হস্তশিল্প পরম্পরার। বাগানেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। নানা মাধ্যম। নানা কাজ। আর শিল্পসুষমার সৌকর্য হৃদয়গ্রাহী। সঙ্গে আছে নানা মন্দির, নানা ভঙ্গিমার বুদ্ধ। আর কিছু কিছু শব্দ, যেগুলো একটু ভালো, শুনলে মেলানো যায় নিজের ভাষার সঙ্গে।
থাটবাইন্যু টেম্পল, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্কুটি নিয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী মন্দির দেখতে। পথে ছড়িয়ে আছে নাম না জানা স্তূপ, ছোট ছোট টেম্পল। স্তূপ হলো ঘণ্টার আদলের বা উল্টো করে রাখা কোন আইসক্রিম আকৃতির স্থাপনা, যার বাইরের দিক থেকে পুরোটাই স্থায়ীভাবে পাকা করে দেওয়া, ভেতরে যাওয়া যায় না। কারণ, ভেতরে কোনো মহামুনি, ঋষির দেহাবশেষ রাখা আছে। কয়েকটা ছোট মন্দিরের সামনে স্কুটি খাড়া করে ভেতরে গেলাম। ভেতরে সেই নিশ্চুপ গৌতম বুদ্ধ পদ্মাসনে বসে রয়েছেন—কোথাও আঁখি মুদিত, কোথাও আঁখি মদির। কোথাও তিনি সোনালি বসনে, কোথাও খয়েরি। প্রতিটি মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের সামনে তাজা ফুল রাখা। ভিক্ষুরা নিয়মিত খুব ভোরে আসেন, প্রার্থনা করেন, সাধারণ জনগণও আসেন।
মন্দিরে ভেতরে
এখানে দেখি একটা আফ্রিকান মেয়ে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সঙ্গে সাইকেল বা বাইক নেই, হেঁটে এসেছে, হাঁটবে এই গরমে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে হলে তো যে কেউ এই মরুভূমির গরমের কথা শুনলে অক্কা পাবে। আমি রাইড অফার করতেই রাজি হয়ে গেল। মেয়েটির নাম কিয়া, এসেছে আমেরিকা থেকে, পেশায় ডেন্টিস্ট। ওর দাঁতগুলোও মুক্তোর মতো। আর এই মুক্তো ঝরানো মেয়ে কিনা পথে পথে ঘুরছে! পথে পথে অবশ্য আমিও ঘুরি, তবে আমি গরিব দেশের গরিব বাজেট ট্রাভেলার, গাড়ি করে ঘোরার সামর্থ্য নেই। কিন্তু এরা কেন এভাবে ঘুরবে! আসলে শখ আর কৌতূহলের কাছে সবকিছু হার মানে।
ওকে জায়গামতো নামিয়ে দিয়ে আমি চললাম থাটবাইন্যু টেম্পল, এখন অবধি বাগানের সবচেয়ে উঁচু মন্দির। পাঁচতলা করা হয়েছিল নির্মাণকালে। উপাসনালয়টি তৎকালীন বাগানের মনোরম স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। ১১৫১ সালে রাজা প্রথম সিথু এই মন্দির নির্মাণ করেন। থেরাভারা মতাবলম্বীদের জন্য নির্মিত এ মন্দিরের প্রতি তলায় চারপাশে খোলা ছাদ আছে এবং মন্দিরের গায়ে বৌদ্ধধর্ম–সংক্রান্ত বিভিন্ন ভাস্কর্য খোদাই করা ছিল। মন্দিরটি শুধু উপাসনার জন্যই ব্যবহৃত হতো তা নয়, এখানে বিশাল গ্রন্থাগার ও মঠও ছিল। বর্তমানে শুধু উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয়।
থাটবাইন্যু টেম্পল বাইরের দিকে সাদা চুনকাম করা। টিলোমিনলোর মতো ইটের বাহারি শোভা দেখাচ্ছে না। নিচতলাটা এখন ফাঁকা। বিভিন্ন চিত্রশিল্পী মনের আনন্দে বারান্দার ছায়ায় বসে ছবি আঁকছেন। আর বিক্রির জন্য ছবিগুলো ঝুলিয়ে রেখেছেন পাশে। কোনো ছবি বাগানের প্রাকৃতিক দৃশ্যের, কোনোটাবা গৌতম বুদ্ধকে বিভিন্ন আঙ্গিকে আঁকা।
থাটবাইন্যু টেম্পল
দোতলায় মন্দির। সিঁড়ির গোড়ায় জুতো খুলে রেখে ওপরে উঠতে হয়। সিঁড়িগুলোর উচ্চতা একেকটা এক ফুটের বেশি। আমার মতো লিলিপুটের হামাগুড়ি দিয়ে চড়তে হয়। দোতলায় ভেতরে উপাসনালয়। বাইরে প্রশস্ত ছাদে এখন তপ্ত রোদে কোনো মানুষ নেই। একজনমাত্র স্থানীয় নারী পূজা দিতে এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে এখানকার আরও অনেক তথ্য পেলাম। তিনতলা অবধি ওঠা যায়। এর ওপরে দর্শনার্থীদের আর উঠতে দেওয়া হয় না। প্রত্নতাত্ত্বিক ডিপার্টমেন্ট নিষেধ করে দিয়েছে। এখান থেকে সূর্যোদয় খুব ভালো দেখা যায়। কালকের প্ল্যান এখনই করে রাখলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে নিচে নামতেই দেখি আমার জুতা একটা এদিকে, আরেকটা অন্যদিকে।
মিয়ানমারে এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ, এ দেশে চুরি হয় না। উল্টো হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় একই জায়গায়, লোকজন এসে ধরে গছিয়ে দেয়। জুতো নেবে কে! পায়ে দিতে গিয়ে দেখি আশেপাশে চরে বেড়ানো কুকুর বাবাজিদের বিশেষ প্রিয় খাদ্য প্রায় হয়েই উঠেছিল আমার জুতা জোড়া। এক পাটির তো প্রায় শেষ অবস্থা।
বাইরের পাতাহীন শুকনা গাছে ট্র্যাডিশনাল উৎসবের পোশাক পরা অনেকগুলো রঙিন পাপেট ঝোলানো দেখে মন ভালো হয়ে গেল; জুতার শোক ভুলে গেলাম। মাথায় বড় মুকুট, চমৎকার স্থানীয় নাচের পোশাক পরা পাপেট দেখে একটা কিনে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটু আগে পরিচয় হওয়া এন্দেরা হা হা করে উঠল। বলল, হেরিটেজ টাউনের বাইরে তাদের গ্রাম থেকে কিনলে অর্ধেক দামে পাওয়া যাবে। আমি বললাম, দুপুরের খাবার খেতে ওদিকেই যাচ্ছি, তুমিও এসো, নামিয়ে দেব।
বাগানের অগুনতি স্তুপের মাঝে লেখক
জিজ্ঞেস করলাম, আমি না থাকলে কী করে যেতে। বলল, এখন অনেক স্থানীয় লোক মাঠে চাষ করার জন্য গরুর গাড়ি নিয়ে আসেন। তাঁদের কারও সঙ্গে চলে যেতাম।
আসলেই দেখলাম বহুদূরে একটি গরুর গাড়ি হেলেদুলে আসছে। ধান চাষের মাঠ খালি, সব ধান কাটা হয়ে গেছে।
আমাদের দেশের উচ্চারণে ওর নাম ইন্দিরা।
ইন্দিরা আর আমি চললাম বাগান টাউনের দিকে। পথে যথারীতি পড়ল অনেক স্তূপ আর উপাসনালয়। কিছুদূর গিয়ে দেখি নদীর ঘাট। এই রুক্ষ শুষ্ক জায়গায় নদী! আহা, কী আনন্দ!নদীর নাম এরাবদি। আমি এতক্ষণে উচ্চারণ ধরে ফেলেছি। তোতাপাখির মতো বলতে লাগলাম, 'ইরাবতী, ইরাবতী।' ইন্দিরা আমাকে পাগল ঠাউরেছে নিশ্চয়ই।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে মূল শহরে পৌঁছে গেলাম। ইন্দিরা আমাকে দোকান দেখিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। পাগলের সঙ্গে কে থাকে!
খুঁজেপেতে আগে বের করলাম খাবারের দোকান।
ইয়াঙ্গুনেই মিয়ানমারের খাবারের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে আমার পাকস্থলীর। তাই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। কোনার একটা টেবিল দেখে ভাত-মাছ অর্ডার করে দিলাম। আমি জানি এখনই অজস্র ছোট বাটিতে হাজির হবে কাঁচা শাকপাতা, সালাদ (যদিও আমাদের দেশে এমন সালাদ কেউ খাবে না, শুধু পাতা আর পাতা অথবা বাদাম আর শুকনা আস্ত ডালভাজা বা তিলভাজা), টি লিফ সালাদ, বিভিন্ন প্রকারের গ্রেভি বা ঝোল বা ক্লিয়ার স্যুপ আর কী কী যেন। দেখতে দেখতে টেবিল ভরে উঠবে ১৫–১৬ ধরনের সালাদ আর ঝোলে, সঙ্গে ভাত আর মাছ আসবে ভাজা বা ঝোলে গড়াগড়ি খেতে খেতে। একসঙ্গে এত পদের খাবার সামনে নিয়ে খাওয়া খুবই আনন্দদায়ক হতে পারে, তবে এই দেশে আমি শুধু ভাত আর মাছ ছাড়া পাতাবাহারি কিছুই তেমন খাই না। মাছের ঝোলে এদের নির্মিত বিখ্যাত পেস্ট থাকে, যা ফারমেন্টেড মাছ দিয়ে তৈরি করা হয়। আমার তো মনে হয় অন্য যেকোনো রান্নায় এরা এই পেস্ট ব্যবহার করে। মুরগির মাংসেও আমি একই গন্ধ পেয়েছি।
বাগানের ফালুদা
খাওয়া শেষে ফালুদা না খেলে স্বয়ং ব্রহ্মা রাগ করবেন। মিয়ানমারের অনেক কিছুই ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে, এমনকি মানুষের নামও। কে জানে কখন কোন মানুষরূপী দেবতার দেখা পেয়ে যাই। তাই ঝটপট ফালুদা খেয়ে বাজারে ছুট লাগালাম। ফালুদার স্বাদ ভারতে তৈরি ফালুদার মতোই। আইসক্রিম, সিরাপ, রাইস নুডলস, সাবুদানা, দুধ দিয়ে বানানো হয়।
বাজারে ঢুকে দিশেহারা অবস্থা। এত রঙিন সবকিছু! কোনো দোকানে বিকোচ্ছে 'ল্যাকার' বা কাঠের রঙিন শৌখিন তৈজসপত্র আর ডেকোরেশন পিস। চায়ের পাত্রে চা খাওয়া যায়। অন্যান্য পাত্রে খাবারও খাওয়া যায়। আগুনে পোড়ে না কাঠ বা বাঁশের তৈরি এসব পাত্র। আর এর ওপর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখলে অবাক হতে হয়। এত সূক্ষ্ম কাজ আগে এত সহজলভ্য পরিবেশে দেখিনি। প্রথমে পাত্রের আদল দেওয়া হয়, তারপর একবার পলিশ পড়ে। পলিশ করে এর ওপর চিকন ছুরির ফলা দিয়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়। এর ওপর আবার পলিশ পড়ে। এর ওপর পড়ে রংতুলির আঁচড়। রংতুলির আবরণ ছাড়াও এদের থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বার্নিশের ফিনিশিংয়ের পর দেখলে মনে হবে এ নির্ঘাত কোনো রাজা-মহারাজার ব্যবহার্য সামগ্রী। যেকোনো মিনিয়েচার আর্টের কাছে হার মানতে চাইবে। এত বর্ণবিভোর আর জৌলুশময়! দুই হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বংশপরম্পরায় এই সব ল্যাকার ওয়ার্ক আজও মানুষের জীবিকার অংশ হয়ে রয়ে গেছে।
কারুশিল্পের দোকানে
বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই হস্তশিল্পের কারখানা আর পসরা। এই বস্তু তো মণ কে মণ কিনে নিলেও মন ভরবে না। নিলাম হাত ভর্তি করে নিজের আর বন্ধুদের জন্য।
দারুশিল্প
বাজারের আরেক পাশে গড়ে উঠেছে কাঠের কারুশিল্প। লম্বা বড় বড় বা মাঝারি অথবা ছোট কাঠ খোদাই করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন আকারের ওয়াল হ্যাঙ্গি, বুদ্ধের মূর্তি, শোপিস ইত্যাদি। ল্যাকারের জিনিসের মতো এরাও সূক্ষ্ম কারুকাজে, অনন্য রুচিশীলতায় ভরপুর। এখন অবধি আমি কাঠের ওপর এত সূক্ষ্ম কারুকাজ অন্য কোথাও আর দেখিনি। হাত আর মেশিন—উভয় পদ্ধতিতেই কাঠ খোদাই আর নকশা চলছে। এই দারুশিল্প আমার অজানা আরেকটা বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছে। ফাইনাল টাচের পর কারুকাজকে আর এই ধরণির বলে মনে হয় না। স্বর্গীয় রূপ, ঔজ্জ্বল্য এসে ভর করে এর ওপর।
স্যান্ড পেইন্টিংয়ের নাম বাগানে আসা যেকোনো ভ্রমণার্থী শুনে থাকবেন। না শুনলেও বিভিন্ন উপাসনালয়ের সামনে বা মেঝেতে বসে চিত্রশিল্পীদের আঁকতে দেখা যায়। আমিও সবে দেখে এলাম থাটবাইন্যু টেম্পলের সামনে। বালির ওপর আঁকা হয় বলে এর নাম স্যান্ড পেইন্টিং। আর মজার ব্যাপার হলো অন্যান্য চিত্রকলার মতো ইজেলে রেখে এ ছবি আঁকা যায় না, মাটিতে রেখে উবু হয়ে বসে আঁকতে হয়। কারণ হলো, প্রথমে কাপড়ে আঠা মেখে এর ওপর বালু খুব করে গড়িয়ে নিতে হয়। আঠার সঙ্গো বালু আটকে গেলে শুকানোর পর এতে ছবি আঁকা হয়। সাধারণত শিল্পীরা বংশানুক্রমে এই শিল্পে দীক্ষা নিয়ে থাকেন। বালুর ক্যানভাসে তখন আঁকা হয় গাঢ় বা মিষ্টি কমলা রঙের টেম্পল, গৌতম বুদ্ধ, ভিক্ষু বা বাগানের প্রকৃতির ছবি। কমলা রঙের আধিক্যের কারণ রংটি ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক। কিছু চিত্রকলা আবার করা হয় সাদাকালোয় তবে সংখ্যায় নগণ্য।
স্যান্ডপেইন্টিং
এ ছাড়া বাজারে আছে বিভিন্ন আদলের পাপেট। একটা যদিও কিনেছি আগেই, তবে দেখতে দোষ নেই। এক ফুট বা এর চেয়ে একটু বড় আকারের পাপেটের কেউ পরে আছে সাধারণ পোশাক, কেউ–বা নাচের পোশাক, কেউ আবার রাজা–বাদশাহর জমকালো পোশাক। এখানে পাপেট শো হয় সন্ধ্যায়। আলাদা মঞ্চ আছে। গ্রামবাসী মাঝেমধ্যে নিজেদের জন্যও পাপেট শোর আয়োজন করেন। পরদিন কাছের একটা গ্রামে পাপেট শো আছে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য করা শোয়ের চেয়ে স্থানীয় মানুষদের করা শো বেশি আনন্দদায়ক হবে।
* লেখক: ফাতিমা জাহান
থাটবাইন্যু টেম্পল, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্কুটি নিয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী মন্দির দেখতে। পথে ছড়িয়ে আছে নাম না জানা স্তূপ, ছোট ছোট টেম্পল। স্তূপ হলো ঘণ্টার আদলের বা উল্টো করে রাখা কোন আইসক্রিম আকৃতির স্থাপনা, যার বাইরের দিক থেকে পুরোটাই স্থায়ীভাবে পাকা করে দেওয়া, ভেতরে যাওয়া যায় না। কারণ, ভেতরে কোনো মহামুনি, ঋষির দেহাবশেষ রাখা আছে। কয়েকটা ছোট মন্দিরের সামনে স্কুটি খাড়া করে ভেতরে গেলাম। ভেতরে সেই নিশ্চুপ গৌতম বুদ্ধ পদ্মাসনে বসে রয়েছেন—কোথাও আঁখি মুদিত, কোথাও আঁখি মদির। কোথাও তিনি সোনালি বসনে, কোথাও খয়েরি। প্রতিটি মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের সামনে তাজা ফুল রাখা। ভিক্ষুরা নিয়মিত খুব ভোরে আসেন, প্রার্থনা করেন, সাধারণ জনগণও আসেন।
মন্দিরে ভেতরে
এখানে দেখি একটা আফ্রিকান মেয়ে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ সঙ্গে সাইকেল বা বাইক নেই, হেঁটে এসেছে, হাঁটবে এই গরমে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে হলে তো যে কেউ এই মরুভূমির গরমের কথা শুনলে অক্কা পাবে। আমি রাইড অফার করতেই রাজি হয়ে গেল। মেয়েটির নাম কিয়া, এসেছে আমেরিকা থেকে, পেশায় ডেন্টিস্ট। ওর দাঁতগুলোও মুক্তোর মতো। আর এই মুক্তো ঝরানো মেয়ে কিনা পথে পথে ঘুরছে! পথে পথে অবশ্য আমিও ঘুরি, তবে আমি গরিব দেশের গরিব বাজেট ট্রাভেলার, গাড়ি করে ঘোরার সামর্থ্য নেই। কিন্তু এরা কেন এভাবে ঘুরবে! আসলে শখ আর কৌতূহলের কাছে সবকিছু হার মানে।
ওকে জায়গামতো নামিয়ে দিয়ে আমি চললাম থাটবাইন্যু টেম্পল, এখন অবধি বাগানের সবচেয়ে উঁচু মন্দির। পাঁচতলা করা হয়েছিল নির্মাণকালে। উপাসনালয়টি তৎকালীন বাগানের মনোরম স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। ১১৫১ সালে রাজা প্রথম সিথু এই মন্দির নির্মাণ করেন। থেরাভারা মতাবলম্বীদের জন্য নির্মিত এ মন্দিরের প্রতি তলায় চারপাশে খোলা ছাদ আছে এবং মন্দিরের গায়ে বৌদ্ধধর্ম–সংক্রান্ত বিভিন্ন ভাস্কর্য খোদাই করা ছিল। মন্দিরটি শুধু উপাসনার জন্যই ব্যবহৃত হতো তা নয়, এখানে বিশাল গ্রন্থাগার ও মঠও ছিল। বর্তমানে শুধু উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয়।
থাটবাইন্যু টেম্পল বাইরের দিকে সাদা চুনকাম করা। টিলোমিনলোর মতো ইটের বাহারি শোভা দেখাচ্ছে না। নিচতলাটা এখন ফাঁকা। বিভিন্ন চিত্রশিল্পী মনের আনন্দে বারান্দার ছায়ায় বসে ছবি আঁকছেন। আর বিক্রির জন্য ছবিগুলো ঝুলিয়ে রেখেছেন পাশে। কোনো ছবি বাগানের প্রাকৃতিক দৃশ্যের, কোনোটাবা গৌতম বুদ্ধকে বিভিন্ন আঙ্গিকে আঁকা।
থাটবাইন্যু টেম্পল
দোতলায় মন্দির। সিঁড়ির গোড়ায় জুতো খুলে রেখে ওপরে উঠতে হয়। সিঁড়িগুলোর উচ্চতা একেকটা এক ফুটের বেশি। আমার মতো লিলিপুটের হামাগুড়ি দিয়ে চড়তে হয়। দোতলায় ভেতরে উপাসনালয়। বাইরে প্রশস্ত ছাদে এখন তপ্ত রোদে কোনো মানুষ নেই। একজনমাত্র স্থানীয় নারী পূজা দিতে এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে এখানকার আরও অনেক তথ্য পেলাম। তিনতলা অবধি ওঠা যায়। এর ওপরে দর্শনার্থীদের আর উঠতে দেওয়া হয় না। প্রত্নতাত্ত্বিক ডিপার্টমেন্ট নিষেধ করে দিয়েছে। এখান থেকে সূর্যোদয় খুব ভালো দেখা যায়। কালকের প্ল্যান এখনই করে রাখলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে নিচে নামতেই দেখি আমার জুতা একটা এদিকে, আরেকটা অন্যদিকে।
মিয়ানমারে এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ, এ দেশে চুরি হয় না। উল্টো হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় একই জায়গায়, লোকজন এসে ধরে গছিয়ে দেয়। জুতো নেবে কে! পায়ে দিতে গিয়ে দেখি আশেপাশে চরে বেড়ানো কুকুর বাবাজিদের বিশেষ প্রিয় খাদ্য প্রায় হয়েই উঠেছিল আমার জুতা জোড়া। এক পাটির তো প্রায় শেষ অবস্থা।
বাইরের পাতাহীন শুকনা গাছে ট্র্যাডিশনাল উৎসবের পোশাক পরা অনেকগুলো রঙিন পাপেট ঝোলানো দেখে মন ভালো হয়ে গেল; জুতার শোক ভুলে গেলাম। মাথায় বড় মুকুট, চমৎকার স্থানীয় নাচের পোশাক পরা পাপেট দেখে একটা কিনে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটু আগে পরিচয় হওয়া এন্দেরা হা হা করে উঠল। বলল, হেরিটেজ টাউনের বাইরে তাদের গ্রাম থেকে কিনলে অর্ধেক দামে পাওয়া যাবে। আমি বললাম, দুপুরের খাবার খেতে ওদিকেই যাচ্ছি, তুমিও এসো, নামিয়ে দেব।
বাগানের অগুনতি স্তুপের মাঝে লেখক
জিজ্ঞেস করলাম, আমি না থাকলে কী করে যেতে। বলল, এখন অনেক স্থানীয় লোক মাঠে চাষ করার জন্য গরুর গাড়ি নিয়ে আসেন। তাঁদের কারও সঙ্গে চলে যেতাম।
আসলেই দেখলাম বহুদূরে একটি গরুর গাড়ি হেলেদুলে আসছে। ধান চাষের মাঠ খালি, সব ধান কাটা হয়ে গেছে।
আমাদের দেশের উচ্চারণে ওর নাম ইন্দিরা।
ইন্দিরা আর আমি চললাম বাগান টাউনের দিকে। পথে যথারীতি পড়ল অনেক স্তূপ আর উপাসনালয়। কিছুদূর গিয়ে দেখি নদীর ঘাট। এই রুক্ষ শুষ্ক জায়গায় নদী! আহা, কী আনন্দ!নদীর নাম এরাবদি। আমি এতক্ষণে উচ্চারণ ধরে ফেলেছি। তোতাপাখির মতো বলতে লাগলাম, 'ইরাবতী, ইরাবতী।' ইন্দিরা আমাকে পাগল ঠাউরেছে নিশ্চয়ই।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে মূল শহরে পৌঁছে গেলাম। ইন্দিরা আমাকে দোকান দেখিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। পাগলের সঙ্গে কে থাকে!
খুঁজেপেতে আগে বের করলাম খাবারের দোকান।
ইয়াঙ্গুনেই মিয়ানমারের খাবারের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে আমার পাকস্থলীর। তাই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। কোনার একটা টেবিল দেখে ভাত-মাছ অর্ডার করে দিলাম। আমি জানি এখনই অজস্র ছোট বাটিতে হাজির হবে কাঁচা শাকপাতা, সালাদ (যদিও আমাদের দেশে এমন সালাদ কেউ খাবে না, শুধু পাতা আর পাতা অথবা বাদাম আর শুকনা আস্ত ডালভাজা বা তিলভাজা), টি লিফ সালাদ, বিভিন্ন প্রকারের গ্রেভি বা ঝোল বা ক্লিয়ার স্যুপ আর কী কী যেন। দেখতে দেখতে টেবিল ভরে উঠবে ১৫–১৬ ধরনের সালাদ আর ঝোলে, সঙ্গে ভাত আর মাছ আসবে ভাজা বা ঝোলে গড়াগড়ি খেতে খেতে। একসঙ্গে এত পদের খাবার সামনে নিয়ে খাওয়া খুবই আনন্দদায়ক হতে পারে, তবে এই দেশে আমি শুধু ভাত আর মাছ ছাড়া পাতাবাহারি কিছুই তেমন খাই না। মাছের ঝোলে এদের নির্মিত বিখ্যাত পেস্ট থাকে, যা ফারমেন্টেড মাছ দিয়ে তৈরি করা হয়। আমার তো মনে হয় অন্য যেকোনো রান্নায় এরা এই পেস্ট ব্যবহার করে। মুরগির মাংসেও আমি একই গন্ধ পেয়েছি।
বাগানের ফালুদা
খাওয়া শেষে ফালুদা না খেলে স্বয়ং ব্রহ্মা রাগ করবেন। মিয়ানমারের অনেক কিছুই ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে, এমনকি মানুষের নামও। কে জানে কখন কোন মানুষরূপী দেবতার দেখা পেয়ে যাই। তাই ঝটপট ফালুদা খেয়ে বাজারে ছুট লাগালাম। ফালুদার স্বাদ ভারতে তৈরি ফালুদার মতোই। আইসক্রিম, সিরাপ, রাইস নুডলস, সাবুদানা, দুধ দিয়ে বানানো হয়।
বাজারে ঢুকে দিশেহারা অবস্থা। এত রঙিন সবকিছু! কোনো দোকানে বিকোচ্ছে 'ল্যাকার' বা কাঠের রঙিন শৌখিন তৈজসপত্র আর ডেকোরেশন পিস। চায়ের পাত্রে চা খাওয়া যায়। অন্যান্য পাত্রে খাবারও খাওয়া যায়। আগুনে পোড়ে না কাঠ বা বাঁশের তৈরি এসব পাত্র। আর এর ওপর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখলে অবাক হতে হয়। এত সূক্ষ্ম কাজ আগে এত সহজলভ্য পরিবেশে দেখিনি। প্রথমে পাত্রের আদল দেওয়া হয়, তারপর একবার পলিশ পড়ে। পলিশ করে এর ওপর চিকন ছুরির ফলা দিয়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়। এর ওপর আবার পলিশ পড়ে। এর ওপর পড়ে রংতুলির আঁচড়। রংতুলির আবরণ ছাড়াও এদের থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বার্নিশের ফিনিশিংয়ের পর দেখলে মনে হবে এ নির্ঘাত কোনো রাজা-মহারাজার ব্যবহার্য সামগ্রী। যেকোনো মিনিয়েচার আর্টের কাছে হার মানতে চাইবে। এত বর্ণবিভোর আর জৌলুশময়! দুই হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বংশপরম্পরায় এই সব ল্যাকার ওয়ার্ক আজও মানুষের জীবিকার অংশ হয়ে রয়ে গেছে।
কারুশিল্পের দোকানে
বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই হস্তশিল্পের কারখানা আর পসরা। এই বস্তু তো মণ কে মণ কিনে নিলেও মন ভরবে না। নিলাম হাত ভর্তি করে নিজের আর বন্ধুদের জন্য।
দারুশিল্প
বাজারের আরেক পাশে গড়ে উঠেছে কাঠের কারুশিল্প। লম্বা বড় বড় বা মাঝারি অথবা ছোট কাঠ খোদাই করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন আকারের ওয়াল হ্যাঙ্গি, বুদ্ধের মূর্তি, শোপিস ইত্যাদি। ল্যাকারের জিনিসের মতো এরাও সূক্ষ্ম কারুকাজে, অনন্য রুচিশীলতায় ভরপুর। এখন অবধি আমি কাঠের ওপর এত সূক্ষ্ম কারুকাজ অন্য কোথাও আর দেখিনি। হাত আর মেশিন—উভয় পদ্ধতিতেই কাঠ খোদাই আর নকশা চলছে। এই দারুশিল্প আমার অজানা আরেকটা বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছে। ফাইনাল টাচের পর কারুকাজকে আর এই ধরণির বলে মনে হয় না। স্বর্গীয় রূপ, ঔজ্জ্বল্য এসে ভর করে এর ওপর।
স্যান্ড পেইন্টিংয়ের নাম বাগানে আসা যেকোনো ভ্রমণার্থী শুনে থাকবেন। না শুনলেও বিভিন্ন উপাসনালয়ের সামনে বা মেঝেতে বসে চিত্রশিল্পীদের আঁকতে দেখা যায়। আমিও সবে দেখে এলাম থাটবাইন্যু টেম্পলের সামনে। বালির ওপর আঁকা হয় বলে এর নাম স্যান্ড পেইন্টিং। আর মজার ব্যাপার হলো অন্যান্য চিত্রকলার মতো ইজেলে রেখে এ ছবি আঁকা যায় না, মাটিতে রেখে উবু হয়ে বসে আঁকতে হয়। কারণ হলো, প্রথমে কাপড়ে আঠা মেখে এর ওপর বালু খুব করে গড়িয়ে নিতে হয়। আঠার সঙ্গো বালু আটকে গেলে শুকানোর পর এতে ছবি আঁকা হয়। সাধারণত শিল্পীরা বংশানুক্রমে এই শিল্পে দীক্ষা নিয়ে থাকেন। বালুর ক্যানভাসে তখন আঁকা হয় গাঢ় বা মিষ্টি কমলা রঙের টেম্পল, গৌতম বুদ্ধ, ভিক্ষু বা বাগানের প্রকৃতির ছবি। কমলা রঙের আধিক্যের কারণ রংটি ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক। কিছু চিত্রকলা আবার করা হয় সাদাকালোয় তবে সংখ্যায় নগণ্য।
স্যান্ডপেইন্টিং
এ ছাড়া বাজারে আছে বিভিন্ন আদলের পাপেট। একটা যদিও কিনেছি আগেই, তবে দেখতে দোষ নেই। এক ফুট বা এর চেয়ে একটু বড় আকারের পাপেটের কেউ পরে আছে সাধারণ পোশাক, কেউ–বা নাচের পোশাক, কেউ আবার রাজা–বাদশাহর জমকালো পোশাক। এখানে পাপেট শো হয় সন্ধ্যায়। আলাদা মঞ্চ আছে। গ্রামবাসী মাঝেমধ্যে নিজেদের জন্যও পাপেট শোর আয়োজন করেন। পরদিন কাছের একটা গ্রামে পাপেট শো আছে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য করা শোয়ের চেয়ে স্থানীয় মানুষদের করা শো বেশি আনন্দদায়ক হবে।
* লেখক: ফাতিমা জাহান