে উঠতে পারলাম না আর। ঋতুপর্ণাকে একটা বন্ধুর পার্টিতে দেখলাম, তারপরে সেই বন্ধুকে বললাম যে বাল একটু লাইন করিয়ে দে। ব্যাস, ঋতু প্রথম দেখাতেই গলে গেছিল তাই ঋতুকে কাবু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বাবা মা জানে ঋতুর কথা, বাবার একটু আপত্তি আছে কারন ঋতু নার্স, মায়ের একদম চোখের মণি হয়ে গেছে ঋতু। বাবাকে বশ করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। ওইদিকে ঋতুর পরিবারের দিক থেকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না আশা করা যায়। ওর বাবা নেই, ওর মা জানেন আমাদের ব্যাপার। ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে একবার আমার। আমাদের একদম নির্জলা, নির্ভেজাল প্রেম। কোন টানাপোড়েন নেই, সোজা সরল গাড়ি একদম হাইওয়ে দিয়ে হাঁকিয়ে চলেছে।”

দেবায়ন হো হো করে হেসে বলে, “ভাই আমার অবস্থা এক। কলেজের প্রথম দিনে শালা হুমড়ি খেলাম অনুপমাকে দেখে।”

ধিমানঃ “শালা তুই একা না বে, অনেকে সেদিন হুমড়ি খেয়েছিল অনুপমাকে দেখে। বাল, তুই হাত মেরে নিলি।”

অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “বাল ছেঁড় তোরা, আমার পেছনে কলেজের অর্ধেক কেন শালা সারা কোলকাতা আমার পেছনে। এবারে সবাই যে যার মনের মানুষ পেয়ে গেছে, ব্যাস আবার কি। এবারে তনিমার একটা হিল্লে হলে হয়।” দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কি আমাদের গল্প বলতে শুরু করে দিলে নাকি?”

দেবায়নঃ “সবাই যখন বলছে তাই একটু বলে দেই আর কি।”

পায়েল হেসে বলে, “সেদিন শালা বৃষ্টি না হলে বড় ভালো হতো। তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি পেয়ে যেতাম আর এরা দুইজনে আঁটি চুষতো।”

অনুপমা পায়েলের মাথায় টোকা মেরে বলে, “আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ও। আর কেন অপেক্ষা করতাম। সেদিন যদি কিছু না বলতো তাহলে ট্যাক্সির নিচে চলে আসতাম।”

পরাশরঃ “ওকে ওকে ঠিক আছে, যেটুকু আছে সেইটুকু শুনি একটু।”

দেবায়নঃ “যাই হোক সিঁড়িতে ধাক্কা খাওয়ার কথা কারুর অজানা নেই। তারপরে একটু বন্ধুত্ব হলো, তারপরে একদিন কফি হাউসে করলাম প্রোপোস, ডারলিং একবারে গলে মোম। আমার মাকে কয়েক মাস আগে জানিয়েছি, মা অনু বলতে অজ্ঞান। আর কাকু কাকিমার এক অবস্থা, বাড়ির লোকের সাথে যুদ্ধ নেই, কথা কাটাকাটি নেই, একদম হাইওয়ে দিয়ে চলছে আমাদের প্রেমের গাড়ি। একটু এবড় খাবড় না থাকলে ঠিক বোঝা যায় না যে হ্যাঁ প্রেম করছি।”

পায়েল চেঁচিয়ে বলে, “শালা তোর গল্প আমি সব জানি। তুই বাড়া আর বুক ফুলিয়ে কিছু বলতে যাস না।”

দেবায়ন পায়েলকে মিচকি হেসে বলে, “কেন সেদিন রাতে কি ডোজ ঠিক পড়েনি? আবার চাই নাকি?” অনুপমা, দেবায়নের বাজুতে চিমটি কেটে চুপ করে যেতে অনুরোধ করে।

গল্প করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বাড়ির উদ্দেশ্যে কিছু পরে সবাই রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে অনুপমা পায়েলকে একবার অগ্নিহোত্রীর কথা জিজ্ঞেস করে। পায়েল সত্যি কথা বলে ফেলে, অনুপমাকে বলে যে অগ্নিহোত্রীর ব্যাপারে বিষদ কিছু জানা নেই তবে ওর পিসতুতো দাদার বন্ধু হিসাবে ভালো লাগে এই মাত্র। পরিচয়ের পরের পর্বের দিকে এগোনোর আগে একবার অন্তত অগ্নিহোত্রীর ব্যাপারে সম্পূর্ণ জেনে নেবে।

পরাশরের সাথে দেবায়নের কথা হয়। পরাশর জানায় যে কিছু দিনের মধ্যে ঈদ, ঈদে জারিনার বাড়িতে জারিনার মা ওকে ডেকেছে। নিজেদের সম্পর্কের সম্বন্ধে কিছু কথাবার্তা বলতে চায় পরাশর, বুকের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বাজছে তাও ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাবার ছেলে নয়।

বাড়ি ফিরে অনুপমা দেখে যে ওর ভাই মুখ শুকনো করে বসে আছে। ভাইকে কারন জিজ্ঞেস করলে, অঙ্কন উত্তর দেয় যে একটা বাইকের বায়না ধরেছিল, বাবা বকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। অনুপমা ভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে। মাকে জিজ্ঞেস করে বাইক না কিনে দেওয়ার কারন। পারমিতা জানায় যে অঙ্কনের ইদানিং পড়াশুনায় বিশেষ মন নেই। কোচিংয়ের স্যার নাকি একদিন পারমিতাকে ফোনে জানিয়েছে যে মাঝে মাঝে অঙ্কন কোচিংয়ে আসে না। অনুপমা সব শুনে রেগে যায়। অঙ্কনকে খাবার পরে নিজের ঘরে নিয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে কোচিংয়ে না যাবার কারন। মুখ দেখে অনুপমা বুঝতে পারে যে অঙ্কন প্রেমে পড়েছে। লাজুক হেসে অঙ্কন জানায় যে কয়দিন কোচিং যায়নি, সেই কয়দিন এক বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছিল। ভাইয়ের নতুন প্রেমের কথা শুনে অনুপমা উৎসুক হয়ে যায়। ভাইয়ের বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করাতে, অঙ্কন জানায় যে স্কুলের এক বান্ধবী, নাম গরিমা মিত্তল, মাড়োয়ারি মেয়ে। অনুপমা গরিমার ফটো দেখতে চাইলে, মোবাইলে একটা মেয়ের ফটো দেখায় অঙ্কন। মেয়েটা বেশ সুন্দরী, পাতলা আর ছিপছিপে গড়নের, মুখের গঠন ডিম্বাকৃতি, গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। অনুপমার কাছে অঙ্কন বায়না ধরে যে বাবাকে বলে কয়ে ওকে বাইক দিয়ে হবে। অনুপমা জিজ্ঞেস করলে জানায় যে বাইকে গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে কোলকাতা ঘুরবে। অনুপমা হেসে ফেলে ছোটো ভাইয়ের কথা শুনে। অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে রাতে দেবায়নকে ফোনে ভাইয়ের সব কথা জানিয়ে দেয়। দেবায়ন বলে যে ছেলে বড় হয়ে গেছে, নিজের মনের মতন সাথী খুঁজে পাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এখন খেলাধুলা করে বেড়াবে কিছু দিন, মন ভরে গেলে হয়তো নতুন সাথী খুঁজতে বেরিয়ে যাবে।

কয়েকদিন পরে বাবাকে অনেক অনুরোধ করে অঙ্কনের জন্য বাইক কেনা হয়। বাইক পেয়ে অঙ্কন ভারী খুশি, সেই সাথে অনুপমা জানিয়ে দেয় যে, এবারে যেন পড়াশুনাতে মন দেয় আর যেন কোনদিন কোচিং পালিয়ে সিনেমা দেখতে না যায়। অনুপমা, মাকে একদিন রাতে জানায় যে ওর ভাই প্রেম করছে। সেই শুনে পারমিতা খুব খুশি, অঙ্কনকে বলে গরিমাকে বাড়িতে ডাকতে। উচ্চমাধ্যমিকে যাবার পরে অঙ্কনের বয়সের সাথে সাথে আচরনের অনেক পরিবর্তন ঘটে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কথা বলা। আগে শুধু দিদির সাথেই মন খুলে কথা বলতে পারতো, মায়ের কাছে মন খুলে কথা বলার অবকাশ কোনদিন পায়নি। মায়ের মুখে গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে অঙ্কন জানিয়ে দেয় যে ভবিষ্যতে একদিন নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাড়িতে আসবে।

অনুপমা আর দেবায়নের জীবনে নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ বিদায় নেয়। মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যেন সাজ সাজ রব পড়ে যায়, সকালে উঠে কলেজে দৌড়ানো, তারপরে কম্পিউটার ক্লাস, অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা। দেবায়নকে ওর মা জানিয়ে দিয়েছেন যে কম্পিউটার ক্লাসে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তাই টাকা একটু সঞ্চয় করে নিয়ে পুজোর আগে দেবায়নের জন্য বাইক কিনে দেবে। দেবায়ন বোঝে মায়ের কষ্ট, তাই বাইকের জন্য বেশি আব্দার করেনি। দেবশ্রী একদিন বিকেলে অফিস থেকে এসে বলে যে এক শুক্রবার অনুপমাকে নিয়ে বাড়িতে আসতে, অনেকদিন দেখা পায়নি হবু বৌমার। সেই শুনে দেবায়ন বেশ খুশি। দেবশ্রী, পারমিতাকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে আগামী শুক্রবার অনুপমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে, দিন দুই থাকবে দেবশ্রীর কাছে। রাতের বেলা দেবায়ন আর অনুপমা, ফোনে গল্প করে কাটিয়ে দেয়।

পরেরদিন বিকেলে কলেজের পরেই দুইজনে বাড়ি পৌঁছে যায়। সেদিন দেবশ্রী তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরে। হবু শ্বাশুড়িকে দেখে অনুপমা বেশ খুশি। দেবশ্রী অনেকদিন অনুপমাকে দেখেনি তাই বেশ খুশি। অনুপমা আর দেবশ্রী রান্না ঘরে রান্নায় ব্যস্ত। দেবায়ন বসার ঘরে বসে ওর জীবনের প্রধান দুই মহিলাকে দেখে।
 
অনুপমা মিচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি দেখছো এমন ভাবে?”

দেবায়নঃ “কেন তোমাদের দেখতে দোষ আছে নাকি?”

দেবশ্রী হেসে বলে, “আজকে কিন্তু অনু আমার কাছে শোবে। ভুলেও বেড়াতে যাবার কথা ভাবিস না যেন।”

হেসে ফেলে দেবায়ন, “না না, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কেউ তোমাদের আলাদা করতে পারবে না। এহেন অবস্থায় দুই সিংহীর মাঝে কেন এক ছোটো হরিণ শাবক নিজের প্রান দেয়?”

অনুপমাঃ “হ্যাঁ আর বলতে, তুমি হরিণ শাবক। তাহলে রাতে শুধু ঘাস খেয়ে থাকবে আর আমরা কষা মাংস আর লুচি খাবো।”

খাবার সময়ে দেবায়ন মাকে বলে, “মা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আবার কি করলি তুই, না নতুন কিছু চাই তোর।”

দেবায়ন বলে, “না মা, এবারে প্রবলেম ঠিক আমার নয়। আমার এক বন্ধুর, পরাশর।”

অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, তোমাকে কিছু একটা উপায় বের করতে হবে।”

দেবশ্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি উপায়, কি ব্যাপার। সব কথা শুনি আগে তারপরে বিচার করা যাবে।”

দেবায়ন বলতে শুরু করে, “মা, আমাদের এক বন্ধু আছে পরাশর। আমাদের সাথে পড়ে। সেই ছেলে একটা মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার নাম জারিনা, বেশ মিষ্টি দেখতে। মুশকিল হচ্ছে, পরাশরের বাড়িতে কেউ জারিনাকে মেনে নেবে না। ওইদিকে জারিনার বাড়িতে জারিনার মা একটু নরম হয়েছেন। ঈদের পরে পরাশর জারিনার বাড়িতে গিয়েছিল। জারিনার আম্মিজান পরাশর আর জারিনার সব কথা জানে, মন মানতে চাইলেও সমাজ আত্মীয় স্বজন যে মানতে চায় না। জারিনার বাবাকে জারিনার মা কথার ছলে পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে কিছু আঁচ আগে থেকে দিয়েছিলেন। জারিনার বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন এহেন সম্পর্ক সম্ভব নয়। পরাশরকে বলেছেন যে মেয়েকে সেই ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে যেন ভাবে না যে মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। সেই কথা শুনে, পরাশর আর জারিনা খুব ভেঙে পড়ে। জারিনা কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, সেই সাথে আত্মহত্যার কথা বলে। মেয়ের মুখ দেখে ওর আব্বাজান কিছুটা নরম হন, কিন্তু জারিনার আব্বাজানের এক কথা, পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে সেই সাথে জারিনার বাবা, পরাশরের পরিবারের সাথে কথা বলতে চায়। এখানে সমস্যা হচ্ছে যে, পরাশরের মা এক কথায় জানিয়ে দিয়েছে যে ভিন্ন ধর্মীর মেয়েকে বাড়ির বউমা করে আনতে নারাজ। কোন এক সময়ে পরাশরের ঠাকুরদাকে বাংলাদেশে মুসলমানেরা হত্যা করেছিল, সেই কথা নিয়ে আজো বসে আছে ওর বাবা জেঠা। পরাশর কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না।”

অনুপমাঃ “মামনি, তুমি আমাদের ডিক্সানারি, তুমি কিছু উপায় বলে দাও।”

দেবশ্রী হেসে ফেলে, “তোরা দুইজনে কি সারা পৃথিবীর সমস্যার সমাধান করতে বেরিয়েছিস?”

অনুপমা বায়না ধরে, “না মামনি, কিছু একটা তোমাকে করতেই হবে। জারিনার বাবাকে কিছু করে বুঝাতে চেষ্টা করতে হবে আর সেই সাথে পরাশরের বাড়িকে। জারিনার বাবা কিছুটা নরম হয়েছেন, এবারে পরাশরের বাড়িকে কি করে নরম করা যায় সেটা বলে দাও।”

দেবশ্রী বলে, “কেন? যেমন ভাবে জারিনা ওর বাড়িকে নরম করেছে তেমনি ভাবে মানসিক চাপ দিয়ে পরাশর নিজের পরিবারকে চাপে ফেলুক।”

দেবায়নঃ “মা, সে কাজ করা হয়ে গেছে। ওর বাবা আর জেঠা ওকে ত্যাজপুত্র করে দেবে বলেছে। ওইসব আত্মহত্যার কথা ধোপে টেঁকেনি পরাশরের বাড়িতে। ওর কাকাও কিছু বুঝিয়ে উঠতে পারেনি ওর বাবা জেঠাকে।”

দেবশ্রীঃ “কাল একবার পরাশরকে বাড়িতে ডাক, আগে ওর সাথে কথা বলে দেখি। আর আমি একজন বাইরের মানুষ হয়ে কি মুখে দুই বাড়ির সাথে কথা বলবো?”

দেবায়ন আর অনুপমা বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। দুই পরিবারের সাথে যেচে কথা বলা ঠিক নয়, যেখানে দেবশ্রী দুই পরিবারের কাউকে চেনে না। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে পরাশরের সাথে কথা বলে সব কিছু জেনে তবে কিছু একটা বিচার করবে। পরের দিন যথারীতি পরাশর, দেবায়নের বাড়িতে আসে। সেই সময়ে অনুপমা অথবা দেবায়ন, দুইজনেই কম্পিউটার ক্লাসে ছিল, তাই পরাশরের সাথে দেখা হয় না। বিকেলে বাড়িতে ফিরে দেবায়ন মাকে পরাশরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। দেবশ্রী জানায় যে বর্তমানে ওদের পড়াশুনাতে মন দেওয়া উচিত। সময় মতন সব ঠিক হয়ে যাবে।

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, কি করে ঠিক করবে তুমি?”

দেবশ্রী হেসে বলে, “পরাশরের মুখে সব কিছু শুনলাম। ওদের যৌথ পরিবার, ওর জেঠা বাড়ির কর্তা। ওর জ্যাঠা পুরানো দিনের মানুষ, শুনে মনে হলো ভাঙবে তবু মচকাবে না। ওর বাবাকে হয়তো বুঝানো সম্ভব হবে, তবে মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলতে হবে। ওর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর হলে কি হবে, বাড়িতে ভিজে বেড়াল। ওর মায়ের আর ওর কাকিমার কথা বলা যেতে পারে শুধু হেঁসেল ঠ্যালা ছাড়া আর কিছু নয়। এমন যৌথ পরিবার এখন এই কোলকাতায় আছে। ওর জেঠুর সামনে নাকি কারুর মুখ ফোটে না। অনেক ভালো ভালো শাল গাছ আমার সামনে নুইয়ে পড়েছে। যেখানে ছলকপটে কাজ হয় না, সেখানে ভালোবাসা দিয়ে কাজ হয়। ভাবছি একদিন দুই বাড়িকে আমাদের বাড়িতে নেমতন্ন করবো। কিন্তু তার আগে কোন এক অছিলায় তোদের মধ্যে কাউকে পি.জি হসপিটালে গিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করতে হবে। তোদের দুই জনের মধ্যে কেউ এগিয়ে গেলে তারপরে না হয় আমি ওর বাবার সাথে পরিচয় করতে পারবো। তারপরে, পরিচয় বাড়লে জারিনার পরিবারকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে অসুবিধে হবে না। এবারে পরাশরের বাড়ি কি করে যাওয়া যায়। দেবায়ন আশা করি ওদের বাড়িতে গেছে, তাই অনায়াসে একদিন ওদের ডেকে বাড়িতে খাওয়ানো যায়। ওই দিনে জারিনার বাবা মা আর পরাশরের বাবা মায়ের সাথে এক সাথে কথা বলবো। সামনা সামনি দুই অভিভাবককে বসিয়ে কথা বলে বুঝিয়ে দেখি।”
 
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, “তোমার কাছে সব কিছুর সমাধান আছে, তাই না মামনি।”

দেবশ্রী হেসে বলে, “গত কাল থেকে অনেক তেল মেরেছিস, তাই ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি।”

দেবায়নঃ “কিন্তু কি করে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় হবে? সেটা একটু বলে দাও?”

দেবশ্রীঃ “সব বুদ্ধি কি আমি দেবো নাকি? যেমন করে পরাশর জারিনার বাড়িতে গেছে, ঠিক তেমন করে তোমাকে ওর বাড়ির লোকের সাথে পরিচয় করতে হবে।”

অনুপমা হেসে বলে, “চিন্তা নেই মামনি, পার্ক সার্কাস মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি ওর ঠ্যাঙ ভেঙে দেবো, ব্যাস আবার কি। পরাশর সাথেই থাকবে, অগত্যা ওকে নিয়ে জারিনার বাড়িতে যেতেই হবে।”

সেই শুনে দেবায়ন অনুপমার চুল টেনে বলে, “মা এবারে তোমার বউমা কিন্তু আমার ওপরে চড়াও হচ্ছে। মারপিট করলে কিন্তু আমি ছেড়ে দেবো না।” দুইজনে মারামারি শুরু করে দেয়।

দেবশ্রী মৃদু ধমক দিয়ে বলে, “ঠিক আছে, দেখা যাক, ওই ঠ্যাঙ ভাঙতে হবে না। দেখি কাউকে পাই কিনা যে পি.জি হসপিটালে কাজ করে। তার মারফত একবার ডক্টর মিসবাউলের সাথে দেখা করে আসবো।”

খাওয়া শেষ, দেবায়ন টিভি দেখতে ব্যস্ত। মায়ের কড়া নির্দেশে অনুপমার ধারে কাছে যেতে পারেনি। গত রাতে ঘুমিয়ে যাবার পরে মায়ের রুমে উঁকি মেরেছিল দেবায়ন। যথারীতি, প্রেয়সীর অর্ধ নগ্ন শরীর দেখে ক্ষান্ত হয়ে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের বিছানায় এসে, লুক্কায়িত বাক্স থেকে অনুপমা, পারমিতার প্যান্টি বের করে নাকের কাছে শুঁকে আত্মরতি করে ঠাণ্ডা করতে হয়েছে নিজেকে।

সেদিন অনুপমা একটা পাতলা স্লিপ গায়ে দিয়ে দেবায়নের কোল ঘেঁসে বসে টিভি দেখছিল। টিভির দিকে বিশেষ মন ছিল না অনুপমার, মন বড় আনচান করছিল একটু দেবায়নের সান্নিধ্য পাওয়ার। দেবশ্রীর রুমের দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে দুই জনে পরস্পরের ঠোঁটের মাঝে বিলীন হয়ে যায়। চুম্বনে মর্দনে কামাগ্নি জ্বলে উঠতে বিশেষ সময় নেয় না, কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। দেবশ্রী নিজের রুম থেকে অনুপমাকে ডাক দেয়, বলে যে সোমবার ওদের কলেজ আর দেবশ্রীর অফিস, সুতরাং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে যাতে সকাল সকাল উঠতে পারে। অগত্যা অনুপমা, দেবায়নের কোল থেকে উঠে শুকনো মুখে দেবশ্রীর রুমে ঢুকে পড়ে। দেবশ্রী কিছু অফিসের কাজে ব্যস্ত।

রাতে মামনিকে অফিসের কাজে ব্যস্ত দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “তোমার অফিসে ইদানিং কি কাজ খুব বেড়ে গেছে?”

দেবশ্রী ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তা একটু বেড়ে গেছে।”

অনুপমাঃ “দিল্লীর কথা কি হলো? তুমি কি ভেবেছো?”

ম্লান হেসে দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তোরা যখন দিল্লী যাবি না তাহলে আমি গিয়ে কি করবো? তাই আর সেই নিয়ে ভাবছি না। দেখি আরো কয়েক মাস এমনিতে আমি মিস্টার ঠাকুরকে একটু হিন্ট দিয়েছি যে আমার দিল্লী আসা হবে না। তাই মনে হয় আমার কাজ বেড়ে গেছে। কোলকাতা অফিসের সাথে সাথে অন্য অফিসের কাজগুলো আমার ঘাড়ে ধিরে ধিরে এসে পড়ছে।”

অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?” দেবশ্রী জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে অনুপমার দিকে তাকায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথ অথবা মল্লিকা তোমাকে ফোন করে?”

প্রশ্ন শুনে দমে যায় দেবশ্রী, মুসৌরি ভ্রমণের পরে বেশ কয়েক মাস খুব ফোনে কথা হতো ধৃতিমানের সাথে। গত কয়েক সপ্তাহে সেই ফোনের কথা একটু কমে আসে। অনুপমার দিকে ম্লান হেসে বলে, “হ্যাঁ, কথা হয়, কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস?”

অনুপমা হেসে বলে, “না এমনি জিজ্ঞেস করছি। মিস্টার দেবনাথ কিছু বলেছে তোমাকে, কোলকাতা আসছে কি ওরা?”

হেসে ফেলে দেবশ্রী, “তোর মামনিকে কি এই বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চাস? তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”

অনুপম হেসে দেয়, “না সেটা নয় মামনি, তবে তুমি বড্ড একা। আমি জানি অনেক কিছু তাই বলছিলাম। তুমি একবার মিস্টার দেবনাথকে বলে দেখতে পারো কোলকাতায় আসার কথা। দেখো না কি বলে?”

দেবশ্রীঃ “আমার বলা কি সব? ওর একটা মেয়ে আছে না, মল্লিকার ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি?”

অনুপমা বলে, “হ্যাঁ তা আছে বৈকি। তুমি কি করবে কিছু ভাবলে?”

দেবশ্রী হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “মেয়ে আমার অনেক বড় হয়ে গেছে। ছাড় ওইসব আলোচনা, চলো শুয়ে পড়ি।”

অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলে, “মামনি প্লিস একটু দেবায়নের কাছে যাবো?”

দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “একদম দুষ্টুমি নয়। কাল সকাল সকাল ওঠা আছে, তোদের কলেজ আর আমার অফিস আছে।”
 
পরেরদিন কলেজে পৌঁছানো মাত্র, পরাশর দেবায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে যে পায়ের ধুলো দিতে। বাবা মায়ের কথা শুনে আর জারিনার বাড়ির কথা শুনে একপ্রকার দুই জনে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। জারিনা ভেঙে পড়েছে, চাইলেও দেখা করতে পারছে না পরাশরের সাথে। দেবায়নের মায়ের কথা শুনে একটা আশার ক্ষীণ আলো এই ঘন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। পরাশর বলে যে দেবায়নের মা বলেছেন কোন ভাবে নাম পরিচয় না জানিয়ে জারিনার সাথে পরাশরের মায়ের সাক্ষাৎ করাতে হবে। জারিনাকে দেখে এক মেয়ে হিসাবে পছন্দ হয়ে গেলে তারপরে পরাশরের মায়ের মন গলানো সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু কি ভাবে সেটা সম্ভব হবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না পরাশর। অনুপমা বলে যে একটা উপায় করে দেবে যাতে পরাশরের মায়ের সাথে জারিনা সাক্ষাৎ হয়। পরাশর, অনুপমাকে বলে যদি ওদের পরিবার রাজি হয়ে যায় জারিনা আর পরাশরের সম্পর্কে, তাহলে সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে অনুপমা আর দেবায়নের কাছে। অনুপমা হেসে বলে, কাজের সময় যেন পাশে থাকে তাহলেই হবে। পরাশর বলে যে পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেবায়নের মায়ের সাথে জারিনার বাবার পরিচয় করিয়ে দেবে। দেবায়ন, পরাশরের কানেকানে মজা করে জানায় যে জারিনার সাথে প্রথম রাত দেবায়ন কাটাতে চায়। সেই কথা শুনে পরাশর মারতে ছোটে দেবায়নকে।

একদিন শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনার কলেজ যায় জারিনার সাথে দেখা করতে। ওদের দেখে জারিনা অবাক হয়ে যায়। অনুপমা আর শ্রেয়াকে দুঃখের কথা জানায় জারিনা। পরাশরের সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়, মাঝে মাঝে কলেজের অছিলায় দুই একবার দেখা করেছে, কিন্তু ভয়ে ভয়ে, ওদের একসাথে কেউ দেখে জারিনার বাড়িতে যদি বলে দেয় তাহলে ওর আব্বাজান বকাবকি করতে পারে। অনুপমা ওকে শান্ত করে বলে যে পরাশরের বাড়িতে যেতে হবে। সেই শুনে জারিনা যেন আকাশ থেকে পড়ে, জারিনা জিজ্ঞেস করে কি ভাবে পরাশরের বাড়িতে যাবে। জারিনা জানে পরাশরের মায়ের মতিগতি, এক ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ। অনুপমা হেসে বলে যে ওরা সব বন্ধু বান্ধবীরা পরাশরের বাড়িতে যাচ্ছে, পরাশরের মায়ের হাতের পায়েস খাবার জন্য। সেই অছিলায় জারিনাকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। ওদের বাড়িতে যাবার পরে সবাইকে বন্ধু হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে, কারুর নাম ঠিক জানানো হবে না। জারিনাকে কিছু করে পরাশরের মাকে হাত করতে হবে, রান্না ঘরের কাজে, বাড়ির কাজে সাহায্য করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরাশরের মায়ের মন জয় করতে হবে। সব পরিকল্পনা শুনে জারিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনাকে সাহস জুগিয়ে বলে যদি পরাশরকে বিয়ে করতে হয় আর পরাশরকে যদি ভালোবাসে তাহলে অনেক কিছু করতে হবে। জারিনা রাজি হয়ে যায় পরাশরের বাড়িতে যাবার জন্য, মুখে হাসি টেনে বলে সব কিছু করতে রাজি এমনকি পরাশরের সাথে জাহান্নামে যেতে রাজি।

কলেজের বাইরে দেবায়ন, ধিমান আর পরাশর দাঁড়িয়ে ছিল। জারিনাকে নিয়ে বের হবার পরে ছয়জনে পরাশরের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সারা রাস্তা জারিনা পরাশরের হাত ছাড়েনা এক মুহূর্তের জন্য। দুইজনের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরাশর আগে থেকে ওর মাকে জানিয়ে রেখেছিল যে কলেজের কয়েকজন বন্ধু ওর বাড়িতে দুপুরবেলা আসবে। সেই মতন পরাশরের মা সব বন্ধুদের জন্য পায়েস বানিয়ে রেখেছিল।
বাড়িতে ঢোকার আগে, জারিনাকে জড়িয়ে ধরে পরাশর। জারিনা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ওর মা অপমানিত করে তাড়িয়ে দেবে নাতো? দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। অনুপমা বলে যে কেউ এখুনি নিজেদের পরিচয় দেবে না, শুধু কলেজের বন্ধু বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে সবাই, কারুর নাম এখুনি বলবে না পরাশরের মায়ের কাছে। পরিকল্পনা মতন পরাশরের বাড়িতে ঢোকে সবাই। পরাশরের মা সবাইকে বসার ঘরে বসতে বলে। জারিনা, অনুপমা আর শ্রেয়ার মাঝখানে চুপচাপ বসে থাকে। অনুপমা জারিনাকে ঠেলে বলে যে ঘরের কাজে পরাশরের মাকে সাহায্য করতে। জারিনার ছোটো বুকে বাজতে শুরু করে যুদ্ধের দামামা। একবার সবার দিকে তাকিয়ে নেয়। পরাশর পারলে লুকিয়ে যায় কোথাও, ওর মা একবার জানতে পারলে কেটে ফেলবে জারিনা আর পরাশরকে। জারিনা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে পরাশরের মা ওদের জন্য খাবার প্লেটে সাজাচ্ছিলেন। জারিনাকে আসতে দেখে পরাশরের মা একটু হাসেন। জারিনা প্লেটের মধ্যে সবকিছু সাজাতে সাহায্য করে, সেই সাথে পরাশরের মায়ের সাথে গল্প করে মন ভুলানোর জন্য। প্লেটে খাবার সাজিয়ে বসার ঘরে আসে পরাশরের মা আর জারিনা। জারিনার কান লাল হয়ে গেছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আশঙ্কায় ওর বুকের খাঁচা ফেটে পড়ার যোগাড়। বসার ঘরে সবাইকে খাবার দেবার পরে পরাশরের মা চলে যান।

অনুপমা জারিনাকে ঠেলে পরাশরের মায়ের পিছু নিতে বলে। জারিনা একবার উপরের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পরাশরের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোন কথা নেই, আসন্ন আশঙ্কায় সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। কিছু পরে ভেতর থেকে হাসির কলতান শোনা যায়, জারিনা বেশ গল্পে মশগুল হয়ে গেছে পরাশরের মায়ের সাথে। বেশ কিছু পরে পরাশরের মা জারিনাকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকায়। সবাই চুপ। পরাশরের মা বলেন যে বেশ ভালো পরিকল্পনা করেছে জারিনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর। সেই সাথে পরাশরের মা জানান যে জারিনাকে তার পছন্দ আছে কিন্তু ওর জেঠু আর বাবাকে মানাতে একটু কষ্ট হবে। জারিনা হবু শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে যে যদি ওদের সম্পর্কের সুস্থ সুরাহা না হয় তাহলে গঙ্গায় ডুবে মরবে দুইজনে। পরাশরের মা হেসে ফেলে জারিনার কথা শুনে, সেই সাথে জানিয়ে দেন যে কিছু একটা ব্যাবস্থা করা যাবে তবে ওনার একার পক্ষে সম্ভব নয় ওর বাবাকে বোঝানো। দেবায়ন জানায় যে ওর মা সেই কাজে সাহায্য করবে। পরাশরের বাড়ির সবাইকে একদিন নেমতন্ন করবে দেবায়ন সেই সময়ে দেবায়নের মা চেষ্টা করবেন পরাশরের বাবার সাথে কথা বলতে। পরাশরের মা, জারিনার গলায় একটা সোনার হার পরিয়ে দেয়। জারিনার চোখে জল চলে আসে সেই সাথে পরাশরের মায়ের চোখে জল চলে আসে। পরাশরের মা, পরাশরকে বলে যে ওদের জন্য আরো একদিন নেমন্তন্ন রইল সেদিন ওর হবু বউমা রান্না করবে। সে যা রান্না করবে তাই পরাশরের মা ওর জেঠুকে আর বাবাকে রাতে খেতে দেবে। জারিনা বলে যে রান্না করতে সে এখুনি প্রস্তুত।
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে পরাশরের বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। যাবার আগে অনুপমা আর দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে নেমন্তন্নের কথা। দেবায়ন জানায় যে মায়ের সাথে কথা বলে একটা দিন ধার্য করে ওদের সবাইকে ডাকা হবে। দেবায়ন জানায় না যে সেদিন জারিনার বাড়ির লোককেও নেমন্তন্ন করা হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই জারিনা, অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে ট্যাক্সির মধ্যে। জারিনা আর পরাশর খুব খুশি, একটা বাধা কাটলো, বাকি বাধা কি করে কাটবে সেই চিন্তায়। দেবায়ন জানায় সময়ের সাথে সাথে বাকি বাধা ধিরে ধিরে লুপ্ত হয়ে যাবে।

পরাশর এর মাঝে একদিন দেবায়নের মাকে পি.জি হসপিটালে নিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দেবশ্রী জারিনার বাবা, ডক্টর মিসবাউল আন্সারির সাথে কথা বলেন পরাশর আর জারিনার সম্পর্কের ব্যাপারে। ডক্টর আন্সারি দেবশ্রীর কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে যান। তিনি জানিয়ে দেন যে হসপিটালে এই সব আলোচনা করা ঠিক নয়। দেবশ্রী বলেন নিরুপায় হয়ে হাতপাতালে আসতে হয়েছে যেহেতু দেবশ্রী ডক্টর আন্সারিকে চেনে না তাই। ডক্টর আন্সারি হেসে প্রতি উত্তরে দেবশ্রীকে নিজেদের বাড়িতে ডাকেন একদিন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেবশ্রী পরাশরকে বলে, কথা বলে দেখবে কতটা কি করা যায়। দেবশ্রী পরাশরকে আস্বস্ত সুরে বলে পড়াশুনায় মন দিতে, বিয়ে শাদির জন্য এখন একটা বছর হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়োতে কোন কিছুর সুস্থ সুরাহা হবে না।

দেবায়ন আর পরাশরকে নিয়ে একদিন বিকেলে ডক্টর আন্সারির বাড়িতে যান দেবশ্রী। ডক্টর আন্সারি নিজের চেম্বারে সেদিন বেশ ব্যস্ত ছিলেন। জারিনাকে দেখে দেবশ্রীর বেশ ভালো লাগে, সেই সাথে জারিনার মা, নাজমার সাথে কথাবার্তা হয়। নাজমা বলেন যে প্রথম দিন থেকেই পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তবে মেয়ের মুখে সব শুনে মায়ের মন শেষ পর্যন্ত গলে যায়। তার ভয় এই গোষ্ঠি নিয়ে, এই গোষ্ঠির মাথারা এই শাদী নিকাহর বিরুদ্ধে যাবেন। ওইদিকে জারিনা বেঁকে বসে আছে, পরাশরকে বিয়ে না করতে পারলে গঙ্গায় ডুব দেবে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না নাজমা। দেবশ্রী, জারিনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে আর যেন আত্মহত্যার কথা মুখে আনে না। ডক্টর আন্সারি কাজের ফাঁকে উপরে এসে দেবশ্রী আর বাকিদের সাথে দেখা করে যান। ডক্টর আন্সারি কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েকে খুব ভালবাসেন তবে এই গোষ্ঠি দ্বন্দের মাঝে পড়ে এক ঘরে হয়তো হতে হবে। ডক্টর আন্সারি বলেন পরাশর যদি ধর্মান্তরিত হয় তাহলে দুই জনের সম্পর্কের একটা সুরাহা হতে পারে। দেবশ্রী চিন্তিত, ওইদিকে নাজমা কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। জারিনার চোখ ছলছল। দেবশ্রী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে সপরিবারে নিজের বাড়িতে একদিন রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করেন। দেবায়ন, পরাশর সবাই বেশ চিন্তিত, দেবশ্রী ওদের আস্বাস দিয়ে বলে যে কিছু একটা উপায় তিনি বের করবেন। ডক্টর আন্সারি জানিয়ে দেন যে পরাশরের বাড়ির সাথে দেখা করতে চান, দেবশ্রী জানিয়ে দেন যে সময় মতন সব ঠিক করে দেবেন।

বর্ষা কাল কেটে গেছে, মুসৌরি থেকে বেড়িয়ে আসার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। আকাশে থোকা থোকা পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়ায়। কলেজের সাথে সাথে দেবায়ন আর অনুপমার কম্পিউটার ক্লাস পুরোদমে চলে। এর মাঝে এক রবিবার, দেবায়ন পরাশরের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোককে রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করে আসে।

সকাল বেলাতেই অনুপমা দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায় দেবায়নের মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য। পরাশর আর জারিনা বারেবারে অনুপমাকে ফোনে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। বারেবারে জিজ্ঞেস করে কোন অঘটন ঘটাবে কি না। পরাশর বেশ ভয়ে ভয়ে আছে, ওর বাবা গম্ভির প্রকৃতির মানুষ। পরাশরের মা একবার ওর বাবাকে বলতে চেষ্টা করেছিল জারিনার ব্যাপারে কিন্তু তিনি শুনতে নারাজ।

বিকেলে জারিনার সাথে, জারিনার মা বাবা দেবায়নের বাড়িতে পৌঁছে যায়। ওদের আসার কিছু পরেই পরাশরের বাবা মা পৌঁছে যায়। জারিনা একটা সুন্দর সাদা রঙের সালোয়ার পরে এসেছিল। দেবায়নের মা সবাইকে বসার ঘরে বসিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। পরাশরের বাবা সুরঞ্জন বাবু, দেবায়নের মাকে এই নিমন্ত্রনের কারন জিজ্ঞেস করে। ডক্টর আন্সারিকে দেখে তার বুঝতে বিশেষ দেরি হয় না এই নিমন্ত্রনের আসল কারন। সুরঞ্জন বাবু কিঞ্চিত রেগে পরাশরের মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে দেখে। পরাশর দাঁত পিষে শ্বাস রুদ্ধ করে দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। জারিনা শক্ত করে অনুপমার হাত ধরে ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী দুই বাড়ির অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।

দেবশ্রী বলেন, “পরাশর আর জারিনা, ওদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে আপনাদের কাছে।”

পরাশরের মা রঞ্জিকা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে সব বুঝতে পেরে যায়। নাজমা একবার পরাশরের দিকে তাকায়, অন্যদিকে রঞ্জিকা তার হবু বউমা, জারিনার দিকে তাকায়। পরাশর আর জারিনা, শ্বাস রুদ্ধ করে আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে গেছে।

ডক্টর মিসবাহুল দেবশ্রীর উত্তরে বলেন, “দেখুন দিদি, আপনি জানেন যে দুই ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই আমি আপনাকে একটা উপায় বলেছিলাম যে যদি পরাশর ওর ধর্ম বদলে নেয় তাহলে এই নিকাহর ব্যাপারে আমার কোন অসুবিধে নেই।”

সুরঞ্জন বাবু চোয়াল শক্ত করে একবার পরাশরের দিকে একবার পরাশরের মায়ের দিকে তাকিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বলে, “তোমরা সব কিছু জানতে তাই তো? এই বিবাহ কিছুতেই সম্ভব নয়।” ডক্টর মিসবাহুলের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বলেন, “কেন আমার ছেলে ধর্মান্তরিত হবে? এই বিয়েতে আমার মত নেই, এই সম্পর্ক হতে পারে না।”

পরাশরের মা প্রমাদ গুনে পরাশরের বাবাকে চুপ করতে বলে। দেবশ্রী শীতল কণ্ঠে বলেন, “কেন এই বিবাহ সম্ভব নয়? জারিনা কি দেখতে খারাপ? জারিনার কি কোন দোষ আছে? জারিনা পড়াশুনায় ভালো, কমার্স নিয়ে একটা বড় কলেজে পড়ছে। ভালো শিক্ষিত বাড়ির মেয়ে। ওর দাদা, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়ছে। এমত অবস্থায় আপনার আপত্তি কোথায়?”

দেবশ্রীর উত্তরে ডক্টর মিসবাহুল বলেন, “দেখুন দিদি, আমি বিশেষ কোন তর্কে যেতে চাই না। আমি জানি পরাশর কি করেছে না করেছে। আপনার সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়ে গেছে। আমার এই একটা শর্ত যে পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে, তবেই আমি আমার মেয়ের নিকাহ ওর সাথে দেবো।”

সুরঞ্জন বাবু গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “ছেলে ধর্মান্তরিত হলে আমি ওকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেবো। ওই রকম ছেলে আমার চাই না।”

পরাশর রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবশ্রী পরাশরকে শান্ত করে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “রাগের বশে কিছু করে বসলে সেটা সমস্যার সুরাহা হয় না, বরং এক নতুন সমস্যা তৈরি হয়। আমার কথা একটু শুনুন, তারপরে নিজেদের কথা বলবেন।”

ডক্টর মিসবাহুল বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনি চুপ করে থাকেন। সুরঞ্জন বাবু দেবশ্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার এতে কি আসে যায়? ছেলে আমার, ও কাকে বিয়ে করবে না করবে সেটা আমরা ভেবে দেখবো। পরাশর আমাদের বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে ওর একটা কর্তব্য আছে কি নেই বাড়ির প্রতি।”

রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপ করেছিলেন, কিন্তু সুরঞ্জন বাবুর এহেন মন্তব্যে আহত হয়ে রাগত কণ্ঠে ধমকে ওঠেন, “প্লিস একটু মাথা ঠাণ্ডা করে কথা শোনো। এমন ভাবে রেগে গেলে কোন কিছুর সুরাহা হয় না।” সুরঞ্জন বাবু চুপ করে যান।

দেবশ্রী ম্লান হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমার এখানে কোন স্বার্থ নেই। আমার ছেলের বন্ধু হিসাবে, পরাশর আমার কাছে এসেছিল, ওদের ভালোবাসা দেখে আমার মনে হলো এদের একটা সুস্থ সুরাহা করা উচিত। নাহলে দুটি প্রান হয়তো হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। অন্তিমে কেউ সুখী হবে না।”
 
ডক্টর মিসবাহুল অবাক হয়ে বলেন, “আপনি নিঃস্বার্থে এদের জন্য করছেন?”

দেবশ্রী হেসে বলে, “না না, আজকাল কেউ কি আর নিঃস্বার্থে কাজ করে। আপনার মেয়ে সুরঞ্জন বাবুর বউমা হলে, ঈদে ওর হাতের বিরিয়ানি খেতে পারবো, পায়া, মটন কোর্মা কত কিছু খেতে পারবো। সেই স্বার্থে আমি এই কাজে নেমেছি।” দেবশ্রীর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে শুধুমাত্র সুরঞ্জন বাবু ছাড়া। দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার, আপনি শিক্ষিত আপনি একটা কারন আমাকে দেন কেন জারিনা আপনার বাড়ির বউমা হতে পারবে না।”

সুরঞ্জন বাবু নিচু কণ্ঠে বলেন, “না মানে, বুঝতেই পারছেন কেন এই সম্পর্কে আমার অমত।”

দেবশ্রীঃ “ছেলে মেয়ে ভিন্ন ধর্মের সেই নিয়ে আপনার অমত। আপনি হিন্দু, ডক্টর মিসবাহুল মুসলমান, এই জন্য অমত।” সুরঞ্জন বাবু মৃদু মাথা নাড়ান। দেবশ্রী বলে, “আমি ভগবান মানি, তবে ধর্মের নামে এই আচার ব্যবহার মানি না। আমি ধর্ম অথবা ভগবান একটু ভিন্ন ভাবে মানি, সময় আমাকে তাই শিখিয়েছে। আমি আপনাদের দুইজনকে আঘাত করতে চাই না, তবু বলি। এই ধর্ম আর তাঁর আচার ব্যবহার মানুষের তৈরি, ভগবানের নয়। ভগবান গাছ পালা, নদী নালা, পশু পাখী মানুষ তৈরি করেছিলেন। তাই পৃথিবীর সব জায়গার গাছ পালা, নদী নালা, মানুষ এক রকমের দেখতে। সব জায়গার মানুষের একটা নাক, দুটো চোখ, দুটি হাত, দুটি পা। সবাই মুখ দিয়ে খায়, চোখ দিয়ে দেখে। একটা ছোটো বাচ্চা যখন জন্ম গ্রহন করে তখন সে জানে না তার ধর্ম কি। তার মুখ থেকে প্রথম শব্দ বের হয় কান্নার আওয়াজ, অ্যাঁ। সেই “অ্যাঁ” কান্নার আওয়াজ অনেকটা “মা” ডাকের মতন শোনায়। তাই “মা” ডাক পৃথিবীর সব ভাষাতেই এক। সেটা আলাস্কার কোন প্রত্যন্ত জায়গায় হোক, অথবা ইংল্যান্ডের রানীর বাড়ি হোক, অথবা চিনের দেয়ালের পেছনে হোক অথবা ভারতের কোন শহরে। মাকে সব বাচ্চা মা বলেই ডাকে। সেই ডাক তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না, তেমনি ভালোবাসা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, সেটা বুকের ভেতর থেকে আসে। মানুষ যত বড় হয়, তারা নিজের সুবিধার্থে, পারিপার্শ্বিক ভৌগোলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভাষা, ধর্ম আচার ব্যবহার, জীবন শৈলী ইত্যাদি গঠন করে।” দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “ধরুন আপনার এক্সিডেন্ট হলো, আপনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হলো। সেখানে আপনার রক্ত চাই, তখন কি আপনি জিজ্ঞেস করবেন রক্তদাতার নাম?” সুরঞ্জন বাবু মাথা নাড়িয়ে বলেন “না”। দেবশ্রী বলেন, “আপনার শরীরে হয়তো ভিন্ন ধর্মীর রক্ত দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে তোলা হলো, সেখানে আপনার আপত্তি থাকবে না। আপনি কোনদিন রেস্তোরাঁতে খেতে যান না? সেখানে কোনদিন জিজ্ঞেস করেছেন যে শেফের ধর্ম কি? রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার আপনার ভালো লাগবে। যখন একটা জীবন অপারেশান থিয়েটারে ছটফট করে তখন এই সব কথা মাথায় আসে না। শুধু একটু ভালোবাসার সময়ে আপনাদের মাথায় আসে জাত পাত, ধর্ম বিদ্বেষ, উঁচু নিচু, বড়োলোক গরিব। এই সব জাত পাত ধর্ম বিদ্বেষ সব কিছু মানুষের মনের তৈরি। এই দুইজনের জন্য এই সব একটু দুরে রাখতে পারবো না আমরা?”

সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল চুপ। ঘরের বাকি সদস্য চুপ করে দেবশ্রীর কথা শুনে যায়। জারিনা অনুপমার হাত ধরে পাথর হয়ে গেছে। অনুপমার কানেকানে বলে যে এতো কথা কেউ কোনদিন ওর আব্বাজানের সামনে বলতে সাহস পায়নি। অনুপমা জানিয়ে দেয় যে ওর মামনি অন্য ধাতুর তৈরি মানুষ, যত কঠিন লোহা হোক না কেন, তাদের হৃদয় গলাতে তিনি সক্ষম।

দেবশ্রী ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি একজন নামকরা ডক্টর। আপনি যখন একজনের চিকিৎসা করেন, তখন তার রোগ চিকিৎসা করেন না তাকে নাম দেখে চিকিৎসা করেন। আমি আর্টসের ছাত্রী ছিলাম, বিজ্ঞান পড়িনি তবে আমি ছোটবেলা থেকে ছেলেকে পড়াতে পড়াতে একটু বিজ্ঞান শিখে ফেলি আর তাই দিয়ে বিচার করেছিলাম এই মহামহিম শক্তিকে। বোঝার চেষ্টা করেছি আসল ভগবানকে। আমার মধ্যে, একটা গাছের মধ্যে, একটা কুকুরের মধ্যে, একটা মাছের মধ্যে বহিরঙ্গের অনেক তফাত কিন্তু ধর্মে বলে ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান। আমিও বলি ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু একটু অন্য ভাবে মানি। আমরা সবাই অনু পরমানু দিয়ে গঠিত। সবার দেহে সেই প্রোটন নিউট্রন ইলেক্ট্রন আছে। সেই এটমের মধ্যে যে শক্তি সেই ভগবান। অমান্য করতে পারেন?” ডক্টর মিসবাহুল মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দেবশ্রী বলেন, “সেই শক্তি কিন্তু এই হিন্দু, মুসলমান, শিখ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ তৈরি করেনি, করেছি আমরা কারন আমাদের মাথায় একটা ঘিলু বলে বস্তু আছে। আমরা ভাবনা চিন্তা করতে পারি আর তাই সকলকে হাতের মুঠিতে রাখার জন্য ভগবানের দোহাই দিয়ে একসময় তৈরি হয় এই ধর্ম। আমার বলার বক্তব্য এইটুকু, যে সামান্য একটা মানুষের তৈরি নিয়মের বাধা নিয়ে কেন দুই ছোটো ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেওয়া? তাতে কি ওরা সুখী হতে পারবে? একবার চেয়ে দেখুন ওদের চোখের দিকে তারপরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন।” ডক্টর আন্সারি পরাশরের দিকে তাকায় আর সুরঞ্জন বাবু জারিনার দিকে তাকায়। দুই ছেলে মেয়ের চোখে জল, ছলছল থমথমে চেহারায় দুইজনে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী বলে, “তবে হ্যাঁ, আমি যখন বাড়িতে ডেকেছি ডিনারের জন্য তখন যেন না খেয়ে চলে যাওয়া না হয়।”

সুরঞ্জন বাবু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “এতো কথা আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বলেনি। আপনার সাথে যুক্তি তর্কে দার্শনিক তথ্যে পেরে ওঠা বড় কষ্টকর। আপনার বক্তব্য গভীর অর্থ বহন করে যা খন্ডন করা অসম্ভব। তবে আমাকে একটু ভাবতে সময় দেন।”

দেবশ্রী হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবছেন? খাবার কথা না কবে বিয়ে দেবেন সেটার কথা?”

ডক্টর মিসবাহুল হেসে ফেলেন, “আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা বড় মুশকিল। কিন্তু সমাজ, আত্মীয় স্বজনেরা কি বলবে?”

দেবশ্রী বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “আপনারা কি ছেলে মেয়েদের শুকনো মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? সত্যি কথা বলতে লোকেরা কি বলবে, আত্মীয় স্বজনেরা কি বলবে সেই নিয়ে বড় মাথা ঘামাই। যাদের সুখ দুঃখে আমাদের দাঁড়ানো উচিত তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের কথা শুনতে ব্যস্ত হয়ে যাই যারা হয়তো আমাদের খেয়ে আমাদের পেছনে নিন্দা করে বেড়ায়। আপনাদের কিছু হলে আপনার ছেলে বউমা, মেয়ে জামাই এসে দাঁড়াবে। দেবায়নকে নিয়ে আমি যখন অথৈ জলে পড়েছিলাম, তখন আমার কোন আত্মীয় আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আপনার দুই জনে একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনাদের কোন আত্মীয় আপনাদের পেছনে আপনাদের নিন্দা করেনি?”

নির্বাক সুরঞ্জন বাবু, নির্বাক ডক্টর মিসবাহুল। দেবশ্রী হেসে বলেন অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে আমার বউমা। সমাজ কে কি বলল না বলল তাতে আমার আসে যায় না। তবে ওই দুষ্টু মেয়েটার মুখের হাসির জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত।”

সুরঞ্জন বাবু দেবশ্রীকে বললেন, “দিদি, সব বুঝলাম। আপনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন সব মেনে নিলাম। আমাদের পরিবারের কথা একটু বলি আপনাকে। আমাদের যৌথ পরিবার, আমার দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে বছর আটেক আগে, তার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার ওই একটা ছেলে, পরাশর বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে বউমা হবে বাড়ির বড় বউমা। ভবিষ্যতে তার কাঁধে সবাইকে পরিচালনা করার ভার আসবে। তাই আমি...”

কথা শেষ করতে দেয় না দেবশ্রী কারন তার অজানা নয়, তাই বললেন, “আমি সব জানি, পরাশর আমাকে সব কিছু বলেছে। দেখুন, আমি বলছি না আজকেই জারিনাকে আপনার বউমা করে নিয়ে যেতে। আপনি আপনার দাদাকে বুঝিয়ে বলুন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের মতি গতি, মানুষের চিন্তা ধারা বদলায়। আশা করি আপনি সেই চেষ্টা করবেন। আর আসল কথা, বউমা কেমন লেগেছে সেটা আগে বলুন।”

নাজমা আর রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, কোন কথা না বলে শুধু দেবশ্রীর কথা শুনে গেছে। নাজমা বললেন, “জানেন দিদি, প্রথম যেদিন পরাশর মাথা ফাটিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল, সেদিন আমি মেয়ের মুখ দেখে বুঝে গেছিলাম, ওই ফাটা মাথার কারন।” নাজমার কথা শুনে পরাশরের কান লাল হয়ে যায়, জারিনা পারলে অনুপমার পেছনে লুকিয়ে যায়।

সেই শুনে হেসে ফেললেন রঞ্জিকা, “আমার বাড়িতে দেবায়ন আর অনুপমা, জারিনাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি ওকে দেখে। তারপরে যখন দেখলাম যে ফুটফুটে মেয়েটা রান্না ঘরে এসে আমাকে সাহায্য করছে তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। বড় মিষ্টি মেয়ে। এতো পাকা যে আমাকে বলে চোখে কাজল পরলে নাকি আমার চোখ দুটি বড় বড় দেখাবে।” রঞ্জিকা জারিনার দিকে দেখে হেসে ফেলে। জারিনা লজ্জায় অনুপমার পেছনে মুখ লুকায়। রঞ্জিকা সুরঞ্জন বাবুকে বললেন, “দেখো, সত্যি বলছি, বাড়িতে এই সব নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। আমার আর কাকলির কথা কেউ শোনে না। দেবশ্রীদির মতন যুক্তি দিয়ে বুঝাতে আমি পারতাম না। আমি জানিনা তোমার কি মত, তবে বউমা আমার ভারী মিষ্টি।”

ডক্টর মিসবাহুল বললেন, “আমার একটু সময় চাই, মানে আমাদের পরিবার আরো গোঁড়া। সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা, সবাইকে মানিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমি যা ভেবে এসেছিলাম, সেই ভাবনা চিন্তা যুক্তি তক্ক আপনার দর্শন শাস্ত্রের কাছে নগন্য। আমি কোনদিন এইভাবে ধর্মকে, ভগবানকে দেখিনি। আজকে আপনার কথা শুনে মনে হলো আমরা কেন, পৃথিবীর সবাই যদি আপনার মতন চোখ খুলে একটু দেখতে পারতো তাহলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠতো। সত্যি বলতে আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, এই প্রথম পরাজয়ে আমি দুঃখিত নেই। কিন্তু বুঝতেই পারছেন।”

সুরঞ্জন বাবু সমস্বরে বলেন, “একই অবস্থা আমার পরিবারের। দুঃসাধ্য তবে আপনার কথা শুনে মনে হলো অসম্ভব কিছুই নয়।”

দেবশ্রীঃ “আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনাদের দুইজনের পারিবারিক সমস্যার কথা। অনেক সময় আছে, জারিনার কলেজ শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। পরাশরের কলেজ শেষ হতে এক বছর বাকি। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়, আপনার সেই চেষ্টা করুন।”

ডক্টর মিসবাহুল মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “দুই জনের পড়াশুনা শেষ হোক আগে তারপরে ব্যাবস্থা করবো।”

সুরঞ্জন বাবু বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এ্যাস্ট্রে নিশ্চয় আপনার বাড়িতে পাওয়া যাবে না?”

দেবশ্রী হেসে ফেলে, “আমি সিগারেট খাই নাকি?”

দেবায়ন তাড়াতাড়ি একটা কাপে একটু জল নিয়ে টি টেবিলে রাখে। সুরঞ্জন বাবু একটা সিগারেট বের করে ডক্টর মিসবাহুলের দিকে এগিয়ে দেয়। ডক্টর মিসবাহুল হেসে বলেন যে একটাই ধরাতে, জারিনা জন্মাবার পরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে বেয়াই মশাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা কঠিন। নাজমা ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে বারন করে। সুরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, আর রাগ কেন এবারে হয়তো দুই বেয়াই মিলে সিগারেট খেয়ে মনের গ্লানি দূর করবে।

রঞ্জিকা হেসে বলেন, “দিদি, আপনার ওই এটম, নিউট্রন শুনে আমার পেটের ইলেক্ট্রন কামড় দিচ্ছে। আমি আমার বেয়ানকে নিয়ে রান্না ঘরে চললাম। আপনি যা ভালো বুঝবেন সেটা করুন।”

পরাশরের মায়ের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এতক্ষণ বাড়িতে যেন ছোটো একটা ঝড় বয়ে গেল। দেবশ্রীর সামনে বসে ছোটো দুই সোফায় ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলেন। দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরকে কাছে ডেকে সবাইকে প্রনাম করতে বলেন। জারিনা আর পরাশর, সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুলকে প্রনাম করার পরে দেবশ্রীকে প্রনাম করে।

রঞ্জিকা পরাশরকে বলে, “দিদিকে একদম সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করিস, নাহলে এই যাত্রায় কিছু সম্ভব হতোনা।”

দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরের মাথা চুম্বন করে আশীর্বাদ করেন। জারিনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। পরাশর দেবায়নকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন। চারপাশের বদ্ধ আবহাওয়ায় একটা খুশির আমেজ। বসার ঘরের দেয়ালে দেবায়নের বাবা, সায়ন্তনের একটা বড় ছবি ঝুলানো। দেবশ্রী একবার সেই ছবির দিকে জল ভরা চোখে তাকায়। তারপরে দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, তোরা সন্তুষ্ট? চারজনে দৌড়ে এসে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে।

!!!!!!!!!! উনবিংশ পর্বের সমাপ্তি !!!!!!!!!!
 
বিংশতি পর্ব।

কিছুদিন ধরে পায়েলের চরিত্রের বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। আগে যেমন অনুপমার সাথে রোজ দিন গাড়িতে করে কলেজে আসতো, সেটা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলে বলে যে বাসে আসাই ঠিক কেননা সকালে অনুপমার বাড়ির নাম করে একটু আগেই বেরিয়ে যায় আর অগ্নিহোত্রীর সাথে দেখা করে। অগ্নিহোত্রী ওকে নিতে আসে তাই অনুপমার সাথে কলেজে আসা কমিয়ে দিয়েছে। তবে বিকেলে কোন কোন দিন পায়েল, অনুপমার বাড়িতে কলেজ ফেরত চলে আসে, কোন কোন দিন একা একা কলেজ ছুটি হবার আগেই বেরিয়ে পড়ে। অনুপমার বাড়িতে আড্ডা মারার সময়ে অঙ্কন মাঝে মাঝে ওদের সাথে গল্প করে। অঙ্কনের নতুন প্রেম, গরিমার কথা পায়েলকে জানায় অনুপমা। পায়েলের ব্যাপারে অঙ্কনকে একদিন জানায় অনুপমা। পায়েল ইদানীং ছোটো স্কার্ট, চাপা টপ ছেড়ে লম্বা স্কার্ট আর জিন্স পরা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে সালোয়ার কামিজ পরে কলেজে আসে। ওর এই পোশাক আশাকের পরিবর্তন সবার চোখে পড়ে। সবাই জিজ্ঞেস করলে লাজুক হেসে উত্তর দেয় যে অগ্নিহোত্রীর পছন্দের কাপড় পরতে হয় এবং পায়েল তাতে বেশ খুশি। মাঝে মাঝে সপ্তাহ শেষে উধাও হয়ে যায়, অনুপমাকে ফোনে বলে যদি ওর বাড়ি থেকে কেউ জিজ্ঞেস করে তাহলে যেন জানিয়ে দেয় যে পায়েল অনুপমার সাথেই আছে। পায়েলকে অগ্নিহোত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলে পায়েল হাসি মুখে এড়িয়ে যায় সেই প্রশ্ন, জানিয়ে দেয় যে সময় মতন অগ্নিহোত্রীর সাথে দেখা করিয়ে দেবে, সেই সাথে পায়েল জানায় যে বাড়ি থেকে পালানো হয়তো হবে না। অনুপমা একটু অবাক হয়ে যায় সেই সাথে খুশি হয় যে পায়েল তার পুরানো চিন্তা ছেড়ে দিয়েছে। পায়েল বলে যে ওর বাবা মা হয়তো ওদের সম্পর্ক মেনে নেবে না, তবে বিয়ের যখন সময় হবে তখন নিশ্চয় সবাই মেনে নেবে। কথাটা হেঁয়ালির মতন হলেও, অনুপমা খুঁচিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না।

দেবায়ন অঙ্কনের কথা জিজ্ঞেস করে। অনুপমা জানায় যে অঙ্কন প্রেমে পড়ে অনেক বদলে গেছে। শনি, রবি বাড়িতে থাকে না বললে চলে। অনুপমা বার কয়েক গরিমার সাথে দেখা করার কথা বলেছিল, অঙ্কন কথা ঘুরিয়ে দেয়। অনুপমা বলেছে যে ওর জন্মদিনে বাড়িতে ডাকতে। অঙ্কন জানিয়েছে যে জন্মদিনে গরিমাকে বাড়িতে ডেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।

বর্ষার শেষে শরতের মিষ্টি আভাসে আকাশ বাতাস মুখরিত। ইতিমধ্যে দেবায়ন বাইক কিনেছে, অনুপমার ইচ্ছে ছিল একটা স্টাইলিস্ট বাইক, কিন্তু দেবায়নের পছন্দ ছিল একটা ভারী বাইকের তাই শেষ পর্যন্ত বুলেট কেনে। বেশ ভারী গাড়ি, রাস্তা কাঁপিয়ে কলেজ কাঁপিয়ে আওয়াজ করে বের হয়। লম্বা চওড়া ছেলে দেবায়ন, পেছনে অনুপমাকে নিয়ে কলেজ থেকে বের হলে অনেকের চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন পরেও অনুপমা ওই ছেলেগুলোর আর মেয়েদের চাহনি উপভোগ করে।

সামনে পুজো, সবাই ঠিক করে যে পুজোতে একসাথে ঠাকুর দেখবে, একসাথে পুজোর জামা কাপড় কেনা কাটা করবে। অগত্যা দেবায়ন আর অনুপমার ঠিক সময় হয়ে আর ওঠে না। কলেজের পরে দৌড়াতে হয় সোজা কম্পিউটার ক্লাসে, শনি রবিবারেও ওদের ক্লাস থাকে। সঙ্গীতা, শ্রেয়া মনমরা হয়ে যায়। পায়েল জানায় যে ওর পুজোর শপিং করা হয়ে গেছে। অনেকদিনের বন্ধুত্ব অনুপমার আর পায়েলের। গত দুই বছরে পায়েল অনুপমাকে ছেড়ে পুজোর জামা কাপড় কিনতে যায়নি। এবারে পায়েলের কথা শুনে খুব আহত হয় অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে বুঝিয়ে বলে যে পায়েল হয়তো ওর প্রেমিকের সাথে শপিং করে নিয়েছে, এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। পায়েল নিশ্চয় চিরকাল অনুপমার পাশে থাকবে না। অনুপমা আহত হলেও বোঝে দেবায়নের কথা।

কলেজে পালিয়ে একদিন সব বন্ধু বান্ধবী মিলে পুজোর শপিং করতে বের হয়। পায়েল লাঞ্চের আগেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। সবাই ওর কথা জানে যে পায়েল অগ্নিহোত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, একমাত্র সঙ্গীতা ছাড়া কেউ অগ্নিহোত্রীকে দেখেনি। ধিমান ঋতুপর্ণাকে ডেকে নেয় সাথে। অনেকদিন পরে ঋতুপর্ণার সাথে সবার দেখা।

দেবায়ন ঋতুপর্ণাকে দেখেই বলে ওঠে, “ডারলিং অনেক দিন পরে তোমার সাথে দেখা হলো, কেমন আছো?” দেবায়নের স্বভাব সবার পেছনে লাগা। ঋতুপর্ণা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই দেবায়ন ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, “ডারলিং ওইদিন ঠিক জমলো না। হবে নাকি একবার আরো।”

লজ্জায় ঋতুপর্ণার গাল কান লাল হয়ে যায়। ধিমান মারতে ছোটে দেবায়নকে, “শালা তোর বউকে গিয়ে কর না।”

দেবায়ন বলে, “ওরে ছাগল, বাঁশের চেয়ে কঞ্চির দর বেশি। শালী সবসময়ে একটু বেশি মিষ্টি হয়, সে যদি ঋতুর মতন সেক্সি হয় তাহলে কথা নেই।”

শ্রেয়া একটু রেগে যায় ওদের কথা শুনে, অনুপমাকে বলে, “এই তোর বরকে সাবধান করে দে।”

অনুপমা হেসে দেবায়নের কান টেনে ধরে বলে, “তুমি থামবে না এখানে তোমাকে পিটাবো।”

ধিমান হেসে বলে, “পুচ্চিসোনা কিন্তু রেগে গেছে এবারে আর ঢুকাতে পারবে না পুচ্চু বাবু।”

দেবায়ন হেসে বলে, “কত মাল আছে, ঋতু আছে, সঙ্গীতা আছে। আর শ্রেয়ার কথাই নেই, রূপক ওকে ছেড়ে অন্য কারুর সাথে লাইন মারতে ব্যস্ত।”

শ্রেয়া রেগে যায় ওই কথায়, এমনিতে রূপক আসেনি বলে শ্রেয়া রেগেই ছিল, “ধুর বাল, রূপকের কথা ছাড়। আমাকে না জানিয়ে অন্য কোথাও গাড়ি গ্যারেজ করলে টায়ার ফাটিয়ে দেবো।”

সবাই হেসে দেয় শ্রেয়ার কথা শুনে। এস্প্লানেডে ঘুরে ঘুরে ওরা সবাই শপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুজোর মরশুমে এস্প্লানেড ভিড়ে ঠাসা। সব দোকানে প্রচুর ভিড়, সারা কোলকাতা যেন উপচে এস্প্লানেডে এসে পড়েছে। মেয়েরা নিজেদের জামা কাপড় কেনার চেয়ে, গল্পে বেশি ব্যস্ত। দশ খানা দোকান ঘোরার পরে কারুর একটা পোশাক পছন্দ হয়। প্রবাল চুপ করে সঙ্গীতার পেছন পেছন ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে। ধিমান আর দেবায়ন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে প্রবালকে দেখে।

ধিমান প্রবালকে বলে, “বাল এবারে সঙ্গীতার কামিজের নিচে ঢুকে যা একেবারে।”

প্রবাল চোখ পাকিয়ে তাকায় দেবায়ন আর ধিমানের দিকে। দেবায়ন হেসে ফেলে ওর চোখ পাকানো দেখে, “ওরে, ওই রকম ভাবে তাকাস না সোনা। বড্ড ভয় করছে আমাদের।”

সঙ্গীতাঃ “এই তোরা থামবি একটু।”

ধিমানঃ “কেন ডারলিং? তোর মেনুপুষুকে আঘাত করেছি তাই এতো লেগে গেল?”

সঙ্গীতাঃ “কেন, তোর ঋতুকে যখন দেবায়ন বলছিল তখন কেন মারতে ছুটেছিলি?”

অনুপমা সঙ্গীতাকে বলে, “ঠিক তো বলেছে। তুই যা তার উলটো প্রবাল।”

সঙ্গীতা ম্লান হেসে, “শেষ পর্যন্ত তুই? আমি ভেবেছিলাম...”
 
অনুপমাঃ “আরে আরে না না... এখানে আবার কান্নাকাটি জুড়ে দিস না। সামনে পুজো, এখানে বন্যা হয়ে গেলে মুশকিল আছে।”

আবার সবার মধ্যে হাসির কলতান ওঠে। রূপক কোন এক কাজের জন্য আসতে পারে না তাই নিয়ে শ্রেয়ার সাথে সকাল থেকে এক চোট রাগারাগি হয়ে গেছে।

অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে রূপক কেন আসতে পারেনি? কি বলেছে তোকে?”

শ্রেয়াঃ “মাতৃভক্ত ছেলে, মাকে নিয়ে শ্যামবাজার যাবে শপিং করতে।”

দেবায়নঃ “গাঁড় মারিয়েছে। বিয়ের পরে দেখিস ভাই, মায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকবে।”

সঙ্গীতা হেসে বলে, “যারা মায়ের আঁচলের তলায় লুকায়, বিয়ের পরে তারা বৌয়ের আঁচলের তলায় লুকায়।” স্বর নামিয়ে অনুপমার কানেকানে বলে, “আমারটা দেখছিস না, একদম ভিজে বেড়াল। আমি যদি ওকে বলি, প্রবাল আমার এখুনি আম খেতে ইচ্ছে করছে তুই এনে দে যেখান থেকে পারিস। প্রবাল সারা ভারত ঘুরে এনে দেবে।”

ঋতুপর্ণা ধিমানের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমারটা বাবা একদম উলটো। ও যা ভাববে সেটা না হলে রণ মূর্তি ধারন করে।”

এমন সময়ে শ্রেয়ার কাছে রূপকের ফোন আসে। রূপকের ফোন পেয়েই শ্রেয়া রেগে যায়, “যাও তোমার সাথে আমার কোন কথা বার্তা নেই। সবাই বয়ফ্রেন্ড নিয়ে এসেছে আর তুমি তোমার মায়ের সাথে শপিং করো।”

রূপক শ্রেয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আরে বাবা, তোমার ড্রেস কিনতে আমি আর তুমি একসাথে যাবো। আচ্ছা একটা কথা বলো না, পায়েল কি তোমাদের সাথে?”

শ্রেয়াঃ “হটাত পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করলে? কি ব্যাপার?”

রূপকঃ “মনে হলো পায়েলকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে শপিং করছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

শ্রেয়াঃ “তা হতে পারে। পায়েল আজকাল খুব উড়ছে। লাঞ্চের আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছে। বলল যে অগ্নিহোত্রীর সাথে শপিংয়ে যাবে তাই তো অনুর মুখ শুকনো।” শ্রেয়া উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস ওরে, “হ্যাঁ গো ওর সাথে যে ছেলেটা আছে সে দেখতে কেমন? পায়েলের চয়েস নিশ্চয় ভালো হবে।”

সঙ্গীতা মুখ বেঁকিয়ে বলে, “অগ্নিহোত্রী দেখতে একটা বাঁদর।”

রূপকঃ “দূর থেকে দেখলাম। ফর্সা গায়ের রঙ, ভালোই দেখতে মনে হয়। আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছেলেটা। ওর সামনে দাঁড়িয়ে পায়েল। তবে মনে হলো ছেলেটার বয়স পায়েলের চেয়ে কম।”

অনুপম আর সঙ্গীতা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সঙ্গীতা শ্রেয়ার কাছ থেকে ফোন নিয়ে রূপককে জিজ্ঞেস করে, “সঙ্গের ছেলেটা কালো নয়? ওর চুল একটু লম্বা হবে।”

রূপক জানায়, “না তো, কেন অগ্নিহোত্রী কি কালো? তাহলে অগ্নিহোত্রী নয় এই ছেলে অন্য কেউ। ছেলেটার বয়স মনে হয় পায়েলের চেয়ে কম হবে।”

সঙ্গীতাঃ “ছেলেটা অগ্নিহোত্রী হতেই পারে না।”

অনুপমার দিকে দেখে সবাই। অনুপমা বলে, “আমাকে কেন দেখছিস তোরা? আমি প্রেম করেছি নাকি? দাঁড়া আমি পায়েলকে একটা ফোন করি।” অনুপমা পায়েলকে ফোন করে, পায়েলের ফোন বেজে যায় কিন্তু পায়েল ফোন উঠায় না।

রূপক বলে, “হ্যাঁ, ফোন বের করেছে কিন্তু ফোন কেটে দিল মনে হলো।”

শ্রেয়াঃ “হবে ওর কোন ভাইয়ের সাথে শপিং করতে বেরিয়েছে। এতো টেনশন নিচ্ছিস কেন তোরা?”

রূপক হেসে ফেলে শ্রেয়ার কথা শুনে, “আরে বাল, ভাইয়ের সাথে একদম গায়ে গা লাগিয়ে, হাতের আঙুল পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? ধুর ওটা অন্য কেউ, ওর নতুন কোন বয়ফ্রেন্ড হবে। থাক ছাড়ো ওসব কথা তোমাদের শপিং কেমন চলছে।”

অনুপম আহত হয় রূপকের কথা শুনে। রূপককে বলে এগিয়ে গিয়ে পায়েলের সাথে দেখা করতে। রূপক ফোন হাতে এগিয়ে যায় পায়েলের দিকে, ততক্ষণে পায়েল ওর সাথের ছেলেটাকে নিয়ে বাইকে করে বেরিয়ে যায়। রূপক ওদের বলে, “ধুর বাল, পায়েল চলে গেল বাইকে।”
 
অনুপমা বড় আহত হয় পায়েলের ব্যবহার শুনে। শ্রেয়া বলে, “ছাড় পায়েলকে, আমরা বাকি শপিং সেরে ফেলি। ও কার সাথে কি করছে সেটা সময় হলে জানা যাবে।”

সঙ্গীতা অনুপমা, দুইজনে চিন্তিত হয়ে বলে, “পায়েল এটা ভালো করছে না। আমাকে বলল অগ্নিহোত্রীর সাথে প্রেম করছে, কিন্তু ছেলেটা অগ্নিহোত্রী নয়। কি যে করছে মেয়েটা, ওর কপালে শেষ পর্যন্ত কি হবে ভগবান জানে।”

অনুপমা বাকি বন্ধুদের জানিয়ে দেয় যে ওর শরীর ভালো লাগছে না তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়। সবাই একটু অবাক হয়ে দেবায়নকে প্রশ্ন করে। দেবায়ন জানায় যে সকালে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তাই ব্রেকফাস্ট করেনি, কিছুদিন থেকে অনুপমার প্রেসার একটু লো চলছে তাই শরীর খারাপ।

দেবায়ন অনুপমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দশ্যে রওনা দেয়। অনুপমা সারাটা রাস্তা মুখ ভার করে দেবায়নের পেছনে বসে থাকে। পায়েলের সাথের ছেলেটা যদি অগ্নিহোত্রী না হয়ে অন্য কেউ হয় তাহলে পায়েলের এতো গোপনীয়তা কেন? শরতের ঠাণ্ডা বাতাসে অনুপমা, দেবায়নকে পেছন থেকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। বাইকে যেতে যেতে পিঠের উপরে চেপে যায় অনুপমার নরম শরীর। দেবায়নের পিঠ নরম তুলতুলে স্তনের পরশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দেবায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে অনুপমার গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে এই বারে পুজোতে কোথায় বেড়াতে যেতে চায়। অনুপমা হেসে জানিয়ে দেয় যে এবারে কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা নেই, সবাই মিলে এইবারে পুজোতে আনন্দ হই হুল্লোড় করবে। অনুপমা জানায় যে, ওদের বাড়ির অদুরে ম্যাডক্স স্কয়ার, বলা যেতে পারে ওদের পাড়ার পুজো। ওর বাবা ওই পুজোতে অনেক টাকা চাঁদা দেয় সেই সাথে ক্লাবের সভাপতি। এবারে সারাদিন পুজোর প্যান্ডেলে বসবে আর সব বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারবে। অনুপমা বলে একটা গাড়ি করে অষ্টমীর দিনে সব বন্ধু বান্ধবী ঠাকুর দেখতে বের হলে বেশ ভালো হয়। সেই শুনে দেবায়ন বেশ খুশি। পুজোর সময়ে সবার বাড়িতে একটু ছাড় পাওয়া যায়, দেবায়ন আর অনুপমার বাড়ি থেকে কোন রকমের অসুবিধে হবে না।

বাইক পন্ডিতিয়া থেকে ঘুরে অনুপমাদের বাড়ির দিকে ঢোকে। অনুপমা অনুরোধ করে একবার ম্যাডক্স স্কয়ারে নিয়ে যেতে, মাঠের মাঝে দুর্গা পুজোর প্যান্ডেল বানানো শুরু হয়ে গেছে। অনুপমাকে সবা চেনে, ওইখানে। দেবায়নের সাথে অনুপমাকে দেখে একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে। অনুপমা সেই ভদ্রলোককে হাঁপাতে দেখে কারন জিজ্ঞেস করে।

আগন্তুক, রঞ্জিত দাস, ক্লাবের মেম্বার, হাঁপাতে হাঁপাতে অনুপমাকে বলে, “হ্যাঁ রে, বিশাল কান্ড ঘটে গেছে। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। আজকে মনে হয় সোমেশদার কপালে দুঃখ আছে।”

অনুপমা আর দেবায়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন? কার কি হয়েছে?”

রঞ্জিত বলে, “আরে আর বলিস কেন। তোর ভাই অঙ্কন আর ওই সান্যাল ডাক্তারের মেয়ে পায়েল, কিছুক্ষণ আগে ওরা দুইজনে এখানে বসে গল্প করছিল। তোর ভাই আর পায়েল, দুইজনকে সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছি। এই তো প্রেম করার বয়স, করুক না কে মানা করেছে। কিন্তু শালা, ওই বকাটে বাঞ্চোত শরত দে, সান্যাল ডাক্তারের পোঁদে তেল মারার জন্য ডাক্তারকে সব বলে দিয়েছে। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা, কমলেশ মেয়েকে ধমক ধামক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আর তোদের বাড়ি গেছে। আজকে মনে হয়, সোমেশদাকে পারলে খেয়ে ফেলবে।”

অনুপমা আর দেবায়ন সব কিছু বুঝে যায়। দেবায়ন বাইকে চড়া মাত্রই অনুপমার কাছে ওর মায়ের ফোন আসে, তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসার জন্য বলে। দেবায়ন তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে বাইক ছুটিয়ে দেয়। অনুপমা রাগে দুঃখে দেবায়নের কাঁধ খামচে ধরে থাকে। কোনোরকমে বাইক দাঁড় করিয়ে দেবায়ন দৌড় লাগায় বাড়ির দিকে। অনুপমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় বসার ঘরে। বসার ঘরে ঢোকা মাত্র চোখ যায় সোফায় বসা বাবার দিকে। পারমিতা এক দিকে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। সবার চোখ মুখ থমথমে, কমলেশ নামের ঝড় বয়ে চলে গেছে ওদের বাড়ি ঢোকার আগেই।

দেবায়ন আর অনুপমাকে দেখে মিস্টার সেন গর্জে ওঠেন, “দ্যাখ তোর ভাইয়ের আর বান্ধবীর কান্ড। সারা পাড়ায় আমার মুখ ডুবিয়ে তবে ছাড়লো। এইবারে পুজোতে ভেবেছিলাম কোলকাতায় থাকবো, কিন্তু ক্লাবের সবাই জেনে যাবে। কমলেশ যা তা বলে গেল আমাকে। আর কি বলি বল, আমি কি মানা করেছিলাম ওকে? শেষ পর্যন্ত কি না নিজের থেকে পাঁচ বছরের বড় একটা মেয়েকে প্রেম করেছে? পিটিয়ে ছাল খুলে দেওয়া উচিত। বাইক চাই, বাইক চাই, নাচানাচি দেখো ছেলের। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, কোচিং ফাঁকি দিয়ে শুধু প্রেম করে বেড়িয়েছে।”

অঙ্কন চুপ করে ওর মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে। দেবায়ন মিস্টার সেনকে শান্ত করে বলে, “আপনি একটু শান্ত হন, আগে বলুন পায়েলের বাবা কি বলেছে আপনাকে?”

মিস্টার সেন, “আচ্ছা তুমি বলো, আমি কি তোমাদের কোনদিন মানা করেছি? তুমি আর অনু তোমার মায়ের সাথে মুসৌরি বেড়াতে গেলে, আমি মানা করেছিলাম? একবার অন্তত ওর মাকে জানাতে পারতো যে ছেলে প্রেম করছে। প্রেম করেছে, সেটা বড় কথা নয় কিন্তু একটু দেখে শুনে করবে তো? অত বড় মেয়ে তার উপরে কমলেশ। আমি কমলেশকে অনেক দিন ধরে চিনি। একদম ইতর মনোবৃত্তির মানুষ। ডাক্তার হলে কি হবে মুখের ভাষা, মানসিকতা একদম ভালো নয়।”

অনুপমা অঙ্কনকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে তোদের এতদিন ধরে জিজ্ঞেস করে গেলাম তোরা একটা উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করলি না।”

অঙ্কন চুপ করে পারমিতার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পারমিতা মেয়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “কি বলছিস তুই? পায়েল আর অঙ্কনের ব্যাপারে তুই জানতিস না?”

অনুপমা কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয়, “জানলে কি আর তোমার কাছে গরিমার কথা বলতাম?” অনুপমা অঙ্কনকে বলে, “তুই উপরে যা, পরে তোর সাথে কথা হবে।” অঙ্কন উপরে না গিয়ে অদুরে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কথা শোনে।

মিস্টার সেন বলেন, “কমলেশ খুব রেগে মেগে ঘরে ঢুকে তোলপাড়। আমার ছেলে নীচ, আমার ছেলে ইতর, আমরা ব্যাভিচারি। আমাদের নাকি আত্মসন্মান বোধ কিছু নেই, টাকা পয়সা আছে বলে সব কিছু করতে পারি আমরা। আমার ছেলে ওর মেয়ের মাথা খেয়েছে। অঙ্কনকে তো প্রায় কান ধরে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আমি কিছু বলার আগেই যা তা বলতে শুরু করে দেয়।”

পারমিতা মাথায় হাত দিয়ে সোফার উপরে বসে পড়ে, “সব ঠিক আছে, ছেলে প্রেম করেছে পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু পায়েল?” দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “না পায়েল নয়। তুমি ওকে কিছু করে বুঝাতে চেষ্টা করো দেবায়ন। পায়েল নয়, পায়েলকে মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”

অনুপমা আর দেবায়ন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। পারমিতার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ওদের অজানা নয়। দেবায়নের সাথে পায়েলের আর অনুপমার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত পারমিতা। সেই মেয়েকে বাড়ির বউমা হিসাবে মানতে বড় কষ্ট হয়।

নিরুপায় অনুপমা পারমিতাকে প্রবোধ দিয়ে বলে, “মা, আমাদের একটু ভাবতে দাও। সময় সব ঠিক করে দেবে, দাঁড়াও দেখি আগে পায়েল আর অঙ্কনের সাথে কথা বলে।”

পারমিতা দেবায়ন আর অনুপমার দিকে কাতর কণ্ঠে বলে, “যাই কর, অঙ্কন প্রেম করেছে ভালো কথা কিন্তু আমি পায়েলকে ঠিক অঙ্কনের জন্য মেনে নিতে পারছি না। পায়েল ওর চেয়ে অনেক বড় আর পায়েলের ব্যাপার আমি সব জানি।”

অঙ্কন এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে বলে, “দেখো তোমাদের জানাই নি সেটা আমার ভুল, তার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে পায়েলকে আমি ভালোবাসি আর পায়েল আমাকে ভালোবাসে। আমি জানতাম মা, দিদি, দেবায়নদা কেউ আমাদের এই সব মেনে নেবে না। তাই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দুইজনে লুকিয়ে রাখবো আমাদের সম্পর্ক। এতো তাড়াতাড়ি যে ধরা পড়ে যাবো সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি।”
 
অঙ্কনের কথা শুনে মিস্টার সেন রেগে যান, “তুই একটা নচ্ছার ছেলে। পড়াশুনার নাম নেই তোর। রক্তের দোষ আর কোথায় যাবে। ভালো হতো যদি...” কথাটা শেষ করলো না মিস্টার সেন, চোখে মুখে ফুটে ওঠে এক অব্যক্ত বেদনা। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে চুপ করে যান, কথাটা বলে খুব ভুল করেছে মিস্টার সেন।

পারমিতার চোখ ছলছল করে ওঠে মিস্টার সেনের সেই অব্যক্ত বাক্য ভেবে। অনুপমা ওর বাবাকে ধমকে ওঠে, “তুমি কি বলছো ভাইকে? একটু ভেবে চিন্তে কথা বলো।”

পারমিতা ছলছল চোখে মিস্টার সেনকে বলে, “এতদিন তোমার ছেলে খুব ভালো ছিল তাই না? আর একটা কথা বলবে না তুমি আমার ছেলের সম্বন্ধে।”

মিস্টার সেন বুঝে যান যে অব্যাক্ত ওই বাক্যবাণ বড় নিষ্ঠুর, মুখ থেকে বের হয়ে যায়নি সেটাই বড় কথা। অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে মিস্টার সেন গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “তোকে উপরে যেতে বলা হয়েছে তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?”

অঙ্কন মাথা নিচু করে বলে, “বাবা কি বলতে চাইছে আমার রক্তের ব্যাপারে আমি জানতে চাই।”

সবাই নির্বাক হয়ে অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার জন্য দেবায়ন অঙ্কনকে বলে, “আরে বাবা কিছু না, রক্তের কথা কিছু না। তুই জানিস কাকু রাগের মাথায় মাঝে মাঝে উলটো পাল্টা বলে ফেলে। ব্যাপার হচ্ছে, তুই যখন খুব ছোটো ছিলিস, তখন তোর ব্লাডে হিমোগ্লোবিন কম হয়ে যায় একবার। সেই সময়ে বেশ কয়েক বোতল রক্ত চড়াতে হয়েছিল। সেসব কথা তোর মনে নেই। ওই রক্তের কথা বলা হচ্ছে আর কিছু না।”

অঙ্কন চুপ করে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা বাবাকে বলতে আমার কোন ভয় ছিল না। শুধুমাত্র দিদিকে ভয় ছিল বলে আমরা লুকিয়ে ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ওর কলেজ শেষ হলে আর আমার কলেজ শুরু হলে তারপরে আমরা তোমাদের আমাদের ব্যাপারে বলবো। আমি পায়েলকে ভালোবাসি, ওকে ছাড়া আমি থাকবো না। ”

ভাইয়ের থমথমে মুখ দেখে অনুপমা বলে, “তুই নিজের ঘরে যা, না হলে তুই আজকে দেবায়নের সাথে ওর বাড়ি চলে যা। আমরা আগে এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে দেখি। আমি জানি কমলেশ কাকু যখন জেনে গেছে পায়েলের এই ব্যাপার তখন ওর ওপরে খুব অত্যাচার হবে। দেখি কি করা যায়।”

মিস্টার সেন অঙ্কনের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুই উপরে যা। পরে তোর সাথে কথা বলবো।”

মিস্টার সেন মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। পারমিতা মিস্টার সেনের পাশে বসে শান্ত হতে অনুরোধ করে। অনুপমা অথবা দেবায়নের মাথা কিছু কাজ করছে না, কি করবে কিছুই ভেবে পায় না দুইজনে। আগমনীর ঢাকের বাদ্যির জায়গায় বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। দেবায়ন অঙ্কনকে বলে নিজের কাপড় গুছিয়ে নিতে। পারমিতা আর অনুপমা করুন চোখে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। অঙ্কন উপরে নিজের ঘরে চলে যাবার পরে দেবায়ন বলে অঙ্কনের সাথে কথা বলে বিচার করে ওদের জানিয়ে দেবে। পারমিতা কিছুতেই পায়েলকে বাড়ির বউমা করতে নারাজ। অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে বসে। মিস্টার সেন চুপ করে সোফায় বসে ড্রিঙ্ক করতে শুরু করে দেন।

দেবায়ন কিছু পরে অঙ্কনকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অনুপমা আর পারমিতা দুইজনে দেবায়নকে বারবার বলে যে করে হোক অঙ্কনকে বুঝাতে। দেবায়ন বলে যে চেষ্টা করবে, আগে অঙ্কনের কাছে সম্পূর্ণ গল্প শুনতে চায় দেবায়ন। অনুপমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে দেবায়ন ওর মাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সাথে অঙ্কন আসছে। অঙ্কনের কথা শুনে দেবশ্রী একটু অবাক হয়ে কারন জিজ্ঞেস করে। উত্তরে দেবায়ন জানায় যে বাড়িতে ফিরে সব কিছু মাকে খুলে বলবে।

কয়েকদিন পরেই মহালয়া আর তার আগেই এই রকম একটা কান্ড ঘটে যাওয়াতে দেবায়ন বেশ চিন্তিত। অঙ্কন চুপ করে পেছনে বসে, দেবায়নকে বেশ সমিহ করে চলে তাই বুকের মধ্যে দুরুদুরু শুরু হয়ে যায় ওর। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কি জিজ্ঞেস করবে, কি করবে কিছুই ভেবে পায় না।

বাড়িতে ঢুকতেই দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে পারমিতা ফোনে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছে। দেবশ্রী একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার অঙ্কনের দিকে। অঙ্কন চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। দেবশ্রী ওর মনের অবস্থা সামাল দেবার জন্য হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসতে বলে। অঙ্কনকে দেবায়নের রুমের মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে দেবশ্রী দেবায়নকে পায়েলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। উত্তরে দেবায়ন জানায় যে পায়েল ওদের কলেজের বান্ধবী। দেবশ্রী বলে যে পারমিতা খুব আহত হয়েছে পায়েল আর অঙ্কনের ব্যাপারে জেনে। বারবার বলে দিয়েছে যে ছেলেকে কোন ভাবে বুঝিয়ে যেন পায়েলের থেকে দুরে সরিয়ে রাখে। দেবায়ন নিজের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে যে অঙ্কন ওখানে দাঁড়িয়ে। অঙ্কনের থমথমে চেহারা দেখে দেবায়ন ভাবনায় পড়ে যায়। মাকে বলে, আগে অঙ্কনের সাথে কথা বলে তারপরে কোন এক সিদ্ধান্ত নেবে। অঙ্কন জানিয়ে দেয় যে কোন রকম উলটো সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। দেবায়নের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অঙ্কনের কথা শুনে। অঙ্কনের অবস্থা সঙ্গিন দেখে দেবশ্রী বলে যে আগে খাওয়া দাওয়া সারতে তারপরে সব কিছু জেনে বুঝে একটা বিচার করা যাবে।

খাওয়ার পরে দেবায়ন অঙ্কনকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ঠিক সেই সময়ে অনুপমার ফোন আসে। চিন্তিত অনুপমা জানায় যে পায়েলের ফোন বন্ধ, পায়েলের বাড়ির ফোনে ফোন করেছিল কিন্তু কেউ ফোন তোলেনি। ওইদিকে মিস্টার সেন আর পারমিতা বেঁকে বসেছেন পায়েলের ব্যাপারে। অনুপমা ওর মাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছে যে পায়েল মেয়ে হিসাবে খারাপ নয়। মন ভালো, মিষ্টি মেয়ে। বাড়ির প্রবল চাপ ওকে বাড়ির বাইরে উশৃঙ্খল করে দিয়েছে। বাড়িতে ওর বাবা মায়ের কাছে একটু ছাড় পেলে হয়তো পায়েল এতটা উশৃঙ্খল হয়ে উঠতো না। কিন্তু পারমিতা কিছুই মানতে রাজি নয়। অঙ্কনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, দেবায়ন জানায় যে অঙ্কনের সাথে এখন কথা বলা হয়ে ওঠেনি।

রাতে অঙ্কনকে দেবায়ন জিজ্ঞেস করে পায়েলের কথা। অঙ্কন চুপ করে থাকে, দেবায়নের বাঘের মতন কণ্ঠস্বর শুনে গলা শুকিয়ে যায়। দেবায়ন স্বর নরম করে আস্বস্ত করে জানিয়ে দেয় যে ওর বাবা মা সবাই পায়েলের বিরুদ্ধে। অঙ্কন কি বলবে ভেবে পায় না। দেবায়ন ওদের গল্প শোনার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, অঙ্কনকে বলে যে পুরো কাহিনী জানালে ওর জন্য কিছু করতে পারে।

বুক ভরে শ্বাস নেয় অঙ্কন, “তুমি সত্যি বলছো?”

দেবায়নঃ “তোর গার্লফ্রেন্ড গরিমা, কেউ আছে কি ওই নামে? আর পায়েল যে আমাদের অগ্নিহোত্রীর কথা বলে বেড়াতো, কে সে লোক? সঙ্গীতার কাছে শুনেছি যে পায়েলের পিসতুতো দাদার বন্ধু, মানে অগ্নিহোত্রী আছে।”

অঙ্কন বলে, “অগ্নিহোত্রী আর গরিমা, দুই জনেই বর্তমান। তবে আমার গার্লফ্রেন্ড গরিমা নয়। গরিমা আমার ভালো বান্ধবী, প্রনবেশের গার্ল ফ্রেন্ড। আমাদের কাজে সাহায্য করার জন্য ওকে আমি সব কথা জানিয়েছিলাম। তোমাদের সামনে কাউকে প্রস্তুত করতে হতো তাই গরিমা আমার গার্ল ফ্রেন্ড সাজতে রাজি হয়। আমি ওকে জানিয়েছিলাম যে এই খেলা হয়তো বেশ কিছুদিন খেলতে হবে। গরিমাকে সন্তুষ্ট করতে ওকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিতে হয়েছে। দিদি আমাকে সেই টাকা দিয়েছিল।”

দেবায়নঃ “হুম, গরিমার কথা বুঝলাম। কিন্তু তুই কি করে পায়েলের প্রেমে পড়লি? একটু খোলসা করে বল, কিছু লুকাস না।” দেবায়নের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, “আমি জানি তুই বড় হয়ে গেছিস, আর পায়েল কি রকম মেয়ে সেটাও আমার অজানা নয়।”

অঙ্কন বলতে শুরু করে ওদের গল্প। পায়েল পাড়ার মেয়ে, ছোটো বেলা থেকে অঙ্কন দেখে আসছে তবে আগে কোনদিন পায়েলকে দেখে ওর মনে কিছু হয়নি। প্রথম যেদিন পায়েল ওর দিদির সাথে ওদের বাড়িতে আসে সেদিনও পায়েলকে দেখে ওর কিছু মনে হয়নি। দিদির বাকি বান্ধবীরা বাড়িতে আসতো, গল্প করতো কিন্তু তাদের মধ্যে পায়েলকে ওর বড় ভালো লাগে। ভালো লাগার কারন, পায়েলের খোলামেলা পোশাক আর নধর দেহের গঠন। হাঁটতে চলতে যেন এক ঝঙ্কার বেজে উঠতো অঙ্কনের চোখের সামনে। ওই ঝঙ্কারের আর মত্ত চালে পায়েলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় অঙ্কন। কিন্তু পায়েল ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড় আর দিদির বান্ধবী তাই কোনদিন মুখ ফুটে পায়েলকে নিজের মনের কথা জানায় নি। দিদির সাথে মাঝে মাঝে পায়েল ওদের বাড়িতে থেকে যেতো, রাতে গল্প করার সময়ে অথবা কোন অছিলায় পায়েলের সাথে গল্প করতো। তখন পায়েলের হাবভাবে অঙ্কন বুঝতে পারতো যে ওর প্রতি পায়েলের একটু সংবেদনশীল। কিন্তু বহুদিন ধরে দুই জনে শুধু চোখের দেখা আর কথা বলা ছাড়া নিজেদের মনের কথা কাউকে ব্যাক্ত করেনি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top