What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Other রজনীকান্ত সেন বাংলা গানের এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়। (1 Viewer)

বেঁচে থাকতে তিনটে বই বেরিয়েছিল ওঁর, 'বাণী', 'কল্যাণী', 'অমৃত'। ওঁর কবিতা এমন সাড়া ফেলেছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই একটা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়।

ছোটদের নীতিশিক্ষার জন্য লিখেছেন 'সদ্ভাব-কুসুম'। হাসপাতালে দুঃসহ রোগযন্ত্রণার মধ্যেও লিখেছেন উমার আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতকাব্য 'আনন্দময়ী'।

আরও আছে— কাব্যগ্রন্থ 'অভয়া', 'বিশ্রাম', একেবারে শেষের দিকের লেখাগুলি নিয়ে 'শেষ দান'।

চিকিৎসার খরচ জোগাতে 'বাণী' ও 'কল্যাণী'র গ্রন্থস্বত্ব আর কিছু বিক্রি না হওয়া বই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র চারশো টাকায়।

স্ত্রী কেঁদে আকুল। তাঁকে বলেছিলেন, ''আমাকে যদি দয়াল আর কিছু দিন বাঁচিয়ে রাখে তবে শত সহস্র বাণী, কল্যাণী লিখে তোমার পায়ে অঞ্জলি দেব, তুমি আর কেঁদো না।''

রোজনামচায় লিখে গিয়েছেন, ''আমার এমন অবস্থা হ'ল যে, আর চিকিৎসা চলে না, তাইতে বড় আদরের জিনিষ বিক্রয় ক'রেছি।

হরিশ্চন্দ্র যেমন শৈব্যা ও রোহিতাশ্বকে বিক্রয় ক'রেছিলেন। হাতে টাকা নিয়ে আমার চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল।...''

রজনীকান্তের ডায়েরি পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এই রোজনামচা বিখ্যাত মানুষের অন্তরকাব্য নয়, পাশের মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন থেকে তার জন্ম।

নিজের রোগের কথা নিজেই লিখছেন: ''গলনালী আর শ্বাসনালী দুটো জিনিষ আছে। আমার ভাত খাবার নালীর মধ্যে ঘা নয়, নিঃশ্বাসের নালীর মধ্যে ঘা, সেখানে কোনও ঔষধ লাগানো যায় না।''

গান গাওয়ার সময় সময়ের হিসেব থাকত না রজনীকান্তের। রংপুরে গিয়ে সন্ধে থেকে রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত টানা গান গাইছেন, আবার পরের দিন অবিশ্রান্ত।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সাহেব ডাক্তার দেখে জানিয়েছিলেন, 'ওভারস্ট্রেনিং অব ভয়েস'ই সম্ভবত অসুখের কারণ।

ধুম জ্বর, খেতে যন্ত্রণা, গলা ফুলে ওঠা, কাশিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ট্রাকিয়োটমি অপারেশন করে গলায় শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচলের জন্য ছিদ্র করে বসিয়ে দেওয়া হল রবারের নল।

বন্ধ হয়ে গেল গান, কথা বলা— পরে খাওয়াও। বিছানার পাশে কাগজ-পেনসিল থাকত, সেখানেই লিখে দিতেন দরকারি কথা, মনের কথাও।

সেই সব টুকরো টুকরো লেখা পড়ে মানুষটার শেষের ক'মাসের প্রতিটি দিন অনুমান করা যায় মাত্র, তল পাওয়া যায় না।

''তোমাদের মতন যদি আমার আগেকার মত Loud Logic থাক্‌তো তবে তর্ক করতেম। তোমরা চট করে বলে ফেল, উত্তর লিখ্‌তে আমার প্রাণান্ত।''

আমার শ্রাদ্ধে বেশি খরচ ক'র না। কিন্তু যেমন পিপাসা তেমনি খুব জল দিও। আম উৎসর্গ করিও। জল দিতে কৃপণতা ক'র না। বড় পিপাসায় ম'লাম, জল দিও।''

''আমি একটু বাঙ্গালা সাহিত্যের আলোচনা করেছিলাম ব'লে বাঙ্গালা দেশ আমার যা কর্‌লে তা unique in the annals of Bengali Literature. এই সাহিত্য-প্রিয় বাঙ্গালা দেশ, মানে—

Literature-loving section of Bengalis bearing the major portion of my expenses. Is it not unprecedented in a poor country like mine?''

সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন কান্তকবির সাহায্যে। কুমার শরৎকুমার রায় টাকা পাঠাতেন।

মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ওঁর সংসারের, ছেলেদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। হাসপাতালে কত যে মানুষ রোজ আসতেন, তার ইয়ত্তা নেই।

মেডিক্যাল কলেজের ছেলেরা পালা করে ওঁর শুশ্রূষা করতেন, কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র হেমেন্দ্রনাথ বক্সী তো ছায়ার মতো থাকতেন ওঁর পাশে।

স্কুল-কলেজের ছেলেরা রজনীকান্তের 'অমৃত' নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে বিক্রি করে সেই টাকা তুলে দিয়েছিল কবির হাতে।

মিনার্ভা থিয়েটারে 'রাণাপ্রতাপ' ও 'ভগীরথ' নাটকের স্পেশ্যাল শো হয়েছিল সারদাচরণ মিত্রের উদ্যোগে, রজনীকান্ত সম্পর্কে গিরিশ ঘোষের লেখা পাঠ করা হয়েছিল অভিনয়ের আগে।

সেই সন্ধ্যার টিকিট-বিক্রির বারোশো টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ওঁকে। বরিশাল থেকে উকিলরা টাকা তুলে পাঠিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় হাসপাতালে তাঁকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ''আমার আয়ু নিয়ে আপনি আরোগ্য লাভ করুন!''

এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রোগযন্ত্রণা ভুলে রজনীকান্ত সে দিন হেঁটে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে।

সে দিনের করুণ বর্ণনা ধরা আছে মেয়ে শান্তিবালার লেখায়। ''কাকে দেখতে এসেছি, কাকে দেখছি,'' বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রজনীকান্ত তো কথা বলতে পারেন না, কাগজে লিখেই জানিয়েছিলেন তাঁর মনের ভিতরের তোলপাড়।

রাজশাহীতে নাটকের মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের 'রাজা ও রাণী'তে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, সেই কথা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রজনীকান্তের গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই স্মৃতি।

ছেলেমেয়েদের ডেকে গান শোনাতে বললেন— 'বেলা যে ফুরায়ে যায় খেলা কি ভাঙে না হায়...' নিজে অর্গান বাজিয়েছিলেন সঙ্গে।

চলে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ''আমায় আশীর্বাদ করুন, দয়াল শীঘ্র আমাকে তার কোলে নিয়ে যান।''

সে দিন রাতেই গান লিখে বোলপুরে পাঠালেন— 'আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করিয়া গর্ব করেছ দূর'।

আর বোলপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিটা তো ইতিহাস:

শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই। কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই।

পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।...আত্মার এই মুক্ত স্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে।

সামনে খাবার, খেতে পারেন না। অসম্ভব পিপাসা, কিন্তু জল দিলে সব পড়ে যায় বুক বেয়ে। মুখ দিয়ে কখনও বেরিয়ে আসে দুর্গন্ধময় পুঁজ-রক্ত। রাতের পর রাত ঘুম হয় না।

তাই কাগজ টেনে রজনীকান্ত সেন লিখে যান একের পর এক লেখা— গান। কবিতা। মনের কথা। কখনও মাকে, কখনও দয়ালকে। সেই গানে যন্ত্রণা কোথায়, বরং অশেষ কৃতজ্ঞতা।

ছত্রে ছত্রে নিঃশেষ সমর্পণ, শান্ত শরণাগতি। এক দিন গেয়েছিলেন

'আমি অকৃতী অধম ব'লেও তো মোরে কম ক'রে কিছু দাওনি', সেই তিনিই হাসপাতালে বসে লেখেন 'সেখানে সে দয়াল আমার বসে আছে সিংহাসনে' বা 'ওগো, মা আমার আনন্দময়ী, পিতা চিদানন্দময়'।

অন্তরে কোন সাধন থাকলে এমন লেখা যায়?

এক দিন কাগজের টুকরোয় লেখা 'কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব' গানখানি দেখে স্ত্রী উদ্বেগে বলেছিলেন, কথা দাও, এ গান তুমি আর গাইবে না।

রজনীকান্তও গাননি আর। তবে হাসপাতালে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর শেষযাত্রায় যেন এই গানই গাওয়া হয়।

শান্তিবালার লেখায় আছে রজনীকান্তের মৃত্যুর অনেক বছর পরের এক স্মৃতি।

সিলেটে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতির সভা, রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। মেয়েরা রবীন্দ্রনাথকে তাঁরই গান শোনালেন, তার পর কবিকে অনুরোধ করলেন একটা গান গাইতে।

রবীন্দ্রনাথ সে দিন গেয়েছিলেন রজনীকান্তের গান, 'তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিনমর্ম মুছায়ে...

*** সংগৃহিত ***

(
 

Users who are viewing this thread

Back
Top