ধৃতিমানের গলার স্বরে বেদনা। বহু মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছে দেবশ্রী, কার কণ্ঠস্বর কি বলতে চাইছে সেটা ভালো ভাবেই জানে। ধৃতিমানের কণ্ঠে পাপবোধ ছলকে পড়ছে, কারন জানতে উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবশ্রী। তাড়াতাড়ি একটা ম্যাক্সি ছেড়ে, জিন্স আর শার্ট পরে হোটেলের বারে ঢোকে। রাত অনেক হয়ে গেছে, হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে এক অজানা আশঙ্কায়। বারের এক কোনায় দুই মহিলার সাথে একজন লোক বসে। অন্য কোনায় একা ধৃতিমান এক গ্লাস স্কচ নিয়ে চুপচাপ বসে। দেবশ্রীকে দেখে ধৃতিমান উঠে দাঁড়ায়। দেবশ্রী ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওই দুই চোখ কিছু বলতে চাইছে দেবশ্রীকে। সামনের সোফার উপরে দেবশ্রীকে বসতে অনুরোধ করে ধৃতিমান। টেবিলের উপরে একটা ছোটো মেয়ের হাসিখুশি ছবি।
ধৃতিমান ম্লান হেসে গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে, “আমি স্বপ্নে ভাবিনি আপনি সত্যি আসবেন।”
দেবশ্রী এইরকম ভাবে আসার কারন নিজেই ঠিক করে জানেনা। দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে আপনার? এতো রাতে আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে হটাত আমার কথা কেন মনে পড়ল?”
টেবিলের উপরে থেকে দেবশ্রী ছবিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হাসি হাসি মুখ, বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, মেয়েটার নাক, থুতনি ধৃতিমানের মতন। দেবশ্রীর হাতের ছবি দেখিয়ে ধৃতিমান বলে, “আপনার হাতের ছবিটা আমার একমাত্র কন্যের, মল্লিকা দেবনাথ।” এক অজানা আশঙ্কায় দেবশ্রীর হৃদয় ধুক করে ওঠে। ধৃতিমান বলে, “দিল্লিতে ডিপিএস এ ক্লাস এইটে পড়ে। দুই বছর পরে স্কুল ফাইনাল দেবে।” বড় একটা পাথর বুকের উপরে থেকে সরে যায়, দেবশ্রীর। ধৃতিমান বলে, “জানেন ম্যাডাম, মলির চেহারা, মলির চোখ দুটি ওর মায়ের কথা আমাকে বারেবারে মনে করিয়ে দেয়।” দেবশ্রী একবার ভাবে ধৃতিমানের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করবে। ধৃতিমান, “আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন যে আমি মুম্বাই থাকাকালীন খুব চুপচাপ ছিলাম।”
দেবশ্রী মাথা নাড়ায় “হ্যাঁ, করেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা দেখে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি আর।”
ধৃতিমানঃ “আজকে আপনাকে একটা মনের কথা বলবো, আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি আমি।”
দেবশ্রী একবার ছবির দিকে তাকায়, আরেকবার ধৃতিমানের মুখের দিকে তাকায়। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার স্ত্রী কোথায়?”
ধৃতিমান চোখের কোল মুছে বলে, “সব বলছি ম্যাডাম। মুম্বাই আমার ভালোবাসার শহর, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়ার শহর। আমি মুম্বাইয়ের ছেলে, ছোটবেলা থেকে ওইখানে বড় হয়েছি, বিচে খেলেছি, গনপতি বাপ্পা মোরিয়া করে মাথায় গনপতি নিয়ে বিসর্জন দিয়েছি। কলেজে পড়ার সময়ে এক মারাঠি সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়, তার নাম কল্পনা পাটেকর। কলেজ শেষে আমি মাস্টারস করি মার্কেটিংয়ে, ও ছিল একাউন্টসে। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেল, আমাদের বিয়ে হলো না। একটু ভেঙে পড়েছিলাম আমি তবে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। ব্রেকআপের কারন আর কিছু না, আমি নাকি একটু ন্যাকাপনা ছেলে, আমার মধ্যে নাকি পুরুষত্ব নেই। দুইজন শেষ পর্যন্ত দুইজনের পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমান দেখতে মোটামুটি, বয়সের ভারে একটু ভুঁড়ি হয়ে গেছে, দেবশ্রীর চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা কিন্তু পুরুষত্ব বিহীন একেবারে বলা চলে না। ওর কথাবার্তা ওর চালচলন আদবকায়দা বেশ রুচিসম্পন্ন। বেশি খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না দেবশ্রীর।
ধৃতিমানঃ “পড়াশুনা শেষে চাকরি পেলাম। বাবা আমার জন্য মেয়ে বাঙালি মেয়ে দেখলেন, তার নাম রেনুকা, বেহালায় বাড়ি। ষোলো বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে রেনুকা চাকরি করতে চায়, আমি বাধা দিলাম না। আমার স্ত্রী রেনু, বড্ড ভালো মেয়ে, খুব ভালবাসতো আমাকে। পুরাতন সব ব্যাথা মন থেকে মুছে গিয়েছিল আমার। মার্কেটিংয়ের কাজ, মাঝে মাঝেই বাইরে থাকতাম কাজের জন্য। প্রথম দুই বছর বিশেষ কিছু পদোন্নতি ঘটল না, পরের বছর আমি বেশি করে কাজে মন দিলাম আর বাড়ির বাইরে থাকতাম। তবে যেটুকু সময়ে বাড়িতে বা মুম্বাই অফিসে থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্ত্রীর সাথে কাটাতে। রোজ অফিস ফেরত ওকে আমি ওর অফিস থেকে তুলে নিতাম, কোনদিন বিচের ধারে ঘোরা, কোনদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফেরা। মোটামুটি ভালো মন্দ মিলিয়ে সুন্দর ছিল আমাদের দুই জনের সংসার।”
“বিয়ের তিন বছর পরে ঘর আলো করে আমার লক্ষ্মীর জন্ম। মল্লিকা নাম দিলাম সেই ছোট্ট ফুটফুটে মুক্তোর বিন্দুকে। মলির জন্মের পরে পরিবার বাড়ল, কাজ বাড়ল। আমার বাড়িতে থাকা কমে গেল। রেনুকা চাকরি ছেড়ে দিল মেয়েকে দেখার জন্য। আমি বাড়ির বাইরে থাকতে লাগলাম কাজের জন্য। মাথায় ভর করলো উপরে ওঠার, টাকা প্রতিপত্তি নামযশ কেনার। আমার সাথে যারা পাস করেছিল তাদের গাড়ি হয়ে গেছে, কেউ কেউ ফ্লাট কিনেছে। আমরা দুই কামরার একটা ফ্লাটে থাকতাম, ভালোবাসার ফ্লাট ছোটো হয়ে গেল আমার কাছে।” কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে ধৃতিমানের, সেই সাথে দেবশ্রী একবার ছবিতে মল্লিকার হাসিহাসি চেহারা দেখে আর ধৃতিমানকে দেখে। ধৃতিমান, দেবশ্রীর দিকে একটা ছবি এগিয়ে দেয়। এক সুন্দরী মহিলা কোলে একটা ছোটো মেয়ে। দুইজনে কোন এক সমুদ্র সৈকতে সাগর জলের মধ্যে শুয়ে।
ধৃতিমান বলে, “আমার স্ত্রীর আর মেয়ের শেষ ফটো। ঠিক দশ বছর আগে, এক শীতের ছুটিতে আমরা গোয়া ঘুরতে যাই। সময় বিশেষ পেতাম না, তাই বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিলাম। মলি তখন সবে আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, মাম্মা, পাপ্পা। শুনতে বড় মিষ্টি লাগতো।”
দেবশ্রীর মনে পড়ে যায় দেবায়নের কথা, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হতো ছেলেকে। নিজে হাতে কিছুতেই খাবে না সে ছেলে। রাতের বেলা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তো দেবায়ন, কোনদিন বাড়ির কাজ সারতে একটু দেরি হয়ে গেলে কান্নাকাটি বাধিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলতো। সব কাজ ছেড়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আবার রান্না ঘর পরিষ্কার, এঁঠো বাসন গুলো সকালের কাজের লোকের জন্য জড়ো করে রাখা ইত্যাদি কাজ করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া।
ধৃতিমান বলে চলে, “ট্রেনে যেতে বলেছিল রেনুকা, আমি নতুন গাড়ি কিনেছিলাম তখন। গাড়ি করে আমরা গোয়া ঘুরতে গেলাম। পাঁচদিন খুব জমিয়ে ছুটি কাটালাম। রেনুকা সাঁতার জানে, সমুদ্রকে ভয় করে না। মেয়েকে পিঠে বেঁধে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে এক উদ্দাম খুসি। শেষদিন, গোয়ায় এক ব্যস্ত বাজারে আমি আর রেনুকা কিছু কেনাকাটা করছিলাম, মলি আমার কোলে ছিল। রঙিন চুড়ি, স্টোল ইত্যাদি দেখতে দেখতে রেনুকা এগিয়ে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। সেই সময়ে হটাত আমার চোখ পড়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার দিকে। বড় চেনা মনে হলো মহিলাকে, কাছে এগিয়ে যেতেই চিনতে অসুবিধে হলো না আমার পুরাতন প্রেমিকা, কল্পনাকে। আমাকে দেখে চমকে গেল কল্পনা, জিজ্ঞেস করলো আমার কথা। আমি বললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে মলিকে দেখিয়ে পরিচয় দিলাম আমার মেয়ে। নিজের কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি রেনুকা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে চলে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা কার্ড বের করে কল্পনার হাতে গুঁজে চলে গেলাম। রেনুকা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, কল্পনাকে অন্তত দেখেনি রেনুকা। দেখলে কি হতো জানতাম না। হোটেলে ফিরে এলাম, বিকেলের দিকে কল্পনার ফোন এল। আমাকে বলল যে আমার সাথে মুম্বাই ফিরে দেখা করতে চায়। আমি কারন জিজ্ঞেস করাতে জানাল কিছু ব্যাক্তিগত কারনে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর বিয়ে হয়েছে কি না। উত্তরে জানায় যে স্বামীর সাথে কিছু দ্বন্দের ফলে বছর দুয়েক ধরে আলাদা থাকে। ডিভোর্স হয়নি ওদের মধ্যে। রেনুকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম অদুরে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজছে। রেনুকার হাসি মুখ আমাকে চুম্বকের মতন টেনে নিল। আমি কল্পনাকে বললাম যে মুম্বাই ফিরে ওর সাথে আমি দেখা করবো। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করে উঠলো পুরানো প্রেমের কাঁটা, কল্পনার কথা জানতে বড় ইচ্ছে হলো। শেষ বিকেল, গোয়ায় রেনুকাকে জড়িয়ে ধরে আমরা আড়াই জনে সূর্যাস্ত দেখলাম।”
“বিকেলবেলা গোয়া থেকে রওনা দিলাম মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রেনুকা মলিকে কোলে নিয়ে বসে। মলি রেনুকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রেনুকা মলিকে পেছনের সিটের উপরে বিছানা করে বেল্ট দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে দিল সিটের সাথে। আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য গল্প করতে শুরু করে রেনুকা। একটু খানি ক্লান্তি বোধ করলে বিস্কুট খাইয়ে দেয় অথবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল মুখের কাছে ধরে। রেনুকা আমাকে বলেছিল যদি আমার গাড়ি চালাতে কষ্ট হয় তাহলে রাতে কোথায় একটা হোটেল দেখে থেকে যেতে। আমি হেসে বললাম যে ওর মতন সুন্দরী পাশে বসে থাকলে ঘুম কেন যম পর্যন্ত আমার পাশে আসতে পারবে না। গল্প করতে করতে এক সময়ে রেনুকার চোখ বুজে এল। আমি আর ওকে জাগালাম না। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে পেছন মলির দিকে তাকিয়ে দেখি, পাশে বসে রেনুকা ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম, রেনুকার দিকে ঝুঁকে ওর গায়ের সুবাস বুকে টেনে নিলাম। ভাগ্য বিধাতা সেখানেই বাধ সাধল, ওর গায়ের গন্ধে আমি পাগল হয়ে গেলাম, চোখে লাগল ঘুমের আবেশ।”
“সকাল হয় হয়, আমরা মুম্বাইয়ের খুব কাছে, ঠিক খোপোলি পেরিয়েছি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমার, হটাত সাত বছর আগের কল্পনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি পুরানো প্রেমের স্বপ্নে ভেসে গেলাম। গাড়ি নিয়ে সোজা ধাক্কা রাস্তার পাশে একটা লাইট পোস্টে। গাড়ির সামনেটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি, রেনুকা সামনের কাঁচ ভেঙে অর্ধেক শরীর গাড়ির বাইরে, মাথাটা বনেটের উপরে। আমার পা আটকে গেছিল ব্রেক প্যাডেলে, স্টিয়ারিং বুকে বেঁধে আমাকে গেঁথে দিয়েছিল সিটের সাথে। কোনোরকমে জ্ঞান হারাবার আগে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, মলির কিছু হয়নি, সিটের সাথে বাঁধা থাকার ফলে শুধুমাত্র সিট থেকে নিচে পড়ে কান্নাকাটি করছে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হস্পিটালের বেডে শুয়ে। অফিসের লোকজন বাড়ির লোকজন সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি চোখ খুলে রেনুকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে চায় না আমার স্ত্রীর কথা, সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে সান্ত্বনা দেবার কারন। সবাইকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রেনুকার নাম ধরে ডাক দিলাম, কেউ উত্তর দিল না। একদিন গেল, দুই দিন গেল, তিনদিন গেল, রেনুকার দেখা নেই। আমার থমথমে চেহারায় শ্বাশুড়ি মলিকে কোলে নিয়ে চুপ করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। আমি আমার শালাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর দিদির কথা। শালা একটু মাথা নাড়াল, আমার মেয়েকে আমার কোলে তুলে দিল। আমি চেঁচিয়ে বললাম একবার আমি রেনুকাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে গেল মর্গে, আমি দেখলাম আমার সুন্দরী ভালোবাসার পাত্রী রেনুকাকে। সাদা চাদরে ঢাকা, মাথায় ঘাড়ে ব্যান্ডেজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে রেনুকার কি হয়েছে। আমার শালা আমাকে জানাল যে, মাথা ভেঙে প্রচুর কাঁচ মাথায় ঢুকে যাওয়ার ফলে সেই খানেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। আমি নির্বাক, আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো এক্সিডেন্ট কি করে হলো, আমি নির্বাক। রেনুকা আমাকে বারবার বলেছিল ঘুম পেলে রাতে কোথাও থেকে যেতে, আমি থাকিনি ওর কথা শুনিনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে পড়ে যেতো যে আমার ভুলের জন্য আমার মেয়ে মাতৃহীনা।”
“আমি মুম্বাইয়ের চাকরি ছেড়ে বাইরে চলে গেলাম। আমার শ্বাশুড়ি আমার মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় চলে গেল। একবছর নিজের থেকে দুরে পালিয়ে থাকলাম, দেশের বাইরে চলে গেলাম। মাঝে মাঝেই আমার মা আমার শ্বাশুড়ি আমাকে ফোন করতো। মলির আধো আধো কথা আমাকে বড় টানতো। আমি ফিরে এলাম দেশে, কিন্তু মুম্বাইয়ে আর ফিরে গেলাম না। এই দিল্লীতে চাকরি নিলাম, কিন্তু মেয়ের সামনে যাবার মতন সাহস ছিল না আমার। দুই বছর পরে আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বললেন যে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে। আমার মা বাবা আমাকে মুম্বাই ফিরে যেতে বলল, আমি রেনুকাকে ছাড়া আর মুম্বাই ফিরে যেতে পারলাম না। বড় ভালবাসতো আমাকে আমার স্ত্রী, ওকে ছাড়া মুম্বাই কেন এই পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আর কোনদিন কল্পনার সাথে দেখা করিনি, যদিও কল্পনা বেশ কয়েক বার ফোন করেছিল যখন আমি হসপিটালে ছিলাম। আমি উত্তর দেইনি। তারপরে আর কোনদিন ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি আমি। একদিন আমার মা আর আমার শ্বাশুড়ি মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে চলে এল। রেনুকা চলে যাওয়ার দুই বছর পরে মেয়ের মুখ দেখে কেঁদে ফেললাম, বেঁচে থাকার একটা রসদ খুঁজে পেলাম। সেই থেকে মেয়ে আমার কাছে। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখলেই মনে হয় আমি ওর মায়ের খুনি। সেই রাতের ঘুম, সেই রাতের আমার পুরানো হারানো প্রেমিকার স্বপ্ন আমার বাস্তবের স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।”
দেবশ্রী স্তব্দ হয়ে যায় ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমানের হাত ধরে দেবশ্রী প্রবোধ দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে, “ধৃতিমান দশ বছর আগে যা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আপনার দোষ একটাই আপনি স্ত্রীর কথা শোনেনি। মিস্টার দেবনাথ, আপনি খুনি নন। মানুষের জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসে, মানুষকে সেই সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এগিয়ে চলতে হয়। জীবন একজনের চলে যাওয়াতে থেমে যায়না, মিস্টার দেবনাথ। নিজেকে এই রকম ভাবে কষ্ট না দিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিন পুনরায়।”
ধৃতিমান সামনে দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে বলে, “অনেক চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। গত দশ বছরে অনেকের কাছে গেছি, অনেকেই আমার সাথী হয়েছে, কিন্তু কাউকে মনে ধরাতে পারলাম না।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে। ধৃতিমানের চোখে দেবশ্রীর প্রতি প্রেমের জল দেখে দেবশ্রীর মন বিচলিত হয়ে ওঠে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো, খুব তাড়াতাড়ি আপনার জীবনে এক সাথী আসবে। সে মল্লিকাকেও নিজের মতন করে বুকে টেনে নেবে।”
ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, “দেবশ্রী, তোমাকে প্রথম দিন দেখেই কেন জানিনা ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল যে তুমি সেই মহিলা যে আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারবে।” 'আপনি' থেকে 'তুমি' চলে এল ধৃতিমানের ঠোঁটে, 'ম্যাডাম' হয়ে গেল 'দেবশ্রী'।
ধৃতিমান ম্লান হেসে গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে, “আমি স্বপ্নে ভাবিনি আপনি সত্যি আসবেন।”
দেবশ্রী এইরকম ভাবে আসার কারন নিজেই ঠিক করে জানেনা। দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে আপনার? এতো রাতে আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে হটাত আমার কথা কেন মনে পড়ল?”
টেবিলের উপরে থেকে দেবশ্রী ছবিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হাসি হাসি মুখ, বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, মেয়েটার নাক, থুতনি ধৃতিমানের মতন। দেবশ্রীর হাতের ছবি দেখিয়ে ধৃতিমান বলে, “আপনার হাতের ছবিটা আমার একমাত্র কন্যের, মল্লিকা দেবনাথ।” এক অজানা আশঙ্কায় দেবশ্রীর হৃদয় ধুক করে ওঠে। ধৃতিমান বলে, “দিল্লিতে ডিপিএস এ ক্লাস এইটে পড়ে। দুই বছর পরে স্কুল ফাইনাল দেবে।” বড় একটা পাথর বুকের উপরে থেকে সরে যায়, দেবশ্রীর। ধৃতিমান বলে, “জানেন ম্যাডাম, মলির চেহারা, মলির চোখ দুটি ওর মায়ের কথা আমাকে বারেবারে মনে করিয়ে দেয়।” দেবশ্রী একবার ভাবে ধৃতিমানের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করবে। ধৃতিমান, “আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন যে আমি মুম্বাই থাকাকালীন খুব চুপচাপ ছিলাম।”
দেবশ্রী মাথা নাড়ায় “হ্যাঁ, করেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা দেখে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি আর।”
ধৃতিমানঃ “আজকে আপনাকে একটা মনের কথা বলবো, আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি আমি।”
দেবশ্রী একবার ছবির দিকে তাকায়, আরেকবার ধৃতিমানের মুখের দিকে তাকায়। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার স্ত্রী কোথায়?”
ধৃতিমান চোখের কোল মুছে বলে, “সব বলছি ম্যাডাম। মুম্বাই আমার ভালোবাসার শহর, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়ার শহর। আমি মুম্বাইয়ের ছেলে, ছোটবেলা থেকে ওইখানে বড় হয়েছি, বিচে খেলেছি, গনপতি বাপ্পা মোরিয়া করে মাথায় গনপতি নিয়ে বিসর্জন দিয়েছি। কলেজে পড়ার সময়ে এক মারাঠি সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়, তার নাম কল্পনা পাটেকর। কলেজ শেষে আমি মাস্টারস করি মার্কেটিংয়ে, ও ছিল একাউন্টসে। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেল, আমাদের বিয়ে হলো না। একটু ভেঙে পড়েছিলাম আমি তবে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। ব্রেকআপের কারন আর কিছু না, আমি নাকি একটু ন্যাকাপনা ছেলে, আমার মধ্যে নাকি পুরুষত্ব নেই। দুইজন শেষ পর্যন্ত দুইজনের পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমান দেখতে মোটামুটি, বয়সের ভারে একটু ভুঁড়ি হয়ে গেছে, দেবশ্রীর চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা কিন্তু পুরুষত্ব বিহীন একেবারে বলা চলে না। ওর কথাবার্তা ওর চালচলন আদবকায়দা বেশ রুচিসম্পন্ন। বেশি খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না দেবশ্রীর।
ধৃতিমানঃ “পড়াশুনা শেষে চাকরি পেলাম। বাবা আমার জন্য মেয়ে বাঙালি মেয়ে দেখলেন, তার নাম রেনুকা, বেহালায় বাড়ি। ষোলো বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে রেনুকা চাকরি করতে চায়, আমি বাধা দিলাম না। আমার স্ত্রী রেনু, বড্ড ভালো মেয়ে, খুব ভালবাসতো আমাকে। পুরাতন সব ব্যাথা মন থেকে মুছে গিয়েছিল আমার। মার্কেটিংয়ের কাজ, মাঝে মাঝেই বাইরে থাকতাম কাজের জন্য। প্রথম দুই বছর বিশেষ কিছু পদোন্নতি ঘটল না, পরের বছর আমি বেশি করে কাজে মন দিলাম আর বাড়ির বাইরে থাকতাম। তবে যেটুকু সময়ে বাড়িতে বা মুম্বাই অফিসে থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্ত্রীর সাথে কাটাতে। রোজ অফিস ফেরত ওকে আমি ওর অফিস থেকে তুলে নিতাম, কোনদিন বিচের ধারে ঘোরা, কোনদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফেরা। মোটামুটি ভালো মন্দ মিলিয়ে সুন্দর ছিল আমাদের দুই জনের সংসার।”
“বিয়ের তিন বছর পরে ঘর আলো করে আমার লক্ষ্মীর জন্ম। মল্লিকা নাম দিলাম সেই ছোট্ট ফুটফুটে মুক্তোর বিন্দুকে। মলির জন্মের পরে পরিবার বাড়ল, কাজ বাড়ল। আমার বাড়িতে থাকা কমে গেল। রেনুকা চাকরি ছেড়ে দিল মেয়েকে দেখার জন্য। আমি বাড়ির বাইরে থাকতে লাগলাম কাজের জন্য। মাথায় ভর করলো উপরে ওঠার, টাকা প্রতিপত্তি নামযশ কেনার। আমার সাথে যারা পাস করেছিল তাদের গাড়ি হয়ে গেছে, কেউ কেউ ফ্লাট কিনেছে। আমরা দুই কামরার একটা ফ্লাটে থাকতাম, ভালোবাসার ফ্লাট ছোটো হয়ে গেল আমার কাছে।” কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে ধৃতিমানের, সেই সাথে দেবশ্রী একবার ছবিতে মল্লিকার হাসিহাসি চেহারা দেখে আর ধৃতিমানকে দেখে। ধৃতিমান, দেবশ্রীর দিকে একটা ছবি এগিয়ে দেয়। এক সুন্দরী মহিলা কোলে একটা ছোটো মেয়ে। দুইজনে কোন এক সমুদ্র সৈকতে সাগর জলের মধ্যে শুয়ে।
ধৃতিমান বলে, “আমার স্ত্রীর আর মেয়ের শেষ ফটো। ঠিক দশ বছর আগে, এক শীতের ছুটিতে আমরা গোয়া ঘুরতে যাই। সময় বিশেষ পেতাম না, তাই বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিলাম। মলি তখন সবে আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, মাম্মা, পাপ্পা। শুনতে বড় মিষ্টি লাগতো।”
দেবশ্রীর মনে পড়ে যায় দেবায়নের কথা, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হতো ছেলেকে। নিজে হাতে কিছুতেই খাবে না সে ছেলে। রাতের বেলা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তো দেবায়ন, কোনদিন বাড়ির কাজ সারতে একটু দেরি হয়ে গেলে কান্নাকাটি বাধিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলতো। সব কাজ ছেড়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আবার রান্না ঘর পরিষ্কার, এঁঠো বাসন গুলো সকালের কাজের লোকের জন্য জড়ো করে রাখা ইত্যাদি কাজ করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া।
ধৃতিমান বলে চলে, “ট্রেনে যেতে বলেছিল রেনুকা, আমি নতুন গাড়ি কিনেছিলাম তখন। গাড়ি করে আমরা গোয়া ঘুরতে গেলাম। পাঁচদিন খুব জমিয়ে ছুটি কাটালাম। রেনুকা সাঁতার জানে, সমুদ্রকে ভয় করে না। মেয়েকে পিঠে বেঁধে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে এক উদ্দাম খুসি। শেষদিন, গোয়ায় এক ব্যস্ত বাজারে আমি আর রেনুকা কিছু কেনাকাটা করছিলাম, মলি আমার কোলে ছিল। রঙিন চুড়ি, স্টোল ইত্যাদি দেখতে দেখতে রেনুকা এগিয়ে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। সেই সময়ে হটাত আমার চোখ পড়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার দিকে। বড় চেনা মনে হলো মহিলাকে, কাছে এগিয়ে যেতেই চিনতে অসুবিধে হলো না আমার পুরাতন প্রেমিকা, কল্পনাকে। আমাকে দেখে চমকে গেল কল্পনা, জিজ্ঞেস করলো আমার কথা। আমি বললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে মলিকে দেখিয়ে পরিচয় দিলাম আমার মেয়ে। নিজের কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি রেনুকা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে চলে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা কার্ড বের করে কল্পনার হাতে গুঁজে চলে গেলাম। রেনুকা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, কল্পনাকে অন্তত দেখেনি রেনুকা। দেখলে কি হতো জানতাম না। হোটেলে ফিরে এলাম, বিকেলের দিকে কল্পনার ফোন এল। আমাকে বলল যে আমার সাথে মুম্বাই ফিরে দেখা করতে চায়। আমি কারন জিজ্ঞেস করাতে জানাল কিছু ব্যাক্তিগত কারনে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর বিয়ে হয়েছে কি না। উত্তরে জানায় যে স্বামীর সাথে কিছু দ্বন্দের ফলে বছর দুয়েক ধরে আলাদা থাকে। ডিভোর্স হয়নি ওদের মধ্যে। রেনুকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম অদুরে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজছে। রেনুকার হাসি মুখ আমাকে চুম্বকের মতন টেনে নিল। আমি কল্পনাকে বললাম যে মুম্বাই ফিরে ওর সাথে আমি দেখা করবো। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করে উঠলো পুরানো প্রেমের কাঁটা, কল্পনার কথা জানতে বড় ইচ্ছে হলো। শেষ বিকেল, গোয়ায় রেনুকাকে জড়িয়ে ধরে আমরা আড়াই জনে সূর্যাস্ত দেখলাম।”
“বিকেলবেলা গোয়া থেকে রওনা দিলাম মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রেনুকা মলিকে কোলে নিয়ে বসে। মলি রেনুকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রেনুকা মলিকে পেছনের সিটের উপরে বিছানা করে বেল্ট দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে দিল সিটের সাথে। আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য গল্প করতে শুরু করে রেনুকা। একটু খানি ক্লান্তি বোধ করলে বিস্কুট খাইয়ে দেয় অথবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল মুখের কাছে ধরে। রেনুকা আমাকে বলেছিল যদি আমার গাড়ি চালাতে কষ্ট হয় তাহলে রাতে কোথায় একটা হোটেল দেখে থেকে যেতে। আমি হেসে বললাম যে ওর মতন সুন্দরী পাশে বসে থাকলে ঘুম কেন যম পর্যন্ত আমার পাশে আসতে পারবে না। গল্প করতে করতে এক সময়ে রেনুকার চোখ বুজে এল। আমি আর ওকে জাগালাম না। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে পেছন মলির দিকে তাকিয়ে দেখি, পাশে বসে রেনুকা ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম, রেনুকার দিকে ঝুঁকে ওর গায়ের সুবাস বুকে টেনে নিলাম। ভাগ্য বিধাতা সেখানেই বাধ সাধল, ওর গায়ের গন্ধে আমি পাগল হয়ে গেলাম, চোখে লাগল ঘুমের আবেশ।”
“সকাল হয় হয়, আমরা মুম্বাইয়ের খুব কাছে, ঠিক খোপোলি পেরিয়েছি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমার, হটাত সাত বছর আগের কল্পনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি পুরানো প্রেমের স্বপ্নে ভেসে গেলাম। গাড়ি নিয়ে সোজা ধাক্কা রাস্তার পাশে একটা লাইট পোস্টে। গাড়ির সামনেটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি, রেনুকা সামনের কাঁচ ভেঙে অর্ধেক শরীর গাড়ির বাইরে, মাথাটা বনেটের উপরে। আমার পা আটকে গেছিল ব্রেক প্যাডেলে, স্টিয়ারিং বুকে বেঁধে আমাকে গেঁথে দিয়েছিল সিটের সাথে। কোনোরকমে জ্ঞান হারাবার আগে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, মলির কিছু হয়নি, সিটের সাথে বাঁধা থাকার ফলে শুধুমাত্র সিট থেকে নিচে পড়ে কান্নাকাটি করছে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হস্পিটালের বেডে শুয়ে। অফিসের লোকজন বাড়ির লোকজন সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি চোখ খুলে রেনুকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে চায় না আমার স্ত্রীর কথা, সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে সান্ত্বনা দেবার কারন। সবাইকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রেনুকার নাম ধরে ডাক দিলাম, কেউ উত্তর দিল না। একদিন গেল, দুই দিন গেল, তিনদিন গেল, রেনুকার দেখা নেই। আমার থমথমে চেহারায় শ্বাশুড়ি মলিকে কোলে নিয়ে চুপ করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। আমি আমার শালাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর দিদির কথা। শালা একটু মাথা নাড়াল, আমার মেয়েকে আমার কোলে তুলে দিল। আমি চেঁচিয়ে বললাম একবার আমি রেনুকাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে গেল মর্গে, আমি দেখলাম আমার সুন্দরী ভালোবাসার পাত্রী রেনুকাকে। সাদা চাদরে ঢাকা, মাথায় ঘাড়ে ব্যান্ডেজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে রেনুকার কি হয়েছে। আমার শালা আমাকে জানাল যে, মাথা ভেঙে প্রচুর কাঁচ মাথায় ঢুকে যাওয়ার ফলে সেই খানেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। আমি নির্বাক, আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো এক্সিডেন্ট কি করে হলো, আমি নির্বাক। রেনুকা আমাকে বারবার বলেছিল ঘুম পেলে রাতে কোথাও থেকে যেতে, আমি থাকিনি ওর কথা শুনিনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে পড়ে যেতো যে আমার ভুলের জন্য আমার মেয়ে মাতৃহীনা।”
“আমি মুম্বাইয়ের চাকরি ছেড়ে বাইরে চলে গেলাম। আমার শ্বাশুড়ি আমার মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় চলে গেল। একবছর নিজের থেকে দুরে পালিয়ে থাকলাম, দেশের বাইরে চলে গেলাম। মাঝে মাঝেই আমার মা আমার শ্বাশুড়ি আমাকে ফোন করতো। মলির আধো আধো কথা আমাকে বড় টানতো। আমি ফিরে এলাম দেশে, কিন্তু মুম্বাইয়ে আর ফিরে গেলাম না। এই দিল্লীতে চাকরি নিলাম, কিন্তু মেয়ের সামনে যাবার মতন সাহস ছিল না আমার। দুই বছর পরে আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বললেন যে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে। আমার মা বাবা আমাকে মুম্বাই ফিরে যেতে বলল, আমি রেনুকাকে ছাড়া আর মুম্বাই ফিরে যেতে পারলাম না। বড় ভালবাসতো আমাকে আমার স্ত্রী, ওকে ছাড়া মুম্বাই কেন এই পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আর কোনদিন কল্পনার সাথে দেখা করিনি, যদিও কল্পনা বেশ কয়েক বার ফোন করেছিল যখন আমি হসপিটালে ছিলাম। আমি উত্তর দেইনি। তারপরে আর কোনদিন ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি আমি। একদিন আমার মা আর আমার শ্বাশুড়ি মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে চলে এল। রেনুকা চলে যাওয়ার দুই বছর পরে মেয়ের মুখ দেখে কেঁদে ফেললাম, বেঁচে থাকার একটা রসদ খুঁজে পেলাম। সেই থেকে মেয়ে আমার কাছে। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখলেই মনে হয় আমি ওর মায়ের খুনি। সেই রাতের ঘুম, সেই রাতের আমার পুরানো হারানো প্রেমিকার স্বপ্ন আমার বাস্তবের স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।”
দেবশ্রী স্তব্দ হয়ে যায় ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমানের হাত ধরে দেবশ্রী প্রবোধ দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে, “ধৃতিমান দশ বছর আগে যা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আপনার দোষ একটাই আপনি স্ত্রীর কথা শোনেনি। মিস্টার দেবনাথ, আপনি খুনি নন। মানুষের জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসে, মানুষকে সেই সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এগিয়ে চলতে হয়। জীবন একজনের চলে যাওয়াতে থেমে যায়না, মিস্টার দেবনাথ। নিজেকে এই রকম ভাবে কষ্ট না দিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিন পুনরায়।”
ধৃতিমান সামনে দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে বলে, “অনেক চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। গত দশ বছরে অনেকের কাছে গেছি, অনেকেই আমার সাথী হয়েছে, কিন্তু কাউকে মনে ধরাতে পারলাম না।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে। ধৃতিমানের চোখে দেবশ্রীর প্রতি প্রেমের জল দেখে দেবশ্রীর মন বিচলিত হয়ে ওঠে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো, খুব তাড়াতাড়ি আপনার জীবনে এক সাথী আসবে। সে মল্লিকাকেও নিজের মতন করে বুকে টেনে নেবে।”
ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, “দেবশ্রী, তোমাকে প্রথম দিন দেখেই কেন জানিনা ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল যে তুমি সেই মহিলা যে আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারবে।” 'আপনি' থেকে 'তুমি' চলে এল ধৃতিমানের ঠোঁটে, 'ম্যাডাম' হয়ে গেল 'দেবশ্রী'।