What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected দেবদাস (উপন্যাস) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
IMG_20210707_194712f5b89d415cf767cc.jpg



প্রথম পরিচ্ছেদ

একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না, উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখুয্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া, শ্লেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা ছড়াইয়া, হাই তুলিয়া, অবশেষে হঠাৎ খুব চিন্তাশীল হইয়া উঠিল; এবং নিমিষে স্থির করিয়া ফেলিল যে, এই পরম রমণীয় সময়টিতে মাঠে মাঠে ঘুড়ি উড়াইয়া বেড়ানোর পরিবর্তে পাঠশালায় আবদ্ধ থাকাটা কিছু নয়। উর্বর মস্তিষ্কে একটা উপায়ও গজাইয়া উঠিল। সে শ্লেট-হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল।

পাঠশালায় এখন টিফিনের ছুটি হইয়াছিল। বালকের দল নানারূপ ভাবভঙ্গী ও শব্দসাড়া করিয়া অনতিদূরের বটবৃক্ষতলে ডাংগুলি খেলিতেছিল। দেবদাস সেদিকে একবার চাহিল। টিফিনের ছুটি সে পায় না-কেননা গোবিন্দ পণ্ডিত অনেকবার দেখিয়াছেন যে, একবার পাঠাশালা হইতে বাহির হইয়া পুনরায় প্রবেশ করাটা দেবদাস নিতান্ত অপছন্দ করে। তাহার পিতারও নিষেধ ছিল। নানা কারণে ইহাই স্থির হইয়াছিল যে এই সময়টিতে সে সর্দার-পোড়ো ভুলোর জিম্মায় থাকিবে।

এখন ঘরের মধ্যে শুধু পণ্ডিত মহাশয় দ্বিপ্রাহরিক আলস্যে চক্ষু মুদিয়া শয়ন করিয়াছিলেন এবং সর্দার-পোড়ো ভুলো এক কোণে হাত-পা ভাঙ্গা একখণ্ড বেঞ্চের উপর ছোটখাটো পণ্ডিত সাজিয়া বসিয়াছিল এবং মধ্যে মধ্যে নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কখন বা ছেলেদের খেলা দেখিতেছিল, কখন বা দেবদাস এবং পার্বতীর প্রতি আলস্য-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছিল। পার্বতী এই মাসখানেক হইল পণ্ডিত মহাশয়ের আশ্রয়ে এবং তত্ত্বাবধানে আসিয়াছে। পণ্ডিত মহাশয় সম্ভবতঃ এই অল্পসময়ের মধ্যেই তাহার একান্ত মনোর ন করিয়াছিলেন, তাই সে নিবিষ্টমনে, নিরতিশয় ধৈর্যের সহিত সুপ্ত পণ্ডিতের প্রতিকৃতি বোধোদয়ের শেষ পাতাটির উপর কালি দিয়া লিখিতেছিল এবং দক্ষ চিত্রকরের ন্যায় নানাভাবে দেখিতেছিল যে, তাহার বহু-যত্নের চিত্রটি আদর্শের সহিত কতখানি মিলিয়াছে। বেশী যে মিল ছিল তাহা নয়; কিন্তু পার্বতী ইহাতেই যথেষ্ট আনন্দ ও আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিতেছিল।

এই সময় দেবদাস শ্লেট-হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ভুলোর উদ্দেশে ডাকিয়া বলিল, অঙ্ক হয় না।

ভুলো শান্ত গম্ভীরমুখে কহিল, কি আঁক?

মণকষা-

শেলেটটা দেখি-

ভাবটা এই যে, তাহার নিকট এ-সব কাজে শ্লেটখানি হাতে পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। দেবদাস তাহার হাতে শ্লেট দিয়া নিকটে দাঁড়াইল। ভুলো ডাকিয়া লিখিতে লাগিল যে, এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে-

এমনি সময়ে একটা ঘটনা ঘটিল। হাত-পা-ভাঙ্গা বেঞ্চখানার উপর সর্দার-পোড়ো তাহার পদমর্যাদার উপযুক্ত আসন নির্বাচন করিয়া যথানিয়মে আজ তিন বৎসর ধরিয়া প্রতিদিন বসিয়া আসিতেছে। তাহার পশ্চাতে একরাশি চুন গাদা করা ছিল। এটি পণ্ডিত মহাশয় কবে কোন্ যুগে নাকি সস্তা দরে কিনিয়া রাখিয়াছিলেন, মানস ছিল, সময় ভাল হইলে ইহাতে কোঠা-দালান দিবেন। কবে যে সে শুভদিন আসিবে তাহা জানি না। কিন্তু এই শ্বেত-চূর্ণের প্রতি তাঁহার সতর্কতা এবং যত্নের অবধি ছিল না। সংসারানভিজ্ঞ, অপরিণামদর্শী কোন অলক্ষ্মী-আশ্রিত বালক ইহার রেণুমাত্র নষ্ট না করিতে পারে, এইজন্য প্রিয়পাত্র এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভোলানাথ এই সযত্ন-সঞ্চিত বস্তুটি সাবধানে রক্ষা করিবার ভার পাইয়াছিল এবং তাই সে বেঞ্চের উপর বসিয়া ইহাকে আগুলিয়া থাকিত।

ভোলানাথ লিখিতেছিল-এক মণ তেলের দাম যদি চৌদ্দ টাকা নয় আনা তিন গণ্ডা হয়, তাহা হইলে,-ওগো বাবা গো-তাহার পর খুব শব্দ-সাড়া হইল। পার্বতী ভয়ানক উচ্চকণ্ঠে চেঁচাইয়া হাততালি দিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। সদ্যঃনিদ্রোত্থিত গোবিন্দ পণ্ডিত রক্তনেত্রে একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; দেখিলেন, গাছতলায় ছেলের দল একেবারে সার বাঁধিয়া হৈহৈ শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে, এবং তখনি চক্ষে পড়িল যে, ভগ্ন বেঞ্চের উপর একজোড়া পা নাচিয়া বেড়াইতেছে এবং চুনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হইতেছে। চীৎকার করিলেন, কি-কি-কি রে!

বলিবার মধ্যে শুধু পার্বতী ছিল। কিন্তু সে তখন ভূমিতলে লুটাইতেছে এবং করতালি দিতেছে। পণ্ডিত মহাশয়ের বিফল প্রশ্ন ক্রুদ্ধভাবে ফিরিয়া গেল, কি কি-কি রে!

তাহার পর শ্বেতমূর্তি ভোলানাথ চুন ঠেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। পণ্ডিত মহাশয় আবার চীৎকার করিলেন, গুয়োটা তুই!-তুই ওর ভেতর!

অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-

আবার!

দেবা শালা-ঠেলে-অ্যাঁ-অ্যাঁ-মণকষা-

আবার গুয়োটা!

কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া, মাদুরের উপর উপবেশন করিয়া প্রশ্ন করিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে দিয়ে পালিয়েচে?

ভুলো আরো কাঁদিতে লাগিল-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-

তাহার পর অনেকক্ষণ ধরিয়া চুন ঝাড়াঝাড়ি হইল, কিন্তু সাদা এবং কাল রঙে সর্দার-পোড়োকে কতকটা ভূতের মত দেখাইতে লাগিল এবং তখনও তাহার ক্রন্দনের নিবৃত্তি হইল না।

পণ্ডিত বলিলেন, দেবা ঠেলে ফেলে পালিয়েচে? বটে?

ভুলো বলিল-অ্যাঁ-অ্যাঁ-

পণ্ডিত বলিলেন, এর শোধ নেব।

ভুলো কহিল,-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-

পণ্ডিত প্রশ্ন করিলেন, ছোঁড়াটা কোথায়-

তাহার পর ছেলেদের দল রক্তমুখে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ফিরিয়া আসিয়া জানাইল, দেবাকে ধরা গেল না। উঃ-যে ইঁট ছোঁড়ে-!

ধরা গেল না?

আর একজন বালক পূর্বকথার প্রতিধ্বনি করিল-উঃ-যে-

থাম বেটা-

সে ঢোক গিলিয়া একপাশে সরিয়া গেল। নিষ্ফল-ক্রোধে পণ্ডিতমশাই প্রথমে পার্বতীকে খুব ধমকাইয়া উঠিলেন; তাঁহার পর ভোলানাথের হাত ধরিয়া কহিলেন, চল্, একবার কাছাড়িবাড়িতে কর্তাকে বলে আসি।

ইহার অর্থ এই যে, জমিদার নারায়ণ মুখুয্যের নিকট তাঁহার পুত্রের আচরণের নালিশ করিবেন।

তখন বেলা তিনটা আন্দাজ হইয়াছিল। নারায়ণ মুখুয্যেমশায় বাহিরে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক খাইতেছিলেন এবং একজন ভৃত্য হাতপাখা লইয়া বাতাস করিতেছিল। সছাত্র পণ্ডিতের অসময় আগমনে কিছু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, গোবিন্দ যে!

গোবিন্দ জাতিতে কায়স্থ-ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া ভুলোকে দেখাইয়া সমস্ত কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। মুখুয্যেমশায় বিরক্ত হইলেন; বলিলেন, তাইত, দেবদাস যে শাসনের বাইরে গেছে দেখচি!

কি করি, আপনি হুকুম করুন।

জমিদারবাবু নলটা রাখিয়া দিয়া কহিলেন, কোথা গেল সে?

তা কি জানি? যারা ধরতে গিয়েছিল, তাদের ইঁট মেরে তাড়িয়েচে।

তাঁহারা দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। নারায়ণবাবু বলিলেন, বাড়ি এলে যা হয় করব।

গোবিন্দ ছাত্রের হাত ধরিয়া পাঠশালায় ফিরিয়া গিয়া মুখ ও চোখের ভাবভঙ্গীতে সমস্ত পাঠশালা সন্ত্রাসিত করিয়া তুলিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, দেবদাসের পিতা সে অঞ্চলের জমিদার হইলেও তাহাকে আর পাঠশালে ঢুকিতে দিবেন না। সেদিন পাঠশালার ছুটি কিছু পূর্বেই হইল; যাইবার সময় ছেলেরা অনেক কথা বলাবলি করিতে লাগিল।

একজন কহিল, উঃ! দেবা কি ষণ্ডা দেখেচিস!

আর একজন কহিল, ভুলোকে আচ্ছা জব্দ করেচে।

উঃ, কি ঢিল ছোঁড়ে!

আর একজন ভুলোর তরফ হইতে কহিল,-ভুলো শোধ নেবে দেখিস।

ইস্-সে ত আর পাঠশালায় আসবে না যে শোধ নেবে।

এই ক্ষুদ্র দলটির একপাশে পার্বতীও বই-শ্লেট লইয়া বাড়ি আসিতেছিল। সে নিকটবর্তী একজন ছেলের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মণি, দেবদাদাকে আর পাঠশালায় সত্যি আসতে দেবে না?

মণি বলিল, না-কিছুতেই না।

পার্বতী সরিয়া গেল- কথাটা তার বরাবরই ভাল লাগে নাই।

পার্বতীর পিতার নাম নীলকণ্ঠ চক্রবর্তী। চক্রবর্তী মহাশয় জমিদারের প্রতিবেশী অর্থাৎ মুখুয্যে মহাশয়ের খুব বড় বাড়ির পার্শ্বে তাঁহার ছোট এবং পুরাতন সেকেলে ইঁটের বাড়ি। তাঁহার দু-দশ বিঘা জমিজমা আছে, দু-চার ঘর যজমান আছে, জমিদারবাড়ির আশা-প্রত্যাশাটা আছে,-বেশ স্বচ্ছন্দ পরিবার-বেশ দিন কাটে।

প্রথমে ধর্মদাসের সহিত পার্বতীর সাক্ষাৎ হইল। সে দেবদাসের বাটীর ভৃত্য। এক বৎসর বয়স হইতে আজ দ্বাদশবর্ষ বয়স পর্যন্ত তাহাকে লইয়াই আছে-পাঠশালায় পৌঁছিয়া দিয়া আসে এবং ছুটির সময় সঙ্গে করিয়া বাটী ফিরাইয়া আনে। এ কাজটি সে যথানিয়মে প্রত্যহ করিয়াছে এবং আজিও সেইজন্যই পাঠশালায় যাইতেছিল। পার্বতীকে দেখিয়া কহিল, কৈ পারু, তোর দেবদাদা কোথায়?

পালিয়ে গেছে-

ধর্মদাস ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া বলিল, পালিয়ে গেছে কি রে?

তখন পার্বতী ভোলানাথের দুর্দশার কথা মনে করিয়া আবার নূতন করিয়া হাসিতে শুরু করিল,-দেখ্ ধম্ম, দেবদা-হি হি হি-একেবারে চুনের গাদায়-হি হি-হু হু-একেবারে ধম্ম চিৎ করে-

ধর্মদাস সব কথা বুঝিতে না পারিলেও হাসি দেখিয়া খানিকটা হাসিয়া লইল; পরে হাস্য সংবরণ করিয়া জিদ করিয়া কহিল, বল না পারু, কি হয়েচে?

দেবদা ঠেলে ফেলে দিয়ে-ভুলোকে-চুনের গাদায়-হি হি হি-

ধর্মদাস এবার বাকীটা বুঝিয়া লইল এবং অতিশয় চিন্তিত হইল; বলিল, পারু সে এখন কোথায় আছে জানিস?

আমি কি জানি!

তুই জানিস-বলে দে। আহা তার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েচে।

তা ত পেয়েচে-আমি কিন্তু বলব না।

কেন বলবি নে?

বললে আমাকে বড় মারবে। আমি খাবার দিয়ে আসব।

ধর্মদাস কতকটা সন্তুষ্ট হইল-কহিল, তা দিয়ে আসিস, আর সন্ধ্যের আগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি ডেকে আনিস।

আনব।

বাটীতে আসিয়া পার্বতী দেখিল, তাহার মা এবং দেবদাসের মা উভয়েই সব কথা শুনিয়াছেন। তাহাকেও এ কথা জিজ্ঞাসা করা হইল। হাসিয়া গম্ভীর হইয়া সে যতটা পারিল কহিল। তাহার পর আঁচলে মুড়ি বাঁধিয়া জমিদারদের একটা আমবাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। বাগানটা তাহাদেরই বাটীর নিকটে, এবং ইহারই একান্তে একটা বাঁশঝাড় ছিল। সে জানিত, লুকাইয়া তামাক খাইবার জন্য দেবদাস এই বাঁশঝাড়ের মধ্যে কতকটা স্থান পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিল। পলাইয়া লুকাইয়া থাকিতে হইলে ইহাই তাহার গুপ্তস্থান। ভিতরে প্রবেশ করিয়া পার্বতী দেখিল, বাঁশঝোপের মধ্যে দেবদাস ছোট একটা হুঁকা-হাতে বসিয়া আছে এবং বিজ্ঞের মত ধূমপান করিতেছে। মুখখানা বড় গম্ভীর-যথেষ্ট দুর্ভাবনার চিহ্ন তাহাতে প্রকাশ পাইতেছে। পার্বতীকে দেখিতে পাইয়া সে খুব খুশী হইল, কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করিল না। তামাক টানিতে টানিতে গম্ভীরভাবেই কহিল, আয়।

পার্বতী কাছে আসিয়া বসিল। আঁচলে যাহা বাঁধা ছিল, তৎক্ষণাৎ দেবদাসের চক্ষে পড়িল। কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সে তাহা খুলিয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া কহিল, পারু, পণ্ডিতমশাই কি বললে রে?

জ্যাঠামশায়ের কাছে বলে দিয়েচে।

দেবদাস হুঁকা নামাইয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, বাবাকে বলে দিয়েচে?

হাঁ।

তারপর?

তোমাকে আর পাঠশালায় যেতে দেবে না।

আমি পড়তেও চাই না।

এই সময়ে তাহার খাদ্যদ্রব্য প্রায় ফুরাইয়া আসিল, দেবদাস পার্বতীর মুখপানে চাহিয়া বলিল, সন্দেশ দে।

সন্দেশ ত আনিনি।

তবে জল দে।

জল কোথায় পাব?

বিরক্ত হইয়া দেবদাস কহিল, কিছুই নেই, ত এসেচিস কেন? যা, জল নিয়ে আয়।

তাহার রুক্ষস্বর পার্বতীর ভাল লাগিল না; কহিল, আমি আবার যেতে পারিনে-তুমি খেয়ে আসবে চল।

আমি কি এখন যেতে পারি?

তবে কি এইখানেই থাকবে?

এইখানে থাকব, তারপর চলে যাব-

পার্বতীর মনটা খারাপ হইয়া গেল। দেবদাসের আপাত-বৈরাগ্য দেখিয়া এবং কথাবার্তা শুনিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছিল,-কহিল, দেবদা, আমিও যাব।

কোথায়? আমার সঙ্গে? দূর-তা কি হয়?

পার্বতী মাথা নাড়িয়া কহিল, যাবই-

না,-যেতে হবে না-তুই আগে জল নিয়ে আয়-

পার্বতী আবার মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি যাবই-

আগে জল নিয়ে আয়-

আমি যাব না-তুমি তা হলে পালিয়ে যাবে।

না-যাব না।

কিন্তু পার্বতী কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিল না, তাই বসিয়া রহিল। দেবদাস পুনরায় হুকুম করিল, যা বলচি!

আমি যেতে পারব না।

রাগ করিয়া দেবদাস পার্বতীর চুল ধরিয়া টান দিয়া ধমক দিল-যা বলচি।

পার্বতী চুপ করিয়া রহিল। তারপর তাহার পিঠে একটা কিল পড়িল-যাবিনে?

পার্বতী কাঁদিয়া ফেলিল-আমি কিছুতেই যাব না।

দেবদাস একদিকে চলিয়া গেল। পার্বতীও কাঁদিতে কাঁদিতে একেবারে দেবদাসের পিতার সুমুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। মুখুয্যেমশাই পার্বতীকে বড় ভালবাসিতেন। বলিলেন, পারু, কাঁদচিস কেন মা?

দেবদা মেরেচে।

কোথায় সে?

ঐ বাঁশবাগানে বসে তামাক খাচ্ছিল।

একে পণ্ডিত মহাশয়ের আগমন হইতেই তিনি চটিয়া বসিয়াছিলেন-এখন এই সংবাদটা তাঁহাকে একেবারে অগ্নিমূর্তি করিয়া দিল। বলিলেন, দেবা বুঝি আবার তামাক খায়?

হাঁ খায়, রোজ খায়। বাঁশবাগানে তার হুঁকো নুকোন আছে-

এতদিন আমাকে বলিস নি কেন?

দেবদাদা মারবে বলে।

কথাটা কিন্তু ঠিক তাই নহে। প্রকাশ করিলে দেবদাস পাছে শাস্তি ভোগ করে, এই ভয়ে সে কোন কথা বলে নাই। আজ কথাটা শুধু রাগের মাথায় বলিয়া দিয়াছে। এই তাহার সবে আট বৎসরমাত্র বয়স-রাগ এখন বড় বেশী; কিন্তু তাই বলিয়া তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা নিতান্ত কম ছিল না। বাড়ি গিয়া বিছানায় শুইয়া অনেকক্ষণ কাঁদিয়া-কাটিয়া ঘুমাইয়া পড়িল,-সে রাত্রে ভাত পর্যন্ত খাইল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top