What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কার্যকারন (ছোটগল্প) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
328
Messages
5,981
Credits
45,360
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » কার্যকারণ


রাত দুটোয় জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আমি সিগারেট জ্বাললুম। নিঃসাড় ঘুমে অচেতন আমার বউ সোনামন তা জানতেও পারল না। সারা বিকেল আমার সিগারেটের প্যাকেট লুকোনো ছিল হাতব্যাগে। খেয়াল করেনি সোনামন, বিছানায় যাওয়ার আগে অবহেলায় সে আমাদের দুই বালিশের ফাঁকে রেখেছিল ব্যাগটা আমি তা দেখে রেখেছিলাম।

বিয়ের একমাস আগে আমার গ্যাসট্রিকের ব্যথাটা বেড়ে গেল খুব। ব্যথা লুকিয়ে আমি ঘুরে বেড়াতাম। পেট আর বুকের মাঝখানে একটা বিন্দুতে ব্যথাটা প্রথমে শুরু হত। ফুলের কলির মতো। তারপরেই ছিল তার আস্তে আস্তে পাপড়ি মেলে দেওয়া। কিছু খেলেই কমে যেত। তারপর আবার গোড়া থেকে সে শুরু করত। সোনামন যখন রাস্তায় আমার পাশে হাঁটত, ট্যাক্সিতে ঢলে পড়ত আমার কাঁধে, কিংবা রেস্টুরেন্টে বসে চাপা ঠোঁটের হাসিটি হাসতে-হাসতে চায়ে চিনি মেশাত তখন আমি বুক–জোড়া টক জল আর কামড়ে ধরা ব্যথাটা গিলে রেখে অনায়াসে হাসতাম, কথা বলতাম। ওকে টের পেতে দিতাম না। শুধু মাঝে-মাঝে সোনামন চমকে উঠে বলত তোমাকে অত সাদা দেখাচ্ছে কেন মানিকসোনা (আমরা পরস্পরকে নানা নামে ডাকি)? আমি শান্ত গলায় উত্তর দিতাম বোধহয় আলোর মতো। ও বিশ্বাস করত না। বলত–আলো না, তোমাকে কেমন ক্লান্তও দেখাচ্ছে! কী হয়েছে? আমি হাসতাম। হেসেই ধরিয়ে নিতাম সিগারেট। ওই সময়টুকুর মধ্যেই আমি কৌশলে সোনামনকে অন্য কোনও বিষয়ে নিয়ে যেতাম নিজেকে আড়াল করে। আমি কখনও লক্ষই করতাম না, আমি কত সিগারেট খাই। সোনামনের

সঙ্গে জীবনে প্রথম এবং একমাত্র প্রেম করার সময়ে আমি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। কেন না। দেখা হলে বা দেখা হওয়ার আগের কিছুটা সময়ে আমার শরীর কাঁপত, স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ত। প্রবল। সঙ্গে-সঙ্গে সিগারেটের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নেওয়া আমার ছিল প্রিয় অভ্যাস। বিবাদে, আনন্দে কিংবা উত্তেজনায় আমার কেবলই ছিল সিগারেট আর সিগারেট। সিগারেটের চেয়ে স্বাদু কিছুই ছিল না।

বিয়ের একমাস আগে আমরা একটা ইতর ট্যাক্সিওয়ালার পাল্লায় পড়েছিলাম। গঙ্গার ধার থেকে সে আমাদের ঘুরপথে নিয়ে যাচ্ছিল। জোড়া ছেলে মেয়ে উঠলে ওটা তাদের অভ্যাস। আমি তাকে রেড রোড দিয়ে বালিগঞ্জের পথ বললাম, সে আমাদের অন্যমনস্ক দেখে সোজা উঠে এল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে। পরপর সে অবাধ্যতা করে যাচ্ছিল। গাড়িতে তার মুখের সামনে লাগানো ছোট্ট আয়নাটায় আমি তার রুক্ষ মুখে বিচ্ছিরি একটু হাসিও দেখতে পেয়েছিলাম। আমি ড্রাইভারকে লক্ষ করছি দেখে সোনামন রাগ করে বলল –তুমি কেবল ওইদিকেই চেয়ে আছ। ওখানে কী! আমি তোমার ডানপাশে। আমি মৃদু হেসে সোনামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ওর কথা শুনছিলাম। কিন্তু আমার লক্ষ ছিল আয়নার দিকে। নির্জন গুরুসদয় রোডে গাড়ি ঢুকলে আমি শান্ত গলায় ড্রাইভারকে থামতে বললাম। ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট আর জিভের শব্দ করল। সোনামন আমার হাত আঁকড়ে বলল , এখানে কেন? আমি হেসে বললাম–বাকিটুকু হেঁটে যাব, সোনামন। বিয়ের আগে একটু পয়সা বাঁচাই।

সোনামন নেমে ফুটপাথে দাঁড়াতেই আমি ট্যাক্সিটা ঘুরে ড্রাইভারের দরজায় গিয়ে একটা ঝটকায় দরজা খুলে ফেললাম। কী করছিলাম তা আমার খেয়াল ছিল না। আঠাশ উনত্রিশ বছর বয়সের শক্ত কাঠামোর ড্রাইভারটা মুখে একটু রাগ দেখাবার চেষ্টা করল। তারপরই আমার মাথার ভিতরে অস্বচ্ছ একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছিল। তাকে গাড়ির বনেটের ওপর চিৎপাত করে ফেলে আমি একনাগাড়ে অনেকক্ষণ মেরে গেলাম। নির্জন রাস্তাতেও লোকজন ছুটে আসছিল। প্রথম ভ্যাবাচাকার ভাবটা সামলে নিয়ে সোনামনই প্রথম ছুটে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল দু-হাতে–মানিকসোনা, এই মানিকসোনা…ওগো…পায়ে পড়ি। আমি সোনামনের কান্নার শব্দও শুনতে পেলাম।

কলকাতার লোকেরা এমনিতেই ট্যাক্সিওয়ালাদের পছন্দ করে না। তার ওপর আমার সঙ্গে সুন্দর একটি মেয়ে রয়েছে। কাজেই ট্যাক্সিওয়ালাকে আরও কিছু মারমুখো লোকের ভিড়ের মধ্যে রেখে দিয়ে আমি সোনামনকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। অভ্যাসমতোই আমার স্বয়ংক্রিয় হাত সিগারেট ধরিয়ে নিল। অনেককাল আমি কোনও দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্যে যাইনি। আমার রক্ত ঠান্ডা। তবু কী করে যে ব্যাপারটা হয়ে গেল। আমার ছেলেবেলায় শেখা ঘুষি মারার কৌশল আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেককাল আর আমার দুই হাত মারধরে ব্যবহৃত হয়নি।

চুপচাপ অনেকটা হেঁটে যাওয়ার পর হঠাৎ সোনামন তখনও তার কিছুটা ধরা গলায় বলল –তুমি যে এমন রাগতে পারো জানতুম না।

লজ্জা পেলাম। গম্ভীর মুখে শুধু বললাম–হুঁ।

সোনামন হঠাৎ বলল –তুমি অত সিগারেট খাও বলেই নার্ভ অত ইরিটেটেড হয়।

অবাক গলায় বললাম–দূর!

সে মাথা নাড়ল–ঠিকই বলছি। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে তুমি যখন সিগারেট কিনতে গেলে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে, তখন আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বলেছিলাম যেন সে তোমার কথা না শোনে, যেন একটু ঘুরে-ঘুরে যায়। আমি মফসসলের মেয়ে, ট্যাক্সিতে চড়ে কলকাতা দেখতে আমার ভালো লাগে।

দাঁড়িয়ে পড়ে আমি বললাম–সত্যি বলছ?

–সত্যি। সে মাথা নাড়ল–কে জানত তুমি রেগে গিয়ে ওই কাণ্ড করে বসবে মানিকসোনা। আমি তোমাকে বলবার সময়ই পেলাম না। তার আগেই তুমি মারতে শুরু করেছ। মাগো! ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল!

অনেকক্ষণ চুপ করে হাঁটতে-হাঁটতে আমি শুধু বললাম–ট্যাক্সির ভাড়াটা দেওয়া হল না।

এ কথা ঠিক যে, উত্তেজনা বেশি হলে আমার ব্যথা বাড়ে। গলা বুক জুড়ে বিষাক্ত টক জল কলকল করতে থাকে। কোনও কিছুতেই তখন আর স্বস্তি পাওয়া যায় না। ওই উত্তেজনার পর সেই বিকেলে আমার ব্যথা বাড়তে লাগল। যখন সুইন–হো স্ট্রিটে আমার ছোট্ট একটেরে ঘরটার তালা খুলছি তখনও আমার মনে হচ্ছে একটু বমি হয়ে গেলে স্বস্তি পাব। সঙ্গে সোনামন না থাকলে বাথরুমে গিয়ে আমি তাই করতুম। কিন্তু পাছে তার কাছে আমার অসুখ ধরা পড়ে যায়, আর সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে, সেই ভয়ে আমি সামান্য কষ্টে আমার যন্ত্রণা চেপে রাখলাম। কিন্তু যে। ভালোবাসে তার কাছে গোপন করা বড় শক্ত। আমাকে ঘিরে সোনামনের সমস্ত অনুভূতিগুলো বড় সচেতন। অনেক সময় সোনামন ঠিকঠাক বলে দেয় আমি কী ভাবছি। কিংবা আমার মন মেজাজ কখন কেমন থাকে বা থাকতে পারে তাও মাত্র আট-ন মাসের পরিচয়ে সে বুঝে গেছে। নির্জন রাস্তা তোমার ভালো লাগে, না গো? ওঃ, তোমার হাই উঠছে, একটু চা খাবে, না? অনেকক্ষণ খাওনি। তুমি খোলা জায়গায় প্রায়ই আমার মুখ আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করো, যাতে কেউ না আমার মুখ দেখতে পায়, তাই না, বলো! ইস, কী বোকা! সোনামন এরকম অজস্র। বলে যায়। ধরা পড়ে গিয়ে আমি আর লজ্জা পাই না। তবু আমি বহুদিন আমার ব্যথাটার কথা গোপন রাখতে পেরেছিলাম। সেদিন ঘরে ঢুকতে–ঢুকতে আমি প্রবল ব্যথাটাকে কষ্টে চেপে রাখছিলাম। আমার ঘরে যখন সোনামন আসে তখন আমি দরজা হাট খোলা রাখি, মাঝখানে একটা টেবিল, তার দুধারে বসি দুজনে যাতে খারাপ কেউ না ভাবে। সেরকমভাবেই বসেছিলাম দুজনে। কথা হচ্ছিল। আমার ব্যথাটার চরিত্র এই যে, শরীর কুঁজো করে কুঁকড়ে রাখলে সামান্য স্বস্তি লাগে। সাধারণত আমি সোজা এবং সহজভাবে বসি। সেদিন আমার শরীর দুবার কি তিনবার ঝাঁকুনি দিয়ে কুঁকড়ে গেল। ভেবেছিলাম অত সামান্য অস্বাভাবিকতা ও লক্ষ করবে না। কিন্তু তিনবারের বার ও কথা থামিয়ে চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি হাসছিলাম। ও আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলল তোমার শরীর ভালো নেই?

প্রশ্ন নয়, ঘোষণা।

শরীর সহজ করে নিয়ে হেসে বলি–কোথায় কী! শরীর ঠিক আছে।

ও মাথা নাড়ল–বাজে বোকো না। তোমার ব্যাপারে আমি বোকা নই। সব বুঝি।

–কী বোঝো?

–তোমার একটা কিছু যন্ত্রণা হচ্ছে।

–কই!

–হচ্ছে, আমি জানি। তোমার মুখ আবার সাদা দেখাচ্ছে।

তুমি লুকোচ্ছ। হাসলাম–বেশ! কিন্তু বলো তো কোথায় যন্ত্রণা?

ও একটু থমকে গেল। দাঁতে সামান্য ঠোঁট চেপে রেখে বলল –বলব?

মাথা নাড়লাম–বলো।

ও আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে ওর চোখে আমার এলানো শরীরের সব ভঙ্গি খুঁটিয়ে দেখে নিল। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে ও আমার পেট দেখিয়ে দিল–ওইখানে।

–না। আমি মাথা নাড়লাম–ঠিক পেটে নয়, তবে কাছাকাছি। আন্দাজ করে বলল ।

কিন্তু এই লুকোচুরির খেলা খেলল না সোনামন। আমার একটা হাত ধরে টানতে-টানতে বলল –কোথায় ব্যথা জানবার দরকার নেই… এখন চলো তো!

–কোথায়?

–ডাক্তারের কাছে।

বহুকাল, প্রায় সেই ছেলেবেলার পর থেকেই কোনও ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। বড় লজ্জা করছিল। কিন্তু সোনামন শুনল না, জোর করে নিয়ে গিয়ে প্রথম যে ডাক্তারখানা পাওয়া গেল সেখানেই এক বুড়োসুড়ো ডাক্তারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। কানে শুধু বলে দিল–দেখো, ডাক্তারকে আবার বোলো না যেন, আমার ব্যথাটা কোথায় বলুন তো!

রোগা একটা হাড় জিরজিরে ছেলে বুড়ো ডাক্তারের সামনে মা কালীর মতো জিভ বের করে দাঁড়িয়েছিল। তার দিক থেকে একবার আড়চোখ তুলে ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করলেন কী?

সোনামনকে খ্যাপানোর জন্যেই আমি ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে কেটে-কেটে বললাম–আজ আমি একটা ট্যাক্সির ভাড়া দিইনি ডাক্তারবাবু। তার ওপর ট্যাক্সিওয়ালাকে আমি খুব। মেরেওছিলাম।

ডাক্তার হাঁ করে তাকালেন। পিঠে সোনামনের একটা চিমটি টের পেলাম।

ধীরেসুস্থে আমি ডান হাতটা এগিয়ে দিলাম ডাক্তারের সামনে, বললাম–দেখুন ডাক্তারবাবু, ট্যাক্সিওয়ালাটার দাঁতে লেগে আঙুলটা অনেকখানি কেটে গেছে। মানুষের দাঁত বড় বিষাক্ত। এর জন্যে একটা ওষুধ দিন।

আমাকে ঠেলে সরিয়ে তখন সোনামন লালচে লাজুক মুখে এগিয়ে এল–না ডাক্তারবাবু, ওর কথা শুনবেন না…ইত্যাদি।

দুটি পাগল প্রেমিক প্রেমিকার পাল্লায় পড়ে আসল ব্যাপারটা বুঝতে ডাক্তারবাবুর অনেকটা সময় এবং ধৈর্য গেল। তারপরও ব্যাপারটা চট করে মিটল না। ডাক্তার অনেক কিছু পরীক্ষা করতে চাইলেন। সোনামনের পাল্লায় করে পড়ে দু-চার দিন ধরে সেই সব ক্লান্তিকর পরীক্ষা আমাকে দিতে হচ্ছিল। কিন্তু সারাক্ষণ আমার মন অন্য কথা বলছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, এসব কিছুই নয়; আসলে সারাজীবন ধরে আমি যে কিছু কিছু অন্যায় করেছি তা সবই তার প্রতিক্রিয়া। সবচেয়ে কাছাকাছি কারণটা হচ্ছে ট্যাক্সির ভাড়া না দেওয়া এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে ওই মার। অবশেষে রোগ ধরা পড়ল–হাইপার অ্যাসিডিটি। গালভরা চমৎকার নামটি শুনে। আমি খুশি হলাম, সোনামন হল না।

ডাক্তার আমার ব্যাপারে তাকে কিছু কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। পাড়ার একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে আমি মাঝে-মাঝে চা খেতাম। সেইখানে এক বিকালে দোকানভরতি লোকের সামনে। সোনামন দোকানদারকে বোঝাল আমার কি বিশ্রী একটা অসুখ হয়েছে। আর চা কত খারাপ। এর পর থেকে আমি চা চাইলে সে যেন আমাকে এক কাপ করে দুধ দেয়। দোকানদারকে কথা দিতে হল।

তারপর চলল গয়লার খোঁজ যে রোজ সকালবেলায় আমার ঘরের সামনে গরু নিয়ে এসে দুধ দুইয়ে দিয়ে যাবে। আমি আপত্তি করলাম–রোজ সকালে উঠে আমি গরুর মুখ দেখতে পারব না। কিন্তু সোনামন শুনল না।

যে হোটেলটায় আমি খেতাম সেখানে গিয়েও সোনামন আমার খাবারে ঝাল মশলার ওপর একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে এল। আর আমার ঘরের টেবিলটা ভরে উঠল বিস্কুটের টিন আর ওষুধের বাক্সে। আর সেই থেকেই আমার সিগারেট হাতছাড়া হয়ে সোনামনের হাতব্যাগে ঢুকে গেল। বিয়ের একমাস আগে থেকেই।

বহুদিন হল প্রায় চোদ্দো–পনেরো বছর বয়স থেকেই আমি বাড়ি আর মা বাবাকে ছেড়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কখনও পড়ার জন্য, কখনও চাকরির জন্য। নিঃসঙ্গ জীবন আমার একরকম প্রিয় ছিল। সেইখানেই পড়ল ডাকাত। সোনামন বিকেলে ফিরে যাওয়ার সময়ে রোজ দিব্যি দিয়ে যেত রাত্রে যেন দুটোর বেশি সিগারেট না খাই। ও চলে গেলে দীর্ঘ অপরাহ্ন আর রাত–জোড়া নিঃসঙ্গতায় সিগারেট ছাড়া তাই হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠত! তবু খেতাম না। ওর দিব্যি মনে পড়ত। একটু হেসে আমি আমার প্রিয় সিগারেটে আগুন না জ্বেলে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম।

আস্তে-আস্তে ব্যথাটা কমে যেতে লাগল। দশ পনেরো দিনের মধ্যেই আর ব্যথার চিহ্ন ছিল। না। টক জলের স্বাদ মুছে গেল বুক আর জিভ থেকে। চেহারা ফিরল একটু। আর সোনামনের মুখে বাচ্চা লুডো খেলুড়ির ছক্কাফেলার মতো ছেলেমানুষি হাসি ফুটে উঠল। তবু মাঝে-মাঝে আমার দুর্বোধ্যভাবে মনে হত আমার অসুখের কারণ কেবলমাত্র সিগারেট কিংবা অনিয়ম নয়। কেননা অনিয়ম এবং সিগারেটেরও আবার কারণ রয়েছে। এই রকম অনুসন্ধান করে যেতে থাকলে হয়তো দেখা যাবে আমার প্রস্তরীভূত মূল অন্যায়গুলিকে। সেই ট্যাক্সির ব্যাপারটা আমার প্রায়ই খুব মনে পড়ত। সোনামনকে আমি দু একবার বলতে গিয়েও সামলে গেছি। কেননা ও হয়তো ব্যাপারটায় নিজের দোষ মনে করে দুঃখ পাবে।

বিয়ের পর দু-মাস কেটে গেছে। আমার অসুখ নেই। নিঃসঙ্গতা নেই। সোনামন যত্ন করে বেঁধে দেয় মশলা আর ঝাল ছাড়া খাবার। কম সিগারেট। আমার সমস্ত শরীরে ধীরে-ধীরে ফুটে উঠছে স্বাস্থ্যের সুলক্ষণ। আর আমাকে নিজের কাছ থেকে পালাতে হয় না বন্ধুদের বিকারগ্রস্ত ভিড়ে কিংবা আড্ডায়। খিদে মেটাবার আলসেমিতে যখন তখন চায়ের কাপ টেনে বসতে হয় না। আমি সুন্দরভাবে বেঁচে আছি। জানি, অলক্ষে অজান্তে কখন সোনামনের গভীর উষ্ণ অন্ধকারে চলে গেছে আমার বীজ। ওই বৃক্ষ থেকে পাকা ফলের মতো বোঁটা ছিঁড়ে শিগগিরই একদিন নেমে আসবে আমার প্রিয় আত্মজরা। আমি জানি। আমি তা জানি। তবু আজ রাত দুটোয় আমি সোনামনকে ঘুমন্ত একা বিছানায় রেখে চুরি–করা সিগারেট জ্বেলে এসে জানলায় দাঁড়ালাম। হায় ঈশ্বর! আমি কীভাবে বলব! সোনামনকে আমি কীভাবে বলব!

ট্যাক্সিওয়ালাটা জানে যে, একটা রাস্তায় দুর্ঘটনার জন্য তার ফাঁসি হবে না। কিন্তু পরিপূর্ণ প্রতিশোধ নেওয়া হবে। আমি তার ট্যাক্সির নম্বর মনে রেখেছি। কিন্তু আমি জানি তাতে লাভ নেই। আমি তাকে আর ছুঁতেও পারি না।

পরশুদিনই আমি তাকে আর একবার দেখলাম। এক পলকের জন্য। সুইন হো স্ট্রিটের ঘরটা ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন যে ছোট্ট বাসাটায় আছি তা বাস রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে। একটু নির্জন চওড়া রাস্তা। বড়লোকদের পাড়া। বিকেলে আমি ফিরছিলাম। সারা মন সোনামনের নাম ধরে ডাকছিল। মনে পড়ছিল দরজা খুলে দিয়ে সোনামন কেমন লঘু পায়ে আমার আক্রমণ থেকে সরে দাঁড়াবে। চলে যাবে ছোট্ট ফ্ল্যাটটার কোণে কোণে। অনেকক্ষণের সেই ক্লান্তিহীন হুটোপুটি। সে সময়ে সোনামন তার ঘন শ্বাসের ফাঁকে-ফাঁকে বলবে–মোটেই তিনটে না মশাই, তুমি আজ। পাঁচটা সিগারেট খেয়েছ সারাদিন। ভুরভুর করছে গন্ধ। ভাবতে-ভাবতে আমি অন্যমনে ফুটপাথ থেকে পা বাড়িয়েছি রাস্তা পার হওয়ার জন্য। অভ্যাসমতো ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। মোড় থেকে ধীরে-ধীরে আসছে একটা ট্যাক্সি। ওটা আসার অনেক আগেই আমি পেরিয়ে যাব মনে করে যখন আমি রাস্তার মাঝামাঝি তখনই হঠাৎ মোটর ইঞ্জিনের তীব্র শব্দ হয়েছিল। হর্ন বাজেনি। হতচকিত আমি দেখলাম। পাগলাটে খ্যাপা ট্যাক্সিটা বাঘের মতো লাফিয়ে চলে এল। বৃথাই আমি একটা হাত তুলে আমার অসহায়তা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কেননা ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি সে কী চায়। সময় ছিল না। একদম সময় ছিল না। শুধু শেষ চেষ্টায় আমি খুব জোরে শূন্যে লাফিয়ে উঠলাম। ট্যাক্সির নীচু বনেটটায় আমার পায়ের জুতোর ঠক করে। শব্দ হল। আমাকে পাকিয়ে ছুঁড়ে একধারে ফেলে রেখে গাড়িটা তার তীব্র গতি বজায় রেখে বেরিয়ে গেল। খুব সামান্য এক পলকেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য আমি ড্রাইভারের রুক্ষ মুখটা দেখতে পেলাম, অস্বচ্ছভাবে শুনতে পেলাম তার চাপাগলার গালাগাল–শালা…

উঠে দাঁড়াবার পরও অনেকক্ষণ আমার সামনে শূন্য রাস্তাটাকে বড় বেশি শূন্য বলে মনে হয়েছিল। চারপাশ খুব নির্জন এবং শীতল যেন কিছুই ঘটেনি। পুরোনো অভ্যাসমতো আমি সিগারেটের প্যাকেটের জন্য পকেটে হাত বাড়ালাম। সোনামনের মুখ মনে পড়ল। আমি যাতে নিরাপদে থাকি সেইজন্যেই আমার সিগারেট কেড়ে নিয়েছে সোনামন। সে চায় আমি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকি, কোনও অসুখ, সামান্য অসুখও যেন না থাকে তার মানিকসোনার।

রাত দুটোর নির্জন রাস্তার দিকে চেয়ে আমার সেই একদিনের চেনা ট্যাক্সিওয়ালাকে ডেকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে ভাই ট্যাক্সিওয়ালা, তুমি কি জানো আমার সোনামন চায় যে, আমি আরও দীর্ঘকাল নিরাপদে বেঁচে থাকি?

তবু আমি জানি এই ঘরে আমার সোনামনের সতর্ক যত্নের বাইরে খোলা রাস্তায় আমাকে যেতে হবে। কলকাতায় রাস্তার গলিতে হাঁটাপথে কোথাও না কোথাও পছন্দমতো জায়গায় সে। আমাকে পেয়ে যাবে। হয়তো সারাদিন ধরে তার ট্যাক্সি ওঁত পেতে অপেক্ষা করে থাকবে গলির মোড়ে, অফিসের পাশেই কোনও চোরা গলিতে, হয়তো বা সে আমার পিছু নিয়ে ফিরবে দীর্ঘ পথ। তারপর একদিন দেখা হবে। সে তো জানেও না কে আমার সোনামন, কীংবা কীরকম আমাদের ভালোবাসা! জানেও না সোনামনের শরীর জুড়ে আমাদের সন্তান আসবে শিগগিরই একদিন! সে শুধু বিচ্ছিন্নভাবে আমাকে জানে যে, আমি অন্যায়কারী, সে জানে আমি তাকে একদিন মেরেছিলাম। তাই বহু খুঁজে-খুঁজে সে আমার চলাফেরার পথ বের করেছে। এখন কেবল সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় আছে সে।

পরিপূর্ণ শান্ত আমার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আমার চুরি-করা প্রিয় স্বাদু সিগারেট ধরিয়ে সামান্য অন্যমনে অনিশ্চয়ভাবে আমি মৃত্যুর কথা ভাবছিলাম। তিনমাস আগে সেরে যাওয়া বুক ও পেটের মাঝখানের সেই ব্যথাটা আস্তে-আস্তে ফুলের কলির মতো ফুটে উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top