What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected আমার প্রিয় কবিতাগুলো............ (1 Viewer)

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে- প্রদীপ বালা
একটা রক্ত করবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
ঋতু আসে ঋতু যায়
ভীড় ঠেলা ট্রাম ব্যস্ত মানুষ
সব পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
ঝুপ করে ফের সন্ধ্যা নামে
ক্লান্ত পাখির ডানার ঝাঁপটা
শুনতে শুনতে দাঁড়িয়ে আছি
এই শহরে আবারও ফের
বসন্তেরই অপেক্ষাতে
দাঁড়িয়ে আছি

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
ভয় ধরল রাষ্ট্রযন্ত্রের
লাঠি হাতে তেড়ে এল সাঁজোয়া ভবন
টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটল
জলকামানে ভিজে গেল মানুষ যত
রাজপথে সব দাঁড়িয়ে ছিল
উজাড় হল গ্রাম থেকে গ্রাম
উজাড় হল বস্তি কত
দেশদ্রোহীর তকমা পেল
মানুষ যারা আওয়াজ দিল

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
একলা কৃষক ধানের আলে বসে থাকে
ফলিডলের শিশি হাতে
ধান থেকে সুখ উবে গেছে বহু আগে
‘মন কী বাতে, মন কী বাতে’

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
পিলপিলিয়ে মানুষ এল
শহর থেকে গ্রামের থেকে
বস্তি থেকে গঞ্জ থেকে
রাস্তা মোড়ে জটলা হল
দেশপ্রেমীরা দৌড়ে এল
গেরুয়া বসন দৌড়ে এল
ধরল কলার ধরল টুঁটি
স্বদেশ প্রেমের আঁটুনিতে
প্রেমের দশা ‘ফস্কা গেরো’

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
হা বসন্তে বৃষ্টি ছাঁটে
রক্ত চোখে সূয্যি পাটে

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
অনেক কথা আটকে আছে
অনেক হাতে হাত রাখেনি
প্রেমিক যুবক
ব্যর্থ হাওয়ায় উড়ে গেছে
নিজের মতো একলা বিকেল
হারিয়ে গেছে অন্ধকারে

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
একলা মেয়ের পথ আটকালো
মুখোশ পরা রাজনীতিকে
বুকের আঁচল উড়িয়ে দিল
নষ্ট হাওয়ার স্বদেশপ্রেমে
চতুর্দিকে চতুর্দিকে

রক্তকরবী ফুটবে যেদিন
পুড়বে শহর ছুটবে মানুষ
রক্তচোখে
মিছিল থেকে মিছিল হবে
রাজপথে ফের জুড়বে মানুষ
ধ্বংস হবে মিথ্যে ফানুস,
মানুষ এসে পথ দেখাবে
মুখ লুকোবে রাষ্ট্রযন্ত্র
রক্ত চোখের বাড়বে বহর

তাই,
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
ফুটপাতে ফুটপাতে আবার
বিপ্লবের গান শুনবো বলে
দাঁড়িয়ে আছি
পচাগলা লাশের শহর
আগুন চোখে পোড়াব বলে
দাঁড়িয়ে আছি
২৮ দিনের শিশুর কাছে
সহিষ্ণুতা শিখব বলে
দাঁড়িয়ে আছি

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি…
পঁচিশ বছর…
একটা রক্ত করবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
ঋতু আসে ঋতু যায়
ভীড় ঠেলা ট্রাম ব্যস্ত মানুষ
সব পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
ঝুপ করে ফের সন্ধ্যা নামে
ক্লান্ত পাখির ডানার ঝাঁপটা
শুনতে শুনতে দাঁড়িয়ে আছি
এই শহরে আবারও ফের
বসন্তেরই অপেক্ষাতে
দাঁড়িয়ে আছি

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
ভয় ধরল রাষ্ট্রযন্ত্রের
লাঠি হাতে তেড়ে এল সাঁজোয়া ভবন
টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটল
জলকামানে ভিজে গেল মানুষ যত
রাজপথে সব দাঁড়িয়ে ছিল
উজাড় হল গ্রাম থেকে গ্রাম
উজাড় হল বস্তি কত
দেশদ্রোহীর তকমা পেল
মানুষ যারা আওয়াজ দিল

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
একলা কৃষক ধানের আলে বসে থাকে
ফলিডলের শিশি হাতে
ধান থেকে সুখ উবে গেছে বহু আগে
‘মন কী বাতে, মন কী বাতে’

একটা রক্তকরবী ফুটবে বলে
পিলপিলিয়ে মানুষ এল
শহর থেকে গ্রামের থেকে
বস্তি থেকে গঞ্জ থেকে
রাস্তা মোড়ে জটলা হল
দেশপ্রেমীরা দৌড়ে এল
গেরুয়া বসন দৌড়ে এল
ধরল কলার ধরল টুঁটি
স্বদেশ প্রেমের আঁটুনিতে
প্রেমের দশা ‘ফস্কা গেরো’

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
হা বসন্তে বৃষ্টি ছাঁটে
রক্ত চোখে সূয্যি পাটে

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
অনেক কথা আটকে আছে
অনেক হাতে হাত রাখেনি
প্রেমিক যুবক
ব্যর্থ হাওয়ায় উড়ে গেছে
নিজের মতো একলা বিকেল
হারিয়ে গেছে অন্ধকারে

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
একলা মেয়ের পথ আটকালো
মুখোশ পরা রাজনীতিকে
বুকের আঁচল উড়িয়ে দিল
নষ্ট হাওয়ার স্বদেশপ্রেমে
চতুর্দিকে চতুর্দিকে

রক্তকরবী ফুটবে যেদিন
পুড়বে শহর ছুটবে মানুষ
রক্তচোখে
মিছিল থেকে মিছিল হবে
রাজপথে ফের জুড়বে মানুষ
ধ্বংস হবে মিথ্যে ফানুস,
মানুষ এসে পথ দেখাবে
মুখ লুকোবে রাষ্ট্রযন্ত্র
রক্ত চোখের বাড়বে বহর

তাই,
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি
ফুটপাতে ফুটপাতে আবার
বিপ্লবের গান শুনবো বলে
দাঁড়িয়ে আছি
পচাগলা লাশের শহর
আগুন চোখে পোড়াব বলে
দাঁড়িয়ে আছি
২৮ দিনের শিশুর কাছে
সহিষ্ণুতা শিখব বলে
দাঁড়িয়ে আছি

একটা
রক্তকরবী ফুটবে বলে
দাঁড়িয়ে আছি…
পঁচিশ বছর…
 
কেউ কথা রাখেনি -জসিম উদ্দিন মোহাম্মদ



চেয়ে দেখি সজনে ডালটা ঠিক আগের মতোই আছে।
মৃদু মন্দ বাতাসের ঝাঁক ছেঁড়া দ্বীপে নোঙর তুলে
কার জানি পথ চেয়ে বসে আছে;
বড় কম সময় নয়; বেশ কয়েক যুগ তো হবেই!

সালাম, শফিউরের অতৃপ্ত আত্মারা এসেছিল কালও;
আমি কোন সদুত্তর দিতে পারিনি।
বলতে পারিনি আমি ভাল আছি,
আমার পাণ্ডুর মুখ দেখে যা বুঝার তাঁরা বুঝে নেয়।
অতঃপর এক সাগর পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর ঘৃণার
অকাল দীর্ঘশ্বাস মাঝ রাত পাণ্ডুর করে দেয়।

এমনি করে
রাতের পর রাত, দিনের পর দিন কেঁদে কেঁদে হয়রান হই।
কেউ শুনেনি। শোনার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
কেউ কথা রাখেনি,
শুকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে আমার অন্তরাত্মা !
এখনও পীচ ঢালা কালো পথে শহীদের রক্তের ছোপ ছোপ দাগ
দুঃখিনী মায়ের চোখের জলে মুছে যায়নি ।

ডাহুক ডাকা রাত অবশেষে ভোর হয়, ডেকে আনে প্রভাতফেরি
স্বর্গ থেকে এসে মিছিলে যোগ দেয় রফিক ভাই।
জাব্বার ভাই।
তারা সক্রোধে চিৎকার করে।
জানতে চায় নাড়ী ছেঁড়া ফুল নিয়ে কেন এতো কাড়াকাড়ি?
কেউ জবাব দেয় না।
আবারও শপথের মালা গলে পড়ে।
সূর্য দেব রক্তিম হওয়ার আগেই আবার সুতো ছিঁড়ে যায়।
কেউ কথা রাখেনি।
ফুলগুলো শহীদ মিনারে লাওয়ারিশ পড়ে থাকে।
কেউ খবর নেয় না।

এমনি করে ফি বছর নগ্ন পদ বিক্ষেপে ৮ই ফাগুন আসে।
শহীদের বেদীতে তোমাদের পুষ্পদান আমায় পুলকিত করে,
সভায় সভায় আশ্বাসের ফুলঝুরিতে আমার নিঃশ্বাস বেড়ে যায়!
অতঃপর সব কিছু ভেঙ্গে যায়,
স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে আসে,
আমি অবাক চোখে কেবল তাকিয়ে দেখি, কেমন করে
চেতনার বহ্নি শিখা বিশ্বায়নের উদোম হাওয়ায় মিশে যায়!
 
মানুষ- নির্মলেন্দু গুণ
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,

ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি।
 
গুড মর্নিং বাংলাদেশ- শামসুর রহমান
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত,
হাউ ডু ইউ ডু?
সুপ্রভাত সাতরওজা, মাহুংটুলি, নবাবপুর,
বঙ্গবন্ধু ত্র্যাভিনিউ, পুরানা পল্টন;
সুপ্রভাত বাগেরহাট, মহাস্থানগাড়, ময়নামতি,
সুপ্রভাত পলাশতলী পাড়াতলী,
সুপ্রভাত কক্সবাজার, হিমছড়ি;
সুপ্রভাত আদিয়াবাদের খাল, তাল তমাল হিন্তাল,
নিতাই জেলের জাল, কাশেম মাঝির নাও,
বঁইচি ফুল, কামেলার কানের দুল,
সুপ্রভাত বরিশাল, সুনামগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, টেকনাফ,
সুপ্রভাত বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা,
সুরমা, কর্ণফুলী।
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত,
তুমি কেমন আছো?
বাংলাদেশ, কখনো তুমি ডুরে শাড়ি পরে
ধান ভানো, কখনো জিন্স পরে মেতে ওঠো
ডিসকো নাচে।
কখনো তুমি কলসি কাঁখে জলকে যাও, কখনোবা
পুকুরঘাটে গল্প করো, সুন্দর একটা পাখি দেখে ভাসো
খুশির ঢেউয়ে, গ্রীষ্মের দুপুরে তালপাতার
পাখা দিয়ে বাতাস ক’রে
ঘুম পাড়াও পঞ্চম সন্তানকে; পান, সুপুরি এগিয়ে দাও
অতিথির দিকে, রাঁধো পাবদা মাছের সালুন;
পৌষালী রাতে একা একা তৈরী করো
নক্শি কাঁথা। দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশ, যারা তোমার সংস্কৃতির পাছায়
চিমটি কাটে, ঘষে দেয় বিষলতা,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন।
যারা তোমার বাজু থেকে কেয়ূর,
নাক থেকে নোলক আর নাকছাবি,
গলা থেকে হাঁসুলি,
কোমল থেকে বিছাহার খুলে নিয়ে
পাচার করে দেশান্তরে,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন,
যেসব ধাপ্পাবাজ সুদিনের সপক্ষে মিথ্যার থুতু ছিটায়,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন।
শোনো বাংলাদেশ, স্বপ্নের ফেনা তোমার চোখ
এমন অন্ধ হয়ে যায়নি যে, তুমি
দেখতে পাচ্ছো না শকুনের ঝাঁক বড়শির মতো নখ দিয়ে
আকাশের উদর ছিঁড়ে খুঁড়ে হিঁচড়ে টেনে আনছে
মেঘের নাড়িভুঁড়ি;
দেখতে পাচ্ছো না সংসদ ভবন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে,
রাজনীতিবিদগণ জনগণের কাছ থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে বনভোজন করছেন দীর্ঘকাল;
শাসনতন্ত্র কাটা ঘুড়ির মতো ভাসমান,
উন্নয়ন বিশারদগণ পাঁচসালা পরিকল্পনাকে
কুরে কুরে খাচ্ছেন ঘুণের ধরনে।
দেখতে পাচ্ছো না বখাটে বুদ্ধিজীবীদের মাথায়
বেধড়ক উৎসাহে ক্রমাগত হাগছে প্যাঁচা আর বাদুড়,
দেখতে পাচ্ছো না, সাত ঘাট থেকে চেয়ে-চিন্তে-আনা
হে ব্যর্থ অন্নপূর্ণা,
যে, তোমার সন্তানের পাতের ভাত খায় সাত কাকে।
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত
হাউ ডু ইউ ডু?
তুমি কি জেল্লাদার হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো
বিদেশীকে দেখে
তোমার ঊরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমেষে?
আমি আমার আগুন-ওগড়ানো চোখ হ্যামলেটের মতো
এখন সরিয়ে নিচ্ছি বটে, কিন্তু হে ধর্ষিতা,
বারবার আমি আমার লড়াকু হাত-পাগুলোকে ভুলিয়ে
ভালিয়ে
রাখতে পারবো কি?
 
হওয়া না হওয়ার গল্প- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সে চেয়েছিলো
একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে।
তার তো
একটাই জীবন। মানুষের জীবনে প্রেমের চেয়ে নির্মল
পিপাসার জল আর কী থাকতে পারে?
সে আরও অনুভব করতো
প্রেমই কবিতার প্রাণ, তার শব্দ, তার ধ্বনি –
তার মন্ত্র।
কিন্তু তবু
তার কবিতা, একটার পর একটা তার নিজের লেখা কবিতা
কি প্রেম কি জল
এমনকি পায়ের নিচের শক্ত মাটি পর্যন্ত খুঁজে পেলো না।
কবিতার জন্য তার দিবস-রজনীর জাগরণ
যা ছিলো তার জীবনের কঠিনতম সত্য
প্রেম নয় – তাকে বারবার অপ্রেমের দারুণ আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে
বলতোঃ ‘এখানেই তোর পরিশুদ্ধি। এই যে আগুন, মানুষের পৃথিবী
আগে তার খিদে মেটা। তোর সমস্ত কবিতা, তোদের সমস্ত কবিতা
সে তার ক্ষুধার্ত জিভ দিয়ে চেটে খাবে। তুই মুর্খ,
জীবনের পাঠ এখান থেকেই শুরু কর।‘
দেখতে দেখতে তার কৈশোর গেল, যৌবন গেল,
এখন তার মাথার সব চুল সাদা, হাতের পাঁচ আঙুলে মাঘের শীত!
মাঝেমধ্যেই রাতদুপুরে ঘুমুতে না-পারার যন্ত্রণায়
সে চিৎকার করে উঠতোঃ
‘আমি একটি প্রেমের কবিতা লিখতে চাই, মাত্র একটি প্রেমের কবিতা।‘
আর তখনই শোনা যেত তার মাথার ভিতর, তার বুকের মধ্যে
সেই কঠিন তিরস্কারঃ
‘বুড়ো হয়ে গেলি, এখনও স্বপ্ন দেখছিস!
দ্যাখ! ভাল করে দ্যাখ! তোর চারদিকে
এখন নতুন ধানের হলুদ হেমন্তের পৃথিবী। কিন্তু তারপর?
তারপর কী দেখছিস? – ধান কাটা হয়ে গেছে, চাষীরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে…
কিন্তু মাঝখানে ও কে? ওরা কারা?’
দেখতে দেখতে তার পাকা ধানের হলুদ পৃথিবী খুনখারাপি লাল,
লাল থেকে আগুন! আবার আগুন! ‘আগুন! তুমি আমাকে
সারা জীবন ধরে পুড়িয়েছ। কিন্তু আমি তো
শুদ্ধ হলাম না। শুধু পুড়ে গেলাম। আমি সারা জীবন
শুধু হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস, তাদের সর্বনাশ
আমার জটায় বেঁধে সরস্বতী-নদীর জলে ঝাঁপ দিতে গেলাম,
কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। তুমি আমাকে কী জীবন শেখাও, আগুন? –
এই কি মানুষের জীবন!’
তার একটিমাত্র প্রেমের কবিতা? … ‘কবিতা! তুমি এখন
তিন ভুবনের কোন্ অতলান্ত অপ্রেমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছ?
ঘুমাও! তুমি ঘুমাও! আর, আমি জেগে থাকি
আর এক আরম্ভের জন্য… মৃত্যুর মুখোমুখি… আমি জেগে থাকি…
 
শুনছো!- তসলিমা নাসরিন
আমি তুমুল প্রেমে পড়েছি তোমার,
শুনছো, শুনতে পাচ্ছে!?
এমন প্রেমে অনেককাল আমি পড়িনি
এমন করে কেউ আমাকে অনেককাল আচ্ছন্ন করে রাখেনি।
এমন করে আমার দিনগুলোর হাত পা রাতের পেটে সেঁধিয়ে যায়নি
এমন করে রাতগুলো ছটফট করে মরেনি!
গভীর ঘুম থেকে টেনে আমাকে তুমি বসিয়ে দিলে–
এভাবে কি হয় নাকি?
আমি হাত বাড়াবো আর এখন তোমাকে পাবো না, রাতের পর রাত পাবো না!
আমি ঘুমোবো না, একফোঁটা ঘুমোবো না,
কোথাও যাবো না, কিছু শুনবো না, কাউকে কিছু বলবো না,
স্নান করবো না, খাবো না!
শুধু ভাববো তোমাকে, ভাবতে ভাবতে যা কিছুই করিনা কেন,
সেগুলো ঠিক করা হয়না–
ভাবতে ভাবতে আমি বই পড়ছি, আসলে কিন্তু পড়ছি না,
বইয়ের অক্ষরে চোখ বুলোনো ঠিকই হবে, পড়া হবে না
ভাবতে ভাবতে আমি সেন্ট্রাল স্কোয়ারে যাচ্ছি, যাচ্ছি কিন্তু যাচ্ছি না,
ঘণ্টা দুই আগে পেরিয়ে গেছি স্কোয়ার, আমি কিন্তু হাঁটছিই,
কিছুই জানি না কী পেরোচ্ছি, কোথায় পৌঁচোচ্ছি,
এর নাম হাঁটা নয়, কোথাও যাওয়া নয়,
এ অন্য কিছু, এ কারও তুমুল প্রেমে পড়া।
---------------------------------------
শুনছো,
তুমুল প্রেমে তুমিও পড়ো না গো!
 
আমার একটা "তুই" চাই- রিফফাত লায়লা
আমার একটা 'তুই' চাই।
কিছু অ-দরকারি কথা বলতাম তাহলে!
একদম এলেবেলে খামখেয়ালি
কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা..

লিখতাম, চা বানাচ্ছি... খাবি?
উত্তর আসতো, চিনি কম দিস একটু!
হুট করে মাথায় গুনগুন করে উঠা
গানের দুটো লাইন লিখলে
পরের চারলাইন টপাটপ উত্তরে চলে আসতো!

রাত দুটোয় এক লাইনের মেসেজ, বইটা পড়া শেষ হলো। সকাল সাতটায় রিপ্লাই, নতুন বই আজই ধরিস না, আজ শুধু আমার সাথে কথা বল..!

এবার জন্মদিনে কী দিবো রে তোকে?
তোর চিবুকের কালো তিলটায় একটা চুমু খেতে দিবি.... ব্যাস!

কিংবা... দূরছাই ভাল্লাগেনা লিখলেই
সাথে সাথে উত্তর, এক্ষুণি চল... কোথাও ঘুরে আসি..
অথচ দুজনেই জানি... আমরা আজ কোত্থাও যাবোনা!!

আমার এমনই একটা 'তুই'ই লাগবে রে
খুব খুব অ-দরকারি কিছু কথা আছে
আমার, তোর সাথেই...!
 
৩২নম্বর মেঘের ওপারে- আনিসুল হক
আকাশের ওপারে আকাশ,

তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—
৩২ নম্বর মেঘমহল।
৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি।
আপনার গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি,
চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা,
হাতে পাইপ।

ছাদের কিনারে সানসেটে উড়ছে কবুতরগুলো।
উঠানে সাইকেল-রিকশা চালাচ্ছে লাল সোয়েটার পরা রাসেল।
পানের ডিব্বা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশের গোল টেবিলটাতে সুপারি কাটায় ব্যস্ত আপনার রেণু।
জামাল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়া ক্যাপটা পরে আয়নায় তাকাচ্ছেন।
ছাদের ঘরে বেহালা বাজাচ্ছেন কামাল। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে বেহালার মূর্ছনা।

আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—৩২ নম্বর মেঘমহল।
সেইখানে দোতলার ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে
পুরু লেন্সের ভেতর থেকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আপনি দেখছেন...

.
যেমন করে দেখেছিলেন
একাত্তরের মার্চে ওড়ানো সবুজের মধ্যে লাল সূর্য আর হলুদ মানচিত্রখচিত পতাকা;
যেমন করে তাকিয়ে দেখেছিলেন সত্তরে একাত্তরে রোজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়
৩২ নম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা-পাগল মানুষগুলোকে;
যেমন করে সাতই মার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ-কোটি চোখে দেখতে পেয়েছিলেন
একটা জাতির জন্মের ফুল ফোটা;
যেন আপনি রিলকে, পৃথিবীর শেষতম কবি যিনি
শিল্পীর মগ্নতা নিয়ে নিরীক্ষণ করেন কী করে কলি থেকে পাপড়ি উন্মীলিত হয়, ফুটে ওঠে ফুল।
আকাশের ওপারে আকাশে
মেঘমহলের ৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি তাকিয়ে আছেন—
বারবার দেখেও আপনার আশ মিটছে না;
শিল্পী যেমন ছবি আঁকা শেষ করে ক্যানভাস থেকে দূরে গিয়ে পুরোটা ছবি বারবার করে দেখেন;
লেখা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ যেমন বারবার পড়তেন তাঁর কবিতা
আর পাণ্ডুলিপিটাকে বানিয়ে ফেলতেন একটা আস্ত শিল্পকর্ম;

তেমনি করে আপনি দেখছেন
আপনার আঁকা ছবিটাকে
দূর থেকে, কিন্তু পূর্ণ চোখে।
তেমনি করে আপনি পড়ছেন আপনার লেখা কবিতাটাকে।
অপার্থিব শিল্পসুষমায় অপরূপ দিব্যকান্তি
আপনি দেখছেন কী রকম জ্বলজ্বল করছে আপনার শিল্পকর্মখানি—
দেখছেন কী রকম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাঙালিরা—
দেখছেন কী রকম মুক্ত কণ্ঠে তারা গাইছে আমার সোনার বাংলা—
স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর
কবিজনোচিত উজ্জ্বলতা আর মগ্নতা অবয়বজুড়ে;
ভোরের সোনালি আলোয় কাঁচা-পাকা চুলে স্বর্গীয় দ্যুতি।

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর জীবনানন্দ দাশের পাশে দাঁড়িয়ে আপনি বলছেন,
‘ওই দেখুন, ওই যে আমার কবিতা—
কবিগুরু, ওই যে আপনার সোনার বাংলা,
বিদ্রোহী কবি, ওই যে আপনার জয় বাংলা,
জীবনানন্দ বাবু, ওই যে আপনার রূপসী বাংলা,

ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
চির অপরূপ চির মধুর চির অপরাজেয় বাংলাদেশ।’

আপনি চশমা খুলে হাতে নিলেন,
আপনার উজ্জ্বল চোখ দুটি থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রু।

অনেক নিচে মর্ত্যের এক চার কোনা ঘরে লেখার টেবিলে বসে আছি—
আমার চোখ ভিজে গেল
আমি পাশ-টেবিলে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
কে বলেছে আপনি নাই, এই তো আপনি আছেন—এইখানে,
সবখানে, সমস্ত বাংলায়—
এইখানে বাংলার লাল ও সবুজে
আমাদের অশ্রু আর ভালোবাসায়,
আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার
আর এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ মন্ত্রে—
‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না...’
 
তিনি এসেছেন ফিরে- শামসুর রহমান
লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।

এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছ্বসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি
কুমোর বউ।

ওরা তাঁকে হত্যা ক’রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।
 
কথা ছিলো সুবিনয়- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত,
রাখালেরা পুনর্বার বাশিঁতে আঙুল রেখে
রাখালিয়া বাজাবে বিশদ।
কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বসবে না,
চিত্রল তরুণ হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না
রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।

কথা ছিলো, শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম।
নদীর চুলের রেখা ধ’রে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ,
কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন।

অথচ দ্রাক্ষার রসে নিমজ্জিত আজ দেখি আরশিমহল,
রাখালের হাত দুটি বড় বেশি শীর্ণ আর ক্ষীণ,
বাঁশি কেনা জানি তার কখনোই হয়ে উঠে নাই-

কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো।
একদিন বট বিরিক্ষির ছায়ার নিচে জড়ো হবে
সহজিয়া বাউলেরা,
তাদের মায়াবী আঙুলের টোকা ঢেউ তুলবে একতারায়-
একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধ’রে বোলবে: উদ্ধার পেয়েছি।

কথা ছিলো, ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে
আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরন্য, জমিন, আমাদের
পাহাড় ও সমুদ্রের আদিগন্ত উপকূল-
আজন্ম এ জলাভূমি খুঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার।

কথা ছিলো, আর্য বা মোঘল নয়, এ জমিন অনার্যের হবে।
অথচ এখনো আদিবাসী পিতাদের শৃঙ্খলিত জীবনের
ধারাবাহিকতা
কৃষকের রন্ধ্রে রক্তে বুনে যায় বন্দিত্বের বীজ।
মাতৃভূমি-খন্ডিত দেহের ’পরে তার থাবা বসিয়েছে
আর্য বণিকের হাত।

আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব
লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা,
প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানারঙ পতাকা ওড়ায়।
কথা ছিলো, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’,
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।
অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু
অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।
জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,
আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top