What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected প্রিয় মধুবন (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » প্রিয় মধুবন



মাথা অনেক শূন্য লাগছে আজকাল। অনেক বেশি শূন্য। যেন একখানা খোলামেলা ফাঁকা ঘর। মাঝে-মাঝে শুধু একটি কি দুটি শালিক কি চড়ুইয়ের আনাগোনা। এরকম ভালো। এরকম থাকা ভালো। আমি জানি।

কালকেও আমার কাছে একখানা বেনামি চিঠি এসেছে। তাতে লেখা 'বিপ্লবের পথ কেবলই গার্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়! বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে!' লাল কালিতে লেখা চিঠি। নাম সই নেই, তবু আমি হাতের লেখা চিনি। লিখেছে কুণাল মিত্র। আমার বন্ধু। এখনও বোধহয় ফেরারি। প্রায় দশ বছর তার খোঁজ জানি না।

আমাদের ডাকঘরগুলির কাজে বড় হেলাফেলা। চিঠির ওপর ঠিকঠাক মোহরের ছাপ পড়েনি। আমি কাল সারাদিন আতস কাঁচ নিয়ে চেষ্টা করে দেখলাম। না, কোথা থেকে যে চিঠিটা ডাকে দেওয়া হয়েছে তা পড়াই গেল না। জানি যেখান থেকেই দেওয়া হোক ডাকে, কুণাল আর সেখানে নেই। সে সরে গেছে অন্য জায়গায়। রমতা যোগীর মতো ফিরছে কুণাল, কোথা থেকে কোথায় যে চলে যাচ্ছে! তবু বড় ইচ্ছে করছিল কুণাল কোথায় আছে তা জানতে।

কাল বিকেলের দিকে আলো কমে এলে আমি আতস কাঁচ নামিয়ে রাখলাম। মাথা ধরে গিয়েছিল সারাদিন আতস কাঁচের ব্যবহারে। তাই চোখ ঢেকে বসেছিলাম অনেকক্ষণ! ভুল হয়েছিল। সে তো ঠিক চোখ-ঢাকা নয়! টের পেলাম দুটি হাতের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে গড়িয়ে নামছে চোখের জল।

বিপ্লবের পথ কেবলই গাৰ্হস্থ্যের দিকে বেঁচে যায়! বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে! এ আমারই কথা। কুণাল কেবল কথাটা ফিরিয়ে দিয়েছে। যেন ওর কথার আড়ালে উঁকি মারছে তার সকৌতুক দয়াহীন মুখ–রাস্তা তুমিই দেখিয়েছিলে, ঘর থেকে বের করে এনেছিলে তুমিই। তারপর সরে গেছ কোথায়! এখন কার এঁটো চেটে বেড়াচ্ছ মধুবন? তোমার ঘেন্না করে না?

চমৎকার এইসব শব্দভেদী বাণ কুণালের। মেঘের আড়াল থেকে লড়াই। প্রতিদিন পালটে যাচ্ছে তার ঠিকানা। আর আমি মধুবন–আমি বাঁধা পড়েছি স্থায়ী ঠিকানায়। কুণাল হয়ে গেছে ছায়া কিংবা মায়া। আমি এখন কোথায় পাব তাকে? এ চিঠির তাই জবাব দেওয়ার দায় নেই।

কাল সন্ধেবেলায় আমি ঘরের আলো জ্বালিনি। কুণালের চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিলাম। আমার বুকের মধ্যে টিকটিকির বাসা। ঘর ছাড়ার কথা মনে হলেই সে ডাক দেয় টিকটিক টিকটিক। যেয়ো না। যাব না তা আমি জানি। তবু চোখের জলে আমার দু-হাতের আঙুল ভিজে গিয়েছিল। নিজের জন্য নয়, আমি কুণালের জন্য কেঁদেছিলাম। তারপর ফাঁকা একখানা ঘরের মতোই শূন্য হয়ে গেল মাথা। মাঝে-মাঝে একটি দুটি শালিক কি চড়ুইয়ের মতো ভাবনা। ও স্মৃতি আনাগোনা করে গেল।

অনেকক্ষণ আমার বাইরের কোনও জ্ঞান ছিল না। তারপর আমার বউ সোনা আমাকে ডাকল, 'রাজা, একটু এ-ঘরে এসো।'

গিয়ে দেখি সে কাপড় পালটাচ্ছে। বলল , 'দেখো, আমি তোমাকে সারাদিন একটুও জ্বালাইনি। তবু এখখন জিজ্ঞাসা করছি ও চিঠিটা কার? সারাদিন তুমি ওটা নিয়ে বসে আছ?' আমি চিঠিটা এনে তার হাতে দিলাম।

ও দেখল। তারপর অবহেলায় চিঠিটা টেবিলের ওপর ফেলে গিয়ে বলল , 'দ্যাখো কী বিচ্ছিরি ব্লাউজ পরেছি। পিছন দিকে বোতাম ঘর। কিছুতেই আটকাতে পারছি না, তুমি একটু বোতাম এঁটে দাও না।'

তখন সোনার সাজ আমি লক্ষ করলাম। কনুই পর্যন্ত হাতাওয়ালা একটা ব্লাউজ পরেছে সে, গলায় আর হাতে পাতলা লেস-এর ফ্রিল দেওয়া। ব্লাউজটা আরও কয়েকদিন ধরে পরতে দেখেছি। কোনওদিনই বোতাম এঁটে দেওয়ার জন্য আমার ডাক পড়েনি। তাই মৃদু হেসে আমি ওর পিঠের দিকে বোতাম আর হুকগুলো লাগিয়ে দিলাম।

ও আস্তে করে বলল , 'ইস, কী ঠান্ডা হাত!'

'ঠান্ডা!' আমি অবাক হয়ে বললাম, 'কই!' বলে হাত দুটো ওর গালে রাখলাম।

মাথা ঝাঁকিয়ে সোনা বলল , 'না সে ঠান্ডা নয়! নিস্পৃহতার কথা বলছিলাম।'

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। সোনা ধীরে-ধীরে আঁচল তুলে দিচ্ছিল শরীরে। হঠাৎ মুখ এগিয়ে বলল , 'আদর!'

তক্ষুনি কুণালের চিঠিটার কথা একদম ভুল হয়ে গেল।

সোনার ব্লাউজের বোতাম আর হুকগুলো আর-একবার লাগিয়ে দিতে হল আমাকে। তারপর সোনা টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে বলল , 'লাল কালিতে লেখা এই দেড় লাইনের চিঠিটা নিয়ে এখন আমরা কী করব? বাঁধিয়ে রাখব?'

হেসে বললাম, 'ঠাট্টাটা আমাকেই লাগল, সোনা। চিঠির ও কথাগুলো একদিন আমিই বলতাম। বহুদিন পর অনেক খুঁজে-খুঁজে আমার কাছে ফিরে এসেছে আমারই কথা।'

ও ভ্রূ কুঁচকে চিঠিটার দিকে চেয়ে থেকে বলল , 'এটা কি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য?

'না, না!' আমি মাথা নেড়ে হেসে উঠি, 'ওটা এমনিই, ঠাট্টার ছলেই আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া।'

সামান্য দ্বিধা করে সোনা বলল , চিঠিটার নাম–সই নেই। তবু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি একে জানো। কে?'

একটু ভেবে বললাম, 'ও বোধহয় আমারই এক সত্তা। অতীত থেকে লিখে পাঠাচ্ছে।'

'কবিতা!' সোনা হেসে ফেলল, 'এ কবিতা হয়ে গেল, রাজা।' হাসি থামিয়ে আস্তে-আস্তে বলল , 'আমি তো তোমার কাছে শুনেছিলাম যে আমি তোমার এক সত্তা। তোমার এরকম আর ক'টা সত্তা আছে, রাজা?'

হিংসুক। সোনা ভীষণ হিংসুক। ঘরে ওর রাজতন্ত্র। আমি ওর রাজা। ওকে এখন কিছুতেই বোঝানো যায় না যে একদিন আমি কুণালের ছিলাম প্রিয় মধুবন।

না, কুণালের প্রিয় মধুবন হওয়ার জন্য আর-একবার পিছু–হাঁটার কোনও ইচ্ছেই নেই আমার। এখন আমি বেশ আছি। ফাঁকা, খোলামেলা শান্ত একটি ঘরের মতো শূন্য মাথা। মাঝে-মাঝে এক-আধটা শালিক কি চড়ুইয়ের আনাগোনা। এক-আধটা ভাবনা, এক-আধখানা স্মৃতি। তার চেয়ে বেশি কী দরকার। এখন আমার আলো বাতাস ভালো লাগে, ছুটির দিন ভালো লাগে, অবসর আমার বড় প্রিয়। আমার প্রিয় সেলাই–কলের আওয়াজ, আমার শিশুছেলের কান্না, আলমারিতে সাজিয়ে রাখা পুতুল কিংবা ফুলদানিতে ফুল। আর বুকের মধ্যে সেই টিকটিকির ডাক। যেয়ো না। যেয়োনা।

তবু মাঝে-মাঝে যখন ভিড়ের মধ্যে রাস্তায় চলি তখন হঠাৎ বড় দিশেহারা লাগে। কিংবা যখন মাঝরাতে হঠাৎ কখনও ঘুম ভেঙে যায় তখন লক্ষ করে দেখি পাথর হয়ে জমে আছে আমার অনেক আক্ষেপ। আয়নায় নিজের মুখ দেখে কখনও চমকে উঠি। মনে কয়েকটা কথা বৃষ্টির ফোঁটার মতো কোনও অলীক শূন্য থেকে এসে পড়ে। তুমি যে এসেছিলে কেউ তা জানলই না। হায়, মধুবন!

সত্য বটে এ সবই আবেগের কথা। নইলে আমার মনে স্পষ্ট কোনও আক্ষেপ নেই। না আছে। পিছু–হাঁটার টান। খুব একটা স্মৃতিচারণও নেই আমার। মাঝে-মাঝে সোনা যখন আমাদের ছেলেটাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায়, বা বাপের বাড়িতে থেকে আসে একটি দুটি দিন, তখন কখনও-সখনও সন্ধেবেলায় বা রাত্রে আমি ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। একটি-দুটি কথা অন্ধকারে মশা ওড়ার শব্দের মতো অন্ধকারে গুনগুন করে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ

আমার বাচ্চা ছেলেটার কান্নার শব্দ মনে-মনে ডেকে আনি, সোনার গলার স্বরের জন্য নিস্তব্ধতার কাছে কান পেতে রাখি। আস্তে-আস্তে সব আবার ঠিক হয়ে যায়। যদি কখনও হঠাৎ মনে হয় যে এরকম শান্ত জীবন হওয়ার কথা ছিল না আমার, আরও দূরতর, ভিন্ন অনিশ্চয় এক জীবন আমার হতে পারত, তখন সঙ্গে-সঙ্গে আমি হাতের কাছে যা পাই হয়তো ওষুধের শিশি, ফাউন্টেন পেন। কিংবা অন্য কিছু না পেলে হাতের আংটির পাথরের দিকে চেয়ে থেকে আস্তে-আস্তে মনকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসি। অতীত এবং ভবিষ্যৎ থেকে ফিরিয়ে নিই আমার মুখ। আস্তে-আস্তে বলি, এরকমই ভালো। এরকম থাকাই আমাদের ভালো। তখন মাথা অনেক শূন্য লাগে। অনেক বেশি শূন্য। যেন একখানা খোলামেলা ফাঁকা ঘর।

অনেকদিন আগে কুণালের সঙ্গে আমার জীবন শেষ হওয়ার কিছু পরে ওইরকম লাল কালিতে লেখা বেনামি আর-একখানা চিঠি এসেছিল আমার সঠিক ঠিকানায়। তাতে লেখা 'জীবনে সৎ হওয়াই সব হওয়া নয়! আদর্শই সব! আদর্শ না থাকলে পুরোপুরি সৎ হওয়াও যায় না!' প্রতিটি বাক্যের পর একটি করে বিস্ময়ের চিহ্ন। আসলে ওগুলো সকথিত জিজ্ঞাসা। ছুঁচের মুখের মতো ওই চিহ্নগুলো আমাকে বিঁধেছিল। আমারই বলা কথা আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া। সেই তার প্রথম বেনামা চিঠি। তারপর আমার বিয়ের কিছু পরে আরও একখানা। এইরকম : 'বৃষ্টি হলেই মিছিল ভেঙে যাবে! দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াতে হবে গাছতলায়। মাথা বাঁচাতে।' কি জানি। সে গাছতলায় বলতে এ ক্ষেত্রে ছাদনাতলায় বুঝিয়েছিল কি না। চিঠিটা আমি সোনাকে দেখাইনি। শুধু মনে-মনে বুঝতে পেরেছিলাম, সে আমার সব খবর রাখে, হদিস রাখে সঠিক ঠিকানার। সে আমাকে ভোলেনি। সামান্য ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিল। কী জানি, আমি তাকে আরও তো কত কী শিখিয়েছিলাম। সে যদি সব মনে রেখে থাকে। তারপর ক্রমে বুঝতে পেরেছিলাম যে তা নয়। এ তার আমাকে নিয়ে খেলা। আসলে পুরোনো পুতুলের মতো ভেঙে সে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তার জীবন থেকে। মাঝে-মাঝে সে কেবল দূর থেকে আমাকে ওইভাবে স্পর্শ করে দেখতে চায় আমি কতটা চমকে উঠি।

বলতেই হয় খেলাটা চমৎকার শিখেছে কুণাল। সে খেলতে জানে। গতকাল আমি সামান্য অন্যরকম হয়ে গেলাম। আজ সকালে তাই আমার মুখের দিকে ঘুমচোখে চেয়ে সোনা প্রথম প্রশ্ন করল, 'আজও তুমি ওই ভূতুড়ে চিঠিটার কথা ভাবছ।' চমকে উঠলাম। বস্তুত তা নয়। চিঠিটার কথা আমি ভাবছিলাম না, কুণালের কথাও না।

হেসে বললাম, 'দূর।'

সোনা হাসল না। অনেকক্ষণ চুপচাপ করে ছেলের কাঁথা বিছানা গুটিয়ে রাখল, মশারি চালি করল, তারপর এক সময়ে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল , 'কেন ভোরে উঠে জানলার কাছে বসে আছ। এত সকালে ওঠা বুঝি তোমার অভ্যাস।

সে কথা ঠিক। ভোরে ওঠা আমার অভ্যাস নয়। কেন যে আজ অত ভোরে ঘুম ভেঙে গেল কে না জানে। তারপর আর ঘুম আসছিল না। শীতকাল, তবু লেপের ওম ছেড়ে উঠে গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে এসে আমি জানালার ধারে বসলাম। খুব কুয়াশা ছিল, জানালার নীচের রাস্তাটাকে মনে হচ্ছিল আবছায়ায় নিঃশব্দে নদী বয়ে যাচ্ছে। আর দূরের কলকাতা খুব উঁচু গাছের অরণ্যের মতো জমে আছে হিমে। সিগারেট ধরাতেই একটি-দুটি পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি প্রাণপণে সেগুলো ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম। ঠেকানো গেল না। খুব ভোরে একদিন এক আশ্রমের ঋত্বিককে দেখেছিলাম ডান হাতখানি ওপরে তুলে চোখ বুজে আহ্বানী উচ্চারণ করতে 'তমসার পার অচ্ছেদ্যবর্ণ মহান পুরুষ, ইষ্টপ্র তাঁকে আবির্ভূত, যদবিদা চরণে তদুপসানাতেই ব্রতী হই। জাগ্রত হও, আগমন করো। আমরা যেন একেই অভিগমন করি…।' গান নয়, শুধু টেনে টেনে উচ্চারণ করে যাওয়া। কবেকার কথা। তবু গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমরা যেন একেই অভিগমন করি। ভোরের শান্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার মনে হয়েছিল–হায়, মধুবন! হায়, কুণাল!

আমি আমার আংটির মদরঙের গোমেদ পাথরটার দিকে চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। আবছা অন্ধকারেও পাথরটা চিকমিক করছিল। আমি আস্তে-আস্তে আংটির গোমেদ পাথরটায় আমার মনকে স্থির করার চেষ্টা করছিলাম। তখন হঠাৎ–খোলা জানলা দিয়ে যেমন ঘরের মধ্যে আসে পোকামাকড়–তেমনি হঠাৎ অনেকদিন আগে শোনা কয়েকটা শব্দ বিদ্যুৎবেগে আমার মধ্যে খেলা করে গেল। প্রথমে আমি কিছুক্ষণ ভেবেই পেলাম না এই শব্দগুলি কী, কিংবা কোথা থেকে এল চেনা শব্দ। বড় চেনা। কয়েকটি মুহূর্তের পর মনে পড়ে গেল, এ আমার বীজমন্ত্র নাম, কৈশোরে শেখা। এতকাল বীজমন্ত্রের শব্দগুলি নিয়ে মনে-মনে খেলা করতে-করতে সেই কৈশোরের ধ্যান অভ্যাস করার কথা মনে পড়েছিল। একটা সাদা-কালো চক্রের ছবির দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতাম। তারপর চোখ বুজতেই সেই চক্রটা অমনি চলে আসত দুই জ্বর মাঝখানে, নাসিকার মূলে যাকে বলা হয় আজ্ঞাচক্র। অনেক শিখেছিলাম আমি। পইতের পর আমাকে শিখতে হয়েছিল পুজো পাঠ আহ্নিক। দণ্ডী ঘরে কয়েকটা কষ্টের দিন কেটেছিল, যার মধ্যে চুরি করে খেয়েছিলাম রসগোল্লা। মনে পড়ে এক শীতের খুব ভোরে দণ্ডী ভাসাতে যাচ্ছি ব্রহ্মপুত্রে, সঙ্গে জ্ঞাতিভাই তারাপ্রসাদ। হাফপ্যান্ট পরা তারাপ্রসাদ নদীর উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে হাই। তুলছিল। আমি তার দিকে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ঢালু বেয়ে জলের কাছে নেমে গেলাম। আমার পায়ে লেগে একটা মাটির ঢেলা আস্তে গড়িয়ে গিয়ে টুপ করে জলে ডুবে গেল। বিবর্ণ মেটে রঙের জলে ভেসে যাচ্ছিল আমার গেরুয়া ঝোলা আর লাঠি। এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম মাথার ওপর ফিকে নীল আকাশ, আর চারদিকেই মাটির নরম রং। কোথাও এতটুকু আবেগ বা অস্থিরতা নেই। সব শান্ত ও উদাসীন, আর বাতাসে মিশে থাকা সামান্য কুয়াশার মৃদু নীল আভা। জলে আমাকে ঘিরে ছোট-ছোট ঢেউ ভাঙার শব্দ। খুব সামান্য স্রোতে ধীরে-ধীরে দুলে–দুলে ভেসে যাচ্ছে গেরুয়া ঝোলা সুদ্ধ আমার দণ্ডী। খুব দূরে তখনও নয়। বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছিল তাকে। যেন ডুবন্ত এক সন্ন্যাসীর গায়ের কাপড় ভেসে যাচ্ছে জলে। মনে হয়েছিল আর দু-এক পা দূরেই রয়েছে জন্ম–মৃত্যু ও জীবনরহস্যের সমাধান। আর মাত্র দু-এক পা দূরে। আমার চারিদিকে বিবর্ণ মাটি রঙের জলস্থল বৈরাগীর হাতের মতো ভিক্ষা চাইছে আমাকে। তার ইচ্ছে হয়েছিল আমার ওই দণ্ডী যতদূর ভেসে যায়, নদীর পাড় ধরে আমি ততদূর হেঁটে যাই। ফিরে গিয়ে কী লাভ? অনেকক্ষণ বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে জলে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে তারাপ্রসাদ আমাকে জোর করে তুলে এনেছিল। তার পরও বহুদিন আমার সেই ঘোর কাটেনি।

সেই কথা মনে পড়তেই আমি প্রাণপণে অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আজ ভোরে। বীজমন্ত্রের যে শব্দগুলি মনে এসেছিল আমি সেগুলো নিয়ে খেলা করছিলাম। আর আমার আংটির গোমেদ পাথরটায় স্থির করার চেষ্টা করছিলাম আমার সমস্ত অনুভূতি। বহুদিন বাদে কৈশোরের সেই ধ্যান করার ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল আমাকে।

কুণাল জানে না তার চেয়ে আমি অনেক বেশি ফেরারি।

.

অফিসে বেরোনোর সময়ে সোনা মনে করিয়ে দিল, 'আজ আমাদের বিয়ের বার্ষিকী। মনে থাকে যেন।'

মনে ছিল না। চার বছর হয়ে গেল। এখন আমার ছত্রিশ, আর সোনা বোধহয় আঠাশ পেরিয়ে এল। ঘাড় ফিরিয়ে সিঁড়ির তলা থেকে সোনাকে একটু দেখলাম, আমার দিকেই চেয়ে আছে। হাসলাম। ও হাসল। পরস্পরকে বোঝার চেনা পুরোনো হাসি। রাস্তার রোদে পা দিতেই সরগরম কলকাতার উত্তপ্ত ভিড়ের মধ্যে মন হালকা হয়ে যাচ্ছিল। একটা বেনামি চিঠির জন্য কাল আমার

অফিস কামাই একথা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছিল।

মিডলটন স্ট্রিটে আমার অফিস। দরজায় পা দিতেই টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বুড়ো দারোয়ান, রিসেপশন কাউন্টারের চঞ্চল মেয়েটি মৃদু হেসে নড করল, 'মর্নিং স্যার' বলে, জুনিয়ার একটি অফিসার হলের আর-একদিকে চলে গেল। আমি লিফট নিলাম না। অনেকদিন পর একটু হালকা লাগছে আজ। আমি জুতোর শব্দ তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে দীর্ঘ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠে এলাম আমার চারতলার অফিসে। টাইপিস্টের ঘর থেকে অবিরাম টাইপ মেশিনের শব্দ ভেসে আসছে। আমার ছোট অফিস ঘরটার বাইরে অপেক্ষা করছে আমার ছোঁকরা চটপটে স্টেনোগ্রাফার। আমি তার দিকে চেয়ে একটু হেসে ঢুকে গেলাম ঘরে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা নিস্তব্ধ ছোট্ট ঘরটা আমার।

সবুজ কাঁচে ঢাকা টেবিল, গভীর গদিওয়ালা চেয়ার আর পিছনে প্রকাণ্ড কাঁচের জানালা। দূরে। ময়দানের চেনা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। কোট খুলে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিয়ে আমি কাঁচের শার্সি খুলে দিলাম। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে এল। পাতা-পোড়ানো ধোঁয়ার মৃদু গন্ধ। উদাস রোদ হাওয়া আর মৃদু ধোঁয়ার গন্ধ আমি আমার অন্তরে গ্রহণ করে নিচ্ছিলাম। বেশ নিশ্চিন্ত জীবন আমার। একটি-দুটি ছোটখাটো অভাববোধ এবং কখনও-সখনও সামান্য একটু একঘেয়েমি ছাড়া কোনও গোলমাল নেই। আমি সুখী। একটি ছোট শ্বাস ছেড়ে আমি চেয়ারে ফিরে এলাম।

দুপুরে হঠাৎ এল সোনার টেলিফোন। তার গলার স্বর শুনে চমকে উঠে বললাম, 'কী হয়েছে।'

'কই! কিছু না!' বলে ও হাসল, 'তোমাকে উল আনার কথা বলেছিলাম, রাজা! মনে আছে? মনে করিয়ে দিলাম। তোমার কোটের ডানদিকের পকেটে নমুনা দিয়ে দিয়েছি। চার আউন্স এনো।'

'দূর! আমি পারব না। আবার অফিসের পর দোকানে ছোটাছুটি। তা ছাড়া উলের রং মেলানো বড় ঝামেলা।'

'পারবে।' বলে হাসল, 'তুমি না পারলে চলবে কী করে? তুমি ছাড়া আমার কে আছে আর? মৃদু হাসলাম। আমাকে পটাতে সোনা ওস্তাদ।

একটু চুপ করে থেকে বলল , 'আজ বিকেলের কথা মনে আছে তো?।' বলেই আবার হাসি, 'বলো তো আজ কী?'

'আজ?' আমি একটু ভাবনার ভান করে বললাম, 'আজ তো খোকনের জন্মদিন!

'বদমাশ!'

'তাই না!'

'ঠিক আছে। তাই। শুধু সময়ে এসো।'

তারপর একটু চুপচাপ। টের পেলাম ও ফোন তখনও ছাড়েনি। আমিও ছাড়তে দ্বিধা করছিলাম। তখন হঠাৎ ও বলল , 'রাজা, আমার ফোন পেয়ে তুমি চমকে উঠলে কেন?'

সামান্য গোলমালে পড়ে বললাম, 'কই!'

'ভয় পেয়েছিলে?'

'কীসের ভয়!

ও হাসে-'কীসের ভয় তার আমি কী জানি! বউ–ছেলে চুরি যাওয়ার ভয় হতে পারে, ঘরে আগুন লাগার ভয় হতে পারে। কত ভয় আছে মানুষের!'

'বদমাশ' বলে আমি ফোন রেখে দিলাম।

সত্য যে আমি ভয় পেয়েছিলাম। সোনা যেভাবে বলল সেভাবে নয়। তবে অনেকটা এরকমই অস্পষ্ট একটা ভয়।

বিকেলে আমি অনেক ঘুরে-ঘুরে ওর ফরমাশি উল কিনলাম, আর আজকের দিন উপলক্ষ্যে ওর জন্য কিনলাম কালো জমির ওপর হলুদ আর সুরকি রঙের এমব্রয়ডারি করা একটা কার্ডিগান, কিছু ফুল, গোটা দুই বাংলা উপন্যাস। বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তা পা দিয়েছি, সে সময়ে কোথাও কিছু ছিল না-তবু হঠাৎ মনে হল যদি এই অবস্থায় কোনওদিন কুণাল আমাকে দেখে! কে জানে বাইরের এত অচেনা লোকজনের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে আমাকে লক্ষ করছে কি না! সে দেখছে তার প্রিয় মধুবনকে। পরনে স্যুট মধুবনের, উলের প্যাকেট, কাগজে মোড়া বউয়ের কার্ডিগান, হাতে ফুল আর উপন্যাস। কি জানি কেমন অস্বস্তি এল মনে, রজনীগন্ধার ডাঁটিতে অকারণে বোকার মতো আমার মুখ আড়াল করলাম।

পরমুহূর্তেই হেসে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম আমি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে কয়েক পলকের জন্য আমার দুর্বলতা এসেছিল।

সন্ধেবেলায় আমাদের অনুষ্ঠান জমল খুব। আমার অনেককালের বন্ধু অতীশ এসেছিল তার বউকে নিয়ে, আরও দু-একজন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন।

যখন সবাই চলে যাচ্ছে তখন সিঁড়ির গোড়ায় সতীশ আমাকে আলাদা ডেকে নিল, 'তোর সঙ্গে কথা আছে।'

আড়ালে নিয়ে গিয়ে সে প্রশ্ন করল, 'কী ব্যাপার রে? শুনলাম তোর কাছে বেনামা একটা চিঠি এসেছে?'

মাথা নাড়লাম–হ্যাঁ। বললাম, 'কে বলল ?'

'তোর বউ।' ও হাসল, 'ও খুব ভয় পেয়ে গেছে। বলছিল কাল থেকে তুই নাকি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছিস। কেঁদেছিস।'

হাসলাম, 'দূর।'

অতীশনীচু গলায় প্রশ্ন করল, 'কে লিখেছে?'

বললাম, কুণাল। কুণাল মিত্র।'

'ও!' বলে ভাবল অতীশ, 'বছরচারেক আগে সে আর-একবার তোকে চিঠি দিয়েছিল না?'

'হ্যাঁ। আমার বিয়ের ঠিক পরেই।'

'এবার কী লিখেছে সে?

আমি বললাম, 'অনেকদিন আগে আমি তাকে শিখিয়েছিলাম : সাবধান! বিপ্লবের পথ কিন্তু কেবলই গাৰ্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়! বনের সন্ন্যাসীও ফিরে আসে ঘরে! সেই কথাই সে ফেরত পাঠিয়েছে আমাকে।'

হাসল অতীশ, 'তোকে টিজ করছে, না?

আমি মাথা নেড়ে জানালাম–হ্যাঁ।

ধীরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল অতীশ, 'ওর বেশি আর কিছুই কুণালের করার নেই।'

আমি চেয়ে রইলাম অতীশের মুখের দিকে।

অতীশ ম্লান হাসল, 'মধুবন, আমি কুণালের খবর রাখি। বছরখানেক আগে তার খবর পেয়েছিলাম। হাওড়া জেলার মফসসলে একটা কারখানায় সে চাকরি করছে। দুঃখে কষ্টে আছে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি তাকে তোর কাছে আসতে বলেছিলাম। তুই বড় চাকরি করিস। সে মাথা নেড়ে জানাল আসবে না। বলেছিল, আমার খবর মধুবনকে দেবেন না। আমি কথা দিয়েছিলাম। আজ কথা ভাঙতে হল মধুবন, নইলে হয়তো তোর শান্তি থাকত না।'

একটু চুপ করে থেকে অতীশ আবার বলল , 'ভাবিস না মধুবন। এইসব ছোটখাটো চমক সৃষ্টি করা ছাড়া ওর জীবনে তো আর কিছু এখন করার নেই। ওরও ছেলেপুলে নিয়ে বড় সংসার, তোর খোঁজখবর রাখার সময় তেমন নেই। তবু মাঝে-মাঝে ওইসব চিঠি পাঠায়, পাঠিয়ে মজা পায়।'

কুণালকে প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে অতীশ চলে গেল। আমি নিঃশব্দে ঘরে ফিরে এলাম। দেখি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সোনা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ফিরে একঝলক হেসে বলল , 'কী গো কুণাল মিত্রের বন্ধু, ভূতপূর্ব বিপ্লবী? এবার একটু হেসে কথা কও।'

হাসলাম। বুঝলাম অতীশ চিঠিটা আন্দাজ করে সোনাকে সব বলে গেছে। তবু কী করে আমি সোনাকে বোঝাব যে আমি এখনও সুখী নই।

কুণাল কতদূর বিপ্লবী ছিল, সঠিক ফেরারি ছিল কি না তা নিয়ে আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। আমি স্বেচ্ছায় সরে এসেছি অনেক দূরে। এখন নিশ্চিন্ত জীবন আমার। তবু মাঝে-মাঝে একজন ফেরারির কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে। রাজনীতির জন্য নয়, বিপ্লবের জন্যও নয়, এসব কোনও কিছুর জন্যই এখন আর আমার একটুও ব্যস্ততা নেই। এখন আমার প্রিয় সেলাইকলের আওয়াজ, আমার শিশু ছেলের কান্না, আলমারিতে সাজিয়ে রাখা পুতুল কিংবা ফুলদানিতে ফুল। কেবল মাঝে-মাঝে এসবের ফাঁকে-ফাঁকে একটু বিমনা হয়ে ভাবতে ভালো লাগে আমারই এক সত্তা পালিয়ে ফিরছে মাঠে জঙ্গলে, খেতে খামারে, পাহাড়ে পর্বতে। কুণালের কথা শুনে তাই আমি একটু খুশি হইনি, অবাকও নয়। আমি তো জানতাম বিপ্লবের পথ গাৰ্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়! বনের সন্ন্যাসী ফিরে আসে ঘরে! আমি তো তা জানতাম!

রাতে শুয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে সোনা বলল , 'কষ্ট পাচ্ছ?'

চমকে উঠি বলি, 'কই! কীসের কষ্ট?'

'আমি জানি। পাচ্ছ।'

'কেন?'

'কী জানি!' বলে একটু চুপ করে থেকে বলল , বোধহয় তোমার মাঝে-মাঝে সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছা করে, না? এমন উদ্দেশ্যহীন নিস্তেজ জীবন তোমার ভালো লাগে না। আমি জানি।'

'দূর।' বলে জোরে হেসে উঠলাম। তবু সোনার মুখ সামান্য বিবর্ণ দেখাচ্ছিল।

'বড় ভয় করে গো।' ঘুমের আগে আমার আদরে তলিয়ে যেতে-যেতে সোনা বলল । অমনি আমার বুকের মধ্যে টিকটিক টিকটিক। যেয়ো না। যেয়ো না।

নিঃসাড়ে ঘুমের ভান করে অনেকক্ষণ পড়ে থেকে আমি গভীর রাতে উঠে লেখার টেবিলে ছোট বাতিটি জ্বেলে বসলাম। কুণালকে একটা চিঠি লেখা দরকার। চেনা কুণালকে নয়। এ আর এক কুণালকে, যাকে আমি চিনি না।

সারারাত ধরে আমি লিখলাম আমার চিঠি সিগারেটের পর সিগারেট জ্বেলে। তারপর টেবিলের ওপরেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ভোরবেলা সোনা আমাকে ডেকে তুলল। তার চোখে–মুখে ভয়, ঠোঁট কাঁপছে কান্নায়, 'কী করছিলে তুমি রাজা? সারারাত…সারারাত ধরে।'

আমি সুন্দর করে হাসলাম। তারপর ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলাম চিঠিটা। ও প্রথমে বুঝতেই পারল না।

বললাম, 'সারারাত ধরে আমি এ চিঠিটা লিখেছি সোনা। বেনামি একটা চিঠি।

'ওমা!' ও অবাক হয়ে বলল , 'এ তো মাত্র একটা লাইন!'

আমার কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ও শব্দ করে চিঠিটা পড়ল, 'ওরে কুণাল, বনের সন্ন্যাসীর চেয়ে ঘরের সন্ন্যাসীই পাগল বেশি!'
 

Users who are viewing this thread

Back
Top