What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (3 Viewers)

দেবায়ন হেসে বলে, “এই তো হানিমুন হয়ে যাচ্ছে আবার কোথায় যাবো।”

অনুপমা দেবায়নের বুকে ছোটো কিল মেরে বলে, “ধুর বাবা বলো না কোথায় নিয়ে যাবে? এখানে হানিমুন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। মামনি মনে হয় না, আমাকে তোমার কাছে একা ছাড়বে। আমাদের হানিমুন মাঠে মারা গেল।”

দেবায়নঃ “কোথায় যেতে চাও তুমি?”

অনুপমাঃ “হানিমুনে সঞ্চয়িতাদির বাড়ি। আমার মাসির মেয়ে সঞ্চয়িতা, ইংল্যান্ডে, মারগেট শহরে থাকে। তিন বছর আগে ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। উফফফ কি দারুন জায়গায় বাড়ি জানো, একদম সমুদ্রের তীরে।”

দেবায়ন চুপ করে মিষ্টি হাসি মাখানো অনুপমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিস্টার সেনের কথা মনে পড়ে যায়, অনুপমার বাবা বলেছিলেন যে মেয়ে যদি কখন লন্ডন যেতে চায় তাহলে কি চাকরির পয়সায় মেয়েকে লন্ডন নিয়ে যেতে পারবে দেবায়ন। দেবায়ন কোনদিন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বের হয়নি, মায়ের অফিসের দৌলতে সুদুর মুসৌরি বেড়াতে এসেছে। নিবিড় আলিঙ্গন পাশে বদ্ধ কোমল প্রেয়সীর দেহপল্লব, আদুরে কণ্ঠে অনুপমা আবার বলে, “নিয়ে যাবে আমাকে? দারুন জায়গা, নীলচে সবুজ সমুদ্রের পাশে খুব ছোটো সাজানো শহর।”

দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ সোনা তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।” মাথার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ খেয়ে যায় মিস্টার সেনের কথা, নিজের কোম্পানি যদি দাঁড় করাতে না পারে তাহলে প্রেয়সীর স্বপ্ন পূরণ করতে অক্ষম হবে দেবায়ন।

অনুপমা দেবায়নের চোখে চোখ রেখে বলে, “ধুর বোকা ছেলে, আমি তোমার সাথে মজা করছিলাম। আমি তোমার চোখ পড়তে জানি পুচ্চু। তুমি নিজেকে যত চেনোনা, তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে চিনি, বুঝেছো। আমি মারগেট যাবো না, তুমি আমাকে যদি আউট্রামের স্কুপে বসিয়ে আইস্ক্রিম খাইয়ে বলো যে আমাদের হানিমুন হয়ে গেছে, তাতেই আমার হানিমুন হয়ে যাবে। তুমি এতো কেন ভাবছো যে আমার বাবা আমাকে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে? আমার বাবার কাছে পয়সা ছিল, ছেলে মেয়ের জন্য সময় আর ভালোবাসা ছিল না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি পুচ্চুসোনা, তোমার বুকের মাঝে থাকলেই আমার হানিমুনের সাধ পূরণ হয়ে যাবে।”

অনুপমার কথা শুনে দেবায়ন উত্তরের ভাষা হারিয়ে প্রেয়সীকে জড়িয়ে মাটি থেকে উঠিয়ে দেয়। অনুপমা দেবায়নের গলা জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বন এঁকে দেয়। ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়ার পরশ দুই প্রেমঘন নর নারীকে একত্রিত করে দেয়, সময় থমকে দাঁড়ায় দুই মিলনেচ্ছুক হৃদয়ের চারপাশে।

কোলে তুলে দেবায়ন অনুপমাকে বলে, “না পুচ্চি সোনা, তুমি বলেছো যখন আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। আমি দেখি আমাদের এই কোম্পানির ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলে।”

অনুপমাঃ “পুচ্চু, অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। আমাদের আগে কম্পিউটার কোর্স করতে হবে, তারপরে মামনির সাথে কথা বলতে হবে। কম্পিউটার কোর্স করতে মামনির যখন কোন বাধা নেই তাহলে আশা করি আমাদের আই.টি কোম্পানির স্বপ্নেও মামনি বাধা দেবে না।”

দেবায়নঃ “ঠিক জানিনা পুচ্চি। তবে মায়ের মনের মধ্যে কিছু একটা আছে বলে মনে হয়। মাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

অনুপমাঃ “হ্যাঁ, মামনি মাঝে মাঝে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে, চোখ ভাসা ভাসা হয়ে যাচ্ছে। আমি খেয়াল করেছি আজ সকালে খাবার সময়ে। চলো দেখা যাক মামনি একা একা কি করছে আবার।” দেবায়ন আর অনুপমা দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে। দূর থেকে দেবশ্রীকে নীল রঙের জিন্সে দেখে অনুপমা দেবায়নকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “মামনিকে জিন্সে দারুন দেখাচ্ছে। আবার পাশে এক ভদ্রলোক দেখছি মনে হচ্ছে? চলো দেখা যাক।”

দেবায়ন আর অনুপমা এগিয়ে আসে দেবশ্রী যেখানে দাঁড়িয়েছিল। পাশের ভদ্রলোককে দেখে দেবায়নের মনে পড়ে যে এই ভদ্রলোক হোটেলে ছিলেন, সকালে রেস্তোরাঁতে দেখতে পেয়েছিল দেবায়ন। অদুরে দাঁড়িয়ে ছোটো ফুটফুটে একটা মেয়ে, বয়স খুব বেশি নয় তবে সুন্দরী, দেখে মনে হলো যেন স্কুলে পড়ে।

দেবায়ন আর অনুপমাকে দেখে দেবশ্রী হেসে বলে, “কি রে তোদের বেড়ানো হলো?”

দেবায়ন মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”

দেবশ্রী পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এতদুর এসে একজনকে খুঁজে পেলাম। আমাদের দিল্লী অফিসের মারকেটিংয়ের ম্যানেজার, মিস্টার ধৃতিমান দেবনাথ।” মেয়েটির পরিচয়ে বলে, “এই হলো, ধৃতিমানের কন্যে, মিস মল্লিকা দেবনাথ। দিল্লীতে ডি.পি.এসে ক্লাস এইটে পড়ছে।”

দেবায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় ধৃতিমান, “গ্লাড টু মিট ইউ।” অনুপমার দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায়।

ধৃতিমানের দেখা পেয়ে দেবশ্রীর মুখের ভাবব্যক্তি বদলে যায়, বিষণ্ণ চিন্তিত চেহারায় এক অনাবিল খুশির আলোক ছটা বিচ্ছুরিত হয়। মল্লিকার সাথে দেবশ্রী বেশ মিশে গেছে। অনুপমার শ্যেন দৃষ্টি ধৃতিমানের চেহারা নিরীক্ষণ করে। বয়স তেমন কিছু বেশি নয়, কথাবার্তা মার্জিত, তবে চেহারার ভাবব্যক্তি ঠিক অনুপমার পছন্দ হয় না। বারেবারে ওর মামনির শরীরের দিকে কেমন এক আড় চোখে তাকিয়ে দেখে।

দেবশ্রী বলে, “আমাদের হোটেলে উঠেছেন, গতকাল রাতে মেয়েকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছেন।”

ধৃতিমান দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডামের সাথে কথা হচ্ছিল তোমাদের নিয়ে। তুমি ফাইনাল ইয়ারে তাই না?”

দেবায়নঃ “হ্যাঁ।”

ধৃতিমানঃ “কেমন লাগছে মুসৌরি?”

দেবায়নঃ “এই সকালে এখানে পৌঁছেছি, এখনো শহর ঘুরে দেখা হয়নি। তবে ভিড় দেখে মনে হলো বেড়ানোর চেয়ে হোটেলে থাকা ভালো। লোকজন কেঁচোর মতো কিলবিল করছে।”
 
ধৃতিমান হেসে উত্তর দেয়, “ছুটির মরশুমে এইরকম হবেই।”

অনুপমা দেবায়নের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে, আলতো করে দেবায়নের বাহুতে একটা ছোটো চিমটি কাটে। দেবায়ন অনুপমার দিকে তাকাতেই অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, এবারে চলো মুসৌরি ফিরে একটু শপিং করা যাক।”

দেবশ্রী ধৃতিমানের দিকে হেসে বলে, “এক হোটেলে যখন আছি তাহলে সেখানে দেখা হবে। আর হ্যাঁ, কথাবার্তা কিছুই হয়নি এখনো, পরে জানাবো। জানিনা একটু ভয় ভয় করছে।” মল্লিকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমার জন্য কি কিনবো?”

মল্লিকা হেসে জানায়, “আবার প্রেসেন্ট দেবেন?”

দেবশ্রী একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, বুঝতে পারে যে ওর মায়ের সাথে মল্লিকার পরিচয় এই সুদুর মুসৌরিতে এসে হয়নি, এখানে আসার আগে মল্লিকা দেবায়নের মাকে চেনে।

ধৃতিমান দেবশ্রীকে বলে, “আমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো।” দেবায়নের দিকে ফিরে বলে, “ডিনার আমার তরফ থেকে, কেমন?”

দেবায়ন হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে।”

গাড়িতে চড়ে দেবায়নেরা মুসৌরির উদ্দশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ছাড়তেই কিছু পরে পেছনে ধৃতিমানের গাড়ি দেখা যায়। ঘণ্টা দুই পরে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে বিকেলের দিকে দেবায়নেরা মুসৌরি পৌঁছে যায়। দেবায়ন জানিয়ে দেয় যে শপিংয়ে ওর ইচ্ছে নেই, ও হোটেলে ফিরে যেতে চায়। ম্যাল রোডে দেবশ্রী আর অনুপমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি দেবায়নকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেয়। হোটেলে পৌঁছানোর পরে গাড়ি ছেড়ে দেয় দেবায়ন। হোটেলে ঢুকে একা একা কিছুক্ষণ নিজের কামরায় বসে টিভি দেখে, তারপরে বারে চলে যায়। একটা বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে অনুপমার কথা ভাবে। খুব বড়লোকের মেয়ে অনুপমা সেন, রুপের ডালি সাজিয়ে ওর কোলে এসে পড়েছে তবে এই সুন্দরীর মনের আশা পূরণ করতে হলে ওকে অনুপমার বাবার কথা মেনে কোম্পানি খুলতে হবে। নিজের একটা আই.টি কোম্পানির স্বপ্ন বুকের মধ্যে এঁকে নেয় দেবায়ন। সময় কেটে যায় কতক্ষনে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারে না। একহাতে বিয়ারের বোতল অন্য আঙ্গুলে সিগারেট জ্বালিয়ে চোখের সামনে অনুপমার মিষ্টি মুখের স্বপ্ন দেখে।

দেবায়ন সম্বিৎ ফিরে পায় ধৃতিমানের কণ্ঠস্বর শুনে, “একা একা বসে যে? ম্যাডাম কি শপিং করতে গেছেন?” ধৃতিমান ওর পাশে একটা হুইস্কির গ্লাস নিয়ে বসে পড়ে।

ধৃতিমানকে দেখে দেবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিয়ে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মা আর অনুপমা একটু ম্যাল রোডে শপিং করতে গেছে। মেয়েদের শপিং করতে যাওয়া মানে একশোটা দেখবে তারপরে একটা নেবে তাই আমি আর যাইনি। আপনার মেয়ে কোথায়?”

ধৃতিমান হেসে বলে, “তা ঠিক বলেছো। মল্লিকা রুমে বসে টিভি দেখছে, আমি ভাবলাম একটু বারে যাই আর দেখো তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল, বেশ ভালোই হলো।”

দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “আপনি মেয়েকে নিয়ে একা বেড়াতে এসেছেন, ফ্যামিলি কোথায়?”

ধৃতিমান ম্লান হেসে বলে, “ফ্যামিলি বলতে এক ওই মেয়ে, মল্লিকা। এই অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকি ছুটি পাওয়া যায় না। ওর গরমের ছুটি তাই ভাবলাম একটু ঘুরে বেরিয়ে আসি।”

দেবায়ন বুঝতে পারলো যে ভদ্রলোক ইচ্ছে করে নিজের স্ত্রীর কথা এড়িয়ে গেছেন, দুটি কারন হতে পারে এড়িয়ে যাবার, এক এই ভদ্রলোক ডিভোর্সি, দ্বিতীয় স্ত্রী হয়তো গত হয়েছেন। দুইজনের মাঝে কথাবার্তা গল্প গুজব শুরু হয়। দেবায়ন জানতে পারে যে মায়ের নাম শুধুমাত্র কোলকাতা অফিসে সীমিত নেই, দিল্লীর হেড অফিস থেকে শুরু করে বম্বে, পুনে সবাই মাকে চেনে। মায়ের গর্বে ছেলের বুক ফুলে ওঠে। দেবশ্রীর সাথে ধৃতিমান এই রিক্রুটমেন্ট টুরে গিয়েছিল সেখানেই পরিচয়। ধৃতিমান দেবায়নকে ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন উত্তরে বলে কলেজ শেষে কোন আই.টি কম্পনি জয়েন করতে চায় আর সেই জন্য কোলকাতা ফিরে একটা কম্পিউটার কোর্স করবে। ধৃতিমান জানায় যে ওদের কোম্পানির দিল্লী অফিসে কিছু আই.টি ফিল্ডে লোক দরকার পড়ে সেখানে ইচ্ছে করলে জয়েন করতে পারে। দেবায়ন জানায় কোলকাতা থেকে বাইরে যেতে চায় না। দেবায়নের কথা শুনে একটু দমে যায় ধৃতিমান। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে কোলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষ কোন বড় কোম্পানি নেই, ইচ্ছে করলে দিল্লীতে এসে চাকরি করতে পারে। দেবায়ন ওর আসল পরিকল্পনা একজন বাইরের লোকের কাছে জানাতে অনিচ্ছুক তাই বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে যে ছোটো খাটো যা চাকরি পাবে তাতেই সে খুশি তবে কোলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে নারাজ। ধৃতিমানের সাথে তর্কে যেতে নারাজ দেবায়ন। নিজের জন্মভুমি ছেড়ে দূর দেশে থাকা, নিজের ভালোবাসার দেশ ছেড়ে অচিন পুরে সোনার খাঁচায় বন্দি জীবনে নারাজ দেবায়ন।

শপিং থেকে ফিরে দেবশ্রী দেবায়নকে ফোন করে রুমে ডাকে। দেবায়ন আর অনুপমার জন্য ভারী জ্যাকেট কেনে দেবশ্রী, নিজের জন্য বেশ কয়েকটা স্টোল আর শাল। পারমিতার জন্য একটা শাল আর মিস্টার সেনের জন্য একটা দামী শার্ট কেনে। অঙ্কনের জন্য একটা চামড়ার জ্যাকেট কেনা হয়। অনুপমা শপিং গল্পে মত্ত, এইখানে এই দেখছে ওই খানের ওইটা ভালো এই নিয়ে বউমা আর হবু শ্বাশুড়ির মাঝে গল্প শুরু হয়। গল্পে আবার রাত বেড়ে ওঠে, দেবশ্রী আর অনুপমা একে একে জামা কাপড় বদলে রাতের খাবারের কথা বলে। রেস্তোরাঁর দিকে যাওয়ার সময়ে অনুপমা দেবায়নেকে মুখ ভার করে জানায় অনেক চেষ্টা করেও ওর মামনি ওকে দেবায়নের সাথে এক রুমে রাত কাটাতে বারন করেছে। দেবায়ন কিঞ্চিত দুঃখিত হয়ে যায়, কোলকাতা থেকে দুই জনে অনেক স্বপ্ন বুকে করে এনেছিল, নিরবে নিভৃতে একসাথে রাত কাটাবে। অনেকদিন অনুপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দেবায়ন। অনুপমা মৃদু হেসে জানিয়ে দেয় যে ওর মামনিকে আবার একবার অনুরোধ করে দেখবে।

রেস্তোরাঁতে ধৃতিমান আর মল্লিকার সাথে দেখা। আগে থেকে একটা পাঁচজনের টেবিল বুক করে রেখেছিল ধৃতিমান। অনুপমা বারেবারে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে তার ভাবব্যক্তি নিরীক্ষণে ব্যস্ত। দেবশ্রী আর ধৃতিমান সামনা সামনি বসে আর দেবায়ন আর অনুপমা সামনা সামনি বসে। দেবশ্রীর পাশে বসে মল্লিকা, বারেবারে দেবশ্রীর মুখের দিকে তাকায় আর ফিকফিক করে হেসে ফেলে। খাওয়ার সময়ে ধৃতিমান, অনুপমা আর দেবশ্রীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে শপিংয়ের কথা। মল্লিকা কিঞ্চিত মুখ ভার করে অভিমানি কণ্ঠে বলে যে ওকে কেন শপিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দেবশ্রী হেসে বলে যে পরেরদিন ওদের সাথে শপিংয়ে নিয়ে যাবে। মল্লিকা বেশ খুশি। দেবশ্রী ধৃতিমানের প্রশ্নের উত্তরে হেসে বলে, ছুটির মরশুমে মুসৌরির মতন নামকরা জায়গায় ভিড় হবেই। সব দোকানে অনেক ভিড়, রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই, রেস্তোরাঁ আর হোটেলগুলোতে লোকজন মনে হয় উপচে পড়ছে আর জিনিস পত্রের দাম তেমন কিছু কম নয়। ধৃতিমান জানায় যে দেবায়নের সাথে বারে দেখা হয়েছিল। দেবশ্রী ছেলের দিকে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বারে কি করছিল। মায়ের শ্যেন চাহনির সামনে মাথা নিচু করে উত্তর দেয় যে একা একা ভালো লাগছিল না তাই একটু বারে বসে বিয়ার নিয়েছিল। অনুপমা মাঝে মাঝে কথোপকথনে যোগদান করে। অনুপমা ওর মামনিকে আস্বস্ত করে বলে বেড়াতে এসে এইটুকু ছাড় ছেলে মেয়েদের দেওয়া উচিত। দেবশ্রী মৃদু হেসে বলে ছাড় সে দিয়ে দিয়েছে তাই বলে যেন সেই স্বাধীনতার অপমান না করে। অনুপমা বুঝে যায় ওর মামনি কি বিষয়ে বলতে চাইছে।

ধৃতিমান বলে, “ম্যাডাম, তোমার ছেলে বেশ বুদ্ধিমান।”

দেবশ্রী একটু হেসে বলে, “জানি না মাথায় কি আছে।”

অনুপমা দেবায়নকে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কি গো তুমি বুদ্ধিমান নাকি? জানতাম না তো?”

ধৃতিমানঃ “আমি জিজ্ঞেস করছিলাম যে কলেজের পরে কি করতে চায়।” দেবশ্রী একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার ধৃতিমানের দিকে তাকায়। ধৃতিমান বলে, “আজকাল তথ্য প্রযুক্তির বাজার, জেনে খুশি হলাম যে তোমার ছেলে আই.টি জয়েন করতে চায়, খুব ভালো।”

দেবশ্রী দেবায়নের দিকে তাকাতেই দেবায়ন উত্তরে বলে, “হ্যাঁ, মানে কথাবার্তা হচ্ছিল সেইরকম কিছু।”

ধৃতিমান বলে, “আমি ওকে বলছিলাম যে আমাদের দিল্লীর অফিসে আই.টি ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, সেখানে লোকের প্রয়োজন থাকে।”
 
দেবশ্রী খাওয়া থামিয়ে ধৃতিমানের উদ্দশ্যে বলে, “এই সব কথা হয়েছে?”

ধৃতিমান দেবশ্রীর বলার ধরন না বুঝে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মানে আমি ওকে বলছিলাম যে দিল্লীতে অনেক আই.টি কোম্পানি আছে, আর আমাদের অফিসে লোকের দরকার পড়ে। কিন্তু তোমার ছেলে কোলকাতা ছাড়তে চায় না, কোলকাতা সম্বন্ধে বেশ ইমোশানাল।”

ধৃতিমানের এহেন আচরনে দেবশ্রী একটু ক্ষুব্ধ হয়ে যায়, চোদ্দ দিনের একজনের সাথে থেকে তার প্রেম প্রীতি অন্তত বাইশ বছরের স্নেহ মমতাকে ভাসিয়ে দিতে পারে না। ধৃতিমানের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে চিবিয়ে শীতল কণ্ঠে দেবশ্রী বলে, “ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া আমি পছন্দ করিনা, ধৃতিমান।”

মায়ের হিম শীতল কণ্ঠস্বরের পেছনের কারন বুঝে উঠতে পারে না দেবায়ন, কারন খুঁজতে অনুপমার দিকে তাকায়। অনুপমা ভুরু কুঁচকে ইশারায় জানিয়ে দেয় যে ওর মামনির হটাত করে এইরকম কণ্ঠের উত্তরের কারন ওর অজানা।

ধৃতিমান সহজে অনুধাবন করে দেবশ্রীর মনের কথা, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না মানে আমরা শুধু আলোচনা করছিলাম ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে।”

দেবশ্রী ক্রোধ সংবরণ করে কথা ঘুরিয়ে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তুই আগে মুসৌরি এসেছিলি তা আর কোথায় ঘুরেছিস? কাল আমাদের কি প্রোগ্রাম হবে?”

অনুপমাঃ “এখানে বেশ কয়েকটা ঝরনা আছে, কেম্পটি ফলস নামকরা, আরো ছোটো ছোটো ঝরনা আছে। তারপরে ম্যাল রোডের শেষে একটা রোপওয়ে আছে, কাল আমরা সেই সব জায়গায় ঘুরতে যাবো।”

দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই এতো চুপচাপ কেন? মায়ের হাতের রান্না এতো খারাপ যে হোটেলের রান্না থেকে মাথা উঠাতে পারছিস না?”

দেবায়ন হেসে বলে, “না মা, সেটা নয়।”

দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি দিল্লী কবে ফিরছো?”

ধৃতিমান এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না, ওর ধারনা ছিল দেবশ্রীর সান্নিধ্যে হয়তো দুটি রাত নিভৃতে কাটাতে পারবে। কিন্তু দেবশ্রীর ভাবমূর্তি দেখে সেই সাহস যোগাতে অক্ষম হয় ধৃতিমান, “না মানে, দিন দুয়েক পরে ফিরবো।”

দেবশ্রী থালা থেকে মাথা না উঠিয়ে বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে তোমার সাথে তাহলে কথা হবে।” মল্লিকার দিকে তাকিয়ে বলে, “আগামী কাল আমরা ঘুরতে যাবো, তখন তোমাকে নিয়ে যাবো।”

মল্লিকা হেসে বলে, “বাপির সাথে থাকলে বেড়ানো যাবে না। আমি সকাল বেলায় তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে থাকবো।”

খাওয়া শেষে দেবশ্রী ধৃতিমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, অনুপমা আর দেবায়নকে নিয়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায়। দেবশ্রী দেবায়নকে বলে ওর সাথে কিছু কথা বলতে চায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করাতে বলে দেবায়ন একা নয় অনুপমার সাথে কিছু কথা আছে। দেবায়ন জানায় যে জামাকাপড় বদলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেবশ্রীর রুমে চলে আসবে। দেবায়ন বেশ ভাবনায় পড়ে যায় মা কি কথা বলতে চায় সেই নিয়ে। জামাকাপড় বদলে মায়ের রুমে ঢুকে দেখে মা টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে, হাতে একটা সাদা খাম। মায়ের পাশের সোফার উপরে বসে অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি কারন, অনুপমা জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের অপেক্ষা করা হচ্ছিল।

দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কম্পিউটার কোর্স করতে চাস, ভালো কথা, তার টাকা আমি যোগাড় করে দেবো। তারপরে কোলকাতায় কি তেমন কোন ভালো আই.টি কোম্পানি আছে যেখানে তুই মনের মতন কাজ পাবি?”

দেবায়ন আর অনুপমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। একটা কিছু অনুধাবন করেছিল অনুপমা, কিন্তু সেটা ওদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।

দেবায়ন একবার অনুপমার দিকে তাকিয়ে মাকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি আছে কোলকাতায় যেখানে চাকরি পেতে পারি। আর আজকাল সল্টলেকে অনেক নতুন নতুন আই.টি কোম্পানি খুলছে।”

দেবশ্রীঃ “দ্যাখ, তুই আর অনুপমা, দুইজনেই এখন আমার সম্বল।” অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার মেয়ে নেই।”

অনুপমা দেবশ্রী জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, “মামনি আমি তোমার মেয়ে নই?”

দেবশ্রী অনুপমার গালে হাত বুলিয়ে স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলে, “না তুই আমার মেয়ে নয়। মেয়েরা বাবা মায়েদের দায়িত্ব। তুই আমার বাড়ির সন্মান, আমার বউমা, আমার ভবিষ্যৎ তুই।” অনুপমা জড়িয়ে ধরে দেবশ্রীকে। দেবশ্রী অনুপমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সব মায়ের মতন আমি চাই আমার ছেলে ভালো থাকুক, ভালো চাকরি করুক। আমি যে কষ্টে ওকে মানুষ করেছি, সেই কষ্ট যেন তোদের পোহাতে না হয়।”

দেবায়ন মায়ের পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো?”
 
দেবশ্রী খানিকক্ষণ চুপ থাকার পরে হাতের খাম দেবায়নের হাতে ধরিয়ে বলে, “আমি একটা চাকরির অফার পেয়েছি। দিল্লীতে আমার হেডঅফিসে ডি.জি.এম এইচ.আর পোস্টের, মাইনে কোলকাতার চেয়ে দ্বিগুন। আমার সি.ই.ও সেই সাথে আমাকে জানিয়েছে যে দিল্লীতে এলে তোকে এখানের বড় কোম্পানিতে চাকরি করিয়ে দেবে অথবা আমাদের কোম্পানিতে তোর চাকরি হয়ে যাবে।”

অনুপমা আর দেবায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, ভালোবাসার দেশ, ভালোবাসার শহর কোলকাতা ছেড়ে অচিনপুরি দিল্লীতে চলে আসবে? ভাবতে পারছে না অনুপমা, দেবায়নকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই চোখের কোণে জল ছলকে আসে। অনুপমা ধরা গলায় বলে, “তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? এই বলার জন্য আমাদের ডেকে নিয়ে এলে।”

দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “না মা, আমি জানি তুই কি ভাবছিস। তোর ভালোবাসা যদি এতো গভীর হয় তাহলে তোর ভয় কোথায়? আমি এখুনি দিল্লীতে ট্রান্সফার নিচ্ছি না মা। তোদের কলেজ শেষ হবে তারপরে দিল্লীতে ট্রান্সফার নেব। দেবায়নের চাকরি হয়ে গেলেই আমি তোদের দুইজনের বিয়ে দিয়ে দেবো।”

দেবায়ন মায়ের হাত ধরে বলে, “তোমার কোলকাতা, তোমার বাড়ি। সব ছেড়ে তুমি দিল্লীতে আসতে চাও?”

দেবশ্রীঃ “বাড়ি ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হবে জানি। বাড়ির এক একটা ইঁট আমার বুকের জল করা রক্ত দিয়ে গাঁথা। কিন্তু তুই যদি কোলকাতায় চাকরি না পাস তাহলে যেখানে তোর চাকরি হবে সেখানে আমাকে যেতে হবে। সেই ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

দেবায়ন অবাক চোখে মাকে প্রশ্ন করে, “তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছ মানে? তুমি অফার নিয়েছ?”

দেবশ্রী ম্লান হেসে বলে, “না, চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোদের সাথে কথা বলা দরকার তাই তোদের এখানে ডাকা।”

দেবায়ন মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “মা আমাদের কিছু বলার আছে তোমাকে। এই কয়দিনে আমরা দুইজনে অনেক কিছু ভেবেছি আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে।”

দেবশ্রীঃ “কি?”

দেবায়নঃ “আমরা কম্পিউটার শিখতে চাই একটা কারনে। কলেজের পরে দুইজনে মিলে একটা ছোটো আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলতে চাই কোলকাতায়।”

দেবশ্রী ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি? তুই কি ভাবছিস? একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খোলা এতো সহজ? কি জানিস তুই এই সফটওয়্যার, এই কম্পিউটার নিয়ে? এক বছরে তোদের এমন কি হাতি ঘোড়া শিখিয়ে দেবে যে তোরা কোম্পানি খুলতে চাস? একটা কোম্পানি খুলতে কত মাথা ব্যাথা সেটা জানিস? ব্যাবসার কি জানিস তুই?”

অনুপমাঃ “মামনি, শ্রেয়ার বন্ধু রূপক, যাদবপুরে আই.টি তে বি.টেক করছে। ওর সাথে মিলে আমরা এই কোম্পানি খুলতে চাই।”

দেবশ্রী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যায় অনুপমার কথা শুনে, “মানে আমাকে না জানিয়ে এই সব ভাবনা চিন্তা করা হয়ে গেছে তোদের?”

অনুপমাঃ “না মামনি, আমরা এখন পর্যন্ত কাউকে এই কথা জানাই নি। রূপক অথবা শ্রেয়া কারুর সাথে এই বিষয়ে কোন কথা হয়নি। শুধু তোমাকে জানালাম আমাদের পরিকল্পনার কথা। তোমার মতামত না পেলে, তোমার আশীর্বাদ না পেলে আমরা কিছুই করতে পারবো না, মামনি।”

দেবশ্রীঃ “আচ্ছা একটা কথা বল, যত ছোটো কোম্পানি হোক না কেন সেটা শুরু করতে অনেক টাকা লাগে। কোথা দিয়ে আসবে এতো টাকা? আমি অত বড়োলোক নই যে একটা কোম্পানি তৈরি করার মতন টাকা আমার কাছে থাকবে। জমি কিনেছি দেবায়নের বাবার জীবনবিমা আর ওর বড় মামার দেওয়া টাকা দিয়ে। বাড়ি করতে আমাকে এল.আই.সি থেকে লোণ নিতে হয়েছে। মাসের শেষে আমার হাতে এমন কিছু বাঁচে না যে তোদের আমি তোদের টাকা দিতে পারবো।”

দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, সময় এসেছে মাকে সব কথা খুলে বলার। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, সময় মতন টাকার যোগাড় আমরা ঠিক করে নেব।”

দেবশ্রীঃ “পারমিতা, মিস্টার সেন তোদের এই পরিকল্পনার কথা জানেন?”

অনুপমা মাথা নাড়িয়ে উত্তরে জানায়, “হ্যাঁ, বাবা সব জানে। বাবা, মায়ের মত আছে এই ব্যাপারে। আসলে আমার বাবা ওকে এই আই.টি কোম্পানি খুলতে বুদ্ধি দিয়েছেন।”

অনুপমার কথা শুনে দেবশ্রীর কান গরম হয়ে যায়। দেবশ্রী বুঝতে পারেন যে ছেলে নিশ্চয় মিস্টার সেনের সাথে কথা বলে এই টাকার ব্যাবস্থা করেছে, কিন্তু ছেলের মুখ থেকে সত্য শুনতে চায়, “পরিকল্পনা বেশ গভীর ভাবে ভাবা হয়েছে মনে হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় টাকার কথা ভাবা হয়েছে। কোথা থেকে টাকা যোগাড় হবে?”

দেবায়নঃ “মা, প্লিস আমাদের কথা শুনে রেগে যেও না। আমাদের পুরো পরিকল্পনার কথা আগে শোনো, বিচার করো, তারপরে বলো আমরা ভুল কি করছি। আমি আর অনুপমা, রূপকের সাথে মিলে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করতে চাই। সেই বুদ্ধি আমাকে সোমেশ কাকু দিয়েছেন আর সেই সাথে বলেছেন যে কোম্পানির তৈরির যত টাকা লাগে তিনি আমাদের দেবেন।”
 
দেবশ্রীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে, হিম শীতল ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “তোর বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি অনেকের কাছে হাত পেতেছিলাম কেউ বিশেষ সাহায্য করেনি। তারপরে তোকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছি যাতে তোকে কারুর কাছে হাত না পাততে হয় আর তুই কি না নিজের আত্মসন্মানটুকু ডুবিয়ে মিস্টার সেনের কাছে টাকা চাইলি?”

মাথা নিচু করে বসে থাকে দেবায়ন। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “না মামনি তুমি ভুল বুঝছো। আমাদের কথা একটু ভালো করে শোন।”

দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর কি শোনাতে চাস তুই?”

অনুপমা বুঝতে পারে যে ওর মামনি রেগে গেছে, দুঃখে ভেঙে পড়েছে। আস্বস্ত কণ্ঠে মামনিকে বলে, “মামনি, চাকরির চেয়ে একটা ছোটো ফার্ম খুলতে দোষ কি? দেবায়নের স্বপ্ন একটা নিজের ফার্ম হবে।”

দেবশ্রীঃ “ওটা দেবায়নের স্বপ্ন না তোর স্বপ্ন?”

মায়ের কথার উত্তরে দেবায়ন বলে, “মা, চাকরি করতে করতে কিছু বছর পরে আমি একটা নিজের ফার্ম খুলতে চেষ্টা করতাম ঠিক। ওটা আমার স্বপ্ন ছিল বলতে পারো। অনু এই ব্যাপারে আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। অনু বরাবর আমার চাহিদাকে সন্মান দিয়েছে, মা।”

দেবশ্রী অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, তুই কি বলতে চাইছিস শুনি?”

অনুপমা ওর মামনির হাত দুটি ধরে বলে, “মামনি, প্লিস আমাদের ভুল বুঝো না। আমার স্বপ্ন শুধু তোমার কাছে থাকার। আমার কথা একটু শোনো মামনি। সফটওয়্যার ফার্ম তৈরি করতে গেলে একটা ফাইনেন্সিয়ারের দরকার পড়তো, সেখানে আমার বাবা আমাদের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চায়। তোমার কাছে টাকা থাকলে তুমি দেবায়নকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে না? সেখানে বাবা যদি আমাদের সাহায্য করে তাহলে ক্ষতি কোথায়? তুমি টাকা দিলে ঠিক আর আমার বাবা আমাকে টাকা দিলে সেটা ভুল? এটা কেমন মামনি?”

দেবায়ন মুখ তুলে অনুপমার দিকে তাকায়। দেবশ্রী দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধান বানী শোনায়, “ভুল নয় সেটা সত্যি। তবে একটা কথা মনে রাখিস। এই সম্পদ প্রতিপত্তির সিঁড়ি চড়তে চড়তে, কোনদিন ফেলে আসা ধাপগুলো যেন ভুলে যাস না। এমন যেন না হয়, যে একদিন তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর তোর সামনের জন তোকে প্রশ্ন করলো, তুমি কি ঠিক করেছো দেবায়ন? আর সেইসময়ে তোর কাছে সেই উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই।”

দেবায়ন মায়ের হাত ধরে আস্বস্ত করে বলে, “না মা, আমি কথা দিচ্ছি, এমন কিছু আমরা করবো না যাতে আমি নিজের সামনে দাঁড়াতে অথবা তোমার সামনে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে যাই।”

দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, “কোলকাতায় ফিরে আমি একবার মিস্টার সেন আর পারমিতার সাথে দেখা করতে চাই।”

বুক দুরুদুরু করে ওঠে দেবায়নের। মিস্টার সেন বারেবারে বারন করেছিল, কাউকে যেন খোলসা করে বিশেষ কথা না জানায়। কিন্তু দেবশ্রীর কাছে লুকাতে পারলো না অনুপমা অথবা দেবায়ন, মমতার তীব্র বন্ধনে মনের কথা খুলে বলতে হলো। অনুপমা প্রমাদ গোনে, বাবার সাথে মামনি দেখা করলে বাবা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, দেবশ্রীকে আস্বস্ত করে বলে, “মামনি এখন অনেক সময় বাকি আছে। প্লিস মামনি, এখুনি এইসব নিয়ে আমরা কোন ভাবনাচিন্তা করছি না। আগে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাক তারপরে না হয় তুমি মায়ের সাথে বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।”

দেবশ্রীঃ “ঠিক আছে তাই হবে। ফাইনাল পরীক্ষার আগে, কলেজ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তোরা দুইজনে এই সব ব্যাপারে একদম মাথা খাটাবি না। আগে নিজেদের পড়াশুনা, কলেজ ঠিক ভাবে শেষ কর। আমি পারমিতা আর মিস্টার সেনের সাথে এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে চাই। সবার কি ইচ্ছে সেটা জানার পরে আমি আমার সিদ্ধান্ত তোদের জানাবো।” অনুপমার গাল টিপে আদর করে বলে, “এখুনি যেন ভেবে বসিস না যে আমি তোদের কথা মেনে নিয়েছি। যা অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ রাতে ছুটি দিচ্ছি, বেশি দুষ্টুমি যেন করিস না।”

অনুপমা অবাক হয়ে খুশিতে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, “তুমি আমার দুষ্টু মিষ্টি মামনি।”

দেবশ্রীঃ “হুম বুঝতে পারছি বেশ তেল মারা হচ্ছে। যা বদমাশ, আর হ্যাঁ কাল তাড়াতাড়ি উঠিস, কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাবি কত ফলস দেখাবি বললি যে।”

অনুপমাঃ “উম্মম্ম মামনি, কাল আবার শপিং যাবো বিকেলে। কালকে তোমার জন্য একটা ভালো কারডিগান কিনে দেবো আমি।”

দেবশ্রী অনুপমার গাল টিপে বলে, “আরে পাগলি মেয়ে। যেদিন তুই নিজের আয় করা টাকায় কিনে দিবি সেদিন আমি খুশি হব। তুই দশ টাকার কানের দুল কিনে দিলেও আমি সেদিন বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো যে আমার বউমা আমাকে কিনে দিয়েছে।”

অনুপমা আদুরে কণ্ঠে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মামনি, তুমি বড্ড ইমোশানাল করে দাও।”

দেবায়ন বুঝতে পারল যে হবু বউমা আর হবু শ্বাশুড়ির মাঝে কিছুক্ষণ ভাবাবেগের আলাপ চলবে। দেবায়ন অনুপমাকে বলে, “আমি চললাম, তোমাদের ন্যেকামো শেষ হলে চলে এসো।”

অনুপমার আর দেবায়ন, দেবশ্রীর রুম থেকে বেরিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকে পড়ে। নিজেদের রুমে ঢুকতেই দেবায়ন অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। প্রশস্ত বুকের সাথে অনুপমার কোমল দেহ পিষে মিলিয়ে একাকার করে দেয়। চুম্বনে আদরে ভরিয়ে দেয় অনুপমার সুন্দর মুখ। অনুপমা দেবায়নের গলা দুই হাতে জড়িয়ে প্রেমের চুম্বন নিবিড় করে আহরণ করে। জীবন প্রদীপ থমকে যাওয়ার আগের মুহূর্তের মতন পরস্পরকে আদরে চুম্বনে ভরিয়ে তোলে জোড়া কপোত কপোতী। দেবায়ন অনুপমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়।

অনুপমাকে বুকের উপরে ফেলে মুখখানি আঁজলা করে ধরে বলে, “তুমি না থাকলে আজকে আমি মায়ের সামনে কথা বলতে পারতাম না। জানিনা তুমি না থাকলে কি হতো আমার।”

অনুপমা দেবায়নের চোখের মণির মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে বলে, “এমন করে কেন বলছো, আমি তোমার পাশে সবসময়ে আছি। তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারিনা পুচ্চু সোনা।”
 
দেবায়নঃ “আচ্ছা মাকে কি ভাবে পটালে বলতে পারো, তোমাকে আমার সাথে রাতে থাকতে দিল যে?”

অনুপমা দেবায়নের নাকের উপরে আঙুল ঘুরিয়ে বলে, “শুধু কি তুমি পারো মানুষকে কথায় ভুলাতে, তোমার গার্লফ্রেন্ড অনেক কিছু পারে, বুঝলে।”

দেবায়নঃ “সে বুঝলাম এবারে...”

অনুপমা ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি মাখিয়ে বলে, “এবারে আর কি, তুমি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ো আমি একটু গা ধুয়ে আসছি।”

দেবায়ন গেঞ্জি খুলে বিছানায় উঠে পড়ে। অনুপমা চোরা হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে একটা পাতলা স্লিপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। দেবায়ন পার্সের থেকে কন্ডম বের করে বালিশের নিচে রেখে দেয়, নিভৃতে প্রেয়সীর সাথে ভালোবাসার খেলার জন্য আগে থেকে তৈরি হয়ে এসেছিল। আসন্ন কামকেলির উত্তেজনায় প্যান্টের ভেতরে লিঙ্গ ছটফট করে। অনুপমা কিছু পরে বাথরুম থেকে ছোটো স্লিপ পরে বেরিয়ে আসে। ঘরের মৃদু আলোকে অনুপমাকে ঠিক যেন স্বর্গের এক নর্তকীর মতন মনে হয়। কোমরে হাত রেখে বেঁকে দাঁড়িয়ে, চোখে মিষ্টি আহবানের ঝিলিক। দেবায়ন বিছানা ছেড়ে উঠে অনুপমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কোমরে হাত রেখে নরম পেটের উপরে গাল ঘষে দেয়। অনুপমা দেবায়নের চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে দুই চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে।

দেবায়ন স্লিপের নিচে হাত দিয়ে অনুপমার নগ্ন পাছার ত্বকের উপরে তালু চেপে বলে, “তুমি বড্ড মিষ্টি পুচ্চিসোনা।”

অনুপমাঃ দেবায়নের চুলে বিলি কেটে বলে, “সোনা, তুমি মিষ্টি করে তুলেছো তাই মিষ্টি, তুমি যেমন রাখবে, তেমনি থাকবো আমি।”

দেবায়নঃ চুম্বনে আলিঙ্গনে উত্তেজিত করে তোলে প্রেয়সীকে, দুই প্রেমঘন কপোত কপোতী মেতে ওঠে শরীরের খেলায়। নিভৃতে নির্জনে একাকী বন্ধ দরজার পেছনে দেবায়ন আর অনুপমার পার্থিব শরীর ভালোবাসার চরমে এক হয়ে যায়।

দেবায়ন আর অনুপমা রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পরে অনেকক্ষণ দেবশ্রী একাকী বসে চিন্তা করে নিজের ভবিষ্যৎ। ছেলের আর হবু বৌমার খুশি দেখে টেবিলের উপরে রাখা অফার লেটার দেখলো দেবশ্রী। দিল্লী তাহলে আর যাওয়া হচ্ছে না। হৃদয়ের এককোণে ধৃতিমানের জন্য প্রেম জেগে উঠেছিল সেটা হয়তো আর ফলপ্রসু হবে না। ধৃতিমানের আগ বাড়িয়ে দেবায়নের সাথে আলোচনায় দেবশ্রী একটু ক্ষুব্ধ। একবার মনে হয় ধৃতিমানকে ডেকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে ওর দিল্লী আসা হবে না এবং দেবায়নের সাথে ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে কোন কথা হয়নি। ঠিক সেইসময়ে রুমের দরজায় টোকা শুনে অবাক হয়ে যায় দেবশ্রী। রাত অনেক, গায়ে শাল জড়িয়ে দরজা খুলে দেখে যে ধৃতিমান দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ ধৃতিমানের কথাই ভাবছিল দেবশ্রী, চোখের সামনে ধৃতিমানকে দেখতে পেয়ে কথা ভুলে গেল। মনের মধ্যে একটু খুশির ছোঁয়া জেগে ওঠে। ধৃতিমান হেসে জিজ্ঞেস করে যে ভেতরে আসতে পারে না বাইরে দাড় করিয়ে রাখতে চায়। দেবশ্রী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে এতো রাতে আসার কারন আর ধৃতিমানকে রুমের মধ্যে আসতে বলে।

ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে কানে কানে বলে, “তুমি এমন ভাব করছো যেন আমার আসার কারন জানো না। যেতে বললে চলে যাবো, চিন্তা নেই তবে গুটি কয় কথা জিজ্ঞেস করার ছিল তাই তোমাকে এতো রাতে ডিস্টার্ব করতে এলাম।”

দেবশ্রী হেসে বলে, “হ্যাঁ, তুমি তো রাতের ঘুম সকালের ঘুম কাড়তে ওস্তাদ। কি জিজ্ঞেস করতে চাও?”

ধৃতিমান রুমে ঢুকে সোজা বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করে, “একটু কাছে আসবে না।”

দেবশ্রী হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “তুমি না একদম যা তা, আচ্ছা বাবা আসছি।” বলে ধৃতিমানের পাশে গিয়ে বসে।

ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তুমি আমার ওপরে রেগে আছো তাই না।”

দেবশ্রী হাত না ছাড়িয়ে বলে, “তা আছি একটু রেগে। তুমি কেন দেবায়নের সাথে ওই চাকরির ব্যাপারে, দিল্লীর ব্যাপারে এখুনি কথা বলতে গেলে? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? প্রথম দিনে এমন ভাবভঙ্গি দেখালে ওদের মনে সন্দেহ হতো না?”

ধৃতিমানঃ “এই দেখ, আমি অতশত ভাবিনি। এই একটু দেবায়নের সাথে আলাপ করতে ইচ্ছে হলো, ওর মনের অভিপ্রায় জানতে ইচ্ছে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

দেবশ্রীঃ “দেখ ধৃতি, আমি ওদের দিল্লীর কথা জানিয়েছি, চাকরির কথা জানিয়েছি। দেবায়ন আর অনুপমা কোলকাতা ছাড়তে চায় না। আমি হয়তো দিল্লীতে ট্রান্সফার নেব না।”

ধৃতিমানঃ দেবশ্রীর কথা শুনে একটু আহত সুরে বলে, “আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো দিল্লী আসবে। আমি প্ল্যান করে নিয়েছিলাম যে তুমি এই অফিস জয়েন করলে আমি চাকরি বদলে অন্য চাকরি নিয়ে নেব। তুমি ডি.জি.এম আর আমি সামান্য একটা সিনিয়র মারকেটিং ম্যানেজার, এক অফিসে ঠিক ভালো দেখাবে না।”

দেবশ্রী ম্লান হেসে বলে, “পৌরুষত্বে লাগছে তাই না? না গো, দিল্লী আসা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

ধৃতিমানঃ “আমি এক কাজ করতে পারি, আমি চাকরি বদলে কোলকাতা চলে আসি তাহলে কেমন হয়। শ্বশুর বাড়ি বেহালা, তার পাশে একটা ফ্লাট কিনে নেব। মলি ওর ঠাকুমার কাছে থাকতে পারবে।”

দেবশ্রীঃ “ধৃতি, তুমি কি মল্লিকার সাথে এই সব ব্যাপারে আলোচনা করেছো?”
 
ধৃতিমান মাথা নাড়ায়, “না করিনি, তবে মলি আমার কথার খেলাপ করবে না।”

দেবশ্রীঃ “প্লিস ধৃতি, ছেলে মেয়েরা এখন আর ছোটো নয়। একবার মল্লিকার মতামত নিয়ে নিও। একরাতে যে স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছো সেই নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু আমাদের মিলনে যদি আমাদের সন্তানেরা খোলা মনে না নেয় তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না ধৃতি।” ধৃতিমান একটু চিন্তায় পড়ে যায়। দেবশ্রী আবার জিজ্ঞেস করে, “তুমি মল্লিকার সাথে কথা বলবে তো?” ধৃতিমান মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”

দেবশ্রীঃ “তুমি যদি কোলকাতায় চলে আসো তাহলেও আমি ঠিক ভেবে উঠতে পারছি না, কি ভাবে ছেলের সাথে কথা বলবো আমাদের বিষয় নিয়ে।” ধৃতিমান নিজেও জানে না কি ভাবে মেয়ের সামনে এই ব্যাপার প্রস্তুত করবে। ধৃতিমানকে চিন্তিত দেখে দেবশ্রী বলে, “ধৃতি, রাত অনেক হয়েছে মল্লিকা একা রুমে আছে। আমার পাশের রুমে দেবায়ন আর অনুপমা। তুমি চলে যাও, ধৃতি, প্লিস একটু বোঝার চেষ্টা করো।”

ধৃতিমান মৃদু হেসে দেবশ্রীর কপালে একটা গভীর চুম্বন এঁকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। হোটেলের পেছনের দিকে ওর রুম, বড় কাঁচের জানালা দিয়ে দুরে দেরাদুন শহরের আলো ঝলমল করতে দেখা যায়। জানালার পাশে সোফায় বসে অনেকক্ষণ সেই দূর আলো গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে দেবশ্রী, প্রেমের টান দ্বিতীয় বার ওর মনকে দোলা লাগিয়েছে কিন্তু তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত। ভেবেছিল দেবায়ন দিল্লীতে আসতে চাইবে, কিন্তু অনুপমা আর দেবায়নের কথা শুনে মনে হলো সেই আশা দূর অস্ত। দেবশ্রী জানে না, মল্লিকা আদৌ দিল্লী ছেড়ে কোলকাতা আসতে রাজি হবে কি না। ওর হৃদয়ের ভালোবাসার নবীন কিরণ ফুটে ওঠার আগেই যেন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে।

পরের দিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ে মুসৌরি ঘুরতে। মল্লিকাকে সাথে ডেকে নেয় দেবশ্রী। অনুপমা জানায় যে মুসৌরির অদুরে একটা জায়গা আছে অনেক উঁচু নাম নাগ টিব্বা। গাড়ি নিয়ে ওরা নাগ টিব্বার উদ্দশ্যে রওনা হয়ে যায়। নাগ টিব্বা বেশ উঁচু জায়গা, চারপাশে শুধু উঁচু উঁচু পাইন, দেবদারু বন। তার মাঝখান থেকে বেশ কিছু দূর ট্রেকিং করে গেলে পাহাড় চুড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। সময়ের জন্য আর দেবশ্রীর জন্য অনুপমা আর দেবায়ন সেই চুড়ার দিকে আর এগোয় না।

মল্লিকার সাথে অনুপমা বেশ মিশে যায়, গল্পের ছলে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে ওর ব্যাপারে। মল্লিকা জানায় যে ওর মা ওর ছোটো বেলায় গত হয়েছে, মাকে ঠিক ভাবে মনে নেই ওর। সেই শুনে অনুপমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ওর বাবা বাড়িতে বিশেষ থাকেনা বললেই চলে। মাসের দশ দিন বাড়ির বাইরে কাটায়, মল্লিকার দেখাশোনা ওর দিদা করে। ছোটো বেলা থেকে দিদার কাছেই মানুষ। মল্লিকা বলে যে ওর বাবা ওকে বিশেষ কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না। গরমের ছুটির জন্য দিদা মামা বাড়ি, কোলকাতায় চলে গেছে। অনুপমা, মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করে যে কোলকাতা কেমন লাগে। ছোটবেলা থেকে দিল্লীতে বড় হয়েছে মল্লিকা, মাঝে মাঝে ছুটি কাটাতে মামা বাড়ি বেহালা যায়। মল্লিকা জানাল যে কোলকাতা ভালো কিন্তু দিল্লীর মতন ওখানে ওর বন্ধু বান্ধবী নেই, কোলকাতা গেলে খুব একা একা মনে হয় ওর। মল্লিকার কথা শুনে দেবশ্রী ক্ষণিকের জন্য আহত হয়, মনের ভাব চেপে রেখে মল্লিকাকে বলে যে কোনদিন কোলকাতা গেলে যেন ওদের বাড়িতে যায়। মল্লিকা জানিয়ে দেয় যে পুজোর ছুটিতে মামা বাড়ি গেলে নিশ্চয় ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে।

নাগ টিব্বা থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়, মাঝপথে খাওয়া দাওয়া সেরে সোজা মুসৌরি পৌঁছে একবার কেম্পটি ফলস ঘুরে আসে। বিকেলে মেয়েদের শপিং এ যেন নিত্য এককর্ম, অনুপমা একরকম জোর করেই দেবায়নকে নিয়ে যায়। কেনাকাটা সেরে রুমে পৌঁছায় ওরা। সারাদিন দেবশ্রীর সাথে কাটিয়ে মল্লিকা যেন এক নতুনত্বের স্বাদ খুঁজে পায়, এক স্বাধীনতার স্বাদ যেটা ওর বাবার কাছ থেকে পায়নি। হোটেলে ফেরার সময় মাতৃহীন মেয়েটার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে দেবশ্রী, মল্লিকার মনে নেই ওর মা দেখতে কেমন ছিল। হোটেলে ফিরে নিজের রুমে যাওয়ার আগে, দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে পরেরদিন যেন ঘুরতে গেলে সাথে নিয়ে যায়। মাতৃহীন কুসুমকলির ছোঁয়ায় দেবশ্রীর বুক কেঁপে ওঠে, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার অনুপমা আর দেবায়নের দিকে তাকায়। মিষ্টি হেসে মল্লিকার কপালে চুমু খেয়ে জানিয়ে দেয় পরেরদিন ওকে সাথে নিয়ে যাবে।

পরের দিন দেরাদুন ঘুরতে যায়, সেখানে সহস্র ধারা দেখে ফিরে আসে। এই কয়দিন ধৃতিমান হোটেলেই ছিল, মল্লিকা ওদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে। অনুপমার বেশ মনে ধরে যায় মল্লিকাকে, সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ে। দেবায়নকে বলে যে অঙ্কনের জন্য একদম সঠিক মেয়ে, বড় হলে মল্লিকার সাথে অঙ্কনের বিয়ে দেওয়া যেতে পারে। দেবায়ন হেসে জানায় ওর শ্যালক বাবুর চারপাশে অনেক মেয়ে ঘোরাফেরা করে, কখন কাকে কি ভাবে মন দিয়ে ফেলবে এই কাঁচা বয়সে সেটা অঙ্কন নিজেই জানে না। অনুপমা হেসে ফেলে দেবায়নের কথা শুনে, ভাইকে ভালোভাবে চেনে।

বুধবার খুব ভোরবেলা হোটেল থেকে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে। দেবশ্রী আর মল্লিকার সাথে দেখা করেনি, বুঝতে পেরে গেছিল মল্লিকার সাথে হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না, তাই মিছিমিছি একটা বাঁধন বাড়িয়ে কি লাভ। দেবশ্রীর ছেলে, দেবায়ন কোলকাতা ছেড়ে যেতে নারাজ, ধৃতিমানের একমাত্র কন্যে দিল্লী ছেড়ে আসতে নারাজ। এইমত অবস্থায় এই দুই তৃষ্ণার্ত নর নারীর মিলন দূর অস্ত। গাড়িতে উঠে দেবশ্রী অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল, নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিল, হৃদয়কে বেঁধে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। চোখের কোণে একচিলতে অশ্রু টলমল করে আসে, বারেবারে মল্লিকার হাসি মুখ মনে পড়ে যায়। অনুপমা দেবশ্রীকে ওই টলমল অশ্রুর কারন জিজ্ঞেস করাতে, হেসে জানায় যে কিছু পুরানো কথা মনে পড়ে গেছে তাই এই অভাগির চোখে একটু জল এসে গেছিল। অনুপমা বেশ বুঝতে পারে তিনদিনে মল্লিকা ওর মামনির হৃদয় জয় করে নিয়েছে তার শিশুশুলভ বন্ধনে। কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও আর করে না অনুপমা, অনুপমা বুঝে যায় ওর মামনির লুক্কায়িত অশ্রুর আসল কারন। চিন্তায় মগ্ন অনুপমা, সুরাহা খুঁজে বেড়ায় চারপাশে, ওর মামনির হৃদয়ের কান্নার আওয়াজ ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মুসৌরি থেকে দিল্লী পর্যন্ত, বারো ঘন্টা গাড়িতে বিশেষ কারুর মুখে কথা ছিল না। দেবায়ন রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত ছিল, পেছনে বসে দুই রমণীর মনের আওয়াজ ওর কানে পৌঁছয় না।

সন্ধ্যের কিছু পরে দিল্লী পৌঁছে যায় ওরা। মুসৌরি থেকে দিল্লী পর্যন্ত সবাই চুপ করেছিল। গাড়ি দিল্লী ঢোকার পরে সবার মুখে কথা ফোটে। অনুপমা আর দেবায়ন এই ভ্রমণের গল্পে মেতে ওঠে। দেবশ্রী বসে ছেলে মেয়েদের কথা শোনে। গাড়ি আউটার রিং রোড দিয়ে যাওয়ার সময়ে, দেবশ্রী একবার সেই হোটেলের দিকে তাকায় যেখানে ও ছিল। গাড়ি এয়ারপোর্ট ঢোকার আগে একবার গুরগাঁওয়ের দিকে তাকায় যেখানে ওদের হেডঅফিস। অনুপমা বিষণ্ণতার কারন জিজ্ঞেস করলে দেবশ্রী এড়িয়ে যায় ওর উত্তর, হাসি মুখে জানিয়ে দেয় ওর মন খারাপ নয়। চোখের সামনে ছেলে আর হবু বউমা নিয়ে ঘুরতে এসেছে ওর মতন খুশি আর কে।

প্লেনে দেবায়নের সিট অন্য দিকে পড়ে। দেবশ্রী আর অনুপমা পাশাপাশি বসে। দেবায়ন চেয়েছিল অনুপমার পাশে বসতে কিন্তু অনুপমা বুঝিয়ে বলে যে ও ওর মামনির পাশে বসতে চায়। প্লেনে ওঠার আগেই অনুপমা বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল ওদের আসার কথা। পারমিতা জানিয়ে দিয়েছিল যে গাড়ি পৌঁছে যাবে এয়ারপোর্টে।

অনুপমা দেবশ্রীকে জিজ্ঞেস করে, “মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো কিছু মনে করবে না।”

দেবশ্রীঃ “কি জিজ্ঞেস করবি?”

অনুপমাঃ “মামনি, মুসৌরি থেকে ফেরার পথে তুমি অত চুপচাপ ছিলে কেন?”

দেবশ্রী ভাবতে পারেনি অনুপমা এমন একটা প্রশ্ন করবে। কিছুক্ষণ অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে অনুপমার মনের কথা। অনুপমার চোখ জোড়া বলে দেয় অনুপমা আর ছোটো মেয়ে নয়, চোখ কান খোলা রেখে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। দেবশ্রীর বুক কেঁপে ওঠে অনুপমার চোখের প্রশ্ন দেখে, কথা ঘুরিয়ে বলে, “না মানে এমনি।”

অনুপমা বেশ বুঝতে পারে যে ওর মামনি কথা লুকিয়ে ফেলেছে, তাও মামনির মনের কথা জানার জন্য জিজ্ঞেস করে, “মামনি, তুমি ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে মল্লিকাদের বাড়ি গিয়েছিলে, তাই না?”

ধরা পড়ে যায় দেবশ্রী, মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আমার অফিস কলিগ, একসাথে টুরে ছিলাম, তার উপরে এবার বাঙালি, তাই ডিনারে ডেকে ছিল মিস্টার দেবনাথ।”

অনুপমা দেবশ্রীর হাত ধরে বলে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথকে তোমার ভালো লাগে?” সত্যি কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে দেবশ্রী। অনুপমা দেবশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথের সাথে মুসৌরিতে দেখা হয়ে যাওয়া। সেটা নিশ্চয় কাকতালিয় নয় তাই না?” কি উত্তর দেবে দেবশ্রী, প্লেনের এ.সির ঠাণ্ডায় হাত দুটি হিম শীতল হয়ে যায়। অনুপমা যদি দেবায়নকে সব বলে দেয়, তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার। ওর মা কারুর প্রেমে পড়েছে আর সেই লোক মিস্টার ধৃতিমান দেবনাথ, যে দিল্লী থাকে। অনুপমা আস্বস্ত কণ্ঠে বলে, “মামনি এতো ভাবছো কেন? ভাবছো আমি দেবায়নকে বলে দেবো। না মামনি, তুমি যতক্ষণ না চাইবে, দেবায়ন কিছু জানতে পারবে না। তুমি সত্যি বল, মিস্টার ধৃতিমানকে তোমার ভালো লেগেছে, তাই না। সেই জন্য মুসৌরিতে মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন মিস্টার দেবনাথ। যাতে আমাদের সবার সাথে দেখা হয়, দুই পরিবার যাতে পরস্পরকে চিনতে পারে জানতে পারে।” দেবশ্রী নির্বাক, সারা চেহারা রক্তশূন্য হয়ে যায়। অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মামনি তুমি কি চাও।”

এর উত্তর ঠিক জানে না দেবশ্রী, কম্পিত কণ্ঠে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোকে কে বলেছে আমি মিস্টার দেবনাথকে...”

অনুপমাঃ “মামনি, তোমার চোখ বলেছিল সব কথা ওই ধনোলটি গিয়ে। মামনি, আমাকে একটু বিশ্বাস করে নিজের মনের কথা বলবে না?”

দেবশ্রী মনে বল জুগিয়ে বলে, “জানিনা ঠিক আমি কি চাই। তবে তোদের মুখে হাসি ফুটে উঠলেই আমার সব থেকে বড় পাওনা।”

অনুপমা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, “দিল্লী যেতে পারছো না বলে তোমার দুঃখ হচ্ছে তাই না? আচ্ছা মামনি, এই এক বছর পরে দেবায়নের নিজের কোম্পানি হয়ে যাবে, আমরা আমাদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব। তুমি কি করবে?”

দেবশ্রী ম্লান হেসে বলে, “আমি চাকরি করে যাবো।”
 
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “না মামনি, আমাদের কাজ শুরু হলে তোমাকে চাকরি করতে দেবো না। তোমার সেবার জন্য সবসময়ে লোক থাকবে আর যাতে তোমাকে কষ্ট না করতে হয়। তোমার বাড়ির সামনে একটা বড় গাড়ি, একটা ড্রাইভার দাঁড়িয়ে থাকবে সব সময়ে।”

দেবশ্রী হেসে ফেলে, “রাম না হতেই রামায়ন গাইছিস? না রে। একটা ফুটফুটে নাতনী অথবা নাতি হবে, তাকে নিয়ে থাকবো আমি। তোরা যাবি অফিসে আর আমি থাকবো আমার কুট্টি নাতি নাতনী নিয়ে।”

অনুপমা হেসে ফেলে দেবশ্রী কথা শুনে, “মামনি তুমি কথা ঘুরিয়ে দিলে আবার। তুমি যেতে পারছো না দিল্লী তাই দুঃখ হচ্ছে তাই না। কিন্তু মিস্টার দেবনাথ কোলকাতা চলে আসতে পারে তো? ওনার শ্বশুর বাড়ি তো বেহালাতে? উনি এখানে কোন কাজ খুঁজে নিতে পারেন।”

দেবশ্রীঃ “একটা সমস্যা আছে রে মা। দেবু যেমন কোলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে চায় না তেমনি মল্লিকা দিল্লী ছেড়ে আসতে চায় না। তারপরে মিস্টার দেবনাথের সাথে মোটে কয়েক দিনের আলাপ, আমি এখন পর্যন্ত গভীর ভাবে কিছুই চিন্তা ভাবনা করে দেখিনি। কি করে করবো বল, এই যে তুই আমার সাথে এতো গল্প করলি, এতো মনের কথা বললি, অন্য কেউ কি আমার কথা বুঝতো রে। তোদের ফেলে কোথাও গিয়ে যে শান্তি পাবো না।”

অনুপমাঃ “মামনি আমি যদি দেবায়নকে বুঝিয়ে বলি।”

দেবশ্রীঃ “তুই কি বলতে চাস?”

অনুপমাঃ “মামনি, মানে আমাদের কলেজের শেষে আমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাব। তুমি আরো একা হয়ে যাবে তখন। আমি যদি দেবায়নকে বুঝিয়ে বলি, তাহলে কি তুমি বিয়ে করবে মিস্টার দেবনাথকে?”

দেবশ্রী অথই জলে পড়ে যায় অনুপমার কথা শুনে, কোনদিন ভাবতে পারেনি এইটুকু মেয়ে এতো বড় কথা বলবে। হাঁ করে অনুপমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উত্তর দেয়, “না রে। আমার সূর্য পশ্চিমে ঢলে গেছে, তোদের সূর্য উদিয়মান। ওই একটা সুন্দর গান আছে না, তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা। মিস্টার দেবনাথ আমার জীবনের পথের মাঝে এক পথিক মাত্র, ক্ষণিকের অতিথি, পথ চলতে একসময়ে হটাত দেখা হয়ে গেল, কিছু দূর একসাথে হাঁটলাম। তারপরে তার পথ অন্যদিকে বাঁক নেয় আমার পথ অন্যদিকে। আর আমাকে প্রতিজ্ঞা কর দেবুকে এই সব ব্যাপারে কিছু জানাবি না কোনদিন।”

অনুপমার চোখ ভিজে আসে ওর মামনির চোখের দিকে তাকিয়ে, একবার মনে হয় জড়িয়ে ধরে বলে মামনি তুমি চলে যাও, আমি দেবায়নকে সব বুঝিয়ে বলে দেবো। কিন্তু ওর মামনি নিজের হৃদয়কে বুঝিয়ে শান্ত করে নিয়েছে, মিস্টার দেবনাথ ওর জন্য নয়, ওর জীবনে একজন এসেছিল সেই শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না।

অনুপমা ওর মামনির হাত বুকের কাছে নিয়ে বলে, “মামনি আমি প্রতিজ্ঞা করছি, কেউ জানবে না এই কথা। তবে মামনি আমাকে একটা কথা দিতে হবে, যদি মিস্টার দেবনাথ কোলকাতা চলে আসেন তাহলে কিন্তু তোমাদের একসাথে করার দায়িত্ব আমার।”

দেবশ্রী চেয়ে থাকে অনুপমার মুখের দিকে, এক কন্যের অপূর্ণ ইচ্ছে অনুপমা ভরিয়ে দেয়। দেবশ্রী অনুপমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে, “তুই আমার সোনা মেয়ে, এইরকম যেন থাকিস। সেটা পরের কথা, পরে ভেবে দেখা যাবে।”

কোলকাতা নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই পারমিতার দেখা। অনুপমা অবাক হয়ে যায় মাকে দেখে, ভেবেছিল শুধুমাত্র গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, ভাবতে পারেনি যে ওর মা ওকে নিতে আসবে। অনুপমা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর মাকে, “কি ব্যাপার তুমি চলে এলে?”

এয়ারপোর্টে পারমিতাকে দেখে দেবশ্রী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাপ রে তুমি নিজে চলে এলে আমাদের নিতে।”

পারমিতাঃ “কেন, তুমি ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারো আর আমি এই এয়ারপোর্ট থেকে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি না?”

দেবশ্রী হেসে বলে, “না না তা পারো। তুমি নাকি আমাদের বাড়িতে এসেছিলে? কি বলতো, প্রথম বার এলে আর আমি ছিলাম না। এবারে কিন্তু একদিন আসতেই হবে।”

দেবশ্রীর কথা শুনে অনুপমা আর দেবায়ন মুখ টিপে হেসে ফেলে। ওদের হাসি দেখে পারমিতার কান লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কোনোরকমে লজ্জা ঢেকে বলে, “তুমি আগে আমাদের বাড়িতে আসবে তারপরে আমি যাবো।”

দেবশ্রীঃ “ঠিক আছে, তা নাহয় গেলাম। কিন্তু তোমার জন্য যেগুলো এনেছি তাহলে সেগুলো নিতে কে আসবে?”

পারমিতা, “উফফ আর পারি না। ঠিক আছে পরের রবিবার আসবো।” অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই বেশ ভালো ঘুরেছিস মনে হচ্ছে? এই কয়দিনে একবার ফোন করিস নি, মামনিকে কাছে পেয়ে মাকে ভুলে গেলি।”
অনুপমা পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “না মা, সেটা নয়।”

অনুপমার গাল টিপে পারমিতা বলে, “বুঝি রে, মেয়ে যে বিয়ের আগেই শ্বাশুড়ির হাতে চলে গেছে।”

দেবশ্রী হেসে বলে, “না না, তোমার মেয়ে অনেক ভালো। কোন জ্বালাতন করেনি, একটু শুধু বড় হয়ে গেছে, মায়েদের মনের কথা একটু বেশি বুঝতে শিখে গেছে।”

পারমিতা অবাক হয়ে অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সত্যি মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। দেবায়ন আর দেবশ্রীকে লেকটাউনে পৌঁছে দেয়। নামার আগে দেবশ্রী পারমিতাকে বলে যে আগামী রবিবার সপরিবারে নিমন্ত্রন রইল।

!!!!!!!!!! অষ্টাদশ পর্বের সমাপ্তি !!!!!!!!!!!
 
উনবিংশ পর্ব।

মুসৌরি ভ্রমণের পরের রবিবার, সকাল থেকে দেবশ্রী খুব ব্যস্ত। কাজের লোক দিয়ে সব ঘর আগের দিন পরিষ্কার করে রেখেছিল। দেবায়ন নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার করে। দেবশ্রীর চিন্তা, মিস্টার সেন আর পারমিতা অনেক বড়োলোক, ওদের এই ছোটো বাড়িতে কি ভাবে মানিয়ে নেবে। গ্রীষ্মকাল বাড়িতে এ.সি লাগানোর মতন শখ কোনদিন হয়নি ওর। বারেবারে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মিস্টার সেনের গরম লাগলে কি করা যাবে? দেবায়ন আস্বস্ত করে জানিয়ে দেয় ওইসব অবান্তর ভাবনা চিন্তা দূর করে দিতে। দেবায়ন মায়ের সাথে কাজে সাহায্য করে। দেবায়ন বারবার বলে যে মিস্টার সেন অথবা পারমিতা, ওদের বাড়িতে এসে কোন রকম অসুবিধেতে পড়বে না। দেবশ্রীর মন তাও মানে না। দুপুরের জন্য মাটন বিরিয়ানি সেই সাথে কষা মাংস। রাধাবল্লভি, ছোলার ডাল, ইত্যাদি বেশ কয়েক প্রকার ব্যাঞ্জন তৈরি করা হয়ে গেছে।

দুপুর বেলায় অনুপমা বাড়ির সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যায় দেবায়নের বাড়িতে। দুই পরিবারের মিলনে বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। গরমে ঘেমে যান মিস্টার সেন, সেই দেখে দেবশ্রী একটু ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ে। পারমিতা হেসে জানিয়ে দেয় একদিন ঘামিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। দুপুরে খাবার সময়ে দেবশ্রী, মিস্টার সেনকে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। অনুপমা আর দেবায়ন প্রমাদ গোনে, হয়তো দেবশ্রী মিস্টার সেনকে সব কিছু বলে দেবে। দেবশ্রী আর মিস্টার সেন একসাথে দেবায়নের দিকে তাকায়, দুইজনের চোখে ভিন্ন প্রশ্ন। দেবায়ন হাল্কা মাথা দুলিয়ে, 'না' বলে। উত্তর একটা, কিন্তু ভিন্ন প্রশ্নের ভিন্ন অর্থ বহন করে সেই মাথা নাড়া। মিস্টার সেন দেবশ্রীকে বলেন, এই তথ্য প্রযুক্তির সময়ে সব ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার শেখা একটু জরুরি। কোন শিক্ষা ফেলা যাবে না, ভবিষ্যতে কোন না কোন ভাবে কাজে লেগে যাবে। দায়িত্বজ্ঞান পূর্ণ অভিভাবকদের মতন মিস্টার সেন আর দেবশ্রী, দেবায়ন আর অনুপমাকে কম্পিউটার শেখার জন্য অনুমতি দেয়। অনুপমা খাওয়ার পরে দেবশ্রীকে অনুরোধ করে যে ওদের ফার্মের প্লানের কথা এখুনি যেন ওর বাবাকে না জানায়। বুদ্ধিমতী দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ওদের আই.টি ফার্মের কথা মিস্টার সেনের সাথে আলোচনা করবে।

গ্রীষ্মের ছুটির মাঝে একদিন দেবায়ন আর অনুপমা, পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা কম্পিউটার সংস্থায় যায় খোঁজ খবর নিতে। এক বছরের ফাস্ট ট্রাক কোর্স, তাড়াতাড়ি সব শেখানোর জন্য একটু পয়সা বেশি লাগবে সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে সময় একটু বেশি দিতে হবে। দুটো সেমেস্টারে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার কথা শুনে দেবায়ন একটু ইতস্তত করে, মাকে ফোনে জানায় টাকার কথা। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যত টাকা লাগে তার জন্য তৈরি। দেবায়ন আর অনুপমা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে। শনিবার আর রবিবার সারাদিন ক্লাস, সেই সাথে সপ্তাহে দুই দিন, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার বিকেলে দুই ঘন্টার ক্লাস। একদিকে কলেজের ফাইনাল ইয়ার, সেইসাথে কম্পিউটার ক্লাস। দেবায়ন আর অনুপমা বুঝতে পারে সামনের দিনগুলো ওদের নিঃশ্বাস ফেলার মতন সময় থাকবে না। কম্পিউটার সংস্থা থেকে বেরিয়ে দেবায়ন আর অনুপমা ফ্লুরিস কাফেতে বসে।

অনুপমা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ গো, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, এইসব আমরা পারবো তো? মানে কলেজ আর কম্পিউটার একসাথে।”

এক প্রশ্ন দেবায়নের মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু অনুপমাকে আস্বস্ত করে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পারবো। তুমি কলেজের পড়াশুনাতে মন দাও আর আমি কম্পিউটার ক্লাসে।”

অনুপমাঃ “মানে, তুমি কি কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে দেবে নাকি? গ্রাজুয়েশান না করলে মামনি কিন্তু তোমাকে আস্ত রাখবে না।”

দেবায়ন হেসে বলে, “না রে পাগলি মেয়ে। আমি বলছিলাম, তুমি আমাকে কলেজের নোটস দিয়ে হেল্প করবে আর আমি তোমাকে কম্পিউটার শিখিয়ে দেবো। পড়াশুনা বন্টন করে নেব আমাদের মাঝে।”

অনুপমাঃ “দেখো পুচ্চুসোনা, আমার কম্পিউটার না শিখলেও চলবে। আমি তো শুধু তোমার সাথে কাটাবো বলে জয়েন করেছি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, এই কম্পিউটার কিন্তু পরে করলেও চলবে। গ্রাজুয়েশানটা একটু ঠিক করে করে নাও।”

দেবায়নঃ “উফফফ বাবা, সেই জন্য বলছি, তুমি ফিসিক্স পড়ো আর বাকি আমার ওপরে ছেড়ে দাও।”

অনুপমাঃ “তোমার মাথার মধ্যে কি ঘুরছে একটু পরিষ্কার করে আমাকে জানাবে?”

দেবায়ন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “তোমাকে কতবার এক কথা বলতে হয় একটু বলতো? আমরা কলেজের পরে একটা আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলবো ব্যাস আবার কি।”

অনুপমা দেবায়নের হাত ধরে মিনতির সুরে বলে, “সোনা, বড্ড ভয় করছে।”

দেবায়নঃ “কম্পিউটার শিখছি বলে ভয় করছে? কেমন মেয়ে তুমি?”

অনুপমাঃ “না সোনা, সেটা নিয়ে ভয় নয়। জানিনা, তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বড় একটা ঝড় আসবে।”

দেবায়ন অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে প্রেয়সীর চোখ দুটি ছলছল করছে, কাঁধের উপরে হাত রেখে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে, “কি হলো তোমার?”

অনুপমাঃ “আচ্ছা পুচ্চু, এই কম্পিউটার শিখে তুমি কোন চাকরি করতে পারো না?”

দেবায়ন অবাক হয়ে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত এই প্রশ্ন কেন? নিজের বাবাকে অবিশ্বাস করছো তুমি?”

অনুপমার মনে ঠিক সেই কথাই জেগেছিল, প্রানের মানুষ যে অলীক স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে গেছে সেটা দেখে একটু আহত হলেও সেটা লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলে, “না মানে কিছু না। মানে আমরা পারবো তো এই সব করতে?” কথা ঘুরিয়ে দেয় বুদ্ধিমতী অনুপমা, “আগামী সপ্তাহে কলেজ শুরু। কলেজে এবারে অনেক জোড়া পাখী দেখবো। পরাশর জারিনা নতুন প্রেমে বিভোর, ওইদিকে আমাদের সেই পার্টিতে সঙ্গীতা আর মিচকে প্রবাল জুটি বেঁধে নিল। আচ্ছা একটা কথা বল, পরাশর আর জারিনা, ওদের সম্পর্কের কি হবে? না মানে আমার তো মনে হয় না দুইজনের বাড়ির কেউ মেনে নেবে। দুইটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে মেয়ের সম্পর্ক। সমাজের চোখে খুব বড় ব্যাপার। ওদের পরিবার ওদের মেনে নেবে কি?”

দেবায়ন হেসে বলে, “চেষ্টা করতে দোষ কি? এই দেখ না, মানুষ আগে পাখী দেখে শুধু ওড়ার স্বপ্ন দেখতো। কেউ যদি এগিয়ে না এসে ডানা না লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো তাহলে কি আজ প্লেন বলে কিছু হতো? কাউকে তো পথ দেখাতে হয়, প্রেম কি আর ধর্ম, জাত পাত মানে? মানলে কি আর তুমি আর আমি এই জায়গায় বসে কফি খেতাম।” বলেই দেবায়ন অনুপমার গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।

অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “ধুত, তুমি না একদম শয়তান। এতো লোকের মাঝে একি করলে? এটা কি লন্ডন নাকি?”

দেবায়ন হেসে বলে, “কাউকে একটা শুরু করতে হয়।”
 
অনুপমাঃ “এটা ভারতবর্ষ পুচ্চু। আরও এক হাজার বছর ধরে বয়ে যাবে এই গঙ্গার জল, কিন্তু এখানের মানুষের মনের বিচারধারা বদলাবে না পুচ্চু। এরা শিবলিঙ্গ পুজ করবে, ফুল বেল পাতা চড়াবে, দুধ মধু ঢালবে। কিন্তু সেই লিঙ্গ আর যোনির আসল অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করে পড়ে থাকবে, এই হলো আমাদের দেশ। এরা খাজুরাহ, কোনারক দেখতে যাবে কিন্তু যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে লজ্জা পাবে, এই হলো আমাদের দেশ। এরা নারীহত্যা করতে পিছপা হবে না, নারীদের উপরে অত্যাচার করতে পিছপা হবে না, কিন্তু মা কালী, মা দুর্গার পুজোতে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দেবে, এই হলো আমাদের দেশ। এরা ভালোবাসার সন্মান দিতে জানে না কিন্তু রাধা গোবিন্দর পুজোতে নেচে কুঁদে বেড়াবে, এই হলো আমাদের দেশ।”

দেবায়ন হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত দার্শনিক হয়ে উঠলে? ছাড়ো এসব কথা, মিমি সুন্দরীর কি খবর?”

অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “ধুর বাবা, পাশে বৌ বসে তাও শ্বাশুড়ির দিকে নজর। একে নিয়ে আর পারা গেল না।”

দেবায়ন অনুপমা গাল টিপে বলে, “আচ্ছা না হয় ওর কথা না জিজ্ঞেস করলাম, একবার আমার পায়েল সুন্দরীর কথা শুনি।”

অনুপমাঃ “পায়েল ভালো আছে, প্রত্যেকদিন কথা হয় ফোনে। ওর বাবা বাড়ি ফিরে এসেছে তাই বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া এক প্রকার বন্ধ। কলেজ খুললে আবার ওর দেখা পাবে।”

দেবায়ন অনুপমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায়। সেখানে পারমিতার সাথে দেখা। আজকাল পারমিতা মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দেবায়নকে বাড়িতে দেখে পারমিতা বেশ খুশি, অনেকদিন পরে দেবায়নের সাথে দেখা। অনুপমা, মায়ের চেহারার লালিমা দেখে বুঝে যায় মায়ের মনের অভিব্যক্তি, মনে মনে হেসে ফেলে। পারমিতা দেবায়নকে বলে আজকাল আর ওর দিকে নজর দিচ্ছে না। দেবায়ন হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে নিশ্চয় দেবে, বর্তমানে দেবায়নের মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক কাজের ভার। পারমিতা হাসে, অনুপমার গাল টিপে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নকে কেড়ে নেবে না। অনুপমা, মাকে জড়িয়ে ধরে জানিয়ে দেয় সেই বিশ্বাসটুকু দেবায়ন আর মায়ের উপরে আছে।

কলেজ শুরু হয়ে যায় এক সপ্তাহের মধ্যে। সেই সাথে শুরু হয়ে যায় কম্পিউটার ক্লাস। কম্পিউটার ক্লাসে বেশি ছাত্র ছাত্রী নেই, বিকেলে যাদের সাথে ক্লাস করে অনুপমা আর দেবায়ন, তারা সকলেই কর্মরত মানুষ, কাজের তাগিদায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি শিখতে এসেছে। ক্লাসের ম্যাডাম, মিস সুপর্ণা চ্যাটারজি বেশ ভালো মহিলা, কম ছাত্র ছাত্রী থাকায় তার পড়ানোর বেশ সুবিধা। কম বয়সি শিক্ষিকা দেখে দেবায়নের অতি পুরাতন স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই সুপর্ণাকে অবান্তর প্রশ্নে ব্যতিব্যাস্ত করে তোলে, আর অনুপমা পাশে বসে বকে মেরে চুপ করিয়ে রাখে। ম্যাডামের পেছনে লাগতে পিছপা হয় না দেবায়ন।

প্রতিদিন সকালে পায়েল, অনুপমার বাড়িতে আসে সালোয়ার পরে, অনুপমার বাড়িতে ড্রেস বদলে, স্কার্ট টপ অথবা ছোটো জিন্স ফ্রিল শার্ট পরে দুই বান্ধবি গাড়ি নিয়ে কলেজে বেরিয়ে পড়ে। কলেজ খোলার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে পায়েলের চেহারায় এক খুশির ছোঁয়া ভেসে ওঠে। অনুপমা সেই হাসি সেই আনন্দের আলোক ছটা দেখে বুঝে যায় পায়েলের জীবনে এক নতুন ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। কলেজের পথে একদিন পায়েল জানায় যে একটা ছেলের সাথে ওর দেখা হয়েছে। অনুপমা সেই ছেলেটার সম্বন্ধে জানতে চাইলে পায়েল বলে যে ওর পিসতুতো দাদার এক বন্ধু, ডালহৌসিতে একটা অফিসে চাকরি করে। প্রেম প্রীতি পর্যন্ত কথা এখন যায়নি তবে ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে পায়েলের। অনুপমা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তাহলে অঙ্কনের সাথে পায়েলের কোন সম্পর্ক নেই। অনুপমা জানতে চায় ছেলেটার সাথে কবে দেখা করাবে। পায়েল মিচকি হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ছেলেটার সাথে দেখা করাবে। ছেলেটার নাম জানতে চাইলে জানায় যে অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, বাড়ি নৈহাটি।

অনুপমা কলেজে এসে দেবায়নকে পায়েলের কথা জানায়। দেবায়ন পায়েলকে উত্যক্ত করার জন্য বলে শেষ পর্যন্ত কি হাত ছাড়া হয়ে গেল? পায়েলকে সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দেয় মজা করে। সঙ্গম সম্ভোগের সময়ে কামাবেগে পায়েল বলেছিল যে দেবায়নের জন্য ওর শরীর অবারিত দ্বার। পায়েলের গালের রঙ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। অনুপমা, পায়েলকে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে যে কথা না রাখলে কিন্তু দেবায়ন একদিন ওকে ধরে নিয়ে জোর করে সঙ্গম করবে। অনুপমা কথায় পায়েল শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়। অনুপমা হেসে জানিয়ে দেয় যে ওরা মজা করতে চাইছিল।

গরমের ছুটির শুরুতে, দেবায়নের বাড়ির একরাতের পার্টি সব বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে এক নতুন যোগসুত্র স্থাপন করে দেয়। সঙ্গীতা, ছোটো স্কার্ট, হাতা বিহীন টপ ছেড়ে সালোয়ার কামিজ অথবা লম্বা স্কার্ট পরতে শুরু করে দিয়েছে। প্রবালের চোখ দেখলে বোঝা যায় দুই বছর আগেকার সেই প্রবাল এখন সঙ্গীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রেয়া, সঙ্গীতা, পায়েল আর অনুপমার বন্ধুত্ব আগে থেকেই বেশ ঘন ছিল, সেই এক রাতের পরে ওদের বন্ধুত্ব যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে। প্রবাল আগে কারুর সাথে বিশেষ কথা বলতো না, ওর মুখে কথা ফুটেছে। ধিমান আর পরাশর আগে দেবায়নকে একটু অন্য নজরে দেখতো কারন ওদের নজর অনুপমার দিকে ছিল, কিন্তু নিজেদের বান্ধবী পেয়ে যাওয়ার পরে আর সেই রাতের পার্টির পরে সবার মনের দ্বার যেন খুলে গেছে। ওদের ক্লাস একটু ছন্নছাড়া ছিল আগে, গ্রীষ্মের ছুটির পরে সবার রঙ সবার চালচলন পালটে যায়, দেখে মনে হয় যেন এক হাতের পাঁচ আঙুল সবাই, একটা আঙ্গুলে ব্যাথা পেলে সম্পূর্ণ হাত যেন ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে।

একদিন লাঞ্চের পরে কোন ক্লাস ছিল না, সব বন্ধু বান্ধবীরা ফ্লুরিস কাফেতে চলে আসে আড্ডা মারতে। শ্রেয়া একবার অনুরোধ করেছিল রূপককে ডাকার জন্য, সবাই চেঁচিয়ে ওঠে যে বাইরের কাউকে ডাকা যাবে না। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া আর ধিমান চুপচাপ বসে পড়ে। গল্প চলাকালীন পায়েল কিছু পরে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। অনুপমা আর সবাই কারন জিজ্ঞেস করাতে পায়েল জানায় যে তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে ওর বাবা বকা দেবেন। পায়েলের বাবার সম্বন্ধে শ্রেয়া আর অনুপমা ভালোভাবে জানে। পায়েল চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, অনুপমা একবার মাথা উঠিয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। সাধারণত অনুপমা সাথে থাকলে পায়েল ওর সাথেই বাড়ি ফেরে, কারন পায়েলকে ওর বাড়িতে নেমে জামা কাপড় বদলে বাড়ি ফিরতে হয়। পায়েলের আচরনে অনুপমার মনে একটু সন্দেহ হয়, অনুপমা জোর করে জিজ্ঞেস করে পায়েলের বাড়ি ফেরার আসল কারন। এমন সময়ে পায়েলের মোবাইলে ফোন আসে। সবাই বুঝে যায় যে পায়েল কারুর সাথে দেখা করতে চলেছে। সব বান্ধবীরা পায়েলকে চেপে ধরে ওর মনের মানুষের কথা জিজ্ঞেস করে। চাপাচাপির ফলে শেষ পর্যন্ত পায়েল, সেই ব্যাক্তিকে জানিয়ে দেয় যে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে তাই সেদিন আর দেখা করতে পারবে না। গল্পের মোড় ঘুরে যায় সবার প্রেম কাহিনীর দিকে। অনুপমা পায়েলকে তার প্রেম কাহিনী শোনানোর জন্য চেপে ধরে।

পায়েল মুখে লাজুক হাসি নিয়ে বলতে শুরু করে, “তোরা যখন মুসৌরি বেড়াতে গেলি তার মাঝে একদিন আমি পিসির বাড়ি, নৈহাটি বেড়াতে গেছিলাম।”

সঙ্গে সঙ্গে সবার প্রশ্ন ছেঁকে ধরে অনুপমা আর দেবায়নকে, “এই কি রে তোরা কবে মুসৌরি বেড়াতে গেছিলি? একা একা, তোদের সাহস কম নয় তো?”

দেবায়ন আর অনুপমা ফিকফিক করে হেসে ফেলে। পায়েল উত্তর দেয় অনুপমার হয়ে, “ওরে ছাগল, দেবায়নের মায়ের সাথে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। বিয়ের আগেই মেয়ে শ্বাশুড়িকে হাত করে নিয়েছে। দেবায়নের মা, বউমা বলতে একেবারে অজ্ঞান, পারলে কাল ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আর ওইদিকে দেবায়নকে আর বলিস না, কাকু কাকিমা পারলে দেবায়নকে মাথায় করে রাখে। বর্তমানে দুই বাড়ির এমন সম্পর্ক, বুঝলি কিছু।”

অনুপমা একপ্রকার দেবায়নের কোলে শুয়ে ছিল, সেখান থেকে উঠে পায়েলের মাথায় চাঁটি মেরে জিজ্ঞেস করে, “ধুর শালা, তুই তোর গল্প বল না শুনি।”

পায়েলঃ “আমার গল্প বিশেষ কিছু না। পিসির বাড়ি নৈহাটি গেলাম সেখানে পিসতুতো দাদার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। নাম অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, ডালহৌসিতে একটা এক্সপোর্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে তবে এই মাত্র কথা। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কয়েকবার, ভালো ছেলে, তবে প্রপোস করেনি এখন। যেদিন প্রোপোস করবে তারপরের দিন তোদের জানিয়ে দেবো।”

পায়েলের মুখে নাম শুনে সঙ্গীতা একটু ভাবনায় পড়ে যায়, পায়েলকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা নৈহাটির কোথায় থাকে। পায়েল জানায়, যে নৈহাটির মীরা বাগানে ওদের বাড়ি। পায়েল কারন জিজ্ঞেস করে সঙ্গীতাকে।

সঙ্গীতা জানায়, “আমার মামা বাড়ি মীরা বাগানে, আমি ছেলেটাকে ভালোভাবে না হলেও একটু চিনি। ছেলেটা একটু বকাটে আছে, তুই শুধু একটু সাবধানে থাকিস। পুজোতে মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে অনেক বার দেখেছি প্যান্ডেলে বসে শালা ঝাড়ি মারছে। প্রবলেম শালা ঝাড়ি মারা নিয়ে নয়, তবে ওর আচার ব্যবহার আমার ঠিক মনে হয়নি। কেমন ইতর ছোটলোকের নজর ওর। ও ডালহৌসিতে চাকরি করে কি না জানিনা।”

পায়েলের সাথে দিনে চার পাঁচের আলাপ, “কই না তো আমার সেইরকম কিছু মনে হলো না ওকে দেখে? পিসতুতো দাদার ভালো বন্ধু, দেখতে শুনতে ভালো, বেশ পয়সা ওয়ালা বাড়ির ছেলে। ওদের নাকি বেশ বড় ব্যাবসা আছে স্টেসানের কাছে।”

সঙ্গীতা ম্লান হেসে বলে, “জানিনা ভাই, তবে একটু বাজিয়ে নিস। ফাটা ঢোল কিনে ফেললে কিন্তু সারা জীবন সেটা কাঁধে বইতে হবে।”

সঙ্গীতার কথা শুনে সবাই পায়েলের দিকে তাকিয়ে সাবধান করে দেয়। পায়েল জানিয়ে দেয় যে একবার ভালো ভাবে জেনে বুঝে নেবে তারপরে না হয় ভালোবাসা প্রেমের কথা চিন্তা করে দেখবে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top