মানুষ মাত্রেই সুন্দর। আর নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসে না, আরও একটু আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় না, এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। তাই তো সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ অলংকার, প্রসাধনীর পাশাপাশি ত্বক ও চুলের যত্নে, নিজের রূপকে বিকশিত করতে অগুনতি পদ্ধতিতে খুঁজে চলেছে সৌন্দর্যচর্চার নানা উপায়। গ্রিক পুরাণ, ভারতীয় আয়ুর্বেদগ্রন্থ, চীনের রহস্যময় সব সৌন্দর্যচর্চা, আরকের প্রাচীন নথিপত্র—কোথায় নেই সৌন্দর্যচর্চার বর্ণনা! আর এই চিরাচরিত সৌন্দর্যসাধনের ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিশেষায়িত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর বিউটিশিয়ান বা সৌন্দর্যশিল্পীরা। দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই বিউটিশিয়ানরা আমাদের রূপ সৌন্দর্যে উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আমাদের জীবনের এক অত্যন্ত বড় অংশ হয়ে উঠেছেন। তাই তো আজ, ২৬ জুন, বিউটিশিয়ান দিবসে কৃতজ্ঞতা, স্বীকৃতি আর অনেক ভালোবাসা প্রাপ্য তাঁদের।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রশিক্ষিত বিউটিশিয়ানদের সৌন্দর্যচর্চার দুনিয়ায় কসমেটোলজিস্ট বলে অভিহিত করা হয়। বলা যায়, আজকের দিনে এই কসমেটোলজি একেবারে আধুনিক মূলনীতির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান বিশ্বে সৌন্দর্যের বৈশ্বিক ধারণার খোলস ভেঙে নিত্য ধাবমান সংজ্ঞায় বিশেষায়িত হচ্ছে দিনকে দিন। আবার গত দেড় বছরে পুরো পৃথিবীর প্রতিটি ব্যাপারের মতো সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রেও অতিমারিজনিত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে ব্যাপক আকারে। অন্যদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ, মানুষের বহমান ও সদাপরিবর্তনশীল প্রয়োজন—এসব কিছুর নিরিখে বলা যায়, সৌন্দর্যচর্চাশিল্পীদের প্রতি সবার আকাঙ্ক্ষাটা এখন নিছক গৎবাঁধা ফেসিয়াল, কেশবিন্যাস, পেডিকিউর, ম্যানিকিউরের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যচর্চার বদলে যাওয়া দিকগুলোর দিকে এবারে নজর দেওয়া যাক।
বৈশ্বিক মাপকাঠিতে সৌন্দর্য
সংকীর্ণ মাপকাঠিতে সৌন্দর্য পরিমাপের দিন এখন সুদূর অতীতে তলিয়ে গেছে। ইনক্লুসিভ বিউটির মূলকথাই হচ্ছে, মানুষ মাত্রেই সুন্দর। গ্লোবাল বিউটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রোডাক্ট ডিজাইন না করতে পারলে, বৈচিত্র্যময় বর্ণ, ত্বকের ধরন, বয়স, জাতীয়তার মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে না পারলে সৌন্দর্যপণ্যের কোম্পানিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা আছে এখন।
আর কসমেটোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কাজের ধরনে এই ব্যাপারগুলোর প্রতিফলন থাকা খুবই জরুরি। সবাইকে যেন তার স্কিনটোনের চেয়ে হালকা দেখায়, চুলগুলো যেন সোজা হয়, মেকআপের কারসাজিতে নাক–মুখ যেন কন্টুরিং করে খাড়া দেখায়, এসব ঘুণে ধরা ধারণা এখন জীবাশ্মস্বরূপ। বরং রূপবৈচিত্র্যকে উদ্যাপন করাই এখন বিউটিশিয়ানদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।
সৌন্দর্যচর্চায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও স্বয়ংক্রিয় সেট আপের মাধ্যমে বিউটি ট্রিটমেন্ট তো এখন মামুলি ব্যপার। আমরা বরং চোখ ফেরাই এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ নিয়ে। সৌন্দর্যবর্ধনের উপাদান, মেকআপ–সামগ্রীর দোকানে গিয়ে সময় নিয়ে শেড নির্বাচন, ট্রায়াল প্যাক থেকে একটু ট্রাই করে দেখা নিজের ত্বকে—এর মধ্যে একরকম আনন্দ তো আছেই; আবার সঠিক প্রোডাক্টও নির্বাচন করা সহজ এভাবে।
এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করতে জনসন্স অ্যান্ড জনসন্স, লরেলসহ অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি নিয়ে এসেছে ভার্চ্যুয়াল ট্রাই অনের ধারণা। অনলাইনে একজন সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে বা নিজের পছন্দমতো মেকআপ–সামগ্রী একটি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিজের ভার্চ্যুয়াল ত্বক ও চুলে প্রয়োগ করে দেখা যায় এই ব্যবস্থায়।
শেডটি আপনাকে মানাবে কি না, এই মেকআপে আপনাকে কেমন লাগবে, চুলের রংটি ভালো দেখাবে কি না—এ ব্যাপারে খুবই ভালো ধারণা পাওয়া যায় ভিডিওফিল্টারের মতো সহজে ব্যবহারযোগ্য এসব অ্যাপ্লিকেশনে। ত্বকের ধরন ও কাঙ্ক্ষিত প্রোডাক্টের উপযোগিতা–সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে এরূপ ব্যবস্থায় সহজেই নিজের পছন্দের সৌন্দর্যচর্চার উপকরণ কেনা যাবে। এই ধরনের বিউটি টেকনোলজিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চীন।
অতিমারির সঙ্গে বোঝাপড়ায় সৌন্দর্যচর্চা
অতিমারির ধাক্কা এসে পড়েছে বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সৌন্দর্যচর্চায় যেখানে বিউটিশিয়ানদের শারীরিক দূরত্ব মেনে কাজ করা খুবই দুরূহ, সেখানে কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা থাকতেই হবে। এই নিরিখে সৌন্দর্যসেবা প্রদায়ক ও কসমেটোলজিস্টদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও সাবধানতা খুব জরুরি। বিশ্বের বড় বড় রূপসদন ও প্রতিষ্ঠান এখন দক্ষ বিউটিশিয়ানের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পারসোনালাইজড সেবা ও পরামর্শ দিচ্ছে বিউটি ট্রিটমেন্টপ্রত্যাশী মানুষকে।
তবে এ ক্ষেত্রে কাস্টোমাইজড সেবা অর্থাৎ যার যার প্রয়োজন ও উপযোগিতা অনুযায়ী সৌন্দর্যসেবা, এই ধারণা আরও জোরালো ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর চলমান করোনাকালে অনলাইনে এই ধরনের সেবা ও পরামর্শ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। তাই সমস্যা শুনে বা ভিডিও দেখে সমাধান দেওয়ার মতো দক্ষতা আর মুনশিয়ানা অর্জন করতে হচ্ছে রূপবিশেষজ্ঞদের। আবার ভিডিও কনফারেন্সের উপযোগী 'জুম রেডি' লুকের দিকে ঝুঁকছে মানুষ এখন। সে অনুযায়ী সেরাম ট্রিটমেন্ট, হেয়ার স্টাইল, ডিপ ক্লেঞ্জিং বা গভীরভাবে ত্বকের রোমকূপ অবধি পরিষ্কার করার বিভিন্ন পদ্ধতির দিকে মনোযোগী হচ্ছে সৌন্দর্যচর্চায় বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্থানীয় সৌন্দর্যচর্চার গণ বিশ্বায়ন
স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল ও জাতির মানুষের মধ্যে যুগ যুগ ধরে সমাদৃত হয়ে আসছে বিশেষ কায়দাকানুনের যত সৌন্দর্যচর্চা ও মেকআপের পদ্ধতি। হাল জমানার ক্রেজ কে-বিউটির কথাই ধরা যাক। কোরিয়ান স্কিন কেয়ার রুটিন, মেকআপ টেকনিকের সমন্বয়ে এই কে- বিউটির ধারণা এখন সারা বিশ্বে ধারণাতীত জনপ্রিয়। খুব হালকা রঙের ওষ্ঠরঞ্জকের ব্যবহারে এর ফ্রেশ ও গ্লসি এই পুতুলসুলভ লুক পশ্চিমা ত্বকে খুব সহজে মানিয়ে যায়।
কিন্তু একে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার স্কিন টোন ও চেহারার গড়ন অনুযায়ী মানানসই করে তোলাই একজন দক্ষ বিউটিশিয়ানের পরিচয় হতে পারে। হিজাবি স্টাইলের সঙ্গে চড়া রঙের অ্যারাবিয়ান আই মেকআপ থেকে শুরু করে আমার নারকেল তেলে চুল মালিশ তথা ইন্ডিয়ান হেড ম্যাসাজ—বহু ধরনের স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা অর্জন করা ট্রেন্ড এখন কসমেটোলজিস্টদের পাঠ্যসূচিতে থাকে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা সৌন্দর্যচর্চা
আবহমানকাল ধরে শুধু তরুণীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রেখে সৌন্দর্যচর্চার সব আয়োজন আবর্তিত ছিল। অ্যান্টি-এজিং বিউটি ট্রিটমেন্টগুলোরও উদ্দেশ্য ছিল যেন শুধুই সটান তরুণীসুলভ ত্বকের ব্যবস্থা করা, তা সে ত্বকের যতই সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হয়ে যাক না কেন। এজিং গ্রেসফুলি বা আপন উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়ে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া—বর্তমান সময়ের পরিণত নারী-পুরুষ এখন এভাবেই ভাবছেন। তাই বেশি বয়সের ত্বক, চুলের যত্নে সব সৌন্দর্যচর্চার সামগ্রী উদ্ভাবনে আগ্রহ বাড়ছে এখন। আবার সৌন্দর্যচর্চাকে মেয়েলি বলে দূরে ঠেলে রাখা পুরুষ সম্প্রদায় এখন সারা বিশ্বেই ঝুঁকছে সৌন্দর্যচর্চার দিকে। তাই পুরুষের ত্বক, চুল, দাড়ি, গোঁফ এসব কিছুর জন্য উপযোগী প্রসাধনী, রূপচর্চার উপকরণ, কেশসজ্জার যন্ত্রপাতি যেমন স্বয়ংক্রিয় ট্রিমার ইত্যাদির ব্যাপারে বিশেষ দক্ষতা লাভ করতে হচ্ছে বিউটিশিয়ানদের। জেন্ডার নিউট্রাল মেকআপও এখন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিটি বয়স গ্রুপের জন্য গবেষণা ও জরিপ করা হয় এখন কসমেটোলজির দৃষ্টিকোণ থেকে। কিশোরীরা যখন মেকআপ ও গ্রুমিং টুলস ব্যবহার করবেই, তাই প্রাকৃতিক ও নিরাপদ পদ্ধতিতে তাদের সৌন্দর্যচর্চার প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ চলছে।
বিউটি ইন্ডাস্ট্রি এখন সারা বিশ্বে এক সুবিশাল ক্ষেত্র। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা না হলেও চিরাচরিত সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ কসমেটোলজির শরণাপন্ন হচ্ছেই কোনো না কোনোভাবে। করোনা–পরবর্তী ত্বক ও চুলের ক্ষতি, মানসিক শক্তি অর্জন, করোনাকালীন অবসাদ ও বিষাদ কাটিয়ে ওঠা—এমন নানা আশাবাদও সৌন্দর্যচর্চার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নানা জরিপে। এই সময়ে একজন বিউটিশিয়ান তাঁর দক্ষতা, সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ, সংবেদনশীলতা আর সহমর্মিতা নিয়ে আমাদের পাশে থাকেন নিজেকে আরও পরিপূর্ণ আর আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে। তাই আজকের দিনটি তাঁদের প্রতি সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা প্রকাশের উপযুক্ত দিন।
* তানিয়া ফেরদৌস