প্রাণিকুলের জীবনধারণের একটি অপরিহার্য উপাদান পানি। এ কারণে বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। একজন সুস্থ মানুষের দেহে ৬০ শতাংশের বেশি পানি। এই পানিই আমাদের শরীরে স্বাস্থ্যকর পুষ্টি বিতরণে সহায়তা করে, বর্জ্য অপসারণ করে, ত্বকের আভা বাড়ায় ও পেশিগুলো সচল রাখে। শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পাশাপাশি দাঁতের যত্নেও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, দাঁতের সুস্থতায় পানির ভূমিকা কী।
পানি আমাদের দাঁতকে শক্তিশালী করে। বিশেষ করে ফ্লোরাইডযুক্ত পানি পানে আমাদের দাঁতের ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। ফ্লোরাইডকে বলা হয়, 'মুখগহ্বরের প্রাকৃতিক যোদ্ধা'। মূলত ফ্লোরাইড দাঁতের বহিরাবরণ এনামেলকে সুরক্ষিত রাখে। উন্নত দেশগুলোতে কলের পানিতেই ফ্লোরাইড মেশানো থাকে। এমন একটি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির যেসব অঞ্চলের পানিতে ফ্লোরাইড নেই, সেসব অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় যেসব অঞ্চলের পানিতে ফ্লোরাইড আছে, সেসব অঞ্চলের শিশুদের দাঁতের ক্ষয় হওয়ার পরিমাণ অনেক কম।
পানি পানে আমাদের মুখ পরিষ্কার থাকে। অনেকের খাওয়ার সময় বা শেষে কোমল পানীয় পানে অভ্যস্ত। কোমল পানীয় হয়তো আমাদের সাময়িক তৃষ্ণা মেটায়। তবে মনে রাখা উচিত, সেই সঙ্গে কোমল পানীয় দাঁতে অনাকাঙ্ক্ষিত চিনি রেখে যেতে পারে। দাঁতে লেগে থাকা চিনি, দাঁতের ক্ষয়ের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার প্রধান খাবার। এরা দাঁতের আবরণে অ্যাসিড তৈরির মাধ্যমে দাঁতের ক্ষয়ের সূচনা করে। অন্যদিকে প্রতি চুমুক পানি আমাদের তৃষ্ণা নিবারণের পাশাপাশি আমাদের মুখ ও দাঁতে লেগে থাকা অবশিষ্ট খাদ্যকণা পরিষ্কার করে এবং মুখের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট অ্যাসিড পাতলা করে। এ জন্য প্রতিদিন দুই বেলা ব্রাশ করা অব্যাহত রাখতেই হবে। সারা দিনের পর্যাপ্ত পানি পানে সুন্দর হাসিও থাকবে সুস্থ।
পানি মুখের শুষ্কতা দূর করে। দাঁতের ক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা দেয় মুখের লালা বা প্রচলিত ভাষায় থুতু। এটি আমাদের খাদ্যচর্বণে সাহায্য করে, আবার মুখগহ্বর পরিষ্কারের কাজেও সহায়তা করে। লালাতে থাকা ক্যালসিয়াম, ফসফেট ও ফ্লোরাইড আমাদের দাঁতের শক্তি বাড়ায়। তাই যখনই মুখের লালার সরবরাহ কমে আসবে, তখনই মুখ শুষ্ক হয়ে উঠবে। এই শুষ্কতা দাঁতের ক্ষয়ের আশঙ্কা তৈরি করে। মুখের শুষ্কতা এড়াতে নিয়মিত পানি পান করা উচিত।
পানি ক্যালরিমুক্ত। অপর দিকে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত কোমল পানীয়তে চিনি ও ক্যালরি বেশি থাকে, যা মানুষের ওজন বাড়ায় এবং মুখগহ্বরে নানা ধরনের রোগব্যাধির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পানি পান করলে যেমন ওজন কমে, তেমনি মুখগহ্বরের রোগ প্রতিরোধেও পানি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এবার প্রশ্ন হলো দিনে কী পরিমাণ পানি পান করতে হবে। দিনে গড়ে একজন পুরুষকে সাড়ে তিন থেকে চার লিটার ও একজন নারীকে তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার পানি পান করা উচিত। তবে অতিরিক্ত পানি গ্রহণও শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত পানি আমাদের কিডনি নিষ্কাশিত করতে পারে না। শরীরে থেকে যাওয়া এই বাড়তি পানি রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যাকে হাইপোনাট্রেমিয়া বলে। কখনো কখনো এ পরিস্থিতি জীবনঘাতীর কারণও হতে পারে।
পানির রকমভেদ। শুরুতেই বলেছি, ফ্লোরাইডযুক্ত পানি দাঁতের জন্য সবচেয়ে উপকারী। খুব সম্ভবত রাজধানীর ওয়াসার পানিতেও ফ্লোরাইড রয়েছে। কিন্তু ওয়াসার পানি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে নগরবাসীর বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে দূষিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই এ পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে খাওয়াই ভালো। মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনলে তাতে ফ্লোরাইড আছে কি না, দেখে নিতে পারেন। এ ছাড়া ডিস্টিল্ড ওয়াটার, প্রাকৃতিক মিনারেল পানি, দূষণমুক্ত কূপের পানি খেতে পারেন।
অপর দিকে লেবুপানি, ঝাঁজালো পানি, ডাবের পানি বা বিভিন্ন রকম জুস আমাদের শরীরের জন্য উপকারী হলেও দাঁতের জন্য খুব একটা ভালো নয়। কারণ, এসব অ্যাসিডীয় পানি দাঁতের এনামেলের জন্য ক্ষতিকর। তাই এ ধরনের পানীয় পান করার পর কুলকুচি করে নেওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, এ রকম অ্যাসিডিক পানীয় পানে অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্রাশ করা যাবে না। কারণ, এসিডের উপস্থিতিতে ওই সময় দাঁতের আবরণ দুর্বল থাকে এবং তৎক্ষণাৎ ব্রাশের ছোঁয়ায় সে আবরণের ক্ষয়ে যাওয়া তরান্বিত হয়। তাই নিয়মিত ও পরিমাণমতো পানি পান করুন। সুস্থ শরীর, মন ও দাঁত নিয়ে প্রাণ খুলে হাসুন।
লেখক: চৌধুরী মিরাজ মাহমুদ ছগীর | ডেন্টাল সার্জন, দ্য ডেন্টাল চেম্বার, উত্তরা