ঈদের দিন রাজধানীর নিরন্ন ও অসহায় মানুষেরা হাজির হয়েছিলেন লালমাটিয়ায়। তাঁদের মুখে ঈদের খাবার তুলে দিয়েছে 'মেহমানখানা' নামের এক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ। ঘুরে আসা যাক সেদিনের মেহমানখানা থেকে।
মেহমানখানায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন খোরশেদ আলম। ভগ্নস্বাস্থ্যের মানুষ তিনি। চোখ জোড়া কোটরাগত, বয়সের ভার যেন তাঁর শরীর নিতে পারছে না। এর মধ্যে ঈদের দিন সকাল থেকে ছিলেন অভুক্ত। তবু চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলেন, তাঁর সেই হাসিতে ফুটে উঠল সরলতার মাধুর্য। কাছে যেতেই অস্ফুটে বললেন, 'সকালে খাওয়া হয় নাই, এহানে আইছি, ঈদের খাবার খাই। খুব স্বাদ হইছে।'
করোনাকালে নিরন্ন ও অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠেছে 'মেহমানখানা'। রাজধানীর লালমাটিয়ার ডি-ব্লক এলাকায় কয়েকজন তরুণের স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ এটি। অসহায় মানুষকে খাওয়ানোর উদ্যোগটি প্রায় দেড় বছর আগে চালু হয়েছে। লকডাউনের দিনগুলো ছাড়াও প্রতি শুক্রবার এখানে খাবারের আয়োজন হয়। মহল্লার রাস্তার দুপাশে বসে খাবার খেতে পারেন ক্ষুধার্ত মানুষেরা। এই মানুষদের জন্যই ঈদুল আজহার আয়োজনে ৭৮ বছর বয়সী রিকশাচালক খোরশেদ আলম এসেছিলেন, এসেছিল তাঁর মতো আরও অনেকেই।
খোরশেদ আলম
দুপুরের খাবার বিতরণের দ্বিতীয় পর্ব ছিল সেটি। কেউ বসেছিলেন ফুটপাতে সারি মেনে, কেউ বসেছিলেন নিজের রিকশায়। এমনই একটি রিকশায় ছিলেন খোরশেদ আলম। তাঁর পাতে তখন মাংসের একটি টুকরো আর কয়েক লোকমা খিচুড়ি অবশিষ্ট। কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে মুখে পুরছিলেন। তাঁর খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তৃপ্তি নামের শব্দটি মিশে আছে খাওয়ায়। কথা বলার মানুষ পেয়ে খাওয়া থামিয়ে আলাপ জোড়েন, বলেন তাঁর নিজের কথা। সে কথা কষ্টের।
খোরশেদ আলমের তিন মেয়ে। সবারই বিয়ে দিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের আগে ভ্যানে সবজি বিক্রি করতেন। বলেন, 'জামাই অ্যাক্সিডেন্ট করল, ভ্যানটা বেইচা জামাইয়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে হইল।'
স্ত্রী ফিরোজা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে ২ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায়। রিকশা চালিয়ে ভাড়া দিতে পারেন না বলে বাসার মালিক তাঁদের বের করে দিয়েছে। এখন একটি মসজিদের বারান্দায় রাত কাটান খোরশেদ আলম। স্ত্রীকে রেখেছেন গার্মেন্টসকর্মীদের একটি মেসে। দিনে সেখানে দিতে হয় ৫০ টাকা।
খোরশেদ আলমের জীবনের করুণ গল্প শুনে পেছনের রিকশায় যাই। একটি রিকশায় বসে দুজন খাচ্ছিলেন। জানালেন, তাঁরা দুই ভাই। কিছুটা লজ্জাবনত হয়ে ছবি তুলতে বারণ করলেন। জানালেন, করোনাকালে তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন। হাজারীবাগ এলাকায় পরিবার নিয়ে কোনোভাবে থাকছেন। একজন এখন রিকশা চালান, অন্যজন হোটেল শ্রমিকের কাজ করেন। হোটেলের সে কাজও লকডাউনে বন্ধ আছে। ঈদের দিন একটু ভালো খাবার আশায় মেহমানখানায় এসেছেন। তবে পরিবারের অন্যদের কথা উঠতেই অপরাধবোধে মুখটা ভার হলো তাঁদের, পাতের খাবার যেন দুই ভাইয়ের গলা বেয়ে আর নামতে চাইল না।
অসহায়ত্বের গল্প
এমন অনেক গল্পের মুখোমুখি হতে হলো মেহমানখানায় খেতে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। সেসব গল্প অসহায়ত্বের, দুমুঠো খাবারের।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের খাওয়ানো শেষ। স্বেচ্ছাসেবকেরা তৃতীয় পর্বের খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত। কেউ মাংস ধুয়ে পরিষ্কার করছিলেন, কয়েকজন করছিলেন থালা পরিষ্কার। একটি দল আছে পাচকের সহকারীর ভূমিকায়। মাঝেমধ্যেই সামর্থ্যবান মানুষ আসছেন কোরবানির মাংস নিয়ে। স্বেচ্ছাসেবকেরা নিয়ে যাচ্ছেন তা পরিষ্কার করতে।
মেহমানখানার অন্যতম উদ্যোক্তা আসমা আক্তার লিজার সঙ্গে কথা হয় তখন। তিনি জানালেন, ঈদুল আজহায় তাঁরা তিন দিনের আয়োজন করেছেন। ১১টি গরু পেয়েছেন তাঁরা, পেয়েছেন খাসিও। তিন দিন চলবে ঈদের মেহমানদারি। ২২ জুলাই জানিয়েছেন, প্রায় ১২ হাজার মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছে মেহমানখানা। আসমা আক্তার বলেন, 'আমাদের শুধু গা খাটুনি। এখানে আমাদের এক টাকাও বিনিয়োগ নেই। চাল-ডাল-তেল-নুন—সবই মানুষের দেওয়া।'
মানুষের সহায়তা নিয়েই কয়েকটি গরুর মাংস বিতরণ করেছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে। লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর এলাকার প্রায় ২০০ পরিবারকে এ সহায়তা দেন। আসমা আক্তার যেমনটি বলছিলেন, 'এই পরিবারগুলো গত বছরও সচ্ছল ছিল। কেউ কেউ আমাদের সহায়তাও করত। এখন তারা সংকটে পড়েছে। ফোন করে কষ্টের কথা বলেন। এমন পরিবারকেই মাংস, পোলাওয়ের চালসহ রান্নার প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া হয়েছে।'
দুই সন্তান সাগর আর সানজিদাকে সঙ্গে এনেছিলেন সীমা আক্তার
ততক্ষণে তৃতীয় পর্বের খাবার প্রস্তুত হয়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবকেরা থালায় খিচুড়ি আর মাংস তুলে নেন। খাবার পরিবেশন শুরুর আগে হ্যান্ড মাইক হাতে আসমা বলে যান, 'আপনারা যাঁরা ঈদ করতে মেহমানখানায় এসেছেন, সবাই আমাদের মেহমান। কেউ ভিক্ষুক নন, কেউ মিসকিন নন, আপনারা মেহমান। আমাদের সেবায় ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। ঈদ মোবারক।'
এই পর্বে দুই সন্তান সাগর আর সানজিদাকে সঙ্গে এনেছিলেন সীমা আক্তার। গৃহকর্মী হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকায় কাজ করেন তিনি। মেহমানখানায় প্রায়ই আসেন। সীমা আক্তার বলেন, 'এখানে খাইতে আইসা খারাপ লাগে না, সবাই আদর কইরা খাওয়ায়। এই জন্য ঈদের দিনেও আইছি।'
* সজীব মিয়া, ঢাকা
মেহমানখানায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন খোরশেদ আলম। ভগ্নস্বাস্থ্যের মানুষ তিনি। চোখ জোড়া কোটরাগত, বয়সের ভার যেন তাঁর শরীর নিতে পারছে না। এর মধ্যে ঈদের দিন সকাল থেকে ছিলেন অভুক্ত। তবু চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলেন, তাঁর সেই হাসিতে ফুটে উঠল সরলতার মাধুর্য। কাছে যেতেই অস্ফুটে বললেন, 'সকালে খাওয়া হয় নাই, এহানে আইছি, ঈদের খাবার খাই। খুব স্বাদ হইছে।'
করোনাকালে নিরন্ন ও অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠেছে 'মেহমানখানা'। রাজধানীর লালমাটিয়ার ডি-ব্লক এলাকায় কয়েকজন তরুণের স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ এটি। অসহায় মানুষকে খাওয়ানোর উদ্যোগটি প্রায় দেড় বছর আগে চালু হয়েছে। লকডাউনের দিনগুলো ছাড়াও প্রতি শুক্রবার এখানে খাবারের আয়োজন হয়। মহল্লার রাস্তার দুপাশে বসে খাবার খেতে পারেন ক্ষুধার্ত মানুষেরা। এই মানুষদের জন্যই ঈদুল আজহার আয়োজনে ৭৮ বছর বয়সী রিকশাচালক খোরশেদ আলম এসেছিলেন, এসেছিল তাঁর মতো আরও অনেকেই।
খোরশেদ আলম
দুপুরের খাবার বিতরণের দ্বিতীয় পর্ব ছিল সেটি। কেউ বসেছিলেন ফুটপাতে সারি মেনে, কেউ বসেছিলেন নিজের রিকশায়। এমনই একটি রিকশায় ছিলেন খোরশেদ আলম। তাঁর পাতে তখন মাংসের একটি টুকরো আর কয়েক লোকমা খিচুড়ি অবশিষ্ট। কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে মুখে পুরছিলেন। তাঁর খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তৃপ্তি নামের শব্দটি মিশে আছে খাওয়ায়। কথা বলার মানুষ পেয়ে খাওয়া থামিয়ে আলাপ জোড়েন, বলেন তাঁর নিজের কথা। সে কথা কষ্টের।
খোরশেদ আলমের তিন মেয়ে। সবারই বিয়ে দিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের আগে ভ্যানে সবজি বিক্রি করতেন। বলেন, 'জামাই অ্যাক্সিডেন্ট করল, ভ্যানটা বেইচা জামাইয়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে হইল।'
স্ত্রী ফিরোজা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে ২ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায়। রিকশা চালিয়ে ভাড়া দিতে পারেন না বলে বাসার মালিক তাঁদের বের করে দিয়েছে। এখন একটি মসজিদের বারান্দায় রাত কাটান খোরশেদ আলম। স্ত্রীকে রেখেছেন গার্মেন্টসকর্মীদের একটি মেসে। দিনে সেখানে দিতে হয় ৫০ টাকা।
খোরশেদ আলমের জীবনের করুণ গল্প শুনে পেছনের রিকশায় যাই। একটি রিকশায় বসে দুজন খাচ্ছিলেন। জানালেন, তাঁরা দুই ভাই। কিছুটা লজ্জাবনত হয়ে ছবি তুলতে বারণ করলেন। জানালেন, করোনাকালে তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন। হাজারীবাগ এলাকায় পরিবার নিয়ে কোনোভাবে থাকছেন। একজন এখন রিকশা চালান, অন্যজন হোটেল শ্রমিকের কাজ করেন। হোটেলের সে কাজও লকডাউনে বন্ধ আছে। ঈদের দিন একটু ভালো খাবার আশায় মেহমানখানায় এসেছেন। তবে পরিবারের অন্যদের কথা উঠতেই অপরাধবোধে মুখটা ভার হলো তাঁদের, পাতের খাবার যেন দুই ভাইয়ের গলা বেয়ে আর নামতে চাইল না।
অসহায়ত্বের গল্প
এমন অনেক গল্পের মুখোমুখি হতে হলো মেহমানখানায় খেতে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। সেসব গল্প অসহায়ত্বের, দুমুঠো খাবারের।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের খাওয়ানো শেষ। স্বেচ্ছাসেবকেরা তৃতীয় পর্বের খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত। কেউ মাংস ধুয়ে পরিষ্কার করছিলেন, কয়েকজন করছিলেন থালা পরিষ্কার। একটি দল আছে পাচকের সহকারীর ভূমিকায়। মাঝেমধ্যেই সামর্থ্যবান মানুষ আসছেন কোরবানির মাংস নিয়ে। স্বেচ্ছাসেবকেরা নিয়ে যাচ্ছেন তা পরিষ্কার করতে।
মেহমানখানার অন্যতম উদ্যোক্তা আসমা আক্তার লিজার সঙ্গে কথা হয় তখন। তিনি জানালেন, ঈদুল আজহায় তাঁরা তিন দিনের আয়োজন করেছেন। ১১টি গরু পেয়েছেন তাঁরা, পেয়েছেন খাসিও। তিন দিন চলবে ঈদের মেহমানদারি। ২২ জুলাই জানিয়েছেন, প্রায় ১২ হাজার মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছে মেহমানখানা। আসমা আক্তার বলেন, 'আমাদের শুধু গা খাটুনি। এখানে আমাদের এক টাকাও বিনিয়োগ নেই। চাল-ডাল-তেল-নুন—সবই মানুষের দেওয়া।'
মানুষের সহায়তা নিয়েই কয়েকটি গরুর মাংস বিতরণ করেছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে। লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর এলাকার প্রায় ২০০ পরিবারকে এ সহায়তা দেন। আসমা আক্তার যেমনটি বলছিলেন, 'এই পরিবারগুলো গত বছরও সচ্ছল ছিল। কেউ কেউ আমাদের সহায়তাও করত। এখন তারা সংকটে পড়েছে। ফোন করে কষ্টের কথা বলেন। এমন পরিবারকেই মাংস, পোলাওয়ের চালসহ রান্নার প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া হয়েছে।'
দুই সন্তান সাগর আর সানজিদাকে সঙ্গে এনেছিলেন সীমা আক্তার
ততক্ষণে তৃতীয় পর্বের খাবার প্রস্তুত হয়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবকেরা থালায় খিচুড়ি আর মাংস তুলে নেন। খাবার পরিবেশন শুরুর আগে হ্যান্ড মাইক হাতে আসমা বলে যান, 'আপনারা যাঁরা ঈদ করতে মেহমানখানায় এসেছেন, সবাই আমাদের মেহমান। কেউ ভিক্ষুক নন, কেউ মিসকিন নন, আপনারা মেহমান। আমাদের সেবায় ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। ঈদ মোবারক।'
এই পর্বে দুই সন্তান সাগর আর সানজিদাকে সঙ্গে এনেছিলেন সীমা আক্তার। গৃহকর্মী হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকায় কাজ করেন তিনি। মেহমানখানায় প্রায়ই আসেন। সীমা আক্তার বলেন, 'এখানে খাইতে আইসা খারাপ লাগে না, সবাই আদর কইরা খাওয়ায়। এই জন্য ঈদের দিনেও আইছি।'
* সজীব মিয়া, ঢাকা