রেস থ্রি
পরিচালনা: রেমো ডিসুজা
অভিনয়: সলমন খান, অনিল কপূর, ববি দেওল, সাকিব সালেম, জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ, ডেইজি শাহ।
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে প্রতি বছরই সলমন খানের ছবি মুক্তি পায়। এর আগের তিনটি ঈদে মুক্তি পেয়েছিল 'বজরঙ্গি ভাইজান' (২০১৫), 'সুলতান' (২০১৬), 'টিউবলাইট' (২০১৭)। এ বছর মুক্তি পেল 'রেস থ্রি'। সারা বছর ধরে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ যেমন ঈদের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তেমনই অপেক্ষা করে থাকেন সলমন খানের ছবির জন্য। কাঁটাতারের সীমানা অতিক্রম করে গ্রাম-শহরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ফুলমালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় আদরের ভাইজানকে। অর্চনা আর আজান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ফলে রেস থ্রি শুধু একটা ছবি নয়, হয়ে ওঠে একটা সেলিব্রেশন। এ রকম বৃহৎ সেলিব্রেশনকে অস্বীকার করে গম্ভীর ইন্টেলেকচুয়ালপনা দেখানোটা ঠিক সম্ভব নয়।
রেস সিরিজের আগের দু'টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন আব্বাস-মস্তান জুটি। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সইফ আলি খান। রেস থ্রি-তে এদের কেউই আর নেই। পরিচালক হিসেবে রেমো ডিসুজা আছেন। এক জন পরিচালক থাকতে হয় বলে আছেন। ছবিটা আসলে একটা আস্ত ওয়ান ম্যান শো। তিনিই গোটা ছবির শরীর। তিনি স্ক্রিনে এলে দর্শক পাগল হয়। বাকি ছবি জুড়ে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কে আছে না আছে সেটা খুব একটা ম্যাটার করে না। এ ভাবেই সলমন দু'ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের একটা ছবি একার কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেছেন। এই ছবি নিয়ে খুব একটা বেশি কিছু বলার নেই। ভাল না খারাপ সেটাও বলা ঠিক সম্ভব হচ্ছে না। আসলে ভাল খারাপের ঊর্ধ্বে। হয় আপনি একে স্বীকার করবেন নইলে সম্পূর্ণ অস্বীকার। মাঝামাঝি কিছু হতে পারে না।
ছবিতে শমশের সিংহ (অনিল কপূর) পশ্চিম এশিয়ার আল সিফা নামক একটি দ্বীপে বেআইনি অস্ত্রের কারবার চালান। তার অস্ত্র সারা বিশ্বে চোরাচালান হয়। বহু বছর আগে কোনও একটা সঙ্কটের মুখে পড়ে তিনি ভারত থেকে আল সিফায় চলে আসেন। এখানে তিনি তাঁর ছেলে সূরয (সাকিব সালেম) আর মেয়ে সঞ্জনাকে (ডেইজি শাহ) নিয়ে থাকেন। ছবিতে অনেক দিন পর ববি দেওল অভিনয় করেছেন। তিনি এই পরিবারের বডিগার্ড। ছবিতে গ্ল্যামার ছড়ানোর জন্য আছেন জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ। আর আছেন শমশেরের অবৈধ সন্তান সিকন্দর। সিকন্দর হল অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আর এক নাম। নামের অর্থ হল শক্তিবলে শত্রুকে পরাজিত করা। এই রোল সলমন খানের থেকে বেটার আর কে-ই বা করতে পারেন। রেস সিরিজের ছবিগুলির বিশেষত্ব হল ষড়যন্ত্র। সোজা চোখে যাকে যা মনে হচ্ছে আসলে সে তা নয়। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন মুখ। কে কখন কী ভাবে কী ষড়যন্ত্র করছে সেই মিস্ট্রি আনফোল্ড হতে হতেই ছবি শেষ হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
'রেস থ্রি' ছবির একটি দৃশ্য।
ছবিতে অ্যাকশন দৃশ্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছবিতে অ্যাকশন ডিরেক্ট করেছেন টম স্ট্রুথার্স। যিনি এর আগে ক্রিস্টোফার নোলানের দ্য ডার্ক নাইট, ইনসেপশন ও ডানক্রিক ছবিগুলিতে কাজ করেছেন। বুঝতেই পারছেন যে, লেভেলই আলাদা। ছবিতে সলমন খানকে দিয়ে যা যা করানো সম্ভব সেগুলোর সবই করানো হয়েছে। কোথাও এতটুকুও ফাঁক রাখা হয়নি। তিনি আকাশে উড়ে স্টান্ট করেছেন, বাইকে স্টান্ট করেছেন, বন্দুক নিয়ে করেছেন, খালি হাতে করেছেন। এমনকি, তিনি যখন কিছু করছেন না, এমনিই স্বাভাবিক সংলাপ বলছেন তখনও দর্শক ভাবছে নিশ্চয়ই তিনি কিছু একটা করছেন। এ রকমই তাঁর ক্যারিশমা। ছবির শেষের দিকে একটি অ্যাকশন দৃশ্যে সলমনের জামায় আগুন লেগে যায়। আর তার পরেই আসে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য যেখানে তিনি তাঁর জামা খুলে ফেলেন। বিশ্বাস করুন গোটা হল কেঁপে ওঠে। মনে হয় না, এটা একটা সিনেমা হল। মনে হয়, কোনও একটা বিশাল ময়দানে একটা জাতি বরণ করে নিচ্ছে তাদের আদরের নায়ককে। নায়কের বয়েস হয়েছে। মুখে তার ছাপ পড়েছে। স্বাভাবিক কারণেই শরীর আর আগের মতো নেই। ঈষৎ ঝুলে পরেছে। কিন্তু তাতে কী? কথায় আছে না যে 'বাঘ বুড়ো হতে পারে কিন্তু শিকার করতে ভোলে না'!
সলমন খানের ছবি সম্পর্কে বলা হয়, এই ছবি দেখতে এলে মাথাটা বাড়িতে রেখে আসতে হয়। কারণ ছবিতে অনেক ক্ষেত্রেই কোনও লজিক থাকে না। গাছ তো অনেক ছোট জিনিস, গল্পের গরু এভারেস্টে পর্যন্ত উঠে যায়। কথাটায় সত্যতা আছে। কিন্তু এটাই একমাত্র সত্য নয়। আর একটা সত্য আমাদের মনে রাখতে হবে, এ রকম অ্যাকশন স্টান্ট ছবির ঘরানা ভারতীয় সিনেমার আদি থেকে চলে আসছে। অতীতের ফিয়ারলেস নাদিয়ার হাত ধরে যে ঘরানা শুরু হয়েছিল বর্তমানের সলমন খান সেই ঐতিহ্যের বংশধর। এই ধরনের ছবি চলে আসছে, কারণ এর সামাজিক প্রয়োজন আছে। এই ছবির একটা বড় সংখ্যক দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রায় কোনও দরজা খোলা নেই। খোলা নেই কোনও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা। বিভিন্ন না পাওয়ার বেদনা থেকে মুক্তি পেতে তারা প্রেক্ষাগৃহে যায় তাদের আদরের ভাইজানের ছবি দেখতে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের চার দেওয়ালের মাঝে দু'-তিন ঘণ্টার জন্য ভুলে যায় তাদের জীবনের অনেক যন্ত্রণা। লার্জার দ্যান লাইফ হিরো সলমন খানকে দেখে তার জায়গায় তারা নিজেদের কল্পনা করে ক্ষণিকের শান্তি পায়। ফলে এই ছবি থেকে লজিক্যাল রিয়ালিজম আশা করাটা ঠিক নয়। এই ছবি সহজ-সরল। অনেক প্রিটেনশাস (ভণ্ড, দাম্ভিক) ছবির থেকে সৎ। এই ছবি কোনও মহান কৃতিত্ব বা গুরুত্বের দাবি করে না। দর্শকদের নির্মল আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এর জন্ম। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির প্রচুর মানুষ আছেন, বিশেষ করে মহিলা আছেন, যাঁরা সলমন খানের ফ্যান। তাঁর প্রেমে পাগল। বহুদিন ধরে তার পেশীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। এই প্রেমেরও যথেষ্ট মানবিক মূল্য আছে।
ছবিতে একটা দৃশ্য আছে যেখানে সলমনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে তাঁকে শেষ করে দেওয়ার জন্য। সেখানে তিনি একটা ডায়ালগ দেন, "জিস রেস সে মুঝে নিকালনে কি বাত কর রহি হ্যাঁয় ইয়ে বেওকুফ...ওহ নেহি জানতে উস রেস কা সিকন্দর হুঁ ম্যায়।" তিনি তাঁর মতো করে দর্শকের হৃদয়ে আছেন। আরও বহু দিন থাকবেন।