What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (2 Viewers)

ইমাম আব্দুল আযীয ছিলেন এক আকর্ষণীয় প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। পিতার মত তিনিও ছিলেন দ্বীনদার এবং আলেম হিসাবে সুপ্রসিদ্ধ। এক ক্ষুদ্র গোত্রপতি হিসাবে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, স্বীয় নেতৃত্বগুণে একসময় তিনিই সমগ্র আরবের এক প্রতাপশালী অধিপতিতে পরিণত হন। (আমীন আর-রায়হানী, তারিখু নজদ আল-হাদীছ ওয়া মুলহাকাতুহু (বৈরূত : আল-মাতবা‘আহ আল-ইলমিয়াহ, ১ম প্রকাশ : ১৯২৮), পৃঃ ৫৫।) শুধু তাই নয় দীর্ঘ প্রায় ৩৯ বছরের শাসনামলে তিনি আরবের বুকে এমন এক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, যা ছিল পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর উপর সুদৃঢ়ভাবে ভিত্তিশীল। খুলাফায়ে রাশেদার পর এমন ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসনব্যবস্থা আর কখনো পরিদৃষ্ট হয়নি। তিনি কেবল আপোষহীন রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না; বরং শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিবিড় সাহচর্যে তিনি পরিণত হয়েছিলেন তাওহীদ ও সুন্নাতের একজন প্রজ্ঞাবান দাঈ ইলাল্লাহ। তাই যখনই কোন নতুন অঞ্চল বিজিত হ’ত তাঁর প্রথম কাজ ছিল সেখানে মুবাল্লিগ এবং দাঈ প্রেরণ করা। তাঁর অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার বরকতে শিরক ও বিদ‘আতের আস্তাকুড়ে পরিণত হওয়া সমগ্র আরব আবারও তাওহীদের আলোকচ্ছটায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে। (ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৬ পৃঃ; হায়কাল, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫।) তাঁর সমসাময়িক ইমাম শাওকানী তাই তাঁর প্রশংসায় লিখেছেন, প্রায় সমগ্র হেজাযের অধিবাসী ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করল এবং শরী‘আতের নির্দেশাবলী পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এমন এক সময়ে এটা ঘটেছিল যখন তারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানত না কেবল বক্র উচ্চারণে কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করা ব্যতীত। এই চরম জাহেলিয়াতের মধ্য থেকেই উঠে এসে তারা সময়মত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতসহ ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান যথার্থভাবে পালনকারীতে পরিণত হল’। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২।)ফালিল্লাহিল হামদ
 
সঊদ বিন আব্দুল আযীয (১৮০৩-১৯১৪ খৃঃ) :
ইমাম আব্দুল আযীযের মৃত্যুর পর জেষ্ঠ্য পুত্র সঊদ বিন আব্দুল আযীয তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি ছিলেন পিতার চেয়েও অধিক চৌকস ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পিতার পদাংক অনুসরণ করে দ্রুতগতিতে তিনি নতুন নতুন রাজ্য দখল করতে লাগলেন এবং দাওয়াতের ময়দান বিস্তৃত করে চললেন। বাহরাইন, আম্মান ও রা’স আল- খাইমাহ জয় করার পর তিনি বছরা দখল করে নেন এবং যথারীতি সেখানকার শিরকী আস্তানাসমূহ সমূলে উচ্ছেদ করেন। (ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/ ২৬৯ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৩।) অতঃপর সবদিক থেকে নিরাপদ হয়ে তিনি আবারো হেজাযের কেন্দ্রভূমি মক্কা-মদীনার দিকে নযর দিলেন এবং ১৮০৫ সালে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে প্রথমে মদীনা দখল করলেন। অতঃপর মদীনার যাবতীয় কবর-মাযার ধূলিসাৎ করে সেখান থেকে শিরক ও বিদ‘আতী আমল-আক্বীদা উৎখাত করেন। (ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৮৮ পৃঃ; প্রাচ্যবিদ ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে, এসময় রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের উপর থেকে সবুজ গম্বুজটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। তবে এ ঘটনা সত্য নয়। দ্রঃ মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৪।) মদীনা বিজয়ের পর সঊদী বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রযাত্রা করলে শরীফ গালিব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পূর্বেই ইমাম সঊদের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত; পৃঃ ১১৪; আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।) অতঃপর ১৮১১ সালের মধ্যে ওয়াহ্হাবী সাম্রাজ্য দক্ষিণে আলেপ্পো থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এবং পূর্বে পারস্য উপসাগর থেকে ইরাকের সীমান্ত হয়ে পশ্চিমে লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। (সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) পৃঃ ৩০৫; Philip K. Hitti, History of Arabs (London : Macmillan Press Ltd, 16th Edition: 1994) p. 741.)
 
অবশেষে শংকিত ওছমানীয় সুলতান আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করলেন না। তিনি যেকোন মূল্যে ওয়াহ্হাবীদের দমন করার জন্য তৎকালীন তুর্কী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক মিসরের খেদিভ মুহাম্মাদ আলী পাশাকে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে মুহাম্মাদ আলী পাশা রণপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন এবং তাঁর পুত্র তুসুনের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী হেজাযের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। প্রথমে তুসুন ওয়াহ্হাবীদের সাথে কয়েকটি মোকাবিলায় পরাজিত হলেও ১৮১২ সালে দুই মাস যাবৎ অবরোধ রাখার পর মদীনা দখল করতে সক্ষম হন। পরের বছর মিসরীয়রা একইভাবে মক্কাও দখল করে নেয়। হেজায মিসরীয় দখলে চলে গেলেও আরবের বাকী অংশে ওয়াহ্হাবীদের আধিপত্য অটুট ছিল। মিসরীয়রা বিভিন্নস্থানে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হলেও বার বার পরাজয়ের শিকার হয়। অবশেষে স্বয়ং মুহাম্মাদ আলী পাশা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য হেজাযে আগমন করেন এবং প্রথম যুদ্ধেই গুরুতর পরাজয় বরণ করেন। (ইসলামী বিশ্বকোষ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৫; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৭; আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে, ১৮১৪ সালে তারাবা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যেসব যুদ্ধ হয়, তাতে ওয়াহ্হাবীদের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন ‘গালিয়া আল-বাক্বমিয়াহ’ নাম্মী এক বিধবা ধনী মহিলা। বুদ্ধিমত্তা ও প্রখর ব্যক্তিত্বের কারণে কার্যত তিনিই ছিলেন তারাবার শাসক। ওয়াহ্হাবীদেরকে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ ও যোদ্ধা সরবরাহ করে অকুন্ঠ সহযোগিতা করেছিলেন। তারাবার পরাজয়ের পর মুছত্বফা বেক-এর নেতৃত্বাধীন তুর্কী সৈনিকরা যুদ্ধে গালিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাঁকেই সম্মিলিত ওয়াহ্হাবী বাহিনীর নেতৃত্ব দানকারিনী হিসাবে ধারণা করেছিল (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.371)।)
মিসরীয়দের বিরুদ্ধে সঊদী বাহিনী নতুনভাবে যখন একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছিল, ঠিক তখনই ১৮১৪ সালের ১লা মে ইমাম সঊদ বিন আব্দুল আযীয মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সঊদীদের মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়ে। ফলে মিসরীয় বাহিনীর জন্য সমগ্র আরব দখলের পথ সহজ হয়ে গেল। (ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৩৬৪ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯।)নেতৃত্বগুণে ও মহানুভবতায় ইমাম সঊদ ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা ও যুদ্ধের ময়দানে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর নৈতিকতা ও উদারচিত্ততা ঐতিহাসিকদের অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর শাসনামলেই হেজায সহ সমগ্র আরব উপদ্বীপ ওয়াহ্হাবীদের পূর্ণ অধিকারে চলে আসে। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১২৮-১৩০ পৃঃ; আমীন আর রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৬২ পৃঃ; John Lewis Burchhardt, Ibid, P.382. )
 
আব্দুল্লাহ বিন সঊদ (১৮১৪-১৮১৮ খৃঃ):
ইমাম সঊদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পিতার মতই সাহসী ও রণকুশলী হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.288. ) মিসরীয়দের সাথে ত্বায়েফের এক বিরাট যুদ্ধে তাঁর ভুল রণকৌশলের কারণে সঊদী বাহিনী চরমভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং প্রায় ৫ হাযার সৈন্য মিসরী বাহিনীর হাতে নিহত হয় এবং ৩ হাযার সৈন্য গ্রেফতার হয়। এতে ওয়াহ্হাবীদের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.398; বারখার্ট উক্ত যুদ্ধে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আলী পাশার কৌশলে ওয়াহ্হাবীরা উন্মুক্ত ময়দানে নেমে এসে ফাঁদে আটকা পড়ে এবং চারিদিকে ঘেরাও হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুহাম্মাদ আলী ঘোষণা দেন যে, প্রত্যেক ওয়াহ্হাবীর মাথার মূল্য ৬ ডলার। ফলে মিসরীয় সৈন্যরা পাইকারী হারে ওয়াহ্হাবীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রায় ৫ হাযার লাশের স্তুপ জমে গেল যুদ্ধের ময়দানে, যাদেরকে টুকরো টুকরো করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরে বন্দীদের মক্কায় নেয়ার পর অধিকাংশকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।)
 
এ যুদ্ধে মুহাম্মাদ আলী পাশা স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি তুসূনকে রেখে সাময়িকভাবে মিসরে যান। ইতিমধ্যে তুসূন আল-কাছীমে শিবির গড়ে নজদ আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিলে ইমাম আব্দুল্লাহ সেখানে তাদেরকে অবরোধ করতে সমর্থ হন। দুই মাস যাবৎ অবরোধের পর উভয় পক্ষ সন্ধিতে রাযী হয়। ইমাম আব্দুল্লাহ প্রতিকূল পরিবেশ বিবেচনা করে মিসরীয়দের সাথে সন্ধি করাকেই নিরাপদ মনে করলেন। (ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৩৭৮ পৃঃ; তবে ঐতিহাসিকদের মতে, তাঁর এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কেননা তার সামনে ছিল দু’মাসের অবরোধে দুর্বল হয়ে পড়া মিসরীয়দের আরবের মাটি থেকে উচ্ছেদ করার সূবর্ণ সুযোগ। কিন্তু এ সুযোগ কাজে না লাগিয়ে নিজেকে তিনি নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলেন। দ্রঃমাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৪।) ১৮১৫ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির শর্ত নির্ধারিত হল যে, ইমাম আব্দুল্লাহ তুর্কী সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিবেন এবং সেনাপতি তূসূন মিসরীয়দের নিয়ে নজদ ভূমি ছেড়ে যাবেন। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩।) কিন্তু খেদিভ মুহাম্মাদ আলী পাশা এই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পরের বছর তাঁর ২য় পুত্র ইবরাহীম পাশার নেতৃত্বে আরব ভূখন্ডে এক অভিযান প্রেরণ করেন। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.419.) ইবরাহীম পাশা কতিপয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৮১৮ সালে ওয়াহ্হাবীদের রাজধানী দিরঈইয়া নগরী অবরোধ করেন। দীর্ঘ ৬ মাসের টানা অবরোধে অবশেষে ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে ইমাম আব্দুল্লাহ বিন সঊদ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। অতঃপর তাঁকে তুর্কী খেলাফতের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নেওয়া হয় এবং ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। (ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৪২২ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪১।)
 
এভাবেই ১ম সঊদী রাষ্ট্র কিংবা ঐতিহাসিক ফিলবীর ভাষায় ‘১ম ওয়াহ্হাবী সাম্রাজ্য’-এর করুণ অবসান ঘটল। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।) উন্মত্ত মিসরীয় বাহিনী এ সময় সঊদ বংশের আরো ২১জনকে হত্যা করে। এছাড়া মুহাম্মাদ বিন আব্দুলওয়াহ্হাবের বংশধরদের বেশ কয়েকজন সহ বহুসংখ্যক আলেম-ওলামা ও কাযীগণ নিহত হন। অবশিষ্টদেরকে মিসর ও ইস্তাম্বুলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।) দিরঈইয়ার পতনের পর মুহাম্মাদ আলী পাশা সেখানে ৯ মাস অবস্থান করেন এবং শহরের সমস্ত অধিবাসীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে সরকারী প্রাসাদ-দূর্গ, বাড়ী-ঘর, গাছ-পালা একে একে সমূলে ধ্বংস করে ফেলেন। সমস্ত শহরকে এমনই ভাবে বিরান করে ফেলা হয় যেন সেখানে ইতিপূর্বে কোন জনবসতিই ছিল না। (ইবনু বিশর, প্রাগুক্ত, ১/৪৩৪ পৃঃ; মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১৪৫ পৃঃ; আমীন আর-রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৭৬ পৃঃ।) পৌনে এক শতাব্দীকাল ব্যাপী যে নগরী আরব যমীনে তথা সারাবিশ্বের বুকে অভূতপূর্ব এক দ্বীনী জাগরণের পাদপীঠ হিসাবে তাওহীদী নিশান বহন করছিল, একনিমিষেই তা জনমানবহীন এক ঊষর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হল। অপমৃত্যু ঘটল শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের হাতে গড়া ‘মানহাজুন নবুওয়াত’ এবং তাওহীদ ও সুন্নাতের জ্বলন্ত স্বাক্ষর এই পবিত্র সাম্রাজ্যের। ভোজবাজির মত হারিয়ে যাওয়া প্রতাপশালী এ রাষ্ট্রের কথা স্মরণ করতে যেয়ে তাই ১৮৮০ সালে ঐতিহাসিক ব্লেন্ট লিখেছিলেন, ‘আরবের বুকে সঊদী রাষ্ট্র আজ কেবল অতীত কেচ্ছা মাত্র।’ (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১৪৮ পৃঃ।) অনুরূপভাবে ১৮৭৫ সালে ডাউটি নজদ বাসীদের উদ্ধৃতিদিয়ে বলেন, তাদের সকলেরই কমপক্ষে এই মত ছিল যে, এই ওয়াহ্হাবী রাষ্ট্রের নতুন করে জেগে উঠার আর কোন সম্ভাবনা নেই। (প্রাগুক্ত, ১৪৯ পৃঃ।) তবে আলহামদুলিল্লাহ শত্রুদের এই লোমহর্ষক নৃশংসতার পরও ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের সুপ্ত কোন বীজ থেকে আবারো পুনর্জন্ম নিয়েছিল সঊদী আরব রাষ্ট্র। ফলে দিরঈইয়া ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেও পার্শ্ববর্তী রিয়াযেই আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উত্তর পুরুষদের নতুন রাজধানী।
১ম সঊদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য :
মানহাজুন নবুওয়াতের আদলে গড়ে উঠা এই রাষ্ট্রটির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হল।
 
(১) রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা :
ইসলামী আক্বীদার পরিশুদ্ধি এবং তাওহীদ ও সুন্নাহর বিজয় সাধনের প্রতিজ্ঞা থেকেই জন্ম হয় ১ম সঊদী আরব রাষ্ট্রের। এ রাষ্ট্রের প্রধানকে ‘ইমাম’ বলা হ’ত এবং তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.293. ) তিনি যেমন ছিলেন ধর্মীয় নেতা, তেমনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও। ফলে ন্যায় ও ইনছাফের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং ইমামের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এই রাষ্ট্রে ইসলামী শরীআ‘ত ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণবিকাশ সাধিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হ’ত ইসলামী শরীআ‘তের পুংখানুপুংখ অনুসরণের ভিত্তিতে। যার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন পর্যটক বারখার্ট তাঁর গ্রন্থে। (Ibid, P.278-83. ) প্রাদেশিক শাসকদেরকে কেন্দ্রীয় ইমামই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দান করতেন। তাদের আক্বীদা ও আমলের দৃঢ়তার প্রতি বিশেষ নযর রাখা হ’ত। এছাড়া সর্বস্তরে বিশেষ শূরা বা পরামর্শ কমিটি ও সাধারণ পরামর্শ কমিটি নামক দু’টি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী আঞ্জাম দেয়া হ’ত। (আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।) এছাড়া ওয়াহ্হাবী ইমামদের চাল-চলন ও ব্যক্তিগতজীবন সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় বারখার্টের বর্ণনায় তাতে তাঁদের সহজ-সরল ইসলামী জীবনযাপনের চমৎকার পরিচয় ফুটে উঠে। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 287-293. )
 
(২) সামরিক নীতি :
যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ইসলামী নীতিমালা অনুসৃত হ’ত এবং গণীমতের মালকে নিয়মমাফিক ৫ ভাগে ভাগ করা হ’ত। সাধারণত বাদ ফজর তাকবীরের মাধ্যমে সেনাদলের যুদ্ধযাত্রা শুরু করা হত এবং বিজিত অঞ্চলে আত্মসমর্পণকারী স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতি ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী ন্যায় ও ইনছাফের আচরণ করা হত। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.319. ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৭৭ পৃঃ।) বিজিত অঞ্চলে ওয়াহ্হাবীদের প্রথম কাজ ছিল শিরক ও বিদ‘আতের আখড়াগুলো ধ্বংস করে দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ও ইসলামী আইন কার্যকর করার জন্য ক্বাযী ও মুফতী নিয়োগ করা। (Ibid, P. 280-281; আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ।)
 
(৩) সামাজিক অবস্থা :
ইমাম আব্দুল আযীযের শাসনামলে আরব ভূখন্ড পরিণত হয় এক ঐক্যবদ্ধ, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজ্যে। ওয়াহহাবী দাঈদের মাধ্যমে বেদুইনদের মাঝে ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রসার লাভ করে। ফলে কলহ প্রিয় ও সংঘাতে লিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব বেদুইন গোত্রসমূহ পারস্পরিক সংঘাত ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই-ভাইয়ে পরিণত হয়। অথচ স্বর্ণযুগের পর এ দৃশ্য ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। (James Wynbrant, Ibid, P. 127. ) সমাজ থেকে সকল অনৈতিক আচার-প্রথা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তুর্কীদের মধ্যে সিল্কের পোষাক পরা ও ধূমপানের যে বাজে অভ্যাস ছিল তা দূরীভূত করা হয়। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 283. ) নারীদের বেপর্দা চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিল। ছালাতের সময় বাজারে দায়িত্বশীলরা ‘ছালাত, ছালাত’ বলে মানুষকে মসজিদের দিকে আহবান করত এবং ছালাত তরককারীদের শাস্তি দিত। ফলে ছালাতের সময় কারো বাইরে ঘুরাফিরার সুযোগ ছিল না। (মাস‘ঊদ আলম নদভী, প্রাগুক্ত, ১১৭-১১৯ পৃঃ।) এভাবে একটি আইন-কানূন বিহীন বর্বর সমাজে ওয়াহ্হাবীরা নৈতিকতা ওন্যায়বিচারের যে অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল- তারউচ্ছ্বসিত প্রশংসাকরে বারখার্ট বলেন, The merit, therefore, of the Wahabys, in my opinion, is not that they purified the existing religion, but that they made the Arab strictly observe the positive precepts of one certain religion. অর্থাৎ আমার মতে, এটাই ওয়াহ্হাবীদের কৃতিত্ব নয় যে, তারা প্রচলিত ধর্মমতকে পরিশুদ্ধ করেছিল বরং আরবদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের সদর্থক নৈতিক শিক্ষাসমূহ কঠোরভাবে পালনে অভ্যস্ত করতে পারাই ছিল তাদের মূলকৃতিত্ব। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 285. )
 
(৪) বিচারব্যবস্থা :
নজদের বিচারব্যবস্থা ছিল পূর্ণাঙ্গভাবে কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফে ছালেহীনের নীতির উপর ভিত্তিশীল। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 296. ) রাজ্যে বিচারপতির পদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক নির্বাচিত হওয়ার জন্য আলেমে দ্বীন হওয়া এবং ইসলামী শরীআ‘তের উপর বিশেষ দক্ষতা অপরিহার্য ছিল। সাথে সাথে তার ন্যায়পরায়ণতার দিকটি ছিল সর্বাধিক বিবেচ্য। ইসলামী শরী‘আতের ফৌজদারী কার্যবিধি তথা হুদূদ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বিচারকগণ বিশেষ কোন মাযহাবের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন না; বরং সর্বাধিক অগ্রাধিকারযোগ্য মত অনুযায়ী ফয়ছালা করতেন। বিচার প্রক্রিয়ায় কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব ও শিথিলতার সুযোগ না থাকা এবং দ্রুততম সময়ে রায় কার্যকরের ফলে গোটা রাজ্যে সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্যবোধ সৃষ্টি হয়। ফলে পাপাচার ও হানাহানির প্রবণতা একেবারেই হ্রাস পেয়ে যায়। (আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়াহ আল-আলামিয়াহ; আমীন আর-রায়হানী, প্রাগুক্ত, ৬২ পৃঃ; John Lewis Burchhardt, Ibid, P. 286. ) স্বর্ণযুগের পর বেদুইন আরবের সামাজিক পরিমন্ডল আবারও সিক্ত হ’তে থাকে ন্যায়, ইনছাফ ও শান্তির অজস্র স্রোতধারায়। পর্যটক Burchhardt বলেন, For the first time after, perhaps, since the days of Muhammad, a single marchent might traverse the desert of Arabia with perfect safety, and the Bedouins slept without any apprehension that their cattle would be carried off by nocturnal depredators অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর যুগের পর সম্ভবত এই প্রথমবারের মত কোন ব্যবসায়ী মরুভূমির মাঝে একাকী পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে চলাচল করত, আর রাত্রিতে দস্যু দলের হাতে গৃহপালিত পশু-প্রাণী লুট হওয়ার কোন আশংকা ছাড়াই বেদুইনরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। (John Lewis Burchhardt, Ibid, P.297. )হানাহানির মাত্রা এতটাই কমে আসে যে তিনি লিখেছেন, আমি নিশ্চিত করে বলছি, ইবনে সঊদের ১১ বছরের শাসনামলে দিরঈইয়ায় মাত্র ৪/৫ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। (Ibid, P.298. ) ঐতিহাসিক ইবনে বিশর ইমাম আব্দুল আযীযের শাসনামলের শান্তি-শৃংখলার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, তাঁকে সত্যিই যুগের ‘মাহদী’ হিসাবে আখ্যা দেয়া যায়। কেননা তাঁর শাসনামলে একজন মানুষ মূল্যবান ধন-সম্পদসহ শীত-গ্রীষ্ম, ডান-বাম, পূর্ব-পশ্চিম যখন যেখানে খুশী নজদ, হেজায, ইয়ামান, আম্মান সর্বত্রই নির্বিঘ্নে সফর করত। এমতাবস্থায় সে কেবল আল্লাহ ছাড়া কোন চোর বা দস্যুর ভয় পেত না। (ইবনে বিশর, প্রাগুক্ত, ১/২৬৭ পৃঃ।)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top