What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (3 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
326
Messages
6,134
Credits
46,324
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
লীলাবতী
লেখক- হুমায়ূন আহমেদ




পূর্বকথা

আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মোহনগঞ্জে, আমার নানার বাড়িতে। ছায়াময় একটি বাড়ি, পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর সারদেয়াল–পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। সব কিছুই রহস্যময়। সন্ধ্যাবেলায় সারদেয়ালে ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটাহাঁটি করে। গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ভূতে ঢিল মারে। কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। অশরীরী কিছু যন্ত্রণা তো করবেই। এদেরকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। মূলবাড়ি থেকে অনেক দূরে বিশাল এক তেঁতুলগাছের পাশে টাট্টিখানা। সন্ধ্যার পর যারা টাট্টিখানায় যায় তারা না-কি প্রায়ই তেঁতুলগাছে পা বুলিয়ে পেততুনি বসে থাকতে দেখে।

দিনমানে অন্য দৃশ্য। বাড়ির কাছেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠভর্তি বক। আমার নানাজান আবুল হােসেন শেখ দোনলা বন্দুক হাতে বক শিকারে বের হন। আমি তাঁর সঙ্গী। ছররা বন্দুকের গুলি হলো। অনেকগুলি বিক একসঙ্গে মারা পড়ল। তাদের গায়ের ধবধবে পালক রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে–আমি চোখ বড় বড় করে দেখছি। মাথার উপর মৃত বকদের সঙ্গীরা ট্যা ট্যা শব্দে ঘুরছে, অদ্ভুত সব দৃশ্য।

নানার বাড়ির স্মৃতি মাথায় রেখেই লীলাবতী উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই সময়ের রহস্যময়তাকে ধরার চেষ্টা। লেখাটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল অন্যদিন পত্রিকায়। কোনো ধারাবাহিক লেখাই আমি শেষ করতে পারি না। খেই হারিয়ে ফেলি। আগ্রহ কমে যায়। লীলাবতীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। একসময় লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, ভালো লেখা যত্ব নিয়ে লিখতে হয়, তাড়াহুড়া করা যায় না। তুমি মন খারাপ করো না। একসময় এই লেখা আমি শেষ করব।

আমি আমার কথা রেখেছি। বইমেলায় লীলাবতী বের করতে পেরে মাজহার নিশ্চয়ই খুশি। আমিও খুশি। লেখাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন ঘাড়ে চেপে ছিল— এখন নেমে গেছে।

লীলাবতী উপন্যাসের সব চরিত্ররা ভালো থাকুক। তাদের প্রতি এই আমার শুভকামনা।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর


০১.

রেললাইনের উপর একটা বক বসে আছে। মেছো বাঁক। এ ধরনের বক বিলের উপর উড়াউড়ি করে। অল্প পানিতে এক ঠ্যাঙ ড়ুবিয়ে মাছের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ডাঙায় আসার কথা না। আর যদি আসেও গম্ভীর ভঙ্গিতে রেললাইনে বসে থাকার কথা না। সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে বকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর ঘটনাটা কী? এ কী চায়?

বকটা ধবধবে সাদা। পানির বকের পালক সাদাই হয়। সারাক্ষণই পানিতে ডোবাড়ুবি করছে। পালকে ময়লা লেগে থাকা? কোনো কারণ নেই। ডাঙার বকের পালক এত সাদা না— বাদামি রঙ। মেছো।ক পানিতে যেমন এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনের উপরও এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাথ, নড়াচ্ছে না, শরীর নড়াচ্ছে না, স্থির দৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমানের বিস্ময় আরো প্রবল হলো, বকটা কী দেখছে? বিলের পানিতে এভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অর্থ আছে— মাছের গতিবিধি লক্ষ করা। এখানে বকটার একদৃষ্টিতে রেললাইনের পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী? সে কি রেললাইনের পাথর দেখছে?

ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেন চলে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। ঘন জংলায় আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেন দেখা যাবে। বকটা এখনো নড়ছে না। রেললাইনের কম্পন তার অনুভব করার কথা। ধ্যান ভঙ্গ হবার সময় এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান বুকের ভেতর সামান্য চাপ অনুভব করলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার এরকম হয়। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়।

রেলের ইঞ্জিনটা এখন দেখা যাচ্ছে। কয়লার ইঞ্জিন। বুনকা বুনকা ধোঁয়া ছাড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! বকটাকেও দেখা যাচ্ছে। বক আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সিদ্দিকুর রহমান অস্থির বোধ করলেন। হুশ! হুশ! শব্দ করে বকটাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু গলা কেমন যেন আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ ব্যথা। তিনি তাকালেন রেলের ইঞ্জিনের দিকে। ভালো স্পিড দিয়েছে। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে বকটার দিকে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। গাঢ় ঘুমে তার চোখের পাতা নেমে এসেছে। চারদিকে অদ্ভুত এক শান্তি-শান্তি নীরবতা। বাতাস মধুর ও শীতল। বুকের ব্যথাটা নেই। নিঃশ্বাসের কষ্ট নেই।

একসময় তিনি চোখ মেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাঠের উপর তিনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। তার বাঁ-দিকে প্ৰকাণ্ড শিমুল গাছ। গাছটার ছায়া পড়েছে তাঁর শরীরে। ছায়াটা এমনভাবে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি একটা ছায়ার চাঁদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখের সামনে আশ্বিন মাসের মেঘশূন্য আকাশ। আকাশে দুটা চিল উড়ছে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়ছে। তাদের দেখাচ্ছে বিন্দুর মতো। তিনি উঠে বসলেন।

ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও না। রেললাইনের উপর বকটা দাঁড়িয়ে নেই। সে ট্রেনের নিচে চাপাও পড়ে নি। চাপা পড়লে তার রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমান দুই হাতে ভর দিয়ে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছে। রেললাইনের ওপাশের জলে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা ক্যাচ ক্যাচি পাখি তার পায়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে। তিনি চাপা গলায় বললেন–‘হুশ! হুশ! সেইসঙ্গে ডান পায়ে মাটিতে বাড়িও দিলেন। পাখিগুলি একটু দূরে চলে গেল— তবে ভয় পেয়ে উড়ে চলে গেল না। ক্যাচক্যাচি পাখিগুলি চড়ুই পাখির মতোই সাহসী। এরা মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। ধূসর বর্ণের পাখি। চোখ হলুদ। সারাক্ষণ ক্যাচক্যাচ করে বলেই নাম ক্যাচ ক্যাচি পাখি। তাদের আরো একটা বিশেষত্ব আছে–এরা সাতজনের একটা দল বানিয়ে থাকে। ক্যাচ ক্যাচি পাখির বাকে সবসময় সাতটা পাখি থাকবে। সাতের বেশিও না, কমও না। যদি কখনো কেউ দেখে দলে সাতটার কম পাখি আছে, তাহলে তার ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের মৃত্যু ঘটে। অর্থহীন প্রচলিত প্রবাদ, তার পরেও ক্যাচক্যাচি পাখি দেখলেই সবাই পাখি গোনে। সিদ্দিকুর রহমানও গুনতে শুরু করলেন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়। একটা পাখি তো কম! তিনি আবারো গুনলেন। পাখি ছয়টা। এর মানে কী? পাখি ছয়টা কেন?

ধুলাবালির উপর বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু তাঁর উঠতেও ইচ্ছা! করছে না। বরং আবারো শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত শুয়ে থাকলে মন্দ হয় না। সন্ধ্যা মিলাবে। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়বে। আজ চাঁদের নয় তারিখ, চাঁদের আলো আছে। সেই আলো কুয়াশায় পড়বে। কুয়াশাকে মনে হবে চাঁদের আলোর হাওর। সেই হাওরের ভেতর দিয়ে বাড়িতে পৌছে যাওয়া। খোলা মাঠে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নানান বিষয়ে চিন্তা করতে খারাপ লাগার কথা না। তাঁর বয়স সাতান্ন। এই বয়সে মানুষ পার করে আসা জীবনের কথা চিন্তা করে। সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করে। কোনো হিসাবই মেলে না। এই বয়সটা হিসাব মেলানোর জন্যে ভালো না।

সিদ্দিকুর রহমান চারদিক দেখে নিয়ে আবারো শুয়ে পড়লেন। পাঞ্জাবিতে ধুলা যা লাগার লেগে গেছে। বাড়িতে পৌছে গরম পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। বড় এক বালতি গরম পানিতে সামান্য কিছু কপূরদানা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে গোসল। পানিতে কপূর দিয়ে গোসলের অভ্যাস তিনি পেয়েছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী আয়নার কাছ থেকে। কপূর দিয়ে গোসলের জন্যে আয়নার শরীরে কপূরের গন্ধ লেগে থাকত। কাপড়ে কপূরের গন্ধ লাগলে কাপড় বাসিবাসি মনে হয়। মানুষের গায়ে এই গন্ধ আবার অন্যরকম লাগে। আয়না। কতদিন আগে চলে গেছে, কিন্তু তার অভ্যাস রেখে গেছে। মানুষ কখনো পুরোপুরি চলে যায় না। কিছু-না-কিছু সে রেখে যায়।

তিনি আয়নার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলেন। চট করে চেহারা চোখে ভেসে উঠল। এটাও একটা আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা। আগে অনেকবার চেষ্টা করেছেন, চেহারা মনে করতে পারেন নি। লম্বা মুখ, সরু কপাল, বড় বড় চোখ। চোখের রঙ বাদামি। একটা কিশোরী মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে বড় করার চেষ্টা করলে যেমন দেখায় তাকে সেরকম দেখাচ্ছে। সে তরুণীও না, কিশোরীও না। দুয়ের মাঝামাঝি থেকেই আয়না তার ক্ষুদ্র জীবন শেষ করে গেল। আফসোসের ব্যাপার। খুবই আফসোসের ব্যাপার।

নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি যখন প্রথম বাড়িতে ঢোকেন তখন তাঁর দাদিজান ফুলবানু জীবিত। বুড়ির বয়স সত্ত্বরের উপরে। মেরুদণ্ড বেঁকে গেলেও শক্তসমর্থ শরীর। কানে শুনতে পান না। কিন্তু চোখে খুব ভালো দেখেন। নতুন বউকে দেখে ফুলবানু বিরক্ত মুখে বললেন–শুনছি বউ হেন, বউ তেন। কই গায়ের রঙ তো ময়লা! ভালো ময়লা। তিন রাইজ্য খুঁইজ্যা কী বউ আনল?

সিদ্দিকুর রহমানের এক ফুপু বললেন, আম্মা। আপনি কী বলেন? কী সুন্দর চাপা রঙ!



ফুলবানু বললেন, হাতের আর মুখের চামড়ার রঙ কোনো রঙ না। পেটের চামড়ার রঙ আসল। পেটের চামড়া দেখছো? ও নতুন বউ, শাড়ির আঁচলটা টান দিয়া পেট দেখাও।

নতুন বউ দাদিজানের কথা শুনে কেঁদে কেটে অস্থির।

রাতে সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, দাদিজানের কথায় তুমি কিছু মনে করবে না। দাদিজান এরকমই। আয়না ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, কেউ আমাকে কোনোদিন কালো বলে নাই।

কেউ বলে নাই, এখন একজন বলেছে। তাতে কী?

তাতে অনেক কিছু।

সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, গায়ের রঙ কিছু না বউ। মনের রঙ আসল রঙ। মনের রঙ কালো না হলেই হয়।

নতুন বউ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এটা তো ভুল কথা। আমার গায়ের রঙ কালো হলে আপনি কি আমাকে বিবাহ করতেন? আপনারা প্রথম খুঁজেছেন রঙ। আপনারা সম্বন্ধ করতে গিয়ে কোনো মেয়ের মনের রঙ কী সেই খোঁজ নেন নাই। মনের রঙ দেখা যায় না। গায়ের রঙ দেখা যায়। আমি কি ভুল বলেছি?

সিদ্দিকুর রহমান জবাব দেন নি, তবে স্ত্রীর উপর সামান্য বিরক্ত হয়েছেন। নতুন বউ মুখের উপর কটকট করে এত কথা বলবে কেন? বাসররাতে স্বামী কথা বলবে, স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে হ্যা-নাসূচক মাথা নাড়বে। এটাই চিরকালের নিয়ম।

নতুন বউয়ের মুখের উপর কথা বলার এই স্বভাব অল্পদিনেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই মেয়ে মুখ বন্ধ রাখে না। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। ফুলবানু নাতবউয়ের উপর খুবই বিরক্ত হলেন। তিনি তার নাম দিলেন—কটর কটর পক্ষী। বাড়িতে কেউ এলেই ফুলবানু আয়োজন করে নতুন বউয়ের নতুন নাম শুনিয়ে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে গল্প করতে বসেন–ভাটি অঞ্চলের মেয়ে। পানির মধ্যে বড় হইছে। পাইন্যা স্বভাব হইছে। পাইন্যা স্বভাব কী বুঝলা না? পানি কী করে? গড়াইয়া চলে। নয়া বউ গড়াইয়া চলে। সবসময় গড়াইতেছে। মেয়ের কেমন বাপ-মা কে জানে! কোরান মজিদ পাঠ করতে শিখে নাই। নাতবাউরে সেদিন বললাম— কোরান মজিদ পাঠ কইরা শুনাও। সুরা ইয়াসিন পাঠ করো। নাতবউ বলল, সে কোরান মজিদ পড়তে শিখে নাই। তোমরা কেউ এমন কথা কোনোদিন শুনছো— মেয়েরে কোরান মজিদ পাঠ করতে না শিখাইয়াই মেয়ে বিবাহ দিয়েছে? ছিছিছি! ঝাড়ু মারি এমন বাবা-মা’র মুখে। এরা শিয়াল কুত্তার অধম।

আয়না কোরান মজিদ পাঠ করতে পারে না। শুনে সিদ্দিকুর রহমানও বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি মনের বিরক্তি চেপে রেখে বলেছিলেন— কোরান মজিদ পাঠ করতে পারাটা খুবই প্রয়োজন। তুমি শিখে নাও। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবরে বলব। তুমি বোরকা পরে তাঁর কাছে সবক নিবা। আয়না। তাকে বিস্মিত করে বলেছিল, কোরান মজিদ তো আমি পড়তে পারি।

পড়তে পারো তাহলে দাদিজানের কাছে মিথ্যা বললে কেন?

উনি কানে শোনেন না। উনি কোরান মজিদ পাঠ কী শুনবেন?

তোমাকে পড়তে বলেছে তুমি পড়বে। উনি শুনতে পান কি পান না সেটা উনার ব্যাপার।

উনার কোনো কথা আমি শুনব না।

কেন শুনবে না?

উনি আমার সাথে অশ্লীল কথা বলেন।

কী অশ্লীল কথা?

সেটা আমি বলতে পারব না। আমি মুখে আনতে পারব না।

গ্ৰামদেশের বৃদ্ধারা নাতবউয়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলে। এতে দোষ হয় না।

দোষ-গুণের কথা না। আমার ভালো লাগে না।

তোমার ভালো লাগা দিয়ে তো দুনিয়া চলবে না।

না চললে না।

সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে।

আয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে না। আপনার দাদি দুষ্ট প্রকৃতির। আপনিও দুষ্ট প্রকৃতির। দুষ্ট দাদির নাতি দুষ্ট হয়।

সিদ্দিকুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলো কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার দাদি সম্পর্কে এই ধরনের কথা আর কোনোদিন বলবে না। শৈশবে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। আমাকে মানুষ করেছেন। আমার দাদিজান। এটা মাথায় রাখবা।

আয়না শান্ত গলায় বলেছে, এটা আপনি মাথায় রাখেন। উনি আপনাকে মানুষ করেছেন। আমাকে করেন নাই। আমি উনাকে দুষ্ট মহিলা বলব।

এই পর্যায়ে সিদ্দিকুর রহমান রাগ সামলাতে পারেন নি। আয়নার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আয়না ব্যাপারটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে খাটের এক কোনায় বসেছিল— খাট থেকে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান তুলতে গেলেন। তার আগেই আয়না উঠে পড়ল। শান্ত ভঙ্গিতে খাটের যে জায়গায় আগে বসেছিল সেই জায়গায় বসল। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আপনার দাদিজান আমার শরীর শুকে বলেছেন–আমার শরীরে পরপুরুষের গন্ধ আছে। আপনার গায়ের গন্ধ উনি চিনেন। আপনার গায়ের গন্ধ না-কি আমার শরীরে নাই। প্রথম যে-পুরুষের সঙ্গে মেয়ে শোয় সেই পুরুষের গন্ধ গায়ে লেগে যায়। আমি না-কি বিয়ের আগে অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি। সেই পুরুষের টক-টক গন্ধ আমার গায়ে আছে। যে মহিলা এমন কথা বলেন তাকে আমি দুষ্ট মহিলা বলব।

সিদ্দিকুর রহমান কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। স্ত্রীর গালে চড় মারার ব্যাপারটায় তিনি নিজেও হ’কচাকিয়ে গেছেন। এখন আয়না। কী বলছে সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। তার উচিত এখনি স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া। কীভাবে চাইবেন তাও বুঝতে পারছেন না।

আয়না বলল, আমি কাল সকালে বাপের বাড়ি চলে যাব। আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। যদি না করেন তাহলে আমি নিজেই চলে যাব। যতদিন আপনার দাদি জীবিত থাকবেন ততদিন আমি আসব না। উনার মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর আসব।

এটা কেমন কথা?

কেমন কথা আমি জানি না। আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো কথাই নাই। কাল সকালে আমাকে বাপের দেশে পাঠাবেন।

মুখে বললে তো হয় না, আয়োজন করতে হবে। সঙ্গে লোক দিতে হবে। একা তোমাকে কোনোদিনই ছাড়ব না।

লোক জোগাড় করেন। যতদিন না লোক জোগাড় হয়েছে ততদিন আমি এই বাড়ির কিছু খাব না। পানিও না।

তুমি বাড়াবাড়ি করছি।

মানুষমাত্রই অল্পবিস্তর বাড়াবাড়ি করে। আপনিও করেন। আমিও করি। আপনি চড় দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, আমিও খাওয়া বন্ধ করে বাড়াবাড়ি করব।

এই বলেই খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আয়না শুয়ে পড়ল। সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, আয়না ঘুমিয়ে পড়েছে।

আয়না সত্যি সত্যি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল। সিদ্দিকুর রহমান নানানভাবে চেষ্টা করলেন, কোনো লাভ হলো না। তার পরের দিন দুপুরে নান্দাইল রোড স্টেশনে তিনি স্ত্রীকে তুলে দিতে গেলেন। ট্রেনের কামরায় ওঠার পর আয়না এক চুমুক পানি খেয়ে তার অনশন ভঙ্গ করল।

ফুলবানু ঘোষণা করলেন, আয়নাকে ফিরিয়া আনার কোনো চেষ্টা করলে তিনি সবার সামনে গুড়ের শরবতে ইদুর-মারা বিষ গুলো খাবেন। যদি না খান তাহলে তিনি সতী মায়ের সতী কন্যা না। বাজারের বেবুশ্যা। তিনি শুধু যে একা বেবুশ্যা ৩া না, তার মাও বেবুশ্যা। তার পরেও সিদ্দিকুর রহমান আয়নাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন। নিজে গিয়েছেন। কয়েকবার। লোক পাঠিয়েছেন। আয়না রাজি হয় নি। তার এক কথা— যতদিন বুড়ি বেঁচে থাকবে ততদিন আমি যাব না। বুড়ি যেদিন মারা যাবে তার পরদিন আমি উপস্থিত হব।

আয়না পরের বছরই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। ফুলবানু আরো এগার বছর বেঁচে রইলেন। শেষের দিকে ফুলবানু চোখে দেখতে পেতেন না। একেবারেই কানে শুনতে পেতেন না। হাঁটাচলার শক্তি নেই। ঘা হয়ে শরীর পচে গেল। চিত-কাত করে শোয়াতে গেলে হাত দিয়ে তাকে ধরা যায় না। কচি কলাপাতা গায়ের উপর দিয়ে ধরতে হয়। সেই কলাপাতাও গায়ে লেগে যায়। পাতা টেনে তোলার সময় তিনি ব্যথায় চিৎকার করেন। এমন অবস্থাতেও মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে কথা বলার শক্তি এবং প্রবল ঘ্ৰাণশক্তি নিয়ে তিনি বেঁচে রইলেন।

বয়সের সঙ্গে এই দু’টি শক্তি বেড়েছে। বাড়ির সীমানার ভেতর কেউ ঢুকলেই তিনি গন্ধ শুকে শুকে বলে দেন কে ঢুকেছে।

পাকনা বড়ই খাইয়া কে ঘরে ঢুকছে? কে ঢুকছে? লাটসাবের নাতি হও আর যে-ই হও মুখ ধুইয়া আয়। চুকা গন্ধ আসন্তাছে। চুকা গন্ধে বয় (বমি) আসন্তাছে। যে আসছে সে তো পিসাব কইরা পানি নেয় নাই। আমি পিসাবের গন্ধও পাইতেছি।

ততদিনে সিদ্দিকুর রহমান দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। স্ত্রীর নাম মোসাম্মত রমিলা খাতুন। থালার মতো গোলাকার মুখ। রুগ্ন শরীর কিন্তু কাজ করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। রমিলার উপর ভার পড়ল ফুলবানুর সেবা-শুশ্রুষার। রমিলা খুবই দক্ষতার সঙ্গে তাঁর দাদিশাশুড়ির সেবা করতে শুরু করল। ফুলবানুর রমিলাকে পছন্দ হলো। সারারাত ফুলবানুর ঘুম হয় না। গল্প করার জন্যে রমিলাকে ডেকে আনেন। গলা নিচু করে জগতের অশ্লীলতম গল্প করতে থাকেন। বিকারগ্রস্ত মানুষের প্রলাপ। রমিলাকে মাথা নিচু করে শুনতে হয়। একটু পরে পরে ‘হুঁ’ বলতে হয়।

ও নাতবউ শোনো, ঘোড়ার চেট দেখছো? দেখো নাই? না দেখলে গফ যেটা করতেছি। এইটা বুঝবা না। সিদ্দিকরে বলো মর্দ ঘোড়া একটা আনতে। ঘোড়ার পুটকিতে ঝাড়ু দিয়া খোঁচা দিলে ছলাৎ কইরা বাইর হয়। একটা দেখনের মতো জিনিস। হি হি হি হি।

মৃত্যুর তিন মাস আগে ফুলবানুর জবান বন্ধ হয়ে গেল। তিনি ঠোট নাড়েন, জিভ নাড়েন – কোনো শব্দ বের হয় না। এই সময় তাঁর শরীর থেকে তীব্ৰ পচা গন্ধ বের হতে শুরু করল। সিদ্দিকুর রহমান বসতবাড়ি থেকে অনেক দূরে পুকুরপাড়ে তড়িঘড়ি করে ছনের ঘর তুলে তাঁর দাদিজানকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। সেবা করার জন্যে রমিলা সঙ্গে গেল। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবকে এনে ফুলবানুর মৃত্যু প্রার্থনা করে বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা হলো। এক লক্ষ দশ হাজার বার দুরুদে শেফা পাঠ করা হলো। তার পরেও মৃত্যু আসে না।

রাত একটু বাড়লেই পুকুরপাড়ের ছনের ঘরের চারপাশে শিয়াল হাঁটাহাঁটি করে। রমিলা ঘরের ভেতরও মানুষজনের হাঁটাহাঁটির শব্দ পায়। তাদের ফিসফাস কথা শানে। এরা এই জগতের মানুষ না–বিদেহী আত্মা। হয়তো ফুলবানুর মৃত পিতামাতা। তাদের সন্তানকে দেখতে এসেছে। ভয়ে রমিলার হাত-পা কাপে। রমিলা ভয় প্রকাশ করে না। খাটের চার মাথায় চারটা হারিকেন জ্বলিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে রাত কাটায়। মাঝে মাঝে তার কাছে মনে হয়, কে যেন পেছন থেকে তার ঘাড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে পেছন ফিরে তাকায় না। মাথা আরো নিচু করে কোরানশরিফের পাতা উল্টায়। পেছনে তাকালে সত্যি সত্যি যদি কিছু দেখা যায়! কী দরকার?

এক শ্রাবণ মাসের মধ্যরাতে রমিলার মুক্তি ঘটল। ফুলবানু হঠাৎ গোঙানি ধরনের শব্দ করে নিথর হয়ে গেলেন। রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ফুলবানুর ঘরের দরজা ভালোমতো বন্ধ করে পুকুরপাড়ে চলে গেল। গায়ে সাবান ডলে মনের আনন্দে সাতার কেটে পুকুরে গোসল করল। ভেতর বাড়িতে ফিরে এসে ভেজা কাপড় বদলে পাটভাঙা নতুন একটা শাড়ি পরল। চুল বঁধিল। চোখে কাজল দিল। সূর্য ডোবার পর আয়নায় নিজেকে দেখা নিষেধ, তার পরেও অনেকক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে সিদ্দিকুর রহমানের শোবার ঘরের বন্ধ দরজার কড়া নাড়ল। সিদ্দিকুর রহমান ভীত গলায় বললেন, কে? কে?

রমিলা শান্ত গলায় বলল, আমি। খারাপ সংবাদ আছে। আপনার দাদিজান মারা গেছেন।

কী সর্বনাশ! বলো কী! কখন?

এই তো কিছুক্ষণ। দরজা খোলেন।

তিনি দরজা খুলে স্ত্রীকে দেখে খুবই অবাক হলেন। মরা-বাড়িতে সে এত সাজপোজ করেছে কেন? তার কি মাথায় গোলমাল হয়েছে! যে-যন্ত্রণা তার উপর দিয়ে গিয়েছে মাথায় গোলমাল হবারই কথা।

রমিলা বলল, আপনি যান। মুনশি-মওলানা খবর দেন, আত্মীয়স্বজন খবর দেন। আমি কিছুক্ষণ শান্তিমতো ঘুমাব। অনেকদিন আমি শান্তিমতো ঘুমাইতে পারি না। কেউ যেন আমারে না ডাকে।

মরার সময় দাদিজান কি কিছু বলেছেন? অনেক সময় মৃত্যুর আগে-আগে জবানবন্ধ মানুষের জবান খুলে যায়। কথা বলে। দাদিজান কিছু বলেছেন?

হ্যাঁ, বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনি যেন আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তানটাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের সন্তান অন্যখানে মানুষ হবে এইটা কেমন কথা?

সত্যি বলেছেন?

রমিলা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না, দাদিজান কিছু বলেন নাই। মৃত্যুর সময় তার জবান খুলে নাই। এইটা আমার নিজের কথা। আপনার প্রথম স্ত্রীর ঘরে যে মেয়েটা আছে সে এখন কত বড়?

অনেক বড় হয়েছে। দশ-এগার বছর। সে আসবে না। আগেও কয়েকবার চেষ্টা করেছি। তার মামারা দেয় না। সেও আসতে চায় না।

আবার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। মেয়েটার নাম কী?

ভালো নাম লীলাবতী। সবাই লীলা বলে ডাকে।

বাহ, সুন্দর নাম– লীলা! তারা যদি দুই ভইন থাকত। তাইলে পরের ভইনের নাম হইত খেলা। দুই ভইনের একত্রে নাম— লীলা-খেলা।

বলতে বলতে রমিলা হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি। হাসির দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। একসময় সে হাসি সামলাবার জন্যে মুখে আঁচলাচাপা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। মাথার ঘোমটা খুলে শাড়ির আঁচল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, হাসে। কেন?

রমিলা বলল, জানি না কেন হাসি।

হাসি থামাও।

থামাইতে পারতেছি না।

সে হাসতেই থাকল।

রমিলার মাথা-খারাপের লক্ষণ সেদিনই প্রথম প্রকাশ পেল।



সন্ধ্যা নেমে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান আগের জায়গাতেই বসে আছেন। এখনো শীত নামার কথা না, কিন্তু শীত-শীত লাগছে। সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। একটা কলা থাকলে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে থাকা যেত। সেটা মন্দ হতো। না। গায়ের উপর হিম পড়ত। শীতের প্রথম হিমের অনেক গুণাগুণ আছে। আয়ুৰ্বেদিক কিছু ওষুধে প্রথম শীতের শিশিরের ব্যবহার আছে।

তিনি উঠে বসলেন। দীর্ঘ ঘুমের পরে শরীরে ভোতা ভাব চলে আসে, সেই ভাবটা আছে। হাত-পা ভারি-ভারি লাগছে। বাড়ির দিকে রওনা হতে ইচ্ছা! করছে না। বরং ইচ্ছা করছে রেললাইনের স্লিপারে পা দিয়ে হাটা শুরু করতে। তিনি একজন সুখী এবং পরিতৃপ্ত মানুষ। সুখী মানুষদের মধ্যেই হঠাৎ বৈরাগ্য দেখা দেয়। অসুখী মানুষরা সাধু-সন্ন্যাসী হয় না। তৃপ্ত পরিপূর্ণ মানুষরাই হয়। বৈষয়িক দিক দিয়ে তিনি সফল মানুষ না। বাড়ি-ঘর, দিঘি জলমহালের তাঁর যে বিশাল সাম্রাজ্য সেটাও পূর্বপুরুষের করে যাওয়া। তিনি পূর্বপুরুষের সম্পদ রক্ষা করে যাচ্ছেন। এর বেশি কিছু না।

ভোগী মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি তাও না। শহরবাড়ি নামের সুন্দর বাংলো বাড়ি ছেড়ে তিনি বাস করেন মূল বাড়িতে। মূল বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দুই দিকেই ঘন জঙ্গল। হাওয়া একেবারেই আসে না। গরমের সময় কষ্ট হয়। তালের পাখা পানিতে ভিজিয়ে বাতাস করতে হয়। গরমের সময় হাওয়া করার জন্যে তার নিজস্ব একজন লোক আছে। তার নাম বন্দু। সে সারারাত একতালে পাখা করে যেতে পারে। তিনি বন্দুকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। উত্তরবন্দে বন্দুকে তিনি দুই বিঘা ধানী জমি দিয়েছেন। মুখে-মুখে দেয়া না— দলিলপত্র করে দেয়া। দাতা হিসেবে তার কোনো সুনাম নেই। বিত্তবান মানুষরা এক পর্যায়ে স্কুল দেয়, মাদ্রাসা দেয়, নতুন মসজিদ বানায়। সিদ্দিকুর রহমান সেদিকে যান নি— তবে তিনি তাঁর নিজের খুব কাছের মানুষদের জন্যে অনেক করেছেন। লোকমান এবং সুলেমান এই দুই ভাইকেও এক বিঘা করে জমি দিয়েছেন। ঘর তুলে দিয়েছেন। এই দুই ভাই তাঁর পাহারাদার। এরা সারারাত বাড়ির উঠানে বসে থাকে। লোকমানের হাতে থাকে টোটাভরা দোনলা বন্দুক। সুলেমানের হাতে অলঙ্গা। তালকাঠ দিয়ে বানানো বর্শাজাতীয় অস্ত্ৰ। অলঙ্গাচালনায় সুলেমান অত্যন্ত পারদর্শী।

অতি বিত্তবান মানুষদের শত্রু থাকবেই। তারও আছে। উপগ্রহের মতো তারা তাকে ঘিরে পাক খায়। তাকে সাবধান থাকতে হয়। দিনের বেলা একা ঘুরে বেড়ালেও রাতে তা করা যায় না। লোকমান এবং সুলেমানকে সঙ্গে রাখতে হয়। তিনি সাবধান থাকেন।

রেললাইনের স্লিপারে পা দিয়ে অতি দ্রুত কে যেন আসছে। কুয়াশার কারণে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার হাঁটার ভঙ্গিতেই সিদ্দিকুর রহমান তাকে চিনলেন–লোকমান। তার খোজে আসছে। লোকমান জানে চেয়ারম্যান সাহেবের রেললাইনের পাশ ধরে হাঁটার অভ্যাস আছে। প্রথমে সে খোঁজ নিতে এসেছে রেল সড়কে।

তিনি গলা-খাকারি দিলেন। এতদূর থেকে গলা-খাকারির শব্দ শুনতে পারার কথা না। কিন্তু লোকমান ঠিকই শুনল। থমকে দাঁড়িয়ে গেল এবং মাথা সামান্য নিচু করে দ্রুত তার দিকে আসতে শুরু করল। সিদ্দিকুর রহমান এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করলেন। অর্থ-বিত্তের মতো লোকমানও এক ধরনের সম্পদ। এই সম্পদের গুরুত্বও কম না।

কোনো খবর আছে লোকমান?

জি-না।

মাগরেবের ওয়াক্ত কি হয়েছে? লোকমান চাঁদরের ভেতর থেকে হাত বের করে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। যদি হাতের পশম না দেখা যায় তাহলে সূর্য ড়ুবে গেছে। মাগরেবের নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম আকাশ লাল থাকতে থাকতে নামাজটা পড়ে ফেলতে হয়।

লোকমান বলল, জি, নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে।

নামাজের ব্যবস্থা করো। নামাজ পড়ে তারপর যাব। ওজুর পানি লাগবে না। ওজু আছে।

লোকমান অতি দ্রুত গাছের শুকনা পাতা সরিয়ে নিজের গায়ের চাঁদর পেতে দিল। গায়ের চাঁদর সরানোয় লোকমানের কাধে রাখা বন্দুক দেখা যাচ্ছে। সে বন্দুক মাঠে শুইয়ে রেখে ঝিম ধরার মতো করে বসে আছে। বন্দুকের মাথা পূর্বদিক করে রাখা। বন্দুকের মাথা কখনো পশ্চিম দিক করে রাখতে নাই।

সিদ্দিকুর রহমান নামাজ শেষ করলেন। অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি। সময় নিয়ে নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে দোয়া করলেন। অদ্ভুত দোয়া। তিনি বললেন, হে রহমানুর রহিম, তুমি রমিলার প্রতি তোমার রহমত প্ৰকাশ করো। তুমি তার মৃত্যু দাও। আমি তোমার পাক দরবারে তোমার বান্দার মৃত্যু কামনা করছি। এই অন্যায় দোয়ার জন্যে তুমি আমাকে ক্ষমা করো, ক্ষমা করো দয়াময়।

চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। বনের ভেতরে শিয়াল ডাকতে শুরু করেছে। গতবছর শিয়ালের ডাক প্রায় শোনেনই নি। এই বছর শিয়ালের উপদ্রব বেড়েছে। সমানে হাঁস-মুরগি খাচ্ছে। এত শিয়াল কোথেকে এসেছে কে জানে? বন্য পশুপাখি কখনো এক জায়গায় থাকে না। তারা জায়গা বদল করে। মানুষও তো এক অর্থে পশু। তার ভেতরেও জায়গা বদলের প্রবণতা আছে। কিন্তু সে জায়গা বদলায় না। সে চেষ্টা করে শিকড় গেড়ে বসতে। বাড়ি-ঘর বানায়। গাছপালা লাগায়। এমন ভাব করে যেন সে থিতু হয়েছে। অথচ সে কখনো থিতু হয় না। সে সবসময়ই জায়গা বদলের অস্থিরতা নিয়ে বাস করে।

সিদ্দিকুর রহমান চাঁদর থেকে নামলেন। চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!

লোকমান ছুটে এলো।

সাথে টর্চ আছে?

জি আছে।

চলো রওনা দেই।

জি আচ্ছা।

না গিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটি। উত্তরদিকে যাই।

জি আচ্ছা।

সিদ্দিকুর রহমান বকটা যো-জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে উপস্থিত হলেন। লোকমান কোনো কথা না বলে তার পেছনে পেছনে আসছে। একে বলে আনুগত্য। এ-ধরনের আনুগত্য আজকাল পাওয়া যায় না। তার ভাগ্য ভালো তিনি পেয়েছেন। তিনি যা করতে বলবেন লোকমান তা-ই করবে। কোনো প্রশ্ন করবে না। আচ্ছা, তিনি যদি লোকমানকে বলেন–লোকমান, তুমি রেললাইনের উপর বসে থাকে। আমি না বলা পর্যন্ত নড়বে না। ট্রেন গায়ের উপর এসে পড়লেও নড়বে না। তাহলে সে কি শুনবে?

লোকমান!

জি?

পান খেতে ইচ্ছা করছে। পানের বাটা নিয়ে আসো। আর সবাইকে বলে আসো, আমার ফিরতে সামান্য দেরি হবে।

একলা থাকবেন?

হ্যাঁ, একাই থাকব। কোনো অসুবিধা নাই। টর্চটা আমার কাছে দিয়ে যাও। শোনো লোকমান, আমি হাঁটা ধরছি। উত্তর দিকে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি এসে আমাকে ধরে।

কথা শেষ করার আগেই লোকমান প্ৰাণপণে দৌড়াতে শুরু করেছে। সিদ্দিকুর রহমান জানেন তিনি বেশিদূর যেতে পারবেন না, তার আগেই লোকমান উপস্থিত হবে। লোকমান একা আসবে না, সঙ্গে সুলেমানকে নিয়ে আসবে। তারা দুই ভাই তাঁর পেছনে পেছনে এগোতে থাকবে। এরা দুইজন যেন তার ছায়া। মানুষের একটা ছায়া পড়ে, তাঁর পড়ে দুই ছায়া।

সিদ্দিকুর রহমান হাঁটতে শুরু করলেন। রেললাইনের পাশেই বন। বনের ভেতর জমাটবাঁধা অন্ধকার। সেখানে জোনাকি পোকা জুলছে। একটা-দুটা জোনাকি না— শত শত জোনাকি। একসঙ্গে এত জোনাকি তিনি অনেকদিন দেখেন নি। শেষ কবে দেখেছিলেন মনে করার চেষ্টা করলেন। তাও মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে, তিনি ঘন জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে শত শত জোনাকি। কিছু জোনাকি তার নাকে-মুখে এসে পড়তে শুরু করল। জোনাকির শরীর থেকে ঝাঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কবে ঘটেছে এই ঘটনা? কবে?

কেউ কি রেললাইনে বসে আছে? সে-রকমই তো মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমানের হাতে টর্চ। টর্চের আলো ফেললেই ঘটনা। কী বুঝা যায়। কিন্তু তাঁর টর্চের আলো ফেলতে ইচ্ছা করছে না। জিন ভূত না তো? অঞ্চলটা খারাপ। অনেকেই কী সব দেখেছে–রেললাইন ধরে হেঁটে যায়। শিস বাজায়।

সিদ্দিকুর রহমান আরো কিছুদূর গেলেন। যে বসেছিল। সে উঠে দাঁড়িয়েছে। জিন হলে উঠে দাড়াত না। কুয়াশায়ে মিলিয়ে যেত।

কে?

ছায়ামূর্তি বলল, স্যার আমি।

এখানে কী করো?

ছায়ামূর্তি জবাব দিল না। মনে হয় তার কাছে জবাব নেই। সিদ্দিকুর রহমান এগিয়ে গেলেন। ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হলো। সে তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিল।

ছায়ামূর্তির নাম আনিস। সিদ্দিকুর রহমানের দুই মেয়ের জায়গির মাস্টার। এই লোকের একা একা রেললাইনে বসে থাকার অভ্যাস আছে সিদ্দিকুর রহমান জানতেন না। তাকে নিরীহ গোবেচারা ধরনের মানুষ বলেই জানতেন।

এখানে কী করছো?

কিছু করছি না। বসে ছিলাম।

তুমি কি প্রায়ই এদিকে আসো?

আনিস জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চলো আমার সঙ্গে। হাঁটি।

রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটাপথ। চাঁদের আলোয় রেললাইন চকচক করছে, সেই সঙ্গে পায়ে চলা পথও চকচক করছে। সিদ্দিকুর রহমান আগে আগে যাচ্ছেন। আনিস তার পেছনে। আনিসের গায়ে ছাইরঙা চাঁদর। দূর থেকে চাঁদরটা সাদা দেখাচ্ছিল। এর কী কারণ হতে পারে? সিদ্দিকুর রহমানের মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরছে।

আনিস!

জি স্যার।

বাংলা তারিখ কত?

কার্তিকের ছয় তারিখ। তেরশ সাতান্ন।

পড়েছিল। তিনি হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার সঙ্গে কি সিগারেট আছে?

আনিস অপ্ৰস্তৃত গলায় বলল, জি আছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দাও একটা সিগারেট খাই।

আনিস সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। অতি সস্তার বিক সিগারেট। সিদ্দিকুর রহমানের মতো মানুষের হাতে এই সিগারেট দেওয়া যায় না।

মাস্টার শোনো, আজ থেকে তিনশ বছর আগে আমার পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার নাম নওরোজ খাঁ। পাঠান বংশের মানুষ। তাঁর সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী এবং পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম লীলাবতী। নওরোজ খ্যা ঘন জঙ্গলের ভিতর ঘর বানিয়ে স্ত্রী এবং মেয়েটাকে নিয়ে থাকতেন। মেয়েটা কালাজ্বরে মারা যায়। জঙ্গলের ভিতর কোথাও তার কবর আছে।

আনিস কিছু বলল না। তার মাথায় একটা প্রশ্ন এসেছে। সিদ্দিকুর রহমানের নামের শেষে খা নাই কেন? প্রশ্নটা সে করল না। জায়গির মাস্টারের মুখে প্রশ্ন মানায় না। সিদ্দিকুর রহমান সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাশলেন। কাশির বেগ কমে এলে বললেন, আমার বড় মেয়ের নাম যে লীলাবতী এটা কি তুমি জানো?

জি না।

তার মা মেয়ের ওই নাম রেখেছিল। আমার কাছে গল্প শুনেই বোধহয় রেখেছে। নামটা সুন্দর না?

জি স্যার।

ডাক নাম লীলা। ভালো নাম লীলাবতী।

আনিস বলল, হিন্দু ধরনের নাম— লীলাবতী, কলাবতী।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, এটা ঠিক বলেছ। হিন্দুয়ানি নাম। আমার মাথায়ও এই প্রশ্ন এসেছে। নওরোজ খাঁ নামের এক পাঠান। তার মেয়ের নাম লীলাবতী রাখবে কেন?

আনিস বলল, হয়তো এই মেয়ে তার নিজের ছিল না। মেয়েটা হিন্দু ছিল। উনি তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছেন। তিনশ বছর আগে আইনকানুন কিছু তো ছিল না।

সিদ্দিকুর রহমান হাঁটা বন্ধ করে মাস্টারের দিকে তাকালেন। ছেলেটা গুছিয়ে কথা বলছে তো!

মাস্টার।

জি।

সন্ধ্যার সময় রেললাইনের উপর বসেছিলে কেন?

স্যার আপনাকে আরেক দিন বলব।

ঠিক আছে আরেক দিন শুনব।

আনিস বলল, আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে সিগারেটের তৃষ্ণা হয়েছে। আপনি যদি অনুমতি দেন একটা সিগারেট ধরাব।

ধরাও।

আর যদি বেয়াদবি না নেন। তাহলে আরেকটা কাজ করব।

কী কাজ?

রেললাইনের উপরে বসে থাকব।

থাকো। বসে থাকো।

সিদ্দিকুর রহমান এগিয়ে যাচ্ছেন। একবার পেছনে ফিরলেন— আনিস মাস্টার যে রেললাইনে বসে আছে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তবে তার ঠোঁটের জুলন্ত সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে।
 
আমার নাম আনিস। আনিসুর রহমান।

এই অঞ্চলে আমার অনেকগুলি নাম আছে— কুঁজা মাস্টার, গুঁজা মাস্টার। কুঁজা হয়ে হাঁটি এইজন্যে কুঁজা মাস্টার। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল গণি সাহেব আমাকে ডাকেন ভোঁতা-মাস্টার। সবসময় মুখ ভোঁতা করে রাখি বলে এই নাম। হ্যাঁ, আমি সবসময় মুখ ভোঁতা করে রাখি। মাঝে মাঝে মুখ ভোঁতা করে রেললাইনে বসে ভাবি— একটা ট্রেন এসে গায়ের উপর দিয়ে চলে গেলে কেমন হয়?

রেলগাড়ি ঝমাঝম
ভোঁতা মাস্টার আলুর দাম।

না হয় নাই, ছড়াটা আরো লম্বা–

আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি
ভোঁতা মাস্টার শ্বশুরবাড়ি
রেলগাড়ি ঝমাঝম
ভোঁতা মাস্টার আলুর দাম।

আলুর দাম হওয়া খারাপ কিছু না। সব সমস্যার সমাধান। আমার সমস্যা ভালো লাগে না, এইজন্যেই আমি সমস্যার ভিতর থাকি। যে যার নিন্দে, তার দুয়ারে বসে কান্দে। যে যা পছন্দ করে না তাকে তার মধ্যে থাকতে হয়। যেসব মানুষ আমি পছন্দ করি না— তারা থাকে আমার আশেপাশে। যেমন সিদ্দিকুর রহমান।

সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে আমি পছন্দ করি না। কেন করি না। আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার না। একটা কারণ হতে পারে মানুষটা ক্ষমতাবান। জমি-জমা, অর্থ-বিত্ত, লোক-লঙ্কর বিরাট রাজত্ব। আর আমি বেতনবিহীন কলেজের হতদরিদ্র ভোঁতা মাস্টার। দস্তয়োভস্কির উপন্যাসের চরিত্র। আমার নুন নাই পান্তাও নাই। তবে নুন পান্তা যে কাঁচামরিচ দিয়ে ডলে খেতে হয় সেই কাঁচামরিচটা আছে।

রেললাইনের উপর বসে আমি প্রায়ই ভাবি–একজন মানুষ যার নাম সিদ্দিকুর রহমান, সে দস্তয়োভস্কির নামও শুনে নাই। কিন্তু সে নিজে দস্তয়োভস্কির এক চরিত্র এবং সে এরকম আরো চরিত্র পুষছে। আমি আনিসুর রহমান সেরকম একটি চরিত্র। ভোঁতা মাস্টার, কুঁজা মাস্টার, গুঁজা মাস্টার। নাম নেই মানুষ। নাম থাকে না পশুদের। তাহলে আমি কি পশু গোত্রের কেউ? কিংবা ক্ৰমে ক্রমে পশু হয়ে যাচ্ছি?

গত সন্ধ্যাবেলায় আমি রেললাইনের উপর বসেছিলাম। হঠাৎ ভূতের মতো পেছন থেকে উদয় হলেন সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হলো। আমার কথাবার্তা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ছিল না। উপায় কী? অতি ক্ষমতাধর সামন্ত প্ৰভু প্রশ্ন করলে তাঁর ক্রীতদাসদের জবাব দিতে হয়। হ্যা আমি ক্রীতদাস। অবশ্যই ক্রীতদাস। তিনবেলা অন্নদান করে তিনি আমাকে কিনে নিয়েছেন। আমি তার অন্নদাস।

সিদ্দিকুর রহমান প্রশ্ন করলেন, সন্ধ্যাবেলা রেললাইনের উপর বসে আছ কেন?

আমি অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, স্যার, আপনাকে আরেকদিন বলব।

এই লোক আর চাপাচাপি করল না। চাপাচাপি করলে কিছু একটা বানিয়ে বলে দিতাম। যদিও আমার বলার ইচ্ছা ছিল–আমি রেললাইনে বসে থাকলে তোর কী? রেললাইন তোর তালুকের উপর দিয়ে যায় নাই। সরকারি রেললাইন। ইচ্ছা হলে আমি বসে থাকব। ইচ্ছা হলে শুয়ে ঘুমাব। আমার উপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যাবে।

হ্যাঁ, তুই তুই করেই বলতাম। সব মানুষ সমান। মেধায় বুদ্ধিতে একজন বড় একজন ছোট। অথচ আমরা মানুষ বিচার করার সময় তার মেধাবুদ্ধি দেখি না। আমরা দেখি মানুষটার টাকা পয়সা আছে কি-না। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই? এই অঞ্চলের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের নাম আব্দুল নুর— নূরের চাকর। এই নূরের চাকরের সঙ্গে গত শনিবার আমার দেখা। আমি উনাকে দেখে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি (এটা আমার স্বভাব।— আমি সবসময় চেষ্টা করি। সবাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে। বেশির ভাগ সময় সম্ভব হয় না।) উনি বললেন, মাস্টার সাহেব, আসসালামু আলায়কুম।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, ওয়ালাইকুম সালাম।

উনি গলা তীক্ষ্ণ করে বললেন, একজন মুসলমানের সঙ্গে আরেকজন মুসলমানের যখন দেখা হয় তখন সালাম দিতে হয়। এটা ইসলাম ধর্মের শিক্ষা।

আমি বললাম, জি জি।

উনি বললেন, যে বয়োকনিষ্ঠ সে আগে সালাম দিবে। এটাই ধর্মীয় বিধান। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু আপনি সালাম দেন না। এর কারণটা কী? জুমার দিন। আপনি জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন না, এর কারণ কী?

আমি বললাম, আমি আপনার মতো ভালো মুসলমান না, আমি খারাপ মুসলমান। এইজন্যেই যাই না।

পাঞ্চেগানা নামাজ পড়েন না?

জি-না।

আল্লা-খোদা বিশ্বাস করেন? না-কি তাও করেন না?

আমি জবাব দিলাম না। জবাব দিতে পারতাম। বলতে পারতাম, জি-না আমি আল্লাহ খোদা, ভগবান, জেসাস ক্রাইস্ট, গড কিছুই বিশ্বাস করি না। আমাকে মালেকভাই বলেছিলেন, শুধু নিজেকে বিশ্বাস করবি আর কিছুই বিশ্বাস করবি না। আমি কুঁজা মাস্টার আরো কুঁজা হয়ে গেলাম। মওলানা আব্দুল নূর কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর খড়খড়ে গলায় বললেন, চিন্তা করে জবাব দেন।

যে প্রশ্নগুলি এই মওলানা আমাকে করেছেন সেই প্রশ্ন তিনি কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে করবেন না। কারণ সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের হিসাব আলাদা। উনি প্রতিবছর গ্রামের একজন মানুষকে নিজ খরচে হজে পাঠান। মওলানা সাহেবকেও একদিন পাঠাবেন। আব্দুল নূর সেই অপেক্ষায় আছেন। মওলানা সাহেবের মাসিক একশত টাকা বেতনও তিনি দেন। সারা বৎসরের খোরাকির চাল দেন।
 
মওলানা আব্দুল নূর এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার প্রশ্নের জবাব না। শুনে তিনি যাবেন না। আমি বললাম, মওলানা সাহেব, আপনার বয়স সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের চেয়ে অনেক বেশি। ধর্মীয় নিয়মে পথেঘাটে দেখা হলে উনারই উচিত আপনাকে সালাম দেয়া। উনি তা করেন না। আগবাড়িয়ে সবসময় আপনি সালাম দেন। এর কারণ কী? উনি তো প্রায়ই জুম্মার নামাজেও যান না। এই প্রসঙ্গে কি আপনি তাঁকে কিছু বলেছেন?

একটু আগে মওলানা সাহেব আমার জবাবের অপেক্ষা করেছেন। এখন আমি তার জবাবের অপেক্ষা করছি। ফলাফল কেউ কারো প্রশ্নের জবাব দিলাম না। দুজনই মাথা নিচু করে দুদিকে চলে গেলাম।

আমি অভাজন ব্যক্তি। আমার ফটফট করে কথা বলা উচিত না। আমি বলিও না। মুখ বুজে থাকি। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয় তখন বলি। সমস্যা হলো আমার সারাক্ষণই মেজাজ খারাপ থাকে। তখন ইচ্ছা করে আশেপাশে যারা থাকে তাদের সবার মেজাজ খারাপ করে দেই। আমার মেজাজে কারো কিছু যায় আসে না। কেউ খেয়ালও করে না। শুধু সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের দুই মেয়ে খেয়াল করে। তারা আমার ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে।

দুই মেয়ের একজনের নাম কইতরী, আরেকজন জইতরী। কইতর হলো কবুতর। কবুতর থেকে কইতরী। তাহলে জাইতরীটা কী? জইতর বলে কোনো পাখি কি আছে? যে পাখির নাম থেকে এসেছে জাইতরী? না-কি নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম? সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারবেন না। গ্রামের মানুষদের চিন্তাভাবনা জমি-জমার বাইরে যায় না। তিনি তার বড়মেয়ের নাম রেখেছেন। লীলাবতী। এই নামের অর্থ কি তিনি জানেন? যে লীলা করে বেড়ায় সে-ই লীলাবতী। লীলা অর্থ কেলি, প্রমোদ। অর্থ ঠিকমতো জানলে সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের নাম লীলাবতী রাখতেন না।

লীলার কথা থাক। কইতরী জইতরীর কথা বলি। এই দুই কন্যাকে আমি প্রতি সন্ধ্যায় পড়াই। ওরা মাথা দুলিয়ে পড়ে, আমি তাদের সামনে মূর্তির মতো বসে থাকি। আমার বাম-হাতে থাকে একটা বেত। (বেতটা বাঁ-হাতে থাকার কথা না, ডান-হাতে থাকার কথা; কিন্তু আমি লেফটহ্যান্ডার। মালেক ভাইও লেফটহ্যান্ডার।) মেয়ে দুটি ভীত চোখে কখনো আমার দিকে তাকায় আবার কখনো বেতের দিকে তাকায়। কখন আমার হাতের বেত তাদের উপর নেমে আসবে তা তারা যেমন জানে না, আমিও জানি না। যে-কোনো কারণে আমার মেজাজ খারাপ হলে তার ফল ভোগ করে মেয়ে দুটি। তারা নিঃশব্দে কাদে। আমার ভালো লাগে। কাদুকা। সবাই কাঁদুক।

মেয়ে দুটির বয়স কত— এগার বারো, না-কি আরো কম? আমি জানি না, আমার জানতে ইচ্ছাও করে না। এদের গায়ে বেতের বাড়ি দেয়া নিতান্তই অনুচিত কাজ। আমি এই অনুচিত কাজটা করি। তাতে পরে যে আমার অনুশোচনা হয়, তা না। মেয়ে দুটি ভালো। তাদের উপর যে শারীরিক নির্যাতন হয়। সেই খবর তারা গোপন করে রাখে, কাউকে বলে না।

আমিও ভালো। আমার উপর যে মানসিক নির্যাতন চলে আমিও সেটা গোপন করে রাখি। রাস্তায় কেউ যখন জিজ্ঞেস করে— কুঁজা মাস্টার! যান কই? আমি ভদ্রভাবেই প্রশ্নের জবাব দেই। কখনো বলি না, কুঁজা না ডাকলে হয় না? ডাকুক। যার যা ইচ্ছা। আমি তো লোকালয়ে বাস করি না। আমি সভ্যসমাজের বাইরের এক ভূখণ্ডে বাস করি। যেখানে খবরের কাগজ আসে না। এইটুকু জানি, দেশের গভর্নর মোনায়েম খাঁ। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। যা জেনে এই অঞ্চলে এসেছিলাম তার বাইরে কিছু জানি না।

আমার জানার উপায়ও নেই। আমি ভাটি অঞ্চলের এক গর্তে ঢুকে গেছি। এই গর্ত থেকে বের হবার কোনো উপায় আমার নেই। অথচ এই আমি একসময় আন্দোলন করেছি। আহারে কী উত্তেজনার দিন! মধ্যরাতে দেওয়ালে চিকা মারা! চা খেতে খেতে গোপন মিটিং। বিপ্লব আনার মিটিং। বিপ্লব আনার রাস্তা করতে হবে। কারণ বিপ্লব খানাখন্দ দিয়ে আসে না, তাকে তোয়াজ করে আনতে হয়। তার জন্যে প্রশস্ত সড়ক দরকার।
 
সড়ক বানানোর কলাকৌশল জানতে একবার গেলাম ম্যালেক ভাই-এর কাছে। রোগা একজন মানুষ। চাঁদর দিয়ে সারা শরীর ঢাকা। ছোট গোল একটা মুখ চাঁদরের ভিতর থেকে বের হয়ে এসেছে। খাড়া নাক। তীক্ষ্ণ চোখ। মালেক ভাই বললেন, আল্লাহ বিশ্বাস করো?

আমি বললাম, জি করি।

তিনি বললেন, আল্লাহ যেসব মানুষকে সমান বানিয়েছেন এটা বিশ্বাস করো।

আমি বললাম, জি করি।

নাম কী?

আনিস।

শোনো আনিস, আল্লাহ সব মানুষকে সমান বানান নাই। কাউকে রূপবান বানিয়েছেন, কাউকে অন্ধ করে পাঠিয়েছেন। কাউকে বানিয়েছেন রাজা, কাউকে ক্রীতদাস। বুঝতে পেরেছ?

চেষ্টা করছি।

ভালোমতো চেষ্টা করো। যেদিন মাথা থেকে আল্লাহ খোদা ভগবান এইসব দূর করতে পারবে সেইদিন আমার কাছে আসবে। আমি তোমাকে পার্টির সদস্য করে নেব। তোমার মতো নির্বোধি পার্টির প্রয়োজন আছে।

এখন কি চলে যাব?

হ্যাঁ, চলে যাবে। তোমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার সময় আমার নাই।

একটা বই দিচ্ছি, বইয়ের একটা গল্পের নাম— ‘White nights’, লেখকের নাম দস্তয়োভস্কি। পরেরবার যখন আসবে গল্পটা পড়ে আসবে।

পরেরবার যখন গেলাম। তিনি বললেন, গল্পটা পড়েছ?

আমি বললাম, জি।

চোখের পানি ফেলেছ?

আমি হ্যা-সূচক মাথা নাড়লাম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, কতটুক পানি ফেলেছ? চায়ের কাপে এক কাপ না আধা কাপ?

মাপি নাই তো!

এখন থেকে সবকিছু মাপবে, দুঃখ মাপবে। আনন্দ মাপবে। বইটা ফেরত এনেছ?

জি।

আরেকটা বই নিয়ে যাও। পড়ে। এই বই পড়ে চোখে পানি আসে না, তবে আসতেও পারে। একেকজন মানুষ একেকরকম।

আমাকে বই পড়া শিখিয়েছেন মালেক ভাই। চিন্তা করতে শিখিয়েছেন মালেক ভাই। কী উত্তেজনাময় দিনই না গিয়েছে। একদিন আমাদের আস্তানায় পুলিশ এসে উপস্থিত। আমরা আগেই খবর পেয়ে পালিয়ে গেলাম। ধরা পড়লেন মালেক ভাই। উনার পায়ে সমস্যা, উনি দৌড়াতে পারেন না।

এখন আমার জীবনে কোনো উত্তেজনা নেই। উত্তেজনাহীন জীবনে সুনিদ্রা হবার কথা। আমার রাতে ঘুমাই হয় না। আমি রাত জেগে জেগে দস্তয়োভস্কির উপন্যাস ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট-এর বাংলা অনুবাদ করি।

It was towards evening on a sweltering day early
in July that a young man left the Cubicle sublet to
him S-Lane, went Out into the street and, with
slow and somewhat irresolute steps, made for
K-Lane.
 
জুলাই মাসের এক বিকেলে…

অনুবাদ আগায় না। আমার কাছে ইংরেজি ডিকশনারি নেই। অনেক শব্দের মানে আমি জানি না। Sweltering day অর্থ কী? আমার এখন এমনই অবস্থা সামান্য একটা ডিকশনারিও আমি কিনতে পারছি না। অথচ একসময় বড় বড় স্বপ্ন দেখতাম। বিপ্লবের সূতিকাগার মহান রাশিয়ায় যাব। রাশিয়ান ভাষা শিখব। মূল রুশভাষা থেকে অনুবাদ করব দস্তয়োভস্কি। আমার সব স্বপ্ন আমার সঙ্গে গর্তে ঢুকে গেছে। কোনোদিন যদি গর্ত থেকে বের হই। তাহলে কি স্বপ্নগুলি সঙ্গে নিয়ে বের হব, না-কি তারা গর্তেই থেকে যাবে?

এখন গর্তের ভেতর আমি আর কলেজ লাইব্রেরি থেকে আনা দস্তয়োভস্কির উপন্যাস ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট-এর মলিন একটা কপি। যে কপিটার আঠার, বিশ এবং বাইশ এই তিনটা পৃষ্ঠা পােকায় কাটা। আমি গর্তে বসে এই মহান উপন্যাসের অনুবাদ করি। ডিকশনারির অভাবে অনুবাদ আগায় না। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল গনি সাহেবকে লাইব্রেরির জন্যে ডিকশনারি কিনতে বলেছিলাম। উনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, ফান্ড নাই। কোনো শব্দের অর্থ জানতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন। মেট্রিকে আমি ইংরেজিতে সিক্সটি ফোর পেয়েছিলাম। সেই সময় এইটাই ছিল হাইয়েস্ট।

সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে বললে তিনি নিশ্চয়ই ময়মনসিংহ থেকে ডিকশনারি আনিয়ে দেবেন। কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছা করে না। প্রায় মুর্থ মানুষদের সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। আমার দল আলাদা। মূর্খদের সঙ্গে কথা বলার মানে সময় নষ্ট। মূর্থের কথা শুনবে আরেক মূর্খ। জ্ঞানীর কথা শুনবে জ্ঞানী। সিদ্দিকুর রহমানের কথা শুনবে সুলেমান-লোকমান। আমার কথা শোনার মানুষ। আপাতত নেই। কোনো একদিন হয়তো হবে। না হলেও ক্ষতি নেই।

সিদ্দিকুর রহমান মানুষটাকে মূর্খ বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। মানুষটার মধ্যে কিছু রহস্যময়তা আছে। তিনি একা একা নদীর পাড়ে হাঁটেন। জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। রহস্যময় মানুষ পুরোপুরি মূর্থ হয় না। এই লোকও নিশ্চয়ই মূর্খ না। তারপরেও তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কারণ তিনি অন্যের কথা শুনতে পছন্দ করেন না। নিজে কথা বলতে পছন্দ করেন।

মাঝে মাঝে রাতে খাবার সময় তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে যান। তার সঙ্গে খানা খেতে হবে। তখনই আমি বুঝি আমাকে তিনি কিছু শুনাতে চান। আমি জানি তিনি আমাকে যে গল্প শুনাতে চান সেই গল্পের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ তৈরি হবে না। তারপরেও অতি বিনয়ের সঙ্গে গল্প শুনতে হবে।

মাস্টার।

জি।

পানিতে মানুষের মতো কোনো সম্প্রদায় কি বাস করে?

আপনার প্রশ্নটা বুঝলাম না। পানিতে যাযাবর সম্প্রদায় বাস করে। নৌকায় নৌকায় ঘুরে।

আমি বেদের কথা বলছি না। পানির নিচে থাকে। মাঝে মাঝে তাদের দেখা যায়।

আপনি কি মৎস্যকন্যাদের কথা বলছেন?? রূপকথার বইয়ের মৎস্যকন্যা?

না, মৎস্যকন্যা না। পানির নিচে বাস করে। মানুষের মতো, অথচ মানুষ না।

আপনার প্রশ্নটাই বুঝতে পারছি না।

তাহলে থাক। খানা খাও।

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খানা খেতে বসি। এই লোক থাকুক পানির নিচের অদ্ভুত জিনিস নিয়ে। যে জিনিস অর্ধেক মানুষ অর্ধেক অন্যকিছু। আমার প্রয়োজন পূর্ণমানুষ। অর্ধেক মানুষ না।

সিদ্দিকুর রহমান নামের মানুষটা যে আমাকে পছন্দ করেন এটা আমি বুঝতে পারি। মানুষের ঘৃণা যেমন বুঝা যায়, ভালোবাসাও বুঝা যায়। মালেক ভাই আমাকে পছন্দ করতেন। তিনি কিছু না বললেও তার পছন্দ বুঝতে পেরেছিলাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তুই তো বাঁ-হাতি, আমিও বাঁহাতি। ইন্টারেস্টিং তো।

আমি বললাম, ইন্টারেস্টিং কেন?

তিনি বললেন, যারা দোজখে যাবে তারা যে সেখানে বা-হাত ব্যবহার করবে, এটা জানিস?

জানি না তো!

পড়াশোনা না করলে জানাবি কীভাবে? পড়াশোনা কর।
 
মালেকভাই কেন আমাকে পছন্দ করতেন সেটা বের করতে পারি নি। আমি কেন তাঁকে পছন্দ করতাম সেটা বের করেছি। আমি তাঁর কথা শুনে চমৎকৃত হতাম। মানুষকে চমৎকৃত করার কৌশলটা আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি।

এই কৌশল আমি সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের উপর মাঝে মাঝে প্রয়োগ করি। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের মতো মানুষরা চমৎকৃত হতে পছন্দ করেন। তার চারপাশে চমৎকৃত হবার মতো কিছু নাই। জলমহালের বন্দােবস্তা। ফসল কাটা। ফসল তোলা। জমি কেনা। বাজারের ঘরের বিক্রি-বাটা দেখা। পাটের মৌসুমে পাটের ব্যবসা। গুড়ের মৌসুমে গুড়। ধনী থেকে আরো ধনী হবার মতো বিষয়। চমৎকৃত হবার মতো কিছু না।

এই লোকের বিশাল বাড়ি। একটা না, কয়েকটা। একেকটার একেক নাম— শহরবাড়ি, বাংলা বাড়ি, মূল বাড়ি। আবার নদীর কাছে একটা বাড়ি

এখন শুনছি জঙ্গল কিনবে। কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে খানা খাচ্ছি। উনি হঠাৎ বললেন, জলপাইগুড়ির জঙ্গল কখনো দেখেছ?

আমি বললাম, না।

উনি বললেন, আমি যৌবনে একবার গিয়েছিলাম। দুই রাত দুই দিন ছিলাম। গহীন জঙ্গল। বন্য বরাহ, হাতি, গণ্ডার, নীল গাই। নিজের চোখে দেখেছি। এরকম একটা জঙ্গল কিনতে পারলে আর কোনো আফসোস থাকত না।

আমি বললাম, জঙ্গল কিনতে চান?

হুঁ। একা একা জঙ্গলে হাঁটব। গাছপালা, বন্য ফুল, পশুপাখি দেখব। আর চমৎকৃত হব।

তাঁকে চমৎকৃত করার মতো অনেক কিছুই আমি করতে পারি। কিন্তু আমি করি না। মানুষকে চমকে বেড়ানো আমার কাজ না। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে চমকে দেবার মতো কথা আমি অনেক বলতে পারি। যেমন আমি বলতে পারিআপনাদের এক পূর্বপুরুষ হামিদুর রহমান বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। কেন পেয়েছিলেন। আপনি কি জানেন? আমি জানি। তিনি চারজন স্বদেশীকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। চারজনের মধ্যে তিনজনই ছিল মুসলমান। এরা পুলিশের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে তাঁর ঢাকায় টিকাটুলি এলাকার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। চারজন স্বদেশীর তিনজনের ফাঁসি হয়ে যায়। একজনের হয় কালাপানি। আর উনার হয় খান বাহাদুর উপাধি। রাজভক্তির পুরস্কার।

আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমি ইতিহাস খুঁজে বেড়াই।

সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বড় কন্যা লীলাবতী বিষয়েও কিছু কথা বলে আমি তাঁকে চমৎকৃত করতে পারি। লীলাবতী ছিল সপ্তম শতকের বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ পণ্ডিত ভাস্করাচার্যের একমাত্র কন্যা। ভাস্করাচার্য গণিত বিষয়ে দুটি বিখ্যাত গ্ৰন্থ রচনা করেন। একটির নাম সিদ্ধান্ত শিরোমণি আর অন্যটির নাম লীলাবতী। তিনি চেয়েছিলেন তার আদরের একমাত্র কন্যার নাম পৃথিবীতে স্থায়ী হয়ে যাক। কন্যার নামে অতি জটিল গণিত বইয়ের নাম আর কোনো গণিতজ্ঞ রাখেন নি।

কী সুন্দর গল্প! সিদ্দিকুর রহমান এই গল্প শুনলে বিশেষভাবে চমৎকৃত’ হয়ে বলতেন— এই গল্প তোমাকে কে বলেছে?

তার উত্তরে আমি বলতাম, বই বলেছে। আমি বইপড়া লোক। জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার দেখা লোক না। জন্তু-জানোয়ার দেখে চমৎকৃত হওয়া যায়, কিছু জানা যায় না। ভাস্করাচার্য কেন অঙ্ক বই-এর নাম লীলাবতী রাখলেন সেই গল্পটা আরো ভালোমতো শুনতে চান?

সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বলতেন, শুনতে চাই।

তখন আমি বলতাম, তাহলে আমার সঙ্গে চলুন। সন্ধ্যার পর যখন কুয়াশা ঘন হয়ে পড়বে তখন দুজনে রেললাইনে পা তুলে বসব। দুজনের হাতে থাকবে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট টানতে টানতে গল্প করব। রাজি আছেন? কী, কথা বলেন না কেন? রাজি?
 
০৩
কার্তিক মাসের সকাল।

সিদ্দিকুর রহমানের গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। তিনি কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টিতে একধরনের মুগ্ধতা আছে। মুগ্ধতার কারণ এই বছর শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে। হাজার হাজার ফুল। গত বছর এবং আগের বছর গাছে কোনো ফুল ফুটে নি। শিউলি গাছ মাঝেমধ্যে ফুল দেয়া বন্ধ করে এটা তার জানা ছিল না। ফল গাছের ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায়। সব আমগাছে প্রতিবছর মুকুল আসে না। ফুল গাছের ক্ষেত্রে এই ব্যাপার কখনো ঘটে না। ফুল ফুটানো তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক।

সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন শহরবাড়ির সামনে। এই বাংলো ধরনের বাড়ি তার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান বানিয়েছিলেন। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ফুলার কটেজ। পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রথম লে. গভর্নর ফুলার সাহেবের নামে বাড়ি। বাড়ির ডিজাইন করা হয়েছিল গভর্নর সাহেবের ইংল্যান্ডের বাড়ির ছবি দেখে। বাড়ির সামনে তিনি চেরিগাছও লাগিয়েছিলেন। গাছগুলি বাঁচে নাই।

হামিদুর রহমানের ধারণা ছিল বাড়ি দেখে ফুলার সাহেব মুগ্ধ হবেন। শুধু তার এক রাত থাকার জন্যে কেউ এত আয়োজন করবে। এটা নিশ্চয়ই তিনি ধারণা করে বসে ছিলেন না। ফুলার সাহেবের ময়মনসিংহের নেত্রকোনার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসতে চাওয়ার পেছনের কারণ পাখি শিকার। সাহেব নিরামিষাশী হলেও পাখি শিকারের প্রচণ্ড নেশা ছিল। রাজকার্যের বাইরে তিনি পাখি শিকারের জন্যে অনেক সময় বের করতে পারতেন।

খান বাহাদুর হামিদুর রহমান গভর্নর সাহেবের পাখি শিকারের জন্যে বিপুল আয়োজন করিয়েছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি সুসং দূর্গাপুরের মহারাজার কাছ থেকে নান্দিনা নামের একটা মাদি হাতি কিনে নেন। গভর্নর সাহেব হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যাবেন। তার জৌলুসাই আলাদা। জামালপুর থেকে কারিগর। এনে দুটা পালকি বানানো হয়। যে-সব জায়গায় হাতি যাবে না সে-সব জায়গায় পালকি যাবে। মুন্সিগঞ্জ থেকে একটা বজরা কিনে আনেন। নদীতে বজরা বাধা থাকবে। বজরায় পান ভোজনের ব্যবস্থা। বরফকলের বরফ, স্কচ হুইস্কি। সাহেবরা মদ্যপান ছাড়া কোনোরকম খেলাধুলাই করতে পারেন না। বাঙালির যেমন পান-সুপারি সাহেবদের সেরকম বরফ-মদ।

গভর্নর সাহেবের পছন্দের খানা তৈরির জন্যে কোলকাতার আলীপুর থেকে একজন ফিরিঙ্গি বাবুর্চি আনা হয়। বাবুর্চির নাম হর্নথন।

লেফটেনেন্ট গভর্নর ফুলার শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাখি শিকারে আসেন নি। তিনি স্বদেশী আন্দোলনকে কঠিন হাতে দমন করতে গিয়ে কংগ্রেসী নেতাদের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেন। তাকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। লর্ড মিন্টো ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। গভর্নর সাহেবের পদত্যাগে ভারতবর্ষে যে মানুষটি সবচে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি সম্ভবত খান বাহাদুর হামিদুর রহমান। অনেকের ধারণা লাট সাহেব তাঁর বাড়িতে আসেন নি এই শোকে সেই বছরই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর একমাত্ৰ সন্তান হাসানুর রহমানের বয়স তখন মাত্র দশ। অতি দ্রুত পরিবারটি ধ্বংসের মুখোমুখি এসে পড়ে। নানান পাওনাদার এসে জুটে। একজন এসে জোর করে হাতি নিয়ে চলে যায়। একজন নিয়ে যায় বজরা। জমিজমা নিয়েও দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা মামলা শুরু করে দেন।

বিস্ময়কর ঘটনা হলো বালক হাসানুর রহমানের পাশে সে সময় যে মানুষটি এসে দাঁড়ায় সে ফিরিঙ্গি বাবুর্চি হর্নথন। তার মুখে একটাই বুলি— I will kill all the bastards বন্দুকসে গোলি মারদুঙ্গা। হর্নথন এই বাড়িতেই মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যান। গ্রামের মানুষরা তাকে ডাকত হন্টন সাহেব। হন্টনের আগে একটি বিশেষণও ব্যবহার করত— পাগলা। পাগলা হন্টন। বাড়ির নামও লোকজন পাল্টে দিল। বাংলো বাড়ির নাম হয়ে গেল— শহরবাড়ি। এই বাড়ির সামনে এসে দাড়ালে অঞ্চলটাকে শহর মনে হয়। গ্রাম মনে হয় না। কাজেই বাড়ির নাম শহরবাড়ি।
 
কুয়াশার ভেতর দিয়ে রোদ এসেছে। কুয়াশা ভেজা রোদ। সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে মুখ ফিরালেন। পাগলা হন্টন শেষ বয়সে এই কাজটা করতি–ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমানের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে এই মানুষটার আশেপাশে। সে হড়বড় করে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে যেত। বালক সিদ্দিকুর রহমান ইংরেজি কিছুই বুঝত না কিন্তু মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনন্ত। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পাগলা হন্টন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান করত। কিছু কিছু গান সিদ্দিকুর রহমানের এখনো মনে আছে—

I adore thee
l Serve thee
Fall before thee

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। পাগলা হন্টন সাহেবের কথা মনে হলেই তার মন খারাপ লাগে। এও এক রহস্য। তার কত প্ৰিয়জনই তো মারা গেছেন। তাদের কথা এরকম হুটহাট করে মনে আসে না। আর মনে এলেও মন খারাপ হয় না। তিনি ডাকলেন, সুলেমান!

সুলেমান সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি।

আজি কী বার?

বিষুদৃদবার।

আজ তো রমিলার স্নানের দিন।

জি।

নতুন সাবান আছে না?

জি।

রমিলাকে সপ্তাহে একদিন স্নান করানো হয়। এই স্নান তিনি নতুন সাবান ছাড়া করেন না। খুবই আগ্রহ করে তিনি সাবানের মোড়ক খুলেন। কিছুক্ষণ গন্ধ নেন।



রমিলার ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে রোদ এসে খাটে পড়েছে। তিনি সাবধানে রোদে হাত রাখলেন। তার ভাবটা এরকম যেন এটা রোদ নাআগুন। আগুনে হাত রাখলে পুড়ে যাবে। তিনি আঙুল বন্ধ করছেন এবং ফাক করছেন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে রোদ খাটের চাঁদরে পড়ছে এবং বন্ধ হচ্ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে।

তিনি কিছুক্ষণ এই খেলা খেললেন। দূর থেকে কইতরী তাকে লক্ষ করছে। কইতরীর চোখে কৌতূহল এবং ভয়। তার সামান্য মনখারাপ হলো। কইতরী তারই মেয়ে। অথচ মায়ের ভয়ে সে অস্থির। তিনি হাত ইশারায় মেয়েকে ডাকলেন। কইতরী ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা তো অনেক বড় হয়েছে। সুন্দরও হয়েছে। যতই দিন যাবে। এই মেয়ে ততই সুন্দর হবে।

মাগো, তোমার ব্যাপজান কই জানো?

না।

খোঁজ নিয়া বাইর করতে পারবো?

হুঁ।

তোমার বাপজানরে বলো তালা খুঁইল্যা আমারে যেন বাইর করে। আইজ আমার মাথা ঠিক আছে।

আইচ্ছা।

তোমার বয়স কত হইছে মা?

এগার।

মাশাল্লাহ।

তার খুব ইচ্ছা করছে মেয়েকে একটা প্রশ্ন করতে। লজ্জায় করতে পারছেন না। একটা বিশেষ সময় থেকে মেয়েরা যে শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়— তার দুই মেয়ে কি তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? কোনো মা মেয়েদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পান না। তিনি পাচ্ছেন কারণ তিনি সাধারণ মা না। তিনি পাগল মা।

কইতরী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় মার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। ভালো লাগলেও তার চোখ থেকে ভয় যায় নি।

তোমার ভাইন জাইতরী কই?

শহরবাড়িত।

তারেও ডাক দিয়া আনো। তোমরার দুই ভইনের মাথাত আমি তেল দিয়া দিব।

আচ্ছা।

তোমার ভাই মাসুদ কই?

জানি না।

তারেও খবর দেও। অনেক দিন তারে দেখি না।

আচ্ছা খবর দিব।
 
কইতরী চলে যাচ্ছে, রমিলা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত মুগ্ধ হয়ে ছেলেমেয়ের দিকে তাকানো ঠিক না। নজর লেগে যায়। বাপ-মায়ের নজর–কঠিন নজর রমিলা মনে মনে বললেন, আল্লাগো মাফ করো। মাকুন্দগো আমার নজর যেন না লাগে।

তিনি নজর না লাগানোর জন্যে অন্যদিকে তাকাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মেয়ের উপর থেকে নজর সরাতে পারছেন না।

মেয়ে যে ফ্রকটা পরে আছে তার রঙ সুন্দর– হলুদ। হলুদ মেয়েদের রঙ। এই রঙ পুরুষের জন্যে নিষেধ। কেন নিষেধ কে জানে! ভালো মুনশি মাওলানা পেলে জিজ্ঞেস করে দেখতেন। যখন তার মাথা ঠিক থাকে তখন অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে। কথা বলার মতো একজন কেউ যদি থাকত!

তিনি খাট থেকে নামলেন। তার হাঁটতে ইচ্ছা করছে। ঘরের তালা না। খোলা পর্যন্ত তিনি ঘরের ভেতরই কিছুক্ষণ হাঁটবেন বলে ঠিক করলেন। ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া এবং ফিরে আসা। তার ঘরটা বেশ বড়। ঘরের একমাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে হলে একশ তিনি কদম পা ফেলতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই তিনি হাঁটেন চোখ বন্ধ করে। খাটটা ছাড়া এই ঘরে অন্যকোনো আসবাব নেই। কাজেই চোখ বন্ধ করে হাঁটতে অসুবিধা হয় না। বরং একটা সুবিধা হয়–চোখ বন্ধ করে হাটলে তিনি অনেক রকম গন্ধ পান। পশ্চিমের দেয়ালের কাছে গেলে কাঠ পচা গন্ধ এবং ন্যাপথিলিনের গন্ধ পান। যখন উত্তর দেয়াল ঘেঁসে হাঁটেন তখন পান আতরের গন্ধ। পূর্বদিকের জানালার কাছে এলেই নাকে আসে কাঁচা ঘাসের গন্ধ।

সিদ্দিকুর রহমান ঘরের তালা খুলতে খুলতে বললেন, ভালো আছ?

রমিলা মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেন, হু।

সিনান করবে? গরম পানি দিতে বলব? আজ বিষ্যুদবার।

সিনান সইন্ধ্যাকালে করব। আজ সিনান কইরা নয়া একটা শাড়ি পরব।

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে তাকালেন। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন— নিয়া শাড়ি কেন? জিজ্ঞেস করলেন না।

রমিলা স্বামীকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন। এখন মাথা আরো নিচু করে গুটিসুটি পাকিয়ে ফেললেন।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, রান্না করতে মন চায়? রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে দিতে বলব?

না। মেয়ে দুটিার মাথায় তেল দিয়ে দিব।

বসবে কোথায়?

এক জায়গায় বসলেই হবে।

আমি কি থাকব। আশেপাশে?

দরকার নাই। আমার শরীর আজ ভালো।

বিশেষ কিছু কি খেতে ইচ্ছা করে? ইচ্ছা করলে বলো ব্যবস্থা করি। তোমার যখন মাথা ঠিক থাকে না তখন তো খেতে পারো না। আজ আরাম করে খাও।

সইন্ধ্যাকালে খাব।

রমিলা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় চলে এসেছেন। সিদ্দিকুর রহমান তাঁর পেছনে পেছনে আসছেন। রমিলাকে তালা খুলে বের করা ঠিক হয়েছে কি না।

বুঝতে পারছেন না। রমিলা সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে না। বারান্দার শেষ মাথা পর্যন্ত সে এসেছে চোখ বন্ধ করে।

রমিলা!

জি।

তোমার শরীর কি আসলেই ঠিক আছে?

হুঁ।

রমিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে স্বামীর দিকে সরাসরি তাকালেন। ফিসফিস করে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলব।

আইজ রাইতে একটা ঘটনা ঘটব।

কী ঘটনা?

সেইটা আপনেরে বলব না। ঘটনা ঘটনের পরে আপনের দিল খোশ হইব। এই জন্যেই আমি নয়া শাড়ি চাইছি।

নতুন শাড়ির ব্যবস্থা করতেছি। শোনো রমিলা, আমি তোমার আশেপাশেই আছি। মাথার মধ্যে উনিশ-বিশ কিছু যদি টের পাও আমারে ডাকবা।

আচ্ছা।
 
রমিলা খুব যত্ন করে দুই মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। চুল টেনে ফিতা দিয়ে বেঁধে দিলেন। মেয়েদের বুদ্ধি পরীক্ষার জন্যে কয়েকটা সিমাসা দিলেন। কঠিন সিমাসা। বুদ্ধি থাকলে ভাঙানো যাবে। বুদ্ধি না থাকলে না।

বলো তো মা, জিনিসটা কী?

কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?

জইতরী-কইতরী দুজন একসঙ্গে বলল, পারব না।

আচ্ছা আরেকটা ধরি।

জইতরী বলল, প্রথমটা আগে ভাঙাও।

রমিলা বললেন, সবগুলা পরে একসঙ্গে ভাঙায়ে দিব। এখন আরেকটা শোনো—

আকাশে উড়ে না পক্ষী উড়ে না জঙ্গলে
এই পক্ষী উড়ে শুধু শনি মঙ্গলে।

পারব না।

তাহলে এটা ভাঙাও

মহাকবি কালিদাসের অতি আজব কথা
নয় লক্ষ তেঁতুল গাছের কয় লক্ষ পাতা?

পারব না।

দেখ এইটা পার কি-না—

তিন অক্ষরে নাম তার বৃহৎ বলে গণ্য
পেটটা তাহার কেটে দিলে হয়ে যায় অন্ন।

কইতরী আনন্দিত গলায় বলল, এইটা পারব। এটা ভারত। ভারতের পেট কাটলে হয়। ভাত।

হইছে। মা, তোমার খুব বুদ্ধি।

কইতরী বিড়বিড় করে বলল, মা, তুমি কি ভালো হয়ে গেছ?

রমিলা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললেন, এখন ভালো। মন্দ হইতে কতক্ষণ!

কইতরী বলল, শহরবাড়ি যাইবা?

না।

কইতরী বলল, তেঁতুল খাইবা? গাছ পাকনা তেঁতুল।

রমিলার তেঁতুল খেতে ইচ্ছা করছিল না, তারপরেও বললেন, আনো দেখি।

দুই মেয়েই দৌড়ে চলে গেল। লোকমানকে দেখা যাচ্ছে। সে অনেকক্ষণ থেকেই আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। পরপুরুষের সামনে পর্দা করা উচিত। কিন্তু লোকমান তাকে মা ডাকে। পুত্রের সামনেও কি পর্দার বিধান আছে? রমিলা মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে লোকমানকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। লোকমান প্রায় ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।

কেমন আছ লোকমান?

আম্মা, ভালো আছি।

ঘরদোয়ার বড়ই অপরিষ্কার। ঝাড় পোছ দেও। কুটুম আসব।

কে আসব আম্মা?

রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যখন আসব তখন জানিবা। এখন সামনে থাইকা যাও।

রমিলা চোখ বন্ধ করলেন। তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ভোঁতা ধরনের চাপ ব্যথা। লক্ষণ মোটেই ভালো না। এই ব্যথা বাড়তে থাকবে। তারপর হঠাৎ করেই ব্যথা বোধ থাকবে না। শুরু হবে ভয়ঙ্কর সময়। যে সময়ের কোনো হিসেব তার কাছে থাকবে না। রমিলার উচিত অতি দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। তার মন খারাপ লাগছে, মেয়ে দুটি আগ্রহ করে তেঁতুল আনতে গিয়েছে। এই তেঁতুল তারা দিতে পারবে না। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে মেয়েদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।

এই তো তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। মেয়ে দুটাই তো সুন্দর হয়েছে। কই তরী একটু বেশি সুন্দর। শুধু যদি চুল কালো হতো! এই মেয়ের চুল। লাল। মেয়েদের লাল চুল ভালো না।

লাল চুলের মেয়েদের দিকে জিন-পরীর নজর থাকে।

বলে আমারো যেন তালাবন্ধ করে। আমার মাথা নষ্ট হইতে শুরু করছে।

জইতরী-কইতরী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রুমিলা ক্লান্তগলায় বললেন, তোমরা সাজগোজ কইরা থাকবা। বাড়িতে কুটুম আসতেছে।

কইতরী বলল, কুটুম কে মা?

রমিলা বললেন, তোমাদের বড় ভইন। তার নাম লীলা। লীলাবতী।

তোমারে কে খবর দিছে মা?

কেউ খবর দেয় নাই। আমি আগে আগে কিছু কিছু জিনিস জানি। ক্যামনে জানি বলতে পারব না।

রমিলা তেঁতুল হাতে নিয়ে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। আর দেরি করা ঠিক না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top