স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর পূর্ণ হলো আজ। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার পিজে হার্টগ। পুরো নাম স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। ইংরেজ এই শিক্ষানুরাগী তাঁর সময়ের সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুলে। উচ্চশিক্ষা নেন ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ দ্য ফ্রান্স থেকে। সবশেষে তিনি ম্যানচেস্টারের ওয়েলস কলেজে বিশপ বার্কলে স্কলার ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা কেমন ছিল? জেনে নেওয়া যাক।
- ঢাকা শহরে হার্টগ দম্পতির কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু ছিল না। সেই নিঃসঙ্গতা তাঁরা কাটাতে চেষ্টা করেছেন কর্মব্যস্ততায় ডুব দিয়ে। টানা পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে হার্টগ দিনে অন্তত ১৮ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছেন।
- তাঁর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল 'গভর্নমেন্ট হাউস' (বর্তমান উপাচার্যের ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশের গভর্নরের বাসভবন হিসেবে), কিন্তু তিনি সেই রাজকীয় প্রাসাদে থাকতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ ভবনটি নির্মাণাধীন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দূরে ছিল।
- শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত থাকেন কি না, সব সময় খোঁজ নিতেন তিনি। হাজিরা খাতা দেখতেন। এই প্রশ্নে তিনি কঠোর ছিলেন। বিশেষ করে, বিজ্ঞানের ছাত্ররা ক্লাস না করলে তিনি তাঁদের পরীক্ষা দিতে দিতেন না। ১৯২২ এবং ২৩ সালে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি নমনীয় হতে রাজি হননি। ১৯২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন ভাষণে তিনি বলেন: We have not hesitated to maintain a high examination standard from the first and we shall not hesitate to maintain it. (শুরু থেকেই পরীক্ষার মান বজায় রাখতে আমরা কার্পণ্য করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।)
পুরোনো কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত
- সন্ধ্যা বেলা তিনি খাওয়াদাওয়া সেরে নিতেন। তারপর বের হতেন—হলে শিক্ষার্থীরা কী করছে তা দেখতে। শিক্ষার্থীদের টেনিস ও ভলিবল খেলা উপভোগ করতেন। নিজে টেনিস খেলায় অংশ নিতেন অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে।
- বাঙালি নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র ছিলেন খুবই মেধাবী। তাঁর ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, কিন্তু কোনো বিশেষ বিষয়ে নয়। বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস সব বিষয়ে তাঁর আগ্রহ। হার্টগ তাঁকে যে কোনো ক্লাসে উপস্থিত থেকে লেকচার শোনার অনুমতি দিয়েছিলেন।
- তেজগাঁওয়ে যে কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা থেকে এলাকাটির নামকরণ হয় ফার্মগেট, তা হার্টগের সুপারিশেরই বাস্তবায়ন হয়েছিল। সরকারকে তিনি বুঝিয়েছিলেন—বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকায় একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। বর্তমানের যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, এটিও স্যার ফিলিপ হার্টগের পরিকল্পনার ফসল। আজ বাংলাদেশে অনেকগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি গবেষণার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান রয়েছে—এসবের অনেক কিছুরই যাত্রা শুরু হয়েছে ফিলিপ হার্টগের হাত ধরে।
স্যার ফিলিপ হার্টগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, সৈয়দ আবুল মকসুদ
- তিনি স্টেটসম্যানসহ কয়েকটি ইংরেজি দৈনিক ও সাময়িকী রাখতেন। অন্য সবার টাকা পরিশোধ করে গেলেও স্টেটসম্যানের টাকা ভুলবশত পাওনা থেকে যায়। ১৯২৫ সালের ১৮ মে থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ৫ টাকা ৪ আনা বকেয়া ছিল। সেই টাকা স্টেটসম্যানের স্থানীয় এজেন্টকে বুঝিয়ে দিতে লন্ডন থেকে তিনি উপাচার্য ল্যাংলির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে গিয়েও তিনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভুলে যাননি। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক যাঁরাই লন্ডনে গেছেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা জানতে চেয়েছেন।
* তথ্যসূত্র: স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, সৈয়দ আবুল মকসুদ।