নেকির মজুতদারি !!!
মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন।
- এই শুনছ, সাতাশ তারিখ একটা বুকিং দিয়ে ফেললাম।
- বলো কী? আমি তো চব্বিশ তারিখে কনফার্ম করে ফেলেছি।
- কী কনফার্ম করছ?
- কেন? টিকেট!
- আচ্ছা, তুমি কি কোনোদিনই আমার কথা মন দিয়া শুনবা না?
গিন্নির গলায় জ্বলে ওঠার স্পষ্ট আলামত দেখেই আমি ধপ করে নিভে গেলাম। ধৈর্যের মাস মাহে রমজান। অথচ এই মাসেই মানুষের মেজাজ বোধহয় মহা তিরিক্ষি হয়ে থাকে। পোষা বিড়ালের মতো মিউমিউ করে আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলাম,
- তুমিই তো বললা, এবার রোজার ঈদ না, কুরবানির ঈদ ছেলের সাথে করবা। তাই তো তোমার কথা মতো চব্বিশে এপ্রিল লন্ডনের টিকেট কাটলাম!
আমার চুপসে যাওয়া চেহারা দেখেই হোক কিংবা প্রবাসে থাকা একমাত্র ছেলের প্রসঙ্গ টানাতেই হোক, গিন্নির মেজাজের চুলাও নিভে গেল। হেসে বলল,
- আরে বোকা, আমি টিকেটের কথা বলতেছি না। বলছি ইফতারির কথা। বড় মসজিদে কদরের রাতে ইফতারি দেওয়ার ডেট পেয়ে গেছি।
গিন্নির গলায় দিগ্বিজয়ের সুর। হবেই বা না কেন? এমনিতেই রোজার মাসে ভালো কাজ করলে সওয়াব বেশি। আর রোজাদারকে ইফতারি করানোর চাইতে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? আর সেটা যদি হয় মসজিদে অনেক মানুষকে একসাথে কদরের রাতে, তাহলে তো কথাই নেই, নেকি বেড়ে যাবে হাজার গুন। যদিও সাতাশের রাতেই কদর পড়বে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও নেকির এই পৌনঃপুনিক প্রাপ্তির সম্ভাবনায় গিন্নির তো খুশি হবারই কথা।
ইসলামে যত ইবাদত আছে, তার মধ্যে সম্ভবত রোজাই একমাত্র ইবাদত, যার মধ্যে লোক দেখানোর কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষুৎপিপাসায় কষ্ট পেয়েও কেউ যদি গোপনে এক ঢোক পানি না খায়, বাথরুমে ঢুকে দুই টান বিডি না ফোঁকে, সে তো একমাত্র আল্লাহর ভয়ে। স্বাভাবিক কারণেই এই ইবাদতটি আল্লাহর কাছে সবচে বেশি প্রিয়। ফযিলতও অনেক বেশি। আবার এই মাসেই কুরআন মজিদ নাযিল হয়েছিল। তাই এই মাসকে আল্লাহ তালা অন্যান্য মাসের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। করেছেন সম্মানিত ও মহিমান্বিত।
অধিক সওয়াবের আশায় রোজার মাস এলেই তাই মুসলমানদের মধ্যে দান খয়রাতের ধুম পড়ে যায়। হিসাব করে সদকা যাকাত দেয়। মাদরাসার তালবেয়ালিমদের ডেকে ইফতারি করায় কিংবা মসজিদের মসজিদে ইফতারি দেয়। গিন্নিও এর ব্যতিক্রম নয়। সংসার চালানোর মতো দান খয়রাতের দিকটাও সেই দেখে। নির্দিষ্ট কিছু মসজিদে ইফতারি দেয়। সেই সব মসজিদে আবার আগে থেকে বলে না রাখলে ডেট পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, রোজা শুরু হবার আগেই পাইকারি দোকান থেকে অনেক পরিমাণে ছোলা, মুড়ি, চিড়া, চিনি, তেল, বেসন, খেজুর, পিঁয়াজ ইত্যাদি কিনে গরিব পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি করে। আমার কাজ শুধু হিসেব করে টাকাটা তার হাতে তুলে দেওয়া। আমি কখনও তার এই লাভজনক নেকি উপার্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাজারে না গেলেও পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। ইফতারি তো দূরের কথা, দৈনন্দিন বাজার করতে গিয়েও গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের উঠছে নাভিশ্বাস। সেখানে মসজিদে বাহারি ইফতারি দেওয়া কিংবা বাসায় বাসায় ইফতার সামগ্রী বিলানো কতটা যুক্তিযুক্ত? আমি জানতে চাইলাম,
- বাকি মসজিদগুলোতে ডেট এখনো পাওনি?
- ডেট পাওয়া কি অত সোজা? তুমি তো টাকা দিয়েই খালাস। সব ঝামেলা তো আমাকেই পোহাতে হয়।
কথায় বারুদের গন্ধ পেলাম। এমন কিছু বলা যাবে না যাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমি অন্য পথ ধরলাম। গলা নরম করে জানতে চাইলাম,
- তার মানে তুমি না দিলেও অন্য কেউ ইফতারি দিয়ে দেবে?
- অবশ্যই। নেকি কামাইয়ের এমন সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? তবে চিন্তা নাই। আমি ভাই বেরাদারগো বলে রাখছি। ডেট পেয়ে যাব।
আমি গলা আরও মোলায়েম করে বললাম,
- এবার মসজিদে ইফতারি না দিলেই কি নয়?
- এ কেমন নাফরমানি কথা? ইফতারি দেবো না কেন? তাছাড়া প্রতি বছর দেই। এবার না দিলে লোকে কী বলবে?
বুঝলাম, নেকি কামাইয়ের সাথে কিছুটা ইগোও জড়িয়ে আছে। সেই পাছে লোকে কিছু বলার মতো! বলালাম,
- বলো তো, প্রতি মসজিদে কত লোকের ইফতারি দাও তুমি?
- দুই তিনশো। কদরের রাতে তো চারশো ছাড়িয়ে যায়।
- তার মানে কি এই, কি দুই তিনশো কিংবা চারশো লোক মসজিদে ইফতারি না করলে বাড়িতে ইফতারি জুটবে না?
- তা কেন? আমার দাদা বাড়ি, নানাবাড়ির গ্রামের মানুষ অত গরিব না।
- তাহলে তারা মসজিদে ইফতারি করে কেন?
- সবাই মিলে ইফতারি করলে অনেক সওয়াব হয়। তাছাড়া এই রোজাদারদের মধ্যে একজনও যদি আল্লাহর পেয়ারা বান্দা হয়, তার উছিলায় অন্যদের গুনাহও মাফ হয়ে যায়।
রীতিমতো ওয়াজের ঢঙ্গে বলল বউ। এই একজনের উছিলায় অন্যদের গুনাহ মাফ হওয়ার ব্যাপারটা আমার সব সময়েই গোলমেলে লাগে। আমার বিচার আমার ভালো মন্দ কাজের উপর ভিত্তি করে হবে। সেটা যদি অন্যের উছিলায় মাফ হয়ে যায়, তাহলে ন্যায় বিচার হলো কোথায়? ধর্মের এই জটিল বিষয়ে বিতর্ক করার মতো জ্ঞান আমার নেই। সে পথে না গিয়ে বললাম,
- সে নাহয় তাদের সওয়াব হলো। তাদের গুনাহ মাফ হলো। তাতে তোমার লাভ কী?
- কী বেকুবের মতো কথা বলছ? তুমি জানো না, যে ভালো কাজ করে এবং যে করায়, দুজনেরই সমান সওয়াব হয়।
- তার মানে তুমি তোমার সওয়াবের স্বার্থে এমন কিছু লোককে ইফতার করাচ্ছ, যা না করালেও তাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এবার গিন্নিকে বেশ বিভ্রান্ত দেখায়। আর বিভ্রান্ত হলে সে রেগে যায়। রেগে মেগে বলল,
- আসলে কী বলতে চাচ্ছ তুমি? তোমার কি টাকায় টান পড়ছে? এবার কি ইফতারির টাকা দিতে চাও না?
- না না, টাকা দিতে চাইব না কেন? বরং বেশিই দেবো। যদি…
- যদি কী?
- বলছি, তার আগে বলো, তোমাকে যদি অপশন দেওয়া হয়, হয় শুধু সেহরি খাবে, নয় শুধু ইফতারি পাবে, কোনটা তুমি বেছে নেবে?
- অবশ্যই সেহরি। সেহরি না খেলে রোজা রাখব কেমন করে?
- একজাক্টলি। রোজা উপলক্ষে বাজারে সব কিছুর দাম বেড়েছে বলে এবার তুমিও তোমার সংসার খরচ বেশি নিয়েছ, ঠিক?
- বাহ, নেবো না? না নিলে চলব কেমন করে?
- মসজিদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, এই যে তুমি গরিব প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিলাও, তাদের ইনকাম কি বেড়েছে?
- বাড়ে নাই বইলাই তো দিচ্ছি। যাতে রোজা রেখে ভালোমন্দ ইফতারি করতে পারে।
- কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছ, এদেরই অনেকেরই সেহরি খাওয়ার মতো চাল ডাল, তেল নুন, মাছ তরকারি কিনতে হিমসিম খেতে হচ্ছে?
- তা ঠিক।
- আবার এদেরই অনেকেই লজ্জায় কারও কাছে হাতও পাততে পারছে না।
- হুম। তাহলে কী করতে বলছ তুমি?
- নিঃসন্দেহে মানুষকে ইফতারি করানো সওয়াবের কাজ। কিন্তু এবার যদি মসজিদে কিংবা বাসায় ইফতারি না দিয়ে সেই টাকা তুমি ঐ সব গরীব দুঃখীর মাঝে ভাগ করে দাও, তাহলে তারা সেই টাকা তাদের প্রয়োজন মতো খরচ করতে পারবে। বেগুন, বেসন কিনে বেগুনি না বানিয়ে চাল ডাল কিনে দুবেলা পেট পুরে খেতে পারবে। মনে রেখো, চাইলে শুধু পানি দিয়েও ইফতারি করা যায়, কিন্তু শুধ পানি খেয়ে রোজা রাখা যায় না।
- তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ওভাবে টাকা দিলে ওরা লজ্জা পাবে না?
- না, পাবে না। কারণ টাকাটা তুমি ইফতারির নাম করেই দেবে। সেই টাকা তারা কীভাবে খরচ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।
- হুম। বুঝলাম। কিন্তু এতে সওয়াব কম হবে না?
- দেখো, আমরা আমাদের সকল কাজ নেকির নিক্তিতে ওজন করে নাই বা করলাম। তাতে নিজেকে কেমন নেকির ব্যবসায়ী বলে মনে হয়। বেশি মুনাফার আশায় রোজার মাসে বিক্রি করবে বলে যারা পণ্য মওজুদ করে রাখে, তাদের সাথে নিজের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। নিজেকেও কেমন নেকির মজুতদার বলে মনে হয়। তার চেয়ে নাহয় কিছু কাজ আমরা মানুষের প্রয়োজনের কথা ভেবেই করলাম। তাতে নেকি কতটুকু হবে আমি জানি না, কিন্তু অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো দুমুঠো খেতে পেরে নিঃসন্দেহে খুশি হবে। আর মানুষ খুশি হলে নিশ্চয়ই তার স্রষ্টাও খুশি হবেন।
বিদ্রঃ কোনো ধর্মীয় বিতর্ক তোলা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। একজন মানুষ হিসেবে আমার বিবেককে যা নাড়া দিলো, তাই লিখলাম। সহমত পোষণ করলে শেয়ার করতে পারেন।
মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন।
- এই শুনছ, সাতাশ তারিখ একটা বুকিং দিয়ে ফেললাম।
- বলো কী? আমি তো চব্বিশ তারিখে কনফার্ম করে ফেলেছি।
- কী কনফার্ম করছ?
- কেন? টিকেট!
- আচ্ছা, তুমি কি কোনোদিনই আমার কথা মন দিয়া শুনবা না?
গিন্নির গলায় জ্বলে ওঠার স্পষ্ট আলামত দেখেই আমি ধপ করে নিভে গেলাম। ধৈর্যের মাস মাহে রমজান। অথচ এই মাসেই মানুষের মেজাজ বোধহয় মহা তিরিক্ষি হয়ে থাকে। পোষা বিড়ালের মতো মিউমিউ করে আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলাম,
- তুমিই তো বললা, এবার রোজার ঈদ না, কুরবানির ঈদ ছেলের সাথে করবা। তাই তো তোমার কথা মতো চব্বিশে এপ্রিল লন্ডনের টিকেট কাটলাম!
আমার চুপসে যাওয়া চেহারা দেখেই হোক কিংবা প্রবাসে থাকা একমাত্র ছেলের প্রসঙ্গ টানাতেই হোক, গিন্নির মেজাজের চুলাও নিভে গেল। হেসে বলল,
- আরে বোকা, আমি টিকেটের কথা বলতেছি না। বলছি ইফতারির কথা। বড় মসজিদে কদরের রাতে ইফতারি দেওয়ার ডেট পেয়ে গেছি।
গিন্নির গলায় দিগ্বিজয়ের সুর। হবেই বা না কেন? এমনিতেই রোজার মাসে ভালো কাজ করলে সওয়াব বেশি। আর রোজাদারকে ইফতারি করানোর চাইতে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? আর সেটা যদি হয় মসজিদে অনেক মানুষকে একসাথে কদরের রাতে, তাহলে তো কথাই নেই, নেকি বেড়ে যাবে হাজার গুন। যদিও সাতাশের রাতেই কদর পড়বে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও নেকির এই পৌনঃপুনিক প্রাপ্তির সম্ভাবনায় গিন্নির তো খুশি হবারই কথা।
ইসলামে যত ইবাদত আছে, তার মধ্যে সম্ভবত রোজাই একমাত্র ইবাদত, যার মধ্যে লোক দেখানোর কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষুৎপিপাসায় কষ্ট পেয়েও কেউ যদি গোপনে এক ঢোক পানি না খায়, বাথরুমে ঢুকে দুই টান বিডি না ফোঁকে, সে তো একমাত্র আল্লাহর ভয়ে। স্বাভাবিক কারণেই এই ইবাদতটি আল্লাহর কাছে সবচে বেশি প্রিয়। ফযিলতও অনেক বেশি। আবার এই মাসেই কুরআন মজিদ নাযিল হয়েছিল। তাই এই মাসকে আল্লাহ তালা অন্যান্য মাসের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। করেছেন সম্মানিত ও মহিমান্বিত।
অধিক সওয়াবের আশায় রোজার মাস এলেই তাই মুসলমানদের মধ্যে দান খয়রাতের ধুম পড়ে যায়। হিসাব করে সদকা যাকাত দেয়। মাদরাসার তালবেয়ালিমদের ডেকে ইফতারি করায় কিংবা মসজিদের মসজিদে ইফতারি দেয়। গিন্নিও এর ব্যতিক্রম নয়। সংসার চালানোর মতো দান খয়রাতের দিকটাও সেই দেখে। নির্দিষ্ট কিছু মসজিদে ইফতারি দেয়। সেই সব মসজিদে আবার আগে থেকে বলে না রাখলে ডেট পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, রোজা শুরু হবার আগেই পাইকারি দোকান থেকে অনেক পরিমাণে ছোলা, মুড়ি, চিড়া, চিনি, তেল, বেসন, খেজুর, পিঁয়াজ ইত্যাদি কিনে গরিব পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি করে। আমার কাজ শুধু হিসেব করে টাকাটা তার হাতে তুলে দেওয়া। আমি কখনও তার এই লাভজনক নেকি উপার্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাজারে না গেলেও পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। ইফতারি তো দূরের কথা, দৈনন্দিন বাজার করতে গিয়েও গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের উঠছে নাভিশ্বাস। সেখানে মসজিদে বাহারি ইফতারি দেওয়া কিংবা বাসায় বাসায় ইফতার সামগ্রী বিলানো কতটা যুক্তিযুক্ত? আমি জানতে চাইলাম,
- বাকি মসজিদগুলোতে ডেট এখনো পাওনি?
- ডেট পাওয়া কি অত সোজা? তুমি তো টাকা দিয়েই খালাস। সব ঝামেলা তো আমাকেই পোহাতে হয়।
কথায় বারুদের গন্ধ পেলাম। এমন কিছু বলা যাবে না যাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমি অন্য পথ ধরলাম। গলা নরম করে জানতে চাইলাম,
- তার মানে তুমি না দিলেও অন্য কেউ ইফতারি দিয়ে দেবে?
- অবশ্যই। নেকি কামাইয়ের এমন সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? তবে চিন্তা নাই। আমি ভাই বেরাদারগো বলে রাখছি। ডেট পেয়ে যাব।
আমি গলা আরও মোলায়েম করে বললাম,
- এবার মসজিদে ইফতারি না দিলেই কি নয়?
- এ কেমন নাফরমানি কথা? ইফতারি দেবো না কেন? তাছাড়া প্রতি বছর দেই। এবার না দিলে লোকে কী বলবে?
বুঝলাম, নেকি কামাইয়ের সাথে কিছুটা ইগোও জড়িয়ে আছে। সেই পাছে লোকে কিছু বলার মতো! বলালাম,
- বলো তো, প্রতি মসজিদে কত লোকের ইফতারি দাও তুমি?
- দুই তিনশো। কদরের রাতে তো চারশো ছাড়িয়ে যায়।
- তার মানে কি এই, কি দুই তিনশো কিংবা চারশো লোক মসজিদে ইফতারি না করলে বাড়িতে ইফতারি জুটবে না?
- তা কেন? আমার দাদা বাড়ি, নানাবাড়ির গ্রামের মানুষ অত গরিব না।
- তাহলে তারা মসজিদে ইফতারি করে কেন?
- সবাই মিলে ইফতারি করলে অনেক সওয়াব হয়। তাছাড়া এই রোজাদারদের মধ্যে একজনও যদি আল্লাহর পেয়ারা বান্দা হয়, তার উছিলায় অন্যদের গুনাহও মাফ হয়ে যায়।
রীতিমতো ওয়াজের ঢঙ্গে বলল বউ। এই একজনের উছিলায় অন্যদের গুনাহ মাফ হওয়ার ব্যাপারটা আমার সব সময়েই গোলমেলে লাগে। আমার বিচার আমার ভালো মন্দ কাজের উপর ভিত্তি করে হবে। সেটা যদি অন্যের উছিলায় মাফ হয়ে যায়, তাহলে ন্যায় বিচার হলো কোথায়? ধর্মের এই জটিল বিষয়ে বিতর্ক করার মতো জ্ঞান আমার নেই। সে পথে না গিয়ে বললাম,
- সে নাহয় তাদের সওয়াব হলো। তাদের গুনাহ মাফ হলো। তাতে তোমার লাভ কী?
- কী বেকুবের মতো কথা বলছ? তুমি জানো না, যে ভালো কাজ করে এবং যে করায়, দুজনেরই সমান সওয়াব হয়।
- তার মানে তুমি তোমার সওয়াবের স্বার্থে এমন কিছু লোককে ইফতার করাচ্ছ, যা না করালেও তাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এবার গিন্নিকে বেশ বিভ্রান্ত দেখায়। আর বিভ্রান্ত হলে সে রেগে যায়। রেগে মেগে বলল,
- আসলে কী বলতে চাচ্ছ তুমি? তোমার কি টাকায় টান পড়ছে? এবার কি ইফতারির টাকা দিতে চাও না?
- না না, টাকা দিতে চাইব না কেন? বরং বেশিই দেবো। যদি…
- যদি কী?
- বলছি, তার আগে বলো, তোমাকে যদি অপশন দেওয়া হয়, হয় শুধু সেহরি খাবে, নয় শুধু ইফতারি পাবে, কোনটা তুমি বেছে নেবে?
- অবশ্যই সেহরি। সেহরি না খেলে রোজা রাখব কেমন করে?
- একজাক্টলি। রোজা উপলক্ষে বাজারে সব কিছুর দাম বেড়েছে বলে এবার তুমিও তোমার সংসার খরচ বেশি নিয়েছ, ঠিক?
- বাহ, নেবো না? না নিলে চলব কেমন করে?
- মসজিদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, এই যে তুমি গরিব প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিলাও, তাদের ইনকাম কি বেড়েছে?
- বাড়ে নাই বইলাই তো দিচ্ছি। যাতে রোজা রেখে ভালোমন্দ ইফতারি করতে পারে।
- কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছ, এদেরই অনেকেরই সেহরি খাওয়ার মতো চাল ডাল, তেল নুন, মাছ তরকারি কিনতে হিমসিম খেতে হচ্ছে?
- তা ঠিক।
- আবার এদেরই অনেকেই লজ্জায় কারও কাছে হাতও পাততে পারছে না।
- হুম। তাহলে কী করতে বলছ তুমি?
- নিঃসন্দেহে মানুষকে ইফতারি করানো সওয়াবের কাজ। কিন্তু এবার যদি মসজিদে কিংবা বাসায় ইফতারি না দিয়ে সেই টাকা তুমি ঐ সব গরীব দুঃখীর মাঝে ভাগ করে দাও, তাহলে তারা সেই টাকা তাদের প্রয়োজন মতো খরচ করতে পারবে। বেগুন, বেসন কিনে বেগুনি না বানিয়ে চাল ডাল কিনে দুবেলা পেট পুরে খেতে পারবে। মনে রেখো, চাইলে শুধু পানি দিয়েও ইফতারি করা যায়, কিন্তু শুধ পানি খেয়ে রোজা রাখা যায় না।
- তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ওভাবে টাকা দিলে ওরা লজ্জা পাবে না?
- না, পাবে না। কারণ টাকাটা তুমি ইফতারির নাম করেই দেবে। সেই টাকা তারা কীভাবে খরচ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।
- হুম। বুঝলাম। কিন্তু এতে সওয়াব কম হবে না?
- দেখো, আমরা আমাদের সকল কাজ নেকির নিক্তিতে ওজন করে নাই বা করলাম। তাতে নিজেকে কেমন নেকির ব্যবসায়ী বলে মনে হয়। বেশি মুনাফার আশায় রোজার মাসে বিক্রি করবে বলে যারা পণ্য মওজুদ করে রাখে, তাদের সাথে নিজের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। নিজেকেও কেমন নেকির মজুতদার বলে মনে হয়। তার চেয়ে নাহয় কিছু কাজ আমরা মানুষের প্রয়োজনের কথা ভেবেই করলাম। তাতে নেকি কতটুকু হবে আমি জানি না, কিন্তু অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো দুমুঠো খেতে পেরে নিঃসন্দেহে খুশি হবে। আর মানুষ খুশি হলে নিশ্চয়ই তার স্রষ্টাও খুশি হবেন।
বিদ্রঃ কোনো ধর্মীয় বিতর্ক তোলা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। একজন মানুষ হিসেবে আমার বিবেককে যা নাড়া দিলো, তাই লিখলাম। সহমত পোষণ করলে শেয়ার করতে পারেন।