সোবহান সাহেব (ছদ্মনাম) ঢাকার অদূরে গাজীপুরে পরিবার নিয়ে বাস করেন। সুবিধামতো জায়গায় বাড়ি থাকায় তিনি মোটামুটি খুশি। ঢাকা থেকে কাছে, সেইসাথে চারপাশের পরিবেশও সুন্দর। একদিন হঠাৎ তার বাড়ির চারপাশের জায়গা বড় একটি ব্যবসায়িক গ্রুপ তাদের বিলাসবহুল রিসোর্ট বানানোর জন্য কিনতে থাকে। সোবহান সাহেবকেও প্রস্তাব দেয় তার জমি বিক্রি করার জন্য। জমির জন্য ভালো দামও দিতে রাজি হয়।
কিন্তু ইচ্ছা করলেই সোবহান সাহেবের পক্ষে বাড়ি বিক্রি করে নতুন জায়গায় চলে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তার অন্য কোথাও এরকম জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, আর পেলেও সে জায়গা কেউ বিক্রি করবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া তার অনেক কষ্টে গড়া বাড়ি। নতুন বাড়ি করতে অনেক সময় আর কষ্টের ব্যাপার। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এই জমিতে তার পূর্বপুরুষের কবর রয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি এই জমি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকে না। সেই বড় ব্যবসায়িক গ্রুপটি সোবহান সাহেবের বাড়ির চারপাশের সব জায়গা কিনে নেওয়ার পর তার চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ, গ্যাস,পানির লাইন সবই! সোবহান সাহেব নিরুপায় হয়ে পড়েন। এমন দুর্দশা থেকে বাঁচতে অবশেষে তিনি বাধ্য হন তার জমি সেই ব্যবসায়িক গ্রুপকেই দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু সেই ব্যবসায়িক গ্রুপ আর তাকে পাত্তা দেয় না। আগে তারা ভালো দাম দিতে চাইলেও এখন তারা সেই দাম দিতে রাজি নয়, কারণ সোবহান সাহেব আগে রাজি হননি। আর তারাও জানে যে এখন সোবহান সাহেবের পক্ষে জমি না দিয়ে উপায় নেই।
সোবহান সাহেব না পারেন কারো কাছে অভিযোগ জানাতে, না পারেন আইনের আশ্রয় নিতে। অবশেষে সেই ব্যবসায়িক গ্রুপের বড় কর্তার হাত-পা ধরে আগের মূল্যেই নিজের জমি তুলে দিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন তিনি।
রাস্তার মাঝে একটি আলোচিত নেইল হাউজের সামনে তার মালিক লু বাউজেন
শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায়ই এমন ঘটনা অহরহ ঘটে। নগরায়নের প্রভাবে বাড়ছে এমন ঘটনার সংখ্যাও। মাঝে মধ্যে এমন অনেক ঘটনার পরেও কিছু বাড়ি বা জমির মালিক অটল থাকার চেষ্টা করেন নিজের জায়গায়। কেউ হয়তো সবকিছুর বিপক্ষে কিছুদিন টিকেও থাকেন এবং তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করেই ছাড়েন। নিজের অবস্থানে অটল থাকা এমন বাড়ি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চীনে। চীনের আলোচিত এমন কিছু বাড়ি নিয়ে আজকের এই লেখা।
চীনা ভাষায় এই বাড়িগুলোকে ডাকা হয় ডিংজিহু নামে, আর ইংরেজিতে 'নেইল হাউজ'। এগুলোকে নেইজ হাউস বা 'পেরেকবাড়ি' ডাকার কারণ হচ্ছে পুরনো কাঠের মধ্যে বাঁকানো পেরেক যেমন সহজে তোলা যায় না কিংবা হাতুড়ি দিয়ে চূর্ণ করা যায় না, নেইল হাউজগুলোকেও তেমনি মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ করা সহজ হয় না। চীনের নেইল হাউজগুলো বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় ২০০৮ সালে। বেইজিংয়ে অলিম্পিক গেমস চলাকালে বিদেশী সাংবাদিকদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই বাড়িগুলো।
চীনের হুবেউ প্রদেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্পে নেইল হাউজ
নেইল হাউজগুলোর ইতিহাস সাধারণত একইরকম। কোনো সড়ক কিংবা বড় স্থাপনা নির্মাণের সময় সরকার কিংবা মালিকপক্ষের কাছে অত্যন্ত ছোট আয়তনের কোনো বাড়ি বা জমির মালিকের জমি প্রদান না করার ফলে এই বাড়িগুলোর সৃষ্টি। তবে চীনে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও জমির মালিকদের এরকম বেঁকে বসা সম্ভব হচ্ছে সাম্প্রতিককালে চীনের ভূমি সম্পর্কিত আইন সংশোধনের জন্য।
চীনে আগে সরকার জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জমির মালিকদের সে জমির প্রতি কোনো আইনগত অধিকার ছিল না। কিন্তু ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ভূমি সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন আনা হয়। ২০০৭ সালের আইনে বলা হয়, সরকার ইচ্ছা করলেই কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে না, যদি না সেখানে জনস্বার্থের কোনো বিষয় থাকে।
সমঝোতার পর ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে একটি নেইল হাউজ
আইন পরিবর্তনের ফলে নেইল হাউসের মালিকদের যদিও আইনগত ভিত্তি দৃঢ় হয়, তবে আইনের ফাঁকফোকরও কম নেই। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো শপিং মল নির্মাণের জন্য জমি চাওয়া হয়, তাহলেও এটা প্রমাণ করা যায় যে শপিং মলটি জনস্বার্থেই ব্যবহার করা হবে! এছাড়াও এই ছোট বাড়িগুলো সাধারণত বেশিদিন টিকে থাকে না কিংবা থাকতে পারে না, কারণ তাদেরকে একটি বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হয় কিংবা চারপাশের পরিস্থিতির জন্যই তাদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়। আসুন জেনে আসি আলোচিত কিছু নেইল হাউজের ঘটনা।