একত্রিংশ পর্ব
দারোগা শব্দটার দুই-তৃতীয়াংশ রোগা হলেও, সাধারনত শান্তিরক্ষকরা মোটাই হয়ে থাকেন। তাদের ভুঁড়িটা তাদের বাকি শরীরের থেকে ফুটখানেক এগিয়ে থাকে। মধ্যপ্রদেশের এত উন্নতির জন্য, প্রায়শঃই তাদের কর্মদক্ষতার অবনতি ঘটে। কিন্তু এই শাষকের জমানায় তাতে কিছুই আসে যায় না; কারণ কর্মদক্ষতা নয়, শাষক দলের প্রতি নিশঃর্ত আনুগত্যই এই জমানায়, সরকারী চাকুরেদের পারফর্ম্যান্সের মূল মাপকাঠি। সরকারী কর্মচারীর পদোন্নতি থেকে বদলি সবই নির্ভর করে শাষক দলের সঙ্গে সে কতোটা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে, তার উপর। যে সামান্য কয়েকজন কর্মচারী সরকারী দলের অঙ্গুলিহেলনে না চলে, স্বাধীনভাবে নিজের দায়িত্বপালন করতে চান, তাদের না জোটে পদোন্নতি, না জোটে বাড়ীর কাছে মালাইদার পোস্টিং। মাধবপুর থানার ওসি ওহিদুল ইসলাম এই দ্বিতীয় গোত্রের লোক।
তার বাড়ী মুর্শিদাবাদে; বাড়ীর কাছে সীমান্ত লাগোয়া একটি থানায় পোস্টিং থাকাকালীন পার্টির স্থানীয় এক শীর্ষনেতার শালাকে, সীমান্ত পার করে গরুপাচারের অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার করেন। লোকটিকে নিয়ে থানায় পৌঁছানো মাত্র তার কাছে ফোন চলে আসে; তার জেলার এস পি এবং পার্টির জেলা সম্পাদকের কাছ থেকে; নেতার শালার নাম যেন এফআইআরে নথিভূক্ত না করা হয় এবং তাকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়। ওহিদুল ফোন নামিয়ে রেখে নেতার শালার নাম এফআইআরে লেখেন এবং গুপ্তকুঠুরিতে নিয়ে থার্ড ডিগ্রী দিয়ে তার কাছ থেকে লিখিত অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে শাষকদলের মদতপুষ্ট কিছু স্মাগলার। বিক্ষোভ ক্রমশঃ চরমে ওঠে, ওহিদুলের কাটামুন্ডু দাবী করা হয় এবং থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। একটু পরেই জেলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স এসে তাকে রক্ষা করে এবং তাকে এসপি’র দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই তাকে বদলী করে দেওয়া হয় সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে।
সুন্দরবনে প্রথম কিছুদিন ভালই চলছিলো। এখানে বড়োসড়ো কোনো অপরাধ নেই। চুরিচামারি, ছোটখাটো ডাকাতি, জমি নিয়ে শরিকি বিবাদ, এইসব খুচরো ব্যাপারে জড়িয়ে পার্টি হাত গন্ধ করতো না। ওহিদুল সাহেবও স্বাধীনভাবে ডিউটি করছিলেন। গন্ডগোল বাঁধলো, যখন তিনি শাষকদলের স্থানীয় এক পঞ্চায়েত উপ-প্রধানের ছেলেকে, একটি গরীবঘরের মেয়েকে বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লাগাতার ধর্ষণ করার অপরাধে গ্রেপ্তার করলেন। ডিপার্টমেন্টের উর্ধতন অফিসার এবং পার্টির সর্বোচ্চ জেলা নেতৃত্বের বারংবার নির্দেশ, হুমকি, অনুরোধে সত্ত্বেও যখন ওহিদুল কর্ণপাত করলেন না, জেলার এসপি সাহেব আর কোনো রিস্ক নিলেন না। পার্টির নির্দেশেই তাকে কমপালসারি ওয়েটিঙে পাঠানো হলো।
প্রায় দেড় বছর ঘরে বসে মাইনে পেয়ে যখন অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলেন ওহিদুল, খবর পেলেন যে সব নেতার নিকটাত্মীয়দের ধরেছিলেন, তাদের সবাই সাক্ষী এবং প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছে। সেইসব কেস যে সকল অফিসার তদন্ত করেছিলেন, তাদের পদোন্নতি অথবা বাড়ীর কাছে মালাইদার পোস্টিং হয়। ওহিদুল বুঝতে পারলেন জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না। অবশেষে তিনি এক বন্ধুর সাহায্যে নিজের জেলা মুর্শিদাবাদের, এক বিরোধী দলের নেতাকে গিয়ে ধরলেন। বিরোধী দলের হলেও শাষক দলের সঙ্গে ভালই সখ্যতা আছে তার। শুধু তারই নয়, বিরোধী দলের অনেক নেতাই শাষক দলের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখে চলতেন, এটা সমর্থকরা বুঝতে পারে না। নীচুতলার সমর্থকদের মধ্যেই মারামারি-কাটাকাটি হয়, নেতাদের মধ্যে কিন্তু গলাগলির সম্পর্কই থাকে। যাই হোক, সেই নেতাকে ধরে, একরকম মুচলেকা দিয়ে, অবশেষে ওহিদুল পোস্টিং পেলেন; নিজের জেলায় নয়, কলকাতা শহরতলীর মাধবপুর থানায়।
শিক্ষিত মধ্যবিও এলাকা, পকেটমারি, ছিনতাই, ইভ-টিজিঙের মতো পেটি কেস ছাড়া কিছুই নেই। এলাকায় একটি এলিট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেখানে ড্রাগ পেডেলিং হয়; এছাড়া কয়েকটি বস্তি এলাকায় অবৈধ চোলাই-বাংলা মদের ঠেক এবং সাট্টার ঠেক আছে। ড্রাগ পেডেলিং-এর সঙ্গে জড়িত আছে অনেক রাঘব-বোয়াল এবং চোলাই-বাংলা এবং সাট্টার ঠেক থেকে পুলিশ-পার্টি-লোকাল ক্লাবগুলো প্রসাদ পায়, তাই জয়েনিং-এর সময়ই ওহিদুলকে স্ট্রিক্টলি বারণ করে দেওয়া হয়ছিলো, ওই ব্যাপারে না চুলকাতে, না হলে বড়ো ঘা হয়ে যাবে। সে চোখ বুঁজে থাকতো। ঠেকগুলো থেকে যা আমদানি হয়, তার অধঃস্তন কর্মচারীরা ভাগাভাগি করে নেয়, সে নিজে ছুঁয়েও দেখে না। তারা ওহিদুলকে পেছনে গান্ডু বলে ডাকে। চরম হতাশচোদা অবস্থায় ওহিদুল চাকরি ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করলেন।
এই রকম সময়ে এলাকার মুকুটহীন সম্রাট লাল্টু চৌধুরির ফোন পেয়ে খুবই অবাক হলেন ওহিদুল। লালটু তাকে জানালেন একদল উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির লোক মত্ত অবস্থায় ইউনিভার্সিটির একজন স্বনামধন্য প্রফেসরের বাড়ীতে চড়াও হয়ে লুঠতরাজ চালাচ্ছে। এর পিছনে রাষ্ট্রবিরোধী অতিবাম একটি গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদত আছে। ডান-বাম- অতিবাম কোনো রাজনীতিই ওহিদুল বোঝে না। কিন্তু সে এটুকু বুঝলো এক বৃদ্ধ শিক্ষিত ভদ্রলোক আক্রান্ত, তাকে বাঁচাতে হবে। এটাই একজন পুলিশ অফিসার হিসাবে তার কর্তব্য। এক বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিলেন। যেতে যেতে তিনি ভাবছিলেন, পার্টির লোকাল কমিটির নেতা কেনো তাকে সরাসরি ফোন করলেন? সাধারনত এনারা তার মতো ছোটখাটো অফিসারকে পাত্তাই দেন না। তাহলে কি …………..