০১. যুদ্ধের বছর
ক.
যুদ্ধ বাঁধছে। এ পাড়ায় গুঞ্জন, ও পাড়ায় গুঞ্জন। লোক জট পাকাচ্ছে উঠোনে, মাঠে, গলির মোড়ে। কারও চোখ কপালে, কারও নাকের তলায়, হাঁ করা মুখের ভেতর, কারও গালে, কানে, মাথায়। চোখ সবার খোলা। চোখের সামনে দৌড়োচ্ছে লোক, দৌড়োচ্ছে আলোয়, অন্ধকারে। কাচ্চা বাচ্চা বোঁচকা বুচকি কাঁখে নিয়ে, ঘাড়ে নিয়ে, দৌড়োচ্ছে। পালাচ্ছে। পালাচ্ছে শহর থেকে গ্রামে। ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে ফুলপুর, ধোবাউড়া, নান্দাইল। দালানকোঠা, দোকানপাট, ইস্কুলঘর, অমরাবতী নাট্যমন্দির ছেড়ে নদীর ওপারে, ধানক্ষেতে, ধুধু মাঠে, অরণ্যে। ঘর থেকে যারা দু’পা নড়তে চায় না, হৈ হৈ পড়ে গেল তাদের মধ্যেও, বোঁচকা বাঁধ। শকুনেরা ঠোঁটে করে গন্ধ আনছে মরা মাংসের। গুলির শব্দ ভেসে আসছে কবুতরের অস্থির ডানায় করে। মানুষ পালাচ্ছে পায়ে হেঁটে, রেলগাড়িতে, নৌকোয়। ঘরের মত পড়ে থাকে ঘর, উঠোনে গাছগাছালি, জলচৌকি, দা বটি, কালো বেড়াল।
দুটো তিন চাকার মেশিন চালানো গাড়ি এসে থামে আমাদের বাড়ির দরজায়, সন্ধেয়। ওতে চড়ে আমরাও রওনা দিই পাঁচরুখি বাজারের দক্ষিণে মাদারিনগর গ্রামে। শহর ছেড়ে যেই না ফেরি করে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে শম্ভুগঞ্জে পৌঁছই, কোমরে গামছা বাঁধা, ঝোপ থেকে ঝাঁপিয়ে রাস্তায় নেমে ছ’জন যুবক আমাদের নাকের সামনে দাঁড়ায়। দু’হাতে মা’কে আঁকড়ে বিস্ফারিত চোখে দেখি ছ’টি বন্দুক, ছ’টি কাঁধে। অনুমান করি এরই নাম যুদ্ধ, আচমকা পথ আটকে মানুষ মেরে ফেলা। ছ’জনের একজন, নাকের নিচে চিকন কালো মোচ, বলে, গলা ঢুকিয়ে তিন চাকার খোলা দরজায়, শহর খালি কইরা যান কই! সব চইলা গেলে আমরা কারে লইয়া যুদ্ধ করুম! বাড়ি ফিইরা যান। মা বোরখার ঘোমটা তুলে, এক ছটাক রোষের ওপর দু’ছটাক আকুতি মিশিয়ে বলেন, এ কি কন! সামনের গাড়ি তো চইলা গেল। আমার ছেলেরা ওই গাড়িতে। আমাদের যাইতে দেন।
মন গলে না মোচঅলার। কাঁধের বন্দুক মাটিতে ঠুকে চেঁচায়, এক ইঞ্চিও সামনে নড়ব না চাক্কা। পিছাও।
গাড়িকে পিছিয়ে ফেরিতে উঠিয়ে বিড়ি ধরিয়ে গন্ধ ছড়িয়ে কাঁচাপাকা চালক বলে, এরা বাঙালি, আমগোরই লোক, এরা তো আর পাঞ্জাবি না, ডরের কিছু নাই। বুক ধুকপুক করে যেন ছ’টি বন্দুক থেকে ছ’জোড়া গুলি এসে রেগেছে বুকে। দু’পাশে ঠেসে বসা কালো বোরখায় ঢাকা দু’জনের সুরা পড়ার বিড়বিড় আর তিন চাকার ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে শুনতে পার হতে থাকি জুবলি ঘাট, গোলপুকুর পাড়। আর কোনও শব্দ নেই, কেবল আমাদের ধুকপুক, বিড়বিড়, ঘড়ঘড়। রাতের কম্বল মুড়ে আলো নিবিয়ে ঘুমিয়ে গেছে পুরো শহর।
সে রাতেই তিন চাকার গাড়িকে বাবা আবার পাঠিয়ে দিলেন পুবের বদলে পশ্চিমে, মাদারিনগরের বদলে বেগুনবাড়ি। গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে ইয়াসমিন, ছটকু। মা ঝিমোন, জেগে থাকেন আমার সঙ্গে নানি আর নানির হাতে শক্ত করে ধরা নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি।
ঝুড়ির ভিতরে কি গো নানি?
নানি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, চিঁড়ামুড়ি, গুড়।
বেগুনবাড়ি গ্রামে কলাগাছ ঢাকা যে বাড়িটির কাছে আমাদের বিড়িখোর চালক গাড়ি থামায়, সেটি রুনু খালার শ্বশুর বাড়ি।
পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে উঠোনে কুপি উঁচু করে আমাদের দেখে।
শহর থেইকা ইষ্টি আইছে।
কুয়া থেইকা পানি তুলো।
ভাত রান্দো।
পান সাজো।
বিছনা পাতো।
পাঙ্খা কর।
পাতা বিছানায় আড়াআড়ি করে শুই শহরের ইষ্টিরা। ঘুমে কাদা ছটকুর ঠাং আমার ঠ্যাংএর ওপর, ঠ্যাং সরালে পেটে গুঁতো খাই ইয়াসমিনের হাঁটুর। চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মিনমিন করি, কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাইতে পারি না।
ঘামাচি ওঠা গায়ে পাখার বাতাস করতে করতে মা তাঁর ছিঁদকাঁদুনে মেয়ের ঢং শুনে গলা চেপে ধমকান, কোলবালিশ লাগব না, এমনি ঘুমা।
ধমক খেয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা চুপ হয়। চৌকির এক কিনারে গুটিসুটি শুয়ে আছেন নানি, কালো পাড় শাড়িতে ঢাকা তাঁর মুখ মাথা, প্লাস্টিকের ঝুড়ি, চিঁড়ামুড়ি গুড়। চৌকাঠে টিমটিম জ্বলে কুপি, কুপির আলোয় টিনের বেড়ায় পাঁচ হাত পাঁচ পা ছড়িয়ে ভূত নাচে আর হুসহুস ডাকে। দেখে দু’হাঁটুর ভেতর মুখ ডুবিয়ে বলি মা ও মা, আমার ডর করে মা।
কোনও সাড়া নেই মা’র, ঘুমিয়ে ছটকুর মত কাদা।
ও নানি, নানি গো।
নানিও রা করেন না।
ভূতের বিদ্যেয় আমার হাতেখড়ি শরাফ মামার কাছে। এক রাতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে তিনি বলেছিলেন, পুস্কুনির পাড়ে দেখলাম শাদা কাপড় পরা একটা পেত্নী খাড়োয়া রইছে, আমার দিকে চাইয়া পেত্নী একটা বিজলি দিল, আর আমি লেঙ্গুর ফালাইয়া দৌড়।
শরাফ মামা ঠিরঠির কেঁপে লেপের তলায় ঢুকে যান, আমিও। শামুকের মত শুয়ে থাকি সারারাত।
পরদিনও এরকম ঘটনা নিয়ে ফেরেন মামা। বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে হেঁটে আসছেন, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু মামদো ভূতের গলা শুনলেন–কিরেঁ শরাঁফ যাঁস কঁই? এঁকটু থাঁম। উর্ধ্বশাসে দৌড়ে এসে ঠাণ্ডা পানিতে সেই কনকনে শীতের রাতে গোসল করেন। বাড়িতে শরাফ মামার খাতির বেড়ে যায়। আমি, ফেলুমামা, টুটুমামা তাঁকে ঘিরে বসে থাকি অর্ধেক রাত অবদি। হাত-পাখায় তাঁকে বাতাস করেন পারুল মামি। নানি গরম ভাতের সঙ্গে শিংমাছের ঝোল বেড়ে আনেন ভূত দেখা ছেলের জন্য, পাতের কিনারে নুন। কানা মামুর বড়শিতে ইয়া বড় বড় মাছ উঠত। আস্তা মাছ লইয়া কুনওদিনও বাড়ি ফিরতে পারে নাই মামু। এক রাইতে দেখে পিছন পিছন এক বিলাই আইতাছে। মামুর কান্ধের উপরে মাছ। মামু হাঁটে বাড়ির পথে, হঠাৎ হালকা হালকা লাগে কান্ধের মাছ। ফিইরা দেখে মাছের অর্ধেকটা নাই, আর বিলাইটাও হাওয়া। আসলে তো বিলাই না, ওইটা ছিল মাউছ্যা ভূত, বিলাইয়ের রূপ ধইরা মাছ খাইতে আইছিল।
শরাফ মামা খেতে খেতে কানা মামুর কিচ্ছা বলেন।
ওসবের পর থেকে আমার রোমকূপের তলায় তলায় ঢুকে গেছে ভয়। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়, রাতে কেন, দিনের বেলায়ও একা তার ছায়া মাড়াই না। সন্ধে হলেই ঘরে সেঁধিয়ে যাই, গু মুত পেটে চেপে। বেশি বেগ পেলে বড় কাউকে হারিকেন হাতে আগে আগে হাঁটতে হয়, পেছনে আমি ডানে বামে চোখ কান সজাগ রেখে পড়ি কি মরি দৌড়ে সেরে আসি ঝামেলা।
নানিবাড়ি ছেড়ে আমলাপাড়ার বাড়িতে যখন উঠি, আমার বয়স সাড়ে সাত কী আট। বাড়িটির নাম বাবা এক এক করে জিজ্ঞেস করেন তাঁর দুই ছেলেকে, কী হলে ভাল হয়, দাদা বলেন অবকাশ, ছোটদা ব্লু হেভেন। যদিও জানতে চাওয়া হয়নি, আমি আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম, আমার পছন্দ রজনীগন্ধা। দাদার বলা নামটিই শ্বেত পাথরে খোদাই করে কালো ফটকের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। বাড়িটি বিশাল, নকশা কাটা থাম, দরজা। ঘরের সিলিংএ তাকালে মনে হয় আকাশ দেখছি, আকাশে সবুজ কড়িকাঠ সাজানো, কাঠের ওপর আড়াআড়ি লোহার পাত, যেন রেললাইন, পুঁ ঝিকঝিক শব্দ তুলে রেলগাড়ি ছুটবে বলে। বেলগাছের তল থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে, পেঁচানো সিঁড়ি, ছাদের নকশা কাটা রেলিং ধরে দাঁড়ালে পুরো পাড়া চোখের সামনে। মাঠের কিনার ঘেঁসে নারকেল আর সুপুরি গাছের সারি। উঠোন জুড়ে আম জাম কাঁঠাল পেয়ারা বেল আতা জলপাই ডালিম। খুশিতে আমার দুই দাদা, আমি আর ইয়াসমিন বাড়িময় গোল্লাছুট খেলি। দু’মাইল দূরে পড়ে থাকে এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর, তার পাড়ে নানির চৌচালা ঘর, পড়ে থাকে কড়ইতলায় আঙুলের গর্ত করে মার্বেল খেলা, ছাই মাখা ত্যানায় চিমনি মুছে হারিকেন জ্বালানো, পড়ে থাকে মামাদের সঙ্গে শীতল পাটিতে বসে সন্ধে হলে দুলে দুলে আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে পড়া, পড়ে থাকে ভোরের খেঁজুর রস, ভাপা পিঠে। ও বাড়ি থেকে আর কিছু সঙ্গে না আসুক, ভূতের রোমকাঁটা ভয় ঠিকই এসেছে, এই যুদ্ধের কালে বেগুনবাড়ি অবদিও সে আমার পেছন ছাড়েনি। শরাফ মামা বলতেন–রাত শেষ হইলেই ভূত পেত্নীরা নিজের দেশে ফিইরা যায়।
সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি পাঁচ পা অলা ভূত নেই ঘরে, টিনের ফুটকি ফুঁড়ে রোদ ঢুকে ঘর তাতাচ্ছে। উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসে গল্প করছেন মা, নানি, রুনুখালার শাশুড়ি। শহর ছেড়ে আমার কোথাও যাওয়া হয়নি এর আগে, কেবল একবার রেলের চাকার তালে ঝিক্কির ঝিক্কির মৈমনসিং ঢাকা যাইতে কত্তদিন বলতে বলতে ঢাকা পৌঁছেছিলাম, দিগন্ত ছোঁয়া লালমাটিয়ার মাঠের কাছে বড়মামার বাড়িতে। ইচ্ছে করে খোলা আকাশ জুড়ে ঘুড়ির মত উড়ে উড়ে মেঘবালিকাদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি। দাওয়ায় বসে কয়লার গুঁড়োয় দাঁত মাজতে মাজতে ভাবি যুদ্ধ ব্যাপারটি মন্দ নয়, ইস্কুল বন্ধ দিয়ে দিল আচমকা, বাড়ির ছাদে বসে অবিরাম পুতুল খেলে কাটাচ্ছিলাম, কেবল উড়োজাহাজের শব্দ শুনলেই দৌড়ে নামতে হত নিচে, কানে তুলো গুঁজে মা আমাদের পাঠিয়ে দিতেন খাটের তলায় আর বিড়বিড় করে সুরা পড়তেন। পরে লম্বা একখানা গর্ত খোঁড়া হয়েছিল মাঠে, বোমা পড়ার শব্দ হলে বাড়ির সবাই যেন ওতে ঢুকে পড়ি। হাসপাতালে বোমা পড়ার পর শহর আর নিরাপদ নয় বলে বাবা আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন দু’গাড়ি ভরে, এক গাড়ি দাদা, ছোটদা, শরাফ মামা, ফেলু মামা, টুটুমামাকে নিয়ে চলে গেল মাদারিনগর, আরেকগাড়ি এল বেগুনবাড়ি, নিজে রয়ে গেলেন শহরের বাড়িতে, অবস্থা আঁচ করে তিনিও, দরজায় তালা ঝুলিয়ে, এরকমই কথা যে, বাড়ি ছাড়বেন। কুয়োর জলে কুলকুচো করে বুক ভরে শ্বাস নিই, বাতাসে লেবুপাতার গন্ধ। এখন আর বাবার রক্তচোখ নেই, উঠতে বসতে ধমক নেই, যখন তখন চড় চাপড় নেই, এর চেয়ে আনন্দ আর কী পেতে পারি জীবনে, আমি হাওয়ার সঙ্গে নাচব আজ গ্রামের রাস্তায়। গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসি বনের ছায়। মুঠি বাড়ালেই. সীম আর সীম, নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে খাব আর যত গেঁয়ো চাষীদের বিলাব নিমন্ত্রণে, আহা!
ছটকু, চল দোকানে যাই। তেঁতুল কিনা আনি।
ছটকুকে প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও বাঁশের কঞ্চির মত খাড়া হয়ে যায়। তেঁতুল খাওয়ার লোভে জিভে আমার জল গড়াচ্ছে। উঠোন আড়াল করা কলাগাছের বেড়ায়, তার তল দিয়ে বেরিয়ে, ক্ষেতের আল বেয়ে, সামনে আমি পেছনে ছটকু, বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছি, কাকতাড়ুয়ার মত সামনে দাঁড়ায় হাসু। তাগড়া ছেলের পরনে মালকোঁচা লুঙ্গি, হাতে বনবন ঘুরছে মরা ডাল।
ছটকু যাইতে পারব, তুমি না। তুমি মেয়ে মানুষ। মেয়ে মানুষের দোকানে যাইতে নাই।
কেন যাইতে নাই? আমি ত সবসময় যাই!
ঠোঁট উল্টে অগ্রাহ্য করতে চাই গেঁয়ো ছেলে হাসুকে।
শহরের দোকানে যাও, এইটা শহর না। গেরাম। গেরামে মেয়ে মানুষেরা ঘরে থাহে। বাইরে বাইরয় না।
বলে কাকতাড়ুয়া আমার দিকে পা পা করে হাঁটে, ওর চোখের গর্ত থেকে মুখ বাড়াচ্ছে দুটো ছাই রঙা ইঁদুর। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা গ্রামের কথা বইয়ে পড়েছি, বড় সাধ ছিল গ্রামে আসার, আর এসে কিনা ধানের শীষের সঙ্গে নাচা হল না, যাওয়া হল না যেদিকে দু’চোখ যায়, বন বাদাড়ে, হাওড়ে বিলে, কোথাও হারিয়ে গিয়ে গিয়ে শোনা হল না কোনও রাখাল ছেলের বাঁশি, বরং সকাল হওয়া মাত্রই দেখতে হল ইঁদুর, তাও চোখে, সে বাড়ির লোকেরই, যে বাড়িতে অতিথি আমি! গলায় এক থোকা কষ্ট জমে আমার। পেছনে সরতে সরতে মা’র একেবারে গা ঘেঁসে থামি, উঠোনে। মা’র পরনে মলিন এক শাড়ি। এলো চুল ঢেকে রেখেছেন ঘোমটায়। মা’র আঁচলের কোণা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে কষ্ট-কণ্ঠে বলি–আমারে দোকানে যাইতে দেয় না।
মা সাড়া দেন না। দু’হাতে তাঁর চিবুকখানা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলি ওই হাসু আমারে তেঁতুল কিনতে যাইতে দেয় না।
মা চিবুক ছাড়িয়ে ধমকে ওঠেন–তেঁতুল খাইতে হইব না, শইলের রক্ত পানি হইয়া যায় চুক্কা খাইলে।
মা’র চিরকালই তেঁতুলের বিরুদ্ধে এই এক অভিযোগ। মা যেন দেখতে না পান, ছাদের সিঁড়িতে বসে, তেঁতুলের গুলি নুনে ডলে, বুড়ো আঙুলে অল্প অল্প তুলে জিভে ট্টা ট্টা শব্দ করে খেতাম। জিভ শাদা করে, দাঁত টক করে, রক্ত পানি করে তবে আমার তেঁতুল ফুরোতো। হাত পা কোথাও কাটলে ভয় পেতাম, এই বুঝি ধরা পড়ে যাব, রক্তের বদলে যখন পানি বেরোবে। কিন্তু না, যখনই কাটে, কাচে বা শামুকে, গোলাপের কাঁটায় বা উঠোনের ভাঙা ইটে পড়ে, রক্তই বেরোয়। রক্ত মুছে ক্ষতে ডেটল মেখে দেন মা, আর ছেঁড়া ত্যানায় বেঁধে দেন আঙুল হলে আঙুল, ঠ্যাং হলে ঠ্যাং। আমি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখি হাসি, রক্ত পানি না হওয়ার হাসি।
বাড়িভর্তি লোক এ বাড়ির। মেয়েদের নামগুলো ফলের, ডালিম, পেয়ারা, আঙুর, কমলা আর ছেলেদের নাম হাসু, কাসু, বাসু, রাসু। রাসু আমার মেজ খালু, থাকেন শহরে, যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে কোথায় কোন গ্রামে লুকিয়েছেন কেউ জানে না। রুনু খালার শাশুড়ির দু’গাল ফুলে থাকে পানে, রস গড়িয়ে পড়ে দু’ঠোঁটের কোণ বেয়ে। আঙুলের মাথা শাদা হয়ে থাকে চুনে, পানের বাটা থেকে চুন না লাগা আঙুলে এক চিমটি শাদা পাতা তুলে ফুলে থাকা গালে ঢুকিয়ে নানির কানের কাছে মুখ এনে বলেন–রাসুডা কই আছে কেডা জানে! বাইচা আছে না মইরা গেছে। শুনছি পাঞ্জাবিরা মানুষ মাইরা শহর উজাড় করতাছে।
পিঁড়িতে বসা নানির ছোট্ট শরীরখানা কাপড়ের একটি পুঁটলির মত দেখতে লাগে। কালো পাড় শাদা শাড়ির পুঁটলি নড়ে না। পুঁটলির ভেতর আরেক পুঁটলি, নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি, শক্ত হাতে ধরা, ঝুড়িতে চিঁড়ামুড়ি, গুড়। নানির চোখে পাথর হয়ে থাকে দুটো তারা। পুঁটলির মত এরাও নড়ে না। তারাদুটো দেখেছে গভীর রাতে দরজায় টোকা দিচ্ছেন হাশেমমামা, নানির মেজ ছেলে। নানি দরজা খুলতেই রেলগাড়ি যাওয়ার শব্দের তলে গুঁড়ো হয়ে যায় হাশেম মামার স্বর–মা আমি যাইতাছি।
এত রাইতে ডাকস কেন! হইছে কি! কুপির সলতে উসকে দিয়ে সিঁড়িতে নামেন নানি।
আমি গেলাম।
হাশেম মামা হনহন হাঁটতে থাকেন পুকুর পাড়ের দিকে। নানি পেছনে দৌড়ে বলেন, কই যাস এত রাইতে? থাম।
হাশেম মামা হাঁটতে হাঁটতে পেছন না ফিরে বলেন–যুদ্ধে যাইতাছি। দেশ স্বাধীন কইরা তবে ফিরবাম।
থামরে হাশেম থাম।
নানি গলা ছেড়ে ডাকেন তাঁর অবাধ্য ছেলেকে যতক্ষণ না অন্ধকারের পেটের ভেতরে ঢুকে যান ছেলে।
নিসাড় দাঁড়িয়ে থাকেন নানি। বুক টনটন করে, যে বুকের ওমে, যে বুকের দুধে পঞ্চাশের মন্বন্তরে জন্ম নেওয়া হাশেম মামাকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। পারুল মামি চৌকাঠে এক পা, আরেক পা চালা ঘরের সিঁড়িতে রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। লোকে বলে হাশেমের বউ পরীর মত সুন্দরী। অন্ধকারে নানি দেখেন পারুল মামির গা থেকে জ্যোৎস্না বেরোচ্ছে। বউটি আস্ত একখানা চাঁদ। এমন চাঁদকে এখন তিনি লুকোবেন কোথায়! ঘরে ঘুমোচ্ছে পারুল মামির ছ’মাসের মেয়ে। সংসার ফেলে এভাবে কেউ আচমকা হারায়! অন্ধকার হাতড়ে কোথায় তিনি খুঁজে পাবেন হাশেম মামাকে, জানেন না। নানি যুদ্ধ কী, মহাযুদ্ধ দেখেছেন, জাপানি বোমা পড়েছে দেশে, কিন্তু এভাবে সংসার ছত্রখান হয়নি। কাক ডাকা ভোরে পারুল মামিকে তাঁর বাপের বাড়ি রেখে সঙ্গে চার ছেলে আর একটি নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি, এসেছিলেন মেয়ের বাড়িতে, অবকাশে, শলাপরামর্শ করতে, টিনের চৌচালা ছেড়ে দালানে। মেয়ের জামাই বললেন–গ্রামে চইলা যান আম্মা, শহর নিরাপদ না।
সেই গ্রামে যেতে গিয়েই হাতছাড়া হয়ে গেল তিন ছেলে, এখন থলে ঝাড়া ছেলে, নিজের নাতনিরও ছোট, ছটকু, কেবল হাতের কাছে।
রাসুর খবর না পেয়ে রুনু খালার শাশুড়ি চোখের জল ফেলেন, আর পাশের পিঁড়িতে রোদে পিঠ দিয়ে বসা পুঁটলি-নানি ছেলে যুদ্ধে গেছে জেনেও টুঁ শব্দ করেন না। যুদ্ধে গেলে কেউ কি আর ফেরে! নানির চোখের তারা নড়ে না।
খ.
রুনু খালার শ্বশুর খবর পেয়েছেন মিলিটারি আসছে বেগুনবাড়ির দিকে, ছ’টি মুণ্ডু পড়ে আছে সিকি মাইল দূরে, পাটক্ষেতে। মুণ্ডু দেখতে লোক দৌড়োচ্ছে, আবার উল্টো দিকেও বোঁচকা হাতে ছুটছে লোক। আমাদের, শহরের ইষ্টিদের জন্য ঠিক হয় আরও গহন গ্রামের দিকে পালিয়ে যাওয়া। বেগুনবাড়ি থেকে মোষের গাড়ি করে গভীর রাতে রওনা দিই হাঁসপুর। মোষঅলাকে পথ দেখিয়ে নেয় কাসু, হাসুর ভাই কাসু। বন বাদাড়ের ঝিঁ ঝি ঝিঁ ঝি, হুক্কা হুয়া, ভুতুম ভুতুমের মধ্যে এসে আঁতকা থেমে যায় মোষ। কুণ্ডুলি পাকাতে পাকাতে মা’র পাছার তলে সেঁধিয়ে থাকি। শরাফ মামা বলতেন অন্ধকারে ভূতেরা সব বেরিয়ে আসে বাইরে, তারা খপ করে মানুষ ধরে, আর কপ করে খায়। ভূতের প্রিয় জায়গা হল গাছের মগডাল। আর মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অমাবস্যার রাতে শেওড়া গাছের তলে। সপ সপ করে কার যেন হেঁটে আসার শব্দ শুনি। মোষঅলা চাবুক কষান মোষের পিঠে, মোষ নড়ে না। হাট হাট হাট, সপাং সপাং। বাঁশবনের ভেতর দিয়ে হঠাৎ মোষ দৌড়োয়। ছইয়ের ভেতর মাথায় মাথায় ঠোকর লাগার শব্দ হয় ঠমঠম, ঠমঠম। ভুরু নেই, চোখের পাতা নেই, লোম নেই, চুল নেই, ব্যারামে ভোগা ছটকু পিঁ পিঁ করে কাঁদে। আবার হাট হাট, আবার সপাং। সপ সপ, সপ সপ। ছটকুর লিকলিকে হাত ধরে রাখে নানিকে, নানির হাতে শক্ত করে ধরা প্লাস্টিকের ঝুড়ি। ঝুড়িতে চিঁড়ামুড়ি গুড়।
হাঁসপুরের বাড়িটি কাসুর বোন ডালিমের শ্বশুর বাড়ি। বাড়ির মাঠে বসে মোষদুটো জিরোয়। মোষঅলাও। কাসু আগে আগে হাঁটে, শহরের ইষ্টিরা কাসুর পেছনে, কাসু হাঁটে আর পেছনে তাকায়, হাসুর চোখের ইঁদুর কাসুর চোখে নেই।
হাসুর দুই চোখে দেখেছি দুইটি ইঁদুর,
তাই, বাঁশবন পার হয়ে চলি হাঁসপুর।
লেখাপড়া জানা, দরদালানে থাকা, মটরগাড়ি চড়া শহরের মানুষদের এ বাড়ির সবাই খাতির করে। সবচেয়ে বড় ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয় আমাদের জন্য, আলমারি খুলে রঙিন ফুল পাতা আঁকা কাচের গ্লাস আর চিনেমাটির থালবাটি বার করা হয়। কই মাগুরের ঝোল রাঁধা হয়, ডাক পড়লে আমরা ঝাঁক বেঁধে পিঁড়ি পেতে বসি পাকঘরে। অতিথ খাইয়ে, পোলাপান খাইয়ে, ক্ষেত ফেরা পুরুষদের খাইয়ে, বেলা ফুরোলে বাড়ির মেয়েরা খেতে বসেন। বিছানায় নকশি কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়, লাল নীল সুতোয় ভুলো না আমায় লেখা ওয়াড় লাগানো হয় বালিশে। মাথা গুনে বালিশ। মাথার বালিশই দু’ঠ্যাংএ চেপে ঘুমোই, কোলবালিশের অভ্যেস মরে না যুদ্ধেও। স্বপ্নের ভেতরে ভাসি হাঁসের মত হাঁসপুরের জলে, উড়ি ছটকু আর কাসুর লাল ঘুড়ির মত হাওয়ায়।
এ বাড়িতে আমার বয়সী মেয়েরা এক প্যাঁচে শাড়ি পরে, কারও কারও শুনি বিয়েও হয়ে গেছে। ভোরে উঠে ওরা হাঁস মুরগির খোঁয়াড় খোলে, উনুনে ফুঁকনি ফোঁকে, মশলা বাটে, ঢেঁকি পাড় দেয়, কুলোয় চাল ঝাড়ে, ওদের ডেকে বলি–খেলবা এক্কা দোক্কা, কুতকুত? শুনে ওরা ঠোঁট টিপে হাসে, খেলতে আসে না। ছেলেরা গাছে উঠে আম পাড়ে, গাব পাড়ে, ডাব পাড়ে, ওদের মত আমারও ইচ্ছে করে গাছে উঠতে। ওরা বলে: মেয়েমানষরা গাছে উঠলে গাছ মইরা যায়।
ওরা হাডুডু খেলে লুঙ্গি কাছা মেরে। আমি খেলতে চাইলে বলে: মেয়েমানষের হাডুডু খেলতে হয় না।
ওরা কাঁধে গামছা ফেলে বিলে যায় মাছ ধরতে। ওদের পেছন পেছন আমিও রওনা হই, পেছন ফিরে বলে ওরা–মেয়ে মানষের মাছ ধরতে নাই।
ঘুট্টি উড়াইতেও নাই?
না, ঘুট্টি উড়াইতেও নাই।
কে কইছে নাই? আমি কোমরে দু’হাত রেখে বুক টান করে দাঁড়াই।
গায়ে কাদা মাখা, কালো মিশমিশে, মুখ ভর্তি হলুদ দাঁতের ছেলে দু’পা পেছনে এসে বলে, কও তো কাচা গাব পাকা গাব কাচা গাব পাকা গাব! খুব তাড়াতাড়ি কইতে হইব। বলতে পারলে মাছ ধরতে নেবে আশায় বলে দেখি কাচাগাবপাচাবাপকাকাপাপ ধরনের শব্দ বেরোচ্ছে। হলুদ দাঁত খাঁক খাঁক করে হাসে। ওর সঙ্গে বাকিরাও খাঁক খাঁক। আমাকে পেছনে রেখে ওরা চলে যায় বিলের দিকে। আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি রেডিমেড ফ্রক পরা শহুরে মেয়ে। দুপুরবেলা পুকুরে নেমে মেয়েরা যখন এক সাঁতারে আরেক পাড়ে চলে যায়, এক ডুবে মাঝপুকুর থেকে ঘাটের কাছে এসে মাথা তোলে, আমি মুগ্ধ চোখে, ঘাটে বসে, দু’পা ভিজিয়ে জলে, ওদের দেখি। আমাকে খালি গায়ে দেখে মেয়েরা বলাবলি করে, ঢেঙ্গি ছেড়ির অহনো বুনি উডে নাই।
শরাফ মামা খলসে মাছে ভরা পুকুরে উল্টো সাঁতার, ডুব সাঁতার দিয়ে শাপলা ফুল ছিঁড়ে এনে পাড়ে বসে থাকা আমাকে বলতেন, সাঁতার শিখবি? বেশি কইরা পিঁপড়া খা, তাইলে সাঁতার পারবি। পিঁপড়ে ধরা চিনি গুড় খেয়ে পুকুরে নেমে সাঁতরাতে চেষ্টা করেছি অনেকদিন, জল আমার দু’পা টেনে পাকে ফেলে নিয়ে যায় জলের তলে। হাঁসপুর গ্রামের ন্যাংটো পোলাপানও জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরায়, দেখে শরম লাগে, এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে আজও কোমর জলে কলমিলতার মত দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে ওদের মত সারাপুকুর সাঁতার কাটি, এক পাড় থেকে আরেক পাড়। গা পোড়া দুপুরে ঠাণ্ডা জলে ঢেউ তুলে সাঁতরানোর মত আনন্দ আর হয় না! মা খবর পাঠান, পুষ্কনিতে বেশিক্ষণ পইরা থাকলে ঠাণ্ডা লাইগা জ্বর আইব। কোমর জল থেকে শহুরে মেয়েকে উঠে আসতে হয় ডাঙায়। ডাঙা তো নয়, আস্ত একটি চুলো।
ডাঙায় অনেক কাণ্ড ঘটে বটে। পাঞ্জাবিরা পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের বাড়িঘর, পোড়া বাড়ির বউঝিরা হাঁসপুরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কপাল চাপড়ায়। হাঁসপুর থমথম করে, যেন এক্ষুণি বোমা পড়বে হাঁসপুরের চাঁদিতে। গ্রামের দুটো বাড়িতে রেডিও আছে। যে বাড়িতে বেমক্কা উঠেছি আমরা, আমি মা নানি ছটকু ইয়াসমিন, সে বাড়িতে; আরেকটি রেডিও কাসেম শিকদারের বাড়ি। সন্ধের পর দু’বাড়িতে লোক ভিড় করে রেডিওর খবর শুনতে। রেডিও শুনতে আসা লোকেরা উঠোনের শীতল পাটিতে বসে হুঁকো টানেন, হুঁকো ঘোরে এক মুখ থেকে আরেক মুখে। গেল দু’মাস ধরে টাক মাথা গাল ফোলা সবুজ লুঙ্গি লোকটি বলে আসছেন–স্বাধীন বাংলার খবরে কইছে মুক্তিবাহিনী আইতাছে, আর দেরি নাই।
ডালিমের শ্বশুর জলচৌকিতে বসে তাঁর মিশমিশে কালো পিঠে ছপছপ করে গামছা মেরে মশা তাড়ান। আঙুলে থুতনির শাদা দাড়ি আঁচড়ে বলেন–মিলিটারির লগে কেমনে পারব হেরা? ভারত থেইকা নাকি টেরনিং লইয়া আইতাছে। গেরামের জমিরালি, তুরাব, জব্বর, ধনু মিয়া বেবাকে তো যুদ্ধে গেল। এগো নাক টিপলে দুধ বারয়, এরা কিয়ের যুদ্ধ করব! ঢাকায় তো মানুষ মইরা ছারখার! গেরাম কে গেরাম জ্বালাইয়া দিতাছে, মিলিটারিরা কি মানুষ! ওরা অইল জানোয়ারের জাত। আমারে তো ত্রিশাল বাজারে এক সিপাই জিগায় আপকা নাম কেয়া হায়? আমি কই আমার নাম দিয়া তুমার কাম কি হালা। চানতারা মজজিদের ইমাম দেখলাম, সিপাইএর পিছন পিছন চলে। ইমাম সাইবের মতলব আমার ভালা ঠেকল না।
হাম করে তারু খলিফা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বুড়ো চোখে ভাল দেখেন না, হাতে বাঁশের লাঠি, পরনের গেঞ্জিখানা ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা, লোকে বলে এ বুড়োর খতিতে আসলে ম্যালা পয়সা, বুড়ো ছিলেন ত্রিশাল বাজারের দরজি, বাঁ চোখ নষ্ট হওয়ার পর দরজিগিরি ছেড়ে ছেলের বাড়িতে, হাঁসপুরে থাকেন, মাঝে মাঝে এ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান, কই যান কেউ জানে না, মাস গেলে ফেরত আসেন। যুদ্ধ বাঁধার পর তারু খলিফা হাঁসপুর গ্রাম ছেড়ে আর কোথাও উধাও হননি। সন্ধে হলে রেডিও শুনতে এ বাড়িতে আসেন। তারু খলিফা কথা কম বলার লোক, বেশির ভাগই মাথা ডান কাঁধে ফেলে অন্যের কথা শোনেন, পছন্দ না হলে থেকে থেকে হাম বলেন, এরপর ফাঁক পেলে নিজের যা মত তা গুছিয়ে বলেন। তারু খলিফার হাম শোনার পর হুঁকোর গড়ড়ড় গড়ড়ড় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। টাক মাথা গাল ফোলা সবুজ লুঙ্গির পিঠ ছিল তারু খলিফার দিকে, তিনি গা ঘুরিয়ে বসেন। বুড়ো আরও দু’তিনটে হাম বলার পর বলেন, মুক্তিবাহিনীরা দেশ স্বাধীন করবই। আমগো গেরিলারা আগাইতাছে। দরকার অইলে ভারতের সৈন্য নামব দেশে। এই দেশ আমাগো অইব। শেখ মুজিবর দেশ চালাইব, আয়ুব ইয়াইয়ার আমল যাইব, জম্মের মত যাইব।
তারু খলিফার কথা শেষ হলে সবুজ লুঙ্গি গলা তুলে বলেন, এই সিরাজ্যা, একটা পাঙ্খা দিয়া যা।
হলুদ দাঁতের ছেলেটি ঝাঁ করে উড়ে এসে ঘর থেকে একটি তালপাতার পাখা এনে দেয় সবুজ লুঙ্গিকে। গায়ে ধুলো কাদা নেই, মাছ টাছ ধরে সাফ সুতরো হয়ে ঘরে ফিরেছে হলুদ দাঁত। সবুজ লুঙ্গি এক হাতে গা চুলকোন, আরেক হাতে বাতাস করেন নিজেকে। ঘরের বউ ঝিরা ঘরের বেড়ায় কান পেতে উঠোনে বসা পুরুষের কথা বার্তা শোনেন। বিছানার ওপর পুঁটলির মত বসে থাকেন নানি, নানির চোখের তারা নড়ে না। ভূতের ভয়ের ওপর মিলিটারির ভয় বুকে বাবুই পাখির মত বাসা বাঁধে আমার।
তারু খলিফার কথাই ঠিক, মুক্তিবাহিনীরা শেষ অবদি স্বাধীন করেছে দেশ। আমরা তখন দাপুনিয়া নামের এক গ্রামে। শীতের সকালে বৈঠক ঘরের দাওয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছি আর মুখ থেকে ফকফক করে ধোঁয়া ছাড়ছি। হঠাৎ শুনি চিৎকার, চিৎকার। চিৎকারের উৎস দেখতে পাকা রাস্তার দিকে দৌড়োয় পোলাপান। কান পেতে থেকে বুঝি উৎস ক্রমে ক্রমে এগোচ্ছে এদিকেই। লোকের চোখে কৌতূহল, কী হল, কী হল, কারা আসে আবার দাপুনিয়ায়! আবার কি ঘর পোড়ার খবর, লাশের খবর! গত সাতদিন ধরে নাগারে গুলির শব্দ শুনে দাপুনিয়া গ্রামের কানে তালা রেগে গেছে। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে দাপুনিয়া শ্বাসের মত করে শ্বাস নেয়নি। এখন কে আসে চিৎকার করে এই গ্রামে! কে আসে এই সকালে পাকা রাস্তা ধরে? মিলিটারি? না, এ ঠিক মিলিটারির শব্দ নয়। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এ ওর। বাড়ির মেয়েরা জানলার পর্দা ফাঁক করে তাকিয়ে থাকে এখনও না আসা উৎসের দিকে। আমি পর্দা ফাঁকের মধ্যে নেই, ছেলেপিলেদের ভিড়ে মিশে যেতে পারি, এখনও ডাঙর হইনি, ঢেঙ্গি ছেড়ির বুনি উডে নাই। উৎসের এ চিৎকার অন্যরকম, রোম দাঁড়িয়ে যায় গায়ের, আশায়। মনে আমার একশ পায়রা ওড়ে ডানা মেলে।
উৎস এগোতে থাকে দাপুনিয়া বাজারের দিকে, বন্দুক হাতে বিশ পঁচিশজন যুবক, শম্ভুগঞ্জে আমাদের তিন চাকার গাড়ি আটকানো যুবকগুলোর মত দেখতে, ট্রাকে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। কী তেজি এই রোল, কী বিবশ করা এই উত্তেজনা! দাপুনিয়ার স্তব্ধতা চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ে। মানুষ যেন আঁধার গুহা থেকে এক যুগ পর বেরিয়েই দেখছে আলো ঝলকানো জগত। হিম-ঠাণ্ডা নদীতে ডুবতে ডুবতে হাতের কাছে পেয়েছে পাল তোলা নৌকো। দাপুনিয়া গ্রামের মানুষ এতকাল মনে মনে, বড়জোর ফিসফিসিয়ে এ ওর কানে কানে বলেছে জয় বাংলা। আজ তারা হররা শুনছে জয় বাংলার। ত্রাসের চাদর ছুঁড়ে ফেলে মানুষ গলা ফাটায় জয় বাংলা বলে। আমিও। ওদের মত হাতের মুঠি তুলে চিৎকার করি। মানুষ ছোটে ট্রাকের পেছন পেছন, জয় বাংলার পেছন পেছন, মুক্তির পেছন পেছন। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকি, মা’কে খবর দিতে। মা জানালায় দাঁড়িয়েছিলেন।
মা জয় বাংলা কও। দেশ স্বাধীন অইছে। দু’পাক নেচে বলি।
মা হাসছেন আর গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে তাঁর। আঁচলে মুছছেন জল, আবারও ঝরছে। আবারও হাসছেন তিনি। একই মুখে হাসি, কান্না দুটোই।
নানির চোখের তারা নড়ে না। সেই কবে থেকে পাথর হয়ে আছেন তিনি, পাথরে টোকা দিলে ঠমঠম শব্দ হয়, নানির গা থেকে সে শব্দও হয় না। নানি কেন তাঁর পান খাওয়া খয়েরি দাঁত মেলে হাসছেন না, মন কি মরে আছে প্লাস্টিকের ঝুড়িটির শোকে, যেটিকে আর তাঁর শক্ত করে ধরতে হয় না, পেটের ভেতর পুঁটলি করে পুঁটলি হয়ে বসতে হয় না!
রাস্তায় এখনও জটলা, মানুষ দৌড়োচ্ছে, জয় বাংলা জয় বাংলা বলে দাপুনিয়া মাথায় তুলছে। কাল ছিল গুলির শব্দ, মরাকান্না, আজ হাসি, আজ উল্লাস, আজ হৈ হৈ, আজ জয় বাংলা। জয় বাংলা মানে কেউ আর কারও বাড়ি পুড়বে না, আর কেউ কাউকে গুলি করবে না, কোথাও বোমা পড়বে না, কেউ আর কাউকে ধরে নিয়ে যাবে না চোখ বেঁধে, বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসবে না, আকাশে ভিড় করবে না শকুনের দল, আমরা ফিরে যাব শহরের বাড়িতে, আমার ফেলে আসা ঘরটিতে ঘুমোব কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে, আমার মাপুতুল মেয়েপুতুল এখনও ওদের ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে আছে, গিয়ে ওদের ঘুম ভাঙাব।
উত্তেজনা আমার পেছন পেছন নাকি আমি তার পেছন, নাকি উত্তেজনা আমার কাঁধের ওপর, নাকি আমি তার কাঁধের ওপর, না বুঝেই দৌড়ে যাই আবার সেই জটলার দিকে, মিছিলের দিকে। মিছিলে খালেদকে দেখি সবার সামনে, হাতে বাঁশের কঞ্চির ওপর বাঁধা পতাকা, সবুজের মধ্যে লাল এক গোল্লা, গোল্লার মধ্যে তোবড়ানো হলুদ কাপড়। খালেদের পেছন পেছন গ্রামের ছেলে কী ছোকরা কী যুবক, সব।
ভিড়ের মধ্যে ছটকুর হাতেও দেখি ঠিক ওরকম এক পতাকা। আমারও ইচ্ছে করে একটি পতাকা হাতে পেতে। এ একেবারে নতুন পতাকা। ইস্কুলে সবুজের মধ্যে চাঁদ তারা আঁকা পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের গাইতে হত পাক সার জমিন সাদ বাদ। ছোটদা যখন মিছিল করতেন আয়ুব শাহি ধ্বংস হোক বলে, একদিন তোশকের তল থেকে চাঁদ তারার সবুজ পতাকাটি নিয়ে গিয়েছিলেন হাতে করে। মিছিল থেকে সন্ধেয় ফিরে এসে ছোটদা বাড়িতে জানিয়ে দিলেন, আইজকা মিছিলে পতাকা পুড়াইছি।
মিছিল শেষ করে রাস্তার কিনারের এক কাঁঠাল গাছের ডালে চড়ে হাতের পতাকাটি উড়িয়ে খালেদ বলেন এইটা হইল জয় বাংলার পতাকা। এখন থেইকা এইটাই আমাদের পতাকা। সবাই বল জয় বাংলা। সবুজ রং হচ্ছে গিয়া আমাদের সবুজ ধানক্ষেত, মধ্যে লাল সূর্য, আর সূর্যের মাঝখানে আমাদের মানচিত্র। নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা একটা দেশ পাইছি, দেশের নাম আজ থেইকা পূর্ব পাকিস্তান না, দেশের নাম জয় বাংলা। সবাই বল জয় বাংলা।
সবাই বলে জয় বাংলা। খালেদ নেমে আসেন ডাল থেকে। পরনে তাঁর শাদা লুঙ্গি, শাদা শার্ট। কালো চুল, কালো মুখ, মুখে লাল ব্রণ ওঠা খালেদ। চোখদুটো বড় বড়, দুটো কালো ভ্রমর যেন। রাতে, বাড়ির সব যখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল আর আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখা বন্দুকের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে আবার কাঁথার তলে ডুবে গিয়েছিলাম, বন্দুকে গুলি ভরার শব্দ শুনে কাঁথা সরিয়ে ভ্রমর চোখদুটো দেখেছিলাম, খালেদ বলেছিলেন–এইটা কি জানো? মাথা নেড়ে বলেছি, জানি, বন্দুক।
বন্দুকের এই হচ্ছে বাঁট, আর এইখানে বুলেট থাকে, এইটার নাম হইল ট্রিগার, এইখানে টিপলেই গুলি বার হয়। খালেদ বন্দুকের গায়ে হাত রেখে রেখে বলেন। আপনে কি মানুষ মারেন? প্রশ্ন করে শুকনো মুখে থাকি উত্তরের তৃষ্ণায়। খালেদ হেসে বলেন, আমি শত্রু মারি।
বন্দুকটি খড়ের নিচে লুকোনো ছিল অনেকদিন, যে খড়ের ওপর বিছানা পেতে আমরা ঘুমোই, তার; কে জানতো! আচমকা বাড়ি ফিরে বিছানা সরিয়ে খড় সরিয়ে বন্দুক বের করে আনেন খালেদ। আর রাত ঘন হলে গা খানা কালো চাদরে মুড়ে বন্দুক হাতে বেরিয়ে যান।
দাপুনিয়ার এ বাড়িতে আসার পর সে রাতেই প্রথম খালেদকে দেখেছি। আর আজ দ্বিতীয়বার। খালেদ দেখতে হাশেম মামার মত। দু’জন নাকি হরিহর আত্মা। এক ইস্কুলে পড়েছেন। এক থালায় ভাত খেয়েছেন। হাশেমমামা যুদ্ধে গেছেন শুনে খালেদও গেছেন।
কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়ি খড়ের ওপর, খড় ওম দেবে শীতে। ছটকু ঘুমিয়ে কাদা। ছটকু সেরাতে এভাবেই ঘুমিয়েছিল, মাথায় বালিশ পড়তেই ছটকুর ঘুম এসে যায়। ও না ঘুমোলে নির্ঘাত চেঁচাত, আর ওরা ঠিক গুলি করে মারত ওকে, কেবল ওকে কেন, যারা ঘুমিয়ে ছিলাম ও বিছানায়–আমাকে, ইয়াসমিনকে। আমি অবশ্য ঘুমোইনি, ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম, যেন ঘুমের মধ্যে আমি তখন ঘুমরাজ্যের ঘুমপরীর সঙ্গে খেলা করছি, দোলনা দুলছি, যেন আমি আর মানুষের দেশে নেই, যেন আমি কিছুই টের পাচ্ছি না ঘরে অনেকগুলো বুট পরা লোক হাঁটছে, কাঁধে তাদের বন্দুক, তারা যে কোনও সময় হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে ইয়ার্কি করতে করতে গুলি করে মারতে পারে যে কাউকে, কেউ ঘুমিয়ে নেই জানলেই তার খুলি উড়ে যাবে গুলিতে, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে, ক্যাম্পে নিয়ে চাবকে চাবকে বেয়নেটের গুঁতোয় গুঁতোয় হাড়গোড় গুঁড়ো করা হবে। বুট পরা লোক যা খুশি করুক, তুমি ঘুমিয়ে থাকো মেয়ে, তোমার চোখের পাতা যেন না নড়ে, তোমার গা হাত পা কিছু যেন না নড়ে, হাতের কোনও আঙুল যেন না নড়ে, তোমার বুক যেন না কাঁপে, যদি কাঁপেই যেন বুকের কাঁপন ওরা, যখন মশারি তুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, টর্চের আলো ফেলবে তোমার ওপর, তোমার মুখে, তোমার বুকে, তোমার উরুতে, চোখ থেকে লালা গড়াবে, জিভ বেয়ে আগুন ঝরবে আর কথা বলবে এমন ভাষায় যা তুমি বোঝ না, টের না পায়। টের না পায় তোমার এক ফোঁটা অস্তিত্ব, টের না পায় তুমি আছ, তুমি জেগে আছ, যদিও তুমি আছ, জেগে আছ।যদি পায়ই টের, তবে যেন ওরা বলতে বলতে চলে যায়, তুমি ঢেঙ্গি মেয়ে কেবল, তুমি কিশোরী হওনি, যুবতী হওনি, এখনও তোমার বুনি উডে নাই।
আমার গা বেয়ে ঠান্ডা একটি সাপ হাঁটছিল, সাপটি আমার গলা পেঁচিয়ে ছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে, তবু আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম, টর্চের আলোয় আমার চোখের পাতা কাঁপতে চাইছিল, তবু আমি চোখের পাতা রাখছিলাম চোখের ওপর, ছটকুর ঠ্যাং একটি তোলা ছিল আমার ঠ্যাংয়ের ওপর, ঠ্যাংটিকে ওভাবেই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, আমার হাত একটি পড়ে ছিল ইয়াসমিনের পেটের ওপর, সেটিকে ইয়াসমিনের পেটের ওপরই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, কোলবালিশ ছিল আমার পিঠের পেছনে, সেটিকে পিঠের পেছনে দিচ্ছিলাম পড়ে থাকতে।
বুটজুতোর লোকগুলো দাঁড়িয়েছিল খাটের কিনারে, এক হাতে মশারি, আরেক হাতে টর্চ আর চোখগুলো জিভগুলো লালাঝরা আগুনঝরা আমার চুলে চোখে নাকে কানে গলায় বুকে পেটে তলপেটে উরুতে ঠ্যাঙে পায়ে। ওদের গা থেকে গড়িয়ে ঠান্ডা সাপ সড়সড় করে নেমে এল আমার শরীরে, সারা শরীর হেঁটে বেড়ালো, পিঠে পেটে তলপেটে, যৌনাঙ্গে, শুঁকল। সাপ ঢুকে গেল আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।
বন্দুক নিয়ে, খানিকটা নুয়ে, যেহেতু তাঁর মাথা দরজার মাথা ছাড়িয়ে যায়, খালেদ চলে যাওয়ার পর আমার হাড়ের ভেতর সেই ঠান্ডা সাপটি আবার হাঁটে। আমি চোখ খুলে রাখি যদি দেখতে পাই বুট পায়ে কেউ আসে, মাথায় হেলমেট পরা কেউ, জলপাই রঙের পোশাক পরা। খড়ের ওম, গায়ের কাঁথা, কিছুই আমার ঠান্ডা হয়ে থাকা শরীরকে উষ্ণ করে না। সাপ আমার শরীর ছেড়ে নড়ে না।
ওভাবে কতক্ষণ পড়ে ছিলাম আমি! কতক্ষণ ঘুমের মত করে না ঘুমোনো মেয়ে! মনে হচ্ছে বছর পার হচ্ছে, ওরা তবু টর্চের আলো নিবোচ্ছে না, যুগ পার হচ্ছে তবু মশারি ছাড়ছে না হাত থেকে। মনে হচ্ছে, ঠান্ডা হয়ে হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। হালকা হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর, কবুতরের গা থেকে ঝরা একটি পালকের মত। আমি আর ঘুমে কাদা ছটকু আর ইয়াসমিনের মধ্যিখানে শোয়া নেই, আমাকে উত্তুরে হাওয়া এসে নিয়ে যাচ্ছে চাঁদের দেশে। সামনে বুট পরা কেউ আর দাঁড়িয়ে দেখছে না, সবার নাগাল ছেড়ে আমি অন্য এক দেশে।
চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে আর হাত নেড়ে আমাকে বলছে এসো হে এসো। ও চাঁদের বুড়ি গো আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, জল দেবে? জল? চাঁদে তো জল নেই। কী বল, চাঁদে জল নেই! আমি যে তবে মরে যাব। তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। বুটের শব্দগুলো দূরে চলে যাচ্ছে, এ ঘর থেকে দূরে, আরেক ঘরে। চাঁদের বুড়ি বলে চোখ খোল মেয়ে, তুমি ঘামছ কেন শীতের রাতে! না বুড়ি আমি চোখ খুলব না, চোখ খুললে আমি আগুন দেখব আর লালা দেখব, ঠান্ডা একটি সাপ দেখব আমার গায়ে, আমি চোখ খুলব না। চোখ বুজেই ছিলাম, ইয়াসমিনের পেটের ওপর আমার হাত, আমার ঠ্যাংয়ের ওপর ছটকুর ঠ্যাং।
দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির সূর, কে বাঁশি বাজায় এত রাতে। কে আমার ঘুম ভাঙাতে চায় অসময়ে, আমি আজ রাতে আর জাগব না, শুনশান রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়, চোখ বোজ সকলে, ঘুমমেঘ তোমাদের ওড়াতে ওড়াতে চাঁদের দেশে নিয়ে যাবে, চাঁদের বুড়ি কোনও টুঁ শব্দ করবে না, চরকা কাটা ফেলে বুড়িও মেঘের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাবে।
এ আসলে বাঁশির মত, বাঁশি নয়। এ আমার মা’র ফোঁপানো কান্না। মা কোথাও কাঁদছেন, ঘরে নয়, ঘরের বাইরে। মা সেই মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছেন, যে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বাবা। রাসু খালু বলছেন না মরে নাই, বড়বু কাঁইন্দোন না, দুলাভাই মরে নাই। কিন্তু মরার মত। রাসু খালু নারকেল গাছের পেছনে দু’হাত বাঁধা বাবার বাঁধন খুলে দিলেন আর তাঁর কাঁধ থেকে বাবার মাথা পিছলে গেল, পিছলে যেতে যেতে মাটিতে, ঘাসে, উপুড় হয়ে।
বাবার শরীরখানা টেনে ঘরে তোলেন তিনি। ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকে প্রায় নিস্পন্দ শরীর, রক্ত ঝরছে মুখ থেকে, বুক থেকে, পেট থেকে। রাসু খালুর এ বাড়িতে থাকার কথা নয়, এসেছিলেন দরদালানের ফাঁক ফোকরে লুকোতে। আমাদের থাকার কথা দাপুনিয়া। হাঁসপুরে ঘরপোড়া ধোঁয়া ওড়ে, তাই হাসঁপুর থেকে অন্ধকারে পালাতে হয়েছিল দাপুনিয়া। সেখানে, পাকা রাস্তার কিনারে বাড়ি খালেদের, হাশেম মামার হরিহর আত্মার, সে বাড়ির ভেতরে গা ঢেকে বসে ছিলাম। শহর থেকে বাতাস ভেসে আসে খবর নিয়ে, গন্ডোগোল থামছে। সেই বাতাসের পেছন পেছন তহবনের ফতফত শব্দ তুলে হাত বৈঠার মত নেড়ে হন হন করে হেঁটে এসে নানা, দাপুনিয়া বাজারের দক্ষিণে, খালেদের বাড়িতে, বলেন–চল চল বাড়ি চল, গন্ডোগোল থামছে। নানার চিবুকের দাড়ি বাতাসে নড়ে, ডানে বাঁয়ে। শুনে, পুঁটলি-পাঁটলিসহ, প্লাস্টিকের ঝুড়িসহ নানি আমি মা ছটকু ইয়াসমিন রওনা দিই শহরের দিকে। নানি চলে গেলেন এঁদো গলির পুকুর পাড়ে, চৌচালা ঘরে। আর মা তাঁর দু মেয়ে নিয়ে অবকাশের কালো ফটক খুলতেই বাবা বলেন–এ কী করলা, শহরে আইছ কেন, যুদ্ধ শেষ অয় নাই তো!
যুদ্ধ শেষ হয়নি তা পাড়া দেখেই টের পেয়েছি। অর্চনাদের বাড়ি খাঁ খাঁ করছে, প্রফুল্লদের বাড়িও। বিভাদের বাড়িতে বিভারা নেই, অদ্ভুত সব মানুষেরা, ভিন ভাষায় কথা বলে।
বাবা বলেন, বিহারিরা সব হিন্দু বাড়ি দখল কইরা রইছে।
উঠোনে ঘাসগুলো আমার মাথা সমান লম্বা হয়ে গেছে, যেন এ বাড়িতে হাজার বছর ধরে কেউ থাকে না। মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি দেখেছিলাম এমন, দালান থেকে চুনসুরকি ইট খসে পড়ছে, লম্বা ঘাসের ভেতর সড়সড় করে সাপ হাঁটছে আর ঘরগুলোর ভেতর হু হু হু হু করে ভুতের সঙ্গে ডাংগুটি খেলছে বাতাস।
উৎকণ্ঠার গলা-জলে ডুবে বাবা বলেন, শহরের অবস্থা ভাল না। ডাক বাংলায় মিলিটারি ভর্তি। রাইতটা কাটাইয়া সকালে রওনা দেও।
হ্যাঁ, তাই কথা ছিল। মা বড়দাদাকে পাঠিয়ে নানিকে ডেকে আনেন অবকাশে। চৌচালা ঘরে, টোকা দিলে খসে পড়বে দরজা জানালা, আবার না ডাকাতি হয়ে যায়। নানিও বোরখার তলে দু’হাতে প্লস্টিকের ঝুড়ি চেপে রিক্সা করে পৌঁছে যান দালানে, নিরাপত্তায়। রাত গিয়ে সকাল হলেই দাপুনিয়া রওনা হতে হবে। নিঝুম বাড়িতে নানি পেতেছিলেন জায়নামাজ। জায়নামাজের কিনারে, দেয়াল ঘেঁসে রেখেছিলেন নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি। চিঁড়ামুড়ি,গুড়। নামাজে বসলেও নানি ক্ষণে ক্ষণে দেখেন ঝুড়িটি, ঠিক ঠিক আছে কি না। ঝুড়ি নড়ে না, নানি নড়েন। হাঁসপুকুরের বাড়িতে ঝুড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়েছিলাম চিঁড়ে গুড় খাব বলে, নানি তখন নামাজে দাঁড়িয়ে হাতদুটো হাঁটুতে রেখে নুতে যাচ্ছিলেন, তাঁর আর নোয়া হয়নি, সেজদা হয়নি, চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন ঝুড়িটি।
বলেছিলাম, চিঁড়া খাইতে ইচ্ছা করতাছে।
নানি ধমকে ওঠেন, চিঁড়া খাইতে অইব না। ভাগ।
নামাজ প্রায় পড়া শেষ করে এনেছেন, এমন সময় কালো ফটকে শব্দ হয় ভীষণ। ভীষণ সেই শব্দ, যেন এক পাল বুনো হাতি এসেছে কলাগাছের মত দাঁড়ানো বাড়িটি খেতে।
রাসু খালু দৌড়ে এসে নানিকে বলেন, পালান পালান মিলিটারি।
মা বসে কোরান পড়ছিলেন ঘরে, যে ঘরে ছটকু আমি ইয়াসমিন সবে শুয়েছি। রাসু খালুর পালান পালান শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে কোরান ফেলে, পড়তে গিয়ে কোরানের ওপর রাখা ছিল অনন্ত বালা দুটো, ফেলে, মা ছুট ছুট।
মা আর নানি উঠোনের অন্ধকারে হারিয়ে যান, মেথর ঢোকার দরজা গলে খাঁ খাঁ করা প্রফুল্লদের বাড়ি।
বাবার শরীর পড়ে থাকে মেঝেয়। নানি অন্ধকার থেকে ফিরে জায়নামাজ পাতা জায়গায় হাতড়ান, আবছা আলোয় হাতড়ান আর বিড়বিড় করে বলেন, আমার ঝুড়ি কই, এই রাসু এই ঈদুন, আমার ঝুড়ি কই?
রাসু খালু চাপা স্বরে বলেন, বাড়ি লুট হইয়া গেছে।
মা ঘর থেকে ঘরে মোমবাতি হাতে ঘোরেন। আলমারি খোলেন, টাকা পয়সা নেই। কোরান আছে, কোরানের ওপর রাখা অনন্ত বালা নেই। নানির ঝুড়ি নেই।
পলকের মধ্যে এত কিছু ঘইটা গেল, নোমানের বাপরে মাইরা ফালাইয়া রাখল, বাড়ি লুট অইল। কী পাপে যে শহরে আইছিলাম! ও মা গো এ কী অইল গো! মা ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন।
নানি হাতড়াতে থাকেন সারা ঘর। ঝুড়ি নেই। বাবার মুখ থেকে শব্দ বেরোয় আহ উহ, পানি দেও। রাসু খালু পানি ঢালেন বাবার মুখে। বাবার শরীর নড়ে না, ঠোঁট নড়ে। রাসু খালুর গা কাঁপে, ভয়ে। বাড়ির মেয়েমানুষদের বাইরে পাঠিয়ে তড়িঘড়ি তিনি লুকিয়েছিলেন খাটের তলে। মেয়েমানুষের প্রতি এদের বিষম লোভ, দেখলেই, কিশোরী কি মাঝবয়সী, এদের পান্তলুন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে শক্ত দন্ড। বিছানার চাদরে গা মুড়ে বসেছিলেন তিনি খাটের তলে যেন দেখলে মনে হয় লেপ কম্বলের বস্তা। বিড়বিড় করে কলমা পড়ছিলেন, মরার আগে আগে কলমা পড়লে ঈমান মজবুত থাকে। বেরিয়ে এসেছেন কালো ফটকের বাইরে বুটের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ারও পর। গা এখনও কাঁপছে তাঁর, খাটের তলে যেমন কেঁপেছিল। বাবাকে পানি খাইয়ে গায়ের গেঞ্জি তুলে বুকে থু থু দেন রাসু খালু।
মার শরীরখানা ধপাশ করে মেঝেয় পড়ে–সব্বনাশ অইয়া গেছে। মা’র ঝুড়ির ভিতরে চল্লিশ ভরি সোনা ছিল। বিশ হাজার টাকা ছিল। ঝুড়ি নাই।
এত সোনা কই পাইছেন আম্মা? রাসু খালু চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করেন। বাড়ির সব বউ ঝিগোর সোনা। পাড়া পড়শির সোনা। পারুলের, ফজলির, রুনুর, ঝুনুর, সোহেলির মা’র, সুলেখার মা’র, আর সাহাব ভাইএর বউএর গয়নাগাটি। মা আমার লক্ষ্মী বইলা মা’র কাছে ওরা রাখতে দিছিল। মা ঘুমায় নাই। এক রাইতও ঘুমায় নাই। মাইনষের আমানত আগলাইয়া রাখছে।
ভূতে পাওয়া চিকন গলায় মা বলেন।
ঘরে মোমবাতি জ্বলে নিবু নিবু। মা বসে থাকেন মেঝেয়, বাবার না নড়া শরীরের কাছে। ফুঁপিয়ে কাঁদেন মা।
রাসু খালু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মাইনষে ত মাটির নিচে গয়নাগাটি টাকা পয়সা রাইখা দিছে। আম্মা আবার এইগুলা নিয়া চলতে গেছেন ক্যান? জান বাচানি ফরজ বড়বু। আপনাগোর ইজ্জত বাঁচছে, এইডা বড় কথা।
নানি হাতড়ান সারাঘর। খাটের তলে, সোফার তলে, জায়নামাজের তলে। ঝুড়ি নেই তবু ঝুড়ি খোঁজেন।
গ.
নানি হাতড়ান হাড়গুলো। শহরের বড় মসজিদের কুয়ো থেকে হাড় তোলা হয়েছে। হাজার হাজার হাড়। হাড় দেখতে ভিড় করেছে অগুনতি মানুষ, হারিয়ে যাওয়া ছেলের হাড়, স্বামীর হাড়। নানি হাড়গুলো হাতড়ান। পায়ের হাড়, বুকের পাঁজর, হাতের হাড়, মাথার খুলি। নানি হাশেমের হাড় খোঁজেন। সন্ধে হয়ে আসে। মানুষেরা রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যায়। নানি মসজিদের কুয়োর পাড়ে বসে, হাড়ের পাহাড়ে ডুবে হাশেমের হাড় খোঁজেন।