বাজার করতে গিয়ে দেখি সুইডিশ মুরগি দোকানে বিক্রি হচ্ছে, তাও আবার ইকোলজি (পরিবেশবিজ্ঞান), বিশাল ব্যাপার। ঘটনাটি জানতে হয়। দেশি মুরগি, তারপর ইকোলজি। তাহলে এত বছর কী মুরগি খেলাম! মুরগির গায়ে তার জন্ম থেকে শুরু করে কবে, কোথায়, কখন কী খেয়েছে, কী করেছে, বলতে গেলে সব লেখা। নরমাল যেসব মুরগি দোকানে সচরাচর বিক্রি হয়, তার দাম ৫০ ক্রোনার কেজি, মাইচ চিকেনের (যে মুরগিকে ভুট্টা খাওয়ানো হয়) দাম ৭০ ক্রোনার মতো কেজি। ইকোলজি এবং দেশি মুরগি দাম ১৪০ ক্রোনার কেজি।
বাংলাদেশে থাকতে দেশি এবং ইকোলজি মুরগিই খেয়েছি। ভাবলাম, ঠিক আছে দাম বেশি হলেও খেতে মজা হবে, তাই কিনতে কোনো রকম দ্বিধা করলাম না। ইদানীং শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলও ইকোলজি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে, তবে দাম অনেক বেশি। সবকিছু ন্যাচারাল পদ্ধতিতে উৎপাদন করা কোনো রকম কেমিক্যাল ছাড়া। সত্যিই খাবারের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মতো।
আজ বাজার করতে গিয়ে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। জেলে মাছ ধরেছে পুকুর, নদী, নালা বা খাল থেকে। গাভি সারা দিন ঘাস আর খড় খেয়ে দুধ দিয়েছে। সব ধরনের শাকসবজি অত্যন্ত সাধারণভাবে উৎপাদন করে হাটবাজারে বিক্রি হয়েছে। এসব খাবার যারা উৎপাদন করেছে, তারা স্কুলে যায়নি। লেখাপড়া না জানা খেটে খাওয়া কৃষক কাজ করে রোজগার করেছে এবং অন্যান্য মানুষের খাবার জোগাড় করেছে। কাউকে বিষ খাওয়ায়নি। অথচ এখন সবাই শিক্ষিত হয়ে ইকোলজি ছেড়ে ভেজাল এবং নানা ধরনের কেমিক্যালের সমন্বয়ে উৎপাদন করছে বিভিন্ন খাবার।
মানলাম উৎপাদন বাড়াতে এবং খাবার বেশি দিন তাজা রাখতে কেমিক্যালের ব্যবহার; কিন্তু আমরা কি এখন আগের মতো পাচ্ছি সেই ন্যাচারাল খাবারগুলো?
সুইডেনে কিন্তু কৃষকেরা চেষ্টা করে চলছে ন্যাচারাল খাবার বাজারে দিতে। সরকার সব সময় তাদের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আসছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার উৎপাদন করলেও কৃষক যাতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছে। সর্বোপরি কৃষকের জীবনযাত্রার মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে না।
মানবজাতির জীবনে যে জিনিসগুলো সবচেয়ে দরকারি, তা কিন্তু কৃষকদের (কৃষক বলতে ফসল উৎপাদন, শাকসবজি, ফুল ও ফলের চাষ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, দুগ্ধ খামার, মৎস্য চাষসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে) থেকে আমরা পেয়ে থাকি অথচ তাদের আমাদের সমাজে ছোট করে দেখা হয়, ভাবতেই মন বিষণ্নতায় ভরে গেল। সমাজে একজন কৃষকের মূল্য আর একজন চাকরিজীবীর জীবনের মানমর্যাদার মধ্যে গড়ে উঠেছে বিশাল পার্থক্য। পার্থক্য এতই বেশি যে সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। আর যাহোক, সুইডেনে কৃষকের জীবনকে কেউ ছোট করে দেখে না।
মানবজাতির জন্মের শুরুতে পরিশ্রমী ও মেহনতি মানুষই প্রথম সারির মর্যাদাসম্পন্ন অথচ তাদের অবজ্ঞা করে যে শিক্ষিত সমাজ আমরা গড়েছি, এটা শুধুই কুশিক্ষায় ভরপুর। একে অতি সত্বর ধ্বংস করে সুশিক্ষার বীজ বপন করতে হবে।
বর্তমানের শিক্ষিত সমাজ দায়ী পৃথিবীর নানা ধরনের সমস্যার জন্য। কারণ, শিক্ষিত হলেই হবে না, শিক্ষার প্রকৃত রূপ অর্থাৎ সুশিক্ষা অর্জন করতে হবে। পৃথিবীর গাছপালা থেকে শুরু করে জীবজন্তুর অস্তিত্বের ক্রমাগত সর্বাঙ্গীণ উন্নতির লক্ষ্য হওয়ার কথা বিজ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য। সেটা না হয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে ভয়ংকর এবং ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মূল কারণ মানবজাতি কুশিক্ষার কলুষতায় আচ্ছন্ন হয়ে বিবেকের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
শিক্ষার গুণগতমান যদি বিশ্ব কল্যাণের সর্বোত্তম সঠিক পথ নির্দেশনা দিতে না পারে, তবে সে শিক্ষা বর্জন করতে হবে। ৫০ বা ১০০ বছর আগে পাশ্চাত্যে কী ঘটেছিল, সেটা এখন বিবেচ্য বিষয় নয়, বর্তমানে কী ঘটছে, সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।
আমি সুইডেনে সুইডিশ জাতির দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত। তাদের কর্ম থেকে শুরু করে নৈতিকতার ওপর সূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছি। তাদের সমাজের, ন্যাচারের এবং জলবায়ুর ওপর উদারতা দেখে আমি মুগ্ধ। মুগ্ধ এই কারণে যে এসবের পাশাপাশি সমানতালে বিজ্ঞানের ওপরও এদের দক্ষতা রয়েছে। যেকোনো সময় তার অপব্যবহার করে খাদ্যে ভেজাল বা নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে মানুষের বারোটা বাজাতে পারে। কিন্তু সব সক্ষমতা থাকতেও তারা ইকোলজি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। বাড়িতে গাড়ি থাকতেও হেঁটে, সাইকেলে, বাসে বা ট্রেনে কর্মে যেতে চেষ্টা করছে। কৃষক বা সমাজের নীচু কাজের কর্মীকে আলাদা করে তাদের প্রতি অবিচার, অত্যাচার বা জুলুম করছে না।
আমাদের কর্মের ফল দেখতে ওপারে যাওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না, তার আগেই আমরা অনেক কিছুই দেখতে শুরু করেছি। আমরা নিজেদের প্রতি যেমন আস্থা হারিয়েছি অন্যের প্রতি অবিচার করছি, আমরা জীবে দয়া করা ছেড়েছি, আমরা সম্পূর্ণরূপে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছি। কারণ লোভ, লালসা, ঘৃণা, অহংকার আমাদের বিবেকে ঢুকে জ্ঞানহীন করে ফেলেছে।
এসব কুসংস্কার দূর করতে হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। সেটা শুরু হোক কাজের লোকের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, সমাজের মেহনতি মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা এবং নিজের নৈতিকতার পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে। এতটুকু ন্যূনতম জ্ঞান থাকা দরকার যে বিষ খেলে আমি মারা যাব তার অর্থ যদি অন্য কাউকে সেটা খাওয়াতে সাহায্য করি বা খাওয়াই, তাহলে সেও তো মারা যাবে! এটা জেনেশুনেও যদি আমরা কাজটি করি, তবে মানুষের সারি থেকে নিজের নাম মুছে দানবের সারিতে লিখে সেখানে যোগ দেওয়াই শ্রেয়। তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদটা অন্তত বোঝা যাবে। তা না হলে—ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়
বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়
মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায়
মানুষকে কী দেখে চিনবে বলো?
আমরা যে সত্যিই মানুষ, তা কীভাবে শনাক্ত করব, এটাই এখন প্রশ্ন?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন