হঠাৎ বিয়ে। আম্মা কল দিয়ে বললেন, 'তুই একটু সেজেগুজে "মায়াবতী ভিলা" বাড়ির নিচে আয়।'
—আম্মা, চোখে কি সুরমা টুরমা দিয়ে আইমু? চোখ বড় বড় লাগবে। একদম গরুর চোখের মতো। দেখতে বেশি একটা খারাপ লাগবে না!
—তুই ফাজলামো করিস নে তো। তাড়াতাড়ি আয়। আর শোন, কালো জামা কিন্তু ভুলেও পরবি না। ওইটা শোকের প্রতীক। বিয়ের দিন সাদা জামা পরতে হয়। তোরে সাদা জামায় বেশ লাগে দেখতে। ওয়ার্ডরোব খুলে দ্যাখ। তোর জন্য সাদা জামা আছে। সেদিন কিনে রাখছি। ওইটা পরে চলে আয়।
—আচ্ছা আম্মা, কপালের কোন পাশে যেন কাজলকালো টিপ দেয়? আমি মনে করতে পারছি না।
—ডান পাশে। কেউ কেউ বাম পাশেও দেয়। তুই কি কপালে কালো টিপ দিয়ে আইবি?
—হুম। একটা কালো টিপ দিয়ে আসতে চাইতেছি। যেন কেউ নজর লাগাতে না পারে!
—তুই তাড়াতাড়ি আইবি? না লোক পাঠামু, হ্যাঁ? দ্রুত চলে আয়।
বিজ্ঞাপন
—আম্মা, এত দ্রুত কেন?
—তুই বুঝবি না। মেয়ে রাজি হয়েছে। কাজীও এসেছে। তুই-ই খালি বাকি আছস!
—মেয়ে রাজি হয়েছে মানে? আর কাজী-ই বা কেন আসবে?
—তোর আজ বিয়ে।
—আমার বিয়ে! অথচ আমি-ই জানি না? তা ছাড়া আম্মা, আমার তো পছন্দ–টছন্দ আছে, তা–ই না?
—তোর আবার পছন্দ। তোর বয়স ২৩ চলতেছে। এখনো তুই একটা মেয়েও পছন্দ করে দেখাতে পারলি না। তোর ওপর ভরসা করা যাবে না আর। অনেক দিন ধরে ভরসা করে বসেছিলাম কিন্তু তুই...!
ও পাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে এল।
মা হয়তো কাঁদছেন। এটা সুখের কান্না। আমার আজ বিয়ের কান্না।
ফোনটা কেটে গেল।
যাক, লকডাউনে নিজ বাড়িতে বসে বসে খাওয়ার কোনো মানে হয় না। এবার খাব শ্বশুরবাড়িতে। সময়–অসময়ে যাব, খাব। শ্বশুরের পকেট তো সব সময়ই গরম থাকারই কথা।
আম্মার পছন্দের পাত্রী যে এত কিউটের ডিব্বা হবে, ভাবতেও পারিনি। তা ছাড়া আম্মার কাছে দুনিয়ার সব মেয়েই বিশ্বসুন্দরী। এ জন্য একটু চিন্তা হচ্ছিল।
রাত দশটায় বিয়ে হয়ে গেল। কাজী সাব টাকা নিয়ে চলে গেলেন। আমি বউ নিয়ে চলে এলাম।
অবাক করা কাহিনি। আমার বিছানায় গোলাপের পাপড়ি পড়ে আছে। ফুলের বাহার বিছানাজুড়ে। ফুলের গন্ধে ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার।
'ও' তো খাটের একপাশে বসে কাঁদছে।
আরে, কাঁদার কী হলো? কাছে গিয়ে ঘোমটা টেনে জিজ্ঞেস করলাম, মাথা ধরেছে বুঝি?
'ও' মাথা নেড়ে বলল, উঁহু!
—বমি বমি লাগছে বুঝি?
—উঁহু!
—প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে বুঝি!
—উঁহু!
—তাহলে কাঁদছ কেন, শুনি?
—আমি আম্মু যাব। আ আ আ! আমি আম্মু যাব! আ আ আ!
—বাসর রাতে এসব বলে না পাগলি মেয়ে। এতো আহ্লাদি হলে চলে হুম? ঘুমিয়ে থাকো। কাল সকালেই তোমাকে নিয়ে যাব।
—না। আমি এখনই আম্মু যাব।
—আচ্ছা, দাঁড়াও। তোমার আম্মুকে ফোন দিয়ে এখানে নিয়ে আসি কেমন?
—জ্বি আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর এসে দেখি ও ঘুমিয়ে গেছে। ও এমনিতেই অনিন্দ্যসুন্দরী। ঘুমালে তার সৌন্দর্য দশ গুণ বেড়ে যায়। যে নারীকে ঘুমন্ত অবস্থায় সুন্দর দেখায়, সে–ই প্রকৃত সুন্দরী, রূপবতী।
না। আজ আর জাগাব না তাঁকে। ভ্যানভ্যান ভালো লাগে না। খালি একটি বাক্যই শিখেছে। আমি আম্মু যাব আ আ আ।
দুদিন পর...
শ্বশুরবাড়িতে এলাম। আমাদের বউ-জামাইকে দেখে বাড়ির উঠোনে মুরগি ধরাধরি শুরু হয়ে গেছে। দেশি মুরগি খাওয়াবে মনে হচ্ছে। দাদাশ্বশুর পান খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলেছেন। হাসলে খালি গোলাপ ফুলের মতো লাল-ই দেখা যায়।
এ-ই দেক দেক। জামাই আইছে।
শালা–শালি দৌড়ে এসে হাতের বাজার–সদাই সব নিয়ে গেল। বউও লজ্জা পেয়ে দ্রুত ঘরে চলে গেল।
দুপুরে খেতে বসেছি। আহ, কী জামাই আদর!
রুই মাছের মাথা। মুরগির রান। গরুর গোশত। আরও কত কী! একটু আগে শালি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ৫০০ টাকা নাই করে ফেলেছে। শালাটা অভিমান করে বসে আছে। ওকে হয়তো হাজার দুয়েক দিতে হবে। ৫০০ টাকায় নাকি ওর কিচ্ছু হবে না৷ পর্দার ও পাশ থেকে ভাবিরা দুষ্টুমি করে বলছে, 'এই যে দুলাভাই, বেশি খেলে কিন্তু পেট বেড়ে যাবে৷ পাছে কিন্তু আমার ননদের কষ্ট হবে।' আমি কিছু বোঝার আগেই ওরা হেসে উঠল। থাক, এত বোঝার সময় নেই আমার। আগে খেয়ে নিই।
বউ বলল, 'মুরগিরটা নেন। এটা আমি নিজের হাতে রান্না করেছি।'
—আহা, কী সুস্বাদু হয়েছে। তুমিও একটু চেখে দ্যাখো না।
—উঁহু! আপনিই খান। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি।
—আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার শ্বশুরবাড়ি। আমিই খাই। তুমি তোমার শ্বশুরবাড়িতে খাইয়ো।
—ওই!
—হুঁ।
—শোনেন না!
—হুম। কান খোলা আছে। বলতে থাকো। তা ছাড়া খাওয়ার সময় এদিক—ওদিক তাকাতে নেই। খাবার মাইন্ড করে।
—শ্বশুরবাড়ি কেমন লাগছে আপনার?
মুরগির রান মুখে দিতে দিতে বললাম,
'ভালোই লাগছে বেশ,
তবে পকেটের বারোটা বাজা শেষ!
শালি–শালাদের বাংলাদেশ।'
—হি হি হি হি। আপনি কিন্তু কবির লাহান, কথায় কথায় খালি কবিতা কন।
লেখক: মনজুর সা'দ, শেরপুর