What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গর্ভধারিণী - সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গর্ভধারিনী
লেখক- সমরেশ মজুমদার

০১.
টেলিফোনটা বাজছিল। মুখ তুলে দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল জয়িতা। এগারোটা দশ। অবশ্যই এই ফোনটা ওর জন্যে নয়। ওর বন্ধুরা কেউ এই সময়ে ফোন করবে না। যদি কোনও বিপদ আপদ হয় তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু বিপদ আপদের আশু সম্ভাবনা তো ছিল না। অতএব এই ফোনটি সীতা রায়ের। যদিও সীতা রায় এখনও বাড়িতে নেই, কখন ফিরবেন তারাই জানেন না এবং তার ওপর আজ যখন শনিবারের রাত তখন ওই টেলিফোন নিয়ে মাথাব্যথা করার কোনও মানে হয় না। অবশ্য করাত চালানোর মত শব্দটা বেজে যাচ্ছে। যে করছে তার ধৈর্য আছে। না ধরিয়ে ছাড়বে না।এই বাড়িতে দুটো কাজের লোক আছে। একজন দৈনিক আর একজনের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে আছে। কাজকর্ম ঠিকঠাক করে কিন্তু কানে শুনতে পায় না। সীতা রায়ের অবশ্য শ্রীহরিকে ওই কারণেই পছন্দ। বাড়ির কথা বাড়ির বাইরে যাবে না। কিন্তু মুশকিলটা হল টেলিফোনের আওয়াজটা শ্রীহরিকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। খানিক আগে ডাইনিং টেবিলে খাবার দিয়ে তিনি চলে গেছেন নিজের ঘরে। অতএব উঠতে হল জয়িতাকে। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্পোর্টস গেঞ্জি আর জিনসের টাইট প্যান্টে ওকে আরও রোগা দেখায় কিন্তু শাড়িটারির চেয়ে এই পোশাকই ভাল লাগে জয়িতার।রিসিভারটা অত্যন্ত অযত্নে কানে তুলে জয়িতা বলল, হ্যালো!একটু থিতনো ওপাশে, তারপর হাসির মাড় লাগানো কড়কড়ে শব্দ বাজল, উঃ কি ঘুম বাবা, এগারোটা বাজতে না বাজতেই যদি প্রেসিডেন্সির মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে কি করে চলবে! রিসিভার ধরে আমার হাতব্যথা হয়ে গেল।জয়িতার চোখ ছোট হল। সে কেটে কেটে উচ্চারণ করল, ঠিক কত নম্বর চাইছেন?আঃ কাম অন বেবি! তুমি তো জয়িতা, রামানন্দের মেয়ে?হ্যাঁ। তাই বলা হয়ে থাকে আমাকে।বলা হয়ে থাকে? হাসির তুবড়ি আকাশ ছুঁল এবার, সাবাস। শুনেছিলাম তুমি নাকি খুব স্মার্ট, শাড়ি ব্লাউজ পরো না, বাট আই হ্যাভ নেবার সিন ইউ অ্যারাউন্ড! রামানন্দ একটু আগে বলছিল তুমি খুব রোগা, খুব?জয়িতা বাঁ দিকে তাকাল। সেখানে বেলজিয়ামের আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে। পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির একটা দাঁড়ি। নো বাঁক, মাংসের বাড়তি চমক কোথাও নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে তার কোনও রোগ নেই। ভাল হজম হয়, চমৎকার ঘুম হয়, এবং মেয়ে বলেই সারামাসের চারদিনের যন্ত্রণাটা নিয়ম মেনেই ঘটে যায়। সে প্রেসিডেন্সিতে শতকরা চুরাশি নম্বর পেয়ে ঢুকেছিল। তার কোনও শারীরিক অসুবিধে নেই। অথচ এই মহিলা মাঝরাতে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন সে খুব রোগা কিনা! হু ইজ সী?প্রশ্নটা করা মাত্রই মহিলা জবাব দিলেন না। বললেন, আসলে ব্যাপার কি জানো, আমার মনে হল তুমি এখন একা আছ। আমি জানি একজন কবিরাজকে। তার ওষুধ খেয়ে অনেকেই মোটা হয়েছে। মেয়েদের মোটা না হলে ভাল দেখায়, বল?আর ইউ ড্রাঙ্ক?ওমা, আমার কথা শুনে তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি! না ভাই, আমি ড্রিঙ্ক করি না, তবে খেতে চাইলে খাওয়াই। আসলে তোমার ওপর আমার স্নেহ, আই মিন, এক ধরনের অ্যাটাচমেন্ট এসে গেছে বলতে পার। জয়িতা, তোমাকে আরও বড় হতে হবে। আরও বড়। মন দিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। তুমি জে. ই. দিলে না কেন?জয়িতা ঠোঁট কামড়াল। ইটস ইনটলারেন্স! সে শীতল গলায় প্রশ্ন করল, লুক, আমি আপনাকে চিনি না জানি না। আপনার কাছে অনাবশ্যক উপদেশ শুনতে আমি রাজি নই। এবং এখন রাত অনেক হয়েছে।রাত কত হলে তোমার বাবা বাড়িতে ফেরেন জয়িতা?আই ডোন্ট নো। আই অ্যাম নট কনসারন্‌ড।তাই তো এই ফোন। তোমাকে আমার খু-উ-ব নেগলেকটেড চাইল্ড বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। তোমার বাবার চেয়েও বড় হতে হবে। তুমি কি এখন পড়াশুনা করছিলে জয়িতা?কিন্তু আমি জানতে চাই আপনি কে?দ্যাখো, কোন কোন সম্পর্ক জন্ম থেকেই তৈরি হয়, কোনটা পরে আসে। আমি তোমার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ে সম্পর্কিত। এখন আমি তোমাকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। তোমার সম্পর্কে আমার মাদারলি ফিলিংস এসে গেছে।কিন্তু কেন? কি জন্যে? আমাকে কি আপনি দেখেছেন?নো। তবে শুনেছি তোমার কথা। আর এখন তো আমার সঙ্গে তোমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তোমার কোন প্রব্লেম থাকলে আমাকে বলতে পার।আপনি এখনও পরিচয় দিচ্ছেন না! যদিও আপনাকে আমার ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। অ্যাট লিস্ট আপনার গলার স্বর খুব ভাল। সম্পর্কটা কি?মায়ের সঙ্গে মেয়ের যা সম্পর্ক। ইন ফ্যাক্ট আমি সীতার চেয়ে ভাল মা হব।মা! ভগবান। আপনার কি মাথা খারাপ! আমার বাবা এখনও ডিভভাসী নন এবং কখনও হবেন কিনা সন্দেহ আছে। আর ইউ ম্যাড?নট অ্যাট অল। তাহলে তোমাকে বলি। আমি আর রামানন্দ শ্লেস্ট টুগেদার। একটু আগে ও উঠে গেছে আমার বিছানা থেকে। আমি এসব কথা তোমাকে বলতে চাইনি কিন্তু তুমি বাধ্য করলে। ওর জামায় আমি একটা দাগ রেখে দিয়েছি ফর ইওর ইনফর্মেশন। এখন ব্যাপারটা হল, আমি ব্যাপারটাকে কেবল আনন্দ উপভোগ হিসেবে দেখেছি না। ওর সব কিছু আমাকে ইন্সপায়ার্ড করেছে। তা থেকেই তোমার সম্পর্কে আমার মাদারলি ফিলিংস এসেছে, বুঝতে পেরেছ? কথাগুলো শেষ করে আবার সেই কড়কড়ে হাসি জুড়লেন মহিলা।ডিসগাস্টিং! চিৎকার করে উঠল জয়িতা, যতক্ষণ আপনি আপনার নাম না বলছেন ততক্ষণই আমার–! ওয়েল, এসব কথা আমাকে বলে কোনও লাভ নেই!আমি মিসেস দত্ত। ঐন্দ্রিলা দত্ত। গুড নাইট।লাইনটা কেটে গেল। এখন রিসিভারে আবার ডায়াল টোন ফিরে এসেছে। একটানা শব্দটা যে কানে বাজছে প্রথমে খেয়াল করেনি জয়িতা। সে নিজের অজান্তেই ঠোঁট কামড়াল। তারপর রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ঘরে ফিরে এল।ঐন্দ্রিলা দত্ত। এই নাম সে জীবনে শোনেনি। হয়তো বাবার লেটেস্ট। কিন্তু মহিলা যেই হোন না কেন কথা বলতে জানেন। লেটেস্ট কায়দায় ব্ল্যাকমেল করা। অথচ ব্ল্যাকমেল বলে আপাত মনে হবে না। চেয়ারে বসে দুটো পা টেবিলের ওপর তুলে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট টেনে নিল সে। মাঝারি দামের সিগারেট। বেশ কড়া। বছর দুয়েক হল সে সিগারেট খাচ্ছে। ওর বন্ধুরাও এই সিগারেটই পছন্দ করে। অবশ্য আনন্দ সিগারেট খায় না। কোনও নেশাটেশার মধ্যে নেই। রিয়েল সিরিয়াস গাই। নরেন্দ্রপুরের ছেলেদের মধ্যে একটা গুডি গুডি ভাব থাকে। আনন্দটা সেটাকে ভিত্তি করে আরও এগিয়েছে। সব কিছু খুব সিরিয়াসলি ভাবে। কিন্তু বোর করে না। সুদীপ বা কল্যাণ ঠিক আছে। সুদীপটা ক্যালকাটা বয়েস থেকে বেরিয়েছে। বড্ড বেশি কথা বলে। কয়েকবার পাউডার অ্যাটেম্পট্‌ করে বলেছে, কেন যে ওরা এসব খায়! ধ্যুৎ। অনেস্ট কনফেশন। ওকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি জয়িতার। মুশকিলটা কল্যাণকে নিয়ে। ও পড়তো স্কটিশ স্কুলে। একদম মধ্যবিত্ত বলে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দেয় তাদের একটা পরিবার থেকে। আনন্দও মধ্যবিত্ত কিন্তু কল্যাণের মত উল্টোপাল্টা মানসিকতার ছেলে নয়। কল্যাণ কোনও ব্যাপারে দারুণ স্মার্ট কথা বলল, আবার পরক্ষণেই এমন একটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা আঁকড়ে ধরল যে ওকে খুব বিরক্তিকর বলে মনে হয় তখন। কিন্তু সব মিলিয়ে এই তিনজনেই জয়িতার বন্ধু। আনন্দ হোস্টেলে থাকে। কল্যাণের বাড়িতে ফোন নেই। সুদীপের আছে। কিন্তু এখন সুদীপ বোধ হয় বাড়িতে ফেরেনি। ওদের দমদমে যাওয়ার কথা সন্ধ্যে সাতটায়। আনন্দ আর সুদীপের। পার্টির ডিসিশন জানতে যাবে ওরা।তবু জয়িতার মনে হল সুদীপকে একটা ফোন করলে হয়। যতই সে ব্যাপারটার গুরুত্ব না দিক, মনের মধ্যে নোংরা লাগার মত একটা অনুভূতি পাক খাচ্ছে। মহিলা স্পষ্ট বললেন আমি তোমার বাবার সঙ্গে ঘুমিয়েছি! এরকম কেউ বলতে পারে? অবশ্য সেটা যদি সত্যিই হয় তাহলে এখন জয়িতার কিছুই আসে যায় না। পুরো ব্যাপারটা সীতা রায়ের। রামানন্দ রায় এবং সীতা রায়ের। জন্মসূত্রে ওরা অবশ্য বাবা-মা। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক। রামানন্দ রায়ের বয়স পঞ্চাশ। হ্যান্ডসাম, স্টিল হ্যান্ডসাম, টল, চুলে কলপ দেন প্রতি রবিবার, মুখে ভাঁজ পড়েনি। ড্রিংকসের জন্যে চোখের তলায় সামান্য ব্যাগ তৈরি হয়েছে এবং পেটে ঈষৎ চর্বি। তবে স্মার্টনেসের জন্যে সেগুলো তেমন নজরে পড়ে না। মাঝে মাঝে দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পান। দাঁত তুলতে রাজি নন। সেই সময় ওয়াটারলু স্ট্রিটের বারীন রায় ওর ভগবান।
 
Last edited:
রামানন্দ রায় চাকরি করতেন মাঝারি ফার্মে। খুব ছেলেবেলায় জয়িতা নিজেদের দেখেছে শোভাবাজারের বারোয়ারি বাড়িতে। তারপর ভবানীপুরে, এখন বালিগঞ্জ পার্ক রোডের ছয়তলার বারোশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। এর ফাঁকে রামানন্দ রায় তিনটে চাকরি ছেড়েছেন এবং এখন যেখানে পৌঁছেছেন সেখানে পৌঁছনোর জন্যে কলকাতার এলিট সম্প্রদায় সমানে দৌড়ে যাচ্ছে। ইদানীং বাবার সঙ্গে খুব কম দেখা হয় জয়িতার। রবিবারের সকালে সাঁতার কেটে ফিরে এসে মিনিট দশেক হয়তো বা। পড়াশুনোর খবর নিতেন আগে। এখন নেন না। সামনে বসে দুএকটা বই তুলে পাতা ওলটান। জয়িতার মনে হয় ওই সময় রামানন্দ রায়ের মনে এক ধরনের পাপবোধ কাজ করে। নাহলে বারংবার জিজ্ঞাসা করতেন না, এভরিথিং অল রাইট? প্রশ্নটা মুদ্রাদোষের পর্যায়ে চলে গেছে।

সীতা রায় অবশ্য এসবের ধার ধারেন না। তিনি ঘুম থেকে ওঠেন বেলায়। উঠে লেবু চা খান। ততক্ষণে মাসাজ করার মেয়েটা এসে যায়। আগে দরজা বন্ধ থাকত, এখন খোলাই থাকে। শরীরের সর্বত্র দলাই-মালাই করে মেয়েটা মাসে আটশো টাকা পায়। তারপর একটা স্যুপ গোছের কিছু খেয়ে সীতা রায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে। ওখানে শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া, মেদবৃদ্ধি রোধের বিলিব্যবস্থা করে দেয় একটা নামকরা প্রতিষ্ঠান। সীতা রায় সেখান থেকে ফেরেন দুটো নাগাদ। তখন তার খাদ্য বয়েলড ভেলিটেবল, ডিম এবং চর্বি ছাড়া সেদ্ধ মাংস। অবশ্য এর মধ্যে একবার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন নিয়ম করে। জয়িতা তখন হয়তো স্নান সেরে তৈরি হচ্ছে কলেজে যাওয়ার জন্যে, সীতা রায় ঘরে ঢুকে কাঁধ নাচাবেন, ও ঈশ্বর! এটা ভদ্রলোকের ঘর না ডাস্টবিন? একটু কেয়ার নিতে পার না কেন? কোনও মানুষ এত অগোছালো থাকতে পারে ভাবতে পারি না। তুমি যে কি করে আমার পেটে এসেছিলে তাই ভেবে পাই না।

ঠাণ্ডা গলায় জয়িতা জবাব দেয়, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পার।

ননসেন্স। তোমার কথাবার্তা খুব রাফ হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা।

কেন?

হোয়াট উইল বি ইওর ফিউচার! অনেক মেয়ের চেহারা ভাল থাকে না কিন্তু একটা চেষ্টা থাকে সেটাকে ভাল দেখানোর। ইনফ্যাক্ট তোমার বয়সে সাজগোজ করলে যে কোনও ছেলে ইনভলভড হতে বাধ্য! তোমাকে এতবার বলছি ক্লাবে এসো, পার্টিগুলো অ্যাটেন্ড করো, দেয়ার আর লট অব ফ্রেশ বয়েস—একবার বিয়ে হয়ে গেলে নো প্রব্লেম। অথচ তুমি কোনও কথাই শুনতে চাও না। এই সেদিন চোপরা বলছিল, মিসেস রায়, আপনি যখন এমন সুন্দরী তখন আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই অসামান্য রূপসী হবে। আমি আর কি বলব, টোক গিললাম। সীতা রায়ের শরীরে এখন হালকা সবুজ হাউস কোট।

কি করব বল, আমার চেহারার ওপর তো আমার হাত নেই।

সেকথা আমি বলিনি। আমি যখন শোভাবাজারে থাকতাম তখন কি চেহারা ছিল আমার? এখন আমার দিকে তাকালে কোনও ছেলে চোখ ফেরাতে পারে না। আমি তৈরি করেছি এইটে, ঈশ্বর দেয়নি। তুমি পড়াশুনায় ভাল তার মানে এই নয় ছেলেরা তোমার জন্যে ছুটে আসবে।

মা, ছেলেদের ব্যাপারে আমার কোনও আকর্ষণ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, পড়াশুনা করতেও আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না।

তার মানে? তুমি কি করতে চাও?

সেইটেই ভাবছি। যখন করব তখন জানতে পারবে। শুধু আপাতত আমায় নিয়ে তোমরা ভেব না। বোজ রোজ এক কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না। ফোন বাজছে, মনে হচ্ছে তোমার ফোন! জয়িতা কথা শেষ করামাত্র সীতা রায় ঘড়ি দেখলেন। তারপর দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন টেলিফোন ধরতে। জয়িতা মায়ের দিকে তাকাল। শী ইজ অ্যারাউন্ড ফরটি টু। শরীরচর্চা কেন্দ্রগুলোর কৃতিত্ব আছে বটে। যৌবন শরীরের ফুলদানিতে চমৎকার সাজিয়ে রাখে। ইদানীং মা চুল ইস্ত্রি করাচ্ছে। আগে কাঁধ অবধি নামিয়েছিল। এখন সেটা কোমরে। ইস্ত্রিটা বাড়িতেই করা হয়। চওড়া টেবিলের ওপর কম্বল বিছিয়ে মা মোড়া নিয়ে পাশে বসে চুলগুলো ছড়িয়ে দেয় কম্বলে। সেগুলোকে টান টান করে বিছিয়ে তার ওপর সার্টিনের কাপড় ঢেকে কন্ট্রোলড টেম্পারেচারে ইস্ত্রি চালানো হয় ওপর থেকে ডগা পর্যন্ত। জয়িতা মাঝে মাঝেই ভেবেছে ইস্ত্রিটা যদি মাথায় ঠেকে যেত তাহলে কি রকম হত ব্যাপারটা! কিন্তু কখনই সেটা হয়নি। যে মেয়েটি এই কাজটি করে তার পটুত্ব অসাধারণ। এর ফলে পালিশ করা চুল কোমর অবধি নিয়ে মা যখন সন্ধ্যেবেলায় বের হয় তখন সেখান থেকে একটা জেন্না ছিটকোয়। মায়ের গায়ের রঙ আগে বেশ চাপা ছিল। কী মন্ত্রে যে সেটা গমের মত হল কে জানে! সরু কোমরের অনেকটা খোলা থাকায় সেটা মুক্ত হাতের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে যায়। সীতা রায় লম্বা।
 
জয়িতা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই মাকে দেখতে পেল। রিভলভিং চেয়ারে বসে মা কথা বলছে রিসিভার কানে ঠেকিয়ে। অন্যের এই রকম বাক্যালাপ শোনা উচিত নয় কিন্তু সীতা রায়ের ভঙ্গি দেখে জয়িতা চলে আসতে পারল না। যোলো বছরের নেকি খুকির মত ভঙ্গি করছে সীতা রায়, ওঃ নো। যু আর রিয়েল নটি। কত বয়স হল জানো? এখন কি সে ফিগার আছে? বেশ, দেখি তুমিই বল। মাপার জন্যে গায়ে হাত দিতে হয় না, পুরুষদের চোখ জহুরীর মত। উঁহু হল না। আই অ্যাম থার্টি সিক্স টোয়েন্টি ফাইভ থার্টি সেভেন। দ্যাখো না ভাই, টোয়েন্টি ফাইভটাকে কিছুতেই টোয়েন্টি থ্রি করতে পারছি না। ইউ লাইক ইট! নটি বয়! না বাবা, আমি আর একটু কমাতে চাই। চোপরার কথা বলল না। লোকটার কোনও টেস্ট নেই। মিসেস গুপ্তার কোমর থার্টি টু-র নিচে হবে না। তার সঙ্গে তুই নাচছিস! খবরদার, তোমাকে যেন ওই ধুমসিটার সঙ্গে না দেখি। ইউ নো, আমি খুব অহঙ্কারী। গুপ্তার মত ইজিলি অ্যাভেলেবল নই। রামানন্দ আছে, ভালই আছে। হু কেয়ার্স! এক কালে শুনতাম টিন এজার্সদের নিয়ে ঘুরত, এখন দত্ত মেয়েটা কোথেকে আমদানি হয়েছে! তাই? ওর স্বামীর শুনেছি বিরাট এক্সপোর্টের কারবার। মেয়েটা সান্যালের? তোমাদের এই রোমিও সান্যাল বেশ আছে। বিয়েথা করেনি, একে ওকে বাচ্চা দিয়ে যাচ্ছে! না বাবা, আমার কাছে ঘেঁষতে এসেছিল। বাট আই ডোন্ট লাইক আনম্যারেড গাইস। প্যানপেনে প্রেমের রিস্কে নেই আমি। এই বয়সে বিয়ে-থা করতে বলবে—ওরে বাব্বা! বয়স বলব না? ঠিক আছে বাবা, দুধ তো শিশুদের জন্যে কিন্তু ক্ষীর ডিলিসিয়াস—সকলের সহ্য হয় না! হি হি হি। সন্ধ্যেয় ক্লাবে এসো। কোথাও হারিয়ে যাওয়া যাবে। হ্যাঁ বাবা হা, প্রমিস। সীতা রায়কে রিসিভার নামিয়ে রাখতে দেখেও দরজা ছেড়ে নড়ল না জয়িতা। উৎফুল্ল সীতা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মেয়ের দিকে নজর পড়তেই বললেন, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ?

জয়িতা সেই একই ভঙ্গিতে বলল, তোমাকে দেখছিলাম।

কাঁধ নাচালেন সীতা রায়, এমন বিরক্ত করে না এরা, সুন্দরী হবার এই জ্বালা! চিতায় উঠেও প্রশংসা শুনতে হয়। বাই দ্য ওয়ে, তোমার টাকার দরকার?

না।



সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে নেবাল জয়িতা। আজকাল সে সীতা রায়ের সামনেই সিগারেট খায়। প্রথম প্রথম সঙ্কোচ লাগত। বিদ্রোহ করার ভঙ্গিতে সেটা শুরু করেছিল। কোনও প্রতিবাদ না আসায় এখন অভ্যাসে এসে গেছে। শুধু রামানন্দ রায় এক কার্টন নিজের সিগারেট মেয়ের টেবিলে রেখে বলেছিলেন, সিগারেট খেতে হলে এইটে খেও। সস্তা সিগারেটে শরীরের ক্ষতি হয়।

জয়িতা দুটো প্যাকেট পাশাপাশি রেখে বলেছিল, আমারটায় লেখা আছে সিগারেট স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ আর তোমারটায় সার্জেন জেনারেল উপদেশ দিয়েছেন। একই ব্যাপার। আমার এইটেই ভাল লাগে।

তুমি কি আমার কোনও কিছু গ্রহণ করবে না বলে ঠিক করেছ?

তুমি কি দিচ্ছ তার ওপর আমার গ্রহণ করা নির্ভর করছে, তাই না বাবা?

তুমি ইদানীং খুব অবাধ্য হয়ে যাচ্ছ জয়ী। আই ডোন্ট লাইক দিস।

ড়ু ইউ?

রামানন্দ রায় সিগারেটের কার্টন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, যা ইচ্ছে তাই কর। আই নো ইউ আর টেকিং অ্যাডভানটেজ।

আজ রাত্রে কথাটা নতুন করে মনে পড়ল জয়িতার। ওরা বলে এটা ফাস্ট লাইফ। এই জীবনযাপন করতে না পারলে ওদের সমাজে অচল হয়ে যেতে হবে। কে কতটা আধুনিক হতে পারছে তার প্রমাণ দিতে হবে কে কতটা নিচে নামতে পারছে তার মধ্যে দিয়ে। জয়িতা নিজেও জানে না সে কেন এ জীবনটাকে গ্রহণ করতে পারল না। সত্যি বলতে কি, এই বালিগঞ্জ পার্ক রোডের বনেদী বস্তিতে তার বয়েসী অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা সন্ধ্যের পর যে বাহীন স্বাধীনতা পায় তা ফুটিয়ে ভোগ করে। ঠিক তাদের নিচের ফ্ল্যাটেই জুনরা থাকে। বাবা মা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর বন্ধুরা এসে জড়ো হয়। পাউডার সিগারেটে পুরে বুকভর বাতাস নেয়। ঝিমুনি আসা মিউজিক বাজে। জুন নিজে বলেছে ও সারা মাস ট্যাবলেট খায়, কারণ কখন কি যে হয়ে যায়, কে রিস্ক নেবে। ইটস্ অল ইন দ্য গেম। জুনের বয়স মাত্র পনেরো। অথচ ওখানে যাওয়ার প্রবৃত্তিটাই কখনও এল না। আনন্দ কিংবা কল্যাণের এই প্রশ্ন ওঠে না, সুদীপটা ইচ্ছে করলে এই জীবনটা নিতে পারত, কিন্তু সুদীপ স্বচ্ছন্দে বলতে পারে, আই হেট দেম। বিশ্বাস কর আমি ওদের মলমূত্রের চেয়ে বেশি ঘেন্না করি।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করেছিল, তাহলে আছিস কেন ওদের সঙ্গে?

প্রিটেনশন। নিজেকে ভুলিয়ে রাখা। আফটার অল দুবেলা ভাল-মন্দ খেতে পাচ্ছি। আমার মধ্যে যে সুবিধেবাদী শয়তানটা আছে সেইটের জন্যে রয়ে গেছি।
 
সুদীপ যে কথাগুলো স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করতে পারে জয়িতা তা পারে না। বস্তুত বন্ধুদের কাছে সে বাড়ির আবহাওয়ার কথা কখনও উচ্চারণ করেনি। ওরা তাকে কখনই মেয়ে বলে মনে করে না, আলাদা খাতির দেখায় না, সুদীপ তো অনেক ছেলেলি স্ল্যাং বলে যায় অনায়াসে এবং সে নিজেও ওদের ছেলে বলে সংকুচিত থাকে না। ঠিক চারটে অস্তিত্ব একাকার হয়ে যাওয়া আর কি। ব্যাপারটা কলেজের অন্য মেয়েদের চোখে করকরে ঠেকে। মেয়েদের এই অতিরিক্ত মেয়েলিপনা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না জয়িতা। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েগুলো তাদের সব রকম কনজারভেটিভ ধারণা বুকে পুষে রেখে এমন ভাবভঙ্গি করে যেন পৃথিবীর সব ছেলেই তাদের দিকে হামলে পড়ছে। হাসি পায় জয়িতার। এরা কেউ সীতা রায় নয়। লাবণ্যের মত অমিত রায়ের সঙ্গে কাঁপা কাঁপা সংলাপ বলার জন্যেই মনে মনে রিহার্সাল দেয় সব সময়। জীবনের কোন সমস্যা, দেশের মানুষের কথা ভাবতে ওদের বয়েই গেছে। একটি মনের মত স্বামী পাওয়ার জন্যে মেয়েদের কেন বড় হতে হবে?

অর্থাৎ এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, কোনটাই জয়িতার ধাতের সঙ্গে মেলে না। আর মুশকিলটা এখানেই। এই মহিলা, কি নাম যেন, ঐন্দ্রিলা দত্ত, মানে সেই এক্সপোর্ট বিজনেসের মালিকের স্ত্রী, কি স্বচ্ছন্দেই না উচ্চারণ করলেন আমি তোমার বাবার সঙ্গে শুয়েছি। এই কথা শোনার পর তার কি করা উচিত!

জয়িতা টেলিফোনের নম্বর ঘোরাল। ওপাশে রিং হচ্ছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে এগারোটা। এই সময় টেলিফোন করার সময় নয়। ওপাশে রিসিভার উঠল, হলো?

স্বরে বোঝা গেল কাজের লোকজন কেউ। জয়িতা স্বস্তি পেল। সুদীপের বাবা ফোন ধরলে বড্ড খেজুরে আলাপ করেন। তুমি কেন প্যান্ট পরো, না না প্যান্ট খারাপ নয়, আসলে মেয়েদের প্যান্ট পরলে অনেক অসুবিধে, শাড়িতে তোমাকে ভালই মানাবে। সুদীপকে সে বলেনি কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে একটা টসটসে ভাব থাকে।

সুদীপ আছে?

আপনি কে কথা বলছেন?

আমি সুদীপের শাশুড়ী?

নিঃশব্দে রিসিভার নামিয়ে লোকটা যেন ছুটে গেল ডাকতে ডাকতে। গলার স্বর পিছলে যাওয়াতে সেই রকম মনে হল। জয়িতার পেটের ভেতর এতক্ষণে হাসি কুলকুলিয়ে উঠল। শোনামাত্র সুদীপের মুখের অবস্থা কিরকম হবে?

এই শালা, ইয়ার্কি মারার একটা লিমিট আছে! সুদীপের গলায় রাগ স্পষ্ট।

মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। আনন্দ বলেছে–।

জ্ঞান দিস না। এইবার কার্তিকদা বাড়িসুষ্ঠু প্রচার করবে আমার একটা শাশুড়ী আছে? একেই মরছি নিজের জ্বালায়–।

গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলে কোনও ক্ষতি হয় না। মিটিং-এ কি হল?

গ্রান্টেড। টেলিফোনে বলা যাবে না।

কেন?

সন্দেহজনক ঘটনা ঘটেছে। একজন নাকি এসে খোঁজখবর নিয়েছে আমার সম্পর্কে।

ওক্কে!

কেন ফোন করলি? কাল তো দেখাই হত!

আই অ্যাম ইন আ প্রব্লেম।

সেকি? তোর ওখানেও কেউ গিয়েছিল নাকি?

না না, এখন অতটা হিরো হইনি। প্রব্লেমটা আমার বাবাকে নিয়ে।

ডোন্ট বদার। গুলি মার।

তুই বুঝছিস না। একটু আগে একজন ভদ্রমহিলা ফোন করে আমাকে খুব জ্ঞান দিলেন। মা মা ভাব দেখালেন। কারণ আজ নাকি তিনি আমার বাবার সঙ্গে শুয়েছেন। জাস্ট ইমাজিন!

বয়স কত?

আঃ, আমি চিনি নাকি যে বয়স বলব।

তুই খুব ডিস্টার্ব?

অফকোর্স।

তুই একটা গাধা। যে যা করছে করুক, তোর কি?

আমার বাবা–।

তোর বাবার দায়িত্ব তোর নয়। তাছাড়া উই মে লিভ হোম এনি ডে এনি টাইম। শোন, তোর বাবা কোথায়?

কেন?

কনগ্রাচুলেশন জানাব। ফোনটা ওঁকে দে। বলব, চালিয়ে যান দাদা! দেশটাকে আপনারাই খোলতাই করছেন। আপনাদের সংখ্যা যত বাড়ছে তত আমরা বাড়ছি, এইটেই লাভ।

বি সিরিয়াস সুদীপ। আমি একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই আজ রাত্রে।

কি লাভ? এদেশের কমনিস্টদের যেমন বিপ্লবের কথা বলে কোনও লাভ হবে না তেমনি এইসব সেক্সহান্টার্সদের বিবেক বলে কোনও বস্তুকে জাগানো যাবে না। এসব না করলে বেচারারা বেকার হয়ে যাবে। ঘুমিয়ে পড়। কাল দেখা হবে। গুডনাইট।




রিসিভারটা নামিয়ে রাখল জয়িতা। সুদীপের কথা শুনলে বোধ হয় ভাল হত। যে যা ইচ্ছে করুক, তার কি? কিন্তু মহিলার গলার স্বরটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আবার ডায়াল ঘোরাল জয়িতা।

রিং হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ঘুম-জড়ানো গলা শুনতে পেল, হ্যালো।

মিলি আন্টি, তুমি বাড়িতে আছ? আমি জয়িতা।

ও। হ্যাঁরে, আমার শরীর খারাপ। অনেকদিন বের হইনি। কি ব্যাপার, এত রাত্রে?

আই অ্যাম সরি। আমি খুব ডিসটার্বড়! আচ্ছা তুমি ঐন্দ্রিলা দত্ত বলে কাউকে চেন?

মাই গড! তুই ওকে চিনলি কি করে? চিনেছি।

খবরদার ওর সঙ্গে মিশবি না। শী ইজ আ বিচ। তোর বাপ মা তো আমার সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু বুঝবে ঠ্যালা। তোর আঙ্কলের সঙ্গে ওই মেয়েটা একদিন দেখা করেছিল অফিসে গিয়ে। কি কথা হয়েছে কে জানে, আমাকে ফোন করে বলে কিনা আপনার স্বামী খুব অ্যাগ্রেসিভ, সামলানো দায়! একে ওকে এসব বলে আনন্দ পায়। অবশ্য সত্যি যে একদম থাকে না তা নয়। কেন, তোর বাবার ব্যাপারে কিছু বলেছে বুঝি?

কিছু না। আচ্ছা রাখছি। গুডনাইট।

রিসিভার রেখে আর একটা সিগারেট ধরাল জয়িতা। এবার মিলি আন্টি গন্ধ খুঁজছেন। কিছু একটা ঘটনা টেনে বের করতে পারলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই কলকাতায় চাউর করবেন কেচ্ছা। কিন্তু যেটুকু জানা গেল তাতে ঐন্দ্রিলা সম্পর্কে চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। আবার সুদীপের কথা মনে পড়ল। এ নিয়ে ভেবে কি লাভ! না, একমত নয় সে। উত্তরপুরুষের কাছে যদি পূর্বপুরুষ কৈফিয়ৎ চাইতে পারে তাহলে উত্তরপুরুষেরও অধিকার আছে পূর্বপুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। ইটস্ এনাফ। সীতা রায় স্বীকার করুক, সাহস থাকলে বলুক, আধুনিকতা বলতে তারা বোঝে মদের বোতল খোলা এবং সম্পূর্ণ না ভালবেসে, একটুও মনের কাছাকাছি না গিয়ে দেহ উপভোগ করা। সে জেগে থাকবে যতক্ষণ না ওরা ফিরে আসে।

ঘড়িতে এখন বারোটা পাঁচ। এই ফ্ল্যাটে বসে থাকলে কলকাতায় কোথায় কি হচ্ছে বোঝা অসম্ভব। যতক্ষণ না কেউ তোমার দরজার বোতামে হাত না দিচ্ছে ততক্ষণ তুমি জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। জয়িতা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। নিচে হট ট্রাক চলছে। দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজের সঙ্গে পুরুষকণ্ঠে উঁচু গলায় সুরেলা চিৎকার। অনেকটা দূর এখানে দাঁড়ালে চোখে পড়ে। অন্ধকারের গায়ে টুকটাক আলোর বিন্দু বসান। এ পাড়া অর্থবানদের, এত রাত্রে তারাই জেগে থাকে যাদের কাছে ঘুম মানেই এক ধরনের মৃত্যু।

বাবা ওই ঐন্দ্রিলা দত্তের সঙ্গে ঘুমিয়েছেন-এই সংবাদে সে বিচলিত হচ্ছে কেন? উল্টোটাই বা ভাবছে না কেন? কেউ তো ফোন করে বলতে পারত তোমার মায়ের সঙ্গে একটু আগে ঘুমিয়ে নিলাম। কেউ বলেনি কিন্তু এমনটা যে ঘটছে না তা কে বলতে পারে! মা সেদিন কাউকে সান্যাল লোকটা সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। মজার ব্যাপার হল ওই সান্যালকে সবাই চায়। মাও। যতই ফোনে ন্যাকামি করুক মা, সান্যালের সঙ্গে মিশলে ও বিয়ে করতে চাইতে পারে, কিন্তু মা জানে সবাই জানে সান্যাল কখনই বিয়ে করবে না। যে কোন মেয়েকে সান্যাল বলে, উই আর ফ্রেন্ডস অ্যান্ড দ্যাটস অল! মিলি আন্টিকে একবার মাকে বলতে শুনেছিল সে। তখন মিলি আন্টির সঙ্গে এবাড়ির সম্পর্ক ভাল ছিল। রোজ বিকেলে কেচ্ছার আসর বসত। মিলি আন্টি বলেছেন, সান্যাল একটা চীজ। তোমার সঙ্গে শোবে, উপকার করবে কিন্তু সম্পর্ক চাইলে বলবে, ডোন্ট এক্সপেক্ট এনিথিং ফ্রম মি। উই আর ফ্রেন্ডস। আর মেয়েগুলোও যেমন, ওকে দেখলেই হামলে ওঠে! তোমার মেয়েটাকে সামলে রেখ। ও মা মেয়ে কাউকে বাদ দেয় না।
 
এই ইঙ্গিতটাই হল কাল। মিলি আন্টির সঙ্গে মায়ের সম্পর্কে চিড় ধরল। কারণ তখন সান্যাল আঙ্কলের সঙ্গে মায়ের খুব ভাব। বাড়িতে কোনও স্পেশ্যাল ডিশ হলেই সান্যাল আঙ্কল আসে। রামানন্দ রায়ই ফোন করে ডেকে আনে। কিন্তু একথা ঠিক, সান্যাল আঙ্কল তার দিকে কোনদিন তাকায়নি। হেসে দু-একবার হা-ই বলেছেন মাত্র। এই সানাল আঙ্কল তত দিনদুপুরে এ বাড়িতে আসতেন যখন রামানন্দ রায় বাইরে থাকতেন। সেসময় নিবিড় আলোচনার জন্যে মায়ের দরজা বন্ধ থাকত। দরজা খুললে সান্যাল আঙ্কল আর দাঁড়াত না। ব্যাপারটা কেউ তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি বলেই কি তার এমন খারাপ লাগেনি যেমন বাবার ক্ষেত্রে লাগছে! চোখ বন্ধ করল জয়িতা। বছর বারো আগেও, রামানন্দ রায়কে হাম না খেতে পারলে তার ঘুম হত না। বাবার গায়ের গন্ধটা যে কি ভাল লাগতএখন দাঁড়িপাল্লায় দুজনেই সমান। সুদীপের কথা শোনাই উচিত কাজ হবে।

সীতা রায়দের এই পৃথিবীটা অদ্ভুত। কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না। প্রতিনিয়ত এ ওর নামে কেচ্ছা ছড়াচ্ছে। অথচ প্রত্যহ একসঙ্গে জড়ো হয়ে মদ না খেলে এদের চলেও না। বিত্তবান মানুষগুলো ভদ্রতার মুখোশ পরে সর্বক্ষণ সুযোগের সন্ধানে থাকে কি করে পরস্ত্রীর প্রেমহীন শরীরখনন করা যায় সেখানেই তাদের তৃপ্তি। সেই চাবিবদলের গল্পটা তো এখন প্রত্যেকের জানা। পাটিতে শুধু স্বামীস্ত্রীদের প্রবেশাধিকার। মদ খেতে খেতে এ ওর স্ত্রীর সঙ্গে যতটা সম্ভব খেজুরে-ঘনিষ্ঠতা করার পর টেবিলের ওপর প্রত্যেকের গাড়ির চাবিগুলো রাখা হয়। এবার স্বামীরা একে একে একটা চাবি তুলে নেন। যার ভাগ্যে যে গাড়ি ওঠে তার মালিকানকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন ভাগ্যবান। এসব তো সে শুনেছে। কিন্তু কখনও আজকের মত উত্তেজনা আসেনি মনে-শরীরে। এ শুধু সরাসরি তার মুখে শব্দগুলো ছুঁড়ে মারা হল বলে? জয়িতা ধীরে ধীরে মায়ের ঘরে এল। সীতা রায় এক ঘরে বাস করেন না। যদিও মাঝখানে দরজা আছে কিন্তু সেটা বছরের কোন্ রাত্রে খোলা হয় কে জানে। এখনও বন্ধ। কিছুদিন হল জয়িতা এই ঘরে আসেনি, রামানন্দের ঘরেও যায়নি।

সীতা রায়ের ঘরে ঢুকলেই মিষ্টি কিন্তু হালকা গন্ধ পাওয়া যায়। আর ওই গন্ধটার মতনই সমস্ত ঘরটি চমৎকার সাজানো। কোথাও বাড়তি নেই, অগোছালোপনা নেই। এই ঘরে বই নেই তবে অজস্র ম্যাগাজিন আছে। দেশি-বিদেশি মেয়েদের ম্যাগাজিন যেগুলোতে শরীর সাজানোর নানান প্রক্রিয়া দেওয়া আছে। আয়নার পাশে সীতা রায় দাঁড়িয়ে আছেন। ও ছবির বয়স কত তা টের পাওয়া শিবের অসাধ্য। গত সপ্তাহ কিংবা দশ বছর আগের যে কোনও সময়ের হতে পারে।

জয়িতা সীতা রায়ের ম্যাগাজিন তুলে নিল। এটাই লেটেস্ট। বিশ্বসুন্দরীর ছবি ওপরে ছাপা। দুতিনটে পাতা ওলটাতেই একটা ছোট্ট কার্ড পড়ে গেল নিচে। পেজমার্ক করার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছিল ওটাকে। কার্ডটা তুলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জয়িতার। প্যারাডাইস! এই জায়গাটার কথাই কদিন থেকে ওদের মধ্যে আলোচনায় এসেছে। আনন্দর কাছ থেকে খবরটা শোনার পর থেকেই সুদীপ টগবগ করে ফুটছিল। ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর একটা বিশাল চত্বরে গজিয়ে ওঠা প্যারাডাইসকে দেখেও এসেছে ওরা। কিন্তু মায়ের কাছে এই কার্ডও এসে গেছে। চমৎকার! সুদীপের গলা মনে পড়ল। একটু আগেই টেলিফোনে সুদীপ জানিয়েছে, গ্রান্টেড। জয়িতা একবার ভাবল কার্ডটাকে সরিয়ে ফেলবে কিনা! তারপর মনে হল, প্যারাডাইসের হদিস যদি সীতা রায়ের জানা থাকে তাহলে এই কার্ডটা না পেলেও তার চলে যাবে। সীতা রায়কে সে কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারবে না।

ঠিক এই সময় বেল বাজল। তীব্র এবং কর্কশ। যত রাত বাড়ে তত শব্দটা ওইরকম হয়ে যায়। জয়িতা চটপট নিজের ঘরে ফিরে এল। ওদের কাছে চাবি আছে, নিজেরাই দরজা খুলে ভেতরে চলে আসতে পারে, তবু বেল বাজাবে। এই সময় শ্রীহরিদা উঠবে না এবং সে নিজে দরজা খোলে না। বোধহয় রামানন্দ রায় নিজের উপস্থিতি সোচ্চারে জানাতে চান।

দরজা বন্ধ করে রামানন্দ রায় বললেন, ও ডার্লিং, তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
 
সীতা রায় একবার মেয়ের ঘরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন, সারা সন্ধ্যের ক্রাউড তোমার চেয়ে অনেক অ্যাডভান্সড।

মানে?

ওরা এই কথাটা সন্ধ্যে থেকে বলছে, তুমি রাতদুপুরে।

আই সি। বেটার লেট দ্যান নেভার।

থ্যাঙ্কস। সীতা রায় গম্ভীর ভঙ্গিতে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। রামানন্দ একটু টললেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর বললেন, ডার্লিং, গুড নাইট!

সীতা রায় যেন আরামবোধ করলেন কথাটায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হাসি হাসলেন তিনি। তারপর রামানন্দ রায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, এই জন্যেই তোমাকে আমার ভাল লাগে। তুমি ঠিক বুঝতে পার কখন আমি ডিস্টার্বড় হতে চাই না।

সেম টু ইউ। আই অ্যাম রিয়েলি টায়ার্ড টুনাইট।

মি টু-উ-উ-উ। আই লাভ ইউ ডিয়ার।

মি টু-উ-উ। আমরা কি একটা কিস-এর কথা ভাবতে পারি?

ও নটি, দ্যাটস অল ফর দ্য নাইট, না? আমি তোমার প্রশংসা করলাম একটু আগে।

আমিও।

এর অধর ওর কপোল স্পর্শ করল কি না-করল দুজনেই তৃপ্ত ভঙ্গিতে দুটো দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় জয়িতা তার দরজায় এসে দাঁড়াল।

তোমাদের একটা ফোন এসেছিল।

দুটো মানুষই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন। রামানন্দ রায় বললেন, আঃ, তুমি এখনও জেগে আছ? না , লেট নাইট করা ঠিক নয়। তার স্বরে জড়তা যাচ্ছিল না।

সীতা রায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মানে? কার ফোন? কে ফোন করেছিল?

একজন মহিলা। ভদ্র বলতে বাধছে।

হোয়াট! অভদ্র মহিলা আমাকে চাইবে কেন? সীতা রায়ের গলায় উম্মা।

কারণ তিনি কিছু সংবাদ দিতে চেয়েছিলেন।

এবার রামানন্দ রায় বললেন, আঃ, কি হেঁয়ালি করছ? চটপট বল, ঘুম পাচ্ছে।

জয়িতা বলল, ভদ্রমহিলা বললেন তিনি আমাকে নাকি মেয়ের মত স্নেহ করছেন। এই স্নেহপ্রবণতা তার মনে এসেছে কারণ তিনি ফোন করার একটু আগে তোমার সঙ্গে।

কথাটা শেষ করতে পারল না জয়িতা। তার সমস্ত শরীর কাঁপছিল।

ইজ ইট? সীতা রায় স্বামীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, হু ইজ শী?

রামানন্দ রায়কে হতভম্ব দেখাল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ইউ স্লেপ্ট উইথ মিসেস দত্ত? সীতা রায় চিৎকার করে উঠল।

হু টোল্ড ইউ?

সান্যাল আমাকে বলেছে। তুমি ক্লাব থেকে কেটে পড়ার সময় সান্যাল আমাকে বলেছে। আমি সান্যালকে বিশ্বাস করিনি তখন। ওঃ!

ন্যাকামি করো না। ইউ বিচ! ইউ হ্যাভ বিন ডিঙ বাই সান্যাল।

নো! সান্যাল সম্পর্কে কিছু বলার রাইট তোমার নেই।

বিকজ ইউ লাইক হিম! হি ইজ, আমি জানি না তুমি কার কার সঙ্গে কি কর!

চুপ কবরী। কি করে সাহস পায় ওই মেয়েছেলেটা বাড়িতে ফোন করার! চমৎকার, সে আমার মেয়ের মা হয়ে গেল কারণ তুমি ওর সঙ্গে শুয়েছ!

ইউ কান্ট প্রুভ ইট! ক্যান ইউ? কোনও মেয়ে ফোন করে সত্যি কথা বলে না! বাট আই ক্যান প্রভ, আমি প্রমাণ করতে পারি তুমি কার কার সঙ্গে হারাও!

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে ছুটে গেলেন সীতা রামানন্দ রায়ের কাছে, প্রমাণ কর। মেয়েরা যদি পাঁকেও নামে তাহলে তাদের গায়ে কাদা লাগে না। কারণ তারা তেল মেখে নামে। কিন্তু তুমি—তুমি ইউ ফুলতোমার শার্টের পেছনে লিপস্টিকের ছাপ, দ্যাট হোর তোমার শার্টে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে নিজের ঠোঁটে।


এই মুহূর্তে রামানন্দ রায় চুপসে যাওয়া বেলুনের মত হয়ে গেলেন। দৃশ্যটা আর দেখতে পাচ্ছিল না জয়িতা। রামানন্দ মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বললেন, জয়ি, বিশ্বাস করো না, শী ডিড ইট! লিপস্টিকের ছাপ ওর।

সীতা রায় চিৎকার করলেন, নো। জয়ি, হি ইজ আ লায়ার। ডোন্ট বিলিভ হিম।

জরি তা দুজনের দিকে তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, এত রাত অবধি কেন জেগে আছি জানো? আমি তোমাদের একটা কথা জানাতে চাই!

দুজনেই কোনও উত্তর দিল না।

জয়িতা হাসল। তারপর দরজার দুটো পাল্লা বন্ধ করার আগে বরফগলায় উচ্চারণ করল, আমি তামাদের ঘেন্না করি। বন্ধ দরজার এপিঠে দাঁড়িয়ে সে অনেকক্ষণ পর প্রথম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
 
০২.
জয়িতার সঙ্গে কথা বলে সুদীপ ব্যালকনিতে এল।

ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা বেশ চওড়া। যেহেতু রাত এখন বেশ তাই লোজন নেই বললেই চলে। ঠাকুরের পানের দোকানটা অবশ্য খোলা। আশেপাশের বাড়ির রাধুনেরা এখন ওখানে আড্ডা মারছে। ও-পাশের রকটায় দুজন দাবা খেলছে রাস্তার আলোয়। এ ছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই। মাঝে মাঝেই হুস-হাস গাড়ি ছুটে যাচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। সুদীপ ভাল করে লক্ষ করল। না, কোনও অপরিচিত মুখ সে দেখতে পেল না। কেউ সন্দেহজনক ভঙ্গিতে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে নেই।

অথচ তার খোঁজে নাকি দুবার লোকটা এসেছিল। কার্তিকদার বর্ণনা মত সে কোন চেনা লোকের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছে না। কার্তিকদার বয়স হয়েছে, ওলট-পালট হয়ে যায় সব। কিন্তু দুবারে বলার সময় যে মিলগুলো পেয়েছে সেরকম কোনও মানুষকে চেনে না সুদীপ। তাছাড়া লোকটা এসেছিল তখন যখন বাড়িতে সে ছিল না, বাবাও নয়। দুবারই। অস্বস্তিটা লেগে আছে শোনার পর থেকেই। আনন্দর হোস্টেলেও একই কাণ্ড ঘটেছে। আনন্দ আজ রাস্তায় হাঁটার সময় বারংবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে। তার সন্দেহ ছিল কেউ বোধহয় অনুসরণ করছে। কিন্তু সুদীপ বলেছিল তারা এমন কোনও কাজ করেনি যে এমন কাণ্ড ঘটবে, অথচ বাড়িতে এসে কার্তিকদার কাছে শোনার পর আনন্দর কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। এত রাত্রে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই। আনন্দর হোস্টেলে ফোন থাকলেও সুপার এত রাত্রে ঢেকে দেবে না। কল্যাণের বাড়িতে টেলিফোন নেই। জয়িতা তো নিজেই করল। সুদীপ আশঙ্কা করেছিল ওর ওখানেও বোধ হয় কেউ হানা দিয়েছে! জয়িতার যে সমস্যা সেটা ওর অনেকদিনের দেখা। এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার। তবে এটা খুব চমকপ্রদ ঘটনা মানতেই হবে। যে মহিলাটি জয়িতাকে ফোন করে বলেছেন তিনি আজ ওর বাবার সঙ্গে শুয়েছেন তিনি নমস্যা। ওঁকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। অবশ্য যদি ভদ্রমহিলা হন।

জয়িতার বাড়ির আবহাওয়াটা তো এখন কলকাতার ওপরমহলে উঠে যাওয়া বা উঠতে চাওয়া পরিবারের। ওখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে যখন জয়িতা তখন ওদের জন্যে এত আপসেট হয় কেন ও মাঝে মাঝেই কে জানে! একমাত্র ওই একটি ব্যাপার ছাড়া জয়িতার কোন ব্যাপারে জড়তা নেই। জড়তা? সুদীপ শব্দটা নিয়ে দুচারবার নাড়াচাড়া করল। জড়তা তার নিজের নেই? অজস্র ব্যাপারে অকারণ আড়ষ্টতা আসে কেন?

সুদীপ নিজের ঘরে ফিরে এল। কীটসব্যাগ নয়, ত্রিপলের একটা লম্বা ঝোলা আছে সুদীপের। দীপু মামা এনে দিয়েছিল জার্মানি থেকে। বেশ মজবুত, দেখতেও খারাপ নয়। এতকাল সেটা পড়ে থাকত চ্যাপটা হয়ে, এখন ফেঁপে ফুলে চমৎকার দেখাচ্ছে। বেশ কিছুকাল যাতে স্বচ্ছন্দে থাকা যায় এমন জিনিসপত্র ওতে ভরা হয়ে গেছে। যে কোনও সময় নোটিস এলেই বেরিয়ে পড়তে পারে সুদীপ। হাওয়া ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

এই বাড়িটা সুদীপের বাবা অবনী তালুকদারের। হাইকোর্টের নামজাদা উকিল। বিশাল বাড়িটায় তিনজন মানুষকে নিয়ে বেশ কয়েকজন ঝি-চাকর আরাম করে আছে। খাবার টেবিল ছাড়া সুদীপের সাহায্যে ওরা তেমন লাগে না। এই যে আজ একটা লোক দুবার এল, এরা তার নাম-ঠিকানা জেনে নেওয়ার বুদ্ধিটুকুও ধরে না। সুদীপের অস্বস্তি কিছুতেই কাটছিল না।

অবনী তালুকদার সুদীপের সঙ্গে কথা বলেন না। মাস ছয়েক হল বাক্যালাপ বন্ধ। সুদীপ আশঙ্কা করেছিল তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে কিন্তু অবনী তালুকদার সেটা বলেননি। তবে সমস্ত খরচ-খরচা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। সুদীপের অবশ্য এখন পর্যন্ত তাতে কিছু আটকাচ্ছে না। খরচ বলতে সিগারেট, বাসভাড়া, চায়ের দাম আর কলেজের মাইনে। জমানো টাকায় সেটা চলে যাচ্ছে আপাতত। তবে সে নিজে যেমন, তেমন অবনী তালুকদারও চেষ্টা করেন যাতে পরস্পরের মুখোমুখি না হন। ওকালতি যারা করেন তারা তো বুদ্ধিমান হবেনই। অবনী তালুকদার তার চেয়ে বেশ বেশি কিছু মাথায় ধরেন। এমন বিষয়াসক্ত মানুষ সুদীপ গল্প-উপন্যাসেও পড়েনি। আর সেই আসক্তিতে ভদ্রলোক একটার পর একটা একনম্বর দুনম্বর কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। তেজারতি কারবার তো আছেই, ভদ্রলোকের মনে দয়া-মায়া-ভালবাসা বলে কোন বস্তু নেই, ছিল কিনা তাতেও সন্দেহ। তবে কর্তব্যজ্ঞান ছিল। ছয় মাস আগের প্রতিটি সকালে তিনি সুদীপকে প্রশ্ন করতেন, সব ঠিক আছে? আমি চাই তুমি বড় হয়ে আমার প্র্যাকটিশে আসবে। তোমার জন্যে যে সোনার খনি রেখে যাচ্ছি তা কোনও বাপ তার ছেলের জন্যে রেখে গেলে ধন্য হত সেই ছেলে। যাও। একদম মালা জপার মত একই শব্দাবলী বোজ আওড়ে যাওয়া। কথাগুলো শোনার সময় শেষের দিকে হাসি পেত সুদীপের। ছয় মাস আগে সেটা চুকে গেল। চুকিয়ে দিল সুদীপ।
 
অবনী তালুকদার আর একটি কর্তব্য নিয়মিত করে থাকেন। হাইকোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পর প্রথমেই চলে যান স্ত্রীর দরজায়। ঘরে ঢোকেন না, যেখানে দাঁড়ান সেখান থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। বেশির ভাগ দিনই নার্স জবাব দেয়। সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান তিনি নিজের ঘরে। হ্যাঁ, স্ত্রীর জন্যে অবনী তালুকদার নার্স রেখেছেন। আয়া রাখলে অনেক কম খরচ হত। প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তার আসেন। ডাক্তারের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। স্ত্রীর শরীরের জন্যে পয়সা খরচ করতে কোনদিন কার্পণ্য করেননি। এসবই তার কর্তব্যপালনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত হবে।

আজ রাত্রে অবনী তালুকদার ফিরবেন না। খবরটা জেনেছে সুদীপ কার্তিকদার কাছ থেকে। সচরাচর অত্যন্ত লাভজনক মামলা না পেলে কলকাতা ছেড়ে নড়েন না অবনী তালুকদার। আজ নিশ্চয়ই শিকারটা বড় মাপের, না হলে পাটনায় যাবেন কেন? অতএব সেই দিক দিয়ে বাড়িটা খালি। অবনী তালুকদার থাকলেও কোন অস্তিত্ব বোঝা যেত না। বরং ঝি-চাকরদের ওপর হুকুমজারি আছে কেউ যেন গলা তুলে কথা না বলে। সব সময় একটা শান্ত পরিবেশ বাড়িতে পেতে চান অবনী তালুকদার। ঠিক দশটায় সদর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। সুদীপের অবশ্য ইদানীং তাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সদর বন্ধ হয়ে গেলে সুদীপ পেছনের পাঁচিল টপকে ভেতরে চলে আসে। কার্তিকদার দরজা খোলাই থাকে। সেইটে দিয়ে দোতলায় উঠে আসতে কোন অসুবিধে নেই। অবনী তালুকদার যে ব্যাপারটা জানেন না, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এই বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ যে কিভাবে আছে সে হিসেব তিনি নিত্য রাখেন।

সুদীপ দোতলার হলঘরে এল। ঝি-চাকররা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছে। মাঝে মাঝে সামনে রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ ছাড়া এই বাড়ি এখন একদম চুপচাপ।

মায়ের ঘরটা একদম কোণায়। দরজায় এসে দাঁড়াতেই হালকা নীল আলোয় ঘরটাকে দেখতে পেল। মা শুয়ে আছেন খাটে। একটা হালকা চাদর তার গলা পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া। যেহেতু এখন মায়ের শরীর ওপাশ-ফেরানো তাই এখান থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না।

সুদীপ কয়েক পা এগিয়ে এসেই থমকে দাঁড়াল। মায়ের বিছানার ওপাশে একটা লম্বা ডেক-চেয়ারে শুয়ে আছেন একজন মহিলা। মাথাটা এক পাশে হেলানো, চোখ বন্ধ। কোলের ওপর একটি রঙিন সিনেমা পত্রিকা খুলে উপুড় করে রাখা। সেখানে বোম্বের একজন সুন্দরী শরীর আধখোলা করে মদির হাসছে। সুদীপ বুঝল এই নার্সটি নতুন। বাবার নির্দেশে মায়ের নার্স প্রতি মাসেই বদলে যায়। এ ব্যাপারে অবনী তালুকদারের থিয়োরি হল, অসুস্থ মানুষের সেবা কেউ দীর্ঘকাল করলে একঘেয়েমি আসতে বাধ্য এবং সেটা এলে সেবায় গাফিলতি দেখা দেবে। অতএব নতুন নতুন নার্স চাই। এই মহিলাটিকে সুদীপ আগে দ্যাখেনি। শেষবার এই ঘরে এসেছিল সে তিনদিন আগে! মা অসুস্থ হওয়ার পর নিত্য দুবেলা আসত সে। কিন্তু এখন! সুদীপ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। নিজের এই পরিবর্তনের পেছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পায়নি। হয়তো দীর্ঘকালীন অসুস্থতা এক ধরনের বিরক্তি উৎপাদন করে কিংবা প্রতিনিয়ত একই যন্ত্রণার প্রকাশ দেখে দেখে তার গুরুত্ব কমে যায়। আর যে কারণটা সেটা তো ছয় মাস আগেই ঘটেছিল। মা কখনও প্রতিবাদ করতে শেখেননি। তিনি যতই অত্যাচার করুন, স্বামীর সামনে চোখ তুলে রূঢ় কথা বলা ধৃষ্টতা, মায়ের এই টিপিক্যাল দাসসুলভ মনোভাব সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। মায়ের সঙ্গে একসময় এই ব্যাপারে অনেক কথা বলেও সে একটি জবাব পেয়েছে, কি হবে, আমার তো যা হবার তা হয়েই গেছে, মিছি মিছি ওই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে! শুরুতেই যখন সব মেনে নিয়েছি–।

মাকে কখনও শ্রদ্ধা করেনি সুদীপ। মাকে সে ভালবাসত একটা নরম স্নেহপ্রবণ অনুভূতির জন্যে। অসহায় মানুষটি জানেন না তার গণ্ডি কি, নিজেকে উজাড় করে দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়ান, দেওয়াটা ঠিক হল কিনা, যদি সে রাগ করে। এমন মানুষের প্রতি মায়া জন্মায়, মায়া থেকে ভালবাসাও আসে কিন্তু শ্রদ্ধা যদি তার সঙ্গে না মেশে তাহলে সেই ভালবাসা একসময় ফিকে হয়ে যেতে বাধ্য। মায়া আর করুণা কি এক? সুদীপ জানে না। কিন্তু মায়ের জন্যে তার কষ্ট হত। অবনী তালুকদারের বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে মা কেন এমন কুঁকড়ে থাকবেন?

কিন্তু এ তো গেল ভেতরের ব্যাপার। মায়ের শরীর নিয়ে প্রাথমিক দুশ্চিন্তা এবং কষ্টের সময়টুকু পার হয়ে গেলে সে যখন জেনেছিল আর কখনও সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই তখন থেকেই নিজের অজান্তে মনের রাশ ঢিলে হতে শুরু করেছিল। ঠিকঠাক চিকিৎসার নামে তদারকি চলছে, নার্স আছে, ব্যাস! মায়ের যন্ত্রণাগুলো, শরীরের বিভিন্ন উপসর্গগুলো বারংবার একই চেহারা নিয়ে আসছে ফিরে যাচ্ছে। এ থেকে যখন আর কোন পরিত্রাণের আশা নেই তখন অনুভূতির চামড়া একটু একটু করে মোটা হয়ে গেল। একমাত্র মৃত্যু-সংবাদ ছাড়া মা আর কোন আলোড়ন তুলতে পারবেন না এবং সেটাও একটা মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার মত। সত্যি বড় কষ্ট পাচ্ছিল। এভাবে বেঁচে মরে থাকার চাইতে অনেক আগেই চলে গেলে ঢের বেশি বেঁচে যেত।
 
অতএব, ব্যাপারটা এমনভাবে ভেবেছে সুদীপ। প্রিয়জন সে যতই প্রিয় হোক না কেন, অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সে অসুখে জীবনহানির সম্ভাবনা থাকলে তো বটেই, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিকারের জন্যে। হয়তো শেষ সম্বল ব্যয় করতেও কার্পণ্য করে না। কিন্তু যদি সেই অসুস্থতা দীর্ঘকালীন হয়, যদি কোনদিন সুস্থ হবার সম্ভাবনা না থাকে তখন একসময় দায় বলে মনে হতে বাধ্য। কেউ মুখে বলেন, কেউ ব্যবহারে প্রকাশ করে ফেলেন, কেউ বলেন না বোঝেন না কিন্তু মনে মনে জানেন মুক্তি পেলে ভাল হত।

সুদীপ খাটের এ-পাশে চলে এল। যত দিন যাচ্ছে তত মায়ের শরীর ছোট হয়ে আসছে। মুখ বসে গিয়েছে, চোখ কোটরে। কিন্তু চুলগুলো প্রায় একইরকম আছে। হয়তো নিয়মিত স্নান হয় না বা তেল মাখানো সম্ভব হয়নি বলে ফুলে-ফেঁপে একাকার। একটা মানুষের চেহারা পালটাতে পালটাতেও তো কিছুটা থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া শরীর নিয়ে মা এখন শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। মাঝে মাঝে শরীরটা কাঁপছে।

বসুন।

সুদীপ চমকে ফিরে তাকাল। মহিলার মুখে একটু বিব্রত হাসি, হাত বাড়িয়ে ডেক-চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ মাথা নাড়ল, কেমন আছেন এখন?

আছেন এই পর্যন্ত। সমস্ত শরীরে বেডসোর হয়ে গেছে। আমি পাউডার দিচ্ছি কিন্তু আসলে উনি যদি বসতেও পারতেন তাহলে।

বেডসোর! সে তো সেরে গিয়েছিল।

প্রথমবার হয়ে সেরে যায়। কিন্তু আবার হলে সামলানো মুশকিল। সেইটেই হয়েছে। দেখবেন? সুদীপ কিছু বলার আগেই মহিলা এগিয়ে গিয়ে মায়ের শরীর থেকে চাদর সরিয়ে নিল খানিকটা। আর চমকে উঠল সুদীপ। হাঁটুর ওপর থেকে কোমর পর্যন্ত চাপ চাপ শাল ঘা বীভৎস হয়ে আছে।

মহিলা চাদর নামিয়ে দিলেন। এ-পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রেখেছি কারণ ওদিকটায় সামান্য কম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে রাখাও যাবে না। ওঁর যে কি যন্ত্রণা হচ্ছে কি বলব।

ডাক্তারবাবুকে বলেছেন?

আমি আসার পর একবারই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দিনে যিনি থাকেন তিনি বললেন, ডাক্তারবাবু বলেছেন ওষুধ দিতে। বিশেষ কিছু করার নেই। আপনি বসুন না। এবার মহিলা আর একটা চেয়ার এনে কাছে রাখলেন।

সুদীপ বসল। নার্স মহিলা বোধহয় অনেকক্ষণ কথা না বলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন এবং কথা বেশি বলাই বোধহয় স্বভাব, খুব যন্ত্রণা পাচ্ছেন। এরকম কেস তো আমি আগে দেখেছি। কেউ কেউ বছরের পর বছর কষ্ট পেয়ে পেয়ে তবে যেতে পারেন।

উনি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

হ্যাঁ। তবে স্পষ্ট বলতে পারেন না তো। খনখনে হয়ে গেছে গলার স্বর। আর কথা বলতেও কষ্ট হয়। তবে এর মধ্যে মজার কথাও বলেছেন।

কিরকম? সুদীপ অবাক হল।

এই তো আজ বিকেলে এলে বললেন, তুমি এলে ভাল লাগে। বেশ দেখতে ভাল তুমি। আমি মনে মনে হেসে বাঁচি না। আমাকেও নাকি ভাল দেখতে।



সুদীপ ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। একটু লাজুক অভিব্যক্তি, চোখে চোখ পড়তে মুখ নামালেন। মধ্যতিরিশে শরীর যথেষ্ট যৌবনবতী। সে বলল, মাকে কি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ। না হলে যে ঘুমুতেই পারেন না। এত যন্ত্রণা নিয়ে বিনা ওষুধে কি ঘুমানো যায়?

ও! সুদীপ বুঝল এখন এই ঘরে বসে কোনও লাভ নেই। নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধের পরিমাণটা বেশি না হলে অমন নিঃসাড়ে পড়ে থাকতে পারে না কেউ। মানুষের জীবনীশক্তি কখনও কখনও বিস্ময় ছাড়িয়ে যায়। তিনবার সিরিয়াস অ্যাটাক হয়ে গেছে। একসময় ব্রেন কাজ করছিল না, সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল, ম্যাসেজ করে চিকিৎসায় থেকে থেকে শরীরে সামান্য সাড় এল, মুখে আবার কথা ফুটল। কিন্তু প্রেসার নিয়ত এমন কম বেশি হতে লাগল যে চতুর্থ অ্যাটাকের জন্যে তৈরি ছিল ওরা। এবং সেটাই শেষবার একথা সবাই জানত। তার বদলে ব্লাড ইউরিয়া বাড়ল। যাবতীয় রোগ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন সব ছেড়ে শুধু বেডসোর নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এক একটা রাত আগে এমন কেটেছে যে ভোর হবার আগেই মা চলে যাবেন বলে মনে হত। অথচ এইভাবে বেঁচে মরে থাকতে হচ্ছে।

সুদীপ উঠল, আপনি খাওয়া-দাওয়া করেছেন?

হ্যাঁ। ফ্ল্যাক্সে চা রেখেছি, খাবেন?

না। আপনি আর বসে থেকে কি করবেন! উনি যখন উঠবেন না তখন শুয়ে পড়ুন।

আমাদের কি শুলে চলে। পেসেন্ট ঘুমের ঘোরে পেচ্ছাপ পায়খানা করে ফেলতে পারে। জেগে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। মহিলা হাসলেন।

সুদীপ মনে মনে বলল, সে তো দেখতেই পেয়েছি ঘরে ঢোকার সময়। সে যাওয়ার সময় বলল, ঠিক আছে। কাল সকালে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলব।

মহিলা বললেন, যদি কোনও কারণে রাত্রে ঘুম ভাঙে তাহলে খবর দেব?

কোন জরুরি ব্যাপার নয় তবু সুদীপ না বলতে পারল না।

বাইরে বেরিয়ে এসে সুদীপের দৃষ্টি গেল অবনী তালুকদারের ঘরের দিকে। দরজাটি বন্ধ। পর্দা ঝুলছে। দরজায় তালা না দিয়ে কি অবনী তালুকদার পাটনায় যাবেন? বিশ্বাস হয় না। সুদীপ এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরাল। তার অনুমানে ভুল হয়নি। পিতৃদেব এত বড় ভুল করবেন না। অভিজ্ঞতা থেকেই তো মানুষ শিক্ষা নেয়।

অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ? সুদীপের ঠোঁটে হাসি ফুটল। অসম্ভব। কোনদিন কি কেউ নেয়? নেওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। নিতে গেলে অনেক কাজ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন শেষ করতে পারত না। সাতষট্টি থেকে একাত্তরে এদেশে যে উদ্যোগের জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছিল তা থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে এদেশে কেউ কখনও বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষের চেহারা পালটাতে চাইবে না। কিন্তু–।
 
সুদীপের খুব ইচ্ছে করছিল তালাটা ভাঙতে। অবশ্য তালা ভাঙলেই কিছু পাওয়া যাবে? কিছুদিন আগে একদিন সকালে অনী তালুকদার যখন কোর্টে বেরুবেন, সুদীপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ, ঠিক তখনই বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিল পুলিশের সাহায্যে আয়কর বিভাগের লোকজন। খুব কৌতুক বোধ করছিল সুদীপ যখন আয়কর অফিসার বলেছিলেন বাড়ির সবাইকে একটি ঘরে অপেক্ষা করতে যতক্ষণ অনুসন্ধান শেষ না হয়। সেই সময় তদন্তকারী অফিসার জানতেন না, একজনের পক্ষে বিছানা ছেড়ে ওঠাই সম্ভব নয়। অবনী তালুকদার খুব চেঁচামেচি করেছিলেন। ব্যাপারটা আদালতে তুলবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এত নির্দিষ্ট আইনী যে তাকে সব হজম করতে হয়েছিল। বাড়ি ঘেরাও হচ্ছে দেখে প্রথমে সুদীপ নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিল। যদিও ওই সময় সে এমন কিছু করেনি যে তার ওপর পুলিশের নজর পড়বে। কিন্তু যোগাযোগ থাকার অভিযোগ তো থাকতেই পারে। একাত্তরের অনেক গল্প শোনা এবং পড়া ছিল। চকিতে মনে হয়েছিল পেছনের পথ দিয়ে পালাবে কিনা? সেইসময় উত্তেজিত হয়ে অবনী তালুকদারকে ছুটে আসতে দেখেছিল সে। কপালে ঘাম জমেছে। মুখের রঙ একেবারে কালো। তাকে দেখে ঘন ঘন নিঃশাস ফেলতে ফেলতে বললেন, খোকা, আমাকে তুই বাঁচা–সেভ-মি! ইনকামট্যাক্স রেইড করেছে।

এইরকম চেহারায় অবনী তালুকদারকে দেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না সুদীপ। তবু জি। করেছিল শক্ত হয়ে, আমি কি করব?

এই ব্যাগটাকে সরিয়ে ফেল। ওরা যেন টের না পায়। কুইক!

কি আছে ওতে?

যাই থাক, তোমার তাতে কি? ব্যাগটাকে লুকিয়ে রাখ, ওরা চলে গেলে ফেরত চাই। ছেলের হাতে সেটাকে ধরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে গেলেন অবনী তালুকদার। নিচে তখন হৈচৈ হচ্ছে। অবনী তালুকদার অফিসারদের ওপর তড়পাতে শুরু করেছেন। সুদীপ ব্যাগটা খুলতে গিয়েও খুলল না। কিভাবে ব্যাগ পাচার করবে সেটা অবনী বলেননি। পেছনের দরজায় তো পুলিশ থাকতে পারে। সে ব্যাগটাকে তুলে হলঘরের টেবিলের উপর রেখে দিল। এবং তারপরেই অফিসাররা উঠে এলেন। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি?

আমি সুদীপ।

অবনীবাবুর ছেলে?

নীরবে মাথা নেড়েছিল সুদীপ। এখন হলে কি করত সে জানে না।

অফিসার বললেন, আপনাদের বাড়িটা সার্চ করব। মিস্টার তালুকদারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে খুশি হব। তারপর সহকারীকে বললেন, এই ঘরটা তত বেশ ফাঁকা। বাড়ির সবাইকে এখানেই আসতে বলুন। দেখবেন কেউ যেন এই ঘর ছেড়ে না যায়!

সুদীপ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর নিচ থেকে ঠাকুর চাকর সমেত অবনী তালুকদার উঠে এলেন, দিস ইজ টুমাচ বাক্যটি উচ্চারণ করতে করতে। দ্বিতীয় অফিসার তাকে হুকুম শোনাতেই তিনি সুদীপের পাশের চেয়ারে বসে রুমালে মুখ মুছলেন। খুবই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। কাজের লোকেরা ঘরের অন্য কোণে জড়ো হয়েছিল চুপচাপ। রুমালটা পকেটে পুরে সামনে তাকাতেই স্থির হয়ে গেলেন এক মুহূর্তে অবনী তালুকদার। তার চোখ একবার ছেলে আর একবার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ব্যাগটার মধ্যে ঘুরল। সুদীপ দেখল উনি উঠতে গিয়েও সামলে নিলেন। সমস্ত মুখ মড়ার মত সাদা হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় চাপা গলায় গর্জন করলেন যেন, ওটা ওখানে রেখেছ কেন?

রাখার জায়গা পাইনি। ঠোঁট না নেড়ে শব্দ তিনটে উচ্চারণ করল সুদীপ।

স্কাউন্ড্রেল! ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি? ব্যাগটাকে সরাও-ওঃ ভগবান।

সুদীপ দেখল অফিসাররা টেবিলটার পাশেই দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে নিচ্ছেন কি ভাবে কাজ শুরু করবেন। ওরা কেউ ব্যাগটার কথা খেয়াল করছেন না। অবনী তালুকদারের চোখের দৃষ্টি আঠার মত ব্যাগটার গায়ে লেগে আছে। সুদীপ চাপা গলায় বলল, ওইভাবে দেখলে ওরা বুঝতে পারবে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরালেন। তারপর বললেন, আমার বুকে ব্যথা করছে।

সুদীপ বাবার দিকে তাকাল। তারপর গলা তুলে অফিসারকে খবরটা জানাল। ভদ্রলোক দ্রুত ছুটে এলেন, হোয়াটস দ্য ট্রাবল? আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

হ্যাঁ বলতে গিয়ে না বললেন অবনী, বোঝা গেল। তারপর বললেন, ঠিক আছে।

অফিসার জানালেন, আপনার মেডিক্যাল হেলপ দরকার হলে বলবেন।

ওঁরা সরে গেলে অবনী চাপা গলায় বললেন, সোয়াইন!

সুদীপ নীরবেব মাথা নাড়ল, অবশ্যই।

ধুন্দুমার কাণ্ড চলল। অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেল। অবনী তালুকদারের ঘর থেকে সত্তর হাজার টাকার নোট পাওয়া গেল। এবং প্রচুর কাগজপত্র। সুদীপ লক্ষ্য করল অফিসাররা এই মুহূর্তে প্রশ্ন করছেন না কিছু। তারা প্রাপ্ত জিনিসগুলোর একটা তালিকা তৈরি করছেন মাত্র। এইসময় অবনী তালুকদার চিৎকার করে উঠলেন, ওহ নো। ওগুলো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা সবার সামনে টেনে আনতে পারেন না!

অফিসার নির্লিপ্ত গলায় বললেন, আপনার যেসব ব্যক্তিগত জিনিসের সঙ্গে গোপন সম্পদের কোন যোগাযোগ নেই সেগুলোয় আমরা হাত দিচ্ছি না মিস্টার তালুকদার। কিন্তু খুজতে হলে তো এগুলোতে হাত দিতেই হবে।


তিনটে অ্যালবাম পড়ে আছে মাটিতে। একবার তাকিয়ে সুদীপ মাথা নামিয়ে নিল। মেয়েটাকে সে চেনে। এই বাড়িতেই কাজ করত। জন্মদিনের পোশাকে অবনী তলুকদার ওর ছবি কবে তুললেন কে জানে! কিন্তু এই মেয়েটিকে নিয়ে তো কোন গোলমাল হয়নি। যাকে নিয়ে গোলমাল হয়েছিল, তারপর এই বাড়িতে আর কোনও অল্পবয়সী মেয়েকে কাজে রাখা হয়নি। তার আগে প্রায় প্রতি মাসে একটা করে ঝি আসত আর যেত। ঘটনার কথা মনে পড়তেই শরীর গুলিয়ে উঠল সুদীপের। অবনী তালুকদারের পাশে বসতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top