What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected জিদ - বাঙ্গালীর হাসির গল্প (1 Viewer)

Bergamo

Forum God
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
9,649
Messages
117,051
Credits
1,241,096
Glasses sunglasses
Berry Tart
Statue Of Liberty
Profile Music
Sandwich
আজ কবি জসীমউদ্‌দীনের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর 'বাঙ্গালীর হাসির গল্প' আমাদের চিরকালীন আনন্দের উৎস। আজ তাঁকে আমরা স্মরণ করছি ওই সংকলনের এক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

6vyO7Zc.jpg


এক তাঁতি আর তার বউ। তারা বড়ই গরিব। কোনোদিন খায়, কোনোদিন খাইতে পায় না। তাঁত খুঁটি চালাইয়া, কাপড় বুনাইয়া, কিইবা তাহাদের আয়?

আগেকার দিনে তারা বেশি উপার্জন করিত। তাহাদের হাতের একখানা শাড়ি পাইবার জন্য কত বাদশাজাদীরা, কত নবাবজাদীরা তাহাদের উঠানে গড়াগড়ি পাড়িত।

তখন একখানা শাড়ি বুনিতে মাসের পর মাস লগিত। কোনো কোনো শাড়ি বুনিতে বৎসরেরও বেশি সময় ব্যয় হইত।

সেইসব শাড়ি বুনাইতে কতই না যত্ন লইতে হইত। রাত থাকিতে উঠিয়া তাঁতির বউ চরকা লইয়া ঘড়র-ঘড়র করিয়া সুতা কাটিত। খুব ধরিয়া ধরিয়া চোখে নজর আসে না, এমনই সরু করিয়া সে সুতা কাটিত। ভোরবেলায় আলো-আঁধারির মধ্যে সুতাকাটা শেষ করিতে হইত। সূর্যের আলো যখন চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িত, তখন সুতা কাটিলে সুতা তেমন মুলাম হইত না।

তাঁতি আবার সেই সুতায় নানারকমের রঙ মাখাইত। এত সরু সুতা আঙুল দিয়া ধরিলে ছিঁড়িয়া যায়। তাই, বাঁশের সরু শলার সঙ্গে আটকাইয়া, সেই সুতা তাঁতে পরাইয়া, কতরকমের নকশা করিয়া তাঁতি কাপড় বুনাইত। সেই শাড়ির উপর বুনট করা থাকিত কত রাজকন্যার মুখের রঙিন হাসি, কত রূপকথার কাহিনী, কত বেহেস্তের আরামবাগের কেচ্ছা। ঘরে ঘরে মেয়েরা সেই শাড়ি পরিয়া যখন হাঁটিত, তখন সেই শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কত গোলেবাকওয়ালী আর কত লুবানকন্যার কাহিনী ছড়াইয়া পড়িত।

শাড়িগুলির নামই বা ছিল কত সুন্দর। কলমি ফুল, গোলাপ ফুল, মন-খুশি, রাসমন্ডন, মধুমালা, কাজললতা, বালুচর। শাড়িগুলির নাম শুনিয়াই কান জুড়াইয়া যায়। কিন্তু কিসে কি হইয়া গেল। দেশের রাজা গেল, রাজ্য গেল। দেশবাসী পথের ভিখারি সাজিল। বিদেশী বণিক আসিয়া শহরে কাপড়ের কল বসাইল। কলের ধুঁয়ার উপর সোয়ার হইয়া হাজার হাজার কাপড় ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল; যেমন সস্তা তেমনই টেকসই। আবার যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়। তাঁতির কাপড় কে আর কিনিতে চায়!

হাট হইতে নক্সী-শাড়ি ফিরাইয়া আনিয়া তাঁতিরা কাঁদে। শূন্য হাঁড়িতে চাউল না পাইয়া তাঁতির বউ কাঁদে। ধীরে ধীরে তারা সেই মিহিন শাড়ি বুনান ভুলিয়া গেল। এখনকার লোক নক্সা চায় না। তারা চায় টেকসই আর সস্তা কাপড়। তাই তাঁতি মিলের তৈরি মোটা সুতার কাপড় বুনায়। সেই সুতা আবার যেখানে-সেখানে পাওয়া যায় না। চোরাবাজার হইতে বেশি দামে কিনিতে হয়। এখন কাপড় বেচিয়া যাহা লাভ হয়, তাহাতে কোনোরকমে শুধু বাঁচিয়া থাকাই যায়। এটা ওটা কিনিয়া মনের ইচ্ছামতো খাওয়া যায় না।

কিন্তু তাঁতির বউ সে কথা কিছুতেই বুঝিতে পারে না। সে তাঁতিকে বলে, 'তোমার হাতে পড়িয়া আমি একদিনও ভালমতো খাইতে পারিলাম না। এত করিয়া বলি, হাটে যাও। ভালমতো একটা মাছ কিনিয়া আনো। সে কথা কানেই তোল না।'

তাঁতি উত্তর করে, 'এই সামনের হাটে যাইয়া তোমার জন্য ভালমতো একটা মাছ কিনিয়া আনিব।'

সে হাট যায়, পরের হাট যায়, আরও এক হাট যায়, তাঁতি কিন্তু মাছ কিনিয়া আনে না।

সেদিন তাঁতির বউ তাঁতিকে ভাল করিয়াই ধরিল, 'এ হাটে যদি মাছ কিনিয়া না আনিবে তবে রহিল পড়িয়া তোমার চরকা, রহিল পড়িয়া তোমার নাটাই, আমি আর নলি কাটিব না। রহিল পড়িয়া তোমার শলা, আমি আর তেনা কাড়াইব না। শুধু শাক ভাত—আর শাক ভাত, খাইতে খাইতে পেটে চর পড়িয়া গেল। তাও যদি পেট ভরিয়া খাইতে পারতাম!'

তাঁতি কী আর করে? একটা ঘষা পয়সা ছিল, তাই লইয়া তাঁতি হাটে গেল। এ দোকান ও দোকান ঘুরিয়া অনেক দর দস্তুর করিয়া সেই ঘষা পয়সাটা দিয়া তাঁতি তিনটি ছোট্ট মাছ কিনিয়া আনিল।

মাছ দেখিয়া তাঁতির বউ কী খুশি। আহ্‌লাদে আটখানা হইয়া সে মাছ কুটিতে বসিল। এভাবে ঘুরাইয়া, ওভাবে ঘুরাইয়া কত গুমর করিয়াই সে মাছ কুটিল! যেন সত্য সত্যই একটা বড় মাছ কুটিতেছে। তারপর পরিপাটি করিয়া সেই মাছ রান্না করিয়া তাঁতিকে খাইতে ডাকিল।

তাঁতি আর তার বউ খাইতে বসিল। তিনটি মাছ। কে দুইটা খাইবে, আর কে একটি খাইবে, কিছুতেই তারা ঠিক করিতে পারে না! তাঁতি বউকে বলে, 'দেখো, রোদে ঘামিয়া, কত দূরের পথ হাঁটিয়া এই মাছ কিনিয়া আনিয়াছি। আমি দুইটি মাছ খাই। তুমি একটা খাও।'

বউ বলে, 'উঁহু। তা হইবে না। এতদিন বলিয়া কহিয়া কত মান–অভিমান করিয়া তোমাকে দিয়া মাছ কিনাইয়া আনিলাম। আমিই দুইটি মাছ খাইব।'

তাঁতি বলে, 'তাহা কিছুতেই হইবে না।'

কথায় কথায় আরও কথা ওঠে! তর্ক বাড়িয়া যায়। সেই সঙ্গে রাতও বাড়ে, কিন্তু কিছুতেই মীমাংসা হয় না, কে দুইটি মাছ খাইবে আর কে একটি মাছ খাইবে! অনেক বাদানুবাদ, অনেক কথা কাটাকাটি, রাতও অর্ধেক হইল। তখন দুইজনে স্থির করিল, তাহারা চুপ করিয়া ঘুমাইয়া থাকিবে। যে আগে কথা বলিবে, সে–ই একটা মাছ খাইবে।

তাঁতি এদিক মুখ করিয়া, তাঁতির বউ ওদিকে মুখ করিয়া শুইয়া রহিল। থালাভরা ভাত-তরকারি পড়িয়া রইল। রাত কাটিয়া ভোর হইল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। ভোর কাটিয়া দুপুর হইল কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই।

দুপুর কাটিয়া সন্ধ্যা হইল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। বেলা যখন পড়-পড়, আকাশের কিনারায় সাঁঝের কলসি ভর-ভর, পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে, 'আরে ভাই! আজ তাঁতি আর তাঁতির বউকে দেখিতেছি না কেন? তাদের বাড়িতে তাঁতের খটর খটরও শুনি না, চরকার ঘড়র ঘড়রও শুনি না। কোনো অসুখ বিসুখ করিল নাকি? আহা! তাঁতি বড় ভাল মানুষটি। বেচারা গরিব হইলে কী হয়, কারো কোনো ক্ষতি করে নাই কোনোদিন।'

একজন বলিল, 'চল ভাই! দেখিয়া আসি ওদের কোনো অসুখ বিসুখ করিল নাকি।'

পাড়ার লোকেরা তাঁতির দরজায় আসিয়া ডাকাডাকি আরম্ভ করিল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নাই। ভিতর হইতে দরজা বন্ধ।

তখন তারা দরজা ভাঙিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, তাঁতি আর তাঁতির বউ শুইয়া আছে। নড়ে না, চড়ে না—ডাকিলেও সাড়া দেয় না। তারপর গাঁয়ের মোল্লা আসিয়া পরীক্ষা করিয়া স্থির করিল, তাহারা মরিয়া গিয়াছে।

আহা কী ভালবাসারে! তাঁতি মরিয়াছে, তাহার শোকে তাঁতির বউও মরিয়া গিয়াছে। এমন মরা খুব কমই দেখা যায়।এসো ভাই আতর গোলাপ মাখাইয়া কাফন পরাইয়া এদের একই কবরে দাফন করি।

গোরস্তান সেখান হইতে এক মাইল দূরে। এই অবেলায় কে সেখানে যাইবে? পাড়ার দুইজন ইমানদার লোক মরা কাঁধে করিয়া লইয়া যাইতে রাজি হইল। মোল্লা সাহেব ঘোড়ায় চড়িয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। কবর দেয়ার সময় জানাজা পড়িতে হইবে। গোরস্তানে মোরদা আনিয়া নামানো হইল; মোল্লা সাহেব একটি খুঁটার সঙ্গে তাঁর ঘোড়াটা বাঁধিয়া সমস্ত তদারক করিতে লাগিলেন।

তাঁর নির্দেশমতো কবর খোঁড়া হইল। তাঁতি আর তাঁতির বউকে গোসল করাইয়া, কাফন পরাইয়া সেই কবরের মধ্যে শোয়াইয়া দেওয়া হইল। তখনও তাহারা কথা বলে না। তাহাদের বুকের উপর বাঁশ চাপাইয়া দেওয়া হইল। তখনও তাহারা কথা বলে না। তারপর যখন সেই বাঁশের উপর কোদাল কোদাল মাটি ফেলানো হইতে লাগিল, তখন বাঁশ–খুঁটি সমেত তাঁতি লাফাইয়া বলিয়া উঠিল, 'তুই দুইটা খা, আমি একটা খাব।'

সঙ্গে ছিল দুইজন লোক আর মোল্লা সাহেব। তারা ভাবিল, নিশ্চয়ই ওরা ভূত হইয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গের দুইজন লোক মনে করিল, তাঁতি যে তার বউকে দুইটা খাইতে বলিল, নিশ্চয়ই সে তাহাদের দুইজনকে খাইতে বলিল। তখন তাহারা ঝুড়ি কোদাল ফেলিয়া দে–দৌড়, যে যত আগে পারে! মোল্লা সাহেব মনে করিলেন, তাঁতি নিজেই আমাকে খাইতে আসিতেছে। তখন তিনি তাড়াতাড়ি আসিয়া ঘোড়ার পিঠে সোয়ার হইয়া মারিলেন চাবুক। ভয়ের চোটে খুঁটি হইতে ঘোড়ার দড়ি খুলিয়া লইতে ভুলিয়া গেলেন।

চাবুক খাইয়া ঘোড়া খুঁটি উপড়াইয়া দিল ছুট। ঘোড়া যত চলে সেই দড়িতে বাঁধা খুঁটা আসিয়া মোল্লা সাহেবের পিঠে তত লাগে। তিনি ভাবেন, বুঝি ভূত আসিয়া তাঁর পিঠে দাঁত ঘষিতেছে। তখন তিনি আরও জোরে জোরে ঘোড়ার গায়ে চাবুক মারেন, আর দড়ি সমেত খুঁটা আসিয়া আরও জোরে জোরে তাঁর পিঠে লাগে।

হাসিতে হাসিতে তাঁতি আর তাঁতির বউ বাড়ি আসিয়া ভাত খাইতে বসিল।

* জসীমউদ্‌দীন: বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১৪ মার্চ ১৯৭৬)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top