What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লড়াই (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Welcome! You have been invited by বোঙ্বাই to join our community. Please click here to register.

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » লড়াই


পালান আমাদের খেতে কাজ করে।

সে ভালো লোক কি মন্দ লোক তা বোঝা খুব মুশকিল। তবে সে জানে খুব ভালো মাঞ্জা দিতে, মাছের এক নম্বর চার তৈরি করতে, কাঠমিস্ত্রির কাজও তার বেশ জানা, আর পারে গভীর ভাঙা গলায় গেঁয়ো গান গাইতে।

পালান গাছের নারকেল চুরি করে বেচে দিয়ে আসে। নিশুতরাতে পুকুরে জাল ফেলে মাছ তুলে নিয়ে যায়, খেতের ফসল চুরি করে। কিন্তু ধরা পড়লেই দোষ স্বীকার করে পায়ে ধরে ক্ষমা চায়। অনেক কাজের কাজী বলে আর তার হাসিটি বড় নির্দোষ আর সরল বলে দাদু তাকে তাড়ায় না।

আমাদের দিশি কুকুরটার নাম ঘেউ। ভারী তেজি কুকুর। মেজকাকা যখন বিয়ে করে কাকিমাকে ঘরে আনলেন—বেশিদিনের কথা নয়—তখন কাকিমার বড়লোক বাপের বাড়ি থেকে যেমন হাজাররকমের দামি জিনিস দিয়েছিল তেমনি আবার দুটো প্রাণীও দিয়েছিল সঙ্গে। এক প্রাণী হল এক যুবতী ঝি, তার নাম অধরা, অন্য প্রাণীটি হল ঘেউ।

ঘেউয়ের রং সাদা, চেহারা বিশাল আর চোখ রক্তবর্ণ। সে আসবার পর থেকে এ বাড়িতে বাইরের লোক আসা প্রায় বন্ধ। ঘেউ ডাকে কম কিন্তু কামড়ায় বেশি। সে আসার পর থেকে এ বাড়িতে অন্য বাড়ির ছেলেরা আসে না, অন্যের কুকুর-গরু আসা বন্ধ। হাঁস-মুরগি পর্যন্ত ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।

মেজকাকিমা বড় সুন্দরী। হাঁটু পর্যন্ত এক ঢাল চুল, দুধে-আলতায় গায়ের রং, রূপকথার রাজকন্যের মতো চেহারা। তিনি আস্তে হাঁটেন, কম কথা বলেন, দুটো বড়-বড় চোখে মাঝে-মাঝে অবাক হয়ে চারধার দেখেন। জেঠিমা, মা, বড়কাকিমা যখন উদয়াস্ত সংসারের কাজ করছেন তখন মেজকাকিমা শুয়ে বসে বই পড়ে সময় কাটান। তাঁর ছাড়া কাপড় অধরা কেচে মেলে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, আলতা পরিয়ে দেয়। সবাই গোপনে বলে, নতুন বউ কারও বশ মানবে না।

তা হোক, তবু মেজকাকিমাকে আমাদের বড় পছন্দ। তাঁর কাছে জিনিস কেনার পয়সা চাইলেই পাই। শিশুদের তিনি বড় ভালোবাসেন। প্রায়ই মিষ্টি কিনে এনে আমাদের খাওয়ান।

আমার দাদুর অনেক পয়সা। লোকে তাকে বিরাট ধনী বলে জানে। কিন্তু বড়লোকদের মতো চালচলন দাদুর নয়। যেটুকু সময় ওকালতি করেন সেটুকু বাদ দিলে অন্য সময়ে তার হেঁটো ধুতি, খালি গা—আর হাতে হয় দা নয়তো কোদাল কিংবা বেড়া বাঁধবার বাঁখারির গোছা। দাদু কখনও বিশ্রাম করতে ভালোবাসেন না। বলেন, বিশ্রাম এক ধরনের মৃত্যু। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চার ঘণ্টা ঘুমোবে। বাকি সময়টায় কাজ করবে।

পালান আর ঘেউ দাদুর ছায়া হয়ে ঘোরে। বাড়িতে ধোপা নাপিত এলে ঘেউ তাদের তাড়া করবেই। তখন দাদু বা পালান তাকে ধমক দিলে তবেই ক্ষান্ত হয়। অন্য কারও ধমককে সে গ্রাহ্য করে না, এমনকী মেজকাকিমা বা অধরার ধমককেও নয়। তাই মেজকাকিমা একদিন রাগ করে অধরাকে বললেন বাপের বাড়িতে থাকতে ঘেউ আমার কত বাধ্য ছিল। এখন বেয়াড়া হয়েছে। অধরা, ওকে এখন থেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবি।

মেজকাকা কাকিমাকে বড় ভয় পেতেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে প্রায়ই চোখে চোখে তাকাতে পারতেন না। কাকিমা তাঁকে শেকল কেনার কথা বলতে কাকা খুব মজবুত বিলেতি শেকল কিনে এনে দিলেন। ঘেউ বাঁধা পড়ল।

দাদু এসব টেরও পাননি। পরদিন বাগানে গিয়ে গাছপালার পরিচর্যার সময়ে একটু অবাক হয়ে চারপাশ দেখে বললেন, কুকরটা কই রে?

পালান বলে, বাঁধা আছে দেখেছি।

—বাঁধা? কে বাঁধল?

—ওই, খোঁচড় ঝি-টাই বোধহয়।

দাদু ডাকলেন, ঘেউ! কোথায় রে তুই?

মেজকাকার ঘরের পেছনের বারান্দা থেকে এখন ঘেউয়ের করুণ আর্তনাদ আর শিকলের ঠনঠন শব্দ ভেসে এল। আর কী ভীষণ যে দাপাদাপি করতে লাগল সে। মেজকাকিমা কঠিন স্বরে ঘেউকে বললেন, বেত খাবে এরপর।

ঘেউ চুপ করল।

দাদু একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।

আমরা আলায়-বালায় ঘুরি, অতশত খেয়াল করি না। তবু টের পেলাম, বাড়ির হাওয়ায় একটা থমথমে ভূতুড়ে ভাব।

সেবার পুজোর কিছু আগে মেজকাকিমার বাপের বাড়ি থেকে তত্ব এল। সে তত্ব দেখে লোকে তাজ্জব। বিশাল বিশাল পেতলের পরাতে থরে বিথরে সাজানো সব জিনিস। খাবারদাবার, কাপড়চোপড়, গয়নাগাঁটি পর্যন্ত। কম করে পনেরোজন লোক বয়ে এনেছে, সঙ্গে আবার বল্লমধারী পাঁচজন পাইক।

সে-তত্ব দেখতে বিস্তর লোক জমা হয়েছিল। ঘেউ বাঁধা আছে বলে লোকে তখন আসতে সাহস পায়।

জীবজন্তু বা পোকামাকড় মারা দাদু খুব অপছন্দ করতেন। এমনকী সাপ পর্যন্ত মারা নিষেধ ছিল। আমাদের বাড়িতে বহুকাল ধরে একজোড়া গোখরো ঘুরে বেড়ায়। বাস্তুসাপ বলে তাদের আমরা খুব একটা ভয় পেতাম না। তারা যেখানে সেখানে বিড়ে পাকিয়ে পড়ে থাকে। কখনও রোদ পোহায়, হাততালি দিলে চলে যায় ধীরেসুস্থে।

এই সাপ দুটোকে ভয় পেতেন কাকিমা। মাঝে-মাঝে রাগারাগি করে বলতেন, সাপকে কোনও বিশ্বাস আছে? এক্ষুনি এদের মেরে ফেলা দরকার।

তাঁর সে-কথায় কেউ কান দেয়নি। এমনকী মেজকাকাও না। সবাই বিশ্বাস করত, সাপ দুটো এ-বাড়ির পরম মঙ্গল করছে।

মেজকাকিমার বাপের বাড়ির তত্ব এসেছিল ঠিক দুপুরবেলায়, পুরুষমানুষ কেউ তখন বাড়িতে নেই। তত্ববাহক লোকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বাড়ির মেয়েরা মহা ব্যস্ত।

সেই সময়ে মেজকাকিমা পাইকদের ডেকে বললেন, দুটো গোখরো সাপ আছে এ-বাড়িতে। একটু আগেও উঠোনের পশ্চিম ধারে তুলসীঝাড়ের তলাকার গর্তে ঢুকতে দেখেছি ওদের। ও দুটোকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলো।

পাইকরা মহা বাধ্যের লোক। সঙ্গে-সঙ্গে লাঠিসোঁটা আর বল্লম বাগিয়ে উঠে পড়ল।

এক পাইক তুলসিঝাড়ের তলাকার গর্তে শাবল চালিয়ে মুখ বড় করে ফেলল। ভিতর থেকে ফোঁসফোঁসানির শব্দ আসছিল। ঠিক সেই সময়ে দৃশ্যটা দেখে বারান্দা থেকে ঘেউ বুকফাটা চিৎকার করে দাপাদাপি শুরু করল। তার দুই চোখ লাল, মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে, শিকলটা প্রায় সে হেঁড়ে আর কি!

মেজকাকিমা একটা লম্বা বেত নিয়ে এসে সপাটে কয়েক ঘা বসালেন ঘেউয়ের পিঠে। ঘেউ সে মার গ্রাহ্য করল না। উলটে শিকল প্রায় ছিঁড়ে মেজকাকিমাকে কামড়াতে গেল।

পুকুরে নেমে পানা পরিস্কার করছিল পালান। ঘেউয়ের চিৎকারে কী যেন বুঝতে পেরে উঠে এসে উঠোনে দাঁড়াল। বিশাল কালো চেহারা তার, কালো কাঁধে তখনও সবুজ কচুরিপানা লেগে আছে।

অবাক হয়ে সে তুলসিঝাড়ের কাছে পাইকদের কাণ্ড দেখে হঠাৎ দু-হাত তুলে ধেয়ে আসতে আসতে বলল, সর্বনাশ। সর্বনাশ!

মেজকাকিমা তখন রাগে আগুন। পাইকদের চেঁচিয়ে বললেন, এ লোকটা মহা চোর। এটাকে ঠান্ডা করো তো। তারপর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও বাড়ি থেকে।

পালান একবার ঘুরে তাকাল মেজকাকিমার দিকে। মনে হল, এক রাগী দৈত্য তাকিয়ে আছে সুন্দরী রাজকন্যার দিকে।

পরমুহূর্তেই পালান লকড়ির ঘরে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড লাঠি হাতে বেরিয়ে লাফিয়ে উঠোনে নামল।

ততক্ষণে অবশ্য পাইকরা একটা গোখরো সাপকে বল্লমে বিধে মেরে ফেলেছে। উঠোনে সাপটাকে শুইয়ে তারা অবাক হয়ে সাপটার বিশাল দৈর্ঘ্য দেখছিল। দুজন পাইক ওদিকে শাবল আর বল্লমের খোঁচায় দ্বিতীয় সাপটাকেও জখম করে ফেলেছে।

এ সময়ে পালানের লাঠি তাদের একজনের কাঁধে পড়তেই লোকটা 'বাপ' বলে উঠোনে গড়িয়ে পড়ে। অন্য পাইকরা মুহূর্তের মধ্যে সজাগ হয়ে যে যার অস্ত্র হাতে নেয়।

তারপরই উঠোন জুড়ে এক বিশাল লড়াই বেধে যায়। একদিকে পালান একা, অন্যদিকে পাঁচজন পাইক সমেত পনেরোজন জোয়ান।

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতু মেয়ে কমললতা গিয়ে হঠাৎ খুব সাহস করে ঘেউয়ের গলার বকলস থেকে শেকলের হুকটা খুলে দিল। ঘেউয়ের সাদা শরীরটা আলোর ঝলকানির মতো উঠোনে ছুটে গেল।

সারা পাড়া জুড়ে বিশাল হাঙ্গামার গোলমাল ছড়িয়ে পড়ল। ভিড়ে ভিড়াক্কার। আমরা ছোটরা সেই ভিড়ের পিছনে পড়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু বিকট গালাগাল আর চেঁচানি শুনতে পাচ্ছিলাম।

সব লড়াই-ই একসময়ে থামে। এটাও থামল। দেখি, ভিড়ের ভেতর চ্যাংদোলা করে পালানকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছে কিছু পাড়ার লোক। তার পেটে বুকে বল্লমের ফুটো, মাথা রক্তের টুপি পরে আছে। ঘেউ মাটিতে পড়ে করুণ আর্তনাদ করছিল। অনেক চেষ্টাতেও সে কোমর আলগা করে দাঁড়াতে পারছিল না।

মানুষ কীভাবে যুদ্ধে জিতবে তার কোনও নিয়ম নেই। অনেক সময়ে মানুষ যুদ্ধে জিতেও হারে, আবার কখনও হেরেও জিতে যায়।

এই ঘটনার দু মাস বাদে দেখা যেত, পালান আবার খেতের কাজে নেমেছে। তবে আগের মতো অতটা দৌড়ঝাঁপ গাছবাওয়া পারে না। ধীরেসুস্থে টুকটুক করে কাজ করে বেড়ায়, দাদুর। সঙ্গে ছায়া হয়ে লেগে থাকে।

ঘেউও আগের মতো নেই। তার একটা ঠ্যাং সবসময় উঁচু হয়ে থাকে। তিন ঠ্যাঙে সে নেংচে নেংচে ঘোরে দাদুর সঙ্গে।

দাদু নির্বিকার। সেই হেঁটো ধুতি, খালি গা আর হাতে সবসময়ে গৃহকর্মের নানা সরঞ্জাম। মেজকাকিমা তখন ঘোমটা টেনে খুব লজ্জা-বউয়ের মতো নানা কাজকর্ম করে বেড়ায়। জেঠিমা, মা, কাকিমাদের সঙ্গে একসঙ্গেই খায়, গল্প করে, হাসেও।

এখন অধরার বড় কাজ বেড়েছে। সামনে অগ্রহায়ণে পালানের সঙ্গে তার বিয়ে, পালানকে সেই জন্য দাদু একটু জমি দিয়েছেন ঘর বাঁধতে, তাতে অবসর সময়ে ঝুড়ি দিয়ে মাটি ফেলতে হয় অধরাকে। ভিত করে তারপর বাঁশবাঁখারি টিন দিয়ে ঘর উঠবে। বড় খাটুনি। মেজকাকিমা তাকে যখন-তখন ডাকলে সে একটু বিরক্ত হয়ে বলে, বাবা-রে-বাবা, সবসময়ে তোমাদের কাজে মাথা দিলেই চলবে! আমার নিজের বুঝি কাজ নেই?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top