বাংলা সংগীতে নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি এক কণ্ঠশিল্পীর নাম নার্গিস পারভীন। সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানে সুরেলা কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন, অথচ আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এই শিল্পীর নামটিই শুনেননি।
ভালোবাসা দিয়ে মোরে এত সুখ দিয়েছো, সবাই বলে যত সর্বনাশের মূল, যে আমার হৃদয় করলো চুরি, কাগজের ফুল নয় দু'চোখের ঘুম নয়, মনে আমার এ কোন ভাবনা, পোড়া চোখ তুই কেন বন্ধ থাকিস না বা ঐ ভীরু মন আমার— এ গানগুলোর যে আবেদন তা শুধু একজন নার্গিস পারভীনের মিষ্টি গলাতেই উঠে আসতো।
নার্গিস পারভীন প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন ১৯৭৯ সালে আলম খানের সুরে 'কন্যা বদল' ছবিতে, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় 'ভালোবাসা দিয়ে মোরে এত সুখ দিয়েছো' শিরোনামের গানটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে, সর্বমহলে ভালো লাগায় সিক্ত হয়। তবে চলচ্চিত্রে বেশি গান করেননি তিনি। মাত্র ২৫টির মতো চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তবে বেশ কিছু আধুনিক গান করেছেন তিনি, আর যে গানই তিনি কণ্ঠে তুলেছেন সেটাই যেন সুরের ঝরনা হয়ে শ্রোতামহলে ভালো লাগার আবেশে ভিজিয়ে দিয়েছে।
নার্গিস পারভিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালে কুষ্টিয়ায়, সেখানেই কেটেছে তার শৈশব। পড়াশোনার শেষ ভাগ কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করে। রেডিওতে প্রথম গান করেন সত্তর দশকে রাজশাহী বেতার থেকে এবং সেখানে তিনি তালিকাভুক্ত হন। শুরু থেকেই তার কণ্ঠে কলকাতার গুণী কণ্ঠ শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটা ছায়া ঘিরে রাখতো। অনেকেই তার কণ্ঠকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলাতে চাইতেন। কণ্ঠে নিজস্বতা নিয়েও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। অথচ এটা ছিল তার প্রতি একেবারেই ভুল ধারণা। কাকতালীয়ভাবে কণ্ঠে হয়তো কিছুটা মিল থাকলেও একটু গভীর ভাবে শুনলে বোঝা যায় তার কণ্ঠের নিজস্বতা।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে সুবল দাসের সুরের সেই বিখ্যাত গানটির কথা— 'ঐ ভীরু মন আমার মনে, রিমঝিম বৃষ্টির সুরে, গান শুনিয়ে যাবে চিরদিন, তুমি কথা দাও।'
বাংলা চলচ্চিত্রে এত মেলোডি সমৃদ্ধ গান খুব কমই এসেছে। রবীন্দ্র সংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী কাদেরী কিবরিয়ার সঙ্গে নার্গিস পারভীনের সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠে যে রোমান্টিক আবেশ ছড়িয়েছিল— একমাত্র যারা গানটি শুনেছেন তারাই বলতে বাধ্য হবেন এমন সুরেলা রোমান্টিক গান তাদের বহুদিন শোনা হয়নি।
একজন আদর্শ সংগীতশিল্পী হওয়ার সমস্ত গুন থাকা সত্ত্বেও সংগীত জগতে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেননি নার্গিস পারভিন। এর প্রধান কারণ হঠাৎ বিয়ে এবং বৈবাহিক সূত্রে বহুদিন দেশের বাইরে অবস্থান। যদিও পরবর্তীতে তিনি দেশে ফিরে এসে আবারও সংগীতে মনোনিবেশ করেছিলেন কিন্তু তত দিনে যে শূন্যতা ছিল তা কাটিয়ে উঠতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন ছিল। একসময় কঠিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি, শরীরে বাসা বাঁধলো ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি। অবশেষে ১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
আর এভাবেই হারিয়ে গেল নীরবে এক সুরেলা কণ্ঠস্বরের, যে কণ্ঠের মুগ্ধতা ছড়াতো বহু গানপ্রিয় শ্রোতামহলে।
নার্গিস পারভীনের উল্লেখযোগ্য কিছু গান— ভালোবাসা দিয়ে মোরে এত সুখ দিয়েছো, আমি তো কেবলই এক সাধারণ মেয়ে, মনে আমার এ কোন ভাবনা, সবাই বলে যত সর্বনাশের মূল, দুটি মন আর দুটি জীবন, আমার চোখে রাত্রি থাকুক, কাগজের ফুল নয় দু'চোখের ঘুম নয়, তুমি না হয় সর্বনাশের মতোই ভালোবাসো, যে আমার হৃদয় করলো চুরি, অন্তরে কান্দন আমার চোখে, চাই না কিছু চাই না আমার আছে লক্ষ্মী সোনা, গান গাওয়া মোর বৃথা হয়ে গেল, বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে ও পোড়া চোখ বন্ধ থাকিস না।
* লিখেছেন: আরিফুল হাসান | চিত্র কৃতজ্ঞতা: ফারুক আহমেদ পিজু